২. মেসার্স ব্রিদার অ্যাণ্ড স্কাটল

০৬.

মেসার্স ব্রিদার অ্যাণ্ড স্কাটল-এর অফিসে মিঃ পোয়ারো প্রবেশ করলেন।

অত্যন্ত অমায়িক মানুষ মিঃ স্কাটল। তিনি হাত ঘষতে ঘষতে বললেন, সুপ্রভাত, সুপ্রভাত। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য মঁসিয়ে?

ভদ্রলোক পোয়ারোকে এক নজরে দেখে তার সম্বন্ধে ধারণা করতে চেষ্টা করলেন।

–মিঃ স্কাটল, নিশ্চয়ই আমি আপনার সময় নষ্ট করছি না। জেমস বেন্টলীর সম্বন্ধে কিছু খবর জানতে এসেছি আমি।

–আপনি রিপোর্টার না পুলিশ?

–না। এ ব্যাপারে বেন্টলীর এক আত্মীয় আমাকে তদন্ত করতে বলেছেন।

–কোনো নিকটাত্মীয় বেন্টলীর আছে বলে তো শুনিনি?

আর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড হয়েছে তো বেন্টলীর। আপনি জানেন না?

–এখনো কার্যকরী হয়নি দণ্ড। যতক্ষণ শ্বাস, আশ ততক্ষণই নয় কি? অবশ্য ওর বিরুদ্ধে তো সেই প্রমাণ।

–এই আত্মীয়টি ওর কে?

–তিনি অবশ্যই ধনী।

 –আপনি দেখছি মশাই অবাক করলেন। ধনী কথাটায় মিঃ স্কাটল নড়েচড়ে বসলেন।

পোয়ারো বললেন, ছেলেকে নিয়ে মিসেস বেন্টলী পরিবার ছেড়ে অনেক দূরে চলে আসায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এদের সঙ্গে।

–তা হলে তো খুবই দুঃখের ব্যাপার যে বেন্টলীকে বাঁচাতে কেউ এতদিন এগিয়ে আসেনি।

–জানতে পারা মাত্র তারা তদন্তের ভার দিয়েছেন আমাকে।

–কিন্তু বুঝতে পারছি না, আপনাদের আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?

সামনের দিকে পোয়ারো ঝুঁকে পড়লেন–শুনুন আপনাদের এখানে বেন্টলী কাজ করতো মিঃ স্কাটল। কিছু বলুন ওর সম্বন্ধে।

–বিশেষ কিছু নেই ওর সম্বন্ধে বলার মত। ও আমার অধস্তন কর্মচারীদের মধ্যে একজন। বেশ ভালোই ছিল। অন্তত বিরুদ্ধে বলবার মত কিছু নেই। তবে কি জানেন? আমরা হলাম বাড়ি বিক্রির এজেন্ট। তেমন তুখোড় ছিল না সে এ বিষয়ে। আমাদের ব্যবসায় কথার চালে খদ্দেরদের মত করতে হয়, তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝে এগোতে পারলে কাজ হতে হয়। এদিকটা বেন্টলী ঠিক তেমনভাবে কায়দা….

মিঃ স্কাটলকে পোয়ারো কথা শেষ করতে দিলেন না। মনস্তত্ত্ব কথাটা তার সতর্কতা বাড়িয়ে তুলল।

-সত্যিই কি আপনার মনে হয় যে, ওই কর্মচারীটি একজন খুনী?

 চমকে উঠে স্কাটল বললেন, নিশ্চয়ই, তবে সত্যি কথা বলতে গেলে তাকে মানসিক দিক দিয়ে খুনী বলে মনে করি না আমি, বড্ড নরম প্রকৃতির ও।

–আপনারা ওকে বরখাস্ত করেন?

–দেখুন, আমাদের তা করতে হয়েছিল ব্যবসার খাতিরে মোটেও ও জনপ্রিয় ছিল না।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পোয়ারো অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন, জনপ্রিয় ছিল না ছেলেটি অর্থাৎ খদ্দেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারার মত সাধারণ কিছু গুণের অভাব ছিল তার।

একথা পোয়ারো ভেবে খানিকটা নিশ্চিন্ত বোধ করলেন যে, এ যাবৎ যে সব খুনীদের তিনি জেনেছেন তাদের অধিকাংশই জানাশুনো সাধারণ লোকেদের মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখত।

–ক্ষমা করবেন, আপনার সাথে কি একটু কথা বলতে পারি?

ব্লু ক্যাট রেস্তোরাঁর আলো আঁধারি ঘরে বসে পোয়ারো চোখ বোলাচ্ছিলেন মেনুকার্ডে। হঠাৎ চমকে উঠলেন নারী কণ্ঠস্বর শুনে। এক তরুণী সামনে দাঁড়ানো, সোনালী চুল মাথাভর্তি, একটা ঝকঝকে নীল পশমী জামা গায়ে, পোয়ারোর মনে হল একে কিছুক্ষণ আগেই তিনি দেখেছেন।

তরুণীটি বলল, মিঃ স্কাটলের অফিসে সব কথাই আপনার শুনেছি।

খুনের তদন্তের ব্যাপারটা পাঁচকান হোক পোয়ারো সেটা মনে মনে চাইছিলেন। তরুণীটির কথা শুনে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনি পার্টিশানের ধারে টাইপ করছিলেন, আমি দেখেছি।

সম্মতির ভঙ্গিতে তরুণী ঘাড় হেলাল। সাদা ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসলও। বেশ স্বাস্থ্যবতী সে, তেত্রিশ চৌত্রিশ বছর বয়স হবে।

–মিঃ বেন্টলীর সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে চাই।

–কি বলতে চান?

–সত্যিই কি উনি আপিল করবেন? অন্যরকম সাক্ষ্য প্রমাণ কিছু পাওয়া গেছে বুঝি? ঈশ্বর করেন যেন তাই হয়। আমি সত্যিই বিশ্বাস করি না উনি এ কাজ করেছেন।

মৃদুস্বরে পোয়ারো বললেন, আপনি তা হলে এ কথা সত্যিই বিশ্বাস করেন না?

–দেখুন, আমি প্রথম প্রথম কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু প্রমাণগুলো যে সবই ওঁর বিরুদ্ধে। তাই ওকেই খুনী বলা ছাড়া উপায় কি? আমার ধারণা তখন উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।

–একটু কি অদ্ভুত প্রকৃতির বেন্টলী?

–না না, বরং বলতে পারেন একটু বেশি লাজুক। আসলে আত্মবিশ্বাস নেই ওর। মেয়েটির দিকে পোয়ারো তাকালেন। ওকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হল তার।

–আপনি কি পছন্দ করতেন ওকে?

–হ্যাঁ, তা করতাম। আমার বান্ধবী বেন্টলীকে ঠাট্টা করত। বেশ ঠান্ডা প্রকৃতির ছিলেন উনি কিন্তু ওর যথেষ্ট জ্ঞান ছিল বহু বিষয়ে। মাতৃহীন ছিলেন। বেশ কয়েক বছর ধরে যথাসাধ্য করেন অসুস্থ মায়ের জন্য, খুব স্নেহশীলা ছিলেন মা-ও।

আপনি কি ওর বন্ধু?

–ঠিক বন্ধু নয়। টুকিটাকি গল্প করতাম আমরা। এখান থেকে উনি চলে যাবার পর আমি ওঁকে একটা চিঠি লিখি, কিন্তু কোনো উত্তর দেননি তিনি।

–কিন্তু ওকে আপনি পছন্দ করেন তাই না?

হ্যাঁ।

জেমস বেন্টলীর ভীরু চোখ আর রোগা চেহারাটা পোয়ারো মনশ্চক্ষে দেখতে পেলেন।

ওকে সবাই যা মনে করে, তার মধ্যে তিনজন ব্যতিক্রম। মানবচরিত্র বিশ্লেষণে নিখুঁত মিঃ স্পেন্স, পোয়ারো আর এই তরুণীটি।

–আপনার নাম?

–মড উইলিয়ামস। আপনাকে কি আমি সাহায্য করতে পারি।

নিশ্চয়ই। কিছু লোক আছে এখনো যারা মনে করে নির্দোষ বেন্টলী, সেকথা তারাই প্রমাণ করতে চেষ্টা করছে। আমি এ ব্যাপারে যথেষ্ট অগ্রসর হতে পেরেছি।

পোয়ারো শেষের মিথ্যে কথাটা অক্লেশে বললেন। তিনি কথা বলাতে চান মডকে দিয়ে।

–আচ্ছা মিস উইলিয়ামস, আপনার সাথে কথাবার্তা বলার সময় কখনো কি বেন্টলী ওর কোনো শত্রুর কথা উল্লেখ করেছিল?

-না, তা কিছু বলেননি তবে তরুণী মেয়েদের নাকি ওর মা খুব একটা পছন্দ করতেন না।

মাতৃভক্ত ছেলেদের মায়েরা কখনোই পছন্দ করেন না তরুণীদের তা জানি আমরা। অন্য কথা আমি ভাবছিলাম। যেমন ধরুন, কারও কথা যার সাথে ওদের বনেনি বা রাগারাগি হয়েছে কারো সঙ্গে এমন কোনো ঘটনা।

-না, সেরকম কোনো শত্রুতার কথা ওঁর মুখে শুনিনি।

–বেন্টলী তার বাড়িউলি মানে মিসেস ম্যাগিনটি সম্পর্কে কিছু বলেছে?

–তেমন কিছু নয়, একটা বেড়াল হারিয়ে একবার মহিলা খুব মুষড়ে পড়েছিলেন, ওর মুখে সে কথা শুনেছিলাম।

–টাকা যে মহিলা লুকিয়ে রাখতেন, সে সম্পর্কে?

–হ্যাঁ বলেছিলেন, উনি খুব অসাধারণ। আমিই যে কোনো সময়ে ওটা নিতে পারি। তবে তেমন কিছু ভেবে নিশ্চয়ই ও কথা বলেননি।

–ভালো কথা আমি এটাই জানতে চাইছিলাম। টাকাটা কেমন ভাবে সহজে হাত করা যায় সে কথাও ও নিশ্চয়ই বলেছিল। এভাবে কিন্তু মনের কথা পাকা খুনীরা ফাস করে না। যাক সে কথা। যদি নির্দোষ হয় বেন্টলী তবে কেউ না কেউ নিশ্চয়ই খুনী– কে সে?

-আপনি কি কোনো ধারণা করেছেন?

–হ্যাঁ, এই শুরু তদন্তের।

-এবার আমাকে ফিরতে হবে। আমাকে যে কোনো সময় দরকার হলে জানাবেন। যথাসাধ্য আপনাকে সাহায্য করতে আমি প্রস্তুত।

পোয়ারো তার বর্তমান ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিলেন মডকে।

পোয়ারো ফেরার বাস ধরলেন। নির্দোষ বেন্টলী এ কথা ভাবে। এমন একজনকে দলে পেয়ে একটু খুশী তিনি। যখন বেন্টলীর সাথে জেলে দেখা করে ছিলেন, তার সঙ্গে কথা হয়েছিল যা যা, মনে পড়ে গেল সব। ভাবলেন, দুএকজন বন্ধু তাহলে বেন্টলীর ছিল কিন্তু ওকি তা জানে?

বেন্টলী বলেছিল, মিঃ পোয়ারো ধন্যবাদ। তবে আমার মনে হয় না আর এখন আপনারা কিছু ধরতে পারবেন।

-আচ্ছা মিঃ বেন্টলী, কোনো শত্রু ছিল কি আপনার মায়ের?

–মোটেই না। সকলেই তাকে শ্রদ্ধা করত।

–আর আপনার বন্ধুরা?

