২. সন্ধে রাত্তিরে পরাণ চাট্টি

সন্ধে রাত্তিরে পরাণ চাট্টি পান্তা নিয়ে বসেছে। পান্তা খেয়ে সে একটু গড়িয়ে নেবে। তারপর চটের থলিটি নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। ওই থলিটিতে নানারকম ছোটখাটো যন্ত্রপাতি আছে।

দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। রোজগারপাতি নেই বললেই হয়। এই গরমটা পড়াতেই কাজ ভণ্ডুল হচ্ছে বড়। যত গরম পড়ে ততই লোকে হাঁসফাঁস করে, রাতে ঘুমোত চায় না, ঘুমোলেও তেমন গভীর ঘুম হয় না। আর গেরস্ত না ঘুমোলে পরাণেরও কাজ হতে চায় না। যতদিন বর্ষা বাদলা না নামছে ততদিন টানাটানি যাবেই। বর্ষা বাদল হলে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হবে। বৃষ্টির শব্দ আর ব্যাঙের ডাকে মানুষ টেনে ঘুমোবে, আর তখনই পরাণের বরাত খুলবে।

তার বউ গোমড়ামুখো নয়নতারা পান্তা ভাতের থালাটা পরাণের সুমুখে নামিয়ে দিয়ে একটু আগেই বলছিল, ‘চাল কিন্তু তলানিতে ঠেকেছে। কাল একবেলারও খোরাকি হয় কি না কে জানে। বলে রাখলুম, ব্যবস্থা দেখো।”

পরাণের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। নয়নতারা কটমট করে কথা কয় বটে, কিন্তু অন্যায্য কথা কয় না। কাজকর্মে সে তত পাকাঁপোক্ত নয়, একথা সে নিজেও জানে। নইলে এই গ্রীষ্মেকালে বদন মণ্ডল, পাঁচু গড়াই, গেনু হালদারের তো রোজগার বন্ধ হয়নি। বদন তো পরশুদিনই রায়বাড়ির গিন্নিমার সীতাহার হাতিয়ে এনে সেই আনন্দে আস্ত বোয়াল মাছ কিনে ফেলল। পাঁচু গড়াই বিষ্টু সাহার দোকান থেকে ক্যাশ বাক্স ভেঙে সাতশো একান্ন টাকা পেয়ে একজোড়া জুতো কিনেছে। গেনু হালদার দিন দুই আগে এক রাতে দু-দুটো বাড়িতে হানা দিয়ে এক পাঁজা রুপোর রেকাবি আর দুটো আংটি হাতিয়ে এনেছে। আর পরাণ একটা পেতলের ঘটিও রোজগার করতে পারেনি। গতকাল অনেক কসরত করে কষ্টেসৃষ্টে সতু ঘোষের বাড়িতে ঘরের জানালার শিক বেঁকিয়ে ঢুকেছিল বটে। শেষ অবধি দুটো কাঁচের ফুলদানি ছাড়া আর কিছুই জোটেনি। ফুলদানির তো আর বাজার নেই। বউ সে দুটো ছুঁড়ে ফেলতে গিয়েছিল। শেষ অবধি তাকে তুলে রেখেছে।

বুকটা দমে গেছে পরাণের। খোরাকির পয়সাটাও না জুটলে তো বউয়ের কাছে মুখই দেখানো যাবে না।

অধোবদনেই পান্তা খাচ্ছিল পরাণ। গলা দিয়ে যেন হড়হড়ে পান্তাও আজ নামতে চাইছে না।

হঠাৎ দরজায় একটা খুটখুট শব্দ হল। শব্দটা মোটেই ভাল মনে হল না পরাণের। কেমন যেন গা ছমছমে শব্দ।

সে চট করে ঘটির জলে হাতটা ধুয়ে ফেলে চাপা গলায় নয়নতারাকে বলল, “আমি মাচানের তলায় লুকোচ্ছি। জিজ্ঞাসাবাদ না করে দরজাটা খুলো না।” বাঁশের মাচানটার ওপর তাদের কাঁথাকানির বিছানা, মাচানের তলায় রাজ্যে হাঁড়িকুড়ি। পরাণ গিয়ে হামা দিয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। পুলিশ এলেও তার তেমন দুশ্চিন্তার কারণ নেই। গত কয়েকদিন এ বাড়িতে চোরাই জিনিস আসেনি বললেই হয়। ওই দুটো কাঁচের ফুলদানি ছাড়া। কাঁচের ফুলদানি ফঙ্গবেনে জিনিস, তার জন্য কি আর পুলিশ গা ঘামাবে?

