২. রিসিভার রেখে অরিন্দম রায়চৌধুরি

রিসিভার রেখে অরিন্দম রায়চৌধুরি বললেন, কাজটা খুব সহজ হবে না। দিনে হলে অন্য কথা। আবার হঠাৎ বৃষ্টি এসে গেলে কেলেঙ্কারি। তাই বললুম, সিরিয়াস অ্যাডভেঞ্চার। আচ্ছা কর্নেল সরকার! পুলিস ডেডবডি উদ্ধারের কাজটা কাল সকালে করলেও তো পারত।

বললুম, থানার অফিসার-ইন-চার্জ যখন কাজটা রাত্রেই করতে চাইছেন–

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, করতে চাইছেন মানে কী? বৃষ্টি এসে গেলে ওঁরা এরাতের মতো কিছু করবেন না।

ওসি তা-ই বললেন?

 মুখে বলেননি। কিন্তু আমি তো পুলিশকে জানি। তার চেয়ে বড়ো কথা, কোনো মেয়ে নিখোঁজ হয়েছে এমন খবর পুলিশের হাতে নেই।–

উঠে দাঁড়িয়ে বললুম যদি সত্যিই বৃষ্টি আসে, বৃষ্টিতে পুলিশ ডেডবডি খুঁড়ে না তুললে খুনি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। ডেডবডি ধারিয়া নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে পারে।

মিঃ রায়চৌধুরি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ন এবং মাটিতে রক্তের দাগ তো থেকে যাবে।

বললুম, তাতে খুনিরই সুবিধা হবে। যতক্ষণ না কোনো মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর পুলিশ পাচ্ছে ততক্ষণ সে খুনের সব সূত্র নষ্ট করে ফেলার যথেষ্ট সময় পাবে। তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, আমি ডেডবতি দেখিনি। ওখানে কেউ কোনো মরা জানোয়ার পুঁতে রাখতেও পারে। দুটি স্লিপার আর একটুকরো ছেঁড়া আঁচল মানুষ খুনের পক্ষে জোরালো প্রমাণ নয়। ধরুন, কেউ তাঁর সঙ্গিনীকে নিয়ে ডমরুপাহাড়ে উঠেছিল। নেমে আসার সময় জুতো পা থেকে খুলে গেছে। আঁচল কাঁটাঝোপে আটকে গিয়ে ছিঁড়েছে।

অরিন্দম রায়চৌধুরি হেসে ফেললেন। তারপর বারান্দায় গিয়ে আকাশ দেখতে থাকলেন। আমিও আকাশের অবস্থা দেখার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। এখান থেকে পূর্ব-দক্ষিণে কয়েকটা উঁচু পাহাড় আকাশের কিছুটা আড়াল করেছে। পাহাড়গুলো বাঙালিটোলার কছাকাছি। বেলা আটটা না বাজলে এখান থেকে সূর্য দেখা যায় না।

একটু পরে মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, পুলিসের একটা অ্যাডভান্স পার্টি আসার কথা। এখনই বেরোতে হবে। আপনি কি পোশাক বদলাবেন?

বললুম, না।

তাহলে আপনি এগোন। লনে অপেক্ষা করুন গিয়ে। আমি পাজামা-পাঞ্জাবি ছেড়ে প্যান্ট-শার্ট পরে নিই…

লনে গিয়ে উত্তরে ফাগুলালের ঘরের দিকে তাকিয়েছিলুম। ফাগুলাল বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে খইনি ডলছে। তার বউ উনুনে রুটি সেঁকছে। ঘরের ভিতর একটা খাটিয়ায় বসে তার মেয়ে মুনিয়া স্কুলের পড়া তৈরি করছে, ফাগুলালের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড়ো ছেলে সুরেশ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। ধানবাদে চাকরি করে শুনেছি। ছোটো ছেলে রাকেশ ধরমপুর কলেজে পড়ে। মিঃ রায়চৌধুরি ফাগুলালের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ জুগিয়েছিলেন। ফাগুলালের কাছে শুনেছি, সুরেশ বিয়ে করেছে ধানবাদে। বছরে একবার আসে হোলির সময়। বাবা-মাকে টাকাকড়ি কদাচিৎ পাঠায়।

