সারা উঠোনে ডালবাটা ছত্রখান হয়েছিল। এখানে সেখানে ডালবাটায় কাকের পায়ের ছাপ। এতক্ষণ সারা উঠোনে হুটোপাটা করে কাকটা পেঁপে গাছে বসে ঠোঁট দিয়ে তার গা পরিষ্কার করছিল।
বামাসুন্দরী হাতজোড় করে কাকটাকে প্রণাম করে বললেন, “যাই, ঠাকুলুঝি আজ আবার কী কাণ্ড বাধালে দেখে আসি। আছাড় খেতে পারেও বটে মানুষটা, আমাদের এত বয়স হল, এখনও তো অত আছাড় খেতে পারি না।”
সতীশ ভরদ্বাজ গম্ভীরভাবে বারান্দার চেয়ারে বসে পুজোর চালকলার পেতলের রেকাবিখানা টেবিলের ওপর রেখে খবরের কাগজটা পড়ছিলেন। তারপর শব্দ করে খবরের কাগজ পড়তে লাগলেন, “জিনিসপত্রের দাম ক্রমশই বৃদ্ধি পাইতেছে। এইরূপ বৃদ্ধি পাইলে গরিব মনুষ্যেরা কী করিয়া প্রাণধারণ করিবে, কাহার কাছে হাত পাতিবে? হ্যাঁ, ঠিকই তো, ইয়ার্কি পেয়েছ নাকি? ইহারা কী করিয়া ইয়ে করিবে?”
ঠাকুরমশাই একটু অন্যরকম করে কাগজ পড়েন। বেশ বসে জোরে জোরে খবর পড়ছেন, পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে তার ভিতরেই নানারকম মন্তব্য করতে থাকেন। শুনলে মনে হয় যেন ওসব কথাও কাগজে ছাপা আছে।
যেমন তিনি এখন পড়ছেন, “কালিচরণ সাধুকে পুলিশ দায়রায় সোপর্দ করিয়াছে। সে নাকি পঞ্চবর্ষীয়া এক বালিকার কান হইতে দুল ছিনাইয়া লইয়া…ইস, ছিঃ ছিঃ-বালিকাটির কান কাটিয়া প্রবল রক্তপাত হইতে থাকে…চামারটাকে জুতোপেটা করতে হয়।…দুই দলের খেলায় কেহই গোল করিতে পারে নাই–তা পারবে কেন, অপদার্থ সব। সিমলায় প্রচণ্ড তুষারপাত…উঃ ঊঃ ইঃ ইঃ, বরফ বড় ঠাণ্ডা রে বাপ! মুরগিহাটায় জোড়া খুন…ছুরিকাঘাতে..বাবারে, ছুরি যখন কচ্ করে শরীরে ঢোকে তখন না জানি কেমন লাগে!”
ঠিক এসময়ে ঝপাত করে কাকটা নেমে এল বারান্দার রেলিঙে। বসে ডাকল, কা?
ঠাকুরমশাই কাগজটা নামিয়ে ডবল পাওয়ারের চশমার ওপরের অংশটা দিয়ে কাকটাকে দেখে বললেন, “কা তব কাস্তা কন্তে পুত্রঃ? তোমার স্ত্রীই বা কোথায় ছেলেপুলেই বা কোথায়? পশুপাখির আত্মীয়স্বজন থাকে না। বড় হতভাগ্য হে তোমরা।” বলে খবরের কাগজটা ফের তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন “বর্ধমানে বড় কাকের উৎপাত বাড়িয়াছে। এই কাকগুলি কিছু অন্যরকম। সাধারণ কাক নয়। গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকিয়া ইহারা দিনে ডাকাতি করিতেছে…”
কাকটা ডাকল, ক্কঃ।
ঠাকুরমশাই ফের কাকটার দিকে চেয়ে বললেন, “কং? কে। তুমি? কোত্থেকে আসছ? বর্ধমান নয় তো? তোমার ভাব সাব ভাল ঠেকছে না হে! গচ্ছ, গচ্ছ।”
কাকটা একটু কাসির শব্দ করে বলল, “ক্যায়াও?”
“ঝোলালে। ক্যায়াওটা আবার কী?”
কাকটা এক লাফে টেবিলের ওপর চলে এল। তারপর চোখের সামনে, হাতের নাগালে বসে টাউ-টাউ করে চালকলা খেতে লাগল।
ঠাকুরশাই তেড়ে গিয়ে বললেন, “হুঁশ।”
কাকটাও চাল ঠুকরে দিতে এসে বলল, কবয়ঃ।”
সতীশ ভরদ্বাজ পিছিয়ে এলেন।
“কবয়ঃ?” ঠাকুরমশাই বললেন, “এ তো বিশুদ্ধ সংস্কৃত!”
