পরদিন সোমবার সকালে আমার সল্টলেকের ফ্ল্যাট থেকে কর্নেলকে ফোন করেছিলুম। আহিরগঞ্জের ভুতুড়ে ঘটনা আমার মাথায় ভূতের মতো ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু কর্নেলের দিক থেকে তেমন সাড়া পাইনি। কবে যাচ্ছেন, জিজ্ঞেস করলে শুধু বলেছিলেন, দেখা যাক। মাদুলিটা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে একই নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বরে বলেছিলেন, কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মঙ্গলবার বিকেলে দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার নিউজরুমে বসে পুলিশসূত্রে পাওয়া এক কিলোগ্রাম হেরোইন উদ্ধারের খবর লিখছি, সেই সময় কর্নেলের টেলিফোন এল। জয়ন্ত! তুমি কি খুব ব্যস্ত?
বললুম, নাহ্। মাত্র এক কেজি হেরোইন উদ্ধার আমাকে ব্যস্ত করছে না। আহিরগঞ্জের ভূতটার উৎপাতে মাথা সবসময় ভোঁ-ভোঁ করছে!
হুঁ! আমারও করছে। কারণ এইমাত্র আমাদের হেকিমসাহেব সেখান থেকে ট্রাঙ্ককলে জানালেন, গতকাল সন্ধ্যায় উনি ভুতুড়ে বাঘের পাল্লায় পড়ে রিভলভার থেকে দু রাউন্ড ফায়ার করেছেন।
বলেন কী? কোথায়?
ফোনে বলা যাবে না। তুমি তোমাদের চিফ অব দ্য নিউজব্যুরো সত্যবাবুকে ম্যানেজ করে চলে এস। রাত নটায় এসপ্ল্যানেড থেকে বক্রেশ্বরের বাস ছাড়ে। আমরা বরং বাসেই যাব। সেখান থেকে আহিরগঞ্জ যাওয়ার ব্যবস্থা আশা করি হয়ে যাবে। ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টের এক কর্তাকে বলতে হবে। ছাড়ছি।…
হেকিমসাহেব মানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাই। সত্যি বলতে কী, রবিবার থেকেই ওঁর জন্য আমি উদ্বেগ বোধ করছিলুম। হঠকারী জেদি এই প্রাক্তন পুলিশ অফিসার কোথাও নাক গলাতে গিয়ে প্রায়ই অদ্ভুত কাণ্ড বাধিয়ে বসেন। নিজেও বিপদে পড়েন। কর্নেলকেও ভোগান।
সত্যদাকে আহিরগঞ্জের চোর বাঘ এবং পুলিশ খবরটার টোপ গিলিয়ে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লুম।
কর্নেল আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বললেন, ট্রেনে অণ্ডাল জংশন হয়ে আহিরগঞ্জ যেতে হলে সময় কম লাগত। কিন্তু আমাদের বক্রেশ্বর হয়ে যেতে হবে। কারণ ওখানে ইরগেশন ডিপার্টমেন্টের জিপ পাব। আমরা উঠব শঙ্খদহ ওয়াটারড্যামের বাংলোতে। আমরা সরাসরি মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে। যেতে চাইনে। ইরিগেশন বাংলো থেকে ওঁর ফার্মের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। তাতে কোনো অসুবিধে নেই।
বললুম, হেকিমসাহেবের খবরটা বলুন কর্নেল।
কর্নেল একটু হেসেই গম্ভীর হলেন। হালদারমশাই একটু ভুল করে ফেলেছেন। কাল সন্ধ্যায় উনি জঙ্গলে ঢুকেছিলেন। কেন ঢুকেছিলেন, তা ফোনে বলেননি। মুখোমুখি বলবেন। তো অন্ধকারে টর্চের আলোয় ঝোপের আড়ালে নাকি একটা বাঘের মাথা দেখতে পান। দেখামাত্র–ওঁর যা হঠকারী অভ্যাস, রিভলভার থেকে বাঘটাকে লক্ষ্য করে পরপর দুবার গুলি ছোঁড়েন। আশ্চর্য ব্যাপার! বাঘটা নাকি গর্জন করেনি। নিঃশব্দে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কল্পনা করো দৃশ্যটা! মাথায় টুপি মুখে দাড়ি ঝুলপাঞ্জাবি আর লুঙ্গিপরা এক হেকিমসাহেব রিভলভার বের করে গুলি ছুঁড়ছেন। হাজঙ্গলের ভেতর সন্ধ্যার অন্ধকারে ঘটনাটা ঘটেছে। তবু বলা যায় না, দৈবাৎ কেউ ব্যাপারটা দেখে ফেললেই– যা গে! তুমি এক পেয়ালা কফি খেয়ে সল্টলেকে ফিরে যাও। তৈরি হয়ে ট্যাক্সি চেপে চলে আসবে এসপ্ল্যানেডে লং ডিসট্যান্স রুটের বাসস্ট্যান্ডে। সেখানে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব। যে-ভাবে হোক, সাড়ে আটটায় তোমার ওখানে পৌঁছুনো চাই। আর–তোমার ফায়ার আর্মস নিতে ভুলো না। হা! অবশ্যই সঙ্গে একটা রেনকোট নেবে।..
