খোকা মাসকয়েকের হতে সেন সাহেব আর অনিন্দিতা তোড়জোড় করেছিলেন খোকাকে নিয়ে গিয়ে, জেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ভিক্ষা করে সুনীলকে পুত্ৰমুখ দেখাবার জন্যে, কিন্তু চাই বাদ সেধেছিল। বলেছিল, এ দৈন্য অসহ্য! এ হ্যাংলামি বরদাস্ত করা যায় না। লোহার গরাদের ভিতর থেকে ছেলেকে দেখবে ও? ছি ছি।
তবে আর কী করা?
চন্দ্রাও তো আর যেতে চায় না।
বলে, দেখলে অসহ্য লাগে। ওকে চিনতে পারি না।
তবে আর তার মুখটা ভুলতে বসছে কিনা এ প্রশ্ন যেন?
কিন্তু আড়াইটা বছর তো শেষ হবেই।
না কি হবে না? বিশ্বাসের বাইরে চলে যাচ্ছে কেন।
.
ভবানীবাবু তাঁর বসবার ঘরের টেবিলের সামনে বসে একটা খাতার পৃষ্ঠা ভরে হিজিবিজি করে ওই কথাটাই লিখে চলেছিলেন, ব্যাপারটা ক্রমেই যেন বিশ্বাসের বাইরে চলে যাচ্ছে।…মনে হচ্ছে সময়টা যেন আমার প্রত্যাশার দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টিতে তাকিয়ে অবিরত পিছিয়ে চলেছে।.নীল কি সত্যিই কোনওদিন আসবে?
বিজ্ঞ বিচক্ষণ প্রৌঢ় ভবানী রায়ও এমন একটা অবাস্তব চিন্তার মধ্যে পাক খাচ্ছেন। তাঁর মধ্যেও সেই অনুভূতির স্নায়ুগুলো যেন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে।…
নীলুকে ওরা জালে ফেলে ধরে একটা পাঁকের কুণ্ডে ফেলে দিল, আমি কিছু করতে পারলাম না।..নীলুর গায়ের ওই পাঁকটা কি কোনওদিন সাফ হবে? আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে নীলু বোধহয় আর কোনওদিন তেমন করে বাবা বলে ডেকে উঠবে না।
বাবা!
ভবানীবাবু চমকে উঠলেন।
না, এ গলা নীলুর নয়, তার বউয়ের।
ভবানীবাবু খাতাটা মুড়ে রেখে বললেন, ছোটবউমা? এসো মা।
চন্দ্রা টেবিলের ধারটায় হাত রেখে আস্তে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব বলব ভাবছি, বলতে পারছি না।
আশ্চর্য, চন্দ্রার প্রকৃতিতে কী অদ্ভুত পরিবর্তন। যা মুখে আসে ফট করে বলে বসে, এই তো চন্দ্রার চিরদিনের প্রকৃতি।
চন্দ্রা বিয়ের কনে, এসে শ্বশুরকে বলে বসেছিল, এ মা আপনি নস্যি নেন? কী বিচ্ছিরি!…এই কিছুকাল আগেও বলেছিল, যাই বলুন বাবা আপনি ইচ্ছে করে বুড়ো বুড়ো হয়ে থাকেন। আমার বাবাকে দেখুন তো? একটু স্মার্ট হবার চেষ্টা করুন তত বেয়াইয়ের মতো।
দুমদাম এমন কত কথা বলেছে এক সময় চন্দ্রা।…মানে যে সময় সুনীলের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে মুখে। আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে।
আজ চন্দ্রা কথা বলতে ভাবে, দ্বিধা করে।
ভবানীবাবু বললেন, এই দ্যাখো বলতে পারছ না কী গো মা? বলো।
চন্দ্রা বলে ফেলে, এমনি কাগজ দেখে একটা চাকরির জন্যে অ্যাপ্লাই করেছিলাম, ইন্টারভিউতে ডেকেছে
ভবানীবাবু থতমত খেয়ে যান।
ভবানীবাবুর চিন্তার আয়নায় এমন ছবি ফুটে ওঠেনি, চন্দ্রার বিনীত নিবেদনের ভঙ্গিতে। ভবানীবাবু অনুমান করছিলেন এবার বোধহয় চন্দ্রা হাঁপিয়ে উঠেছে। নিউ আলিপুরে চলে যাবার কথা বলতে এসেছে। ভাববার সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করে ফেলছিলেন দ্বিরুক্তি করবেন না।
কিন্তু এখন?
তবু দ্বিরুক্তির ভাষাটা যতটা সম্ভব মোলায়েম করে উচ্চারণ করলেন। বললেন, চাকরির দরখাস্ত করেছিলে? কেন গো মা?
চন্দ্রা টেবিলে হাতটা বুলোতে বুলোতে বলে, এমনি। মানে কাজটাজ তো কিছু নেই, চুপচাপ বসেই থাকি সারা দুপুর
ভবানীবাবু মৃদু কৌতুকের সুরে বলেন, শাশুড়ির মতো দিবানিদ্রাটা শিখে নিতে পারছ না বুঝি?
এ কথার উত্তর দেবার দরকার হয় না, চন্দ্রা একটু হাসল। তারপর বলল, খোকাও তো লায়েক হয়ে উঠেছে, আমায় আর গণ্যই করে না। নিজেকে এমন নিষ্কর্মা নিষ্কর্মা লাগে।
ভবানীবাবু ওর নিচুকরা মুখটার দিকে তাকিয়ে দেখেন। ওর মধ্যে থেকে সেই আহ্লাদে ভাসা অহংকারী অহংকারী ভাবটা খুঁজে বার করতে চেষ্টা করেন।…পান না। তবু আবারও কৌতুকের গলায় বলেন, তা তো লাগে। এদিকে তুমি চাকরি করছ শুনলে তোমার বাবাটি কী ভাববেন শুনি।
বাবা আবার কী ভাবতে যাবেন?
এই দ্যাখো! ভাবতে যাবেন না? ভাববেন শ্বশুর ব্যাটা আর ভাত জোগাতে পারল না তাঁর মেয়ের!
চন্দ্রা একটু হেসে বলল, তা বাবার যা বুদ্ধিশুদ্ধি, ভাবতেও পারেন। সে কথা ছেড়ে দিন।
ছেড়ে দেব? ছেড়ে দিতে বলছ?
ভবানীবাবু সেই মুড়ে রাখা খাতাটার মলাটের উপরই আবার আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বলেন, আচ্ছা, তোমার বাবার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।…কিন্তু আমার বাবা?
চন্দ্রা চমকে বলে, কী বলছেন?
বলছি–তোমার বাবার কথা ছেড়েই দিচ্ছি, কিন্তু আমার বাবার কাছে কী জবাব দেব?.মুখ তুলে তাকান ভবানীবাবু।
চন্দ্রাও সোজাসুজি তাকায়।
আস্তে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বলে, সে জবাবটা না হয় আমার ভাগেই রাখুন।
ভবানীবাবু আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেন, তা কী হয়? সে যদি বলে, আপনি তো ছিলেন!
চন্দ্রা একটু অনুনয়ের গলায় বলে, আমি তো অভাবের জন্যে চাইছি না বাবা! মানে আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না
পেরেছ ছোট বউমা। তোমার এই বাবাটা স্মার্ট নয় বলে যে বোকা হাবা, তা ভেবো না। কিন্তু ভাবছি শুধু আমি বুঝলেই কি হবে? আর যদি কেউ না বুঝতে চায়?
না বুঝলে, উপায় কী?
ভবানীবাবু বোঝেন চন্দ্রা সংকল্পে স্থির।
ভবানীবাবুর হাতের কলমটা আবার খাতায় মাথা ঘষে।
.
ভবানীবাবু একটু থেমে বলেন, কাজটা কী?
খুব তুচ্ছ, বাবা!
তা আমার এমন মা জননী অমন তুচ্ছ কাজেই বা লাগতে যাবে কেন শুনি?
চন্দ্রা তার বড় বড় কালো চোখে গভীর ছায়া ফেলে বলে, আমার মতন তুচ্ছই বা আর কে আছে?
ভবানীবাবু গভীর পরিতাপের গলায় বলেন, ও কথা বলতে নেই ছোটবউমা। ভাবতেও নেই। ভগবান কুপিত হন।
ভগবান? সে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার চেনাজানা নেই বাবা চন্দ্রা হেসেই বলে, তিনি আপনাদের সার্কেলের লোক।..আমি যা ঠিক জানি, তাই বলছি।
তবু আর একটু দেখলেও তো হত। ওর থেকে ভাল
আমি আর একদিনও থাকতে পারছি না বাবা।
ভবানী রায়ের মুখে আর কথা জোগায় না।
অতএব ভবানী রায়ের পুত্রবধু, সুনীল রায়ের স্ত্রী একটা তুচ্ছ চাকরিতে লেগে যায়।
.
সারা সংসারটা উপর এ যেন আর একটা বাজের ধাক্কা।
এ কী?
এতদিন পরে, যখন সেই হতভাগ্য লোকটার ফিরে আসার সময় সন্নিকট, তখন কিনা তার পরিবার চাকরিতে ঢুকতে গেল।
কী বলবে সে এসে?
কী বলবে তার মা বাপকে?
অপর্ণা ক্ষোভ দুঃখ অভিযোগ আর প্রতিবাদের সংমিশ্রণে গঠিত একটা তীব্রতার সঙ্গে বলেন, আর কটা দিন পরে হলে হত না? আর তিনটে মাস বাদেই সে– চন্দ্রা স্থির গলায় বলে, তিনটে মাসই কি কম দিন মা?
এরপর অপর্ণা স্বামীর কাছে গিয়ে প্রায় আছড়ে পড়লেন, তুমি রাজি না হলে ও সাহস করতে পারত?
ভবানী রায় সোজা হয়ে বসলেন।
বললেন, কিন্তু আমার রাজি না হওয়ার যুক্তি কী?
যুক্তি নেই? তুমি বলতে পারলে না, আমার এখানে কি তোমায় খুব কষ্টে কাটছে বউমা?
অমন বোকার মতো কথা বলতে যাব কেন?
তা হলে এ কথাও তো বলতে পারতে, বউমা, তোমার যদি কোনও কিছুর অভাব বোধ হয়, আমায় খুলে বলতে পারতে
ভবানীবাবু অপর্ণার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, খুলে বললে সে অভাব মেটাবার ক্ষমতা আমাদের আছে?
অপর্ণা বেশ রেগে ওঠেন। বলেন, তা এমন কী লাগবে, যা জোগাবার ক্ষমতা আমাদের একেবারে হবে না? না হয় ওর বাপের মতন অত পয়সা তোমার নেই, তা বলে–ক্ষমতা না থাকে, ধার করেও করব।
ভবানীবাবু তেমনি ভাবেই তাকিয়ে বলেন, তুমি আর কোনওদিন সাবালক হলে না। তুমি ওর নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারবে? প্রাণ হু-হু করা মেটাতে পারবে? ধার কর্জ করে?
অপর্ণা চুপ হয়ে যান।
ভারী গলায় বলেন, এতদিন গেল, আর–এ যেন কূলে এসে তরী ডোবা
এই রকমই হয় অর্পণা। এতদিন গিয়েছে বলেই আর একটা দিনও সহ্য হচ্ছে না।…একটা গল্প আছে জানো? একজন কয়েদির কুড়ি বছরের জন্যে জেল হয়েছিল, এই কুড়ি বছর ধরে তার মনের ওপর দিয়ে অনেক চিন্তার ঝড় গিয়েছে, কিন্তু যেদিন কুড়ি বছর পূর্ণ হবে, ভোর হলেই ছাড়া পাবে, তার আগের রাত্রে লোকটা আত্মহত্যা করল।
দুর্গা দুর্গা।
অপর্ণা বলেন, এ আবার কী গল্প তোমার।
না, এটাই বোঝাচ্ছিলাম, প্রতীক্ষার শেষ মুহূর্তগুলোই অসহ্য দীর্ঘ।
বেশ। ঠিক আছে বলব না কিছু। বউ চাকরি করলে, তোমার খুব মুখ উজ্জ্বল হবে তো?
ভবানীবাবু কেমন এক রকম ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলেন, আমার মুখ? তোমার কি মনে হয় সেটা এখনও খুব উজ্জ্বল আছে?
এরপরও কী মুখ নিয়ে কথা বলবেন অপর্ণা?
অপর্ণার কি ভুলে যাবার কথা, সুনীলের জেল হয়ে যাবার পর বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন সবাই কেবল কেবল এসে খবর নিয়েছে, আসল রহস্যভেদের কোনও সুরাহা হল?
এঁরা মলিন মুখে মাথা নেড়েছেন।
পরে আর আসেনি তারা, জিজ্ঞেসও করেনি আর। বোধহয় নিজেরাই আসল রহস্যভেদ করে ফেলে বৃথা পরিশ্রম থেকে বিরত হয়েছিল। ওটা যে ওরা ধরে ফেলেছে, তাও মুখের রেখায় ফুটিয়ে গেছে।
অতএব ভবানী রায়ের মুখের ঔজ্জ্বল্যের হ্রাস বৃদ্ধির ব্যাপারে চন্দ্রার এত কিছু ভূমিকা থাকার কথা নয়।
অবশ্য শুধুই অপর্ণা নয়, চির-নাবালক বলে যাকে বদনাম দিলেন ভবানীবাবু। ভবানীবাবুর বড় ছেলে, বুদ্ধিমান বিচক্ষণ সুশীল রায়? সেও তো এসে প্রশ্ন করল, বাবা? চার চাকরি করার কি খুবই দরকার পড়েছিল আপনার?
