২. সনাতন রায় আর পাঁচটা হাটুরের মতো নয়

সনাতন রায় আর পাঁচটা হাটুরের মতো নয়। সে হাটে আসে সব বিটকেল জিনিস কিনতে। ওই তার এক বাতিক। যে জিনিস কারও কাজে লাগে না, যেসব জিনিস লোকে ফিরেও দেখে না, সেগুলিই গাঁটগচ্চা দিয়ে সে কিনে নিয়ে যায়। তা বলে সনাতন যে পয়সাওলা লোক তাও নয়। পয়সাওয়ালাদের পয়সা ওড়ানোর জন্য অনেক বাতিক জন্মায়। সনাতন নিতান্তই সামান্য একজন গরিব গোছের মানুষ। মাধবগঞ্জের বাজারে তার একখানা ছোটখাটো মনোহারি দোকান আছে। ব্যবসা ভাল চলে না। তবে সনাতনের কোনওক্রমে চলে যায়। তিনকুলে তার কেউ নেই। বুড়ি মা এতদিন বেঁচে ছিল, এই তো ছ’মাস আগে মাও মারা যাওয়ায় সনাতনের ঝাড়া হাত-পা। দোকানের পেছনেই তার দু’খানি ঘর, বারান্দা আর উঠোন নিয়ে একখানা বাড়ি। সেই ঘর দু’খানায় গেলে লোকে হাঁ করে চেয়ে থাকবে। চিনেলণ্ঠন, ভাঙা পুরনো শেজবাতি, পুরনো পেতলের পিলসুজ, বহু পুরনো আবছা-হয়ে-আসা অয়েল পেন্টিং, তুলোট কাগজ আর তালপাতার কিছু পুঁথি, ব্রিটিশ আমলের পুরনো সেন্টের খালি শিশি, নাগাদের তির-ধনুক, দোয়াতদানি, অচল পয়সা কী নেই তার ঘরে! কেন এসব সে জমায়, জিজ্ঞেস করলে সনাতন কেবল লজ্জার হাসি হাসে। বিটকেল জিনিস কেনা ছাড়া তার আর কোনও শখ-আহ্লাদ নেই।

ঝিকরগাছার এই হাটে একজন দোকানদারের কাছেই সে আসে। সে হল মাথায় ফেজ টুপিওলা, জোব্বা পরা প্রায় নব্বই বছর বয়সের এক বুড়ো। তার নাম দানু।

দানুর দোকানে পুরনো বই, ছবি, পুঁথি, নানা জায়গার রাজবাড়ি বা জমিদারবাড়ির পরিত্যক্ত জিনিসপত্র থাকে। বেশিরভাগই অকাজের জিনিস। খদ্দেররা এসে সেসব নাড়াঘাটা করে বটে, কিন্তু দাম শুনে পিছিয়ে যায়। হ্যাঁ, দানুর জিনিসের দাম বেশ চড়া। তার ওপর সে বেজায় বদমেজাজিও বটে। মেজাজ দেখেও খদ্দেররা হটে যায়।

বড় করে পাতা একটা ত্রিপলের ওপর সাজানো পসরা। এক কোণে দানু গম্ভীর মুখে চুপচাপ বসা। সনাতন একটা পুরনো বিবর্ণ চটি বই উলটেপালটে দেখছিল। বইটার নাম, সশরীরে অদৃশ্য হইবার কৌশল। সেখানা রেখে আর একখানা বই তুলল সে, শূন্যে ভাসিয়া থাকিবার সহজ উপায়।

“এসবে কি কাজ হয় দানুজ্যাঠা?”