“কয়।” কাকটা বলল।
ঠাকুরশাইয়ের হাত থেকে কাগজটা খসে পড়ে গেল। হঠাৎ তিনি বুঝতে পারলেন, এতক্ষণে ধরে যা হচ্ছে তা খুব সাধারণ ঘটনা নয়। বামাসুন্দরীকে ভয় খাওয়ানোর জন্য যা বানিয়ে বলেছিলেন তাই বুঝি সত্যি হল! তিনি হঠাৎ হাউ মাউ করে দৌড়ে গিয়ে উঠোনের ওপাশে বৈজ্ঞানিক হারাধনের ল্যাবরেটরিতে ঢুকে টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। সেখানে একটা উপুড় করা গামলার মতো কী-এক যন্ত্র, সেটা ছোঁয়ামাত্র ঠাকুরমশাইয়ের গা কাঁটা দিয়ে উঠল, মাথার চুল এমন কী টিকিটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল। শরীরে একটা শিরশির ভাব।
টেবিলের ওপাশ থেকে হারাধন গম্ভীরভাবে বলল, “সাকসেসফুল।”
“কী বাবা, কী সাকসেসফুল?”
“স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি। এতক্ষণ এটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলাম।”
মনোজের মেজকাকা ভজহরি বাজার করার ব্যাপারে খুব পাকা লোক। সবাই বলে, ভজবাবুর মতো বাজাড় দুনিয়ায় দুটো নেই। বাজারের যত ব্যাপারী আর দোকানদার বাজাড় ভজহরিকে দেখলেই ভয় খায়। যে তে-এঁটে সবজিওলা সকাল থেকে ফুলকপির দর দেড় টাকার এক পয়সা নীচে নামায়নি, সে পর্যন্ত বাজাড় ভজবাবুকে দেখলে নাভাস হয়ে নিজে থেকেই ‘পাঁচসিকে’ বলে ফেলে। যে-সব দোকানদার গোলমেলে দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারা দিয়ে ওজন করে, তারা ভজবাজাড়র গন্ধ পেলেই সব সরিয়ে ফেলে ভালমানুষ সাজে। অবশ্য ভজবাবু কখনও দোকানদারের দাঁড়িপাল্লা বা বাটখারায় মেপে জিনিস কেনেন না, তাঁর সঙ্গে সবসময়ে নিজস্ব দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারা থাকে। রান্নার ঠাকুর গুফো মিশির আর চাকর রঘু সেসব বাজারে বয়ে নিয়ে যায়।
ভজবাবুর বাজার করার কায়দা একটু অন্যরকম। সে কায়দাটা এমনই অদ্ভুত যে অন্য খদ্দেররা নিজেদের বাজার করা বন্ধ রেখে ভজবাজাড়র বাজার করা হাঁ করে দেখে।
যেমন আজ টমেটোওলা ভজবাবুকে দেখে খুব বিনয়ী হাসি হেসে এক গালের পান অন্য গালে নিয়ে আড়াই টাকার টমেটোর দাম ন সিকে চেয়ে বলল, “আপনি বলেই চার আনা ছেড়ে দিলাম।”
ভজবাবু নির্নিমেষলোচনে টমেটোওলার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইলেন। পাড়ার থিয়েটারে কেপুবাবু সিরাজদ্দৌলা সেজে মহম্মদী বেগ-এর হাতে ছোরা খেয়ে যেমনভাবে চেয়েছিলেন (সে-দৃশ্যে যে হাততালি পড়েছিল তা দু মাইল দূর থেকে শোনা যায়) ঠিক তেমনি চোখের দৃষ্টি ভজবাবুর। সেই চোখ দেখে টমেটোওলার রক্ত জল হয়ে যেতে লাগল। মিনমিন করে সে আরও দু আনা ছেড়ে বলল, “ঠিক আছে ভজবাবু, না হয় দু আনা কম দেবেন।”
ভজবাবু সে কথার উত্তর দিলেন না। তাঁর থমথমে মুখচোখ ক্রমে লাল হয়ে উঠেছিল। চোখ দুটো স্থির, নাকের পাটা কাঁপছে। এক পাশে বেগুন দর করতে করতে, অন্য পাশে পালং শাক থলিতে ভরতে ভরতে দুজন-চারজন করে লোক এগিয়ে এসে আশেপাশে দাঁড়িয়ে গেল। ভজবাবুর পার্ট দেখবে।
ভজবাবুর ঠোঁট কেঁপে উঠল, ফিসফিস করে প্রথমে বললেন, “মহাপাপ।”
কথা শোনার জন্য দু-চারজন কান এগিয়ে আনল। ভজবাবু এবার আর-একটু জোরে বলে উঠলেন, “মহাপাপ!” সেই গম্ভীর ধ্বনি শুনে টমেটোওলার মুখ শুকিয়ে গেল।
পরক্ষণেই ভজবাবু হঠাৎ দু হাত লাফিয়ে উঠে বিকট হুংকার ছাড়লেন, “মহাপাপ! মহাপাপ! মহাপাপ!”
যারা কান এগিয়ে এনেছিল, তারা এই বিকট শব্দে কান চেপে ধরে পাঁচ হাত করে পিছিয়ে গেল।
ভজবাবু লাফাচ্ছেন আর হুংকার দিচ্ছেন, “মহাপাপ! পৃথিবী রসাতলে যাবে।”
তারপর টমেটোওলার দিকে আঙুল তুলে চেঁচাতে লাগলেন, “তুইও রসাতলে যাবি। এখনও সময় আছে, বল ঠিক করে।”
টমেটোওলা নিথর হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর হঠাৎ চোখে মুছে ধরা গলায় বলল, “সাত সিকে। দিন বাবু, আপনার দাঁড়িপাল্লা দিন।”
ভজবাবু সব জায়গায় এক কায়দা খাটান না। তা হলে আর বাজাড় হিসেবে তাঁর অত নাম-ডাক কিসের?
