২. মরুভূমি
মোটরবাইকের এক ধরনের কর্কশ শব্দ শুনতে শুনতে রিহান জ্ঞান ফিরে পেল। তার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, প্রচণ্ড ঝাঁকুনি এবং মুখের উপর বাতাসের ঝাঁপটা–তাকে নিশ্চয়ই মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে একটা স্ট্যান্ডের সাথে বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রিহান চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না, নিশ্চয়ই কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। মরুভূমির শীতল বাতাসে তার শরীর অবশ হয়ে আসতে চায়, তার ভেতরে যন্ত্রণায় শরীরের ভেতরে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মনে হচ্ছে মাথাটা ছিঁড়ে পড়ে যাবে। হাত দুটো পেছনে শক্ত করে বাঁধা, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত দুটোতে কোনো অনুভূতি নেই বলে মনে হচ্ছে। রিহান কান পেতে শুনল–আশপাশে একাধিক মোটরবাইকের শব্দ। একসাথে বেশ কয়েকজন তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কোথায় কে জানে। রিহান হাত দুটো নাড়িয়ে বাধনটা একটু ঢিলে করার চেষ্টা করল, কোনো লাভ হলো না কিন্তু হঠাৎ করে রক্ত সঞ্চালনের একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল।
রিহানের সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আবার সে চেতনা হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু তার ভিতরেও অনেক কষ্টে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখল। তাকে কারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে জানে না, কিন্তু অনুমান করতে পারে–নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করার জন্যে নিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবে হাতের বাধন খুলতে পারলে তবুও সে বাচার একটা শেষ চেষ্টা করতে পারে। রিহান আবার চেষ্টা করে দেখল, বাঁধনটা খুলতে পারল না কিন্তু মনে হয় একটু ঢিলে হল। রিহান নিশ্বাস বন্ধ করে চেষ্টা করতে থাকে, বাঁধনটা না খুলেও সে যদি কোনোভাবে একটা হাত বের করে আনতে পারে তা হলেও সে একবার বাঁচার চেষ্টা করে দেখতে পারে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করে সে বাম হাতটাকে টেনে বের করে আনার চেষ্টা করে, হাত কেটে রক্তাক্ত হয়ে যায় তবু সে হাল ছাড়ে না, একসময় মনে হতে থাকে সে বুঝি কখনোই পারবে না তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে লেগে রইল। যখন মনে হল আর কিছুতেই পারবে না তখন হঠাৎ করে বাম হাতটা খুলে এল। সাথে সাথে হাতের তীব্র যন্ত্রণাটা ম্যাজিকের মতো কমে যায়, অন্ধকারে হাত ঘষে ঘষে রিহান হাতের মাঝে রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে।
রিহান শুনতে পেল যারা মোটরবাইক চালাচ্ছে তারা নিজেদের মাঝে কথা বলছে মোটরবাইকের প্রচণ্ড শব্দে কথা স্পষ্ট বোঝা গেল না, রিহানের মনে হল তারা কোথাও থামার কথা বলছে। দেখা গেল সত্যিই তাই, তার মোটরবাইকটা খানিকটা ঘুরে বেশ হঠাৎ করেই থেমে গেল। রিহান বাঁধা অবস্থায় অচেতন হয়ে থাকার ভান করে, বুঝতে পারে তার দুই পাশে আরো দুটি মোটরবাইক থেমেছে এবং সেখান থেকে মানুষগুলো নেমে এসেছে। একজন বলল, জ্ঞান হয়েছে নাকি?
