২. সকালবেলাটা আজ বেশ ভালই ছিল

সকালবেলাটা আজ বেশ ভালই ছিল। দিব্যি পুবদিকে হাসি-হাসি মুখ করে সুয্যিঠাকুর উঠি-উঠি করছিলেন। উলটোদিকের বাড়ির গবাক্ষবাবু দাঁতন করতে করতে বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। আর গলাখাঁকারি দিচ্ছিলেন। পাশেই তাঁর ভাই অলিন্দবাবু নিজের দোতলা বাড়ির বারান্দায় ডনবৈঠক করছিলেন। নবাবগঞ্জে নবাগত জ্ঞানপাগলা মাথায় একটা রঙিন টুপি পরে নরহরিবাবুর বাড়ির বাইরের সিঁড়িতে বসে গম্ভীর মুখে কী যেন ভাবছিল। আর নরহরিবাবু নিজে বাইরের ঘরে বসে জুত করে তাঁর প্রিয় জলখাবার মুড়ি আর নারকেল কোরা খেতে খেতে ভারী আরাম করছিলেন।

ঠিক এই সময়ে সজনীবাবু প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন দেখে নরহরি ভদ্রতাবশে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে একগাল হেসে বলেছিলেন, “পেন্নাম হই সজনীবাবু, প্রাতর্জমণে বেরিয়েছেন বুঝি!”

সজনীবাবু খুবই রাশভারী মানুষ। কেউ কিছু বললে বা জিজ্ঞেস করলে হুঁ হাঁ দিয়ে জবাব সারেন। বেশি কথা কন না। আজ হঠাৎ কী হল কে জানে। দাঁড়িয়ে একবার অপাঙ্গে নরহরিবাবুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “ওঃ নরহরিবাবু। তা কী খবর?”

নরহরিবাবুর হাতে তখনও মুড়ির বাটি, গালের মুড়িক’টা তাড়াতাড়ি চিবোতে চিবোতে বললেন, “আজ্ঞে ভাল। খবর বেশ ভাল।”

“মুড়ি খাচ্ছেন বুঝি? বাঃ, বেশ।”

মুড়ির বাটিটা হাতে নিয়েই বেরিয়ে এসেছেন দেখে নরহরিবাবু ভারী লজ্জা পেয়ে বললেন, “এই চাট্টি খাচ্ছিলাম আর কি!”

“বেশ, বেশ। তা আপনি তো অভয় বিদ্যাপীঠে বাংলাই পড়ান!?”

“যে আজ্ঞে।”

“আচ্ছা, কাল থেকে একটা শব্দের মানে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি কি বলতে পারেন কল্যবর্ত’ কথাটার মানে কী?”

বিনা মেঘে বজ্রপাত আর কাকে বলে? কল্যবর্ত শুনেই মুখের মুড়িটা বিস্বাদ ঠেকতে লাগল। ভাবলেন, কলা দিয়ে মুড়িটা মেখে খেতে বলছেন কি না। মুড়িতে কলা মেখে বেশ একটা আবর্তের সৃষ্টি করেই কি কল্যবর্ত হয়?

সজনীবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, “আচ্ছা চলি।” সেই থেকে সকালটাই মাটি। সজনীবাবুর প্রশ্নটা গবাক্ষবাবু শুনতে পেয়েছেন, কারণ তাঁর দাঁতন থেমে গেছে। অলিন্দবাবুও শুনেছেন, কারণ বৈঠকি ছেড়ে তিনি রেলিঙের ওপর দিয়ে বুকে নরহরিবাবুর দুর্দশা দেখছেন। শুধু জ্ঞানপাগলাই যা নির্বিকার।

নরহরিবাবু ঘরে এসে মুড়ির বাটিটা নামিয়ে রেখে বিরস মুখে গিন্নিকে বললেন, “না, চাকরিটা গেল।”

“কেন, চাকরি গেল কেন? এই সাতসকালে কারও চাকরি যায় বলে তো শুনিনি বাপু!”

“আর সকাল-বিকেলের হিসেব করে কী হবে? চাকরিটা নেই বলেই ধরে নাও। এর পরেও কি আর কারও চাকরি থাকে?”

