ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

২. ভস্মাবৃত অগ্নি

২. ভস্মাবৃত অগ্নি

এগিয়ে এল সৈন্যবাহিনী। তরবারি নিয়ে প্রস্তুত হল মঘবা। শুরু হল সংঘর্ষ। দুজন সৈন্য আহত হয়ে আর্তনাদ করে হাতের অস্ত্র ফেলে দিল। মঘবার হাতের ঘূর্ণিতে অসি বারংবার ব্যর্থ করে দিল শত্রুর দলবব্ধ আক্রমণ। কিন্তু এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে একটিমাত্র লোক কতক্ষণ যুদ্ধ করতে পারে? হঠাৎ একটা কাটা-বসানো কৌশলহমুষল সবেগে এসে পড়ল মঘবার মাথায়, সঙ্গেসঙ্গে অচৈতন্য হয়ে সে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

দলপতি রূঢ়স্বরে বলল, ওকে বেঁধে ফেল। আদেশ পালিত হল তৎক্ষণাৎ। হঠাৎ একজন সৈন্য সংজ্ঞাহীন বন্দির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, আরে! কী আশ্চর্য! এযে দস্যুদলপতি মঘবা! রাজদরবার থেকে এই মঘবার ছিন্নমুণ্ডের জন্য সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

অট্টহাস্য করে দলপতি বলল, হাটের মাঝখানে প্রহরারত রক্ষীদের পর্যবেক্ষণের জন্য যে মঞ্চটা রয়েছে, তা উপরে খাড়া করা থামের উপর ঘৃণিত দুস্যটাকে বেঁধে রাখো। তারপর চটপট ঘোড়া হাঁকিয়ে নগরপালকে খবর দাও। তাকে পুরস্কারের কথাটাও মনে করিয়ে দেবে। তিনি যেন রাজদরবারে ঘোষিত সহস্র স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে যথাসম্ভব শীঘ্ৰ এইখানে চলে আসেন।

..মঘবার জ্ঞান যখন ফিরে এল, সে দেখল তাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। সৈন্যদের দলপতি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মঘবার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। অকে চোখ মেলে চাইতে দেখে সে বলে। উঠল, ওরে পরস্ব-অপহারক পাষণ্ড তস্কর! ততকৈ এখনই হত্যা করা হবে। কিন্তু তিনি এখানে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে আমি কিঞ্চিৎ হাতের সুখ করে নিতে চাই।

বলার সঙ্গেসঙ্গে হাত চলল। বন্দির মুখের উপর পড়তে লাগল ঘুষির পর ঘুষি। মঘবার মুখ থেকে তবু একটি কাতর শব্দও শোনা গেল না, কেবল তার দুই চক্ষু জ্বলতে লাগল নিষ্ফল আক্রোশে। চারপাশের জনতা দলপতির নিষ্ঠুর আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে। হয়তো তারা মঘবাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসতো, কিন্তু অস্ত্রধারী সৈনিকদের বেষ্ঠনী ভেদ করে মঞ্চের উপর আরোহন করার সাহস বা ক্ষমতা, যুদ্ধে অনভিজ্ঞ জনতার ছিল না।

ভীষণদর্শন এক রণকঠার হাতে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছিল এক রাজসৈন্য। সে মাঝে মাঝে কুঠারের বিপরীত দিক দিয়ে প্রহার করে জনতাকে সরিয়ে দিচ্ছিল। ক্রমশঃ জনতার চাপ বৃদ্ধি পেল। কুঠারধারী মাথার উপর কুঠার আস্ফালন করে চেঁচিয়ে উঠল, এখনই চলে যা এখান থেকে। বেশি চিৎকার করলে এখনই কুঠারের ধার পরখ করব তোদের উপর।

আচম্বিতে তার মুখের উপর পড়ল প্রচণ্ড মুষ্ঠাঘাত, সঙ্গেসঙ্গে প্রবল আকর্ষণে তার কুঠার হল হস্তচ্যুত! যে-ব্যক্তি কুঠার ছিনিয়ে নিয়েছিল, সে বিদ্যুৎবেগে কুঠার চালাল, এদিক-ওদিক চিটকে পড়ল কয়েকটি সৈন্য। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সেনাদলের বেষ্টনী ভেঙে কুঠারধারী মঞ্চের কাছে ছুটে গেল এবং কেউ বাধা দেওয়ার আগেই এক প্রচণ্ড লক্ষে উপস্থিত হল মঞ্চের উপর! মঞ্চে দণ্ডায়মান দলপতি সভয়ে পিছিয়ে গেল বন্দির সামনে থেকে, তার পাশে দাঁড়িয়ে যে তিনজন সৈন্য দলপতির অত্যাচারে উৎপীড়িত বন্দির অবস্থা দেখে দন্তবিকাশ করে আনন্দ প্রকাশ করছিল-তারা এইবার উদ্যত তরবারি হস্তে কুঠারধারীকে আক্রমণ করল। প্রবল বন্যার মুখে বালির বাঁধ যেমন ভেসে যায়, তেমনি ভাবেই ব্যর্থ হল সৈন্যদের প্রতিরোধের প্রয়াস; রক্তাক্ত দেহে মঞ্চের উপর মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়ল তিন সৈনিক। আবার ঘুরল কুঠারফলা মঘবার দিকে, অভ্রান্ত নিশানায় ছিন্ন হয়ে গেল বন্দির বন্ধনরঙ্কু। মাথার উপর শোণিতসিক্ত কুঠার তুলে আগন্তুক হাঁকল, মঘবা! অস্ত্র সংগ্রহ করা। ওরা আসছে।

