২. প্রচুর মদ্যপান

০২.

 অশনি একটা বারে ঢুকে প্রচুর মদ্যপান করবে ভেবেছিল। কিন্তু শেষ অবধি তা করল না। মনে হল এ এমন একটা বিচিত্র সমস্যা যে গার্গীকে পুরোপুরি ভুলে যাওয়া তার উচিত হবে না। এব্যাপারে তারও কি কোন নৈতিক কর্তব্য নেই? তারকবাবু পাগলের মতো সেই ভোরবেলা থেকে গার্গীর খোঁজে ছুটোছুটি করছেন, তাঁকে সে সাহায্য করলেও পারত।এখনও পারে বৈকি। অন্তত গার্গী কোথায় গেল, এটুকু খোঁজ পেলেও চলে।

কিন্তু এ তো খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার শামিল। আশি লক্ষ লোক বাস করে বৃহত্তর কলকাতায়। আশি লক্ষের মধ্যে গার্গীর চেনাজানা কতজন, তার সঠিক হিসেব পাওয়াও মুশকিল। অশনি ক্রমশ নার্ভাস হয়ে পড়ছিল। মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছিল। এলোমেলো গাড়ি চক্কর দিয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সে একটা নিশ্চিত সূত্রের খোঁজ কোথায় মিলবে–শুধু একথাই ভেবে হন্যে হচ্ছিল। ফোর্টের পিছনে গঙ্গার ধার ঘুরে যখন ইডেনের কাছে সে গাড়ি থামাল, তখন বেলা সাড়ে দশটা। ভেতরে ঢুকে একটা গাছের নিচে বসে সে কিছুক্ষণ ভাবল তারপর ঠিক করল, গার্গীর আপিসে যাওয়া যাক!

একটা সিগারেট আস্তে সুস্থে শেষ করে উঠল। গার্গীর আপিস ডালহৌসি পাড়ায়। সাততলা বাড়ির পাঁচতলায় দুটো ছোট্ট ঘর। একটা ছোট প্রাইভেট কোম্পানি। ওখানে সে একবারও যায়নি। গার্গীর বর্ণনা শুনেছে শুধু। গার্গী সেখানে টাইপ করত, আবার ফাইলপত্তরও নাকি সামলাত। বাড়ির নিচে রাস্তায় অশনি বার দুই গার্গীর জন্যে অপেক্ষা করেছিল। রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়েই সামনে লিফট দেখা যায়।

অশনি যখন সেখানে পৌঁছল, তখন বাড়িটায় কাজের অর্কেস্ট্রা বাজছে। সামনে একটা ফাঁকে গাড়ি পার্ক করে সে এগিয়ে গেল। লিফটের জন্যে লাইনে দাঁড়াল।

পাঁচতলায় পৌঁছে অশনি দেখল অসংখ্য প্রাইভেট কোম্পানির আপিস সেখানে। দেয়ালে ছোট্ট ফলকে লেখা : দয়াময়ী ট্রেডিং করপোরেশন। হ্যাঁ, এটাই বটে। বাঁদিকে তীরচিহ্ন। সে বাঁদিকে এগিয়ে একটু পরেই কোনার দিকে আপিসটা দেখতে পেল। বাইরে টুলে একজন উর্দিপরা বেয়ারা বসেছিল। তাকে অগ্রাহ্য করে স্মার্ট ভঙ্গিতে অশনি ভেতরে ঢুকে পড়ল। বেয়ারাটা কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিল, কিন্তু বলেনি।

ঘরটা মোটামুটি চওড়া। চার পাঁচটা টেবিলে জনাতিন কর্মচারী কাজ করছে। তাদের একজন মহিলা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। বাকি দুজনের একজন অশনিরই বয়সী, অন্যজন প্রৌঢ়। একটা টেবিলে টাইপরাইটার আছে। কোন কর্মচারী নেই। তা হলে গার্গী ওখানেই বসত। ঘরের বাঁদিকে একটা কাঠের চেম্বার। ওখানে নিশ্চয় মালিক ভদ্রলোক বসেন। ঘরের কোনায় অনেকগুলো কাঠের প্যাকবাকসো। অশনি ঢুকে দ্রুত সবকিছু দেখে নিচ্ছিল। তারপর টের পেল টেবিলের লোকগুলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন সে যুবক কর্মচারীটির দিকেই এগিয়ে গেল। নমস্কার করে বলল, ইয়ে–মিস গার্গী রায় কি এসেছেন?