ভবানীবাবু বললেন, দরকারটা আমার নয় সুশীল, তাঁর হয়তো পড়েছিল।
এতে আমাদের কি কিছুই বলবার ছিল না?
বলবার তো কত ক্ষেত্রে কত কীই থাকে সুশীল। আমার থাকে, তোমার থাকে, বাড়ির ঝি-চাকরটারও থাকে। তবু বলা হয় না।
না বলবার কারণ কিছু নেই। অন্তত নীলু আসা পর্যন্ত উনি যেমনভাবে ছিলেন, তাই থাকা উচিত ছিল না কি?
তা তুমিও সেটা বলতে পারতে। সেকালের মতো তো এখন মেয়েদের ভাশুরের সঙ্গে বাক্যালাপ নিষিদ্ধ নেই।
আমি? আমি কী বলব?
কেন? তুমিও তার গুরুজন। বড় ভাইয়ের মতো। সৎ উপদেশ দেবার অধিকার নিশ্চয়ই আছে।
সুশীল বিরক্তভাবে বলে, এমন এক একটা অ্যাবসার্ড কথা বলে বসেন আপনি। আমি বললে উনি শুনবেন?
ভবানীবাবু মৃদু হেসে বলেন, তার মানে শুনবেন না, এমন ভয় তোমার আছে?
শুনবেন না, এমন ভয় নয়, শুনবেন না সেটাই নিশ্চিত। কীরকম জেদি মেয়ে উনি, তা তো আর কারও জানতে বাকি নেই। ওঁর নিজের দাদারাই বলেন। ওঁর বড় ভাই সীতেশবাবুর সঙ্গে কোর্টে তো প্রায়ই দেখা হয়, বলেন তো এত জেদি অবাধ্য
থাক সুশীল, এগুলো যখন তোমার জানাই হয়ে গেছে, আর বৃথা দুশ্চিন্তা করে কী করবে?
আপনি বারণ করলে শুনতেন।
তোমার তাই ধারণা?ভবানীবাবু বলেন, তবেই বোঝো? আমার হাতের এই এত জোরালো অস্ত্রটা এত তুচ্ছ কারণে খরচা করে ফেলব?
এটা আপনার কাছে খুব একটা তুচ্ছ কারণ হল?
ভবানীবাবু বলেন, হল বইকী! এখন তো কত মেয়েই চাকরি-বাকরি করছে।
সেটা আলাদা সুশীল বাপের এই নিরুত্তাপ কথায় উত্তেজিত হয়ে বলে, এ ক্ষেত্রে আলাদা প্রশ্ন। সুনীল জেলে, লোকে ভাববে তার স্ত্রী এ বাড়িতে তেমন আরামে নেই তাই।
লোকে? লোকে তো কত কীই ভাবে সুশীল। নীলুকেও তো লোকে আসল আসামি ভাবে।
সুশীল ফস করে বলে ফেলে, সেটা ভাবলে তাদের খুব দোষ দেওয়া যায় না বাবা! লোভ মানুষকে কোথায় টেনে নিয়ে যেতে পারে আপনার হয়তো ধারণা নেই। কিন্তু আমরা, যারা আইন আদালতের জগতে ঘোরাফেরা করি, জানি
সুশীল হচ্ছে অ্যাটর্নি, কাজেই মনুষ্য চরিত্রের গভীর গোপন তথ্য সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের দাবি সে করতে পারে।
বড় ছেলের কথা শুনে ভবানীবাবু গম্ভীর হন, বলেন, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, তোমাদের ওই আইন আদালতের জগতে ঘোরাফেরা করবার দায় আমায় দেননি।
ওঃ! তাই বলুন। তার মানে আপনি ছোটবউমাকে সমর্থনই করছেন। অবশ্য এক হিসেবে ভালই করেছেন। আপনার ছোট ছেলেটি যে আর কখনও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এ ভরসা তো নেই। আপনিও কিছু চিরদিন থাকছেন না।
গটগট করে চলে যায় সুশীল।
বাবার এই নিস্তেজ নিরুদ্যম ভাব তার দুচক্ষের বিষ। চিরকালই প্রায় এক রকম। অথচ কর্তার পোস্টটা তো ভবানীবাবুরই। তাঁকে হটিয়ে দিয়ে তো আর সংসারটাকে শক্ত হাতে চালানো যায় না। অথচ সেই চালনার ক্ষমতা সুশীলের আছে। অন্দর মহলের দিকে রমলাও আছে। কিন্তু তারা দুজন বুদ্ধি ক্ষমতা উৎসাহ সব থাকতেও জগন্নাথ হয়ে বসে আছে।…থাকতে বাধ্য হয়েছে।
আর ওই পৌরুষহীন কর্তা এবং ন্যাতাজোবড়া গিন্নিতে মিলে সংসারটি যা চালাচ্ছেন, তা তাকিয়ে দেখলে মাথায় আগুন জ্বলে যায়।
ঝি-চাকর-ঠাকুর, এবং একটা ফাইফরমাশের বাচ্চা ছেলে, এই চার চারটে লোককে পোষা হচ্ছে, অথচ, দেখ, কোথাও কোনওখানে টিপটপের ভাব নেই। যখনকার যা, তা হবার জো নেই। ঠাকুর যত ইচ্ছে বেলায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে যা পারে করে, না পারে করে না। ফলে চা খাবার কোনও টাইমের ঠিক নেই; কোনওদিন ছটায়, কোনওদিন আটটায়।…বেড় টী বলে কোনও বস্তু সংসার থেকে পাবার জো নেই, নেহাত রমলা ঘরে হিটারের ব্যবস্থা করে রেখেছে, তাই জোটে।…
ওদিকে চাকরবাবু দুপুরের বিশ্রামটুকুকে দিবানিদ্রায় পরিণত করে, দুপুর গড়িয়ে বিকেলে ফেলে। এবং রমলার মুখে শুনতে পাওয়া যায়, ডাকলে নাকি বেজার হয়ে পাশ ফিরে শোয়।…ঝি ঘর মুছতে আসে যেদিন যখন খুশি। কখনও সকালে, কখনও সন্ধ্যায়।…
আর বাড়ির গিন্নি অম্লানবদনে এইসব সহ্য করেন, এবং রমলা বেশি বিরক্তি দেখালে বলেন, আহা ওদেরও তো রক্তমাংসের শরীর বউমা, সবদিন কি সমান বয়?
গিন্নির বড় ছেলে বউয়ের শরীরটাও যে রক্তমাংসের, আর সেটা এইসব অসঙ্গত কাণ্ড দেখলে জ্বলে ওঠে, তা ভাবেন না তিনি। ছোট পুতুরটি যে কী করেছেন না করেছেন ভগবান জানেন, ছোটবউটি তাতে লজ্জায় মরে থাকবেন তা নয়, যেন সাপের পাঁচখানা পা দেখেছেন।…ইচ্ছে হল তো এ বাড়ির ছায়া মাড়ালেন না, ইচ্ছে হল তো, এসে শেকড় গাড়লেন, এখন বাড়ির মুখ হাসিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাসে চেপে অফিস যাওয়া ধরলেন, সব সহ্য করে যাচ্ছে কর্তা গিন্নি!…
মুখ ফুটে কারও কিছু বলার জো নেই।
ঘরের ভিতরে দুই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলোচনা তীব্র হয়ে ওঠে, অসন্তোষ ধূমায়িত হয়, এবং তাদের হাতে পরিচালনার ভার থাকলে, সংসারের চেহারাখানা কীরকম হত, তাই নিয়ে আক্ষেপ চলে। আর মাঝে মাঝে ধূমায়িত আগুন ফস করে একটু জ্বলেও ওঠে।
তবু ভবানীবাবু আর অপর্ণাই তাঁদের শিথিল মুঠোয় সংসারের হালটা ধরে বসে আছেন!
যাকগে মরুকগে বলেই বসে ছিল এরা।
কিন্তু চন্দ্রার এই নতুন কাণ্ডে রীতিমত বিচলিত হয়েছে ওরা।…কেন, তারা কি বাড়ির কেউ নয়? তাদের মান অপমান নেই? ঠিক আছে, ওই জেলখাটা ছেলে নিয়েই থাকুন উনি, এরা নিজেদের পথ দেখবে।
এইসব তপ্ত চিন্তা বা উত্তপ্ত আলোচনা অবশ্য রাত্রির নির্জনতার মধ্যেই সীমিত থাকে, দিনের আলোয় সুশীল যদিও বা একটু থমথমে মুখে থাকে, রমলা দিব্যি হেসে গা পাতলা করে বেড়ায়। ঠাট্টা তামাশায় ভাসে।
হাসে চন্দ্রার ওই চাকরি করা নিয়েও।
প্রথমটায় অবশ্য অবাক হয়ে বলেছিল, চাকরি করতে যাবে কী গো? তোমার ছেলে দেখবে কে?
চন্দ্রা বলেছিল, দেখবে যাদের ছেলে তারাই। দাদু দিদা, জেঠা জেঠু।
আহা তা বললে কী হয়? কথাতেই আছে, মুড়ি বলো চিড়ে বলল, ভাতের তুল্য নয়, মাসি বলল পিসি বলল, মায়ের তুল্য নয়। তাছাড়া ছেলে তো তোমার বাপু মা অন্ত প্রাণ।
চন্দ্রা শান্তভাবে বলেছিল, এখন লায়েক হয়ে গেছে, এখন আর মাকে পৌঁছে না।
অতএব ছেলের ছুতো করেও চন্দ্রার মন নরম করা গেল না।
নেহাতই যখন চন্দ্রা দুর্মতি ছাড়ল না, রমলা ঘরের মধ্যে যে আলোচনাই করুক, ঘরের বাইরে এসে দিব্যি হেসে হেসে বলে, বেশ বুদ্ধি বার করলি চন্দ্রা, দিব্যি সাত সকালে খেয়ে দেয়ে ফরসা জামাকাপড় পরে বেরিয়ে যাবি, সারাদিন আর অন্দরমহলে পড়ে পচতে হবে না।
আবার গলা তুলে বলে, ঠাকুর, বড়বাবুর আগে ছোট বউদি বাবুর ভাত বাড়ো।
চন্দ্রার সস্তা বলতে কোনও শাড়িই নেই, সবই দামি দামি ভাল। আর চন্দ্রা কিছু বিধবা নয় যে, শ্রীহীন পোশাক কিনে পরতে বসবে? সুন্দরী চন্দ্রা যখন তার বেছে বেছে অর্ডিনারি শাড়িগুলো পরেও বেরোয়, মনে হয় খুব সেজে বেরোচ্ছে।
রমলা বরকে ডেকে বলে, দেখলে?
দেখব না কেন?
কোন অফিসে কাজ নিয়েছে?
জানি না।
যেখানে হোক, সকলের মুণ্ডু ঘোরাবে।
এ কথায় অবশ্য কোনও মন্তব্য করে না সুশীল। করায় সভ্যতায় বাধে, চুপ করেই থাকে।
রমলা আক্ষেপের নিশ্বাস ফেলে বলে, ঠাকুরপো যে এসে কী দেখবে! একেই তো কী শরীরমন নিয়ে আসছে
সুশীলের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে, সুশীল কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। ছোট ভাই সম্পর্কে অলক্ষিত জগতে ঈর্ষা তার চিরদিনই ছিল। আপন স্বভাবের ত্রুটিতে নিজে সে কখনওই কারও বিশেষ প্রিয় হতে পারে না, আর সুনীলের মধ্যে সেই গুণই ষোলো আনা। সুনীল ঘরে-পরে সকলের প্রিয়। যেন সুশীলের থেকে সে খুব একাট উচ্চ মানের জীব।
সুনীলের এই দুঃখের যাতনায় এমনিতে দুঃখবোধ করলেও, একটু যেন পুলকিতও হয়েছে সুশীল। ভিতরে ভিতরে তার কোথায় যেন একটা প্রতিপক্ষ ভাব ছিল। তাই ছেলেটা বিনা দোষে দোষী হল এ কথাটি মন থেকে মানতে ইচ্ছে হয় না। খুব গভীরে ভাবে, হুঁ! বিনা দোষে! আরে বাবা, দেবদূতসদৃশকেই দেখা আছে! মোটারকম কিছু সরিয়ে ফেলে, দুএকটা বছর জেল খেটে নেয়, তারপর বেরিয়ে এসে সেই টাকা বার করে। আমার কনিষ্ঠ ব্রাদারটি যে তেমন নয়, কে জোর দিয়ে বলতে আসবে।
ওদিকে সেন সাহেবের বাড়িতেও আর একবার নতুন করে আলোড়ন উঠল। জামাই সম্পর্কে মাথা হেঁট ছিলই, সেটা আরও বাড়ল মেয়ের এই ইল্লুতেপনায়।
হ্যাঁ তাও যদি একটা স্কুলেটুলে দিদিমণির চাকরি হত, সহ্য করা যেত। এটা কী?
এমন অদ্ভুত চাকরির নামও শোনেনি কেউ। গেরস্ত ঘরের বউ যাবে এই চাকরি করতে।
শুনে মাত্রই টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করে বসেছিলেন সেন সাহেব।
বেয়াইমশাই, আপনি এটা অ্যালাউ করলেন?