দানু বিরস মুখে বলে, “কে জানে বাপু। আমি বই বেচে খালাস, কাজ হয় কি না তা বই যে লিখেছে তার সঙ্গে বুঝে নাওগে।”

দানুর ওরকমই ক্যাটকেটে কথা। বই রেখে সনাতন অন্যসব জিনিস দেখতে লাগল। হরেক জিনিস। ছোট-বড়-ভাঙা-আস্ত নানা আকৃতি আর প্রকৃতির জিনিস। পুরনো কলম আর দোয়াতদানি, জং ধরা ছুরি, বাহারি হাতপাখা–দেখতে দেখতে সনাতনের মাথা টাল খায়। একধারে ভঁই হয়ে থাকা রাবিশের মধ্যে সনাতন একটা কাঠের বাক্স দেখে সেটা টেনে আনল। বেশ ভারী বাক্স। ইঞ্চিদশেক লম্বা, সাত ইঞ্চির মতো চওড়া, আর চার ইঞ্চির মতো পুরু।

“এবাক্সে কী আছে দানুজ্যাঠা?”

“তা কে জানে বাপু। আমি খুলে দেখিনি?”

“দ্যাখোনি! সোনাদানাও তো থাকতে পারে।”

“তা থাকলে আছে।”

“দেখার ইচ্ছে হয়নি?” দানু বিরস মুখে বলে, “তা সোনাদানা থাকলেই বা আমার কী? আমার তিনকুলে কেউ নেই, তিন কাল গিয়ে এক কালে ঠেকেছে। সোনাদানা দিয়ে আমার আর হবেটাই বা কী, বলো তো বাপু!”

সনাতন বাক্সটা খোলার চেষ্টা করছিল।

দানু নিস্পৃহ চোখে চেয়ে দেখে বলল, “ওভাবে কি খোলে রে বাপু। গা-তালা যে আটকানো আছে।”

“তা হলে চাবিটা দিন।”

“চাবি থাকলে তো আমিই খুলতুম। চাবিটাবি নেই। বন্ধ বাক্সটাই শুধু পেয়েছি। কিনতে চাইলে কিনতে পার, তবে হাজার টাকা দাম পড়বে।”

চোখ কপালে তুলে সনাতন বলে, “হাজার?”

“হ্যাঁ, বাপু। ভেতরে সোনাদানা থাকলেও তোমার। ইটপাটকেল থাকলেও তোমার।”

সনাতন বাক্সটার গায়ের ময়লা রুমালে একটু ঘষে পরিষ্কার করে নিয়ে দেখল, কালচে কাঠের ওপর নানা নকশা খোদাই করা আছে। এক-দেড়শো বছরের পুরনো তো হবেই।

সনাতন ভারী দোনোমোনোয় পড়ে গেল। হাজার টাকা অনেক টাকা। ভেতরে ইটপাটকেলই যদি থাকে তা হলে শুধু বাক্সটার দামই হাজার টাকা পড়ে যাচ্ছে। খুবই ঠকা হয়ে যাবে।

কিন্তু কৌতূহল বড়ই বলবতী। বন্ধ বাক্সয় কী আছে তা জানার অদম্য কৌতূহলও তাকে পেড়ে ফেলল। “কিছু কমসম হয় না দানুজ্যাঠা?” দানু পাথরের মতো নির্বিকার মুখ করে বলল, “কখনও দেখেছ এক পয়সাও দাম কমিয়েছি? এসব জিনিসের তো বাপু কোনও বাঁধাধরা দাম নেই। যার শখ চাপে সে কেনে। তাতে সে ঠকতেও পারে, জিততেও পারে। দাম কমাতে পারব না বাপু। ওই হাজার টাকাই দিতে হবে।”

সনাতন হিসেব করে দেখল, কুড়িয়ে বাড়িয়ে তার কাছে হাজার টাকা হয়ে যাবে বটে, কিন্তু বাড়তি পয়সা কিছুই প্রায় থাকবে না। এবার চেপে শীত পড়েছে, সইফুলের দোকান থেকে একখানা ফুলহাতা সোয়েটার কিনবে বলে ঠিক করে রেখেছিল। এক শিশি গন্ধ তেল কেনারও শখ ছিল। একজোড়া চটিও না কিনলেই নয়। তা বাক্স কিনলে আর সেসব কেনা হবে না। বড়জোর এক কাপ চা আর দুটি শিঙাড়ার পয়সা পড়ে থাকবে পকেটে।

সনাতন ভারী বেজার মুখে গেঁজে থেকে হাজারটা টাকা বের করে দানুকে দিয়ে বলল, “বাক্স থেকে কী বেরোবে কে জানে! লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু, বুঝলেন দানুজ্যাঠা?”

