২. ময়নাগড় বাজারের লোকজন

ময়নাগড় বাজারের লোকজন ভারী অবাক হয়ে দেখল সকাল সোয়া সাতটায় উদ্ধববাবু হাঁফাতে-হাঁফাতে এসে বাজারে ঢুকছেন। কয়েকজন হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল। স্কুলের ইংরেজির মাস্টারমশাই তাড়াতাড়ি কবজির ঘড়িটা কানে তুলে দেখলেন, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে কিনা। জগদীশ হালুইকর তার জামাই গোপালকে ডেকে বলল, উদ্ধববাবুটা বোধহয় পাগলই হয়ে গেল রে! গায়ের বিখ্যাত দৌড়বীর পটল বলল, ওঃ, এই বয়সেও যা দৌড়টা দিলেন জেঠু, যৌবনে নিশ্চয়ই অলিম্পিকে গেলে মেডেল আনতেন। উদ্ধববাবু রাজু দাসের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে হ্যাঁ-হ্যাঁ করে হাঁফাতে লাগলেন, কথা কওয়ার মতো অবস্থা নেই। শুধু তার মধ্যেই বারকয়েক হিজিবিজি… হিজিবিজি…ভূ..ভূত.. বলে হাল ছেড়ে দিলেন। রাজু তাড়াতাড়ি টিউবঅয়েল থেকে জল এনে এই শীতে তাঁর মাথায় থাবড়াতে লাগল।

নয়নপুরের জমিদার সিদ্ধেশ্বরবাবু বললেন, উদ্ধব কিছু একটা বলবার চেষ্টা করছে মনে হয়। কী বলছে বলে তো?

রাজু বলল, উনি বলতে চাইছেন যে, উনি ভূত দেখেছেন। হিজিবিজি ভূত।

সিদ্ধেশ্বর চিন্তিত গলায় বললেন, আহা, সকালবেলাটায় ভূত কোথা থেকে আসবে। এ-সময়ে তাদেরও বিষয়কৰ্ম, প্রাতঃকৃত্যাদি থাকে।

নরহরি ঘোষ মাথা নেড়ে বলে, না মশাই, সায়েন্সে পরিষ্কার বলা আছে, ভূতেরা প্রাতঃকৃত্য, আচমন, স্নান, ভোজন এসব করে না। তবে সায়েন্সে বলা আছে, রোদ হচ্ছে ভূতের সবচেয়ে বড় শত্রু। গায়ে রোদ পড়লেই ভূত গায়েব। কাজেই বিজ্ঞানের নিয়মানুসারে উদ্ধববাবুর পক্ষে সকালবেলায় ভূত দেখা সম্ভব নয়।

সিদ্ধেশ্বর বললেন, আহা, ও তো নিজেই বলছে ভূত নয়, হিজিবিজি দেখেছে।

হিজিবিজি নয় সিদ্ধেশ্বরবাবু, উদ্ধববাবু বলতে চাইছেন, ইজি, বি ইজি। অর্থাৎ সব ঠিক আছে, তোমরা স্বাভাবিক হও।

পশুপতিবাবু মাথা নেড়ে বললেন, হল না হে, হল না। ইজি, বি ইজি মানে হল গিয়ে..দাঁড়াও বলছি, পেটে আসছে মুখে আসছে না..সে যাক গে, তবে রোদ উঠলে ভূত উবে যায় ও কথাটাও ঠিক নয়। শীতকালে জমাট নারকেল তেল। যেমন রোদে রাখলে গলে যায়, তেমনই রোদে ভূতও গলতে থাকে!

নরহরি ঘোষ খিঁচিয়ে উঠে বলল, বলি এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলা জানো?

পশুপতিবাবু জানেন না, তাই তিনি শুকনো মুখে পিছিয়ে দাঁড়ালেন।

নরহরি বুক চিতিয়ে বলল, তা হলে ফটফট করতে আসো কেন?