বিস্তারিত বলার প্রয়োজন দেখছি না। বক্রেশ্বরগামী ডিলাক্স বাসের সিট যত আরামদায়ক হোক, বর্ষায় রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। কর্নেল সারাপথ নাক ডাকিয়ে ঘুমোলেন। আমি চোখ বুজে বসেছিলুম। মাঝে মাঝে বৃষ্টির উৎপাত এবং খানাখন্দে বাসের চাকা পড়ে হঠাৎ-হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি।
বক্রেশ্বর বাসস্টেশনে পৌঁছুতে সকাল আটটা বেজে গিয়েছিল। ইরিগেশনের জিপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। জিপচালক যে কর্নেলের চেনা লোক, তাতে অবাক হইনি। তার নাম মোহন সিং! শক্তসমর্থ প্রৌঢ়। বক্রেশ্বর নদের ব্রিজ পেরিয়ে যাওয়ার সময় বর্ষাকালের মত্তমাতাল জলপ্রবাহ দেখে কেন যেন গা ছমছম করছিল। বীরভূম জেলার পশ্চিমপ্রান্তে এই এলাকাটি অসমতল এবং মাঝে মাঝে রুক্ষ টাড় জমি, কোথাও আবাদি জমির ওপর বড় বড় পাথর চোখে পড়ছিল। একটা পাথরের টিলার নিচে বাঁদিকে বাঁক নিতেই ডাইনে পশ্চিমে বিস্তীর্ণ জলাধার দেখা গেল। আবার ঘুরে আমাদের জিপ চলল নদীর সমান্তরালে। কিছুক্ষণ পরে সুইস গেটের ব্রিজে সশস্ত্র গার্ডকে মোহন সিং অনুমতিপত্র দেখিয়ে এগিয়ে চলল। জলাধারের দক্ষিণে উঁচু জমির ওপর রঙিন সুন্দর বাংলো আর কয়েকটি কোয়ার্টার দেখতে পেলুম। উঁচু জমিটাতে গাছপালা, ফুলের বাগান বৃষ্টিভেজা সকালে উজ্জ্বল সোনালি রোদে ঝলমল করছিল।
বাংলোর চৌকিদার রামভরোসাও কর্নেলের চেনা লোক। বুঝলাম, তিন বছর আগে এই এলাকায় এসে কর্নেল এই বাংলোতেই উঠেছিলেন।
ব্রেকফাস্টের সময় কর্নেল বললেন, আচ্ছা রামভরোসা, এখানে কোথায় নাকি ভূতের উৎপাত হচ্ছে? ভূতটা বাঘ হয়ে ভয় দেখাচ্ছে? বাসে আসতে আসতে শুনছিলুম।
রামভরোসা মুখে ভয়ের ছাপ ফুটিয়ে বলল, জি হাঁ! আহিরগঞ্জের জমিন্দারবাবুর পোতা এখানে ফেরাম করেছেন। দাওয়াইকি বহত পেড়-উড় চাষ করেছেন। ওহি ফেরামে ভূত-পিরেত কভি আদমি কভি শের বার ঘুষে। মালুম, উও শের অট্টহাস দেবীর শের আছে। দেবীর পূজা না করে ফেরাম হয়েছে। দেবীর বহত্ রাগ হয়েছে।
রাতবিরেতে কি তুমি এখান থেকে বাঘের ডাক শুনেছ?
জি হাঁ কর্নির্লসাব। পাঁচ-ছে রোজ আগে রাত্তিরে আমি বাঘের ডাক। শুনেছি। বলে চৌকিদার তিনটে আঙুল দেখাল। তিনবার শের হাঁক দিয়েছিল।
কাছাকাছি, নাকি দূরে?
