১১.
পোয়ারো এবার মিসেস লরিমার বাড়িতে এলেন। সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। কলিংবেল টিপতেই এক বুড়ি দরজা খুলে দিল।
সে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চান?
মিসেস লরিমাকে।
তাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে বুড়ি ঝি মিসেস লরিমাকে ডাকতে গেল। পোয়ারো ঘরটির দিকে নজর বুলিয়ে নিল। প্রাচীন বনেদি ঢঙের আসবাবপত্র। চেয়ারগুলোয় দামী কুশন পাতা। দেওয়ালে টাঙানো পুরানো আমলের ফটোগ্রাফ, টেবিলের ওপর ফুলদানিতে গোলাপ শোভা পাচ্ছে।
মিসেস লরিমা ঘরে প্রবেশ করলেন। পোয়ারো মৃদু হেসে শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমার বিশ্বস ম্যাডাম এই অযাচিত আগমনকে ক্ষমার চোখেই দেখবেন।
কিন্তু এই আগমনের সঙ্গে আপনার পেশার কি সম্পর্ক আছে?
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ আছে।
কিন্তু আমি আপনাকে দশ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না, আর তাছাড়া শখের গোয়েন্দার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই, মিসেস লরিমা বললেন।
মিঃ পোয়ারো উত্তর দিলেন, দশ মিনিটই যথেষ্ট।
যে ঘরে মিঃ শ্যাতানা নিহত হন, সে ঘরের একটা বর্ণনা আমায় দিতে পারেন?
গোটা কতক কাঁচের ফুলদানি ছিলো, আধুনিক ডিজাইনের দেখতে ও বেশ সুন্দর একগুচ্ছ ছোট ছোট রক্তিম টিউলিপ ফুল। ঘরটা এত বেশি জিনিষপত্রে ঠাসা যে প্রথম ঢুকে মনে হয়েছিল কোনো যাদুঘরে এসে পৌঁছেছি।
অল্প থামলেন লরিমা, আমি হয়তো আপনার কোনো কাজেই লাগতে পারলাম না। খুবই দুঃখিত, মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করিনি।
আর একটা প্রশ্ন বাকি আছে, পোয়ারো ব্রীজের স্কোরশীটগুলো বার করে টেবিলের ওপর রাখলেন।
লরিমা কাগজগুলো নিয়ে দেখলেন, এটা হলো প্রথম রাবার তখন আমার পার্টনার ছিলেন মিস মেরিডিথ। অপরপক্ষে ডাক্তার রবার্টস আর মেজর ডেসপার্ড। প্রথম ডিলে আমরা চারটে স্পেড ডেকেছিলাম। পরের তাসে দুটো ক্লাব ডাকা হয়েছিলো। তৃতীয় ডিলে খুব বেশি ডাকাডাকি চলে। আমার মনে আছে মিস মেরিডিথ পাস দিলে একটা হার্ট দিয়ে মেজর ডেসপার্ড ডাক শুরু করেন। আমি পাস দিলাম। ডাক্তার রবার্টস বীড দেন তিনটে ক্লাব। মিস মেরিডিথ মুখ খোলেন, তিনি ডাকেন স্পেড। মেজর ডেসপার্ড বলে চারটে ডায়মণ্ড। আমি ডবল দিই। ডাক্তার রবার্টস গোড়ার হার্ট রঙে ফিরে যান। কিন্তু চারটে হার্টসে একটা ডাউন দেন।
পোয়ারো সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন, কি অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি!
মিসেস লরিমা এবার উঠে দাঁড়ালেন, কিছু মনে করবেন না আমি এক্ষুনি বেরোব আর দেরি করা উচিত হবে না।
নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনাকে দেরি করিয়ে দেবার জন্য সত্যিই আমি দুঃখিত।
পোয়ারো উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দন করলেন। এবং রাস্তায় পা দিলেন।
.
১২.
অনেক কষ্টে শ্ৰীমতী অলিভার গাড়ি থেকে রাস্তায় নামলেন। এত অপরিসর জায়গায় গাড়ি থেকে নামতে উঠতে খুবই কষ্টকর–এইসব ভাবতে ভাবতে বিরক্তিতে তার মন ভরে উঠল। তার হাতব্যাগের মধ্যে গুটিকতক ম্যাপ, গোটা তিনেক রহস্য উপন্যাস এবং কিছু আপেল। গাড়ি থেকে নেমে তিনি ধীরে ধীরে ওয়েনডন কুটিরের দিকে এগোলেন।
শ্ৰীমতী অলিভার অ্যানা মেরিডিথের বাড়িতে এলেন, ভালো আছেন তো, মিস মেরিডিথ? আমাকে চিনতে পারছেন নিশ্চয়?