ব্যায়ামবীর গদাধর মাসল দেখানোর জন্য শীতেও হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, উদ্বববাবু যে ভূত দেখেছেন তাতে সন্দেহ নেই। তেঁতুলতলার বেঁটে ভূতের কথা সবাই জানে। আর নরহরিবাবুকে বলি, রোদ লাগলে ভূত গায়েব, একথা যদি কেউ বলে থাকে, তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন

তো, দুই রদ্দায় তার ঘাড় ভেঙে দেব। রোদে যদি ভূত গায়েব হয়ে যায়, তা হলে শাস্ত্রে কি মিথ্যে কথা বলেছে যে, ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা!

একথায় বেশ জনসমর্থন পাওয়া গেল। নরহরি ঘোষ আর উচ্চবাচ্য করলেন না। কারণ, তিনি ব্যায়ামবীর গদাধরকে একটু সমঝে চলেন।

নিধুবাবু বলে উঠলেন, ও হো, তেঁতুলতলার বেঁটে ভূতের কথা বলছ তো! ও তো বকেশ্বর। তা বাপু, সত্যি কথা বললে বলতে হয়, বকেশ্বর ভারী নিরীহ, ভিতু আর লাজুক ভূত। জনসমক্ষে কখনও বেরোয় না। কেউ দেখে ফেললে লজ্জা পেয়ে, জিভ কেটে সরি বলে সরে যায়।

এক কেজি করলা কিনে গামছায় বেঁধে রামশরণ এসে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সব কথা শুনছিল। সে বলল, হাঁ হাঁ, উ বাত ঠিক আছে। বকাসুর পিরেতকে আমি ভি চিনি। উ তো উমদা ভূত আছে। আমি তো উসকো খইনি ভি খিলায়েছি।

এমন সময় চারদিকে একটা হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। দারোগা নীলমাধব রায় রোঁদে এসেছে। তাকে অবশ্য নিজের হাতে বাজার করতে হয় না। ব্যাপারিরাই তার বাড়িতে মাছ, মাংস, সবজি, দুধ, ঘি, ডিম সব পৌঁছে দিয়ে আসে। তবে কর্তব্যবশে সে বাজারে এসে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে যায়।

উদ্ধববাবুর খবর শুনে নীলমাধব দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এল। তার বিশাল চেহারা। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া। তবে চেহারাটা বড় থলথলে। বাজখাই গলায় সে হাঁক দিল, এখানে সোরগোল কিসের? কী হয়েছে? নীলমাধবের সঙ্গে দশ-বারোজন সেপাই। তারা লাঠি আনসাতে-আনসাতে ভিড় হঠিয়ে দিতে লাগল, হঠো, হঠো, বড়বাবুর আসবার সাস্তা করো।

নীলমাধব সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, কী হয়েছে উদ্ধববাবু?

উদ্ধববাবুর হাঁফটা একটু কমেছে। কাহিল মুখে বললেন, ওফ, খুব জোর প্রাণে বেঁচে গেছি বড়বাবু।

নীলমাধব হাঁক মেরে বলল, ওরে ষষ্ঠীচরণ, নোটবই বের কর, জবানবন্দি নে। হ্যাঁ, এবার বেশ গুছিয়ে বলুন তো, ঠিক কী ঘটেছে।

উদ্ধববাবু বেশ গুছিয়েই বললেন। ভূত হলেও হিজিবিজি যে অন্যান্য ভূতের মতো এলেবেলে ভূত নয়, সেটাও বুঝিয়ে ছাড়লেন।

নীলমাধব ভ্রূ কুঁচকে সব শুনল।

তারপর বলল, দেখুন, দিনের বেলায় আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। তবে রাতের বেলায় অন্য কথা। যাই হোক, এখন আমি আপনার গল্পে বিশ্বাস করছি না। আমার মনে হচ্ছে। আপনি একজন ডেনজারাস ক্রিমিনালের পাল্লায় পড়েছিলেন। সে মোটেই অদৃশ্য হয়ে যায়নি, গা ঢাকা দিয়েছে। হিজিবিজি তার আসল নাম হতে পারে না, ছদ্মনাম। এই ঘটনা থেকে মনে হচ্ছে, ময়নাগড় আর আগের মতো শান্তশিষ্ট জায়গাটি নেই। বিপদের কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে।

