২. লম্বু দানু যে খুব ওস্তাদ ফুটবল খেলোয়াড়

লম্বু দানু যে খুব ওস্তাদ ফুটবল খেলোয়াড় তা নয়। সে ল্যাকপ্যাক করে লম্বা-লম্বা পায়ে ছোটে বটে, কিন্তু ড্রিবল করতে গিয়ে বারবার আছাড় খায় আর হি হি করে হাসে। বলে শট করতে গিয়ে উলটে পড়েও যায়। বেজায় লম্বা বলে তার হেড করা বল সব সময়েই বারের উপর দিয়ে চলে যায়। এসব নানা গোলমাল থাকলেও সে কিন্তু কাজের কাজটা ঠিকই করে দেয়। যখনই দল হারতে বসে তখনই ঠিক লম্বু দানু একটা-দুটো গোল দিয়ে দলকে জেতাবেই কী জেতাবে। আর এই জন্যই রায়পাড়ার শীতলা ক্লাবের সেক্রেটারি কাম কোচ কালীপদ ঘোষ ঠিক করেছেন, দানুকে হবিবপুর গ্রামের ইলেভেন টাইগার্সদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচটায় খেলাবেন। তবে এই নিয়ে একটু বিতর্কও দেখা দিয়েছে। কারণটা হল, দানু শীতলা ক্লাবের মেম্বার তো নয়ই, এমনকী, রায়পাড়ার বাসিন্দাও নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সে পায়েসপুরেও নবাগত। তার বাড়ি প্রতাপগড়ে। বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে পায়েসপুরে এসে জুটেছে। সুতরাং হবিবপুরের ইলেভেন টাইগার্স যদি বুঝতে পারে যে, শীতলা ক্লাব একজন বহিরাগতকে খেলাচ্ছে, তা হলে ম্যাচ বাতিল হয়ে হবিবপুর ওয়াক ওভার পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং দানুকে খেলানো উচিত হবে কি না সেই নিয়ে ক্লাব-কর্তৃপক্ষ এখনও পাকা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

শীতলা ক্লাবের ফুটবল ক্যাপ্টেন প্রাণারাম অবশ্য দানুকে খেলানোর পক্ষে। কারণ, দানু বলতে গেলে তারই আবিষ্কার, মাস দুই আগে একদিন সন্ধেবেলা তার পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে একটা ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ঢ্যাঙা ছেলেকে উঁকি দিতে দেখে সে ভারী চমকে গিয়েছিল। প্রাণারাম চেঁচিয়ে উঠেছিল, “কে! কে রে তুই?”

ছেলেটি বড়-বড় দাঁত বের করে হেসে বলল, “কিছু কাজটাজ করে দিতে হবে?”

“কাজ! কীসের কাজ?”

“যে-কোনও কাজ।”

“কাজ করতে চাস কেন?”

“কাজ করলে চাট্টি খেতে পাওয়া যায়। নইলে তো কেউ খেতে দেয় না। তাই কাজ খুঁজছি।”

শুনে প্রাণারামের একটু দয়া হল। সে চুপিচুপি রান্নাঘর থেকে কয়েকটা রুটি আর একটু গুড় এনে দিল। ছেলেটি বারান্দায় বসে খুব যত্ন করে রুটি খেল। প্রাণারাম বলল, “তুই কী কী কাজ করতে পারিস?”

“যা বলবে সব করে দেব।”

“আমার পিসির বাড়িতে মস্ত একটা ভীমরুলের চাক হয়েছে। কেউ ভয়ে সেটা ভাঙতে পারছে না। ভেঙে দিতে পারবি?”

ছেলেটা ঘাড় কাত করে বলল, “খুব পারব। এ তো সোজা কাজ। আমি অনেক ভীমরুলের চাক ভেঙেছি।”

“ঠিক আছে, কাল সকালে আসিস।” ছেলেটি রাজি হয়ে চলে গেল এবং পরদিন সকালে ঠিক এসে হাজির হল। প্রাণারামের পিসি সরযূদেবী অনাথা বিধবা। ছেলেপুলে নেই। বিরাট বাড়িটায় একা থাকেন।

সরযূদেবীর দোতলার বারান্দায় ভীমরুলের বিশাল চাকটা দেখলে ভয় হওয়ারই কথা। প্রায় দু’ হাত লম্বা আর থামের মতো মোটা মেটে রঙের চাক। সর্বদাই ভীমরুলরা ভনভন করছে চারদিকে। কিন্তু দানু বিন্দুমাত্র ঘাবড়াল না। নারকেলের ছোবড়া জ্বেলে ধোয়া তৈরি করে আধঘণ্টার মধ্যে ভীমরুলদের চাকছাড়া করে দা দিয়ে চাকটা কেটে পুকুরপাড়ে নিয়ে গিয়ে ভেঙে ফেলল।

পিসি ভারী খুশি হয়ে দু’টো টাকা দিতে গেলেন, কিন্তু দানু নিল। বলল, “দুপুরে দুটো ভাত দেবেন, তা হলেই হবে।”

পিসি বললেন, “তা দেব বাবা।”

প্রাণারাম বলল, “ও পিসি, দানু তো বাপে তাড়ানো ছেলে! ওকে তোমার কাছেই রেখে দাও না কেন?”