দূরে। কর্নিলসাব! শের হাঁক দিলে বিশ কোরোশ দূরে থেকে কানে আসে।
অট্টহাস দেবীর বাঘ এতকাল পরে কেন হামলা করছে? সিংহরায়সায়েব তো পাঁচ বছর আগে ফার্ম করেছেন শুনেছি। সেবার আমি এখানে এসে ওঁর ফার্ম দেখতে গিয়েছিলুম। তখন তো বাঘের উৎপাত হয়নি?
রামভরোসা চাপাস্বরে বলল, জমিদারবাবুর পোতা সিংহরায়সাব এক মাহিনা আগে দেবীর মন্দিরে গিয়েছিলেন। উনহির ফেরামের এক আদমি গোপালবাবু সঙ্গে ছিলেন। মন্দির তো খণ্ডহরপুরী। জঙ্গলের মধ্যিতে আছে। সিংহরায়সাব আর গোপালবাবু মন্দিরে কুছু খারাব কাম করেছিলেন।
কী খারাব কাম?
মালুম নেহী কর্নিলসাব! লেকিন ড্যামকা পিছে এক সাঁওতাল বস্তি আছে–সেই বস্তির মানকু হাড়াম তখন জঙ্গলে শিকারে গিয়েছিল। মানকু আমাকে বলেছিল, সিংহরায়সাব আর গোপালবাবু ওখানে কুছু করছে। মানকুকে তারা ভাগিয়ে দিয়েছিল। খারাব কাম না করবে তো মানকুকে ভাগিয়ে দেবে কেনো?..
ব্রেকফাস্ট শেষ করে কর্নেল বারান্দায় গেলেন। তারপর বাইনোকুলারে জলাধার এবং উত্তর-পূর্বে জঙ্গলের দিকটা দেখতে থাকলেন। আমি বিছানায় গড়িয়ে পড়লুম। রাতের বাসজার্নির ধকলে সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল।
কর্নেল ঘরে এসে বললেন, তুমি বিশ্রাম করো। আমি একটু ঘোরাঘুরি করে আসি।
বললুম, বাঘ খুঁজতে বেরুচ্ছেন?
কর্নেল হাসলেন। দিনদুপুরে বিশেষ করে জুলাই মাসের ভ্যাপসা গরে বাঘ দেখার চান্স নেই। মিঃ সিংহরায়ের ফার্মে গিয়ে আমাদের হেকিমসাহেবের সঙ্গে দেখা করা দরকার।
আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হতে পারে।
রেনকোট নিয়ে বেরুচ্ছি। তুমি রেনকোট এনেছ তো?
এনেছি।
বাহ। রেস্ট নাও।
কর্নেল পিঠে কিটব্যাগ এঁটে রেনকোট বগলদাবা করে বেরিয়ে গেলেন। আমি উঠে দরজাটা শুধু ভেজিয়ে দিলুম। তারপর দক্ষিণের জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিলুম। দেখলুম কর্নেল নদীর সমান্তরালে উঁচু বাঁধের ওপর দিয়ে। হেঁটে চলেছেন। বাঁধের দুধারে ঘন গাছপালা। একটু পরেই তিনি অদৃশ্য হয়ে। গেলেন।
ফ্যান ঘুরছিল ফুল স্পিডে। তবু কেমন একটা স্থাকাঁদেওয়া গরম। সরকারি আমলাদের জন্য এইসব বাংলোয় এয়ারকন্ডিশনার থাকে। এখানে কেন নেই? খুঁজতে খুঁজতে যন্ত্রটা আবিষ্কার করলুম।
দেওয়ালের উঁচুতে এয়ারকন্ডিশনার বহাল তবিয়তে আছে। খোলা জানালাটা তখনই বন্ধ করে দিয়ে যন্ত্রটার সুইচ অন করে দিলুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্নিগ্ধ হিমে ঘর ভরে গেল। ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে এল। তারপর কখন যে। পায়ের দিক থেকে চাদর টেনে মুড়ি দিয়েছি কে জানে!