নীলমাধব তার সেপাইদের অকুস্থল মার্চ করার হুকুম দিল। তারপর বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে জলদগম্ভীর গলায় বলল, ভাইসব, বন্ধুগণ, প্রিয় দেশবাসী, মা, বোন, ভাইয়েরা, বয়োবৃদ্ধ, বয়োবৃদ্ধা, নাবালক, নাবালিকা, যুবক ও যুবতীবৃন্দ, কমরেডগণ, আমার সহযোদ্ধা এবং সহমর্মীগণ, সংগ্রামী শ্রমিক, কৃষক, মজদুর, আপামর নগর ও ভারতবাসী, প্রবাসী ও অনাবাসী, সবাইকেই জানাই আমার বিপ্লবী ও সংগ্রামী অভিনন্দন। আপনারা হয়তো জানেন না। ময়নাগড়ের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ, এই স্বপ্নিল ছবির মতো গ্রামে, যেখানে বারো মাসে তেরো পার্বণ, যেখানে গান গেয়ে বাউল নেচে বেড়ায়, যেখানে গান গেয়ে ধান কাটে চাষা, যেখানে পায়ের নীচে দূর্বা কোমল, মাথার উপর নীল আকাশ, যেখানে গাছে-গাছে থরে বিথরে ফুল ফল ধরে আছে, যেখানে গাঙের জলে ঝিলিমিলি ঢেউ খেলে যায়, মাঝির গলায় শোনা যায় ভাটিয়ালি গান, যেখানে খেতভরা ফসল, মরাই ভরা ধান, গোয়ালভরা গোরু, যেখানে মানুষের মুখে হাসি আর ধরে না, সেই ময়নাগড়ে বিপদের সংকেত এসে পৌঁছেছে। আপনারা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ুন, চারদিকে নজর রাখুন, সন্দেহভাজন কাউকে দেখতে পেলেই থানায় খবর দিন। এর জন্য আপনাদের হয়তো পুরস্কারও দেওয়া হবে।

নন্দগোপাল পশুপতিকে ঠেলা দিয়ে বললেন, এ কোন জায়গার কথা বলছে বলো তো!

ঠিক আঁচ করতে পারছি না। বিলেতেও বোধ হয় ময়নাগড় বলে কোনও জায়গা আছে।

না, বিলেত নয়। তবে সুইজারল্যান্ডে হলেও হতে পারে।

নীলমাধবের ভাষণ শেষ হওয়ার পর ফের বাজারের বিকিকিনি শুরু হল।

পাঁচুর মনটা ভালো নেই। এইসব গণ্ডগ্রাম থেকে অনেক দূরে হেলাবটতলার পাথরের উপর চুপচাপ বসে ভাবছিল সে। আজ হঠাৎ সে বুঝতে পারছে, পাঁচু হয়ে জন্মানোটাই তার ভুল হয়েছে। তাকে কেউ পোছে না, পাত্তা দেয় না, খাতির করে না, বসে তার সঙ্গে কেউ দুটো কথা অবধি কয় না। এমনকী তার নিজের বাড়িতেও তাকে কেউ যেন দেখেও দেখতে পায় না। বরাবর তাকে লোকে বোকা, গাধা ইত্যাদি বলে এসেছে। স্কুলের মাস্টারমশাই একবাক্যে বলতেন, তোর কিছু হবে না।

মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে না পারলে বেঁচে থেকে লাভ কী? কিন্তু এই মানুষের মতো মানুষ হওয়ার কথাতেই সে মুশকিলে পড়ে যায়। দুনিয়ায় তো হরেক কিসিমের মানুষ। কোন মানুষটার মতো মানুষ হলে ভালো হয় সেটাও তো বোঝা দরকার। তাই আজ বসে গম্ভীর হয়ে খুব ভাবছে পাঁচু।

কে একটা লোক এসে তার পাশটিতে বসে বলল, এ জায়গাটাই তো ময়নাগড়, নাকি হে?

