ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

২. বামা-পরাক্রমে ভীমা!

২. বামা-পরাক্রমে ভীমা!

কিছুদুর এসে উচ্চভূমির উপর থেকে নীচের দিকে দৃষ্টিপাত করে চমকে উঠল গ্রীক সৈনিক ও আর্যযুবক পাহাড়ের তলদেশে গিরিপথের উপর তরুণীকে আক্রমণ করেছে চারজন মুখোশধারী আততায়ী! তরুণীর হাতে রক্তাক্ত তরবারি, আশ্চর্য কৌশলে সে আত্মরক্ষা করছে। তার পায়ের কাছে একটি মুখোশধারীর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে, খুব সম্ভব তার দেহে প্রাণ নেই। তরুণী এবং আততায়ীর দলকে দেখলেই বোঝা যায় তাদের ধমনীতে আর্যরক্ত অনুপস্থিত সকলেই অনার্য।

আজাক্স ক্রুদ্ধস্বরে বলল, দেখ! তোমার দেশবাসীর কীর্তি নিরীক্ষণ করো! ধিক! সকলে মিলে নারীহত্যা করছে!

পিঠের ধনুর্বাণ হাতে নিয়ে গম্ভীরস্বরে যুবক বলল, মাভৈঃ! তোমাকে নারীহত্যা দেখতে হবে না। রক্তপিপাসু তরবারির নির্লজ্জ নৃত্য থামিয়ে এইবার বাজবে ধনুকের টঙ্কার-সঙ্গীত!

পরক্ষণেই সশব্দ টঙ্কারে ছুটল তীর, আর্তনাদ করে হাতের তরবারি ফেলে দিল একজন ঘাতক। আবার বেজে উঠল ধনুকের ছিলা আরও একটি ঘাতকের হাত থেকে খসে পড়ল তরবার। দুজনের দক্ষিণ বাহু বিদ্ধ করেছে দুটি তীর অব্যর্থ সন্ধানে!

তীরের উৎস আবিষ্কার করার জন্য মুখ তুলতেই উচ্চভূমি উপর দন্ডায়মান আর্যযুবক ও গ্রীকসৈনিকের দন্ডায়মান মূর্তি আততায়ীদের দৃষ্টিগোচর হল। একজন দুবৃত্ত উচ্চৈস্বরে বলল, আমরা তোমাদের শত্রু নই। আমাদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়লে কেন?

যুবক হাঁক দিয়ে বলল, একটি নারীকে পাঁচজন পুরুষ আক্রমণ করেছ? কী বীরপুরুষ! সুখের বিষয় তোমাদের মধ্যে একজন রমণীর অসির আঘাত দেহে ধারণ করে নরকে পৌঁছে গেছে!… শীঘ্র এই স্থান ত্যাগ করো, নচেৎ আমার ধনুক আবার বাণবর্ষণ করবে।

যে দুজন দুবৃত্ত তখনও অক্ষত ছিল তাদের মধ্যে একজন ভল্লধারী। সে এগিয়ে এসে বলল, আমাদের হাতে তীরধনুক নেই, তাই এত সাহস?

পরক্ষণেই সে উচ্চভূমিতে দণ্ডায়মান শত্রুদের উদ্দেশ্যে সজোরে ভন্ন নিক্ষেপ করল।

সাবধান গ্রীক! সাবধান!– এক প্রচণ্ড ধাক্কায় আজাক্সকে ছিটকে ফেলে নিজেও সরে গেল যুবক। আজাক্স যেখানে পঁড়িয়েছিল, সেইখানে ভূমিতে বিদ্ধ হয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগল নিক্ষিপ্ত ভল্ল।

রে বর্বর! গর্জন করে উঠল আজাক্স, আমি বিবাদে লিপ্ত হতে চাইনি, কিন্তু তোরা আমাকে যুদ্ধে প্ররোচিত করেছিস।

আজাক্স অদুরে অবস্থিত এক প্রস্তরকে সবলে আকর্ষণ করল।

আর্যযুবক বিস্মিত নেত্রে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করল, ওই গুরুভার প্রস্তর অনায়াসে উত্তোলন করল! এই গ্রীক অমানুষিক শক্তির অধিকারী।

দুই হাতে সেই প্রকাণ্ড পাথরকে মাথার উপর তুলে আজাক্স প্রচণ্ড কণ্ঠে হুঙ্কার দিল, বর্বর। আজ তোরা গ্রীকের বাহুবল দর্শন কর

পরক্ষণেই সেই বিশাল প্রস্তর নিক্ষিপ্ত হল। কোনরকমে সরে গিয়ে নিক্ষিপ্ত প্রস্তর থেকে আত্মরক্ষা করল আততায়ীরা। যে দুই ব্যক্তি বাণে আহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন সভয়ে বলে উঠল, ওই বিরাট পাথরটাকে যে-লোক মাটির ঢেলার মতো ছুঁড়ে মারতে পারে, সে মানুষ নয়– দৈত্য! এখানে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য।

সে দ্রুত পদচালনা করল। তার সঙ্গীরা তাকে অনুসরণ করল তৎক্ষণাৎ।

পিছন থেকে হাস্যতরল কণ্ঠে তরুণী চিৎকার করে বলল, কোথায় পলায়ন করছিস? তোরা তো আমাকে হত্যা করতে এসেছিস, এখন কাজ শেষ না করে চলে গেলে তোদের ভাগ্যে পুরস্কারের পরিবর্তে জুটবে তিরস্কার। চলে আয়— আমি তো মরার জন্য প্রস্তুত।

ছুটতে ছুটতে একজন আততায়ী বলল, কথাটা সত্য বটে। কাজ শেষ না করে ফিরে গেলে মালিক কী বলেব?

আর একজন উত্তর দিল, যা খুশি বলুক। অর্থের জন্য প্রাণবিপন্ন করতে পারি না। ওখানে থাকলে আমরা কেউ বাঁচতুম না।

তার কথায় সায় দিয়ে তৃতীয় ব্যক্তি বলল, ঠিক কথা। ওই ধনুক-হাতে লোকটা অতদুর থেকে আমাদের দুজনকে তীর ছুঁড়ে দিল। আর ওর সঙ্গে যে গ্রীক সৈন্যটা ছিল সেটা তো একটা দানব।

চতুর্থ ব্যক্তি মতপ্রকাশ করল, আর মেয়েটাই বা কম কীসে? চোখের পলকে কিন্নরের তলোয়ার রুখে দিয়ে তার বুক ফুটো করে দিল।

প্রথম ব্যক্তি উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, কথা না বলে আরও জোরে পা চালাও। ওই ধনর্বাণ হাতে লোকটা যদি তাড়া করে আসে? মনে রেখো ও অনেক দূর থেকে মানুষ ঘায়েল করতে পারে।

এমন ভয়াবহ সম্ভাবনার কথা মনে হতেই তারা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অন্তর্ধান করল ঘন অরণ্যের অন্তরালে…।

তরুণী কয়েক মুহূর্ত আততায়ীদের গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর উচ্চভূমিতে অবস্থিত দুই ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, শৃগালের দল পালিয়েছে। আর্য যোদ্ধা! গ্রীক সৈনিক! তোমরা আমার প্রাণরক্ষা করেছ। তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

ঢালু পাহাড়ী পথে চটপট নেমে এল আর্যযুবক, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন নেই; রাজকন্যা! তোমার প্রাণরক্ষার সুযোগ পেয়েছি বলে গর্ববোধ করছি।

রাজকন্যা! তরুণী সবিস্ময়ে যুবকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তোমরা আমাকে জানো?

