ছয়
টেরি ওয়াশবার্ন, প্রথম রোগী, করিডোরে অপেক্ষা করছিলো। কুড়ি বছর আগে হলিউড চিত্রজগতে এক সাড়া জাগানো নাম। অভিনেত্রী জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল বিস্ময়কর ভাবে। ওরিগনের এক কাঠচেরাই ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেছিলেন। সবকিছু ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যায়। এটাই অবশ্য প্রথম নয়, তারপর পাঁচ-ছবার বিয়ের কনের সেজেছিল সে। সব শেষে যে স্বামীর সঙ্গে নিউইয়র্কে বাস করছে সে একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী।
জুডকে দেখে রাগে কাঁপতে কাঁপতে টেরি উঠে দাঁড়ালো–শেষপর্যন্ত এসেছেন, জুডের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল সে। কি হয়েছে আপনার? মনে হচ্ছে কোনো শিং-ওয়ালা। জন্তু আপনাকে গুতিয়ে দিয়েছে?
–ছোটো খাটো একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, মাফ করবেন দেরি হয়ে গেছে।
–ক্যারলের কথা পড়লাম। ওটা কি সেক্স মার্ডার?
–না। জুড দরজা খুললেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি দশ মিনিটের মধ্যেই ডেকে পাঠাচ্ছি।
চেয়ারে বসে জুড ডেক্স ক্যালেন্ডারে নামের তালিকা পড়ে নিলেন। ফোন তুলে একের পর এক ডায়াল ঘুরিয়ে রোগীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার বাতিল করলেন। ফোন রাখলেন। টেরিকে প্রথমে ডেকে পাঠালেন।
টেরি ঘরে ঢুকে কৌচের ওপর শুয়ে পড়ল। স্কার্টটা উঠে গেল। উরুর অনেকখানি, অনাবৃত করে দিল।
একসময় সে ছিল সত্যিকারের সুন্দরী। সেই সৌন্দর্যের রেশ এখনও অস্তগামী সূর্যের শেষ আলোর মতো উদ্ভাসিত। মানুষের চোখ যে কি করে এত আবেদনময়ী হয়ে উঠতে পারে জুড তা জানেন না। নরম দুটি চোখে চির সরলতার চাউনি। মুখে দু-একটা ভাঁজ পড়েছে, কিন্তু আজও ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়। আজও ওর পীনোন্নত বুক আর নিতম্বের হিল্লোল যে কোনো পুরুষের মনে কামনার সঞ্চারণ ঘটাতে পারে। জুডের মনে হল ও বোধহয় সিলিকন ইঞ্জেকসন নিয়ে এসেছে, কিন্তু জুড সেকথাটা প্রকাশ । করলেন না। কথাটা তিনি ওর মুখ থেকেই শুনতে চান।
জুডের অধিকাংশ রোগীনীদের মনের মধ্যে একটা ধারণা জন্মায় যে ডাক্তরবাবু তাদের প্রেমে পড়ে গেছেন। কিন্তু টেরির ব্যাপারটা একেবারে আলাদা। এখানে এসেই জুডের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। ও যে এ বিষয়ে কত দক্ষ তা প্রথম দিনেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। জুডকে প্রলোভিত করার জন্য নারীত্বের যাবতীয় ছলাকলা প্রয়োগ করেছে। অবশেষে জুড নিরুপায় হয়ে ওকে সতর্ক করে দিয়েছেন। বলেছেনস্বভাব না পাল্টালে তিনি ওকে অন্য ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এরপর টেরি অনেকটা সংযত করেছে নিজেকে।
এক বিখ্যাত ইংরেজ চিকিৎসক মারফত এই কেসটা জুডের কাছে এসেছে। একটি জঘন্য আন্তর্জাতিক কেলেঙ্কারিতে টেরির নাম জড়িয়ে পড়েছিল। তাই ভদ্রলোক টেরির চিকিৎসা করতে চাননি। টেরি তখন এক জাহাজ ব্যবসায়ীকে ভালোবাসে। সেই সময় ফরাসী চুটকি পত্রিকায় খবর বেরোলো, ব্যবসাসূত্রে ব্যবসায়ীটি একদিনের জন্য রোমে গিয়েছিল। টেরি একটা পালতোলা নৌকো ভাড়া করে। হবু স্বামীর তিন ভাইয়ের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে যৌনসংযোগ করে। ব্যাপারটা অবশ্য ধামাচাপা দেওয়া হয়। এমনকি পত্রিকার কর্তৃপক্ষ এই খবর প্রকাশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। জুডের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারেই টেরি সব স্বীকার করেছিল।
টেরি বলেছিল–ওঃ, সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা, সেক্স ছাড়া আমি একমুহূর্ত থাকতে পারি না। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য মনের মতো পুরুষ পাই না।, হাত ঘষতে গিয়ে স্কার্টটা ওপরে তুলে ধরেছিল। নিতম্বের বেশ খানিকটা অনাবৃত করে দিয়েছিল। তারপর দেখলো জুড সেদিকে তাকাচ্ছেন না। সে বলেছিল, আমার কথাগুলো বুঝতে পারছেন কি?
প্রথম দিনেই জুড ওর সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনে নিয়েছিলেন। পেনিসিলভিনিয়ার কয়লাখনি ঘেরা ছোট্ট একটা অঞ্চলে ও জন্মেছিল। ওর বাবা ছিল খনি মজদুর। প্রতি শনিবার পাঁড় মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরতো। মাকে গালাগাল দিতো। মারধোর করতো।
তের বছর বয়সেই পূর্ণযুবতী হয়ে ওঠে টেরি। মুখে দেখা দেয় পরীর সৌন্দর্য। এক সময় ও জানলো খনি মজদুরদের অবসর সময়ের সাথী হলে বেশ কিছু পয়সা রোজগার হতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা বাবার মগজে ঢুকে যেতে বিপদ হল। একদিন রাতে লোকটা আকণ্ঠ মদ গিলে বাড়ি ফিরলো। মাকে চুলের মুঠি ধরে তাড়িয়ে দিলো। ভিতরের থেকে দরজা বন্ধ করে টেরিকে মারতে শুরু করলো, তারপর ধর্ষণও করলো নিজের মেয়েকে।
কৌচে শুয়ে শুয়ে টেরি এইসব বর্ণনা দিচ্ছিল। জুড তখন এক দৃষ্টিতে টেরির আবেগ শূন্য মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন।
–আমার মা বাবার সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
–আপনি পালিয়ে গেলেন? জুড আবার বললেন–বলছিলাম কি আপনার বাবা যৌনসংযোগ করার পর
–পালিয়ে গেলাম?
মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে বাঁধ ভাঙ্গা হাসিতে ফেটে পড়েছিল মেয়েটি। বলেছিল–বলছেন কি? ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছিল। আমার ডাইনি মা-টাই তো ওখানে থাকতে দিল না আমাকে।
জুড সুইচ টিপে টেপ রেকর্ডার আবার চালু করলেন। বলুন, আজ কি নিয়ে আলোচনা হতে পারে?
টেরি হেসে বলল–কেন আমরা সেই কথাটাই জানতে চাইছি? আপনি এত সরল তাই নিয়ে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তাহলে কেমন হয়?
জুড অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন ক্যারলের মৃত্যুটাকে সেক্স মার্ডার বলে মনে হচ্ছে কেন?
–আমি সবকিছুর মধ্যে সেক্স খুঁজে পাই। দেহটা মোচড় দিল সে। অকারণে স্কার্টটা বেশ খানিকটা ওপরে উঠে গেল।
–পোশাকটা ঠিক করে নিন।
টেরি গোবেচারা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–ওঃ সরি, ডাক্তারবাবু আপনি কিন্তু শনিবার একটা পার্টি মিস করলেন।
–বলুন না আপনার মুখ থেকেই শোনা যাক।
টেরি কিছুটা দ্বিধা করে বলল–শুনলে আমাকে ঘেন্না করবেন নাকি?
ওর বলার ভঙ্গিমাটা কেমন যেন বেখাপ্পা লাগল জুডের। জুড বললেন–আমি তো আগেই বলেছি, আপনি যা মনে আসবে তাই বলবেন। আমার মতামতের জন্য অপেক্ষা করবেন না। আপনার নিজের বিচারটাকেই প্রাধান্য দেবেন।
একটুক্ষণের নীরবতা। টেরি বলল ওটা ছিল প্রকাশ্য পার্টি। আমার স্বামী আমাকে একটা মেসিন ব্যান্ড এনে দিয়েছে। ওটা কি জিনিস জানেন তো?
মুখে সরলতার চিহ্ন এনে জুড জানতে চাইলেন–কি জিনিস?
এবার খিল খিল হাসিতে হেসে উঠলো ওই অভিনেত্রীটি। তার শরীরের সবখানে হাসির হিল্লোল ছড়িয়ে পড়লো। জুড এক মুহূর্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকালেন। পুরুষ সত্ত্বা হঠাৎ উথলে উঠলো। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। নাঃ, রোগীণীর সাথে এ ধরনের ব্যবহার করা কখনই উচিত নয়।
–ওটাতে নকল পুরুষাঙ্গ লাগানো থাকে। কোমরের সঙ্গে বেল্ট লাগিয়ে ইলেকট্রিক ক্যারেন্টে মেসিনটা চালু করতে হয়, পাশ ফিরে তাকিয়ে টেরি বলল–সব কথা বললে আমাকে ঘেন্না করবেন না তো?
–আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাইছি, মিসেস ওয়াকা বার্ন। আমরা এমন কিছু কাজ করে থাকি যার জন্য আমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।
কৌচে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো টেরি আপনাকে বলেছিলাম না, হ্যারিকে আমি নপুংসক বলে সন্দেহ করি।
–হ্যাঁ।
–বলতে গেলে কোনোদিনই ও আমাকে সেই অর্থে ব্যবহার করেনি। সব সময় একটা একটা বাহানা দিয়েছে। শনিবার রাতে ওর সামনে ব্যান্ডটা ব্যবহার করলাম। হঠাৎ ও কি রকম যেন হয়ে গেল।
কাঁদতে শুরু করে টেরি, জুড, কাগজের রুমাল এগিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করেন–আপনাকে জল দেবো?
–না না। ঠিক আছে, টেরি উঠে বসে। ব্যাগ থেকে নিজের রুমালটা বের করে। নাক মুছে নেয় ও–ক্ষমা করবেন, বোকার মতো কাজটা করে ফেললাম। বুঝতে পারি না আমি কেন হ্যারির মতো একটা পুরুষকে বিয়ে করেছি।
–এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আপনার মতো অনেক নারী একই প্রশ্নের জালে বন্দীজীবন কাটাতে বাধ্য হয়।
–কেমন করে বলবো? আপনি তো একজন সাইক্রিয়াটিস্ট, উত্তরটা আপনারই ভালো জানা আছে। আপনি কি মনে করেন আগে থেকে জানলে আমি কি একটা ক্লীবকে বিয়ে করতাম।
–আপনার কি তাই ধারণা?
