দ্বিতীয় – নিরুদ্দিষ্টের সন্ধানে
১. stra মানে কি Australia?
পুরো রাস্তাটা যে সবাই মিলে হন্যে হ’য়ে, সব বিপদ-আপদ মাথায় ক’রে, ছুটে বেড়িয়েছেন, সবটাই কিনা মিথ্যেমিথ্যি, শুধু একটা বুনোহাঁসের পেছনে ছোটাই যেন সার হ’লো!
কোথায় দক্ষিণ আমেরিকা, আর কোনখানেই বা মহাদেশ অস্ট্রেলিয়া! কোথায় যেতে গিয়ে কোনখানে! আর সব কি না গুপ্তলিপিটা ভুল প’ড়ে! শুধু বর্ণপরিচয় থাকলেই তো হয় না, সব সংকেতের গোপন অর্থটা বার করবার মতো বুদ্ধি বা এলেমও থাকা চাই! এমনিতেই তো যে-কোনো হেঁয়ালির জট খুলতে চাওয়ার ব্যাপারটাই কঠিন—তার ওপর মুশকিল আসানের এই-যে তিন-তিনটে তলব নানা ভাষায় পাওয়া গেছে তার অনেক হরফই তো জলে ধুয়ে-মুছে উধাও হ’য়ে গেছে! প্রথমত অসম্পূর্ণ শব্দগুলো—(অসম্পূর্ণ তো ছিলো না, জলই তাদের খেয়ে গেছে)—ঠিকঠাক পূরণ করতে হবে, না-হ’লে আর ধরা যাবে কী ক’রে, কাপ্তেন গ্রান্ট সত্যি-সত্যি কোন্ হদিশ দিয়ে সাহায্য চেয়েছিলেন!
মঁসিয় পাঞয়ল অপ্রতিরোধ্য : এত সহজে যদি দমে যাবার পাত্র হ’তেন তাহ’লে এই ক্রমবর্ধমান জগৎটির হাল-হকিকৎ সম্বন্ধে এত-বড়ো একজন বিশারদ তিনি হ’য়ে উঠতেন কী করে? অতএব, আবারও তিনি নতুন করে আদ্যোপান্ত লিখে ফেলেছেন এই ক্রিপ্টোগ্রামের অর্থ, তবে ক্রিপ্টোগ্রামটি হয়তো কোনোকালেই ক্রিপ্টোগ্রাম হ’তে চায়নি, এই বোতলে-ভাসানো চিঠি তো আসলে ছিলো সাহায্য পাবার, উদ্ধার হবার ব্যাকুল অনুরোধ, শুধু জল এসে কিছু কথা মুছে দিয়েছে ব’লেই এখন হয়তো তাকে মনে হচ্ছে ক্রিপ্টোগ্রাম বা গুপ্তলিপি, প্রতিবার নতুন ক’রে অভিনিবেশ দেবার পর মঁসিয় পাঞয়ল প্রতিবারই যার নতুন অর্থ খুঁজে পাচ্ছেন, এ যেন সেই ব্যাসকুট যা বারে বারেই নব-নব তাৎপর্যে ভরে যায়। অতএব, এখন নতুন ক’রে এই ব্যাসকূটের মর্মোদ্ধার করার পর তাঁর হতাশ কিন্তু উৎসুক শ্রোতাদের তিনি নাটকীয় ভঙ্গিতে পুরো জবানটাই— অন্তত তিনি যা ধরতে পেরেছেন—প’ড়ে শোনালেন :
১৮৬২ সালের ৭ জুন গ্লাসগোর ত্রিমাস্তুল রণতরী ব্রিটানিয়া অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে সলিল সমাধি লাভ করেছে। দুজন নাবিক আর কাপ্তেন গ্রান্ট কোনোক্রমে মহাদেশের ডাঙায় গিয়ে উঠেছেন, এবং উঠে প’ড়েই বর্বর ও নিষ্ঠুর আদিবাসীদের পাল্লায় পড়েছেন—এখন তাঁরা তাদের হাতেই বন্দী। এই কাগজটা তাঁরা…দ্রাঘিমা এবং ৩৭°১১ অক্ষাংশে বোতলে ক’রে ভাসিয়ে দিয়েছেন। সেখানে জাহাজডুবি হয়েছে, সেখানে সাহায্য পাঠান।
মেজর ম্যাকন্যাব্স কাজের লোক, অল্পকথার মানুষ। তাঁর জীবনের সারকথা : কথা কম কাজ বেশি। কিন্তু এবার তাঁরও মনে হ’লো যৎকিঞ্চিৎ উচ্চবাচ্য না-করলে আবারও হয়তো আলেয়ার পেছনে ছুটতে হবে। তিনি ব’লে উঠলেন, ‘সবুর! সবুর! একমিনিট। দুম করে একেবারে অস্ট্রেলিয়া যাবার আগে আমাদের বোধহয় আরো-একটু সবকিছু তলিয়ে ভেবে দেখা উচিত। আমরা তো আগের বারে চিরকুটটার ভুল অর্থ করেছিলুম—এবার যে আবার একটা ডাহা ভুল করছি না তা-ই বা কে জানে! এবার বরং আরো হুঁশিয়ার হয়ে আটঘাট বেঁধে আমাদের ঠিক ক’রে নিতে হবে—’
মেজর ম্যাকন্যাব্স তাঁর কথাটা শেষ করতে পারলে তো? তাঁর পাণ্ডিত্যের ওপর কারু কটাক্ষ সহ্য করার পাত্র অন্তত মঁসিয় পাঞয়ল নন। তিনি প্রায় তিড়িংবিড়িং করে জ্ব’লে উঠে তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন : ‘কবুল করি, আগের বার আমার ভুল হয়েছিলো। কিন্তু ভুল তো মানুষমাত্রেই করে—আর সে-ভুল আবার শুধরেও নেয় মানুষই। শুধু যারা হাঁদার হদ্দ, তারাই পুরোনো ভুলটাকে আঁকড়ে ধ’রে থাকে।’
‘উঁহু-উঁহু, আমি মোটেই অত চ’টে যাবার কথা বলিনি।’ কথা বলবেন ব’লে যখন স্থির করেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স তখন তিনি কথাই বলবেন। ‘অতটা মাথাগরম করার মতো কিছুই আমি বলিনি। ৩৭°১১ অক্ষরেখা ঠিক-ঠিক কোন-কোন দেশের ওপর দিয়ে গেছে, আগে বরং সেটাই খতিয়ে দেখা যাক। আমার কথার বিনীত মর্মার্থ ছিলো এটাই।’
‘এই সাঁইত্রিশ ডিগ্রি এগারো মিনিট অক্ষরেখা যেখান দিয়ে গেছে, সেখানে বেশিরভাগ জায়গাতেই আছে জল। জানেনই তো, পৃথিবীতে ডাঙার চাইতে জলের ভাগই অনেক-বেশি। এই-যে, এই দেখুন, দক্ষিণ আমেরিকার পরেই পড়ছে ত্রিস্তান ডা কুনিয়া দ্বীপটা—কিন্তু ধন্ধে ফেলা চিরকুটটায় এই দ্বীপের কোনো নামগন্ধও নেই। ফলে তাকে আপাতত বাদ দেয়া যেতেই পারে। তারপর আসছে ভারত মহাসাগরে ওলন্দাজদের ঘাঁটি—আমস্টারডাম আইল্যান্ডস—তারও কোনো নামগন্ধ নেই এই চিরকুটে। তারপর আমরা পৌঁছে যাচ্ছি সরাসরি অস্ট্রেলিয়াতে—ইংরেজিতে লেখা চিরকুটটায় আছে stra আর ফরাশিতে লেখা চিরকুটটায় আছে austral—এ-দুটোই Australia-র কথা বলছে সেটা বুঝতে মগজে ধূসর পদার্থ বেশি লাগে না।’
‘ততঃকিম্?’
‘অস্ট্রেলিয়ার পর, এই-যে, এই দেখুন নিউ-জিলান্ড–সে মোটেই কোনো মহাদেশ নয়—সাউথ আইল্যান্ড আর নর্থ আইল্যান্ড এই দুইকে মিলিয়েই এই নবসিন্ধুসৈকত গ’ড়ে উঠেছে। কিন্তু তারও তো কোনো উল্লেখই নেই কোনো চিরকুটে।’
‘ঠিক আছে। না-হয় নিউ-জিল্যান্ডকেও বাদ দেয়া গেলো।’
‘তবেই দেখুন—দক্ষিণ আমেরিকা আর নিউ-জিল্যান্ডের মাঝখানে এই অথৈ-সমুদ্রের মাঝখানে ঐ সাঁইত্রিশ ডিগ্রি এগারো মিনিট অক্ষরেখায় পড়ছে কেবল আরেকটা প্রায় খাঁ-খাঁ মরুভূমির মতো দ্বীপ—মারিয়া তেরেসা। কিন্তু এই মারিয়া তেরেসার নামের উল্লেখও তো চিরকুটে কোথাও পাচ্ছি না। তাহলে নিজেরাই ঠিক ক’রে বলুন, কোথায় যাবেন, কোথায় যাওয়া সমীচীন হবে।
‘হুম, তাহ’লে তো দেখা যাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া যাবার তোড়জোড় করাই ভালো।’
অমনি এককথায় সবাই রাজি। ‘বেশ, চলো তবে অস্ট্রেলিয়ায়।’
‘হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া যাওয়াই উচিত, তবে পথে আমস্টারডাম আইল্যান্ডস আর ত্রিস্তান ডা কুনিয়া দ্বীপে জাহাজ ভিড়িয়ে এই খোঁজটা অন্তত নেয়া দরকার ব্রিটানিয়া সে-সব দ্বীপে কখনও থেমেছিলো কি না,’ মেজর ম্যাকন্যাব্সের মাথা কিন্তু সকলের এত উৎসাহ ও উত্তেজনার মধ্যেও দিব্বি ঠাণ্ডা আছে—সত্যি-সত্যি কী করা উচিত, সে-কথাটা এই ভবি সহজে ভোলেন না।
‘সে আর বেশি কথা কী,’ লর্ড গ্লেনারভন বললেন, ‘ঐ দ্বীপগুলো তো পথেই পড়বে—সেখানে জাহাজ ভিড়িয়ে খোঁজখবর নেবার জন্যে আমাদের তো একেবারে অন্য রাস্তায় গিয়ে পড়তে হবে না।’
এবং এই সিদ্ধান্তই মনঃপূত হলো সকলের। এবং ডানকান ছুটলো পুরোদমে, গন্তব্য অস্ট্রেলিয়া হ’লেও অন্য দ্বীপগুলোর বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে হবে তাকে। আর কারুই যেহেতু আর একফোঁটাও তর সইছিলো না, প্রায় একটা নজিরই গ’ড়ে দিলে ডানকান, দশদিনেই পেরিয়ে এলো ২১০০ মাইল—দূর থেকে, দিগন্তে মেঘের মধ্যে ঝাপসা ভেসে উঠলো সমুদ্রতল থেকে সাতহাজার ফিট উঁচু ত্রিস্তান ডা কুনিয়ার গিরিচূড়া।
ত্রিস্তান ডা কুনিয়া দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের কতগুলো দ্বীপ নিয়ে গ’ড়ে উঠেছে, ব্রিটিশ উপনিবেশ সেন্ট হেলেনার সে অংশ, আর সেই সেন্ট হেলেনার রাজধানী হ’লো জেমসটাউন। ত্রিস্তান ডা কুনিয়া নাম থেকেই মালুম হয় এটা এককালে ছিলো পুর্তুগালের উপনিবেশ—কিন্তু সাম্রাজ্য নিয়ে ইওরোপের বিভিন্ন শক্তির মধ্যে যখন খেয়োখেয়ি লেগে গিয়েছিলো, তখন অস্ট্রেলিয়া দখল করার কাছাকাছি সময়েই ইংরেজরা এই দ্বীপগুলো পর্তুগিশদের কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়। হোক-না ছোটো-ছোটো দ্বীপ—দ্বীপ না-বলে বলা ভালো হয়তো সমুদ্রের জল থেকে অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সেই-কবে মাথা তুলে দাঁড়ানো পাহাড়ের চুড়ো, কিন্তু সাম্রাজ্য বানাবার রাক্ষুসে খিদে এই আগ্নেয়গিরির চুড়োগুলোকেই বা খামকা আর-কারু কাছে ছেড়ে দেবে কেন?