দানু হাজারটা টাকা আলগোছে নিয়ে আলখাল্লার পকেটে সাঁদ করিয়ে বলল, “তা বাপু, পরে আবার আমাকে দোষ দিয়ো না। কেনার জন্য তো তোমাকে মাথার দিব্যি দিইনি।”

“না দানুজ্যাঠা, আপনার আর দোষ কী?”

“ওবাক্সের জন্য আরও দু’জন এসে ঘুরে গেছে। একজন তিনশো অবধি উঠেছিল, অন্যজন পাঁচশো দিতে চেয়েছিল। আমি সাফ বলে দিয়েছি, এ-দোকানে দরাদরি হয় না। আমার দামে নিতে হয় নাও, নইলে কেটে পড়ো।”

সনাতন বাক্সখানা তার ঝোলাব্যাগে পুরে নিয়ে উঠে পড়ল। মনটা খচখচ করছে। হাজার টাকা বোকাদণ্ডই গেল আজ!

সনাতন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর বেঁটেমতো রোগাপানা চেহারার একটা লোক এসে বেজার মুখে দানুকে বলল, “দিন দাদা, বাক্সখানা দিন। তিনশো বলেছিলাম, আরও না হয় দুশো দিচ্ছি।”

দানু ছোট চোখ করে লোকটাকে দেখে বলল, “বাক্স! বাক্স তো বিক্রি হয়ে গেছে।”

লোকটা চমকে উঠে বলে, “অ্যাঁ!”

“হ্যাঁ হে, বিক্রি হয়ে গেছে।”

“কেন ছল-চাতুরি করছেন মশাই? না হয় আরও একশো টাকা দিচ্ছি। বড় পছন্দ হয়ে গেছে বাক্সখানা।”

দানু বিরস মুখে বলে, “মেলা ঘ্যানঘ্যান কোরো না তো বাপু। তোমার মুরোদ জানা আছে। বাক্স হাজার টাকাতেই বিক্রি হয়েছে। এবার কেটে পড়ো।”

লোকটা হঠাৎ মাথায় দু’হাত চেপে বসে পড়ল। বলল, “সর্বনাশ!”

দানু তেরছা চোখে লোকটাকে দেখে নিয়ে বলল, “কেন হে, সর্বনাশের কী হল?”

লোকটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “কে কিনেছে বলতে পারেন?”

“তা কে জানে! কত খদ্দের আসে, আমি কি সবার নাম-ঠিকানা লিখে রাখি?”

“আহা, চেহারাটা কেমন সেটা তো বলতে পারেন!”

“চেহারারই বা ঠিক কী? হাটে কত লোক, সকলের চেহারা আলাদা করে মনে রাখা কি সোজা? আমি বুড়োমানুষ, চোখেরও জোর নেই, মনেও থাকে না।”

“সর্বনাশ হয়ে যাবে মশাই, একেবারে সর্বনাশ। আচ্ছা, লোকটার বয়স কত?”

“চব্বিশ-পঁচিশ হবে বোধ হয়।”

“ফরসা না কালো?”

“ফরসার দিকেই।”

“ইয়ে, তার নামটা কি মনে আছে?”

“না হে বাপু, ওসব মনেটনে নেই।” বেঁটে লোকটা ভারী বিমর্ষ হয়ে চারদিকে হতাশভাবে একবার তাকিয়ে গুটিগুটি চলে গেল।

দানু নির্বিকার বসে রইল। আরও আধঘণ্টা বাদে বেশ মুশকো চেহারার একটা লোক এসে হাজির। এ-লোকটাই পাঁচশো টাকা দর দিয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ল দানুর।

লোকটা এসেই কোটের ভেতরের পকেট থেকে একতাড়া একশো টাকার নোট বের করে হাজার টাকা গুনে দানুর দিকে বাড়িয়ে বলল, “দিন দাদু, বাক্সটা দিন। হাজার টাকাই দিচ্ছি।”

দানু বিরক্ত হয়ে বলে, “আর হাজার টাকা দেখিয়ে লাভ নেই। বাক্স বিক্রি হয়ে গেছে।”

লোকটা চোখ পাকিয়ে বলে, “তার মানে?”