একজন নিহত সৈনিকের তরবারি তুলে নিয়ে মঘবা সবিস্ময়ে বলে উঠল, সুবন্ধু! তুমি! হ্যাঁ, আমি। কিন্তু কথা বলার সময় নেই। ওরা আসছে।

সত্যই তাই। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণেকের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ছিল চতুর্দিকে দণ্ডায়মান সেনাবাহিনী, এখন সংবিৎ ফিরে পেয়ে তারা ধেয়ে আসছে মঞ্চের দিকে।

 রক্তাক্ত কুঠার তুলে একলাফে মঞ্চ থেকে জমির উপর নেমে এল সুবন্ধু, মঘবা! ওরা আসছে।

আর একলাফে তলোয়ার হাতে সুবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল মঘবা, যারা আসছে, তাদের মধ্যে অনেকেই আর ফিরে যাবে না।

লড়াই শুরু হল। মঘবার ভবিষৎবাণী মিথ্যা হল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই হতাহত হয়ে রক্তাক্ত দেহে ধরণীকে আলিঙ্গন করল কয়েকজন সৈন্য। সৈন্যদের বেষ্ঠনী ভেদ করতে সচেষ্ট হল মঘবা, তরবারির আঘাতে সম্মুখের দুই সৈনিককে ধরাশায়ী করে সে বলে উঠল, সুবন্ধু! বৃথাই আমার দলের লোক তোমাকে শশক নামে সম্বোধন করে! তোমার মতো নিরীহ ব্যক্তি যে এমন ভয়াবহ দক্ষতায় কুঠার চালনা করতে পারে, তা ভাবতেই পারি নি!

প্রচণ্ড বেগে কুঠার হাঁকিয়ে এক সৈনিককে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিয়ে সুবন্ধু বলল, মঘবা! সব কিছুরই সময়-অসময় আছে। এখন অন্ততঃ নিরীহ-চরিত্র প্রকাশের সময় নয়। কুঠারের চাইতে-তরবারি আমার প্রিয়– তবে প্রয়োজন হলে সব অস্ত্রই আমি ব্যবহার করতে পারি।

রক্তাক্ত কুঠার শূন্যে আস্ফালন করে সম্মুখে অগ্রসর হল সুবন্ধু, সভয়ে তার পথ ছেড়ে সরে গেল হতাবশিষ্ট রাজসৈন্য। উদ্যত তরবারি হস্তে সুবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়াল মঘবা, ওই যে নিকটেই কাঠের বেড়ার গায়ে বাঁধা আছে কয়েকটি অশ্ব। মালিকদের অনুমতি না নিয়েই ওদের মধ্যে দুটি অশ্ব আমরা ব্যবহার করব।… সুবন্ধু! আমায় অনুসরণ করো।

যে কয়েকজন রাজসৈন্য তখনও খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তারা শত্রুদের পালাতে দেখেও বাধা দিতে সাহল করল না। দুটি অশ্বকে বন্ধনমুক্ত করে মঘবা ও সুবন্ধু যখন অরণ্য অভিমুখে প্রস্থানের উদ্যোগ করছে, ঠিক তখনই নগরপাল তার অশ্বরোহী দেহরক্ষীদের নিয়ে দস্যু মঘবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করতে অকুস্থলে উপস্থিত হলেন।

সন্ত্রস্ত সেনাদল অশ্বারোহী বাহিনীকে দেখে উৎফুল্ল ও উত্তেজিত হয়ে উঠল। নগরপাল মহাশয়! ওই যে অশ্বারোহণে পলায়ন করছে দুস্য মঘবা, সঙ্গে রয়েছে তার দলভুক্ত এক দুর্ধর্ষ দুবৃত্ত! শীঘ্র ওদের গ্রেপ্তার করুন।