ইতিমধ্যে বিপুলবপু আজাক্সা তার সঙ্গীকে অনুসরণ করে নীচে নেমে এসেছিল, যুবক কিছু বলার আগেই সে বলে উঠল, না, আমি তোমায় জানি না। তবে তুমি যে-ই হও, তোমার প্রাণরক্ষা করা আমার কর্তব্য ছিল। আমি ইতস্তত করছিলাম, কারণ এই ব্যক্তির নিরাপত্তার ভার রয়েছে আমার উপর। এই ব্যক্তি আহত নিহত হলে গ্রীক সেনাপতি আমায় কঠিন শাস্তি দেবেন। নচেৎ বহু পূর্বেই আমি ওদের আক্রমণ করতাম। চোখের সামনে নারীহত্যা দেখতে আমি অভ্যস্ত নই। ওদের যদি হাতের কাছে পাই, তাহলে তৎক্ষণাৎ হত্যা করব।

বলতে বলতে রুদ্ধ আক্রোশে আজাক্সের প্রকাণ্ড দেহ ফুলে ফুলে উঠল।

যুবক মৃদু হেসে বলল, ওহে গ্রীক! শান্ত হও। শত্রুরা কেউ এখন তোমার সামনে অবস্থান করছে না।

রাজকুমারী বলল, গ্রীক যোদ্ধা আমায় জানে না, জানা সম্ভব নয়। কিন্তু তুমিই বা আমার পরিচয় জানলে কেমন করে?… আর্য! মনে হয় ভ্রমণ করতে করতে ইতিপূর্বে তুমি হয়তো এই রাজ্যে এসেছিলে এবং তখনই আমায় দেখে আমার দেশবাসীর কাছে পরিচয় জানতে পেরেছ তাই নয় কি?

যুবক স্মিতমুখে বলল, না, আগে কখনও তোমায় দেখ নি। অনুমানে মনে হল তুমি বাহিক রাজ্যের রাজকন্যা ছায়া।

অনুমান! তুমি আমার নামটাও অনুমান করতে পেরেছ? ছায়ার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ঘনীভূত, এমন নির্ভুল অনুমান অসম্ভব।

তবে শোনো রাজকন্যা, যুবক বলতে শুরু করল, আমি জানি তোমার পিতার মৃত্যুর পর তোমার পিতৃব্য অপ্রাপ্তবয়স্কা ভ্রাতুস্পুত্রীর নামে রাজ্যশাসন করছে। এখন নির্দিষ্ট বয়সের সীমা পার হয়ে রাজকন্যার রাজ্যপ্রাপ্তির সময় এগিয়ে এসেছে, তাই দুরাচার পিতৃব্য রাজকন্যাকে অর্থাৎ তোমকে হত্যা করতে সচেষ্ট হয়েছে। বাকি রাজ্য মগধের অনুগত মিত্র রাজ্য। অতএব ছায়া নামক উক্ত রাজকন্যা মগধের রাজা নন্দকে বিশ্বস্ত অনুচরের সাহায্যে পত্র পাঠিয়ে সব কিছু জানায় এবং মগধরাজ্যের নিকট বিচার প্রার্থনা করে। কিন্তু তোমার পিতৃব্য প্রচুর উৎকোচ দিয়ে নাজকে বশীভূত করে বিপদ থেকে উদ্ধার পায়। আরও একটি সংবাদ আমার কর্ণগোচর হয়েছে– তরুণী রাজকন্যা নাকি অসি চালনায় অতিশয় দক্ষ। বাহ্রিক রাজ্যের সীমান্তে দেখলাম অসিহস্তে এক তরুণীর আশ্চর্য রণকৌশল অনুমান করলাম এই তরুণী নিশ্চয় রাজকন্যা ছায়া কারণ বীরপ্রসবিনী ভারতে বহু নিপুণ যোদ্ধার দর্শন পাওয়া গেলেও অসিচালনায় সিদ্ধহস্ত রাজকন্যা বিশেষ সুলভ নয়।

রাজকন্যা নীরবে শ্রবণ করছিল এইবার সে মৌনভঙ্গ করল, আশ্চর্য ধীশক্তি!… কিন্তু বাহিক রাজ্যের সকল সংবাদ জানা না থাকলে অতিশয় বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষেও আমার সঠিক পরিচয় অনুমান করা সম্ভব নয়। মগধের রাজসভায় নিশ্চয়ই তোমার যাতায়াত আছে- নতুবা এই সকল গোপনীয় সংবাদ তোমার পক্ষে জানা অসম্ভব। কে তুমি?… নীরব কেন? আমার কাছে পরিচয় দিতে কি তোমার আপত্তি আছে?

যুবক হাসল, রাজকন্যা! মগধের রাজসভায় আমার যাতায়াত আছে একথা স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই।

–তোমার নাম? দেখে মনে হয় তুমি ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। তবে আমার অনুমান ভুল হতে পারে।

–আমার নাম সুবন্ধু। রাজকন্যার অনুমান ভুল নয়। আমি ভাগ্যান্বেষী বটে। রথচালনা ও যুদ্ধ আমার পেশা।

-আর্য! এখন ফাল্গুন মাস। আগামী পূর্ণিমার রাত্রি অতিবাহিত হলে তুমি এই রাজ্যে এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ কর। হয়তো আমি তোমায় কিছু আনন্দ দান করতে পারব ভাগ্যান্বেষী সৈনিকের কিছু চাহিদাও হয়তো আমি ওই সময়ে পূরণ করতে পারব। তুমি যদি আমার স্বজাতি হতে তাহলে তরবারি সম্বল করে তোমাকে ভাগ্য অন্বেষণ করতে দিতাম না। কিন্তু তা হওয়ার নয়।

সুবন্ধু গভীর স্বরে বলল, রাজকন্যা! ফাল্গুনী পূর্ণিমার পর আমি বোধহয় এই রাজ্যের কাছাকাছি থাকব না। কিন্তু কী তুমি আমায় দিতে চাও, জানি না। আমি সেই দানের যোগ্য কি না, তাও জানি না। তবে তোমায় আমায় জাতিগত ভেদ নেই, আমি তোমার স্বজাতি বটে।

–কী বলছ! তোমার মুখ, অবয়ব, সর্বাঙ্গ বলে দিচ্ছে তুমি আর্যবংশে জন্মগ্রহণ করেছ। আর রাজদুহিতা হলেও আমি অনার্য নারী! তুমি আমার স্বজাতি হও কেমন করে?

–আমি ভারতবাসী। তুমিও তাই। অতএব আমরা একই জাতির অন্তর্গত।

–আর্য ও অনার্য একই জাতির অন্তর্গত বলতে চাও?