যুবকটি জবাব দিতে যেন সময় নিল। তার চোখে চাপা কৌতূহল এবং একইসঙ্গে রসিকসুলভ কোন ভাব টের পেল অশনি। সে তো স্বাভাবিকই। কে জানে, গার্গী এর সঙ্গেও প্রেম করছিল কি-না। যুবকটি তারপর ঘাড় নাড়ল।

অশনি বলল, আসেননি?

–এলে তো দেখতে পেতেন! ..বলে যুবকটি ফাইলে কী লিখতে শুরু করল।

পাশের টেবিল থেকে প্রৌঢ় ভদ্রলোক বললেন–দাঁড়িয়ে কেন? বসুন।

অশনি বসল। প্রৌঢ় লোকটিকে অমায়িক এবং সদালাপী বলেই মনে হচ্ছিল তার। খুব পান খান। কৌটো থেকে একটা পান বের করে মুখে দিয়ে বললেন–ওনার সঙ্গেই দরকার?

অশনি বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

একটু বসুন। এসে পড়তেও পারেন!

যুবকটি বলল, আসবেন না। কাল আপনাকেই তো বলে গেলেন, না আসতেও পারি! মৃদুলাদি, তাই বললেন না মিস রায়?

মৃদুলা নামে মহিলাটা একটু হেসে বললেন, শিবুদার মাথায় অত বাড়তি কথা রাখার জায়গা আছে? এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের হিসেব-নিকেশে মাথার পুরোটা জ্যাম। তাই না শিবুদা?

শিবুদা হেসে ফেললেন। তা যা বলেছ! আজ্ঞে হ্যাঁ, ভুলেই গেছি কথাটা। কিন্তু … বলে হঠাৎ লাফিয়ে উঠলেন। তাহলে আমি করছি কী! দেখছ কাণ্ডটা? মিস রায় এসে চিঠিগুলো টাইপ করবেন ভেবে গোছগাছ করছি–আর এদিকে …উনি কথা অসমাপ্ত রেখে আরও জোরে হেসে ফেললেন।

অশনি বলল, আসব না বলে গেছেন তাহলে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। কাল যাবার সময় বললেন, কোথায় যেন কী কাজ আছে। আটকে যেতে পারেন। এগারোটার মধ্যে এলে ভাল নয়তো আর আসছেন না। …শিবুদা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ..নীরেন, ভাইটি! এই চিঠিগুলো নিচে অভয়ের ওখান থেকে টাইপ করে নিয়ে আয় তো! খুব আরজেন্ট। লক্ষীটি ভাই আমার!

উনি চিঠিগুলো যুবকটির টেবিলে এগিয়ে দিলেন। অশনি মরিয়া হয়ে বললে, ইয়ে–কোথায় যাবেন-টাবেন, কিছু বলে যাননি মিস রায়?

না তো! ..শিবুদা বললেন। আপনার সঙ্গে আজ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল বুঝি?

অশনি বলে ফেলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। বিশেষ জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।

মৃদুলাদি তেমন হেসে বললেন, গার্গীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট তো! ওইরকমই।

অশনিও হাসল। ঠিক বুঝলুম না!

মৃদুলাদি হঠাৎ কেন যেন চটে গেলেন। বললেন, বোঝাবুঝির কী আছে! এ তো আজ নতুন দেখলুম না। যেদিন আপনার মতো কারও সঙ্গে নাকি অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে, সেদিনই গার্গী আসে না। আর আমাদেরই হাজার কৈফিয়ত দিয়ে মরতে হয়!

নীরেন নামে যুবকটি চিঠিগুলো নিয়ে বেরোচ্ছিল, অশনি উঠল। বাইরে করিডরে যেতেই নীরেন তাকে দেখে দাঁড়াল। একটু হেসে বলল, আপনি কোথায় যাবেন স্যার? নামটাম বলে গেলেও উনি যদি আসেন জানাব।

অশনি একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, আমার নাম অশনি দাশগুপ্ত। আমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার একজন সাংবাদিক।

নীরেন তক্ষুনি গলে গেল। ফের হাত তুলে নমস্কার করে বলল, আপনার নাম আমার খুবই চেনা স্যার। এই তো কাল না পরশু, স্কাইক্র্যাপারের আগুন লাগার প্রব্লেম্ নিয়ে কাগজে লিখেছেন! ঠিক বলিনি স্যার?

অশনি মৃদু হেসে বলল হ্যাঁ।

নীরেন অনুশোচনার ভঙ্গিতে বলল, তা আগে বলতে হয় স্যার! তা ইয়ে– মিস রায়ের সঙ্গে আপনার চেনাশোনা, নাকি রিলেটিভ?

–না, এমনি চেনাশোনা।

–কোন পার্সোনাল ব্যাপার যদি না হয়, ধরুন আপনার লেখার মেটিরিয়ালের জন্যে কোন ফ্যাক্ট-ফিগার দরকার হয়, আপনি স্যার আমাকেও বলতে পারেন!

অশনি আবার একবার টের পাচ্ছিল, আজকাল খবরের কাগজ মানুষকে কতখানি গিলে খেয়েছে। কিন্তু খবরের কাগজের প্রভাব এবার সে অনায়াসেই এই যুবকটির ওপর খাটাতে পারে। সে বলল, না। তেমন কিছু নয়। ব্যাপারটা পার্সেনাল–তবে আপনাকে না জানাবার মতোও নয়। ওর ভাই দীপুর। পড়াশুনোর জন্যে একজন প্রাইভেট টিউটরের কথা বলেছিল। তাছাড়া ও বাসা বদলাবার জন্যেও চেষ্টা করছে তো। ফ্ল্যাট-ট্যাট যদি পেয়ে যায় সুবিধেজনক ভাড়ায়, আমি চেষ্টা করেছিলুম। এসব ব্যাপারেই আজ ওকে বলতে এসেছিলুম।

অশনি অনর্গল এইসব মিথ্যা বলে ফেলল। করিডোর সঙ্কীর্ণ। শেষ মাথায় গিয়ে লিফটের সামনে নীরেন একটু হেসে চট করে বলল–আপনি স্যার একজন নামকরা লোক। আপনাকে বলতে আপত্তি নেই। আপনার সঙ্গে মিস রায়ের কতটা কি জানাশোনা, আমি জানিনে। যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা কথা বলতুম। কিন্তু এভাবে তো হবে না। চলুন, নিচে গিয়ে চিঠিগুলো টাইপ করতে দিই। তারপর কোথাও একটুখানি বসব।

অশনি প্রচণ্ড কৌতূহল চেপে বলল, নিশ্চয়।

 লিফটে নিচে নেমে নীরেন বলল, একমিনিট দাদা। এক্ষুনি আসছি।

স্যার থেকে দাদায় পৌঁছনোতে অশনি টের পেল, তার অনেক সুবিধে হবে। গার্গীর ব্যাকগ্রাউন্ড অন্তত কিছুটা এই যুবকটা জানে, তাতে কোন ভুল নেই। গার্গীর অন্তর্ধানের সূত্র টের পেলে অশনি অন্তত ধাতস্থ হতে পারবে।

একটু পরেই নীরেন বেরিয়ে এল। তাকে কৃতার্থ মানুষের মতো নমনীয় দেখাচ্ছিল। সে বলল, ওই রেস্তোরাঁয় বসতে আপত্তি নেই তো দাদা?

–মোটেও না। চলুন। …বলে একটু এগিয়ে তার গাড়িটা দেখে নিল। তারপর পা বাড়াল।

অশনি ছোট্ট করে হু বলল। পাশের রেস্তোরাঁয় ঢুকে দুজনে কোনার দিকে একটি নিরিবিলি টেবিলে বসল। তারপর অশনি বলল, কী খাবেন বলুন?

নীরেন জিভ কেটে করজোড়ে বলল, প্লিজ দাদা! আমি হোস্ট। আমার লাক, তাই আপনার সঙ্গে আলাপ হল।

–বেশ। কিন্তু স্রেফ চা। অশনি সিগারেট বের করে ওকে দিল। …কারণ, আমি খেয়ে বেরোইনি। গিয়ে খাব। এখন চায়ের বেশি কিছু না।

নীরেন বলল, আপনি সিগারেট দিলেন! ঠিক আছে–চা খেয়ে আমার ব্র্যান্ড খেতে হবে কিন্তু।

অশনি দেশলাই ধরিয়ে দিতে দিতে বলল, নিশ্চয়।

 চায়ের অর্ডার দিয়ে নীরেন চোখ বুজে সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে বলল, কথাটা এবার বলি। ইদানীং এক ভদ্রলোক প্রায়ই মিস রায়ের কাছে আসেন। আমার বা আপনার চেয়ে একটু বেশি বয়েস। খুব সায়েব সেজে আসেন। গাড়ি নিয়ে আসেন। গাড়িতে একটা ইয়া বড় অ্যালসেসিয়ানও দেখেছি। ভদ্রলোকের নাম।…

কথা কেড়ে অশনি বলল, সুনীথ ব্যানার্জি।

নীরেন ঘাড় নেড়ে বলল, না।

–দীপঙ্কর সেন?

 নীরেন নড়ে বসল।–হ্যাঁ, দীপঙ্কর সেন। বলবেন, নাম কীভাবে জানলুম। তাই তো? একদিন ভদ্রলোক ফোন করেছিলেন। মিস রায় সেদিন আসেননি। ভদ্রলোক বললেন, বলবেন দীপঙ্করবাবু ফোন করেছিলেন। আমার দাদা সব কাজে একটু ইয়ে আছে। বললুম, পুরো নাম বলুন স্যার। লিখে রাখব। ওই নামে আমাদের পার্টি আছে কিনা।

নীরেন হাসতে লাগল। অশনি বলল, তাই বুঝি?

নীরেন গম্ভীর হয়ে গেল হঠাৎ। গতকাল বিকেল চারটেয় দীপঙ্করবাবু এলেন। মিস রায় আমাদের মৈত্র সাহেবের কাছে সকাল-সকাল ছুটি নিয়ে বেরোলেন।

–মৈত্র সাহেব কে?

–প্রোপ্রাইটারের ছেলে। আর মৈত্র। মালিক বুড়ো হয়েছেন–একটু অসুস্থও বটে। তাই মাসখানেক থেকে ওনার ছেলে এসে চেম্বারে বসছেন। তা যা বলছিলুম, গতকাল মিস রায়কে উনি ডেকে নিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা কেমন লাগল।

-কেন?

দীপঙ্করবাবুর চেহারা কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছিল। গতকাল মিস রায়ও খুব কথা বলেন না। শিবুদা জিগ্যেস করলে বললেন, শরীর ভাল না। মহিলাদের শরীর নিয়ে প্রশ্ন করা উচিত নয়, কী বলেন?

–হুঁ। তারপর?

দীপঙ্করবাবু ঢুকে তুষোমুখে দাঁড়ালেন। অমনি মিস রায়ও মুখ হাঁড়িপানা করে মৈত্র সায়েবের চেম্বারে ঢুকলেন। তারপর বেরিয়ে কোন কথাবার্তা নয়– দুজনে চলে গেলেন। আমরা তো হাঁ করে বসে রইলুম।

চা এসে গেল। দুজনে চায়ে চুমুক দিল। তারপর অশনি বলল, ওই ভদ্রলোক এর আগেও এসেছেন বলছেন?

–হ্যাঁ। বেশ কয়েকবার।

–ওঁর নামই যে দীপঙ্কর সেন, কীভাবে বুঝলেন? কেন? কতবার ফোন করেছেন। চেনা গলা, তাছাড়া মিস রায় ফোন ধরে মিঃ সেন কথাটা বলেছেন মাঝে মাঝে। দুইয়ে দুইয়ে চার হবে না কেন বলুন?

অশনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার ভুল হতেও পারে। মিস রায় কি আপনাদের কারও কাছে বলেছেনে যে, উনিই দীপঙ্কর সেন? কিংবা ওঁকে আপনাদের সামনে কি কোনসময় মিঃ সেন বলে ডেকেছেন?

নীরেন একটু ভেবে একটু হাসল–আপনি দাদা একজন সাংবাদিক। আপনার মতো অত তলিয়ে কিছু ভাবিনে। আপনার যুক্তি অগ্রাহ্য করা যায় না বটে; তবে আমার বিশ্বাস, উনিই দীপঙ্করবাবু, তাতে কোন ভুল নেই।

অশনি আর ও নিয়ে কোন প্রশ্ন করল না। কাল যে ভদ্রলোক বিকেলে দয়াময়ী ট্রেডিং কর্পোরেশনে এসে গার্গীকে ডেকে নিয়ে যান, তাঁর নাম দীপঙ্কর সেন হতেও তো পারে। অশনি গার্গীকে যতই ভালবাসুক, ওভাবে ডেকে নিয়ে যেতে কিছুতেই পারত না। নাকি ভালবাসার শেষ সীমায় পৌঁছলে ওভাবে ডেকে নেওয়া সম্ভব হয়? শেষ সীমা বলেতে দেহ-টেহ বোঝায় কি না তাও অবশ্য অশনি জানে না।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে নীরেন বলল, দাদা, যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা বলি। বলব?

অশনি যেন ঘুম থেকে জেগে বলল, নিশ্চয়, নিশ্চয়!

নীরেন ফিসফিস করে বলল, মিস রায়ের সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক জানি না। কিন্তু উনি ক্লিন মেয়ে নন, দাদা।

অশনি একটু চাল।–ক্লিন নয় মানে?

নীরেন আরও চাপা গলায় বলল, স্পষ্ট কিছু বুঝিয়ে বলতে পারব না। তবে ওঁর চলাফেরাটা কেমন যেন মিসট্রিয়াস।

কথাটার প্রতিধ্বনি উঠল অশনির গলায়–মিসট্রিয়াস?

আজ্ঞে হ্যাঁ! মধ্যে মাঝে প্রায়ই দুম্ করে অফিস থেকে কেটে পড়েন। গাদাগাদা ফোন আসে, আবার মৈত্র সায়েবও দেখি ইদানীং ওনার সঙ্গে চেম্বার লক করে কী সব গুজুর-গাজুর করেন। ব্যাপারগুলো ঠিক বোঝা যায় না।

–আজ মৈত্র সায়েব আসেনি?

উনি বারোটায় আসেন। আবার কোনদিন দেরিও হয়।

অশনি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, ঘড়ি দেখে বলল, আজ তাহলে উঠি নীরেনবাবু। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে সুখী হলুম। আচ্ছা নমস্কার।

 বলে সে নীরেনকে হতবাক রেখেই বেরিয়ে গেল এবং সটান গাড়িতে ঢুকল। জোরে বেরিয়ে গিয়ে বড় রাস্তায় গতি কমাল। না কমিয়ে উপায় ছিল না। ট্রাফিকে আলো লাল। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার চোয়াল আঁটো দেখতে পেল। ব্যাকভিউ মিররে তাকিয়ে নিজের মূর্তি দেখে সে চমকাল। তাকে কি অ্যাগ্রেসিভ দেখাচ্ছে এখন? তার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে, এটা ঠিক। আশ্চর্য লাগে গার্গী তার এতখানি পুরুষসুলভ ঈর্ষার কারণ হবে, সে আগে টের পায়নি।