মঘবাকে অনুসরণ করতে করতে ধাবমান অশ্বপৃষ্ঠ থেকে পিছনে মুখ ফিরিয়ে দৃষ্টিপাত করে সুবন্ধু বলে উঠল, মঘবা! ওরা এগিয়ে আসছে। এখনই আমাদের ধরে ফেলবে। আমাদের ঘোড়া দুটো ওদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারছে না।

খুব স্বাভাবিক, পিছনে না তাকিয়ে মঘবা বলল, এই জন্তু দুটো ব্যাপারীদের ঘোড়া। হাটের জিনিসপত্র নিয়ে এই ঘোড়াগুলোর পিঠেই স্থান থেকে স্থানান্তরে ভ্রমণ করে বাণিজ্যজীবী বণিকের দল। প্রহরীদের শিক্ষিত অশ্বের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ওদের নেই।

তাহলে ঘোড়া ছুটিয়ে শ্রান্ত হওয়ার প্রয়োজন কী? আমরা বরং এইখানে স্থির হয়ে অপেক্ষা করি। তারপর শত্রুবধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করব।

—ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে নৈমিষারণ্যের বনভূমি। ওইখানে পৌঁছে গেলেই আমরা নিরাপদ। ঘোড়া ছোটাও সুবন্ধু, ঘোড়া ছোটাও।

-ওই অরণ্যে পৌঁছানোর আগেই অনুসরণকারী রক্ষীদল আমাদের ধরে ফেলবে।

সুবন্ধুর কথার উত্তর দিল না মঘবা, কটিবন্ধ থেকে শিঙাটিকে তুলে নিয়ে ফুঙ্কার দিল। তীব্রশব্দে বেজে উঠল শিঙা। সুবন্ধু আশ্চর্য হয়ে ভাবল হঠাৎ শিঙা। বাজানোর কারণ কী? বেশিক্ষণ তাকে মাথা ঘামাতে হল না- বনের আড়াল থেকে এক ঝাঁক তীর ছুটে এসে অনুসরণকারী অশ্বরোহীদের প্রাণঘাতী অভ্যর্থনা জানাল! মুহূর্তের মধ্যেই অশ্বারোহী রক্ষীদের তিন ব্যক্তি হল পপাত ধরণীতলে এবং আর সকলে চমকে থেমে গেল তৎক্ষণাৎ!

আবার ছুটে এল একঝাঁক তীর উড়ন্ত মৃত্যুদূতের মতো সুবন্ধু আর মঘবার পাশকাটিয়ে ছুটে গেল অশ্বারোহী রক্ষিবাহিনীর দিকে। প্রহরীরা এইবার রণে ভঙ্গ দিল; এগিয়ে এসে পলাতকদের আক্রমণের চেষ্টা না করে তারা তীরের নাগালের বাইরে সরে এল দ্রুতবেগে এবং নিরাশ হয়ে দেখল তাদের দুই সম্ভাব্য শিকার অন্তর্ধান করছে প্রান্তরের সীমানায় অবস্থিত অরণ্যের গর্ভে!

…জঙ্গলের ভিতর ঢুকে সুবন্ধু দেখল গাছের আড়ালে গা-ঢাকা দিয়ে ধনুকে বাণ চড়িয়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করছে একদল যোদ্ধা। তাদের সকলেই সুবন্ধুর পরিচিত সকলেই মঘবার দলের মানুষ। সুবন্ধু বুঝল শিঙার সঙ্কেতধ্বনি শুনলেই মঘবাকে বিপন্ন বুঝে সাহায্য করতে ছুটে আসে তার দলের লোক। শিঙাটাকে মঘবার কটিবন্ধে ঝুলতে দেখে সুবন্ধু ভেবেছিল ওটা তার শখের জিনিস- এইবার সে শিঙার তাৎপর্য বুঝতে পারল।

নগরপালের রক্ষীদল আর বনের ভিতর প্রবেশ করার সাহস পেল না। তীরবিদ্ধ হতাহত সঙ্গীদের নিয়ে তারা প্রস্থান করল। তাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে সতর্ক প্রহরায় দাঁড়িয়ে রইল মঘবার ধনুর্বাণধারী বিদ্রোহী বাহিনী..