ঘুম ভাঙল কর্নেলের ডাকে। ঘরে তখন বেজায় হিম। কর্নেল ভিজে রেনকোট, খুলে ফ্যান বন্ধ করে বললেন, কাজটা ঠিক করোনি ডার্লিং! এয়ারকন্ডিশনার আরামদায়ক যন্ত্র। কিন্তু এই এলাকায় স্বাভাবিক আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। সব জানালা খুলে ফ্যানের হাওয়াই যথেষ্ট ছিল। কিংবা ফ্যান বন্ধ করে কম ডিগ্রির ঠাণ্ডাও নিরাপদ।
তখনই উঠে বসেছিলুম। ঘড়ি দেখেছিলুম। একটা পনেরো বাজে। বললুম, গরম হাওয়ায় গায়ে ফোস্কা পড়ছিল। তাই
উঁহু। যান্ত্রিক সভ্যতার খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।
হেসে ফেললুম। এসেই বক্তৃতা শুরু করলেন? মনে হচ্ছে, আপনার মেজাজ কোনো কারণে বিগড়ে গেছে।
কর্নেল অনিচ্ছার সঙ্গে একটু হাসলেন। তা গেছে। মিঃ সিংহরায়ের ফার্মের কাছে একটা ব্লাড় জমিতে লালঘুঘুর ঝক দেখে ক্যামেরা তাক করেছি, হঠাৎ জমিটার শেষে একটা ঝোঁপ থেকে হেকিমসাহেবের টুপি দেখামাত্র পাখিগুলো পালিয়ে গেল। তখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি।
হালদারমশাই ওখানে কী করছিলেন?
আবার কী? গোয়েন্দাগিরি। ওখানে ঝোপের ভেতর ওত পেতে বসে ফার্মের একটা লোকের দিকে লক্ষ্য রেখেছিলেন। তার গতিবিধি নাকি সন্দেহজনক।
আপনার সঙ্গে কী কথাবার্তা হলো?
বলবখন। ফেরার পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি। খিদে পেয়েছে। তুমি কি স্নান করবে?
নাহ! শীত-শীত করছে।
করবেই তো। সেজন্যই বলছিলুম কাজটা ঠিক করোনি।
বাইরে রামভরোসার ডাক শোনা গেল। কর্নিলসাব!
এস রামভরোসা।
চৌকিদার ঘরে ঢুকে সেলাম ঠুকে বলল, লাঞ্চ রেডি। এখন আনব?
নিয়ে এস।
আমি বাথরুমে ঢুকে চোখে জল ছিটিয়ে মুখ ধুয়ে এলুম। তারপর কর্নেল বাথরুমে গেলেন। বারান্দায় বেরিয়ে দেখি, বৃষ্টি কমে এসেছে। কিন্তু সেই ছ্যাঁকাদেওয়া গরমটা কমেনি। ড্যামের জলে বৃষ্টির ফোঁটা বিচিত্র নকশা আঁকছিল। এলোমেলো হাওয়া এসে উত্তাল ঢেউ দিয়ে সেই নকশা ভেঙে দিল।
কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। তাই কোনো প্রশ্ন করিনি। খাওয়ার পর উনি চুরুট ধরিয়ে ইজিচেয়ারে আরাম করে বসলেন। চোখ বুজে অভ্যাসমতো হেলান দিয়ে বললেন, হালদারমশাই হেকিমসাহেব সেজে সমস্যায় পড়েছেন। ফার্মের একটা ঘরে ওঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেবাযত্নের ত্রুটি নেই। কিন্তু সাদা নকল দাড়ি, পরচুলা আর জোব্বা পরে থাকা সত্যিই কষ্টকর। শুধু রাত্রিবেণা দরজা এঁটে ছদ্মবেশে ছেড়ে যেটুকু আরাম। কিন্তু লোডশেডিং-এর উৎপাতও আছে। এই বাংলোয় এমার্জেন্সি লাইন আছে। তাই সারাক্ষণ বিদ্যুৎ থাকে। ওখানে তা নেই। ওঁকে হেকিমসাহেব সাজবার পরামর্শ দিয়ে ঠিক করিনি।
জিজ্ঞেস করলুম, ভুতুড়ে ঘটনার কোনো ক্লু কি হালদারমশাই পেয়েছেন?
চৌকিদারের মুখে তুমি গোপালবাবুর নাম শুনেছ। গোপালবাবু ফার্মের ম্যানেজার। ওঁর গতিবিধি নাকি সন্দেহজনক। কাল সন্ধ্যায় গোপালবাবুকে জঙ্গলের দিকে যেতে দেখে হালদারমশাই ফলো করেছিলেন। তারপর হঠাৎ ঝোপের আড়ালে বাঘ দেখতে পান।
সর্বনাশ! তাহলে গোপালবাবু হেকিমসাহেবের গুলি ছোঁড়া লক্ষ্য করেছেন।
হালদারমশাই-এর ধারণা, কে গুলি ছুঁড়েছিল গোপালবাবু জানেন না। তবে গুলির শব্দ শুনে গোপালবাবু ওঁর প্রায় নাকের ডগা দিয়ে ফার্মের দিকে ছুটে পালিয়েছিলেন। ফার্মে ফিরে গোপালবাবু বলেছেন জঙ্গলে চোরাশিকারি ঢুকেছে।
আপনি ফার্মে যাননি?
হালদারমশাই ফার্মে ফিরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে গেলুম। গোপালবাবু এবং অন্যান্য লোক আমাকে চিনতে পারলেন। মিঃ সিংহরায় আহিরগঞ্জে কী কাজে গেছেন। ওঁর একটা জিপগাড়ি আছে। অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে চলে এলুম। বলে এতক্ষণে কর্নেল হাসলেন। অসাধারণ অভিনয় করতে পারেন হালদারমশাই। আমার পরিচয় নিলেন গোপালবাবুর কাছে। তারপর হিন্দুস্তানি ভাষায় আমাকে সুলেমানি আরক সেবনের পরামর্শ দিলেন।
হিন্দুস্তানি ভাষাটা কী?
হিন্দি-উর্দুর জগাখিচুড়ি। তোমার জানা উচিত। তথাকথিত হিন্দি সিনেমায় যে ভাষায় চরিত্রেরা কথা বলে। তৎসম শব্দ কম থাকে এ ভাষায়।
সুলেমানি আরক খেলে কী হয়?
কর্নেল হাসলেন। খ্রিস্টান-ইহুদিদের সলোমন হলেন মুসলিমদের সুলেমান। আমি বৃদ্ধ। সুলেমানি আরক খেলে নাকি যুবক হয়ে যাব। একাধারে বাদশাহ এবং প্রফেট সুলেমান নাকি ওই আরক খেয়ে আমৃত্যু যুবক ছিলেন। বলে কর্নেল আরেকদফা হাসলেন। হালদারমশাইয়ের কাণ্ড! এখানে আসার আগে চিৎপুর থেকে আস্ত একটা হেকিমি বাকসো আর ওষুধ কিনে এনেছেন। সব ওষুধের আরবি-ফার্সি নামও ওঁর মুখস্থ। নিজের চোখে সুরমাও পরেছেন। সেই সুরমা আমাকে পরাতে চাইছিলেন হেকিমসাহেব। সুরমার নাম সুরমায়ে হাসিনা। চোখে পরলে নাকি বিশ্বসুন্দরীরাও বশীভূত হবে।
বাহ্! তাহলে জমিয়ে তুলেছেন হালদারমশাই!
তা আর বলতে? আজ সকালেই সবাইকে গুল-ই-ফরিস্তা নামে হজমিগুলি বিলি করেছেন। ফরিশতা অর্থাৎ দেবদূতরা নাকি স্বর্গের গুল অর্থাৎ ফুল থেকে ওই গুলি তৈরি করে খান।
কিন্তু আপনার মেজাজ খারাপের কারণ কী?
কর্নেল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। আস্তে বললেন, আমার কোনো কুসংস্কার নেই। কিন্তু আমি বরাবর লক্ষ্য করেছি, লালঘুঘুর ঝক আমার ক্যামেরাকে ফাঁকি দিলেই অঘটন ঘটে।
অঘটন তো ঘটেই গেছে। বাঘটা যে ভূত নয়, তা হালদারমশাই পরোক্ষে প্রমাণ করেছেন। ভূত হলে বাঘটা ওঁকে অন্য রূপ ধরে ভয় দেখাত।
কর্নেল আর কোনো কথা বললেন না। ফের চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে টাকে হাত বুলোতে থাকলেন।
আজ আমার চোখে ভাতঘুমের টান ছিল না। বারান্দায় গিয়ে বসলুম। মেঘ কেটে রোদ ফুটেছে। ঝাঝালো হাওয়াটা আছে। নিচে ড্যামের জলে উত্তাল ঢেউ খেলছে। মাটির রুক্ষতা বৃষ্টিতে ভিজে কোমল দেখাচ্ছে। এখানে মাটির রঙ ঈষৎ লাল। ইতস্তত তাজা বৃক্ষলতাগুল্ম আর লনের রঙবেরঙের ফুল দেখতে দেখতে বাকি ক্লান্তিটুকু ঘুচে গেল।
কিছুক্ষণ পরে দেখলুম, বাঁধের দিক থেকে সাইকেলে চেপে প্যান্টশার্ট পরা মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক বাংলোর দিকে এগিয়ে আসছেন। গেটের সামনে সাইকেল থেকে তিনি নামলে চৌকিদার রামভরোসা এগিয়ে গিয়ে তাকে সম্ভাষণ করল।
গেট খুলে ভদ্রলোক লনে ঢুকলেন। চৌকিদার আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টে তাকিয়ে বলল, ইনি জমিন্দারবাবুর পোতার ফেরামে মানিজারবাবু আছেন। কর্নিলসাবের সঙ্গে দেখা করতে আসলেন।
ভদ্রলোক বারান্দার নিচে সাইকেল রেখে বললেন, কর্নেলসায়েব কোথায় রামভরোসা?
কর্নেল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, আরে গোপালবাবু যে! কী খবর?
নমস্কার সার। মালিকের হুকুমে আসতে হলো। উনি এই চিঠিটা দিয়ে পাঠিয়েছেন।
বসুন গোপালবাবু! কর্নেল চিঠিটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বললেন, আমি তো কয়েকদিন এখানে আছি। মিঃ সিংহরায়ের গেস্ট হতে আপত্তি নেই। তবে চলে যাওয়ার দিন ওঁর গেস্ট হব। আরে! আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন!
গোপালবাবু এতক্ষণে বসলেন। বললেন, সিংহরায়সাহেব বরাবর খেয়ালি মানুষ। আপনি তো দেখে এলেন। এক হেকিম সাহেবকে. কলকাতা থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। হেকিমসাহেব লোকটা একেবারে ছিটগ্রস্ত। ওঁকে নিয়ে আমাদের প্রবলেম বেধেছে।
কী প্রবলেম?
সারাটা দিন ফার্মের চারপাশে চক্কর দিয়ে বেড়াচ্ছেন। ভূততাড়ানো মন্ত্র পড়ছেন। কখনও জঙ্গলে চলে যাচ্ছেন। অজানা জায়গা। সাপের উপদ্রব আছে। তাছাড়া ইদানীং একটা বাঘও এসে জুটেছে জঙ্গলে। তখন আপনাকে কথাগুলো বলার সুযোগ পাইনি। আপদ বিদায় হলে বাঁচি! গোপালবাবু চাপাস্বরে ফের। বললেন, আমাদের রাঁধুনি হরি ঠাকুরের ঘরে ঠাকুরদেবতা আছেন। আজ সকালে হেকিমসাহেব ওঁর ঘরে ঢুকেছিলেন। ঠাকুরমশাই রেগে আগুন। সিংহরায়সাহেব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করলেন।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। হেকিমসায়েবের পাগলামি আমি লক্ষ্য করেছি।
সিংহরায়সাহেব অনেক বছর মুসলমানদের দেশে-দেশে ঘুরেছেন। উনি জাতিধর্ম মানেন না। অবশ্য আমিও যে তত মানি-টানি, তাও নয়। কিন্তু
গোপালবাবু বিরক্ত মুখে থেমে গেলেন। কর্নেল বললেন, ভেষজ গাছপালা দেখতেই উনি এসেছেন মনে হলো। ইউনানি বা হেকিমি ওষুধ আমাদের আয়ুর্বেদের মতো উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়।
গোপালবাবু বললেন, আমি শুনেছি হেকিমরা গরুর চর্বি আর হাড়ের গুঁড়োও ওষুধে ব্যবহার করে।
এই সময় রামভরোসা এসে বলল, কর্নিলসাবের টেলিফোন এসেছে আপিসে। জলদি আসুন।
কর্নেল ব্যস্তভাবে উঠে গেলেন। আমি বললুম, এখানে টেলিফোন আছে?
থাকবে না কেন? গোপালবাবু বললেন। ইরিগেশন অফিস আছে যখন তখন ফোন না থাকলে চলে? তা আপনাকে তো চিনতে পারলুম না?
বললুম, আমি কর্নেলের সঙ্গে এসেছি। আমার নাম জয়ন্ত চৌধুরি।
তা আপনার কী করা হয়?
বুঝলুম ভদ্রলোকের মধ্যে গ্রাম্যতাদোষ আছে। বললুম, আমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার।
নমস্কার! নমস্কার! আপনি কাগজের লোক? আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়া সৌভাগ্যের কথা মশাই! ফিরে গিয়ে একটু কড়া করে লিখবেন তো– লোডশেডিংয়ের ঠেলায় আমরা অস্থির। অথচ কাগজে সরকার বলছেন বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত। কাণ্ডটা দেখুন! অত লাখ টাকা দামের ভেষজ গাছ-গাছড়ার ফার্ম। সেখানে কোনো রাত্তিরে আলো থাকে না। দিনের বেলায় যদি বা কারেন্ট থাকে, সন্ধ্যায় ভোল্টেজ নেমে যায়। তারপর ব্যস্!
কাগজে খবর পড়েছি আপনাদের ফার্মে নাকি ভূতের উৎপাত হয়েছিল?
গোপালবাবু গম্ভীরমুখে বললেন, লোকেরা ভূত বলে রটিয়েছে। চোরের কীর্তি।
কিন্তু পুলিশও নাকি বাঘ দেখেছিল। গর্জন শুনেছিল!
হ্যাঁ। চোর যখন ঢুকেছিল, তখন দৈবাৎ বাঘও ঢুকেছিল। কেউ মানতে চায় না। কিন্তু অট্টহাসের জঙ্গলে বরাবর একটা বাঘ আছে। রাতবিরেতে দূর থেকে আমি জঙ্গলে বাঘের ডাক শুনেছি।
কিন্তু ফার্মে বাঘ কেন ঢুকবে? ওখানে জীবজন্তু আছে কি?
গোপালবাবু মুখে রহস্যের ছাপ ফুটিয়ে বললেন, সায়েব অনেকরকম বিদেশি গাছ-গাছড়াও লাগিয়েছেন। রাত্তিরে নানারকম গন্ধ পাওয়া যায়। এমন হতে পারে, বাঘ কোনো গন্ধের টানে চলে আসে, যে গন্ধ, ধরুন বাঘিনীর–মানে, সেক্সয়াল কোনো গন্ধের মতো। ওই যে কী নামটা-সায়েবের কাছে শুনেছি, ফেরোমেন না কি গন্ধ!
সায় দিয়ে বললুম, আপনার ধারণা হয়তো ঠিক।
কর্নেল ফিরে এলেন। চেয়ারে বসে বললেন, ইরিগেশন ইঞ্জিনিয়ার মিঃ দাশগুপ্তের ফোন। তো গোপালবাবু! আপনি মিঃ সিংহরায়কে গিয়ে বলুন, বরং আজ সন্ধ্যায় ওঁর ফার্মে গিয়ে এক পেয়ালা কফি খেয়ে আসব। না–আমাদের জন্য জিপ পাঠাতে হবে না। এখানেই জিপের ব্যবস্থা আছে।…
গোপালবাবু চলে যাওয়ার পর কর্নেল আস্তে বললেন, ভুতুড়ে ফোন!
চমকে উঠলুম। ভুতুড়ে ফোন মানে?
যে লোকটা মিঃ সিংহরায়কে উড়ো চিঠি লিখেছিল, সেই লোকটা আমাকে বলল, পল্টুকে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। আমি যেন ও ব্যাপারে নাক না গলাই। গলার স্বর শুনে মনে হলো বয়স্ক লোক। সম্ভবত টনসিলের অসুখ আছে লোকটার। আমি বললুম, পল্টু কী পাপ করেছে আমাকে খুলে বলুন! তাহলে আমি নাক গলাব না। লোকটা বলল, সেটা পল্টুকে জিজ্ঞেস করবেন। তারপর ফোন ছেড়ে দিল। ক্লার্ক শান্তনুবাবুর কাছে শুনলুম, আহিরগঞ্জে অটোমেটিক টেলিফোন এক্সচেঞ্জ হয়েছে। কাজেই
কর্নেল হঠাৎ চুপ করলে আমি বললুম, কাজেই কে ফোন করেছে, জানা সহজ নয়।
যাক গে! ওঠ। পোশাক বদলে নাও। রেনকোট আর ফায়ার আর্মস সঙ্গে নেবে। বেরুব।
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা ছিল। মনে হলো, চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা না করে কলকাতা ফিরবেন না।