পাঁচু আড়চোখে লক্ষ করল, লোকটা বেজায় ঢ্যাঙা, খুব ফরসা, গায়ে ঢোলা পোশাক আর পোঁটলাপুটলি আছে। ফিরিওলাই হবে বোধ হয়।

ছেলেটাকে পাঁচুর খারাপ লাগল না। তবে তার মনটা ভালো নেই বলে খুব উদাস গলায় বলল, এ হল ময়নাগড়।

ছেলেটা খুব মিষ্টি করে জিগ্যেস করল, তুমি কে ভাই?

পাঁচুর সঙ্গে এত মিষ্টি করে কেউ কখনও কথা বলে না। তাই তার ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। সে একটু নড়েচড়ে বসে বলল, আমি হলুম পাঁচু, এ-গাঁয়ের সবচেয়ে বোকা লোক।

ছেলেটা চোখ কপালে তুলে বলে, আঁ! বলো কী? তুমি যে বোকা তা বুঝলে কী করে?

বোকা না হলে আমার আজ অবধি কিছু হল না কেন বলো তো! ক্লাস এইটে ফেন্টু মেরে লেখাপড়ায় ইস্তফা দিতে হল। বাপ, মা, দাদা, দিদি, মাস্টারমশাইরা সবাই বলতেন, তোর কিছু হবে না। ভারী রাগ হল, বুঝলে! লেখাপড়া হল না বলে খারাপ লোক হওয়ার জন্য খুঁজে খুঁজে পলাশপুরের জঙ্গলে গিয়ে হাবু ডাকাতের সাঙাত হওয়ার চেষ্টা করলাম। দু-চারদিন তালিম দেওয়ার পর হাবু বলল, ওরে, তোর লাইন এটা নয়। যা বাপু, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যা। কিছুদিন তক্কেতক্কে থেকে একদিন টকাইচোরকে গিয়ে ধরে পড়লুম। তা টকাই ফেলল না। যত্ন করে বিদ্যে শেখাতে লাগল। মাসখানেক পরে হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নেড়ে বলল, না রে পাঁচু, এ জিনিস তোর হবে না। ভালো চোর হতে গেলে একটু মাথা চাই। রে। চালাক-চতুর-চটপটে না হলে চুরি-বিদ্যা কি শেখা যায়? তারপর এর, ওর, তার মতো হওয়ার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু মেহনতই সার হল, যে পাঁচু সেই পাঁচুই রয়ে গেলাম। আজ সকাল থেকে নিজেকে বেজায় বোকা-বোকা লাগছে। মনে হচ্ছে বুদ্ধিটা আরও একধাপ নেমে গেছে।

তা হলে তো তোমার সময়টা খারাপই যাচ্ছে।

খুব খারাপ, বেঁচে থাকতেই ইচ্ছে করছে না। মরতেই ইচ্ছে যাচ্ছে, বুঝলে! কিন্তু সনাতনদাদুর অবস্থা দেখে মরতেও ভয়-ভয় করছে।

সনাতনদাদুটা আবার কে?