রিহান গলার স্বরটি চিনতে পারল না, সে দুই হাত একসাথে করে অচেতন হওয়ার ভান করে রইল। ভালো করে লক্ষ না করলে কেউ সহজে বুঝতে পারবে না তার হাতগুলো খোলা। রিহান অনুভব করল একজন মানুষ সাবধানে তাকে স্পর্শ করে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, না, এখনো অজ্ঞান হয়ে আছে।
জ্ঞান আর ফিরবে না। জানতেই পারবে না কী হয়েছে– কথাটা খুব ভালো একটা রসিকতা এরকম ভঙ্গি করে মানুষটা উচ্চ স্বরে হেসে উঠল, কিন্তু অন্য কেউ তার হাসিতে যোগ দিল না।
ছেলেটাকে খুলে এই খাদের কাছে নিয়ে এস–গুলি করে নিচে ফেলে দেব।
ঠিক আছে।
রিহান অনুভব করল দুজনে মিলে তার শরীরের বাধন খুলে ফেলছে, উত্তেজনায় তার বুক ধকধক করতে থাকে, যদি দেখে ফেলে সে হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে তা হলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে, কিন্তু মানুষগুলো সেটা বুঝতে পারল না। কালো কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা তাই সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, হয়তো এখানে অন্ধকার। রিহান টের পেল তাকে ধরাধরি করে মানুষগুলো খাদের কাছে নিয়ে এসেছে, সে তার শরীর শক্ত করে রাখে, ঠিক বুঝতে পারছে না কী করবে। হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠে ছুটে পালানোর চেষ্টা করবে? নাকি কাউকে জাপটে ধরে তার অস্ত্রটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করবে?
রিহান শুনল একজন বলল, কে গুলি করবে?
ভারী গলায় একজন বলল, আমি করবো না। আমার খুনোখুনি ভালো লাগে না।
অন্য একজন বলল, খুনোখুনি করতে কি আমাদের ভালো লাগে নাকি? করতে হয় বলে করি। মনে আছে সেবার কী হল তানিয়াকে নিয়ে?
রিহানের বুক ধকধক করতে থাকে, তানিয়া নামের একটি মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। তাকেও মেরে ফেলেছিল এরা? ঈশ্বর ক্লডের আদেশে? কী করেছিল তানিয়া?
আমি বলি কী—
কী?
লটারি করে বের করি কে গুলি করবে।
এই কাজের জন্যে লটারি করতে হবে। এই দ্যাখো আমি গুলি করি–
রিহান লাফিয়ে উঠে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে শুনতে পেল, আহা–এত তাড়া কীসের? করা যাক লটারি, মজা হবে খানিকটা। শেষ রাতে একটু মজা হোক না।
কীভাবে লটারি করবে?
এই যে পাথরটা কোন হাতে আছে বলতে হবে। যে হারবে সে গুলি করবে। কী বলো?
ঠিক আছে।
রিহান শুনতে পায় মানুষগুলো কথা বলতে বলতে একটু দূরে সরে গিয়ে লটারি করতে থাকে। এটাই তার সুযোগ—-শেষ সুযোগ। রিহান নিঃশব্দে হাত দিয়ে চোখের বাধা কাপড়টা খুলে তাকাল। এতক্ষণ চোখ বাঁধা ছিল বলেই কিনা কে জানে আবছা অন্ধকারে সে বেশ স্পষ্ট দেখতে পেল তিনটা মোটরবাইক পাশাপাশি দাঁড় করানো। দুটোর ইঞ্জিন বন্ধ করানো, তৃতীয়টি ধুকধুক করে চলছে। তার হেডলাইট জ্বালিয়ে খানিকটা আলোর ব্যবস্থা করা আছে। রিহান মনে মনে হিসেব করে সে যদি হঠাৎ করে মোটরবাইকটার ওপরে উঠে বসতে পারে তা হলে পালানোর একটা সুযোগ আছে। মানুষগুলো ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতে একটু সময় লাগবে তার মাঝে সে অনেকদূর সরে যেতে পারবে। তখন সবাই মিলে তাকে গুলি করার চেষ্টা করবে, পিছু পিছু ধাওয়া করবে কিন্তু মনে হয় তার মাঝেও তার পালিয়ে যাবার একটা ভালো সম্ভাবনা আছে।