এই ছোট্ট গিরিপাহাড়দ্বীপে সচরাচর যেহেতু নেহাৎ বেকাদায় না-পড়লে কোনো জাহাজই ভেড়ে না, তাই ডানকান স্বেচ্ছায়, তার পরিকল্পনামাফিক এখানে এসে তত্ত্বতালাশি নেবে ব’লেই থেমেছে শুনে, এখানকার গবর্নর প্রায় যেন গদ্গদ হ’য়েই খাতির করলেন লর্ড গ্লেনারভনকে। এই ছোট্ট নামকাওয়াস্তে দ্বীপটার এ-মাথা থেকে ও-মাথা অব্দি সবকিছু ঘুরিয়ে দেখালেন তাদের—নৌকোয় ক’রে দ্বীপের চারপাশও ঘুরে-আসা হ’লো, কিন্তু না, মঁসিয় পাঞয়লের আন্দাজই সম্ভবত ঠিক, কাপ্তেন গ্রান্ট বা ব্রিটানিয়ার কোনো খোঁজই পাওয়া গেলো না এখানে।
যখন বোঝা গেলো এখানে ব্রিটানিয়ার খোঁজ পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, তখন সে-রাত্তিরেই দ্বীপ থেকে নোঙর তুললো ডানকান, এবং আবার ভাসলো অথৈ জলে, অকূলপাথারে, পরবর্তী থামবার জায়গা আমস্টারডাম দ্বীপ।
মাঝখানে একবার কয়লা নেবার জন্যে থামতে হয়েছিলো ডানকানকে, কিন্তু সে শুধু কয়লা নেবার জন্যেই—–অন্য কোনো কাজ ছিলো না তার, কোনো শুলুকসন্ধান নেবার কথাও ওঠেনি। আমস্টারডাম দ্বীপগুলোয় পৌঁছুবার আগে অব্দি কোথাও কোনো খবর নেবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অবশ্য এই তথাকথিত আমস্টারডামেও কাউকে কিছু জিগেস করার কোনো মানে নেই। এই ২৯০০ মাইল পাড়ি দেবার পর এই বাহারে নামের দ্বীপটায় পৌঁছে দেখা গেলো, এই একরত্তি ডাঙাকে দ্বীপ না-বলে দ্বীপের কোনো লিলিপুশন সংস্করণ বলাই চলে। কিংবা হয়তো দূর থেকে দেখে কারু ভ্রম হ’তে পারে যে এ বুঝি কোনো তিমিঙ্গিলের পিঠ-জলে গা ভাসিয়ে দিয়ে বুঝি রোদ পোহাচ্ছে। শুধু একটুক্ষণের জন্যেই সেখানে নোঙর ফেলেছিলো ডানকান। কেননা খোঁজখবর নিতে কোনো সময়ই বোধকরি লাগলো না—যেন ঘড়ির কাঁটার মধ্য থেকে কয়েকটা মুহূর্তকে বগলদাবা ক’রে বার ক’রে নিয়ে গিয়েই জিজ্ঞাসাবাদ সারা হ’লো—যেন ঘড়ির কাঁটা তাতে ঘোরেইনি। কেননা দ্বীপের বাসিন্দা বলতে কুললে তিনজন লোক, একজন ফরাশি আর দুজন দোআঁশলা, মুলাটো, কালাআদমি। তিনজনেই এককথায় জানিয়ে দিলে, উঁহু, কই, ব্রিটানিয়া তো কস্মিনকালেও এখানে থামেনি–কিংবা ঐ জাহাজের কেউই দ্বীপে কখনও পা দেয়নি।
উচিত ছিলো, এ-কথা শোনবামাত্র তক্ষুনি ফের নোঙর গোটানো, কিন্তু এবার যেহেতু শেষ-ভরসা অস্ট্রেলিয়াতেই পাড়ি জমাতে হবে, সেইখানেই বোধহয় সব্বাই এখানে একটুথেমে নিয়ে বুকের মধ্যে সাহস আর আশা সঞ্চয় ক’রে নিতে যচ্ছিলো।
তাছাড়া ছিলো-তো, অফুরন্ত আমোদের খনি, জাক পাঞ্চয়লের শ্রীমুখনিঃসৃত অনর্গল বুকনি। মাঝে-মাঝে তথ্য আর কল্পনায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে না-ফেললে জাক পাঞ্চয়লকে হয়তো বলাই যেতো জীবন্ত একখানা বিশ্বকোষ, যে-রকম বিশ্বকোষ প্রণয়নের স্বপ্ন দেখেছিলেন ভোলতেয়াররা। সেই যবে থেকে ইয়ন হার্ট আর জেরার্ড মের্কাটোর নামে দুই ওলন্দাজ চমৎকার বাঁধাই করে মানচিত্রের একটি সংগ্রহ বার করেছিলেন (মঁসিয় পাঞয়লের এমনকী সালতারিখও দিব্বি মনে থাকে—সেটা নাকি ছিলো ১৬৩৬ সাল), তারপর থেকে কতই যে কার্টোগ্রাফার অর্থাৎ মানচিত্রআঁকিয়েরা আসর জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছিলেন। সেই প্রথম সংগ্রহটার মুখপত্রে ছিলো বিশালদেহী অ্যাটলাসের ছবি, গ্রিকপুরাণের সেই দেবতা, যে কাঁধে ক’রে ব’য়ে রেখেছিলো আস্ত পৃথিবীটাই। সেই থেকেই নাকি মানচিত্রের বইয়ের নাম হ’য়ে গেলো অ্যাটলাস। তো, এই অ্যাটলাস সেই সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পরের পর বেরিয়েই চললো; যত-যত লোক ভৌগোলিক অভিযানে বেরিয়েছিলো তাদের আঁকা নকশা দেখে-দেখে কার্টোগ্রাফাররা নিজেদের কেরামতি দেখিয়েই চললেন—কোথায় পাহাড়, কোথায় নদী, কোথায় সাগর, কোথায় ডাঙা, কোথায় আগ্নেয়গিরি আর কোনখানেই-বা মরুভূমি, কোথায় দুর্গম নিবিড় বনানী আর কোথায়ই-বা জনপদ—সব আস্তে-আস্তে যেন লোকের চোখের সামনে খুলে যেতে লাগলো। আস্ত পৃথিবীটাই যেন ক্রমে বড়ো হ’য়ে যেতে লাগলো, বেড়ে যেতে লাগলো—আবিষ্কৃত হ’লো এমনকী আস্ত নতুন মহাদেশও।
মঁসিয় পাঞয়ল যখন কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে এ-সব কথা বলতে শুরু করেন, সবাই তখন তাঁকে ঘিরে বসে হাঁ ক’রে তার কথা শোনে, আর তাঁর জ্ঞানের পরিধি দেখে তাজ্জব হ’য়ে যায়। গত ক-দিন ধ’রে তিনি অস্ট্রেলিয়াকে নিয়েই পড়েছিলেন। কারা-কারা অস্ট্রেলিয়া গিয়েছেন, কোথায় কোথায় পড়েছিলো তাঁদের পদধুলি, কী তাঁরা দেখেছেন আউটব্যাকে—কেননা অস্ট্রেলিয়ায় জনবসতি নাকি শুধুই সমুদ্রের তীর ঘেঁসে, তারপর ভেতরে মাইলের পর মাইল গেছে বিশাল জমি, পাহাড় পর্বত গাছপালা জীবজন্তু সবই নাকি অন্যরকম—আর সেই বিশাল ভিতরদেশকেই—মজার না?—তারা বলে আউটব্যাক—’বাইরে, পেছনে’। এমন কোনো নাম যার মগজ থেকে বেরিয়েছিলো, তার কল্পনার বাহাদুরি ছিলো মানতেই হয়। মঁসিয় পাঞয়ল যখন একে-একে অভিযানকারীদের নাম বলতে লাগলেন, নির্ভুল সালতারিখ শুদ্ধু, তখন ঐ ছিটগ্রস্ত পণ্ডিতের ওপর বেশ সম্ভ্রমই বোধ হ’তে থাকে সকলের। অস্ট্রেলিয়ার কিছুই নয় ইওরোপের মতো—’কিছুই নয়’ মানে তার গাছপালা জীবজন্তু সবই অন্যরকম, এমনকী দক্ষিণ গোলার্ধে ব’লে তার আকাশটা অন্যরকম, উলটোরকম, তারাগুলো আকাশের পটে যেন ঠিক উলটে দিয়েছে কেউ, এমনকী উলটে দিয়েছে ঋতুগুলোকেও। ইওরোপে যখন হি-হি হিম শীত, সেখানে তখন বিকট দমবন্ধ করা গরম। ফলে বড়োদিনে যখন ইওরোপ গান গায় হোয়াইট ক্রিসমাসের, বরফে ঢাকা প্রান্তরের ওপর দিয়ে স্লেজে ক’রে আসছে সান্তা ক্লস, বা সন্ত নিকলাউস, তখন গরমে এখানকার লোকের প্রাণ আইঢাই যাই-যাই, বেচারা সান্তা ক্লস তার গরম জামাকাপড় খুলে হাঁসফাস করতে-করতে যেন দরদর ক’রে ঘামে।
সান্তা ক্লসের দুর্দশাটা এমন মজার ভাবে বর্ণনা করেন জাক পাঞ্চয়ল যে রবার্ট আর মেরি তো হেসেই কুটিপাটি, অন্যরাও মুচকি-মুচকি হাসেন বটে, আর এতে একদিক থেকে ভালোই হয়—ছেলেমেয়েরা অন্তত সাময়িকভাবে ভুলে যায় কেন তারা এই অভিযানে বেরিয়েছে, কাপ্তেন গ্রান্টের কথাটা তখন যেন মনের কোনো চিলতে খুপরিতে অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
কিন্তু এত-সবের মধ্যেও চিরকুটটাকে নিয়ে প্রায়ই মাথা খাটায় সবাই মিলে। সত্যি কি মর্মোদ্ধার করা গেছে এই আর্তোদ্ধারের আহ্বানের—চিরকুটগুলো নিয়ে যত বসা যায় ততই মনে হয় সেগুলো যেন গভীর, গভীরতর রহস্যে ভ’রে যাচ্ছে, ধাঁধাটা যেন এমন জটপাকানো যে তার ভেতর বুঝি সহজে কোনো আলো ফেলাই যাবে না। যেমন, এই যে খটকাটা জেগেছে, তার উত্তরটা কী? পেরুর উপকূল ছেড়ে বেরুবার পর এক-সপ্তাহের মধ্যেই জুনমাসের সাত তারিখে কি ব্রিটানিয়া ভারত মহাসাগরে গিয়ে পৌঁছুতে পারে?
খোদ পাঞয়লও সবজান্তা হ’য়েও কেমন-একটা ধাঁধার মধ্যে প’ড়ে গিয়েছিলেন। একদিন তাই সরাসরি কাপ্তেন জন ম্যাঙ্গল্সকেই তিনি জিগেস ক’রে বসলেন, ‘আমরা যে-সমুদ্রপথ দিয়ে যাচ্ছি সেই সমুদ্র দিয়ে কি কোনো জাহাজ একমাসেই গিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছুতে পারে?’
‘দেখতে হবে জাহাজের এনজিনের জোর কতটা—কত অশ্বশক্তি আছে,’ বুঝি প্রায় না-ভেবেই উত্তর দিয়েছেন কাপ্তেন, ‘দিনরাত একটানা যদি চলে, চব্বিশ ঘন্টায় যদি দশমাইল পথ পেরুতে পারে, তবে একমাসেই অস্ট্রেলিয়া পৌঁছে যেতে পারে বৈ কি!’
‘তাহ’লে চিরকুটগুলোয় নিশ্চয়ই 7 তারিখের আগে 1 অথবা 2 ছিলো—জল লেগে মুছে গিয়েছে। তার মানে, আমি বলতে চাচ্ছি, কাপ্তেন গ্রান্ট সম্ভবত 17 অথবা 27 তারিখ গিয়ে পৌঁছেছিলেন ভারত মহাসাগরে।’
‘হুম, এটা হ’লেও হ’তে পারে। এই সম্ভাবনাটার কথা মোটেই উড়িয়ে দেয়া যায় না,’ কমকথার মানুষ মেজর ম্যাকন্যাব্স-এর মুখ থেকে আজকাল যে নানারকম সদুক্তিকর্ণামৃত বেরোয়, এই মন্তব্যটা তারই আরেকটা নজির।
জাক পাঞ্চয়ল অমনি সবজান্তার ভূমিকায় পুনর্বার অবতীর্ণ হলেন। মাঝখানে যে একটা প্রশ্ন ক’রে তিনি এমন দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন যে এমনকী তাঁরও সবকিছু জানা নেই, সম্ভবত সেই ঘাটতিটা পুষিয়ে নেবার জন্যেই বোধকরি। এমন-সব সারগর্ভ উক্তি ক’রে চললেন পর-পর, তাতে তাঁর জ্ঞানের বহর দেখে সব্বাই প্রায় কুপোকাৎ। কেমন, যেন একটা হীনম্মন্যতারই বোধ জেগে ওঠে, যদি দেখা যায় আরেকজন-কেউ——মানুষই তো বটে—একটা স্বয়ংচল স্বয়ংক্রিয় বিশ্বকোষই হ’য়ে উঠেছে।
শেষটায় মেজর ম্যাকন্যাব্স আর তুবড়ির মতো ছোটা জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা সহ্য করতে না-পেরে হেসেই যদিও কথাটা বললেন বটে, তবু তার মধ্যে দিয়ে একটু জাতিবিদ্বেষ ফুটে বেরুলো বৈকি। ফরাশি সেনাদের ধরাচুড়ো পরার পর অনেকটা ব্যাঙের মতো দেখায়, সেইজন্যেই কি তাদের ফ্রস বা ব্যাঙ বলে? নাকি ব্যাঙের ঠ্যাঙ তাদের একটা মুখরোচক খাদ্য ব’লেই তাদের ফ্রগ্বলে? তার উত্তর অবিশ্যি মেজর ম্যাকন্যাব্স নিজেই জানেন না। কিন্তু একবার যখন পাঞয়লের কথার তোড় একটু ক’মে এসেছে, তিনি ফাঁক বুঝে, তাঁকে খানিকটা তাতিয়ে দেবার জন্যেই হয়তো, জিগেস ক’রে বসলেন, ‘আচ্ছা, মঁসিয় পাঞয়ল, এটা কি আপনি বলতে পারবেন অস্ট্রেলিয়ায় কেন ফরাশিদের এত রমরমা? ইংরেজরা কেন ফরাশিদের হাতেই দখলদারি ছেড়ে দিয়ে এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে সটকে পড়েছে?’
পাঞয়ল বুঝি আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে একটু অপ্রস্তুতই বোধ করেছেন। থতমত খেয়ে বলেছেন : ‘কেন?’