ফাগুলালের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে পড়ে গেল, ফাগুলাল ডমরুপাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে বলছিল। কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। শঙ্খচূড় সচরাচর জল থেকে বেশি দূরে বাস করতে চায় না। অন্তত তার বিচরণক্ষেত্রের সন্নিকটে একটি ডোবা থাকাও চাই।

অবশ্য আমার অভিজ্ঞতা বা পরোক্ষ জ্ঞানের বাইরে অনেক কিছুই থাকতে পারে। পোর্টিকোর মাথায় উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। ঘড়ি দেখলুম, প্রায় আটটা বাজে। অরিন্দম রায়চৌধুরি এসে বাঁদিকে গ্যারেজে গিয়ে ঢুকলেন। পাশাপাশি দুটো গাড়ি রাখা আছে। একটা ফিয়াট। একটা জিপ। জিপগাড়িতে স্টার্টের শব্দে ফাগুলাল এদিকে তাকাল। ইঞ্জন গরম হওয়ার পর মিঃ রায়চৌধুরি লনে গাড়িটা আনলেন। এইসময় ফাগুলাল এসে আমাকে সেলাম দিল। মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ফাগুলাল! তুমি কিছু দেখনি। কর্নেলের সঙ্গে পাহাড়েও ওঠনি। দূর থেকে পাখি দেখিয়ে দিয়েছিলে শুধু। বুঝেছ?

হ্যাঁ স্যার! আপনারা কি পুলিশের সঙ্গে পাহাড়ে উঠবেন?

বৃষ্টি না হলে উঠব। কেন?

স্যার। আপনি তো জানেন ওই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে।

আমার সঙ্গে রাইফেল আছে। টর্চ আছে। আসুন কর্নেল সরকার।

জিপে ওঁর ডানপাশে বসে এতক্ষণে দেখলুম, উনি রাইফেলটা জিপের পিছনের সিটে রেখে লম্বা টর্চটা তার এবং আমার মাঝখানে সিটের উপর রাখলেন।

গাড়ির ওপাশে গিয়ে ফাগুলাল বলল, স্যার! একটু সাবধানে থাকবেন।

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ঠিক আছে। তুমি বাড়ির পিছন দিকে নজর রেখো।

জঙ্গবাহাদুর সেলাম করে গেট খুলে দিল। পিচের রাস্তাটা বাঁদিকে চলে গেছে ধারিয়া ফলস-এর পাশ দিয়ে দুমকার দিকে। ডাইনে অর্থাৎ উত্তরে গিয়ে ঢুকছে ধরমপুর বাজারে। মিনিট পাঁচেক পরে সেই পাহাড়ি রাস্তাটার মোড়ে পৌঁছে জিপ দাঁড় করালেন মিঃ রায়চৌধুরি। বললেন, পুলিশের ব্যাপার আমি জানি। দেখুন না তথাকথিত অ্যাডভান্স পার্টি কখন পৌঁছোয়।

তিনি রাইফেল আর টর্চ নিয়ে নামলেন। বাঙালিটোলায় স্ট্রিটলাইট নেই। চারদিকের অন্ধকার টর্চের আলোয় একবার ঝলসে দিয়ে মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, গুমোট গরম। বাতাস বন্ধ। আকাশ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

গাড়ি থেকে নেমে বলুলম, আমি একটা বড়ো ভুল করেছি মিঃ রায়চৌধুরি।

ভুল করেছেন? কী ভুল?