ভবানীবাবু এ কথা বললেন না, অ্যালাউ না করলে শুনত, এ বিশ্বাস আপনার মেয়ের ওপর আছে?
শান্তভাবে বললেন, এতে আর অ্যালাউ না করবার কী আছে? আজকাল তো বহু মেয়ে বউ কাজটাজ করছে।
করতে পারে। তবু বাড়ি হিসেবে প্রেস্টিজের প্রশ্ন আছে। আপনার কী হচ্ছে জানি না, আমার তো লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে। আমার কাছে থাকলে এমন ঘটনা কিছুতেই ঘটতে দিতাম না।
ভবানীবাবু মৃদু হেসে বলেন, হয়তো সেইজন্যেই আগে থেকেই আপনার কাছ হতে চলে এসেছে।
আপনি হাসছেন। আমি এটা হাসির কথা ভাবছি না। সমাজে আমার একটা মান সম্মান আছে (যেন ভবানীবাবুর নেই সেটা।), অনেকেই আমার মেয়েকে চেনে।
সেন সাহেব একটু থেমে বলেন, তাও যদি একটা সমপূর্ণ কাজ হত। গাড়ি ফাড়ি করে যেত! তা নয় বাসে করে ট্যাং-ট্যাং করে–লোকে দেখছে।…সুনীলের ফেরার টাইমের মুখে এরকম একটা যাচ্ছেতাই ব্যাপার! যা বুঝছি মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে শক্ত হয়ে উঠবে।
হ্যাঁ, ওইটুকুই বলেছেন তিনি, ওর থেকে শক্ত কথা মুখ দিয়ে বার করেননি। তবু ভবানীবাবু বউমার কাছে তাঁর বাবার উক্তিটি ফাঁস করেননি, শুধু বলেছিলেন, তোমার বাবা তোমার এই চাকরি করায় দারুণ চটে গেছেন।
কিন্তু চন্দ্রার বুকের পাটাটা কী জোরাল! কোনও কিছুতেই ভয় পায় না। হেসে বলেছিল, এটাই তো বাবার পেশা।
কিন্তু আজকের এই সন্ধিলগ্নে খুব একটা ভয় পাচ্ছে চন্দ্রা।
গত রাত্রে সারারাত জেগে বসে থেকে যেন অবিরত একটা ভয়ের সঙ্গে লড়াই করেছে।
সেই ভয়টার কোনও অবয়ব নেই, তবু খুব ভারী হয়ে চেপে বসে আছে চেতনার উপর।
.
সুনীল আসছে।
রাত পোহালেই সুনীল আসবে।
ড্রাইভার সত্যচরণ ভোরবেলাই গাড়ি নিয়ে যাবে। নির্দেশ দেওয়া আছে কাল থেকে।
নির্দেশ দেওয়া আছে, তবু খুব ভোরবেলাই নেমে এলেন ভবানীবাবু। গেট খুলে পাশের গ্যারেজের সামনে এসে দাঁড়ালেন।…দেখলেন সত্যচরণ আসছে। ভবানীবাবুর ঠোঁটটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। ভবানীবাবু কিছু বলতে পারলেন না।
সত্যচরণ বলল, আপনি আসছেন তো গাড়িতে?
আমি? আমি গাড়িতে?
ভবানীবাবু যেন অবাক হয়ে গেলেন। যেন ঘাবড়ে গিয়ে বললেন
আমাকে যেতে হবে?
যেতে হবে তা তো বলছি না– সত্যচরণ অবাক হল, যাবেন কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি। বড়দা তো যাবেন বলেছেন।
বড়দা? সুশীল বলেছে যাবে?
ভবানীবাবু যেন হাতে চাঁদ পান।
আর পাওয়াটা অভাবিত। এটা ভাবেননি।
তা চাঁদটা যখন পেয়েই গেলেন, তার সদ্ব্যবহার করবেন না কেন? তাড়াতাড়ি বললেন, সুশীল যাবে? তবে আর আমার যাবার কী দরকার? অ্যাাঁ সত্যচরণ, তাহলে কি আর আমার যাবার দরকার আছে?
সত্যচরণ আরও অবাক হয়।
বাবু তাকে প্রশ্ন করে কর্তব্য নির্ধারণ করবেন?
বলল, আপনি যা ভাল বোঝেন।
না না আমি বাড়িতেই দেখব।তারপর আস্তে আস্তে বলেন, আর কেউ যাবে বলে জানো?
চন্দ্রার নামটা উল্লেখ করেন না, শুধু সন্তর্পণে ওইটুকুই বলেন।
সত্যচরণ বলে, বোধহয় বড় বউদিও যাবেন।..দেরি আছে, আপনি বলেছিলেন বলেই এত তাড়াতাড়ি এলাম।
ভবানীবাবু আস্তে মাথা ঝুঁকিয়ে ফুটপাথে পায়চারি করতে থাকেন।…
এখন কি খুব ঘুম পাচ্ছে ওঁর?
তাই আর কথা বলতে ইচ্ছে করল না?
নাহলে তো জিজ্ঞেস করতে পারতেন, আচ্ছা সত্যচরণ, তোমার মা যাবে না? আর ছোট বউদি?
সত্যচরণ বহুবার জেলখানার দরজায় গাড়ি নিয়ে গেছে। কিন্তু ছোট বউদিকে নিয়ে কোনওদিন নয়। এ বাড়িতে এসে অবধি চন্দ্রা আর কোনওদিন জেলের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়নি পাঁচ মিনিটের জন্যে স্বামীকে একটু দেখবার প্রার্থনা নিয়ে।
বলতে কি রমলাই বরং ওই পাটটা নিয়মিত রেখেছে।…পারমিশান পেলেই তার সদ্বব্যবহার করে। শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে যায়। বরং অপর্ণাও কোনও কোনওদিন বলেন, আজ আর আমার যেতে মন লাগছে না বউমা, সেই চকিতের মতন একটু দেখা–প্রাণ হুহু করে ওঠে।
রমলার অমন কিছু হয় না, রমলা যায়।
আচ্ছা রমলার সঙ্গে যেতে হবে বলেই কি চন্দ্রা মনকে এমন কঠিন করে ফেলেছে?
চন্দ্রা কি এমনি হিংসুটে মেয়ে?
চন্দ্রা যে কী মেয়ে, সত্যিই বোঝা শক্ত।
ভবানীবাবুও সেই কথা ভাবছিলেন, বোঝা শক্ত! ছোট বউমার বর্তমান মনোভাব আমি ঠিক ধরতে পারি না।
ও কি বদলে যাচ্ছে?..নীলুর থেকে ওর মন সরে যাচ্ছে! ওর ওই চাকরি জোগাড় করাটা কি স্বাভাবিক? পালিয়ে যাবার মতো নয়? পরিস্থিতি থেকে আত্মরক্ষার মতো?
তবে কি ও নীলুর ওপর বিশ্বাস হারাচ্ছে? তাহলে? আর সকলের মতো ক্রমশ ভাবতে শুরু করছে
নীলু এসে আবার এক চরম আঘাত পাবে।
ভবানীবাবু একটা অসহায়তা অনুভব করছেন।
অথচ যাই ঘটুক, কিছু করার নেই। হলেও নিজের সন্তান। তার দাম্পত্যজীবনে বিপর্যয় এলে কিছুই করার থাকে না।
আস্তে আস্তে পায়চারি করতে করতে ভাবেন, না না, এরকমই বা ভাবতে বসছি কেন আমি? মেয়েটা ক্রমশই হতাশ হয়ে পড়ছে। কম দিন তো হল না। যতই জানা থাক–আড়াই বচ্ছর, তবু এক একটা দিনই যে এক বচ্ছর!
ভবানীবাবু নিজের চিন্তার মধ্যে এসে গেলেন।…এই তো আমারই মনে হচ্ছে যেন দশ বচ্ছর হতে চলেছে।…কিন্তু ওর আসবার মুহূর্তে আমার এরকম হচ্ছে কেন? আমি খুব আহ্লাদ খুঁজে পাচ্ছি না কেন? যতবার উৎসাহ করে ভাবতে চেষ্টা করছি, আবার আমার নীলু ঘরে আসছে, ততবারই যেন একটা ছায়া ছায়া ভাব এসে আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলছে।…হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে নীলুকে বুঝি আর আগের মতো পুরোটা পরিষ্কার ভাবে দেখতে পাব না, বুঝি জেলখানার সেই লোহার গরাদগুলোর ছায়া লেগে থাকবে ওর গায়ে মুখে।…যে ছায়াগুলো পড়তে দেখেছি এতদিন দেখতে গিয়ে।
আচ্ছা, যারা জেল থেকে ফেরে, তাদের সকলের বাবারই কি এরকম হয়? এইরকম ভয় ভয়? নীলুর মতো যারা বিনা দোষে শাস্তি ভোগ করে, তাদেরও?
নিজেকে যেন অপরাধী অপরাধী লাগে ভবানীবাবুর। আশ্চর্য হচ্ছেন তিনি নিজের ব্যবহারে। ভাবছেন, আমার নীলু আসছে আর দুএক ঘণ্টা পরে, অথচ আমার বুকের ভিতর থেকে সুখ উথলে উঠছে না? এ কী?
.
বাবা, আপনি এই জামা পরেই যাচ্ছেন নাকি?
রমলার প্রশ্নে চমকে উঠলেন ভবানীবাবু।
কখন নেমে এসেছে ওরা, টের পাননি তো!
এত সকালেও রমলা ওর নিজস্ব পদ্ধতিতে সাজসজ্জা সেরে ফেলেছে। মাথায় উঁচু চুড়ো খোঁপা, মুখে স্নো পাউডারের পুরু প্রলেপ, চোখে কাজলের রেখা, আর ঝকঝকে জরিপাড় গাঢ় বেগুনি শাড়ি!
রমলার হাতে এক ঝাড় গোলাপ।
ভবানীবাবুর হঠাৎ মনে হল, একসঙ্গে এতগুলো লাল গোলাপ তিনি বোধহয় জীবনে কখনও দেখেননি।
গোলাপগুলোর রং কী উগ্র।
রমলার দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখলে মনে হচ্ছে, ও যেন স্টুডিওয় এসে ফটো তোলবার জন্যে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছে।
ভবানীবাবু ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হঠাৎ বোকার মতো বলে বসলেন, তোমরা আগে আর কোথাও যাচ্ছ নাকি?
আগে? আগে কোথায় যাব?
সুশীল আশ্চর্য গলায় বলে, সকাল সাড়ে সাতটায় তো ওর টাইম। হঠাৎ এ কথা বলছেন কেন?
না মানে এইসব এত ফুলটুল—
এই এত হল? রমলা মধুর গলায় বলে, এই আপনি এত বলছেন বাবা? আমার তো মনই ওঠেনি। আপনার ছেলের সঙ্গে ঝগড়াই হয়ে গেল কম বলে।…আজ যা আহ্লাদ হচ্ছে আমার, এই ফুলগুলো দিয়ে তার কিছুই বোঝানো যাবে না।
ভবানীবাবু অন্যমনস্কের মতো রমলার ফুলের তোড়া বুকে ধরা মধুর ভঙ্গির দিকে তাকিয়ে বললেন, ফুলগুলো ওকে দেবে নাকি?
অদ্ভুত!
নীলু না বলে ওকে বললেন।
যেন নামটা হঠাৎ ভুলে গেছেন।
রমলা হেসে উঠে বলল, এ মা, আহ্লাদে বাবা আজ বেভুল হয়ে গেছেন। দেব না তো নিয়ে যাচ্ছি কেন? কাল সন্ধেবেলায় এনে জলেটলে ডুবিয়ে তাজা রেখেছি। ফুল দেব না? আজ ঠাকুরপো জেল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না? আপনি জানেন না বুঝি ফুল দিতে হয়।
ভবানীবাবু ফস করে বলে ফেলেন, স্বদেশি করে জেলে গেলে বেরোবার দিন ফুলের মালাটালা দিয়ে আনে বটে শুনেছি
রমলা চকিতে একবার বরের দিকে তাকায়, তারপর নিজস্ব তরল ভঙ্গিতে বলে, ওসব স্বদেশি বিদেশি আমি জানি না। আমার আহ্লাদ হচ্ছে আমি ফুল নিয়ে যাচ্ছি। আসুন, আবার হয়তো দেরি হয়ে যাবে–
শশুর গাড়িতে না উঠলে উঠতে সভ্যতায় বাধছে, তাই দাঁড়িয়ে থাকে রমলা।
ভবানীবাবু এবার অমনস্কে ফিরে আসেন। আস্তে বলেন, আমি তো যাচ্ছি না।
যাচ্ছেন না!
না তো।
তা হলে নেমে এসেছেন যে?
এমনি! সত্যচরণ এল কিনা, তাই
সুশীল গম্ভীর ভাবে বলে, না যান তো আর দেরি করে লাভ নেই। তবে গেলে ভাল করতেন। সুনীল একটু মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারে।
সত্যি। রমলা গাড়ির দিকে এগিয়ে বলে, আশ্চর্য। মা যেতে চাইলেন না, আপনিও যেতে রাজি হচ্ছেন না, চন্দ্রার কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। কত সাধ্যসাধনা করলাম। ঠাকুরপো যে কী ভাববে! কেউ গেল না–
ভবানীবাবু শান্তভাবে বলেন, কেউ গেল না মানে? তোমরা তো যাচ্ছ?