‘অস্ট্রেলিয়ার ব্যাঙের ডাক শুনে ভয়ে আঁৎকে উঠে ইংরেজ কাপ্তেনরা জাহাজ নিয়ে চম্পট দিয়েছিলেন ব’লে—আর-ককখনও অনেকদিন ওমুখো হয়নি। সেই-ফাঁকে ঐ ব্যাঙের লোভেই ফরাশিরা, তাদের স্বজাতির খোঁজে এসে, এখানে বেশ জম্পেশ করে জমিয়ে বসেছে।’
হেসে ফেলেছেন জাক পাঞ্চয়ল, তবে একটু আপত্তি জানাতেও ছাড়েননি। ইংরেজরা না-হয় চারপাশে সাম্রাজ্য ছড়িয়ে ব’সে অন্যসব লোকদের সম্বন্ধেই নাক শিটকোয়, তাদের আর মানুষ বলেই মনে করে না। কিন্তু আপনি তো স্কট, হাইল্যান্ডের লোক, তাদের দেখাদেখি আপনি কেন আমাদের ফ্রগ বলবেন-আমরা ফরাশিরাও কিন্তু খুব-একটা কুয়োর ব্যাঙ নই—আমরাও পৃথিবীর নানান মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছি।’
জ্ঞান বিতরণের ফাঁকে-ফাঁকেই, মওকা পেলেই, মেজর ম্যাকন্যাব্স তাঁকে একটু তাতিয়ে না-দিয়ে উসকে না-তুলে ছাড়তেন না। একঘেয়ে সমুদ্রযাত্রায় এ-সব আড্ডায় বরং একঘেয়ে জল দেখে-দেখে বিকল চিত্ত অন্য কোনো বিষয়ে কথাকাটাকাটি শুরু ক’রে দিতে পারে। তাছাড়া মেরি আর রবার্ট যেভাবে মনমরা হ’য়ে আছে, তাতে তাদেরও এতে কথঞ্চিৎ দুর্ভাবনা বা হতাশা থেকে মুক্তি দেয়া যায়। যতদিন তারা জানতো যে কাপ্তেন গ্রান্ট-এর কোনো হদিশ নেই, মারাই পড়েছেন বুঝি-বা, তারা একরকম ক’রে এই দুর্ভাগ্যের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিলো। এখন, যখন আবার কাপ্তেন গ্রান্ট-এর হদিশ পাবার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তিনি যে বেঁচে আছেন এমন-একটা সম্ভাবনা যে আর নিছকই কল্পনার স্তরেই সীমাবদ্ধ হ’য়ে নেই, অথচ তবু তিনি যে কোথায় আছেন সত্যি-সত্যি, এবং কীভাবে আছেন, তার কিছুই জানা যাচ্ছে না, তখনই বরং আশা-নিরাশার দোলায় তাদের মন অনবরত পেণ্ডুলামের মতো দোল খেয়ে যাচ্ছে।
তারপরেই, বিশে ডিসেম্বর, কেপ বার্নউইলিতে গিয়ে পৌঁছুলো ডানকান। এতদিন কেটে গিয়েছে, দু-দুটো বছর তো বটেই, এর মধ্যে ব্রিটানিয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ নিশ্চয়ই এখন আর এখানে প’ড়ে নেই। সব লুঠপাট হ’য়েই গেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তবু তো খোঁজখবর কিছু নিতেই হয়। এতদিন নিরুদ্দিষ্টের সন্ধানে তাঁরা কত-কত জায়গায় ছুঁড়ে বেরিয়েছেন, কোনো খবরই পাননি—এখানে ভাঙাচোরা ব্রিটানিয়াকে পাওয়া যাক বা না-যাক, হয়তো লোকমুখে কিছু-একটা খবর পাওয়া যাবে। আর শেষ অব্দি এখানেও যদি কোনো খোঁজ না-মেলে, তাহলে না-হয় ফের ইওরোপেই ফিরে যাবে ডানকান। কেননা ব্রিটানিয়া এখানকার দরিয়ায় না-ডুবে যদি অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে কোথাও সলিলসমাধি লাভ করে থাকে—মঁসিয় জাক পাঞ্চয়লের সুচিন্তিত অভিমত—তাহ’লে কাপ্তেন গ্রান্ট নিশ্চয়ই অনেক আগেই ইওরোপে ফিরে যেতেন। পূর্ব অস্ট্রেলিয়ায় ইংরেজদের উপনিবেশ বেশ জাঁকিয়েই বসেছে, সেখান থেকে ইওরোপ ফিরে যাবার জাহাজও যাতায়াত করে হরদম, ফলে কাপ্তেন গ্রান্টের পক্ষে কোনো-একটা জাহাজে উঠে-পড়া খুবই সম্ভব। বরং যখন ডানকান যেখানে এসে পৌঁছেছে, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায়, সেখানে এখনও কোনো বড়ো বসতি গ’ড়ে ওঠেনি, আউটব্যাক শুরু হয়েছে প্রায় সমুদ্রতীর থেকে একটু-ভিতরে গিয়েই, আর এই আউটব্যাকে খাঁ-খাঁ করছে রুক্ষ উষর তপ্তবালির মরুভূমি।
অনেক ঝক্কিঝামেলা পুইয়ে ডাঙায় নেমেই দেখা গেলো দূরে একটা উইন্ডমিলের চাকা হাওয়ায় অনবরত পাক খেয়ে যাচ্ছে। উইণ্ডমিল আছে—অর্থাৎ এখানে লোকজনও আছে আশপাশে কোথাও, নিশ্চয়ই ছোটোখাটো হ’লেও চাষ-আবাদের কোনো-একটা ব্যবস্থা আছে। আর, সত্যি তা-ই, একটু এগুতেই দেখা গেলো খানকয়েক বাড়ি একটা জায়গায় যেন জটলা পাকাচ্ছে, সামনেই সবুজ মাঠ, সেখানে গোরু-ভেড়া চরছে, ঘোড়াও আছে, কাছেই যে খেতখামারের ব্যবস্থা আছে, তারই চিহ্ন হিশেবে আছে একটা গোলাবাড়িও।
এঁদের এগুতে দেখে, সবচেয়ে বড়োবাড়িটা থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলেন একজন প্রৌঢ়, বিশাল দশাসই চেহারা—এত বয়েস হাওয়া সত্ত্বেও কোথাও বয়সের কোনো ছাপ পড়েনি। তাঁর পেছনে ঘেউ-ঘেউ করতে-করতে ছুটে এসেছে চারটে তাগড়াই কুকুর। প্রৌঢ়ের সঙ্গে-সঙ্গে আরো বেরিয়ে এসেছে চারজন বলিষ্ঠ তরুণ, লাল চুলের ঢল নেমেছে তাদের মাথায়, যেন আগুনের শিখা জ্ব’লে উঠেছে ঐ ঝাঁকড়াচুলে। নিশ্চয়ই আয়ারল্যান্ডের মানুষ, ইংরেজদের অত্যাচারে দেশে তিষ্ঠোতে না-পেরে অজানায় ঝাঁপ খেয়ে ভাসতে ভাসতে শেষকালে এরা সবাই এই পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতেই এসে পৌঁছেছে।
প্রৌঢ় সরাসরি তাঁদের সামনে এসে এগিয়ে এলেন। বললেন : ‘স্বাগতম্। ওয়েলকাম—প্যাডি ও মুরের বাড়িতে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাই।’
‘আপনি—?‘
‘হ্যাঁ, আমি আয়ারল্যান্ডেরই লোক। যা অবস্থা, তাতে দেশে থাকলে কবেই না-খেতে পেয়ে মারা যেতুম, এখানে এসে চাষ-আবাদ ক’রে মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যেই আছি। আসুন, ভেতরে আসুন সবাই—তারপর ভালো ক’রে আলাপ করা যাবে। কতকাল যে এখানে বাইরের লোকের পা পড়েনি—মাঝে-মাঝে একেবারে হাঁপ ধরে যায়।’
প্রৌঢ় তাদের নিয়ে গেলেন মস্ত-একটা ঘরে, যার মাঝখানে রয়েছে বিশাল-একটা টেবিল, বাসনকোশন খাবারদাবার দেখে মালুম হ’লো এটাই এই খামারের ডাইনিং হল। বোঝাই গেলো, সবাইকে নিয়ে প্রৌঢ় খেতে বসছিলেন, এবার অভ্যাগতদেরও তাঁদের সঙ্গেই বসিয়ে দিলেন খাবারটেবিলে। তারপর মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনাদের অপেক্ষাতেই ছিলুম।’
‘আমাদের অপেক্ষায়?’ বিস্ময়ে লর্ড গ্লেনারভনের বুঝি বাক্স্ফুর্তিই হ’তে চাচ্ছিলো না।
‘রোজই অতিথিদের অপেক্ষা করি কিনা—যদি কেউ দৈবাৎ পথভুল ক’রে এখানে এসে পড়ে। আমার দরজা সারাবছর ঐ অনাগত অতিথিদের জন্যে খোলা থাকে। অবশেষে এখন, যা-হোক, আপনারা এসে পৌঁছেছেন।’
নির্জনবাসের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই লর্ড গ্লেনারভনের। কিন্তু এ-কথা থেকে এটুকুই শুধু বুঝতে পারলেন যে, সারাদিন না-হয় খেটেখুটে কাজে-কর্মে কাটিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু অবসর সময়ে দুটো কথা কইতে না-পারলে পেট ফেঁপে যায়, বুঝি দম আটকেই যায়, গলার কাছে এত কথা জমে থাকে। ড্যানিয়েল ডি-ফো রবিনসন ক্রুসো-র গল্পটা বোধহয় ফেঁদেছিলেন জাহাজডোবা নাবিক আলেকজান্ডার সেলকার্ককে নিয়ে—কিন্তু ফ্রাইডে যদি না-আসতো তাহলে একদিন একা থাকতে-থাকতে ক্রুসোর দশা যে কী হ’তো, সেটা ভাবতেই বুক শুকিয়ে যায়।
প্যাডি ও মুর—সেটাই তো এই দিলদরিয়া প্রৌঢ়র নাম, তা-ই না?—অ্যাদ্দিন বাদে অচেনা-কারু সঙ্গে কথা বলতে পেরে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন, কথার যেন ফুলঝরি ছুটছে। খেতে-খেতেই নিজের কাহন শোনালেন সাত-সতেরো তারপর একসময় শুনলেন গ্লেনারভনদের সাগরপাড়ির পেছনকার কাহিনিটা। সারা আমেরিকা ছুঁড়ে বেরিয়েও এখনও তাঁরা কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো সন্ধান পাননি—যেন মরীচিকার পেছনে ছুটেছেন—এবারে এই অস্ট্রেলিয়াতেও ব্রিটানিয়ার কোনো হদিশ না-পেলে, বাধ্য হ’য়ে, শেষটায় এই বেচারা ছেলেমেয়ে দুটিকে নিয়ে ঘরের ছেলেকে ঘরেই ফিরে যেতে হবে।
লর্ড গ্লেনারভন যেমনভাবে কাপ্তেন গ্রান্টের কাহিনীটা ফেঁদেছিলেন, তাতে তা সকলেরই মর্মস্পর্শ করেছিলো। শুনতে-শুনতে কখন যে সবাই কাঁটাচামচে নাড়ানো বন্ধ ক’রে স্তব্ধ হ’য়ে এই করুণ কাহিনীতে মগ্ন হ’য়ে পড়েছিলো, তা কেউই খেয়াল করেনি। হঠাৎ চমক ভাঙলো কার কথায়, স্তব্ধতার জন্যেই সম্ভবত অতর্কিত কথাগুলোকে ঠিক দৈববাণীর মতো শোনালো :
‘কাপ্তেন গ্রান্ট যদি এখনও বেঁচে থাকেন, তবে অস্ট্রেলিয়াতেই আছেন!’
২. আকাশবাণী এবং আয়ারটন
যেন বিদ্যুৎ স্পর্শ করেছে, এমনিভাবে ঝাঁকুনি খেয়ে লাফিয়ে উঠলেন লর্ড এডওয়ার্ড।
‘কে? কে এ-কথা বললে?’
‘আমি,’ টেবিলের ওপাশ থেকে শান্ত ধীরগলায় জবাব দিলে প্যাডি ও মুর-এরই এক সাগরেদ।
আর তার দিকে তাকিয়ে এবার তাজ্জব হওয়ার পালা খোদ প্যাডি ও’মুর-এরই। ‘তুমি? আয়ারটন?’
হ্যাঁ। এঁদের মতো আমিও হাইল্যান্ডার—স্কটল্যান্ডেরই মানুষ। ব্রিটানিয়া জাহাজে আমিও ছিলুম।’
এটা যেন দ্বিতীয়-আরেকটা বজ্রাঘাত।
কী বলছে এই লোকটা, এই-যাকে আয়ারটন ব’লে সম্বোধন করেছেন প্যাডি ও মুর? ব্রিটানিয়া-য় ছিলো এ? কাপ্তেন গ্রান্টের সঙ্গে?
মেরি প্রায় যেন মূর্ছাই যাবে!
জন ম্যাঙ্গল্স, জাক পাঞ্চয়ল, রবার্ট গ্রান্ট—সবাই ততক্ষণে যে-যার চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে এসে ঘিরে ধরেছেন আয়ারটনকে।
রুক্ষ, হট্টাকট্টা চেহারা আয়ারটনের, অনেকদিন সমুদ্রে ঘুরে বেড়াবার জন্যেই বোধ, করি লোনা হাওয়ায় রোদে-জলে গায়ের রঙ প্রায়-তামাটে। ঘন জোড়াভুরু, ঝোপের মতো ঢেকে রেখেছে তার তীব্র দুটি চোখকে। দড়ির মতো পাকানো—কিন্তু কঠিন জোয়ান নাবিকশরীরে পেশী ছাড়া যেন আর-কিছুই নেই—মেদবর্জিত বাহুল্যবর্জিত ঋজু শরীর। লম্বা তেমন নয়, কিন্তু প্রকাণ্ড চওড়া কাঁধ, বলিষ্ঠ, ক্ষিপ্র, তেজিয়ান। মুখের মধ্যে একটা বেপরোয়া দুঃসাহসী তেজের ছাপ।
‘তুমি ছিলে ব্রিটানিয়ায়?’ লর্ড এডওয়ার্ডের গলার স্বরে একইসঙ্গে যেন বিস্ময়, অবিশ্বাস, আর হঠাৎ-মাথা-চাড়া-দেয়া একটা আশার ভাব।
‘আমি ছিলাম কোয়ার্টারমাস্টার–আমার ওপরই ভার ছিলো হালের, সিগন্যালের, সারেঙের —’
‘জাহাজডুবির পর তুমিও কি কাপ্তেন গ্রান্টের সঙ্গে গিয়ে ডাঙায় উঠেছিলে?’
‘না, আমি হঠাৎ এক প্রচণ্ড ধাক্কায় ডেক থেকে ছিটকে প’ড়ে যাই জলে- ‘আমরা যে-চিরকুট পেয়েছি তাতে দুজন নাবিকের কথা লেখা আছে। তুমি তাহ’লে সে-দুজনের কেউ নও?’
‘না। কিন্তু কোন-চিরকুটের কথা বলছেন? আমি তো কোনো চিরকুটের কথা জানি না। আমি ভেবেছিলাম, আর-সকলের সাথে কাপ্তেন গ্রান্টেরও বুঝি সলিলসমাধি হয়েছে, শুধু আমি একাই কোনোমতে প্রাণে বাঁচতে পেরেছি—’
‘কিন্তু তুমি তো নিজেই এইমাত্র বললে যে কাপ্তেন গ্রান্ট বেঁচে আছেন—’
‘তা তো বলিনি। বলেছি, কাপ্তেন গ্রান্ট যদি এখনও বেঁচে থাকেন—’
‘বলেছো, তবে তিনি অস্ট্রেলিয়াতেই আছেন!
‘হ্যাঁ। বেঁচে গিয়ে থাকলে এখানেই কোথাও তিনি আছেন।’
এতক্ষণে, ফাঁক পেয়ে, মেজর ম্যাকন্যাব্স আসল প্রশ্নটা করলেন। ‘ব্রিটানিয়া ঠিক কোনখানে ডুবেছিলো?’
আসলে প্রথম প্রশ্নটা এইটেই হওয়া উচিত ছিলো। উত্তেজনায় সব তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিলো লর্ড এডওয়ার্ডের, তাই এতক্ষণ তিনি উলটোপালটা নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন—তিনি এখনও ঠিক বিশ্বাস ক’রে উঠতে পারেননি যে কাপ্তেন গ্রান্টের সঙ্গে ব্রিটানিয়া জাহাজের সেই কপালমন্দ-পাড়িতে ছিলো, এমন-কারু সঙ্গে সত্যি তাঁদের দেখা হয়েছে।
‘অস্ট্রেলিয়ার কাছেই, প্রায় তীরে এসে। প্রকাণ্ড একটা ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজ থেকে আমি ছিটকে প’ড়ে যাই। জাহাজ নিশ্চয়ই তারপরেই ডুবেছে।’
এবার জন ম্যাঙ্গসের আরো-একখানা মোক্ষম প্রশ্ন, এ যদি সত্যি ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার হ’য়ে থাকে তবে এ-প্রশ্নের উত্তর তার জানা উচিত। ‘কত অক্ষরেখায়?’
‘সাঁইত্রিশ ডিগ্রি—’
‘পশ্চিম উপকূলে?’
‘না, পূর্ব উপকূলে।’
যেমন দুমদাম ক’রে প্রশ্ন আসছে, তেমনি দুমদাম ক’রে আয়ারটন উত্তর দিচ্ছে! উত্তর দিতে একমুহূর্তও দেরি হচ্ছে না তার, একটুও দ্বিধা বা দোনোমনার ভাবও নেই।
‘সেটা কত তারিখ ছিলো?’
‘১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে সাতুই জুন—রাতের বেলায়, সেইজন্যেই জলে ছিটকে পড়ার পর গোড়ায় আমি অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাইনি—তা ছাড়া সমুদ্রেও খ্যাপা তাণ্ডব চলছিলো, বড়ো-বড়ো সব ঢেউ, ঢেউয়ের সঙ্গে যুঝতে গিয়ে একেবারে জেরবার হ’য়ে যাচ্ছিলাম – ‘
কিন্তু তার স্মৃতিচারণ থামিয়ে দিয়ে ততক্ষণে লর্ড এডওয়ার্ড ব’লে উঠেছেন, তারিখ তো মিলে যাচ্ছে!’ এতক্ষণে তাঁর গলায় হর্ষের একটু আভাস এসেছে।
জেরা চললো, তারপরেও, অনেকক্ষণ। কত-যে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলো আয়ারটন, গলার সুরে দ্বিধা নেই, চোখের পাতা কাঁপেনি, ককখনও একটু থতমতও খায়নি।
আর যতক্ষণ ধ’রে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছে, সারাক্ষণ প্রায়-পলকহীন চোখে তারই দিকে তাকিয়ে থেকেছে মেরি। এতদিনে বুঝি একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে—বুঝি অবশেষে বাবার সঙ্গে আবার তার দেখা হবে—প্রায় মৃত্যুর মধ্য থেকে ল্যাজারাসের মতো অন্ধকার ফুঁড়ে এবার উঠে আসবেন কাপ্তেন গ্রান্ট। ব্রিটানিয়ার একজনের খোঁজ যখন পাওয়া গেছে, তখন অন্যদেরও দেখা মিলতে আর কি বেশি দেরি হতে পারে?
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স আর মেজর ম্যাকন্যাব্স কিন্তু এত-সহজে কোনো অভাবিত উটকো দাবি মেনে নিতে রাজি নন। বিশেষত, সমুদ্রে-যারা-ঘুরে-বেড়ায় তারাই জানে অনেক ভাগ্যান্বেষী ফেরেব্বাজ চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কানাঘুষোয় তারা শুনতে পায় কোথায় কোন জাহাজডুবি হয়েছে, তারপর জাহাজের মালিক বা জাহাজের কাপ্তেনের বাড়ির লোকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে সাতকাহন ফেঁদে এ-ধরনের লোক তাদের নিংড়ে টাকাকড়ি বার করে নেবার চেষ্টা ক’রে থাকে। বিশ্বাসপ্রবণ লোকদের ঠকাবার জন্যে কত লোকই যে ওৎ পেতে থাকে—এ যেন ঝোপে-ঝোপে সব নেকড়ে, উৎপাত বাধাবার জন্যে সবসময়েই প্রস্তুত। ফলে কাপ্তেন আর মেজর আরো-নানা কথা জিগেস ক’রে জেনে নিতে চাচ্ছিলেন, এই আয়ারটন যা-যা বলছে, সে-সব কথা ঠিক কি না। না-যাচাই ক’রে, না-বাজিয়ে নিয়ে চোখবুজে অনায়াসে সবকিছু বিশ্বাস ক’রে নেয়া চলে না। বিশেষত তাঁরা দুজনেই এইদলের মধ্যে সবচেয়ে সন্দেহপ্রবণ, সবচেয়ে পোড়খাওয়া লোক। এটা অন্তত তাঁদের জানতে বাকি নেই যে সমুদ্রের ধারে বাতাসে যে-সব কথা ভেসে বেড়ায় তাতে সালতারিখ মিলিয়ে কাউকে ধাপ্পা দেয়া খুবই সহজ কাজ।
কিন্তু আয়ারটন যখন ব্রিটানিয়ার এই এতবড়ো সাগরপাড়ি দেবার আগেকার ঘটনা নির্ভুলভাবে সব ব’লে গেলো, তাঁদের সন্দেহও আস্তে-আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগলো। তার কথা ধেকে এও বোঝা গেলো যে মেরি আর রবার্টকেও সে চেনে এইটুকু বয়েস থেকেই
একবার রবার্টের বয়েস তখন মাত্র দশ হবে—শেরিফকে নিয়ে একটা আপ্যায়নসভার আয়োজন হয়েছিলো জাহাজের ডেকে, ধুমধাম করে ভোজসভা এসেছিলো, এমন সময়ে হঠাৎ রব উঠেছিলো রবার্টকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না—তারপর অনেক খুঁজে দেখা গেলো সে মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে, সাল আঁকড়ে ধরে ল্যাগব্যাগ ক’রে দোল খাচ্ছে শূন্যে।
অমনি রবার্ট সায় দিয়ে উঠলো, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই হয়েছিলো। কিন্তু সে-তো কবেকার কথা। তখন আমি ভারি দুষ্টু আর দুরন্ত ছিলুম!’ এমন ভঙ্গি ক’রে কথাটা সে বললে যেন এখন আর সে অমনতর ডানপিটেটি আর নেই।
এ-রকম একটা নয়, পর-পর অনেকগুলো ছোটোখাটো গল্পই বলে গেলো আয়ারটন। মেরি চোখ গোল-গোল করে হাঁ করে সব কথা শুনছে, আর যতই বাবার কথা শুনছে ততই যেন চোখের কোল ভিজে উঠছে তার। সে প্রায় ধরাগলাতেই জিগেস করলে তার বাবার কথা।
আয়ারটন বললে কাপ্তেন গ্রান্টের নাকি পরিকল্পনা ছিলো পাপুয়া-নিউগিনির পশ্চিম উপকলে একটা নয়া উপনিবেশের পত্তনি করবেন, তার নাম দেবেন নিউস্কটল্যান্ড, ওলন্দাজরা যেমন কতগুলো দ্বীপের নাম দিয়েছিলো নিউ-আমস্টারডাম। সেবার কাইয়াও পেরিয়ে ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে তিনি ইওরোপ ফিরছিলেন—এমন সময় হঠাৎ আকাশ কালো ক’রে জমলো ঘন মেঘ, আর তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুরন্ত ঘূর্ণিহাওয়া। ঝড়টা যেমন প্রচণ্ড ছিলো, তেমনি এসেছিলোও আচম্বিতে, অতর্কিতে। এমন দুর্যোগ তা এত বছরের নাবিক জীবনেও আয়ারটন আগে আর-কখনও দ্যাখেনি। ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃষ্টিও নেমেছিলো মুষলধারে—কেউ যেন আকাশ থেকে অবিশ্রাম পিপে-পিপে জল ঢেলে দিচ্ছিলো। দেখতে-না-দেখতে জাহাজের খোলে পর্যন্ত গিয়ে জল ঢুকলো, এতটাই যে জাহাজটা কাৎ হ’য়ে প্রায় বুঝি ডুবেই যায়। এরই মধ্যে প্রায়-ডুবুডুবু জাহাজ নিয়েই যেন ধুঁকতে ধুঁকতে এগুচ্ছিলো ব্রিটানিয়া, আর বাইশে জুন সেই দুর্যোগের মধ্যেই দূর থেকে আবছা দেখা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার উপকূল। যখন সবাই ভাবছে এবার বুঝি কোনোরকমে জাহাজটাকে নিরাপদে নিয়ে গিয়ে তীরে ভেড়ানো যাবে, তখন একটা চোরা ডুবোপাহাড়ে ঘা লেগে থরথর করে কেঁপে উঠেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো ব্রিটানিয়া। সেই-তখনই ঐ অতর্কিত ঝাঁকুনিতে আর ঢেউয়ের ঝাপটায় আয়ারটন ছিটকে পড়েছিলো জাহাজ থেকে। তারপর থেকে কাপ্তেন গ্রান্ট বা ব্রিটানিয়ার আর-কোনো খবরই পায়নি সে। ধ’রে নিয়েছিলো, সেখানেই অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব-উপকূলের কাছেই ব্রিটানিয়া ডুবে গিয়েছে— সেই দুর্যোগের মধ্যে আর-কেউই আত্মরক্ষা করতে পারেনি। কিন্তু এখন বাবার টেবিলের কথাবার্তা থেকে সে বুঝতে পেরেছে যে, কাপ্তেন গ্রান্ট দুজন সঙ্গীসমেত বেঁচে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর অবস্থা এখন মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর–কেননা তাঁদের পাকড়েছে বুনো আদিবাসীরা, জংলিরা—কথা শুনে সে বুঝতে পেরেছে যে কোনোরকমে একটা বোতলে নিজেদের দুরবস্থার কথা চিরকুটে লিখে কাপ্তেন গ্রান্ট বোতলটা জলে ভাসিয়ে দিয়েছেন।
আয়ারটন নিজেও তীরে ভেসে এসে জংলিদের হাতে ধরা পড়েছিলো। তারা তাকে পাকড়ে গভীর দুর্ভেদ্য জঙ্গলের মধ্যে আটকে রেখেছিলো—তার ওপরে নাকি তারা অকথ্য অত্যাচার করেছে, সে-সব নির্যাতনের চিহ্ন এখনও আছে তার শরীরে। সেখানে দু-বছর বিস্তর দুর্ভোগ পোহাবার পর সে কোনোরকমে প্রাণ হাতে ক’রে পালায়—কেমন ক’রে সে প্রাণে বেঁচেছে, হাজারো বিপদ উপেক্ষা ক’রে এতদূর পথ পাড়ি দিয়েছে সে-ও প্রায়-এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর কাহিনী। মাত্র দু-মাস হলো, এখানে প্যাডি ও মুরের খামারে কাজ পেয়ে সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে—এখন অন্তত প্রাণের কোনো আশঙ্কা নেই, খাটবে আর খেয়ে-প’রে বাঁচবে—খাটতে সে ডরায় না, কিন্তু এত-সব দুর্ভোগের পর এখন একটু নিশ্চিন্ত জীবন চাই তার।
এতক্ষণ সবাই প্রায় রুদ্ধশ্বাসেই তার এই রগরগে আখ্যান শুনছিলো। কিন্তু তাকে দম ফেলবার কোনো ফুরসৎ না-দিয়েই মেজর ম্যাকন্যাব্সের হঠাৎ জিগেস ক’রে বসলেন : ‘ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার ছিলে তুমি? পেটি অফিসার? ‘
আয়ারটন ঘাড় নেড়ে বললে, ‘হ্যাঁ।’ বলেই বুঝতে পারলো যে এখনও তাদের সন্দেহ ঘোচেনি। তাই সে আরো জুড়ে দিলে : ‘এত দুর্বিপাকের মধ্যেও আমি কিছু-কিছু কাগজপত্র বাঁচাতে পেরেছি—আর সে-সব আমার সঙ্গেই আছে। দাঁড়ান, দেখাচ্ছি।’
শাবুদ এসে হাজির করলে সে প্রায় মিনিটখানেকের মধ্যেই : কাপ্তেন গ্রান্টের স্বাক্ষর-সংবলিত চিলতে একটুকরো কাগজ, তাতে এই মর্মে একটা বয়ান যে অমুক মিস্টার আয়ারটন…ব্রিটানিয়া জাহাজের কোয়ার্টারমাস্টারের পদে নিযুক্ত হয়েছে। কাগজটা সে তুলে দিলে মেজর ম্যাকন্যাব্স-এরই হাতে, কেননা তাঁর হাবভাবেই বোঝা যাচ্ছিলো তিনি খুব-একটা কড়ামেজাজের লোক, আর্মির কোনো কেউকেটা, শাবুদ ছাড়া কোনোকিছু এককথাতেই বিশ্বাস ক’রে ফেলার পাত্তর তিনি নন। কিন্তু যখন এই জিজ্ঞাসাবাদ ও সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করার প্রক্রিয়াটা চলেছে, তখনই প্যাডি ও’মুর একটু মিনমিন ক’রে বলেছিলেন : ‘আয়ারটনকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন, মেজর। গত দু’মাস ধরে তো একে আমি দেখছি—খুব চটপটে কাজের লোক। জাহাজডুবির কথা সে আগেই আমাকে বলেছিলো—তবে অবশ্য এতটা খুঁটিনাটি সমেত বিশদ ক’রে বলেনি।’
মেজর ম্যাকন্যাব্স কাগজের ওপর একবার চোখ বুলিয়েই সেটা চালান ক’রে দিয়েছিলেন লর্ড এডওয়ার্ডের হাতে। গ্লেনারভনও সেটা আগাপাশতলা খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। তারপর সকলের উদ্দেশেই বললেন : ‘এখন তাহ’লে কী করা উচিত আমাদের? আচ্ছা, আয়ারটন, তুমিই বলো-এ-অবস্থায় কী করা যায়?’
আয়ারটন প্রথমটায় খানিকক্ষণ চুপ ক’রে থেকে কী যেন ভাবলে। তারপর বললে : ‘আমাকে যে আপনাদের বিশ্বাস হয়েছে, সেজন্যে আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার নিজের একটা কথা মনে হচ্ছিলো। আমি যে-রকমভাবে তীরে সাঁৎরে উঠে এসে বুনোদের খপ্পরে প’ড়ে গিয়েছিলাম, আমার মনে হয় কাপ্তেন গ্রান্টেরাও যদি ওরই কাছাকাছি কোথাও ডাঙায় উঠে থাকেন, তাহ’লে নির্ঘাৎ জংলিদেরই কবলে পড়েছেন। ওঁদের খোঁজ করতে হ’লে আমাদের গোড়ায় অকুস্থলে যেতে হবে—ঠিক যেখানটায় জাহাজডুবি হয়েছিলো, সেখানে। প্রথম খোঁজখবর সেখান থেকেই শুরু করা উচিত।’
একবার কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স বললেন : ‘কিন্তু সেটা তো এক্ষুনি করা যাবে না। জাহাজ মেরামত করতে হবে—তাতে খানিকটা সময় লাগবে। বিশেষত এখানে যেহেতু কোনো জাহাজসারাইয়ের উপযুক্ত বন্দর বা কারখানা নেই, আমাদের তাই একটু অসুবিধের মধ্যেই কাজ করতে হবে।’
এতক্ষণ জাক পাঞ্চয়ল যে কী ক’রে চুপচাপ ব’সে-ব’সে অন্যদের কথাবার্তা বিনাবাক্যব্যয়ে শুনছিলেন, সেটাই আশ্চর্য। তাঁর নিশ্চয়ই কথা বলার জন্যে সারা মুখটাই চুলবুল করছিলো। এতক্ষণ তিনি কেবল উশখুশই করেছেন, কিন্তু লাগসই কোনো কথা ভেবে বার করতে পারেননি। এবার সুযোগ পেয়েই তিনি সরাসরি একটা সিদ্ধান্তই ঘোষণ ক’রে বসলেন—তাঁর একার নেয়া সিদ্ধান্ত : ‘তাহ’লে আমরা সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তরা বরাবর ডাঙার ওপর দিয়েই যাবো—তাতে এ-অঞ্চলটা সরেজমিন জরিপ করে দেখাও হবে।’
‘কিন্তু ডানকান?’ জাহাজের নামটার ওপর একটু জোর দিয়েই জিগেস করলে আয়ারটন।
‘কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স যদি সঙ্গে থাকেন, তাহ’লে আমরা সোজা ভিক্টরিয়া চ’লে যাবো–না, না, মেলবোর্নেই যাবো— ডানকান যেখানে ঠিকভাবে কারখানায় সারাই হবে, সেখানে। আর মেলবোর্নে তাঁদের না-পাওয়া গেলে, ডানকান আমাদের তুলে নিয়ে যাবে টুফোল্ডে। এছাড়া মনে রাখতে হবে, আমাদের সঙ্গে মহিলারাও থাকবেন।’ পাঞয়ল এ-কথাটা বললেন মেরি আর লেডি হেলেনার দিকে একটি প্রসন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে
‘আপনি কি ঠাট্টা করছেন নাকি, মসিয় পাঞয়ল?’ লর্ড এডওয়ার্ড একটু বুঝি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতেই বললেন।
ঠাট্টা? উঁহু, মোটেই না। কতটাই বা যেতে হবে, ভাবুন তো? মাত্র তো সাড়ে-তিনশো মাইল পথ। সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তর বরাবর কোথাও যে বুনোরা আছে, এমন কথা আমি কোনো বৃত্তান্তেই পড়িনি। তেমন-কোনো গভীর জঙ্গলই নেই তো জংলিদের দেখা পাবেন কোথায়? কোনো হিংস্র জন্তুজানোয়ার ও নেই—যদিও এখানে এমন-অনেক জীবজন্তু আছে যা পৃথিবীর অন্য-কোথাও নেই। অনেকটা রাস্তায় রেললাইন আছে, সুসভ্য শ্বেতাঙ্গরা আছে (এখানে সুসভ্য কথাটায় বেশ জোরই দিলেন পাঞয়ল, সম্ভবত বুনো বর্বরদের সঙ্গে তাদের ব্যবধানটা কথাটায় চাপ দিয়েই তিনি বোঝাতে চাচ্ছিলেন), গাড়িঘোড়া আছে, বাড়িঘর আছে, বনতি আছে, একটা শাসনযন্ত্র অর্থাৎ সরকারি দফতরও আছে। একটা গাড়িতে ক’রেই, রোজ যদি বারো মাইল পথও চলি, তবে খুব বেশি ধকল পোহাতে হবে না—একমাসের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাবো অস্ট্রেলিয়ার ওমাথায়—আপনারা যেমন এডিনবারা থেকে লণ্ডন যান, এ অনেকটা তারই মতো হবে আর-কি!’