সে তুমি চিনবে না। আমি তো সারা গায়ে টহল দিয়ে বেড়াই, আনাচ-কানাচ, কোনা-খামচি সব চিনি। ময়নাগড়ের বৃত্তান্ত আমার মতো কেউ জানে না। গাঁয়ের শেষে পেত্নিরজলা বলে একটা মস্ত মজা দিঘি আছে, জানো তো! ধারে ফলসা বন, সেটা পেরিয়ে গিয়ে মজা দিঘির উপরে গহীন জঙ্গলের মধ্যে কয়েকটা উঁচু-উঁচু ঢিবি আছে। তা, সেইসব ঢিবির একটাতে গিয়ে আমি বসে থাকতাম দুপুরবেলায়। একদিন বসে আছি, চারদিকে ঝঝ করছে চোতমাসের দুপুর, হঠাৎ যেন কাছেপিঠে একটা দরজার হুড়কো খোলার সব্দ হল। ভারী অবাক হলাম। এই জঙ্গলে তো বাড়িঘরের চিহ্নমাত্র নেই, তবে দরজা খোলে কে? তখন নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি, ঢিবির তলার দিকে একটা পুরোনো কেলে দরজার কানা একটু ফাঁক করে একজন অষ্টাবক্র কৃকলাশের মতো রোগা লোক বেরিয়ে এল। পরনে একটা নেংটি গোছের, আদুড় গা। আমি যে-ই উপর থেকে কে বলে হাঁক মেরেছি, অমনি ভিতরে ঢুকে ঝপ করে দরজা সেঁটে দিল। আমি তাড়াতাড়ি নীচে গিয়ে দরজার জায়গাটা ভালো করে দেখলুম। দরজা বলে। বোঝার উপায় নেই। উপরে পুরু মাটি জমে আছে, তাতে গাছপালা গজিয়েছে। মাটি খানিক খামচে সরিয়ে দরজার কড়া পেলাম বটে, কিন্তু বিস্তর ডাকাডাকি আর টানাটানিতে দরজা খোলেনি। তারপর রোজ গিয়ে দুপুরে তক্কেতকে ঢিবির উপর বসে নজর রাখি। দিনপনেরো বাদে লোকটা ফের বেরোল। এবার আর আমি হাঁক মারিনি। সোজা দুই লাফে নেমে গিয়ে লোকটাকে জাপটে ধরেছি। কিন্তু কী আশ্চর্য কাণ্ড, ধরতেই পারলুম না, আমার হাত যেন হাওয়া কেটে ফিরে এল।

বটে? হা গো। তবে এবার আর লোকটা পালাল না। আমাকে খুব মন দিয়ে দেখল। তারপর বলল, কেন মিছে হয়রান হচ্ছিস বাবা? আমি চোর-ঘঁচোড় নই। তিনশো বছর ধরে নিজের সম্পত্তি আগলে বসে আছি। মাঝে-মাঝে একটু হাঁফ ছাড়তে বেরোই। তা তুই এখানে ছোঁকছোঁক করছিস কেন? বলতে নেই, আমি একটু ঘেবড়ে গিয়েছিলাম। তবে লোকটা তেমন খারাপ নয়। দুঃখ করে বলল, বিষয় হল বিষ। বুঝলি, ওই যে বিষয়-চিন্তা করতে-করতে পটল তুলেছিলুম, সেই থেকে আর আত্মাটার সদ্গতি হল না। ঢিবির মধ্যে সেঁধিয়েই এতগুলো বছর কেটে গেল। বাঃ, তোমার তো খুব সাহস!

ঠোঁট উলটে পাঁচু বলে, সাহসের কাজ তো কিছু নয়। এমনিতে তো গাঁয়ের লোক কেউ আমাকে মানুষ বলেই মনে করে না, কথাটথাও কয় না। হয়তো ভাবে, বোকা ছেলেটার সঙ্গে কথা কয়ে হবেটা কী? কিন্তু সনাতনদাদু সেদিক দিয়ে ভালো। অনেক কথাটথা কইল। একদিন আমাকে বাড়ির মধ্যেও নিয়ে গেল।

ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, না হে, তোমার সাহস আছে। তা কী দেখলে সেখানে? পাঁচু চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, অন্ধকারে কি কিছু দেখা যায়। কয়েকটা লোহার বাক্স আছে মনে হল, তাতে বড়-বড় তালা ঝুলছে।

সে তো গুপ্তধন। তোমার লোভ হল না?

নাঃ। সনাতনদাদুর দশা দেখে আমার লোভ উবে গেল। মরার ইচ্ছেও চলে গেল।

এখনও কি সনাতনদাদুর কাছে যাও?

