২. মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডার

॥ ২ ॥

ফেলুদা যে কেসটা নেবে সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। আজকাল আমরা মক্কেলের কথাবার্তা হংকং থেকে কেনা একটা মাইক্রোক্যাসেট রেকর্ডারে তুলে রাখি। মিঃ পুরীর বেলাতে ওঁর অনুমতি নিয়ে তাই করেছিলাম। ফেলুদা দুপুরে সেই সব কথাবার্তা প্লে ব্যাক করে খুব মন দিয়ে শুনে বলল, ‘কেসটা নেবার সপক্ষে দুটো যুক্তি রয়েছে; একটা হল এর অভিনবত্ব, আর দুই হল—গোয়েন্দাগিরির প্রথম যুগে দেখা হরিদ্বার-হৃষিকেশটা আরেকবার দেখার লোভ।’

বাদশাহী আংটির ক্লাইম্যাকসটা যে হরিদ্বারেই শুরু হয়েছিল সেটা আমিও কোনোদিন ভুলব না।

পার্ক হোটেলে টেলিফোন করে কেসটা নিচ্ছে বলে ফেলুদা মিঃ পুরীকে জানিয়ে দিয়েছিল। আর মিঃ পুরীও আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে আগাম টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুষ্পক ট্র্যাভলসে ফোন করে ফেলুদা ডুন এক্সপ্রেসে আমাদের বুকিং-এর জন্য জানিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ দুদিন পরে এক অদ্ভুত ব্যাপার। রূপনারায়ণগড় থেকে মিঃ পুরীর এক টেলিগ্রাম এসে হাজির—

‘রিকুয়েস্ট ড্রপ কেস। লেটার ফলোজ।’

ড্রপ কেস! এতো তাজ্জব ব্যাপার! এমন ত আমাদের অভিজ্ঞতায় কখনো হয়নি।

মিঃ পুরীর চিঠিও এসে গেল দুদিন পরে। মোদ্দা কথা হচ্ছে—ছোটকুমার মত পালটেছে। সে হরিদ্বার-হৃষিকেশ গিয়ে ছবি তুলবে, তাতে উপাধ্যায় থাকবেন, কিন্তু তাতে শুধু দেখান হবে তিনি কিভাবে নিজের তৈরি ওষুধ দিয়ে স্থানীয় লোকের চিকিৎসা করেন। রূপনারায়ণগড়ের রাজার চিকিৎসাও যে উপাধ্যায় করেছিলেন সেটা ছবিতে বলা হবে, কিন্তু মহামূল্য পারিতোষিকের কথাটা বলা হবে না।

ফেলুদা টেলিগ্রামে উত্তর দিল—‘ড্রপিং কেস, বাট গোইং অ্যাজ পিলগ্রিমস।’ অর্থাৎ কেস বাতিল করছি, কিন্তু তীর্থযাত্রী হিসেবে যাচ্ছি।

আমি জানি ফেলুদা ও কথা লিখলেও ও নিজের গরজেই চোখ-কান খোলা রাখবে, আর তদন্তের কোনো কারণ দেখলে তদন্ত করবে। সত্যি বলতে কি, ভবানী উপাধ্যায় আর ছোটকুমার পবনদেও সিং—এই দুটি লোককেই আমার খুব ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছিল।

আমরা তিনজন এখন ডূন এক্সপ্রেসের একটা থ্রি টিয়ার কম্পার্টমেন্টে বসে আছি। ফৈজাবাদ স্টেশনে মিনিট দু-এক হল গাড়ি থেমেছে, আমরা ভাঁড়ের চা কিনে খাচ্ছি।

‘আপনি যে বলছিলেন হরিদ্বার গেসলেন, সেটা কবে?’ ফেলুদা তার সামনের সীটে বসা লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার ঠাকুরদা একবার সপরিবারে তীর্থভ্রমণে যান,’ বললেন লালমোহনবাবু, ‘ইনক্লডিং হরিদ্বার। তখন আমার বয়স দেড়; কাজেই নো মেমারি।’

এবার অন্যদিক থেকে একটা প্রশ্ন এল।

‘আপনারা কি শুধু হরিদ্বারই যাচ্ছেন, না ওখান থেকে এদিকে ওদিকেও ঘুরবেন?’