আমরা তো যাচ্ছি, না গিয়ে পারছি না বলেই যাচ্ছি। কিন্তু যাই বলুন বাবা, আসল লোকেরা না গেলে–
ভবানীবাবু মৃদু হেসে বলেন, যারা না গিয়ে থাকতে পারবে না, তারাই আসল লোক বউমা!
গাড়িতে উঠে ধড়াম করে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিয়ে সুশীল বিরক্ত গলায় বলে, এক এক সময় বোকার মতো কথা বলো তুমি।
বাঃ বোকার মতো আবার কী হল?
কিচ্ছু না, চুপ করে থাকো।
গাড়ি চড়লে সত্যচরণের উপস্থিতিটা রমলার কিছুতেই মনে থাকে না, সর্বদাই সাবধান করতে হয় সুশীলকে।
রমলার মতে তাই ট্যাক্সি চড়া ঢের আরামের। পাঞ্জাবি ড্রাইভার হলে তো আরও ভাল। গাড়িই তো গল্প করার জায়গা। সংসার থেকে বেরিয়ে না পড়লে সংসারের সমালোচনা করা যায়?
.
গাড়িটা বেরিয়ে গেলে ভবানীবাবুর মনে হল, সুশীলের কথাই হয়তো ঠিক, নীলু আসল মুখগুলো না দেখতে পেলে মনঃক্ষুণ্ণ হবে। গেলেই হয়তো ভাল হত। কিন্তু কিছুতেই ইচ্ছে হল না আবার সেই ফাটকের ফটকের সামনে গিয়ে গাড়ি থেকে নামতে।…তার চাইতে নীলুই এসে নামুক তার চিরচেনা ফটকে।
গোলাপের তোড়াটা দেওরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে রমলা উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, সব আগে তোমায় কামিয়ে জুমিয়ে সভ্য হয়ে নিতে হবে। আমার তো ইচ্ছে ছিল এখান থেকেই একেবারে সেলুনে গিয়ে ঢুকে, ঠিকঠাক করিয়ে নিয়ে যাব, যাতে তোমার ছেলে না বাপ দেখে ভয় পায়। কিন্তু তোমার দাদা বলল, পাগলামি কোরো নামানে দেরি হয়ে যাবে তো? বাড়িতে সবাই হাঁ করে হয়েছে।
একদা সুনীল নাকি এত জলি ছিল যে, কৌতুক করে ভিন্ন কথাই বলত না। ছেলেবেলা থেকেই পয়সাকড়ির দরকার হলে মায়ের সামনে ভিক্ষুকের ভঙ্গিতে হাত পেতে সুর করে বলত, মা কিছু ভিক্ষে পাই–
কলেজটলেজ যাবার তাড়ার সময় বামুনঠাকুরকে বলত, মহারাজ! গরিবকে দুটি খেতে দিন!..এমনকী বাবার কাছেও কথা বলত ওইরকম হালকা ভাবেই।
ভবানীবাবু বলতেন, কী রকম পরীক্ষা দিলি?
ও বলত, গাড্ডু মারব বলে মনে হচ্ছে।
রেজাল্ট বেরোলে ভবানীবাবু যদি সে কথা তুলে বলতেন, ফার্স্ট হলি, আর অনায়াসে বলে দিয়েছিলি গাড়ু খাব!
সুনীল বলত, কী জানি বাবা, কী গুণে ফার্স্ট করল! আমি তো লিখে এসে পর্যন্ত রসগোল্লার স্বপ্ন দেখছি–
আর বিয়ের পর?
বউদির সঙ্গে তো ঠাট্টা কৌতুকের বান বওয়াত। বউদি অবিশ্যি ছ্যাবলা, তবু সুনীল তার সেই ছ্যাবলা ঠাট্টার উত্তরেই কথার ফুলঝুরি কাটতো।…আর কথার মধ্যে সারকথা, চন্দ্রার কথা। বৈষ্ণব কবিদের ভাষায় নিন্দাচ্ছলে স্তুতি।
কিন্তু আজ সুনীল বউদির এই চপল কৌতুকে সাড়ামাত্র না দিয়ে উদভ্রান্ত মতো ভাবে ফুলের তোড়াটা আবার রমলার হাতেই ধরিয়ে দিয়ে দাদাকে প্রশ্ন করল, সবাই ভাল আছে তো?
দাদা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ ভাল আছে সকলেই। কেন যে আসতে চাইলেন না কেউ।
আসতে চাইল না কেউ!
প্রশ্ন নয়, যেন স্বগতোক্তি।
ঝাপসা ঝাপসা গলায় বিস্ময়হীন একটা অভিব্যক্তি।
সুশীল আক্ষেপের তীক্ষ্ণসুরে বলল, কই আর? মা বললেন, না, ওকে আমি বাড়ি বসে দেখব।..বাবা বললেন, তোমারই তো যাচ্ছ, সবাই মিলে যাবার কী দরকার?…আর ছোট বউমা? সুশীল একটু বিস্ময়ের হাসি হেসে বলল, ছোট বউমাকে তোর বউদি ডেকে ঘুম ভাঙিয়ে দেবার পর, সকালবেলায় আবার নাকি খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলেন! তৈরি হয়ে নিতে পারলেন না। বললেন দেরি হবে।
সুনীল তাকিয়ে রইল দাদার দিকেও নয়, বউদির দিকেও নয়, গাড়ির মধ্যে ড্রাইভারের নাকের সামনে যে একটা পালকের ডানা লাগানো প্লাস্টিকের পুতুল হাওয়ায় দুলছিল, সেইটার দিকে।
রমলা একটু পরে স্বগতোক্তি করল, কী জানি, আজও অফিস ছুটবে, না কামাই করবে।
কিন্তু অন্যমনস্ক সুনীলের কানে কথাটা ঠিকমতো প্রবেশ করল না।…
অফিস শব্দটা এখন তার পরিচিত জগতের বাইরে।
গাড়ি এসে সেই চিরচেনা ফটকটার সামনে থামল।
বুকটা ধক্ করে উঠল সুনীলের, সুনীল তিনতলার দিকে চোখ তুলতে গিয়ে তুলতে পারল না।
সুনীল দেখতে পেল গেটের একটা রেলিং চেপে ধরে গেটের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা! সুনীলের হঠাৎ মনে হল বাবার সঙ্গে তার জায়গাটার বদলাবদলি হয়ে গেছে।
সুনীলই তো ওই ভাবে লোহার গরাদে চেপে ধরে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতো।
সুনীল হেঁট হয়ে প্রণাম করতে গেল, ভবানীবাবু কীরকম স্খলিত স্বরে বললেন, এখানে নয়, এখানে নয়, ভিতরে চল।বলে নিজেই চলতে শুরু করলেন।
সুনীলের অনুপস্থিতির মাঝখানে বাবার পায়ে কি কিছু হয়েছিল? অমন লটপটিয়ে হাঁটছেন কেন?
চন্দ্রার ঘুমিয়ে পড়ার খবরটা সুশীল বানিয়ে বলতে যায়নি। সত্যিই এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। সকালে।
রমলার ব্যবহারে ত্রুটি ছিল না।
রমলা সক্কালবেলাই চন্দ্রার দরজায় টোকা দিয়ে বলেছিল, চন্দ্রা তৈরি হয়ে নে, একটু পরেই বেরোনো হবে। তোর ভাশুর বলে দিলেন।
তারপর রমলা ফুলের ঝাড় হাতে নিয়ে এসে অবাক হয়ে দেখল, দরজা তখনও ভিতর থেকে বন্ধ। রমলা এবার অধৈর্য টোকা মারল। জোরে জোরে ডাক দিল।
তখন চন্দ্রা দরজা খুলল।
রমলা অসহিষ্ণু গলায় বলল, এ কী, তুই এখনও তৈরি হসনি?
চন্দ্রা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে যেন বোকার মতো বলল, না! হঠাৎ বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুমিয়ে পড়েছিলি? আমি ডেকে দেবার পর?
তাই তো মনে হচ্ছে।
রমলা পিছনে স্বামীর অসহিষ্ণু ডাক শুনতে পায়, হল তোমাদের?
রমলা বিমূঢ় ভাবে বলে, সেরেছে, তাড়া দিচ্ছে। তা হলে?
তা হলে আর কী উপায়। তোমরাই চলে যাও।
তুই যাবি না?
কী করে আর হচ্ছে?
তারপরেও রমলা বলেছিল, তাড়াতাড়ি সেরে নে না বাবা, বরং তোর ভাশুরকে একটু বলে আসি
চন্দ্রা বলেছিল না, না কি হয়? তোমাদের দেরি হয়ে যাবে।
তবুও কিছু বলতে যাচ্ছিল রমলা, বোধহয় দুধের স্বাদের সঙ্গে ঘোলের স্বাদের তুলনা করে কোনও ছড়া, সুশীলের তাড়ায় চলে যেতে হয়েছিল রমলাকে।
রমলা চলে যাওয়ামাত্রই স্নানের ঘরে ঢুকে পড়েছিল চন্দ্রা। হয়তো মুখের চেহারা থেকে সারারাত্রির ইতিহাস আর এই ভোরবেলার ঝড়ের চিহ্ন মুছে ফেলতে।
স্নান করে এসে খোকাকে তুলল, মুখ ধুইয়ে জামা পরিয়ে হরলিক্স গুলতে বসল।..যেমন সবদিন। যেন আজ এইমাত্র কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে চলছে না।…
আচ্ছা এখন চার হাত পা কাঁপছে না কেন?
ছোট্ট চাকরটা এসে বলল, ছোটমা, খোকাবাবুকে ঠাকুমা চাইছে।
চন্দ্রা বলল, বলগে ওর এখনও খাওয়া হয়নি।
তুমি খাইয়ে নাও না, আমি বসে আছি।
দেরি হবে, তুমি বলে এসো।
ও চলে গেল।
চন্দ্রা খোকনকে খাইয়ে নিয়ে, তাকে নিয়ে বসেই থাকল।…ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে যতই ঝুলোঝুলি করুক, আটকে রাখল।
কিন্তু কেন?
ওই বাচ্চাটার মধ্যে থেকে কি চন্দ্রা কোনও শক্তি সংগ্রহ করতে চাইছে?
চাকরটা আবার এল।
ঠাকুমা বলছে, খোকাবাবুকে দাও।
চন্দ্রা আস্তে ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। চন্দ্রার মনে হল, অপর্ণাও বোধহয় শিশুটার মধ্যেই আশ্রয় খুঁজছেন।
চন্দ্রা বসে রইল।
চাকরটা নিজে থেকেই বলল, নাকি কারুর শিক্ষামতো বলল, কে জানে, বলল, তুমি নীচেয় যাবে না?
না।
ও বলল, বড়বাবু বড়মা গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
জানি। সকালে তোমার কাজ নেই? গল্প করতে বসলে?
ও তাড়াতাড়ি খোকাকে নিয়ে চলে গেল। ছোটমাকে খুব ভয় ভয় করে ওর। বড়মা বেশ, কত গল্প করে ওর সঙ্গে। ছোট মা যেন সাহেব।
খোকা চলে যেতেই ঘরটা হঠাৎ যেন দারুণ বড় হয়ে গেল, হাঁ করে গিলতে এল চন্দ্রাকে। চন্দ্রা মনে মনে জপ করতে লাগল, ঘরটা এবার অন্যরকম হয়ে যাবে। ঘরটা আবার আগের মতো হয়ে উঠবে, কিন্তু বারেবারেই জপের খেই হারিয়ে যাচ্ছে।…
চন্দ্রা টেবিলের উপরে রাখা সুনীলের বিবাহপূর্বকালের একক ফটোখানা আর হাক আলমারির মাথায় রাখা বিবাহকালের যুগল ফটোখানা পেড়ে নামাল, আঁচল দিয়ে মুছল, খুব নিরীক্ষণ করে দেখে দেখে সোজা করে বসাল। যেন একচুল বাঁকাচোরা হয়ে থাকাটা খুব একটা অঘটন, যেন ওইটার উপরই চার সবকিছু নির্ভর করছে।
চন্দ্রা বিছানাটা ঠিক করে ধোপদস্ত বেডকভারটা ঢাকা দিল, তারপরই হঠাৎ চন্দ্রা নীচে থেকে তার শাশুড়ির ডুকরে কেঁদে ওঠার শব্দ শুনতে পেল।
আশ্চর্য, তবু ঘরের দেয়াল ঘেঁষে পাতা সোফাটার উপর চন্দ্রা বসে রইল নিথর হয়ে। বাড়িতে কেউ কেঁদে উঠলে যে ছুটে গিয়ে দেখতে হয়–কী হল, এই সাধারণ ভদ্রতাটুকুও কি জানা নেই চন্দ্রার?