পিসি একটু সন্দিহান হয়ে বললেন, “চোরাচোড় নয় তো?”

কথাটা দূর থেকেও কী করে যেন শুনতে পেল দানু। একগাল হেসে বলল, “না পিসি, আমি চোরাচোড় নই। ঘরদোরে থাকতে না দেন তো নীচের বারান্দাতেই পড়ে থাকতে পারি।”

তা সেই থেকে দানু সরযূদেবীর বাড়িতেই আছে। দেখা গেল, সে খুবই কাজের ছেলে। পিসির চল্লিশ-পঞ্চাশটা নারকেল গাছের পুরুষ্টু নারকোল সব দু’-চারদিনের মধ্যে পেড়ে ফেলল সে। তারপর বিরাট পুকুরের সব কচুরিপানা তুলে ফেলল। বাগান পরিষ্কার করে মাটি কুপিয়ে নতুন গাছের চারা লাগাল। হাটবাজার করা, কাঠ কাটা, কুয়োর জল তোলা, সব কাজেই সে বেশ পোক্ত! কয়েকদিনের মধ্যেই সরযূদেবী তাকে ভারী ভালবেসে ফেললেন। এখন তার দানু ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। একদিন প্রাণারামকে বলেই ফেললেন, “বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছে রে! ছেলেটিকে পুষ্যি নেব কিনা ভাবছি।”

সেদিন শীতলা ক্লাবের সঙ্গে বাবুপাড়ার ওল্ড ফাঁইটার্স ক্লাবের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। কিন্তু শীতলা ক্লাবের দু’-দু’জন বাঘা প্লেয়ারের জলবসন্ত হয়েছে। চিন্তিত প্রাণারাম এসে দানুকে বলল, “হ্যাঁ রে, তুই ফুটবল খেলতে পারিস?”

দানু ঘাড় কাত করে একগাল হেসে বলল, “খুব পারি! একবার চান্স দিয়েই দ্যাখো না!”

উপায় ছিল না বলে সেদিন শীতলা ক্লাবের দলে দানুকে নামানো হল। কিন্তু দানুর খেলা দেখে সবাই হেসেই অস্থির। লম্বা পায়ে তার লগবগ করে দৌড় আর দড়াম-দড়াম করে আছাড় খাওয়া দেখে একবার তাকে বসিয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল প্রাণারাম। মাঠের চারদিকে জড়ো হওয়া দর্শকদের মধ্যে হাসির লহর বইছে। তার মধ্যে অবশ্য গাঁয়ের সবচেয়ে বোকা লোক হরিবন্ধু নফরও ছিলেন। তিনিই শুধু বলেছিলেন, “এই ছেলেটির সঙ্গে মারাদোনার খুব মিল।”

এ কথা শুনে পাশে বসা সুধীরবাবু চটে উঠে বললেন, “এর সঙ্গে মারাদোনার মিল আর বাঘের সঙ্গে খরগোশের মিল একই কথা। মারাদোনা বেঁটে, হোঁতকা, আর এ হল ঢ্যাঙা আর রোগা। তা হলে মিলটা পেলে কোথায়?”

হরিবন্ধু আমতা-আমতা করে বললেন, “তা বটে! তবে একটা কেমন মিলও যেন আছে। পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”

যাই হোক, হাফটাইমের মধ্যেই ওল্ড ফাঁইটার্স শীতলা ক্লাবকে তিন গোল দিয়ে বসল।

হাফটাইমে দানুকে বসিয়ে দেওয়ার কথা উঠতেই কালীপদবাবু বললেন, “তোমরা হয়তো লক্ষ করোনি, দানু খেলা না জানলেও প্রচুর দৌড়তে পারে, আর ল্যাং খেয়েও দমে যায় না। এ দু’টো গুণের জন্য ওকে খেলানোই উচিত হবে। তা ছাড়া আমাদের প্লেয়ারও শর্ট।”