এ-প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবুর পাশে বসা এক বৃদ্ধ। মাথায় সামান্য চুল যা আছে তা সবই পাকা, কিন্তু চামড়া টান, দাঁত সব ওরিজিন্যাল, আর চোখের দুপাশে যে খাঁজগুলো রয়েছে সেগুলো যেন হাসবার জন্য তৈরিই হয়ে আছে।

‘হরিদ্বারে একটু কাজ ছিল,’ বলল ফেলুদা। ‘সেটা হয়ে গেলে পর⋯দেখা যাক্‌—’

‘কী বলছেন মশাই!’ বৃদ্ধের চোখ কপালে উঠে গেছে—‘অ্যাদ্দূর এসে কেদার-বদ্রীটা দেখে যাবেন না? বদ্রীনাথ ত সোজা বাসে করেই যাওয়া যায়। কেদারের শেষের কটা মাইল অবিশ্যি এখনো বাস রুট হয়নি। তবে এও ঠিক যে কেদারের কাছে বদ্রী কিছুই নয়। যদি পারেন ত একবার কেদারটা ঘুরে আসবেন। শেষের হাঁটা পথটুকু আর—’ ফেলুদা আর আমার দিকে তাকিয়ে—‘আপনাদের বয়সে কী! আর—’ লালমোহনবাবুর দিকে তাকিয়ে—‘এনার জন্য ত ডাণ্ডি আর টাট্টুঘোড়াই আছে। টাট্টু ঘোড়ায় চড়েছেন কখনো?’

শেষের প্রশ্নটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকেই করা হল। লালমোহনবাবু হাতের ভাঁড়টায় একটা শেষ চুমুক দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে গম্ভীরভাবে অন্য দিকে চেয়ে বললেন, ‘আজ্ঞে না, তবে থর ডেজার্টে একবার উটের পিঠে চড়ে দৌড়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেটা আপনার হয়েছে কি?’

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।—‘তা হয়নি। আমার চরবার ক্ষেত্র হল হিমালয়ের এই বিশেষ অংশ। তেইশবার এসেছি কেদার-বদ্রী। ভক্তি-টক্তি আমার যে তেমন আছে তা নয়, তবে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য থেকেই আমি সব আধ্যাত্মিক শক্তি আহরণ করি। কোনো বিগ্রহের দরকার হয় না।’

ভদ্রলোকের নাম পরে জেনেছিলাম মাখনলাল মজুমদার। শুধু কেদার বদ্রী নয়, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, গোমুখ, পঞ্চকেদার, বাসুকিতাল—এসবও এঁর দেখা আছে। নেহাৎ একটা সংসার আছে, না হলে হিমালয়েই থেকে যেতেন। অবিশ্যি এটাও বললেন যে আজকের বাস-ট্যাক্সিতে করে যাওয়া আর আগেকার দিনের পায়ে হেঁটে যাওয়া এক জিনিস নয়। বললেন, ‘আজকাল ত আর কেউ পিলগ্রিম নয়, সব পিকনিকারস। তবে হ্যাঁ, গাড়ির রাস্তা তৈরি করে ত আর হিমালয়ের দৃশ্য পালটানো যায় না। নয়নাভিরাম বলতে যা বোঝায়, সেরকম দৃশ্য এখনও অফুরন্ত আছে।’

ভোর ছ’টায় ডুন এক্সপ্রেস পৌঁছাল হরিদ্বার।

সেই বাদশাহী আংটির সময় যেমন দেখেছিলাম পাণ্ডার উপদ্রবটা যেন তার চেয়ে একটু কম বলে মনে হল। স্টেশনেই একটা রেস্টোরান্টে চা বিস্কুট খেয়ে নিলাম। উপাধ্যায়ের নাম এখানে অনেকেই জানে আন্দাজ করেই বোধহয় ফেলুদা রেস্টোরান্টের ম্যানেজারকে তাঁর হদিস জিগ্যেস করল।

উত্তর শুনে বেশ ভালোরকম একটা হোঁচট খেলাম।

ভবানী উপাধ্যায় তিন চার মাস হল হরিদ্বার ছেড়ে রুদ্রপ্রয়াগ চলে গেছেন।

‘তাঁর বিষয় আরো খবর কে দিতে পারে বলতে পারেন?’ জিগ্যেস করল ফেলুদা। উত্তর এল—‘এখনকার খবর পেতে হলে রুদ্রপ্রয়াগ যেতে হবে, আর যদি আগেকার খবর চান ত কান্তিভাই পণ্ডিতের কাছে যান। উনি ছিলেন উপাধ্যায়জীর বাড়িওয়ালা। তিনি সব খবর জানবেন।’

‘তিনিও কি লক্ষ্মণ মহাল্লাতেই থাকেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন ওঁরা। সবাই ওঁকে চেনে ওখানে। জিগ্যেস করলেই বলে দেবে।’