রিহান বুক ভরে একটা নিশ্বাস নেয়, হঠাৎ করে সে তার সারা শরীরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। চোখের কোনা দিয়ে সে মানুষ তিনজনকে দেখে তারপর সাবধানে উঠে গুঁড়ি মেরে মোটরবাইকটার দিকে এগুতে থাকে। আবছা অন্ধকার থাকায় মানুষগুলো প্রথম দুএক সেকেন্ড তাকে দেখতে পায় নি, হঠাৎ করে একজন তাকে দেখে চিৎকার করে উঠল। রিহান তখন লাফিয়ে উঠে ছুটে মোটরবাইকটার উপর বসে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে সোজা মানুষগুলোর দিকে ছুটে যায়। মানুষগুলো নিজেদের বাঁচানোর জন্যে লাফিয়ে সরে গেল এবং রিহান পোড়া টায়ারের গন্ধ ছুটিয়ে তাদের ভেতর দিয়ে গুলির মতো বের হয়ে গেল। মরুভূমির বিস্তৃত পাথুরে সমতলের উপর দিয়ে সে ছুটে যেতে থাকে, মরুভূমির শীতল বাতাসে তার চুল উড়তে থাকে, বাতাস চোখে–মুখে কেটে কেটে বসতে শুরু করে।
কয়েক সেকেন্ডের ভিতরেই সে গুলির শব্দ শুনতে পেল। তার কানের কাছ দিয়ে শিসের মতো শব্দ করে বুলেট ছুটে যেতেই সে তার মোটরবাইকের হেডলাইট বন্ধ করে দিল। অন্ধকার অপরিচিত মরুপ্রান্তর, যে কোনো মুহূর্তে একটা বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে সে ছিটকে পড়তে পারে কিন্তু রিহান এই মুহূর্তে সেটি তার মাথা থেকে জোর করে সরিয়ে রাখল। রিহান মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল অন্য দুটি মোটরবাইক তাকে ধরার জন্যে ছুটে আসছে, ধরে না ফেললেও গুলির আওতায় পেয়ে যাবে কিছুক্ষণের মাঝে, তখন কী
মোটরবাইকটিকে এলোমেলোভাবে ছুটিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ করে রিহান হতবুদ্ধি হয়ে যায়, বিশাল একটা খাদের দিকে সে ছুটে যাচ্ছে। কী করছে চিন্তা না করেই সে চলন্ত মোটরবাইক থেকে লাফিয়ে পড়ল, প্রায় সাথে সাথে মোটরবাইকটা প্রায় উড়ে গিয়ে খাদের মাঝে পড়ে এবং কয়েক সেকেন্ড পরে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে সাথে আগুনের হলকা উপরে উঠে আসে।
রিহান প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দাতে দাঁত চেপে কোনোভাবে নিজেকে অচেতন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করল। কোনোভাবেই এখন তাকে অজ্ঞান হয়ে গেলে চলবে না। মানুষগুলো কয়েক মিনিটের মাঝে এখানে চলে আসবে, তার মাঝে তাকে এখান থেকে সরে যেতে হবে। যেভাবে হোক।
রিহান মাটিতে ঘষে ঘষে প্রায় সরীসৃপের মতো নিজেকে সরিয়ে নিতে থাকে। বড় বড় কিছু পাথর আছে কয়েক মিটার দূরে, তার পিছনে চলে যেতে পারলে সে নিজেকে লুকিয়ে নিতে পারবে। শরীরের কোনো হাড় ভেঙেছে কি না সে জানে না, কপালের এক পাশ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ে বাম চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে একটা কালো পরদা নেমে আসতে চাইছে বারবার, অনেক কষ্টে রিহান নিজেকে জাগিয়ে রেখে নিজেকে টেনে নিতে থাকে। অমানুষিক একটা পরিশ্রম করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে সে বড় বড় নিশ্বাস নিতে লাগল।
কিছুক্ষণের মাঝেই খুব কাছাকাছি দুটো মোটরবাইক এসে থামল। মানুষগুলো অস্ত্র হাতে নেমে আসে। খাদের পাশে দাঁড়িয়ে তারা বিধ্বস্ত জ্বলন্ত মোটরবাইকটা দেখার চেষ্টা করতে থাকে। একজন মাথা উচিয়ে জিজ্ঞেস করল, দেখা যাচ্ছে?
অন্যজন উত্তর করল, কী দেখতে চাও?
ছেলেটাকে।
কত গভীর খাদ দেখেছ? এখান থেকে দেখবে কেমন করে?
প্রথম মানুষটা চিন্তিত মুখে বলল, তা হলে ঈশ্বর ক্লডকে কী বলব?
যেটা সত্যি সেটাই বলব।।
সেটা কী? ছেলেটা বেঁচে আছে না মরে গেছে?
