২. স্প্যানিস হোটেলের বহির্বিভাগ

০২.

স্প্যানিস হোটেলের বহির্বিভাগের স্যুটের অর্থাৎ পেন্ট হাউস স্যুটের দ্বিতীয় বাথরুমে ঢুকল অনিতা সার্টেস। পেন্ট হাউস স্যুট হাউসের সবচেয়ে দামী আর আরামদায়ক স্যুট–অন্ততঃ যবে থেকে সিলাস ওয়ারেনটনের ছেলে উইলবার ওয়ারেনটন এই হোটেলে এসেছে। সিলাস ওয়ারেনটন টেক্সাসের কোটিপতি তেলখনির মালিক। উইলবার সম্প্রতি মারিয়া গোমে, নামক একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। মারিয়ার বাবা দক্ষিণ আমেরিকায় কয়েকটি রূপোর খনির মালিক। উইলবার প্যারাডাইস সিটির স্প্যানিস-বে হোটেলেই তার মধুচন্দ্রিমা যাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মারিয়া প্রায় বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছে।

এই ঊনত্রিশ বছর বয়সেও উইলবার তার বাবার তেল খনিতে যোগদান করেনি। সে হাভার্ডে পড়াশোনা করেছে। অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেছে। একবছর সেনাবাহিনীতে ছিল। তারপর বাবার ইয়ট নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে মারিয়ার দেখা পেয়েছে এবং বিয়ে করেছে। হানিমুন শেষহলে,তার বাবার তেলখনিতে দশজন ভাইস প্রেসিডেন্টের অন্যতমহয়ে যোগদানকরার কথা।

তার বাবা–সিলাস ওয়ারেন্টন পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে তার ছেলেকে বেশী ভালবাসেন। তাঁর স্ত্রী উইলবারের জন্মের কয়েক বছর পরেই মারা গেছেন। তিনি আর বিয়ে না করে উইলবারের উপরেই তার সমস্ত স্নেহ-ভালবাসা ঢেলে দিয়েছেন।

উইলবার যখন বাবাকে বলেছিল সে মারিয়াকে বিয়ে করতে চায় একলহমায় মারিয়ার দিকে তাকিয়ে তার ভুরু কুঁচকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছেলেকে তিনি এত ভালবাসেন, যে এ বিয়েতে তিনি না করতে পারেন নি। ডিভোর্স তো রয়েছেই। তিনি তার ছেলের পিঠ চাপড়িয়ে বলেছিলেন বেশ আমার কিন্তু নাতি চাই। আমাকে নিরাশ কোরনা।

মারিয়ার প্রথম থেকেই উইলবারের বাবার ওপর বিরূপ মনোভাব। তার মনে হয়েছিল এরকম অসভ্য বৃদ্ধ সে আর কখনো দেখেনি। আর বাচ্চা! দূর দূর, যতদিন পারা যায় জীবনে উপভোগ করে নিতে হবে। বাচ্চাকাচ্চা যত ঝামেলার ব্যাপার।

অনিতা সার্টেস্ হোটেলের অন্যান্য পরিচারিকাদের মধ্যে একজন।বছর খানেক হল সে এখানে কাজ করছে। বয়স বছর তেইশ। গায়ের রঙ কালো-মাথার চুলগুলো কুচকুচে কাল। জাতিতে কিউবান। তার কাজ হচ্ছে বাথরুম পরিষ্কার করা, ঘরদোর ঝাট দেওয়া–বিছানার চাদর পাল্টানো।

উইলবারের বাথরুম পরিষ্কার করার পর মারিয়ার বাথরুমে গিয়ে তার মেজাজ চড়ে গেল। বড়লোকদের বকে যাওয়া এইসব মেয়েগুলো কি নোংরা। মেঝেময় ভিজে তোয়ালে পড়ে আছে। কাজ করতে করতে তার স্বামী পেড্রোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। দুবছর তাদের বিয়ে হয়েছে। পেড্রোর পিড়াপিড়িতেই তারা হাভানা ছেড়ে ফ্লোরিডায় এসেছে। কিন্তু পেড্রো এখনও স্থায়ীচাকরী পায়নি। মাঝে মাঝে রাস্তায় ঝাড়ু দেয়। তাতে কটা পয়সাই বা হয়।