তবে তার চেয়েও আশ্চর্য লাগে, শেষ যেদিন দেখা–গার্গী তাহলে তার সঙ্গে সবটা অভিনয় করছিল আগাগোড়া? নিশ্চয় অভিনয়! তা নাহলে কোন এক বাস্টার্ড দীপঙ্কর সেনের সঙ্গে।…

প্রি প্রি প্রি! সিগনাল সবুজ হয়েছে। সামনে কোন গাড়ি নেই। পিছনে গাড়ি জ্যাম হয়ে গেছে। ট্রাফিক পুলিশটা দৌড়ে এল হুইসল বাজিয়ে। অশনি গিয়ার টেনে অ্যাকসিলেটরে চাপ দিল।

এসপ্ল্যানেড গিয়ে সে ভাবল, এভাবে কোথায় যাচ্ছে? কিন্তু সচেতন ভাবনার প্রতি অচেতন ইচ্ছার কোন দৃকপাতই নেই। সে দেখল, তার গাড়ি রেড রোডে দ্রুত চলেছে। কিন্তু কিছু করার নেই। তার শরীর ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে, কিছু একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া অব্দি এই উত্তেজনা কিছুতেই শেষ হবে না।

.

রাস্তার নাম তারকবাবুর মুখে শোনার পরই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ভবানীপুর এলাকায় এই রাস্তাটা একটা বড় রাস্তা থেকে আরেকটা সমান্তরাল বড় রাস্তায় পড়েছে। একটা গেটের গায়ে ফলকে তে আছে ইভনিং লজ। দারোয়ান আছে। বোঝা গেল, গার্গীর এই মক্কেলটিও এক কাপ্তান। কে জানে এরও বিলিতি বউ-টউ আছে নাকি।

তার গাড়ির সাড়া পেয়ে দারোয়ান বেরিয়ে সেলাম দিল। বলল, সেনসাহেব নেহি হ্যায় সাব।

কখন বেরিয়েছেন?

 সুবে মে।

–ঠিক হ্যায়। কখন ফিরবেন কিছু বলেছেন?

–দো চার রোজ দের হোগা, সাব। বাহার গয়ে কৌন জরুরি কামমে।

মেমসাব?

দারোয়ান একটু অবাক হয়ে বলল–মেমসাব? কোই মেমসাব তো নেহী হ্যায়, সাব। উনহি একেলা রহৃতা সির।

-কেন? সাদী নেই কিয়া তুমহারা সাব?

জী নেহী। বলে দারোয়ান একটু হাসল। …আপ জানতা নেহী?

 অশনি মাথা দোলাল মাত্র। তোমার সায়েব গেলেন কিসে? গাড়িতে নিশ্চয়? একা?

দারোয়ানের মুখে এবার বিব্রত হওয়ার ভাব ফুটে উঠল। কিন্তু তার মনিবের তুল্যমুল্য আরেক সায়েবকে অস্বীকার করতেও তার দ্বিধা স্বাভাবিক। সে বলল–গাড়িমে হাওড়া টিশনতক। জী হ–একেলা, ড্রাইভার পছ দেকে, আয়া।

ড্রাইভারকে একটু ডেকে দেবে?

অশনি নিজের প্রশ্নে নিজেই বিস্মিত হল। হয়তো বেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই পরমুহূর্তেই সে বলল–আমার সঙ্গে তোমার সায়েবের জরুরি অ্যাপয়েমেন্ট ছিল আজ। অথচ দেখছি উনি চলে গেছেন। নিশ্চয় আরও কোন জরুরি ব্যাপার। তা না হলে হঠাৎ যাবেনই বা কেন?