চন্দ্রা দিব্যি বসে ভাবতে লাগল, বেশি আনন্দেও যদি লোকে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে পারে, তো তেমন আনন্দে মূৰ্ছা যেতেই বা দোষ কী? অধিক দুঃখ আর অধিক আহ্লাদের প্রকাশের রূপ যখন একই।
তা হলে তো চন্দ্রাকে হঠাৎ সেই আতঙ্কের মুখোমুখি হতে হবে না।
ধরো চন্দ্রা মূর্ছা গিয়ে পড়ে রইল।
চন্দ্রা যে কতক্ষণ এই এক অদ্ভুত চিন্তার মধ্যে তলিয়ে বসে ছিল কে জানে, হয়তো যুগযুগান্ত কাল। অকস্মাৎ চন্দ্রা তার দরজার সামনে সেই আতঙ্কের ছায়াটাকে দেখতে পেল।
অপর্ণা কিন্তু বড় সহজ পথটি বেছে নিলেন। অপর্ণা ছেলেকে দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠে তার উপর আছড়ে পড়লেন।
অপর্ণাকে দেখে ভবানীবাবুর যেন ঈর্ষা হল। ভবানীবাবুও তো ওকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠতে পারতেন। পারতেন সেই তখনই, যখন গেটের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সকলের আগে।
প্রাণের ভিতরটায় যেখানে গভীর একটা শূন্যতা অবিরত হাহাকার করেছে, সেখানটা ভরাট করে ফেলতে পারতেন, ওকে জড়িয়ে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠতে পারতেন, অপর্ণা তুমি কোথায়? দেখ এসে তোমার নীলু এল।
কিন্তু ভবানীবাবু করলেন না এসব।
মূঢ়ের মতো বললেন কিনা, ভিতরে চল, ভিতরে চল।
রমলা, যে নাকি নেহাতই তৃতীয় ব্যক্তি, সে অপর্ণার কাছে ওই পরম আবির্ভাবকে উপস্থাপনা করল। দেওরের পিঠে হাত দিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠল, মা, দেখুন কাকে নিয়ে এলাম।
অপর্ণা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছিলেন, ওরে কোন পাষাণদের হাতে পড়েছিলি বাপ, আমার ছেলেকে কী হাল করে ফেরত দিল। নীলুর আমার সেই কাঁচা সোনার মতো রং কোথায় গেল গো, সেই পাথরে কুঁদে কাটা গড়ন। এই আড়াই বছরে তোকে যে বিশ বছরের বেশি বুড়ো করে দিয়েছে। নীলুর আমার কণ্ঠা দেখা যাচ্ছে, গালের হাড় উঁচু হয়ে গেছে। তোকে আমি চিনতে পারছি না।
ভবানীবাবু একটা টুলের উপরে বসে পড়েছিলেন, অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখছিলেন এই আনন্দ বেদনার তীব্র অভিব্যক্তি, একবার বললেন, এসব আর নতুন করে বলবার কী আছে? দেখছিলে না কি এতদিন?
অপর্ণা আবার ডুকরে উঠলেন, সে কি এমন করে দেখতে পেয়েছি? পাহারাদারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে চোরের মতো চকিতের দেখা।
সুনীল একবার নিচু হবার চেষ্টা করে বিফল হয়ে বলল, তুমি যে আমায় প্রণাম করতেই দিচ্ছ না।
বাপকে করেছিল, মাকে করতে পায়নি।
অপর্ণা বললেন, ওরে আমার প্রণামে কাজ নেই, আমি তোকে প্রাণভরে দেখি
ভবানীবাবু আবার একবার ভাবলেন, মা হওয়ার কত সুবিধে। আবার ভাবলেন, অথবা তরল স্বভাবের হওয়ার।
রমলা সেজেগুজে ফুলের ঝাড় হাতে নিয়ে জেলখানার দরজায় যেতে পারে, অপর্ণা পাড়া জানিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে পারেন, অথচ ভবানীবাবু বলতে পারেন না, নীলুকে আমার কাছে একটু বসতে দাও।..আর চন্দ্রা নামের সেই মেয়েটা পারে না ঘর থেকে বেরিয়ে তিনতলা থেকে নেমে আসতে।
না, সবাই সব পারে না।
কাঁদতে কাঁদতে একবার অপর্ণা বললেন, বড়বউমা, নীলুর জন্যে ঠাকুরের প্রসাদ রেখে দিয়েছি জালের আলমারির উপর, নিয়ে এসো। ভাল সন্দেশ আছে–
সুনীল এখন স্বাভাবিক গলায় কথা শুনতে পেয়ে বাঁচল, বলল, না না, মানটান না করে ওসব কিছু না।
বেশ, তবে চা খেয়ে চান করতে যা। বউমা।
ভবানীবাবু দৃঢ় গলায় বললেন, না! ও আগে তিনতলায় যাবে, নিজের ঘরে। নীলু যা
নববিবাহিত নীলু কোনওদিন ঘরে যেতে লজ্জাবোধ করেনি, বাবার সঙ্গে কি মার সঙ্গে গল্প করতে করতে দেরি হয়ে গেলে যখন ভবানীবাবু বলতেন, যা আর নয় রাত হয়ে যাচ্ছে ঘরে যা, তখন অবিলম্বেই উঠে যেত।
আজ বিলম্ব করতে লাগল। এটা ওটা কথা বলতে লাগল। ভবানীবাবু আবারও দৃঢ় স্বরে বললেন, দেরি করিসনে, যা!
নীলু অসহায়ের মতো একবার এদিক এদিক তাকাল, যেন একটা সঙ্গী পেলে ভাল হয়। যেন তার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে কেউ তার ঘরটা চিনিয়ে দেবে, এই প্রত্যাশা রয়েছে মনে।
অপর্ণা বুঝতে ভুল করলেন।
বলে উঠলেন, ছেলেকে খুঁজছিস? তাকে আমি সরিয়ে রেখেছি। অমনি চোখে তো ছেলে দেখা চলবে না, সোনা দিয়ে মুখ দেখতে হবে।
ভবানীবাবু বিরক্ত হয়ে বলেন, এখন নীলু সোনা কোথায় পাবে?
অপর্ণা আরও বিরক্ত গলায় বলেন, ও আবার কোথায় পাবে? পাবে না তা আমি জানি না? আমি সে ব্যবস্থা করে রেখেছি।
সুনীল চলে যাচ্ছিল, একটু থমকে দাঁড়িয়ে যেন হেসে উঠেই বলল, সোনা দিয়ে দেখলেই এই জেলখাটা আসামিটাকে সোনার চোখে দেখবে?…বলতে যাচ্ছিল আসামি বাপটাকে, পারল না। বাপ শব্দটা বলতে লজ্জা করল।
থাম তুই।
অপর্ণা বকে উঠলেন।
তারপর বললেন, একটু দেখা করেই চটপট চানটা সেরে নিগে যা। বসে বসে দেরি করে ফেলিসনে।
আচ্ছা ঠিক এই ভাষাটাই তো ব্যবহার করতেন অপর্ণা আগেও। যখন সুনীল এখানে আসত, থাকত। কিন্তু আজকের কথায় কি সেই সুর বাজল? অপর্ণা যেন জোর করে পুরনো ভাষাটা ব্যবহার করে পরীক্ষা করলেন, ভাষাটায় মরচে পড়ে গেছে কিনা।
সুনীল চলে যেতে অপর্ণা রোষ দৃষ্টি হেনে বললেন, মহারানি তো নিজের মহল ছেড়ে সকাল থেকে একবারও নামলেনই না। ওকে সাত তাড়াতাড়ি খোসামোদ করতে পাঠিয়ে দেওয়া কেন? গেলে আর সহজে নামবে? একটু নেয়ে খেয়ে সুস্থ হয়ে গেলে আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হত।
ভবানীবাবু মৃদু হেসে বলেন, প্রাণ জিনিসটা সকলের মধ্যেই আছে। আর সেটা ঠাণ্ডা হবার প্রশ্নও আছে।
অপর্ণা জ্বলে উঠে বলেন, তা সেটা তো ধরা পড়ছে না। কী করে বুঝব আর কারও প্রাণ ছটফট করছে।
ভবানীবাবু মৃদু হেসে বলেন, সবই কি তোক জানিয়ে বোঝাতে হয়? সবাই কি সব পারে?
অপর্ণা তীক্ষ্ণ হন।
তার মানে আমি পাড়া জানাচ্ছিলাম এই তো! মায়ের প্রাণ যে কী জিনিস সে মা-ই জানে। এসে বাছা আমার একফোঁটা ঠাণ্ডা জল খেয়েছে? ফ্রিজের জল খেতে কত ভালবাসে বাছা। একটু খেয়েটেয়ে নিজের ঘরে যেত।
ভবানীবাবু তাকিয়ে দেখেন।
চিরদিনের অবুঝ আত্মকেন্দ্রিক মানুষটাকে। এখন এই মহা মুহূর্তে কী আর বলবেন?…শুধু বলবেন, চান টান না করে খাবেই বা কী করে? চান করতেও তো তেতলায় উঠতে হত?
কেন একতলা দোতলায় চানের ঘর নেই?
ভবানীবাবু ক্লান্ত স্বরে বললেন, বসে বসে কতকগুলো আলটু ফালটু কথা বলছ কেন?
ছোটবউমাকে তুমি বড় আশকারা দাও। আড়াই বছর পরে বাছা আমার কী হাড়ির হাল হয়ে বাড়ি এল, উনি একবার নীচে নামলেনই না।
ভবানীবাবু গম্ভীর দৃঢ়স্বরে বললেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
হ্যাঁ, ভবানীবাবু তাঁর ছোটবউমাকে সমর্থন করতে তার সব কিছুতেই স্বাভাবিক বলেন। এখনও বললেন।
অথচ জানেন না সেই তাঁর ছোটবউমা, চন্দ্রা নামের মেয়েটা কী ভীষণ অস্বাভাবিক। কেউ ভাবতে পারবে সুনীল যখন ঘরে ঢুকে আস্তে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াল স্থির ভাবে, তখন চন্দ্রা ছুটে এসে বরের বুকে ঝাঁপিয়ে না পড়ে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠে ভয়ের গলায় বলে উঠল, ও কী, দরজা বন্ধ করছ কেন?
অদ্ভুত!
যেন ঘরে কোনও আততায়ী ঢুকেছে।
সুনীল অবাক হয়ে তেমনি ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। সুনীল চন্দ্রাকে দেখতে লাগল। কতদিন হয়ে গেল চন্দ্রাকে দেখেনি, চন্দ্রা আর দেখা করতে যায়নি।
সুনীল কত রকমই ভেবেছে। আর ভেবে ভেবে এই আতঙ্কটিকেই পোষণ করেছে, নিশ্চয় চন্দ্রা কোনও কঠিন রোগে শয্যাশায়ী, কেউ তাকে বলছেনা সে কথা, চেপে যাচ্ছে। মেয়েদের তো বাচ্চাটাচ্চা হবার পরে কত কী অসুখ করে।
বাচ্চাটার সম্পর্কেও স্পষ্ট, বিশ্বাসের ধারণা নেই। একদিনের জন্যে কেউ তাকে নিয়ে গিয়ে দেখায়নি, অথচ রমলা তার বিষয়ে কিছু কিছু গল্পও করেছে, আর বলেছে, চন্দ্রা বলে, জেলখানার খাঁচা থেকে ছেলে দেখতে হবে না ওকে।
এর সবটাই সত্যি কিনা কে জানে, হয়তো বাচ্চাটাই–তাই চন্দ্রা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারেনি, আর ক্রমশ রোগিণী হয়ে গেছে।
যখন নীচের তলায় চন্দ্রা এবং তার শিশুর ছায়ামাত্র দেখতে পাচ্ছিল না, সেই ধারণাই বদ্ধমূল হয়ে উঠল। অপর্ণা কী যেন একটা বললেন, সেটা সত্যি না স্তোকবাক্য, কে জানে!
ভবানীবাবু যখন দৃঢ় স্বরে বললেন, আগে তিনতলায় নিজের ঘরে যাক, তখন সুনীল মনকে শক্ত করতে চেষ্টা করেছে।
সুনীল এতক্ষণ চোখের সামনে এই ছবিই দেখেছে তিনতলায় গিয়ে ঘরের দরজা টেনে দেখতে পাবে একখানি কঙ্কালসার শয্যাশায়িনীকে।…সুনীলকে দেখে উঠে বসবার শক্তিটুকুও আছে কি নেই।
শুধু বিষণ্ণ বিধুর মুখখানিতে ফুটে উঠবে একটি অলৌকিক অভিব্যক্তি।
সুনীল কি তখন সেই শীর্ণ লতিকাটিকে বুকে জড়িয়ে তুলে নেবে?
না, সাবধানে তার কপালে একখানি হাতের ছোঁয়া রাখবে?
সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সুনীল যেন নিজের বুকের মধ্যে সেই পদক্ষেপের ধ্বনি শুনতে পাচ্ছিল।
এখন সুনীল স্থির হয়ে গেল।
বড় বেশি স্থির।
আশ্চর্য! এখনও চন্দ্রা তেমনি সুন্দর আছে! অথবা আরও বেশি সুন্দর হয়েছে।
মাতৃত্ব মেয়েদের চেহারায় যে লাবণ্যের সঞ্চার করে, (বিশেষ করে আরাম আয়েসের ঘরের মেয়েদের) সেটা তো দেখা ছিল না সুনীলের। জানাও ছিল না।
সুনীল শুধু দেখল চন্দ্রা আরও লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছে। চন্দ্রার চোখের কোলে রাত্রি জাগরণের ফলে যে কালির ছাপ পড়েছিল, সদ্য স্নানের মূর্তিতে সেটা ধরা পড়ছে না। চন্দ্রার নিতান্ত সাধারণ শাড়িটাও যে অসাধারণ সুন্দর, সেটা এতদিন ভুলে গিয়েছিল বলেই হয়তো সুনীলের মনে হল চন্দ্রা খুব সেজেছে।
সুনীল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল।
আচ্ছা, সুনীল কি এই সুন্দরী লাবণ্যময়ীকে দেখে মনে মনে আহত হল? সুনীল কি একখানা কঙ্কালসার শয্যাগত মূর্তিই–দেখতে চেয়েছিল? তাই সুনীল অমন স্থির হয়ে তাকিয়ে দেখছে, চন্দ্রার সুডৌল গলায় সরু সোনার হারটুকু তেমনি অনবদ্য, চন্দ্রার বর্ণাভরণে সকালের রোদ এসে পড়ায় স্বর্ণশোভা তেমনি দেদীপ্যমান, চন্দ্রার চুলের রাশি স্নান-স্নিগ্ধ হয়ে তেমনি উজ্জ্বল তেমনি কোমল, চন্দ্রার শাড়ির পাড় লুটিয়ে পড়া পায়ের পাতার অগ্রভাগটুকু তেমনি কমলদল তুল্য।
সুনীল কি হিংসুটে যে এসব দেখে আহত হবে?