টমেটোওলাকে কাঁদিয়ে তিনি পালং শাক বেচতে-আসা একটা ছোট মেয়ের ঝুড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মেয়েটার বয়স দশ বছর হবে। পান-খাওয়া রাঙা ঠোঁট চেপে খুব গম্ভীরমুখে নাকে নোলক দুলিয়ে বসে ছিল।
ভজবাবু তার সামনে উবু হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে ভারী মোলায়েম হেসে ছড়া কাটার মতো সুর করে বলতে লাগলেন, “ও খুকি, তুমি পান খেয়েস? বাঃ বাঃ, পান খেয়েস! নাকে নোলক মুখে পান, জয় জয় বলল জয় ভগবান।”
মেয়েটা ভয় পেয়ে খুব সন্দেহের চোখে ভজবাবুকে দেখতে থাকে।
ভজবাবু মাথা নেড়ে নেড়ে বলেন, “খুকি নোলক পরেসে, খুকি পান খেয়েসে। খুকি নোক পরেসে, খুকি পান খেয়েসে। পালং শাক কত করে গো খুকি?”
মেয়েটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “টাকা টাকা।”
ভজবাবু মুখখানা ভার করে বললেন, “পান খাওয়ার কথায় রাগ করলে খুকুমোনা? এমাঃ, রাগ করলে! পালং কখনও এক টাকা হয়?”
মেয়েটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “বাবা বলে গেছে, এক টাকার কমে কাউকে বেচবি না।”
ভজবাবুর দুচোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। হাপুস চোখে কেঁদে ভজবাবু বললেন, “ও খুকি, তুই আমার ওপর
রাগ করলি শেষে। পান খাওয়ার কথা বললাম বলে রাগ করলি?”
কান্নাকাটি দেখে ছোট মেয়েটা ঘাবড়ে গিয়ে দিশেহারার মতো বলে ফেলে, তা আমি কী করব? বাবা বলে গেল যে।”
ভজবাবু চোখ মুছে ধরা-গলায় বলেন, “তুই বুঝি বাপের সব কথা শুনিস খুকি? চুরি করে তেঁতুল খাস না? নতুন জামার জন্য বায়না করিস না? কাজের সময়ে পালিয়ে খেলতে যাস না?”
মেয়েটা ফিরিক করে হেসে বলল, “আচ্ছা, বারো আনা করে দাও।”
মেছোবাজারের কানাই মাছওলা বড় ভয়ংকর লোক। সবাই জানে, কানাই দিনে মাছ বেচে, রাতে ডাকাতি করে। গুলিপাকানো বিশাল চেহারা তার, চোখ দুখানা সবসময়ে গাঁজাখোরের মতো লাল, খদ্দেরদের সঙ্গে ধমকধামক দিয়ে কথা বলে। আধমন একমন ওজনের বড় বড় মাছ হেলাফেলায় তুলে ভচাং ভচাং করে কেটে ফেলে লহমায়। বুকের পাটা না থাকলে কেউ কানাইয়ের সঙ্গে দরাদরি করতে যায় না।
কানাইয়ের দোকানে আজ মস্ত মস্ত কইমাছ। দূর থেকে ভজবাজাড়কে দেখেই কানাই তড়িঘড়ি কইমাছগুলোকে গামছা-চাপা দিয়ে রাখল। পনেরো টাকা দর দিয়ে রেখেছে, ভজবাবু দেখলেই দশ টাকায় নামিয়ে ফেলবে। তার চেয়ে চেপে রাখা ভাল।
কিন্তু কইমাছ চাপা কি সোজা! তারা লাফায়, হাঁটে, ছোটে। গামছায় চাপা কইমাছেরা গামছাটা ছেঁড়ার জোগাড় করে তুলল।
ভজবাবু এসে গম্ভীরমুখে বললেন, “গামছাটা কত দিয়ে কিনেছিলি?”