দারোয়ান ব্যাপারটা বুঝেছে মনে হল। সে তক্ষুনি লনের দিকে ঘুরে ডাকতে থাকল–চমনলালজী! ইধার আও না ভেইয়া!

একটা রোগা পটকা ফো লোক খালি গায়ে পরনে ফুলপ্যান্ট, খৈনি ডলতে ডলতে গেটের ওপাশে দাঁড়াল। দারোয়ান বলল, ইয়ে সাব পুছা রাহা।..

চমনলাল অশনির দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল–আপ মৈত্র সাহাব?

অশনি চাঞ্চল্য চেপে মাথা দোলাল।

–এক মিনাট ঠারিয়ে। সাহেব আপকে লিয়ে এক খত দেনে বোলা। আনেকা বাত থা না আপকা?

জরুর। তো কঁহা চলা গয়া সেনসাহাব?

–মোহনপুর।

বলে চমনলাল পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা খাম বের করে দারোয়ানের হাতে দিল। দরোয়ান সেটা অশনিকে দিল। অশনির বুক কাঁপতে শুরু করেছিল। সে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল খামটার ওপরে। মিঃ আর মৈত্র লেখা আছে

খামের মুখ আঠা দিয়ে আটা। সে যে স্বয়ং মৈত্ৰসাহেব, এটা বোঝাবার জন্যে দ্রুত খামের মুখ ছিঁড়ে ফেলল এবং একটা ভাজকরা কাগজ পেল! কাগজটা একটু খুলেই পড়ার ভঙ্গি করে আবার খামে ঢুকিয়ে ফেলল। তার হাত কাঁপছিল। এই মৈত্র সাহেবের নিশ্চয় আসার কথা ছিল। যেকোন মুহূর্তে এসে পড়বেন হয়তো। এতএব এখনই কেটে পড়তে হয়। সে স্টার্ট দিল এবং ঠিক আছে বলে জোরে বেরিয়ে গেল।

একটুখানি এগোতেই সামনের দিক থেকে একটা গাড়ি এসে পড়ল। পাশ কাটিয়ে যাবার সময় অশনির চোখ পড়ল সেই গাড়ির আরোহীর দিকে। নিজেই ড্রাইভ করছেন ভদ্রলোক। রীতিমতো একজিকিউটিভ টাইপ চেহারা। গলায় টাই আছে। মুখে পাইপ রয়েছে।

গতি কমিয়ে অশনি ব্যাকভিউ আয়নায় চোখ রাখল। গাড়িটা যখন আয়নার আড়ালে চলে গেল, তখন সে ব্রেক কষে মুখ বের করে ঘুরল। নাম্বারটাও মনে রাখল।

যা সন্দেহ করেছিল, ঠিক তাই। গাড়িটা দাঁড়িয়েছে সেই গেটে। অমনি অশনি গিয়ার টেনে এবং অ্যাকসিলেটারে চাপ দিয়ে জোরে এগোলো। বড় রাস্তায় পৌঁছে আর পিছু ফিরে দেখার সাহসও পেল না। বাঁদিকে ঘুরে কিছুদূর যাবার পর ট্রামলাইন পেরিয়ে সে সামনের ছোট রাস্তায় ঢুকে পড়ল।

তারপর এগলি-ওগলি গোলকধাঁধায় ঘোরার মত ঘুরতে ঘুরতে একসময় সার্কুলার রোডে পৌঁছল। সেখান থেকে ফের ঘুরপথে একেবারে নিজের ফ্ল্যাটে।

ঘর খুলে ঢোকার পর আগে সে পুরোদমে ফ্যান চালিয়ে দিল। জামা খোলার তর সইল না। চিঠিটা বের করল।