আমার এই কিটব্যাগে জঙ্গলনাইফ ছিল। জায়গাটা তা দিয়ে খুঁড়ে নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল।

মিঃ রায়চৌধুরি হাসলেন। গতস্য শোচনা নাস্তি। তবে ন্যায়শাস্ত্রে আছে, পর্বতে ধোঁয়া দেখলে আগুন থাকাটা স্বতঃসিদ্ধ।

মিঃ রায়চৌধুরি! ন্যায়শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্বও আছে। যা প্রতীয়মান, তা বাস্তব নয়।

আপনি কি এতক্ষণে অবভাসতত্ত্বে পৌঁছোলেন।

একটা চুরুট ধরিয়ে বললুম, অবশ্য আমার ইনটুইশন সম্পর্কে আমি বিশ্বাসী। এটা অলৌকিক কোন বোধ নয়। দীর্ঘ সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা। আপনি তো শিকারি ছিলেন। জঙ্গলের মধ্যে কোথাও শব্দ শুনলে শব্দটার দূরত্ব এবং দিকনির্ণয় করতে পারতেন। শব্দটা কীসের তা-ও নিশ্চয় বুঝতে পারতেন। জঙ্গলযুদ্ধে আমার এই ট্রেনিংটা নিতে হয়েছিল।

এইসময় উত্তরে গাড়ির আলো দেখা গেল। মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ওরা আসছে।

দুমিনিটের মধ্যে পুলিশের জিপ এসে আমাদের কাছে থামল। জিপ থেকে একজন পুলিশ অফিসার বললেন, নমস্তে রায়চৌধুরিসাব!

নমস্তে মিঃ পাণ্ডে। ওসি মিঃ সিংহ আসবেন তো?

মিঃ পাণ্ডে বললেন, পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে এসে পড়বেন।

অরিন্দম রায়চৌধুরি জিপে উঠে বললেন, চলুন। রাস্তার অবস্থা খারাপ। কিন্তু জিপের পক্ষে কোনো বাধা নয়।

আমি তার জিপে উঠে বসলুম। চড়াই এবং ছোটবড়ো পাথরের বাধা আগ্রাহ্য করে গাড়ি চড়াইয়ে উঠছিল। প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে আমার শরীর জানিয়ে দিচ্ছিল, তার মধ্যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে। মাথার পাশে একটা রড আঁকড়ে ধরেছিলুম। এঁকেবেঁকে গাড়ি হাড়ভাঙার মতো অদ্ভুত শব্দ করতে করতে অবশেষে সেই সমতল অংশে পৌঁছাল, যেখানে ডানদিকে বটগাছ এবং তলায়। লম্বাটে বেদির মতো পাথর। একটু পরে মিঃ পাণ্ডের জিপ উঠে এসে আমাদের বাঁ পাশে দাঁড়াল। আমরা ততক্ষণে নেমেছি। এবার মিঃ পাণ্ডে এবং আরও একজন অফিসার নামলেন। পিছনে দিক থেকে ছজন কনস্টেবল নামল। চারজন সশস্ত্র। দুজনের হাতে বেঁটে লাঠি। মিঃ রায়চৌধুরি টর্চের আলো নিচে ফেলে মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। রঘুনাথ পাণ্ডে অ্যাডিশনাল ওসি। তাঁর সঙ্গে এসেছে এস আই রণবীর দুবে।

জিপগাড়ি দুটোর কাছে পুলিশের ড্রাইভার এবং একজন আর্মড কনস্টেবল রইল। মিঃ পাণ্ডের একহাতে বেটন, অন্যহাতে স্পটলাইট। স্পটলাইটটা তিনি একজন কনস্টেবলকে দিয়ে আমাকে বললেন, আপনি আগে চলুন কর্নেল সরকার!