“কী হয়েছে সেটা বলবে তো!”

“সজনীবাবু প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, দোষের মধ্যে আমি তাঁকে কুশল প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। উনি উলটে আমাকে এমন একটা শক্ত শব্দের মানে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমি হাঁ হয়ে গেলাম। চাকরিটাও তো করি ওঁরই ইস্কুলে, অভয় বিদ্যাপীঠ সজনীবাবুর বাবার নামে। উনিই সর্বেসর্বা।”

“কীসের মানে বলতে পারোনি শুনি।”

“সে আর শুনে কী করবে। জন্মেও অমন শব্দ শুনিনি। কল্যবর্ত।”

গিন্নি চোখ কপালে তুলে বললেন, “ওমা! এই সোজা শব্দটার মানে বলতে পারোনি! কলাভর্তা মানে তো কলা সেদ্ধ!”

নরহরি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “কলাভর্তা নয় গো, কল্যবর্ত।” গিন্নি বললেন, “এ তো আরবি ফার্সি শব্দ বলে মনে হচ্ছে। তা অত ভেঙে পড়ার কী আছে! ডিকশনারিতে অমন শক্ত শক্ত শব্দ অনেক থাকে। সবাই কি আর সব কিছুর মানে জেনে বসে আছে? তুমি মুড়ি খাও তো৷”।

গিন্নির কথায় যুক্তি আছে বটে, কিন্তু তাতে নরহরির তাপিত হৃদয় শান্ত হল না। মুড়ি খাওয়ার চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু গলা দিয়ে নামতেই চাইল না। আর নামবেই বা কী করে! জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন, রাস্তার ওপাশে অলিন্দবাবু তাঁর দোতলার বারান্দা থেকে নীচে তাঁর দাদা গবাক্ষবাবুকে কী যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়েই বলছেন। জানলার কাছে এগিয়ে গিয়ে নরহরি শুনতে পেলেন, অলিন্দবাবু উত্তেজিতভাবে বলছেন, “এঃ, এই ইস্কুলে আর ছেলেটাকে পড়ানো যাবে না দেখছি। বাংলার মাস্টার যখন এমন সোজা শব্দটার অর্থ বলতে পারল না তখন ইস্কুলের অবস্থা তো বুঝতেই পারছ!”

“তা আর বলতে। শব্দটা কী যেন! ওই সময়ে একটা কাক এমন কা করে ডেকে উঠল যে, শুনতে পাইনি।”

“শোনোনি? আরে কল্যবর্ত, কল্যবর্ত।”

“অ। তা এ তো বেশ সোজা জিনিস। আমারই ভারী চেনা-চেনা ঠেকছে। মানেটা পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”

“আরে কল্যবর্ত হচ্ছে এক ধরনের মর্তমান কলা। অ্যাই বড়বড় সাইজের হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকে তো কল্যবর্তের ঝাড়।”

জ্ঞানপাগলা খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, “পারেনি, পারেনি। মানে বলতে পারেনি।”

পাগলাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানী লোক থাকে। বলতে কী, পৃথিবীর অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষকে সাধারণ বিচারে পাগল বলেই মনে হয়। কার ভেতরে কী আছে বলা তো যায় না!নরহরিবাবু তাই চাপা গলায় ডাকলেন, “ওরে জ্ঞানপাগলা! ও জ্ঞানবাবাজি! একটু ইদিকে আয় তো!”

জ্ঞানপাগলা একটু বিরক্তির ভাব করল মুখে, তবে উঠেও এল। জানলার কাছে এসে বলল, “আমার কি খিদে পায় না নাকি? সেই সকাল থেকে বসে বসে কত ভাল-ভাল কথা ভাবছি, কেউ একটু ডেকে একটু জিলিপি কিংবা বোঁদে খেতে বলল না মশাই!”

নরহরিবাবু বললেন, “খাবি বাবা! এই যে, এই যে এক বাটি নারকোল মুড়ি।”

পাগলা গম্ভীর হয়ে বলল, “অন্যের এঁটোকাঁটা খাই না। আমি নয়নগড়ের রাজবাড়ির ছেলে, ভুলে গেলেন নাকি?”