আমরা সকলেই ভারতবাসী, সকলেই ভারতীয় আর্য ও অনার্যের প্রভেদ আমি মানি না।

পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে সুবন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছায়া বলল, আর্য! তুমি কোনো অনার্য কুমারীকে বিবাহ করতে পারো?

–না, রাজকন্যা। আর্য বা অনার্য কোন রমণীর বরমাল্য আমায় আকর্ষণ করে না। কারণ—

বাক্য অসমাপ্ত রেখে সুবন্ধু স্তব্ধ হল। শ্লেষতিক্ত কণ্ঠে ছায়া প্রশ্ন করল, কারণ? তুমি কি চিরকুমার থাকতে চাও?

দূর দিগন্তের দিকে দৃষ্টি সঞ্চালিত করল সুবন্ধু, রাজকুমারী! আমার চোখের সামনে রয়েছে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে সফল করাই আমার একমাত্র কর্তব্য। বিবাহের কথা এখন আমি চিন্তা করতে পারি না।

রাজকন্যার মুখের উপর থেকে রুদ্ধ রোষের ছায়া মিলিয়ে গেল, স্নিগ্ধস্বরে সে প্রশ্ন করল, কী সেই স্বপ্ন? আমি শুনতে পাই না?

গভীর স্বরে সুবন্ধু বলল, আমি এক অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখি। এই ভারতবর্ষ ভীমার্জুনের স্বদেশ, এখানে বীরের অভাব নেই, অভাব আছে সংহত ঐক্যের।

একটু থেমে সে আবার বলল, এই ছোটো ছোটো পার্বত্য-রাজ্যের রাজারা যদি নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহে শক্তিক্ষয় না করে মিলিতভাবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ রোধ করার চেষ্টা করতো, তাহলে কোনোদিনই বিদেশির পায়ের তলায় ভারতের বক্ষ ক্লিষ্ট ও পিষ্ট হত না।

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠল সুবন্ধু, রাজকুমারী ছায়া। আমি তোমায় একটি ভবিষ্যদ-বাণী করছি, শুনে রাখো। এই খণ্ড ছিন্ন ভারতকে আমি একতার বন্ধনে আবদ্ধ করব; –সেই ঐক্যবদ্ধ ভারতের বুক থেকে অশুভ প্রেতের মতো সাম্রাজ্যবাদী শত্রুকে আমি বিতাড়িত করব।

হে আর্যযোদ্ধা সুবন্ধু! কর্কশস্বরে বলে উঠল আজাক্স, তোমার কথা বলার ভঙ্গি আমার ভালো লাগছে না। সেনাপতি সেলুকাস যদি তোমার নিরাপত্তার ভার আমাকে না দিতেন, তাহলে এই মুহূর্তে আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতাম।

চকিতে ফিরে দাঁড়িয়ে আজাক্সকে সম্বোধন করল সুবন্ধু, আজাক্স! আমায় ক্ষমা করো। ব্যক্তিগতভাবে তুমি আমার শত্রু নও। মহাবীর আলেকজান্ডারের রণনীতি ও কৌশল আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু ভারতবাসী হিসাবে আমার তো কিছু ক্ষোভ, কিছু অভিযোগ থাকতে পারে?

আবার ছায়ার দিকে ফিরল সুবন্ধু, রাজকন্যা! আমার প্রধান অভিযোগ গ্রীসের বিরুদ্ধে নয়, আমার অভিযোগ কিছু দেশদ্রোহী ভারতীয়ের বিরুদ্ধে। তাদের সঙ্কীর্ণ চিত্ত কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থের চিন্তায় মগ্ন, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে তারা উদাসীন। জানো, তক্ষশীলার রাজা কী বলেছিলেন?

–কী বলেছিলেন?

আজাক্সের মুখের দিকে তাকিয়ে আত্মসংবরণ করল সুবন্ধু, এসব কথা থাক। রাজকন্যা, এইবার আমাদের বিদায় গ্রহণের সময় হয়েছে।

সুবন্ধুর কথায় সায় দিয়েই যেন উচ্চভূমি থেকে তীব্র হ্রেষাধ্বনিতে অস্তিত্ব ঘোষণা করল অঞ্জন।

আকাশের দিকে চোখ তুলে রাজকন্যা বলল, হ্যাঁ, অনেক বেলা হল। দিনের আলো থাকতে থাকতেই এই শ্বাপদসংকুল অরণ্য আমায় পার হয়ে যেতে হবে।

অরণ্য পার হবে? সুবন্ধু বিস্মিত স্বরে বলল, কেন? তুমি কি তোমার রাজ্যে ফিরতে চাও না?

-না, অন্তত আজ নয়। রাজপ্রাসাদে ফিরে গেলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত আজ না হয় কাল, দুদিন আগে অথবা দুদিন পরে।

ঠিক কথা, সুবন্ধু মাথা নাড়ল, এই ঘাতকের দলকে নিশ্চয়ই তোমার পিতৃব্য নিযুক্ত করেছে। না, ওখানে তোমার যাওয়া চলে না। গুপ্তঘাতকের অসি বা ছুরি যে-কোনো সময়ে তোমার প্রাণহরণ করতে পারে।

ছায়া হাসল, প্রাসাদের মধ্যে গুপ্তঘাতককে নিযুক্ত করা পিতৃব্যের পক্ষেও বিপজ্জনক। অস্ত্রাঘাতে আমায় হত্যা করলে প্রাসাদের কিছু প্রহরী তা বুঝতে পারবে। প্রহরীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্বস্ত মানুষ, উৎকোচে তাদের সকলকে বশীভূত করা সম্ভব নয়– আমাকে ঘাতকের সাহায্যে হত্যা করা হয়েছে জানলে তারাই হয়তো পিতৃব্যকে আক্রমণ করবে। ব্যাপারটা জানাজানি হলে প্রজারাও বিদ্রোহ করতে পারে।

তবে? তবে তুমি প্রাসাদে ফিরছ না কেন?

 গুপ্তঘাতকের অসি বা ছুরিকে বাধা দেওয়া যায়, ছায়া বলল, কিন্তু ক্রমাগত বিষাক্ত খাদ্য বা পানীয় পরিবেশনের চেষ্টা হলে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব।

-কী সর্বনাশ! তোমাকে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা হয়েছে নাকি? তবে শোনো, রাজকুমারী বলতে শুরু করল, গতকল্য অপরাহ্নে অন্যান্য দিনের মতোই আমি গুরুগৃহে মল্লযুদ্ধ ও অসিচালনা অভ্যাস করছিলাম–

বাধা দিয়ে বিস্মিতকণ্ঠে সুবন্ধু বলে উঠল, মল্লযুদ্ধ! তুমি কী মল্লযুদ্ধ জানো না কি?