জোরালো স্পটলাইটের আলোয় ঢালু পাহাড়ের গা বেয়ে এগিয়ে চললুম। আমার পিছনে মিঃ রায়চৌধুরি এবং মিঃ পাণ্ডে। এখন রক্তের ছোপ লক্ষ করার। প্রশ্ন ওঠে না। প্রায় আধঘণ্টার দুর্গম অভিযান। ইতিমধ্যে শিশিরে পাথর কিছুটা পিচ্ছিল। সাবধান করে দিচ্ছিলুম, পাথরের খাঁজে পা ফেলতে হবে।

অবশেষে চূড়ার সেই ঝোপের সামনে যখন পৌঁছেলুম তখন, আমি ঘেমে গেছি। পিছনে একদল মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ অদ্ভুত লাগছিল। আমার টর্চ বের করে শিশিরে ভেজা ঝোপের একটা দিক সরিয়ে আলো ফেললুম। মিঃ রায়চৌধুরিও জোরালো টর্চের আলো ফেলে বললেন, মাই গড। পাণ্ডেজি। দেখছেন?

আশ্বস্ত হয়ে দেখলুম, ঘাসসুদ্ধ মাটির চাপড়া তেমনই চাপ-চাপ বসানো আছে। পুলিশের স্পটলাইটের আলোয় শুধু একপাশে কোনো জন্তুর নখের আঁচড় লক্ষ্য করলুম। জন্তুটা সবে মাটি সরাচ্ছিল। মানুষজনের সাড়া পেয়ে সরে গেছে।

আমি ভাবছিলুম, কিটব্যাগ থেকে জাঙ্গল-নাইফটা বের করে অন্তত ঝোপটা যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে ফেলি। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল, এই ঝোপেও যদি কোনে ব্লু থাকে, তা নষ্ট হয়ে যাবে। ফাগুলালের সঙ্গে এসে তখন ঝোপটা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে ভুলে গিয়েছিলুম। উত্তেজনাই এর কারণ। সে মুহূর্তে আমাকে প্রচণ্ড বিস্মিত করেছিল একটা পয়েন্ট। নিচে থেকে একটা রক্তাক্ত মৃতদেহ তুলে এনে এখানে পুঁতে ফেলতে শারীরিক শক্তির দরকার। যদি একাধিক লোক মৃতদেহটা এনে থাকে, আলাদা কথা। কিন্তু ঝোপের পাশে মাটিটা বৃষ্টিতে নরম। ঘাসের উপর পায়ের ছাপ পড়া সম্ভব নয়। তবে ঘাস দেবে গেছে মৃতদেহেরই চাপে। দিনের রোদ ছাড়া পায়ের ছাপ খুঁজে বের করা। অসম্ভব। তখন রোদ ছিল না। আর এখন ঝোঁপ ঘিরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। কোনো পায়ের ছাপ কাল দিনেরবেলায় আর খুঁজে বের করা যাবে না। আমাদের পায়ের ছাপে খুনি বা তার সহকারীদের পায়ের ছাপ হারিয়ে গেল।

স্পটলাইটটা যে কনস্টেবলের কাছে ছিল, সে বারবার পাহাড়ের চূড়ার ঝোঁপজঙ্গলের উপর থেকে ঢালু গায়ে আলো ফেলছিল। মিঃ পাণ্ডে কড়া ধমক দিলেন তাকে। স্পটলাইট নিভিয়ে কনস্টেবলটা মৃদূস্বরে বলল, শুনেছি ডমরুপাহাড়ে সাপের উপদ্রব আছে।

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি এই পাহাড়ে শঙ্খচূড় সাপ আছে।

এবার আতঙ্কিত দুই, পুলিশ অফিসার বারবার টর্চ জ্বেলে আশেপাশে আলো ফেলতে থাকলেন। এস আই রণবীর দুবে অস্থির হয়ে বললেন, ওসিসাব লোকজন নিয়ে আসতে এত দেরি করছেন কেন?