“ওঃ, তাও তো বটে। তুই তো আবার রাজাগজা। তা কী খাবি বাপু বল।”

“পাঁচুর দোকানের কচুরি আর জিলিপি। দুটো টাকা ফেলুন।”

“তা না হয় দিলাম, কিন্তু কল্যবৰ্ত কথাটার অর্থ বলতে পারিস?”

ঠোঁট উলটে জ্ঞানপাগলা বলল, “সেটা আর শক্ত কী? সকালের জলখাবারকেই কল্যবর্ত বলে। দিন, টাকা দুটো দিন।”

ধুস। দুটো টাকাই জলে গেল। জ্ঞানপাগলাকে জিজ্ঞেস করাটাই আহাম্মকি হয়েছে। অত শক্ত শব্দটার কী মানেই না করল ব্যাটা। যাই হোক, দুটো টাকা গচ্চা দিয়ে নরহরি উঠে পড়লেন। বাজারে যেতে হবে।

কিন্তু বাজারে গিয়েও বিপদ। আলুওলা শ্রীদাম তাঁকে দেখেই হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “এই যে মাস্টারমশাই, শুনলুম সজনীবাবু নাকি আজ সকালে আপনার পরীক্ষা নিয়েছেন আর আপনি নাকি ফেলুস মেরেছেন।”

নরহরি প্রমাদ গুনলেন। চাকরি তো গেছেই, এবার প্রেস্টিজও গেল। কথাটা যে এত তাড়াতাড়ি চাউর হয়ে গেছে তা দেখে নরহরি তাজ্জব। আলুটা কিনেই তাড়াতাড়ি বাজার থেকে সটকাবার তালে ছিলেন নরহরিবাবু। কিন্তু হঠাৎ বিপিন উকিল এসে পথ আটকাল।

“এই যে নরহরিবাবু! শুনলুম কল্যবর্ত কথাটার মানে বলতে পারেননি! আর শক্তটা কীসের? কল্য মানে কাল, মানে আগামী কালই ধরুন। আর বর্তমানে বেঁচেবর্তে থাকা। সোজা মানেটা দাঁড়াল, যা বাজার পড়েছে, দিনকালের যা অবস্থা, তাতে আগামী কাল অবধি বর্তে থাকলেই বাঁচি। বুঝলেন?”

“যে আজ্ঞে।”

বিপিনবাবু হেঃ হেঃ করে খুব আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। তাঁর পাশে হঠাৎই আবির্ভূত হলেন যোগেনবাবু। দশাসই চেহারা, একসময়ে ব্যায়ামবীর ছিলেন। একবার প্রতিযোগিতায় মিস্টার নবাবগঞ্জ হয়েছিলেন। এখন নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্যশ্রী ব্যায়ামাগার খুলে ছেলেদের ব্যায়াম শেখান। বিপিন উকিলকে হাত দিয়ে সরিয়ে যোগেনবাবু বললেন, “ভুল শুনেছেন। ওটা হবে কলাপত্র। মানেও খুব সোজা, কলার পাতা।”

নরহরিবাবু অগাধ জলে। যে যা বলছে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কী? তার ওপর যোগেনবাবু ব্যায়ামবীর আর বিপিনবাবু উকিল। তিনি ঘাড় কাত করে বললেন, “যে আজ্ঞে।”

ফেরার সময় নরহরিবাবু আর লোকালয় দিয়ে ফিরলেন না। একটু ঘুরে মাঠ-ময়দান ভেঙে, বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে উদাসভাবে হাঁটতে লাগলেন। তারপর একটা বটতলায় বসে পরিস্থিতিটা ভাবতে লাগলেন। চাকরি গেলে কী হবে তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। সামনে যেন ধুধু মরুভূমি। তার ওপর লোকলজ্জা। অনেক ভেবেচিন্তে হঠাৎ শ্যামাপদ তান্ত্রিকের কথা মনে পড়ে গেল তাঁর।