হাফটাইমের পর খেলা শুরু হতেই কিন্তু দেখা গেল, মাঝমাঠ থেকে বল ধরে দানু লম্বা-লম্বা পায়ে দৌড়চ্ছে। বারদুয়েক ল্যাং খেয়ে পড়ে গেল বটে, কিন্তু ফের উঠে দৌড়ে গিয়ে বল ধরে ফেলল। তারপর এর-ওর-তার পায়ের ফাঁকফোকর দিয়ে কী করে যেন ফাঁইটার্সদের গোলে বলটা ঢুকিয়ে দিল। মাঠের চারদিকে হইহই উঠল। এর পরের গোলটা দানুই দিল প্রায় সেই একই ভঙ্গিতে। তবে এবার খুব এঁকেবেঁকে দৌড়ে কয়েকজনকে পাশ কাটিয়ে শেষে হাঁটুর ওঁতোয় গোল। এমন আনাড়ির কাছে গোল খেয়ে ওল্ড ফাঁইটার্সরা খেপে উঠে দানুকে প্রায় ঘিরে ফেলতে লাগল। সে বল ধরলেই চার-পাঁচজন এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ল্যাং মারা, জামা বা হাত ধরে টানা, কনুই দিয়ে পাঁজরে মারা, কিছুই বাকি রাখল না তারা। কিন্তু দানুকে তবু রোখা গেল না। দশ মিনিটের মাথায় সে অনেক দূর থেকে একটা এমন আনতাবড়ি ভলি মেরে বসল যে, সেটা কামানের গোলার মতো গিয়ে ফাঁইটার্সের গোলে সেঁধিয়ে গেল। শোধবোধ। খেলা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে যখন গোল করার জন্য গোটা ফাঁইটার্স দল শীতলা ক্লাবের পেনাল্টি বক্সে উঠে এসেছে, তখন প্রাণারাম হঠাৎ পায়ে বল পেয়ে ফাঁকা জমিতে প্রু বাড়িয়ে দিল, যদি কেউ সেটা ধরে গোল করতে পারে। পারল দানুই। কারণ, সে এত জোরে ছোটে যে, কেউই তার সঙ্গে গতিতে তাল রাখতে পারে না। একা বল ধরে ফাঁকা মাঠে লম্বা পায়ে এক লহমায় গোলের মুখে পৌঁছে গেল দানু। ওদের গোলকিপার ড্রাইভ দিয়ে পানুর পা জড়িয়ে ধরে ফেলে দিল বটে, কিন্তু বলটা ছিটকে গোলে ঢুকেও গেল।

সেই থেকে দানু শীতলা ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড়। যদিও সে পাস দিতে জানে না, ড্রিবল করতে গেলেই পড়ে যায়, নিজের জায়গায় পজিশন নিতে ভুলে যায়, তবু রোজই নানা কিম্ভুত উপায়ে একটা-দুটো গোল ঠিকই দিয়ে দেয়।

একদিন প্রাণারাম দানুকে ডেকে বলল, “দ্যাখ দানু, তোর মধ্যে কিন্তু প্রতিভা আছে। কিন্তু অত আনাড়ির মতো খেলিস কেন? কায়দাকানুন একটু শিখলে হয় না?”

দানু উদাস হয়ে বলল, “কাজ কী শিখে? তুমি তো গোল চাও, সেটা হলেই তো হল!”

“তা বটে! কিন্তু অপোনেন্ট প্লেয়াররা যে তোকে এত ল্যাং মারে, তোর ব্যথা লাগে না? যেদিন মনোজ তোর হাঁটুতে বুট চালিয়েছিল, তাতে মালাইচাকি চৌচির হয়ে যাওয়ার কথা!”

দানু একগাল হেসে বলল, “লাগবে না? খুব ব্যথা লাগে। তবে কী জানো, কষ্ট করে বড় হয়েছি তো, তাই ব্যথা সহ্য করতে পারি। আমার হাড়গোড় খুব শক্ত।”

“তাই দেখছি, ঠিক আছে, তুই তোর মতোই খেলিস।”

আন্তঃজেলা লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হবিবপুরের ইলেভেন টাইগার্সের সঙ্গে তাদের গায়ে খেলতে গিয়েছিল শীতলা ক্লাব। গিয়ে হাজির হতেই হবিবপুরের লোকেরা এসে একজনেরই খোঁজখবর করতে লাগল, “দানু কে? দানু কোথায়? কোন ছেলেটি দানু বলল তো!”

বোঝা যাচ্ছিল, আজ ম্যাচে দানুর কপালে দুঃখ আছে। কালীপদ ঘোষ আর প্রাণারাম মিলে ঠিক করল, আজ দানুকে মাঠে না নামিয়ে রিজার্ভে রাখা হবে। কেন না, আজ ওদের লক্ষ্যই হবে দানুকে মেরে অকেজো করে দেওয়া।

কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই টাইগাররা দুর্দান্ত খেলে দু’টো গোল দিয়ে দিল। আরও দু’টো দিতে পারত, অল্পের জন্য হল না। বিপদ বুঝে হাফটাইমের পর দানুকে নামানো হল। দানু শুধু একবার প্রাণারামকে জিজ্ঞেস করল, “ক’টা গোল করতে হবে বলো তো?”