স্মিতমুখে রাজকন্যা বলল, জানি। কিন্তু তাতে বিস্ময় প্রকাশ করছ কেন? আমার পিতার পুত্র সন্তান নেই, আর আমিও রণবিদ্যার প্রতি বাল্যকাল থেকেই আকৃষ্ট- তাই আমার পিতা আমায় পুত্রসন্তানের মতোই অন্যান্য পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে রণবিদ্যার বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষিত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সুবন্ধু! তুমি কি জানো না মল্লযুদ্ধ না জানলে রণবিদ্যার পাঠ সম্পূর্ণ হয় না?

-সত্য বটে। কিন্তু নারীর পক্ষে মল্লযুদ্ধে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব নয়।

–অবশ্যই সম্ভব। যদি বিশ্বাস না হয় তবে তুমি আমায় পরীক্ষা করে দেখতে পারো।

না, না, সুবন্ধু হাত তুলে বলে উঠল, রাজকুমারী! আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি। অসিচালনায় তোমার দক্ষতা আমি দেখেছি, মল্লযুদ্ধে তোমায় পরীক্ষা করতে গিয়ে নিজের প্রাণবিপন্ন করতে আমি রাজি নই।

আজাক্স এতক্ষণ নীরব ছিল, এইবার প্রচণ্ড অট্টহাস্যে স্তবতা ভঙ্গ করে সে বলে উঠল, আমিও তোমার কথা বিশ্বাস করি, রাজকন্যা! পক্ষান্তরে নারীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করলেও পুরুষের গৌরব নেই, কিন্তু পরাজয়ের লজ্জা অপরিসীম। আমার সঙ্গী সাহসী যোদ্ধা, তবে নির্বোধ গোঁয়া নয়।

মৃদু হেসে সুবন্ধু বলল, রাজকুমারী! অনর্থক বিতর্কে কালহরণ করা অনুচিত। আমাদের সকলের কাছেই সময় অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু তোমাকে কীভাবে বিষপ্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল, আমি সেই ঘটনার বিবরণ জানতে উৎসুক। তুমি যদি আমায় সমস্ত ঘটনা জানাও তাহলে খুশি হব। অনুগ্রহ করে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করে মূল্যবান সময়ের অপচয় কোরো না।

–সুবন্ধু! আমি অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাইনি। তুমি মল্লযুদ্ধে আমার পারদর্শিতা সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছ বলেই মূল্যবান, সময়ের অপচয় হল।

আমি ত্রুটি স্বীকার করছি। এইবার সমস্ত ঘটনার বিবরণ জানিয়ে আমার কৌতূহল নিবৃত্ত করো।

আমার নয়, আমাদের, দৈত্যাকৃতি আজাক্স গম্ভীরস্বরে বলল, আমিও তোমার তিক্ত অভিজ্ঞতার বিবরণ জানতে উৎসুক হয়ে পড়েছি; রাজকন্যা!

তোমাদের কৌতূহল চরিতার্থ করতে আমার আপত্তি নেই, রাজকন্যা আবার বলতে শুরু করল, আমার সঙ্গে আরও দুজন সহযোদ্ধা মল্লযুদ্ধ ও অসিচালনা শিক্ষা করছিল। সম্মুখে দাঁড়িয়ে নির্দেশ ও উৎসাহ দিচ্ছিলেন যুদ্ধব্যবসায়ী আচার্য। অনুশীলন শেষ হলে আমার দুই সঙ্গী বিদায় গ্রহণ করল। আমিও বিদায় চাইলাম। বাধা দিয়ে আচার্য বললেন, বৎসে! তোমার গুরুপত্নী তোমার জন্য কিছু মিষ্টান্ন প্রস্তুত করেছেন। আমার প্রতি নির্দেশ আছে অনুশীলনের পর যেন তোমাকে অন্দরমহলে নিয়ে যাই। অতিশয় ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম, সাগ্রহে অন্দরমহলে প্রবেশ করে গুরু ও গুরুপত্নীর আদেশ পালন করতে সচেষ্ট হলাম। শুধু মিষ্টান্ন নয়, অতিশয় সুস্বাদু শল্যপক্ক মাংসও আমার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। সুবন্ধু! তুমি এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝেছ আমি অন্যান্য রমণীর ন্যায় লজ্জাশীলা নই।.. ক্ষুধার তাড়নায় বিবিধ খাদ্যসামগ্রীর উপর এমন প্রচণ্ড সুবিচার করলাম যে, গুরুপত্নী স্নেহের বশবর্তী হয়েও আমাকে অধিকতর খাদ্যগ্রহণের জন্য অনুরোধ করতে সাহসী হলেন না। সম্ভবত: তিনি ভেবেছিলেন অত্যাধিক আহার্য গ্রহণের ফলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ব। আমার শিক্ষাদাতা আচার্য অবশ্য জানতেন আমার পাকযন্ত্র সহজে বিপন্ন হবে না, তাই আহার সমাপ্ত হলে তিনি আমার উদ্দেশ করে সস্নেহে বললেন, বৎসে! তুমি যে লজ্জার বশবর্তী হয়ে দেহকে বঞ্চিত কর নি, তাতে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। কঠিন ব্যায়াম ও অনুশীলন, প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য এবং যথেষ্ট বিশ্রাম যোদ্ধার দেহকে বলিষ্ঠ করে তোলে। প্রথম দুটি কার্য তুমি সম্পন্ন করেছে, এখন তৃতীয় কার্যটি, অর্থাৎ বিশ্রাম বা নিদ্রার জন্য তুমি গৃহে গমন করো।

গুরুপত্নী স্বামীকে উদ্দেশ করে বললেন, তুমি কন্যাকে গৃহে পৌঁছে দিয়ে এস। রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে, দেহরক্ষীরাও এখানে উপস্থিত নেই। অতএব, আর্যপুত্র! রাজকন্যাকে নিরাপদে রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দেওয়া তোমার কর্তব্য।

গুরুপত্নীর উদবেগ স্বাভাবিক, কারণ অন্যান্য দিন সন্ধ্যার সময়ই আমি গৃহে ফিরে যাই। কিন্তু সেইদিন আমার বিলম্ব ঘটেছিল। বিদায় গ্রহণের সময় দেখলাম রাত্রির অন্ধকার ঘনীভূত। আচার্য আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হতেই আমি বাধা দিয়ে বললাম, রাত্রি এখনও গম্ভীর হয় নি। পথে বিপদ-আপদ হওয়ার সম্ভাবনা বিশেষ আছে বলে মনে হয় না। আর যদি সেরকম কিছু ঘটে এবং সঙ্গে তরবারি থাকা সত্ত্বেও যদি আমি আত্মরক্ষা করতে না পারি, তবে এতদিন আমি বৃথাই অসিচালনা শিক্ষা করেছি।

গুরুপত্নী আমার প্রস্তাবে সম্মতি না দিলেও শিক্ষাদাতা আচার্য আমায় সমর্থন করলেন, ছায়া সত্য কথাই বলেছে। অস্ত্রের সঙ্গে যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে, প্রতিমূহুর্তে তার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং বিশ্বস্ত মিত্রের ন্যায় অস্ত্রই তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়। ছায়া নারী হলেও নিতান্ত অবলা নয়– বিপদের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা তার আছে। বৎসে! তুমি একাকী গৃহে গমন করতে পারো। তোমার তরবারি তোমার সঙ্গী হবে, আমার উপস্থিতি অনাবশ্যক।