এমন-একটা ভঙ্গি ক’রে পাঞয়ল কথাটা বললেন যেন অস্ট্রেলিয়ায় এতটা পথ পাড়ি দেয়া মোটেই কোনো সমস্যাই নয়।
তাঁর জ্ঞানের বহরকে আস্থা জ্ঞাপন ক’রেই লর্ড এডওয়ার্ড এবার লেডি হেলেনাকে জিগেস করলেন—’কী? যাবে নাকি?’
লেডি হেলেনা মৃদুহেসে বললেন : ‘এক্ষুনি। এতে তো একটা দেশও দেখা হ’য়ে যাবে। স্কটল্যান্ডে কতজন ফিরে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ার গল্প শোনায় আমাদের? যত স্কট এখানে আসে, তারা তো সবাই এখানে থেকেই যায়। আমরা বরং ফিরে গিয়ে সবাইকে মেলবোর্নের গল্প শোনাতে পারবো।’
এবার আয়ারটনের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে লর্ড এডওয়ার্ড জিগেস করলেন : ‘আর, আয়ারটন? তুমি?’
আয়ারটন কিন্তু তক্ষুনি হ্যাঁ বা না কিছুই বললে না। কী খানিক ভাবলে একটু। তারপর জিগেস করলে : ‘কিন্তু আপনারা কোথায় গিয়ে উঠবেন ডানকানে?’
‘অস্ট্রেলিয়ার এ-মাথা থেকে ও-মাথা ছুঁড়ে ফেলবার আগেই যদি কাপ্তেন গ্রান্টের পাত্তা পাওয়া যায়, তবে মেলবোর্নেই গিয়ে আমরা জাহাজে চাপবো। আর, তা না-হ’লে, একেবারে পূর্ব-উপকূলে।’
‘আর কাপ্তেন?’
‘তিনি জাহাজ নিয়ে মেলবোর্নে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবেন।’
‘ঠিক আছে। প্যাডি ও’মুর যদি আমায় ছেড়ে দিতে রাজি থাকেন, তবে আপনাদের সঙ্গে যেতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কাপ্তেন গ্রান্টকে খুঁজে পেলে চাঁকে গিয়ে বলবো—আই, আই, কাপ্তেন, বান্দা আবার কাজে যোগ দিতে এসেছে।’
তার এ-কথা শুনে সবাই এতক্ষণ গভীর-গম্ভীর আলোচনার পর একটু যেন ‘স্তির দেখা পেলেন। কথাটা আয়ারটন এমনভাবে বলেছে যে কাপ্তেন গ্রান্টের ঙ্গে যেন অচিরেই সকলের দেখা হয়ে যাবে।
আয়ারটনকে ছেড়ে দেবার কথায় প্যাডি ও’মুর তক্ষুনি রাজি হ’য়ে গেলেন। আয়ারটন চৌকশ, চটপটে, কাজের লোক বটে, তবে এঁদের দরকার আরো-বেশি, আরো-জরুরি।
জাহাজ থেকে ছুতোর নিয়ে এলো তার সব সাজসরঞ্জাম—লর্ড এডওয়ার্ড তক্ষুনি তাকে গাড়ি তৈরির কাজে লাগিয়ে দিলেন। এ-সব ব্যাপারে অকারণে ধানাইপানাই ক’রে সময় নষ্ট করা তাঁর ধাতে নেই—সিদ্ধান্ত একবার নিয়ে ফেললে তক্ষুনি সে-কাজটায় লেগে না-পড়লে তিনি যেন স্বস্তি পান না। সমস্ত কাজটা তদারক করার দায়িত্ব নিলে আয়ারটন—সেও তক্ষুনি কাজে লেগে পড়তে চায়। ছ-জোড়া বলদে-টানা কুড়ি ফিট লম্বা চারচাকার গাড়ি হবে—তাতে যাবেন মহিলারা। পুরুষরা সবাই ঘোড়ার পিঠে। গাড়ির মধ্যেই রসুই পাকাবার ব্যবস্থা থাকবে, রসদ থাকবে।
কাজকর্মের প্রাথমিক প্রস্তুতিটা সারা হ’তেই আয়ারটনকে ডানকানেনিয়ে এলেন লর্ড এডওয়ার্ড। ডানকান মূলত প্রমোদতরী- বিলাসব্যবস্থার কোনো ঘাটতি নেই তাতে—কিন্তু বিলাসের এতসব উপকরণের দিকে আয়ারটনের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। সে সরাসরি এসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো এনজিনঘর, জাহাজের গড়ন, খোল, মাস্তুল, বয়লার। ঘন্টায় সতেরো নট যেতে পারে ডানকান—এ-কথা শুনে এতটাই অবাক হ’লো যে তার চোখদুটো যেন চকচক ক’রে উঠলো। তাহ’লে তো সবচেয়ে- তেজি সবচেয়ে ক্ষিপ্র যুদ্ধজাহাজও পাল্লা দিতে পারবে না এই জাহাজের সঙ্গে।
‘তা তো পারবেই না,’ একটু গর্বের সুরেই বললেন লর্ড এডওয়ার্ড, ‘ডানকানকে তৈরিই করা হয়েছে দৌড়ের বাজিতে জেতবার জন্যে।’
‘ওজন কত জাহাজের?’
‘দুশো দশ টন।’
ঘুরে-ঘুরে সারা জাহাজটাকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিলে আয়ারটন। তার কৌতূহলের যেন শেষ নেই কোনো! দেখে নিলে কোথায় কী হাতিয়ার, কোথায় কী অস্ত্রশস্ত্র আছে। একেবারে-ঝকঝকে একটি অত্যাধুনিক কলকব্জায় তৈরি জাহাজ, এনজিনের শক্তি কত শুনে সে গোড়ায় যেন কথা বলবার শক্তিই হারিয়ে ফেললো। আজকাল যে এ-রকম শক্তিশালী সব জাহাজ তৈরি হচ্ছে এটা জেনে সে বললে, ‘আমরা যখন ব্রিটানিয়াকে ঝড়ের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা ক’রেও ব্যর্থ হচ্ছি, তখন ইওরোপ কিনা এমন-সব জাহাজ বানাচ্ছে যা সবচেয়ে দুরন্ত ঝড়কেও আর ভয় পায় না। ঈশ, যদি এ-রকম একটা জাহাজ থাকতো আমাদের, তাহ’লে অমনভাবে ঝড়ে-খেপে যাওয়া সমুদ্রে আমাদের জাহাজডুবিও হ’তো না—অমন দুর্ভোগও পোহাতে হতো না।’
‘তখন না-হোক, এখন তো এ-জাহাজে তুমি কাজ করতে পারো,’ তার অমন খুশি দেখে বললেন লর্ড এডওয়ার্ড, ‘হয়তো একদিন তুমিও এ-রকম কোনো জাহাজের কাপ্তেন হ’য়ে বসতে পারো।’
‘যদি হ’তে পারি,’ এমন ভাবে আয়ারটন কথাটা বললে তাতে মনে হ’লো, এ রকম কোনো জাহাজ হাতে পেলে সে বুঝি স্বর্গসুখও প্রত্যাখ্যান করতে রাজি আছে।
আয়ারটনকে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিলো লর্ড এডওয়ার্ডের। আয়ারটন জাহাজ থেকে নেমে গেলে লর্ড এডওয়ার্ড মন্তব্য করলেন, ‘লোকটা সত্যি খুবই সপ্রতিভ আর বুদ্ধিমান—কাপ্তেন গ্রান্ট সম্ভবত লোক চিনতে পারতেন—’
‘তা জানতেন কিনা, কে জানে,’ বললেন মেজর ম্যাকন্যাব্স, ‘তবে লোকটা বোধহয় অতিরিক্ত-বুদ্ধিমান। এত-বুদ্ধি সইলে হয়!’ তাঁর বিচ্ছিরিভাবে মুখবেঁকানো দেখে বোঝা গেলো আয়ারটনকে তাঁর আদপেই পছন্দ হয়নি। খাবারটেবিলেও তিনিই আয়ারটনকে সবচেয়ে বেশি কূট প্রশ্ন করছিলেন।
গাড়িটা তৈরি হ’য়ে যেতেই, আর যেন তর সইলো না কারু। ২৩শে ডিসেম্বর ১৮৬৪ সালের সকালবেলায় শুরু হলো দক্ষিণ গোলার্ধের এই অন্যমহাদেশটায় তাঁদের অভিযান। বলদে টানা গাড়িটায় রইলেন মেরিকে নিয়ে লেডি হেলেনা, আর গাড়োয়ান হ’লো আয়ারটনই—এদিককার পথঘাট অন্যদের তুলনায় তারই বেশি চেনা। পেছনে চললো সশস্ত্র সাতজন অশ্বারোহী—লর্ড গ্লেনারভন, মেজর ম্যাকন্যাব্স, জাক পাঞ্চয়ল, রবার্ট গ্রান্ট, কাপ্তেন ম্যাঙ্গলস – আর ডানকানেরই দুজন বাছাই-করা নাবিক!