প্রাণারাম হেসে বলল, “য’টা চাইব ত’টা গোল দিতে পারবি? যা, তা হলে পাঁচ গোল দিস।”

দানু তার স্বভাবসিদ্ধ অষ্টাবক্র মুনির মতো লম্বা শরীর এবং লম্বা-লম্বা পায়ে এমন এঁকেবেঁকে সারা মাঠ জুড়ে দাপাতে লাগল যে, লোকে হাঁ। এবং নামবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একখানা ধাঁই শটে গোল। কিন্তু গোল করার পরও টাইগার্সদের ব্যাক বিপ্লব বুটসুদ্ধ পায়ে দানুর বুকে একটা লাথি জমিয়ে দিতে ছাড়েনি। দানু অবশ্য একটু গড়াগড়ি দিয়ে ফের খাড়া হয়ে তার কাঁকড়ার ভঙ্গিতে খেলা শুরু করে দিল। পাঁচ মিনিটের মাথায় হাফলাইনের কাছ থেকে একখানা রামধনু শট করে বসল দানু। আর সেটা উপরে উঠে গোগাত্তা খেয়ে গোলকিপারের মাথা টপকে গোলে ঢুকল। যথারীতি ফের খেলা শুরু হতেই দানুকে লক্ষ করে চোরাগোপ্তা মার, লাথি, পায়ের ডিমে মারা, মাথায় কনুই দিয়ে ঠুকে দেওয়া, এসব চলতে লাগল বটে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে হল না। বরং দানুকে চার্জ করতে গিয়ে ওদের গোটা দুই প্লেয়ারের ভালরকম চোট হয়ে মাঠ ছাড়তে হল। ফ্রি-কিক থেকে আরও একটা গোল দিল দানু। খেলার শেষ দিকটায় হ্যাঁদানো টাইগার্সদের দম ফুরিয়ে আসছিল। অনায়াসে আরও দু’টো গোল দিয়ে দিল দানু। দলের সবাই এসে জড়িয়ে ধরল দানুকে। প্রাণারাম পিঠ চাপড়ে বলল, “ওঃ, আমার মুখ রেখেছিস!”

কিন্তু রক্ষার আরও বাকি ছিল। নিজেদের ঘরের মাঠে পাঁচ পাঁচটা গোল হজম করা হবিবপুরের মারকুট্টা লোকদের পক্ষে খুব শক্ত ব্যাপার। খেলার শেষে আপ্যায়নের পর তারা যখন একটা খোলা ট্রাকে চেপে ফিরছে, তখন রথতলার কাছে দেখা গেল, পথ জুড়ে একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে। ট্রাকটা থামতেই দু’পাশ থেকে লাঠিসোটা নিয়ে জনাকুড়ি-পঁচিশ ছেলে তেড়ে এসে দমাদম লাঠি আর হকিস্টিক নিয়ে বেধড়ক মারতে শুরু করল তাদের। প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়ে সবাই পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু গুন্ডারা এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে যে, পালানো অসম্ভব। মারের চোটে তাদের প্রাণসংশয়। ঠিক এই সময় লগবগে, রোগা, আপাতনিরীহ দানু কিন্তু ফস করে একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে একাই এমন পালটা মার দিতে শুরু করল, যা অবিশ্বাস্য। লাঠি সেও কম খেল না। কিন্তু সেসব গ্রাহ্য না করে সে এমন লাঠিবাজি করে যাচ্ছিল যে, প্রতিপক্ষ রণেভঙ্গ দিয়ে পালাতে পথ পায় না।

গাঁয়ে ফিরে দানু বীরের সম্মান পেল বটে, কিন্তু তাতে তার বিশেষ হেলদোল নেই। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখিয়ে সে সরযূদেবীর বাড়িতে ফিরে নিজের কাজকর্ম সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

প্রাণারাম এসে বলল, “হ্যাঁ রে দানু, একটা সত্যি কথা বলবি? মাঝে-মাঝে কি তোর উপর কোনও দৈবশক্তি ভর করে? পাঁচ পাঁচটা গোল করলি, সে না হয় হল। কিন্তু কুড়ি-পঁচিশটা ছেলের সঙ্গে লড়াই করলি কী করে?”

দানু নির্বিকার মুখে বলল, “না লড়লে যে মার খেতে হত?”

প্রাণারাম মাথা নেড়ে বলল, “না রে, তুই সোজা লোক নোস। তোর ভিতরে কিছু একটা আছে।”

পায়েসপুরের বীর বলে এতকাল খ্যাতি ও খাতির ছিল বটেশ্বরের। তা বটেশ্বরের চেহারা পেল্লায়। সে তেমন লম্বা নয় বটে, কিন্তু চওড়ায় পুষিয়ে নিয়েছে। সারা শরীরে পেশির বন্যা। বটেশ্বর নড়লেই শরীরের গোল্লা-গোল্লা পেশি পান্তুয়ার মতো ভেসে ওঠে। বীরত্বের কাজ সে এখনও তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু দরকার পড়লে যে করবে, সেই ভরসা গায়ের মানুষদের আছে। সে মোটা-মোটা লোহার রড বাঁকাতে পারে, এক প্যাকেট তাস দু’ হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, তিন-চার মন ওজন তুলতে পারে। দানুর কীর্তি-কাহিনি শুনে সে নাক সিটকে বলল, “ওই হাড়গিলে ছেলেটা। দুর-দুর, ও আবার কী মারপিট করবে? আমি জোরে ফুঁ দিলেই তো উড়ে যাবে!”

