২. মাঠের দক্ষিণ কোণ থেকে

মাঠের দক্ষিণ কোণ থেকে পুরো ব্যাপারটাই পল্টন আর ঘটোৎকচ লক্ষ করছিল। ঘটোৎকচের মেজাজ ভালই আছে। গোটা দশেক কলা আর গোটা ত্রিশেক জামরুল খাওয়ার পর সে এখন পোয়াটাক বাদামভাজা নিয়ে খুব ব্যস্ত। বাদামভাজা পল্টনের জামার পকেটে। সুতরাং ঘটোৎকচকে সেটা চুরি করে খেতে হচ্ছে। কিন্তু মাঠে মাধববাবুর পরিণতি দেখে পল্টন এমন হা হয়ে গেছে যে, পকেটমারের ঘটনাটা টেরই পায়নি। হঠাৎ সে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “কাদামামাকে ধরে নিয়ে গেল যে রে ঘটোৎ!”

হেতমগড় যে কাদামামার কত গর্বের বস্তু সেটা সবাই জানে। হেতমগড় হেরে যাচ্ছিল বলেই উনি মাঠে নেমে হম্বিতম্বি করছিলেন বটে, কিন্তু সেটা যে কাউকে খুন করার জন্য নয় এ তো বাচ্চাদেরও বোঝাবার কথা। তবে কিনা মাধববাবুকে চেনেই বা ক’জন? না চিনলে লোকে বুঝবেও না।

রেফারী বাঁশি বাজাচ্ছে, খেলা আবার শুরু হল বলে, পল্টন নিঃশব্দে ঘটোৎকচের গলার বকলশ থেকে শিকলের আংটা খুলে নিয়ে কানে-কানে কী যেন শিখিয়ে দিল।

এদিকে সেন্টার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই লাতনপুরের ফরোয়ার্ডরা বল ধরে ব্যাভ-বিক্রমে হেতমগড়ের গোলে হানা দিল।

রাইট-উইং থেকে বল চমৎকারভাবে ব্যাক সেন্টার হয়েছে। রাইট ইন বল ধরেই থ করে বলটা এগিয়ে দিল। একেবারে রসগোল্লার মতো সহজ বল। পা ছোঁয়ালেই গোল। তা পা প্রায় চুঁইয়ে ফেলেওছিল লাতনপুরের লেফট-ইন। কিন্তু মুশকিল হল, বলটার নাগাল না পেয়ে। দিব্যি সুন্দর বলটা একটু ধীরগতিতে গড়িয়ে যাচ্ছিল সামনে, লেফট-ইন ছুটে গিয়ে পজিশন নিয়ে শট করতে পাও তুলেছে, ঠিক এই সময়ে একটা অতিকায় বানর কোত্থেকে এসে বলটাকে কোলে তুলে এক লাফে গোলপোস্টের ওপরে উঠে গেল। তারপর লেফট-ইনকে মুখ ভেংচে বলটা মাঠের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তরতর করে নেমে পালিয়ে গেল।

মাঠে কেউ কেউ প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়ল। কেউ রাগে গরগর করতে লাগল। কেউ বলল, “ধর ওটাকে, ধর। রেফারী বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে জড়ো করে বললেন, “এটা একটা ন্যাচারাল ডিসটারবেন। সুতরাং ড্রপ দিয়ে খেলা শুরু হোক।”

লাতনপুর গোল দিতে না পেরে হতাশ, হেতমগড় চতুর্থ গোলের হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ায় বেশ চাঙ্গা। ফলে ড্রপ দেওয়ার পর হেতমগড়ের খেলোয়াড়রা প্রাণপণ চেষ্টায় লাতনপুরের সীমানার মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে পড়ল।