কিন্তু চিঠিটা তাকে হতাশই করল। ইংরেজিতে লেখা আছে : মাই ডিয়ার মৈত্র, কনগ্রাচুলেশান। অল ও. কে। প্লিজ ডোন্ট বি অ্যাংশস। উইথ বেস্ট রিগার্ডস, ইয়োর্স …ইত্যাদি। তলায় জড়ানো হরফে ডি. সেন। ২.৬.৭৫. এবং ৬ সংখ্যা রোমান হরফে লেখা। এ অভ্যাস তো অনেকেরই থাকে।

মৈত্রের ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, তেমন কিছু নয়। দয়াময়ী ট্রেডিং কর্পোরেশনের মৈত্রই যে ওই আর মৈত্র তারও কোনও যুক্তি নেই। শুধু একটা পরিষ্কার সূত্র পাওয়া গেল; দীপঙ্কর সেন মোহনপুরে গেছে। বিহারের মুঙ্গের জেলায় একটা হিলস্টেশন আছে মোহনপুর নামে। কিন্তু এছাড়া আরও মোহনপুরও তো থাকতে পারে।

অশনি ভাবতে বসল।…।

.

দ্বিতীয়বার অশনি যখন ফ্ল্যাট থেকে বেরুল, তখন সে একটা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে স্থির। তাকে খুব শান্ত ও সংযত দেখাচ্ছিল। কৈলাস বোস স্ট্রিটের মোড়ে গাড়ি রেখে সে গেল গার্গীদের বাসায়। এর আগে কোনদিন সে এ বাড়ি ঢোকেন। সেই একবার মাত্র কৃষ্ণার জন্মদিনের পার্টির রাতে প্রথম গার্গীকে বড় রাস্তা অবধি পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল শুধু।

বাড়িটা পুরনো। সে একটা সংকীর্ণ প্যাসেজের মুখে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল। তারপর সদরদরজার কড়া নাড়ল। এক মহিলা দরজা খুলে দিয়ে বললেন, কাকে চাই?

-তারকবাবু আছেন কি?

-উনি তো এই একটু আগে বেরিয়েছেন। ওঁর ছেলে দীপু আছে। ডেকে দেব?

–তাই দিন।…

একটু পরে বছর ষোল-সতের বয়সের ছিপছিপে গড়নের একটি কিশোর এসে দাঁড়াল। অবিকল তারকবাবুর মতো দেখতে। অশনির অবাক চোখে তাকাল।

অশনি বলল, আমার নাম অশনি-তোমার বাবা, আমার কাছে গিয়েছিলেন। তোমার দিদির খবর পেলে কি না খোঁজ নিতে এসেছি।

দীপু বলল–বাবা বেরিয়েছেন।

অশনি বলল–তাহলে গার্গীর খোঁজ পাওয়া যায়নি?

দীপু ঘাড় নাড়ল।

এক মুহূর্ত ইতস্তত করে অশনি চলে এল।

দারুণ একটা প্রতিহিংসা তাকে যেন পেয়ে বসেছে। এটা চরিতার্থ করা ছাড়া তার যেন মুক্তি নেই। কিন্তু তারও আগে নিঃসংশয় হওয়া দরকার, দীপঙ্কর সেনের সঙ্গে সত্যি গার্গী গেছে কি না।

একটা পাবলিক বুথ থেকে সে হাওড়া স্টেশনে ফোন করল। সাংবাদিক। হওয়ার অনেক সুবিধে আছে। রেলদফতরে জানাশোনা কম নেই। আপাতত জানা দরকার মোহনপুরে যাওয়ার গাড়ির খবরাখবর। জানল, মোহনপুরের গাড়ি ছিল সকাল সাতটায়। ফের আছে ৬-৪৭ এ।

এবার অফিসে যাবে অশনি। সেখান থেকে ফের ফোন করবে জানাশোনা এক রেলকর্মচারীকে। আজ সকাল ৭টার ট্রেনে দীপঙ্কর সেন নামে যে গেছে, তার সঙ্গে কোন মহিলার নামে রিজার্ভেশান ছিল কি না, জেনে নেবে। তারপর যা করার করবে।…