নিশ্চয় পারছি! অ্যানা মেরিডিথ করমর্দনের জন্যে দ্রুত হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু তার চোখের তারায় পলকের জন্যে একটা আতঙ্ক ফুটে উঠলো। যাইহোক সংযত হয়ে বলে উঠলেন, এই হচ্ছে আমার বন্ধু মিস দোয়স আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকি।
শ্ৰীমতী অলিভার মাথা নাড়লেন, তারপর মেরিডিথের দিকে ফিরে বললেন, আমার অনেক কথা আছে কোথাও বসতে পারলে ভালো হতো।
নিশ্চয় চলুন, ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসি। শ্রীমতী অলিভার একটি সৌখিন চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এবার কোনো ভূমিকা না করে বললেন, গতদিনের সেই নৃশংস খুনটার সম্পর্কে আলোচনা করতেই আজ এখানে এসেছি। আমাদের এ ব্যাপারে কিছু করা উচিত। তিনি দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করলেন, এই হত্যা ডাক্তার রবার্টসই করেছেন। এখন শুধু মাথা ঠান্ডা রেখে প্রমাণ খুঁজে বার করতে হবে।
কিন্তু সেটা কি উপায়ে? সংশয়ের সুরে মনের ভাব ব্যক্ত করলেন মেরিডিথ।
শ্ৰীমতী অলিভার বললেন, আপনি নিশ্চয়ই চান না আপনাকে কেউ খুনী বলে সন্দেহ করুক।
মেরিডিথ শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমি এখনো বুঝে উঠতে পারছি না আপনি কেন আমার কাছে এসেছেন।
তার কারণ, আমার মতে অন্য দুজনের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু একজন সুন্দরী তরুণীর কথা সম্পূর্ণ আলাদা। তার নামে বাজে কথা রটলে অনেক খেসারত দিতে হবে। আর মেজর ডেসপার্ড তো পুরুষমানুষ আত্মরক্ষায় যথেষ্ট সক্ষম। যত চিন্তা কেবল আপনাকে নিয়ে।
আপনি সত্যিই ভারি দয়ালু!
ব্যাপারটা খুবই সঙ্কটময়। রোডা মন্তব্য করলেন।
নিশ্চয়ই সে কথা আর বলতে? শ্রীমতী অলিভার উত্তেজিত হয়ে বললেন। এইরকম প্রত্যক্ষ খুনের সংস্পর্শে ইতিপূর্বে আমি কোনোদিন আসিনি।
মিস কৌতূহলী হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, আচ্ছা, আপনি এই কর্তৃত্বে থাকলে কি করতেন?
আমি সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রবার্টসকে গ্রেপ্তার করতাম।
তা ঠিক! আচ্ছা কেনই বা ডাক্তার রবার্টস মিঃ শ্যাতানাকে খুন করতে যাবেন? এ বিষয়ে আপনার কি ধারণা?
শ্ৰীমতী অলিভার বললেন, অসংখ্যা ধারণা আমার। যেমন শ্যাতানা হয়তো রবার্টসের কোনো না কোনো আত্মীয়াকে পথে বসিয়েছিলেন। রবার্টস তার প্রতিশোধ নিলেন। আবার এমনও হতে পারে মিঃ শ্যাতানা হয়তো ডাক্তার রবার্টসকে অনেক টাকা ধার দিয়েছিলেন। এখন সেটা পরিশোধ করে দিতে বলেছিলেন সেইজন্য ডাক্তার রবার্টস খুন করেছেন। অথবা রবার্টস হয়তো গোপনে দুটি বিয়ে করে থাকবেন। শ্যাতানা হয়তো সেটা জানতে পেরে গেছেন। এই কারণে আরও দৃঢ় বিশ্বাস ডাক্তার রবার্টসই মিঃ শ্যানার হত্যাকারী।
ডাক্তার রবার্টস কোনো পেশেন্টকে বিষাক্ত ওষুধ খাইয়ে মারতে কোনো অসুবিধাই ভোগ করবেন না।
ইতিমধ্যে অ্যানা কথার মাঝখানে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, মিঃ শ্যাতানা একবার কথা প্রসঙ্গে ল্যাবরেটরির বিষয়ে কি একটা মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এমন ধরনের অনেক বিষ আছে যা নাকি ডাক্তারী পরীক্ষাতেও ধরা পড়ে না।
বাইরের বাগানে কার পদশব্দ পাওয়া গেলো। শ্রীমতী অলিভার ঘাড় ফিরিয়ে সেদিকে তাকালেন। দেখা গেলো মেজর ডেসপার্ড মন্থর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন।
.
১৩.
মেজর ডেসপার্ড একটু লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, আসময়ে আপনাকে বিরক্ত করবার জন্য আমি খুবই দুঃখিত, মিস মেরিডিথ। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তাই ভাবলাম আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই।
না না, আপনার বিচলিত বোধ করবার কোনো কারণ নেই। অ্যানা বললেন, এই আমার বন্ধু রোডা।
রোডা করমর্দন করলেন ডেসপার্ডের সঙ্গে। আপনারা ভেতরে বসুন আমি চায়ের ব্যবস্থা করি। শ্রীমতী অলিভার মন্তব্য করলেন, কি আশ্চর্য যোগাযোগ, আবার আমাদের দেখা হয়ে গেল!
ডেসপার্ড ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। শ্ৰীমতী অলিভার রহস্যময় কণ্ঠে বললেন, আমার বিশ্বাস, ডাক্তার রবার্টসই খুন করেছেন।
তিনজনই চুপচাপ, ঘরের মধ্যে গুমোট আবহাওয়া। ইতিমধ্যে রোডা চা নিয়ে ঢুকলেন, আতিথেয়েতার জন্য ধন্যবাদ। আমার কার্ড রইল লণ্ডনে গেলে আমার সঙ্গে দেখা করবে, তখন সমাধানের পথ খোঁজা যাবে।
রোডা বললেন, চলুন গেট পর্যন্ত আপনাদের এগিয়ে দিয়ে আসি।
অ্যানা হাত বাড়িয়ে অলিভারের সঙ্গে করমর্দন করলেন, শ্ৰীমতী অলিভার তার গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। রোডা হাসিমুখে হাত নেড়ে তাকে অভিবাদন জানালেন।
রোডা হাসিমুখে বললেন, ভদ্রমহিলা খুব মজার তাই না? আমার খুব ভালো লাগলো আলাপ করে। উনি খুব বুদ্ধিমতী তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু উনি কি উদ্দেশ্যে এখানে এসেছিলেন?