অবশ্য গোল হওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না। তবু হেতমগড়ের রাইট-উইং মরিয়া হয়ে লাতনপুরের গোলে একটা অত্যন্ত দুর্বল শট নিয়েছিল। শট এতই দুর্বল যে গোলের দিকে যাওয়ার আগে দুবার মাটিতে ড্রপ খেল। লাতনপুরের ব্যাকরা ভাবল, গোল কীপারই বলটা ধরুক। তাই নিজেরা আর গা ঘামাল না। গোলকীপার নিশ্চিতমনে বলটা ধরার জন্য এগিয়ে এসেছিল। এই সময়ে হঠাৎ গোন্সপোস্টের মাথা থেকে ঘটোৎকচ বিকট একটা ‘হুপ’ দিল, তারপর দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড অঙ্গভঙ্গি করে নাচ জুড়ে দিল। সেই সঙ্গে ‘কুক-কুক’ করে বাঁদুরে গান।

গোলকীপার একটা বাচ্চা দুধের ছেলে। বাঁদরের এই বীভৎস নাচ-গান দেখে সে এমনই ঘাবড়ে গেল যে, বলটার কথা তার মনেই রইল না। বলটা তার সামনেই ড্রপ খেয়ে তার হাত ছুঁয়ে প্রায় বগলের তলা দিয়ে খুব অনিচ্ছের সঙ্গে গোলে গিয়ে ঢুকে গেল।

রেফারী গোলের বাঁশি বাজালেন। লাতনপুর প্রতিবাদ জানালে রেফারী বললেন, “বাঁদরটা চেঁচিয়েছে বটে, নাচও দেখিয়েছে, কিন্তু সে তো দর্শকরাও হামেশাই দেখায়। সুতরাং ওতে আইনভঙ্গ হয় না।”

সুতরাং হাফটাইমের পর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফল দাঁড়াল ৩-১। মাঠে এমন হইচই পড়ে গেল যে কান পাতা দায়।

গোল খেয়ে যেমন একটু বোমকে গেল লাতনপুর, গোল দিয়ে তেমনি চুমকে উঠল হেতমগড়। সুতরাং খেলাটা আর এক তরফা রইল না। লাতনপুরের বিখ্যাত হাফব্যাক ফটিক বল ধরে হরিণের মতো দৌড়ে লেফট-ইনকে বল বাড়াল একবার। লেফট-ইন নিখুঁত একটা ভলি গোলে মেরে দিল। হেতমগড়ের গোলকীপার মাটিতে পড়ে আছে, বল জালে ঢুকছে, ঠিক এই সময়ে আবার বাঁদুরে কাণ্ড। ঘটোৎকচ ঝুপ করে যেন আকাশ থেকে দৈব বাঁদরের মতো নামল এবং বলটা পট করে ধরে আবার গোলপোস্টে উঠে গেল। লাতনপুর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গোলের দাবি করতে লাগল। কিন্তু রেফারী কঠিন স্বরে বললেন, “গোলে বল না ঢুকলে গোল দেওয়ার কোনো আইন নেই। সুতরাং আবার ড্রপ দিয়ে খেলা শুরু হল। হেতমগড়ের খেলুড়েরা দারুণ উৎসাহের চোটে বল লেনদেন করতে করতে ঢুকে পড়ল লাতনপুরের এলাকায়। লাতনপুরের গোলকীপার থেকে শুরু করে সব খেলুড়েই বাঁদরাতঙ্কে কণ্টকিত। তারা এই সময়ে বাঁদরের হস্তক্ষেপ আশঙ্কা করে চারদিক চাইছে, সকলেরই দোনো-মোনো ভাব, বাঁদরটা কখন কোন দিক থেকে হানা দেয়। আর এই দোনো-মোনোর ফলেই হেতমগড়ের রাইট লিংকম্যান ষষ্ঠীচরণ মনের সুখে একখানা ফাঁকা জমি ধরে এগিয়ে গিয়ে গুপ করে জোরালো শটে গোল দিয়ে দিল। ফল সেকেণ্ড হাফের পনেরো মিনিটের মধ্যেই খেলার হাওয়া উল্টো দিকে বইতে থাকে। হেতমগড় বুঝতে পেরেছে স্বয়ং সৌভাগ্যই আজ বাঁদরের রূপ ধরে এসে তাদের পক্ষ নিয়েছে। আর লাতনপুর ভুগছে বাঁদরের আতঙ্কে। সুতরাং দ্বিতীয় গোলটার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ষষ্ঠীচরণ আবার এগোল এবং বল পাস করল রাইট-উইংকে। রাইট উইং বল ধরে ধনুকের মতো বাঁকা পথে ছুটতে লাগল হরিণের মতো। ওদিকে গোলপোস্টের মাথায় ঘটোৎকচ উঠে বসে আছে এবং গোলকীপারের নাকের ডগায় নিজের লম্বা লেজটা নামিয়ে দিয়ে খণ্ড ত দেখাচ্ছে। লাতনপুরের গেম-স্যার জয়পতাকাবাবু একটা পোলভল্টের বাঁশ নিয়ে বাঁদরটাকে তাড়া করতে দৌড়োচ্ছন। রাগী ও রাশভারী জয়পতাকা-স্যারকে বাঁশ নিয়ে দৌড়োতে দেখে লাতনপুরের খেলোয়াড়রা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল। সেই ফাঁকে রাইট-উইং খুব সহজেই গোলে বল ঢুকিয়ে ফল ৩৩ দাঁড় করিয়ে দিল। রেফারী বাঁশি বাজানোর পর লাতনপুরের খেলোয়াড়রা অবাক হয়ে দেখল, তারা আর-একটা গোল খেয়ে গেছে।