হারাধনবাবুকে এক হিসেবে দেশপ্রেমিক বলা যায়। তিনি অবশ্য ভারতবর্ষের খবরাখবর তেমন জানেন না, প্রদেশ বা জেলা বা এমনকী মহকুমা নিয়েও তার তেমন মাথাব্যথা নেই। তার মতে পায়েসপুরই হচ্ছে পৃথিবীর সেরা জায়গা। কাজেই পায়েসপুরের গৌরবেই তিনি সর্বদা গৌরবান্বিত। সর্বদাই তিনি সকলকে পায়েসপুরের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই পায়েসপুরেই নাকি একদা রাজা মানসিংহের সৈন্যরা আমবাগানের ছায়ায় জিরিয়েছিল, আর তাদের ঘোড়াগুলো জল খেয়েছিল ময়নামতীর দিঘিতে। গোরাদের আমলে দু’জন সাহেবও নাকি পায়েসপুরের বিখ্যাত ডাকাত বিষ্ণু বাগদিকে গ্রেফতার করতে আসে। তারা কবুল করে গিয়েছিল যে, এরকম ডাকাবুকো ডাকাত তারা কস্মিনকালেও দেখেনি। প্রতাপগড়ের গৌরবের আমলে রাজা বীরবিক্রম নাকি এই পায়েসপুরের চাটাইয়ের খুব সুখ্যাতি করেছিলেন। এক সময় পায়েসপুর নাকি মিষ্টি কুমড়োর চাষে ভারতবর্ষের এক নম্বর ছিল এবং মেটে কলসি তৈরিতে এই পায়েসপুরের মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কেউ এঁটে উঠত না। ইতিহাসবিত হয়ে আছে এই গাঁয়ের অতি বিচক্ষণ চোর সর্বেশ্বর। আর পণ্ডিত বিনোদবিহারীর নামও সবাই জানে। যিনি বাংলা ব্যাকরণ ‘দীপশিখা’ লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এ গাঁয়ের এখনকার গৌরবও বড় কম নয়। বনমালীবাবু এত ভাল ইংরেজি জানতেন যে, গোরা ম্যাজিস্ট্রেট নাকি বলেছিলেন, ‘বনমালী কাছে থাকলে কারও ডিকশনারি খোলার দরকার হয় না। বনমালীবাবু আটানব্বই বছর বয়সে এখনও বেঁচে আছেন। এ গাঁয়েরই রায়পাড়ার বাসব নন্দী কেশবপুরের জমিদারের ছোট মেয়ের বিয়েতে আশিটা রসগোল্লা খেয়ে যে খবরের কাগজে নাম তুলেছিল, সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। খবরের কাগজের কাটিং হারাধন যত্ন করে ফাঁইলে রেখে দিয়েছেন। হারাধন বিশ্বাস করেন বটেশ্বর একদিন ‘ভারতী’ এবং তারপর ‘বিশ্বশ্রী’ হয়ে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাই তিনি প্রায়ই বটেশ্বরকে তাড়না করেন, “ওহে, উঠে পড়ে লাগো তো! বুক ফুলিয়ে গিয়ে বিশ্বশ্রী হয়ে ইউ এন ও-তে পায়েসপুরের নিশান উড়িয়ে দিয়ে এসো!”

বোকা হরিশঙ্কর একটু ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “পায়েসপুরের কি আলাদা নিশেন আছে হারুখুড়ো?”

হারাধন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “তা থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সেই ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ওরে, নিশেন তৈরি তো আর শক্ত নয়। তিন টুকরো রঙিন কাপড় জুড়লেই একটা নিশেন খাড়া করা যায়। শক্ত কাজ হল সেটাকে বিশ্বের বুকে উড়িয়ে আসা। আর বটেশ্বর সেটা ঠিক পারবে। যে হারে মাসলগুলো দিন কে-দিন কিলবিলিয়ে উঠছে, তাতে একদিন নোবেল প্রাইজও এনে ফেলবে, দেখিস!”

গোবিন্দ অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু খেলাধুলো বা স্বাস্থ্যের জন্য তো নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় না!”