দানু তেতো গলায় বলে, “বাংলা ভাষাতেই তো কথা বলছি বাপু, তাও মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে কেন? বাক্স বিক্রি হয়ে গেছে।”

লোকটা হঠাৎ চাপা একটা হুংকার দিয়ে বলে, “কে কিনেছে?”

“তার আমি কী জানি? খদ্দেরের ঠিকুজি কুষ্ঠি রাখা তো আমার কাজ নয়।”

“চালাকি করে দাম বাড়ানোর চেষ্টা করছেন না তো!”

দানু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে, “এ দোকানে দাম বাড়ানোও হয় না, কমানোও হয় না। যাও বাপু, পথ দ্যাখো।”

লোকটা হঠাৎ একটু হাসল। খুবই রহস্যময় হাসি। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, “আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে প্রতাপগড়ের মেজোকুমার এক রাতে ঘোড়া দাবড়ে বাড়ি ফিরছিলেন। পুরনো গড়ের কাছে তাঁকে বল্লম চালিয়ে খুন করা হয়। মনে পড়ে?”

দানু বিস্ফারিত চোখে লোকটার দিকে চেয়ে রইল। জবাব দিল না। লোকটা ফের বলল, “গদাধরপুরের মস্ত মহাজন শঙ্কর শেঠকে কীভাবে খুন করা হয়, মনে আছে? জানলা দিয়ে তির ছুঁড়ে।”

দানু বিব্রত হয়ে একটা ঢোক গিলল। তাচ্ছিল্যের ভাবটা উবে গেছে।

“আরও বলব? হবিবপুরের ব্রজেন মাস্টারের মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। কিন্তু সবাই জানে, সে সময়ে মোহিত দাসের সঙ্গে বদ্বীপ্রসাদের মামলায় ব্রজেন মাস্টার ছিল মোহিতের সাক্ষী। সে সাক্ষী দিলে বদ্রীপ্রসাদ অবধারিত হারে। তাই সাক্ষী দেওয়ায় আগের রাতে ব্রজেন মাস্টারকে সাপে কামড়ায়। আসলে সাপে কামড়ায়নি, সাপকে দিয়ে কামড়ানো হয়েছিল।”

দানু ফেজ টুপিটা খুলে ফের পরল। একটু বিড়বিড় করল আপনমনে।

“এসব ভাল ভাল কাজের পেছনে কার হাত ছিল জানেন? মছলন্দপুরের দানু হেস। পুলিশ তাকে কখনও ধরতে পারেনি অ্যারেস্ট করেও প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।”

দানু গলার মাফলারটা খুলে আবার জড়িয়ে নিল। লোকটার চোখে আর চোখ রাখছিল না।

“দানু হেসের আরও গুণের কথা শুনবেন? প্রথম জীবনে চুরি, ডাকাতি ছিনতাই করে সে দু পয়সা কামাত। মোটা টাকা পেলে খুনখারাপি করত। বয়স হওয়ার পর সে চোরাই জিনিসের ব্যবসা খুলেছিল। জীবনেও এসব কাজের জন্য সে কোনও সাজা পায়নি। ভারী চালাক-চতুর ছিল সে। তা বলে ভাববেন না যে, তার শত্রুর অভাব আছে। তাকে পেলে আজও তাকে খুন করার জন্য কিছু লোক খুঁজে বেড়াচ্ছে। বুঝেছেন?”

দানু মুখটা নিচু করে খানিক বিড়বিড় করল। তারপর লোকটার দিকে না তাকিয়েই বলল, “এত কথা হচ্ছে কেন?”

“বলি বাক্সটা কে কিনেছে?”

“মাধবগঞ্জের সনাতন রায়।”

“কীরকম পোশাক?”