আস্তানায় এসে পৌঁছাল সুবন্ধু ও মঘবা। দলপতির মুখে তার উদ্ধারের বৃত্তান্ত শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল বিদ্রোহী বাহিনী। তারা একবাক্যে বলল অসাধারণ রণকুশল অভিজ্ঞ যোদ্ধা ছাড়া কোনো ব্যক্তির পক্ষে একক প্রচেষ্টায় মঘবাকে পূর্ববর্ণিত বন্দি দশা থেকে মুক্ত করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু ইতিপূর্বে সুবন্ধু কাপুরুষের মতন বিনা প্রতিবাদে সৈন্যদের অত্যাচার কেন সহ্য করেছিল, এটাই হচ্ছে তাদের জ্ঞাতব্য প্রশ্ন।

অতঃপর সুবন্ধু যা বলল তা হচ্ছে এই:

আমি ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা। বিভিন্ন রাজ্যে অশ্বারোহণে ভ্রমণ করতে করতে এক অরণ্যসংকুল পর্বতসজিত প্রদেশে একটি খরস্রোতা নদীর সম্মুখীন হলাম। পারাপারের জন্য নদীর উপর বৃক্ষকান্ডে নির্মিত একটি অতি সঙ্কীর্ণ সেতু দেখে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে অবতরণ করে আমি পায়ে হেঁটে সেতু পার হতে উদ্যোগী হলাম। আমার অনুগত অশ্ব আমাকে অনুসরণ করতে লাগল। সেতুর মাঝামাঝি যখন এসেছি, তখন দেখলাম বিপরীত দিক থেকে এক ব্যক্তি সেতু পার হওয়ার উপক্রম করছে। লোকটি নিরস্ত্র নয়, তার কটিবন্ধে ছিল দীর্ঘতরবার। সেতুর মাঝামাঝি এসে দুজনেই থেমে গেলাম। বৃহৎ বৃক্ষকান্ডে নির্মিত ওই সেতু ছিল অতি সঙ্কীর্ণ, পাশাপাশি দুটি লোক দাঁড়ানোর জায়গা সেখানে ছিল না। আমি আগে এসেছি, তাই আমারই অগ্রাধিকার কিন্তু উক্ত ব্যক্তি আমাকে রূঢ়ভাবে পথ ছেড়ে দিতে বলল। অবশ্যই তার প্রস্তাবে আমি রাজি হলাম না। প্রথমে বাগযুদ্ধ;-তারপর তরবারি কোষমুক্ত করে লড়াই। স্কন্ধে আহত হয়ে ওই ব্যক্তি নদীতে ছিটকে পড়ল। আমি দেখলাম আহত মানুষটি তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারছে না, এখনই সে সলিল সমাধি লাভ করবে, তাই জলে ঝাঁপ দিয়ে তাকে নিশ্চিত মৃত্যর কবল থেকে উদ্ধার করলাম।

উদ্ধার পেয়ে আহত ব্যক্তি বলল অপুঁদরাজের প্রাসাদে তাকে পৌঁছে দিলে সে অত্যন্ত উপকৃত হবে। আমার ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে তাকে পৌঁছে দিলাম। পথে চলতে চলতে শতানীক নামক ওই ব্যক্তির মুখেই জানতে পারলাম সে অর্বুদরাজ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা– এমনকী পার্শ্ববর্তী কয়েকটি রাজ্যে তার সমকক্ষ যোদ্ধা কেউ নেই। কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম শতানীক কেবল দক্ষ যোদ্ধা নয়, তার অন্তঃকরণও উদার দাক্ষিণ্যে প্রশস্ত। সে অর্বুদরাজ্যের নিকট সমস্ত ঘটনা জানিয়ে নিজের দোষ অকপটে স্বীকার করল। অর্বুদরাজ আমার উদারতার প্রশংসা করে তার রাজ্যের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে খরস্রোতা নদীর গ্রাস থেকে উদ্ধারের জন্য অজস্র ধন্যবাদ জানালেন এবং আমাকে তার অতিথি হতে অনুরোধ করলেন। আমি সানন্দে তাঁর অতিথি হয়ে বিভিন্ন রাজকীয় আমোদপ্রমোদে দিনযাপন করতে লাগলাম। প্রায় এক সপ্তাহ পরে রাজসভায় এক মহামান্য অতিথির আবির্ভাব ঘটল। শুনলাম তিনি পার্শ্ববর্তী কাঞ্চনরাজ্যের প্রতিনিধি- নাম, শশাঙ্কদেব।

শিষ্টাচার বিনিময়ের পর শশাঙ্কদেব জানালেন, যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড নিয়ে অর্বুদ ও কাঞ্জনরাজ্যের মধ্যে বিবাদ চলছে– যুদ্ধবিগ্রহে অনর্থক লোকক্ষয় না করে, দুই রাজ্যের নির্বাচিত দুই যোদ্ধার মধ্যে সংঘটিত দ্বন্দ্বযুদ্ধের দ্বারাই পূর্বোক্ত সমস্যার সমাধান করা উচিত।

অর্বুদরাজ ক্রুদ্ধ ও উদবিগ্ন হয়ে বললেন, তার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এখন অসুস্থ এবং সেই তথ্য জানা আছে বলেই কাঞ্জনরাজ দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তাব জানিয়ে প্রতিনিধি শশাঙ্কদেবকে অর্বুদরাজ্যের রাজসভায় প্রেরণ করেছেন।