কানাই মাথা চুলকে বলে, “কত আর! তিন টাকা বোধ হয়।”
ভজবাবু তেমনি গম্ভীর মুখে বলেন, “মাছের দামের সঙ্গে গামছার দামটা যোগ করে বল কইমাছের দর কত।”
কানাই মুখখানা কাঁচুমাচু করে বলল, “ও মাছ বিক্রি হয়ে গেছে, তাই ঢেকে রেখেছি।”
“কে কিনেছে?” কানাই অন্যদিকে চেয়ে বলল, “দারোগাবাবু।”
এ সব চালাকি ভজবাবু জানেন, তাই একটুও না ঘাবড়ে বললেন, “আমি তো থানার কাছ দিয়েই যাব। মাছগুলো দিয়ে দে বরং, পৌঁছে দিয়ে যাবোখন। দারোগাবাবু আবার নিশিকান্তপুরের ডাকাতির ব্যাপারে আমার পরামর্শ চেয়েছিলেন।”
কানাইয়ের মুখের চেহারা পালটে যায়। পনেরো টাকার মাছ সে তখন বারো টাকায় ছাড়তে রাজি। নিশিকান্তপুরের ডাকাতিটা নিয়ে হইচই করছে পুলিশ।
ওর মুখের চেহারা দেখে ভজবাবু বুঝতে পারলেন যে, কানাইকে এবার বাগে পাওয়া গেছে। জজ যখন আসামীর ফাঁসির হুকুম দেয়, তখন যেমন গম্ভীর করুণ মুখের ভাব করে, ঠিক তেমনি মুখ করে ভজবাবু কানাইয়ের দিকে চেয়ে আছেন। তা দেখে কানাইয়ের বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয়ে-ভয়ে বলে, “দারোগাবাবু বোধহয় মাছের কথা ভুলেই গেছেন। আপনি যখন বলছেন–”
ভজবাবু ইঙ্গিতে রঘু দাঁড়িপাল্লা আর খুঁফো মিশির বাটখারা বের করে ফেলেছে। ঠিক এসময়ে একটা বাধা পড়ল।
হয়েছে কী, গোয়েন্দা বরদাচরণ আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাগ্নে চাকুও বাজারে এসেছে। সবাই জানে, ভজবাবু বাজারে এলে সব জিনিস সস্তা হয়ে যায়। তাই ভজবাবুর পিছু পিছু বাজার করার জন্যে অনেকেই তক্কে তক্কে থাকে। যেই ভজবাবু আড়াই টাকার
মাল সাত সিকেতে কিনে নেন অমনি অন্য বাজাড়রা সেই দোকানিকে হেঁকে ধরে সব মাল সাত সিকে দিয়ে চিলু-চি করে কিনে নেয়। বরদাচরণও সেই দলের।
বরদাচরণ কইমাছ বড় ভালবাসেন। এবছর এখন পর্যন্ত কইমাছ খাওয়ার ভাগ্য তাঁর হয়নি। আজই প্রথম কানাই-মাছওলা কইমাছ নিয়ে বসেছে। অথচ বরদাবাবুর কিছু করারও নেই, কারণ বাজাড় ভজহরি মাছগুলিকে প্রায় গ্রেফতার করে ফেলেছেন।
তাই গোয়েন্দা বরদাচরণের মুখটা খুবই বিষণ্ণ হয়ে গেল।
ভাগ্নে চাকু ব্যাপারটা লক্ষ করে খানিক ভেবে নিয়ে মামার কানে কানে কী যেন একটু বুদ্ধি দিল। তখন মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল বরদাচরণের।
তিনি কাঁচুমাচু মুখ করে ভজবাবুর কাছে গিয়ে খুব কুণ্ঠিত গলায় বললেন, “ভজহরিবাবু, একটু কথা ছিল।”
বাজার করার সময়ে ভজবাবু তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলতে ভালবাসেন না। ওস্তাদ কালোয়াত যেমন গানের সময়ে কেবল তবলচি বা তানপুরোওলা ছাড়া জগতের আর সব ভুলে যায়, ভজবাবুও বাজার করার সময়ে দোকানদার ছাড়া আর কাউকে মনে রাখতে চান না। বাজার করাটাও একটা আর্ট, আর আর্টের সময়ে কে ভ্যাজাল পছন্দ করে?
বিরক্ত ভজবাবু বলেন, “কথার আর সময় ছিল না? কইমাছগুলো, তুলছি, ঠিক এই সময়েই যত কথা!”
বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাগ করবেন না ভজবাবু। আপনার বাড়িতে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।”
“অ্যাকসিডেন্ট!” ভজবাবুর হাত থেকে একটা মাছ লাফিয়ে পালিয়ে গেল। সেটাকে সাঁ করে ধরে ট্যাঁকে খুঁজে ফেলল কানাই। যা বাঁচানো যায়।
বরদাচরণ বিষণ্ণমুখে বললেন, “খুব খারাপ ধরনের অ্যাকসিডেন্ট। বাজারে আসবার পথে আপনার বাড়ির পাশ দিয়ে যখন আসছি তখন শুনি, ভিতরবাড়িতে তুমুল চেঁচামেচি হচ্ছে। বহু লোক ভিড় করেছে। আপনি একটু তাড়াতাড়ি চলে যান।”
ভজবাবু আর কইমাছের দিকে ফিরেও চাইলেন না। সর্বনাশ বলে চেঁচিয়ে উঠে বাড়িমুখো ছুটতে লাগলেন।
.
ভজবাবু বাড়ির কাছাকাছি যখন এসে পড়েছেন তখন শুতিধর ঘোষ আর ফচকে-ফটিকের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। শ্রুতিবাবু একগাল হেসে ভজবাবুকে বললেন, “পড়ে গেছেন।”
হন্তদন্ত ভজবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “মরে যায়নি তো?”
শুতিবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, “না বোধহয়।”
তখন ভজবাবুর মাথায় আর-একটা প্রশ্ন এল, উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, “কে পড়েছে বলুন তো।”
“পিসিমা।”
খুব হতাশ হয়ে ভজবাবু বললেন, “ওঃ! তাই বলুন।”
শুতিবাবু খুব হেসেটেসে বললেন, “গণেশবাবু গরুর দড়ি চুরি করেছিলেন ফাঁসি যাওয়ার জন্য। ধরা পড়ে খুব নাকাল হচ্ছেন রাখোবাবুর কাছে। রাখোবাবু বলেছেন, এবার থেকে যেন গণেশবাবু ফাঁসি যাওয়ার জন্য নিয়মিত বাজার থেকে নতুন দড়ি আনিয়ে নেন।”
ভজবাবু বললেন, “আর কিছু হয়েছে?”
শুতিবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, “হয়েছে। কিন্তু কী যেন! ফটিক, কী যেন..ইলেকট্রিক দিয়ে কী যেন হল…!”
ফটিক বলল, “পুরুতমশাই শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ।” শুতিবাবু লাফিয়ে উঠে বললেন, “আর, দুঃখবাবুকে মনোজ ঠাকুরঝির ইংরিজি জিজ্ঞেস করেছিল, দুঃখবাবু পারেননি।”
“আর কিছু?”
“আরও চান?” শুতিবাবু ভারী অবাক হয়ে বলেন।
ফটিক বলে, “আরও একটা আছে।”
“কী যেন?” শুতিবাবু বলেন।
“সেই যে কাকটার কথা।” ফটিক মনে করিয়ে দিল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা কাক।”
ভজবাবু আর দাঁড়ান না, দৌড়ে বাড়ির দিকে এগোতে থাকেন।
এদিকে ততক্ষণে ঠাকুরঝিকে গোবর থেকে তুলে স্নান করানো হয়েছে। সতীশ ভরদ্বাজ জ্ঞান হয়ে উঠে বসে গরম দুধ খাচ্ছেন। দুঃখবাবু তাঁর ঘরে বসে ডিকশনারি খুলে প্রাণপণ খুঁজে ‘ঠাকুরঝি শব্দের ইংরিজি খুঁজে পাচ্ছেন না। সরোজ একবার সিস্টার-ইন-ল বলায় ভারী রেগে গিয়েছিলেন তার ওপর। গণেশবাবু নিজের ঘরে শুয়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছেন। রামু চশমা-চোখে হারিকেনকে খুঁজতে বেরিয়েছিল, খুব ঠাহর করে দেখে সে মাঠ থেকে হরশঙ্কর গয়লার একটা মোষকে ধরে এনে চুপিসাড়ে গোয়ালে বেঁধে রেখে এখন কদমগাছের তলায় বসে কাঁচা মুলো দিয়ে মুড়ি খাচ্ছে। রাখোবাবুর অফিস যাওয়ার সময় হয়েছে, কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করে দেখেন, স্নানের আগে যখন গেঞ্জি ছেড়েছেন তখন সেই গেঞ্জির সঙ্গে গলার পৈতে খুলে গেছে। কিরমিরিয়া গেঞ্জি কেচে শুকোতে দেওয়ার সময়ে বাজে সুতো ভেবে সেটা কোথায় গুটলি পাকিয়ে ফেলে দিয়েছিল, বজ্জাত সেই কাকটা পৈতে মুখে নিয়ে পেঁপে গাছে গিয়ে বসে ছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, পৈতেটা কাকের গলায় ঝুলছে। তাই দেখে মনোজের ঠাকুমা রেকাবিতে নৈবেদ্য সাজিয়ে পেঁপেতলায় রেখে প্রণাম করছেন। গলায় পৈতে না থাকায় রাখোবাবু কথা বলতে পারছেন না, কিন্তু বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে মুখ নেড়ে ভয়ংকর রাগারাগি করছেন, আর হাত-পা ছুড়ছেন। মুখের নানারকম ভঙ্গিতে কখনও ‘গাধা’ কখনও ‘গরু’, কখনও ‘বোকা’ শব্দগুলি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি।
বাবা কখন কী বলছে তাই নিয়ে মনোজ, সরোজ আর পুতুল উঠোনের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাজি ধরছে। যেমন, একবার রাখোবাবু মুখটা অ্যা-এর মতো করে আবার উ-এর মতো করায়
সরোজ বলল, “এখন বাবা ঘেউ করল।”
পুতুল বলে, “দূর! ও তো কুকুরের ডাক। বাবা বলল, ধ্যাততেরি।”
“মোটেই না।” মনোজ বলে, “বাবা ওভাবে ঢেকুর তোলে।”
রাখোবাবু আ করে একটা ই করলেন।
মনোজ বলল, “পাজি।”
পুতুল বলে, “উঁহু। হায় এ কী বলল বাবা।”
সরোজ বলল, “না। বাবা আমাদের বাড়ি থেকে বেরোতে বলছে।”
ব্যায়ামবীর এবং বৈজ্ঞানিক হারধন ভূতে বিশ্বাস করে না। বাড়িতে নানারকম চেঁচামেচি শুনে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে এসে সব ব্যাপারটা ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করছিল। কিরমিরিয়া গিয়ে তার পা ধরে কাঁদতে বসল, “ও হারাদাদাবাবু গো, বাড়িতে এ-সব কী হল গো? একটা কাকভূত এসে বড়দাদাবাবুর পৈতে নিয়ে গেল গো। বড়দাদাবাবু কথা বলতে পারবে গো?”
হারাধন কাকটার দিকে চেয়ে বলল, “কাকভূত! কাকভূত! কথাটা কেমন চেনা-চেনা ঠেকছে! অনেকটা চাগম কিংবা লামড়োর মতো!”