মিনিট পাঁচেক পরে আমি কিটব্যাগ থেকে জাঙ্গল-নাইফ বের করে বললুম, ততক্ষণ আমি যতটা পারি, এই ঘাসের চাপড়াগুলো সরিয়ে ফেলি? মনে হচ্ছে কাজটা তত কঠিন হবে না।

অস্থির মিঃ পাণ্ডে বললেন, ঠিক আছে। কর্নেল সরকার। আপনি চেষ্টা করুন। কাজটা এগিয়ে থাক। রাম সিং! তুমি কর্নেলসাবকে সাহায্য করো।

কাজটা এত সহজ বলে ভাবিনি। জঙ্গলকাটার ছুরি ভাঁজ করা ছিল। খুলে স্ক্রু আঙুলের চাপে ঘুরিয়ে টাইট করলুম। প্রায় দশইঞ্চি ফলা ঘাসের চাপড়ার তলায় ঢুকিয়ে দিলুম। রাম সিং তার বেটন ভরে চাপড়া উলটে একটু তফাতে ফেলল। মিনিট দশেক পরে আমার ছুরির ডগায় রক্ত মেখে গেল। আরও পাঁচ মিনিটের মধ্যে রক্তাক্ত বিভীষিকা দেখা পাওয়া গেল। লাল গেরিমাটিমাখা দুমড়ে বসানো মৃতদেহটা দেখা দিল। খয়েরি শাড়ি, হাতকাটা ম্যাচিং ব্লাউজ ও সায়ার সঙ্গে সেঁটে থাকা মেয়ে শরীর। মাথার চুল গেরিমাটিতে লাল। আমি চুলগুলো টেনে ধরতেই মুখটা উঁচু হল। শ্বাসনালিকাটা একটি মেয়ে। মিঃ রায়চৌধুরি টর্চের আলো নিভিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন, চেনা মনে হচ্ছে! হ্যাঁ–খুব চেনা। এক মিনিট। বলছি। জয়া! অবিনাশ কবিরাজ মশাইয়ের মেয়ে। বাট হোয়াই? অ্যান্ড হাউ…

.

রাত দশটা নাগাদ ফিরে পোশাক বদলে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে নিচে ডাইনিং ঘরে গেলুম। অরিন্দম রায়চৌধুরি বললেন, আমার কিছু খেতে ইচ্ছা। করছে না। আপনাকে সঙ্গ দেব শুধু।

একটু হেসে বললুম, একসময় আপনি দুর্ধর্ষ শিকারি ছিলেন। তারপর রাজনীতিক। একালের রাজনীতিতে খুনজখম ক্রমে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাছাড়া আপনি বিহার রাজ্যের রাজনীতিক।

কর্নেল সরকার। এটা রাজনৈতিক খুনজখমের ঘটনা নয়। কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের মেয়ে জয়া আমার মেয়ে অন্তরার বন্ধু। এ বাড়িতে তাকে কমবয়স থেকে দেখেছি। অন্তরার বিয়ের পর জয়া আমাকে বলেছিল, ওর একটা চাকরি দরকার। অন্তরা নেই বলে ওর নাকি সময় কাটছে না।

মিসেস সুষমা রায়চৌধুরি দাঁড়িয়ে ছিলেন। বললেন, বাজে কথা, তোমাকে এতদিন বলিনি। অন্তরা ওকে গার্ড দিত।

বুঝলাম না।

নরহরি ঠাকুর পরিবেশন করছিলেন। সুষমা তার দিকে চোখের একটা ইঙ্গিত করলেন। মিঃ রায়চৌধুরির সামনে একটা ডিশে লুচি-বেগুনভাজা রেখে নরহরি ঠাকুর বললেন, যে-যার কর্মফল ভুগবে। তুমি না খেয়ে কি তা আটকাতে পারবে অরু?