নয়নতারা টেমি হাতে নিয়ে উঠে গিয়ে দরজার ভিতর থেকেই সতর্ক গলায় বলল, “কে? কী চাই?”

বাইরে থেকে একটা ঘড়ঘড়ে গলা বলল, “ভয় নেই মা, আমি বুড়ো মানুষ। দরজাটা খোলো।”

দরজা এমনিতেই পলকা, বেড়ালের লাথিতেও ভেঙে যাবে। তার ওপর হুড়কো ভাঙা বলে নারকোলের দড়ি দিয়ে কোনওক্রমে বাঁধা।

নয়নতারা তাই সাতপাঁচ ভেবে দরজাটা খুলেই দিল।

বাইরে দাড়িগোঁফওয়ালা একটা নোক দাঁড়ানো। তার মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গায়ে ঢলঢলে একটা রংচটা জামা, পরনে লুঙ্গি, পিঠে একটা বস্তা ঝুলছে।

টেমিটা তুলে ধরে লোকটার মুখটা ভাল করে দেখে নিয়ে নয়নতারা ঝাঁঝের গলায় বলল, “কী চাই?”

লোকটা জুলজুল করে চেয়ে থেকে বলল, “এটাই কি পরাণ দাসের বাড়ি?”

নয়নতারা বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু সে এখন বাড়িতে নেই।”

“শুনেছি সে একজন গুণী মানুষ, তাই দেখা করতে আসা।”

নয়নতারা ঠোঁট উলটে “গুণী না হাতি! যার দু’বেলা দু’মুঠো চালের জোগাড় নেই তেমন গুণীর গলায় দড়ি।”।

লোকটা এ কথায় যেন ভারী খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “কথাটা বড্ড ঠিক। তবে কিনা এই পোড়া দেশে গুণের আদরই বা কই? তা সে গেল কোথায়?”

“তা কি আমাকে বলে গেছে? এ-সময়ে সে কাজে বেরোয়।”

লোকটা ভারী অবাক হয়ে বলে, “এ-সময়ে তার কী কাজ! সন্ধেবেলায় তো তার কাজে বেরোনোর কথা নয়! কাজ তো নিশুত রাতে।”

নয়নতারা সপাটে বলল, “সে সব আমি জানি না, মোট কথা সে বাড়িতে নেই।”

লোকটা গোঁফ দাড়ির ফাঁকে ভারী অমায়িক একটু হেসে বলল, “তা বললে হবে কেন মা, আমি যে টেমির আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, পান্তাভাত পাতে পড়ে আছে এখনও।”

নয়নতারা নির্বিকার মুখে বলল, “ও তো আমি খাচ্ছিলাম।”

“মাচানের তলা থেকে কার যেন শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজও পাচ্ছি যে। আমার কানটা যে বড় সজাগ। হাঁড়িকুড়ির ফাঁক দিয়ে দু’খানা জুলজুলে চোখও দেখা যাচ্ছে!”

পরাণ আর থাকতে না পেরে হামা দিয়ে বেরিয়ে এল। গা-টা একটু ঝেড়েঝুড়ে লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “কী মতলব হে তোমার?”

লোকটা মিষ্টি করেই বলল, “বলি দরজার বাইরে থেকেই বিদেয় করতে চাও নাকি? বাড়িতে অতিথি এলে একটু বসতেটসতেও কি দিতে নেই?”

পরাণ একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “তা ভিতরে এলেই হয়।” নয়নতারা দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। লোকটা ঘরে ঢুকে চারদিক চেয়ে একবার দেখে নিয়ে বলল, “সতু ঘোষের বাড়ি থেকে ফুলদানি দুটো সরালে বুঝি!”

পরাণ অবাক হয়ে বলে, “তুমি জানলে কী করে হে?”