যাই মাঝে-মাঝে। সাতদিন ঘুমোয়, সপ্তাহে একদিন মোটে বেরোয়। গায়ে একটু রোদটোদ লাগিয়ে ফের ঢুকে যায়।

তুমি কি বুঝতে পেরেছ যে, তোমার সনাতনদাদু আসলে ভূত?

পাঁচু ফের ঠোঁট উলটে বলল, তাতে কী? ভূত কি আর মানুষ নয়? অত দূরেই বা যেতে হবে কেন, এই তো হোথায় তেঁতুলতলার বটগাছে বকেশ্বর থাকে। শীতলামন্দিরের পিছনে থাকে কলসি-কানাই, শ্মশানের কালীমন্দিরের পিছনে থাকে দেড়েল-রঘু।

ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, এদের সঙ্গেও তোমার ভাব আছে নাকি?

না। বশ্বের খুব ভিতু আর লাজুক। কলসি-কানাইকে নাকি কোন সাধুবাবা বলেছিল, তিন লক্ষ তিন হাজার তিনশো তিনটে সুচে সুতো পরাতে পারলেই নাকি সে যা চাইবে তাই পাবে। শুনেছি, কানাই নাকি মোট তিন হাজার সুচে সুতো পরাতে পেরেছিল। তারপরেই একদিন বউয়ের সঙ্গে ওই সুচে সুতো পরানো নিয়েই ঝগড়া লেগেছিল তার। ঝগড়া লাগারই কথা। কানাই যা রোজগার করত তার প্রায় সবটাই চলে যেত সুচ আর সুতো কিনতে। সংসারের সব কাজ ফেলে দিন-রাত শুধু সুচে সুতো পরালে কার না বউ রাগ করবে বলো! তা রেগে গিয়েই বউ বলেছিল, তোমার কি দড়ি-কলসি জোটে না! একথায় রেগে গিয়ে কানাই গলায় কলসি বেঁধে ঝিলে গিয়ে ডুব দিল। দিল তো দিলই। এখন সে বাকি সুচগুলোয় সুতো পরিয়ে যাচ্ছে। দম ফেলার ফুরসত নেই।

আর দেড়েল-রঘু? ও বাবা! সে মস্ত তান্ত্রিক। সাধন-ভজন নিয়ে থাকে, কারও দিকে ভুক্ষেপ নেই। তবে তারও শুনেছি একটা দুঃখ আছে। বেঁচে থাকতে তার দাড়ি মোট আড়াই হাত লম্বা হয়েছিল। তার খুব শখ ছিল চার হাত দাড়ির। দাড়ি মাটিতে ঘষটে যাবে, লোকে চেয়ে দেখবে, তবে না দাড়ির মহিমা। দাড়ির এমনই নেশা হয়েছিল যে, রঘু যখন সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে কালীর দেখা পেল, আর মাকালী যখন বর দিতে চাইল, তখন রঘু চার হাত দাড়ির বর চেয়েছিল।

এঃ হেঃ, মাত্র চার হাত?

আপনি তো বলেই খালাস, মাত্র চার হাত! কিন্তু চার হাত দাড়ি নিয়ে বেঁটেখাটো নাটা মানুষ রঘু যে কী মুশকিলে পড়ল তা বলার নয়। দাড়ি মাটিতে হেঁচড়ে যায়, আর তাতে মাটি ঝটপাট হয় বটে, কিন্তু দাড়িতে উঠে আসে বিস্তর ময়লা, কাঠকুটো, ইঁদুরছানা, আরশোলা, ব্যাঙ, কাকড়াবিছে, কেন্নো, পিঁপড়ে। তা ছাড়া বে-খেয়ালে নিজের দাড়িতে পা বেঁধে কতবার আছাড় খেয়েছে তার হিসেব নেই। শেষে সেই দাড়ির জন্যেই তো প্রাণটাও গেল? ধানখেতের আলের রাস্তায় ওই দাড়িতে আটকেই একটা কেউটের বাচ্চা উঠে এসেছিল কিনা। তারপর আর দেখতে হল না।

বাঃ, ময়নাগড়ের সব ভূতের বৃত্তান্তই তো তোমার জানা দেখছি।

বোকা লোকদের তো ওইটেই সুবিধে। যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। লেখাপড়া জানা চালাকচতুর লোকের তো তা নয়। ভূত দেখলেও নানা ফ্যাকড়া তুলে, কূটকাঁচালি করে ওটা যে ভূত নয় সেটা প্রমাণ করেই ছাড়বে। কিন্তু আপনি কে বলুন তো! আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। চেনার কথাও নয় কিনা। আমার নাম হিজিবিজি।

পাঁচু একটু ভেবে ঘাড় কাত করে বলল, বাঃ, বেশ নাম! ভুল হওয়ার জো নেই। তা এ-গাঁয়ে কাকে খুঁজছেন?

কাউকেই নয়। এ-পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, একটু জিরিয়ে নিতে থেমেছি। তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে ভারী ভালো লাগছে। ইচ্ছে হচ্ছে, দুটো দিন থেকে যাই।

ভারী লজ্জা পেয়ে পাঁচু বলে, যাঃ কী যে বলেন! আমার সঙ্গে দেখা হলে সবাই তো বিরক্তই হয়। কেউ খুশি হয় না তো। অনেকে তো আমাকে দূর থেকে দেখে দরজা বন্ধ করে দেয়।

তা হলে আমিও বোধ হয় তোমার মতোই বোকা লোক, তাই তোমাকে আমার বেশ ভালো লাগছে।

পাঁচু চিন্তিত হয়ে বলে, তা-ই বা হয় কী করে? আপনাকে দেখে যে বোকা বলে মনেই হয় না। বরং মনে হয়, আপনি ভীষণ চালাক।

তা হলে তোমাকে সত্যিই কথাটাই বলি। তুমি কি জানো যে, দুনিয়ায় বোকা লোকের সংখ্যা ভীষণভাবে কমে যাচ্ছে? আমি সারা দেশ চষে বেড়াই, আজ অবধি একটা খাঁটি, নীরেট বোকা লোক দেখতে পেলাম না।

পাঁচু মাথা নেড়ে বলে, সে ঠিক কথা। এ-গাঁয়েও আমি ছাড়া আর বোকা লোক নেই।

আমি আসলে বোকা লোকই খুঁজে বেড়াচ্ছি।

ভারী অবাক হয়ে পাঁচু বলে, বোকা লোক খুঁজছেন কেন?

বোকা তোক না হলে আমার কাজ-কারবারের সুবিধে হয় না কিনা। কিন্তু বোকা লোক খুঁজে বের করা ভারী শক্ত। অনেকে বোকা-বোকা ভাব করে থাকে, আসলে খুব চালাক। অনেকে আবার এক বিষয়ে বোকা তো অন্য বিষয়ে চালাক। ধরো ইংরিজিতে বোকা, অঙ্কে চালাক। আবার অনেকে আছে এত বেশি চালাক যে, চালাক লোকেরা তাদের চালাকি ধরতে না পেরে বোকা বলে ভেবে নেয়। তা তুমি এদের মতো নও তো!

মাথা নেড়ে পাঁচু বলে, তা তো জানি না। অত জানলে তো চালাকই হতাম।

হিজিবিজি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কাজটা খুব শক্ত। পাঁচু বলে, কোন কাজটা?

সত্যিকারের বোকা কিনা তা বুঝতে পারা। তোমাকেও আরও ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

ও বাবা, খাতা-কলম নিয়ে পরীক্ষায় বসতে হবে নাকি? সে কিন্তু আমি পারব না। বলেই পাঁচু অবাক হয়ে দ্যাখে, লোকটা আর তার পাশে নেই। চারদিকে চেয়ে কোথাও হিজিবিজিকে দেখতে পেল না পাঁচু। লোকটা স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।