গুরুভোজনের পর আমি তখন বিশ্রামের জন্য লালায়িত অতি সত্বর পদচালনা করে গৃহে ফিরে এসে আমার পালঙ্ক আশ্রয় করলাম।

দীহা নামে আমার একটি বালক ভৃত্য ছিল। আচার্যের গৃহে রণবিদ্যা অনুশীলনের পর গৃহে ফিরে এলে সে আমার পরিচর্যা করত। কঠিন ব্যায়ামের পর অঙ্গসংবাহন অতিশয় আরামদায়ক এবং প্রয়োজনীয় হলেও সকলের পক্ষে ওই বিলাসিতা ভোগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু রাজদুহিতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি বলে ওই ধরণের সেবা পাওয়া আমার পক্ষে কঠিন ছিল না। পালঙ্কের উপর আমি শয্যাগ্রহণ করতেই দীহা নামক বালক ভৃত্যটি অন্যান্য দিনের মতো আমার পরিচর্যায় মনোনিবেশ করল। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে নিরস্ত করতে সচেষ্ট হলাম। বালক কর্ণপাত করল না, পদসংবাহন করতে করতে বলল, রাজকুমারী! আজ তোমার যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে ভালোভাবে হাত-পা টিপে দিলে আরাম পাবে, ভালো ঘুম হবে।

আমি বালকটিকে কনিষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় স্নেহ করতাম, হেসে বললাম, আরাম যে হচ্ছে তাতে নেই। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, মর্দনের ফলে আড়ষ্ট মাংসপেশি এখন শিথিল হয়ে এসেছে– শুধু নিজের সুখের জন্য তোকে অনর্থক কষ্ট দিতে চাই না।

বালক পূর্বের মতোই আমার পদযুগলের উপর হাত চালাতে চালাতে বলল, আমার কিছু কষ্ট হচ্ছে না। তুমি চুপ করো।

আমাদের মধ্যে প্রভুভৃত্যের সম্পর্ক অনেক আগেই ভ্রাতাভগ্নীর স্নেহে পর্যবসিত হয়েছিল। পদসংবাহনের ফলে আমার চোখে-মুখে নিশ্চয়ই সুখ-অনুভূতির চিহ্ন ফুটে উঠেছিল, তাই বালক দীহা আমার নিষেধ অমান্য করেই পদসেবা করতে লাগল।

এইসময় খাদ্য ও পানীয় নিয়ে এক দাসী কক্ষে প্রবেশ করল এবং মেঝের উপর একটি স্কুল কাষ্ঠাসনের উপর বিবিধ খাদ্যদ্রব্যে পরিপূর্ণ স্থালী ও পরিপূর্ণ পানপাত্র স্থাপন করে বলল, কুমারী! আপনার আহার্য গ্রহণ করুন। আমি পরে এসে আপনার উচ্ছিষ্ট পাত্র নিয়ে যাব।

দাসী প্রস্থান করার সঙ্গেসঙ্গে বালক দীহা উঠে বলল, রাজকুমারী! তুমি ভোজন করো। আমি যাচ্ছি।

আমি হাত নেড়ে তাকে নিষেধ করে বললাম, শোন দীহা! গুরুগৃহে প্রচুর পরিমাণ আহার্য উদরস্থ করার ফলে আমার এখন ক্ষুধা নেই। তুই আমার খাদ্য গ্রহণ কর।

বালক লোলুপদৃষ্টিতে ভোজ্যবস্তু ও দুগ্ধপূর্ণ পানপাত্রের দিকে তাকাল, তারপর একবার লোভসংবরণ করার চেষ্টা করল, না, না, তুমি খেয়ে নাও।

আমি ক্রোধের ভাণ করে বললাম, আমার ক্ষুধা নেই, তুই যদি এই খাদ্য গ্রহণ না করিস, তাহলে সমুদয় আহার্য নষ্ট হবে।

বালক আর আত্মসংবরণ করতে পারল না, আহার্যের সম্মুখে উপবেশন করল, তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

আমিও হেসে ফেললাম। এই রাজভোগ্য আহার্য বালক দীহার ভাগ্যে কদাচিৎ সংগৃহীত হয়, অতএব তার পক্ষে লুব্ধ হওয়া স্বাভাবিক। নিতান্তই চক্ষুলজ্জার জন্য সে আহার্য গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করেছিল।

.. ভোজ্যবস্তু নিঃশেষ করে বালক ক্ষীরের মতো ঘন দুগ্ধপূর্ণ পাত্রের দিকে চাইল, তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো কিছুই খেলে না, দুধটুকু পান করলে ক্ষতি কী?

আমি বললাম, বারংবার এক কথা বলতে ভালো লাগে না। বলেছি তো ক্ষুধা নেই। তোর যদি খেতে ইচ্ছা না করে তবে রেখে দে। দাসী এসে নিয়ে যাবে। ওই দুধ পান করার জন্য লোকের অভাব হবে না।

বালক এইবার দুধে চুমুক দিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মুখ থেকে দুধের পাত্র নামিয়ে বলল, দুধে যেন কেমন একটা অন্যরকম স্বাদ।

অন্যরকম স্বাদ!… তোর ভালো লাগছে না? আমি বললাম, তাহলে থাক। ভালো না লাগলে দুধ পান করার দরকার নেই। পাত্র রেখে দে।

বালক কিছু বলতে গিয়ে হঠাৎ মুখ বিকৃত করল। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, কি হল? অমন করছিস কেন?

পেটে হাত দিয়ে যাতনারুদ্ধ স্বরে বালক বলল, ওঃ জ্বলে গেল! জ্বলে গেল!

পরক্ষণেই তার কণ্ঠরুদ্ধ হল, মাটিতে শুয়ে পড়ে দুই একবার ছটফট করে বালক দীহা স্থির হয়ে গেল!