এখন হয়েছে কী, হারাধন শুধু ব্যায়ামবীর নয়। সে ব্যায়াম জানে, কুস্তি, বকসিং, জুডো, কারাটে জানে। আবার বৈজ্ঞানিক হিসাবেও রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, বলবিদ্যা এবং উদ্ভিদবিদ্যা ইত্যাদি সব কাজের কাজী। তার গবেষণাগারের পিছনে উদ্ভিদবিদ্যার নানারকম পরীক্ষা চালানোর একটা আলাদা বাগান আছে। সেখানে অনেকগুলো কিম্ভুত গাছ রয়েছে। তার মধ্যে একটা আছে চাগম গাছ, আর একটা লামড়ো। অর্ধেক ধান আর অর্ধেক গমের বীজকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে জুড়ে দিয়ে একটা সংকর বীজ তৈরি করে সে তার নাম দিয়েছে চাগম। অর্ধেক লাউবিচির সঙ্গে অর্ধেক কুমড়োবিচি জুড়ে হয়েছে লামড়ো গাছের বীজ। চাগম আর লামড়ো দুটো বীজ থেকেই গাছ বেরিয়েছে বটে, তবে তাতে এখনও কোনও ফসল ধরেনি। চাগম বা লামড়ো কেমন হয় তা জানবার জন্য শহরসুন্ধু লোক অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
হারাধনের পা ধরে কিরমিরিয়া বিলাপ করছে, “বাড়িতে কাকভূত থাকলে আমি মরে যাব গো। ও হারাদাদাবাবু, আমি মরে গেলে তোমার চাগম দিয়ে লামড়োর ঘণ্টা কে চেখে দেখবে গো?
হারাধন গম্ভীরভাবে কিরমিরিয়ার হাত থেকে পা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের বাগানের দিকে চলে যেতে যেতে বলল, “ওটা কাকভূত নয় রে কিরমিরিয়া। ওটা হয় কাক, না হয় তো ভূত।”
সতীশ ভরদ্বাজ একটা সুস্থ হয়ে বসে রাখোবাবুর জন্য নতুন পৈতে গ্রন্থি দিচ্ছিলেন। শেষ গ্রন্থিটা দিতে দিতে গম্ভীর গলায় বললেন, “ভূত।”
রাখোবাবু সতীশ ভরদ্বাজের হাত থেকে পৈতেটা কেড়ে নিয়ে ৩৮
গলায় পরেই বললেন, “কাক।”
সতীশ ভরদ্বাজ মাথা নেড়ে বললেন, “ভূত। ওকে আমি বিশুদ্ধ সংস্কৃত বলতে শুনেছি নিজের কানে।”
রাখোবাবু বললেন, “কাক। নোংরা, বজ্জাত, পাজি, ছুঁচো একটা কাক। নিজের চোখে দেখেছি।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ভুল দেখেছেন।”
রাখোবাবু বললেন, “ভুল শুনেছেন।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “না।”
রাখোবাবু বললেন, “আমারও ওই এক কথা। না।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ওটা যে ভূত নয় তা প্রমাণ করতে পারেন?”
“করছি।” বলে রাখোবাবু পেল্লায় চেঁচিয়ে ডাকলেন, “মনোজ।”
মনোজ গুটিগুটি এগিয়ে বলল, “কী?”
“তোর গুলতিটা নিয়ে আয় তো। কয়েকটা বেশ ভারী দেখে পাথরও আনিস। কাকটার উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত।”
মনোজ দৌড়ে তার গুলতি আর কয়েকটা পাথর নিয়ে এল। রাখোবাবু বড়সড় একটা পাথর গুলতিকে ভরে টিপ করতে লাগলেন। মনোজের ঠাকুমা যে নৈবেদ্য রেখে গেছেন কাকটা উঠোনে নেমে এসে তা খাচ্ছিল। মনোজ, সোজ আর পুতুল বাবার হাতের টিপ দেখবে বলে দম বন্ধ করে আছে।
সরোজ বলল, “বাবা ঠিক লাগাবে।”
মনোজ বলল, “পারবে না।”
পুতুল বলল, “তিন বারে পারবে।”
ঠিক এই সময়ে পেঁপে গাছের পিছনের দেয়াল টপকে একটা টুপিওলা মুখ উঁকি মারল।
সরোজ মনোজ একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, “চাক্কুদা!”
রাখোবাবু কাকটাকে টিপ করতে করতে বিরক্ত হয়ে বললেন, “কাজের সময়ে বড় বিরক্ত করিস তোরা। আর এ কাকটাও অসম্ভব বজ্জাত। কিছুতেই এক জায়গায় স্থির হয়ে বসছে না।”
চাকু খুব ভাল ফুটবল ক্রিকেট খেলে, জুড়ো জানে, বকসিং করে। ব্যায়াম আর প্যাঁচ শিখতে সে রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যায়ামবীর হারাধনের কাছে আসে। তাকে যে লুকিয়ে আসতে হয় তার কারণ চাকুর মামা গোয়েন্দা বরদাচরণের সঙ্গে মনোজের কাকা হারাধনের একেবারেই সদ্ভাব নেই। হারাধন আর বরদাচরণ কেউ কাউকে দেখতে পারেন না।
হারাধনের নাম শুনলে বরদাচরণ বলেন, “বৈজ্ঞানিক? হুঁ!”