অর্বুদরাজের বক্তব্য শুনে শশাঙ্কদেব বিদ্রূপ করে বললেন সমগ্র অর্বুদরাজ্যে শতানীক ব্যতিত কোনো যোদ্ধা নেই, একথা তার জানা ছিল না। শশাঙ্কদেবের তীব্র শ্লেষ অর্বুদরাজের মর্মস্থানে বিদ্ধ করল, তার মুখণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করল কিন্তু উপযুক্ত উত্তর দিতে অসমর্থ হওয়ায় তিনি নতমস্তকে নীরব রইলেন।

অর্বুদরাজের সহৃদয় ব্যবহারে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। বিগত একটি সপ্তাহের মধ্যেই তিনি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের প্রতিনিধির শ্লেষতিক্ত উপহাস আমার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল, আমি উপবিষ্ট অবস্থা থেকে জ্যা-মুক্ত ধনুকের মতো সবেগে দন্ডায়মান হয়ে অবুরাজকে বললাম, মহারাজ! এই পরিস্থিতির জন্য আমিই দায়ী। অমারই জন্য আজ রাজ্যের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বোগশয্যায় শায়িত। অতএব বর্তমান সমস্যার সমাধান আমারই করা উচিত। আপনার অনুমতি পেলে অদরাজ্যের নির্বাচিত যোদ্ধা হয়ে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে রাজি আছি।

বলাই বাহুল্য, রাজার অনুমতি পেতে বিলম্ব হল না। পরের দিন দ্বৈরথের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে কাঞ্চনরাজ্যের যোদ্ধাকে দেখে চমকিত হলাম। উক্ত যোদ্ধাও আমাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিল। অঙ্গদ নামক কাঞ্চনরাজ্যের নির্বাচিত যোদ্ধা বাল্যকালে আমার প্রিয় সঙ্গী ছিল এখন তার দেহে অস্ত্রাঘাত করার কথা ভাবতেই আমার সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে পড়ল। আমি তাকে অস্ত্রত্যাগ করতে অনুরোধ করলাম। সে সগর্বে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানাল কাঞ্চনরাজ্যের কাছে সে শপথবদ্ধ, শপথ ভঙ্গ করলে সে কর্তব্যভ্রষ্ট হবে তবে আমি যদি দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান উপেক্ষা করি, তাহলে আর রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে না।

কিন্তু আমার পক্ষেও তখন আর যুদ্ধ থেকে পশ্চাৎপদ হওয়া সম্ভব ছিল না। আমি পিছিয়ে গেলে বিতর্কিত ভূখণ্ড তো যাবেই, সেই সঙ্গে ভূ-লুণ্ঠিত হবে রাজ্যের মান মর্যাদা, অর্বুদরাজ হবেন বিপক্ষের শ্লেষ ও বিদ্রুপের পাত্র। না, আমি তা হতে দিতে পারি না। অতএব ইচ্ছার বিরুদ্ধেই অসি কোষমুক্ত করে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হলাম।

আমি অঙ্গদকে আঘাত না করে কৌশলে তার হাতের অস্ত্রকে করচ্যুত করতে সচেষ্ট হলাম। কিন্তু অঙ্গদ নিপুণ যোদ্ধা, তাকে আহত না করে তার হাতের তলোয়ার ফেলে দেওয়া সহজ নয়। আমি অতিকষ্টে আত্মরক্ষা করে প্রতিদ্বন্দ্বীর অসি করচ্যুত করার চেষ্টা করছিলাম, সেই সঙ্গে সে যেন আমার অসির আঘাতে আহত না হয় সেদিকেও আমার দৃষ্টি ছিল নিবদ্ধ। কিন্তু অঙ্গদ যেন আমার প্রাণবধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অবশেষে আহত হয়ে ধৈৰ্য্য হারালাম, আমারই অসির আঘাতে মৃত্যুবরণ করল বাল্যবন্ধু অঙ্গদ। যুদ্ধের উন্মাদনা আমার সমগ্র চেতনাকে গ্রাস করেছিল। অঙ্গদের রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহ আমার চিত্তের সদ্যজাগ্রত উন্মত্ত হিংসাকে নিবৃত্ত করল। নিদারুণ শোক এবং অনুশোচনা আমার হৃদয়কে যেন বিদীর্ণ করে দিল। মনে পড়ল বাল্যজীবনের কথা– নিহত অঙ্গদের জননী একসময় নিজের প্রাণ বিপন্ন করে আমার জীবনরক্ষা করেছিলেন। বিষাক্ত সর্পের দংশনে যখন শৈশবে আমার জীবনের অশঙ্কা দেখা দেয়, সেই সময় অঙ্গদ-জননী সপর্দষ্ট বিষাক্ত ক্ষতে মুখ দিয়ে বিষ তুলে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। মাতৃসমা জীবনদাত্রীর একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে তীব্র অনুশোচনায় আমার জীবনে ধিক্কার এসেছিল, অস্ত্রত্যাগ করে উদ্দেশ্যহীন নিরুদ্দেশ যাত্রায় আমি বহির্গত হলাম। অর্বুদরাজ আমাকে প্রচুর ধনরত্ন দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর রাজসভায় সম্মানিত যোদ্ধা হয়ে থাকতে বলেছিলেন- আমি কর্ণপাত করিনি, বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। শুধু একটি অনুগ্রহ ভিক্ষা করেছিলাম তাঁর কাছে প্রিয় অশ্ব অঞ্জনকে রেখে এসেছিলাম তার আশ্রয়ে। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম জীবনে আর কোনোদিন অস্ত্রধারণ করব না। উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাই ভ্রমণ করছিলাম ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।