আয়ারটন শুধু একবার বলেছিলো এখানকার পথঘাটে নিরাপত্তার জন্যেই সঙ্গে আরো লোক থাকা দরকার। আরো কয়েকজন নাবিক সঙ্গে থাকলে তার মতে আরো নাকি বেশি-নিশ্চিন্ত হওয়া যেতো। কিন্তু লর্ড এডওয়ার্ড আর কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স আলোচনা ক’রে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে, মেলবোর্নে গিয়ে জাহাজ মেরামতের কাজটা তাড়াতাড়ি সারবার জন্যে বেশি নাবিক থাকা দরকার জাহাজটাতেই। তাছাড়া প্রত্যেকের সঙ্গেই যেহেতু যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র আছে, তাতে এই সাত অশ্বারোহীই পথে কোনো গণ্ডগোল হ’লে সব সামলাতে পারবে।
আগেই আলোচনা ক’রে স্থির হ’য়েছিলো এই দলটা যখন ডাঙায় কাপ্তেন গ্রান্টের খোঁজ নিতে-নিতে মেলবোর্নের দিকে যাবে, তখন টম অস্টিনই জাহাজ নিয়ে যাবে মেলবোর্নের জাহাজসারাইয়ের ঘাঁটিতে। টম অস্টিন কাজের লোক, দায়িত্ব সম্বন্ধে সে পুরোপুরি সচেতন, আর ভালো নাবিক হবার যেটা সবচেয়ে বড়োগুণ সেটাও তার আছে—গভীর সংকটের সময়ও সে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে।
৩. ছুঁড়ে মারলেও যা হাতে ফিরে আসে, ফের
অস্ট্রেলিয়া একটি বিশাল মহাদেশ, কিন্তু এর বেশিরভাগ অংশই জনমানবহীন, কোথাও দুর্গম অরণ্য, কোথাও-বা দুরারোহ পর্বত, এই যদি উপত্যকার মস্ত অংশ জুড়ে থাকে ঝোপঝাড় গাছপালা—পরক্ষণেই বিশাল বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণায় জিভ চাটে রুক্ষ, ঊষর, ধু-ধু ধুলোর মরুভূমি। লোকালয় যা আছে, সবই সমুদ্রের তীর ঘেঁসে গ’ড়ে ওঠা উপনিবেশে; সমুদ্রতীর থেকে যত-দূরে কেউ যাবে, যত দেশটার ভেতরে ঢুকবে ততই দেখতে পাবে আস্তে-আস্তে বিরল হ’য়ে আসছে বসতি, ক্রমে চোখে পড়বে যে কোথাও কোনো মানুষজন নেই—এমনকী দেশটার আদি বাসিন্দারা অব্দি খুব-একটা অভ্যন্তরে যায় না। আর এই ভিতরদেশকেই বলে আউটব্যাক।
এখানে আকাশটা অব্দি অন্যরকম, ভিন্নরকম। যে-তারা ইওরোপের লোক দ্যাখে আকাশের পুবে, এখানে সেটা ওঠে পশ্চিমে—যেটা দেখা যায় ইওরোপের গ্রীষ্মেবসন্তে, সেটা এখানেও দেখা যায় গ্রীষ্মেবসন্তে—কিন্তু এখানে যে ঋতুগুলোই উলটে গিয়েছে। তাঁরা রওনা হয়েছেন ডিসেম্বরের শেষে, আর দু-দিন, পরেই বড়োদিন, অথচ এখানে তাপমানযন্ত্র দেখায় গরম এমনকী ১১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটকে ছাপিয়ে গিয়েছে, যেখানে-যেখানে পথে গাছপালা পড়ে তার পাতাটুকু অব্দি নড়ছে না, হলকায় যেন ঝিম ধ’রে আছে সব, প্রায় যেন থমথমে, নিশ্চল। আর এই ধরনের আবহাওয়ায় অনভ্যস্ত এই অভিযাত্রীরা গরমে যেন ধুঁকতে শুরু ক’রে দিয়েছেন, যেটা হলো হাঁসফাস করারও পরের অবস্থা।
দেশটা গ’ড়ে উঠেছে—আদিবাসিন্দাদের যথাসম্ভব পরিকল্পনামাফিক খতম ক’রে দেবার পর অথবা আউটব্যাকে রে-রে করে তাড়িয়ে নিয়ে যাবার পর—ফরচুনহান্টার্সদের দ্বারা, যে-সব ডাকাবুকো গাটাগোট্টা লোকেরা নিজেদের নাম বলে ভাগ্যান্বেষী, কেউ হ’য়ে যায় বুশম্যান, ঝোপ-ঝপ্পড়ের দস্যু, অতর্কিত চড়াও হয় জনপদে, আর ছিনিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু—এইসব বাপেতাড়ানো মায়েখেদানো দুর্দান্ত গুণ্ডার দল। এরা নিজেদের দেশে হয়তো খেতে পেতো না, জমিদারের অত্যাচারে জেরবার হ’য়ে যেতো, সংগঠিত প্রতিবাদ করবারও সাহস হ’তো না কখনও, কাজেই দু-একটা হাতিয়ার আর নিজের প্রাণটা সম্বল ক’রে এরা এই দূর-দেশে অন্য একটা গোলার্ধেই, আরেকটা হেমিস্ফিয়ারেই পাড়ি জমিয়েছে। অন্য-যারা আছে তারা অধিকাংশই কয়েদি–কেননা ইংরেজ সরকার এই উপনিবেশটা গ’ড়ে তুলেছে পিনাল কলোনি হিশেবে—ইংলণ্ডের মতো ছোট্ট দ্বীপ থেকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে—নির্বাসনই, কেননা আস্ত-একটা মহাদশেকে তো আর দীপান্তর বলা যায় না—যতরাজ্যের দুষ্কৃতকারীদের; সেইসঙ্গে রাজনৈতিক কারণে যারা সরকারের চক্ষুশূল, তারাও বাদ যায়নি—আর অনেকে পালিয়ে এসেছে স্বেচ্ছায়, যখন শুনেছে সরকারের চরদের নেকনজর পড়েছে তাদের ওপর। আর এইসব কয়েদিদের দিয়ে বিনামজুরিতে খাটিয়ে নেবার কাজটা করাবার জন্যে আছে নির্মম নিষ্ঠুর যত ওয়ার্ডেন আর ওয়ার্ডারের দল—ইওরোপ থেকে প্রায়-একটা আস্ত কঠোরনির্মম শাসনব্যবস্থাই পরিকল্পনামাফিক তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছে ইংরেজরা, যাদের রাজত্ব এখন এতই বিশাল, আর এতই ছড়ানো যে সে-রাজত্বে নাকি ককখনো সূর্যও ডোবে না, মনুষ্যত্ব যদি সাগরজলে সমাধি পায় তো সে অন্যকথা। শুধু-যে অচেনা প্রকৃতিই এখানে বিরূপ, তা-ই নয়, মানুষজনগুলোও বুঝি তারই সঙ্গে মানিয়ে হ’য়ে উঠেছে রুক্ষ, কর্কশ, আর সারাক্ষণ তারা নিজেরাই খাটে অথবা তাদের দিয়ে উদয়াস্ত খাটিয়ে নেয়া হয় ব’লে, পিঠ বাঁকিয়ে সারাক্ষণ নুয়ে ঝুঁকে কাজ করতে হয় ব’লে তীব্রতীক্ষ্ণ রোদ্দুরে যাদের ঘাড় চিংড়িমাছের মতো টকটকে-লাল হ’য়ে গেছে, আর সেইজন্যেই যাদের নাম হয়েছে রেডনেক, আর রেডনেক বললেই বুঝতে হবে যে ঘরে বসে পুথিপত্তর প’ড়ে দর্শন আলোচনা করার কপাল ক’রে তারা জন্মায়নি। শাসনযন্ত্র, স্বাভাবিকভাবেই, এর সঙ্গে মানানসই। রাজপুরুষরা আছে, আর আছে সেপাইশাস্ত্রী, উর্দি, সমরবাহিনী, কাড়ানাকাড়া, বিউগল, আর তারই সঙ্গে জড়ানো যাবতীয় আনুষঙ্গিক লেজুড়। পৃথিবীটাকে এখানে উলটে দিয়ে যেন অন্য-গোলার্ধের যাবতীয় বিষয়বস্তুও এখানে এনে পুঁতে দেয়া হয়েছে। তবে প্রকৃতি তো শূন্যতার স্বভাববিরোধী—সে এই মানুষগুলোকে দিয়েই গান গাওয়ায়, ব্যালাড বা গাথা, অভিযাত্রীদের কাহিনী, বীরদের কাহিনী, দস্যুদের কাহিনী, সেই-যে এক দস্যু ছিলো যার নাকি পায়ের আঙুল ছিলো সাতটা—না, তার গোড়ালি অবশ্য ওলটানো ছিলো না।
তাই এই অভিযাত্রীরা বেরুবার আগে আয়ারটন ভয়ে ভয়ে বলেছিলো, সঙ্গে আরো-কয়েকজন সশস্ত্র নাবিক নিয়ে গেলে হ’তো না—আত্মরক্ষার সুবিধে হ’তো যদি অতর্কিতে কোনো ঝোপঝপ্পড় থেকে বিপদ এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো লর্ড গ্লেনারভনের এই বহরটার ওপর। কেননা লোকালয়গুলো এতই দূরে-দূরে যে হঠাৎ আক্রান্ত হ’লে সাহায্য আসার সম্ভাবনা তো সুদূরপরাহত। কিন্তু লর্ড গ্লেনারভনের হিশেবটা ছিলো অন্যরকম। সাঁইত্রিশ ডিগ্রি অক্ষরেখা বরাবর অঞ্চলটা তেমন জনমানবহীন নয়—সমুদ্র দূরে নেই বলেই এখানে একটু পরে-পরেই উপনিবেশের লোকেরা বসতি বসিয়েছে।
অতর্কিতে কোনো হামলা হ’লে তাকে সামলাবার জন্যে সবাইকেই সবসময় সজাগ থাকতে হবে, অলিখিত নির্দেশটা দেয়া ছিলো এ-রকমই। কিন্তু যে-হামলাটা শুধু আচম্বিত নয়—হয়তো অপ্রত্যাশিতও ছিলো—শুধু হামলার বহর আর বাহারটাই নিশ্চয়ই জানা ছিলো না—সেই হামলাটা যখন এলো তখন তাকে ঠেকাবার ক্ষমতা দেখা গেলো কারুই প্রায় নেই। হামলাটা এলো খুদে খুদে সব পোকামাকড়ের কাছ থেকে, মশার কাছ থেকে, কামড়ে ফুলিয়ে ঢোল ক’রে দেয় এমন-জাতের মাছির কাছ থেকে। বীলজেবাবকে যে পবিত্র ধর্মগ্রন্থে অর্থাৎ বাইবেল-এ পতঙ্গদেব বলেছে, লর্ড অভ দ্য ফ্লাইস বলেছে, তা কি এইজন্যেই? কেননা সেই সকাল থেকে একটানা চ’লে যখন আউটব্যাকের মধ্যে অর্থাৎ গাছপালাবিহীন বিশাল একটা প্রান্তরে এসে পৌঁছুলো বহর, তখনই প্রথম দেখা হ’লো পতঙ্গদেবের এইসব অনুচরদের সঙ্গে, এবং প্রথম সাক্ষাতেই তাদের বিকট মাখামাখিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্ব’লে গেলো, যেন সর্বাঙ্গে কতগুলো কাঁকড়াবিছে কামড়েছে।
তাদের এই নাছোড় আদরে সবাই যখন কারাচ্ছে তখন আয়ারটনের পরামর্শে গায়ে অ্যামোনিয়া ঘ’সে কোনোরকমে জ্বলুনি একটু কমলো। একে অসহ্য গরম, তারপর এই মশামাছির উৎপাত : সোনার ওপর যেন সোহাগা। ঠা-ঠা রোদ্দুরে একটুও ছায়া নেই কোথাও। গাছপালা থাকলে তো ছায়া থাকবে। সন্ধের দিকে অবশ্য তাপমানযন্ত্র একটু দয়া করলো, আর এবার ছোটোখাটো ঝোপঝাড়ও দেখা দিতে লাগলো –অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার সেই বিখ্যাত বুশ – যার আড়ালে নাকি লুকিয়ে থাকে ডাকাতরা, এখানকার লোকে যার নাম দিয়েছে বুশ-রেজার, ঝোপঝপ্পড়বাজ।
শুধু কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খোঁজ পাবার তাড়াতেই যেন এই জনমানবহীন প্রান্তর পেরিয়ে এলো বহর, দু-দিন প্রায়-একটানা চ’লে পেরুলো ষাট মাইল। এই খাঁ-খাঁ প্রান্তরে, ধু-ধু মাঠে কোথায় কার কাছে জিগেস ক’রেই বা জানা যাবে কাপ্তেন গ্রান্টের হদিশ কেউ জানে কি না। যতক্ষণ-না কোনো লোকালয় আসে, ততক্ষণ এভাবেই হুড়মুড় করে চলতে হবে তাঁদের। সবাই ভেবেছিলো মেরি আর রবার্ট বুঝি পথের এই ধকলে একেবারে কাহিল হ’য়ে পড়বে। কিন্তু একবার যখন আয়ারটন তাদের জানিয়েছে এই অস্ট্রেলিয়ার কাছে এসেই ডুবেছে ব্রিটানিয়া আর কাপ্তেন গ্রান্ট যদি সলিলসমাধি থেকে বেঁচে থাকেন, তবে এই অস্ট্রেলিয়াতেই নিশ্চয়ই কোথাও আছেন, তারপর থেকেই যেন স্নায়ুর উত্তেজনা তাদের টানটান ক’রে রেখেছে, পথের কোনো কষ্টই তারা গায়ে মাখছে না।
যদি-বা এখনও কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো সন্ধান না-পেয়ে তারা মুষড়ে প’ড়ে থাকে, তবে অন্যদের মতো তাদেরও আমোদ (না কি প্রমোদ) জোগাবার জন্যে তো আছেনই জাক পাঞ্চয়ল, আরামকেদারার ভূগোলতাত্ত্বিক, পুঁথির পাতায় যা-যা পড়েছেন, তাতেই যেন অস্ট্রেলিয়া তাঁর একেবারে নখদর্পণে এসে গিয়েছে। এই মহাদেশ সম্বন্ধে যা-সব তাজ্জব কাহিনী তিনি শোনালেন, তার কতটাই যে সত্যি আর কতটাই যে মনগড়া, তা-ই বা বিচার করবে কে?
সে-রাতে যখন ক্রাউন ইন নামে একটা সরাইখানায় বড়োদিনের ভোজের আসর জমেছিলো, সেদিনই গোটা ভোজসভাটাই মাত ক’রে দিয়েছিলেন পাঞয়ল, এই মহাদেশ সম্বন্ধে বিচিত্র-সব তথ্য শুনিয়ে। এখানকার নাকি সবকিছুই অদ্ভুত—একবার তো তিনি স্বীকারই করে ফেললেন যে এখানকার জল-মাটি-আকাশ এতই বিস্ময়কর যে প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা নাকি এখনও এই মহাদেশের ভূসংস্থানের রহস্যটাই ভেদ করতে পারেননি। যেন একটা চ্যাপটা বাটির মতো এই মহাদেশটা, কিনারটা উঁচু, মাঝখানটা নিচু হ’য়ে এসেছে। মাটি খুঁড়লে এখনও নাকি পাওয়া যায় সামুদ্রিক জীবের কঙ্কাল, জীবাশ্ম–হয়তো বহুকাল আগে কোনো প্রকাণ্ড অগ্ন্যুৎপাতের ফলেই সাগরতল থেকে উঠে এসেছিলো এই দেশ, আর মাটির তলায় এখনও এমন-সব অদ্ভুত চিহ্ন রয়ে গেছে যা থেকে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে আস্ত এই মহাদেশটাই একদিন—সে-যে কতকাল আগে কেউ জানে না—ছিলো সমুদ্রের তলায়। এখন এর নদীগুলো অব্দি শুকিয়ে যাচ্ছে, কত জায়গায় যে মরা নদীর সোঁতা দেখা যায় তার ইয়ত্তা নেই। ক্রমশই বিকট হা করে এগুচ্ছে এর মরুভূমিগুলো, আর জলমাটিআকাশবাতাস থেকে শুষে নিচ্ছে সব আর্দ্রতা। অথচ এখানে এমন-অনেক গাছ আছে যারা প্রতিবছর তাদের পাতা ঝরায় না, শুধু গাছের বাকলগুলো খ’সে পড়ে—যেন সাপের মতো তারা খোলশ পালটাচ্ছে। অন্যসব দেশে পাতাগুলো সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, এখানে যেন রোদ্দুর এড়াবার জন্যে তারা একটু পাশ ফিরে থাকে—ফলে যেখানে গাছপালা আছে সেখানেও তারা ছায়া দেয় না। এখানকার ঝোপঝাড়গুলো বেঁটে-বেঁটে, শুধু ঘাসগুলো মাথা ছাড়িয়ে ওঠে, এমনই রাক্ষুসে তাদের বাড়।
আর তারপর যখন জীবজন্তুর কথা পাড়লেন জাক পাঞ্চয়ল, তখন বড়োদিনের ভোজসভা হ’য়ে উঠলো যেন জীববিদ্যারই ক্লাস। তাঁর ধারণা, অস্ট্রেলিয়ায় যেন চিরকাল ধ’রে একটা গো অ্যাজ ইউ লাইক অর্থাৎ ভোল পালটে সকলের সামনে অন্য বেশে আবির্ভূত হবার একটা প্রতিযোগিতা চলেছে।
রবার্ট মাঝখানে ফোড়ন কেটেছিলো : ‘তার মানে এখানকার জীবজন্তুরা কি সবসময়েই অন্য জীবজন্তুর চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়? তাহলে তো তারা অন্য জীবজন্তুই—যতক্ষণ-না আমরা তাদের সত্যিকার চেহারা কী, সেটা জানতে পারছি—’
‘না, তা বলছি না, তবে আমরা যে-সব জীবজন্তু দেখে অভ্যস্ত, সে-রকম জীবজন্তুর চাইতে অন্যরকম জীবজন্তুরাই বেশি এখানে।’
‘তাহ’লে তাদের অন্য নাম দিন পণ্ডিতরা—কেন তারা বলবেন যে অমুক জীব তমুক জীবের ভোলটা নিয়ে গিয়ে অন্যভাবে সেজেছে।’
এবার মেজর ম্যাকন্যাব্স একটা সুচিন্তিত টিপ্পনী কাটলেন। ‘লোকে যেখানেই যায়, সঙ্গে ক’রে নিয়ে যায় নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি। অর্থাৎ অচেনা জায়গায় তারা সঙ্গে ক’রে বয়ে নিয়ে যায় নিজেদের অ্যাদ্দিনকার চেনা চৌহদ্দিটাই। তুমি যেখানেই যাও, নিজেকে এড়িয়ে তুমি যাবে কোথায়?’