এখান থেকে পড়লে কেউ বেঁচে থাকতে পারে?
কিন্তু—
কিন্তু কী?
আমরা তো কখনোই নিশ্চিত হতে পারব না।
আমরা না পারলেও ঈশ্বর ক্লড নিশ্চিত হবেন। ঈশ্বর ক্লড সব জানেন।
তা ঠিক।
মোটা গলার মানুষটা হেঁটে খাদের খুব কাছাকাছি গিয়ে বলল, যদি ছেলেটা বেঁচেও থাকে, এই মরুভূমিতে একা একা চব্বিশ ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকতে পারবে না।
তা ঠিক।
তোমার লটারির বুদ্ধি না শুনে তখনই যদি কানের নিচে একটা গুলি করে দিতাম তা হলে একটা মোটরবাইক নষ্ট হত না।
ছেলেটার কত বড় সাহস দেখেছ? প্রভু ক্লড মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন তার পরেও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। লাভ হল কিছু?
একটা মোটরবাইক নষ্ট হল।
চল যাই।
খাদে নেমে কি দেখতে চাও?
দেখতে চাইলে দিনের বেলায় আসতে হবে। এখন অন্ধকারে নামা যাবে না।
তা ঠিক।
মানুষগুলো নিচু গলায় কথা বলতে বলতে ফিরে যেতে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিহান মোটরবাইক দুটোর ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল। ফাঁকা মরুভূমিতে দীর্ঘ সময় সে সেই শব্দ শুনতে পায়, বহুদূর থেকে সেই শব্দ তার কাছে ভেসে আসছে।
মানুষগুলো চলে যাবার পর রিহান নিজেকে পরীক্ষা করে দেখল, শরীরের কোনো হাড় ভাঙে নি, কিছু জায়গা থেতলে গেছে, চটচটে রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। খানিকক্ষণ উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে রিহান বড় বড় নিশ্বাস নিল, তারপর উঠে বসল। এই এলাকা থেকে তাকে সরে যেতে হবে–যতদূর সম্ভব।
নক্ষত্রের আলোতে রিহান উত্তর দিকে হেঁটে যেতে শুরু করে, একটু পরপর তার মাথায় একটা অশুভ চিন্তা এসে ভর করতে থাকে, এই নির্জন নির্বান্ধব মরুভূমিতে সে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে? রিহান জোর করে চিন্তাটা তার মাথা থেকে সরিয়ে রাখে।
সূর্যের আলো প্রখর না হওয়া পর্যন্ত সে হেঁটে গেল। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় তার ভেতরটুকু পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে, একটু পরপর ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ভেঙে পড়তে চাইছে কিন্তু তবুও সে থামল না। যখন আর হাঁটতে পারছিল না তখন থেমে সে একটা বড় পাথরের উপরে উঠে চারদিকে দেখার চেষ্টা করে। দূরে কোথাও কোনো পরিত্যক্ত আবাসভূমি, গুদামঘর, ধসে যাওয়া ফ্যাক্টরি, বা অন্য কিছু আছে কি না খুঁজে দেখে। সূর্যের প্রখর আলোতে চারদিক ধিকিধিকি করে জ্বলছে। বহুদূরে পশ্চিমে কিছু ধসে যাওয়া বাড়িঘর আছে বলে মনে হল। সেগুলো পাথরের স্তূপও হতে পারে। এত দূর থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। রিহান চারদিকে তাকিয়ে গাছপালা খোজার চেষ্টা করে কিন্তু কোথাও সবুজের কোনো চিহ্ন নেই। রিহান একটা বড় নিশ্বাস ফেলে পাথর থেকে নেমে আসে, কোনো একটা বড় পাথরের ছায়ায় সে এখন বিশ্রাম নেবে, সূর্য ঢলে গিয়ে অন্ধকার হওয়ার পর সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাবে।