আশ্চর্য এই, বরদাচরণের নাম শুনলে হারাধনও অবিকল একই সুরে বলেন, “গোয়েন্দা! হুঁঃ!”
বরদাচরণও কুস্তি, বকসিং, জুডো ইত্যাদি নাকি ভালই জানেন। তবে এসব ব্যাপারে বরদা আর হারার মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ, তার কোনও মীমাংসা হয়নি।
চাকু দেয়ালের ওপর মুখ তুলে বাড়ির ভিতরটা ভাল করে দেখে নিয়ে মুখে আঙুল পুরে দুটো অদ্ভুত শিস দিল। শিসের শব্দ হতে-না-হতেই দেয়ালের ওপর বরদাচরণের মুখখানা ভেসে উঠল এবার। তিনিও বাড়ির ভিতরটা দেখতে লাগলেন।
সরোজ মনোজ ফের চেঁচাল, “গোয়েন্দাকাকু!”
রাখোবাবু মনোজ ফের চেঁচাল, “গোয়েন্দাকাকু!”
রাখোবাবু চাকু বা বরদাচরণকে লক্ষই করেননি। তিনি অতি নিবিষ্ট মনে গুলতির তাকের মধ্যে কাকটাকে আনবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু নচ্ছার কাকটা কিছুতেই স্থির থাকছে না, কেবল লাফিয়ে-লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। সরোজ-মনোজের চেঁচামেচি শুনে বিরক্ত রাখোবাবু বললেন, “আঃ, একটু চুপ করবি তোরা? কনসেনট্রেশন নষ্ট করে দিলে লোকে কী করে জরুরি কাজ করবে? যতক্ষণ কাকটার গায়ে না লাগছে ততক্ষণ আমি অফিস যাব না বলে মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছি।”
কাকমারা ভুলে গিয়ে সরোজ মনোজ পুতুল তখন হাঁ করে দেখছে, গোয়েন্দা বরদাচরণ আর চাকু দেয়ালের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে।
দুজনের দেয়াল টপকানো দেখে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাধারণত গোয়েন্দা বরদাচরণ কখনও সদরদরজা দিয়ে ঢোকেন না। তাতে নাকি গোয়েন্দার বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়, লোকে গোয়েন্দা বলে খাতির করে না। গোয়েন্দাদের আচার-আচরণে একটা রহস্যময়তা না থাকলে লোকে সেই গোয়েন্দাকে মানবেই বা কেন? গোয়েন্দারা কখনও সহজ পথে চলবেন না, সহজ পথে ভাববেন না, সহজ চোখে চাইবেন না। সব সময়ে এমন আচরণ করবেন যাতে লোকে চমকে, আঁতকে, ভয় খেয়ে বা ভিরমি খেয়ে যায়। তাই গোয়েন্দা বরদাচরণ বেশির ভাগ বাড়িতেই দেয়াল টপকে, জানালার শিক বেঁকিয়ে ঢোকেন। শোনা যায়, এক বাড়িতে নাকি সিঁধ কেটেও ঢুকেছিলেন।
তবে চেনাজানা লোকের বাড়ি না-হলে তিনি এতটা করেন না।
যাই হোক, বরদাচরণ দেয়ালের ওপর উঠে গলা থেকে ঝোলানো একটা বাইনোকুলার তুলে চোখে লাগিয়ে চারদিক দেখছিলেন। তাঁর সেই দেখা আবার দেখছিল সরোজ, মনোজ পুতুল, সতীশ ভরদ্বাজ। আর ঠিক সেই সময়ে স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাকুরঝি ভেজা পায়ে আর একবার পড়ি-পড়ি করেও সামলে গিয়ে দাঁড়িয়ে চাকু আর বরদাচরণকে দেখতে পেলেন।
রাখোবাবু কাকটার ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বললেন, “কেউ কি নেই যে কাকটাকে এক জায়গায় একটু ধরে রাখবে স্থির করে?”
কাকটার খাওয়া হয়ে গেছে। এবার সে একটা উড়াল দিয়ে ফের পেঁপে গাছটায় বসল। রাখোবাবু বললেন, “এই বার। এইবার!”
বলতে বলতে পেঁপে গাছের দিকে কাকটাকে টিপ করতে গিয়ে তিনি দেয়ালের ওপর মামা-ভাগ্নের মূর্তি দেখে চমকে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বললেন, “কে রে? অ্যাাঁ? কার এই সাহস যে দেয়ালে উঠেছিস?”
তাক করা গুলতি দেখে, আর সেই গর্জন শুনে তৎক্ষণাৎ চাকু পচাং করে দেয়ালের ওপিঠে লাফিয়ে পড়ল। বরদাচরণ তা পারলেন না। চাকু ছেলেমানুষ, সে হালকা শরীরে যত লাফঝাঁপ করতে পারে, বরদাচরণ তা পারেন না। এ বয়সে লাফ-টাফ দিলে হাত-পা ভাঙতে পারে। তবে তিনি বাইনোকুলারটা ফেলে দুটো হাত ওপর দিকে তুলে বলে উঠলেন, “সারেন্ডার! গুলতি ছুড়বেন না। আমি বরদাচরণ।”
“ও বরদাবাবু।” বলে রাখোবাবু গুলতি নামিয়ে নিলেন। বললেন, “কী খবর?”