“কয়েকদিন আগে আমিই সতু ঘোষের বউয়ের কাছে দশ টাকায় ও দুটো বেচে গেছি কিনা।”

নয়নতারা নথ নাড়া দিয়ে বলল, “গুণী লোকের মুরোদটা দেখলেন তো! অন্যেরা কত সোনাদানা চেঁছেছে নিয়ে আসছে, কত চোরের বউ সোনার চুড়ি বালা বেনারসি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ইনি মদ্দ সারারাত গলদঘর্ম হয়ে এনেছেন দুটো কাঁচের ফুলদানি! ম্যা গো, ঘেন্নায় মরে যাই।”

লোকটা দাঁড়ি গোঁফের ফাঁকে ঝিলিক তুলে হেসে বলল, “একটা মাদুর টাদুর হবে? তা হলে একটু বসি। অনেক দূর থেকে আসা কিনা, মাজাটা টনটন করছে।”

নয়নতারা একটা ঘেঁড়াখোঁড়া মাদুর পেতে দিল। তারপর ঝংকার দিয়ে বলল, “আর কী লাগবে শুনি!

লোকটা মাদুরে বসে একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, “তা লাগে তো অনেক কিছু। প্রথমে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল, তারপর একটু চা-বিস্কুট হলে হয়, রাত্তিরে দুটো ডালভাত। কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা দেখছি তাতে ভরসা হচ্ছে না। তা বাপু পরাণ, তোমার সময়টা কি খারাপ যাচ্ছে।”

পরাণ মাদুরের আর এক দিকটায় বসে বলল, “তা যাচ্ছে একটু। তবে চিরকাল তো এরকমধারা যাবে না।”

নয়নতারা ফোঁস করে উঠে বলল, “চিরকাল তো ওই কথাই শুনে আসছি। দিন নাকি ফিরবে। তা দিন আর কবে ফিরবে, চিতেয় উঠলে?”

লোকটা তার কামিজের পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে নয়নতারার দিকে চেয়ে বলল, “ঝগড়া কাজিয়ায় কাজ নেই মা, তুমি বরং ওই সামনের মুদির দোকান থেকে যা যা লাগবে কিনে আনো৷”

নয়নতারা লজ্জা পেয়ে বলে “না, না আপনি টাকা দেবেন কেন?”

“আহা, আমি তোমার বাপের মতোই। তা ছাড়া, এই পরাণ দাসকে তুমি যত অপদার্থ ভাবো তত নয়। ওর বরাতটাই খারাপ। নইলে ও সত্যিই গুণী লোক। এ টাকাটা গুণী মানুষের নজরানা বলেই ভাবো না কেন?”

নয়নতারা নোটটা নিয়ে পরাণের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “গুণীর যা ছিরি দেখলুম তাতে পিত্তি জ্বলে গেল বাবা। এই তো গতকালই খগেন চোরের বউ অতসী এসে তার নতুন গোমেদের আংটি দেখিয়ে কত কথা বলে গেল। বলল, ও মা! পরাণদার মতো লাইনের নামকরা লোকের বউ হয়ে এখনও তুই টিনের ঘরে থাকিস, আমার তো দোতলা উঠে গেল। আরও ঠেস দিয়ে কী বলল জানেন? বলল, তোর দেখছি গায়ে সোনাদানা নেই। ঘরে তেমন বাসনপত্র নেই, কাজের ঝি নেই! কেন রে, পরাণদার কি হাতে-পায়ে বাতে ধরেছে নাকি?”

বুড়ো লোকটা খুব মন দিয়ে সব শুনে মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ মা, পরাণের দিনকাল খারাপই যাচ্ছে বটে। তবে আমি যখন এসে পড়েছি তখন আর চিন্তা নেই। তুমি একটু রান্নাবান্নার জোগাড় করো তো দেখি। আমি আবার খিদেটা তেমন সইতে পারি না।”

“এই যে যাচ্ছি বাবা।” বলে নয়নতারা চলে গেল।

পরাণ জুলজুল করে চেয়ে ঘটনাটা দেখে নিল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি কে বট হে? মতলবখানা কী? বলি পুলিশের চর নও তো!”