স্তম্ভিত বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, ধীরে ধীরে নির্মম সত্য আমার মস্তিষ্কে আঘাত করল বিষ! দুগ্ধে বিষ মিশ্রিত করে আমায় হত্যা করার চেষ্টা হয়েছে। নিয়তির নির্দেশে আমি পরিত্রাণ পেয়েছি, অদৃশ্য ঘাতকের শিকার হয়েছে বালক দীহা! দ্রুত চিন্তা করতে লাগলাম। যে-দাসী খাদ্য পানীয় আমায় পরিবেশন করেছে, সে দুগ্ধে বিষ মিশ্রিত করতে পারে। কিংবা তার অগোচরে অন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষেও দধে বিষ দেওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু এই দম্ভার্যের জন্য যে-ব্যক্তি দায়ী, তাকে চিনতে আমার ভুল হয় নি। অর্থলোভে পেশাদার ঘাতক দুগ্ধে বিষ মিশিয়েছে, নেপথ্য থেকে সেই ঘাতকের হাতকে চালনা করেছেন আমার স্নেহময় পিতৃব্য এই নির্মম সত্য উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে একথাও বুঝলাম এই গৃহে অবস্থান করলে আমার অপঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত। দীহার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার আগেই আমি গৃহত্যাগ করতে মনস্থ করলাম। দাসী উচ্ছিষ্ট পাত্র স্থানান্তরিত করার জন্য কক্ষে প্রবেশ করার আগেই আমি দ্বাররুদ্ধ করলাম। দাসী কক্ষে করাঘাত করেও আমার সাড়া না পেয়ে ফিরে গেল। সে যদি নিরপরাধ হয়ে থাকে তাহলে আমাকে নিদ্রায় আচ্ছন্ন মনে করে ফিরে গেছে আর যদি সে সত্যই দুগ্ধে বিষ প্রয়োগ করে থাকে তাহলে সাড়া না পেয়ে আমার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পুরস্কারের আশায় বিভোর হয়ে সুখস্বপ্নে রাত্রিযাপন করেছে। তবে বিষপ্রয়োগ যে-ই করুক, সে যে আমার পিতৃব্যের নির্দেশেই ওই দুষ্কার্য করেছে তা বুঝতে আমার বিলম্ব হয় নি। অতএব বিষ কে দিয়েছে, তা নিয়ে আর মস্তিষ্ক ঘর্মাক্ত করলাম না। বেশ পরিবর্তন করে কটিদেশে কোষবদ্ধ তরবারি স্থাপন করলাম, তারপর বাতায়ন-পথে দৃষ্টিকে সঞ্চালিত করে প্রভাতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম…

চন্দ্র যখন অস্তায়মান, অন্ধকার যখন ধূসর হয়ে ঘোষণা করছে প্রভাতের আসন্ন আগমন তখনই দ্বার খুলে আমি প্রাসাদের বাইরে পদার্পণ করলাম।

দুজন প্রহরী বিনিদ্রচক্ষে দ্বাররক্ষা করছিল। আমায় দেখে বিস্মিত হলেও তারা অভিবাদন জানাতে ভুল করে নি। মস্তকের মৃদু সঞ্চালনে প্রতি-অভিবাদন জানিয়ে আমি সম্মুখে অগ্রসর হলাম।

কিন্তু প্রহরীরা তাদের রাজকন্যাকে শেষরাত্রে একাকী ভ্রমণ করতে দিতে রাজি হল না, একজন এগিয়ে এসে বলল, রাজকুমারী! এখন অন্ধকার আছে। পথ এখনও নিরাপদ নয়। আপনি এমন অসময়ে একাকী কোথায় চলেছেন?

আমি প্রহরীর দিকে দৃকপাত না করে বললাম, রাত্রে ভালো নিদ্রা হয় নি। তাই একটু প্রাতভ্রমণের প্রয়োজন বোধ করছি।

প্রহরী সবিনয়ে বলল, এখনও অন্ধকার আছে। পথে-ঘাটে সুযোগ-সন্ধানী দুবৃত্তের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ হতে পারে। তাছাড়া অন্যরকম বিপদের ভয়ও আছে- নিকটস্থ পাহাড় ও জঙ্গল থেকে অনেক সময় বন্যজন্তুরা লোকালয়ে বিচরণ করতে আসে, দৈবাৎ তাদের সম্মুখীন হলে আপনার বিপদ ঘটতে পারে। যদি অনুমতি করেন তাহলে আপনার দেহরক্ষী হয়ে আমি আপনার সঙ্গে যেতে পারি। আমার সঙ্গী ততক্ষণ দ্বাররক্ষা করবে।

আমি বুঝলাম প্রহরী আমার শুভাকাঙ্খী, সে সম্ভাব্য বিপদের মুখে আমায় ছেড়ে দিতে চায় না। তবু আমার প্রকৃত উদ্দেশ্য তাকে প্রকাশ করে বলা সমীচীন হবে না বিবেচনা করে রূঢ়স্বরে বললাম, আমার দেহরক্ষীর প্রয়োজন নেই। এক একাধিক দুবৃত্ত যদি আমার সম্মুখীন হয়, তাহলে বিপদ হবে তাদের আমার নয়। তোমাদের রাজকন্যা নিতান্ত অবলা নয় একই জানো না? আর বন্যপশু? তারা সচরাচর লোকালয়ে আসে না, আর এলেও সহজে মানুষকে আক্রমণ করে না। যদি নিতান্তই সেরকম কিছু ঘটে, কোনো দুঃসাহসী পদ যদি আমাকে আক্রমণ করে, তাহলে, তাকে নিবারণ করার জন্য এই তরবার-ই যথেষ্ট অপরের সাহায্য অনাবশ্যক।

প্রহরী আর প্রতিবাদ করতে সাহস পেল না। আমি মন্থরচরণে স্থান ত্যাগ করলাম। দ্রুত পদচারণা করলে প্রহরীর মনে কোনো সন্দেহ জাগতে পারে তাই এই সতর্কতা। প্রহরীদের দৃষ্টির অন্তরালে যাওয়া মাত্রই অতি দ্রুতবেগে চলতে শুরু করলাম এবং কিয়কালের মধ্যেই অরণ্যগর্ভে উপস্থিত হলাম। কিন্তু বেশিদূর যাওয়ার আগেই মুখোশধারী একদল দুবৃত্ত আমায় আক্রমণ করল। প্রভাতে বালক ভূত্য দীহার মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার পরেই বোধহয় আমার পিতৃব্য অনুমান করেছিল আমি গৃহত্যাগ করেছি– নচেৎ অকস্মাৎ মুখোশধারী গুপ্তঘাতকের আবির্ভাব ঘটবে কেন? এই রাজ্যে প্রজাবৰ্গ আমায় ভালোবাসে, আমার মৃত্যুকে পিতৃব্য ভিন্ন অপর কোনো ব্যক্তির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যাই হোক, আজ আমি যাচ্ছি কিন্তু শীঘ্রই হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে আমি ফিরে আসব।

উত্তম সংকল্প, সুবন্ধু বলল, কিন্তু কী আশ্চর্য! ভাগ্যদবতা কি একই সময়ে একসঙ্গে আমাদের উভয়ের ললাটলিপি রচনা করেছেন।

রাজকন্যা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না! সুবন্ধু! তুমিও কী—

বাধা দিয়ে সুবন্ধু বলল, রাজকুমারী! আমার আজ কোনো প্রশ্ন করো না। যদি কোনোদিন সময় আসে, তাহলে আমার কথার অর্থ তোমায় বুঝিয়ে দেব। যদি বেঁচে থাকি, যদি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় তাহলে তোমার ন্যায় বীরাঙ্গনার সাহায্য আমার প্রয়োজন হবে। কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে- হে আমার পথের বান্ধবি! আজ বিদায় দাও।

রাজকন্যা বলল, হ্যাঁ আমার পক্ষেও আর বিলম্ব করা উচিত নয়। তবে যদি কিছু মনে না করো তাহলে বিদায় গ্রহণের পূর্বে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দেবে সুবন্ধু?