–আপনি বলছেন, জেনেশুনেও আমি কি ওকে বিয়ে করতাম?
রাগে কাঁপতে কাঁপতে কৌচ ছেড়ে লাফিয়ে ওঠে টেরি,– নোংরা মন আপনার। ভাবছেন ব্যান্ড কোমরে লাগাতে আমার খুব ভালো লাগে তাই তো?
–কেন ভালো লাগে না?
প্রচণ্ড রাগে উন্মত্ত হয়ে গেল মেয়েটি। জুডকে লক্ষ্য করে একটা ফুলদানী ছুঁড়ে মারলো। সেটা লক্ষ্য ভ্রষ্ট হল। টেবিলে লেগে ফেটে পড়লো-উত্তরটা পেলেন?
–ওটার দাম দুশো ডলার। আপনার বিলের সঙ্গে টাকাটা যোগ হবে।
–সত্যিই কি তাহলে ভালো লেগেছিল?
–আপনিই বলুন।
টেরি গলা নামিয়ে আনলো–আমি নিশ্চয়ই অসুস্থ। হায় ভগবান, আমি অসুস্থ জুড, আমাকে সাহায্য করুন।
জুড এগিয়ে এলেন, আপনাকে সাহায্য করতে গেল আমাকেও আপনার সাহায্য করা দরকার মিসেস ওয়াশ বার্ন। টেরি মাথা নাড়লো।
–আপনি বরং বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা চিন্তা করুন। যখন ওই জিনিসটা ব্যবহার করবেন তখন ভাববার দরকার নেই। চিন্তা করুন তো? কি জন্য ওটা আপনাকে ব্যবহার করতে হচ্ছে? যখন দেখবেন আপনার মনে আর কোনো চিন্তা নেই তখন বুঝতে পারবেন যে কত অজানা তথ্য আপনি জেনে ফেলেছেন।
মুখে স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠলো। রুমাল দিয়ে মেয়েটি নাক মুছলো-ওঃ, আপনি যাদু জানেন। দস্তানা আর হাত ব্যাগ তুলে নেবার পর সে বলল–তাহলে আগামী সপ্তাহে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে কেমন?
–হ্যাঁ, আবার সামনের সপ্তাহে। জুড় করিডোরের দরজাটা খুলে দিলেন।
এই সমস্যার একটা সহজ সমাধান জুডের হাতে ছিল, কিন্তু তিনি ইচ্ছে করেই সমস্যাটা জিইয়ে রাখলেন। মেয়েটা নিজেই সমাধান খুঁজে নিক। ওর অনেক কিছু বোঝা দরকার, ভালোবাসা যে কোনো সময়ে দাম দিয়ে কেনা যায় না। ভালোবাসা, আসে হঠাৎ হাওয়ার মতো। ওই অযাচিত বস্তুটি পাওয়ার আগে নিজের মূল্য উপলব্ধি করতে হবে।
ওর নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে থাকলেন তিনি। সীমাহীন হতাশা আর আত্মবিরাগ মেয়েটিকে এমন হৃদয়হীন করে তুলেছে। মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে টেরি এখন পার হচ্ছে।
টেপটা ঠিক জায়গাতে রেখে দিলেন জুড। নিজের সমস্যার কথা ভাবতে থাকলেন। অবিলম্বে উনিশ নম্বর থানার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
ম্যাকগ্রেভির থমথমে গম্ভীর গলা শোনা গেল–হ্যালো লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি বলছি।
–ডিটিকটিভ সার্জেন্ট অ্যাঞ্জেলিকে ডেকে দেবেন?
–একটু ধরুন।
অ্যাঞ্জেলির গলা–হ্যালো, আমি জুড স্টিভেন্স। খবরটা পেয়েছেন কি?
–আমি খোঁজ নেবো।
–কেবল না বা হ্যাঁ বললেই হবে।
অনেকক্ষণ পর তিনি পরবর্তী প্রশ্নটা করলেন–জিফরেন কি এখনও ওখানেই?
–হ্যাঁ।
–ও আচ্ছা।
–আমি দুঃখিত।
–ধন্যবাদ। আস্তে আস্তে তিনি রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।
বাকি রইলো হ্যারিসন বার্ক। বার্কের সন্দেহ সবাই তাকে হত্যা করতে চাইছেন। জন হ্যানসেন সোমবার দশটা পঞ্চাশ মিনিটে বেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে নিহত হন। এখন দেখতে হবে বার্ক সেই সময় কি করছিলেন? তিনি কি অফিসে ছিলেন? অফিসের নম্বর খুঁজে জুড ডায়াল করলেন।
–ইন্টারন্যাশনাল স্টিল। একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল।
–মিঃ হ্যারিসন বার্ককে একবার লাইনটা দেবেন?
একটি মেয়ে সুরেখা কণ্ঠস্বরে বলল–মিঃ বার্কের অফিস। কে বলছেন?
–আমি ডাঃ জুড স্টিভেন্স। আমাকে কয়েকটা তথ্য জানাতে পারবেন?
–ও, ডাঃ স্টিভেন্স। মেয়েটির কণ্ঠস্বরে স্বস্তি এবং শঙ্কা।
–আমি মিঃ বার্কের বিল সম্বন্ধে বলছি।
–বিল?
জুড দ্রুত বলতে থাকেন–আমার রিসেপসনিস্ট, ও আর নেই। খাতাপত্রগুলো আমি পরিষ্কার করে নিতে চাইছি। ওর খাতায় দেখছিলাম গত সোমবার সকাল সাড়ে নটায় মিঃ বার্কের সঙ্গে আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় লেখা আছে। সময়টা আপনি কি আপনার রেকর্ডের সঙ্গে চেক করে আমাকে জানাবেন।
–এক মিনিট, কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটি ফোন করলো-আপনার রিসেপসনিস্ট নিশ্চয় ভুল করে গেছেন ডাঃ স্টিভেন্স। মিঃ বার্ক সোমবার সকালে কখনই আপনার অফিসে যাননি।
–আপনি নিশ্চিত তো? খাতায় কিন্তু লেখা আছে নটা ত্রিশ থেকে…
–ওই খাতায় কি লেখা আছে তা নিয়ে আমার আদৌ মাথা ব্যথা নেই ডাঃ স্টিভেন্স।
মেয়েটা জুডের নির্বুদ্ধিতায় রেগে ওঠে–মিঃ বার্ক সারা সকাল স্টাফ মিটিং-এ ছিলেন। সকাল আটটা থেকে স্টাফমিটিং শুরু হয়েছিল।
–ঘণ্টাখানেকের জন্য কি ওখান থেকে বেরোনো যায় না।
–মিঃ বার্ক দিনের বেলায় কখনো অফিস থেকে বেরোন না। উনি ফিরলে কি বলবো যে আপনি ফোন করেছিলেন?
–কোনো প্রয়োজন নেই।
–তাহলে? ডাক্তার আবার অতল জলে নিমগ্ন। জিফরেন বা হ্যারিসন বার্কের মধ্যে কেউ তাকে হত্যার চেষ্টা করেন নি। তাহলে? পৃথিবীতে আর কে আছে?
ফোন বেজে উঠলো। রিসিভার কানে লাগালেন ডাক্তার। অ্যানির খসখসে গলাটা শোনা গেল–খুব ব্যস্ত?
–না, বলুন।
–শুনলাম আপনি নাকি গাড়ি চাপা পড়েছিলেন, অ্যানির গলায় উদ্বেগ-খবরটা শুনেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কোথায় পাবো বুঝতে পারিনি।
জুড হালকা চালে জবাব দিলেন–আরে না না, তেমন কিছু মারাত্মক নয়। ওই ঘটনাতে একটা শিক্ষা পেলাম, বেআইনীভাবে হাঁটতে নেই।
–কাগজে লিখেছে গাড়িটি ইচ্ছে করেই আপনাকে চাপা দিতে চেয়েছিল।
–ঠিকই লিখেছে।
–লোকটা ধরা পড়েছে?
–না, মনে হয় ওর মজা করার ইচ্ছে হয়েছিল।
হেডলাইট বন্ধ কালো লিমুজিনের ছবি ভেসে উঠলো জুডের মনের পর্দায়।
–ঠিক জানেন আপনি?
প্রশ্নটা শুনে হঠাৎ অবাক হয়ে গেলেন জুড-হঠাৎ একথা কেন?
–কেন করছি তা আমি নিজেই জানি না। অ্যানির গলা রহস্যময়। ক্যারল মারা গেল, তারপর এই ঘটনা–।
দুটো ঘটনার যোগ তাহলে অ্যানিও করে নিয়েছে? জুড ভাবলেন।
–আমার মনে হয় কোনো বন্দী পাগল রাস্তায় নেমে পড়েছে।
জুড আশ্বাস দিলেন–যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আজ অথবা আগামীকাল পুলিশ তাকে ধরবেই।
–আপনার তেমন চোট লাগেনি তো?
–না। তেমন কিছু হয়নি।
অদ্ভুত একটা নীরবতা বিরাজ করতে থাকে। দুপক্ষই কত কথা বলতে চাইছে কিন্তু কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। নেহাত সৌজন্যের খাতিরে টেলিফোন, কোনো রোগী তার চিকিৎসক সম্পর্কে এটুকু কৌতূহল দেখাতেই পারে। কিন্তু অ্যানির ব্যাপারটা তো একেবারেই আলাদা। অপরিচিত মানুষ বিপদে পড়লে সে খোঁজ খবর নিতে।
–তাহলে শুক্রবার দেখা হচ্ছে।
প্রশ্ন করার মতো কিছু একটা খুঁজে পেলেন জুড।
–ছাড়ি তাহলে? আচ্ছা।
অ্যানির কথা ভাবতে শুরু করলেন তিনি। ওর স্বামীকে কেমন দেখতে? ভদ্রলোককে সুপুরুষ এবং গম্ভীর বলেই মনে হয়। এককালে ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। এখন নামকরা ব্যবসায়ী হয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অকাতরে দান করেছেন। কিন্তু ওর কি এমন সমস্যা যা স্বামীর সঙ্গেও আলোচনা করা সম্ভব হয় না? এমন কি পারিবারিক চিকিৎসকের কাছেও খুলে বলা যায় না? বিয়ের আগে কোনো ঘটনা ঘটেছিল কি? মনে হয় শুক্রবার দিন ও মুখ খুলবে।
বিকেলটা তাড়াতাড়ি কাটলো। যেসব রোগীদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যোগায়োগ করা সম্ভব হয়নি তাদের দেখতে ডাক্তার বাধ্য হলেন। শেষ লোকটি বেরিয়ে গেল। তিনি । হ্যারিসন বার্কের টেপ চালালেন। মন দিয়ে শুনতে শুনতে কিছু লিখতে থাকলেন।
সবটা শুনে টেপ রেকর্ডার বন্ধ করলেন। হতাশায় আচ্ছন্ন হল মন। নাঃ, আর কোনো উপায় নেই। এবার ইস্পাত প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। বার্কের সর্বশেষ অবস্থাটা জানাতে হবে। হঠাৎ জানলার দিকে তাকালেন। অন্ধকার নেমে এসেছে। রাত আটটা বাজে। ক্লান্তি বোধ করতে থাকেন। কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলেন। পাঁজরটা কনকন করছে। হাতটাও অসম্ভব ভারী। বাড়ি গিয়ে গরম জলে স্নান করতে হবে।
বার্কের টেপটা টেবিলের দেরাজে রাখলেন। বাকিগুলো দেওয়ালের গর্তে ঢুকিয়ে দিলেন। টেপটা কোনো মনোবিজ্ঞানীর হাতে তুলে দিতে হবে। ওভার কোট চাপালেন। টেলিফোন বেজে উঠলো। কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে ফোন তুললেন ডাঃ স্টিভেন্স।
কোনো উত্তর নেই, চাপা শ্বাস প্রশ্বাসের আওয়াজ।
–হ্যালো…
উত্তর না পেয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। ভ্রু কুঁচকে উঠলো। ভুল নম্বর হয়তো। ঘুরে দাঁড়ালেন আলোগুলো নেভাতে হবে। বাইরে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করলেন, সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। সব ভাড়াটিয়ারাই চলে গেছে, রাতের শিট এখনও চালু হয়নি। দারোয়ান বিগলো বাদে সম্পূর্ণ বাড়িটাতে আর কোনো জনপ্রাণী নেই।
লিফটের পাশে এসে বোতাম টিপলেন। সংকেত মিটারের কাঁটাটা একটুও নড়লো না। আবার চাপ দিলেন। এবারও একই অবস্থা।
তখনই একটা অঘটন ঘটে গেল, করিডোরের সমস্ত আলোগুলো নিভে গেল একসঙ্গে।
.
সাত
নিচের তলায় আলো জ্বলছে ভেবে সন্তর্পণে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন। ওটাও পুরো অন্ধকার। রেলিং ধরে সাবধানে নামতে শুরু করলেন। নিচতলায় টর্চের আলোর রশ্মি। দেখতে পেলেন। লিফটের সামনে জুড নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্ধকারের ঢেউ যেন চারপাশ থেকে তাকে আক্রমণ করছে। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলেন তিনি। দেশলাইয়ের সন্ধানে পকেটে হাত ঢোকালেন। মনে পড়লো অফিসেই ওটা ছেড়ে এসেছেন।
অসহায় কাকুতি বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে–বিগলো! আমি ডাঃ স্টিভেন্স ওপরে।
কণ্ঠস্বরটা সিঁড়ির দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল। টর্চধারী সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। আবার চিৎকার করলেন, কে আপনি? এবারও নিজের গলার প্রতিধ্বনি শোনা গেল।
হঠাৎ তিনি ওই লোকটাকে চিনে ফেললেন। তার নিয়তি। একজন নয়, অন্তত দুজন। একজন বিদ্যুতের লাইন কেটেছে। অন্যজন সিঁড়িতে পাহারা দিয়েছে। যাতে তিনি এই পথে পালাতে না পারেন।
দু-তিন তলা তফাতে এসে টর্চ লাইটা এগোতে থাকলো। আতঙ্কে তখন তিনি একেবারে হিম হয়ে গেছেন। হৃৎপিণ্ডে কে যেন হাতুড়ি দিয়ে ঘা মেরে চলেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলেন। নির্দিষ্ট তলায় পৌঁছলেন। দরজা ফাঁক করে কান খাড়া করলেন। অন্ধকার করিডোরে কেউ তার অপেক্ষায় নেই তো?
সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে জুডের। অন্ধকারের মধ্যেই করিডোর দিয়ে তিনি ছুটছেন। মনের এই অবস্থাতে দরজাগুলো একটির পর একটি করে গুণতে লাগলেন। অবশেষে ঠিক জায়গায় পৌঁছলেন। দরজাটা খোলার শব্দ হল। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে চাবির গোছটা মাটিতে পড়ে গেল। সেটা কুড়িয়ে নিলেন। দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। কিছুটা নিশ্চিন্ত মনে হল নিজেকে। বিশেষ একটা চাবি ছাড়া দরজাটা বাইরে থেকে খোলা যাবে না।
কান পেতে থাকলেন। করিডোর দিয়ে পায়ের শব্দটা তখন ক্রমশ আরো কাছে এগিয়ে আসছে। সুইচ টিপলেন, খট করে শব্দ হল। আলো জ্বললো না, সারা বাড়িতেই বিদ্যুৎ নেই। টেলিফোনের কাছে গেলেন। অপারেটরের নম্বর ডায়াল করলেন।
জুড স্টিভেন্স বলছি, আমি উনিশ নম্বর থানার ডিটেকটিভ ফ্রাঙ্ক অ্যাঞ্জেলির সঙ্গে কথা বলতে চাই। একটু তাড়াতাড়ি যোগাযোগ করিয়ে দেবেন?
দ্ব্যর্থহীন গলায় কে যেন বলল অপেক্ষা করুন একটু।
করিডোরের দিকের দরজাটাকে কেউ পরীক্ষা করছে জুড বুঝতে পারলেন।
লাইনে গুঞ্জন উঠলো–উনিশ নম্বর থানার ডিটেকটিভ অ্যাঞ্জেলিকে দেবেন তাড়াতাড়ি –একটু ধরুন।
বাইরে থেকে চাপা গলার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। জুড শঙ্কিত হয়ে উঠলেন।
–হ্যালো ডিটেকটিভ অ্যাঞ্জেলি এখন নেই, আমি তার পার্টনার লেফটেন্যান্ট ম্যাকগ্রেভি বলছি।
–আমি জুড স্টিভেন্স আমার অফিস থেকে বলছি। এবাড়ির সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে কেউ আমাকে হত্যা করতে চাইছে।
ম্যাকগ্রেভি বলল–শুনুন ডাক্তার আপনি বরং আমার এখানে চলে আসুন, আমরা আলোচনা করি।
জুড চেঁচিয়ে উঠলেন আমার পক্ষে এখন যাওয়া অসম্ভব। ওরা আমাকে খুন করে ফেলবে।
দরজা খোলার শব্দ হল। বাইরের ঘরে গলার আওয়াজ পেলেন। ওরা ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এই অসম্ভব ব্যাপারটা কি করে সম্ভব হল। এবার ওরা তার ঘরে ঢুকবে।
ম্যাকগ্রেভি কিছু একটা বলে উঠলো। কিন্তু কথাগুলো জুড বুঝতে পারলেন না। অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। ম্যাকগ্রেভি আসতে রাজী হলেও বোধহয় দেরি লাভ হবে নক্যারলের
হ্যানসেন আর ক্যারলের মতো তিনি বিনা প্রতিরোধে মৃত্যুবরণ করবেন না। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে লড়াই করবেন। একটা মোক্ষম অস্ত্রের সন্ধানে চারপাশে হাতড়াতে থাকলেন। খামকাটা ছুরি, ছাইদানি, নাঃ ওরা নিশ্চয় বন্দুক নিয়ে এসেছে।
বড়ো জোর দুই-এক সেকেন্ড, দরজার হাতল ঘোরালো। দরজাটা যদিও ভেতর থেকে তালাবন্ধ কিন্তু সেই তালার কোনো মূল্য নেই। বাঁচার শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে টেবিলটার পাশে নিজেকে আড়াল করে নিলেন। দরজায় ক্যাচ করে একটা শব্দ হল। তালাটা ওরা, ভেঙে ফেলছে না কেন? মনের অতল গভীরে কে যেন তাকে বলে দিল–এ উত্তরটা খুবই জরুরী। কিন্তু তা নিয়ে চিন্তা করার সময় কোথায়। কাঁপা হাতে টেবিলের দেরাজ হাতড়ে হ্যারিসন বার্কের টেপটা বের করলেন। রেকর্ডারের ওপর চাপিয়ে দিলেন। তারপর তাড়াতাড়ি বলতে শুরু করলেন মিঃ বার্ক, আমি খুবই দুঃখিত, ইলেকট্রিক চলে গেলো তবে চিন্তার কিছু নেই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা লাইন ঠিক করে দেবে। আপনি বরং ততক্ষণ আড়াল করে শুয়ে থাকুন।
দরজার শব্দটা থেমে গেল। জুড টেপ রেকর্ডারের একটা বোতামে চাপ দিলেন। পরক্ষণেই তার খেয়াল হল, আরে! বিদ্যুৎ না থাকাতে মেসিনটা তো অচল। মরিয়া হয়ে আবার বলে উঠলেন–ঠিক আছে, এখন শুয়ে থাকুন। সহসা একটা কথা খেয়াল হল। টেবিল হাতড়ে দেশলাই বের করলেন। বাতি জ্বালালেন। টেপ রেকর্ডারের–একটা বোতামের গায়ে ব্যাটারি কথাটা লেখা আছে। বোতামটাতে চাপ দেবার সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল।
বার্কের কণ্ঠস্বর তখন ঘরে গমগম করছে–আমার প্রমাণগুলো তাহলে আপনি শুনতে চান না? কি করে বুঝবো আপনি ওদের দলে নেই?
জুড যেন বরফের মতো জমে গেলেন।
–সেটা আপনি ভালো বোঝেন মিঃ বার্ক। আমি আপনার বন্ধু। আপনাকে সাহায্য করতে চাই। ঠিক আছে, বলুন কি প্রমাণ আপনার হাতে আছে?
–ওরা কাল রাতে তালা ভেঙে বাড়িতে ঢুকেছিলো আমাকে খুন করতে। কিন্তু আমি বোকা নই। প্রত্যেকটা দরজায় তালা লাগিয়ে দিয়েছি। ওরা আমাকে ছুঁতে পারেনি।
বাইরের ঘরে শব্দ থেমে গেল।
টেপ রেকর্ডারে আবার জুডের গলা–তালা ভেঙে ঢোকার ব্যাপারটা জানিয়েছেন। পুলিশকে?
–কিসের জন্য জানাবো? ওরা তো ওদেরই দলের। ওদের বলা আছে, দেখলে যেন আমাকে গুলি করে মারা হয়। কিন্তু ভীড়ের মধ্যে তো আর গুলি চালাতে পারে না। তাই আমি সব সময় তোকজনের মধ্যে দিয়ে হাঁটি।
–তথ্যটা দেওয়াতে আমি খুশি হলাম।
–এতে আপনার কি সুবিধে হবে?
–আপনার প্রত্যেকটি কথা আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি।
সহসা তার ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল–থামাও! এর পরের কথাগুলোতে আছে সব টেপেও তুলে নেওয়া হচ্ছে।
প্রায় ঝাঁপ দিয়ে বোতামটা চেপে ধরলেন। বলে উঠলেন সব আমার মনের মধ্যে রইলোর আমরা এবার আলোচনা করে দেখবো কিভাবে সমস্যার মোকাবিলা করা যায়। এ ধরনের কেস আমার কাছে অনেক আসে। উঃ, আলোগুলো যে কখন জ্বলবে। আপনার ড্রাইভার তো অপেক্ষা করে আছে। আপনি এতক্ষণ নামছেন না দেখে বেচারী চিন্তা করবে।
জুড কান খাড়া করলেন। ওপাশ থেকে ফিসফিসে গলা ভেসে আসছে। ওরা কি মতলব করছে কে জানে? রাস্তায় বহু দূর থেকে একটা সাইরেনের আওয়াজ এগিয়ে আসছে। গলার আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল। তবে কি ওরা বাইরে অপেক্ষা করবে? সাইরেনের আওয়াজটা একেবারে সামনে এসে থেমে গেল। নিশ্চয়ই বাড়ির সামনে গাড়িটা এসে গেছে।
তারপর হঠাৎ আলোগুলো জ্বলে উঠলো।
.
আট
ড্রিংক?
জুডকে লক্ষ্য করে আপন মনে মাথা নাড়লেন ম্যাকগ্রেভি। স্কচের দ্বিতীয় গ্লাসটা জুড নিজেই ঢেলে নিলেন। দুটো হাত ভীষণ কাঁপছে। উষ্ণ পানীয়টা গলা দিয়ে নেমে গেলো।
ম্যাকগ্রেভি এল আলো জ্বলার ঠিক দুমিনিট পরে, তার সঙ্গে কাঠখোট্টা চেহারার একজন সার্জেন্ট এসেছিল। ম্যাকগ্রেভি বললেন–আপনার বক্তব্যগুলো একবার শোনা যাক।
জুড চাপা গলায় বলতে শুরু করলেনদরজায় তালা লাগিয়ে লিফটের কাছে গেছি, হঠাৎ আলোগুলো নিভে গেলো। ভাবলাম, নিচের আলোগুলো নিশ্চয়ই জ্বলছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে চোখে পড়লো কে একজন টর্চ হাতে ওপরে উঠে আসছে। মনে করলাম দারোয়ান বিগলো, কিন্তু সে নয়।
–কে ছিলো?
–আগেই বলেছি আমার জানা নেই। চেঁচিয়েও ওদের কাছে সাড়া পাইনি।
–কি করে বুঝলেন ওরা আপনাকে হত্যা করতে এসেছে?
কড়া একটা জবাব ছিল ঠোঁটের ডগায়, জুড নিজেকে সংযত করলেন। ম্যাকগ্রেভির মনে বিশ্বাস জাগাতে হবে।
–ওরা আমার অফিস পর্যন্ত তাড়া করে এসেছিল।
–দুজন একসঙ্গে?
–অন্তত দুজন। আমি ওদের গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।
–আপনি তখন বললেন, অফিসে ঢুকে রিসেপসন অফিসের দরজাটা ভেতর থেকে তালা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঠিক তো?
–তারপর নিজের ঘরটায় ঢুকে ভেতর থেকে তালা লাগান।
দরজার কাছে এগিয়ে গেলো ম্যাকগ্রেভি–এই দরজাটা ওরা খুলেছে?
-হ্যাঁ।
–অথচ আপনি বলেছিলেন ভেতর থেকে তালা বন্ধ করার পর বাইরে থেকে খুলতে গেলে বিশেষ চাবির দরকার হয়।
জুড দ্বিধার সঙ্গে বললেন–হ্যাঁ। ম্যাকগ্রেভি ব্যাপারটা কোন্ দিকে ঘোরাতে চাইছে তিনি ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন।
–এর চাবি কার কাছে আছে?
–ক্যারলের কাছে একসেট থাকতো।
ম্যাকগ্রেভি হঠাৎ অতিমাত্রায় মার্জিত হয়ে বললেন–আর ঝাড়ুদাররা? তারা কিভাবে ঢোকে?
–ওদের সঙ্গে আমাদের বিশেষ ব্যবস্থা আছে। ক্যারল সপ্তাহে তিনদিন একটু আগে আসতো। ওদের দিয়ে ভেতরটা পরিষ্কার করাতে।
–এটা তো খুবই অসুবিধাজনক ব্যবস্থা। কেন অন্য অফিসগুলো পরিষ্কার করার সময় ওরা আপনাদেরটা করে যেতো না?
–না। আমার এখানে এমন সব ফাইল থাকে যা অত্যন্ত জরুরী ও গোপনীয়। তাই আমি চাই না আমার অবর্তমানে কেউ এখানে ঢুকুক।
সার্জেন্ট সব লিখছে কিনা ম্যাকগ্রেভি দেখলো। আশ্বস্ত হয়ে সে আবার তাকালো জুডের দিকে।
–আমরা যখন আপনার রিসেপশন অফিসে ঢুকলাম, তখন বাইরের দরজার তালাটা খোলা ছিল। জোর করে নয়, চাবি ঘুরিয়ে খোলা।
জুড এই বক্তব্যের উত্তর দিলেন না।
ম্যাকগ্রেভি বলে চলল–আপনি এতক্ষণ আমাদের জানিয়েছেন ওই দরজার চাবিটা থাকতো আপনার আর ক্যারলের কাছে। ক্যারলের চাবি আপাতত আপনার হেপাজতে। একবার ভেবে বলুন তো ডঃ স্টিভেন্স, আর কার কাছে এই দরজার চাবি থাকা সম্ভব?
–আর কারুর কাছেই নয়।
–তাহলে ওরা কিভাবে ঢুকলো।
উত্তরটা জুডের মাথায় এসে গেল। মনে হয় ক্যারলকে খুন করার সময় ওরা চাবিগুলের ছাপ নিয়েছে।
ম্যাকগ্রেভির ঠোঁটের কোণায় অস্পষ্ট হাসির চিহ্ন–হুঁ, খুবই সম্ভব, তবে যদি নিয়ে থাকে তাহলে চাবিগুলোতে মোমের চিহ্ন থাকবে। আচ্ছা, আমি ল্যাবরেটারিতে টেস্ট করার ব্যবস্থা করছি।
জুড মাথা নাড়লেন! একটা মোক্ষম চাল দেওয়া গেছে। কিন্তু তাঁর আত্মতৃপ্তির ব্যাপারটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না।
ম্যাকগ্রেভি বলল–তাহলে ব্যাপারটা আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। দুজন লোক আপাতত ধরে নিলাম এর মধ্যে কোনো স্ত্রীলোক নেই, দরজার চাবি নকল করে আপনার অফিসে ঢুকে আপনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। আমি কি ঠিক বলেছি?
–ঠিক।
এবার আপনি বলছেন, নিজের ঘরে ঢুকেও আপনি ভেতর থেকে তালা বন্ধ করে দিয়েছিলেন ঠিক আছে তো?
–হ্যাঁ।
–কিন্তু আমরা এসে দেখলাম ওই ঘরের তালাটা খোলা।
–চাবিটাও তাহলে ওদের কাছে আছে।
–তাহলে এবার বলুন, সেই চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেও ওরা আপনাকে হত্যা করলো না কেন?
–এর জবাব আমি আগেও দিয়েছিলাম। ওরা টেপের গলা শুনেছিলো তাই–
–তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, দুজন খুনে, যারা এত ঝামেলা করে আলো নেভালো, আপনাকে আটক করলো, তালা খুলে অফিসে ঢুকলোতারা শেষ পর্যন্ত আপনার একগাছা লোমও স্পর্শ না করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল?
ম্যাকগ্রেভির গলায় এবার ব্যঙ্গ।
জুড উত্তেজিত হয়ে বললেন–কি বোঝাতে চাইছেন আপনি?
–বেশ, এখনও যখন আপনার মাথায় ঢোকেনি, তখন খোলসা করে বলছি। শুনুন ডাক্তার, আমার বিশ্বাস কেউ এখানে আসেওনি এবং আপনাকে হত্যা করার চেষ্টাও করেনি। সবটাই আপনার বানানো গল্প কথা।
–আমি আমার মুখের কথা বিশ্বাস করতে বলিনি, বলুন লাইট নিভে যাবার কি ব্যাখ্যা দেবেন? আর বিগলা, সেই বা কোথায় গেল।
–সে এখন লবিতে।
–মারা গেছে?
–যখন আমাদের ঢুকতে দিল, তখন অবধি মরেনি। মেন সুইচের একটা তারের গণ্ডগোল ঠিক করতে পাতাল ঘরে ঢুকেছিল। আমরা যখন এলাম তখন ও সেই ঘর থেকে বেরোচ্ছে।
জুড হতবুদ্ধি হলেন ও আচ্ছা।
–আপনার উদ্দেশ্য আমি ঠিক ধরতে পারছি না স্টিভেন্স। তবে এখন থেকে আমি আপনার দলে নেই। তবে হ্যাঁ, একটা উপকার করতে হবে আপনাকে। এবার থেকে আমাকে আর ডেকে পাঠানোর দরকার নেই। দরকার হলে আমি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবো।
নোটবই মুড়ে নিয়ে সার্জেন্ট ম্যাকগ্রেভিকে অনুসরণ করলো।
হুইস্কির প্রভাবটা কেটে গেছে। আবার চারদিক অতলান্তিক কুয়াশা। জুড কি করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এই ধাঁধার কোনো চাবিকাঠি তার হাতে নেই।
কিন্তু কোন দিকে তিনি যাবেন? তিনিও কি মস্তিষ্ক বিকৃতির রোগী হয়ে উঠেছেন? লক্ষণগুলো পরিষ্কার। গাড়ি দুর্ঘটনা? আজ রাতে দুজন লোকের হানা দেবার ঘটনা? খুনি না হয়ে ছিঁচকে চোরও তো ওরা হতে পারে, এর জ্বলন্ত প্রমাণ হাতেই আছে। ঘরে গলার আওয়াজ শুনে তারা পালিয়ে যায়। হস্ত করার উদ্দেশ্য থাকলে কেউ কি এইভাবে চলে যেতো?
তাহলে? জুড ভাবলে এসবই কি ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ? পুলিশের কাছে আবেদন জানানো অর্থহীন। একটা মতলব ধীরে ধীরে তার মাথায় দানা বাঁধতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত টেলিফোন গাইডটা তুলে নিলেন।
.
নয়
পরের দিন বিকেল চারটে। জুড গাড়ি নিয়ে ওয়েস্ট সাইডের একটা ঠিকানাতে এলেন। বহু পুরোনো ফ্ল্যাট বাড়ি। জরাজীর্ণ অবস্থা, ইট খসানো চেহারা, দেখে দুশ্চিন্তায় পড়লেন। ভাবলেন ভুল জায়গাতে এসেছেন। পরক্ষণেই একটি ফ্ল্যাটের গায়ে নাম ফলক দেখতে পেলেন–
নরম্যান জেড মুডি, বে-সরকারি গোয়েন্দা, গ্যারান্টিসহ যে কোনো কাজের দায়িত্ব নেওয়া হয়।
–জুড গাড়ি থেকে নামলেন। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। একটু বাদেই তুষারপাত শুরু হবে। ফুটপাথে উঠে বাড়িটার প্রবেশ পথের সংকীর্ণ গলিটায় ঢুকে পড়লেন। জায়গাটা বাসি খাবার আর পেচ্ছাপের গন্ধে ভরা। ফলক লাগানো আরেকটা দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাতে লেখা রয়েছে–নরম্যান জেড মুডি-র নাম।
নির্দেশ অনুসারে তিনি ভেতরে ঢুকলেন। মুডি বিলাসী জিনিসে টাকা খরচ করার লোক। নন, তা ঘরের চেহারা দেখে বুঝতে পারা যাচ্ছে। এককোণে জরাজীর্ণ জাপানী পর্দা, তার পেছনে চটা ওঠা টেবিল। খবরের কাগজ আর পুরোনো পত্রপত্রিকা চারপাশে ছড়ানো। চলাফেরা করাই দায়।
ভেতরের একটা দরজা সশব্দে খুলে মুডি বেরিয়ে এল। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতা, ওজন তিনশো পাউন্ড। হাঁটার ভঙ্গিমা গড়িয়ে চলার মতো। গোলগাল মুখ। টানা টানা হালকা সবুজ চোখ দুটো। ডিমের মতো মাথাটা টাকে ভরা। গোয়েন্দা না হয়ে তিনি যদি কমেডিয়ান হতেন তাহলে ভালো মানাতো।
–মিঃ স্টিভেনসন, মুডি অভ্যর্থনা জানালো।
–ডাঃ স্টিভেন্স, জুড বললেন।
–বসুন বসুন।
কোথায় বসা যেতে পারে জুড তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন। একটা আরাম কেদারার ওপর বেশ কিছু পত্রিকা স্থূপাকার করে রাখা ছিল। সেগুলো নামিয়ে চামড়া ফাটা বিধ্বস্ত কেদারার ওপর সন্তর্পণে জুড বসলেন।
মুডি ততক্ষণে বিরাটাকৃতি একটা দোলনা কুর্সিতে গা এলিয়ে দিয়েছে এবার বলুন কোন কাজের জন্য আমাকে চাইছেন?
জুড় বুঝলেন মস্ত বড়ো ভুল হয়ে গেছে। টেলিফোনে যোগাযোগের সময় নিজের নামটা তিনি বলেছিলেন। কয়েকদিন ধরে নিউইয়র্কের প্রায় প্রতিটি কাগজে তার নাম স্থান পাচ্ছে। অথচ এই লোকটা তাঁর নাম শোনেনি। ব্যাপারটা কি বিশ্বাসযোগ্য? ভাগ্যক্রমে একজন বে-সরকারি গোয়েন্দার সন্ধান পাওয়াতে জুড খুশি হয়েছিলেন, এখন বুঝতে পারছেন একে দিয়ে কোনো কাজই হবার নয়।
লোকটাকে না ঘাঁটিয়ে কিভাবে সরে পড়া যায় জুড তাই ভাবছিলেন।
–ভাবছিলাম মিঃ মুডি, এত তাড়াতাড়ি আপনার কাছে আসাটা আমার উচিত হয়নি। যে কারণে এসেছিলাম তার জন্য কিছুটা চিন্তার প্রয়োজন। আপনার সময় নষ্ট করলাম এজন্য দুঃখিত।
–ঠিক ঠিক; আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। কিন্তু অ্যাপয়েন্টমেন্ট করার জন্য আমার ফী দিতে হবে।
–কত?
–পঞ্চাশ ডলার।
জুড ঢোক গিললেন–ক্ষুণ্ণ মনে কিছু নোট গুনে গুঁজে দিলেন মুডির হাতে।
মুড়ি, বললেন অনেক ধন্যবাদ।
ইতিমধ্যে জুড দরজার দিকে এগিয়ে গেছে–ডাক্তার সাহেব?
অমায়িক ভাবে হাসছে মুডি–বলছিলাম, পঞ্চাশ ডলার যখন খসেই গেল তখন একটু বসে আমায় সমস্যাটা জানাতে পারতেন না? আমি সবাইকে বলি মন খুলে সমস্যার কথা বললে মন অনেক হালকা হয়। এটাও কি কম লাভ?
বিচ্ছিরি দেখতে এই লোকটার মুখে নীতিবাক্য শুনে জুডের হাসি পাচ্ছিলো। মানুষের বুক খালি করা সমস্যা শুনতে শুনতে তার জীবনের প্রহরগুলো কোথায় কেটে গেছে। ঘরে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত বে-সরকারি গোয়েন্দাকে নিরীক্ষণ করলেন তিনি। তারপর ভাবলেন, এতে আর কি ক্ষতি হবে? একটা অচেনা লোকের কাছে সব প্রকাশ করতে পারলে হয়তো কিছু উপকার হবে। ফিরে এসে আবার নিজের জায়গাতে বসলেন তিনি।
–ডাক্তার সাহেব, মনে হচ্ছে সারা পৃথিবীর বোঝাটা বোধহয় আপনার কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোকের সম্বন্ধে এত চিন্তা ভাবনা করেন কেন? নিজের জন্য একটু সময় রাখবেন তো? আমি সবাইকে কি উপদেশ দিই জানেন তো? বলি, দ্যাখো বাপু, মেয়েছেলে আর টাকা–এই দুটি জিনিসকে জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলল, দেখবে তোমার প্রায় সব সমস্যাই মিটে গেছে।
বলুন ঠিক বলি কি না?
–আমার মনে হয় কেউ আমাকে হত্যা করতে চাইছে।
–মনে হয়।
–হ্যাঁ। আপনি এমন কারোর নাম করবেন যিনি এইসব কেন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারেন?
–পারি বৈকি। একজনই আছেন তার নাম নরম্যান জেড মুডি। এই মুহূর্তে আপনার সামনে বসে আছেন।
এই কথা শুনে জুড দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
–আপনি আমায় কেন সমস্যাটা খুলে বলছেন না ডাক্তার সাহেব। দেখুন আমরা দুজনে মিলে তার সমাধান করতে পারি কিনা?
–জুড আর হাসি চাপতে পারলেন না। মুডির কথাগুলো তার অভ্যস্ত বুলির সঙ্গে মিলে গেছে। তিনিও রোগীদের বলে থাকেন আপনি আরাম করে কৌচে শুয়ে পড়ুন। মন খুলে সবকিছু বলে ফেলুন। দেখবেন আমরা দুজনে মিলে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলছি।
মনস্থির করলেন সবকিছু খুলে বলাই বাঞ্ছনীয়। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গত কয়েকদিনের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেন। কিছুক্ষণ পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন পরপর শব্দগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। এবার নিজের মস্তিষ্ক বিকৃতির কথাটা সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন। আর কিছু গোপন করলেন না।
তাঁর কথা শেষ হল। মুডি বলল আপনি একটা উটকো সমস্যায় পড়েছেন। মনে হয় কেউ আপনাকে খুন করতে চাইছে। অথবা মস্তিষ্কের ভারসাম্য আপনি হারিয়ে ফেলেছেন, তাই তো?
এই কথা শুনে জুড অবাক হলেন। একটু আগে যে লোকটিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছিলেন, সে যে এমন কথা বলতে পারে জুড তা ভাবতেই পারেননি।
মুডি বলেই চলে–আপনি বললেন, দুজন পুলিশের গোয়েন্দা এর সঙ্গে জড়িত। তাদের নামে জানা আছে কি?
জুড দ্বিধায় পড়লেন। নাম দুটো কি বলা উচিত? শেষ পর্যন্ত নাম দুটি বললেন।
মুডির অভিব্যক্তি বদলে গেল–এমন কি কারণে আপনাকে হত্যা করা যেতে পারে, ডাক্তার?
–কোনো ধারণা নেই। তাছাড়া আমার কোনো শত্রু নেই।
–আসুন মশাই, পথে আসুন। শত্রু দু-একজন থাকবে না তা কি হয়? আমি কি বলি জানেন? আমাদের জীবনটাকে যদি রুটির সঙ্গে তুলনা করা যায় তবে শত্রুর ভূমিকা হবে নুনের মতো। নুন ছাড়া কি রুটির স্বাদ হয়? বিয়ে করেছেন?
–না।
–সমকামী নন তো?
–দেখুন, এইসব নিয়ে পুলিশের সঙ্গে আমার আগেই কথাবার্তা হয়েছে।
–বটেই তো, আপনি এসেছেন আমার সাহায্যের জন্য। আচ্ছা, ধার-টার বাকি আছে নাকি বাজারে?
–ধার বলতে মাস কাবারী বিলগুলো পড়ে আছে।
–আর আপনার পেশেন্টরা?
–ওদের কি দরকার?
–দেখুন, এজন্য তো বলি, ঝিনুকের খোল যদি দরকার হয়, তো যেতে হবে সাগর তীরে। আপনার কাছে যারা আসে তারা বেশির ভাগই মাথা খারাপের রোগী, তাই তো?
–ভুল, জুড জবাব দিলেন–ওরা নানা সমস্যায় জর্জরিত।
–সমস্যা তো বটেই, তবে মানসিক সমস্যা যার সমাধান নিজে করা যায় না। আচ্ছা, ওদের মধ্যে এমন কি কেউ আছে, আক্রোশ আছে যার? আপনার ওপর? আক্রোশ মানে, কাল্পনিক কিছু?
–সে থাকতে পারে, তবে ওদের অনেককেই আমি এক বছরের ওপর দেখেছি, ওদের অতীত জীবনের প্রায় সব কথাই জেনে ফেলেছি।
–ওরা কখনও আপনার ওপর রেগে ওঠে কি?
–এমন ঘটনা খুব একটা ঘটে না। মিঃ মুডি, কোনো রাগী লোকের সন্ধান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। একজন বিকৃত মস্তিষ্ক লোককে খুঁজছি আমি, যে দু-দুটো খুন করার পরও আমাকে হত্যা করতে চাইছে।
জুড আরো বললেন–আমার যদি সেরকম কোনো রোগী থেকে থাকে আর আমি যদি তাকে চিনতে না পেরে থাকি তাহলে আপনি নিশ্চয়ই আমাকে সব থেকে খারাপ মনোবিজ্ঞানী বলবেন।
চোখ তুলে জুডি দেখলেন মুডি গভীর কৌতূহলের সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করছে।
মুডি হাসতে হাসতে বলল–গোড়ার কাজটা গোড়াতেই সেরে রাখা উচিত। আগে দেখতে হবে সত্যি সত্যি কেউ আপনাকে খুন করতে চাইছে নাকি আপনার মাথাটা বিগড়েছে। গাড়ি আছে আপনার?
–আছে। চলে যাবার ইচ্ছে জুডের তখন পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। এই নির্বোধ লোকটির মধ্যে একটা অদ্ভুত বুদ্ধিমান সত্ত্বা বাস করছে, জুড অবাক হলেন।
–আপনার নার্ভগুলো একটু জখম হয়ে পড়েছে, কয়েকদিনের জন্য আপনাকে ছুটিতে যেতে হবে।
–কবে?
–কাল সকালে।
–অসম্ভব। জুড প্রতিবাদ করেন। কাল অনেক পেশেন্টের সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
–সব বাতিল করুন।
–তাতে আপনার কি লাভ?
–আপনার নিজের ব্যবসা কি করে চালাতে হবে সেও কি আমি বলে দেবো। এখান থেকে বেরিয়ে একটা ট্রাভেল এজেন্সিতে ঢুকে পড়ন। নিজের জন্য সিট রিজার্ভ করুন। গ্রসিঞ্জারের কোনো হোটেলে। ক্যাটস্কিল পর্যন্ত আপনাকে বেশ লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। আপনার ফ্ল্যাটের কাছে গ্যারাজ আছে?
–আছে।
–তাহলে মিস্ত্রীকে বলুন লম্বা ট্যুরের জন্য গাড়িটাকে ঠিক করতে।
–এটা পরের সপ্তাহে করলে হতো না?
–রিজার্ভেশন হয়ে গেলেই আপনি অফিসে গিয়ে পেশেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বলবেন, বিশেষ জরুরী কাজে আপনাকে বাইরে যেতে হচ্ছে। এক হপ্তার মধ্যে আবার ফিরে আসবেন।
–কখনই সম্ভব নয়।
–অ্যাঞ্জেলির সঙ্গেও যোগাযোগ করে নেওয়া ভালো। বাইরে যাবার সময় পুলিশ আপনাকে খুঁজে বেড়াক সেটা আমি চাইছি না।
–আমি এসব করতে যাব কেন?
–করবেন, আপনার দেওয়া পঞ্চাশ ডলার সদ্ব্যবহারের জন্য। হ্যাঁ, আমার পারিশ্রমিকের দুশো ডলার কিন্তু আগাম চাই। এর সঙ্গে খরচপাতি বাবদ আরো পঞ্চাশ ডলার।
চেয়ার থেকে মুডি তার বিরাট শরীরটা টেনে তুললাম খুব সকালে বেরিয়ে পড়তে হবে। সন্ধ্যের আগেই পৌঁছতে হবে। সাতটার সময় পারবেন তো?
–হ্যাঁ, বোধহয় পারবো।
–তাহলে বেরিয়ে পড়ুন।
চিন্তাচ্ছন্ন মনে জুড গাড়িতে উঠলেন।
মুডির পরিকল্পনা মতো সব কাজ শেষ হয়ে গেল। জুড ম্যাডিসন এভিনুর এক ভ্রমণ সংস্থার দপ্তরে ঢুকেছিলেন। তারা গ্রসিঞ্জারের হোটেলে ঘর ঠিক করে দিল। ক্যাটস্কিল সম্পর্কে। অনেকগুলি রঙীন বই দিল। জুড টেলিফোনে রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। আগামী কিছুদিনের সাক্ষাৎকার বাতিল করলেন। সবশেষে উনিশ নম্বর থানায় অ্যাঞ্জেলিকে টেলিফোন করলেন।
অপারেটার জানালেন, উনি অসুস্থ আজকে আসেননি। ওনার বাড়ির নম্বর নেবেন কি?
–দিন।
অ্যাঞ্জেলির গলা শুনে জুড বুঝতে পারলেন সে সর্দিকাশিতে আক্রান্ত। তাকে বললেন–আমি কয়েকদিনের জন্য শহরের বাইরে যাব। খবরটা আপনাকে জানিয়ে দিলাম।
অ্যাঞ্জেলি বলল–খুব খারাপ চিন্তা করেননি। কোথায় যাচ্ছেন?
–গ্রসিঞ্জার পর্যন্ত যাব ঠিক করেছি।
–ঠিক আছে চিন্তার কিছু নেই। আমি ম্যাকগ্রেভির সঙ্গে কথা বলে নেবো। আপনার অফিসের ঘটনাটা শুনেছি।
–আপনি শুধু ম্যাকগ্রেভির বক্তব্য শুনেছেন।
–যে খুন করতে এসেছিল তাকে দেখেছেন?
–না।
–কিছু লক্ষ্য করেননি? রঙ, বয়েস কিংবা উচ্চতা।
–না। পুরো অন্ধকার ছিল।
–একটু সাবধানে থাকবেন।
–অবশ্যই।
হ্যারিসন বার্কের ওপরওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বার্কের সর্বশেষে শারীরিক অবস্থার কথা বুঝিয়ে বললেন। কেস তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে তাও বললেন। পিটার হ্যাডলিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করলেন।
বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে জুড মুডির কথা চিন্তা করছিলেন। লোকটার একটা মতলব তিনি ধরতে পেরেছেন। তাকে সমস্ত রোগীর সঙ্গে সাক্ষাৎকার বাতিল করতে বলছে কেন? হয়তো কোনো একটা রোগীকে মুডি সন্দেহ করছে। তাই যদি হয় তাহলে যাত্রা পথে নিশ্চয়ই তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হবে। মুডি হয়তো লোকটাকে হাতে নাতে ধরতে চায়। ফ্ল্যাটবাড়ির টেলিফোন অপারেটার এবং দারোয়ানকেও সে গন্তব্যস্থলের ঠিকানাটা জানিয়েছে। এর অর্থ ভ্ৰমণ পথ সম্পর্কে কোনো গোপনীয়তা রাখতে মুডি ইচ্ছুক নয়।
ফ্ল্যাটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতেই মাইকের সঙ্গে দেখা হল। জুড বললেন–মাইক, আমি কয়েকদিনের জন্য বেরোবো। আমার গাড়িটা ঠিক করে পেট্রল ভরে দাও।
–কিচ্ছু ভাববেন না, ডাঃ স্টিভেন্স। আমি সব ঠিক করে রাখবো। কখন দরকার?
–আমি ঠিক সকাল সাতটায় বেরোবো।
জুড বুঝতে পারলেন বাড়িতে না ঢোকা পর্যন্ত মাইক তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ভোর ছটায় অ্যালার্ম ঘণ্টা বেজে উঠলো। জুড বিছানা থেকে উঠলেন। দাড়ি কামালেন। পোশাক পাল্টালেন, পাঁচদিনের মতো জামা-কাপড় একটা সুটকেসে ভরলেন। টুকিটাকি জিনিস নিলেন। ফ্ল্যাটের দরজা জানলা ভালো করে বন্ধ করে বেরিয়ে এলেন।
লিফটে নিচে নামলেন, গ্যারাজে এসে ওখানকার কীপার উইন্টের সন্ধানে চারপাশে তাকালেন। গাড়িটা দেওয়ালের একপাশে দাঁড় করানো আছে। পেছনের সীটে সুটকেসটা রাখলেন। চালকের আসনে বসলেন। সবেমাত্র গাড়ির চাবিটা ঢুকিয়েছেন হঠাৎ কে যেন তার পাশে এসে বসলো।
–আপনি একেবারে পাকা সময়ে এসে গেছেন। তার দিকে তাকিয়ে মুডি মিটিমিটি হাসছে।
জুড বললেন যাবার সময় আপনি দেখা করতে আসবেন আমি ভাবিনি।
নধর শিশুর মতো মুখটাতে চওড়া হাসি কি আর করি বলুন, কাজকর্ম হাতে নেই, ঘুমও হল না। যাই হোক, আপনার যাবার দরকার নেই। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
–বুঝলাম না কথাটা!
–বোঝেননি? সে কি মশাই? সোজা কথা।
গাড়ির দরজাটা খুলে মুডি হেলান দিয়ে দাঁড়ালো আপনার ছোট্ট সমস্যা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কি সিদ্ধান্তে এসেছিলাম জানেন? আমি ভেবে দেখলাম, একটা তথ্য আমাদের সব থেকে আগে জানা দরকার। সেটা হল, এই যে পাঁচ মিনিট অন্তর অন্তর আপনার ওপর আক্রমণ আসছে, এটা কি আপনার মনোবিকৃতির কারণে না সত্যি কি আপনাকে কেউ লাশ বানাতে চাইছে?
–কিন্তু ক্যাটস্কিল?
–আরে না না ডাক্তার, ক্যাটস্কিল আদৌ আপনি যাচ্ছেন না। নিন, নামুন এখন। জুড গাড়ি থেকে নেমে এলেন।
–ওটা হল প্রচার, এজন্যই তো বলি হাঙর যদি ধরতে হয় জলে আপনাকে নামতেই হবে।
মুডির কথায় জুড অবাক হয়ে গেছেন।
–ক্যাটস্কিল পর্যন্ত এ জীবনে যেতে পারতেন না ডাক্তার। গাড়ির সামনে গিয়ে ইঞ্জিনের ঢাকনাটা তুলে ধরলো মুডি। জুড পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ইঞ্জিনের গায়ে টেপ দিয়ে জড়ানো তিনটে ডিনামাইট, সরু দুটি তার সেখান দিয়ে ঝুলছে।
–এগুলো আপনাকে লাশ বানাবার সরঞ্জাম।
জুড হতভম্ব হয়ে গেলেন আপনি কেমন করে…,
মুডি হাসলো কি বললাম আপনাকে? সারা রাত্রি ঘুমোতে পারিনি না? এখানে এসেছি মাঝরাত্রিতে। দারোয়ানটার হাতে কুড়ি ডলার খুঁজে ফুর্তি করতে পাঠিয়ে, অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ব্যস, কাজ শেষ।
–আপনি তাহলে দেখেছেন কে কাজটা করেছে?