সুবন্ধুর কাহিনি শেষ হল। মঘবার বিদ্রোহী-বাহিনীর যোদ্ধাবর্গ সেই বিস্ময়কর আত্মকাহিনি শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল মঘবা, কিন্তু, সুবন্ধু! শেষ পর্যন্ত তোমার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ হল যে!

সুবন্ধু হাসল, ভ্রম সংশোধন করলাম। শোকে-দুঃখে আত্মগ্লানিতে বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল। পরে বুঝলাম অস্ত্রত্যাগ করা অনুচিত- ন্যায়ের জন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাই ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য।

শুনে সুখী হলাম, পুলকিত স্বরে মঘবা বলল, তোমার মতো রণনিপুণ নির্ভীক যোদ্ধা আমাদের বিদ্রোহী-বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করবে। আশা করি তোমার সাহায্যে আমরা বিশারাজ্যের অত্যাচারী রাজাকে পরাস্ত করে সমুচিত শাস্তি দিতে পারব।

না, মঘবা, না! তোমাকে নিজেই উদ্যোগী হয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের উপযুক্ত সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, ভেসে এল সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, এই যুবককে তুমিই সাহায্য করবে। ছদ্মবেশি রাজপুত্রের তুমি হবে প্রধান সহায়।

চমকে ফিরে তাকিয়ে মঘবা ও সুবন্ধু দেখল তাদের অজ্ঞাতসারে সমবেত যোদ্ধাদের ভিতর নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছেন বিদ্রোহী-বাহিনীর মন্ত্রণাদাতা প্রবীণ ব্রাহ্মণ।

মঘবা সবিস্ময়ে বলল, ছদ্মবেশি রাজপুত্র! আপনি কার কথা বলছেন গুরুদেব?

ব্রাহ্মণ সুবন্ধুর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন, তোমরা যাকে সুবন্ধু বলে জানো, সে মগধের রাজপুত্র। নন্দরাজা নামে এক ক্ষপণক-পুত্র ছলে-বলে-কৌশলে প্রকৃত রাজকুমারকে বঞ্চিত করে মগধের সিংহাসন অধিকার করেছে। সে কুমারকে প্রাণদণ্ড দিয়েছিল, কিন্তু কুমার তার ঘাতকবাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করেছে। এই সেই পলাতক রাজপুত্র, মগধ-সিংহাসনের ন্যায্য উত্তরাধিকারী যাকে তোমরা সুবন্ধু বলে জানো। রাজপুত্রের প্রকৃত নাম চন্দ্রগুপ্ত।

স্তম্ভিত সুবন্ধু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তার সঙ্গে নীরব হয়ে রইল মঘবার বিদ্রোহী-বাহিনী। অপ্রত্যাশিত বিস্ময়কর ঘোষণা তাদের জিহ্বাকে মৌন করে দিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কা প্রথমে সামলে নিল সুবন্ধু, আশ্চর্য! আপনি এই গোপনীয় তথ্য কেমন করে জানলেন?