জয়পতাকা-স্যার অবশ্য ঘটোৎকচকে বাঁশপেটা করতে ব্যর্থ হলেন। কারণ ঘটোৎকচ হঠাৎ একটা ডিগবাজি খেয়ে নেমে জয় পতাকাবাবুর ধুতির কাছা এক টানে খুলে ফেলে হাতের বাঁশটা কেড়ে নিয়ে দৌড়। চারদিকে প্রচণ্ড চেঁচামেচি, হাসাহাসি পড়ে যাওয়ায় রাশভারী ও রাগী জয়পতাকা-স্যার নিজের কাছা আঁটতে আঁটতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “ডিসিপ্লিন! ডিসিপ্লিন!”

খেলা আবার শুরু হল বটে, কিন্তু লাতনপুরের ততক্ষণে সব উৎসাহ নিভে গেছে, দমও ফুরিয়ে এসেছে। খেলায় তার মনোযোগই দিতে পারল না। সুতরাং ঘটোৎকচ আর হানা না দেওয়া সত্ত্বেও হেতমগড় গুনে গুনে আরো দুটো গোল দিল লাতনপুরকে।

হেতমগড়ের ক্যাপটেনের হাতে ভবতারিণী স্মৃতি শীল্ড তুলে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব বললেন, “পশুপাখি যে মানুষের কত উপকারে লাগে, তা বলে শেষ করা যায় না। পশুপাখির কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।” এর পর লাতনপুরের ক্যাপটেনের হাতে রানার্স আপের পুরস্কার তুলে দিয়ে তিনি বললেন, “কিছু কিছু পশুপাখি যে মানুষের কত অপকার সাধন করে তার হিসেব নেই। এইসব অপকারী পশুপাখির হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করাটা আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে নিতে হবে।”

দুরকম কথাতেই দর্শক ও শ্রোতারা খুব হাততালি দিল।

ওদিকে থানার লক-আপে চারটে চোরের সঙ্গে এক কুঠুরিতে আবদ্ধ মাধববাবু এতসব খবর জানেন না। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বুজে বসে আছেন আর হেতমগড়ের হেরে যাওয়ার কথা ভাবছেন। বিকেলে চা খাওয়ার অভ্যাস, কিন্তু লক-আপে চা জোটেনি বলে মাথাটা টিপটিপ করছে। বাঁধানো দাঁত, গামছা ও চটির শোকও

উথলে উঠছে বুকের মধ্যে। সেই সঙ্গে পৈতৃক মোহরের কথা ভেবেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন।

এমন সময়ে চারজন চোরের মধ্যে একজন একটু সাহস করে বলল, “হেতমগড়ের কুমার-বাহাদুর না?”