হারাধন গলা তুলে বললেন, “কে বলল দেওয়া হয় না? এই যে সেদিন নর্মদাদিদির হাতের রান্না নিমসুক্তো আর চাপড় ঘণ্ট খেয়ে তার নাতজামাই বলে গেলেন, আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত! সে কী কঁকা কথা? সেই নাতজামাই কোন ইউনিভার্সিটির যেন প্রোফেসর। তিনি কি না জেনে বলেছেন? তা রান্নাবান্নায় যদি নোবেল থাকে, তা হলে স্বাস্থ্যের খাতেও আছে।”

গোবিন্দ একটু মিইয়ে গিয়ে বলল, “সেরকমই যেন শুনেছিলাম।”

তা বটেশ্বরের এত বড় ভক্ত হারাধনবাবু দানুর বীরত্বের কথা শুনে দানুর দিকে একেবারে ঢলে পড়েছেন। ঘটনার পরদিনই গিয়ে দানুকে বলে এসেছেন, “বুঝলি দানু, উনিশশো বত্রিশ সালে এ গাঁয়ের রমেশ কুমোর হাত দিয়ে বাঘ মেরেছিল, আর তারপর এই তুই। পায়েসপুরের ইজ্জত রেখেছিস, মুখোজ্জ্বল করেছিস। এবার অলিম্পিকের জন্য তৈরি হ’। পায়েসপুর তোর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে বাবা!”

বীরেশ বলল, “তা কী করে হবে? ও তো পায়েসপুরের ছেলে নয়? ওর বাড়ি প্রতাপগড়ে।”

হারাধন খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “বললেই হবে প্রতাপগড়ে? সেখান থেকে তো ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পায়েসপুরের সম্মান রাখতে দরকার হলে আমি ওকে পুষ্যি নেব।”

সময়টা খারাপই যাচ্ছে বটেশ্বরের। এই কদিন আগেও রাস্তায় বেরোলে আশপাশের লোকেরা কথা থামিয়ে হাঁ করে চেয়ে দেখত। হাটেবাজারে লোকজন বিকিকিনি থামিয়ে এ-ওকে ডেকে দেখাত, ‘ওই দ্যাখ, বটবৃক্ষ যাচ্ছে!’ পানুবাবুর সঙ্গে পথে দেখা হলেই বিগলিত হাসির সঙ্গে হেঁ-হেঁ করতে-করতে আর হাত কচলাতে কচলাতে পানুবাবু বলতেন, “হে-হেঁ, কী স্বাস্থ্য! কী স্বাস্থ্য! দেখলেও চোখ সার্থক। হে-হেঁ, কী পেশিই বানিয়েছেন বটুবাবু, যেন জলের মধ্যে মাগুরমাছ খেলে বেড়াচ্ছে। হেঁ-হেঁ, এই যে এত মাসলের বোঝা নিয়ে হেঁটেচলে বেড়ান, একটু ভারী-ভারী লাগে না?”

তা বটেশ্বরের সেই স্বণযুগ আর নেই। বটেশ্বর এখনও রাস্তায় বেরোয় বটে, কিন্তু লোকজন তাকে যেন তেমন লক্ষই করে না। বরং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হাটেবাজারে বটেশ্বরকে দেখা তো দূরের কথা, সেদিন একটু কাঁচালঙ্কা ফাউ চেয়েছিল বলে লঙ্কাওয়ালা এমন খ্যাক করে উঠল যে, বটেশ্বর ভারী অপমানিত বোধ করেছিল। বটেশ্বর বুঝতে পারছে যে, পায়েসপুরে তার একচ্ছত্র আধিপত্য আর নেই। আর এসবের মূলে ওই ল্যাকপ্যাকে, হাড়গিলে চেহারার ঢ্যাঙা দানু। এই যে তার একনিষ্ঠ ভক্ত পানুবাবু, দেখা হলে আজকাল আর হাসি নেই, বিস্ময় নেই, হে-হেঁ পর্যন্ত নেই। মুরুব্বির মতো একটু ঘাড় হেলিয়ে গম্ভীর গলায় শুধু বলেন, “চালিয়ে যান বটুবাবু।”

দুঃখী বটেশ্বর তাই বিকেলের ব্যায়াম-ট্যায়াম সেরে এক সন্ধেবেলা মাঠের ধারে একা-একা বসে দুঃখের কথাই ভাবছিল। দানু ফুটবল খেলা জানে না, অথচ গোল দেয়। তার চেহারা ল্যাকপ্যাকে হলেও গায়ের জোরে কেউ তার সঙ্গে পারে না। সে দু’দিনে তিরিশ-চল্লিশটা গাছের সব ফল পেড়ে ফেলতে পারে। একদিনে বিরাট পুকুরটার সব কচুরিপানা তুলে ফেলে। এসব হচ্ছেটা কী? ভগবানের এ কী অবিচার রে বাবা! সে এত কষ্ট করে বুকডন-বৈঠকি মেরে, বারবেল-ডাম্বেল-মুগুর ভেঁজে মাল ফোলাল, আর বীরের সম্মান পেয়ে গেল হাড়গিলে ঢ্যাঙা দানু! তা হলে ব্যায়ামট্যায়াম করে লাভ হল কী?