–কোনো বন্ধু নেই আমার।

পোয়ারো ভাবলেন, এটা তো মিথ্যে কথা। ওর তো বন্ধুই মড। আত্মবিশ্বাস যে বেন্টলীর চরিত্রে নেই মডের মধ্যে তা বেশ ভালোই আছে।

পোয়ারো ফেললেন দীর্ঘশ্বাস। তবে প্রকৃত খুনী কে? তাকে খুব তাড়াতাড়ি এগোতে হবে। অনেক কাজ বাকি।

.

০৭.

মিসেস ম্যাগিনটির বাড়ি বাস স্টপ থেকে মাত্র কয়েক পা দুটো বাচ্চা খেলা করছিল দরজার ঠিক সামনেই। তাদের একজন বড়সড় একটা রসালো আপেলে কামড় দিচ্ছিল আর প্রাণপণে চিৎকার করতে করতে অন্যজন একটা টিনের ট্রে দিয়ে ঘা দিচ্ছিল দরজায়। কি সুখী দুজনেই।

যেমন কাণ্ড পোয়ারোর এত আওয়াজের মধ্যে আবার নিজেও দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলেন।

বাড়ির পাশ দিয়ে একজন ভদ্রমহিলা বেরিয়ে এলেন।

-আর্নি, এ রকম কোরো না। থামো।

–না থামব না।

আবার আর্নি নামের বাচ্চাটা তার নিজের কাজে মন দিল। মানে মানে দরজার সামনে থেকে পোয়ারো সরে গিয়ে উঁকি মারলেন বাড়ির পেছন দিকে।

গলা পাওয়া গেল ভদ্রমহিলার, প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায় বাচ্চাদের জ্বালায়, তাই না?

অবশ্য বিরুদ্ধগত মত পোষণ করেন পোয়ারো, তবু ভদ্রমহিলাকে নিজের স্বার্থেই তিনি ঘাটাতে সাহস করলেন না।

–আপনার জন্য আমি ভেতর দিকের দরজাটা খুলে রেখেছি।

 তাঁকে সাদর আহ্বান জানালেন মহিলা।

সন্তর্পণে পোয়ারো ভীষণ নোংরা বাসনমাজার জায়গাটা পেরিয়ে ঢুকলেন ততোধিক নোংরা রান্নাঘরে।

-শুনুন মশাই, ভদ্রমহিলা কিন্তু খুন হননি এখানে। ঐ কাণ্ডটা ঘটেছিল বোধ হয় বৈঠকখানায়।

পোয়ারো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

মশাই এই ব্যাপারে আপনিই তো তদন্ত করছেন, তাই না? আপনি সামারহেসদের বাড়িতে উঠেছেন?

-ও, তাহলে আপনি সব খবরই আমার জানেন, আর তা না জানারই বা কি আছে মিসেস….

–কিডল, একজন রাজমিস্ত্রী আমার স্বামী। প্রায় চার মাস আগে এখানে এসেছি। জানেন, আগে ঐ বাচেঁর মায়ের সঙ্গে থাকতাম।

একজন বললে, আর যাই কর তোমরা খুনের জায়গায় থাকতে যেও না। আরে বাবা খুন হয়েছে তো কি হয়েছে? একটা বাড়ি তো বটে। বলুন আপনি? খুপরী ঘরে কষ্ট করে চেয়ার জোড়া দিয়ে শোবার চেয়ে এ ঢের ভালো।

অবশ্য সবাই বলে–খুন হয় যারা তাদের অতৃপ্ত আত্মাটা নাকি ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এসব দিক দিয়ে এই ভদ্রমহিলার আত্মাটি খুব ভালো। তা, হা দেখবেন নাকি খুনের জায়গাটা?

প্রায় অসহায় পোয়ারো নিজের ভাগ্যের হাতে থুড়ি সমর্পণ করলেন ভদ্রমহিলার হাতে।

একটা ছোট্ট ঘরে মিসেস কিডল তাকে নিয়ে এলেন।

-বুঝলেন, ভদ্রমহিলা এই ঘরের মেঝেতে পড়েছিলেন। মাথার পেছনটা ওর একেবারে দু ফাঁক-ওফ। মিসেস এলিয়টই ওকে ওই অবস্থায় দেখে প্রথমে। লারকিনের সাথে যৌথভাবে রুটির ব্যবসা চালায় মিসেস এলিয়ট। ওপরতলা থেকে কিন্তু চুরি গেছে টাকাটা। আমার সঙ্গে আসুন আপনি, দেখিয়ে দিই সব।

সোজা ওপরে উঠে এলেন মিসেস কিডল। একটা শোবার ঘর-বড় ড্রয়ার, পেতলের একটা খাট, চেয়ার কয়েকটা, একরাশ ভিজে আর শুকনো জামা বাচ্চাদের।

-ঠিক এইখানে, বুঝলেন? চারদিকে পোয়ারো তাকালেন। সত্যিই শক্ত বিশ্বাস করা। ভদ্রমহিলা এখানেই থাকতেন, ঘুমোতেন।

-মিসেস কিডল, নিশ্চয়ই ওঁর আসবাব নয় এগুলো?

-না না, সে সবই ওঁর ভাইঝি কুলাভনে নিয়ে গেছেন।

কোনো স্মৃতিচিহ্নই মিসেস ম্যাগিনটির আর পড়ে নেই। সবকিছু কিডলরা দখল করেছে। জীবন সত্যিই মৃত্যুর পর কতখানি প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

বাচ্চার তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল নিচের তলা থেকে।

-এঃ হেঃ, উঠে পড়েছে বাচ্চাটা। কিছুটা অনাবশ্যক ভাবেই মহিলাটি কথাটা বলে সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নেমে গেলেন। পেছন পেছন পোয়ারো। এখানে তার দেখার মত সত্যিই নেই কিছু, পাশের বাড়ির উদ্দেশ্যে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।

–হ্যাঁ মশাই, তাকে আমিই প্রথম মৃত অবস্থায় ওই ভাবে আবিষ্কার করি।

অবাক হতে হয় মিসেস এলিয়টের নাটুকেপনায়। এত ছিমছাম ছোট্টখাট্টো বাড়িতে বেশ বেমানান উনি।

লারকিন, দরজায় রুটিওয়ালা ওই প্রথমে ধাক্কা দেয়। আমাকে বলে যে, মিসেস ম্যাগিনটি কিছুতেই দরজা খুলছেন না। আমার প্রথমেই শুনে মনে হয়েছিল, বয়স হয়েছে। উনি নিশ্চয়ই অসুস্থ হয়েছেন। বয়েস হলে স্ট্রোকটোক হয়, সে তো জানা কথা। ওর বাড়িতে আমি তাড়াতাড়ি যাই। দুজন পুরুষ মানুষের পক্ষে সোজাসুজি একজন মহিলার ঘরে ঢুকে পড়া একটু অসুবিধেজনক। বোঝেন তো?

ঘাড় নাড়লেন পোয়ারো। তারপর বুঝলেন, আমি সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে যাই। সেই বেন্টলী নামে লোকটা, সে দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মাথায়। ওকে কি ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। কত না জানি ভয় পেয়েছে। অবশ্য তখন আমি সত্যিই জানি না কি সর্বনাশই না ঘটে গেছে। দরজায় প্রথমে জোরে জোরে ধাক্কা দিলাম। সাড়া পেলাম না। বাধ্য হয়ে হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলে দেখি…সব কিছু ঘরের ভেতর লণ্ডভণ্ড তক্তাটা মেঝে থেকে খোলা। চেঁচিয়ে উঠেছিলাম আমি ডাকাতি বলে। কিন্তু কোথায় গেলেন বৃদ্ধা মহিলা? আমরা ওকে বসার ঘরে গিয়ে দেখতে পাই। ও….ভাবতেও পারি না আমি, একেবারে মাথাটা থেতলে গিয়েছে। খুন। তখুনি আমি বুঝেছিলাম এটা খুন। ডাকাতি আর খুন একসঙ্গে। তারপর সে কি চিৎকার আমার। ওরা দুজন তো আমাকে নিয়ে বেশ ব্যস্তই হয়ে পড়ল। বোধহয় অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলাম। ব্রাণ্ডি দোকান থেকে এনে খাইয়ে চাঙ্গা করে তোলে আমাকে। কি সমবেদনা পুলিশ সার্জন্টেরও দোহাই আপনার, উত্তেজিত হবেন না, ভয় পাবেন না। গরম চা খান বাড়ি গিয়ে? হ্যানো ত্যানো কত কি। বাড়ি ফিরে আমার স্বামী সব জিজ্ঞেস করলেন, আমার তখনো সেকি কাপুনি। ব্যাপারটা কি জানেন? আসলে আমার মনটা বাচ্চাদের মতই নরম।

পোয়ারো অভদ্রের মত প্রায় দাবড়ানি দিয়েই মহিলাটির আত্মপ্রশংসা করা থামিয়ে দিলেন।

–আচ্ছা আচ্ছা, এখনি বলুন তো ঠিক কখন ওকে আপনি শেষ বারের মত জীবিত অবস্থায় দেখেন?

-সেটা হবে তার আগের দিনই সকালে, উনি বাড়ির পেছনের বাগানে এসেছিলেন পুদিনা শাক তুলতে।

-আপনাকে কি উনি কিছু বলেছিলেন?

-এই টুকটাক আর কি। যেন ভালো যায় সময়টা এ ধরনের শুভকামনা করেছিলেন বলে মনে পড়ছে।

-তাহলে খুন হবার আগের দিন আপনি ওঁকে সকালে শেষবার জীবিত দেখেন তারপর আর নয়।

-হ্যাঁ, তাই তবে ঐ বেন্টলী ছোকরাকে দেখেছিলাম। গলার স্বর মিসেস এলিয়টের খাদে নেমে এল। এই সকাল এগারোটা আন্দাজ। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, এলোমেলো পা ফেলতে ফেলতে যেমন ওর ধরন।

চুপ করে রইলেন পোয়ারো কিন্তু তারপর কিছু বললেন না ভদ্রমহিলা।

হঠাৎ পোয়ারো বললেন, আচ্ছা জবাব দিন তো একটা কথার। সত্যি কি আপনি অবাক হয়েছিলেন যখন পুলিশ বেন্টলীকে গ্রেপ্তার করেছিল?

-হ্যাঁ, হয়েছিলাম আবার হইনিও বলতে পারেন। এটা ঠিক যে আমার বরাবরই ছোকরাকে কেমন খ্যাপাটে ধরনের বলে মনে হত। আমার এক খুড়তুতো ভাইও পাগলাটে। সেও মাঝে মাঝে একটু আধটু উল্টোপাল্টা কাজ করে ফেলে। আমার একেও সেরকম মনে হয়। ফাঁসিকাঠে একে না ঝুলিয়ে পাগলাগারদে পাঠালেও আশ্চর্য হব না আমি। আরে বাবা, ও চোরাই টাকাগুলো এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখল যে বিশ্বসুদ্ধ লোকে সেটা খুঁজে পাবে। মোট কথা ও বড় বোকা আর সাদাসিধে ধরনের।

–আপনার কি কোনো মাংস কাটার বড় ছুরি বা ওই গোছের কিছু হারিয়েছে?