সুনীল হয়তো অবাক হয়েই দেখছে।
দেখছে চন্দ্রা যেন ঠিক তেমনিই আছে?
বাবাকে কত বুড়ো দেখাল, মাকে কত বুড়ি, এই আড়াই বচ্ছরে ওঁদের কতখানি যেন বয়েস বেড়ে গেছে।…অথচ চন্দ্রা?
চন্দ্রা যে রূপবতী, যৌবনবতী, চন্দ্রার যে সংসার-জীবনে অন্য কষ্ট কিছু নেই, নেই অভাব; সেটা কি সুনীলের খেয়ালে আসছে না?
সুনীল তাই অবাক হয়ে ভাবছে, আশ্চর্য, চন্দ্রা ঠিক তেমনিই আছে? অথবা তার থেকে ভাল।
এতক্ষণে চন্দ্রা একটু স্বাভাবিক হল। আস্তে সরে এসে বলল, কী হল? স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলে যে?
সুনীল বলল, তোমায় দেখে স্ট্যাচু হয়ে গেছি।
চন্দ্রা দেখল আতঙ্কের ভয়টা মিলিয়ে যাচ্ছে। সহজ হওয়াই স্বস্তির জোগানদারস হালকা হাওয়াই সাহসের। হালকা হতে পারলে ভয় কমে যায়।
আমায় দেখে?
চন্দ্রা ওর চোখে চোখ না ফেলেই বলল, কেন, আমায় খুব বদলে যেতে দেখছ?
সুনীলের মুখ থেকে এতক্ষণের চিন্তাকণাই ভাষায় দানা বেঁধে বেরিয়ে পড়ল, ঠিক তার উলটো।
ঠিক তার উলটো?
হ্যাঁ, দেখছি তুমি একেবারেই অপরিবর্তিত আছ। মনে হচ্ছে না তোমার জীবনের উপর দিয়ে এতগুলো দিন বয়ে গেছে।
তবু ঝড় বলল না, দিনই বলল। কিন্তু মনে মনে বলতেই থাকল, না মনে হচ্ছে না তোমার উপর দিয়ে কোনও ঝড় বয়ে গেছে।তুমি যেন সুখের পদ্মপাতায় ভাসছিলে।…যদি তুমি বলো মনের চেহারা কি বাইরে থেকে ধরা পড়ে? তা হলে বলব, দেখো আমার মাকে, আমার বাবাকে।…না, তোমার পরিবর্তন হয়নি এ কথা ভুল, খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে।…তুমি যখন সেই তোমাদের নিউ আলিপুরের বাড়ি থেকে জেলের দরজায় দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে, তোমার তখনকার সেই ভেঙেপড়া মূর্তির সঙ্গে আজকের তুমিকে মেলাতে পারছি না। এখানে এসে পর্যন্ত তুমি একদিনের জন্যে দেখা করতে যাওনি, আমি ব্যাকুল হয়ে তাকিয়েছিমার পিছনে কি বউদির পিছনে তুমি আছ কি না।…কেউই খুব একটা সদুত্তর দিতে পারত না। আমি ভয়ে অস্থির হয়ে ভাবতাম নিশ্চয় তুমি কোনও কঠিন ব্যাধিতে শয্যাশায়ী, সবাই আমার কাছে সে কথা চাপছে। আজও আমি ভয়ে কাঁটা হয়েই তোমার কাছে আসছিলাম, না জানি, কী দেখব।…কী দেখলাম? তা ভালই দেখলাম, দেখলাম তুমি আপনমনে বসে বসে প্রস্ফুটিত শতদল হয়ে উঠেছ। তোমার সেই ছিপছিপে গড়নটি, যেন ভরাট হয়ে উঠেছে।… তুমি যেন একটি মহারানি…।
বুঝতে পারছি আর কোনওদিনই তুমি আমার কাছে এসে ভেঙে পড়বে না, তোমার জীবন থেকে আমি পিছনে পড়ে গেছি, আমার সম্বন্ধে তোমার আর কোনও মূল্যবোধ নেই।
কেনই যে এমন অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এল সুনীলের, সুনীলই জানে।
চন্দ্রার অপর্ণার মতো ছুটে এসে ওর বুকের উপর আছড়ে ভেঙে পড়ল না বলে?..না কি চন্দ্রাকে বিছানার সঙ্গে মিশিয়ে পড়ে থাকতে না দেখে?…
সেটাই প্রত্যাশা ছিল তার?
আর চন্দ্রা?
ভগবান জানেন সেই বা কেন অমন নিথর হয়ে বসে রইল! এখন চন্দ্রা কাছে সরে এসে খাটের বাজুতে হাত রেখে বলল, আমার কিছু বদল হয়নি দেখে, বেশ রেগে গেলে মনে হচ্ছে।
রেগে গেলাম?
সুনীল গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, রেগে গেলাম, এমন অদ্ভুত কথা মনে এল কেন তোমার?
তাকাল, কিন্তু ওর ওই দীপ্তিহীন কোটরগত চোখে কি সেই গভীরতার ছায়া পড়ল? যেমন পড়ত সেই অনেকদিন আগে?
না, এখন চোখে পড়ল চন্দ্রার, সুনীলের রংটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে, সুনীলের চোখের কোলে কালি পড়েছে, গালের হাড় উঁচু হয়ে গেছে, কণ্ঠার হাড় উঠে পড়েছে।…আর বড় বড় খোঁচা খোঁচা দাড়িতে সুনীলকে অন্য লোক বলে মনে হচ্ছে।
প্রথম দৃষ্টিতে চন্দ্রা যেন শুধু একটা দেবদেউলের ধ্বংসস্তূপ দেখতে পেয়েছিল, এখন আস্তে আস্তে চোখে পড়ছে, কী কী ভেঙে পড়েছে তার। ভেঙে পড়েছে খিলেন, থাম, কার্নিশ, দেয়ালের কারুকার্য।
কিন্তু ভিতরের বিগ্রহ?
ওই স্তূপে চাপা পড়ে আছে, না গুড়ো হয়ে গেছে?
চন্দ্রা সন্দেহটাকে এখন ছড়িয়ে বসল না পরীক্ষা করতে, চন্দ্রা মৃদু হেসে বলল, এমনি! মনে হল তুমি যেন অন্যরকম দেখতে চেয়েছিলে। চেয়েছিলে খুব বিচ্ছিরি হয়ে গেছি।
সুনীল ওই খাটের বাজু ধরা হাতটার দিকে চোখ ফেলল, নিটোল মসৃণ শাঁখের মতো। সুনীল কি ওই হাতটা একটু চেপে ধরতে পারে না? বলে উঠতে পারে না, হ্যাঁ হ্যাঁ চন্দ্রা সত্যি কথা স্বীকার করতে হলে বলতে হয়, তাই চেয়েছিলাম। দেখতে চেয়েছিলাম তুমি মলিন হয়ে গেছ, বিলীন হয়ে গেছ।…তোমার হাসিটি বিষয় মধুর, তোমার চোখের কানায় কানায় জল, তুমি তোমার প্রায় হারিয়ে ফেলা স্বামীকে আবার পেয়ে লুটিয়ে পড়বে, ভেঙে পড়বে।
না, এসব বলা যায় না।
অন্তত, ওই লাবণ্যময়ী স্থির প্রতিমার সামনে বলা যায় না। সুনীল তাই সামান্য হাসির সঙ্গে বলে, চেয়েছিলাম? তাই কি কখনও কেউ চায়? তুমি যেমনটি ছেলে, তেমনটি আছ এই তো সুন্দর। তবে সত্যি ভাবতাম অনেক আকাশ পাতাল। তুমি তো আর দেখা করতে যেতে না, অনেক অনেকদিন দেখিইনি।
চন্দ্রা আস্তে হেসে বলে, তাই অনেক অনেকক্ষণ ধরে দেখলে? আচ্ছা এবার হয়েছে তো দেখা? এবার বোসো।
না বসব না।
সুনীল যেন তীব্র লুব্ধ দৃষ্টিতে ঘরের সংলগ্ন স্নানাগারের দরজাটার দিকে তাকিয়ে দেখে তারপর চঞ্চল ভাবে বলে, আগে চান করব।
বলে, কিন্তু যেন, একটা সন্দেহের তীব্র দংশন অনুভব করে। ওই সুখের, আরামের জায়গাটায় কি আর আগের মতো অধিকার আছে সুনীলের? সুনীল ওই ছোট্ট ঘরটার ভিতরের দৃশ্যটা ভেবে ভেবে মনে আনতে চেষ্টা করে।
বড় একটা আরশি আছে না দেয়ালে?
বাথটব? শাওয়ার? বেসিন? আলনা?
আলনায় ভাল ভাল তোয়ালে। আরশির সামনে ব্রাকেটে গন্ধ তেল, সুগন্ধী সাবান, প্রসাধনের আরও সব টুকিটাকি।…সব সেই রকমই আছে?…না কি সে সব আর থাকে না?
সুনীল তার পিছনের সাড়ে ঊনত্রিশ মাস কালের স্নানের দৃশ্যটা মনে করে। গতকালও যেখানে যেভাবে স্নান করেছে, সুনীল স্তব্ধ হয়ে যায়। না সুনীলের বোধহয় ওই পালিশ চকচকে দরজাটা ঠেলে ওই ঘরটায় ঢুকে যাবার অধিকার আর নেই। সুনীল নীচে চলে যাবে, উঠোনে যেখানে ঠাকুর চাকররা স্নান করে, সেইখানে স্নান সেরে নেবে।
সুনীল তাই বলে, চান না করে কোথাও বসতে পারছি না, যাই—
যাই!
চন্দ্রা অবাক হয়ে বলে, যাবে কোথায়? এখানে যে স্নানের একটা জায়গা আছে ভুলে গেছ নাকি?
সুনীল মৃদু হেলে বলে, ভুলে গেছি কিনা, তাই ভাবতে চেষ্টা করছি। আর এটাও ভাবছি–ও জায়গাটায় প্রবেশ অধিকার আর আছে কিনা আমার।
হঠাৎ চন্দ্রা অনেকদিন আগের মতো হেসে ওঠে। যে হাসিটাকে সুনীল জলতরঙ্গ বাজনার সঙ্গে তুলনা করত। হেসে উঠে বলে, আচ্ছা, আচ্ছা, খুব ঢং হয়েছে। সব ঠিক করা আছে, যাও চটপট সেরে নাও।
সুনীল যেন ততক্ষণে কৃতার্থ হয়।
এখন ওর হঠাৎ মনে হয়, চন্দ্রার ওই ভেঙে না পড়াটা চেষ্টাকৃত, স্থির হয়ে থাকাটা দুষ্টুমি! চন্দ্রা যা ছিল তাই আছে।
আর আশ্চর্য, এখন ওই কথাটা ভেবে স্বস্তি পেল।
অথচ একটু আগেই চন্দ্রা যেমন ছিল তেমনি রয়েছে দেখে সুনীল আহত হচ্ছিল।
এখন সুনীল হাসল।
বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি চটপট, এই নোংরা পোশাকে তোমায় ছুঁতে পারছি না—
চন্দ্রা বোধহয় সহজ হবার একটা মন্ত্র পেয়ে গেল হঠাৎ। নইলে চন্দ্রা কী করে বলে উঠতে পারল, শুধু পোশাক? আর ওই দাড়ি গজগজে নোংরা গালটার কথা মনে পড়ছে না? ওখানে বুঝি দাড়ি কামানো নিষেধ?
নিষেধ? না, একেবারে নিষেধ হলে তো এতদিনে রবীন্দ্রনাথ হয়ে যেতাম।
দিন তারিখ গুণে, দেয় মাঝে মাঝে অনুমতি। এখন মধ্যবর্তী কাল চলছে
বউয়ের সহজ সুরের কথায় কি সুনীলও তার নিজের সহজতা ফিরে পাচ্ছে?
ঠিক আছে আজ, অনুমতি পাচ্ছ।
বলল চন্দ্রা।
সুনীল খুব সন্তর্পণে পা ফেলে এগিয়ে যায়, দেখে স্নানের ঘরের সামনে পাপোশের পাশে একজোড়া নতুন রবারের চটি তার জন্যে সাজানো রয়েছে।…
সুনীল দরজার হ্যাঁন্ডেলে হাত দেয়, যেন মনে করতে চেষ্টা করে এটাতে ডান দিকে মোচড় দিতে হয়, না বাঁ দিকে। তারপর আবার মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, সব আছে?