বুড়ো হো হো করে হেসে উঠে বলল, “ওহে পরাণচন্দর, পুলিশেরও ঘেন্নাপিত্তি আছে। তারা ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করতে যাবে কেন বলো তো! এখন অবধি এমন একটা লাগসই কাজ করতে পারোনি যাতে পুলিশের নজরে পড়তে পারো। তোমাকে তারা চোর বলে পাত্তাই দেয় না। বলি চুরি বিদ্যেরও তো বি এ, এম এ আছে, নাকি? তা তুমি তো দেখছি এখনও প্রাইমারিটাই ডিঙোতে পারোনি।”

ভারী লজ্জা পেয়ে পরাণ অধোবদন হয়ে বলল, “তা কী করা যাবে বলো! আমি কাজে হাত দিলেই কেমন যেন ভণ্ডুল হয়ে যায়। তা তুমি লোকটি কে? কোথা থেকে আগমন? উদ্দেশ্য কী? বলি ছদ্মবেশে ভগবানটগবান নও তো!”

লোকটা ফের অট্টহাসি হেসে বলল, “পঞ্চাশ টাকা ফেললেই যদি ভগবান হওয়া যায় তা হলে তো কথাই ছিল না হে। ওসব নয়। বাপু হে, শ্রীনিবাস চূড়ামণির নাম শুনেছ কখনও?”।

পরাণ তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, “তা আর শুনিনি! নমস্য মানুষ। প্রাতঃস্মরণীয়। লোকে বলে শ্রীনিবাস চূড়ামণির শরীর নাকি রক্তমাংস দিয়ে তৈরিই নয়, বাতাস দিয়ে তৈরি। এতকাল ধরে কত বড় বড় সব চুরি করলেন কেউ কখনও ধরতেও পারল না। কোথা দিয়ে ঘরে ঢোকেন, কোথা দিয়ে বেরিয়ে যান। লোকে বুঝতেও পারে না। একবার নাকি ইঁদুরের গর্ত দিয়ে কার ঘরে ঢুকেছিলেন।”

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “আহা, অতটা নয়। তবে হ্যাঁ, আমার বেশ নামডাক হয়েছিল এককালে।”

“অ্যাঁ! আপনি!”

“আপনি-আজ্ঞে করতে হবে না, তুমিটাই চালিয়ে যাও। হ্যাঁ, আমিই শ্রীনিবাস বটে। তবে চুরিচামারি আমি বহুঁকাল ছেড়ে দিয়েছি। কিছুদিন কোচিং ক্লাসে ভাল ভাল চোর তৈরি করতুম। এখন তাও করি না।”

“আজ্ঞে, আমার যে কেমন পেত্যয় হচ্ছে না! মাথা ঘুরছে! বুকের ভিতরে ধকধক! এত বড় একটা মানুষ আমার ঘরে পা দিয়েছে! শাঁখ বাজানো উচিত, উলু দেওয়া দরকার!”

শ্রীনিবাস বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুলে বলল, “হবে, হবে। ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। রয়েসয়ে উলুও দিতে পারো, শাঁখও বাজাতে পারো, তবে সব কিছুরই একটা সময় আছে। ওসব হুট করে করতে নেই।”

“তা হলে একটা পেন্নাম অন্তত করতে দিন।” বলে ভারী ভক্তির সঙ্গে শ্রীনিবাসের পায়ের ধুলো নিয়ে জিবে আর মাথায় ঠেকাল পরাণ। তারপর গদগদ হয়ে বলল, “এ যে কাকের বাসায় কোকিল, এ যে বাঘের ঘরে ঘোগ, এ যে শ্রাদ্ধে বিরিয়ানি, এ যে বদনাতে গঙ্গাজল, এ যে নেউলের নাকে নোলক!” শ্রীনিবাস ধমক দিয়ে বলে, “ওরে থাম থাম হতভাগা! উপমার যা ছিরি তাতে ঘাটের মড়া উঠে বসে।”

“আমার যে বুকের মধ্যে বড় আকুলি ব্যাকুলি, বড় হাঁকপাঁক হচ্ছে! বরং একটু পদসেবা করি, তাতে আবেগটা একটু কমবে।”

“তা করতে পারিস। বেজায় হাঁটা হয়েছে আজ, পা টনটন করছে।”

বলে শ্রীনিবাস মাদুরে শুয়ে ঠ্যাং বাড়িয়ে দিল। পরাণ মহানন্দে পদসেবা করতে করতে বলল, “কাজকর্মে কি আবার নামা হবে বাবা?”