-না মশাই, অবশ্য এ কথা পুলিশের তরফ থেকেও করা হয়েছিল আমাকে। শুধু আমাকেই নয়, যতজন এখানে আছে সকলকে। আশ্চর্য লাগছে ভাবলে যে ছোকরা কি দিয়ে খুন করলো মহিলাকে।

ডাকঘরের দিকে গুটিগুটি পোয়ারো এগোলেন। কি কাণ্ড খুনী বলে পরিচিত এই বেন্টলী এমন জায়গায় টাকা লুকিয়ে রাখে যাতে সহজে খুঁজে পাওয়া যায় অথচ খুনের হাতিয়ারটা যে কোথায় লুকালো। মাথা নাড়লেন তিনি। আশেপাশের বাকি বাড়ি দুটোতেও তিনি গিয়েছিলেন যার বাসিন্দারা মিসেস কিডল বা এলিয়েটের মত নয়। তাদের কাছ থেকে মৃতার সম্বন্ধে যা জানা গেছে সংক্ষেপে তা হল :

আত্মসম্মানবোধ সম্পন্না মহিলা ছিলেন উনি। ভালোবাসতেন নিজের মনে থাকতে। ওর এক ভাইঝি থাকে কুলাভনে–সে ছাড়া বিশেষ কেউ ওর সঙ্গে দেখা করতে আসত না। এই নিরীহ মহিলার ওপর কারো রাগ থাকতে পারে মনে হয় না। তবুও অনেকেই সন্দেহ করে বেন্টলীকে খুনী বলে।

মনে মনে পোয়ারো ভাবছিলেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। সমাধানের আলো কই? মিঃ স্পেন্সের মানসিক চাঞ্চল্য অনুভব করি আমি। দুদে পুলিশ অফিসার একজন। তিনিও কিছু করতে পারছেন না। কিন্তু এরকুল পোয়ারো আমি–কেন ব্যর্থ হব আমি?

ডাকঘরে ঢুকলেন পোয়ারো, বেশ সাজানো গোছানো অনেকটা জায়গা। এগিয়ে গেলেন। কিছু ডাক টিকিট কেনার উদ্দেশ্য। তার দিকে যে ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন তিনি মধ্যবয়স্কা বুদ্ধিদীপ্ত চোখ।

মিসেস সুইটিম্যান তার নাম।

–নিন। সব মিলিয়ে মোট বারো পেনি। আর কিছু লাগবে?

 পোয়ারোর মুখের ওপর নিবদ্ধ মহিলাটির বুদ্ধিদীপ্ত দৃষ্টি। একটি আগোছাল চুল ভরা মেয়ের মাথা পিছনের দরজা দিয়ে উঁকি মারছিল।

-এ অঞ্চলে একেবারেই নতুন আমি–পোয়ারো বললেন।

–লণ্ডন থেকে বোধহয় এসেছেন?

–আচ্ছা মাদাম, আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা নিশ্চয়ই জানেন আপনি।

 –মোটেই উদ্দেশ্য জানি না।

মিসেস ম্যাগিনটি।

–ও, সত্যি মর্মান্তিক।

–বোধহয় আপনি ওকে ভালোভাবেই চিনতেন?

-হ্যাঁ, ব্রডহিনির আর পাঁচজনের মতই আমার পরিচয় ছিল ওর সঙ্গেও। ওর সাথে গল্প হত এখানে এলেই। খুবই দুঃখের ব্যাপার আর যদুর শুনেছি বোধহয় কোনো মীমাংসা হয়নি।

পুলিশের তো সন্দেহ বেন্টলীই খুনী।

–হা জানি। তবে ভুল তো পুলিশেরও হতে পারে। এরকম ঘটনা আকছারই ঘটছে। আবার যেন আপনি ভেবে বসবেন না তার সম্বন্ধে আমি খুব উঁচু ধারণা পোষণ করি। আসলে শুধু সন্দেহের বশে কাউকে খুনী ভাবা উচিত নয় তাই না?

লেখার কাগজ চাইলেন পোয়ারো মহিলাটির কাছে। বাঁদিক থেকে উনি কাগজ আনলেন।

–দেখুন মশাই, এসব অঞ্চলে একেবারেই যে চোর ডাকাতি হয় না তা তো নয়। মনে হয় আমার কোনো ছিঁচকে চোর জানলা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকেছিল– তারপর সরে পড়েছে টাকাকড়ি হাতিয়ে। নিন আপনার কাগজ।

কেনাকাটা শেষ হল পোয়ারোর।

–আচ্ছা মাদাম, কখনো তো উনি কারো সম্বন্ধে ভয়টয় প্রকাশ করেননি না?

-না তো আমার কাছে তো অন্তত নয়। মিঃ কার্পেন্টারদের বাড়িতে উনি প্রায়ই যেতেন। ওদের ওখানে মাঝে মাঝে পার্টিটার্টি হয় সেই উপলক্ষে কাজে সাহায্য করতে। যা রাত হত ফিরতে বাড়ি তো পাহাড়ের মাথায়। অন্ধকার রাস্তা দিয়ে হাঁটা হয়ত ভয় করত।

–আপনি ওর ভাইঝি মিসেস বার্চকে চেনেন?

–হা, আলাপ হয়েছে অল্পস্বল্প। মাঝে মাঝে স্বামীকে নিয়ে আসতেন।

–মহিলার টাকাকড়ি যা কিছু সবই তো পাবেন উনি?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মিসেস সুইটিম্যান পোয়ারোর দিকে তাকালেন। স্বাভাবিক নয় কি সেটাই?

-হ্যাঁ, তা তো বটেই তো তো বটেই। আচ্ছা ভাইঝিকে কি মিসেস ম্যাগিনটি পছন্দ করতেন?

-হা খুব ভালোবাসতেন। তবে বড় চাপা স্বভাবের মহিলা ছিলেন উনি।

–আর ভাইঝি জামাইকে?

–যতদূর জানি, তাকেও।

–কবে, ওঁকে আপনি কখন শেষবারের মত জীবিতাবস্থায় দেখেন?

দাঁড়ান মশাই ভেবে দেখি। এডনা মনে আছে তোমার?

অসহায়ের মত দরজার পেছনে দাঁড়ানো এডনা তাকালো।

দাঁড়ান, দাঁড়ান। মৃত্যুর দিন কি? না, তার আগের আগের দিন। সোমাবার ছিল সেদিন আর বুধবার খুন হন উনি। এখানে সোমবার উনি এক বোতল কালি কিনতে এসেছিলেন।

-কালি কিনতে আসেন এক বোতল!

বোধহয় চিঠি লেখার জন্য তা হতে পারে।

-আচ্ছা উনি কি সেদিন কথাবার্তা বেশ স্বাভাবিক বলেছিলেন?

-না, আমার তা মনে হয়নি। এডনা এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে যোগ দিল ওদের কথায়। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন মিসেস সুইটিম্যান। সেদিন কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল ওঁর আচরণ। মানে বেশ উত্তেজিত ভাব আর কি।

–এডনা ঠিক বলেছে তবে ততটা আমি লক্ষ্য করিনি। আপনি জিজ্ঞেস করাতে খেয়াল হচ্ছে এখন।

–মনে করতে পারেন সেদিন উনি কি বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন।

–সবটা না পারলেও হয়ত কিছু কিছু পারব। যেমন বেন্টলীর সম্বন্ধে কিছু বলেননি। তবে কার্পেন্টারদের আর মিসেস আপওয়ার্ড সম্বন্ধে কিছু বোধ হয় বলেছিলেন। ওর তো মনিব দুজনেই।

–ও হ্যাঁ, বলুন তো উনি কোথায় কোথায় কাজ করতেন?

 –সোম আর বৃহস্পতিবার সামারহেসদের বাড়িতে। আপনি তো ওখানেই আছেন?

–হ্যাঁ, এখানে মনে হয় থাকবার মত আর কোনো জায়গার ব্যবস্থাও নেই?

-না, ঠিক ব্রডহিনিতে কোথাও তেমন ভালো পাবেন না। একটু অসুবিধে হচ্ছে ওখানে আপনার না? অবশ্য মিসেস সামারহেস খুবই ভালো তবে ওঁর ঘর গেরস্থালী সম্পর্কে জ্ঞান বেশ কম। সেরকমই বলতেন মিসেস ম্যাগিনটি। অস্থির হয়ে যেতেন ঘরদোর গুছোতে। মঙ্গলবার সকালে উনি যেতেন ডাঃ রেগুলের ওখানে আর মিসেস আপওয়ার্ডের বাড়ি বিকেলে। মিসেস ওয়েদারবি প্রতি বুধবার ওখানে যেতেন। শুক্রবার ছিল যাবার দিন মিসেস সেলকার্কের কাছে অবশ্য বর্তমানে উনিই মিসেস কার্পেন্টার। মিসেস আপওয়ার্ড বৃদ্ধা-উনি থাকেন ছেলের সাথেই। একটি কাজের মেয়ে আছে ওদের। মিসেস ওয়েদারবি বাতে প্রায় পঙ্গু। কিছুই পারেন না করতে। মিসেস কার্পেন্টার আবার মাত্রাছাড়া শৌখিন। মিসেস ম্যাগিনটিকেই সব ঝক্কি পোহাতে হত।

জানার ছিল না আর কিছু। ডাকঘর থেকে পোয়ারো বেরিয়ে এলেন। চুপচাপ মন্থরগতিতে লংমিডোস-এর সামারহেসেদের বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন। প্রার্থনা করছিলেন মনে মনে ওই অখাদ্য বীনসেদ্ধ আর টিনের খাবারগুলো যেন সাবাড় হয়ে গিয়ে থাকে মধ্যাহ্নভোজে। কিন্তু শিকে কি আর ছিঁড়বে বেড়ালের ভাগ্যে? উঃ একবারে যাচ্ছেতাই ওই আস্তানাটা।

পোয়ারো হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলেন আজকের দিনটার কথা। বোধহয় বিফলে গেল। দিনটা যেসব তথ্য জানা গেল, সেগুলোকে মনে মনে সাজালেন :

এক– একজন বান্ধবী ছিল বেন্টলীর।

দুই –তার ও মিসেস ম্যাগিনটির শত্রু ছিল না কোনো।

তিন– মহিলাটিকে মৃত্যুর দিন দুই আগে খুব উত্তেজিত মনে হয়েছিল। এক বোতল কালি কিনেছিলেন তিনি।

বিস্মিত হলে পোয়ারো। কিছুর কি ইঙ্গিত দিচ্ছে কালি কেনার ব্যাপারটা? কোনো চিঠি লেখাটেখা? চিঠি অন্য সকলের ক্ষেত্রে লেখা খুব মামুলী ব্যাপার কিন্তু তা নিঃসন্দেহে ওর পক্ষে মামুলী ছিল না অনভ্যস্ত ছিলেন তিনি নিশ্চয়ই। নইলে কি হঠাৎ কেউ এক বোতল কালি কেনে? উনি যে খুব কম চিঠিপত্র লেখালেখি করতেন তা মিসেস সুইটিম্যানের কথা থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু মাত্র মৃত্যুর দুদিন আগে হঠাৎ ওঁর লেখার দরকার হল–হয়ত কোনো চিঠির উত্তর দিতে কাকে কেন : ব্যাপারটা এও হতে পারে তেমন কিছুই নয়। ভাইঝি বা কোনো বন্ধুকে চিঠি দিয়েছিলেন সত্যিই কালি কেনাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়–কিন্তু এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পোয়ারোর কাছে। এটাকে ভিত্তি করেই এগোতে হবে তাকে….এক বোতল কালি….

.

০৮.

জিজ্ঞেস করছেন চিঠির কথা। বেমি মার্চ মাথা নাড়লেন, না তো, আমি পিসীর কাছ থেকে কোনো চিঠি-পত্তর পাইনি। আর আমাকে হঠাৎ লিখতেই বা যাবেন কেন?