ব্রাহ্মণ হাসলেন, আমি একসময়ে নন্দরাজের সভায় যাতায়াত করতাম। সেই সময় থেকেই তুমি আমার পরিচিত। পরবর্তীকালে অবশ্য আমি রাজসভায় ছিলাম না, কিন্তু প্রয়োজনীয় সংবাদ সর্বদাই সংগ্রহ করেছি। তুমি যে গৃহত্যাগ করেছ এবং নন্দরাজার নিযুক্ত গুপ্তচরের দল যে তোমায় হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, সেই সংবাদও আমার অজানা নয়।

-এইবার আপনাকে চিনতে পেরেছি। আপনি মহামতি চাণক্য। নন্দরাজার ব্যবহারে অপমানিত বোধ করে আপনি রাজসভা ত্যাগ করে অন্তর্ধান করেছিলেন।

বর্তমানে এই বিশা রাজ্যে মঘবার মন্ত্রণাদাতা মন্ত্রীর পদ অধিকার করেছি এবং নন্দরাজার অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছি। বৎস চন্দ্রগুপ্ত! তোমাকে অবলম্বন করেই তৃপ্ত হবে আমার প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু কেবল প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যই আমি উগ্রীব নই, এই খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারতভূমিকে আমি ঐক্যবদ্ধ এক মহান রাষ্ট্রে রূপান্তরিত দেখতে চাই। কুমার! তোমার ললাটে রাজচিহ্ন আছে– যদি আমার কথা শুনে চলো, যদি আমার বুদ্ধির উপর আস্থা রাখতে পারো, যদি মঘবার ন্যায় আমাকে গুরু বলে মান্য করো– তাহলে অনতিকার মধ্যে তুমি মগধের সিংহাসন তো অধিকার করবেই, এমন কি সমগ্র আর্যাবর্ত তথা ভারতভূমির উপর তোমার আধিপত্য স্থাপিত হওয়াও অসম্ভব নয়।

সুবন্ধু- না, সুবন্ধু নয়- এখন থেকে কুমারকে আমরা চন্দ্রগুপ্ত নামেই ডাকব। চাণক্যের দিকে তাকিয়ে কুমার চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আজ হতে মঘবার ন্যায় আমিও আপনাকে গুরু বলে স্বীকার করলাম। গুরুদেব! আমিও নন্দরাজার অত্যাচার-উৎপীড়নের প্রতিশোধ নিতে চাই, অধিকার করতে চাই আমার প্রাপ্য মগধরাজ্যের সিংহাসন। কিন্তু শুধু মগধ অধিকার করেই আমার তৃপ্তি হবে না। এই খণ্ড-ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারতভূমিকে আমি বিদেশির কবলমুক্ত করে এক উজ্জ্বল একতাবদ্ধ আদর্শ রাজ্যে পরিণত করতে চাই আচার্য! আমার উদ্দেশ্য কি সফল হবে?

-ক্ষত্রিয়ের পেশিশক্তির সঙ্গে যদি ব্রাহ্মণের তীক্ষ্ণ কুটবুদ্ধি যোগ দেয় তাহলে অসাধ্যসাধন করা সম্ভব। বৎস চন্দ্রগুপ্ত! তুমি এই রাজ্যের পূর্বদিকে অবস্থিত বিদর্ভরাজ্যের বনাঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করো। এই স্থান মগধের করদরাজ্য, এই রাজ্যের অধিপতি নন্দরাজ্যের প্রতি বন্ধুমনোভাবাপন্ন এবং তোমাকে অনুসন্ধান করে ঘুরছে গুপ্তচরের দল- সুতরাং কয়েকজন বিশ্বস্ত যোদ্ধা তোমার সঙ্গে থাকবে। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তারাই যোগাযোগ রক্ষা করবে।

-গুরুদেব! বিদর্ভরাজ্যের অরণ্যে নিষ্কর্মা হয়ে বসে আমি কি কবর?

–অপেক্ষা করবে। যুদ্ধজয় করতে হলে নিজস্ব বাহিনী সংগঠন দরকার। তার জন্য অর্থের প্রয়োজন। মনে হয় তোমার কাছে তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য সঞ্চিত অর্থ নেই।

-আমার কাছে নিজস্ব কিছু অর্থ না থাকলেও প্রয়োজন হলে বেশ কিছু অর্থ আমি সংগ্রহ করতে পারব।

–কোথা থেকে?

–অর্বুদরাজ আমায় পুত্ৰাধিক স্নেহ করেন। আমি তার সম্মানরক্ষা করেছিলাম। তাঁর প্রতিশ্রুত অর্থ প্রত্যাখ্যান করে আমি যখন চলে আসি, তখন তিনি বলেছিলেন কখনো কোনো প্রয়োজনে যদি আমি তাঁর সাহায্য চাই, তাহলে তিনি আমাকে বিমুখ করবেন না আমাকে তার অদেয় কিছু নেই।

অর্বুদরাজ্য ক্ষুদ্র হলেও সম্পদশালী ধনী রাজ্য। কিন্তু কেবলমাত্র একটি রাজ্যের উপর নির্ভর করে বিশাল কর্মকাণ্ডে অগ্রণী হওয়া অনুচিত।

–শুধু অর্বুদরাজ্য নয়। বাহ্রিকরাজ্য থেকেও আমি যথেষ্ট সাহায্য পাওয়ার আশা রাখি।

বাহিকরাজ্য! চাণক্যের কুঞ্চিত হল, শুনেছি, উক্ত অনার্যরাজ্যের রাণী অস্ত্রচালনায় পুরুষের সমকক্ষ। কিন্তু অনার্যকন্যা কি তোমায় সাহায্য করতে সম্মত হবে?