মাধববাবু চোখ খুললেন। এতক্ষণ লজ্জায় তিনি এই চারটে লোকের দিকে ভাল করে তাকিয়েও দেখেননি। এখন দেখলেন, চার জনের মধ্যে যে লোকটা সবচেয়ে বুড়ো সেই পাকা চুল আর পাকা দাড়িওলা লোকটা জুলজুল করে তার দিকে চেয়ে আছে। মাধববাবু খানিকক্ষণ লোকটার দিকে চেয়ে ম্লান একটু হেসে বলেন, “তুমি বনমালী! তাই বলে।”

বনমালী ছিল হেতমগড়ে মাধবদের বাড়ির মালি। দারুণ সুন্দর সব ফুল ফোঁটাতে আর ফল ফলাতে তার জুড়ি ছিল না। তবে যাকে বলে ক্লিপটোম্যানিয়াক, বনমালী ছিল তাই। চুরি করা ছিল তার মজ্জাগত কু-অভ্যাস। চুরি করতে না পারলে তার পেট ফাঁপত, আইঢাই হত, রাতে ঘুমোতে পারত না ভাল করে। সোনাদানাই হোক বা সেফটিপিন, নস্যির কৌটো, কাঁচের চুড়ি যাই হোক, কিছু না-কিছু তাকে চুরি করতেই হবে। চুরি করে বড়লোক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল না, কেবল জিনিসগুলি নিয়ে নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখে দিত। তাই বনমালীর চুরিবিদ্যের জন্য তাকে কেউ খারাপ চোখে দেখত না। এমনকী, যাতে সে চুরির অভ্যাস বজায় রাখতে পারে তার জন্য বাড়ির এখানে-সেখানে জিনিসপত্র ফেলে রাখা হত। তারপর তার ঘর থেকে একসময়ে গোপনে সেগুলি উদ্ধার করেও আনা হত।

বনমালী অবাক হয়ে বলে, “আপনাকে কয়েদ করেছে এতবড় সাহস পুলিসের হয় কী করে?”

মাধব ম্লান মুখে বলেন, “সে অনেক কথা। সে সব না তোলাই ভাল। তুমি কেমন আছ বলো!”

বনমালী দুঃখ করে বলল, “হেতমগড় ভেসে যাওয়ার পর আর কাজকর্ম জোটেনি। চেয়েচিন্তে দিন কাটে। গাছপালা ছাড়া থাকতে পারি না বলে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই। আর কিছু লোক চুরিবিতে শিখতে আমার কাছে আসে, তাদের শেখাই। কিন্তু আজকালকার ছ্যাচড়াগুলো এত লোভী যে, বিদ্যেটা ভাল করে না-শিখেই হামলে চুরি করতে যায় আর ধরা পড়ে বে-ইজ্জত হয়। এই দেখুন না, এই তিনটে স্যাঙাতকে বিদ্যেটা সবে শেখাতে শুরু করেছিলাম, তা বাবুদের তর সইল না। ভাল করে না-শিখেই থানার পুকুর থেকে মাছ চুরি করতে গিয়ে ধরা-টা পড়ে একশা। নিজেরা তো ধরা পড়লই, আবার পিঠ বাঁচাতে আমার নামও পুলিসকে বলে দিল। তাই কপালের ফেরে জেলখানায় বসে আছি। কিন্তু ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। হাজতে আটক না থাকলে আপনার সঙ্গে দেখাই হত না।”

মাধব বনমালীকে বহুকাল বাদে দেখে খুশি হলেন। এক সময়ে বনমালীর কোলেপিঠে চড়েই মানুষ হয়েছেন। বললেন, “কথাটা খুব খাঁটি। তবে কিনা হাজতে আসা বা থাকাটা আমার তেমন পছন্দ নয় হে, বনমালী।”

বনমালী এক গাল হেসে বলল, “আপনাকে বেশিক্ষণ হাজতে থাকতে হবে না, কর্তা। সে-ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন।”

তারপর এক রোগা-পাতলা চেহারার স্যাঙাতের দিকে চেয়ে বনমালী হুকুম দিল, “বিষ্ণু, ওঠ।”