অ্যানার কণ্ঠে চিন্তার সুর বাজে।
রোডা বিস্মিত দৃষ্টিতে বন্ধুর দিকে ফিরে তাকালেন, কেন! উদ্দেশ্যের কথা তো স্পষ্ট ভাষাতেই ব্যক্ত করলেন।
ওদিকে মেজর ডেসপার্ড ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন। অহেতুক দেরির জন্য অ্যানা ক্ষমা চাইলেন।
মিস মেরিডিথ, এখন অত লৌকিকতার অবসর নেই। আমার আগমনের উদ্দেশ্যটা আপনাকে বুঝিয়ে বলি, কথাটা বলা হয়তো অশোভন হবে, কিন্তু আমার মনে হলো পৃথিবীতে আপনাকে সাহায্য করবার কেউ নেই। যদিও আমি জানি মিস দোয়াস আপনার দুর্লভ বন্ধু। তবু পুলিসের চোখে মিস মেরিডিথ সন্দেহভাজন ব্যক্তি, যাই যদি আপত্তি না থাকে তবে আমার সলিসিটর মিঃ মেহনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন।
অ্যানার চোখমুখ বিবর্ণ হয়ে উঠলো, সত্যিই এর কি কোনো প্রয়োজন আছে?
আমি বলব নিশ্চয় আছে, আইনের কত মারপ্যাঁচ আছে।
রোডা বললেন– এই নোংরা ঘটনাটা অ্যানাকে শেষ করে দেবে।
মেজর ডেসপার্ড ঘাড় সায় দিলেন, সত্যিই পাশবিক কাণ্ড! বিশেষ করে অল্পবয়সী তরুণীকে এর মধ্যে যদি টানা হয়।
রোডা আচমকা প্রশ্ন করলেন, আপনার কাকে সন্দেহ হয়? ডাক্তার রবার্টস না মিসেস লরিমা?
ডেসপার্ডের উত্তর, প্রমাণ না পেলে কোনো কিছুই বলা সম্ভব নয়।
রোডা সায় দিলো, আপনার কথা অস্বীকার করবো না। আচ্ছা সুপারিন্টেন্টে ব্যাটেল কিরকম লোক?
তিনি খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি, কর্মদক্ষতাও অসাধারণ। ডেসপার্ড এবার উঠে দাঁড়ালেন, এবার আমি বিদায় নেবো।
অ্যানাও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে করমর্দনের জন্যে হাত বাড়ালেন।
এবার অ্যানা একা ডেসপার্ডকে এগিয়ে দিতে গেলেন, যখন ফিরে এলেন রোডা তখন খোলা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
শ্ৰীমতী অলিভারকে আমার একদম পছন্দ হয় না, ওঁকে দেখার পরেই মনে কেমন খটকা লেগেছে। গোপন কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে উনি এখানে এসেছিলেন…?
মেয়েরা তো মেয়েদের সন্দেহ করবেই, এতো চিরকালের প্রথা! মেজর ডেসপার্ডও তো মাথায় কোনো মতলব নিয়ে এখানে আসতে পারেন?
নিশ্চয় না অ্যানা প্রতিবাদ করলেন, কিন্তু রোডা দেখেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন।
.
১৪.
মিঃ ব্যাটেল মিস মেরিডিথের সঙ্গে দেখা করবার আগে তিনি এই অঞ্চলের আরো লোকের সঙ্গে দেখা করেছেন। আর এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য অ্যানার সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করা।
মিঃ ব্যাটেলের পক্ষে এই কাজটা কষ্টসাধ্য নয়। তিনি প্রকৃত পরিচয় সর্বদা গোপন করে নানারকম খবর সংগ্রহ করেন। এই মুহূর্তে তিনি একজন বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লোক বলে পরিচয় দিয়েছেন।
ওয়েনডন কুটিরের কথা বলছেন? হ্যাঁ ঠিকই, সার্জারি রোডের ওপর, গেলেই আপনার নজরে পড়বে। ওখানে দুজন তরুণী বাস করেন একজন মিস দোয়স অপরজন মিস মেরিডিথ। দুজনে খুব ভালো মেয়ে, কথা প্রসঙ্গে মিঃ ব্যাটেল অবশেষে মিসেস অসওয়েলের সন্ধান পেলেন, তিনি ঐ কুটিরে ঠিকের কাজ করেন। ওয়েনডনকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, মেয়ে দুটির স্বভাবচরিত্র খুব ভালো, সবসময় নিজেদের মধ্যে হাসিঠাট্টায় মেতে আছে।
মিঃ ব্যাটেল সম্ভাব্য সমস্ত স্থানেই ঘুরে বেড়ালেন। এদিক ওদিক থেকে খবর যা সংগ্রহ করলেন তাও খুব নিরাশ হবার মতো নয়। সমস্ত তিনি মনের মধ্যে গেঁথে রাখলেন। মাঝে মধ্যে দু-একটা রহস্যময় কথাও টুকে নিলেন তার ডায়েরীতে।
অবশেষে সন্ধ্যে আটটা নাগাদ কুটিরে হাজির হলেন। বেল টিপতেই একটি দীর্ঘাকৃতি মেয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালেন। পরনে কমলা রঙের ফ্রক। তন্বী এবং সুন্দরী।
মিস মেরিডিথ কি এখানে থাকেন? প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল। তাকে বেশ গম্ভীর বলে মনে হলো।
হ্যাঁ…আপনি…?