–না। বিষাদে মাথা নড়ে মুডির–আমি আসার আগেই ওরা কাজ শেষ করে গেছে। ভোর ছটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কাউকে দেখতে না পেয়ে বেরিয়ে এসেছি।
–সরু তার দুটোর দিকে ইঙ্গিত করলো মুডি আপনার বন্ধুরা মশাই অসম্ভব চালু। ইগনিশানের সঙ্গে ডিনামাইট লাগানো ছিল। রাস্তায় কোনো সময় ইঞ্জিনের ঢাকনা খুলতে গেলেই আপনি মারা পড়তেন। পাছে একটা অচল হয়ে পড়ে সেই ভয়ে দুটো ব্যবস্থা। যা ছিল তাতে অর্ধেক গ্যারাজ উড়ে যেত।
জুডের মনে হল কেউ বোধ হয় তাকে আক্রমণ করেছে। মুডি উৎসাহের সঙ্গে বলতে থাকেন তাহলে দেখলেন তো আমরা কতখানি এগিয়ে গেলাম। দুটো হিসেব পরিষ্কার হয়ে গেল, এক নম্বর আপনি পাগল নন। দুনম্বর
এবার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল। আমরা জানতে পারলাম, ভগবানের মতো ক্ষমতা সম্পন্ন কোনো মানুষ আপনাকে খুন করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয় সম্ভবনাটি সাংঘাতিক।
.
দশ
বৈঠকখানায় বসে ওরা কথা বলছে। জুড বললেন–বোমার মাল-মসলাগুলো পুলিশকে দেখিয়ে নিলে ভালো হতো না?
–না মশাই, এইজন্য সকলকে বলি বেশি তথ্য জোগানোর অর্থই হল তাকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেওয়া।
–কিন্তু ম্যাকগ্রেভিকে বোঝানো…।
–আমি সত্যি কথা বলছি না।
–তাই কি?
জুড কথাটা ধরে ফেললেন। ম্যাকগ্রেভি হয়তো ধরে নেবেন তিনিই ওগুলো সাজিয়ে রেখেছেন। একজন বেসরকারি গোয়েন্দা পুলিশের সাক্ষ্য প্রমাণ লোপ করে দেবে। এটা তিনি মন থেকে কিছুতেই মানতে পারছিলেন না। তবে লোকটাকে এখন আর পাগল বলে মনে হচ্ছে না, বরং ওই বেঁটে খাটো চেহারার লোকটির ওপর আস্থা ক্রমশ আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে।
মুডি বলতে থাকে–আপনি ডাক্তার আর আমি সাধারণ মানুষ। তাই তো বলি মধু কি যেখানে সেখানে পাওয়া যায়। এর জন্য মৌচাকের কাছে যেতেই হবে।
এবার মুডির আপাত দুর্বোধ্য প্রবচনগুলির আসল অর্থ ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে জুডের কাছে। তিনি বললেন তার মানে? সে বা তারা কি ধরনের লোক হতে পারে এই ব্যাপারে আমার অভিমত কি আপনি তা জানতে চাইছেন তো?
–ঠিক, আমি জানতে চাই যে উন্মাদাগার থেকে পালানো লোক, নাকি আরও গভীর কোনো ব্যাপার?
–আরো গভীর কিছু।
–একথা কেন ভাবছেন ডাক্তার?
–প্রথম কথা দুজন আমার অফিসে চড়াও হয়েছিল। একা হলে আমি উন্মাদ তত্ত্বটা মেনে নিতাম। কিন্তু দুজন পাগল একসঙ্গে আসবে, এটা বড় বাজে চিন্তা হয়ে যাচ্ছে না?
মুডি মাথা নাড়তে নাড়তে বলতে থাকে বেশ বেশ, আপনার মাথাটা বেশ খোলতাই হয়েছে তো, বলে যান, বলে যান।
–দ্বিতীয়ত অসুস্থ মস্তিষ্ক লোকের পক্ষে কোনো কাজ নিয়ম মেনে করা সম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়ম নীতি অনুসারে কাজ করা হয়েছে। জন হ্যানসেন বা ক্যারল রবার্টস কেন মরেছে আমি জানি না। কিন্তু আমি হলাম তৃতীয় বা শেষ লক্ষ্য।
–কেন?
অন্য কারোর ওপর যদি ওদের লক্ষ্য থাকতো তাহলে প্রথমবার আমাকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হবার পর ওরা আমাকে নিয়ে আর মাথা ঘামাতো না। ওদের তালিকায় পরবর্তী যে নামগুলো আছে তাদের ওপর চেষ্টা চালাতো। কিন্তু বার বার ওরা আমার ওপর হামলা চালাচ্ছে।
–বুঝলেন ডাক্তার, আপনার মধ্যে গোয়েন্দা হবার বেশ কিছু উপকরণ ছিল।
–বেশ কয়েকটা ব্যাপারটা আবার বোঝাও যাচ্ছে না।
–যেমন?
–প্রথমত আমাকে হত্যা করতে চাইছে কেন?
–ও ব্যাপারটায় আমরা পরে আসছি। আর কিছু?
–আরেকটা কথা। আমাকে খুন করবার ইচ্ছে থাকলে আমি যখন ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম তখন ড্রাইভার আমাকে চাপা দিতে পারতো। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম।
–ঠিক এইখানে মিঃ বেনসন এস যাচ্ছেন।
জুড বিস্মিত হয়ে মুডির দিকে তাকালেন বেনসন?
–মিঃ বেনসন হলেন আপনার অ্যাক্সিডেন্টের সাক্ষী, আপনি আমার অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার পর আমি থানায় গিয়েছিলাম। পুলিশের রিপোর্টে ভদ্রলোকের নাম পেয়ে দেখা করে এলাম। ট্যাক্সি ভাড়া সাড়ে তিন ডলার, ঠিক আছে।
জুড মাথা নাড়লেন।
–মিঃ বেনসন পশমি পোশাকের কারবার করেন। বড়ো সুন্দর জিনিসগুলো, জানেন। যদি কখনও বান্ধবীদের জন্য ওইসব পোশাক কেনেন আমাকে বলবেন। মিঃ বেনসনকে বলে আমি ডিসকাউন্টের ব্যবস্থা করে দেবো। আপনার অ্যাক্সিডেন্টের দিন রাতে উনি একটা লিমুজিন আপনার দিকে ধেয়ে যেতে দেখেন। অবশ্য আপনিই যে সেই লোক উনি তা জানতেন না। উনি যেখানে ছিলেন সেখান থেকে মনে হয়েছিল গাড়িটা হঠাৎ পিছলে গিয়ে আপনাকে ধাক্কা মেরেছে। উনি দৌড়ে আপনার কাছে আসছিলেন। হঠাৎ উনি লক্ষ্য করলেন গাড়িটা আবার পিছিয়ে এসে আপনার দিকে তাড়া করেছে। কিন্তু তার সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াতে ড্রাইভার আপনাকে ফেলে চম্পট দেয়।
–তার মানে, মিঃ বেনসন যদি না দেখতেন?
–হ্যাঁ। তাহলে আর আমাদের দেখা হতো না। ব্যাপারটা পরিষ্কার। এটা একটা খেলা নয়। আপনাকে খতম করাই ওদের উদ্দেশ্য।
–কিন্তু অফিসে চড়াও হওয়া—
মুডি কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল। তারপর বলল–হ্যাঁ, এটা একটা জটিল ব্যাপার। আমি মেনে নিচ্ছি ওরা আপনাকে খুন করতে এসেছিল। বুঝতে পারল, ঘরে আরও একজন আছে। অমনি পালিয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না।
ঠোঁট কামড়ে সে আবার ভাবতে শুরু করে। তারপর বলে, যদি না
যদি না কী?
–আমি ভাবছি…
–কী?
–ওটা আপাতত থাক। ছোটো একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত হত্যার উদ্দেশ্য বের করতে পারব না, ততক্ষণ সেই মতলবটা কোনো কাজে লাগবে না।
–আমি তো এমন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না যা থেকে কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে।
মুডি কিছুক্ষণ চিন্তা করে নিল ডাক্তার আপনার এমন কোনো গোপন ব্যাপার আছে কি, যা জন হ্যানসেন আর ক্যারল রবার্টসের জানা ছিল? তার মানে আমি জানতে চাইছি,
এমন কোনো গোপন ব্যাপার যেটা শুধু আপনারা তিনজন জানতেন।
জুড মাথা নাড়লেন–না, পেশেন্টদের সম্পর্কে আমার পেশাগত গোপনীয়তা বাদে আর কোনো ব্যাপার নেই। ওদের কেসহিস্ট্রির মধ্যেও কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাপার নেই যা ওদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। একটা কথা মনে রাখবেন ডিটেকটিভ, আমার পেশেন্টরা কিন্তু কেউই সিক্রেট এজেন্ট বা জেল পালানো আসামী নয়। নেহাত সাধারণ বাড়ির গিন্নি অথবা ব্যবসা করে, কেউ কেরাণী এই আর কী।
–আপনি তাহলে নিশ্চিত যে কোনো উন্মাদ এই খুনের দলের সঙ্গে যুক্ত নয়।
–একেবারেই নিশ্চিত। এ সম্পর্কে গতকালও আমার মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন ছিল। সত্যি কথা বলতে কী, এক-এক সময় আমি নিজেকেই বদ্ধ উন্মাদ বলে ভাবছিলাম। গাড়িতে বোমা রাখার ঘটনাটা আবিষ্কার হবার পর এ ব্যাপারে আমার প্রত্যয় আকাশ ছুঁয়েছে।
মুডি মুচকি হাসল–যাক তাহলে ওই চিন্তাটা আপনার মন থেকে দূর করতে পেরেছি বলুন।
জুড অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন–আচ্ছা, আমরা যা যা জেনেছি, তা পুলিশের কাছে গিয়ে বললে কী হয়?
মুডি বিস্ময়ের সঙ্গে তাকাল–আপনার কি ধারণা এগোনোর মতো কোনো কিছু আমরা হাতে পেয়েছি?
জুড নীরব রইলেন।
–নিরাশ আপনাকে করছি না। আমরা সঠিক পথে প্রথম পদক্ষেপ ফেলেছি মাত্র। আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
দুজনে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। ঘরের ছাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় মুডি বলে ওঠে–হ্যাঁ, ফ্যামিলি।
–ফ্যামিলি?