—বলো।

তোমার কি বিশেষ প্রয়োজনীয় কোনো কাজ আছে? সেই কাজের জন্য কি এই মুহূর্তেই তোমার স্থানত্যাগ করা প্রয়োজন?

-এই কথা কেন জিজ্ঞাসা করছ, রাজকন্যা?

–যদি কিছুদিনের জন্য আমার সঙ্গী হতে রাজি হও, আগামী ফাল্গুনী পর্ণিমার রাত্রি পর্যন্ত যদি আমায় সাহায্য করতে রাজি থাকো তাহলে আমি বিশেষ উপকৃত হব।

রাজকুমারী! তোমাকে সাহায্য করতে পারলে, তোমার কোনো কার্য সাধন করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। কিন্তু তা হওয়ার নয়।

সুবন্ধু! যদি ধৃষ্টতা মার্জনা করো তাহলে প্রশ্ন করব তোমার ন্যায় যুদ্ধ ব্যবসায়ী সৈনিক কোন গুরুত্বপূর্ণ কার্যে ব্যাপৃত হয়ে কিয়ৎকালের জন্যও তার কার্য থেকে নিবৃত্ত হয়ে এক বিপন্ন রাজকন্যাকে সাহায্য করতে অসম্মত? তুমি পেশাদার সৈনিক– প্রচুর অর্থের জন্য প্রাণবিপন্ন করতেও তোমার আপত্তি হওয়ার কথা নয়।

রাজকুমারী ছায়া! বিশ্বাস করো যদি সম্ভব হত তাহলে দ্বিতীয়বার আমাকে অনুরোধ করার প্রয়োজন হত না, তোমার ন্যায় অনন্যা রমণীর সেবায় নিযুক্ত হলে আমি সত্যই নিজেকে ধন্য মনে করতাম। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে আমি সম্রাট আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎপ্রার্থী আজাক্স নামে এই গ্রীক সৈনিক আমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে। রাজকুমারী! সম্রাটের সাক্ষাৎলাভ করা আমার মতে সৈনিকের পক্ষে অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। গ্রীক সেনাপতি সেলুকসের অনুগ্রহেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। এই সুযোগ কোনো প্রলোভনেই আমি ত্যাগ করতে পারি না।

তুমি কি গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডারের বেতনভোগী সৈনিক নও?রাজকুমারী সবিস্ময়ে বলল, আমি ভেবেছিলাম সম্রাটের, বেতনভোগী ভারতীয় সেনাদলের অন্তর্গত তুমি এক সৈনিক।

সুবন্ধুর স্পা কুঞ্চিত হল, তোমার এমন ধারণার কারণ কি রাজকুমারী?

-তোমার দেহে সদ্য আঘাতজনিত ক্ষত রয়েছে। ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে গ্রীকসেনাদের মধ্যে অনেকেই ক্ষতচিহ্ন বহন করছে। তাদের সঙ্গী হয়ে যে-সব ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধ করছে, তারাও নিশ্চয়ই রণাঙ্গন থেকে ক্ষতচিহ্নে অলংকৃত দেহ নিয়ে ফিরে আসছে। তোমাকে ক্ষতবিক্ষত দেখে তাই মনে করেছিলাম গ্রীকবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সেনাদলের তুমি এক সৈনিক। তুমি আমার ভুল ভেঙে দেওয়ার পর বুঝতে পারছি ব্যক্তিগত কলহে- হয়তো দ্বন্দ্বযুদ্ধে ব্যাপৃত হয়েই তোমার এই দুর্দশা।

হ্যাঁ রাজকুমারী! সুবন্ধু হাসল, তোমার ধারণা সত্য। স্বেচ্ছায় নয়, নিতান্তই বাধ্য হয়ে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম।

–সুবন্ধু! তোমার আচরণ অতিশয় ভদ্র। তুমি যদি ইচ্ছার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে বাধ্য হও, তাহলে বুঝব তোমাকে যুদ্ধে প্ররোচিত করা হয়েছে। আশা করি সেই ব্যক্তি সমুচিত দণ্ড পেয়েছে।

–অবশ্যই। এই মুহূর্তে বোধহয় অরণ্যগর্ভে তার দেহ শবভোজী শৃগাল ও গৃধিনীর ভক্ষ্যে পরিণত হয়েছে। নিতান্ত দৈবকৃপায় আমি রক্ষা পেয়েছি, নচেৎ আমার শরীরও এতক্ষণে ওইসব মাংসলোলুপ পশুপক্ষীর উদরসাৎ হত। তবে আমাকে কিছু ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে প্রিয় ছুরিকাটি আমার হস্তচ্যুত হয়ে আমার আততায়ীর বক্ষদেশে বিরাজ করছে।

–সেকী! সেটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করলে না কেন?

–ছুরিকা উদ্ধারের চেষ্টা করলে আততায়ীর মৃত্যুকালীন আলিঙ্গনে আমার মৃত্যু ছিল নিশ্চিত। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী যখন মৃত্যুযাতনায় ছটফট করছে, তখনই দুর্জনের সংসর্গ পরিত্যজ্য বিবেচনা করে দ্রুতবেগে স্থানত্যাগ করেছি।

ঘটনার বিবরণ শুনে বুঝতে পারছি তোমার শত্রু অতিশয় বলশালী ছিল। কিন্তু তুমি তো লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত, দূর থেকে শরনিক্ষেপ করে তুমি অনায়াসে শত্রুকে বধ করতে পারতে অন্তত তরবারি ব্যবহার করলেও এমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে না। ছুরিকার সাহায্যে এমন ভয়ানক শত্রুর সম্মুখীন হওয়া নিতান্তই নির্বোধের কাজ।

নরভু ব্যাঘ্র আমাকে সেই সুযোগ দেয় নি। ধনুর্বাণ বা তরবারি হস্তগত করার আগেই সে আমাকে আক্রমণ করে। কোনোক্রমে ছুরিকাঘাতে ব্যাঘ্রকে হত্যা করতে আমি সমর্থ হয়েছিলাম।

ব্যাঘ্র! রাজকুমারীর দুইচক্ষু বিস্ফারিত হল, তুমি যে ব্যাঘ্র কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিলে সে কথা একবারও বল নি তো!