অনিতা পেড্রোকে পাগলের মতন ভালবাসে। তার কাছে পেড্রো জগতের সবচেয়ে সুন্দরতম পুরুষ। সে তার রোগা স্বামীর খিটখিটে মেজাজও মেনে নিয়েছে। নিজের উপার্জনের টাকা স্বামীকেই দিয়ে দেয়। প্যারাডাইস সিটির শেষ প্রান্তে শ্রমিক এলাকায় একটা ঘর নিয়ে তারা থাকে। পেড্রো কিউবায় তার বাবার সেই ছোট্ট আখের ক্ষেতে আবার ফিরে যাবার স্বপ্ন দেখে অথচ সেই সব ছেড়ে এখানে এসেছিল জোর করে।

কাজ করতে করতে অনিতা ভাবছিল, পেড্রো এখন কি করছে। সে কি কাজের খোঁজে বেড়িয়েছে। সপ্তাহের শেষে দেখা যায় পেড্রো তার উপার্জনের সব টাকাই উড়িয়ে দিয়েছে।

অনিতা যখন কাজ করছে, পেড্রো তখন সমুদ্রের ধারে একটা ঘিঞ্জি বারে বসে তার বন্ধু রবার্টেন ফুয়েনটেসের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে বিয়ার খেতে খেতে।

ফুয়েনটেসও কিউবান। এখানে সে তিনবছর রয়েছে। তার কাজ হচ্ছে ধনী লোকদের ইয়ট পরিস্কার করা। পেড্রোকে সে পছন্দ করে আর প্রতিদিনই পেড্রোর হা হুতাশ শোনে।কারণ, পেট্রো দেশে ফেরার জন্য টাকা জোগাড় করতে প্রায় ক্ষেপে গেছে। আর যে কোনঝুঁকি নেবে, এই পেড্রো। সুতরাং, কোন পরিকল্পনা করতে বাধা কোথায়?

নীচু স্বরে প্রায় ফিসফিস করে সে পেড্রোকে বলল, এক হাজার ডলার উপায় করতে কেমন লাগবে?

পেড্রো নেচে উঠল, আরে, তুমি কি বলছ। ঐ টাকাটা পেলে আমি বউকে নিয়ে বাবার কাছে ফিরে যেতে পারি।

বেশ শোন তাহলে, তোমার উপর নির্ভর করছে প্ল্যানটা।

কী রকম?

–কোরাল স্ট্রীটে আমি যে ফ্ল্যাট বাড়িটায় থাকি, তাতে সত্তরজন ভাড়াটে রয়েছে। প্রত্যেকে যাট ডলার করে ভাড়া দেয়। মোট দাঁড়ায় বিয়াল্লিশশ ডলার।

–তাতে কি হয়েছে?

–আরে শোনই না, তুমি আর আমি ঐ টাকাটা হাতিয়ে নিতে পারি। খুব সহজ পদ্ধতিতে।

পেড্রোর চোখ চকচক করে উঠল–এত সহজে এক হাজার ডলার উপার্জন করা ব্যাপারটা খুলে বল ভাই।

–ঐ ফ্ল্যাট বাড়িতেই থাকে এবে লেভী। সেঐ ফ্ল্যাটবাড়ির মালিকের কর্মচারী। তার কাজ হল ঘরে ঘরে গিয়ে প্রত্যেক শুক্রবার ভাড়া সংগ্রহ করা। আমি লক্ষ করেছি ভাড়াগুলো সংগ্রহ করে সে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে হিসাবপত্ৰকরে,তারপরে অফিসেগিয়ে টাকাজমা দিয়ে দেয়। লোকটা ভীতু, মোটা চেহারার আর বয়সও হয়েছে। টাকা গোনবার সময় ওর মুখের সামনে একটা পিস্তল ধরলেই বিয়াল্লিশশ ডলার আমাদের পকেটে আসবে। কি কাজটা খুবই সরল আর সোজা না?