মিঃ রায়চৌধুরি অনিচ্ছার সঙ্গে খেতে শুরু করল। আমার তো প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল। সুষমা বললেন, কবরেজমশাইকে কখন পুলিশ খবর দেবে, তাদের খেয়ালখুশি। তুমি ফাগুলালকে দিয়ে খবর পাঠালে পারতে।

এস আই দুবেজি খবর দিতে গেছেন। এতক্ষণ কবরেজমশাই পুলিশের জিপে চেপে থানায় চলে গেছেন।

সুষমা হঠাৎ বললেন, থাক ওসব কথা। চুপচাপ খেয়ে নাও। আমি দেখি, বাচ্চু ফিরল নাকি।

বাচ্চু এখনও ফেরেনি?

নটায় ফোন করেছিল। ফিরতে দেরি হবে। বলে সুষমা বেরিয়ে গেলেন।

জিজ্ঞেস করলুম, বাচ্চুর ব্যবসা কেমন চলছে?

 মিঃ রায়চৌধুরি অন্যমনস্কভাবে বললেন, ভালো।

বাচ্চু কি রোজ রাত্রে বাড়ি ফেরে?

হ্যাঁ। মোটরসাইকেলে ওর একজন সঙ্গী থাকে। বডিগার্ড বলা চলে। এ বাড়ির কাছাকাছি তার বাড়ি।

বাঙালি?

হ্যাঁ। বাচ্চুর ট্রেডিং এজেন্সিতেই চাকরি করে। শচীন বোস নাম। খোকা বোস নামে ধরমপুরেও পরিচিত। মিঃ রায়চৌধুরি একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ফাগুলালের মতো সে-ও এক পালোয়ান।

নরহরি ঠাকুর ফোকলা মুখে হেসে বললেন, কর্নেলসায়েব! ধরমপুর এরিয়াতে পালোয়ানের ছড়াছড়ি। আমার ছোটোবেলায় ওদের অস্ত্র ছিল লাঠি। এখন সাংঘাতিক সব মেশিন। মেশিন বুঝলেন তো কর্নেলসায়েব?

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, নরহরিদা! কর্নেলসায়েব মেশিন বোঝেন। মনে। হচ্ছে তোমার সব আইটেম শেষ। তুমি এবার কফির জল গরম করো। ফাগুলালাকে দিয়ে কর্নেলসায়েবের ঘরে পাঠাবে।

খিদে সত্ত্বেও আমারও খাদ্যে রুচি কমে যাচ্ছিল। বারবার মনে পড়ছে মেয়েটার মুখ। বেসিনে হাত ধুয়ে হলঘর হয়ে দোতলায় উঠলুম। আমার পেছনে মিঃ রায়চৌধুরি। বললুম, আপনি আর কুকুর পোষেন না কেন?

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আমারও ডন আর জনের কথা মনে পড়ে যায়। ডন একটা চিতাবাঘের পাল্লায় পড়েছিল। তাকে আর খুঁজে পাইনি। জনকে বাচ্চুর বিয়ের পর এক বন্ধুকে দান করেছিলুম। একমাস পরে বেচারা মারা যায়।

দান করেছিলেন কেন?

বউমার প্রচণ্ড ভয়। কুকুর সম্পর্কে ওর অদ্ভুত, ফোবিয়া আছে। তারপর আমার নাতি তুতুনের জন্য নিরীহ জাতের কুকুর আনলুম। নাম দিলুম মিক্কি। ইঞ্চি ছয়েক উঁচু। বাচ্চা কুকুর। দেখেই বউমা ফিট হয়ে গেল। তারপর আর কুকুর সম্পর্কে ভাবি না।

আমরা যখন দক্ষিণের বারান্দায় হাঁটছি, তখন মোটর সাইকেলের শব্দে রাতের স্তব্ধতা চুরমার করতে করতে বাচ্চু মিঃ রায়চৌধুরির একমাত্র ছেলে অনির্বাণ ফিরল। আমার থাকার ঘরে ঢুকে মিঃ রায়চৌধুরি আলো জ্বেলে পাখা চালিয়ে দিলেন। বললুম, কিছুক্ষণ বারান্দায় বসি।

