॥ ২ ॥
রাত্রে দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে সকালে সাড়ে ছটায় উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে বক্সারে ব্রেকফাস্ট খেলাম। মোগলসরাই আসবে পৌনে ন’টায়। লাঞ্চ খাবো প্রতাপগড়ে সাড়ে বারোটার সময়।
জয়ন্তবাবু দেখলাম খুব সকালেই ওঠেন। ব্রেকফাস্ট খেয়ে বললেন, ‘কাছেই কুপেতে আমার এক চেনা ভদ্রলোক রয়েছেন, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।’
লালমোহনবাবুও স্নানটান করে দাড়ি কামিয়ে একেবারে ফিটফাট। উনি ‘বিক’ রেজার দিয়ে দাড়ি কামান। এগুলো বার তিন-চার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়। কলকাতায় পাওয়া যায় না। লালমোহনবাবুর এক বন্ধু কাঠমাণ্ডু থেকে ওঁর জন্য চার প্যাকেট অর্থাৎ কুড়িটা এনে দিয়েছেন। বললেন, ‘ভারী আরামে শেভ করা যায় মশাই।’
ফেলুদা বলল, ‘দু’ মাস পরে ত আবার দিশি ব্লেডে ফিরে যেতে হবে।’
ভদ্রলোক একগাল হেসে বললেন, ‘নো স্যার। দাড়ি কামানোর ব্যাপারে আমি একটু লাক্সারি পছন্দ করি। আমি নিউ মার্কেট থেকে উইলকিনসন ব্লেড কিনি।’
‘সে ত অনেক দাম।’
‘সংসার করিনি, টাকা কার জন্যে জমাবো বলুন ত? তাই নিজের পেছনেই খরচ করি।’
‘আমাদের পেছনেও কম খরচ হয় না আপনার। আপনার গাড়ি আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি।’
‘মশাই, তিনজনের একজন মাস্কেটিয়ারের গাড়ি আর দু’জন চড়বে না—এ কেউ শুনেছে কখনো?’
ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বাইরের প্যাসেজে পায়চারি করতে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে বলল, ‘এক নম্বর কুপেতে জয়ন্তবাবু তাঁর আলাপীর সঙ্গে দিব্যি গপ্পে মেতে আছেন। ইংরিজিতে কথা হচ্ছে, অর্থাৎ ভদ্রলোক অবাঙালি। দেখে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বলে মনে হল, যদিও রং আমাদেরই মতো।’
‘কী কথা হচ্ছে শুনতে পেলেন নাকি?’ জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
‘আলাপী বললেন, “আই গিভ ইউ জাস্ট থ্রি ডেজ।” এর বেশি আর কিছু শুনিনি।’
‘কথাটা কি হুমকি বলে মনে হল?’
‘ট্রেনের শব্দের জন্য গলা তুলতে হয় বলে সব কথাই হুমকির মতো শোনায়।’
একটু পরেই জয়ন্তবাবু তাঁর আলাপীকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের কামরায় এসে ফেলুদাকে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। দিস ইজ মিঃ সুকিয়াস—এ ওয়েলনোন বিজনেসম্যান অফ লাক্নাউ। তা ছাড়া আর্টের সমঝদারও বটে।’
সুকিয়াস ইংরিজিতে বললেন, ‘আশা করি আমাদের আবার লখ্নৌতে দেখা হবে। মিঃ বিসওয়াস আমার অনেকদিনের পুরানো বন্ধু।’
সুকিয়াস চলে গেলেন। জয়ন্তবাবু তাঁর বার্থের আধখানা দখল করে বসলেন। বাকি আধখানায় যথারীতি ফেলুদা বসেছে।
ফেলুদা জয়ন্তবাবুকে উদ্দেশ করে বলল, ‘আপনার শাশুড়ির আসল নাম বলছিলেন ভার্জিনিয়া রেনল্ড্স। এই রেনল্ড্স পরিবার কবে থেকে আছে ভারতবর্ষে?’