“ধুতি, গায়ে আলোয়ান, কাঁধে সবুজ রঙের ঝোলা ব্যাগ। ব্যাগের মধ্যে বাক্সটা আছে।”

“আলোয়ানের রং কী?”

“নস্যি রঙের।”

“চেহারা?”

“ফরসা, রোগা, লম্বামত। মাথায় কোঁকড়া চুল। নাকের বাঁ পাশে বড় আঁচিল আছে।”

“ঠিক আছে। খুঁজে তাকে পাবই।”

“একটা কথা বাপু।”

“কী কথা?”

“তুমি কে?”

“আমি তোমার যম। সময়মতো তোমার সঙ্গে দেখা হবে। ভেবো।”

বলে লোকটা চলে গেল। দানু বিফল হয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর ধীরেসুস্থে দোকান গোটাতে লাগল। না, তার আজ মেজাজটা ভাল নেই।

খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে সনাতনের খিদে পেল। ঝিকরগাছার হাটে এলে রামগোপাল ময়রার দোকানে ছানাবড়া আর রাবড়ি তার বাঁধা। কিন্তু আজ বাক্সটা কিনতে গিয়ে পয়সা সব বেরিয়ে যাওয়ায় সেসব আর খাওয়া হবে না। সে গুটিগুটি তেলেভাজার দোকানের দিকে এগোতে লাগল।

ঠিক এই সময়ে ভারী অমায়িক চেহারার গোলগাল একজন লোক তার সামনে ফস করে উদয় হয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, “আরে! মুখোনা যে বড় চেনা চেনা লাগছে!”

সনাতন লোকটাকে ঠাহর করে দেখেও ঠিক চিনতে পারল না। বলল, “আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না। কে বলুন তো আপনি?”

“আমাকে চিনলেন না! আমি হলুম পিরগঞ্জের নটবর পাল।”

খানিকক্ষণ ভেবে সনাতন মাথা নেড়ে বলে, “না মশাই, নটবর পাল নামে কাউকে মনে পড়ছে না তো! পিরগঞ্জও আমার চেনা জায়গা নয়।”

“হতে পারে মশাই, খুবই হতে পারে। তবে আমার বড় শালা হল গে কালিকাপুরের দারোগা গণেশ হালদার।”

সনাতন মাথা নেড়ে বলল, “ চিনি না।”

“তাও চিনলেন না! তবে বলি মশাই, ঝিকরগাছার হাটে প্রতি পাঁচজন লোকের একজন জানে যে, নটবর পালের তামাক আর ভুসিমালের কারবারে লাখো লাখো টাকা খাটছে মশাই, লাখো লাখো টাকা। তা বলে কি আর মনে সুখ আছে মশাই? কোনও সুখ আছে?”

সনাতন অবাক হয়ে বলে, “তা সুখ নেই কেন?”

“সুখ থাকবে কী করে বলুন! সুখ তো আর চাকরবাকর নয় যে, ডাকলেই জো হুজুর বলে এসে হাজির হবে! আমারটা খাবে কে বলুন তো! কে খাবে আমারটা? আমার ছেলেপুলে নেই, ওয়ারিশন নেই। আছে শুধু টাকার পাহাড়। তাই তো মাঝে-মাঝে নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে উঠে বসে বলি, ওরে নটবর, তোর এই বিষয়সম্পত্তি কাকে দিয়ে যাবি বাপু? তোর কে আছে?”

“তা মশাই, পুষ্যিপুতুর নিলেই তো পারেন।”

এ কথায় লোকটা শিউরে উঠে জিভ কেটে বলল, “ওকথা আর বলবেন না মশাই, খুব শিক্ষা হয়ে গেছে।”

“কেন, কী হয়েছিল?”