পেড্রোর চোখ চকচক করে উঠল। ঠিক আছে, চল কালই গিয়ে ব্যাপারটা করি।

–বেশ। ফুয়েনটেস সাপের মতন কুটিল ভাবে হাসল। লেভীকে রিভলবার দেখানোর কাজটা তোমার। আমাকে সে চিনে ফেলবে। আমি বাইরেটা সামলাব আর তুমি ঘরের মধ্যে কাজটা করবে।

পেড্রো কেমন মিইয়ে গেল, মানে সমস্ত ঝুঁকিটাই আমার।

–আরে এতে ঝুঁকির কি আছে। রিভলবার দেখলেই লেভী স্রেফ অজ্ঞান হয়ে যাবে। আর তুমি সহজেই টাকাটা নিয়ে কেটে পড়বে।

এর জন্য আমার দুহাজার ডলার চাই।

আরে তুমি আমার বন্ধু লোক বলেই এই প্রস্তাবটা করেছিলাম। নইলে আমার লোকের অভাব। দুহাজারের প্রশ্নই ওঠে না।

–বেশ, দেড় হাজারঅয়তো আমি এর মধ্যে নেই।

বেশ বাবা, আমি রাজী।ফুয়েনটেস সামনের দিকে ঝুঁকে আস্তে করে বলল–এবার তাহলে কাজের কথাবার্তা শেষ করে নিই।

.

অনিতা কাজ শেষ করে ঘরে এসে দেখল, পেড্রো বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখে তৃপ্তির হাসি। খুব আরামে সিগারেট খাচ্ছে। পেড্রোর মুখের দিকে তাকিয়ে অনিতা তার সমস্ত ক্লান্তি ভুলে গেল। খুব আনন্দে চেঁচিয়ে বলল-পেড্রো তুমি কাজ পেয়েছ না? তোমার মুখই বলছে।

শনিবার আমরা হাভানায় ফিরে যাচ্ছি। ফেরবার ভাড়া ছাড়া বাবাকে সাহায্য করবার আমার কাছে যথেষ্ট টাকা থাকবে।

অনিতা অবাক হয়ে বলল–তা কি করে সম্ভব? বালিশের তলা থেকে ফুয়েনটেসের দেওয়া রিভলবারটা বার করে পেড্রো বলল, এটা দিয়ে সম্ভব।

অনিতার প্রায় মাথা ঘুরে গেল। আজকাল তার মনে হয় পেড্রো খুব ভয়ানক হয়ে উঠেছে।

–শোন, তুমি এসব কিছু করতে যেও না।

 বালিশের নীচে পিস্তলটা রেখে দিয়ে পেড্রো বলল–বেশ তুমি এখানে থাক। আমি শনিবার হাভানায় ফিরে যাবই। পনেরশ ডলার আমি পাচ্ছি।

শোন, এই কাজে বিপদ রয়েছে।

কোন বিপদ নেই। শনিবার আমি ফিরে যাচ্ছি। পেড্রোর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

.

ডিটেকটিভ ফাস্ট গ্রেড টম লেপস্কি শুক্রবারটাকে খুব পছন্দ করে। কোন ঝামেলা না হলে সেসপ্তাহের শেষের দিনগুলো বাড়ি ফিরে যায়। যদিও বাড়িতে তার স্ত্রী ক্যারল কাজ, করকাজ কর বলে তাকে পাগল করে তোলে। কিন্তু হোটেলে কখন চুরি হবে এই প্রতীক্ষায় থাকার থেকে বাড়ি যাওয়া অনেক ভাল।

আজ রাতে ডিউটি অফ হবার আগে সে জি স্ট্রিং ক্লাবে একটা ঘটনার তদন্ত করার জন্য হাজির হয়েছিল।

জি স্ট্রিং ক্লাবের বিপরীতে একটা সরু গলিতে শ্রমিকদের থাকার একটা এ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।

এবে লেভী শুক্রবারটাকে ঘৃণা করে। ভাড়া আদায় করার কাজ অকে ক্রমশঃ নিঃশেষ করে ফেলছে। সবসময়েই কোন না কোন ভাড়াটে ভাড়া দিতে না পারার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করে আর লেভীকে তার কাজের খাতিরে কঠোর হতেই হয়। যা তার স্বভাববিরুদ্ধ। এ্যাপার্টমেন্টের মালিকদের কড়া হুকুম, ভাড়া না দিতে পারলে তাকে ছাড়বার নোটিশ ধরিয়ে দিতে হবে এবং ভাড়াটেদের সঙ্গে সে সদ্ভাব রাখতে চাইলেও রাখতে পারে না।

আজ শুক্রবার শেষ ভাড়াটের কাছ থেকে ভাড়া তুলতে তুলতে রাত আটটা বেজে গেল। নীচে তার দু-কামরার ঘরে রাতের রান্না করার জন্য সে চঞ্চল হয়ে উঠল।

এবে লেভীর জীবনটা খুব সুখের নয়। অল্প বয়সে সে তার বাবাকে ফল বিক্রীর কাজে সাহায্য করত। বিয়ে করেছিল কাপড়ের কলে কাজ করা একটা মেয়েকে। বাবা মা মারা যাবার পর সে ফলের ব্যবসাটা ছেড়ে দিয়েছিল। তার এক বন্ধু এই ভাড়া আদায় করার কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিল। বছর দুই আগে তার বউ মারা গিয়েছে, তাদের কোন সন্তানও নেই। নিঃসঙ্গ রাতগুলিতে এবে টেলিভিশন দেখে সময় কাটায়। সপ্তাহে একদিন ইহুদিদের ক্লাবে যায়।

এলিভেটরের কাছে এসে এবের বৌয়ের কথা মনে পড়ল। সেসবসময় তার জন্য গরম খাবার তৈরী করে রাখত। আর এখন তাকে রান্না করে খেতে হবে।

টাকা পয়সা ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে এলিভেটর থেকে বেরিয়ে এল এবে। তারপর অন্ধকার সরু প্যাসেজটা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতে গিয়ে সে দেখল আলো জ্বলছে না। নিশ্চয়ই ফিউজ হয়ে গেছে।

এবে এমনিতে সতর্ক লোক। জরুরী অবস্থার জন্য সে সবসময়েই প্রস্তুত থাকে। বসবার ঘরে টেবিলের ওপর একটা শক্তিশালী টর্চ সে রেখে দেয়। অন্ধকার হাতড়ে যেই সে সেটা নিতে গেল, এমন সময় তার কাঁধের ওপর কেউ প্রচণ্ড আঘাত করল। টলমল করতে করতে এবে সামনের চেয়ারটায় প্রচণ্ড ধাক্কা খেল-তারপর সবকিছু সঙ্গে নিয়ে সে মেঝের ওপর হাত পা ছড়িয়ে পড়ে গেল। কিন্তু টাকার ব্যাগটা সে কিন্তু কখনও ছাড়েনি।

পেড্রো দুরু দুরু বক্ষে দাঁড়িয়েছিল। অবশ্য সে ভয় পায়নি। কারণ ফুয়েনটেস তাকে বলেছে এবে ভীতু প্রকৃতির লোক, বন্দুক দেখলেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। পিস্তল ছাড়া সে একটা টর্চ লাইটও এনেছে। টর্চ পেড্রো জ্বালিয়ে ধরল যাতে এবেতার হাতের পিস্তলটা দেখতে পারে। এবেকে। উঠে বসতে দেখে সে কড়া স্বরে বলল, টাকার ব্যাগটা আমার দিকে ছুঁড়ে দাও।

এবে দীর্ঘদিন ধরে ভাড়ার টাকা সংগ্রহ করছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে সে আগে কখনও পড়েনি। একজন পুলিশ তাকে বলেছিল, সবকিছুরই একটা প্রথম আছে। তোমার মালিকরা চায় তুমি একটা পিস্তল রাখ। এই নাও তোমার পারমিট আর এই তোমার বন্দুক। কেমন করে চালাতে হয়, তাও দেখিয়ে দিচ্ছি।

কিন্তু সত্যিই যে বন্দুকের প্রয়োজনহবে সেকথা কখনও ভাবেনি এবে। ভেবে দেখল, ডাকাতটি যদি তার টাকার ব্যাগ নিয়ে পালায়, তাহলে তার চাকরী চলে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার থাকার জায়গাটুকুও চলে যাবে। এবের তাই পিস্তলটার কথা মনে পড়ল।

তাড়াতাড়ি কর–পেড্রো গর্জন করে উঠল। এবে টাকার ব্যাগটা ছুঁড়ে দিল।

পেড্রোর চোখ চকচক করে উঠল। এত সহজে টাকাটা পাওয়া গেল। খুনোখুনিও করতে হল না। উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে পেড্রো টাকার ব্যাগটার দিকে ঝুকল।

এবের হাত ততক্ষণে তার জ্যাকেটটার ভেতর ঢুকে পিস্তলটার বাঁট চেপে ধরেছে বুড়োআঙুল দিয়ে। এবে সেটিক্যাপও খুলে ফেলেছে। পেড্রো ব্যাগটা তুলতে যাবে, এবে পিস্তলটা বার করে ট্রিগার টিপল। পেড্রো অনুভব করল তার গালে ভীষণ গরম একটা কিছু ঢুকে গেল। আতঙ্কিত হয়ে সে তার পিস্তলের ট্রিগার টিপল। টর্চের আলোয় পেড্রো দেখল এবের কপাল রক্তে ভিজে গেল–এবের সারা শরীর খিঁচিয়ে উঠল, তারপরই মেঝের ওপর এলিয়ে পড়ল।

পেড্রো হতবাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার হাতে খুন হয়ে গেছে। হিমশীতল একটা স্রোত তার মেরুদণ্ড দিয়ে নামতে থাকল। ধরা পড়লে বাকি জীবন তাকে জেলের মধ্যে থাকতে হবে–সেখানে থাকবে অনিতানা থাকবেতার বাবা,না থাকবে আখের ক্ষেতের উজ্জ্বল রোদ্দুর।

অনেক লোকের গলার আওয়াজ তার কানে এল। কেউ ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। একজন মহিলা আর্তনাদ করে উঠল।

ফুয়েনটেস কোথায়–ফুয়েনটেসের কাছে তাকে যেতে হবে। এক হাতে ব্যাগ অন্য হাতে পিস্তুলটা ধরে সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।তার গাল বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছেঅনুভবকরল পেড্রো।

ফুয়েনটেস গুলির শব্দ শুনেই বুঝে গেছিল ব্যাপারটা কেঁচে গেছে। দোতালার ভাড়াটেদের দরজা একে একে খুলে যাচ্ছিল। দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস খুনটা তার হাতে হয়নি। ফুয়েনটেস ছুটে গিয়ে ভাড়াটেদের সাথে মিশে গেল। সে দেখতে পেল পেড্রো গালে রক্তঝরা অবস্থায় তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ফুয়েনটেস তাড়াতাড়ি ভীড়ের পেছনে চলে গেল।

পেড্রো ভীত চকিত লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল। তার হাতে ধরা রয়েছে পিস্তল। সে ব্যাগটা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

.

লেপস্কি ক্লাবের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। গুলির শব্দে তার পুলিশসত্তা তৎপর হয়ে উঠল। সে তীরবেগে ক্লাবের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল। ইতিমধ্যেই বাড়ির সামনে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিল। ঠিক ঐ সময় পিস্তল হাতে পেড্রো রাস্তায় বেরিয়ে এল। তাকে দেখে লোকেরা এদিক ওদিক সরে গেল, মেয়েরা আর্তনাদ করতে লাগল।

লেপস্কি দৌড়োন অবস্থায় পেট্রোকে দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ওর পিছু নিল। পেড্রো ভয়ার্ত চোখে পেছন ফিরে লেপস্কিকে দেখেই পিস্তল চালিয়ে দিল। গুলিটা গিয়ে লাগল ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়া এক কৃষ্ণকায় মহিলার মাথায়।

লেপস্কি চিৎকার করে উঠল–দাঁড়াও, নয়তো গুলি খেয়ে মরবে। পেড্রো পাশের একটা গলিতে ঢুকে পালাবার চেষ্টা করল। সেই মুহূর্তে লেপস্কির পিস্তল গর্জে উঠল। তীব্র আঘাতে মুখ থুবড়িয়ে পড়ে গেল পেড্রো, তার হাত থেকে টাকার ব্যাগ আর পিস্তলটা ছিটকে পড়ল। অসহ্য যন্ত্রণায় সে ছটফট করতে থাকল।

ফুয়েনটেসছুটে তার ঘরে ঢুকে পড়ল। ঘরের জানালা দিয়ে সেসবই দেখল। হঠাৎ তার খেয়াল হল পিস্তলটা তাঁর। পেড্রো মরলে তাঁর কিছু যায় আসে না। কিন্তু পিস্তলটা যেতর, পুলিশ ধরে ফেলবে। ফুয়েনটেস ঘামতে লাগল। ইতিমধ্যে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি চলে এল। আতংকিত ফুয়েনটেস ভাবল পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হওয়ার আগেই তাকে পালাতে হবে। সে চটপট কয়েকটা জামাকাপড় একটা ভাঙা স্যুটকেসে ভরে ফেলল। কোথায় যাবে সে? হঠাৎ তার মনে পড়ল বন্ধু ম্যানুয়েল টেরেসের কথা। ফুয়েনটেস আর টেরেস হাভানার কাছেই–এক গ্রামের বাসিন্দা। একসঙ্গে স্কুলে যেত, আখের ক্ষেতে কাজ করেছে। টেরেস সমুদ্র তীরে থাকে। টেরেসের উপর সে ভরসা করতে পারে।

.

হত্যাকাণ্ডের দুঘণ্টা পরে হোমিসাইড স্কোয়াডের সার্জেন্ট হেস পুলিশচীফ টেরেলের অফিসে এসে ঢুকল।

ছিনতাইয়ের ঘটনা বলে মনে হচ্ছে, স্যার। দুজনে মারা গেছে। ভয় পেয়েই বোধহয় গুলি চালিয়েছে। হত্যাকারীকে এখনও সনাক্ত করা যায়নি। আমরা আশেপাশে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিন্তু কেউ মুখ খুলছেনা। লোকটা একজন কিউবান। কিউবানদের মধ্যে খুব একতা আছে। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

–আহত হত্যাকারীটির কি খবর?

–বেঁচে যেতে পারে। গুলি ফুসফুসে লেগেছে। হসপিটালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছে। ল্যারি ওখানে রয়েছে।

–পিস্তলটা কার–জানতে পেরেছ?

শীঘ্রই জেনে যাব।

এই সময় সার্জেন্ট বেইগলার এসে ঘরে ঢুকল। পিস্তলটার পরিচয় জানা গেছে। ওটা একজন কিউবানের। নাম রবার্টেন ফুয়েনটেস। এবে লেভীর একই বাড়িতে থাকে। ম্যাক্স কয়েক জনকে নিয়ে গেছে ওকে ধরে আনার জন্য।

হয় ফুয়েনটে পিস্তলটা বিক্রি করছিল,নয়তত সেও এই ব্যাপারে জড়িত, টেরেল বললেন।

এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। বেইগলার ফোনটা ধরে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলল। তারপর রিসিভার নামিয়ে টেরেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ফুয়েনটেস জামাকাপড় নিয়ে সরে পড়েছে। কেউ জানেনা সে কোথায় গেছে।