“কেন রে, এই বুড়োটাকে দিয়ে আবার কাজ করাতে চাস কেন? আমার কি রিটায়ার হওয়ার জো নেই?”

“কী যে বলেন বাবা! ভগবান কি রিটায়ার করে, নাকি দেশের রাজা রিটায়ার করে, নাকি ডাক্তার কোবরেজই রিটায়ার করে? তারপর ধরুন যতদূর শুনেছি, বাঘ-সিংহীদেরও রিটায়ার নেই।”

শ্রীনিবাস আরামে চোখ বুজে বলল, “তা তুই আমাকে কোন খাতে ধরছিস? ভগবান, না রাজা, না ডাক্তার, না বাঘ?”

“আজ্ঞে, ভগবান বলেই ধরতুম, তবে পাপ হয়ে যাবে বলে ধরছি না। একটু কম সম করে ওই রাজা বলেই ধরে নিন।”

শ্রীনিবাস ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “রাজা না হলেও রাজার কাজেই রিটায়ার ভেঙে এই বুড়ো বয়সে বেরোতে হল, বুঝলি?”

“উরেব্বাস! তাই নাকি? রাজার কাজ মানে তো ভাসাভাসি কাণ্ড! কথায় বলে, মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। তা রাজা খরচাপাতি কেমন দিচ্ছে বাবা?”

শ্রীনিবাস ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “রাজাদের আর সেই দিনকাল কি আছে রে হাবা গঙ্গারাম? রাজা দিগিন্দ্রনারায়ণের বাপমশাই রাজা ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ গরম ভাতে দু’হাতা করে ঘি খেতেন, তাঁর এক্কা গাড়ির ঘোড়ার লেজে দামি আতর মাখানোনা হত যাতে ঘোড়া ছুটলে একা গাড়িতে বসে রাজামশাই ভুরভুরে গন্ধ পান, আসল পাকা সোনার সুতো দিয়ে রাজার নাগরায় নকশা করা হত, তিনদিনের বেশি এক জোড়া নাগরা পরতেন না, চাকরবাকরদের দান করে দিতেন। সেসব দিন তো আর নেই। দিগিন্দ্রনারায়ণের তো এখন পোলাও খেতে ইচ্ছে হলে রানিমা সর্ষের তেলে ভাত ভেজে দেন, রাজবাড়িতে এখন ছেঁড়া গামছাখানাও সেলাই করে ব্যবহার করা হয়, রাজমাতা মিতব্যয়িনী দেবীকে আর আলাদা করে একাদশী করতে হয় না, রোজই তাঁর একাদশী।”

“এঃ হেঃ, আপনার মতো গুণী মানুষ এরকম একটা দেউলে রাজার হয়ে খাটছেন কেন বাবা? দেশে কি রাজাগজার অভাব?”

“রাজার হয়ে খাটছি তোকে কে বলল?”

“তা হলে এই যে বললেন রাজার কাজ!”

“তা বলেছি বটে, তবে তার মানে রাজার হয়ে খাটা নয় রে। মানেটা একটু খটোমটো, তুই ঠিক বুঝবি না। তবে কাজটা রাজবাড়ি সংক্রান্তই বটে।”

পরাণের চোখদুটো এবার ভারী জুলজুল করে উঠল। একগাল হেসে সে বলল, “তাই বলুন! এবার তা হলে রাজবাড়ি খালাস করবেন! এ না হলে ওস্তাদ! আপনার মতো মান্যগণ্য ওস্তাদের কি আর গেরস্তবাড়ির কাজে মানায়! প্রাতঃস্মরণীয় মানুষ আপনি। আর পুরনো রাজবাড়িগুলোয় মেলা কোনা-ঘুপচি, চোরকুঠুরি, কোথায় গুপ্তধন আছে কে জানে বাবা। তা বাবা, আপনার একজন স্যাঙাতট্যাঙাত দরকার নেই? আপনার পায়ের নখেরও যুগ্যি নই বটে, কিন্তু সোদানা তো ওজনদার জিনিস, আপনি বুড়ো মানুষ অত কি বইতে পারবেন? সেসব না হয় আমিই বয়ে দেবখন।”

“সেসব হবেখন। অত উতলা হচ্ছিস কেন? তার আগে বল তো, তুই কি ইংরিজি জানিস?”