“পুষ্যিপুত্তুর নেব বলে সবে মনস্থির করছি, কী করে যে মনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল কে জানে মশাই, হঠাৎ পালে পালে আন্ডাগন্ডা সব ছেলেপুলে হাজির হতে লাগল। কোনওটা হাবাগোবা, কোনওটা বদমাশ, কোনওটা মিটমিটে ডান। সব শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা মশাই, সব শিখিয়ে-পড়িয়ে আনা। নিজের নাম হয়তো বলল সুজিত দাস, বাপের নাম বলল হারাণচন্দ্র মণ্ডল। এইসব দেখেশুনে ঘেন্না ধরে গেছে মশাই, ঘেন্না ধরে গেছে।”

গায়ে-পড়া নোকটাকে এড়ানোর জন্য সনাতন বলল, “আচ্ছা নটবরবাবু, আলাপ করে বড় খুশি হলাম। এবার তা হলে আমি যাই! বেলাও পড়ে আসছে।”

“আহা, তাড়াহুড়োর কী আছে মশাই, হাড়াহুড়োর কী? হাট হল মস্ত লোকশিক্ষার জায়গা। ভাল-মন্দ, বিষয়ী-বৈরাগী, সাধু-চোর, শাক্ত-বোষ্টম কতরকমের মানুষ আসে এখানে। ঘুরে বেড়ালেই কত কী শেখা যায়।”

সনাতন বিব্রত হয়ে বলে, “আজ্ঞে, তা বটে। তবে কিনা মানুষের তো খিদে-তেষ্টাও পায়।”

লোকটা একগাল হেসে বলে, “বিলক্ষণ! মানুষের শরীর বলে কথা, খিদে-তেষ্টা না পাওয়াই তো আশ্চর্যের বিষয়। কী বলেন?”

“তাই তো বলছি।”

“আমি আপনার সঙ্গে একমত। তবে দুঃখের কথা কী জানেন, খিদে-তেষ্টা আমারও পায়। একসময় পোলাও কালিয়া ছাড়া একবেলা চলত না। হাঁড়ি-হাঁড়ি রসগোল্লা উড়িয়ে দিয়েছি। কিন্তু এখন সব বারণ হয়ে গেছে মশাই। সব বারণ। পেঁপে দিয়ে শিং মাছের ঝোল আর মধুপর্কের বাটির এক বাটি ভাত ছাড়া আর পথ্যি নেই।”

“কেন মশাই?”

“ডাক্তাররা শরীরে নানারকম রোগের সন্ধান পেয়েছে। বেশি খেলেই নাকি মৃত্যু অনিবার্য। তাই তো বলছি মশাই, আমার কি দুঃখের শেষ আছে! এত টাকা, এত ঐশ্বর্য, এত খাবারদাবারের আয়োজনের মধ্যে দাঁতে কুটো কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। সেই যে কথায় বলে, সানকিতে বজ্রাঘাত, এ হল তাই। কথাটা কি ঠিক বললুম?”

“বোধ হয় ঠিকই বলেছেন। এবার আমি আসি তা হলে।”

লোকটা ভারী করুণ মুখ করে তার দিকে চেয়ে থেকে একটু মিয়োনো গলায় বলল, “চলে যাবেন? এত বড় একটা সুযোগ আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবেন? আপনাকে তো তেমন পাষণ্ড বলে মনে হয় না!”

সনাতন থতমত খেয়ে বলে, “আজ্ঞে, কোন সুযোগের কথা বলছেন? আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না!”

লোকটার চোখ ছলছল করতে লাগল। ধরা গলায় বলল, “সুযোগ বলে সুযোগ! ব্রাহ্মণ ভোজন করালে সাতজন্মের পাপ কেটে যায় মশাই! ভেবেছিলাম আপনাকে পেয়ে সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে খানিকটা পুণ্যি করে নেব! শুধু পুণ্যিই তো নয়। নিজে খেতে পারছি না বলে অন্যকে খাইয়ে আমার একটা সুখ হয়! আর আপনি আমাকে বঞ্চিত করে চলে যেতে চাইছেন!”

সনাতনের একগাল মাছি। সে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আজ্ঞে আপনার খুবই ভুল হচ্ছে। আমি ব্রাহ্মণ নই!”