বিধুকে এতক্ষণ ভাল করে লক্ষ করেননি মাধব। এবার করলেন এবং একটু অবাক হয়ে গেলেন। বিষ্ণুর হাবভাবের মধ্যে বেশ একটা বাদুরে ভাবভঙ্গি আছে। দাঁড়ানোর সময় একটু কুঁজো হয়ে থাকে, লম্বা রোগা হাত দুখানা সামনের দিকে বুল খায়। মাঝে-মাবে বাঁদরের মতো গা-চুলকানোর স্বভাবও তার আছে। হুকুম পেয়ে সে হাজতঘরের একটা কোণে গিয়ে সমকোণ দুই দেয়ালের খাঁজে দাঁড়াল। তারপর গুরু বনমালীর দিকে ফিরে একটা নমস্কার জানিয়ে দুদিকের দেয়ালে হাত আর পা চেপে টিকটিকির মতো ওপরে উঠে যেতে লাগল। দৃশ্যটা দেখে মাধব হাঁ। ঘটোৎকচেরও যে এমন এলেম নেই!

অনেক ওপরে, ছাদের কাছ বরাবর একটা গরাদ লাগানো ঘুলঘুলি আছে। তা দিয়ে বাইরে সদর রাস্তা পর্যন্ত দেখা যায়। বিষ্ণু ওপরে উঠে সেই ঘুলঘুলি দিয়ে ভাল করে বাইরেটা দেখে নিল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে কী যেন শোনবার চেষ্টা করল। নাক বাড়িয়ে বাতাসটা বোধহয় শুঁকলও একটু। বনমালী মাধবের দিকে চেয়ে বলল, “এ তেমন কোনো কেরানি নয়, কর্তা। এ হল টিকটিকি বিদ্যা। ওস্তাদের ওপর ভক্তি আর বিদ্যে শেখার ‘হাউস’ থাকলে এসব শেখা তেমন কোনো শক্ত কাজ নয়।”

মাধব জবাব দিতে পারলেন না। বিষ্টু খানিকক্ষণ ওপরে থেকে আবার নেমে এল। বলল, “সিপাইরা বেশি নেই। রাস্তাঘাট খুব থমথম করছে। তার মানে আজকের খেলায় লাতনপুর জিততে পারেনি। আর-একটা খুব অবাক কাণ্ড দেখলাম। ঘুলঘুলির ওপাশে একটা কাঁঠাল গাছের ডালে মস্ত একটা বানর বসে আছে, তার কোলে একটা ফুটবল। আমাকে ঘুলঘুলি দিয়ে দেখতে পেয়ে হুপ হুপ করে কী যেন বলল। ভাষাটা ঠিক বুঝলাম না।”

মাধব হেসে বললেন, “জাতভাই বলে বাঁদরটা তোমাকে চিনতে পেরেছে যে! চেষ্টা করলে ভাষাটা আয়ত্ত করা তেমন শক্ত হবে না তোমার। বাঁদরের আর সব কিছু শিখতে তে বাকি রাখোনি বাপু, ভাষাটা আর কত কঠিন হবে? বলতে-বলতেই মাধববাবুর কী একটা খেয়াল হয়। তিনি একটু থেমে চেঁচিয়ে ওঠেন, “বাঁদরটা কি খুব বড়?”

“বড়ই।” বিষ্ঠু জবাব দেয়।

ঘটোৎ নয় তো? মাধববাবু চিন্তিত মুখে আপনমনে বলতে লাগলেন, “কোলে ফুটবল দেখলে? ব্যাপারটা খুব ঘোরালো ঠেকছে তো। শহরটাই বা থমথম করবে কেন? লাতনপুর হাফটাইমের আগেই তিন গোল দিয়েছে দেখে এসেছি। হাফটাইমের পর আরো তিনটে দেওয়া তাদের কাছে শক্ত নয় মোটেই।”

ঠিক এই সময়ে রাস্তা দিয়ে বিরাট শোরগোল তুলে একটা মিছিল এল। “…ভবতারিণী স্মৃতি শীল্ড জিতল কে? হেতমগড় আবার কে?…হেরে হয়রান হল কে? লাতনপুর, আবার কে?…”

বিড়বিড় করে মাধববাবু বললেন, “আশ্চর্য! পরমাশ্চর্য! পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য!”