দয়া করে তাকে গিয়ে বলুন, মিঃ ব্যাটেল একবার দেখা করতে চান।
আসুন, ভেতরে আসুন।
মিস দোয়সের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটেল ভিতরে প্রবেশ করলেন। মিঃ ব্যাটেল দেখা করতে এসেছেন, রোডা অ্যানাকে জানিয়ে দিলেন। অ্যানা এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।
তদন্তের কাজ কতদূর এগিয়েছে? তেমন আশাপ্রদ কিছু জানতে পারলেন?
খুব আশাপ্রদ বলা যায় না তবে এগোচ্ছে। আমরা ডাক্তার রবার্টসের কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। মিসেস লরিমার সঙ্গেও কথাবার্তা হয়েছে, এখন শুধু আর মেজর ডেসপার্ড বাকি।
বলুন কি জানতে চান, অ্যানা মৃদু হেসে বললেন।
এই আপনার আত্মপরিচয় আর কি।
আমি নিজেকে ভদ্র সভ্য বলেই জানি। আমার জন্ম হয়েছিলো ভারতবর্ষের এক শহরে। কোয়েট্টায়। আমার বাবা মেজর মেরিডিথ। এগারো বছর বয়সে মা গত হলেন। বাবা যখন অবসর নিলেন আমার বয়স তখন পনেরো। আঠারো বছর বয়সে বাবা মারা যান। এরপর একটা চাকরি নিতে বাধ্য হলাম।
আচ্ছা মিঃ শ্যাতানার সঙ্গে কিভাবে আপনার পরিচয় হলো?
অ্যানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বলার মতো কিছু নেই, হোটেলের অন্যান্য ট্যুরিস্টদের সঙ্গে যেভাবে আলাপ হয় সেই রকমই। মিঃ শ্যাতানাকে আমি একদম পছন্দ করতাম না। কিন্তু তিনি আমার প্রতি খুবই ভদ্র ব্যবহার করতেন। এই মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতাই আমার অস্বস্তির কারণ।
আচ্ছা এবার আমি উঠি, শুভরাত্রি বলে মিঃ ব্যাটেল বিদায় নিলেন।
চেয়ারে বসে অ্যানা অলসভাবে হাই তুললেন।
.
১৫.
মেজর ডেসপার্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে বাস স্টপেজে এসে দাঁড়ালেন তারপর একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন।
জানলার ধারে একটা সীট দখল করলেন।
ডেসপার্ড বসে আছেন ইতিমধ্যে তিনি দেখলেন মঁসিয়ে পোয়ারে বসে আছেন। হাসিমুখে ডেসপার্ড ও মিঃ পোয়ারো কিছু কুশল বিনিময়ের পর আসল কথায় এলেন।
মেজর ডেসপার্ড বললেন, আপনার রেকর্ড তো মারাত্মক রকমের ভালো।
আচ্ছা মিঃ শ্যানার খুনের বিষয় কি তদন্ত করছেন?
না সরকারী ভাবে কেউ আমাকে নিয়োগ করেনি কিন্তু তবুও আমি নিজে থেকে কেসটা নিতে বাধ্য হয়েছি, কারণ হত্যাকারী আমার ক্ষমতাকে যে ব্যঙ্গ করে, এই ঘটনা তারই প্রকাশ।
কেবল আপনাকেই নয় গোটা স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চোখের সামনে এই অপকীর্তি সাধিত হয়েছে।
ঠিক, আপনার মতো একজনকেই আমি খুঁজছিলাম, যার নজর তীক্ষ্ণ এবং স্মৃতিশক্তিও প্রখর। ডাক্তার রবার্টসকে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম, কোনো ফল পাইনি। মিসেস লরিমাও আমায় হতাশ করেছেন। এবার আপনাকে চেষ্টা করে দেখি।
আচ্ছা মিঃ ডেসপার্ড, আমাকে সেই ঘরের একটা যথাযথ বিবরণ দিন, যে ঘরে মিঃ শ্যাতানা খুন হয়েছিলেন।
ডেসপার্ড হতাশভাবে বললেন, বিশেষ নজর দিয়ে দেখিনি…গোটাগতক ভালো জাতের কম্বল, কতগুলি মূর্তি, কিছু ছবি, একটি কৃষ্ণসার হরিণের মাথা ইত্যাদি।
মিঃ শ্যানার বনে জঙ্গলে গিয়ে শিকারের নেশা ছিল বলে আপনার নিশ্চয় মনে হয় না।
তিনি সেরকম পাত্রই নন, ঘরে বসে দাবা খেলা ছাড়া আর কিছুই খেলতেন না।
সেদিনের ব্রীজ খেলার কথা আপনার কিছু মনে আছে কি? মেজর ডেসপার্ড, ব্রীজ কি আপনি বেশি খেলেন?
না সেরকম কিছু মনে নেই আর ব্রীজ খেলা আমি ক্বচিৎ কদাচিৎ খেলি এই খেলায় যথেষ্ট বুদ্ধি দরকার।
পোয়ারো চিন্তামগ্ন কণ্ঠে বললেন, মিঃ শ্যাতানা তাসে তেমন আসক্ত ছিলেন না। একটা খেলায় তার উৎসাহ ছিল সেটা লোককে ভয় দেখানো।
ডেসপার্ড ঈষৎ বিব্রত হয়ে পড়লো। তিনি বললেন, এক হিসেবে তাকে ব্ল্যাকমেলার বলাই যুক্তসঙ্গত। এইজন্যেই প্রতিফলে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন।
মিঃ পোয়ারো বললেন, তিনি মেয়েদের মনের গতিপ্রকৃতি ভালোভাবে বুঝতেন, তিনি তাদের গোপন কথা বার করার জন্য অনেক কৌশল অবলম্বন করতেন।
ডেসপার্ড অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, সত্যিই অবিশ্বাস্য। লোকটা ছিলো পর্বতপ্রমাণ নির্বোধ। কথা বলতে বলতে ডেসপার্ড উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, আচ্ছা আমার স্টপেজ এসে গেছে আবার দেখা হবে মিঃ পোয়ারো।
দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন ভদ্রলোক।
পোয়ারো জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন মেজর ডেসপার্ড লম্বা লম্বা পা ফেলে ফুটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
.
১৬.
সার্জেন্ট ওকোনার দেখতে শুনতে খুবই সুদর্শন। চওড়া, কাঁধ, দীর্ঘ দেহ, দুচোখে অকপট হাসির উচ্ছ্বাস। মেয়েরা তাকে দেখে প্রেমে পড়ে যেত। তার ফলে সে সহজেই কাজ উদ্ধার করতে পারত।
মিঃ শ্যাতানার খুনের চারদিন পর তাকে এলিসা ব্যাটেলের পাশের চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেছে।
এইমাত্র রাস্তা দিয়ে এক ভদ্রলোক গেলেন তাকে দেখতেই আমার পুরানো মনিব মিঃ ক্র্যাডকের কথা মনে পড়ে গেলো।
এলিসা কৌতূহলী হয়ে বলল, আমিও এক ক্র্যাডক দম্পতির বাড়ি কাজ করেছি। তাহলে আমরা একই বাড়িতে কাজ করেছি, ভদ্রমহিলা খুবই ঝামেলা পাকাতেন। তার সঙ্গে ডাক্তার রবার্টসের নাম জড়িয়ে অনেক রসালো খবর রটেছিলো। ডাক্তার ভদ্রলোক অতিশয় ভদ্র তিনি মিসেস ক্র্যাডককে পেশেন্ট হিসাবেই দেখতেন। মিঃ ক্র্যাডক অ্যানথ্রক্স রোগে মারা গিয়েছিলেন। সে সময় মিসেস ক্র্যাডক খুবই স্বামীর সেবা করেছিলেন। ডাক্তার রবার্টস যখন মিঃ ক্র্যাডক বেঁচেছিলেন তখন ক্র্যাডক দম্পতির বাড়িতে আসাযাওয়া করতেন কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার পর আর আসেননি। মিসেস ক্র্যাডক হঠাৎ সমস্ত কিছু বিক্রী করে মিশরে চলে যান।
তা ঠিক, ওকোনার ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন। ভদ্রমহিলা সেখানেই মারা যান।
.
১৭.
রোডা মনস্থির করল শ্ৰীমতী অলিভার তো তাকে দেখা করবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছেন, তবে কোনো সঙ্কোচ না করে শ্রীমতী অলিভারের বাড়ি যাওয়া যাক। এইসমস্ত চিন্তা করতে করতে রোডা রাস্তায় অনেকক্ষণ কাটিয়ে দিলেন। হাতে বাঁধা রিস্টওয়াচের দিকে নজর দিলেন, সাড়ে তিনটে বাজে, কারোর সঙ্গে দেখা করবার পক্ষে উত্তম সময়।
ফুট পেরিয়ে শ্রীমতী অলিভারের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন রোডা। হাত বাড়িয়ে কলিংবেলের বোতাম টিপলেন।
একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এসে দরজা খুলে দিলো।
মিসেস অলিভার কি বাড়িতে আছেন?
আসুন ভেতরে আসুন।
রোডা দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। প্রৌঢ়া দাসীর পেছন পেছন সরু বারান্দা পেরিয়ে শ্ৰীমতী অলিভারের ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন। তার মনে হলো বুঝি আফ্রিকার জঙ্গলে এসে পড়েছেন। সারা ঘর জুড়ে নানারকম পাখির মেলা। টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে শ্রীমতী অলিভার বসে আছেন। তার চুল উস্কোখুস্কো।
আরে রোডা যে। এসো এসো তোমাকে দেখে খুব খুশী হলাম।
আমি বোধহয় হঠাৎ এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম, রোডা বিব্রত কণ্ঠে বললেন।
আরে না না, তোমাকে অতো ব্যস্ত হতে হবে না। শ্রীমতী অলিভার সহজভাবে বললেন, আমি অবশ্য লেখার কাজে মগ্ন ছিলাম।
রোডা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, বসে বসে একটা উপন্যাস লিখে ফেলা নিশ্চয়ই চমৎকার ব্যাপার।
শ্ৰীমতী অলিভার ব্যাজার মুখে বললেন, না, ব্যাপারটা কিন্তু সহজ নয়। লেখবার আগে, অনেক ভাবতে হয় আর এই ভাবনাটা খুবই ক্লান্তিকর।
কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে তেমন কঠিন বলে মনে হয় না।
তোমার কাছে তা মনে না হবারই কথা, হাসিমুখে উত্তর দিলেন অলিভার; তোমার জন্য কফির বন্দোবস্ত করি।
দাসীকে ডেকে কফির অর্ডার দিলেন, তারপর ফিরে এসে মেরিডিথের কথা জিজ্ঞাসা করলেন।
রোজা বললেন, মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে মেরিডিথ সলিসিটরের কাছে গেছে। অ্যানা খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছে এই ঘটনার দরুন। সে আরও একবার এইরূপ সাংঘাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলো। অ্যানা খুব স্পর্শকতার, কোনো কিছুর সম্মুখীন হতে ও খুব ভয় পায়।
শ্রীমতি অলিভার শান্ত ভাবে মাথা নাড়লেন এবং বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি সাহসী কিন্তু অ্যানার এই সাহসের একান্ত অভাব।
রোডা বিনীত কণ্ঠে বললেন, আপনাকে যা বললাম সেটা কিন্তু অ্যানার কাছে ফাঁস করে দেবেন না। এইসব বিষয়ে আলোচনা ও খুব অপছন্দ করে।
শ্ৰীমতী অলিভার নিশ্চিন্ত করলেন রোডাকে–তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি বলবো না তোমার বন্ধুকে।
টোস্ট আর কফি খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন রোভা, এমনভাবে আচমকা হানা দিয়ে হয়তো আপনার কাজের ক্ষতি করলাম আর বেশি বিরক্ত করব না।
শুভ রাত্রি…বলে রোডা বিদায় নিলেন।
.
১৮.
মিসেস লরিমা দরজা পেরিয়ে পা-বাড়ালেন রাস্তায়। তার সারা মুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তির ছাপ।
ঠিক সেই মুহূর্তে বিপরীত দিকের ফুটপাতে অ্যানা মেরিডিথের ওপর তার দৃষ্টি পড়লো। মিসেস লরিমা সামান্য ইতস্ততঃ করলেন। তারপর রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন, কেমন আছেন, মিস মেরিডিথ?
অ্যানা চমকে ফিরে তাকালেন, ওঃ, আপনি! অনেকদিন বাদে আবার দেখা হলো।
মিস মেরিডিথের দৃষ্টি তখনো সেই ফ্ল্যাটবাড়ির দিকে নিবদ্ধ।
মিসেস লরিমা প্রশ্ন করলেন, ওদিকে ঘন ঘন তাকাচ্ছেন কেন?
অ্যানা ধরা পড়ে যাওয়ার কণ্ঠে বললেন, না, না, ও কিছু নয়। তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। তবে আমার বন্ধু রোডাকে এই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখলাম তাই ভাবছি ও কি মিসেস অলিভারের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল?
মিসেস লরিমা বললেন, ওসব থাক চলুন আমরা একটু চা খাই সামনের ঐ দোকানে বসে।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজন একটা রেস্তোরাঁয় এসে ঢুকলেন।
মিসেস লরিমা মাথা নাড়লেন। মঁসিয়ে পোয়ারো ছাড়া আর কেউ যাননি, কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার প্রশ্ন করলেন অ্যানা, মিঃ ব্যাটেল তাহলে নিশ্চয় গিয়েছিলেন?
হা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন। অ্যানা প্রশ্ন করলেন, ভদ্রলোক কি বিষয়ে জানতে চাইলেন?
মিসেস লরিমা ইতস্ততঃ করে বললেন, নিয়ম মাফিক তদন্ত আর কি।
আচ্ছা মিসেস লরিমা, আপনার কি মনে হয় শেষপর্যন্ত প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়বে?
তিনি শান্ত সুরে বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না সমস্যাটি বড় জটিল। একই সুরে তিনি বললেন, জীবন বড় জটিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে দুটি জিনিষের একান্ত প্রয়োজন প্রথম হচ্ছে অফুরন্ত সাহস; দ্বিতীয়, অসীম সহ্য শক্তি, এবং শেষ লগ্ন সামনে এলে সকলেই ভাবে সত্যই এর কি কোনো প্রয়োজন ছিলো?
অমন ভাবে বলবেন না। ভীত কণ্ঠে বাধা দিলেন অ্যানা।
মিসেস লরিমা হেসে উঠলেন, জীবন সম্বন্ধে এ ধরনের অভিব্যক্তি হয়তো খুবই সাধারণ। তিনি বেয়ারাকে বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
উজ্জ্বল হাসি হেসে অ্যানা বললেন, ওই যে রাস্তার মোড়ে রোডা দাঁড়িয়ে আছে, আচ্ছা চলি নমস্কার। অ্যানা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল রোডার দিকে।
রোডা তুই মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি?
রোডা উত্তর দিল, হা গিয়েছিলাম।
অ্যানা বিরক্তি চেপে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কেন?
রোডা উত্তর দিলেন, তিনি তো আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন, তাছাড়া ভদ্রমহিলার মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। এমন সুন্দর মহিলা আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। এই দেখ আমাকে তার একটা বইও উপহার দিলেন। রোডা হাসিমুখে বইটা বার করে অ্যানাকে দেখালেন। রোডা এবার অ্যানাকে অন্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা তোর সলিসিটর ভদ্রলোককে কেমন দেখলি?
খুব কাঠখোট্টা গোছের, আইনের প্যাঁচ পয়জার সব একেবারে কণ্ঠস্থ।
আর মেজর ডেসপার্ডকে কেমন মনে হলো?
ভারী দয়ালু ভদ্রলোক, অ্যানা বলে উঠল।
তাহলে তিনি নিশ্চয় তোর প্রেমে পড়ছেন এতে আমার আর কোনো সন্দেহ নেই।
রোডার কথা শুনে অ্যানা মৃদু রাগত স্বরে রোডাকে বললে, আবোলতাবোল বকিস না।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, সামনের ঐ বাসটা প্যাডিংটনে যাবে। চারটা পঞ্চাশে ছাড়বার কথা, চল আমরা এগিয়ে যাই।
.
১৯.