নটবর পাল একগাল হেসে বলল, “সৎ ব্রাহ্মণরা কি সহজে ধরা দিতে চায়! আর ছলনা করবেন না মশাই, আপনাকে দেখেই চিনেছি।”

“কী মুশকিল! আপনি তো আমার নামটাও জানেন না।”

“নামে কী আসে যায় বলুন। আলু, পটল, মুলো, নাম একটা হলেই হল। ও নিয়ে ভাববেন না। এই তো কাছেই রামগোপালের দোকান। পোটাক রাবড়ি আর কয়েকখানা গরম ছানাবড়া ইচ্ছে করুন, এই অধমকে এটুকু দয়া যে আজ করতেই হবে। ইদানীং পাপের দিকে পাল্লাটা আমার বেশ ঝুলে পড়েছে বলে টের পাচ্ছি, একটু হালকা হতে দিন।”

রামগোপালের রাবড়ি আর ছানাবড়া সনাতনের বড়ই প্রিয় জিনিস। বড় লোভে ফেলে দিল লোকটা। তবু সনাতন আমতা আমতা করে বলে, “কিন্তু মশাই, আমাকে খাওয়ালে আপনার পাপটাপ কাটবে না, এই বলে রাখছি।”

লোকটা হুংকার দিয়ে বলে, “কে বলল কাটবে না! আলবাত কাটবে। পাপের বাবা কাটবে। এই তো ছয় মাস আগে নকুল ভটচামশাইকে এক হাঁড়ি দই আর ছাপ্পান্নটা রসগোল্লা খাওয়ালুম। বললে বিশ্বাস করবেন না মশাই, দইয়ের হাঁড়ি সাফ হচ্ছে আর শরীরও হালকা হচ্ছে। শেষে যখন রসগোল্লা খাচ্ছেন তখন টপাটপ রসগোল্লা যেই গলা দিয়ে নামছে আমার শরীরটা যেন ফুরফুর করতে লেগেছে। শেষে পাপ যখন চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমাকে ছেড়ে চলে গেল তখন শরীর একেবারে পালকের মতো হালকা, এত হালকা যে মেঝে ছেড়ে দেড় হাত শূন্যে উঠে পড়ল। তখন আমিই ভটচামশাইকে থামালুম, আর না, আর না ভটচামশাই! এরপর যে গ্যাস বেলুনের মতো উড়ে যাব। তা উনি তখন বিরক্ত হয়ে ওই ছাপ্পান্নটাতেই থামলেন। নইলে বিপদ ছিল।

“কী মুশকিল! আমি যে মোটেই বামুন নই। এই দেখুন, আমার গলায় পইতেও নেই।”

লোকটা একগাল হেসে বলে, “চেনা বামুনের পইতে লাগে না। আসুন মশাই, আসুন। হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। পাপ কাটে কি না হাতেকলমে দেখিয়ে দিচ্ছি।”

সনাতনের ভারী সংকোচ হচ্ছিল। লোকটা পাগলই হবে। তবে সে আর গাঁইগুই করল না। পকেটে পয়সা নেই, খিদেটাও চাগাড় দিয়েছে। ভগবান কখনও সখনও গরিবকে এভাবেই হয়তো অযাচিত সাহায্য করেন।

রামগোপালের রাবড়ি হল সরে দুধে মাখামাখি, ওপরে ননি ভেসে থাকে। মুখে দিলেই মনে হয়, স্বর্গে উঠে গেলাম। লোকটা দিলদরিয়া আছে। একপো রাবড়ি আর দশখানা ছানাবড়া হুকুম দিয়ে বসল।

ভারী লজ্জায় লজ্জায় খাচ্ছিল সনাতন। তবে রামগোপালের রাবড়ি আর ছানাবড়া এতই ভাল জিনিস যে, লজ্জা সংকোচ বজায় রাখা কঠিন।

সনাতন খাচ্ছে আর নটবর সামনে বসে ‘আহা, উঁহু’ করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বলছে, “আহা, বেশ রসিয়ে রসিয়ে খান তো মশাই, অত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বেশ গুছিয়ে ধীরেসুস্থে জিবে টাগরায় মাখিয়ে নিয়ে খেতে থাকুন।”

সনাতন বলল, “সেই চেষ্টাই তো করছি মশাই, কিন্তু রাবড়িটা যে জিবে গিয়েই হড়কে যাচ্ছে।”

“তা হলে আর একপো দিতে বলে দিই।”

“পাগল নাকি?”