আমরা আর সময় নষ্ট না করে বিল চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কান্তিভাই পণ্ডিতের বয়স ষাট-পঁয়ষট্টি, বেঁটেখাটো চোখাচাখা ফরসা চেহারা, খোঁচা খোঁচা গোঁফ, কপালে চন্দনের ফোঁটা আর চোখে বাইফোক্যাল চশমা। আমরা ভবানী উপাধ্যায়ের খোঁজ করছি জেনে উনি রীতিমতো অবাক হয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলুন ত? আরেকজন ত ওঁর খোঁজ করে গেলেন এই তিন চার দিন আগে।’

‘তাঁর চেহারা মনে আছে আপনার?’

‘তা আছে বৈ কি।’

‘দেখুন ত এই চেহারার সঙ্গে মেলে কিনা।’

ফেলুদা পকেট থেকে ছোটকুমার পবনদেও-এর ছবিটা বার করে দেখান।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই ত সেই লোক,’ বললেন কান্তিভাই পণ্ডিত। ‘আমি রুদ্রপ্রায়াগের ঠিকানা দিয়ে দিলাম তাঁকে।’

‘সে ঠিকানা অবিশ্যি আমারও চাই,’ বলে ফেলুদা তার একটা কার্ড বার করে দিল মিঃ পণ্ডিতের হাতে।

কার্ডটা পাওয়ামাত্র মিঃ পণ্ডিতের হাবভাব একদম বদলে গেল। এতক্ষণ আমরা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, এবার আমাদের সকলকে চেয়ার, মোড়া আর তক্তপোষে ভাগাভাগি করে বসতে দেওয়া হল।

‘কেয়া, কুছ গড়বড় হুয়া মিঃ মিত্তর?’

‘যত দূর জানি, এখনও হয়নি, বলল ফেলুদা। ‘তবে হবার একটা সম্ভাবনা আছে। এবার আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই, মিঃ পণ্ডিত; আপনি সঠিক উত্তর দিতে পারলে খুব উপকার হবে।’

‘আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।’

‘মিঃ উপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহে কি কোনো একটা মূল্যবান জিনিস ছিল?’

মিঃ পণ্ডিত একটু হেসে বললেন, ‘এ প্রশ্নটাও আমাকে দ্বিতীয়বার করা হচ্ছে। আমি মিঃ সিংকে যা বলেছি আপনাকেও তাই বলছি। মিঃ উপাধ্যায়ের একটা থলি উনি আমার সিন্দুকে রাখতে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে যে কী ছিল সেটা আমি কোনোদিন দেখিনি বা জিগ্যেসও করিনি।’

‘সেটা উনি রুদ্রপ্রয়াগ নিয়ে গেছেন?’

‘ইয়েস স্যার। অ্যাণ্ড অ্যানাদার থিং—আপনি ডিটেকটিভ তাই এখবর আমি আপনাকে বলছি, আপনার হয়ত কাজে লাগতে পারে— পাঁচ-ছে মহিনে আগে দুজন লোক—তখনও মিঃ উপাধ্যায় ছিলেন এখানে—একজন সিন্ধী কি মাড়োয়ারি হবে—হি লুক্‌ড এ রিচ ম্যান—অ্যাণ্ড অ্যানাদার ম্যান—দুজন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। অনেক কথা হচ্ছিল সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। এক ঘণ্টার উপর ছিল। তারা যাবার পরে উপাধ্যায় একটা কথা আমাকে বলে—“পণ্ডিতজী, আজ আমি একটি রিপুকে জয় করেছি। মিঃ সিংঘানিয়া আমাকে লোভের মধ্যে ফেলেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি সে লোভ কাটিয়ে উঠেছি।”’

‘আপনি উপাধ্যায়ের এই সম্পত্তির কথা আর কাউকে বলেন নি?’

‘দেখুন মিঃ মিত্তর, ওঁর যে একটা কিছু লুকোবার জিনিস আছে সেটা অনেকেই জানত। আর সেই নিয়ে আড়ালে ঠাট্টাও করত। আমার আবার সন্ধ্যাবেলায় একটু নেশা করার অভ্যাস আছে, হয়ত কখনো কিছু বলে ফেলেছি। কিন্তু উপাধ্যায়জীকে সকলে এখানে এত ভক্তি করত যে সিন্দুকে কী আছে সেই নিয়ে কেউ কোনোদিন মাথা ঘামায় নি।’

‘এই যে রুদ্রপ্রয়াগ গেলেন তিনি, এর পিছনে কোনো কারণ আছে?’

‘আমাকে বলেছিলেন গঙ্গার ঘাটে ওঁর একজন সাধুর সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলে উপাধ্যায়ের মধ্যে একটা মানসিক চেঞ্জ আসে। আমার মনে হয় চেঞ্জটা বেশ সিরিয়াস ছিল। কথা-টথা সব কমিয়ে দিয়েছিলেন। অনেক সময় চুপচাপ বসে ভাবতেন।’

‘ওঁর ওষুধপত্তর কি উনি সঙ্গেই নিয়েছিলেন?’

‘ওষুধ বলতে ত বেশি কিছু ছিল না : কয়েকটা বৈয়াম, কিছু শিকড় বাকল, কিছু মলম, কিছু বড়ি—এই আর কি। এগুলো সবই উনি নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে আমার নিজের ধারণা উনি ক্রমে পুরোপুরি সন্ন্যাসের দিকে চলে যাবেন।’

‘উনি বিয়ে করেননি?’

‘না। সংসারের প্রতি ওঁর কোনো টান ছিল না। যাবার দিন আমাকে বলে গেলেন—“ভোগের রাস্তা, ত্যাগের রাস্তা, দুটোই আমার সামনে ছিল। আমি ত্যাগটাই বেছে নিলাম।”’

‘ভালো কথা, বলল ফেলুদা, ‘আপনি যে বললেন ওঁর রুদ্রপ্রয়াগের ঠিকানা আপনি দিয়ে দিয়েছেন ওই ভদ্রলোকটিকে—আপনি ঠিকানা পেলেন কি করে?’

‘কেন, উপাধ্যায় আমাকে পোস্টকার্ড লিখেছে সেখান থেকে।’

‘সে পোস্টকার্ড আছে?’

‘আছে বৈ কি।’

মিঃ পণ্ডিত তাঁর পিছনের একটা তাকে রাখা বাক্সের ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটা পোস্টকার্ড বার করে ফেলুদাকে দিলেন। হিন্দিতে লেখা আট দশ লাইনের চিঠি। সেটা ফেলুদা বার বার পড়ল কেন, আর পড়ে বিড় বিড় করে দুবার ‘মোস্ট ইন্টারেস্টিং’ বলল কেন, সেটা বলতে পারব না।

মিঃ পণ্ডিত আমাদের একটা ভালো ট্যাক্সির কথা বলে দিলেন। আপাতত রুদ্রপ্রয়াগ, তারপর যেখানেই যাওয়া দরকার সেখানেই যাবে। গাড়োয়ালী ড্রাইভারের নাম যোগীন্দররাম। লোকটিকে দেখে আমাদের ভালো লাগল। আমরা বললাম বারোটা নাগাদ খেয়ে দেয়ে রওনা দেব হৃষিকেশ থেকে। হৃষিকেশ এখান থেকে মাইল পনের। হরিদ্বারে কিছুই দেখবার নেই, গঙ্গার ঘাটটা পর্যন্ত আগেরবার যা দেখেছিলাম তেমন আর নেই। বিশ্রী দেখতে সব নতুন বাড়ি উঠেছে আর তাদের দেয়াল জোড়া বিজ্ঞাপন। হৃষিকেশে যাওয়া দরকার কারণ আমাদের রুদ্রপ্রয়াগে থাকার বন্দোবস্ত করতে হবে। ইচ্ছে করলে ধরমশালায় থাকা যায়; এখানে প্রায় সব শহরেই বহুদিনের পুরোন নাম করা কালীকমলী ধরমশালা রয়েছে, কিন্তু ফেলুদা জানে যে রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার ওসব ধরমশালায় থাকবে না।

আমরা হৃষীকেশে গিয়ে গাড়ওয়াল মণ্ডল বিকাশ নিগমের রেস্ট হাউসে একটা ডবলরুম পেয়ে গেলাম। ওরা বলল যে, তিনজন লোক হলে বাড়তি একটা খাটিয়া পেতে দেবে। বারোটা নাগাদ খেয়ে আমরা রওনা দিয়ে দিলাম রুদ্রপ্রয়াগ। কয়েক মাইল যাবার পর ডাইনে পড়ল লছমনঝুলা। এখানেও দুদিকে বিশ্রী বিশ্রী নতুন বাড়ি আর হোটেল হয়ে জায়গাটার মজাই নষ্ট করে দিয়েছে। তাও বাদশাহী আংটির শেষ পর্বের ঘটনা মনে করে গা-টা বেশ ছম ছম করছিল।

রুদ্রপ্রয়াগ জরুরী দুটো কারণে। এক হল জিম করবেট। দ্য ম্যানইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ যে পড়েছে সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না কী আশ্চর্য ধৈর্য, অধ্যবসায়, আর সাহসের সঙ্গে করবেট মেরেছিল এই মানুষখেকোকে আজ থেকে পঞ্চান্ন বছর আগে। আমাদের ড্রাইভার যোগীন্দর বলল সে ছেলেবেলায় তার বাপ-ঠাকুর্দার কাছে শুনেছে এই বাঘ মারার গল্প। করবেট যেমন ভালোবাসত এই গাড়োয়ালীদের, গাড়োয়ালীরাও ঠিক তেমনই ভক্তি করত করবেটকে।

রুদ্রপ্রয়াগের আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে—এখান থেকে বদ্রী ও কেদার দু জায়গাতেই যাওয়া যায়। দুটো নদী এসে মিশেছে রুদ্রপ্রয়াগে—মন্দাকিনী আর অলকনন্দা। অলকনন্দা ধরে গেলে বদ্রীনাথ আর মন্দাকিনী ধরে গেলে কেদারনাথ। বদ্রীনাথের শেষ পর্যন্ত বাস যায়; কেদারনাথ যেতে বাস থেমে যায় ১৪ কিলোমিটার আগে গৌরীকুণ্ডে। সেখান থেকে হয় হেঁটে, না হয় ডাণ্ডি বা টাট্টু ঘোড়া ভাড়া করে যাওয়া যায়।

হৃষিকেশ থেকে বেরিয়েই বনের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ে পথ আরম্ভ হয়ে গেল। পাশ দিয়ে বয়ে চলছে স্থানীয় লোকেরা বলে থাকে গঙ্গা মাঈ। হৃষিকেশ থেকে রুদ্রপ্রয়াগ ১৪০ কিলোমিটার; পাহাড়ে রাস্তায় ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার করে গেলেও সেই সন্ধ্যার আগে পৌঁছান যাবে না। তাছাড়া পথে তিনটে জায়গা পড়ে—দেবপ্রয়াগ, কীর্তিনগর, আর শ্রীনগর। এই শ্রীনগর কাশ্মীরের রাজধানী নয়, গাড়ওয়াল জেলার রাজধানী।

পাহাড় ভেদ করে বনের মধ্যে দিয়ে কেটে তৈরি করা রাস্তা একবার ঘুরে ঘুরে উঠছে, একবার ঘুরে ঘুরে নামছে। মাঝে মাঝে গাছপালা সরে গিয়ে খোলা সবুজ পাহাড় বেরিয়ে পড়ছে, তারই কোলে ছবির মতো ছোট ছোট গ্রাম দেখা যাচ্ছে।

দৃশ্য সুন্দর ঠিকই, কিন্তু আমার মন কেবলই বলছে ভবানী উপাধ্যায়ের কাছে একটা মহামূল্য লকেট রয়েছে। একজন সন্ন্যাসীর কাছে এমন একটা জিনিস থাকবে, আর তাই নিয়ে কোনো গোলমাল হবে না এটা যেন ভাবাই যায় না। তাছাড়া মিঃ পুরীর একবার ফেলুদাকে কাজের ভার দিয়ে, তারপরই টেলিগ্রাম করে বারণ করাটাও কেমন যেন গণ্ডগোল লাগছে। অবশ্য তিনি চিঠিতে কারণ দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এ জিনিস এর আগে কক্ষনো হয়নি বলেই বোধহয় একটা খট্‌কা মন থেকে যাচ্ছে না।

লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উস্‌খুস্‌ করছিলেন, এবার বললেন, ‘আমি ভূগণ্ডগোল আর ইতিহাঁসফাঁশে চিরকালই কাঁচা ছিলাম ফেলুবাবু—সেটাত আপনি আমার লেখা পড়েও অনেকবার বলেছেন। তাই, মানে, আমরা ভারতবর্ষের এখন ঠিক কোনখানে আছি সেটা একটু বলে দিলে নিশ্চিন্ত বোধ করব।’

ফেলুদা তার বার্থোলোমিউ কোম্পানির বড় ম্যাপটা খুলে বুঝিয়ে দিল। ‘এই যে দেখুন হরিদ্বার। আমরা এখন যাচ্ছি এই দিকে। এই যে রুদ্রপ্রয়াগ। অর্থাৎ পূবে নেপাল, পশ্চিমে কাশ্মীর, আমরা তার মধ্যিখানে, বুঝেছেন?’

‘হ্যাঁঃ। এই বারে ক্লিয়ার।’