–আপনাকে হয়ত কিছু জানাতে চেয়েছিলেন।

–কিন্তু তিনি মোটেও লেখালিখির ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিলেন না। প্রায় বয়স হয়েছিল সত্তরের কাছে। ওদের সময় লেখাপড়ার তেমন চলও ছিল না।

–তবু উনি নিশ্চয়ই লিখতে পড়তে জানতেন।

-হা, হা একজন বিরাট পড়ুয়া ছিলেন না তিনি ঠিকই, তবে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড আর সানডে কম্প্যানিয়ন নিয়ে ওঁর দিব্যি কেটে যেত সময়। ওঁর কাছে একটু কষ্টকর ছিল লেখালেখির কাজটা। কিন্তু আমাকে জানাবার দরকার হলে যেমন ধরুন কোনো কারণে আমাদের পারস্পরিক দেখা করবার প্রোগ্রামটি বাতিল করতে হলে সাধারণত আমার পাশের বাড়ির কেমিস্ট ভদ্রলোক মিঃ বেনসনকে ফোনে বলে দিতেন। আমি খবরটা পেয়ে যেতাম ওখান থেকেই। মিঃ বেনসন এসব দিক দিয়ে খুব ভদ্র। কখনো কিছু মনে করতেন না। আর ব্রডহিনির ডাকঘর থেকে ফোন করতে পিসীর খরচ হত মাত্র দু পেনি।

পোয়ারো বুঝলেন মিসেস ম্যাগিনটি সত্যি খুব হিসেবী আর মিতব্যয়ী ছিলেন। বেশ সংযত টাকা পয়সার ব্যাপারে।

কথা চালিয়ে গেলেন উনি– কিন্তু আপনাকে তো উনি লিখতেন মাঝে মাঝে।

-হ্যাঁ, বড়দিনে যেমন কার্ড পাঠাতেন।

–হয়ত ইংলণ্ডের অন্যত্র ওর অনেক বন্ধু ছিল- যাদের সাথে চিঠিতে যোগাযোগ রাখতেন।

–আমি সেটা বলতে পারি না। এক ননদ ছিলেন ওঁর–মারা গেছেন দু বছর আগে। আর একজন ছিলেন মিসেস বার্ডলিপ, কিন্তু তিনিও মৃতা।

–ব্যাপারটা তা হলে এমন দাঁড়াচ্ছে যে, তিনি যদি বা কাউকে লিখে থাকেন তা কারোর চিঠির জবাব।

একটু চিন্তিত দেখালো বেমি বার্চকে।

–কিন্তু মিঃ পোয়ারো, ওঁকে কেই বা লিখতে যাবে?

তার মুখটা পরক্ষণেই উজ্জ্বল হয়ে উঠলো–কি আশ্চর্য! সরকার থেকেও তো লিখতে পারে।

পোয়ারো কথাটায় বিশেষ উৎসাহ দেখালেন না।

মিঃ পোয়ারো বুঝলেন, ফর্ম ভর্তি করা, একগাদা আপত্তিকর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সরকারের চিঠি পেলে অনেক ঝামেলা হয়।

–তাহলে আপনি তাই ভাবছেন মহামান্য সরকার বাহাদুরের কাছ থেকে উনি কোনো চিঠি পেয়ে তারই জবাব দিতে ব্যস্ত হয়েছিলেন?

–মনে হয়। তবে যদি তা হত তাহলে পিসী আমাদের কাছে নিশ্চয়ই কাগজপত্র নিয়ে একবার আসতেন। এসব সরকারী ব্যাপারে উনি বরাবর আনাড়ি ছিলেন–বিব্রতও বোধ করতেন।

–আচ্ছা মিসেস বার্চ, আপনার কি মনে আছে ওর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের মধ্যে চিঠি ছিল কিনা কোনো?

–ঠিক মনে নেই আমার, প্রথমে পুলিশ তদন্ত করে। বেশ কিছুদিন পর আমার হাতে তুলে দেওয়া হয় পিসীমার জিনিসপত্র।

-কি হল জিনিসগুলোর?

–ওই যে চেস্টটা দেখছেন, ওটা ওঁর। খুব ভালো, মেহগনি কাঠের। একটা ওয়ার্ডরোব আছে ওপরে আর ভালো কিছু রান্নার বাসনপত্র, বাকি জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছি। এত জায়গার অভাব বাড়িতে।

–ওঁর একান্ত ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের কথা আমি বলছি। এই যেমন–ব্রাশ, চিরুনি ফোটোগ্রাফ, প্রসাধনী, কাপড় জামা….

ওঃ, একটা বাক্সে ওসব জিনিস পুরে আমি রেখেছি ওপরের ঘরে। বড়দিনে জামা কাপড়গুলো গরীবদের মধ্যে ভেবেছি বিলিয়ে দেব। আবার পুরনো জিনিস অনেকে সস্তায় বিক্রি করেন–আমার সেটা পোযাবে না।

–কিছু যদি মনে করেন, একবার খুলে দেখতে পারি এই বাক্সটা?

–নিশ্চয়ই। সেজন্য এত কিন্তু কিন্তু করছেন কেন? অবশ্য আমার মনে হয় না আপনি এমন কিছু তাতে পাবেন যা সাহায্য করবে তদন্তের কাজে। সবই তো পুলিশ দেখেছে। তবু আপনিও দেখুন।

তৎপরতার সাথে মিসেস বার্চ পোয়োরোকে নিয়ে চলে এলেন ছোট্ট একটা শোবার ঘরে। পোয়ারোর মনে হল বাড়ির লোকেদের জামা কাপড় তৈরি করা হয় ঘরটাতে। একটা স্যুটকেস খাটের নিচ থেকে বের করে মিসেস বার্চ বললেন, এই নিন। রান্না চাপিয়ে এসেছি আমি, বড্ড ব্যস্ত। নিজেই আপনি দেখেশুনে নিন।

অত্যন্ত কৃতজ্ঞভাবে পোয়ারো তাকে বিদায় জানালেন। মিসেস বার্চের সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে যাবার শব্দ পেলেন। উনি স্যুটকেসের ডালা খুললেন।

ঝুলে ভর্তি ভেতরটা, প্রথমেই বেরোলো ছেঁড়া একটা কোট। সেই মৃতা মহিলার এটি। উলের দুটো সোয়েটার, আরও একখানা কোট, স্কার্ট আর লম্বা মোজা। একটাও পাওয়া গেল

অর্ন্তবাস যখন, ভাইঝিই বোধহয় ব্যবহারের জন্য নিয়েছে। চুলের একটা ব্রাস, একটা চিরুনি ভাঙা কিন্তু পরিষ্কার, একখানা রুপোর গিল্টি করা আয়না। মহিলা আর তার স্বামীর যুগল ফোটো। পিকচার পোস্টকার্ড দুটো, একটা চিনেমাটির কুকুর, পক প্রণালীর ছেঁড়া পাতা উড়ন্ত চাকীর ওপর, খবরের কাগজের একটা কাটিং, একখানা বাইবেল প্রার্থনার বই–এই ধরনের খুঁটিনাটি জিনিস।

পাওয়া গেল না কোনো দস্তানা বা হাতব্যাগ। হয়ত সেগুলোও মিসেস বার্চ নিজে নিয়েছেন বা কাউকে দিয়েছেন। যা জামাকাপড় আছে তা ভাইঝির গায়ে হত না। বেশ ছোটোখাটো মহিলা ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে।

একটা জুতোর মোড়ক পেয়ে সেটা পোয়ারো খুললেন। বেশ দামী জুতো অবস্থাও ভালোই রয়েছে জুতোর। তবে পায়ে হত না মিসেস বার্চের। জুতো জোড়া যে কাগজে মোড়া ছিল তা দিয়ে পোয়ারো আবার জুতো মুড়িয়ে রাখতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ হেড লাইনের দিকে সেটা ওর নজর গেল, সানডে কম্প্যানিয়ন।

উনিশে নভেম্বরের কাগজে। নিহত হন ভদ্রমহিলা ঐ মাসেরই বাইশ তারিখে। তাহলে এই কাগজখানা উনি মারা যাবার দু-তিন দিন আগে কিনেছিলেন। একখানা পড়েছিল ওর ঘরেই পরে নিশ্চয়ই এটি মিসেস বার্চ জুতো মুড়িয়ে রাখেন।

রবিবার উনিশে নভেম্বর, সোমবার বিশ তারিখে মিসেস ম্যাগিনটি ডাকঘরে যান এক বোতল কালি কিনতে। তাহলে কি আকস্মিকভাবেই কোনো কিছুর ওপর নজর পড়েছিল?

অন্য জুতো জোড়ার মোড়ক খুললেন পোয়ারো। সেখানে নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড শিরোনামের কাগজের পাতা। এটার তারিখও উনিশে নভেম্বর।

চোখের সামনে দুখানা কাগজই টান টান করে মেলে ধরতে পোয়ারো আবিষ্কার করলেন, সানডে কম্প্যানিয়নের পৃষ্ঠার কিছুটা অংশ কেটে নেওয়া হয়েছে পরিষ্কার ভাবে। তন্নতন্ন করে, কাগজ দুখানা খুঁজেও কৌতূহলোদ্দীপক কিছু খুঁজে পেলেন না। নিচে গেলেন সুটকেস গুছিয়ে রেখে তখনো মিসেস বার্চ ব্যস্ত রান্নাঘরে।

নিশ্চয়ই আপনি তেমন কিছু খুঁজে পেলেন না?

দায়সারা ভাবে পোয়ারো বললেন, মিসেস বার্চ, আপনার পিসীমার হাত ব্যাগ বা পার্সে কি আপনি কাগজের কোনো কাটিং দেখেছিলেন।

-কই মনে তো পড়ছে না, হয়ত পুলিশ নিয়ে গেছে।

কিন্তু না, স্পেন্সের দেওয়া কাগজপত্র পোয়ারো ঘেঁটে বুঝলেন সেরকম কিছু পায়নি পুলিশ। তারা বাজেয়াপ্ত করেছে হাতব্যাগ কিন্তু কাগজের কোনো কাটিং ছিল না তাতে।

-হুম, দুটো জিনিস হতে পারে। হয় কিছুই নয় ঘটনাটা, অথবা আমার নতুন পদক্ষেপের সূচনা।

পুরনো খবরের কাগজের ফাইলের সামনে নিথর হয়ে বসে থাকা পোয়ারো ভাবলেন মিসেস ম্যাগনটির কালি কেনার ব্যাপারটা তার মনে যে ধাঁধাঁ লাগিয়েছিল তা নিছক অর্থহীন নয়। সানডে কম্প্যানিয়ন পুরনো দিনের ঘটনার চিত্তাকর্ষক বিবরণ প্রকাশ করার জন্য বিখ্যাত। উনিশে নভেম্বরের সানডে কম্প্যানিয়নের পাতা খোলা পোয়ারোর সামনে। মাঝের পাতার একেবারে ওপর দিকে বড়বড় হরফে লেখা :

বিগত দিনের নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত এই মহিলারা এখন কোথায়?