ঠিক বলেছেন।

দুজনে বসার পরই ঝিরঝিরিয়ে আকস্মিক বৃষ্টি এসে গেল। পরক্ষণেই মেঘের গর্জন। বললুম, ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় থাকার সময় বৃষ্টি এলে সমস্যা হত।

মিঃ রায়চৌধুরি পাঞ্জাবির পকেট থেকে পাইপ আর তামাক বের করে টেবিলে রাখলেন। বললেন, কফি খেয়ে পাইপ টানব। আমার মাথার ভিতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। এ একটা অকল্পনীয় ঘটনা। অবশ্য একটু সান্ত্বনা, আপনি এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। পুলিশ আপনাকে সহযোগিতা করবে, যদি আপনি নিজের পরিচয় জানান। তবে আমার মনে হয়, শিগগির আপনার আত্মপরিচয় দেওয়া ঠিক হবে না। শ্যামসুন্দর সিংহ লোকটাকে তো দেখলেন। নিজের সম্পর্কে লোকটার অদ্ভুত সব ধারণা আছে। জয়ার ডেডবডি উদ্ধারের কাজটা আপনি করে ফেলেছেন। এতেই ওর রিঅ্যাকশন হয়তো লক্ষ করেছেন!

বুঝলুম, অরিন্দম রায়চৌধুরি কথা বলে হাল্কা হতে চাইছেন। বৃষ্টিটা ক্রমে জোরালো হচ্ছিল। মেঘের গর্জনও মুহূর্মুহূ কানে তালা ধরানোর মতো। চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ। বারান্দায় বৃষ্টি বেঁকে এসে আঘাত করছিল। অগত্যা আমরা ঘরে গিয়ে বসলুম। তখনই ফাগুলাল কফির ট্রে নিয়ে এল।

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ফাগুলাল! তোমার বাচ্চুবাবু ঠিক সময়ে ফিরল। একটু দেরি করলেই বৃষ্টিতে ভিজে যেত।

ফাগুলাল, বলল, বাচ্চুবাবু টাউনেই কীভাবে খবর পেয়ে গেছে!

 বল কী? তোমাকে বলল?

হ্যাঁ। বাচ্চুবাবুর দেমাগ খারাপ হয়ে গেছে মনে হল।

কেন? ওর এতে মাথাব্যথার কী আছে?

কী বলছেন স্যার? কবরেজমশাইয়ের মেয়ে একসময়ে এ বাড়ির মেয়ে ছিল।

কফিতে চুমুক দিয়ে বললুম, এই বৃষ্টি আর কিছুক্ষণ চললে ধারিয়া নদীতে বন্যা হবে।

ফাগুলাল বলল, ধরমপুর উঁচু জায়গা স্যার। পুরো বাঙালিটোলা লম্বা একটা টিলাপাহাড়ের মাথা কেটে তৈরি হয়েছিল।

মিঃ রায়চৌধুরি বললেন, ঠিক আছে ফাগুলাল! তুমি তোমার বাচ্চুবাবুকে দেখো। বাচ্চু রোজ রাতে একটু ড্রিংক করে বাড়ি ফেরে। তাই আমাকে এড়িয়ে থাকে। ওর দেমাগ খারাপ মানে বউমার প্রবলেম।

বিকালে ডমরুপাহাড়ের চূড়ায় একটা মৃতদেহ পোঁতা আছে জানার পর থেকে ফাগুলাল আমূল বদলে অন্যমানুষ হয়ে গেছে। একজন হাসিখুশি লোককে মুখ গোমড়া করে থাকতে দেখলে খারাপ লাগে। কিন্তু এখনও আমি তার এই অদ্ভুত রূপান্তরের কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।

মিঃ রায়চৌধুরি আস্তে বললেন, আপনাকে বলা উচিত। কবরেজমশাই তাঁর মেয়ে জয়াকে আমার পুত্রবধূ করার অনুরোধ করেছিলেন। আমার মিসেস একথা শুনে খুব চটে গিয়েছিল।

চটে যাওয়ার কারণ ছিল?