আছে।
আবার হেসে ওঠে চন্দ্রা, না থাকলে বাথরুম থেকে চেঁচিও। সে অভ্যেস তো আছে।
কথা সত্যি। ত্রিবেণীর সেই বাসায়, এমন কতদিন হয়েছে বাথরুম থেকে চেঁচিয়েছে সুনীল, এই, এখানে শুধু একটা ভিজে তোয়ালে দেখছি, শুকনো তোয়ালে কই?.নয় তো চেঁচিয়েছে, দেখো সাবানটা হাত থেকে পিছলে নর্দমায় পড়ে গেল, একটা সাবান দিয়ে যাও, প্লিজ।
সুনীল দরজাটা ঠেলে ঢুকে গিয়ে গভীর গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আমার কী কী অভ্যাস ছিল, আমার আর কিছু মনে নেই।
ঠিক আছে, আমি মনে করিয়ে দেব।
আস্তে দরজাটা চেপে দেয় সুনীল।
এটা কী হল?
এটা কী হল?
এইরকমই কি হবার কথা ছিল?
এতদিনের অধীর প্রতীক্ষা আর এতদিনের তপস্যার প্রস্তুতি, এমন অদ্ভুতভাবে ভেস্তে গেল?
যেন অনেক আড়ম্বর আর অনেক আয়োজনের পর অবশেষে নাটক মঞ্চে উঠল, এবং যবনিকাও উঠল। তারপর প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যটাই গুবলেট হয়ে গেল।…দর্শক এখন ছি ছি করে বলে উঠবে কিনা, নাটক কাঁচা হাতের, ডায়লগ জোলো, আর অভিনয় কিছু না।
বলবেই বলবে, এত ঢাকঢোল বেজেছিল কেন তবে?
চন্দ্রা নিজের মধ্যেকার সেই দর্শকটাকে এই রঙ্গমঞ্চের সামনে বসিয়ে রেখে, তার হয়ে ভাবতে থাকে, এই কিছুক্ষণ আগেও কি এই নাটকের নায়িকা ভাবতে পেরেছিল, সে সব সংলাপ ভুলে গিয়ে, নাটকের সব শর্ত, আর সব অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে বোকার মতো যা তোক একটা কথা বলে ফেলে বসে পড়বে?
আশ্চর্য! আশ্চর্য!
ওই যে মেয়েটা একটু আগে একেবারে হালকা চালে, নেহাত সাধারণ দুটো কথা বলে পার্টের পাট চুকোল, সে কে? সে কি চন্দ্রা?
যে চন্দ্রা কাল সারারাত জেগে শুধু ঘরের মধ্যে পায়চারি করেছে, উঠেছে, বসেছে, জল খেয়েছে, আর জানলায় দাঁড়িয়েছে।…যে চন্দ্রা সকাল থেকে কাঠ হয়ে বসে আছে, কী একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটবে এই আশঙ্কায় কী একটা অসম্ভব ঘটনা ঘটবে, এই প্রত্যাশায়।
ভাবতে ভাবতে চন্দ্রা যেন মস্তবড় কিছু একটা হারানোর যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগল।
পাবার কথা ছিল। বিরাট কী একটা যেন পাবার কথা ছিল। সেই প্রাপ্তিযোগটা, নিজেই চন্দ্রা অসতর্কতায় নষ্ট করে ফেলল। চন্দ্রা সেই মুহূর্তটাকে ধরে ফেলতে পারল না যে মুহূর্তটা ফস্ করে জ্বলে ওঠবার জন্যে প্রস্তুত ছিল।…
অতএব প্রদীপ রইল নিজের মনে তেল সলতে নিয়ে, দেশলাইকাঠি থাকল নিজের ঘরে, বারুদের সঞ্চয় নিয়ে।
না, আর সেই মুহূর্তটি ফিরে আসবে না। যেটা হাতের মুঠোয় ছিল ভরা। চন্দ্রা নিজের ভুলে অসাবধানে হাত থেকে ফেলে দিয়েছে সেটা।
.
বাথরুম থেকে জলের শব্দ আসছে।…
যেন ঝরেই পড়ছে, পড়ছে তো পড়ছে।
কত চান করছে সুনীল?
চন্দ্রা কি উঠে বারণ করবে?
বলবে এত জল ঘাঁটা উচিত হচ্ছে না। এতদিন ধরে মাপা জলে চান করে এসেছ
কিন্তু তা হলে?
চন্দ্রা নামের মেয়েটা আরও বর্ণহীন স্বাদহীন হয়ে যাবে কিনা।…তারপরেই তো তা হলে চন্দ্রাকে বলে উঠতে হবে, এই জল ঝরা পায়ে ঘরে পা দেবে না বলছি। বাথরুম তোয়ালে রাখা হয় কীজন্যে? পা মুছে আসতে পারো না?..
এতদিনের তিল তিল করে জমিয়ে তোলা সঞ্চয়টুকু কৌটো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, নিত্যদিনের আয়ব্যয়ের খাতাটা খুলে বসবে চন্দ্রা?
চন্দ্রা উঠল না।
চন্দ্রা শক্ত হয়ে বসে বসে ওই জলের বাজনা শুনতে লাগল, আর হঠাৎ একসময় মনে পড়ল ওর, সুনীল একবারও খোকার নাম মুখে আনেনি।…
অথচ সকালবেলা খোকাকে যখন চেয়ে পাঠিয়ে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অপর্ণা, চন্দ্রা বোধহয় অবচেতনে একটি ছবি আঁকছিল।
ছবিটা অনেকটা এইরকম—
দরজায় একটা ছায়া পড়ল।
সেই ছায়ার সঙ্গে সোনার প্রদীপের মতো একটুকরো ঝকঝকে আলো।
সুনীল নীচে থেকে খোকাকে কোলে নিয়ে তিনতলায় উঠে আসবে। নিজের ঘরে।
তারপর? তারপর অবর্ণনীয় এক আনন্দের স্বাদ। না কি আনন্দ শব্দটা ওখানে নিতান্তই দীন? কিন্তু কী হল?
স্নানের ঘরে ঢুকলে প্রথমেই চোখ না পড়ে যায় না দেয়ালে আঁটা বড় আরশিটায়।
চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুনীল চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বেসিনের কোণটা চেপে ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
সুনীল আবার নতুন করে আহত হল।
সব ঠিক আছে।
সব তেমনি আছে।
সেই দুধ ধবধব বেসিন, আর বাথটব, সেই ঝকঝকে চকচকে কলের মুখ, শাওয়ার, আলনা, পালিশ-করা টাইলসের মেঝে।…সেই কাচের ব্রাকেটের উপর সাজানো নানাবিধ প্রসাধন দ্রব্য।…কোথাও কোনও ব্যতিক্রম নেই।
শুধু সুনীল নামের হতভাগাটা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। ওই আরশিটায় ওর ছায়া পড়া ধৃষ্টতা।
দেখা যাচ্ছে, চন্দ্রা এই ঘরেই প্রতিষ্ঠিত আছে। একা বলে ভয় পেয়ে দোতলায় মায়ের কাছে শুতে যায়নি। তার মানে চন্দ্রার ভয় করেনি, মন কেমন করেনি।
চন্দ্রা ওর বাবার দেওয়া ওই ডানলোপিলোর গদিদার জোড়া খাটটায় মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে শুয়েছে (মাঝখানে তো শুতেই হবে, পাখার হাওয়াটা পাবে কেন তা না হলে?) ইচ্ছেমতো সময় উঠেছে, এই বিলাসবহুল স্নানের ঘরে ঢুকে ওই সমস্ত প্রসাধন দ্রব্যগুলি ব্যবহার করে করে যথেচ্ছ। আরাম করে স্নান করেছে, বেরিয়ে এসে রানির মতো সেজে সোফায় বসে থেকেছে, কেউ এসে চা দিয়ে গেছে। চন্দ্রার ভঙ্গিতে তেমনি আভাস ছিল।
সুনীল কিছু নেড়েচেড়ে দেখল না তাই বুঝতে পারল না, এসব তার জন্যই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। সুনীলের অনেক শখ শৌখিনতা ছিল। সুনীলের প্রসাধনের খরচা কম ছিল না মাসে। সে সব তো ভুলে যায়নি কেউ।
সুনীল চোরঙের তোয়ালে ভালবাসে না বলে ওই হালকারঙের তোয়ালে, সুনীলেরই অভ্যস্ত সাবান তেল মাজন শ্যাম্পু।
সুনীল তাকিয়ে দেখল না, খেয়াল করল না, ভাবল এসব চন্দ্রার নিত্য ব্যবহারের।
সুনীলের মনের মধ্যে একটা ঈর্ষার জ্বালা চিনচিন করে উঠল।
দুর্ভাগ্য কি মানুষকে হিংসুটে করে তোলে?…আর সুনীল মানুষ বলেই তার ব্যতিক্রম নয়।
না কি সুনীল শুধু চন্দ্রাকেই হিংসে করছে?
কই, রমলার সেই উগ্র প্রসাধনমণ্ডিত চেহারাটা দেখে তো কিছু মনে আসেনি সুনীলের? বোধ করি তাকিয়েও দেখেনি।…দাদার টিপটপ সুটেট বুটেড চেহারাখানাও তো সুনীলকে ঈর্ষাতুর করে তোলেনি?… চোখে পড়েইনি সত্যি।
ওরা তো ওই ভাবেই যেত।
আর ওরাই নিয়মিত যেত।
তা ওদের কথা বাদ দিলেও, অপর্ণাকে দেখেই কি কিছু মনে হল সুনীলের? দেখে হিংসে হল, মার হাতে কেন এখনও ঝকঝকে চকচকে ভারী সোনার চুড়ির গোছা, মার গলায় সেই সাবেক কালের মোটা সোনার বিচেহার। মার পরনে চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়ি।
অপর্ণা রোগা হয়ে গেছেন, বুড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু অভ্যস্ত সাজটা তো বজায় রেখেছেন। ওটা বদলানো উচিত, এমন কথা তাঁর মাথাতেই আসেনি।
সুনীলের প্রিয় খাদ্যবস্তুগুলো সব ছেড়ে বসে আছেন অপর্ণা এবং সহজেই সেই ছাড়ার খবরটা ব্যক্ত করেছেন। কেঁদে কেঁদে বলেছেন, আমার নীলু ফিরে আসুক, তখন আবার ওসব মুখে দেব।
পরাটা বদলায়নি।
কিন্তু চন্দ্রা?
তার কি এসব বহিঃপ্রকাশ আছে?
ভবানীবাবু হয়তো ঠিকই বলেছেন, মায়ের পথটি বড় সহজ!… তার কোনও অভিব্যক্তিকেই আতিশয্য বলে ধরা হয় না, তার ত্রুটিকে কেউ ত্রুটি বলে ভাবে না। মার ব্যবহারের মধ্যে সঙ্গতি অসঙ্গতি, ধীরতা এলোমেলো, কোনওটাই সমালোচকের চোখে পড়ে না।
কিন্তু স্ত্রীর কথা স্বতন্ত্র।
স্ত্রী সম্পর্কে যেন সকলের দৃষ্টি সজাগ। যেন সংসার সুষ্ঠু সবাই তার দিকে সন্দেহের চোখই ফেলে থাকে।
তার আচার আচরণ আতিশয্যও দৃষ্টিকটু, নির্লিপ্ততাও অসহনীয়।
পতিবিচ্ছেদ বিধুরার হাসিটা নির্লজ্জতা, কান্নাটা আদিখ্যেতা, তার সম্পর্কে মাথা ঘামানোর মাথা অনেক।
তার সম্পর্কে সতত অবিশ্বাস।
তাই হয়তো সুনীলের চোখে অপর্ণার গায়ের সোনার ঝিলিক চোখেও পড়েনি, চন্দ্রার বর্ণাভরণের সুবর্ণদ্যুতি পড়ল। চোখটা ঝলসে দিয়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল।
তারপর সুনীলও চন্দ্রার মতো ভাবল, কিন্তু এইরকমই কি হবার কথা ছিল? এতদিন ধরে তিল তিল করে আমি কি এই ছবিই এঁকেছিলাম?
ওর মনে হল, যেন অনাবৃষ্টির আকাশে কালবৈশাখীর আশ্বাস ছিল, ঈশান কোণে মেঘ মজুত হয়েছিল প্রচুর, আকাশ অন্ধকার করে ঝড় উঠি উঠি করল বৃষ্টির আভাস নিয়ে, তারপর হঠাৎ সব থেমে গেল, মিইয়ে গেল।…
না উঠল ঝড়, না হল বৃষ্টি।
যেখানে যা প্রত্যাশা ছিল, সবই যেন ঝুলে পড়ল।
আচ্ছা, চন্দ্রা না হয় ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ল না, সুনীলই বা তেমন করে গিয়ে চন্দ্রাকে ওর স্থিরতার সিংহাসন থেকে উপড়ে ছিঁড়ে নিল না কেন?