জাক পাঞ্চয়ল এবার তাতে সায় দিয়েছেন। ‘হ্যাঁ, এ-কথাটা ঠিক। কোনো চতুষ্পদ জন্তু যদি মুখটা শান দেয়া ছুরির ফলার মতো ছুঁচলো ক’রে পাখির মতো চঞ্চ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়— ‘
‘তাহ’লে সারস আর শেয়ালের নেমন্তন্ন খাবার যে-গল্প ঈশপ এককালে ফেঁদেছিলেন, সে-গল্প এখানে মোটেই খাপ খাবে না।’
‘বিখ্যাত পর্যটকরা কত সময়েই কত-কিছু যে নিজের চোখে দেখেছেন ব’লে দাবি করেছেন, তার আর-কোনো ইয়ত্তা নেই। কেউ দাবি করেছেন তিনি দেখেছেন এমন বিরাট সরীসৃপ যে নাকি অনবরত মুখ দিয়ে আগুনের হলকা বার ক’রে দিচ্ছে। একজন হলফ করে বলেছেন তিনি নাকি এমন শুওর দেখেছেন যাদের নাভিকুণ্ডলী ছিলো তাদের পিঠে—পেটে নয়। একজন তো এমনও বলেছেন তিনি এমন-সব বেঁটেখাটো জীব দেখেছেন যাদের মুণ্ডু আর কানগুলো খচ্চরের মতো, শরীরটা উটের, পাগুলো হরিণের, আর তারা নাকি ঘোড়ার মতোই চিঁহি-চিঁহি ডাকে। কেউ যদি দিব্বি গেলে বলেন তিনি দেখেছেন গ্রিফিন, কিংবা ফিনিক্স পাখি, যদি বলেন জ্বলন্ত আগুনের কুণ্ড থেকেই তিনি একটা পাখিকে উঠে আসতে দেখেছেন, যে তার ডানা ছড়িয়ে আকাশে উড়ে চ’লে গেলো, তবে হয় আমরা তার কথা বিশ্বাস করবো, আর নয়তো বলবো গাঁজাখুরি, উদ্ভট, কিম্ভূত—’ লর্ড এডওয়ার্ড হয়তো আরো-সব তাজ্জব নমুনা হাজির করতেন নামজাদা-সব পর্যটকদের ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে, কিন্তু জাক পাঞ্চয়ল তাঁকে কথা শেষ করতে না-দিয়েই থামিয়ে দিয়েছিলেন। কোনো আসরের মধ্যে তিনি হাজির থাকতে আর-কেউ যে মধ্যমণির মুখ্য ভূমিকাটা কুক্ষিগত করবে, এটা যেন আদপেই তাঁর মনঃপূত নয়।
‘প্রকৃতি অন্তত কখনও উদ্ভট-কিছু বানিয়ে কোনো এক্সপেরিমেন্ট করে না। সে জীবজন্তু তৈরি করে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়েই। ফলে সে যদি এমন জীব তৈরি করে যে তার ছানাগুলোর বাসা নিজের শরীরের সঙ্গেই ব’য়ে নিয়ে যাবে, তবে নিশ্চয়ই বুঝতে হবে যে মায়ের দেহের সঙ্গে এঁটে না-থাকলে পরিবেশ ঐ ছানাগুলোকে বাঁচতেই দেবে না। ক্যাঙারু যদি তার ছানা রু-দের পেটের মধ্যে থলে বানিয়ে তাতে পুরে রাখে, আর ছানাগুলো যদি ঐ পেটের থলে থেকে মাঝে-মাঝে চোখ ছানাবড়া ক’রে চারদিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দ্যাখে, তবে প্রথম দেখে অপ্রস্তুত-কেউ ব্যাপারটা না-জেনেই ভেবে বসতে পারে যে সে এমন কোনো জীব দেখেছে যার দু-জোড়া চোখ আছে—একজোড়া কপালে, একজোড়া পেটে। কিংবা কেউ যদি দ্যাখে মরালের মতো কোনো পাখি জলে ভেসে বেড়াচ্ছে অথচ যে-কিনা কুচকুচে কালো তবে সে হয়তো ভাববে কবিরা এতকাল যে কালো মরালের কথা ব’লে এসেছিলো, সে বুঝি তা-ই দেখেছে। স্থানীয় লোকে যে তার অন্য কোনো নাম দিতে পারে এটা তার মাথাতেই আসবে না।’
‘সুতরাং?’ রবার্ট মোক্ষম প্রশ্নটা ক’রে বসেছে তখন।
‘সুতরাং, এটা ধ’রে নিতেই হবে যে, গোড়ায় লোকে চেনা জীবজন্তুর সঙ্গেই তার আদল খুঁজে বার করে চেনা নামেই ডেকেছে তাদের, বলেছে এটা রাজহাঁস বটে, তবে ধবধবে শাদা নয়, বরং কালো মরালই এটা। অন্তত এটা তো মানতেই হবে যে অস্ট্রেলিয়া অন্যরকম—তার জীবজন্তুও অন্যরকম হবে। এই-তো আজ বড়োদিন, কিন্তু কোথায় সেই হোয়াইট ক্রিসমাস—ঠাণ্ডা কোথায়, বরফ কোথায়, সান্তাক্লসের শ্লেজগাড়ি কোথায়। আমরা তো এখন লু-বওয়া তপ্ত হাওয়ায় ধুঁকছি। এমন সৃষ্টিছাড়া বড়োদিন কেউ কি ক্যারল গাইবে এখন যে হোয়াইট নাইট সাইলেন্ট নাইট যখন রাতচরা পাখিগুলো কেউ ঠকঠক, কেউ সাঁই-সাঁই, কেউ কর্কশ ধাতব স্বরে ডেকে উঠছে—রাত মোটেই চুপচাপও নয়, শাদাও নয়।’
এমন অকাট্য প্রমাণের পর অবশ্য সবাই একবাক্যে তখন স্বীকার ক’রে নিয়েছেন যে অস্ট্রেলিয়ার সবকিছুই সৃষ্টিছাড়া বেয়াড়া, উদ্ভট।
ক্রাউন ইন-এ বড়োদিন কাটাবার পর থেকে সমানে এগিয়ে চলেছে বহর—কখনও বিশাল তরুলতাউদ্ভিদবিহীন প্রান্তর, কখনও-বা সেই বেঁটে ঝোপঝাড়, অথবা উঁচু-উঁচু ঘাসবন। আর এ-রকমই একটা ঘাসবনের কাছে এসে একদিন দেখা গেছে মস্ত আরেকটা বহর চলেছে ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে—ঘাস খেতে-খেতে। মানুষের সঙ্গে কুকুর আর ঘোড়া নিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে অজস্র গোরুমোষ, কয়েক হাজার ভেড়া, এমনকী সওয়ারবিহীন বেশকিছু ঘোড়াসমেত। এই বিরাট শোভযাত্রা পাশ দিয়ে চ’লে যেতে অনেকক্ষণ লাগিয়ে দিয়েছে। আয়ারটন জানিয়েছেন এদের নাকি শস্তায় কেনা হয়েছে নীলগিরিতে—অর্থাৎ ব্লুমাউন্টেনে—হাড়জিরজিরে রোগাপটকা সব জীব, উপযুক্ত খাদ্য নাকি সেদিকটায় নেই, এবারকার খরায় সেদিকে সব জ্বলে-পুড়ে গিয়েছে। এখন ঘাসবনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে-যেতে এদের খাইয়ে-দাইয়ে নধর করা হচ্ছে, তারপর মাঠে চরিয়ে তাকৎ ফিরিয়ে এনে বিক্রি করবে চড়া দামে—যাদের খেতখামার আছে তারা এ-সব বেশিদাম দিয়েই কিনে নেবে।
তারপর সামনে পড়লো—এই-প্রথম—এমন-একটা সোঁতা, যাতে সত্যি-সত্যি কুল কুল করে জল ব’য়ে যাচ্ছে—মরানদী নয়, জলজ্যান্ত নদী-একটা। তার নাম উইমেরা নদী।
অ্যাদ্দিন পথে পড়েছে মরানদীর খাত, কিংবা সরু সুতোর মতো এইটুকু জলের ধারা। ঘোড়া ছুটিয়ে তাকে পেরিয়ে যেতে কোনো মুশকিলই হয়নি, বলদে-টানা গাড়িটা অনায়াসেই পেরিয়ে গেছে সেইসব স্রোতোধারা। এবার কিন্তু বলদে-টানা গাড়িটা নদী পার করতে গিয়ে বিস্তর বেগ পেতে হ’লো, শুধু আয়ারটনের বুদ্ধিমত্তা আর প্রত্যুৎপন্নমতিত্বেই কোনো অপঘাত দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে গেলো বহর। জায়গাটা নাকি সে যখন টহল দিয়ে বেড়িয়েছে অস্ট্রেলিয়ায়, এ-মোড় থেকে ও-মোড়, তখনই চিনে নিয়েছে। ফলে সে জানে উইমেরা নদীর কোনখানে জলের ঢল বেশি, কোথায় সেখানে শুধু হাঁটুজল থাকে।
মেজর ম্যাকন্যাব্স অবিশ্যি মাথা নেড়েছেন দু-একবার। আয়ারটন যদি ব্রিটানিয়া জাহাজ থেকে ছিটকে প’ড়ে থাকে জলে, আর তারপর কাজের ধান্ধায় জীবিকার খোঁজে পুরো অঞ্চলটা চষে ফেলেও থাকে একবার, তবু এখানকার সবকিছু সে তার নিজের হাতের চেটোর মতো এমনই ভালোভাবে চেনে যে মনেই হয় না মাত্র একবারই সে এ-সব অঞ্চলে এসেছিলো।
নদী পেরুবার পর অন্যপারে এসেই আয়ারটন একটু ছুটি চাইলে। এই নদী পেরুতে গিয়ে বলদগুলো বেকায়দায় টান দিয়েছিলো বলে গাড়িটা কয়েক জায়গায় জখম হয়েছে, নড়বোড় করছে, আরেকটু ধকল গেলেই জোড়গুলো হয়তো খুলে আসবে। তাছাড়া কারু-কারু ঘোড়ার নালও খুলে গিয়েছে, সেগুলো লাগাতে হবে। ‘এখান থেকে মাইল-বিশেক দূরে ব্ল্যাকপয়েন্ট নামে একটা রেলস্টেশন আছে, ‘ আয়ারটন জানিয়েছে, ‘সেখানে ছোটোখাটো একটা লোকালয় গ’ড়ে উঠেছে। আর সেখানে মিস্ত্রি আছে, ছুতোর, কামার, তাঁতি থেকে হাতুড়ে ডাক্তার অব্দি। গাড়িটা মেরামত করতে হবে, ঘোড়ার নালও লাগাতে হবে—আমি শুধু যাবো, আর মিস্ত্রি নিয়ে ফিরে আসবো। সব ঠিকঠাক হ’লে মাত্র চোদ্দ-পনেরো ঘন্টা লাগবে আমার।’
‘ঠিক আছে, আয়ারটন। লর্ড এডওয়ার্ড বলেছেন, ‘তুমি ফিরে না-আসা অব্দি আমরা সবাই তাঁবু খাটিয়েই ব’সে থাকবো। তাছাড়া এ-কদিনের রাস্তার ধকলে সবাই বেশ ক্লান্তও হয়ে পড়েছে, এই উপলক্ষে একটু বিশ্রাম ক’রে নিয়ে ফের বেশ টাটকা হ’য়ে নেয়া যাবে। তাছাড়া সন্ধেও হয়ে এসেছে–এমনিতেই আমাদের এখন না-হোক একটু পরেই তাঁবু খাঁটাতে হ’তো।’
আয়ারটন যখন বলছিলো যে তাকে ব্ল্যাকপয়েন্ট স্টেশনে গিয়ে মিস্ত্রি ডেকে আনতে হবে, তখন মেজর ম্যাকন্যাব্স পাশে দাঁড়িয়েই সব কথাবার্তা শুনছিলেন। এভাবে তার একা-একা, সঙ্গীসাথী বিনাই, তাঁবু ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তাবটা ম্যাকন্যাব্সের মোটেই মনে ধরেনি। কী-একটা বলতে গিয়েও কথাগুলো তিনি যেন গিলে ফেললেন। মিথ্যেমিথ্যে তাঁর সন্দেহের কথাটা উঠিয়ে লাভ কী? তাছাড়া, সত্যি-তো, এ-সন্দেহের পেছনে সত্যিকার-কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ তো তাঁর নেই, শুধু-একটা অনুভূতি, মনের ভেতরে কোথায় যেন অস্পষ্ট-একটা কোণে খচখচ ক’রে কী-একটা কাঁটা বিধছে—আর এ-ধরনের অনুভূতিকে পাত্তা দেয়াটা তাঁর ধাতে নেই, যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ নিছক অনুভূতির ওপর নির্ভর ক’রে কোনো রণকৌশল তৈরি করে না, সবসময়েই সেখানে চাই হাতেনাতে কোনো প্ৰমাণ।
উদ্বেগটা মেজর ম্যাকন্যাব্সের যে একারই ছিলো তা নয়, স্বয়ং লর্ড এডওয়ার্ডও কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন। কিন্তু তাঁর অস্বস্তির প্রকৃতিটা ছিলো সম্পূর্ণই অন্যরকম। আয়ারটন যদি কোনো মিস্ত্রি না পায়, তাহলে ভাঙা গাড়ি সারিয়ে নিতে বেশ কিছুদিন সময় নষ্ট হবে। অথচ তিনি চাচ্ছিলেন পারলে এক্ষুনি তাঁর অভিযানটায় বেরিয়ে পড়তে।
দিন ফুটতে-না-ফুটতেই কিন্তু অস্বস্তিটা কেটে গেলো। মিস্ত্রি নিয়ে ফিরে এলো আয়ারটন, ধূলিধূসর ও ক্লান্ত– সারারাত সে একটুও বিশ্রাম করেনি, সোজা গেছে সে ব্ল্যাকপয়েন্টে, তারপর খোঁজখবর ক’রেই মিস্ত্রিকে নিয়ে ফের ফিরতি রাস্তা ধরেছে ও।
তবে যে-মিস্ত্রিকে সে সঙ্গে ক’রে নিয়ে এসেছে, তাকে দেখতে ঠিক যেন কোনো ডাকাতের মতো। প্রকাণ্ড, দড়িপাকানো চেহারা, সারা শরীরে মেদ বলতে কিছু নেই—শুধু পেশী যেন নেচে বেড়াচ্ছে। লোকটা কথা কম বলে, পারলে হয়তো মুখে কুলুপ এঁটেই থাকতো সারাক্ষণ, কিন্তু কাজ জানে।
কোনো লোককে প্রথম দেখবামাত্র কেন ডাকাত-ডাকাত বলে মনে হয়, এটারও কোনো সদুত্তর জানা নেই লর্ড এডওয়ার্ডের। সম্ভবত সেদিন যখন জাক পাঞ্চয়ল অস্ট্রেলিয়ায় কারা-কারা ভাগ্যের সন্ধানে এসেছে, এ-সম্বন্ধে জ্ঞান দিচ্ছিলেন, তখনই মনের মধ্যে অবিশ্বাসের একটা বীজ বুনে দেয়া হয়েছে। ইওরোপ থেকে এত-দূরে যারা এসেছে তারা হয় কয়েদি—নয়তো আইনের হাত থেকে পালাবে বলেই এখানে এসেছে, ডাকাবুকো সব লোক, সম্ভবত স্বয়ং লুসিফারকেও ভয় পায় না।
লোকটা যে সত্যি-সত্যি মিস্ত্রি একজন, তা তার কাজ করবার ধরন দেখেই বোঝা গেছে। আড়াই ঘন্টাও লাগেনি, সে পাকাহাতে ওস্তাদের মতো গাড়ি মেরামত ক’রে দিয়েছে।
মেজর ম্যাকন্যস কিন্তু সবসময়েই সঙ্গে-সঙ্গে ছিলেন, সজাগ চোখে সব খেয়াল ক’রে যাচ্ছিলেন। আর এতটা সজাগভাবে খুঁটিয়ে লক্ষ করেছেন ব’লেই একসময়ে তাঁর চোখে পড়েছে লোকটার কব্জিটা—সেখানে কোনো-একটা আঁটো বালার মতো একটা কালচে দাগ ফুটে আছে। কীসের দাগ এটা? লোকটা যখন ঘোড়ার নাল পরাচ্ছে, তখন হঠাৎ নজরে এলো, নালগুলোর তলা থেকে তেকোণা খানিকটা অংশ যেন কেটে নেয়া হয়েছে। অবাক হ’য়ে গিয়েছে মেজর ম্যাকন্যাব্স তার কারণটা জানতে চাইলেন—আয়ারটন বললে, ‘এখানকার সব ঘোড়ার মালিকরাই তাদের ঘোড়ার নালে বিশেষ-বিশেষ চিহ্ন ব্যবহার করে—যাতে ঘোড়া হারিয়ে গেলে বা চুরি হয়ে গেলে, সেই বিশেষ নালের ছাপ দেখে তাকে খুঁজে বার করা যায়–বা অনেক ঘোড়ার মধ্য থেকে তাকে শনাক্ত করা যায়। এটা ব্ল্যাকপয়েন্টের চিহ্ন।’
ঘোড়াগুলোর নাল পরাতে আধঘন্টার বেশি লাগলো না তার। কাজ শেষ হবামাত্র মজুরি আর দরাজ বখশিশ নিয়ে লোকটা সেলাম ঠুকে চ’লে গেলো।
সে চ’লে যেতেই, তোড়জোড় করে ফের শুরু হ’লো অভিযান—কাপ্তেন গ্রান্টের সন্ধানে। কিছুক্ষণ যাবার পরই দূর থেকে ভেসে এলো রেলের এনজিনের বাঁশি—তীক্ষ্ণ প্রলম্বিত ধাতব কু-উ-উ আওয়াজ। তারপরেই দেখা গেলো রাস্তাটা যেখানে গিয়ে রেলপথের গায়ে পড়েছে, সেখানে ভুশ-ভুশ ক’রে কালোধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে আর তীক্ষ্ণ সুরে বাঁশি বাজাতে-বাজাতে একটা এনজিন কোত্থেকে যেন এসে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। ঘোড়াটায় ছপটি মেরে লর্ড এডওয়ার্ড কাছে এগিয়ে গেলেন—হঠাৎ এভাবে মাঝপথেই ট্রেনের এনজিন থেমে পড়লো কেন?