–কেন সম্মত হবে না, গুরুদেব?

-আর্যজাতির সঙ্গে পর্বতবাসী অনার্যদের প্রীতির সম্পর্ক খুব গভীর নয়। হয়তো বাহিক রাজ্ঞী কোনো কারণে তোমার প্রতি সদয়, কিন্তু বিপদের সময় অনার্য-রমণীর উপর নির্ভর করা সমীচীন হবে কি?

গুরুদেব! প্রদীপ্ত চক্ষে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আমার বিরুদ্ধচারণ করলেও বাহিকরাজ্যের মহারাণী ছায়া কখনো বিপদের সময় আমাকে পরিত্যাগ করবেন না।

তীব্ৰদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চন্দ্রগুপ্তকে নিরীক্ষণ করলেন চাণক্য, তারপর তাঁর মুখে ফুটল মৃদু হাসির রেখা, বৎস! বাত্নিকরাজ্ঞী যদি তোমাকে সাহায্য করে, তাহলে বহু অনার্য রাজা তোমার পক্ষে অস্ত্রধারণ করবে। দাম্ভিক আর্যদের মধ্যে অনেকে অনার্যদের ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রাখে। তারা মুখ- অনার্যশক্তি এক প্রবল শক্তি, তাদের বাদ দিয়ে দুর্জয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলা অসম্ভব। কুমার! অনার্যশক্তির সক্রিয় সাহায্য পেলে তোমার ঐক্যবব্ধ ভারতের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়িত হবে।

একটু থেমে চাণক্য বললেন, এইবার মন দিয়ে আমার কথা শোন। মগধের মিত্রস্থানীয়। করদরাজ্যগুলিতে রাজকীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদ্রোহী-বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করতে হবে। এই কাজের জন্য মঘবার দলভুক্ত যোদ্ধাদের আমি নিযুক্ত করব। কিন্তু কুমার। তুমি ওই সকল লুণ্ঠন ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হবে না। বিদর্ভরাজ্যের অন্তর্গত অরণ্যের গভীর অন্তঃপুরে আত্মগোপন করে তুমি উপযুক্ত সুযোগের জন্য অপেক্ষা করবে।

গুরুদেব! এটা আপনার কেমন কথা? চন্দ্রগুপ্তের কণ্ঠস্বর উত্তেজিত, আমারই জন্য মঘবা ও তার বন্ধুবর্গ জীবনবিপন্ন করে বিভিন্ন করদরাজ্য থেকে সম্পদ সংগ্রহ করবে, আর আমি নিরাপদ দূরত্ব থেকে ওই সম্পদ সঞ্চয় করব?… অসম্ভব প্রস্তাব। এমন স্বার্থপর ক্লীবের ভূমিকা গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

চন্দ্রগুপ্ত! চাণক্যের দুই চক্ষে জাগল ক্রোধের আভাস, মুখের ন্যায় ভাবপ্রবণ হলে কোনোদিনই তুমি কার্যসিদ্ধি করতে সমর্থ হবে না। যখন সময় আসবে, তখন আমিই তোমাকে অস্ত্র হাতে রণস্থলে অবতীর্ণ হতে বলব। যদি নতমস্তকে বিনা দ্বিধায় আমার আদেশ শিরোধার্য করতে পারো, তবেই তোমার পাশে থেকে আমি তোমার সাহায্য করতে পারব। –আর যদি মান্য না করো, যদি নিজের বুদ্ধিতে চলতে চাও, তাহলে তোমার সংশ্রব আমি ত্যাগ করব। বলো কুমার! তুমি কী করবে?

নতমস্তকে ব্রাহ্মণের পদধূলি নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত বললেন, আচার্য! আমায় মার্জনা করুন। আমাকে ত্যাগ করবেন না। আপনার সাহায্য ছাড়া সুবন্ধু কোনোদিনই মগধ-অধিপতি চন্দ্রগুপ্ত হতে পারবে না।

বৎস! চাণক্য প্রসন্নকণ্ঠে বললেন, রাজনীতি অতি কঠিন বিষয়। ভাবাবেগে চালিত হলে রাজনীতিতে সাফল্য অর্জন করা যায় না। আমার উপর ভরসা রাখো- ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা সুবন্ধুকে মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত নামক ব্যক্তিত্বের রূপান্তরিত করার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম।