২. নো-স্মোকিং লেখা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

২.১

সামনের বোর্ডে নো-স্মোকিং লেখা জ্বলে উঠতেই আমার পাশের সহযাত্রী একটু ঝুঁকে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের মাথায় চঞ্চকে টাক, বেশ মোটা চেহারা। বাঃ! এই তো আমরা হংকং পৌঁছে গেলাম। ভদ্রলোক ঘাড় ফিরিয়ে বললেন, কিন্তু তার বিরাট মাথা ডিঙিয়ে আমার পক্ষে বাইরেটা দেখা সম্ভব ছিলনা, তাই বেল্ট বাঁধতে ব্যস্ত হলাম। ভদ্রলোক আবার বললেন, ওরা বলেছিল যে এটা নাকি পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। জানিনা ওদের কথা কতটা সত্যি।

আমাকে দেখে ভদ্রলোক বেল্ট বাঁধতে ঝুঁকে পড়তে আমি ওর ঘাড়ের ওপর দিয়ে জানলার দিকে ঝুঁকে পড়ে দেখলাম সবুজ পাহাড়, নীল সমুদ্রের জলে সূর্যের আলো পড়ে চিকচি করছে সমুদ্রে বেশ নৌকো ভাসছে। মোটা ভদ্রলোক যিনি হনলুলু থেকে আমার সহযাত্রী ছিলেন, প্লেন রানওয়েতে নামতে ও তার ক্যামেরা, ব্যাগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

আপনি কি পেনিনসুলা হোটেলে থাকছেন? ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন।

 না, আমি ওখানে থাকছিনা।

 ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কউলুন তো বেশ ভাল জায়গা। ভাল হোটেল, দোকানপাট সবই এখানে আছে। আপনি কি ব্যবসা সংক্রান্ত কোন কাজে এসেছে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–আচ্ছা সেজন্যই এখানে থাকছে না? আমি মৃদু হাসলাম। ভ্রমণটা বেশ ভালই লাগল, একটু লম্বা বটে কিন্তু বেশ উপভোগ্য।

কাস্টমস-এর ঝামেলা পেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে কোলাহলমুখর এয়ারপোর্টের ব্যক্ত এলাকায় এসে দেখি সেই মোটা ভদ্রলোক হোটেলবাস এ উঠছেন। উনি আমাকে হাত নাড়লেন, আমিও হেসে হাত নাড়লাম।

প্রায় আধডজন বয়স্ক, শুকনো চামড়ার, হলদেটে রং-এর রিক্সাওয়ালা একসঙ্গে চীৎকার আমাকে ডাকতে লাগল। কী করবো ভাবছি। এমন সময় বেঁটে একটা মোটাসোটা চীনা এসে বুকে অভিবাদন জানাল। মাফ করবেন, আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি? আপনার কি ট্যাক্সি লাগবে?

-আমি ওয়াঞ্চাতে যাব, সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেলে।

–আচ্ছা ওটা তো দ্বীপের ওপর। আপনি তাহলে ট্যাক্সি নিয়ে ফেরিঘাটে গিয়ে ওখান থেকে নৌকো করে ওয়াঞ্চাই চলে যান। ফেরিঘাটের উল্টোদিকেই আপনার হোটেল।

অশেষ ধন্যবাদ। আমি বললাম, ড্রাইভারেরা কি ইংরাজী বুঝতে পারে?

-হ্যাঁ, অল্পসল্প ইংরেজী সবাই বুঝতে পারে, বলে ইশারা করে একটা ট্যাক্সি ডাকল। লোকটার পিছু পিছু আমি ট্যাক্সিতে গিয়ে বসলাম। ড্রাইভার একজন রোগা চীনা, জামাকাপড় নোংরা আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামাল।

এ আপনাকে ফেরিঘাটে নিয়ে যাবে স্যার! ভাড়া হংকং ডলারে ছয় ডলার। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমেরিকান এক ডলার হংকং-এর ছয় ডলারের সমান। লোকটা সামান্য হেসে বলল, আপনার হোটেল খুজতে কোন অসুবিধা হবে না।

বললাম, ফেরিঘাটের ঠিক উল্টোদিকে?

একটু ইতস্ততঃ করে সোনা বাধান দাঁত বের করে হেসে লোকটা বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার। আপনি যে হোটেলে যাচ্ছেন সেখানে আমেরিকানরা সাধারণতঃ থাকেনা, বেশীর ভাগ আমেরিকানরা গুসেস্টার নয় পেনিনসুলায় থাকে।

-ঠিকই বলেছেন। আমি একটু হেসে বললাম, তবে আমিওখানেই উঠবো। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

–আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। বলে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে আমাকে দিল। এখানে আপনার একজন গাইডের প্রয়োজন হতে পারে। আপনি শুধু একটা ফোন করলেই…।

–অনেক ধন্যবাদ। আমার মনে থাকবে। কার্ডটা ওর হাত থেকে নিয়ে ঘড়ির চেনের তলায় রাখলাম। লোকটা অভিবাদন করে চলে গেল। আমি ট্যাক্সিতে গিয়ে উঠলাম।

প্লেনে আসতে আসতে আমি হংকং-এর ভৌগলিক বিবরণ দেখে নিয়েছিলাম। কাই-তাক এয়ারপোর্ট কউলুন উপদ্বীপে অবস্থিত। প্রণালী পার হলে হংকং দ্বীপ। ফেরিতে মিনিট পাঁচেক পার হতে লাগে। ওয়াঞ্চাই যেখানে হেরম্যান থাকত, সেটা হংকং-এর সমুদ্র এলাকার একটা শহর।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফেরিঘাটে পৌঁছে, কউলুন-এর এই সমুদ্র এলাকায় এসে দেখি গাদা গাদাকুলি বিশাল বিশাল মোট বয়ে নিয়ে চলেছে। কেউ ট্রাফিক মানছেনা। চেঁচামেচি হৈ-হট্টগোল। বড় বড় আমেরিকান গাড়ি চলছে, মালিক চীনা ব্যবসায়ীরা। কিছুকুলি দু-চাকার ঠেলায়, কিছু কুলি বাঁশের টুকরোতে মোট ঝুলিয়ে দুজনে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক দোকানের সামনে ভীষণ ভীড়, চীনা পুরুষ-মহিলা দাঁড়িয়ে কাঠি দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি কিছু খাচ্ছে। কিছু নোংরা জামাকাপড় পরা, রোগা বেঁটে চীনা ছেলেমেয়ে পিঠেবাচ্চা বাঁধা,রাস্তার একধারে খেলা করছে। একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, এখানে একশজন চীনা পিছু একজন ইউরোপীয়ান। ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে একটা বোটে গিয়ে বসলাম। বোটে চীনা ব্যবসায়ী, আমেরিকান ট্যুরিস্ট আর কিছু চীনা মেয়ে বসেছিল।

আমি বোটের একধারে একটা সীটে বসে হংকং-এর দিকে রওনা হলাম। আমি আরাম করে বসে আগের ঘটনাগুলো স্মরণ করতে লাগলাম। মনে হল, অনেকক্ষণ হল আমি প্যাসাডোনা সিটি ছেড়ে এসেছি। অবশ্য আমার এখানে আসা বেশ কয়েকদিন পিছিয়ে গেছিল কারণ আমার ঘরের সেই ভয়ঙ্কর অতিথি। রেটনিককে শুধু বলেছি, আমি ঘরে ঢুকেই লোকটাকে দেখতে পাই এবং ও আমাকে মারতে আসে তখন আমিও ওকে মারি। হাতে সাইলের পিস্তল ছিল। সম্ভবতঃ ছিঁচকে চোর হবে হয়তো। রেটনিক আমার কথা বিশ্বাস করেনি। বলেছিল, গাধা ছিঁচকে চোর সাইলের পিস্তল নিয়ে কারোর ঘরে ঢোকে না।আমি মনে মনে হেসে আমার কথাতেই অটল ছিলাম। যথেষ্ট সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও অবশেষে হংকং-এ এসে পৌঁছেছি।

আমি স্থির নিশ্চিত ঐ খুনেটাকে যে পাঠিয়েছিল সে সেই রহস্যময় হার্ডউইক। আমি আর একটা পয়েন্ট থ্রি এইট পুলিশ স্পেশাল কিনেছি সেটা ভবিষ্যতে কখনও কাছ ছাড়া করবনা।

বোটটা ফেরিঘাটে নামার জায়গায় গিয়ে পৌঁছাল। সব যাত্রীই নামার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ওয়াঞ্চাই শতকরা একশ ভাগ চীনা শহর। দুজন আমেরিকান খালাসী ছাড়া সবাই চীনা। প্রচুর সুন্দর দেখতে চীনা মেয়ে, তাদের কালো চোখের তারায় আমাকে আমন্ত্রণ জানাল।

একপাশে ছড়ির দোকান আর একপাশে বাচ্চাদের খেলনার দোকান, দুটো দোকানের মাঝখান দিয়ে সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেলে ঢোকার রাস্তা।

হোটেলে ঢুকলাম। রিসেপশনে একজন বৃদ্ধ চীনা বসে আছে মাথায় টুপি, গায়ে কালো কোট, থুনীতে সাদা দাড়ি। বাদামের মত দুটো চোখ, তাতে নির্জীব দৃষ্টি।

আমার একটা ঘর চাই। ব্যাগটা রেখে বললাম। আমার জামাকাপড় খুব একটা ভাল ছিল না। প্লেনের ধকলে নষ্ট হয়ে যাওয়া জামাকাপড় দেখে আমাকে খুব পয়সাওয়ালা মনে হচ্ছিলনা।

অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে খুব নিরাসক্তভাবে আমার সামনে একটা বাঁধানো খাতা আর পেন রাখল। আমি যথাযথ জায়গায় আমার নাম, ঠিকানা লিখে ফেরৎ দিলাম, লোকটা একটা চাবি বোর্ড থেকে নিয়ে কাউন্টারের ওপর রাখল।

দশ ডলার। একটু থেমে বলল, সাতাশ নম্বর ঘর।

 চাবিটা আমি তুলে নিলাম। লোকটা ডানদিকের পথ দেখিয়ে দিতে আমি সরু পথটা ধরে এগিয়ে গেলাম। পাশের একটা ঘর থেকে এক আমেরিকান খালাসী বেরিয়ে এল। রাস্তাটা খুব সরু। ওর পেছনে মোটাসোটা ছোট স্কার্ট পরা চীনা মে। সারা মুখে বিরক্তির ছাপ। আমি সব কিছু পেরিয়ে অবশেষে সাতাশ নম্বর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। তালা খুলে ঘরে ঢুকলাম।

একটা দশফুট বাই দশফুট ঘর। একটা চেয়ার, দুটো বিছানা, দেওয়ালে একটা কাপবোর্ড, মেঝেতে এক চিলতে কাপেট, ঘরে একটা জানলা।

ব্যাগ রেখে বিছানায় বসলাম, বিছানাটা শক্ত। খুব ক্লান্ত লাগছিল। এখন মনে হচ্ছে গ্লসেস্টার বা পেনিনসুলা হোটলে থাকলেই হত। ওখানে ডি-লুক্স শাওয়ারে চান করে, বরফ দিয়ে বীয়ার খেয়ে আরাম করা যেত। কিন্তু আমি তো আরাম করতে আসিনি। এসেছি কাজে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে, হাত-মুখ ধুয়ে খানিকটা ভাল লাগল। হোটেলটা বেশ ঠাণ্ডা। ট্রাফিকের মৃদু আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। হাতের ঘড়িতে দেখলাম ছটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। ঘড়ির স্ট্র্যাপের নীচে রাখা গাইডকার্ডটা বের করলাম। ওয়ন-হপ-হো। ইংরেজী বলিয়ে গাইড। নীচে টেলিফোন নম্বর দেওয়া। মানিব্যাগে রাখলাম।

তারপর দরজা খুলে বাইরে এসে দেখি আমার উল্টোদিকের ঘরে একটা চীনামেয়ে দরজায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের গঠন ভারী সুন্দর, চক্চকে কালো চুলে একটা বিনুনী। সাদা টাইট ব্লাউজ পরনে, নীচে নীল রঙের চাপার্ট। সারা দেহে যৌবনের প্রাচুর্য। যেন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে।

–হেই মিস্টার। বেশ বড় করে একমুখ হেসে বলল, আমি লেইলা, তোমার নাম কি?

নেলসন রায়ান। দরজায় চাবি দিতে দিতে বললাম, শুধু নেলসন বললেই হবে। তুমি কি এখানেই থাক?

-হ্যাঁ। নরম দৃষ্টিতে আমার সারা শরীরটা তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলল, এখানে খুব কম আমেরিকানরা থাকে, তুমি কি থাকবে নাকি?

–সেই রকমই ইচ্ছে আছে। তুমি এখানে কতদিন আছ?

আঠারো মাস। মেয়েটার অদ্ভুত উচ্চারণে ওর কথা বোঝার জন্যে আমাকে খুব মন দিয়ে শব্দ কটা শুনতে হচ্ছে। ও হেসে কি বলতে চাইল আমি বুঝলাম, যখন আরাম করার ইচ্ছে হবে, তখনই আমার ঘরে চলে এসো। কেমন?

হকচকিয়ে উত্তর দিলাম, ঠিক আছে মনে থাকবে।

একটু দুরে ভেতর দিকে একটা দরজা খুলে বেঁটেমত একজন লোক মনে হল ফরাসী নয় ইতালীয় আমাকে অতিক্রম করে চলে গেল। পিছনে অল্পবয়সী একটা চীনা মেয়ে। মেয়েটার বয়স বড় জোর ষোল। এটা যে কী ধরনের হোটেল বুঝতে আর বাকী রইল না আমার। লেইলা খুব শান্ত স্বরে বলল, তুমি আমার ঘরে কি এখুনি আসবে? একটু অস্বস্তি বোধ করলাম। বললাম, না ঠিক এখন নয়। এখন একটু ব্যস্ত আছি।

–আমেরিকান ভদ্রলোকেরা সবসময়ই ব্যস্ত থাকে। ও বলল, তাহলে আজ রাত্রে আসবে তো?

–আমি তোমাকে জানাব।

 মেয়েটা ক্ষেপে গেল।

-এটা কোন কাজের কথা নয়। হয় বল আসবে, না এলে বল আসবে না।

–সে তো ঠিক কথাই। এখন আমার জরুরী কাজ আছে। বলেই আমি প্যাসেজ দিয়ে তাড়াতাড়ি লবিতে চলে এলাম। দেখি সেই ক্লার্ক ধ্যানে রয়েছে।

রাস্তায় এলাম। রিক্সাচালক ছেলে আমাকে দেখে ছুটে এল।

–পুলিশ হেডকোয়ার্টারে চলল। সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা ছুটল। প্রতি মুহূর্তে আমার ভয় করছিল এই বুঝি বিশাল ট্রাক আমাকে চাপা দিয়ে দেবে। গাড়িগুলো কোন গ্রাহ্য না করে যেন গায়ের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল।

অবশেষে হংকং সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনে সশরীরে এসে নামলাম। দেখি অক্ষত অবস্থাতেই আছি।

গেট দিয়ে ঢুকে এক সার্জেন্টকে মোটামুটি কাজের কথাটা বোঝাতে সে একটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অফিস দেখিয়ে দিল। ঘরে চীফ ইন্সপেক্টর বসে আছেন। বয়স্ক, সাদা চুল, বড়সড় মিলিটারী গোঁফ। আমি ওকে আমার পরিচয় দিতে উনি নিজের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোকের নাম ম্যাকার্থী। উচ্চারণ স্কটিশ।

-জেফারসন? শরীরটা হেলিয়ে পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো? কয়েকদিন আগে প্যাসাডোনা সিটি থেকে এই ব্যাপারে একটা খোঁজ চেয়ে পাঠিয়েছিল। আমি নিজে সেটার উত্তর পাঠিয়েছি। লোকটা আপনার কে হয়?

আমি জানালাম আমি ওর বাবা মিঃ জে. উইলবার জেফারসনের হয়ে কাজ করতে এসেছি। আপনি এ ব্যাপারে যা কিছু জানাতে পারবেন তাতেই আমার কাজ হবে। হেরম্যান ও তার স্ত্রী মিস অ্যানের সম্বন্ধে সামান্যতম কোন খবরও আমার কাজে আসতে পারে।

–আপনি বরং আমেরিকান কনস্যুল অফিসে যান। ওরা আপনাকে সাহায্য করতে পারে। পাইপে আগুন দিয়ে সুগন্ধী ধোঁয়া ছেড়ে বলল,আমি ওর ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানিনা। শুধু এটুকুই জানি একটা মোটর দুর্ঘটনায় ও মারা গিয়েছিল। সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন?

–দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটেছিল?

–ভিজে রাস্তায় খুব জোরে গাড়ি চালাচ্ছিল। গাড়ির মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। গাড়িতে আগুনও ধরে গিয়েছিল। আমরা যখন দেখতে পাই তখন আর কিছু করার ছিল না।

-ওর সঙ্গে কেউ ছিল কি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

না।

–ও কোথায় যাচ্ছিল?

 ম্যাকার্থী চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল।

-তা জানি না। দুর্ঘটনা ঘটেছিল কউলুন থেকে মাইল পাঁচেক দূরে, নিউটেরিটোরীতে। কাজেই ও যেখানে খুশী যেতে পারত।

–ওকে কে সনাক্ত করেছিল?

একটু নড়ে বসল। মনে হল কষ্ট করে ধৈর্য রাখার চেষ্টা করছে।

-ওর স্ত্রী।

–লোকটার এখানে কিভাবে চলত? মানে ও কী করত বলতে পারেন?

–সেটা আমার পক্ষে বলা সম্ভবনয়। এখানে কেউ নিজে থেকে গণ্ডগোল না পাকালে আমরা তার পেছনে লাগিনা। জেফারসন সেরকম কোন গণ্ডগোল করত না। আর যতটুকু জানি তাতে তাকে সুনাগরিক বলা যায় না। ওর খ্রীঅনৈতিক উপায়ে…মানে বুঝতেই পারছেন, যা রোজগার করত তাতেই ওদের চলত। আর পুলিশ এতে হস্তক্ষেপ করত না। কারণ একদম নিরুপায় ছাড়া আমরা আমেরিকান নাগরিকদের পেছনে লাগিনা।

–যদি দয়া করে মেয়েটার সম্বন্ধে কিছু বলেন।

— একমুখ ধোয়া ছেড়ে বিরক্ত মুখে বলল, সত্যি কথা বলতে কি মেয়েটা ছিল একটা গনিকা। আসল কথা কি জানেন এই রিফিউজি মেয়েগুলো এখানে এসে পেটের ভাতের রোজগার করতে এই আদিম এবং সহজতম বৃত্তিটাই বেছে নেয়। আমরা আস্তে আস্তে এটা কমাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু কাজটা কি অত সহজ?

–মেয়েটা কেন খুন হয়েছিল, সে ব্যাপারে খোঁজখবর করতে এসেছি।

ম্যাকার্থী মাথা নেড়ে বলল, এ ব্যাপারে আমি আপনাকে কোন সাহায্য করতে পারবোনা। সামনে একগাদা ফাইলের দিকে চেয়ে বলল, আমি যা জানাবার মিঃ রেটনিককে জানিয়ে দিয়েছি। নতুন করে আপাততঃ আমার কিছু জানানোর নেই।

আমি উঠে দাঁড়ালাম।

-ঠিক আছে ধন্যবাদ। একটু ঘুরে দেখি কিছু জানতে পারি কিনা।

–দেখুন, তবে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।

সামনের কাগজগুলো নিজের দিকে টেনে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করল।

যদি আমার কিছু করার থাকে। ওর সঙ্গে করমর্দন করে বেরিয়ে এলাম।

কুইন্স রোড এখন বেশ ব্যস্ত। প্রায় সাড়ে ছটা বাজে। এখন আমেরিকান কনস্যুল খোলা পাব কিনা সন্দেহ আছে। নতুন কোন সংবাদ পেতে হলে আমাকে নিজেকেই সবদিক খুঁজে দেখতে হবে। কিন্তু কোন্ জায়গা থেকে শুরু করব, সেটা ঠিক করতে আমার অসুবিধা হচ্ছে।

আধঘন্টার মত শহরটা ঘুরে দেখলাম। এখানকার লোকজন, আবহাওয়া খানিকটা ভাল লেগে গেল আমার। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম কিছু পান করা যাক।

ওয়াঞ্চাই বেলাভূমির বিশাল এলাকা জুড়ে ছোট ছোট বার। আমি একটা বড়সড় বার দেখে ঢুকে পড়লাম। বক্স-এ খুব হৈ-চৈ গানের বাজনা বাজছে। অনেক আমেরিকান খালাসী এখানে, বীয়ার খাচ্ছে। চীনারা নিজেদের ব্যবসা সংক্রান্ত কথাবার্তা বলছে। লম্বা একটা বেঞ্চে একগাদা চীনা মেয়ে নিজেদের মধ্যে কলকল করে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে খুব জোরে হেসে উঠছে। ওয়েটার এল। আমি স্কটআর কোক-এর অর্ডার দিলাম। ছেলেটা সেগুলো দিয়ে যেতেই দেখি আমার সামনের চেয়ারে কোণা থেকে একটা মাঝবয়সী চীনা মহিলা এসে বসল।

–শুভসন্ধ্যা। আমার শরীরটা তীক্ষ্ণ চোখ দিয়ে একবার দেখে নিয়ে বলল, আপনি কি এই প্রথম হংকং-এ বেড়াতে এসেছেন?

-হ্যাঁ। আমি বললাম।

—আমি যদি আপনাকে সঙ্গ দিই, কিছু মনে করবেন?

–মোটই না। আপনার জন্যে কি পানীয় নোব বলুন।

–শুধু একগ্লাস দুধ। মহিলাটি হেসে বলল।

 আমি ওয়েটারকে হাতের ইশারায় ডাকতে ও যেন বুঝে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক গ্লাস দুধ দিয়ে গেল।

–এখানকার খাবার খুব ভাল, খিদে পেলে খেয়ে নিতে পারেন। দুধে চুমুক দিল।

না, এত তাড়াতাড়ি আমি খাইনা। আপনি দুধ ছাড়া অন্য কিছু কড়া পানীয় খাবেন না?

না। আপনি কি সেস্টারে উঠেছেন? ওটাই এখানকার সবচেয়ে ভাল হোটেল।

-হ্যাঁ। সেরকমই তো শুনেছি। আমার দিকে খানিকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনার কোন সুন্দরী মেয়ে লাগবে না। আমার হাতে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে। ওদের সুন্দর ফিগার। আপনি বললেই আমি একটা ফোন করে দেব ওরা এখানে চলে আসবে আপনার যাকে পছন্দ হবে বলে দেবেন, আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।

ধন্যবাদ। আমার এখন দরকার নেই। আচ্ছা এই মেয়েদের জোগাড় করতে আপনার অসুবিধা হয়না?

মহিলা হাসল। অসুবিধা? হয়, তবে মেয়ে জোগাড় করতে নয়। এখানে অনেক মেয়ে আছে যারা অল্প পয়সার বিনিময়ে পুরুষদের মনোরঞ্জন করে থাকে।

সেলেশিয়াল হোটেল থেকে এই বার এর দূরত্ব কয়েকশো গজ। খুব সঙ্গত কারণেই আমার মনে হল, এই মহিলাই হয়তো স্থানীয় গনিকাদের নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং জো-অ্যানকে চিনতে পারে। বললাম, আমার এক বন্ধু গত বছর এখানে এসেছিল। একটা মেয়েকে তার খুব ভালো, লেগেছিল। তার নাম জো-অ্যান। তার সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছে আছে। আপনি তাকে চেনেন?

কয়েক মুহূর্ত চেয়ে একটা অবাক হবার ছাপ দেখলাম। তারপর টেবিলে টোকা মেরে বলল, চিনি। নিশ্চয়ই চিনি। আপনি বলেন তো এখুনি টেলিফোন করতে পারি। ওকে আপনার পছন্দ হবেই।

আমি আমার অবাক হবার ছাপ লুকোতে চেষ্টা করে বললাম, হ্যাঁ, টেলিফোন করুন না।

–আমার মেয়েদের মধ্যে ও সবচেয়ে সুন্দরী। তবে ও বাড়িতে ওর মা বাবার সঙ্গে থাকে। তাই ওর সঙ্গে একটা হোটেলে যেতে হবে। আপনি ওর জন্যে তিরিশ হংকং ডলার, ঘরের জন্যে দশ হংকং ডলার আর, একটু হেসে বলল, আমার জন্যে মাত্র তিন হংকং ডলার দিন।

–ঠিক আছে। তারপর হেসে বললাম, আমি কি করে বুঝবো যে এই মেয়েটি জো-অ্যান। ওতো অন্য কেউ হতে পারে?

আমাকে খুব নিবিষ্টভাবে দেখে বলল, আপনি তামাশা করছেন? ওতো জো-অ্যান। তাছাড়া আর কে হবে?

–ঠিকই তো। আমি তামাশা করছিলাম।

আমি একটা টেলিফোন করে আসি। দেখলাম মহিলা কাউন্টারের পাশে যেখানে টেলিফোন থাকে, সেখান থেকে ফোন করছিল।

ইতিমধ্যে একজন আমেরিকান খালাসী এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। ও হাত সরিয়ে চুপ করতে বলল। লোকটা আমাকে দেখে চোখ টিপল, আমিও পাল্টা চোখ টিপলাম। মহিলা রিসিভার রেখে দিল। বার-এর সকলে বুঝল আমি একটা মেয়ে বুক করলাম। এটা এখানে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা আর সকলেই এতে খুশী। মহিলাটি আমার কাছে এসে বলল, দশ মিনিটের মধ্যে ও আসছে। ও এলে আপনাকে জানিয়ে দেব।

মিনিট পনের পরবার-এর দরজা খুলে একটা চীনা মেয়ে ঢুকল। বেশ লম্বা, স্বাস্থ্য ভাল। পরনে কালো-সাদা ডোরা ইউরোপীয়ান পোষাক। লাল ফিতের হ্যান্ডব্যাগ। মেয়েটা খুবই আকর্ষণীয়। মেয়েটা চীনা মহিলার দিকে তাকাতে সে চোখ দিয়ে আমাকে দেখিয়ে দিল। ও আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে এল। খালাসীগুলো সিটি মারল। ও বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে ওদের দিকে হাসি ছুঁড়ে দিয়ে আমার কাছে এসে বসল।

–হ্যালো। তোমার নাম কি?

নেলসন। তোমার নাম?

–জো-অ্যান।

-জো-অ্যান কি? আমি বললাম। মেয়েটা টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে নিয়ে বলল, কী আবার। জো-অ্যান শুধু।

–উয়ং-চিয়াং নয়?

 মেয়েটা চট করে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, হ্যাঁ ওটাই আমার নাম। তুমি জানলে কি করে?

ও মিথ্যে কথা বলছে বুঝেও বললাম, গতবছর আমার এক বন্ধু এখানে এসেছিল, সে তোমার কথা খুব বলেছে।

–আমি খুব খুশী। বলে মেয়েটা তার ঠোঁটের মাঝখানে সিগারেটটা রাখল। আমি আগুন। দিলাম। ধোঁয়া ছেড়ে বলল, আমাকে তোমার পছন্দ?

নিশ্চয়ই।

চল তাহলে আমরা যাই।

 চল।

 –আমাকে তিন ডলার দাও, মাদামকে দিতে হবে।

আমি ওকে তিন ডলার দিলাম। সেই মহিলা আমাদের এতক্ষণ লক্ষ্য করছিল। টেবিলের কাছে এসে বলল, ওকে পেয়ে খুশী হয়েছেন তো?

নিশ্চয়ই। কে না হত?

ওর কাছ থেকে তিন ডলার নিয়ে বলল, আবার আসবেন। আমাকে এখানেই পাবেন।

মেয়েটা আগে আগে। আমি পেছনে যাওয়ার সময় খালাসীগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালাম। ওদের একজন আঙুল দিয়ে একটা বাজে ইঙ্গিত করল। সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

–আমি একটা পরিষ্কার হোটেল জানি। ও বলল।

–আমিও জানি। চলো সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেলে আমি থাকি, সেখানে চলল। আমি বললাম।

–আমার হোটেলটা আরও ভাল।

–ঠিক আছে, আমারটাতেই চলোনা। বলে ওর কনুই ধরে কোলাহলমুখর রাস্তায় ঠেলে দিলাম। আমার হোটেলের দিকে হাঁটা দিলাম।

মেয়েটা গায়ে গা ঠেকিয়ে চলতে লাগল। ওর চোখে-মুখে চিন্তার ছাপ, দৃষ্টিটা উদাসীন। গায়ে দামী পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। হোটেলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় ও পেশাদারী কায়দায় ওর নিতম্ব দোলাচ্ছিল। আমার চোখ যেন বেশী করে সেদিকেই চলে যাচ্ছিল।

বৃদ্ধ রিসেপশন ক্লার্ক আমাদের চোখ চেয়ে একবার দেখে আবার ঝিমোতে লাগল। প্যাসেজ দিয়ে এগোতেই দেখি লেইলা ওর ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নেলপালিশ লাগাচ্ছে। আমি ওকে অবজ্ঞা করে দরজা খুলে মেয়েটাকে ঢুকিয়ে হুড়কো দিলাম। মেয়েটা ঢুকেই আমাকে বলল, তুমি যদি আমাকে পঞ্চাশ ডলার দাও, তবে আমি তোমাকে খুব ভালভাবে আনন্দ দেব।

মেয়েটা ওর ফ্রকের চেন খুলে ফেলল। আমি বাধা দেবার আগেই ওর দেহের উৰ্দ্ধাংশের পোষাক খুলে ফেলল।

–একটু আরাম কর। আমার তাড়াহুড়োকিছু নেই। পকেট থেকে ম্যানিব্যাগ বার করতে করতে বুলোম। আমি জো-অ্যানের ফটোটা বের করে ওকে দিলাম। ওর ফর্সা, গোলগাল মুখে হতবুদ্ধি ফুটে উঠল। তারপর চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এটা কি?

–জো-অ্যান-উইং-চিয়াং এর ফটো। ও আস্তে আস্তে উঠে জামাকাপড় পড়ে বিরক্তি ভরে বলল, আমি কি করে জানব যে তোমার কাছে ফটো আছে। মাদাম তত বলল, ওকে কেমন দেখতে তুমি নাকি ওকে চেনো।

–তুমি একে চেন?

–বিছানায় ওর ভারী নিতম্ব পেতে বসল।

না আমি চিনি না। অধৈর্ধের স্বরে বলল, তুমি কি আমায় টাকাটা দেবে?

আমি পাঁচটা দশ ডলারের মোট ওকে দেখিয়ে বললাম, মেয়েটা একটা আমেরিকান ছেলেকে বিয়ে করেছিল, তার নাম হেরম্যান জেফারসন। হেরম্যানকে তুমি চিনতে?

একটু হেসে মেয়েটা বলল, হ্যাঁ একবার ওর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তারপর আবার জো-অ্যানের ফটোটার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু একে এমন দেখাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে,ও মরে গেছে?

–হ্যাঁ। ঠিকই ধরেছে। ও মারা…যেন ওর হাতে কিছু কামড়ে দিল। তাড়াতাড়ি ফটোটা। ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মরা লোকের ছবি দেখলে দিন খারাপ যায়। আমার টাকাটা দিয়ে দিলে চলে যেতাম।

আমি তখন হেরম্যানের ফটোটা ওর মুখের সামনে ধরে বললাম, এটাই তো ওর স্বামীর ফটো?

মেয়েটা এক ঝলক ফটোটা দেখে বলল, না, আমার ভুল হয়েছে। আমি একে কখনও দেখিনি। আমার টাকাটা দিলে চলে যাই।

 দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ফালতু সময় নষ্ট হচ্ছে। ও আমাকে কিছু বলবে না। ওকে টাকাগুলো দিয়ে দিলাম। ও ব্যাগে টাকাগুলো রাখতে রাখতে বলল, আমি ওর সম্বন্ধে কিছু জানিনা। টাকাটার জন্যে ধন্যবাদ। দরজার হুড়কো খুলে ও বেরিয়ে গেল।

ভাবলাম ফালতু টাকাটা গেল। আবার অন্য জায়গায় খোঁজ করতে হবে। আমার নিজের টাকা হলে কষ্টটা আরো বেশী হতো। যেহেতু জেফারসনের টাকা খরচ করছি, তাই গায়ে বেশী লাগল না।

.

২.২

 একটু গড়িয়ে উঠে পড়লাম। খিদে পাচ্ছে। ঠিক করলাম বাইরে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি। দরজা খুলতেই দেখি লেইলা আগের পোষাক পরিবর্তন করে উদাস দৃষ্টিতে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল লাল আর সোনালী পোষাক পরেছে। চুলে খোঁপা তাতে ফুলের রিং লাগিয়ে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে।

–মেয়েটাত বেশীক্ষণ থাকল না। ও বলল, কী ব্যাপার। তাছাড়া আমি থাকতে ওকে নিয়ে এলে কোন্ দুঃখে?

একটা কাজের ব্যাপারে শুধু কয়েকটা কথা বলার জন্যে ওকে এখানে এনেছিলাম।

কী কথা? ওর কণ্ঠে সন্দেহ।

–এই এটা-সেটা। ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।

 বেঁটে হলেও ওকে খুব আকর্ষণীয় লাগছে। বললাম, চলো দুজনে কোথাও ডিনার করে আসি।

ওর সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল।

ও তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ঘরে ঢুকে ওর হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে চলে এল। বলল, খুব ভাল কথা। চল তোমাকে আমি একটা ভাল রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাব। আমার খুব খিদে পেয়েছে, আমরা অনেক কিছু খাব কিন্তু তোমার বেশী খরচাও হবেনা। ও প্রায় লাফাতে লাফাতে প্যাসেজ পেরিয়ে সিঁড়ির মুখে চলে এল। রিসেপশন ক্লার্ক রোগা হাতে বেশ তাড়াতাড়ি, একটা ক্যালকুলেটরে হিসাব কষতে ব্যস্ত। বৃদ্ধ আমাদের দিকে তাকালনা।

লেইলা রাস্তা পেরিয়ে একটা ট্যাক্সির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা ফেরি পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি নিয়ে যাব। রেস্তোরাঁটা ওদিকে কউলুন-এ।

ট্যাক্সি করে ফেরিঘাটে এলাম। একটা ভীড় বোটে চাপলাম। সারাক্ষণ লেইলা বকর বকর করে গেল। চীনেরা নাকি মুভি দেখতে ভালবাসে। সত্যিই, আমি দেখলাম একটা শো-হাউসের সামনে ভীষণ ভীড়।

ওপারে পৌঁছে লেইলা আমাকে নাথান রোড ধরে রেস্তোরাঁয় নিয়ে যেতে লাগল। এই হাঁটাতে ওর খিদে বেশ বাড়বে। ফুটপাতের গা বেয়ে অসংখ্য মানুষের ভীড়ে আমার হাঁটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। কউলুনের এই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আমার বিশেষ অভিজ্ঞতা হল। এত বিচিত্র রঙের নিওন আলোর বিজ্ঞাপন আমি কোথাও দেখিনি।

অবশেষে রেস্তোরাঁতে পৌঁছলাম। রেস্তোরাঁর বাইরেটা আলোকিত এবং বেশ ভীড়। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নর্দমার ধারে খেলা করছে।

চল আমরা এখানেই খুব ভাল খাবার পাই। রেস্তোরাঁর দরজা খুলে ধরল লেইলা। সঙ্গে সঙ্গে গমগমে, বেশ উত্তেজিত কিছু চীনা স্ত্রী-পুরুষের গলার আওয়াজ কানে এসে ধাক্কা মারল। কিন্তু যারা খাচ্ছে তাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। প্রত্যেকটা কেবিনের সামনে ভারী পর্দা ঝোলানো। বেশ জোরে একটা গান বাজছে আর সেই সঙ্গে টুংটাং কাপ-ডিসের আওয়াজ।

রেস্তোরাঁর মালিক একটা কেবিনের পর্দা তুলে ধরে লেইলার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমরা ঢুকে যেতে পা নামিয়ে চলে গেল।

লেইলা বেশ আরাম করে বসে বসে বলল, আমি অর্ডার দেব। প্রথমে আমরা চিংড়িমাছ ভাজা খাব, তারপর একটা স্যুপ। তারপর বেগার-চিকেন–এটা এখানে খুব ভাল করে। তারপর দেখব, আর কী খাওয়া যায়। তবে চিংড়িমাছটা আগে খাব।

ওয়েটারকে দ্রুত ক্যান্টনীজ ভাষায় অর্ডার দিয়ে টেবিলে রাখা আমার হাতটা ওর হাতে তুলে নিল।

–আমি আমেরিকান ভদ্রলোকদের খুব ভালবাসি। এদের বেশ পৌরুষ আছে আর বিছানায় এদের আমার ভীষণ ভাল লাগে। তাছাড়া এদের হাতে পয়সাও তো প্রচুর।

–তুমি যা যা বললে তার কোনটাই আমার নেই। পরে কিন্তু হতাশ হতে হবে। তুমি এখানে কতদিন আছো?

–তিন বছর। আমি একটা রিফুইজী, ক্যান্টন থেকে এসেছি। আমার খুড়তুতো ভাইয়ের নৌকো করে ম্যাকাউ গেছি। সেখান থেকে আমি এই হংকং-এ এসেছি।

ওয়েটার আমাদের গরম গরম চীনা মদ এনে দুটো গ্লাসে ঢেলে দিল। ঐ কড়া মদে চুমুক দিতে দিতে বললাম, তুমি বোধহয় জো-অ্যান-উইং-চিয়াংকে চিনতে পার। ঐ মেয়েটাও তো একটা রিফিউজী ছিল।

ও একটু অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ ওকে আমি ভালভাবে চিনি। তুমি ওকে চিনলে কি করে?

না, ওকে আমি চিনিনা।

এই সময়ে ওয়েটার একটা বড় পাত্র করে বড় বড় সোনালী রং-এর চিংড়িমাছ ভাজা দিয়ে গেল। কাঠি দিয়ে একটা চিংড়ি গেঁথে সেটাকে স-এ ডোবাতে ডোবাতে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তুমি ওর নামটা জানলে কি করে?

–আমার দেশের বাড়ির এক বন্ধুর সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। তোমার সঙ্গে ওর কখনও আলাপ হয়েছিল? ওর নাম হেরম্যান জেফারসন। আমি বললাম, একটা চিংড়ি কাঠি দিয়ে তুলতে গিয়ে সেটা টেবিলক্লথের ওপর পড়ে গেল। আবারনড়বড় করতে করতে চেষ্টা করে সেটা গেঁথেসাবধানে মুখে তুললাম। ভীষণ সুস্বাদু।

-হা নিশ্চয়ই। ও খুব চটপট অবিশ্বাস্য দ্রুত হাতে খাচ্ছে।বলল, জো-অ্যান আর আমি একই সঙ্গে ক্যান্টন থেকে পালিয়ে আসি। ওর ভাগ্য ভাল ছিল তাই একজন আমেরিকানকে ও বিয়ে করে যদিও এখন সে মৃত।

ওয়েটার এবার ফ্রায়েড রাইস দিয়ে গেল। ডিম ভাজা, হ্যাঁমের টুকরো, চিংড়ি ভাজা এইসব দিয়ে মেশানো, সুন্দর গন্ধ বেরোচ্ছে। লেইলা খানিকটা ওর পাত্রে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে লাগল। আমি ওর সঙ্গে পেরে উঠছিনা।

–ও কি জো-অ্যানকে নিয়ে তুমি যে হোটেলে আছ সেই হোটেলে থাকত? আমি প্রশ্ন করলাম।

কাঠি দিয়ে রাইস মুখে তুলতে গিয়ে টেবিলে ছড়ালাম।

লেইলা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

ওর প্লেটের চিংড়িভাজা শেষ। ফ্রায়েড রাইস অর্ধেক উদরস্থ হয়েছে। খুব কম সময়ের মধ্যে বেশী খাবার পেটে চালান দেওয়ার কায়দাটা ভালই রপ্ত করেছে।

–বিয়ের পর তিনমাস ওরা আমার পাশের ঘরটায় থাকত। তারপর হেরম্যান চলে যায়। একপাত্র সুন্দর হাঙরের সুপ এলো।

–ও চলে গেল কেন? আমি প্রশ্ন করলাম। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, বোধহয় অ্যানকে আর প্রয়োজন ছিল না তাই।

চামচে করে স্যুপ খেতে খেতে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? ওকে প্রয়োজন ছিল না কেন?

 লেইলা আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, ও তো জোকে বিয়ে করেছিল শুধু ওর পয়সায় খেয়ে পরে থাকার জন্যে।তারপর যখন নিজে রোজগার করতে আরম্ভ করল তখন আর ওকে কি প্রয়োজন?

–মেয়েটা ওকে কিভাবে খাওয়াত পাত? উত্তর কি আসবে জেনেই জিজ্ঞেস করলাম।

কী করে আবার, এই আমার মতো পুরুষদের মনোরঞ্জন করে। খুব শান্তভাবে ও তাকাল। এছাড়া আর আমাদের পয়সা রোজগারের অন্য রাত কোথায়?

তারপরেই পর্দার ফাঁকে ওয়েটারকে দেখা গেল হাতে একটা মাদুর। আর মাদুরটা মেঝেতে বিছিয়ে একটা বড় পাত্রে বিশাল আকারের উটপাখীর ডিমের মত কিছু একটা এনে সেটা মাদুরে রাখল।

এবার লেইলা আমাকে বোঝাতে লাগল, প্রথমে মুরগীটাকে নানারকমের মশলা মাখিয়ে পদ্মপাতায় জড়িয়ে, তার চারপাশে মাটি লেপে সেটাকে পাঁচঘণ্টা ধরে পোড়ানো হয়।

জিনিষটা যে কি, আমার বোধগম্য হল। ওয়েটার ছেলেটা একটা হাতুড়ি দিয়ে ডিমটা ফাটাতেই তার ভেতর থেকে সুগন্ধীযুক্ত পদ্মপাতা জড়ানো মুরগীটা বেরোল। ছেলেটা তাড়াতাড়ি পদ্মপাতা ছাড়িয়ে মাংসটা সেই পাত্রে রাখল। মাংসটা এত ভাল তৈরী হয়েছে যে হাড় থেকে মাংসটা আপনা-আপনি ছেড়ে গেল। ছেলেটা মাংসগুলো আমাদের পাত্রে যত্নের সঙ্গে চামচে করে তুলে দিল।

লেইলার কাঠি আবার দ্রুতবেগে ওঠানামা করতে লাগল। আমি খেতে থাকলাম। এত সুস্বাদু খাবার আমি আগে কখনও খাইনি। ও খানিকটা মাংস মুখে পুরে বলল, এই হল বেগার চিকেন।

আমি ওর খাওয়া শেষ না হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভাবলাম এখন ওকে প্রশ্ন করে ওর খাওয়ার মনোসংযোগ নষ্ট করা।

আমি ততক্ষণে হাত গুটিয়ে নিয়েছি। ও আবার মাশরুম, বাঁশের কোঁড়কের তরকারী আর জলপাই কেকের অর্ডার দিল। আমি সিগারেট ধরিয়ে আরও মিনিট কুড়ি ধরে ওর খাওয়া দেখছিলাম। অবশেষে ওর চোখে-মুখে তৃপ্তির ছাপ দেখতে পেলাম। এই পরিমাণ খেয়েও যে এত সুন্দর ফিগার রাখতে পারে, সত্যিই তাকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়।

ও আমার থেকে একটা সিগারেট চেয়ে দুটো ঠোঁটের মাঝখানে রাখল আর আমি ওটা ধরিয়ে দিলাম। ও একমুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, চুল এবার আমরা হোটেলে ফিরে যাই। ওখানে আমরা একটু ভালবাসাবাসি করব। ওর হাসিতে কামনার স্পষ্ট আমন্ত্রণ। ও বলল, এই সুন্দর খাওয়া দাওয়া করার পর ওটাই ভাল লাগবে।

আমি বললাম, এই তো সবে সন্ধ্যে, এখন তো সারারাত পড়ে আছে, তাই না! তুমি বরং হেরম্যান আর অ্যানের সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলো। তুমি বলছিলে অ্যানকে বিয়ে করার পর হেরম্যান রোজগার করত। ও কী করত?

লেইলার মুখ দেখে বোঝা গেল, হেরম্যানকে নিয়ে আলোচনায় ও বিরক্তিবোধ করছে।

–সে আমি জানি না। একদিন দেখলাম ও ঘরে বসে একা একা কাঁদছে। জিজ্ঞেস করায় ও বলল, হেরম্যান ওকে ছেড়ে চলে গেছে। এখন ও নিজে রোজগার করছে সুতরাং জো-কে আর দরকার নেই।

-রোজগারটা কীভাবে করত? সে সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

–কেন বলবে? তাছাড়া আমার জানারই বা কি দরকার?

–হেরম্যান কি আবার ফিরে এসেছিল?

 –ঐ মাঝে মাঝে এসে রাত কাটিয়ে চলে যেত। লেইলা মুখে একটা ভঙ্গী করে বলল।

ও চলে যাবার পর অ্যান কি করত?

কী আবার করবে। আগে যা করত তাই! ভদ্রলোকদের মনোরঞ্জন। তাছাড়া আর কী? পেটের জন্যে তো পয়সা দরকার?

-কেন? ও যখন হেরম্যানের স্ত্রী ছিল, তখন হেরম্যান যা রোজগার করত, তার কিছু তো দিত?

কিছু দিত না।

–জো-অ্যানকে ছেড়ে যাবার পর হেরম্যান কোথায় থাকত? তুমি জান?

-রিপালস্ উপসাগরের তীরে এক চীনা জুয়াড়ীর বিরাট অট্টালিকা ভাড়া নিয়েছিল। জায়গাটা আমি দেখেছি। খুব সুন্দর, বড় বাড়ি দুধের মত সাদা রঙ। একটা ছোট ঘাট ও বোট ছিল।

–জো কি সেখানে কখনও গিয়েছিল?

না, না। হেরম্যান ওকে কখনও যেতে বলেনি। ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল। খাবারের দাম অবিশ্বাস্য রকমের সত্ত্বা। আমি দাম মেটালাম। লেইলা সুখী-সুখী মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খুশী হয়েছে তো?

হু-উ। খুব। খাবারগুলো ভাল। আমি বললাম।

চল হোটেলে গিয়ে আমরা একটু আরাম করি।

হংকং-এর আবহাওয়াটাই এমনি। না চাইতেই এরা সব দিয়ে বসে থাকে। তাছাড়া আমি কখনও চীনা মেয়েকে নিয়ে শুইনি। মনে হল, অভিজ্ঞতা হলে কেমন হয়!

-ঠিক আছে। চলো হোটেলেই ফেরা যাক!

বেরিয়ে ব্যস্ত রাস্তায় নামলাম। চারিদিকে অন্ধকার নেমেছে। নাথান রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে ও বলল, তুমি আমাকে নিশ্চয়ই একটা উপহার দেবে?

আমার একটা হাত ওর দুহাতে জড়িয়ে ধরে একটা নিশ্চিন্ত হাসি হেসে লেইলা বলল।

নিশ্চয়ই, এই কথাটা আমিই তোমাকে বলব বলে ভাবছিলাম। তা বল কি নেবে?

–চল আমি দেখাব।

একটু এগিয়ে একটা বাজারে এসে পৌঁছলাম। সবকটা দোকান আলো দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। প্রত্যেক দোকানেই হাসিখুশি সেলসম্যান দাঁড়িয়ে।

আমি একটা আংটি কিনব, যেটা দেখলেই তোমার কথা মনে পড়বে। খুব দামী কিছু চাই না।

আমরা একটা জুয়েলারী দোকানে গেলাম। লেইলা একটা জেড-এরনকল আংটি পছন্দ করল। দশ মিনিট দর কষাকষির পরে লেইলা ওটা চল্লিশ হংকং ডলার থেকে পঁচিশ হংকং ডলারে রফা করল। আমি দাম দিয়ে দিলাম। তারপর আমরা হোটেলে ফিরে যাওয়া মনস্থ করলাম।

ফেরি পেরিয়ে এসে হাত তুলে যখন একটা ট্যাক্সি ডাকছিলাম, ঠিক সেই সময় লেইলা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল। আমি ট্যাক্সি ডাকতে ট্যাক্সিটা যেই আমাদের পাশে এল, দেখি তিনটে গাঁট্টাগোট্টা চীনা ছেলে কালো স্যুট পরা আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর ড্রাইভারের সঙ্গে কিছু কথা বলে আমার কাছে ভুল ইংরাজীতে মাফ চাইল, যেন আমি ট্যাক্সিটা ডেকেছি ওরা বুঝতে পারেনি। তারপর ওরা অন্য একটা ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে গেল। তারপর আমার পাশে যখন তাকালাম, দেখি লেইলা নেই। চারিদিকে তাকালাম। কোথাও নেই।

.

২.৩

 মিনিট পনের এদিক-সেদিক খুঁজলাম। ফেরিঘাটে গেলাম, ওখানেও লেইলা নেই। আমার ভেতরে একটা ভয় ঘুরপাক খেতে লাগল। ট্যাক্সি ডেকে হোটেলে ফিরলাম।

রিসেপশনে সেই বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম, লেইলা ফিরেছে?

কোনরকমে একটা চোখ খুলে বলল, নো স্পিক ইংলিশ। আবার চোখ বুজল। আমি ঘরে এলাম। লেইলার ঘরের দরজার হাতল ঘুরিয়ে ওর ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দেখলাম, লেইলা কোথাও নেই।

আমার ঘরে ফিরে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভীষণ গরম আর দমচাপা ভাব নিয়ে জেগে উঠলাম। সূর্যের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে। ঘড়ি দেখলাম। আটটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। তারপরেই গেলাম লেইলার ঘরের দিকে। ফাঁকা ঘর। একটা শিরশিরে ভয় আমার মেরুদণ্ড বেয়ে উঠতে লাগলো। আমার মনে হল, ও আমাকে ছেড়ে স্বেচ্ছায় পালিয়ে যায়নি ওকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ওর যে খারাপ কিছু ঘটেছে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। অনুমান করলাম, কেউ হয়তো জানতে পেরেছে যে লেইলা আমাকে অনেক কিছু বলে দিচ্ছিল।

মনে মনে স্থির করলাম এখন কী করা উচিত। পরিষ্কার একসেট জামাপ্যান্ট পরে দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ির কাছে এলাম। একটা চীনা ছেলে, সম্ভবতঃ ঐ বৃদ্ধের নাতি কাউন্টারেসে আছে।

লেইলা গতকাল রাত্রে ওর ঘরে ফেরেনি। বলতেই ছেলেটা কেমন বিব্রত বোধ করে মাথা নোয়াল। সম্ভবতঃ কিছু বোঝেনি।

নীচে এসে একটা ট্যাক্সি ডেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার-এ এলাম।

সৌভাগ্যক্রমে ম্যাকার্থীকে পেয়ে গেলাম। দেখি ও গাড়ি থেকে নামছে। ও আমাকে পুলিশ ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। দু-মগ কড়া চা নেওয়া হল। আমি ওকে গতরাতের পুরো ঘটনাটা বললাম।

ও ব্যাপারটাকে কোন পাত্তাই দিলনা। ওর ঠাণ্ডা চাউনি এবং এটা কোন ব্যাপারই নয় ধরণের মুখভঙ্গি আমার রক্তচাপ বাড়িয়ে দিল।

–কিন্তু মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। এতে কোন ভুল নেই। এক সময় আমার পাশে ছিল, হঠাৎ দেখি নেই। আর হোটেলেও ফিরে আসেনি। আমার চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করলাম। ও ওর পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বলল, একটা কথা বলি শুনুন, এ নিয়ে এত মাথা ঘামাবেন না। গত পনের বছর এখানে এই মেয়েগুলোকে নিয়ে কাজ করছি। ওরা আজ এখানে কাল সেখানে। হয়তো আপনার চেয়ে শাঁসালো পাটি দেখে কেটে পড়েছে।

আমি আরও কিছুটা চা খেয়ে অসহায়ের মতো বললাম, কিন্তু আমার ব্যাপারটা আলাদা। হোটেলে ফেরার সময় ও আমাকে কতকগুলো কথা বলছিল।ওকে মনে হয় কিডন্যাপকরা হয়েছে।

কী কথা বলছিল? ম্যাকার্থী জিজ্ঞেস করল।

–আমি একটা খুনের কিনারা করার চেষ্টা করছিলাম। ও আমাকে অনেকগুলো খবর দিচ্ছিল।

ম্যাকার্থী তখন একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, যে লোকটা আমেরিকায় খুন হয়েছে, সে ব্যাপারে ও এখানে আপনাকে কি খবর দেবে?

ও আমাকে বলছিল, হেরম্যান জেফারসন রিপালস্ উপদ্বীপের কিনারায় একটা অট্টালিকা ভাড়া নিয়েছিল।ও নাকি বিয়ের তিনমাস পর থেকে অনেক পয়সা রোজগার করছিল আর এজন্য ওর স্ত্রী জো-অ্যানকে ছেড়ে চলে যায়।

ম্যাকার্থী হেসে বলল, আপনাকে কি বলব বলুন তো? একটা বেশ্যা কি বলল, আর আপনি সেটা বিশ্বাস করছেন?

বুঝলাম। কিন্তু রাত্রে শুধু শুধু ও আমাকে বোকা বানাচ্ছিল?

–একটা বেশ্যার কাজই তো রাত্রে বাইরে কাটানো। ম্যাকার্থীর সোজা জবাব।

 –আপনার এমন আমেরিকানদের জানা আছে কি যারা রিপালস্ উপদ্বীপে থাকে?

বেশ কয়েকজন।

–আপনি একটু খবর নেবেন, ওখানে হেরম্যান কোন বাড়িভাড়া নিয়েছিল কিনা।

নেয় নি, নিলে জানতে পারতাম।

–তাহলে মেয়েটা আমাকে ধাপ্পা দিচ্ছিল?

–ঠিক তাই। আর সেটাই আমার বক্তব্য, আমি আর শুধু শুধু সময় নষ্ট না করে উঠে পড়লাম। বললাম, ধন্যবাদ, আমি আবার আসব।

–আপনাকে সাহায্য করতে পারলে খুশী হব।

একটা ট্যাক্সি ডেকে হোটেলে ফিরে দেখি সেই বৃদ্ধ আবার নিজের জায়গায় এসে গেছে। আমাকে দেখে মাথা নামিয়ে নিল। কিন্তু আমার ওর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলার ইচ্ছে হল। কিন্তু ও যে ইংরেজী বোঝে না। আমার এয়ারপোর্টের সেই ইংরেজী বলিয়ে ওয়ং-এর কথা মনে পড়ল। ও নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আর ওর কার্ডটা আমার কাছে আছে।

আমার ঘরে এলাম। লেইলার ঘরের দরজার হাতল ঘুরিয়ে ধাক্কা মারলাম। তালা দেওয়া। টোকা মেরে কান পেতে কোন শব্দ পেলাম না। নিজের ঘরে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

দরজায় আস্তে টোকা মারার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল, ঘড়িতে দশটা বেজে কয়েক মিনিট। দরজা খুললাম। সেই চীনা ছেলেটা দুর্বোধ্য কিছু একটা বলে প্যাসেজ দেখাল। আমি ওকে অনুসরণ করে রিসেপশন কাউন্টারে এলাম। ম্যাকার্থী আমাকে ফোন করেছে।

ম্যাকার্থী অপর প্রান্ত থেকে বলল, আপনি যে মেয়েটার কথা বলেছিলেন, তাকে আপনি জেড পাথরের একটা আংটি কিনে দিয়েছিলেন, তাইতো সকালে বললেন? আমার হাত পা শক্ত হয়ে উঠল।

–হ্যাঁ একটা নকল জেডের। আমি বললাম।

–আপনি শিগগীর একটা ট্যাক্সি নিয়ে চ্যাথাম রোড পুলিশ স্টেশনে চলে আসুন। জায়গাটা কউলুন-এ। ওরা একটা মেয়ের কথা বলছে, তার হাতে জেডের আংটি রয়েছে।

–ওকি মারা গেছে? আমি প্রশ্ন করলাম।

-হ্যাঁ, ওর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ওখানে সার্জেন্ট হ্যামিশের সঙ্গে দেখা করে ওকে সনাক্ত করতে পারেন।

উনিও কি স্কটিশ? আমি কৌতূহলবশতঃ জিজ্ঞেস করলাম।

–ঠিকই ধরেছেন, এখানে পুলিশ ফোর্সে প্রচুর স্কটিশ আছে।

হু, স্কটল্যান্ডবাসীদের জন্যে এটা একটা সুখবর।

মিনিট চল্লিশ বাদে চ্যাথাম রোড পুলিশ স্টেশনে পৌঁছলাম। লবিতে ফ্রেমে বাঁধানো একগাদা মর্গে তোলা চীনা স্ত্রী-পুরুষের ফটো। নীচে ইংরেজী আর চীনা ভাষায় এদের সনাক্ত করার আবেদন।

ঢোকার মুখে একজন যুবক সার্জেন্ট, মুখ শক্ত, টানটান, মাথায় ঢেউ খেলানো চুল। বসে ফাইলে কিছু কাজ করছে। ইনিই সার্জেন্ট হ্যামিশ। আমি নিজের পরিচয় দিয়ে লাশটা দেখতে চাইলাম।

ক্ষয়ে যাওয়া কম দামী পাইপে তামাক ভরতে ভরতে, আমার কথায় কোন আগ্রহ প্রকাশ না করে বলল, হ্যাঁ, কাল রাত দুটো নাগাদ প্রণালী থেকে একটা ফেরি স্টীমার ওর লাশটা দেখতে পায়। শরীরে বিশেষ কিছুই নেই।

সার্জেন্ট উঠে দাঁড়াল।

তারপর সার্জেন্ট গল্পচ্ছলে বলল, এই লোকগুলো সবসময় নিজেদের মারছে। রোজ অন্ততঃ আধডজন করে এদের লাশ পাচ্ছি। চীনারা মনে হয় নিজেদের জীবন নিয়ে একদম চিন্তা করেনা।

প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে মর্গের উঠোনে পড়লাম। ভেতরে দেখি বেশ কয়েকটা লাশ ঢাকা দেওয়া তার মধ্যে একটা লাশের রবারের চাদরের কোণা তুলে হাতড়ে-হাতড়ে একটা ফ্যাকাসে হাত বের করল। হাতের আঙুলে নকল জেডের একটা আংটি।

সার্জেন্ট হ্যামিশ খানিকটা হাল্কা গলায় বলল, ব্রেকফাস্টে শুধু ডিম আর বেকন খেয়েছি। এখন আপনি যদি এই আংটি দেখে সনাক্ত করতে পারেন, তবে এই সময়ে দৌড়ঝাঁপ-এর হাত থেকে বেঁচে যাব।

আমি আংটিটা আর ছোট পাতলা হাতটা দেখে বললাম, হ্যাঁ এই সেই আংটি।

সার্জেন্ট হাতটা চাদরের নীচে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল, ধন্যবাদ,আমি চীফ ইন্সপেকটরকে জানিয়ে দেব।

আমি একটু এগিয়ে গিয়ে চাদরটা তুলে লেইলারশরীরের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল দেখলাম। ভীষণ কষ্ট অনুভব করলাম। ওকে বিদায় জানালাম।

কালকের রাতের ঘটনা সব মনে পড়তে লাগল। ওর সঙ্গে আলাপ আমার বেশীক্ষণের নয়, কিন্তু ওর ব্যক্তিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার মনে হল, আমি প্রিয় এবং প্রয়োজনীয় একজনকে হারালাম।

ফেরি পার হবার পর দেখি আমার জন্যে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দা মিঃ ম্যাকফারসন অপেক্ষা করছে। আমরা জীপে চড়ে হোটেলে এলাম। জড়ানো চীনা ভাষায় রিসেপশন্ ক্লার্ককে কিছু বুঝিয়ে লেইলার ঘরের চাবি নিল।

ম্যাকফারসন চাবি দিয়ে লেইলার ঘর খুলে ভেতরে ঢুকে পেশাদারী চোখে সব কিছু দেখতে লাগল। কাপবোর্ডে তিনটে জামা আর ড্রয়ারের ওপর একসেট অন্তর্বাস পড়ে আছে। আমি প্যাসেজে দাঁড়িয়ে লেইলার সম্পত্তি দেখতে লাগলাম।

কাপবোর্ডের তলায় উঁকি মেরে কুঁজো হয়ে আঙুল ঢুকিয়ে খুব সাবধানে একটা টিনের পাতলা টুকরো বের করে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, যা ভেবেছিতাই। জানো এটা কি? টিনের চাকতিটা দেখিয়ে আমাকে সার্জেন্ট জিজ্ঞেস করল।

-না, আপনি বলুন। আমি বললাম।

সে আবার কুঁজো হয়ে কাপবোর্ডের তলা থেকে একটা আধপোড়া মোমবাতি বের করে চাকতিটা এক হাতে ধরে বলল, মেয়েটার হেরোইনের নেশা ছিল। এই নেশাতেই সপ্তাহে গড়ে আধডজন মারা যায়।

আপনি এত নিশ্চিত হয়ে বলছেন কি করে?

এই দুটো জিনিষ কারোর কাছে থাকলেই বুঝবেন হেরোইনের নেশা আছে। ম্যাকফারসন বলে চলল, কিভাবে নেশা করে জানেন? এই চাকতিটায় হেরোইন রেখে তলায় মোমবাতি ধরে যে ধোঁয়াটা হয়, সেটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে টানে। আমাদের গভর্নমেন্টের সবচেয়ে বোকামীর কাজ হল আফিম খাওয়া বন্ধ করা। আরে বাবা, এইভাবে যারা আফিম খেত তাদের একটা ঘর, একটা বিছানা, আর খরচসাপেক্ষ সাজ-সরঞ্জাম লাগত। আমরা তাড়া করলে অনেকে ভয়ে পাইপ ভেঙে ফেলত। পরে আবার একটা কেনাও কষ্টসাধ্য ছিল। আমরা ভাবলাম আইন করে নেশা কমাব, আর এই নেশাখোরগুলো দেখল আফিমের বদলে হেরোইনের নেশায় একটা চাকতি আর মোমবাতি হলেই চলবে। এখন যে কোন জায়গায় বাসে, ট্রামে, সিনেমা হলে যেখানে ইচ্ছে এই বিষ টানতে পারে। একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন এমন-এমন জায়গা যেখানে আপনি ভাবতেও পারেন না, সেইসব জায়গায় হঠাৎ মোমবাতি জ্বলে উঠল। বুঝবেন ওখানে হেরোইন টানা হচ্ছে। আফিম বন্ধ না করলে এই নেশাখোরগুলোকে হেরোইন খেয়ে মরতে হতো না।

আমি চোয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, আপনার এই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার জন্যে। ধন্যবাদ। তবে আমি বিশ্বাস করিনা ও আত্মহত্যা করেছে, আমার দৃঢ় ধারণা ওকে খুন করা হয়েছে এবং পরিকল্পনামাফিক ঐ দুটো জিনিষ আপনাকে ধোঁকা দেবার জন্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

ম্যাকফারসনের মুখের কোন ভাবান্তর হলনা। খানিকটা আমুদে গলায় বলল, চীফ বলছিলেন, আপনি একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আমি chandler পড়েছি, Hammet-ও পড়েছি। ওগুলো সব ফিকসন, এটা বাস্তব।

–ভাল কথা। আপনি যা বোঝেন সেটাই ঠিক।

খুব নিরাসক্ত গলায় ও আমাকে প্রশ্ন করল, ওকে যে খুন করা হয়েছে, এটা আপনি কেন মনে করেছেন?

–সেটা আপনাকে বোঝান আমার কম্ম নয়। যা ওর জিনিষপত্রগুলো কি করবেন? আমি বললাম।

–পুলিশ স্টেশনে নিয়ে যাবো, যদি কেউ দাবী করে। সস্তা স্যুটকেসে ওর জামা কাপড়গুলো ভরতে ভরতে বলল, আমরা রোজ যে পরিমাণ এই কেস নিয়ে কাজ করি, আপনি করলেও এ ব্যাপারে আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করতেন না।

-ঠিক বলেছেন আমারও তাই ধারণা।

ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ধারণা আপনার?

–যে লোকেরা ওকে খুন করেছে, তারাও চায়না আপনি আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করেন, তাই না?

ও হেসে বলল, রোজ শয়েশয়ে এই কেস ঘাঁটছি।

আমার আর ওর বকবকানি ভাল লাগছিল না। ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বললাম, যাক্ আমি এখন এখানে আরও কয়েকদিন আছি, প্রয়োজন হলে আসতে পারেন।

ম্যাকফারসন কেমন ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার সঙ্গে প্রয়োজন? কেন?

দুজনে মিলে একটা ডিটেটিভ গল্প তো পড়তে পারি।

মুখের ওপর দমাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

.

২.৪

 আমার মনে হল এবার মিঃ জেফারসনের কিছু টাকা খরচ করার সময় হয়েছে। রিসেপশনের ঐ বৃদ্ধটাকে যদি কিছু ডলারের লোভ দেখান যায়, তাহলে ও আমাকে ম্যাকফারসনের চাইতে বেশী কিছু সময় দেবে।

ম্যাকফারসন হোটেল ছেড়ে চলে যেতে আমি কাউন্টারে গেলাম টেলিফোন করতে। অনুমতি পেলাম। ওয়ং-হপ এর নম্বর ডায়াল করতে সঙ্গে সঙ্গে ওকে পেলাম।

আমি বললাম, আমাকে মনে পড়ছে। আপনি এয়ারপোর্টে আমাকে কার্ড দিয়েছিলেন। আমার একজন দো-ভাষীর প্রয়োজন।

–এ কাজটা আমি করতে পারলে খুশী হব। উত্তর এল,–তাহলে আধঘণ্টার মধ্যে সাংহাই এ্যান্ড হংকং ব্যাংক-এর সামনে চলে আসুন।

ও সম্মতি দিতে বললাম, আমার একটা গাড়ীর দরকার হবে।

হো জানাল, আমার যা কিছুই প্রয়োজন ও খুব আনন্দের সঙ্গে তা যোগান দেবে এবং ওকেও আমি সর্বক্ষণের জন্য ইংরেজী বলিয়ে গাইড-হিসাবে পেতে পারি।

আমি ওকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাংকের বাইরে ওয়ং হপ-এর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

মিনিট দশেকের মধ্যে মিঃ হো চচকে একটা প্যাকার্ড গাড়ী চালিয়ে এল। বলল, ওকে ওয়ং বলে ডাকলেই ও খুশী হবে।

গাড়ীতে উঠে ওর পাশে বসলাম। আমি বললাম, আমি আমার হোটেলের রিসেপশান ক্লার্কের কাছে থেকে কতকগুলো খবর জানতে চাই, ও ইংরাজী জানে না। আমি একজন প্রাইভেট ইন–ভেস্টিগেটর। একটা কেসের ব্যাপারে এখানে এসেছি। ও খুশীতে ডগমগ হয়ে ওর সোনালী দাঁত বের করে হেসে বলল, এতদিন আমি ডিটেকটিভ গল্পই পড়েছি, এখন একজন ডিটেকটিভ দেখে আনন্দ পাচ্ছি।

আমি পকেট থেকে পঞ্চাশ হংকং ডলার ওর হাতে দিয়ে বললাম, আপনার সারাদিনের ফী হিসেবে এটা হবে তো? আপনাকে আমার সারাদিনের জন্যে দরকার লাগতে পারে।

 ওয়ং বলল যে এতে নিজে খুশী কিন্তু গাড়ীর জন্য আলাদা আরও কিছু দিতে হবে। আমি আর দরাদরি না করে ওর প্রয়োজন অনুভব করে ওকে আরও কিছু ডলার দিয়ে, গাড়ী নিয়ে । হোটেলে এলাম। গাড়ীদাঁড় করিয়ে রিসেপশনে এলাম। কাউন্টারের বৃদ্ধ ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। আমি বললাম, ওকে বলুন আমি ওকে কতকগুলো প্রশ্ন করতে চাই, তার জন্যে ও আমাকে সাহায্য করলে আমি ওকে পয়সা দেব। এটা এমনভাবে বলুন যাতে ও কিছু মনে না করে।

আমি ইতিমধ্যে পকেট থেকে পাঁচটা দশ ডলারের নোট বৃদ্ধকে দেখিয়ে মুড়ে রাখলাম। বৃদ্ধ লোভার্ত দৃষ্টিতে নোটগুলোর দিকে চেয়ে ওয়ং-এর মাধ্যমে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে প্রস্তুত বলে জানাল।

আমি জো-অ্যানের মর্গের ফটোটা বের করে ওয়ংকে বললাম, এটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করুন মেয়েটাকে ও চেনে কিনা।

ফটোটা একদৃষ্টে দেখে ওয়ং-এর সঙ্গে কিছু দুর্বোধ্য কথাবার্তা বলল। ওয়ং আমাকে জানাল যে, মেয়েটা এই হোটেলেই থাকত। দিন পনের আগে হোটেলের বিল না মিটিয়েই চলে গেছে। আমি কি সেই বিলটা মিটিয়ে দেব?

আমি জানালাম, না।

আরও প্রশ্ন করায় ওয়ং জানাল, মেয়েটা একটা আমেরিকানকে বিয়ে করে। সেও ওর ঘরেই থাকত। ভদ্রলোকের নাম ছিল হেরম্যান জেফারসন। দুর্ভাগ্যবশতঃ একটা মোটর দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। স্বামীর মৃত্যুর পর বিল না মিটিয়েই ও চলে যায়।

তখন আমি হেরম্যানের একটা ফটো বের করে ওয়ং-কে বললাম জিজ্ঞাসা করুন একে চেনে কিনা। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ফটোটা দেখে বৃদ্ধ বলল ওয়ং-এর মাধ্যমে, এই ভদ্রলোকই সেই আমেরিকান যে মেয়েটার সঙ্গে একই ঘরে থাকত।

–লোকটা এখানে কতদিন ছিল?

ওয়ং মারফৎ বৃদ্ধ জানাল মরার আগে পর্যন্ত।

এই প্রথম ও মিথ্যে বলল। লেইলা বলেছিল যে প্রায় মাস কয়েক আগে এই হোটেল থেকে ও চলে গিয়েছিল। কিন্তু এর কথানুযায়ী হেরম্যান এখানে তিন সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ওর মৃত্যু পর্যন্ত এখানে ছিল।

–কিন্তু আমি শুনেছিলাম জেফারসন এখানে মাত্র তিনমাস ছিল। তারপর স্ত্রীকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যায়। আর সেটা নমাস আগের ঘটনা।

ওয়ং তারপর বৃদ্ধের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে অনেক কথা বলল। তারপর ওয়ং বলল, ও একেবারে নিশ্চিত যে আমেরিকান ভদ্রলোক মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এখানে ছিল।

আমি ভাবলাম, তবে কি লেইলা মিথ্যে বলেছিল? ওয়ংকে বললাম, বলুন লেইলা বলেছে জেফারসন এখান থেকে নমাস আগে চলে গেছে, এও বলুন ও মিথ্যে বলছে।

ওয়ং ক্যান্টনীজ ভাষায় কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালানোর পর জানাল, ও মিথ্যে বলছে না স্যার। জেফারসন রোজ গভীর রাতে আসত আর ভোরে বেরিয়ে যেত। সেই জন্য লেইলা ওকে দেখেনি আর ভেবেছে জেফারসন চলে গেছে।

–জেফারসন এখানে রোজগার করত কীভাবে? আমি একথা জিজ্ঞেস করতে উত্তর এল জানে না।

–কোন ইউরোপীয় ওর সঙ্গে দেখা করতে আসত?

–এবারও উত্তর না।

–জো-অ্যানের কোন বন্ধু ওর সঙ্গে দেখা করতে আসত?

না

আমি উত্তেজিত এবং হতাশ হলাম। কার কথা যে সত্যি ভেবে পাচ্ছিলাম না। কোন থই খুঁজে পাচ্ছি না।

জিজ্ঞেস করলাম খুব হাল্কাভাবে, আচ্ছা জো- অ্যান কি যাবার সময় কোন জিনিষপত্র ঘরে ফেলে গেছে?

-না, কিছুই রেখে যায় নি।

আমি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, তাহলে কি ও চোখের সামনে দিয়ে মালপত্র নিয়ে, বিল না মিটিয়ে চলে গেল?

ওয়ং আমার কথার যুক্তি বুঝতে পেরে বৃদ্ধকে খেঁকিয়ে উঠল। খানিকটা আমতা আমতা করে বৃদ্ধ বলল যে, একটা সুটকেশ ফেলে গেছে, ভাড়া বাকী আছে বলে সেটা জমা রেখেছে।

আমি সুটকেশটা দেখতে চাওয়ায় বৃদ্ধ লেইলার পাশের ঘরের দরজা খুলে খাটের তলা থেকে একটা নকল চামড়ার সুটকেশ বের করল। আমি ওদের দুজনকে বাইরে দাঁড়াতে বলে দরজায় ছিটকিনি তুলে সুটকেশের সস্তা তালায় একটুচাপ দিতেই তালাটা খুলে গেল। দেখলাম কয়েকটা দামী কাপড়জামা আর কিছু টুকিটাকি। সেগুলোর তলায় একটা সাদা খাম পেলাম। খুলে তার ভেতর দেখলাম জেনেৎ ওয়েস্টের দেওয়া ফটোগ্রাফের অনুরূপ একটা হেরম্যানের ছবি। তলায় লেখা, আমার স্ত্রী-জো-অ্যানকে। হয়ত হেরম্যান দুজনকেই ঐ একই ফটোগ্রাফ দিয়েছে।

যাইহোক, লেইলা এবং রিসেপশন ক্লার্কের মধ্যে যে কেউ একজন মিথ্যে বলছে, লেইলা কেন মিথ্যে বলবে?

চিন্তা করে দেখলাম এই ছোট, নোংরা হোটেলে থেকে আমার দরকারী কোন সূত্রের সন্ধান পাবনা। আমাকে এই রহস্যের সূত্রের জন্যে অন্য কোথাও যেতে হবে।

দরজা খুলে বাইরে এসে দেখলাম ওয়ং সিগারেট খাচ্ছে দাঁড়িয়ে আর বৃদ্ধ নেই, হয়ত কাউন্টারে ফিরে গেছে।

আপনার সব কাজ ঠিকমত হয়েছে তো স্যার? ওয়াং-এর প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, হ্যাঁ তবে শুনুন ওয়ং, আমি এখানে থাকবনা। রিপাল উপসাগরের কাছে কোন হোটেল পাওয়া যাবে?

একটু অবাক হয়ে ও বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ রিপালস্ বে হোটেল ওখানে খুব সুন্দর। আপনি বললেই ব্যবস্থা করতে পারি।

যদি পারেন এক্ষুনি আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই।

একটা ব্যাপার স্যার। হোটেলটা কিন্তু চলতি পথের বেশ দূরে। কউলুন ঘুরতে গেলে হোটেলটা আপনার পক্ষে খুব একটা সুবিধাজনক হবে না।

–সেজন্য আমি ভাবছি না। আপনি বৃদ্ধকে এখনই আমার বিল রেডি করতে বলুন। আ ঘরটাও চেক করে নি।

আপনি লোকটাকে আর প্রশ্ন করবেন না? ওয়ং প্রশ্ন করল।

-না। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে চলে যাব।

মিনিট তিরিশ পর আমরা প্যাকার্ড গাড়ীতে চড়ে রিপাসের দিকে রওনা হলাম।

.

২.৫

 রিপালস্ উপসাগরের প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে পাহাড় ঘেরা এলাকা,নীল সমুদ্রের জল আমাকে মুগ্ধ করল। হোটেলটাও প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে বেশ মানানসই। এমন সুন্দর জায়গা আমি খুব কম দেখেছি।

ওয়ং আমাকে হোটেলের যে ঘরটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। প্যাকার্ড গাড়ীটা রেখে বলে গেছে যে কোন প্রয়োজনে তাকে ডাকলে সে খুশী হবে!

এরপর জিনিষপত্র গুছিয়ে টেলিফোন গাইডে কোথাও হেরম্যান জেফারসনের নাম পেলাম না। রিসেপশনে ক্লার্কও তার নাম শোনননি বলে জানিয়ে দিল।

একটা ভাল হোটেলের বয় সমস্ত খবর রাখে–এই প্রবাদ মনে রেখে আমার রুম বয়কে জিজ্ঞাসা করলাম সে এমন অট্টালিকার খবর জানে কি যার প্রান্ত ধাপে ধাপে সমুদ্রের সঙ্গে মিশেছে, যেখানে ছোট একটা ঘাট এবং একটা বোটও আছে।

একটু চিন্তা করে সে বলল, আপনি লিফান-এর বাড়ীর কথা বলছেন? এখন সে বাড়ীতে মিঃ এনরাইট আর তার বোন থাকেন। তারাও আমেরিকান।

–ঐ বাড়ীতে মিঃ হেরম্যান জেফারসন বলে কেউ থাকত বলে তুমি শুনেছো? আমি জিজ্ঞেস করলাম। ও মাথা নেড়ে বলল যে সে জানে না।

বীচ-এগিয়ে পেডালো ভাড়া করে ভাসতে ভাসতে পুরো উপকূল এলাকাটা দেখতে লাগলাম। লিন-ফান-এর বাড়ীটা আলাদাভাবে চিনে নিতে আমার অসুবিধা হল না। সমুদ্রের মধ্যে উঁচু জমি আলাদা হয়ে আছে।

আমি পেডালো চালিয়ে বাড়ীটার দুশো গজের মধ্যে এসে থেমে বাড়ীটা ভাল করে দেখতে লাগলাম। হেরম্যান সত্যিই কি এত পয়সা রোজগার করেছিল যে এত বড় বাড়ী ভাড়া করেছিল? নাকি লেইলাকে অ্যান মিথ্যে কথা বলেছিল?

হঠাৎ আমি সচকিত হলাম। বাড়ীটার সবচেয়ে উঁচু ঘরটায় দুটো বিন্দু। আমি মিনিট দশেক ধরে পেডালো চালিয়ে বুঝলাম, খুব শক্তিশালী লেন্স দিয়ে দুটো চোখ আমাকে লক্ষ্য করে যাচ্ছে। সূর্যের আলোয় লেন্স দুটো আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। পেডালো ঘুরিয়ে নিলাম বীচ-এর দিকে।

এক ঝলক তাকিয়ে দেখে বুঝলাম বিন্দু দুটো এখনো আমার গতিবিধির ওপর নজর রাখছে। আমি মুখে টুরিস্ট টুরিস্ট ভাব ফুটিয়ে ভাবলাম এত চিন্তা করার কি আছে? সুন্দর বাড়ী তাই দেখছিলাম। যুক্তিটা নিজেই মানতে পারলাম না। অতএব হোটেলে ফিরে এলাম।

.

২.৬

 পরদিন সকাল দশটা নাগাদ বীচ-এ এলাম। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে বালির ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। হেরম্যান, ওয়েস্ট, বৃদ্ধ জেফারসন, অ্যান, লেইলাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলাম তখনকার মতো। একটু ঝিমুনি ভাব এসেছিল, খুব কাছে পদশব্দ শুনে চোখ খুললাম। দেখলাম লম্বা, স্লিম, রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রং, বিকিনী পরা একটা মেয়ে আমাকে পেরিয়ে গেল। বীচে শুয়ে থাকা সকলে আগ্রহের সঙ্গে ওকে দেখছে।

 তপ্ত বালির ওপর দিয়ে মেয়েটা সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। ওর ফিগারটা চুম্বকের মত আমাকে আকর্ষণ করছিল। লক্ষ্য করলাম রোদটুপীটাকে অবহেলাভরে বালিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে জলে নেমে, দক্ষতার সঙ্গে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে বিশাল একটা পাথরের চাইয়ের ওপর গিয়ে উঠল। ওকে নির্জন এলাকার রাণী বলে মনে হতে লাগল। ওর সঙ্গ পাওয়ার জন্যে আমার মন অস্থির হয়ে ওঠায় আমি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলাম। ঘোট ঘোট আকর্ষণীয় স্টোকে এগোতে লাগলাম। পাথরের কাছে এসে ওকে বললাম, যদি আমি এই সুন্দর নির্জনতাকে ভেঙে থাকি তো বলুন সাঁতরে অন্যদিকে চলে যাই।

মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আমিও ওকে বেশ কাছ থেকে দেখে বুঝলাম বহু পুরুষের সঙ্গলাভের অভিজ্ঞতা এই মেয়ের আছে। চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে–এই ধরণের মেয়েরা পুরুষের সঙ্গ লাভের জন্যে খুবই আগ্রহী।

ও কামোত্তেজক গলায় হেসে বলল, আমি বরং আশায় আছি কেউ এসে আমাকে সঙ্গ দেবে। আপনি কে? মনে হচ্ছে আজই উড়ে এসেছেন? তাই নয় কি?

আমার নাম নেলসন রায়ান। বিখ্যাত ইংরেজ অ্যাডমিরালের নামানুসারে আমার বাবা আমার নাম রেখেছেন। তিনি অ্যাডমিরাল নেলসনের অন্ধ ভক্ত ছিলেন।

মেয়েটা পাথরের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে বলল, আমি স্টেলা এনরাইট। এখানেই থাকি। নতুন নতুন মুখ আমার ভাল লাগে। আপনি কি এখানে অনেকদিন থাকবেন?

এই মুহূর্তে আমি ভাবতে লাগলাম এটা আমার সৌভাগ্য নাকি বিস্ময় আমার সামনে অপেক্ষা করছে! যে লোকটা লিমফোনের বাড়ী ভাড়া নিয়েছে তার বোন আমার সামনে?

বললাম, সপ্তাহখানেক থাকব।

আমি ওয়াটার প্রুফ পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে ওকে দিলাম। দুজনে সিগারেট ধরালাম। বললাম, এই সুন্দর জায়গায় বাস করা তো ভাগ্যের ব্যাপার!

ধন্যবাদ। এখন আবহাওয়া খুবই সুন্দর, কিন্তু গ্রীষ্মকালটা খারাপ। সিগারেটের ধোয়া উড়িয়ে বলল, আমার দাদা হংকং-এর ওপর একটা বই লিখছে। আমি দাদার দেখাশোনা করি। মাথাটা একটু তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি হোটেলে আছেন?

-হ্যাঁ। আপনাদের এখানে বাড়ী আছে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

আমরা একটা বাড়ী ভাড়া নিয়েছি, যেটা একটা চীনা গ্যাম্বলারের।

লিনফান?

ও বেশ অবাক হয়ে বলল, ঠিক ধরেছেন, আপনি এত সব জানলেন কি করে?

-আমি শুনেছিলাম। তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বললাম, আমি ভেবেছিলাম ওটা হেরম্যান জেফারসন ভাড়া নিয়েছে।

ও ভুরু তুলে আমার দিকে তাকাল।

বোঝা গেল কথাটা সত্যিই ওকে অবাক করেছে, হেরম্যান জেফারসন? আপনি তাকে জানলেন কিভাবে?

আমি যে শহরে থাকি, ও সেই শহরের ছেলে।

–ও। হেরম্যান তো একটা মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে।

–হ্যাঁ। সেরকমই শুনেছিলাম। আপনি তাকে চিনতেন?

-হ্যারি, আমার দাদা ওকে চিনত। আমি ওকে দু-একবার দেখেছি। তাহলে আপনি ওকে, চিনতেন? হ্যারি শুনলে খুব খুশী হবে। লোকটার মৃত্যুটা খুবই দুঃখজনক, ওর চীনা স্ত্রীর পক্ষেও এটা দুঃখের।

আপনি ওর স্ত্রীকে চেনেন?

ঠিক চিনি বলতে পারিনা। তবে দেখেছি।

টুসকি মেরে সিগারেটের ছাই ফেলে বলল, কিছু চীনা মেয়ে সত্যিই আকর্ষণীয়। কিন্তু হেরম্যান যে খুব নীচে নেমে গিয়েছিল তা ঐ মেয়েটার জন্যেই। ঐ মেয়েগুলো ওরকমই হয়। কথাগুলো তেতো, কিন্তু মিষ্টি মোড়কে জড়ানো। এটা আমার কান এড়াল না।

ও বলতে থাকল, হেরম্যানের মৃতদেহ নিয়ে ও আমেরিকা চলে গেছে। আমার তো মনে হয় ওখানেই থেকে যাবে, আর আসবে না কারণ হেরম্যানের বাবা শুনেছি লক্ষপতি। সুতরাং মেয়েটার ভার নেবেন।

আমি আর একটু হলেই বলে দিতাম অ্যান মরে গেছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে জিজ্ঞেস করলাম, আমি শুনেছিলাম যে হেরম্যান নাকি অনেক টাকার মালিক হয়ে যায় হঠাৎ। তারপর ওর স্ত্রীকে আপনারা এখন যে বাড়ীটায় ভাড়া আছেন সেটা ছেড়ে দিয়ে চলে যায়?

স্টেলা মাথা তুলে কুটি করল।

বাঃ কে আপনাকে এসব অদ্ভুত গল্প বলেছে?

–হয়তো কেউ একজন বলেছিল। তারপর হালকা গলায় বললাম, কেন ঘটনাটা কি সত্যি নয়?

না একেবারেই না। আরাম করে শরীর বিছিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, সত্যি কথা বলতে কি হেরম্যান খুব একটা ভাল লোক ছিল না। আমি ওকে পছন্দ করতাম। জংলী স্বভাবের ছিল। কিন্তু হ্যারিকে ও আনন্দ দিত। ওর কোন কালেই পয়সাকড়ি ছিল না। ও নাকি ওর চীনা স্ত্রীর পয়সায় খেত। তাহলে ও এ বাড়ী কি করে ভাড়া নেবে? কে বলেছে আপনাকে এই কথা?

একটা দ্রুতগামী মোটর বোটের ইঞ্জিনের শব্দে আমরা সচকিত হয়ে দেখলাম, একটা স্পীডবোট সাদা ফেনা ছড়িয়ে আমাদের দিকেই আসছে।

-ঐ যে হ্যারি আসছে। স্টেলা উঠে দাঁড়িয়ে বোটটার দিকে হাত নাড়তে লাগল।

বোটটার গতি কমে ইঞ্জিন বন্ধ করার আওয়াজ পেলাম। পাথরের গায়ে এসে বোটটা থামল। একজন হাফপ্যান্ট পরা, রোদে পোড়া, সবুজ-সাদা ডোরাকাটা শার্ট পরা লোক স্টেলার দিকে চেয়ে হাসল। মুখ দেখে মনে হয় ইনি বেশ স্বচ্ছল আর চামড়ার নীচে সরু নীল শিরা দেখে বোঝা যায় ইনি মদ্যপান একটু বেশীই করে থাকেন। আমার দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে স্টেলাকে বলল, ভাবলাম লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে তোমাকে তুলে নিয়ে যাব। তা তোমার এই বয়ফ্রেন্ডটি কে?

–ইনি নেলসন রায়ান। জেফারসনের সঙ্গে এর পরিচয় ছিল।

 তারপর স্টেলা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার দাদা, হ্যারি। আমরা দুজন-দুজনকে অভিবাদন করলাম।

–আপনি হেরম্যানকে জানতেন? তাহলে খুব ভাল হল। আপনি এখানে কদিন আছেন?

–দিন সাতেক। আমার দুর্ভাগ্য আমি এখানে বেশীদিন থাকতে পারছি না।

–শুনুন। আজ যদি আপনার কোন এনগেজমেন্ট না থাকে তাহলে আমাদের সঙ্গে আপনি ডিনার করবেন? আমি এখানেই আপনাকে বোটে তুলে নেব। এটাই আমাদের ওখানে যাবার একমাত্র পথ। কি আসবেন তো?

নিশ্চয়ই। এ তো খুব ভাল কথা। তবে কি, আপনাকে আমাকে নিতে এসে আর কষ্ট করতে হবেনা। আমি নিজেই চলে যাবো।

–আরে তাতে কি? ঠিক আটটার সময় বীচে আসবেন, আমি আপনাকে নিয়ে যাব। তারপর ডিনার খেয়ে আমরা এই বোটে একটু বেড়াব। দেখবেন কী সুন্দর লাগে। স্টেলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি এখন যাবে?

–আমাকে আগে বীচ-এ নিয়ে চল, আমি টুপিটা ফেলে এসেছি।

 স্টেলা বোটে চড়ে বসল। আমি ওর রোদে পোড়া সুঠাম পিঠ থেকে চোখ সরাতে পারলামনা। ও হঠাৎ পেছন দিকে তাকাতে আমি ধরা পড়ে বিব্রত বোধ করলাম। ও হাসল, যেন আমার মনের ভাষা বুঝতে পেরেছে। হাত নেড়ে বলল, চলি আজ রাত্রে দেখা হচ্ছে, হ্যারি আমাকে দেখে মাথা ঝাঁকাল। আমি হাসলাম। বোটটা এগোলো।

আমি সিগারেট ধরিয়ে জলে পাদুটো ডুবিয়ে মনে একটা উত্তেজনা অনুভবকরলাম। আধঘণ্টা সূর্যের উত্তাপে শরীরটা শুকিয়ে এখন বেশ খিদে অনুভব করলাম। সাঁতার কেটে বীচে ফিরে এলাম।

ঠিক আটটায় নীচে পৌঁছলাম। কয়েক মিনিট বাদে স্পীড বোটটা দেখা গেল, একজন স্বাস্থ্যবান চীনা ড্রাইভার আমাকে হাত ধরে বোটে উঠতে সাহায্য করল আর বলল, মিঃ এনরাইট আসতে পারেন নি, সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন।

কয়েক মিনিটেই লিমফানের বাড়ী পৌঁছে গেলাম।

বোট থেকে নেমে সিঁড়ি পেরিয়ে উঁচু জমিতে এলাম। জায়গাটা সুন্দরভাবে সাজান। স্টেলা ইভনিং ড্রেস পরেছে। ফ্রকটা লোকাট। একটা বাঁশের আরাম কেদারায় বসে হইস্কি খাচ্ছে ও মুখে সিগারেট। পাশে একজন চীনা পরিচারক ওর হুকুমের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। হ্যারিকে কোথাও দেখতে পেলাম না।

–আপনি এসে গেছেন। হাতের হুইস্কির গেলাসটা নামিয়ে আমাকে স্বাগত জানালো। কি খাবেন বলুন?

আমি স্কচে সোডার কথা বলাতে সঙ্গে সঙ্গে পানীয় এসে গেল।

–হ্যারি এখনই এসে পড়বে। আপনি ঐ চেয়ারটায় বসুন তাহলে আপনাকে ভালভাবে দেখতে পাবো।

আমি বসে বিশ্রামকক্ষটি ভালভাবে দেখতে লাগলাম। ঘরটা চীনা স্টাইলে সাজানো, দামী দামী আসবাব রয়েছে। দেওয়ালে লাল সিল্কের পর্দা। মাঝখানে বড় কালো রঙের ডাইনিং টেবিল। ডিনারের খাবার সব প্রস্তুত।

–আপনাদের এই জায়গাটা আমার খুব ভাল লেগেছে। আমি হেসে বললাম।

-হ্যাঁ। জায়গাটা সত্যিই ভাল। ভাগ্য ভাল ছিল বলে এ জায়গাটা পেয়ে গেছি, আগে কউলুনে একটা বাড়িতে থাকতাম। মাত্র কয়েক সপ্তাহ এখানে এসেছি। তবে ওটার তুলনায় এটা অনেক ভাল।

–আপনারা আসার আগে এখানে কে ছিল?

মনে হয় না কেউ ছিল। এর মালিক ম্যাকাউতে থাকে। উনি তো এই সেদিন ঠিক করলেন যে বাড়িটা ভাড়া দেবেন।

ঠিক এই সময়ে এনরাইট এল। আমরা করমর্দন করে মুখোমুখি বসলাম।

দু-চারটে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর হ্যারি আমাকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে ব্যবসায়ের ব্যাপারে এসেছেন?

না। আমি ছুটি কাটাতে এসেছি। সপ্তাহ খানেক ছুটি পেয়ে আর লোভ সামলাতে পারলাম না।

যাক ভাল করেছেন। তারপর খুব অন্তরঙ্গ গলায় বলল, স্টেলা বলছিল, আপনি নাকি প্যাসাডোনা সিটি থেকে এসেছে। তাহলে আপনি হয়তো হেরম্যান জেফারসনকে চিনে থাকবেন?

–হ্যাঁ। আমি ওর চেয়ে ওর বাবাকে ভালভাবে জানি। ভদ্রলোক আমি এখানে আসছি শুনে আমাকে হেরম্যানের ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নিতে বলেছেন।

হ্যারি আমার দিকে বেশ আগ্রহভরে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? কী ধরনের খোঁজ খবর?

–দেখুন ও প্রায় পাঁচবছর এখানে আছে। এরমধ্যে ওর বাবাকে চিঠিপত্র লিখত না বললেই চলে। শুধু ও চীনা মেয়েকে বিয়ে করছে জানিয়ে একটা চিঠি দিয়েছিল। তাতে ওর বাবা খুব আঘাত পেয়েছিলেন। আমি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলাম। হ্যারি স্টেলার দিকে তাকাল আর মাথা নাড়াল, খুব স্বাভাবিক।

–দেখুন মিঃ এনরাইট আমার মনে হয়, ভদ্রলোক ওর জীবিতকালে ওর জন্যে কিছু করতে পারেননি বলে খুব কষ্ট পেয়েছেন। ও এখানে কীভাবে রোজগার করত, সে ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন?

–আমার মনে হয়না ও কিছু করত। ছেলেটা বেশ রহস্যময় ছিল। আমি ওকে পছন্দ করলেও অনেকেই ওকে ভালমনে নিতে পারত না। আমার বোন স্টেলা তো ওকে দু-চক্ষে দেখতে পারত না। স্টেলা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, বেশী বাড়িয়ে বোলনা। আমি ওকে দেখতে পারতাম না শুধু এই কারণেই, কেননা ও ভাবত সব মেয়েই বুঝি ওর প্রেমে পড়ে গেছে। এই ধরণের লোকদের আমি পছন্দ করিনা। এনরাইট বেশ জোরে হেসে উঠল।

–ঠিক আছে তুমি ওর প্রেমে পড়নি। মনে হয় ও টক আঙুর ছিল। মিঃ এনরাইট বলল।

–তাহলে তোমার কোন নীতির বালাই নেই, যে কেউ তোমাকে আনন্দ দিলেই তুমি তাকে পছন্দ করে নাও। স্টেলা বলল।

একজন পরিচারক এসে বলল ডিনার প্রস্তুত। আমাদের কথাবার্তায় বাধা পড়ল। আমরা ডিনাররুমে ঢুকলাম।

খুব ভাল চীনা খাবার পরিবেশিত হলো। আমার খেতে খুব ভাল লাগছিল। স্টেলাকে একটু অন্যমনস্ক লাগছিল।

খাওয়া যখন প্রায় শেষ মুহূর্তে, হঠাৎ স্টেলা প্রশ্ন করল, মিঃ রায়ান, আপনাকে কে বলেছিল হেরম্যান এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিল?

ওর কথা শুনে মিঃ এনরাইট খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, হেরম্যান এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল? ঈশ্বরের দিব্যি। আপনাকে কেউ বলেছিল এই কথা?

আমি বললাম, একটা চীনা মেয়ে। সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেল, যেখানে হেরম্যান ভাড়া থাকত, সেই হোটেলে মেয়েটার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। ওই বলেছিল।

আশ্চর্য। স্টেলা ভুরু কুঁচকে বলল, এরকম বাজে কথা বলার অর্থ কি? আমি কাধ ঝাঁকালাম। বললাম, জানি না, হয়ত ও মিথ্যে বলেছিল।

হঠাৎ আমার মনে হল, মিনিট খানেক হল কেউ আমাকে লক্ষ্য করছে। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে বললাম, আমি ওকে হেরম্যানের সম্বন্ধে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আমি এও বলেছিলাম সে কিছু বললে ওকে টাকা দেব। সেই লোভে হয়তো এইসব মিথ্যা বলেছে।

–আমার ঠিক উল্টোদিকের বিরাট আয়না দিয়ে আমার পুরো শরীরটা দেখা যাচ্ছে আর আয়নার ভেতর দিয়ে দেখলাম একটা শক্তসমর্থ চেহারার চীনা ইউরোপীয় স্যুট পরা আমাকে খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছে। আমি আয়না দিয়ে তাকাতে ওর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। হতেই লোকটা অন্ধকারে মিশে গেল। বিপদের গন্ধ পাওয়া সত্ত্বেও আমার চোখে-মুখে সেটা বুঝতে দিলাম না। ও যে আমায় লক্ষ্য করছে আমি দেখেছি সেটা ঝেড়ে ফেলার জন্যে শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে হেসে বললাম, যাকগে বাদ দিন ও নিশ্চয়ই আমাকে ধাপ্পা দিয়েছিল।

চীনারা বিশেষ করে চীনা মেয়েরা ভীষণ মিথ্যে কথা বলে। পৃথিবীতে এরা এক নম্বরের মিথ্যেবাদী। আমার দিকে গভীর ভাবে চেয়ে এনরাইট বলল।

আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, তাই নাকি? আচ্ছা।

স্টেলা আমার কথায় বাধা দিয়ে বলল, চলুন, আমরা একটু টেরেসে গিয়ে বসি। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে স্টেলা বলল, আপনি কি একটু ব্রান্ডি নেবেন?

আমি বললাম, না।

ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের সেই ছেড়ে যাওয়া জায়গায় আবার এসে বসলাম। মাথার ওপরের চাঁদের আলো সমুদ্রের ওপর পড়ে একটা মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।

আমাকে কয়েকটা টেলিফোন করতে হবে। দয়া করে অনুমতি দেন তো কাজটা সেরে আসতে পারি। আপনারা একটু বসুন। তারপর আমরা বোটে করে বেড়াব। আপনার আপত্তি নেই তো? এনরাইট আমার দিকে চেয়ে বলল।

আমি স্টেলার দিকে চেয়ে বললাম, আপনি বেড়াতে যাবেন তো? তাহলে আমার আর আপত্তি কোথায়?

-হ্যাঁ, আমি যাবো। কেমন একটা হতাশ গলায় স্টেলা বলল, হ্যারি তো ওর বোট ছাড়া কিছুই জানে না।

আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে হ্যারি চলে গেছে। স্টেলা আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ওর হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের কিনারায় এসে দাঁড়ালাম।

–একদিক থেকে কিন্তু মেয়েটার ভাগ্য ভাল বলতে হবে। সতৃষ্ণ কণ্ঠে স্টেলা বলল, আমি ওর দিকে তাকালাম। হেরম্যানের বাবা তো খুব ধনী, আমার তো মনে হয় ওর বাবা পুত্রবধূকে দেখবে।

কিন্তু ওর স্বামী মারা গেছে, আমি বললাম।

এখনো ঠিক করে উঠতে পারছি না, জো-অ্যান মারা গেছে বলব কিনা।

একটু অসহিষ্ণুভাবে স্টেলা বলল, অতে তো বরং ভালই হয়েছে। এখন ও মুক্ত, স্বাধীন। শশুরের কাছ থেকে ইচ্ছেমত টাকাপয়সা পাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা ও নিউইয়র্ক যেতে পেরেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, আমার নিউইয়র্ক যেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।

–আপনারা নিউইয়র্ক থেকে আসছেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হুমম। একবছর হলো, দেশে ফেরার জন্যে আমি ভীষণ কাতর।

–আপনি কেন চলে যাচ্ছেন না? আপনি তো ইচ্ছে করলেই যেতে পারেন। এখানে যে থাকতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। আমি ওর মনের কথা জানবার জন্যে বললাম।

কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে বলল,না তা নেই ঠিকই। তবে চিরকাল দাদার সঙ্গে থেকে থেকে একসঙ্গে থাকার অভ্যাস হয়ে গেছে। কাজেই…তারপরেই কথা পাল্টে দূরে পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, চাঁদনী রাতে কি সুন্দর দৃশ্য না?

আমি ভাবলাম ও বারবার এমন প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছে কেন? আমি অবশ্য এনরাইট আসার আগে পর্যন্ত ওর তালে তাল মিলিয়ে প্রকৃতির প্রশংসা করে গেলাম।

হ্যারি এসে গেল। বলল, চলুন যাওয়া যাক। এবারডীন কেমন লাগবে? ওটা এখানকার জেলেদের গ্রাম। খুব সুন্দর জায়গা।

চলুন। আমরা এসে বোটে উঠলাম। এনরাইট চালাতে লাগল। আমি আর স্টেলা পিছনের আসনে বসলাম। বোটটা গর্জন করে সমুদ্রে ভাসল।

ইঞ্জিনের বিকট শব্দের জন্যে আমরা কথা বলতে পারছিলাম না। স্টেলা বিষণ্ণ মুখ করে চুপচাপ সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইল। মনে হচ্ছে, কোন দুঃখজনক ঘটনা মনে মনে চিন্তা করছে। আমি এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনা ও তথ্যগুলো মনে মনে ভাবতে লাগলাম। এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না লেইলা মিথ্যা বলেছে বলে। নাকি এনরাইটরাই আমার কাছে কিছু গোপন করতে মিথ্যে বলছে। নয়তো এরা সঠিক তথ্য জানেনা।

আমরা পৌঁছে গেলাম এবারডীন গ্রামে। ঘাটের মুখটা ছোট বড় নৌকোয় ভর্তি। ঘাটে নামার কোন জায়গাই নেই। এনরাইট ঘাট থেকে বেশ দূরে বোটটা নোঙর করল। এরপর আমরা স্যাম্পান করে পার হয়ে এলাম। স্যাম্পান–তলাটা চ্যাপ্টা–একরকমের ছোট নৌকো। এরপর আমরা খানিকক্ষণ ঐ জেলেদের গ্রামটায় ঘুরলাম। চীনারা তাদের ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেড়াতে এসেছে। চাঁদের আলোয় গ্রামটার সৌন্দর্য যেন আরও বেড়ে গিয়েছিল।

স্টেলা জানাল ও ফিরতে চায়। কারণ ওক্লাস্তবোধ করছে। আবার আমরা স্যাম্পান চেপে ফিরে এলাম। আসতে আসতে স্টেলা বলল, আপনি এখানকার দ্বীপগুলো যদি না দেখে থাকেন তবে একটা ফেরি নৌকো নিয়ে নেবেন।

না এখনো দেখিনি।

কাল যদি আপনার কোন কাজ না থাকে তো বলুন। আমি কাল সিলভার মাইনে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাব। ওখানে একটা জলপ্রপাত আছে, ওটা দেখে আসতে পারবেন, খুব ভাল লাগবে। তারপর আমরা একসঙ্গে ফিরে আসব।

-খুব ভাল কথা, আমি রাজী।

–আমার বোন বড় দয়ালু। হ্যারি বলল, আমরা যখন প্রথম এখানে আসি তখন এক মহিলা আমাদের কাছে কাজ করত। এখন সে অবসর নিয়ে সিলভার-মাইনে থাকে। স্টেলা মাঝে-মাঝে ওর সঙ্গে দেখা করে জিনিষপত্র দিয়ে আসে।

আবার আমরা বোটে চড়লাম। বোট ছাড়তেই কথা বন্ধ হয়ে গেল। মিনিট কুড়ি পর স্টেলাদের বাড়ি পৌঁছলাম। স্টেলা ঘাটে নেমে গেল। হ্যারি আমাকে বীচে পৌঁছে দেবে বলল।

শুভরাত্রি। একটু হেসে স্টেলা বলল, ফেরি বোট দুটোর সময় ছাড়ে, আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব।

এই সুন্দর সন্ধ্যায় ওদের সঙ্গ পেয়ে আমি খুশী হয়ে স্টেলাকে ধন্যবাদ জানালাম। দুজনে দুজনের দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালাম। ইঞ্জিন আবার গর্জে উঠল।

বীচে নামার মুখে হ্যারি জিজ্ঞেস করল, আপনি কবে ফিরছেন?

–এই হপ্তাখানেক পরে। ঠিক বলতে পারছি না।,

-ঠিক আছে। আশা করি আবার আসবেন। আপনার সঙ্গ খুব ভাল লাগল আমার, আমরা উভয়ে করমর্দন করলাম।

হ্যারি বোট চালিয়ে চলে গেল। আমি ওকে লক্ষ্য করতে লাগলাম।

আস্তে আস্তে হেঁটে হোটেলে ফিরতে লাগলাম। আমি কিছুতেই সেই আয়নার ভেতর দিয়ে তাকানো চীনা লোকটাকে ভুলতে পারছি না। ওর সেই চাউনি এখনও আমার চোখে ভাসছে।

আমার সহজাত অনুভূতি বলল–সাবধান। বিপদ আসছে।

.

২.৭

 পরদিন সকালে আমি আমেরিকান কনস্যুল-এর থার্ড সেক্রেটারির অফিসে চলে এলাম।

ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমাকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হল। অনেক ঝামেলা, অন্যান্য কর্মীদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার ওর ঘরে ঢোকার সৌভাগ্য হল।

ভদ্রলোক বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তেল চৰ্চকে চেহারা। অফিস ঘরটা কূটনৈতিক গুরুগম্ভীর আলোচনা করার জন্যে উপযুক্ত আবহাওয়া সৃষ্টি করতে সেইভাবে সাজানো হয়েছে। আমার ভিজিটিং কার্ডটা ছুঁয়ে, চোখ কুঁচকে একবার তাকাল। যেন ওটা ছুঁলে দুরারোগ্য কোন ব্যাধি থেকে আর নিস্তার নেই।

নিজেই উচ্চারণ করল নেলসন রায়ান..প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। তারপর আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, বলুন, আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি?

আমি মিঃ জে-উইলবার.জেফারসনের হয়ে কাজ করছি। দিন সতের আগে ওর ছেলে। হেরম্যান জেফারসন এখানে একটা মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সে ব্যাপারে আমি কিছু অনুসন্ধান করতে এসেছি।

–হুম, তা আমাকে কি করতে হবে? একটা সিগারেট ধরিয়ে ভদ্রলোক বললেন।

–ও হংকং-এর বাসিন্দা ছিল। সুতরাং আমার মনে হয়, ওর নাম নিশ্চয়ই এখানে রেজিষ্ট্রি করা ছিল। আমি বললাম।

–হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

-আপনি ওর শেষ ঠিকানাটা দিতে পারেন? ভদ্রলোকের চোখের চাউনি স্বাভাবিক হল। তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা আমি একটা কথা বলছি, সেটার কি কোন প্রয়োজন আছে? ওটা মরা ফাইল, ভল্টে চলে গেছে। ওখান থেকে বের করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

-বাঃ। আমি কি মিঃ জেফারসনকে গিয়ে একথা বলব যে সময় লাগবে বলে এই সামান্য সাহায্য আমেরিকান কনস্যুল-এর সেক্রেটারি একজন আমেরিকানের জন্যে করতে পারেনি।

মনে হল, জেফারসনের নামটা আবার স্মরণ করিয়ে দিতে থার্ড সেক্রেটারি নড়ে চড়ে বসল। উঁচু মহলে জেফারসনের দহরম-মহরম সম্বন্ধে সজাগ হল। তাড়াতাড়ি টেলিফোন তুলে, মিস্ ড্যাভেনপোর্ট? শুনুন, হেরম্যান জেফারসনের ফাইলটা…হ্যাঁ…হ্যাঁ, হেরম্যান জেফারসন।

–রিসিভার রেখে আমার থেকে কোটিপতি মিঃ জে. উইলবার জেফারসনের খোঁজ নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন তিনি?

–ভালই আছেন। পা বাড়িয়েই আছে। যখন দরকার পড়বে পাছায় লাথি মারবেন। ভদ্রলোকের পা দুটো বেশ লম্বা, জুতোজাড়াও বেশ ভারী।

থার্ড সেক্রেটারির নাম হ্যারিস উইলকক্স। আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে লাগল।

–ভালই বলেছেন। উনি কিন্তু অনেকদিন বেঁচে আছেন। হয়তো দেখব আমরা যখন কবরে যাবো তখনও উনি বেঁচে আছেন।

দরজা খুলে মিস্ ড্যাভেনপোর্ট ঢুকল। পাতলা ছিমছাম চেহারা, বয়স বছর পঁচিশেক। একটা পাতলা, হয়তো কিছুই নেই, ফাইল টেবিলের ওপর রেখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল, তারপর মেয়েটা ওর নিতম্ব দুলিয়ে বেরিয়ে গেল। আমরা দুজনেই ওর যাওয়া লক্ষ্য করলাম।

ও বেরিয়ে যাবার পর উইলকক্স খানিকটা ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল, দেখুন প্রায় সব কাগজপত্র ওর ডেডবডির সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এখানে কি পাওয়া যায় দেখি। ফাইল খুলে বলল, হ্যাঁ এই নিন, ওর শেষ ঠিকানা ছিল সেলেশিয়াল এম্পায়ার হোটেল। হংকং এ এসেছিল তেসরা সেম্বের উনিশশো ছাপান্ন সালে এবং সেই থেকেই ঐ হোটলেই থাকত। গত বছর একটা চীনা মেয়েকে বিয়ে করেছিল। ও কাগজটা দেখার সময় জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা ও এখানে জীবিকা নির্বাহ করত কিভাবে?

–এখানে তো লেখা আছে যে ও এদেশে এসেছিল একজন রপ্তানীকারক হিসেবে। তবে আমার মনে হয় না ও কিছু করত বলে, আর ও সুস্থ জীবন-যাপন করত না।

-আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন যে জেফারসন রিশা উপসাগর তীরে একটা বিশাল অট্টালিকা ভাড়া করেছিল।

উইলকক্স আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? তাহলে তো ও ঠিকানা পরিবর্তন করে সেটা রেজিস্ট্রি করত। না, না। আপনি কি সঠিক জানেন? কোন অট্টালিকা?

–লিমফান-এর বাড়িটা।

-ওঃ। না,না মিঃ ব্রায়ান। ঐ বাড়িটার ভাড়া ব্রিটিশ মুদ্রায় এখন মাসে অন্ততঃ চারশো পাউন্ড। অত পয়সা ওর ছিলনা।

-এখন ঐ বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন মিঃ হ্যারি এনরাইট। ওর বোনকে নিয়ে থাকেন। আমি বললাম। ও মাথা নাড়ল আর ওর চোখে মুখে বেশ উৎফুল্ল ভাব দেখলাম।

–হ্যাঁ আমি জানি। মিঃ এনরাইট তো এক ইংরেজ ভদ্রলোকের কাছ থেকে বাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন। তার নামটা আমার মনে নেই। মিঃ এনরাইট একজন সজ্জন ব্যক্তি। ওর বোনও আমার মনে হয় হংকং-এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয়া মহিলা!

আমার মনে হয় এনরাইট ভাড়া নেবার আগে বাড়িটা খালি ছিল। আমি বললাম।

না না, ওর আগে এক ইংরেজ ভদ্রলোক ছিলেন, আমি শুনেছি।

 –জেফারসনের সঙ্গে চীনা মেয়েটার কি সত্যিই বিয়ে হয়েছিল?

নিশ্চয়ই! এখানেই ওদের বিয়ে হয়েছিল, আপনি চাইলে আমি ওদের ম্যারেজ সার্টিফিকেটের কপি দেখাতে পারি।

–খুব ভাল কথা। ওটা আমি দেখতে চাই।

ও আবার টেলিফোনকরে মিস্ড্যাভেনপোর্ট-কে সার্টিফিকেটটা আনতে বললেন। আমরা ওর আসার-জন্য অপেক্ষা করছি। মিঃ উইলকক্স বলল, মেয়েটাকে আমার স্পষ্ট মনে আছে। ছোট্ট, সুন্দর, কফিন পাঠাবার জন্য সব কাগজপত্র তো আমিই করে দিয়েছিলাম। এটা খুব দুঃখজনক ঘটনা। ওকে সত্যিই দুঃখিত দেখাল। আবার বলল, মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়।

মিস্ ড্যাভেনপোর্ট খুব আস্তে ঘরে ঢুকে সার্টিফিকেটটা দিয়ে তার নিজস্ব মরাল-গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমরা দুজনেই ওর যাওয়ার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। তারপর দুজনের চোখাচোখি হতেই উইলকক্স তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ডেস্কের ওপর দিয়ে আমার দিকে সাটিফিকেটটা বাড়িয়ে দিল।

সাটিফিকেট পরীক্ষা করে দেখলাম একবছর আগে জেফারসনের সঙ্গে জো-অ্যান-এর বিয়ে হয়। বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন ফ্রাংক বেলিং এবং মু-হাই-তন।

–এই ফ্রাংক বেলিং ভদ্রলোক কে? আমি সার্টিফিকেটটা দেখিয়ে উইলকক্সকে প্রশ্ন করলাম।

ও মাথা নেড়ে বলল, জানিনা। হয়তো জেফারসনের কোন বন্ধু হবে। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ইংরেজ। ওদের রেকর্ড আমাদের এখানে থাকে না।

–আর এই মেয়েটা? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

–জো-অ্যান-এর বান্ধবী হয়তো।

 কলমের পেছন দিয়ে ওর পোর্সিলিন-এ বাঁধানো দাঁত ভেতরে ঠেলে দিয়ে একবার আমার দিকে তাকাল। তারপর ঘড়ি দেখল।

ওর কাছ থেকে আর কিছু জানার নেই–এই চিন্তা করে উঠে দাঁড়ালাম।

ধন্যবাদ। আমি আর আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করব না। ও হেসে জানাল যে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে ও খুব খুশী হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হল, আরো খুশী হচ্ছে আমি চলে যাচ্ছি তাই।

দরজার সামনে এসে প্রশ্ন করলাম, আপনার সঙ্গে হেরম্যান জেফারসনের কখনও আলাপ হয়নি?

না। ওর বেশী মেলামেশা ছিল চীনাদের সঙ্গে। আমাদের সঙ্গে ওর কোন মেলামেশা ছিল না।

কনস্যুলেট ভবন থেকে প্যাকার্ড গাড়ির দিকে আসতে আসতে দেখলাম, একটু দূরে উর্দিপরা দুটো পুলিশ একটা ভিখিরী মেয়ে আর একটা রোগা বাচ্চাকে রাস্তার ওপর দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বীপে প্রতি বছর লাখ খানেক রিফিউজি আসছে, তাই এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে এ দৃশ্য কোন দাগ কাটছে না। কিন্তু আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

গাড়িতে গিয়ে বসলাম। এতক্ষণ পর্যন্ত নতুন কি সূত্র পেলাম মনে মনে ভাবতে লাগলাম। তেমন কিছুই নয় তবে আমাকে চীনা মেয়ে মুহাই-তন আর ফ্রাংক বেলিংকে খুঁজে বের করতে হবে আর কথা বলতে হবে।

গাড়ি নিয়ে সেন্ট্রাল পুলিশ স্টেশনে এসে চীফ ইন্সপেক্টর মিঃ ম্যাকার্থীর সঙ্গে কথা বলতে চাওয়াতে আমাকে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হল। তারপর ঢুকতে পেলাম ওর ঘরে। ম্যাকার্থী ওর পাইপ পরিষ্কার করছিল। আমি ঘরে ঢোকাতে ও আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিল। তারপর পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বলল, বলুন এই সকালে আমি আপনার জন্যে কি করতে পারি?

–আমি ফ্রাংক বেলিং নামে একজনকে খুঁজছি। ওকে আমি কিভাবে পাবো বলতে পারেন?

 ম্যাকার্থী পাইপ জ্বেলে আমার দিকে একমুখ ধোয়া ছেড়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল। চোখদুটো সজাগ।

–ফ্রাংক রেলিং? এই ভদ্রলোকের ব্যাপারে আপনি আগ্রহী কেন?

দরকার আছে। হেরম্যান জেফারসনের বিয়েতে ও সাক্ষী ছিল, আপনি ওকে চেনেন?

 হু, চিনি। ও তাহলে হেরম্যানের বিয়েতে সাক্ষী ছিল।

–হুম…। আপনি জানেন ও কোথায় আছে?

–আমি আপনাকে সেটাই জিজ্ঞেস করছিলাম, মনে পড়েছে?

 ও একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আচ্ছা, আচ্ছা। বেলিং-কে ধরার জন্য আমরা খুবই উগ্রীব হয়ে রয়েছি। ও একটা মাদকদ্রব্য চোরাচালান সংস্থার সভ্য। আমরা যখনই ওকে ধরব বলে ঠিক করেছি, ও হাওয়া হয়ে যায়। এখন ও হয় ম্যাকাউ নয় ক্যান্টন-এ পালিয়েছে।

–তাহলে ঐ জায়গাগুলোতে আপনারা খোঁজ করছেন না কেন?

–ম্যাকাউতে করেছি, কিন্তু ক্যান্টনে খোঁজ নেবার মত সুযোগ সুবিধা আমাদের নেই। আমি চেয়ারে একটু আরামকরে বসলাম।

লোকটা কি ইংরেজ?

–হ্যাঁ,…ও একজন ইংরেজ।

 ও যে মাদক দ্রব্য চোরাকারবারীদের সঙ্গে যুক্ত, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। এ মাসের প্রথম তারিখে আমাদের ইনফর্মাররা খবর দিয়েছিল মাল আসছে। বেলিং কয়েক সপ্তাহ আগেও ক্যান্টন থেকে প্রচুর চালান করা হেরোইন এখানে খালাস করার ব্যবস্থা করত। যাই হোক, ইনফরমারের কথানুযায়ী আমরা ওকে ধরার সব ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ও সেটা আগেই জানতে পেরে ক্যান্টন কিংবা ম্যাকাউতে পালিয়ে যায়।

–এ মাসের প্রথম তারিখ…অর্থাৎ জেফারসনের মৃত্যুর দুদিন আগে…।

হতে পারে। আপনি কি এটাকে বিশেষ কোন ঘটনা বলে মনে করছেন?

আমি শুধু যথাসম্ভব প্রয়োজনীয় সংবাদ যোগাড় করে চলেছি। আচ্ছা ওর বিয়ের আর একজন মহিলা সাক্ষী মু-হাই-তন, এর সম্বন্ধে কিছু জানেন?

না। ম্যাকার্থী বলল।

আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে বললাম, এইসব মাদকদ্রব্য চোরাচালানকারীদের সঙ্গে জেফারসনের কোন যোগাযোগ ছিল বলে আপনার কিছু জানা আছে?

থাকতে পারে। বেলিং-এর সঙ্গে যখন ওর বন্ধুত্ব ছিল তখন এই ব্যাপারে জড়িত থাকলেও থাকতে পারে।

–মেয়েটার ব্যাপারে কোন খোঁজখবর দিতে পারেন না?

–দেখবো। রেকর্ড খুঁজে দেখে জানাব। আপনি রিপালস্ বে হোটেলে উঠে গেছেন?

–হ্যাঁ। বেশ আরাম করে বসেই উত্তরটা দিলাম। কিছুটা ঈর্ষান্বিত হয়ে ম্যাকার্থী বলল, এই আপনারা মানে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটররা আছেন ভাল। সব খরচ তো মক্কেলের তাই না?

মৃদু হেসে আমি ম্যাকার্থীর থেকে বিদায় নিলাম। জানিয়ে দিলাম দরকার পড়লে আবার আসব।

কুইনস রোড সেন্ট্রাল-এর ভীড় ঠেলে গাড়ির কাছে এলাম। গাড়ি চালিয়ে সোজা ওয়াঞ্চাই সমুদ্র এলাকায় সেই বার-এ এলাম। যে বারের মাদাম আমার থেকে একগ্লাস দুধ খেতে চেয়েছিল।

বারটা মোটামুটি খালি। কাউন্টারে দুজন ওয়েটারের মধ্যে একজন আমাকে চিনতে পেরে সোনালী দাঁত বের করে এগিয়ে এল।

সুপ্রভাত স্যার। আপনি আবার আসায় খুশী হলাম। পানীয় দেব না লাঞ্চ করবেন?

 রাম আর একটা কোক দাও। আমি বললাম।–মাদাম কোথায়?

 বার-এর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, যেকোন সময় এসে যেতে পারে স্যার?

আমাকে পানীয় দিয়ে গেল। আমি আধঘণ্টা ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। এমন সময় মাদাম ঢুকে কাউন্টার থেকে আমাকে হাত নাড়ল। আমিও হাত নাড়াতে মাদাম আমার সঙ্গে করমর্দন করল এবং বসল।

–আপনাকে আবার দেখে আমি খুশী হলাম। আশা করি সেই মেয়েটা আপনাকে সেদিন আনন্দ দিতে পেরেছে।

আমি তেতো হাসি হাসলাম।

–সেদিন আপনি আমাকে ঠকিয়েছিলেন। আপনি জানতেন মেয়েটা জো-অ্যান ছিল না।

একজন ওয়েটার মাদামের সামনে একগ্লাস দুধ রেখে চলে গেল।

–এটা আমার একটু ভুল হয়ে গেছে। তবে ও তো জো-অ্যানের চেয়েও আকর্ষণীয় ছিল। আমি ভেবেছিলাম এতে আপনি কিছু মনে করবেন না।

–যাক এবার আমি আর একজন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাই। মু-হাই-তন। আপনি তাকে চেনেন?

হঠাৎ ওর মুখ ফ্যাকাশে, ভাবলেশহীন হয়ে গেল। তারপর বলল, এ মেয়েটি সত্যিই খুব ভাল। আপনার খুব পছন্দ হবে।

তবে একটা কথা। ওকে প্রমাণ করতে হবে যে ও মু-হাই-তন। ওকে আমার বিশেষ প্রয়োজন, কিছু কথা আছে।

মাদাম কিছুক্ষণ চিন্তা করল।

–ঠিক আছে। প্রমাণ করবে। আপনি কি এখনই তার সঙ্গে দেখা করতে চান?

না এখনই নয়। আজ রাত আটটার সময় আপনি ওকে এখানে আনতে পারবেন?

মাদাম মাথা নাড়ল।

–শুনুন মাদাম, মেয়েটা যদি সত্যিই মু-হাই-তন হয় এবং আমার সঙ্গে সহয়োগিতা করে তবে আমি আপনাকে পঞ্চাশ হংকং ডলার দেব।

–ঠিক আছে সঠিক মেয়েকেই আপনি পাবেন এবং ও আপনার সঙ্গে সহযোগীতা করবে।

আমি পানীয় শেষ করলাম এবং উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ঠিক, আজ রাত আটটায়। আমি কিন্তু ঠিক জানতে পারব মেয়েটা আসল কিনা। কাজেই আগের বারের মত।…

মাদাম হাসল।

গাড়ি চালিয়ে রিপালস-বে-তে ফিরে এলাম। সারাদিনটা নেহাৎ বৃথা কাটল না।