আমি সার্জেন্ট ওকোনার, ব্যাটেলের নির্দেশমতো আপনাকে ফোন করছি। সকাল এগারোটায় যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে তার সঙ্গে একবার দেখা করেন।
পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন।
ঠিক সাড়ে এগারেটায় ট্যাক্সি থেকে অবতরণ করলেন পোয়ারো। তারপর দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে রওনা হলেন। ব্যাটেলের বসবার ঘরে সবাই বসলেন। ব্যাটেল এসে প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর তিনজনে তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
ব্যাটেল বললেন, আমার মনে হয় এখন আমাদের মধ্যে একবার আলাপ আলোচনা হওয়া দরকার। কিন্তু কর্নেল রেস এখনও এলেন না। বলতে বলতে দরজা ঠেলে কর্নেল রেস ঘরে ঢুকলেন।
আমি খুবই দুঃখিত; একটু দেরি করে ফেললাম। বলেই তিনি বলতে শুরু করলেন, মেজর ডেসপার্ডের বিষয়ে কিছু খবর সংগ্রহ করে এনেছি এই নিন। কর্নেল রেস কতকগুলি টাইপ করা কাগজ ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। শক্ত সমর্থ বলিষ্ঠ পুরুষ। সর্বদা সভ্য সমাজের আইনকানুন মেনে চলেন। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। দূরদৃষ্টি আছে এবং সবিশেষ নির্ভরযোগ্য।
এত প্রশংসাতেও ব্যাটেল তেমন বিচলিত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কোনো দুর্ঘটনা বা আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে কিনা? ব্যাটেল অধৈর্যভাবে মাথা নাড়লেন। মানুষ তার নিজের হাতে আইন তুলে নেবে এটা কখনোই সভ্য সমাজে চলতে দেওয়া যেতে পারে না।
কর্নেল রেস এবার উঠে দাঁড়ালেন, আপনাদের আলোচনায় বেশিক্ষণ যোগ দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। আমার অনেক কাজ বাকি আছে। বিদায় জানিয়ে কর্নেল রেস চলে গেলেন। তিনি যে নথিপত্র রেখে গেছেন মিঃ ব্যাটেল তার মধ্যে চোখ ডোবালেন। আর মাঝে মাঝে নিজের প্যাডে পেন্সিল দিয়ে নোট করে নিলেন কিছু কিছু।
অলিভার এবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা মিঃ ব্যাটেল, আপনি এই খুনের তদন্তের ব্যাপারে কিভাবে এগোচ্ছেন।
ব্যাটেল ধীরে ধীরে শুরু করলেন, প্রথমে আমি এই কথাই বলবো যে মিঃ শ্যানার হত্যাকারী কে তা এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমার লোক সন্দেহভাজন চারজনের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। এবার মিঃ ব্যাটেল পোয়ারোকে জিজ্ঞাসা করলেন, এদের কারোর অতীত জীবন সম্বন্ধে কিছু জানতে পারলেন?
হা ডাক্তার রবার্টসের কোনো নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারো আকস্মিক মৃত্যু ঘটেনি। তবে অনেক তন্ন তন্ন করে ঘেঁটে একটিমাত্র ঘটনার সন্ধান আমি পেয়েছি যার সঙ্গে বর্তমান মামলার কোনো যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। কয়েক বছর আগে ডাক্তার রবার্টস কোনো মহিলা পেশেন্টের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এবং এর জন্য সেই পরিবারে গণ্ডগোলের সূত্রপাত দেখা দেয়। ভদ্রমহিলার স্বামী অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে রবার্টসকে খুব শাসিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক এই ঘটনার অল্প কিছুদিন বাদেই অ্যানথ্রক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
সন্দেহজনক একটিমাত্র সূত্র যা আমি পেয়েছি; ছোট হলেও তা খুব মূল্যবান।
ব্যাটেল এবার অন্যদের সম্বন্ধে বলতে লাগলেন, বছর কুড়ি হলো মিসেস লরিমা বিধবা হয়েছেন। ভদ্রমহিলা অধিকাংশ সময় লণ্ডনে বাস করেন। কোনো রহস্যময় মৃত্যুর সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। তার মতো সম্ভ্রান্ত মহিলার যেভাবে থাকা উচিত তিনি তাই করেছেন। ব্যাটেল হতাশভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মিস মেরিডিথ তার পিতা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। মৃত্যুকালে মেয়ের জন্য কিছু রেখে যাননি ফলে তাকে নিজেই অন্নের সংস্থান করতে হয়।
প্রত্যেকেই মেয়েটির জন্য আন্তরিক দুঃখিত। মেজর ডেসপার্ডের কি খবর? তার সম্বন্ধে কতদূর কি জানতে পারলেন? প্রশ্ন করলেন শ্রীমতী অলিভার।
ব্যাটেল বললেন, আমার লোক তার উপর সবসময় নজর রেখে দিয়েছে। হ্যাঁ ভালো কথা ডেসপার্ড কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতে রাজী নন। ইতিমধ্যে সলিসিটরের পরামর্শ নিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে তিনি বিপদের আশঙ্কা করেন।
পোয়ারো মন্তব্য করলেন, যে কোনো অবস্থার জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত রাখেন।
সেইজন্যই তিনি কারো বুকে ছুরি বসাতে পারেন এটা ভাবা যায় না। মিঃ ব্যাটেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।
পোয়ারো মৃদু হেসে বললেন, আপনাদের একটা বিশেষ কথা জানাই। ডাক্তার রবার্টস এবং মিসেস লরিমার সঙ্গে আমি দেখা করেছি। মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে। বাকি কেবল মিস মেরিডিথ। এই তিনজনের সঙ্গে কথা বলে আমি এইটুকুই জেনেছি ডাক্তার রবার্টস চারিদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেন।
মিসেস লরিমারের মানসিক একাগ্রতা মাত্রাতিরিক্ত বেশি।
পোয়ারো বললেন, এগুলি ক্ষুদ্র নগণ্য হলেও এগুলো তথ্য। হ্যাঁ, আমার তালিকায় সকলের শেষে মিস মেরিডিথের নাম।
মিঃ ব্যাটেল পোয়ারোকে একটি কাজের ভার দিলেন। কাজটা হচ্ছেঅধ্যাপক ল্যাক্সমোরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। তিনি নিজে এই দায়িত্ব নিতে পারছেন না। কারণ আগামীকাল তাকে ডেভনশায়ার রওনা দিতে হবে। ব্যাটেল একটুকরো কাগজে একটা নাম ঠিকানা লিখে পোয়রোর হাতে দিলেন, এই হচ্ছে ল্যাক্সমোরের ঠিকানা। ভদ্রমহিলাকে একবার ভালো করে বাজিয়ে দেখুন। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের প্রকৃত মৃত্যুরহস্য আমি জানতে চাই।
পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু মঁসিয়ে ব্যাটেল, এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ কি কখনো কোনো বিষয়ে প্রকৃত সত্য অবগত করতে পেরেছে?
.
মিঃ পোয়ারো একদিন মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়িতে গেলেন। পকেট থেকে কার্ড বার করে দাসীর হাতে দিলেন। এটা তোমার কত্রীর কাছে নিয়ে যাও।
কিছুক্ষণ বাদে দাসীটি হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসে পোয়ারোকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেলো।
একজন সুন্দরী মহিলা আগুনের চুল্লীর কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি পোয়ারোর দিকে এগিয়ে এসে ধরা ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনিই মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নত করে অভিবাদন জানালেন।
আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন?
ম্যাডাম আমি মাঝে মধ্যে বেসরকারী ভাবে অনুসন্ধানের কাজ করে থাকি।
হ্যাঁ, বুঝেছি আপনি বলুন?
পোয়ারো বললেন, আমি অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুর বিষয়ে কিছু তদন্ত করতে চাই।
ভদ্রমহিলা এবার চমকে উঠলেন এবং রীতিমত ভয়ে বলে উঠলেন, কিন্তু কেন?
পোয়ারো উত্তর দিলেন–আপনার কীর্তিমান স্বামীর জীবনকাহিনী নিয়ে একটা বই লেখা হচ্ছে তাই লেখক সমস্ত তথ্য অবগত হতে চান।
ভদ্রমহিলা এবার দ্রুত বলে ফেললেন, আমার স্বামী কালাজ্বরে মারা যান। আমাজন নদীর ধারে তাকে কবর দেওয়া হয়।
পোয়ারো গম্ভীর স্বরে বললেন, কিন্তু আমি পরলোকগত শ্যাতানার কাছ থেকে অনেকরকম খবর সংগ্রহ করেছি। আপনার স্বামী যে কালাজ্বরে মারা যাননি তা মিঃ শ্যাতানা ভালোভাবেই জানতেন।
অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে ভদ্রমহিলা শুরু করলেন, হ্যাঁ আমার স্বামী বন্দুকের গুলিতে মারা যান।
আমার স্বামী ছিলেন উদ্ভিদবিদ। তিনি তখন লতা গুল্ম নিয়ে একটি বই লিখছিলেন। তাই মেজর ডেসপার্ডের সাথে পরিচয় হলে আমরা সদলবলে ঐ অঞ্চলে যাত্রা শুরু করলাম।
মিসেস ল্যাক্সমোর ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সত্যি কথা বলতে কি আমার স্বামী ছিলেন বয়সে আমার থেকে দ্বিগুণ বড়। আমার সাথে জন ডেসপার্ডের সম্পর্ক ছিল নীরব প্রেমের। আমরা ঠিক করে ছিলাম, বেদনায় হৃৎপিণ্ড পিষ্ট হয়ে গেলেও আমরা মুখ ফুটে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর কথাটাকে উচ্চারণ করবো না।
তারপর সেই নারকীয় রাত্রি। জন আর টিমোথি দুজনে ঝগড়া করছিল। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে এলাম…। দেখলাম সে তখন প্রচণ্ডভাবে জনকে শাসাচ্ছে অবশেষে জন গুলি চালালো। একটা গুলির আঘাতেই টিমোথি মারা গেল। সেদিনের কথা আমি কোনোদিন ভুলবো না।
সমস্তই জনকে বুঝিয়ে বললাম যে এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ কেউ না জানতে পারে; তাহলে লোকনিন্দা, পুলিসী ঝামেলা অনেক কিছু হতে পারে। সুতরাং টিমোথি তখন জ্বরে ভুগছিলো তাই সবাইকে বলা হলো যে টিমোথি জুরে মারা গেছে। আমাজনের তীরে ওকে কবর দেওয়া হলো। নীরব হয়ে গেলেন মিসেস ল্যাক্সমোর। চোখের কোণে মুক্তোর মতো দু ফোঁটা জল টলটল করছে।
পোয়ারো আবার কথা শুরু করলেন। আপনার ইতিহাস খুবই করুণ।
মিসেস ল্যাক্সমোর বললেন, মিঃ জন আত্মরক্ষার জন্যই এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, সব দিক বিচার বিবেচনা করে আপনি নিশ্চয়ই এটা উপলব্ধি করবেন, টিমোথি যে জুরে মারা গেছে সেই কথাটাই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেওয়া সর্বতোভাবে শ্রেয়। মিসেস ল্যাক্সমোর এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
পোয়ারোও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বললেন, ম্যাডাম, এমন মহান আত্মোৎসর্গের কোনো প্রয়োজন দেখি না। এই করুণ ব্যাপারটা যাতে বরাবর গোপন থাকে সেটা আমি চেষ্টা করবো। বিদায় ম্যাডাম।