“আপনার তো দেখছি পাখির আহার! না মশাই, আপনাকে খাইয়ে সুখ নেই। গেল হপ্তায় এই দোকানে বসেই বিপিন বিশ্বাসকে খাইয়েছিলাম, বললে বিশ্বাস করবেন না, দেড় সের রাবড়ি আর পঞ্চান্নটা ছানাবড়া চোখের পলকে উড়িয়ে দিল। ক্ষণজন্মা পুরুষ মশাই, সব ক্ষণজন্মা পুরুষ।”

খাওয়া শেষ হওয়ার পর নটবর পকেট থেকে একখানা রুপোর ডিবে বের করে বলল, “আমার মায়ের হাতে সাজা বেনারসি পাত্তির পান। এক খিলি ইচ্ছে করুন, দেখবেন মনটা ভারী ফুরফুরে হয়ে যাবে। মিষ্টি মশলা দেওয়া আছে।”

সনাতন হাত বাড়িয়ে পানটা নিয়ে মুখে পুরতে যাবে ঠিক এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটল। একটা মুশকো চেহারার লোক ঝড়ের বেগে দোকানে ঢুকে সটান তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধমকের সুরে বলল, “নিশিকান্ত! এটা কী ব্যাপার? কুমার বাহাদুরের শিকার তুমি কোন সাহসে দখল করে বসে আছ? তোমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?”

নটবর পালের বিনয়ের ভাবটা হঠাৎ উবে গেল। গলাটাও হয়ে উঠল ভারী গমগমে। হুংকার দিয়ে বলল, “আমি কে সেটা ভুলে যেয়ো না গদাধর। আমি কিংশুক গিরির ম্যানেজার।

“এ জিনিসের ওপর কিংশুক গিরির কোনও অধিকার নেই, ধর্মত ন্যায্যত ওটা কুমার বাহাদুরের পাওনা। ওই বাক্সের জন্য বহু খুনখারাপি হয়ে গেছে নিশিকান্ত, আরও কয়েকটা হলেও কুমার বাহাদুর পিছপা হবেন না।”

“বটে!” বলে নটবর পাল লাফিয়ে উঠে বলল, “তবে তাই হোক। আমিও তৈরি হয়েই এসেছি। বাইরে আমার দলবল রয়েছে।”

“দ্যাখো নিশিকান্ত, তুমি ভালই জানো যে, লড়াই হলে তুমি উড়ে যাবে। কুমার বাহাদুর রক্তপাত পছন্দ করেন না। তুমি ভালয় ভালয়

সরে পড়ো। আমি এ-লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।”

নটবর রুখে উঠে বলল, “খবরদার বলছি গদাধর। একদম ওসব চেষ্টা কোরো না।”

“তবে রে!” বলে গদাধর লাফিয়ে পড়ল নটবরের ঘাড়ে। নটবরও বড় কম যায় না। দেখা গেল সেও বিদ্যুৎগতিতে পাশে সরে গিয়ে লোকটার ঘাড়ে একখানা রদ্দা বসিয়ে দিল।

তারপর দুজনে চেয়ার টেবিল উলটে গেলাস পিরিচ ভেঙে ধুন্ধুমার লড়াই করতে লেগে গেল।

সনাতন দেখল, এই সুযোগ। মারপিট দেখতে লোকজন জড়ো হয়ে যাওয়ায় তার সুবিধেও হয়ে গেল খুব। সে উঠে পড়ি-কি-মরি করে বেরিয়ে ছুটতে লাগল।

তার মনে হল, চারদিক থেকে হঠাৎ একটা বিপদ ঘনিয়ে আসছে। এবং তার মূলে আছে সদ্য কেনা কাঠের বাক্সটা।