হাত কচলে লাজুক হেসে পরাণ বলে, “কী যে বলেন। বাংলাটাই ভাল করে আসেনা তো ইংরিজি! তবে কিনা বলা কওয়ার দরকারও পড়ে না তো। হাত-পা সচল থাকলেই হল।”

মাথা নেড়ে শ্রীনিবাস বলে, “উঁহু, ওটা কাজের কথা হল না। ভাল কারিগরের সব কিছুই সচল থাকা দরকার। হাত, পা, মগজ, বুলি, কোনটা না হলে চলে?”

“আজ্ঞে, ইংরিজির কথাটা কেন উঠছে বাবা? জানলে কিছু সুবিধে হবে?”

“তা হবে বইকী, ওই যে ফুলদানি দুটো চুরি করে এনেছিস, কখনও ভাল করে উলটেপালটে দেখেছিস?”

পরাণ অবাক হয়ে বলে, “না তো! কাঁচের ফুলদানি দেখে বউটা এমন মুখনাড়া দিল যে, আর ওটার দিকে ফিরেও তাকাইনি। বউ তো ফেলে দিতেই চেয়েছিল, কী ভেবে ফেলেনি।”

“ঘটে বুদ্ধি থাকলে ফুলদানি দুটো উলটে দেখলে দেখতে পেতিস, ওগুলোর নীচে ইংরিজিতে লেখা আছে, আজ থেকে দেড়শো বছর আগে ও জিনিস বিলেতে তৈরি হয়েছিল। স্ফটিক কাঁচের তৈরি। সমঝদার খদ্দের যদি পাস, কত দাম দিতে পারে জানিস?”

বড় বড় চোখে হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শশব্যস্ত পরাণ বলে, “কত হবে বাবা, একশো দেড়শো?”

‘দূর পাগল! একশো দেড়শো কী রে? যদি সাহেব খদ্দের পাস তবে হেসেখেলে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। দিশি খদ্দের কিছু কম দিতে চাইবে, তাও ধর ওই আট-দশ হাজার।”

“তবে যে আপনি দশ টাকায় বেচে দিলেন!”

শ্রীনিবাস একটু হেসে বলল, “বেচব না তো কি চোরাই জিনিস বয়ে বেড়াব? আর বেচা মানে কি আর সত্যিই বেচা নাকি? ও হল গচ্ছিত রাখা। যেমন ব্যাঙ্কে লোকে টাকা রাখে আবার দরকার মতো তুলে নেয়, এও হল তাই। এ-গাঁয়ের ঘরে ঘরে অমন আমার কত জিনিস গচ্ছিত রাখা আছে। দরকার মতো সরিয়ে নেব বলেই রেখেছি।”

“পায়ের ধুলো দিন ওস্তাদ!” বলে ভক্তিভরে ফের শ্রীনিবাসের পায়ের ধুলো নিয়ে পরাণ শশব্যস্তে বলল, “দেখেছেন বাবা নয়নতারার কাণ্ডটা! অত দামি জিনিস কেমন অচ্ছেদ্দায় কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছে! ষষ্ঠী গুণের মেয়ে হয়ে তার আক্কেলটা দেখলেন! পড়ে ভাঙবে যে!”

“অত উতলা হোসনে। তোর হাত কাঁপছে যে! উত্তেজনার বশে ফুলদানির ওপর গিয়ে হামলে পড়লে তোর হাতেই ভাঙবে। বউমা আসুক, সাবধানে তুলে রাখবে’খন।”

“না বাবা, দামি জিনিসের অমন অযত্ন সহ্য হয় না।”

একটু হেসে শ্রীনিবাস বলে, “দামি জিনিস বলে বুঝতে পারলে কি আর অযত্ন করত? কোন জিনিসের কী দাম তা ক’জন বোঝে বল দিকি! তাই তো বলছিলাম, কারিগর হতে গেলে হাতে পায়ে দড় হলেই হয় না, মগজ চাই, চোখ চাই, পেটে একটু বিদ্যে চাই।

গদগদ হয়ে পরাণ বলে, “আপনাকে যখন পেয়ে গেছি, এবার সব শিখে নেব।”

“শোন হতভাগা, হুটপাট করার দরকার নেই, ও দুটো জিনিস একটু ঢাকা চাপা দিয়ে রাখিস। দুটো লোক কাল থেকে ওসব চোরাই জিনিসের খোঁজে এ তল্লাটে ঘুরঘুর করছে।” পরাণ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলে, “সর্বনাশ। তা হলে উপায়?”