জয়ন্তবাবু বললেন, ‘ভার্জিনিয়ার ঠাকুরদাদা জন রেনল্ড্স ভারতবর্ষে আসেন ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে। তখন তাঁর বয়স উনিশ। তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেন। ১৮৫৭-র সেপাই বিদ্রোহের সময় তিনি লখ্নৌতে পোস্টেড ছিলেন। যুদ্ধে যথেষ্ট বীরত্বের পরিচয় দিয়ে একেবারে শেষদিকে সেপাইদের কামানের গোলায় প্রাণ দেন। তাঁর ছেলে টমাসও বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন। তিনি উর্দু শিখে একদম ভারতীয় বনে গিয়েছিলেন। রাজার হালে থাকতেন। নিজের বাড়িতে রেগুলার বাঈনাচের আয়োজন করতেন। ফরসিতে তামাক খেতেন, পান খেতেন, আতর মাখতেন। এমনকী মাঝে মাঝে দিশি পোশাকও পরতেন। অবশেষে তিনি ফরিদা বেগম নামে এক কথক নাচিয়েকে ভালোবেসে ফেলে তাকে বিয়ে করেন। বাড়িতে মুলসমান কেতা চালু ছিল। লোকে টমাসকে বলত “টমাস বাহাদুর”। টমাসের প্রথমে দুটি ছেলে হয়, নাম এডওয়ার্ড আর চার্লস। এরাও ছেলেবেলা থেকেই উর্দু বলত। এরা কেউই আর্মিতে যোগ দেয়নি। এডওয়ার্ড উকিল হয়, আর চার্লস আসামের চা-বাগানে ম্যানেজারি করতে চলে যায়। সে আর লখ্নৌতে ফেরেনি। টমাসের তৃতীয় সন্তান অবশ্য ছিল ভার্জিনিয়া। উনি ছেলেবেলা থেকেই উর্দু আর ইংরিজি একসঙ্গে শিখেছিলেন। গায়ের রংটা ছিল সাহেবের মতো ফরসা, কিন্তু চুল আর চোখ ছিল কালো। তাই যখন ছবিতে দিশি চরিত্রে অভিনয় করতেন, তাঁকে বেমানান লাগত না।
‘আগেই বলেছি ভার্জিনিয়া একজন বাঙালি ক্রিশ্চানকে বিয়ে করেন। এঁর নাম ছিল পার্সিভ্যাল মতিলাল ব্যানার্জি। আসলে ইনি ছিলেন শকুন্তলার ছবির প্রোডিউসর। ইনিই আমার শাশুড়িকে ছবিতে নামান। স্ত্রীর ছবি থেকে উনি অনেক টাকা করেন। সত্যি বলতে কি, ভার্জিনিয়ার বাবা টমাস নবাবী করে শেষ জীবনে বেশ অর্থকষ্ট ভোগ করেন। তখন ভার্জিনিয়া তাঁর ফিল্মের রোজগার থেকে বাবাকে সাহায্য করেন।
‘পার্সিভ্যাল আর ভার্জিনিয়ার তিনটি সন্তান জন্মায়। বড় এবং মেজো হল মেয়ে, ছোটটি ছেলে। বড়টির নাম মার্গারেট সুশীলা। ইনি যে একজন গোয়ার অধিবাসীকে বিয়ে করেন সে কথা আগেই বলেছি। এঁর নাম স্যামুয়েল সাল্ডান্হা। এনার একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান রয়েছে।
‘দ্বিতীয়া মেয়ে প্যামেলা সুনীলাকে আমি বিয়ে করি ১৯৬০-এ। আমার ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের ব্যবসা আছে। আমার মেয়ের কথা ত আগেই বলেছি। এ ছাড়া আমার একটি ছেলেও আছে। তার নাম ভিক্টর প্রসেনজিৎ। মেয়েটির নাম মেরি শীলা। ছেলেটিকে আমার আপিসে ঢোকাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে রাজি হয়নি। সে নিজের পথে নিজের মর্জিমতো চলে। শীলা দু’বছর হল ইজাবেলা থােবার্ন কলেজ থেকে বি-এ পাশ করেছে। ভালো অভিনয় করতে পারে বাংলা ইংরিজি দুইই। তবে ওর আসল ইন্টারেস্ট হল জার্নালিজমে। দু’ একটা ইংরিজি লেখা কাগজে বেরিয়েছে—বেশ ভালো লেখা।’
ভদ্রলোক ফেলুদাকে একটা সিগারেট অফার করে নিজে একটা ধরালেন। লালমোহনবাবু যে সিগারেট খান না সেটা উনি জানেন।
ফেলুদা বলল, ‘অদ্ভুত ইতিহাস।’
‘হাইলি রোম্যান্টিক’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘শকুন্তলা দেবীর কণ্ঠহারটা কী আপনার স্ত্রী কখনো পরেছেন?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল।
‘দু’-একটা পার্টিতে পরেছেন। তবে সচরাচর ওটা সিন্দুকেই তোলা থাকে। দেখলে বুঝবেন জিনিসটার কী মহিমা।’
‘আমি ত না দেখে থাকতে পারছি না’, বললেন লালমোহনবাবু।
‘আর দিন চারেক ধৈর্য ধরুন’, বললেন জয়ন্তবাবু।