বনমালী তার স্যাঙাতদের নিয়ে ঘরের এক কোণে গিয়ে ফিসফিস করে কী পরামর্শ দিচ্ছিল। মাধব মাথায় হাত দিয়ে বসে হাজারো কথা ভাবছিলেন। ভরতারিণী স্মৃতি শীল্ড। বাঁধানো দাঁত। হেতমগড়ের হারানো মোহর। ঘটোৎকচের কোলে ফুটবল। ভাবতে-ভাবতে মাথা ঝিমঝিম করায় একটু ঘুমিয়েও পড়েছিলেন।

হঠাৎ লোহার গেট খুলবার শব্দ হল। ঘরে এসে দাঁড়ালেন থানার নতুন দারোগা নবতরণ ঘোষ। ছ ফুট লম্বা বিভীষণ চেহারা, দুটো চোখ আলুর মতো গোল আর টর্চবাতির মতো জ্বলজ্বলে, হাত দুটো দেখলে মনে হবে ঐ দুই হাতে একটা মোষের মাথা তার ধড় থেকে ছিঁড়ে ফেলতে পারেন। দারোগা হিসেবে নবতারণের সাঘাতিক নামডাক।

নবতারণ মাধবের দিকে চেয়ে বললেন, “আপনার অপরাধ খুবই গুরুতর। পাবলিক প্লেসে আপনি মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছেন। সুতরাং কঠিন শাস্তির জন্য তৈরি হোন।”

মাধববাবু বরাবরই পুলিসের ভয়ে আধমরা। দুনিয়ায় আর কোনো-কিছুকে গ্রাহ্য না করলেও কেবল এই পুলিসই তাঁকে কাবু করে রেখেছে। পুলিস দেখলে তার রাতে ঘুম হয় না, খাওয়া কমে যায়, পেটের মধ্যে অনবরত গুড়গুড় করতে থাকে। এখনো করছিল। তাই তিনি ভ্যাবাচ্যাকা মুখে নবতারণের দিকে চেয়ে ছিলেন।

নবতারণ বনমালীর দিকে চেয়ে বললেন, “তোমার হিস্টরিও আমি সব জানি। এ-অঞ্চলের যত চোর ডাকাত আর বদমাশ সব তোমার কাছে ট্রেনিং নেয়। ট্রেনার হিসেবে তুমি খুবই উঁচুদরের সন্দেহ নেই। কিন্তু আমিও অতি উঁচুদরের দারোগা, এটা ভুলে যেও না। তুমি হাজত থেকে ইচ্ছে করলেই পালাতে পারে, তাও আমি জানি। সেইজন্য আমি বিশেষ ব্যবস্থা করে রেখেছি। সদর থেকে চারটে বাঘা কুকুর আনা হয়েছে, তারা দিনরাত থানা পাহারা দেবে। ভাল ট্রেনিং পাওয়া দু ডজন স্পেশাল সেপাইও আনা হয়েছে তোমাদের ওপর চব্বিশ ঘণ্টা নজর রাখার জন্য। তাছাড়া আমি তো আছিই। লোকে বলে, আমার নাকি দশ জোড়া চোখ, দশটা হাত আর দশটা মগজ। কাজেই খুব সাবধান!”

এই বলে নবতরণ চলে গেলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

বনমালী কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “কর্তা, ব্যাপারটা খুব সুবিধের ঠেকছে না। কাল অবধি নবতারণ এ-থানায় ছিল না। আজই বদলি হয়ে এসে কাজ হাতে নিয়েছে। ওর মতো ঘুঘু লোক আর নেই।”

মাধব নেতিয়ে বসে ছিলেন। বললেন, “তাহলে কী হবে?”

“এখন তো চুপচাপ থাকুন। দেখা যাক।”

বাইরে এমন সময় গোটা চারেক কুকুরের গম্ভীর গর্জন শোনা গেল। হাঁকডাকেই বোঝা যায়, এরা যেমন-তেমন কুকুর নয়। সেলের সামনে দিয়ে কয়েকজন বিকটাকার লোক ঘোরাফেরা করে গেল। তাদের ছুরির মতো ধারালো চোখ, মুখ খুব গম্ভীর। দেখে-শুনে মাধব আরো ঘাবড়ে গেলেন।