“খবর খুব সাঙ্ঘাতিক, আমি একটা তদন্তে এসেছি।”
“তদন্ত! কিসের তদন্ত মশাই?”
“বলছি।” বলে বরদাচরণ দেয়াল থেকে নামবার উপায় খুঁজতে থাকেন। দেয়ালটা মস্ত উঁচু, চাকু লাফ দিলেও বরদাচরণ তা করতে ভরসা পান না। তাই খুব সাবধানে দেওয়ালের ওপর দিয়ে হেঁটে পেঁপে গাছটার কাছবরাবর যেতে থাকেন। ইচ্ছে, পেঁপে গাছ বেয়ে নেমে আসবেন।
সতীশ ভরদ্বাজ বলে ওঠেন, “উঁহু, উঁহু, বড় নরম গাছ ভেঙে যাবে। গাছে আবার কাকভূতও বসে আছে।”
“রাখোবাবু বললেন, “ভূত নয়। কাক।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “ভূত।”
“কাক।”
“ভূত।”
“কাক।”
“ভূত।” কিন্তু মীমাংসা হল না বলে দুজনেই দুজনের দিকে খানিক কটমট করে চেয়ে রইলেন।
ওদিকে, বরদাচরণ কাকটার কথা জানতেন না, পেঁপে গাছের সহনশীলতা সম্পর্কেও তাঁর জ্ঞান নেই। যেই পেঁপে গাছের ডগাটা ধরতে গেছেন অমনি ভুতুড়ে কাকটা বলে উঠল, “খাওরখার।“
“উঁ।” সতীশ ভরদ্বাজ বলেন, “শুনলেন তো! পরিষ্কার বলল–খবরদার।”
রাখোবাবু বলেন, “ওটা কাকের ডাক।”
বরদাচরণ কাকটাকে বললেন, “হুঁশ! হশ?”
কাক বলল, “ক্যা?”
বরদা বললেন, “চোপরাও কেলেভূত। পালা! যাঃ, যাঃ!”
কাক বলল, “কটর, কটর।”
সতীশ ভরদ্বাজ বললেন, “শুনুন। বলছে, কেটে পড়, কেটে পড়।”
বরদাচরণ তখন ট্যাঁক থেকে রিভলবার বার করে ফেলেছেন। কাকটাকে শাসিয়ে বললেন, “দেব খুলি উড়িয়ে? যাঃ বলছি!”
কাকটা হুড়শ করে উঠে বরদাচরণের মাথায় একটা রাম-ঠোক্কর মারল। বরদাচরণ পেঁপে গাছের ডগাসুষ্ঠু ভেঙে নিয়ে হড়াস করে উঠোনে পড়লেন। সেই শব্দে বাড়িময় দৌড়োদৌড়ি চেঁচামেচি পড়ে গেল।
বামাসুন্দরী এসে বরদাচরণকে হাত ধরে তুলে বললেন, “কেন বাবা বরদা, সামনে সদর-দরজা থাকতেও দেয়াল টপকাতে গেলে?”
বরদাচরণ নিজের কোমর হাত দিয়ে মালিশ করতে করতে ব্যথার মধ্যেও বললেন, “তাতে কী মাসিমা, গোয়েন্দাদের কত রিস্ক নিতে হয়! এ তো দেয়াল থেকে পড়া দেখলেন, সিমলায় একবার পাহাড় থেকে পড়তে হয়েছিল। চলন্ত ট্রেন বা মোটর থেকেও কতবার লাফ দিয়েছি। গোয়েন্দাদের ব্যথা লাগে না।”
কাকটা আবার দেয়ালে বসেছে, গলায় পৈতে। বামাসুন্দরী তাকে আর-একবার নমস্কার করে ঘরে চলে গেলেন। রাখোবাবুও গুলতিটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, “না, এ কাকটা খুবই ডেঞ্জারাস দেখছি! গুলতি মারলে হয়তো আবার রিভেঞ্জ নিতে তেড়ে আসবে।”
“তবে?” বলে সতীশ ভরদ্বাজ খুব সবজান্তা হাসি হাসলেন। বললেন, “সাক্ষাৎ ব্রাহ্মণভূত।”
বরদাচরণের পিস্তলটা ছিটকে পড়েছিল জবা গাছের গোড়ায়। সরোজ সেটাকে কুড়িয়ে সুট করে মনোজের হাতে চালান দিল। মনোজ জামার তলায় লুকিয়ে নিয়ে পুতুলের হাতে পাচার করল। পুতুল সেটা নিয়ে নিজের পুতুলের বাক্সে ন্যাকড়া চাপা দিয়ে লুকিয়ে রেখে ভালমানুষের মতো মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
বরদাচরণের অবশ্য পিস্তলটার কথা খেয়াল হল না। পড়ে গিয়ে তাঁর ঘিলু নড়ে গেছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। নিতান্ত গোয়েন্দাদের অজ্ঞান হতে নেই বলে তিনি অজ্ঞান হননি। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে তিনি বারান্দায় রাখোবাবুর মুখোমুখি বসে বললেন, “ব্যাপারটা খুবই জরুরি এবং গোপনীয়। আমি একটা পুরনো ফোটোগ্রাফের সন্ধানে আপনার বাসায় এসেছি। একটা ছোট ছেলের ফোটোগ্রাফ।”