প্রচণ্ড তৃষ্ণা এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে সে পাথরের ছায়ায় ঘুমানোর চেষ্টা করল। তার চোখে ঘুম এল না কিন্তু ভয়ংকর ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়েছিল বলে ছাড়া ছাড়া ভাবে মাঝে মাঝে ঘুমের মতো এক ধরনের অচেতনার অন্ধকারে ঢলে পড়ছিল, আবার ঘুম ভেঙে চমকে চমকে সে জেগে উঠছিল। ধীরে ধীরে সূর্যের আলো তীব্র হয়ে ওঠে, তার মাঝে রিহান একটা বড় পাথরের নিচে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে। শরীরের নানা অংশ প্রচণ্ড ব্যথায় অসাড় হয়ে আছে, রিহান তার মাঝে সূর্য ঢলে পড়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। সূর্য ঢলে পড়ে তাপমাত্রাটা মোটামুটি সহনীয় হয়ে যাবার পর রিহান উঠে বসে তারপর নিজেকে টেনে টেনে এগিয়ে নিতে থাকে।
রিহান ভালো করে চিন্তা করতে পারে না, তার মনে হতে থাকে হয়তো তার প্রভু ক্লডের কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া উচিত তা হলে হয়তো মৃত্যুর আগে এক আঁজলা পানি খেতে পারবে। টলটলে ঠাণ্ডা পানি। চুমুক দিয়ে খাবার আগে সে হয়তো খানিকটা পানি নিজের মুখে ছিটিয়ে দিয়ে শীতল করে নেবে নিজের শরীরকে।
রিহান নিশ্বাস ফেলে চিন্তাটাকে মন থেকে দূর করে দেয়, তারপর ক্লান্ত দেহকে টেনে টেনে পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পরপর তাকে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে, সে আর নিজেকে টেনে নিতে পারছে না। শরীরের সমস্ত চামড়া শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ক্ষতে মুখের ভেতরে এক ধরনের নোনা স্বাদ ছিল এখন সেখানে কোনো অনুভূতি নেই, জিবটা মনে হয় একটা শুকনো কাঠ। বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে তার মাঝে ধুকে ধুকে সে নিজেকে টেনে নিতে থাকে। পশ্চিমে যে এলাকাটাকে সে ধসে যাওয়া প্রাচীন বাড়িঘর মনে করছে সেটা কতদূর সে জানে না, সেটা সত্যিই প্রাচীন বাড়িঘর কি না কিংবা সত্যি সত্যি সেখানে সে পৌঁছতে পারবে কি না সেটাও সে জানে না, তারপরেও সে এগুতে থাকে। নিজেকে টেনে নিতে নিতে মাঝে মাঝে সে দাঁড়িয়ে যায়, রাতের নানা বিচিত্র শব্দ শোনা যায় তখন, নিশ্বাস বন্ধ করে সে পরিচিত শব্দ শোনার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু শুনতে পায় না। গতীর রাতে বহুদূর থেকে সে একটা ইঞ্জিনের চাপা গর্জন শুনতে পেল। কিসের ইঞ্জিন? কোনো লোকালয়ের? কোথায় আছে তারা।
ভোর রাতের দিকে রিহান থামল। সে পশ্চিম দিকে হেঁটে যাবার চেষ্টা করছে কিন্তু অন্ধকারে কোন দিকে হেঁটেছে সে জানে না, একটা গোলকধাঁধার মতো কি সারাক্ষণ ঘুরপাক। খেয়েছে? কী হবে এখন? হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল জীবনের সাথে যুদ্ধে সে হেরে গেছে। এই ভয়ংকর নির্জন মরুভূমিতে সে বেঁচে থাকতে পারবে না, প্রভু ক্লডের মৃত্যুদণ্ডাদেশ থেকে আসলে তার মুক্তি নেই। রুক্ষ বিবর্ণ পাথরে তার মৃতদেহ পড়ে থাকবে, শুকনো বালুতে সেটি বিবর্ণ ধূসর হয়ে একসময় মাটিতে মিশে যাবে। রিহান ভালো করে চিন্তা করতে পারছিল না, মাথার ভেতরে দপদপ করছে, সে কেমন যেন একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে। চারপাশে কী হচ্ছে সেটাও সে দেখতে পারছে না, হঠাৎ করে মনে হচ্ছে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।