–ডাক্তার, আপনি যখন বললেন, প্রত্যেকটা পেশেন্টের সব খবর আপনার জানা আছে, আমি বিশ্বাস করছি। যদি আপনি বলেন, ওদের কারও পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয়, তাও আমি মেনে নেব। মৌচাক যখন আপনার, মধুর মালিক তো আপনিই হবেন।
–না, অনেক সময় ওরা খবরটা জানাতে পারে না।
–এই তো হয়েছে।
–আপনি বলতে চাইছেন ওদের কোনো আত্মীয় আমাকে খুন করার চেষ্টা করছে?
–হতেও পারে।
–এই সম্ভাবনাটা খুবই কম।
–কথাটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবেন ডাক্তার সাহেব? গত পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে। আপনি যে সমস্ত পেশেন্টদের সঙ্গে দেখা করেছেন, তাদের নামের একটা তালিকা আমাকে দিতে পারবেন কি?
জুড কিছুক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে বললেন–না।
–ডাক্তার রোগীর গোপন সম্পর্কের ব্যাপার তো। কিন্তু আমার মনে হয় এক্ষেত্রে নিয়মের হেরফের হলেই ভালো হয়। মনে রাখবেন, আপনার জীবন বিপন্ন। আপনার একটা ভুল পদক্ষেপে সব কিছু শেষ হয়ে যেতে পারে।
–আপনি ভুল পথে এগোচ্ছেন মিঃ মুডি। আমার পেশেন্ট বা তাদের পরিবারের কোনো লোকজন এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে না। ওদের পরিবারের কারও মধ্যে পাগলামির লক্ষণ থাকলে সেটা মনোবৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতে এমনিতেই প্রকাশিত হয়ে পড়ত। পেশেন্টদের স্বার্থ আমাকে রক্ষা করতেই হবে।
–আপনি বলছেন ওদের ফাইলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই?
–অন্তত এমন কিছু নেই, যা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
জুড চোখ বন্ধ করে ফাইলের বিষয়গুলি ভাববার চেষ্টা করলেন। জন ম্যানসান থার্ড এভিনিউর শুড়িখানা থেকে নাবিকদের ধরে আনত। টেরি ওয়াশ বার্ন ছোটো ছোটো ছেলেদের নিয়ে যৌন সংযোগ করায়। চোদ্দো বছরের ইভলিন ওয়ারশ্যাক বাড়িতে থেকে বেশ্যা বৃত্তি করে।
অথচ বাইরের সমাজে এদের একটা সুন্দর পরিচয় আছে।
তিনি মুখ খুললেন–আমি দুঃখিত, ফাইল দেখাননা সম্ভব নয়।
দুকাঁধে কঁকুনি তোলে মুডি–কিছু অনাবশ্যক কাজ তা হলে আপনি আমাকে দিয়ে করিয়ে নিতে চাইছেন?
–আপনি এখন আমাকে কী করতে উপদেশ দিচ্ছেন?
–গত একমাসে আপনার পেশেন্টদের কথাবার্তার যেসব টেপ করেছেন, সেগুলো মন দিয়ে শুনুন। তবে এখন আর ডাক্তার হয়ে শুনবেন না, শুনবেন একজন গোয়েন্দা হিসেবে। কারোর বক্তব্যের মধ্যে এধার ওধার হয়ে গেলেই সেটা খেয়াল করে বুঝতে চেষ্টা করবেন।
–সেটা তো আমি শুনি, ওটাই আমার কাজ।
–আবার শুনুন। তবে চোখ ভোলা রাখবেন। রহস্য উদঘাটনের মধ্যে আপনাকে হারিয়ে ফেলার ইচ্ছে আমার একদম নেই।
ওভারকোট তুলে নিয়ে মুডি পড়তে শুরু করল। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, সে বুঝি ভালো নাচিয়ে। সে বলল–এত সবের মধ্যে সব থেকে মজার ঘটনা কী বলুন তো?
–কী?
–আপনি আগে থেকেই ধরে নিয়েছেন দুজন আপনাকে হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সংখ্যাতে আরও বেশি।
জুড হতভম্বআপনি বলতে চাইছেন একটা পাগল গোষ্ঠী আমার পেছনে লেগেছে?
–ডাক্তার, এই খেলার রেফারী সম্বন্ধে আমি, কিছু আন্দাজ করেছি। তার উদ্দেশ্য আমি জানি না। তবে পরিচয়টা পেয়েছি।
–কে সে?
–না ডাক্তার এখন নয়। বুলির মশলা মেখে মজুত না করে আমি বুলি ছোটাতে রাজী নই। আগে নিজে নিশ্চিত হই, তারপর আপনাকে জানাব।
–আশা করি আপনি সুনিশ্চিত হতে পারবেন।
–নিজের জীবনের যদি কানাকড়ি মূল্য দিয়ে থাকেন, তা হলে প্রার্থনা করুন আমার যেন ভুল হয়।
ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল।
ট্যাক্সি ধরে জুড অফিসে পৌঁছলেন। দরজার ভেতর থেকে চাবি আঁটলেন। চলে এলেন কাঠের তক্তাটার কাছে। এখানে টেপগুলো লুকোনো আছে। গোপন জায়গায় বোতাম টিপে তক্তাটাকে সরিয়ে দিলেন। পদবী অনুযায়ী টেপগুলো সাজানো। সর্বশেষ নেওয়া টেপটা রেকর্ডারে চালিয়ে দিলেন। এর আগে রোগীদের সমস্ত সাক্ষাতকার তিনি বাতিল করেছেন। তাকে অনেকটা সময় একলা থাকতে হবে। রোগীদের পরিবারের লোকেরা এই খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে, এটা সুদূর প্রসারী কল্পনা। তবু লোকটা যখন বলছে, একবার ভেবেই দেখা যাক।
রোজ গ্রাহামের সাক্ষাতকারের টেপটা তিনি শুনছিলেন।
–এটা একটা অ্যাকসিডেন্ট ডাক্তারবাবু, ন্যান্সি এমনিতেই কাঁদুনে বাচ্চা। তাকে যদি আমি আঘাত করি, তাহলে কী হবে বলুন তো।
–ও এত কাঁদে কেন তা জানতে চেষ্টা করেছেন কি?
–ওর বারোটা বেজে গেছে। ওর বাবা এর জন্য দায়ী। মেয়ে অন্ত যার প্রাণ ছিল সেই হ্যারি ওকে রেখে পালিয়ে গেল কী করে?
–আপনাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল না। তাই তো?
–না, বিয়ে আমাদের প্রায় হতে চলেছিল।
–কতদিন আপনারা এক সঙ্গে থেকেছেন?
–চার বছর।
–ন্যান্সির হাত ভেঙে দেবার যে ঘটনাটা বললেন সেটা কবে ঘটেছে?
–এক সপ্তাহ হবে বোধহয়। আসলে ওর হাত ভাঙাটা আমার ঠিক. ইচ্ছাকৃত নয়। মেয়েটা কিছুতেই কান্না থামাচ্ছে না দেখে আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। পর্দার হুড খুলে পিটিয়ে ছিলাম।
–আপনার কি মনে হয়, হ্যারি আপনার থেকেও ন্যান্সিকে বেশি ভালোবাসত?
-না-না, হারি আমার জন্যও পাগল ছিল।
–তাহলে সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেল কেন?
–কারণ সে পুরুষ, পুরুষ মানুষেরা কী জানেন তো? জন্তু। আপনারা প্রত্যেকে একটা জন্তু। আমার মনে হয় আপনাদের শুয়োরের মতো মেশিনে ফেলে কাটা উচিত।
এবার কান্না।
জুড টেপ বন্ধ করলেন। রোজ গ্রাহামের কথা ভাবতে থাকলেন। মেয়েটা পুরুষ বিদ্বেষী, এটাও এক ধরনের মনোবিকার। মারতে মারতে দু-দুবার সে নিজের ছবছরের মেয়ে ন্যান্সিকে মেরে ফেলার উপক্রম করেছিল। কিন্তু হ্যানসেন বা ক্যারলের মৃত্যুর সাথে ওর মানসিকতা খাপ খায় কী?
পরের টেপটা চালালেন তিনি। আলেকজাণ্ডার ফ্যালন।
–মি. ফ্যালন, পুলিশ বলছে আপনি নাকি মি. চ্যাম্পিয়ানকে ছুরি নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন?
–আমাকে যা বলা হয়েছে তাই করেছি।
–কেউ তাহলে আপনাকে এই নির্দেশ দিয়েছিল?
–সে যখন বলেছে।
–সে বলতে?
–ভগবান।
–হঠাৎ ভগবান বলতে গেলেন কেন?
–কারণ চ্যাম্পিয়ান লোকটা ভীষণ বদমাইস। সে একজন অভিনেতা। আমি দেখেছি, স্টেজে সবার সামনে সে একটা মেয়েকে চুমু খেয়েছে। চুমু খেয়েছে আর…
–বলে যান।
–তার বুকে হাত দিয়েছে।
–এতে কি আপনি রেগে গিয়েছিলেন?
–নিশ্চয়ই, রাগব না? এর মানে কী বলুন তো? এর মানে লোকটার মনে কামভাব জেগেছিল।
–এই জন্য ওকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন?
–সিদ্ধান্ত আমি নিইনি, বারবার আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? ভগবান নিয়েছেন। আমি কেবল তার আদেশ পালন করেছি।
–ভগবানের সঙ্গে আপনার প্রায়ই কথাবার্তা হয়?
–কাজ থাকলেই হয়। তিনি আমাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। কারণ আমার মন একেবারেই সাচ্চা। আর এটা হয়েছে কী করে জানেন? বলুন তো এই পৃথিবীতে কোন্ কাজটা সব থেকে পুণ্যের? বদ লোককে দেখো আর কেটে ফেলল।
আলেকজাণ্ডার ফ্যালন। বয়স পঁয়ত্রিশ। পাউরুটি কারখানার মালিকের সহকারী। কমাস মনোরোগের হাসপাতালে ছিল। তারপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু হ্যানসেনের মতো এক সমকামীকে সে হত্যা করবে কেন? ক্যারলের মতো প্রাক্তন বেশ্যা? না, এ দুজনকে হত্যা করার দায়িত্ব ভগবান কি তাকে দিতে পারেন?
ডাক্তার ভেবে দেখলেন, এ সম্ভাবনা খুবই কম।
আরও কয়েকটা টেপ চালিয়ে ঈপ্সিত বস্তু খুঁজে পেলেন না তিনি। নিরাশ হয়ে সোফায় গা এলিয়ে দিলেন। একটু পরে টেলিফোন বেজে উঠল।