সুষমা খুলে কিছু বলেনি। কিন্তু আমার ধারণা, জয়া একটু মেজাজি মেয়ে ছিল। বড্ড বেশি স্মার্ট। বাচ্চুকে তুই-তোকারি করত। কিন্তু অন্তরাকে তুমি বলত। আসলে জয়াকে বাড়ির বউমা বলে কল্পনা করা সুষমার পক্ষে হয়তো সম্ভব ছিল না। সুষমা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে।

আপনি বলেছিলেন জয়ার মা তার ছোটোবেলায় মারা গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ। ওর বিধবা পিসিমা ওকে মানুষ করেছিলেন। ভদ্রমহিলা দুবছর আগে মারা গেছেন।

জয়ার চাকরি সম্পর্কে বলুন!

এখানে খ্রিস্টান মিশন আদিবাসীদের জন্য একটা স্কুল করেছিল। ভালো স্কুল। ফাদার হ্যাঁরিংটনকে অনুরোধ করেছিলুম। আমার মেয়ে অন্তরা এবং জয়া দুজনেই খ্রিস্টান স্কুল-কলেজে পড়েছে। ইংলিশ মিডিয়াম। বাংলা পড়ানোর ব্যবস্থা নেই। আমরা বাঙালিটোলায় বাংলা পড়ানোর জন্য প্রাইভেট নাইটস্কুল করেছিলুম।

জয়ার কি চাকরি হয়েছিল?

ফাদার হ্যাঁরিংটনের স্কুলে প্রাইমারি সেকশনে টিচার হয়েছিল জয়া। শতিনেক টাকা মাইনে। আসলে খ্রিস্টান নানরাই পড়ান। তারপর কী কারণে জয়া চাকরি ছেড়েছিল, আমাকে বলেনি। সত্যি কথাটা হল, গত একবছর বিহার রাজ্যের রাজনীতিতে এমন জটিল টানাপোড়েন চলছে, আমি অন্য কিছুতে মন দেওয়ার সুযোগ পাইনি। এই দেখুন না! আপনাকে সঙ্গ দিতে পারছি না!

পাশের ঘরে মিঃ রায়চৌধুরির স্টাডিতে টেলিফোন বাজল। তিনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি উঠে এসে বারান্দা লক্ষ করলুম। বারান্দার অনেকটা ভিজে গেছে। বৃষ্টি সমানে ঝরছে। মিঃ রায়চৌধুরির স্টাডি খোলা ছিল। উনি ভিতরে ঢুকে রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। আমি জানি, এটা ওঁর প্রাইভেট টেলিফোন। ওঁর শুধু ক্রমাগত হাঁ বলে যাওয়া কানে এল। ভিতরে এসে ইজিচেয়ারে বসে চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলুম। জয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড যেটুকু জানা গেল, ওই শোচনীয় পরিণামের সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই। কবিরাজ অবিনাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা না বলে এক পাও এগোতে পারব না হয়তো।

অরিন্দম রায়চৌধুরি এসে বললেন, পলিটিকাল মেসেজ। আমাকে কাল মর্নিংয়ে সরডিহা ছুটতে হবে। কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রকের প্রতিনিধিরা আসছেন। আমাদের পার্টির কিছু বক্তব্য আছে। আপনি ক্লান্ত। এবার শুয়ে পড়ুন। আমিও শুয়ে পড়ব। ভোরে উঠতে হবে।

আপনি কি জিপ চালিয়ে যাবেন?

নাঃ। যা বৃষ্টি হচ্ছে, রিস্ক নেব না। আপনার যদি জিপ গাড়ির দরকার হয়, বলে যাব ফাগুলালকে। ড্রাইভারকে বসিয়ে রেখে মাইনে দিচ্ছি। কোনো অসুবিধা হবে না। গুডনাইট!

গুডনাইট!