“ঘাবড়াসনি। তারা দুটিও তোর মতোই মর্কট। এসব জিনিসের মর্ম তারাও বোঝে না। ডবল দাম দিয়ে কিনে নেবে বলে সবাইকে ভরসা দিচ্ছে। আসলে ডবল দাম দেওয়ার মুরোদও তাদের নেই। তারা শুধু খোঁজ নিচ্ছে কার বাড়িতে কোন জিনিসটা আছে। জেনে নিয়ে রাতের অন্ধকারে মাল সাফাই করবে।”

“সেটাও তো ভয়ের কথা।”

“তোর এই ভাঙা বাড়ির দিকে তারা নজরও দেবে না বটে, তবু সাবধান থাকা ভাল। আসলে তারা একটা জিনিসই হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেটা পেয়ে গেলে অন্য জিনিসগুলো নিয়ে তারা বিশেষ মাথা ঘামাবে না।”

“সেটা কী জিনিস বাবা?”

শ্রীনিবাস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ রে, নয়নতারা এত দেরি করছে কেন বল তো!”

“আজ্ঞে, এ-বাড়িতে তো বহুঁকাল মান্যগণ্য কেউ আসেনি। আজ আপনার সম্মানে বোধহয় ভালমন্দ কিছু রাঁধবে।”

“অ। তা ভাল।”

শ্রীনিবাসের পা আরও জোরে দাবাতে দাবাতে পরাণ বলল, “জিনিসটা কী তা এই বেলা বলে ফেলুন বাবা। নয়নতারার সামনে গুহ্যকথাটথা না বলাই ভাল। মেয়েদের সামনে গুহ্যকথা বললে বড় ভজঘট্ট লেগে যায়। ওদের পেটে কথা থাকে না কি না, পাঁচকান হয়ে পড়ে।”

“অত হুড়ো দিচ্ছিস কেন রে? সব কথা উপর্যুপরি বলে ফেলাই কি ভাল? কথারও তত দিনক্ষণ, লগ্ন আছে, নাকি? যখন তখন যেমন তেমন কথা বললেই তো হবে না। ভাল করে ভেবেচিন্তে নিকেশ করে বলতে হবে। একটু জিরোই, তারপর চাট্টি খাই, তারপর একটু ঘুমনোও তো দরকার বুড়ো মানুষটার নাকি? বিছানাপত্তরের যা ছিরি দেখছি তাতে ঘুমটাই কি আর হবে?”

শশব্যস্ত পরাণ বলল, “চিন্তা নেই বাবা, মাচানের ওপর আরও কয়েকটা বস্তা পেতে নরম বিছানা করে দিচ্ছি। আরামে শোবেন। আমরা না হয় পাশের ঘরে মাদুর পেতে ঘুমোব।”

“তা সেই ব্যবস্থাই ভাল। লোক দুটোর গতিবিধির ওপর নজর রাখতে তোর বাড়িতেই কয়েকদিন থানা গেড়ে থাকতে হবে। এই একশোটা টাকা রাখ। কাল গিয়ে ভাল করে বাজার করে দু’দিন ভালমন্দ খা দিকি। রাতের কারিগরদের ভালমন্দ খেতে হয়, নইলে এ কাজের হ্যাপা সামলাবি কী করে। ওই হাড়গিলে ল্যাকপ্যাকে কমজোর চেহারায় যে দশটা লোকের কিলও হজম করতে পারবি না। তোর মতো বয়সে আমাকে একশো লোক মিলে হাটুরে মার দিয়েও কিছু করতে পারেনি। পাগলুর হাটে তো একবার বাঁশডলা দেওয়ার পর পুকুরের জলে চুবিয়ে রেখেছিল। প্রাণায়ামের জোরে প্রাণবায়ুটুকু আটকে রাখতে পেরেছিলুম। বুঝেছিস?”