সজনীবাবু শ্যামা তান্ত্রিকের কথায় ওঠেন বসেন। ময়না নদীর ধারে একখানা কালীমন্দিরও বানিয়ে দিয়েছেন তাকে। শ্যামা তান্ত্রিক সেখানে সাধনভজন করে, মারণ উচাটন করে। তার নাকি পোষা ভূতও আছে। শ্যামা তান্ত্রিকের কাছে গিয়ে হত্যে দিলে এ-যাত্রায় বেঁচেও যেতে পারেন নরহরি! অন্ধকারের মধ্যে একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে নরহরি উঠে পড়লেন।

দেদার ঘি-দুধ আর পাঁঠার মাংস খেয়ে শ্যামা তান্ত্রিকের চেহারাটা হয়েছে পেল্লায়। রাগী মানুষ। ভক্তরা ট্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে তেড়ে আসে। তল্লাটে তার বেজায় প্রতাপ, সবাই ভয় খায়। নরহরি যখন গুটি গুটি শ্যামা তান্ত্রিকের ডেরায় হাজির হলেন তখন তাঁর পিলে চমকানোর মতো অবস্থা। মন্দিরের বারান্দায় শ্যামা তান্ত্রিক রক্তাম্বর পরে বসা, কপালে কুটি। সামনে বসা দশ-বারোজন ভক্তের দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বিকট গলায় চেঁচাচ্ছে, “কাঁচ্চা খেয়ে ফেলব, কাঁচ্চা খেয়ে ফেলব বলে দিলাম! নিয়ে আয় ব্যাটাকে ধরে, দেখি তার ধড়ে ক’টা মুণ্ডু আছে! তন্ত্রমন্ত্র দেখাতে এসেছে নবাবগঞ্জে! এখনও তো চেনেনি এই শর্মাকে! এখনও জানে না, এই দশখানা গাঁ জুড়ে গোটা এলাকার ওপর আমার দখল। হুঁ, তারা তান্ত্রিক! তন্ত্রের ব্যাটা জানেটা কী? কিছু নয়, কিছু নয়। পাছে বিদ্যে ধরা পড়ে যায় সেই ভয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ানোর হিম্মত নেই। ব্যাটা গিয়ে জটেশ্বরের জঙ্গলে পুরনো শ্মশানে থানা গেড়েছে। যতসব চোরচোট্টা বদমাশরা গিয়ে জড়ো হয়েছে সেখানে।” শ্যামা তান্ত্রিকের মেজাজ দেখে সবাই তটস্থ। শ্যামা হঠাৎ হুঙ্কার ছাড়ল, “তোমরা কেউ যাও নাকি ওখানে?” সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “আজ্ঞে না।”

“খবর্দার যাবে না। ও জোচ্চোর লোক, ভুলভাল মন্তর পড়ে তোমাদের সর্বনাশ করে ছাড়বে। বুঝেছ?”

সবাই বলে উঠল, “যে আজ্ঞে।” তারা তান্ত্রিকটা কে তা নরহরি জানেন না। তবে এটা বুঝতে কষ্ট নেই যে, জনৈক তারা তান্ত্রিকের সঙ্গে শ্যামা তান্ত্রিকের একটা অদৃশ্য লড়াই চলছে। কথায় বলে ঠেকায় পড়লে বুদ্ধি খোলে, নরহরির মাথাতেও একটা দুষ্টবুদ্ধি চিড়িক দিয়ে উঠল। তিনি ভক্তদের মধ্যে বসে পড়ে হাতজোড় করে বললেন, “আজ্ঞে আমাকেও লোকে টানাটানি করেছিল বটে তারা তান্ত্রিকের কাছে যাওয়ার জন্য।”

শ্যামা তান্ত্রিক বজ্রপাত ঘটানোর মতো গলায় হুঙ্কার ছাড়ল, “বটে! বটে! কার এত বুকের পাটা?”

“কিছু পাজি লোক। তবে আমি যাইনি। ভাবলুম আমাদের শ্যামা মহারাজ থাকতে তারা তান্ত্রিকের কাছে যাব কেন! ওস্তাদ থাকতে আনাড়ির কাছে কেউ যায়?”