ওকে আমাদের চাই-ই। টেরেল বললেন–ওকে খুঁজে বার কর।

বেইগলার এইসব কাজ পছন্দ করে। সে বলল, ঠিক আছে স্যার, ওকে আমি খুঁজে বার করবই।

রাত দুটোর পর অনিতা সমুদ্র তীরে টেরেসের মাছ ধরা নৌকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। কয়েকজন পাহারাদার ছাড়া সমুদ্রতীর নির্জন।

জেলে নৌকাটার কাছে গিয়ে অনিতা থামল। সে নিশ্চিত ফুয়েনটেসকে ওখানেই পাওয়া যাবে।

রাত্রে সে রেডিওতে খবরটা জেনেছে। সকালে সে যখন কাজে বেরুচ্ছিল পেড্রো তাকে বলেছিল, জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও। আজ রাতেই আমরা বেরিয়ে পড়ব।

অনিতা স্বামীকে বলল, আমি জানি এরকমটি হবে না। তবে তুমি আমার ওপর নির্ভর করতে পার।

অনিতা সারাদিন পিস্তলটার কথা ভাবছিল। ফুয়েনটেস পেড্রোকে রিভলবারটা দিয়েছে। অনিতা পেড্রোকে এতই ভালবাসে, ভাবছিল সত্যিই বোধহয় কাজটায় কোন ঝুঁকি নেই। সে দুটো স্যুটকেশে সামান্য জামাকাপড় ভরে নিল। তবু তার ভয় ভয় করছিল।

পেড্রোর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে রেডিওটা খুলে দিয়েছিল। একে একে সবই জানতে পারলো-এবে লেভীর মৃত্যুকৃষ্ণাঙ্গীমহিলা গুলিতে মৃত্যু-পেড্রোর আহত হওয়া শুনে সে পাথর হয়ে গেল।

রেডিও তখনও বলছিল, পুলিশ ফুয়েনটেসকে খুঁজছে। সেই লোকটিকে দেখতে পেলে সঙ্গে সঙ্গে যেন পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। আখের ক্ষেতে রোদে পরিশ্রম করে আর হোটেলে কাজ করে অনিতা ইস্পাতের মতন তৈরী হয়ে গিয়েছিল। সে শোক সামলে ভাবতে বসল–তার হোটেলের চাকরী যাবে। পুলিশ তার খোঁজ করবে। যা করবার তাকে তাড়াতাড়ি করতে হবে।

ফুয়েনটেস নিশ্চয়ই পুলিশের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। ফুয়েনটেসের মুখে সে টেরেসের অনেক গল্প শুনেছে। পুলিশ-জাহাজঘাটায় টেরেসের একটা মাছ ধরার বোট নোঙর করা থাকে। টেরেসের সম্পর্কে সে অনেক শুনেছে। এ অঞ্চলে কিউবানরা তাকে ধর্মপিতার মতন সম্মান করে। কারোর কোন বিপদ হলে সে টেরেসের কাছে যায়। যখন সে মাছ ধরে না, ট্যুরিস্টদের জন্য নানান জিনিসপত্র বিক্রি করে। ব্যবসা তার ভালই চলে।

ফুয়েনটেস নিশ্চয়ই টেরেসের কাছেই আশ্রয় নিয়েছে।

পেড্রোকে বাঁচাতেই হবে। পেড্রো জেলে গেলে অনিতা বাঁচবে কি করে। কিন্তু টেরেস বা ফুয়েনটেসটাকা পয়সা না পেলে কোন সাহায্যই করবেনা। অনেক ভেবে অনিতা একটা পরিকল্পনা খাড়া করল।

ম্যানুয়েল টেরেসের বোটের কাছে গিয়ে অনিতা জানালায় একটা ছোট পাথর ছুঁড়ল।

কে-বলে ম্যানুয়েল বেরিয়ে এল। আমি অনিতা সারটেস–অনিতা নীচু স্বরে বলল।