ভোরের আলো ফোঁটার আগেই রিহান একটা বড় পাথরের পাশে অচেতন হয়ে পড়ল। ভোরের প্রথম আলোতে একটা সরীসৃপ সাবধানে তাকে পরীক্ষা করে সরে যায়। একটা বিষাক্ত বিছে তার খুব কাছে দিয়ে ছুটে গেল। কিছু গুবরে পোকা গর্তের ভেতর থেকে বের হয়ে ইতস্তত ছোটাছুটি করতে থাকে। একটা ছোট মাকড়সা একটা পাথরের আড়ালে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে চারদিক পরীক্ষা করতে শুরু করে।
রিহান ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল সে একটা সবুজ বাগানে ঝরনার কাছে বসে আছে। চারপাশে কচি সবুজ পাতা নড়ছে, পাখি ডাকছে কিচিরমিচির করে। রিহান ঝরনার কাছে এগিয়ে যায়, ঝরনার পানিতে পা ডুবিয়ে সে এক আঁজলা পানি নিয়ে মুখে দেওয়ার চেষ্টা করতেই ঝরঝর করে পানিটুকু তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল। আবার চেষ্টা করল সে, আবার পানিটুকু পড়ে গেল। পাগলের মতো আবার চেষ্টা করল, কিন্তু লাভ হল না, কিছুতেই সে মুখে পানি দিতে পারছে না। কে যেন হা–হা করে হেসে উঠেছে, মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সামনে প্রভু ক্লড দাঁড়িয়ে আছেন। কঠোর মুখে বললেন, না, রিহান তুমি পানি খেতে পারবে না। আমি তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি। তোমার কোনো মুক্তি নেই।
রিহান কাতর গলায় বলল, আমাকে ক্ষমা করুন প্রভু। ক্ষমা করুন।
প্রভু ক্লড হা–হা করে হেসে উঠে বললেন, ক্ষমা করব? তোমাকে? কক্ষনো না। তারপর হাত তুলে বললেন, নিয়ে যাও ওকে আমার সামনে থেকে।
দুজন মানুষ তখন তাকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। তাকে নেবার জন্যে অনেকগুলো মানুষ মোটরবাইকে করে আসতে থাকে। আস্তে আস্তে মোটরবাইকের গর্জন বাড়তে থাকে, ভোঁতা কর্কশ গর্জন। একসময় প্রচণ্ড গর্জনে তার কানে তালা লেগে যায়–চোখ খুলে তাকাল রিহান। সে এখনো বেঁচে আছে? একটা ভোঁতা কর্কশ গর্জন শুনতে পেল সে। মোটরবাইকের গর্জন? প্রভু ক্লডের অনুচরেরা তাকে ধরতে আসছে? এটি কি স্বপ্ন না। সত্যি?
রিহান চিন্তা করতে পারে না, কোনো কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায় না। সে আবার চোখ বন্ধ করল, চোখ বন্ধ করেও সে মোটরবাইকের গর্জন শুনতে পেল–মাটিতে সে কম্পন অনুভব করল। হঠাৎ করে গর্জন থেমে যায়, তখন মানুষের পায়ের শব্দ আর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় রিহান। মনে হয় অনেক দূর থেকে কারো গলার স্বর ভেসে আসছে। কেউ একজন বলছে, দেখো। একটা মানুষ মরে পড়ে আছে।
রিহানের মনে হল অনেক মানুষ তাকে ঘিরে ভিড় করছে। কে একজন তাকে স্পর্শ করল, তারপর বলল, না, না এখনো মরে নি।
কী আশ্চর্য! বেঁচে আছে? বেঁচে আছে এখনো?
রিহান অনেক কষ্ট করে চোখ খুলে তাকাল, ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কিছু অশরীরী প্রাণী তাকে ঘিরে রেখেছে। রিহান কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বলতে পারল না, শুকনো অসাড় জিবটাকে সে নাড়াতে পারল না, শুধু ঠোঁট দুটো নড়ল একবার। অচেতনার অন্ধকারে ডুবে যাবার আগে সে আরো একবার বলার চেষ্টা করল, পানি। কিন্তু সে বলতে পারল না।
শুনতে পেল ভারী গলায় একজন বলল, পানির বোতলটা দাও দেখি। এর মুখে একটু পানি দিতে হবে।
কথাটি সত্যি না স্বপ্ন রিহান বুঝতে পারল না। কিছুতেই এখন আর কিছু আসে যায়।
কিছু আসে যায় না।