শ্যামা তান্ত্রিক একটু নরম হল। গলা এক পরদা নামিয়ে বলল, “তুই অভয় ইস্কুলের মাস্টার না?”

“যে আজ্ঞে বাবা। বড় বিপদে পড়ে এসেছি।”

“আরে বিপদে পড়েই তো লোকে আমার কাছে আসে। আমি হলুম বিপত্তারণ। তা তোর বিপদটা কীসের?”

“আজ্ঞে চাকরি যায় যায়।”

“কেন, কেন, চাকরি যাবে কেন?”

একজন ভক্ত ফস করে বলে উঠল, “আজ্ঞে, উনি কৈবল্য শব্দের মানে বলতে পারেননি, সেইজন্য সজনীবাবু খুব চটে গেছে।”

“কৈবল্য!” বলে হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হাসল শ্যামা তান্ত্রিক। তারপর হাসি-হাসি মুখেই বলল, “কৈবল্য, কেবল কৈবল্য। কেবলম, কেবলম। কৈবল্য হচ্ছে ওই করাল কালী। কালী কৈবল্যদায়িনী। বুঝলি।”

হাতজোড় করে নরহরি বললেন, “আজ্ঞে বুঝেছি। তবে কথাটা কৈবল্য নয়, কল্যবর্ত।”

“কী, কী বললি?”

“আজ্ঞে, কল্যবর্ত।”

“কল্যবর্ত।” আবার হাঃ হাঃ অট্টহাসি হেসে শ্যামা তান্ত্রিক বলল, “ঘুরছে, ঘুরছে, সব ঘুরছে। বুঝলি? স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জুড়ে ঘুরছে, বিঘূর্ণিত হচ্ছে মহাকাশ। সত্য-স্রেতা-দ্বাপরকলি সব চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে ওই কাল। মহাকাল। কালের আবর্ত রে, মহাকালের ঘূর্ণিঝড়। আর তাকেই বলে কল্যবর্ত। বুঝেছিস?”

“আজ্ঞে, আপনি মহাজ্ঞানী। এবার জলের মতো বুঝেছি।”

“হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।”

“কিন্তু চাকরিটা গেলে যে মহাকালের ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাব মহারাজ।”

শ্যামা তান্ত্রিক দুলে দুলে একটু হেসে বলল, “পারবে ওই তারা জোচ্চোর এর মানে করতে? কেন যে লোকে ঠকবাজটার কাছে যায়। এবার ওকে কাঁচ্চা খেয়ে নেব। অনেক সহ্য করেছি, আর নয়।”

নরহরি কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “খুব ভাল হয় তা হলে মহারাজ।”

শ্যামা তান্ত্রিক তাঁর দিকে একটু কুটিল নয়নে চেয়ে বলল, “খবর্দার, ওই তারা জোচ্চোরটার কাছে যাস নে। আমি সজনীকে বলে দেব’খন তোর চাকরিটা যাতে বজায় থাকে।”

পাঁচখানা টাকা প্রণামী দিয়ে নরহরি উঠে পড়লেন। বুকে একটু বল পাচ্ছেন এখন।

মনটা ভাল নেই। কথাটা চারদিকে রটে গেছে। ইস্কুলেও এই নিয়ে কথা হবে, ছাত্ররা দুয়ো দেবে। তবু বাড়ি ফিরে নেয়ে-খেয়ে নরহরি ইস্কুলেও গেলেন। আর যাই হোক, ফাঁসি তো আর হবে না।

যা ভয় করেছিলেন, তাই হল। ইস্কুলে পা দিতে-না-দিতেই দফতরি ফটিক এসে বলল, “হেডমাস্টারমশাই থমথমে মুখ করে আপনার জন্য বসে আছেন। ঘরে মেলা লোক জড়ো হয়েছে। আপনার ফাঁসির হুকুম না হয়ে যায় আজ! যান, শিগগির যান।”

নরহরির পা দুটো কাঁপতে লাগল, বুকে ধড়ফড়ানি। চোখে হলুদ-হলুদ ফুলও দেখতে লাগলেন। তবু মরিয়া হয়ে বুক ঠুকে এগিয়েও গেলেন। মরতেও তো একদিন হবেই।