মৃদুহাস্যে ওষ্ঠাধর রঞ্জিত করে সুবন্ধু বলল, তোমার প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে কোনক্রমে উত্তর দিয়ে আমি আত্মরক্ষা করেছি। বিশদ বিবরণ দেওয়ার সুযোগ তুমি তো দাও নি। ব্যাঘ্রের নখদন্তের চাইতে তোমার প্রশ্নবাণ কম মারাত্মক নয়।

রাজকুমারীর মুখে হাসি ফুটল, সুবন্ধু! তুমি কেবল অস্ত্রচালনায় দক্ষ যোদ্ধা নও, বাক্যবিশারদ রসিক পুরুষও বটে!… কিন্তু এইবার আমাদের বিদায় গ্রহণ করতে হবে, আর বিলম্ব সমীচীন নয়।

রাজকন্যা কর প্রসারিত করল। সহাস্যে তার করগ্রহণ করল সুবন্ধু, সঙ্গেসঙ্গে তার ললাটে জাগল কুঞ্চনরেখা! রাজকুমারী তার ভাবান্তর লক্ষ্য করল না, স্মিতমুখে আজাক্সের দিকে ফিরল, বিদেশি যোদ্ধা! বিদায়ের আগে আমি আবার তোমার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

রাজকন্যা তার কর প্রসারিত করল আজাক্সের দিকে। করমর্দন করতে করতে আজাক্স বলল, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রয়োজন নেই। এক সুন্দরী রাজকন্যার প্রাণরক্ষা করতে পেরেছি বলে আমি গর্ববোধ করছি। তোমার বীরত্ব আমায় মুগ্ধ করেছে। হে বীরাঙ্গনা! তুমি গ্রীকসৈনিক আজাক্সের অভিনন্দন গ্রহণ করো।

অতঃপর বিদ্যায়গ্রহণের পালা শেষ। রাজকন্যা গন্তব্যপথের উপর পদচালনা করে পুরুষ সঙ্গীদের পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল… অকস্মাৎ পিছন থেকে ভেসে এল সুবন্ধুর কণ্ঠস্বর, রাজকুমারী! ক্ষণেক অপেক্ষা করো।

রাজকন্যা থমকে দাঁড়াল। দ্রুত পদক্ষেপে সামনে এসে দাঁড়াল সুবন্ধু, রাজকুমারী! যদি কিছু মনে না করো, তোমার হাতটি একবার দেখব।

বিস্মিত রাজকন্যা হাত বাড়িয়ে দিল। দক্ষিণ করপুট নিবি চিত্তে মেলে ধরে পর্যবেক্ষণ করল সুবন্ধু, করাঙ্গুলি ও হাতের পার্শ্বদেশ টিপে ধরে কী যেন দেখল, হাতের উপরিভাগেও দুই একবার অঙ্গুলিচালনা করল, তারপর বলল, এইবার বাঁ হাতটি দেখাও।

বাঁ হাতটিকেও একইভাবে পর্যবেক্ষণ করে হাত ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠল সুবন্ধু, রাজকুমারী! তুমি সত্যই অনন্যা! তুমি অবশ্যই হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবে।

–কী আশ্চর্য! সুবন্ধু! তুমি কি জ্যোতিষচর্চাও করো না কি?

না। জ্যোতিষ নিয়ে আমি কখনও চিন্তা করি নি।

–তবে আমার হাতে তুমি কী দেখলে? কী দেখে তুমি বলছ আমি হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হব?

রাজকুমারী! আমি তোমার হস্তরেখা দেখি নি। ওসব আমি দেখতে জানি না। কিন্তু তোমার সঙ্গে করমর্দন করে আমি চমকে উঠেছিলাম। তোমার করতল কঠিন ও কর্কশ, তাতে বিশেষ বিস্মিত হই নি, কারণ তরবারির হাতলে ক্রমান্বয়ে ঘর্ষিত হলে হাতের তালু কর্কশ হয়, সেখানে কড়া পড়ে কিন্তু অসিচালনা করলে করাঙ্গুলি কঠিন হয় না, করতলের পার্শ্বদেশ মহিষচর্মের ন্যায় কর্কশ হয় না। কেবলমাত্র বিশেষ ধরনের মল্লযুদ্ধ অভ্যাস করলে হাতের অবস্থা ওইরকম হতে পারে।

সুবন্ধু! আমি যে বিশেষ ধরণের মল্লযুদ্ধ অভ্যাস করেছি সেকথা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাই বলে আমি হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারব এমন কথা বলছ কেন? দক্ষ মল্লযোদ্ধা হলেই কি যুদ্ধে জয়লাভ করা যায়?

রাজকুমারী! দীর্ঘকাল প্রাণঘাতী মল্লযুদ্ধের তালিম নিলে রমণীর করতল ওইরকম কর্কশ হয়, মুষ্টির উপরিভাগ ওইরকম প্রস্তরবৎ কঠিন হয়, নমনীয় কোমল করাঙ্গুলি লৌহশলাকার মতো কঠিন হয় যে-নারী তার সুকোমল করপল্লবকে ওইরকম প্রাণঘাতী অস্ত্রে রূপান্তরিত করতে পারে, সে অসাধারণ মানসিক শক্তির অধিকারী। দেহে মনে এমন অসামান্যা রমণী যদি কোনো কর্ম সম্পন্ন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তবে সে অবশ্যই সাফল্য অর্জন করবে এই কথা বুঝতে তোমার হস্তরেখা পরীক্ষার প্রয়োজন হয় না তোমার কঠিন করতল ও মুষ্টি পরীক্ষা করলেই তা সম্যক উপলদ্ধি হয়।

-হ্যাঁ, সুবন্ধু! তোমার কথা সত্য। বিনা অস্ত্রে শুধু হাত ও পা চালিয়ে শত্রুকে হত্যা করার ওই কৌশল খুব কম মানুষই জানে। আমার আচার্য ওই গুপ্তবিদ্যা আমাকে শিখিয়েছেন। আর সুবন্ধু! তুমিও নিশ্চয় ওই দুর্লভ গুপ্তবিদ্যার অধিকারী?… তুমি নীরব থাকলেও আমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি।

ক্ষণকাল চুপ করে কী যেন চিন্তা করল ছায়া তারপর মুখ তুলে কঠিন স্বরে বলল, হ্যাঁ, পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করার জন্য আমি প্রাণপণ করব। দুরাত্মা পিতৃব্যকে যদি উচিত শাস্তি দিতে না পারি, তবে রণাঙ্গনে প্রাণ বিসর্জন দেব। আমি নিতান্ত অবলা নই– তরবারি ধারণ না করে এই বজ্রমুঠি, এই লৌহশলাকার ন্যায় অঙ্গুলি চালনা করেও আমি শত্রুর প্রাণবধ করতে পারি। সবন্ধ। আমার বিপদের সময় যদি তমি আমার পাশে থাকতে আমি অসাধসাধন করা আমার পাশে থাকতে, আমি অসাধ্যসাধন করতে পারতাম। কিন্তু না– যা কিছু করণীয়, তা আমায় একক ভাবেই করতে হবে। আচ্ছা, বিদায়!

একবারও পিছন দিকে না তাকিয়ে রাজকুমারী ছায়া তার গন্তব্যপথ ধরে চলতে শুরু করল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মোহাবিষ্টের মতো দুজনেই রাজকন্যার গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইল। আচম্বিতে ভেসে এল তীব্র হ্রেষাধ্বনি– অঞ্জন চিৎকার করে বিরক্তি প্রকাশ করছে। এতক্ষণ একস্থানে থাকা তার পছন্দ নয়।

আজাক্সের দিকে তাকিয়ে সুবন্ধু বলল, চলো আজাক্স! আমার অশ্ব অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

নীরবে সম্মতি জানিয়ে এগিয়ে গেল আজাক্স- যে-পথ দিয়ে তারা নেমে এসেছিল, সেই পথ ধরেই আজাক্স উপরে উঠতে লাগল, তাকে অনুসরণ করল সুবন্ধু…