আকাশে মেঘটেঘ ছিল না, দুযোর্গের কোনও আভাসও নেই। কিন্তু হঠাৎ একটা বিকট বজ্রপাতের শব্দে আঁতকে উঠে বটেশ্বরের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল সে। চোখ চেয়ে দেখল, সামনে এক বিভীষিকা দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল লম্বা-চওড়া চেহারার রক্তাম্বর পরা এক সাধু। হাতে পেল্লায় ত্রিশূল, মাথায় জটাজুট, ঘন দাড়ি-গোঁফ, গলায় রুদ্রাক্ষ, আর চোখ দু’খানা অন্ধকারেও জ্বলছে। তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে দেখে বটেশ্বর একটু কুঁকড়ে গেল। ফের বজ্রকণ্ঠে সাধু বলে উঠল, “তুই! তুই এখানে কী করছিস?”

ভয়ে পেটের ভিতরটা গুড়গুড় করে উঠল বটে, কিন্তু শত হলেও তো বটেশ্বর পায়েসপুরের পয়লা নম্বরের পালোয়ান। তাই সে কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছেন মশাই, বসে হাওয়া খাচ্ছি।”

সাধু অতি বিকট গলায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “হাওয়া খাচ্ছিস? তোর কি হাওয়া খাওয়ার কথা?”

“কেন মশাই, আমি হাওয়া খেলে আপনার অসুবিধে কী? নিজের কাজে যান তো মশাই, মেলা ঝামেলা করবেন না।”

তার তড়পানি দেখে সাধু যেন বিস্ময়ে মূক হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ “তবে রে বেআদব,” বলে তার নড়া ধরে এক হ্যাচকা টানে দাঁড় করিয়ে সপাটে গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা কইছিস যে বড়! কে তোকে ছেড়ে দিয়েছে বল, কোন সাহসে তুই মাঠে-ময়দানে বসে গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছিস?”

চড় খেয়ে বটেশ্বরের চোখে সরষেফুল নাচানাচি করছে, মাথার ভিতরে ঝিমঝিম শব্দ। এ তল্লাটে এমন বুকের পাটা কারও নেই যে, তার গায়ে হাত তোলে। তাই একটু সামলে উঠেই “তবে রে,” বলে বটেশ্বর সাধুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কিন্তু একটা নিরেট দেওয়ালেই যেন ধাক্কা খেয়ে পিছিয়ে এল সে।

সাধু কাঁক করে তার ঘাড়টা ধরে ঠেলতে-ঠেলতে মাঠের উত্তর দিকে নিয়ে যেতে-যেতে বলল, “তোর এখনও অনেক শিক্ষা বাকি আছে দেখছি!”

বটেশ্বর বুঝল, তার এতকালের এত মেহনত, এত কসরত, এত ঘাম ঝরানো সবই বৃথা গিয়েছে। এত ঢেউ খেলানো পেশি, এত ল্যাটিসমাস বাইসেপ, কাফ মাসল, সিক্সপ্যাক নিয়েও এসব কী হচ্ছে? এ যে বাঘের মুখে নেংটি ইঁদুরের মতো দশা তার! সে চিচি করে লোকজন ডাকার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পিছন থেকে সাধু হুড়ুম করে তার মাজায় হাঁটু দিয়ে এমন গুতো মারল যে, বটেশ্বরের বাক্য হরে গেল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, “ও মশাই, ও সাধুবাবা, এ কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমায়? এসব কী হচ্ছে? এর ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে!”

সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, নাডুবাবু মাঠে তার গোক খুঁজতে এসেছেন, কিন্তু বটেশ্বর তাঁকে হাত নেড়ে ডাকতেই তিনি সুট করে গোরুর আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। ঘেসুড়ে রামদীনও তার দুর্দশা দেখে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। প্যালাবাবু শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছিলেন, একেবারে মুখোমুখি দেখা। কোথায় সাধুটার পথ আটকাবি, ধমক চমক চেঁচামেচি করে লোক জোটাবি, তা নয়, একগাল হেসে গদগদ হয়ে বললেন, “সাধুর কাছে মন্তর নিলি বুঝি বটেশ্বর? বাঃ বাঃ, ধর্মকর্ম খুব ভাল জিনিস!” এই বলে চলে গেলেন।

লাঠিধারী নন্দরাম চৌকিদারকে দেখে একটু ভরসা হয়েছিল বটেশ্বরের। কিন্তু উলটে নন্দরাম ভারী ভক্তিভরে হাতজোড় করে “গোর লাগি সাধুবাবা,” বলে সাধুকে গদগদ হয়ে পেন্নাম করে পথ ছেড়ে দিল।

পায়েসপুরের উত্তরে প্রতাপগড়ের গহীন জঙ্গল। সেই জঙ্গল নিয়ে বিস্তর রোমহর্ষক গল্পও আছে। রাতে তো দূরের কথা, দিনেদুপুরেও বড় একটা কেউ জঙ্গলে ঢোকে না। সাধু বটেশ্বরকে নিয়ে সেই জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ঘটনাটা চাউর হতে দেরি হল না। সন্ধেবেলাতেই চণ্ডীমণ্ডপে মেলা লোক জড়ো হয়ে গেল।

রাখোহরি কানে কম শোনে। তার ধারণা, বটেশ্বরকে বাঘে নিয়ে গিয়েছে। খুব চিন্তিত মুখে বলছিল, “কথা হল, বটেশ্বরকে ক’টা বাঘে খাবে? সাতটা বাঘের খোরাক যদি একটা বাঘে খায়, তা হলে কি বড্ড আইঢাই হবে না? কত মাংস বটেশ্বরের?”