 এর ঠিক নিচে চারটে পুরনো ঝাপসা ছবি যা দেখেই বোঝা সম্ভব নয়। তবে পুরনো দিনের পোশাকে সজ্জিতা মহিলাদের ছবি তো। তাই অদ্ভুত লাগছিলো। একটি করে নাম ছাপা প্রত্যেক ছবির নিচে।

ইভা কেন-কুখ্যাত গ্রেস মামলার অপর মহিলাটি। জেনিস কোর্টল্যাণ্ড–সেই দুভাগ মহিলা যার স্বামীর নৃশংসতা ছিল নজিরবিহীন।

-ছোট লিলি গ্যাম্বল-সামাজিক বিধিনিষেধের শিকার এই শিশুটি।

ভেরা ব্লেক–কখনো ভদ্রমহিলাটি সন্দেহ করেননি যে একজন হত্যাকারী তার স্বামী। এখন এঁরা কোথায়।

এবার পোয়ারো মনঃসংযোগ করলেন ছবির নিচে দেওয়া এদের জীবনের সংক্ষিপ্ত রোমহর্ষক বিবরণে।

তার মনে পড়ল ইভা কেনের নাম। সেই সময়ের অন্যতম চাঞ্চল্যকর মামলা ছিল সেটা। একটা ছোট শহরে যার নাম পারমিনস্টার তাতে আলফ্রেড ক্রেগ কেরানীর কাজ করত। সাদামাটা চেহারার ভদ্র মার্জিত লোক ছিল সে। কিন্তু তার স্ত্রী দুর্ভাগ্যবশত ছিল রুক্ষ বদমেজাজী স্বভাবের। এক মুহূর্তের জন্যও ক্রেগকে স্বস্তি দিত না। স্ত্রীর দৌলতে ডুবে গেল ক্রেগ, নিজেকে অসুস্থ বলে জাহির করত কিন্তু লোকে বলত সবই মনগড়া অসুখবিসুখ। ইভা কেন এদের বাড়িতে গভর্নেসের কাজ করত। এই উনিশ বছরের ইভা মিষ্টি চেহারার নরম প্রকৃতির অসহায় একটি মেয়ে। আলফ্রেড এবং ইভা দিনে দিনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং গভীরভাবে দুজন দুজনকে ভালোবাসে।

একদিন প্রতিবেশীরা শোনে যে, মিসেস ক্রেগকে স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বাইরে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন ডাক্তার। সবাইকে ক্রেগ সেইরকমই বলেছিল। সে স্ত্রীকে লন্ডনে পৌঁছে দিয়ে আসে গাড়ি করে এবং সেখান থেকে মিসেস ক্রেগ নাকি যাত্রা করেন ফ্রান্সের দক্ষিণে। ক্রেগ পারমিনস্টারে ফিরে আসে। সে প্রতিবেশীদের প্রায়ই কথা প্রসঙ্গে জানাত যে, স্ত্রী চিঠিতে লিখেছে তার শরীর ভালো যাচ্ছে না বলে। ঘরের কাজকর্ম দেখাশুনো করতে ইভা রয়ে যায় ক্রেগের বাড়িতেই। দুজনের ঘনিষ্ঠতাকে কেন্দ্র করে মৃত্যু সংবাদ পায় তার স্ত্রীর। খবর পেয়ে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে সে চলে যায় এবং স্ত্রীর শেষ কাজ করে ফিরে আসে।

একটা মস্ত ভুল করে কিন্তু ক্রেগ। যে জায়গায় তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে বলে সে বলেছিল, সেটা খুবই পরিচিত অঞ্চল। ফ্রান্সের এক জন প্রতিবেশী ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা তার এক আত্মীয়কে লেখা চিঠিতে মিসেস ক্রেগের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছিল। কিন্তু চিঠির উত্তর মারফত সে জানতে পারে এরকম কোনো মৃত্যু ঘটেনি সেখানে। এর কয়েকদিন বাদে পুলিশি তদন্ত হয়। সকলেই জানে তার পরের ঘটনা। আদৌ মিসেস ক্রেগ ফ্রান্সে যায়নি। ময়নাতদন্তে জানা যায় ভেষজ বিশে তাকে হত্যা করে খণ্ড খণ্ড করে পরিষ্কার ভাবে কেটে ফেলে ক্রেগের বাড়ির চিলেকোঠায় লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। হত্যাপরাধে ক্রেগ অভিযুক্ত হয়। ইভা কেনও ধরা পড়ে কিন্তু প্রমাণাভাবে ছাড়া পায়। কারণ এ সবের কিছুই সে জানত না। নিজের অপরাধ ক্রেগ স্বীকার করে শাস্তি পায়। ইভা সেই সময় সন্তানসম্ভবা ছিল সে পারমিনস্টার ছেড়ে চলে যায়। কোনো সহৃদয় আত্মীয় তাকে আশ্রয় দেন। নিজের নাম ইভা পরিবর্তন করে নৃশংস হত্যাকারী ক্রেগের আওতা মুক্ত হয়ে জীবন শুরু করে নতুন ভাবে। নিজের আত্মজার কাছেও এই ঘটনা সে এবং তার জন্মদাতার নাম গোপন রাখে। সে বলে, আমার মেয়ে সুন্দর সুস্থ জীবনযাপন করুক তা চাই আমি আমার অতীতের ছায়া যেন না পড়ে তার জীবনে। আমার কলঙ্ক, দুঃখ সে আমারই থাক, যেন এতে তার কোনো ক্ষতি না হয়।

বেচারা ইভা। কত অল্প বয়সে তার নিজের জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এখন সে কোথায়? হয়ত কোনো ছোট্ট শহরে, একজন বৃদ্ধা শ্রদ্ধেয়া মহিলা হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে শান্ত নিরুপদ্রব জীবন কাটাচ্ছে। হয়ত বা তার মেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী হয়েছে, নিজের জীবনের খুঁটিনাটি সুখদুঃখের কথা মাকে জানায় সে, কিন্তু কোনোদিন নিজে জানতে পারে না তার মা কত দুঃখী।

-হুম।

পরের ছবিতে পোয়ারো নজর দিলেন।

জেনিস কোর্টল্যাণ্ডের এই ছবি, সত্যিই ভদ্রমহিলা দুর্ভাগ্যের শিকার। অত্যন্ত মন্দ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ওর স্বামী। মহিলাটি দীর্ঘ সত্যিই আট বছর নরকযন্ত্রণা ভোগ করে। তারপর ওর সঙ্গে এক ভদ্র যুবকের বন্ধুত্ব হয়। ভদ্র ও আদর্শবাদী এই যুবকটি জেনিসের ওপর একদিন তার স্বামীর অকথ্য অত্যাচার দেখে রেগে ওঠে এত যে, তার অত্যন্ত করুণ পরিণতি হয়। মার্বেল পাথরের ফায়ার প্লেসে সে জেনিসের স্বামীর মাথা ঠুকে ঠুকে ফাটিয়ে দেয়। ফলে পাঁচ বছরের জেল হয় তার। অসহায় জেনিস সব কিছু ভুলে থাকার জন্য বিদেশ চলে যায়।

কিন্তু সত্যিই সে কি সব ভুলে গেছে? সেইটুকু আশা করি আমরা স্বামী সংসার পরিবৃতা হয়ে, হয়ত নিজের দুঃখ মনে চেপে রেখে আপাত দৃষ্টিতে সে সুখী জীবন যাপন করছে। লিলি গ্যাম্বলের ছবিটি হল তৃতীয় ছবি।

যে পরিবারের সন্তান লিলি তাতে পরিবারের লোক সংখ্যা অনুপাতে আয়ের অংক অত্যন্ত কম হওয়ায় ওর এক পিসী নিজের কাছে ওকে নিয়ে আসেন। সিনেমা যেতে চাইলে লিলিকে তিনি বাধা দিতেন। এরকম প্রায়ই বাধা পাওয়াতে লিলি ক্ষিপ্ত হয়ে একদিন মাংস কাটার ছুরি দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে মহিলাকে। এই আঘাতে রোগা এবং ছোটখাটো চেহারার পিসীটি মারা যান। তখন লিলির বছর বারো বয়েস, অল্প বয়েসী কয়েদীদের স্কুলে স্থান পায় লিলি ও লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।

এখন নিশ্চয়ই একজন মহিলা লিলি আবার তার পুরনো জীবন সে ফিরে পেতে পারে। তার আচরণ খুব সন্তোষজনক ছিল। সে যতটা অপরাধের জন্য নিজে দায়ী, তার চেয়ে সমাজের বিধি নিষেধও কিছু কমদামী নয়। লিলি সমাজের নানারকম নিয়মের শিকার হয়েছিল। সে হয়ত আজ কারো সুখী স্ত্রী; কোনো সন্তানের সুখী মা। হায় ছোট্ট লিলি গ্যাম্বল।

পোয়ারো মাথা নাড়লেন। বারো বছরের লিলি, যে নাকি পিসীকে আঘাত করে মাংস কাটার ছুরি দিয়ে সে কখনোই খুব ভালো হতে পারে না। পোয়ারো কিন্তু এক্ষেত্রে হতভাগ্য পিসীর পক্ষই অবলম্বন করবেন।

ভেরা ব্লেকের শেষ ছবিখানা :

এমন এক শ্রেণীর মহিলা হল ভেরা–চিরদিনই যাদের ভাগ্য খারাপ। যে ছেলেটির সঙ্গে প্রথমে তার বন্ধুত্ব ছিল, জানতে পারা যায় ব্যাঙ্কের দারোয়ানকে খতম করে ডাকাতি করায় সে নজরবন্দী পুলিশের। পরবর্তীকালে ভেরা বিয়ে করে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ীকে। চোরাই মালের ব্যবাসা ছিল নাকি তার আবার। পুলিশের নেকনজর থেকে রেহাই পায়নি ভেরার দুই সন্তানও মায়ের সঙ্গে তারা মনিহারি দোকানে গেলে এটা সেটা দোকানের জিনিস সরাত। ভেরার অভিশপ্ত জীবন শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়। এক সহৃদয় ভদ্রলোক আশ্রয় দেন ভেরাকে তার দুটি সন্তানসহ। পর পর ভাগ্যের হাতে মার খাবার পর সুদিন এসেছে ভেরার।

আপন মনে পোয়ারো বললেন, এতেও সন্দেহ আছে আমার। কে বলতে পারে হয়ত ভেরা কোনো এক ধাপ্পাবাজের খপ্পরে পড়েছে এবার।

ভালো করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পোয়ারো ছবি চারটি দেখতে লাগলেন।

ইভা কেনের মাথায় কোকড়া কোঁকড়া চুল–নেমে এসেছে কানের দুপাশ দিয়ে। মস্ত টুপি মাথায়। টেলিফোনের রিসিভার কানে দেবার মত করে এ হাতে ধরা একগুচ্ছ গোলাপ কানের পাশে।

কান ঢাকা টুপি জেনিস কোর্টল্যাণ্ডের মাথায়। কোমরে কোমর বন্ধনী।

খুব সাধাসিধে চেহারার লিলি গ্যাম্বল। হাঁ করে আছে, চোখে মোটা কাঁচের চশমা। এতই অস্পষ্ট ভেরা ব্লেকের ছবি যে প্রায় কিছু বোঝাই যায় না।

মিসেস ম্যাগিনটি কোনো কারণে এগুলো কাগজ থেকে কেটে রেখেছিলেন, বোঝা গেল। এই খবরগুলোর অংশ জুতার মোড়কের কাগজটাতে তাই পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেন? সে কি, কারণ? এসব কি ওর শুধুই কৌতূহল উদ্রেক করেছিল?

আদপেই তা মনে হয় না পোয়ারোর। এই ষাট বছরের মহিলা জীবনে খুব কম জিনিসই ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছেন। পুলিশের রেকর্ড দেখেই তা বোঝা যায়। কাগজ থেকে রবিবার ভদ্র মহিলা কেটে রাখেন এগুলো। ডাকঘরে সোমবার যান এক বোতল কালি কিনতে সুতরাং অনুমান করা কঠিন নয় যে উনি, যাঁর চিঠি লেখার অভ্যেস ছিল না, লিখতে যাচ্ছিলেন একটা চিঠি। যদি আইন সংক্রান্ত চিঠি হত এটা তাহলে উনি সাহায্য নিতেন মিঃ বার্চের। সুতরাং তা যখন নেননি, সে সম্ভাবনা নেই- তাহলে?

আবার ছবি চারটের দিকে পোয়ারো তাকালেন। এখন এরা কোথায়? একটা কথা তিনি ভাবলেন–কে বলতে পারে এদের যে কেউ হয়ত একজন গত নভেম্বরে এই ব্রডহিনিতেই ছিলেন।

অবশ্য পোয়ারো পরের দিনের আগে মিস পামেলা হসফলের সংগে যোগাযোগ করে উঠতে পারলেন না। মিস হসফল কিন্তু বলে রেখেছিলেন তিনি খুব বেশি সময় দিতে পারবেন না, কারণ তাঁকে শেফিল্ড যেতে হচ্ছে বিশেষ কাজে।

দীর্ঘকায় পামেলা চেহারায় পুরুষালি ধাচের, পানাসক্ত এবং ধূমপানে অভ্যস্ত। তাকে দেখে বোঝা বেশ শক্ত যে কাগজের এরকম সেন্টিমেন্টাল লেখাটির লেখিকা তিনি।

-মঁসিয়ে পোয়ারো যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। আমার আবার বড্ড তাড়া আছে।

-ও হ্যাঁ, আপনারই একটা লেখার ব্যাপারে কথাটা সানডে কম্প্যানিয়নে ….গত নভেম্বরে…. নৃশংস ঘটনার শিকার চারজন হতভাগ্য মহিলার ব্যাপারে….

-হা হা। ঘটনাটা বেশ রসালো কি বলেন?

–অপরাধ সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর কথাই আমি বিশেষভাবে বলতে চাইছি। গত উনিশে নভেম্বরের প্রবন্ধটা। চারজন মহিলা হলেন ইভা কেন, ভেরা ব্লেক, জেনিস কোর্টল্যাণ্ড আর লিলি গ্যাম্বল।

মুচকি হাসলেন পামেলা-হা, হা এখন কোথায় এই সব মহিলারা?…মনে পড়েছে।

–মনে হয় আমার নিশ্চয়ই আপনি এসব ব্যাপারে মাঝে মাঝে উদ্ভট উদ্ভট চিঠিপত্র পেয়ে থাকেন।

–ওহ নিশ্চয়ই। কারো কারোর তো আজগুবি চিঠি লেখা ছাড়া কাজ থাকে না কোনো। যেমন ধরুন, কেউ নাকি খুনী ক্রেগকে হেঁটে যেতে দেখেছে রাস্তা দিয়ে। আবার কেউ কেউ নিজের জীবনের আরও করুণ আর আষাঢ়ে গল্প ফাঁদে।

কাগজে এই ফিচারটা ছাপা হবার পর ব্রডহিনি থেকে কোনো এক মিসেস ম্যাগিনটির লেখা একটা চিঠি কি পেয়েছিলেন আপনি।

ওঃ হো মঁসিয়ে পোয়ারো, তা কেমন করে জানব বলুন? আমি দিস্তে দিস্তে রোজ চিঠি পাই। অত চিঠির মধ্যে থেকে একটা বিশেষ কোনো নাম কেমন করে আমার মনে থাকতে পারে আপনি বলুন।

–তা ঠিক। তবুও মনে হয় আমার মনে রাখা উচিত ছিল আপনার; কারণ তার কয়েকদিন পরেই খুন হন উনি।

–আপনি এতক্ষণে ঝেড়ে কাসছেন মঁসিয়ে। ম্যাগিনটি, ম্যাগিনটি…. যেন চেনা চেনা লাগছে নামটা…। হ্যাঁ, মনে পড়েছে এইবার। মাথায় বাড়ি মেরে ওর বাড়ির ভাড়াটে ওকে খুন করেছিল, ঠিক কিনা, অবশ্য উত্তেজক খুন ওটা ছিল না। আপনি বলছেন ঐ ভদ্রমহিলা আমায় কোনো চিঠি লিখেছিলেন?

না, আপনাকে ঠিক কিনা জানি না। তবে সানডে কম্প্যানিয়ন এর চিঠিপত্র বিভাগে হয়ত…।

একই ব্যাপার আমার কাছেই আসত সে চিঠি। খুন হলেন ভদ্রমহিলা–তিনিই চিঠি লিখেছিলেন–তাহলে তো আমার মনে রাখার কথা। দাঁড়ান, দাঁড়ান-ব্রডহিনি থেকে ওটা নয়, ব্রডওয়ে থেকে লেখা।

-তাহলে মনে পড়েছে?

-না, খুব সঠিকভাবে কিছু মনে পড়ছে না… তবে ম্যাগিনটি…এ সবই এত মজার মনে হয় শুনতে মনে হচ্ছে যেন অন্যরকম পদবী। খুব বিশ্রী জড়িয়ে জড়িয়ে লেখা। সম্ভবত ভদ্রমহিলা তেমন শিক্ষিতা নন। তবে আমি নিশ্চিত যে ব্রডওয়ে থেকেই ওটা এসেছিল।

কিন্তু নিজেই তো আপনি বললেন জড়ানো লেখাটা। ব্রডহিনি, ব্রডওয়ে বানানের সামান্য এধার ওধার তো, আপনি ঠিকমত হয়ত পড়তে পারেননি।

–হ্যাঁ, তাও হতে পারে। ছোটোখাটো মফস্বলের জায়গার নাম তো ভুলও হতে পারে। ম্যাগিনটি হা হা, আমি এবার নিশ্চিত। খুনটা হয়েছিল বলেই স্পষ্ট মনে পড়ছে নামটা।

–আচ্ছা উনি কি লিখেছিলেন চিঠিতে মনে আছে আপনার? –কোনো একটা ছবির ব্যাপারে কিছু। সম্ভবত কাগজের ছবির মত উনি কোনো একটা ফটোগ্রাফ কোথাও দেখেছিলেন। তাই জানতে চেয়েছিলেন সেটার জন্য আমরা ওকে কত টাকা দিতে পারি।

এবং উত্তর দিয়েছিলেন আপনি?

-দেখুন, আমাদের এ ধরনের কোনো ফটোর প্রয়োজন ছিল না। চিরাচরিত প্রথায় ধন্যবাদ জানিয়ে ওর প্রস্তাব গ্রহণে অসমর্থ আমরা –একথা লিখে জানিয়ে দিয়েছিলাম ওঁকে। কিন্তু ব্রডওয়ের ঠিকানায় তো যে উত্তর লেখা হয়েছিল, যা বুঝতে পারছি এখন। হয়ত কোনোদিনই উনি সে উত্তর পেতেন না।

-উনি জানতেন কোথাও ওরকম ছবি আছে একটা ….মনে পড়ল পোয়ারোর মরিন সামারহেসের কথা। মরিন বলেছিল, একটু ছোঁক ছোঁক করার অভ্যেস ছিল মিসেস ম্যাগিনটির। সৎ ছিলেন ভদ্র মহিলা কিন্তু একটু যেন বেশি কৌতূহল ওঁর। অতীতের স্মৃতি বিজড়িত আজেবাজে তুচ্ছ জিনিষ মানুষ অনেকেই রেখে দেয়? হয় নিছক সেন্টিমেন্টের দায়ে নয় কিছু না ভেবেই পুরনো বিবর্ণ এরকম একটা ছবি কারও বাড়িতে উনি দেখেছিলেন, সেটা পরে কাগজের কোনো একটা ছবির সাথে এক বলে সনাক্ত করে। এমন কথাও উনি ভেবেছিলেন এ থেকে কিছু টাকা পয়সা যদি পাওয়া যায় মন্দ কি?

উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো, মিস হর্সফল ধন্যবাদ! ক্ষমা করবেন আমাকে কিন্তু যা যা আপনি লিখেছিলেন তা কি সবই সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে? যেমন ধরুন, আমি জানি যে ক্রেগ মামলার সালটা ভুল উল্লেখ করা হয়েছে। ওটা এক বছর পরের মামলা ছিল। জেনিসের স্বামীর নাম হার বার্চের বাদলে হু বার্চ ছাপা হয়েছে। বার্কিংহামসায়ারের বাসিন্দা ছিলেন লিলির পিসী, বার্কশায়ারের নন।

সিগারেট সমেত হাতটা পামেলা অসহিষ্ণুভাবে নাড়লেন।

–দেখুন মঁসিয়ে, বিশেষ কিছু এসে যায় না সঠিক তথ্যে। রোমান্টিক সেন্টিমেন্টে ভরা লেখার সবটাই। মোটামুটি ঘটনাটুকু ঠিক রেখে পাঠকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছি মাত্র।

–না, মানে বলতে চাইছি যেভাবে ঐ মহিলাদের চরিত্রগুলো আপনি বর্ণনা করেছেন, আদপেই হয়তো তা নয়।

আবার অধৈর্য হয়ে পামেলা গলার কর্কশ আওয়াজ চুললেন, নিশ্চয়ই, আমি আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে একমত। আমার তো সন্দেহ নেই যে, ইভা কেন কুকুরীরও অধম এবং সে একটুও সরল ছিল না। কি মতলবেই বা জেসি নামের মহিলাটি আট-আটটা বছর স্বামীর অত্যাচার সহ্য করল চুপচাপ; স্বামীর অঢেল অর্থ নিশ্চয়ই ছিল আর তার পুরুষ বন্ধুটি ছিল কপর্দকহীন।

–আর লিলি?

–অবশ্য আমি ওকে আমার চারদিকে ছুরি নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেও গ্রাহ্য করব না। নিজের হাতের আঙুল নাড়াচাড়া করছিলেন পোয়ারো।

দেখুন মিস হর্সফল, এমন হতে পারে যে সবাই ওরা অন্য দেশে চলে গেছে, নতুন ভাবে জীবন শুরু করতে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের কেউই এদেশে আবার ফিরে আসেনি।

-না, সে তো হতেই পারে। আমায় এবার ছুটি দিন মঁসিয়ে উঠতেই হচ্ছে আমাকে।

পোয়ারো সুপারিন্টেন্টে মিঃ স্পেন্সকে বেশ রাতে ফোন করলেন।

–মিঃ পোয়ারো আপনার কথাই আমি ভাবছিলাম কোনো তথ্য পেলেন? যা হোক কিছু? নতুন?

-তদন্ত করেছি আমি,-গম্ভীর পোয়ারোর গলা শোনা গেল।

–এবং?

 –একটিই তার ফল, সকলেই ব্রডহিনির বাসিন্দারা খুব চমৎকার লোক।

–মঁসিয়ে কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?

বন্ধু আমার, চিন্তা করুন কথাটা খুব চমৎকার লোক–তাই-ই তো তারা…. খুনের উদ্দেশ্যটা যতক্ষণ না জানা যাচ্ছে।

.

০৯.

পোয়ারো স্টেশনের কাছে ক্রমওয়েল গেট পেরোতে পেরোতে আপন মনে মন্তব্য করলেন, খুব ভালো লোক সবাই।

একটা পেতলের ফলক দরজাটার সামনে জানান দিচ্ছিল যে, এখানেই ডাঃ রেগুল থাকেন।

–চল্লিশোত্তীর্ণ ডাঃ রেগুল লম্বা-চওড়া হাসিখুশী মানুষ। তিনি সাদর অভ্যর্থনা জানালেন অতিথি পোয়ারোকে।

-ধন্য হয়েছে আমাদের গ্রাম আপনার আগমনে, মঁসিয়ে পোয়ারা।

আত্মতুষ্টিতে ভরপুর পোয়ারো। তাহলে আপনিও আমার নাম শুনেছেন?

–নিশ্চয়ই শুনেছি। কে না জানে বলুন আপনার কথা। এবার পোয়ারো সংযত হলেন। ডাঃ রেগুল; আমার সৌভাগ্য যে আপনাকে বাড়িতেই পেয়েছি।

বাড়িতেই ডাক্তারকে পাওয়ার সঙ্গে সৌভাগ্যের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। উনি এ সময় বাড়িতেই থাকেন। খুশীমনে উনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, ঠিক সময়েই আপনি এসেছেন। অবশ্য আমাকে মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরোতে হবে। বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি? মশাই আমি তো কৌতূহলে মরে যাচ্ছি যে, এখানে আপনার মত লোক কেন? নিছক বিশ্রামের জন্য না খুনটুনের ব্যাপার।

–অতীতের অপরাধ।

–অতীতের? কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না।

মিসেস ম্যাগিনটি।

–ও হা হা। ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। তা এতদিন বাদে মাথা ঘামাচ্ছেন আপনারা। ব্যাপার কি বলুন দেখি?

তা হলে শুনুন, আমি এসেছি পুলিশের তরফ থেকে, পূর্ণতদন্তের জন্য।

তীক্ষ্ণস্বরে ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু নতুন তথ্যই বা কি থাকতে পারে?

–আপনাকে সেটা এখুনি জানাবার অধিকার নেই রেগুল।

–ও, মাপ করবেন আমায়।

–আপনাকে অবশ্যই এটুকু বলতে বাধা নেই যে এমন অনেক তথ্যের সন্ধান আমি পেয়েছি যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ডঃ রেগুল, আপনার কাছে এসেছি কারণ আমি শুনেছি যে মিসেস ম্যাগিনটি টুকিটাকি কাজের জন্য আপনার এখানে মাঝে মাঝে আসতেন।

দুজনের জন্য ডঃ রেগুল দু গ্লাস শেরী নিয়ে এলেন।

সপ্তাহে একদিন করে উনি আমার এখানে আসতেন। ঘরের কাজ করার জন্য আমাদের অন্য যে মেয়েটি আছে সে বেশ ভালো কিন্তু পেতলের জিনিস, রান্নাঘরের মেঝে ইত্যাদি পরিষ্কার করার জন্য আমরা নিয়োগ করেছিলাম মিসেস ম্যাগিনটিকে।

–আচ্ছা কি মনে হয় আপনার ভদ্রমহিলা সত্যি কথা বলতেন?

-সেটাও ঠিক বলতে পারব না। ওকে সেরকম ভাবে জানবার সুযোগ কখনো হয়নি আমার। তবে যতদূর মনে হয় সত্যি কথাই উনি বলতেন।

তার মানে যদি উনি কারো কাছে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করেন তবে তা সত্যি হতেও পারে, কেমন?

একটু বিব্রত দেখালো ডাক্তারকে।

–অতটা তো ঠিক আমি বলতে পারব না। অনুমতি যদি করেন বরং আমি আমাদের কাজের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি।

-না না, কোনো দরকার নেই তার।

–আপনি তো মশাই আমার কৌতূহল বাড়িয়েই তুলছেন, কি বলেছিলেন ভদ্রমহিলা বলুন তো? নিশ্চয়ই আজেবাজে কথা?

মাথা নাড়লেন পোয়ারো, দুঃখিত ডাক্তার। কিছু বলার হুকুম নেই আমার ওপর। অত্যন্ত গোপনীয় সব ব্যাপারটাই আর সবে তদন্ত শুরু করেছি আমিও।

ডঃ রেগুল শুকনো গলায় বললেন, তাড়াতাড়ি তো আপনাকে তদন্ত করতে হবে।

 –ঠিক বলেছেন, বিশেষ সময় নেই হাতে।

–একথা স্বীকার করতে আমি বাধ্য যে, আমায় অবাক করেছেন আপনি। এখানকার সকলে তো আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে এ কাজ বেন্টলীই করেছে। এতে কোনো সন্দেহ আছে বলে তো শুনিনি?

–আপনাদের সকলের মতে এটা একটা সাধারণ ঘটনা মাত্র?

–সে রকমই তো ভেবেছিলাম।

–আপনি জেমস বেন্টলীকে চেনেন?

ছোটোখাটো অসুখের ব্যাপারে আমার কাছে কখনো কখনো এসেছে। ও খুব ভীতু ছিল স্বাস্থ্যের ব্যাপারে। ওর মা ওকে অতিরিক্ত আহ্লাদ দিয়েছেন আর কি। এখানে আরও এরকম নজীর আছে একটি।

-কি রকম?

মিসেস লরা আপওয়ার্ড। ওঃ কি আহূদই না দেন ছেলেকে। বুদ্ধিমান ছেলেটি, কিছুটা প্রতিভাবানও বটে। উঠতি নাট্যকারদের মধ্যে একজন ওই রবিন আপওয়ার্ড।

–এখানে কি ওরা অনেকদিন আছেন?

–তিন-চার বছর হবে। এ অঞ্চলে কেউই আমরা খুব বেশি দিন আসিনি। বরং লং মিডোস-এর চারদিকে কয়েকটা মাত্র বাড়িতে পুরনো কয়েক ঘর বাসিন্দা আছেন। ওখানেই তো আপনি আছেন?

-হ্যাঁ।

কৌতুক প্রিয় ডঃ রেগুল হেসে বললেন, অতিথিশালা। কিন্তু যা তড়বড়ে স্বভাবের মহিলাটি। আসলে বিবাহিত জীবনে বেশিরভাগ সময়টাই ভারতবর্ষ কাটান ওরা–দাসদাসী পরিবৃত হয়ে আমি তো মশাই বাজি ফেলে বলতে পারি আপনার বেশ অসুবিধেই হচ্ছে ওখানে। ওখানে বেশিদিন থাকতে পারে না কেউ। মেজর সামারহেস লোক ভালো কিন্তু তেমন বোঝেন না ব্যবসাপত্র, আজকাল সেটা খুব দরকার। ওদের দুজনকেই অবশ্যই আমি যথেষ্ট পছন্দ করি। খুব রাশভারী মেজাজের মানুষ ছিলেন মেজরের বাবা। মারা যাবার সময়ে বিশেষ টাকাকড়ি রেখে যেতে পারেননি। তবে নানা অসুবিধে সত্ত্বেও এখানেই শেষ পর্যন্ত সামারহেসরা রয়ে গেলেন।

ঘড়ির দিকে তাকালেন ডাক্তার। পোয়ারো বললেন, আপনার সময় আমি আর নষ্ট করব না।

-না না, আর কিছুক্ষণ আমি থাকতে পারি। আমার স্ত্রীর সাথে আলাপ করলে খুশী হবেন আপনি। ওর খুব কৌতূহল আছে আপনার সম্বন্ধে। মানে, কেন এখানে এসেছে আপনার মত মানুষ। দুজনেই আমরা গোয়েন্দা কাহিনীর দারুণ ভক্ত।

–অপরাধ বিজ্ঞান, রহস্য কাহিনী না কি রবিবারের পত্রিকাগুলো পড়েন?

–তিনটেই।

–সানডে কম্প্যানিয়ন-এর মত বাজে পত্রিকাও?

–তা কেনই বা বাদ যায় ওটা?

–ওরা একটা বিবরণ মাস পাঁচেক আগে ছাপিয়েছিল অতীতের অপরাধ জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন মহিলা সম্পর্কে।

-হা হা, মনে পড়েছে। তবে খুব অস্পষ্ট বিবরণ পুরোটাই।

–তাই মনে হয় আপনার? অবশ্য ক্রেগ মামলার বিষয়টা কাগজ পড়েই জানতে পারি প্রথম। কিন্তু কোর্টল্যাণ্ডের ব্যাপারটা হলফ করে আপনাকে বলতে পারি মোটেই সরল ছিলেন ভদ্র মহিলা। আমি ঘটনাটার কিছুটা জানি কারণ আমার এক কাকার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে ওই ভদ্রলোকের যোগাযোগ ছিল। তেমন সুপুরুষ ছিলেন না ভদ্রলোক। ওঁর স্ত্রীও তথৈবচ। স্ত্রীই তরুণটিকে প্ররোচিত করেন স্বামীকে খুন করার জন্য। তারপর হাজতে যায় তরুণটি আর ভদ্রমহিলা, পরে আবার ঐ ধনী বিধবা অন্যত্র বিয়ে করেন।

এত খবর তো সানডে কম্প্যানিয়ন কিছুই দেয়নি। একটু মনে করে আপনি বলতে পারেন পরে কাকে উনি বিয়ে করেন?

-নাঃ কখনো সেটা শুনেছি বলে মনেও পড়ে না। কিন্তু এটুকু শুনেছিলাম যে, লোক ভালোই ছিলেন তিনি।

অবাক হয়ে সকলে ভাবছে এই চারজন মহিলা কোথায় আছেন এখন।

-বুঝতে পারছি। হয়ত কোনো পার্টিতে এঁদেরই কারো সাথে আপনার হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। আর বাজি ফেলে বলতে পারি নিজেদের অতীত গোপন রেখেছেন এরা সকলেই। এত বিবর্ণ ছবিগুলো সে খুব শক্ত চেনা।

উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। ডঃ রেগুল, এবার আমি উঠছি। আপনি আমার জন্য অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলেন।

–কিন্তু বোধহয় বিশেষ কাজে লাগাতে পারলাম না। একটু অপেক্ষা করুন আমার স্ত্রীকে ডাকছি। তার দেখার খুব ইচ্ছে আপনাকে।

–শেলা, শেলা, হলঘরে গিয়ে ডাক্তার ডাক দিলেন, মৃদু সাড়া পাওয়া গেল ওপর থেকে।

–দেখ কে এসেছেন।

রোগা ফর্সা হালকা রংয়ের চুলের একজন মহিলা নেমে এলেন সিঁড়ি দিয়ে।

-শেলা, ইনি মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো।

ওহ, এত অবাক হয়ে গেলেন মিসেস রেগুল যে কোনো কথা যোগালো না ওঁর মুখে। ওকে অভিবাদন জানালেন পোয়ারো। শেলা বললেন, আমরা জানতাম এখানে আপনি এসেছেন কিন্তু….

স্বামীর দিকে চকিতে শেলা তাকালেন।

মনে মনে পোয়ারো ভাবলেন মহিলা নিতান্তই স্বামীর অনুগত। উনি বিদায় নিলেন আরও দু চার কথার পর। পোয়ারো হান্টার্স প্লেস এসে ওয়েদারবির খোঁজ করলেন। তরুণী বিদেশী পরিচারিকাটি তাকে হলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রেখে খবর দিতে গেল ভেতরে। ঘরটা দেশী বিদেশী নানা জিনিসে বোঝাই। সযত্নের ছাপ নেই কোনো কিছুতেই। একটি মেয়ে কিছুক্ষণ বাদে ঘরে ঢুকল।

-শুয়ে আছেন আমার মা। বলুন আপনাকে কি ভাবে সাহায্য করতে পারি?

–আপনি মিস ওয়েদারবি?

–হেণ্ডারসন, আমার সৎপিতা মিঃ ওয়েদারবি।

ত্রিশের কাছাকাছি বয়স মেয়েটির। অত্যন্ত সাদামাটা চেহারা কিন্তু বেশ উদ্বিগ্ন চোখের দৃষ্টি।

মিস হেণ্ডারসন, এখানে আমি এসেছি, আপনাদের পরিচিতা মিসেস ম্যাগিনটির সম্বন্ধে কিছু যদি বলতে পারেন, তা জানতে। আপনাদের গৃহস্থালির কাজকর্ম উনি করতেন শুনেছি।

-মিসেস ম্যাগিনটি, কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন।

শান্তস্বরে পোয়ারো উত্তর দিলেন, আমি জানি। কিন্তু কিছু জানতে চাই তার সম্বন্ধে।

-ও। জীবনবীমা সংক্রান্ত ব্যাপার?

–না। এখানে পূর্ণতদন্তের জন্য এসেছি।

–পূর্ণতদন্ত? মানে ওর মৃত্যুর ব্যাপারে?

সরকার পক্ষ থেকে জেমস বেন্টলীর অপরাধের সত্যতা যাচাই করতে নিয়োগ করা হয়েছে আমাকে।

–কিন্তু সে কি অপরাধী নয়?

-তাই ভেবেছে পুলিশ। কিন্তু ভুলও তো হতে পারে।

–তাহলে এমন কি হতে পারে যে, অন্য কেউ ভদ্রমহিলাকে খুন করেছে?

হতে পারে।

আচমকা মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, কিন্তু কে?

–সেটাই তো জিজ্ঞাস্য। মৃদুস্বরে পোয়ারো জবাব দিলেন।

–কিছুই তো আমি বুঝতে পারছি না।

–কিন্তু আপনি মিসেস ম্যাগিনটি সম্বন্ধে কিছু তো বলতে পারেন?

–হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কি জানতে চান?

–এই ধরুন, ওঁর সম্বন্ধে আপনি কি ভাবতেন?

 –তেমন কিছু নয়। উনি ছিলেন আর পাঁচজনের মতই।

-খুব কথাবার্তা বলতেন, না চুপচাপ? কৌতূহলী না নির্বিকার? হাসিখুশী না দুঃখী দুঃখী, খুব ভালো না অন্য রকম ভদ্রমহিলা? একটু চিন্তা করলেন মিস হেণ্ডারসন।

-উনি ভালোই কাজকর্ম করতেন। তবে কথা বলতেন বড় বেশি। এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা….। সত্যি বলতে কি ওকে আমি তেমন পছন্দ করতাম না।

–ওদের পরিচারিকাটি দরজা খুলে মুখ বাড়ালো।

–মিস, আপনার মা বলছেন তার কাছে ভদ্রলোককে নিয়ে যেতে।

 পেয়ারার দিকে তাকালেন মিস হেণ্ডারসন।

–দেখা করতে চান আমার মায়ের সাথে?

 –নিশ্চয়ই।

মিস ডীডার হেণ্ডারসন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে পোয়ারোকে বলল, এইসব বিদেশীরা…

বুঝতে পারলেন পোয়ারো যে, তাদের কাজের মেয়েটির কথা বলছে ডীডার। তাই নিজে বিদেশী হওয়া সত্ত্বেও রাগ করলেন না তিনি। তার খুব সহজ সরল মেয়ে বলেই মনে হল ডীডারকে।

নানা টুকিটাকি জিনিসে ভর্তি ওপরের ঘরটা। দেখলেই বোঝা যায় অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন ভদ্রমহিলা এবং ঝোঁক খুব বেশি পছন্দসই জিনিস কেনার দিকে। যেন আসবাবপত্রও বেশি বেশি ঘরে। একটা সোফায় মিস ওয়েদারবি আয়েস করে শুয়ে ছিলেন। চার পাশে তার বই কেনার সরঞ্জাম, কমলালেবুর রস গ্লাসে আর চকোলেট আর এক গ্লাস।

ভদ্রমহিলা বললেন, নিজে আমি উঠে গিয়ে আপনাকে অভ্যর্থনা করতে পারিনি সেজন্য ক্ষমা করবেন। আমাকে ডাক্তার আজ পূর্ণ বিশ্রাম নিতে বলেছেন। আর কথা না শুনলে আমায় বাড়ির লোক বকাঝকা করে।

পোয়ারো তার সাথে করমর্দন করলেন। ডীডার পেছন থেকে বলে উঠল, উনি জানতে চান মিসেস ম্যাগিনটি সম্বন্ধে কিছু।

পোয়রোর হাতের মধ্যে ধরা মিসেস ওয়েদারবির হাত শক্ত হয়ে উঠল মুহূর্তের জন্য। ভদ্রমহিলাই তারপরই হাসলেন।

–ডীডার, তুমি কি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছ, মিসেস ম্যাগিনটি আবার কে?

–ওহ মা, মনে পড়ছে না তোমার, আমাদের বাড়িতে উনি কাজ করতেন… আরে যিনি খুন হলেন।

চোখ বন্ধ করে ভদ্রমহিলা একটু শিউরে উঠলেন।

-আমাকে আর ও কথা মনে করিয়ে দিও না। আমি ভালোভাবে কতদিন পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি। বেচারা বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা। কেউ মেঝের নিচে ওভাবে টাকা রাখে? ব্যাঙ্কে রাখা উচিত ছিল। এইবার সব মনে পড়েছে আমার। আসলে মনে করতে পারছিলাম না ওর নামটা।

ডীডার বলল, মা, সে ব্যাপারেই উনি কিছু জানতে এসেছেন। মিসেস ওয়েদারবি বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো বলুন। ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে আমার। এইমাত্র মিসেস রেগুল ফোনে বললেন বিখ্যাত একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ এখানে এসেছেন আপনার বর্ণনাও দিলেন। তারপরই ফ্রিডা যখন আমাদের কাজের মেয়েটি এসে বলল আমার সাথে দেখা করতে এসেছে একজন ভদ্রলোক তখনই বুঝলাম আপনি এসেছেন। একবার বলুন তো কি হয়েছে?

–ওই, আপনার মেয়ে যা বলল আপনাকে। মৃতা মহিলার সম্বন্ধে আমি জানতে চাই কিছু। উনি প্রতি বুধবার এখানে কাজে আসতেন এবং উনি মারা যান কোনো এক বুধবার। মারা যান যেদিন সেদিনও কাজে এসেছিলেন। তাই না?

–হ্যাঁ, মনে তো হচ্ছে তাই। ঘটনাটা এতোদিন আগের যে আমার সঠিক মনে নেই।

 –সে তো ঠিকই। আচ্ছা, উনি কি কোনোদিন বিশেষ কোনো ঘটনার কথা বলেছিলেন?

বিরক্ত স্বরে মিসেস ওয়েদারবি বললেন, এ ধরনের মহিলারা বড় বেশি বাজে বকেন। আর কে কত কান দেয় বলুন। আর এতো উনি আগে থেকে বলতে পাবেন না যে, সর্বস্ব ওঁর চুরি যাবে এবং খুন হবেন উনি।

–খুন হবার ওঁর কারণ আছে।

 ভ্রূ কুঁচকালেন মিসেস ওয়েদারবি।

-মঁসিয়ে, বুঝতে পারছি না আমি, আদপে কি বলতে চাইছেন আপনি?

–আমি নিজেও এখন পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। যাক গে, আপনারা রবিবারে কি কি কাগজ নেন?

নীল চোখ ভদ্রমহিলার ঈষৎ বিস্ফারিত হল।

–দ্য অবজারভার আর সানডে টাইমস নিই। কেন বলুন তো?

–এমনি। মিসেস ম্যাগিনটি সানডে ক্যানিয়ন আর নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড নিতেন।

পোয়ারোর এ কথায় কেউ কোনো মন্তব্য করল না। খানিকক্ষণ বাদে মিসেস ওয়েদারবি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এত নৃশংস পুরো ব্যাপারটা। সে ভাবতে পেরেছিল এ রকম ভাড়াটে ছেলেটি। মানসিক দিক দিয়ে হয়ত ও অসুস্থ। অথচ এত শিক্ষিত…. ভাবলে খারাপ লাগে খুব।

–হুঁ।

–সত্যি। খুনটা এত নিষ্ঠুর ভাবে করা হয়েছে–শেষমেশ কিনা মাংস কাটার ছুরি। ওফ!

–পুলিশ কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায়নি অস্ত্রটা।

–কে জানে, হয়ত ফেলে দিয়েছে কাছাকাছি কোনো পুকুরে বা ডোবায়।

 ডীডার বলে উঠল, সেসব জায়গাতেও সব খুঁজেছে পুলিশ, আমি দেখেছি।

–ডীডার, এখন থাক এসব কথা। অসুস্থ বোধ করছি আমি। আমার স্নায়ু তো দুর্বল তা জানো।

পোয়ারোর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ডীডার বলল, চলুন যাওয়া যাক, বড় দুর্বল প্রকৃতির মানুষ হলেন মা। গোয়েন্দা গল্প পড়াটুকুও পোষায় না মায়ের।

-সত্যি আমি দুঃখিত। পোয়ারো একথা বলে উঠে দাঁড়ালেন, মিসেস ওয়েদারবি, বাধ্য হয়েই কতকটা বিরক্ত করতে এসেছিলাম কারণ বেন্টলী হয়ত কিছুদিনের মধ্যেই ফাঁসি কাঠে ঝুলবে। অথচ যদি সে প্রকৃত অপরাধী না হয়..

কনুইতে ভর দিয়ে মিসেস ওয়েদারবি আধশোওয়া হয়ে চেঁচিয়ে বললেন, কিন্তু সত্যিই সে তো খুনী।

–কিন্তু মাদাম, আমি যে তাতে এখনো নিশ্চিত নই।

 দ্রুতপায়ে, পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

ডীডার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তাকে জিজ্ঞেস করল, ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?

-যা আমি বললাম, মাদমোয়াজেল।

–হ্যাঁ কিন্তু….থেমে গেল ডীডার। চুপ করে রইলেন পোয়ারো। আবার ডীডার বলল, মাকে অস্থির করে তুলেছেন আপনি। উনি খুন, ডাকাতি এসব ভীষণ ঘেন্না করেন নৃশংসতাও।

–মিস ম্যাগিনটি তো তা হলে মারা যেতে উনি খুবই আঘাত পেয়েছেন বলতে হবে। ভদ্রমহিলা হাজার হোক কাজ করতেন এখানে।

-সে তো একশোবার।

–বোধহয় মাকে সব কথা বলেনও ন আপনারা?

–না, আসলে কম উত্তেজিত করা যায় যতটা এই আরকি।

–যুদ্ধের সময়?

–বিশেষ বোমাটোমা পড়েনি এখানে।

–আপনি তখন কি করতেন?

–সাহায্যকারীদের দলে ছিলাম আমি। বাড়ি থেকে দূরে কোথাও যেতে পারিনি। আমাকে সর্বদা দরকার হয় মায়ের। ঠিকমত কাজের লোকও ছিল না। সেজন্য খুব সুবিধে হয় আমাদের মিসেস ম্যাগিনটিকে পাওয়াতে। বেশ ভালোই কাজকর্ম করতেন উনি। অবশ্য পরিস্থিতিই তো যুদ্ধের জন্য কত বদলে গেছে।

–সেটা আপনি পছন্দ করেন না। না?

–নিশ্চয়ই না। অবশ্য মায়ের কোনো বিকার নেই সর্বক্ষণই উনি অতীতের মধ্যে ডুবে আছেন।

পোয়ারোর নজরে পড়েছিল মিসেস ওয়েদারবির ঘরে নানা পুরনো জিনিসে ভর্তি দেরাজটা।

মৃদুস্বরে বললেন পোয়ারো, পুরনো জিনিসপত্র অনেকে জমাতে ভালোবাসে, বাজে জিনিসও। তাতে আরও বেশি পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে।

–তা হবে। এ সবের মানে আমি বুঝি না কিন্তু জমিয়ে রাখি না নিজে। ফেলে দিই সব।

–তাহলে আপনি ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে থাকেন, অতীতের দিকে নয়?

আস্তে আস্তে ডীডার বলল, আমি বুঝতে পারি না আমি ঠিক কোনদিকে তাকিয়ে আছি। যথেষ্ট বর্তমানই তাই না?

খুলে গেল সামনের দরজাটা। লম্বা বয়স্ক একজন ভদ্রলোক পোয়ারোকে দেখে ভীডারের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিপাত করলেন।

ডীডার বলল, আমার সৎপিতা ইনি।

–আমি এরকুল পোয়ারো। চোখে মুখে মিঃ ওয়েদারবির কোনো ভাবলক্ষণ দেখা গেল না। ও আচ্ছা, এই বলে তিনি নির্বিকার ভাবে গায়ের কোটটা খুলে হ্যাঁঙারে ঝুলিয়ে রাখলেন।

এবার ডীডার বলল, মিসেস ম্যাগিনটি সম্পর্কে ইনি জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন।

দু-এক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর মিঃ ওয়েদারবি বললেন, বেশ কয়েক মাস আগে উনি মারা গেছেন। ওর সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। জানলে তা নিশ্চয়ই পুলিশকে বলতাম।

এবার ঘড়ির দিকে তাকালেন মিঃ ওয়েদারবি।

-ডীডার, আশা করি আর পনেরো মিনিটের মধ্যে দুপুরের খাওয়া আমরা শুরু করতে পারব?

–না, বোধহয় আজ একটু দেরি হবে।

–কেন?

–ফ্রীড়া খুব ব্যস্ত ছিল।

-ডীডার, তোমাকে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে ঘরের কাজকর্ম ঠিকমত হচ্ছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব তোমার। তোমার কাছে আর একটু বেশি সময় জ্ঞান আশা করি আমি।

দরজা খুলে পোয়ারো বেরিয়ে এসে পেছন ফিরে তাকালেন। মিঃ ওয়েদারবির দৃষ্টিতে সৎ মেয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না। আর অন্য জনের দৃষ্টিতে যা ছিল তা সৎপিতার প্রতি নিছক ঘৃণা।