হেডসারের ঘরে মাস্টারমশাইরা জড়ো হয়েছেন। জনাচারেক অভিভাবক বসে আছেন। সকলের মুখেই আষাঢ়ের মেঘ।

তেজেনবাবু নরহরিকে দেখে বললেন, “বসুন। আপনার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এসেছে। কয়েকজন অভিভাবক দরখাস্ত করেছেন আপনাকে বরখাস্ত করার জন্য। আপনি নাকি কী একটা শব্দের অর্থ সজনীবাবুকে বলতে পারেননি।”

নরহরি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, কল্যবর্ত।”

তেজেনবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “পৃথিবীর সেরা পণ্ডিতরাও সব শব্দের অর্থ জানেন না। যাই হোক, অভিভাবকরা কেউ কি শব্দটার অর্থ জানেন?”

অভিভাবকরা একটু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিলেন। নৃপেন বৈরাগী বললেন, “এর মানে হচ্ছে ইয়ে আর কি। ওই যে–যাকে বলে–”

আর এক অভিভাবক সুধীর বৈষ্ণব বললেন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তো–খুব সোজা মানে, ওটা হচ্ছে গিয়ে–”

তৃতীয় অভিভাবক হরিপ্রিয় দাস বললেন, “আরে কলিকালের শেষ যখন হয় তখনই হয় কল্যবর্ত।”

তেজেনবাবু গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “আপনারা বসুন, দক্ষিণাবাবুকে লাইব্রেরি থেকে বাংলা অভিধান আনতে পাঠিয়েছি। তিনি এলেন বলে।”

কথা শেষ হতে না-হতেই হন্তদন্ত হয়ে দক্ষিণাবাবু এসে ঢুকলেন। হাতে মহাভারতের সাইজের অভিধান। ঢুকেই বললেন, “অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য!”

তেজেনবাবু বললেন, “অবিশ্বাস্যটা কী?”

“আজ্ঞে, এরকম একটা শক্ত শব্দের অর্থ যে এত সোজা সেটাই অবিশ্বাস্য।”

“মানেটা তো বলবেন।”

“কল্যবর্ত মানে হচ্ছে প্রাতরাশ, অর্থাৎ সকালের জলখাবার। ব্রেকফাস্ট।”

সবাই হাঁ হয়ে থাকলেন।

তেজেনবাবু মুচকি একটু হেসে অভিভাবকদের দিকে চেয়ে বললেন, “শুনলেন তো! আমি নরহরিবাবুর কোনও দোষ দেখছি না। শব্দটার অর্থ আপনাদের মতো আমাদেরও জানা ছিল না। এবার আপনারা আসুন গিয়ে।”

অভিভাবকরা ঠেলাঠেলি করে বেরিয়ে গেলেন। তেজেনবাবু মাস্টারমশাইদের দিকে চেয়ে বললেন, “আপনারা সবাই যে যার ক্লাসে যান। নরহরিবাবুর ব্যাপারটা নিয়ে ছাত্ররা যাতে আলোচনা না করে সেদিকে লক্ষ রাখবেন।”

সবাই চলে গেলেও নরহরিবাবু বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন।

তেজেনবাবু বললেন, “আপনি ঘাবড়াবেন না। সজনীবাবু প্রকাশ্যে আপনাকে শব্দটার অর্থ জিজ্ঞেস করে অন্যায় করেছেন। আমরা আপনার পক্ষেই আছি। তবে সজনীবাবু খামখেয়ালি লোক, তাঁর প্রতাপও দোর্দণ্ড। তিনি কী করবেন তা জানি না।”

নরহরিবাবু সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন, “তেজেনবাবু একটা কথা।”

“কী কথা?”

“কল্যবর্তমানে যে সকালের জলখাবার, এটা জ্ঞানপাগলা আমাকে বলে দিয়েছিল।”

“অ্যাাঁ, বলেন কী! পাগলাটা জানল কী করে? আমরাই জানতাম না।”

“তাই তো ভাবছি।”