নোয়াপাড়ার বজ্ৰবাহু ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বলল, “ওসব অলক্ষুনে কথা কেন দাদা? বাঘ নয়, বটেশ্বরকে এক সাধু নিয়ে গিয়েছে।”

গদাধর ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, “বাঘে নিলে আর খারাপ কী হত বলো! সাধুর যা বৃত্তান্ত শুনছি তাতে তো মনে হয়, বটেশ্বরকে হয় শবসাধনায় লাগাবে, নয়তো নরবলি দেবে কিংবা কেটেকুটে নরমাংস খাবে। আরে এই সাধুই তো নগেন সর্বাধিকারীর বাড়িতে কদিন আগে হামলা করেছিল, ওদের টমি কুকুরটা তাড়া করায় তেমন কিছু করতে পারেনি।”

নাডুবাবু ঘটনার সাক্ষী। তিনি রোগা মানুষ। উঠে দাঁড়িয়ে জমায়েত লোকজনের সামনে বললেন, “আহা, আমিই তো ছেলেধরাটার হাত থেকে বটেশ্বরকে উদ্ধার করতে পারতাম। কিন্তু এক হাতে গোরুর দড়িটা ধরা ছিল বলে হয়ে উঠল না। তবে একথা ঠিক যে, সেই বিভীষণ সাধুর হাতে পড়ে বড়ই নাকাল হচ্ছিল বটেশ্বর। ওর ভবিষ্যৎ বিশেষ উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে না।”

প্যালাবাবু ভারী বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “তা হলে তোমরা বলতে চাও যে, বটেশ্বরের বৈরাগ্য আসেনি? আমি তো ভেবেছিলুম সংসার-বৈরাগ্য আসায় বটেশ্বর সাধুর হাত ধরে সন্ন্যাসে যাচ্ছে! অপহরণ বলে বুঝতে পারলে কী আর সাধুব্যাটা পারত আমার হাত থেকে পালাতে?”

রামদীন মাথা চুলকোতে-চুলকোতে বলল, “সাধুজি বটেশ্বরবাবুকে পাকড়ে নিয়ে যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আমি শোচলাম কী, বটেশ্বরবাবু দুই মুক্কা মেরে সাধুকে জমি ধরিয়ে দিবেন। আমি দুবলা মানুষ, জিন্দেগিতে কখনও মারপিট করিনি, উসি লিয়ে আমি আঁখে ঘুরিয়ে নিলাম।”

খগেন তপাদার নন্দরামের দিকে চেয়ে বললেন, “তোর হাতে তো লাঠি ছিল, সাধুটাকে ঘা কতক দিতে পারলি না?”

নন্দরাম জিভ কেটে দু’হাত দিয়ে কান ছুঁয়ে নিয়ে বলল, “ছিঃ ছিঃ, ওকথা বলবেন না। সাধু-মহাত্মাদের গায়ে হাত তুলে কী সাতজন্ম নরকে পচব মশাই? আর খুব তেজালো সাধু মশাই! চোখ দুখানা ধকধক করে জ্বলছিল, আর কী দশাসই চেহারা!”

বটেশ্বরের বাবা সর্বেশ্বর মুখ কালো করে বসে ছিলেন। ফোঁত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “এখন মুক্তিপণের অত টাকা আমি পাব কোথায়? আপনারা পাঁচ-দশ টাকা করে কালেকশন না দিলে সাধু যে ছেলেটাকে মেরে ফেলবে!”

খগেন অবাক হয়ে বললেন, “মুক্তিপণ কি চাওয়া হয়েছে?”

সর্বেশ্বর বলল, “এখনও চায়নি বটে, কিন্তু চাইবে। আগে থেকে প্রস্তুত না থাকলেই বিপদ। আমি বড় দেখে একটা ধামা নিয়েই এসেছি। আপনারা উদারহস্তে টাকা ফেলতে শুরু করে দিন। এখন থেকে রোজই বাড়ি-বাড়ি ঘুরে চাদা তোলা হবে।”

সর্বেশ্বরের এই ঘোষণা শুনে একজন দু’জন করে লোক কেটে পড়তে লাগল। এবং চণ্ডীমণ্ডপ ফাঁকা হয়ে যেতে সময় লাগল না।