কেন এতদিনের আবেগ ব্যাকুলতা তৃষ্ণা হাহাকার সব কিছু দিয়ে ওকে ভাসিয়ে দিতে পারল না? লুঠ করে নিতে পারল না।
সুনীল বুঝতে পারল না, কেন যেরকমটি হবার কথা ছিল তেমনটি হল না।
শুধু মনে হল কে কোনখানে যেন একটা ব্রেক কষে দিল।
প্রথমটা কিছু না করে শুধু শাওয়ারটা খুলে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুনীল। জল পড়তে লাগল ঝরঝরিয়ে, সেই দিকে তাকিয়ে রইল আচ্ছন্নের মতো।
সুনীল নামের ওই লোকটা ঠিক এই মুহূর্তে যেন ভুলে গেছে সে কে, কোথায় রয়েছে কেন রয়েছে। তুলে গেছে কী করণীয় আছে তার। ওর যেন অতীত নেই, বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎ শব্দটাও নেই।
চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধিবৃত্তি সব কিছু যেন একটা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে তার। এখন শুধু ওই ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়া জলের ধারাটার দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই ওর।
.
কে জানে কতক্ষণ পরে যেন খেয়াল হল ও স্নান করতে এসেছে।
আবার দেয়ালে চোখ পড়ল।
খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর ছোট ছোট করে ছাঁটা ফুলওলা মুখ মাথা সংবলিত সেই চেহারাটার ছায়া আবার যেন একটা কুৎসিত ব্যঙ্গ হাসি হেসে উঠল।
সুনীল কি সামনে ব্রাকেটে রাখা এই সব শিশি কৌটো থেকে একটা ভারী শিশি তুলে নিয়ে ওই ছায়াটার ওপর ছুঁড়ে মারবে?
না, তাতে শব্দ হবে।
তবে ঘুসি মারবে ওর উপর সজোরে?
হাতটা মুঠো পাকিয়ে উঠল প্রায় অজ্ঞাতসারে, ঘুসির মতো করে তুলল, আরশির উপর নয়, চোখের সামনে।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল, অবাক হল।
বজ্রভাবটা শিথিল হয়ে গেল।
এ হাতটা কার?
এই কালো কর্কশ শিরা ওঠা শীর্ণ!
আগে যে ছেলেটা এই ঘরে গুনগুনিয়ে গান গেয়ে গেয়ে, আর ওই ডজনখানেক শিশি কৌটোর সদ্ব্যবহার করে করে স্নান করত, এ হাত কি তারই?
হাতগুলো যে এমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে, তা তো এই এতদিন খেয়াল করেনি সুনীল।
মা তখন কেঁদে বলে উঠেছিল বটে, তোর সেই কাঁচামোনার রংটা কে কেড়ে নিল রে?
কিন্তু তখনও বুঝতেই পারেনি, মা কী বলছে।
মুঠিটা খুলে শিথিল ভঙ্গিতে দুএকটা শিশি কৌটো তুলে তুলে দেখল।
এগুলো এখনও পাওয়া যায়?
বাজারে চালু আছে?
আশ্চর্য তো!
হঠাৎ সুনীল খুব ক্লান্তি অনুভব করল, সবগুলো দেখল না। শুধু সোপকেসটা সন্তর্পণে খুলে দু আঙুলে ধরে সাবানটা তুলে নিল। এটা চাই! এটার জন্যে যেন প্রতিটি লোমকূপ ক্ষুধার্ত হয়ে রয়েছে।
সাবানটা একেবারে নতুন।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।
নামটা যেন অনেকদিন পরে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া বন্ধুর মতো পরিচিত হাসি হাসল। এই সাবানটা সবচেয়ে প্রিয় ছিল সুনীলের।
চন্দ্রার তা হলে এটা মনে আছে!
না কি কাকতালীয়।
নতুন সাবান একটা আনিয়ে রাখা হয়েছে, সেটাই এটা হয়ে গেছে।
শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়েই জলধারার মধ্যেই গায়ে সাবান ঘষতে থাকল যেন প্রাণপণে। ফেনা হবার অবকাশই পাচ্ছে না, শুধু ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব মৌলিক সৌরভ ছড়িয়ে।
আর স্নানের শেষে নরম শুকনো তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে সুনীলের মনে হল শুধু গায়ের ধুলো ময়লাই নয়, যেন ভিতরের অনেকদিনের জমানো গ্লানিও ধুয়ে বেরিয়ে গেল।
এখন যেন বিশ্বাস হচ্ছে–সুনীল নামের ছেলেটা একদা এখানে অনেক লীলা-বৈচিত্র্যের স্বাদ পেয়ে গেছে।
সহসাই একটু হেসে উঠল সুনীল।
সুনীল বোধ করি এখন মৃতের শামিল।
তাই এখন ভাবা হচ্ছে সুনীল এটা ভালবাসত।
ভাল বাসে নয়।
বাসত।
আলনায় ফর্সা পাট করা পায়জামা গেঞ্জি ঝুলছে। এগুলো তা হলে সুনীল পরতে পারে।
কিন্তু পরে বেরোতে এমন আড়ষ্ট লাগছে কেন? লজ্জা আর অস্বস্তি। দরজার ছিটকিনিটা খুলে ফেলে বেশ সহজ ভাবে কি বেরোতে পারবে? বোকার মতো মনে হবে না তো?
সুনীল রায় যেভাবে পা ফেলতো, সেইভাবে পা ফেলবার অভ্যাসটা কি আছে এখনও?
আও পাটাও কী বিশ্রি দেখতে হয়ে গেছে।
ও যখন প্রথম পা-টা বাড়াবে, চন্দ্রার চোখে পড়ে যাবে না তো?
কিন্তু চন্দ্রা কি এখনও ঘরে আছে? মানের ঘর থেকে বেরোবার মুহূর্তেই একটা অতি পরিচিত আদুরে গলার ঝংকার কানে এসে লাগল।
ঘরের দরজার মোটা ভারী পরদার ওধার থেকে রমলা হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, ও ঠাকুরপো, এখনও হল না তোমার? নীচে তো লোকে লোকারণ্য। ওদিকে মা বসে আছেন মুখ শুখিয়ে, তোমায় না খাইয়ে তো খাবেন না।
জনারণ্যে হারিয়ে গেল সুনীল নামের অনন্ত কৌতূহলের বস্তুটি।… লোকের পরে লোক। আসছে আগ্রহ নিয়ে, কৌতূহল নিয়ে, সন্দেহ নিয়ে, মমতা আর বেদনা নিয়ে।
আর সবচেয়ে অবিশ্বাস্য আর অভাবনীয় ব্যাপার, খবরটা সংগ্রহ করে এসে হাজির হল ত্রিবেণী চ্যাটার্জি। এল সস্ত্রীক।
স্ত্রী অবশ্য চুপচাপ বসে থাকল। (ভদ্রমহিলা চিরদিনই স্বল্পবাক)। চ্যাটার্জি কথার বান ডাকল।
আমি ভাবতে পারছি না রায় তোমার চেহারা এরকম হয়ে যেতে পারে। দুর্ভাগ্য তোমাকে একেবারে ভেঙে গুঁড়ো করে ফেলেছে।
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে, তারপর বলল, মিসেসকে দেখছি না যে?
চ্যাটার্জির স্ত্রীর আবির্ভাব দেখেই সুনীল মাকে বলে এসেছিল চন্দ্রাকে বসবার ঘরে পাঠিয়ে দিতে, কিন্তু চন্দ্রা নামেনি।
সুশীলের ছেলে শঙ্খ এসে বলে গিয়েছিল, ছোটমার দারুণ মাথা ধরেছে, ছোটমা শুয়ে আছে।
বাচ্চা চাকর দুলালের দেখাদেখি সেও বলে ছোটমা।
যে মহিলা দারুণ মাথাধরা নিয়ে শুয়ে আছে, তাকে আর দ্বিতীয়বার ডাকাডাকি করে ব্যস্ত করতে চাইবে কোন পাপিষ্ঠ?
চ্যাটার্জি নিজেই ব্যস্ত হয়ে বলল, থাক, থাক, আমি আর একদিন আসব।
তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে অনেকক্ষণ ধরে সেই তাদের সুখময় জীবনের দিনগুলির কথা বলল, সেদিন আর ফিরে আসবে কিনা, ভাগ্যের কাছে এ প্রশ্ন করল, আবার আসার জন্যে ভগবানের কাছে আবেদন জানাল, তারপর চা মিষ্টি খেয়ে বিদায় নিল।
অপর্ণা আজ বাড়িতে মিষ্টির ভাঁড়ার অফুরন্ত রেখেছেন। আজ তাঁর বড় আনন্দের দিন, আজ যে আসবে, তাকে প্রাণভরে মিষ্টি খাওয়াবেন তিনি।
যারা এসেছে, সবাই যে মিত্রপক্ষ, তা বলা যায় না। ছদ্মবেশী মিত্রও আছে অনেকে। যারা আড়ালে বলে বেড়িয়েছে, আহা বিনা দোষে! রেখে দাও ওসব কথা! এবং সামনে কাতর সহানুভূতি জানিয়েছে।
তারা আজ তাদের সেই কাতর সহানুভূতির ছাড়পত্রে সব আগে এসে হানা দিয়েছে।
অপর্ণা তাদের চেনেন না তা নয়। তবু তাদের স্বাগত জানিয়েছেন, রাজভোগ খাইয়েছেন।… চ্যাটার্জি তো খাবেই। নীলুর আপিসের লোক।
তাও আবার বউ নিয়ে এসেছে।
সমাদর করতে হবে বইকী!
অপর্ণা এমন স্বপ্নও দেখলেন, হয়তো ও আবার সুনীলকে সেই সুখস্বর্গে প্রতিষ্ঠিত করবার বার্তা নিয়ে এসেছে।
অপর্ণা দরজার আড়াল থেকেই দেখছিলেন, তবু অবাক হচ্ছিলেন, এর সম্পর্কে নানা সন্দেহের কথা শুনেছেন কেন? এমন প্রাণখোলা হাসি, এমন মনখোলা গল্প, আর সুনীলের প্রতি এমন সহানুভূতি, এ কখনও ছলনা হতে পারে?
ভবানীবাবুর কাছে গিয়ে বললেন সে কথা।
ভবানীবাবু বললেন, বাইরে থেকে কি বোঝা যায়?
তিনিও আজ এত লোকসমাগমে যেন বিধ্বস্ত।
নীলুকে আমি একবার চোখে দেখতে পেলাম না।বলেছেন মনে মনে।
সুনীলও বুঝি নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে না।
এত লোক, এত কথা, এত ভাবের অভিব্যক্তি, এরাই যেন একদিনে সুনীলের এতদিনের স্মৃতি বিস্মৃতি সব ধুয়ে সাফ করে দিয়ে দিল।
সুনীল আর নতুন রইল না।
সেন সাহেব এলেন সন্ধ্যায়।
বললেন, জানি আজ সারাদিন বাড়িতে ভিড় হবে, তাই আর দিনের বেলা আসিনি। খুকুর মারও জানিয়েছে। শরীরটা ঠিক নেই, বলেছেন, কাল নিজের বাড়িতেই দেখবেন তোমাকে।
সুনীল প্রণাম করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, সেন সাহেব বোধ করি মৌনং সম্মতি লক্ষণম ধরে, কাল কখন গাড়ি পাঠাবেন সেটা জানিয়ে, চন্দ্রাকে ব্যস্ত না করে বিদায় নিলেন। বলে গেলেন, থাক থাক, কালই তো দেখা হচ্ছে।
সেন সাহেবের পরও, অধিক রাত্রেও লোক এল। পাড়ার লোক। তারা সারাদিন জনসমুদ্র দেখে আসতে সাহস করেনি, এখন ধীরেসুস্থে এসেছে।
এইসব ভালবাসার ডালিকে কি ঠেলে ফেলে দিতে পারে কেউ, আমার আর বসে থাকবার ক্ষমতা হচ্ছে না বলে?
অপর্ণা অস্থির হচ্ছেন, ছেলেটা একবার বিশ্রাম পেল না গো– বলে।
ভবানীবাবু বারবার ভেবেছেন, এবার হাতজোড় করে বলে দিই, আজকে ও আর পারছে না।
কিন্তু তাই কি বলা যায়?
ভদ্রতার কাছে কি প্রাণের প্রশ্ন।
সেই সকালের পর সুনীল আবার যখন তার সেই তিনতলায় নিজের ঘরে এসে দাঁড়াল, তখন রাত্তির প্রায় মাঝরাত্তিরে পৌঁছেছে। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর, মাথা ঘুরছে। দেখল চন্দ্রা শুয়ে আছে পালঙ্কশায়িনী রাজকন্যার মতো।
চন্দ্রার মাথার উপর পূর্ণবেগে পাখা ঘুরছে, চন্দ্রার মাথার নীচের বালিশের ধবধবে লেশের ঝালর সেই বাতাসে উড়ছে।
ঘরে মৃদু একটা সুরভিসার ওই বাতাসে ছড়িয়ে খেলে বেড়াচ্ছে।
চন্দ্রার দারুণ মাথা ধরেছে, তাই চন্দ্রা বোধ করি কোনও একটা মৃদু মদির গন্ধ সেন্ট ব্যবহার করেছে।
প্রসাধন বস্তুর সম্ভারে তো সেন সাহেবের মেয়ের ভাঁড়ার ভর্তি।
ঘরের চড়া আলোটা সন্ধে থেকেই জ্বলছেনা, সেও ওই মাথা ধরার জন্যে। মৃদু নীলাভ একটি আলো ঘরটাকে পরীরাজ্যে পরিণত করেছে।
পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়াল সুনীল। যেন স্তব্ধ হয়ে গেল।
নিজেকে অনধিকার প্রবেশকারীর মতো লাগল।
কাল, মাত্র গতকাল রাত্রে সুনীল কোথায় শুয়েছিল?
.