কিন্তু কাছে গিয়েই আঁৎকে উঠলেন লর্ড গ্লেনারভন। ভাঙা সেতুর তলায়, নদীর পাড়ে আর জলের মধ্যে কতগুলো বগি ভাঙাচোরা প’ড়ে আছে। শুধু মাল রাখবার জন্যে যে-লাগেজভ্যানটা ছিলো, সেটা সম্ভবত পেছনে ছিলো ব’লেই দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে।
এরই মধ্যে দলে-দলে লোক ছুটে আসছে অকুস্থলে, দুর্ঘটনার দৃশ্য দেখতে। এই-যে এনজিনটা বাঁশি বাজাতে-বাজাতে এখানে এসে থেমেছে, তাতে ক’রে স্বয়ং সার্ভেয়ার জেনারেল এসেছেন ব্যাপারটা সরেজমিন তদন্ত ক’রে দেখতে। লর্ড গ্লেনারভন নিজেই এগিয়ে গেলেন তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে। পরস্পরের পরিচয় আদানপ্রদানের কাজটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, হঠাৎ একটা বিষম কোলাহল উঠলো। তারপরেই লোকজন ধরাধরি ক’রে নিয়ে এলো গার্ডের মৃতদেহ—লাশটার বুকে বিঁধে রয়েছে একটা ছোরা, প্রায় বাঁটশুদ্ধুই যেন ঢোকানো।
‘ঠিক এই ভয়টাই করছিলুম, সার্ভেয়ার জেনারেল জানালেন। ‘পুলিশ জানিয়েছে যে ব্রিজটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভাঙেনি, কারা যেন বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।’
‘অর্থাৎ?’
‘অর্থাৎ ট্রেনটা যাতে এখানে এসে অতর্কিতে উলটে পড়ে, তারই ব্যবস্থা ক’রে রেখেছে কেউ বা কারা। ট্রেনদস্যুরা ইচ্ছে ক’রেই মলব এঁটেছিলো সামনের কামরাগুলো যাতে নদীতে প’ড়ে যায়—তারপর তারা পরমানন্দে পেছনের লাগেজভ্যানের মালপত্র লুঠ করতে পারে।’
‘এ-রকম হয় নাকি এখানে?’
‘হবে না-ই বা কেন? গোটা অস্ট্রেলিয়াই তো সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধীদের আস্তানা। তাছাড়া অনেক কয়েদিকেও তো সাজার মেয়াদ শেষ হবার পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তারা এখানে যা-খুশি করে বেড়ায়। এখন দেখবেন, লর্ড এডওয়ার্ড, এই ডাকাতির জের কতদূর গড়ায়।’
‘দুর্ঘটনাটা ঘটলোই বা কখন?’
‘কাল নিশুতরাতে। সোয়া-তিনটে নাগাদ।‘
লর্ড গ্লেনারভন বেশ-চিন্তিতভাবেই ফিরে এলেন তাঁর বহরের কাছে। এই ব্যাপারটা তাঁকে শুধু-যে ভাবাচ্ছে তা-ই নয়, তাঁকে কী-রকম যেন সশঙ্ক ক’রে তুলেছে। এই ডাকাতদের প্রাণে মায়াদয়া ব’লে কিছু নেই। কিছু মালপত্র লুঠ করতে পারবে ব’লে যারা একটা যাত্রীবাহী ট্রেন ও-রকমভাবে উলটে দিতে পারে, অনেক নিরীহ নির্বিরোধী লোককে বিনাবাক্যব্যয়ে খতম ক’রে দিতে পারে, তাদের নজর একবার যদি এই বহরের ওপর পড়ে, তাহলেই সর্বনাশ! আয়ারটন বোধহয় ঠিক কথাই বলেছিলো। আরোকয়েকজন সশস্ত্র নাবিক সঙ্গে নিয়ে এলে ডাকাতদের আচম্বিত হামলা ঠেকাতে সুবিধে হতো। এখন অবিশ্যি দিনরাত কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
সেদিন বহর যখন একটা কবরখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছে—না, কোনো গির্জে নেই আশপাশে, কবরখানা বলতে একজায়গায় কতগুলো ক্রুশকাঠ বসানো, এইটুকুই শুধু—তখন দেখা গেলো সেখানে ঐ ক্রুশকাঠগুলোর মধ্যেই প’ড়ে-পড়ে ঘুমুচ্ছে একটা বাচ্চা ছেলে। কত আর বয়েস হবে? আট কি নয়, গায়ের রং কালো। নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসিন্দাদেরই কেউ। ছেলেটার মুখচোখে ঝকঝকে বুদ্ধির ছাপ। তার গলায় ঝুলছে একটা টিকিট—তাতে লেখা : অমুক জায়গায় নিয়ে গিয়ে তমুকের হাতে তুলে দেবার জন্যে এই টোলিন নামের ছেলেটিকে অমুক কুলির সঙ্গে ট্রেনে ক’রে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু ছেলেটি একাই শুয়ে আছে এখানে—আশপাশে আর-কেউ নেই। তার মানে ঐ ট্রেনদুর্ঘটনায় কুলিটি নিশ্চয়ই মারা গেছে, আর এই ছেলেটি কেমন ক’রে যেন প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। অকুস্থল থেকে সে পালিয়ে এসেছিলো চটপট—তারপর ক্লান্ত হ’য়ে এখানে প’ড়ে টানা একটা ঘুম লাগাচ্ছে।
ছেলেটিকে দেখেই তাঁর বলদে টানা গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন লেডি হেলেনা। তাকে এইরকম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে, আর পুরো ব্যাপারটা তলিয়ে বুঝে নিয়ে, লেডি হেলেনার কেমন যেন মায়া প’ড়ে গেলো ছেলেটির প্রতি। তিনি যখন ঝুঁকে প’ড়ে ছেলেটির গলায় বাঁধা টিকিটটা পড়ছেন, অমনি ছেলেটির ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ রগড়াতে রগড়াতে সে ধড়মড় ক’রে উঠে বসলো। যখন সে তার ডাগর চোখদুটি মেলে আশপাশে তাকালে, তখন তার দৃষ্টিতে একই সঙ্গে ফুটে উঠেছে ভয়, বিস্ময় আর কৌতূহলের ছাপ।
লেডি হেলেনা তাকে জিগেস করতেই সে নিজের পরিচয় দিলে – স্পষ্ট, পরিষ্কার ইংরেজি উচ্চারণ তার। মিশনারি স্কুলে থেকে সে ইংরেজ মিশনারিদের কাছে পড়াশুনো করে। পরীক্ষা শেষ হ’য়ে গিয়ে ফল বেরিয়েছে, এখন বেশ কিছুদিন ছুটি—বড়োদিন আর নববর্ষের। ছুটি কাটাতেই সে বাড়ি যাচ্ছিলো মা-বাবার কাছে। পরীক্ষায় ভালোভাবেই উৎরেছে সে, কিন্তু সবচেয়ে ভালো করেছে সে জিওগ্রাফিতে, ভূগোলে সে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে।
এতক্ষণ লেডি হেলেনাই কথা বলছিলেন ব’লে জাক পাঞ্চয়ল মাঝে প’ড়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। কিন্তু যেই শুনলেন ছেলেটি ভূগোলে প্রথম পুরস্কার পেয়েছে, অমনি তাঁর মাথায় কুট ক’রে যেন একটা পোকা কামড়ালো। কেমনতর ভূগোলের জ্ঞান ছেলেটির? তিনি নিজে কি তার পরীক্ষা নিয়ে যাচাই ক’রে দেখবেন একবার? কিন্তু দু-একটা প্রশ্ন ক’রেই যা উত্তর শুনলেন তাতে তাঁর চোখ কপালে উঠলো। তাজ্জব সব জিনিশ ‘শিখিয়েছে তাকে ইংরেজ মিশনারিরা। উপনিবেশের শিক্ষাব্যবস্থা যে এমনতর উদ্ভট-সব তথ্যে ভরা তা তাঁর জানা ছিলো না। না, শুধু তাঁরই নয়, অন্যরা ছেলেটির কথা না-শুনলে কিছুতেই তা আন্দাজ করতে পারতেন না।
ইংরেজ মিশনারিরা ছেলেটিকে শিখিয়েছে, এই ধরাধামের একচ্ছত্র অধীশ্বর ইংরেজরাই—স্বর্গটা প্রভু জিশুর, পৃথিবীটা ইংরেজদের। তার প্রমাণই হ’লো যে ইংরেজ রাজত্বে সূর্য কখনও অস্ত যায় না। এ-দেশে যখন রাত, অন্যদেশে তখন দিন। এমনকী গোটা ইওরোপটাও ইংরেজদের পদানত—ফ্রান্স শুদ্ধ।
এই ফ্রান্স শুদ্ধু কথাটা শুনেই ফ্রান্সের ভূগোলপণ্ডিত জাক পাঞ্চয়লের চোখ আরো-ছানাবড়া হ’য়ে গেছে! কী-একটা বলতে গিয়ে চেপে গেলেন—তারপরেই হা-হা ক’রে অট্টহাসি হেসে উঠলেন।
তারপর হাসি থামিয়ে যা বললেন তার সারাংশ হলো এই : ইংরেজরা ঝুড়ি-ঝুড়ি মিথ্যেকথা বলে, এটা কেই বা না জানে। কিন্তু বাচ্চা ছেলেদেরও ধ’রে-ধরে এমন আজগুবি আর উদ্ভট কথাবার্তা শেখালে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। অতএব—তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন—অতএব এই ছেলেটির ভূগোলের জ্ঞান শুধরে দেবার দায়টা তিনি স্বয়ং এই-মুহূর্ত থেকে নিজেদের কাঁধে তুলে নিলেন। ভারতবর্ষ বলতে যে গোটা এশিয়া বোঝায় না, আর কলকাতা যে সমগ্র এশিয়ার রাজধানী নয়—এ-সব তথ্য যদি এক্ষুনি শুধরে না-দেন, তাহ’লে তো ছেলেটির যাবতীয় লেখাপড়া শেখাই মাটি হবে।
এবং যেমন কথা, তেমনি কাজ। তক্ষুনি। লর্ড গ্লেনারভনের যে-ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার ছিলো ঐ বলদে-টানা গাড়িটায়, সেখান থেকে তক্ষুনি পাঞয়ল রিচার্ডসনের লেখা ভূগোলবইটা নিয়ে এনে দিলেন ছেলেটিকে, বললেন মন দিয়ে যেন এ-বইটা সে দেখে নেয়, পরে তিনি তার পরীক্ষা নেবেন।
কিন্তু পরের দিন ভোরবেলায়—হায়-রে কপাল!—কোথায় গেলো জাক পাঞ্চয়লের নতুন রংরুট-করা ছাত্র। গোটা তাঁবুতে শুধু নয়, আশপাশে কোথাও সে নেই। রিচার্ডসনের ভূগোলবইটা রয়েছে পাঞয়লের কোটের পকেটে, আর লেডি হেলেনার বুকের ওপর রয়েছে একগুচ্ছ ফুল—এই শুখা মরশুমে অস্ট্রেলিয়ায় এমন টাটকা ফুল দুর্লভ বৈ-কি! টোলিন কেন চ’লে গিয়েছে, কে জানে! সে পথ চিনে-চিনে যেতে পারবে তো তার মা-বাবার কাছে? কিংবা যদি বুদ্ধি করে চার্চের স্কুলেও ফিরে যায় তাহ’লেও বাঁচোয়া—নইলে এমন লোকালয়হীন খাঁ-খাঁ প্রান্তরে সে যাবে কোথায়?
রাস্তা এখান থেকে শুধু রুক্ষ বা ঊষরই নয়, উবড়োখাবড়ো, বন্ধুর। বহরের গতি স্বভাবতই ঢিমে হ’য়ে এলো, বিশেষ ক’রে এই অসমতল পথ দিয়ে বলদে-টানা গাড়ির যেতে অসুবিধে হচ্ছিলো খুবই—এমনভাবে গাড়ির ভেতরটা দুলছে একাৎ-ওকাৎ হচ্ছে যেন ঝড়ের সমুদ্রে পড়েছে কোনো নৌকো। এত ঝাঁকুনি লাগে যে হাড়গোড় বোধহয় চুর-চুর হ’য়ে যাচ্ছে। আর এই ভাবেই যেতে-যেতে অবশেষে দূর থেকে দেখা গেলো একটা পাহাড়। আয়ারটন জানালে এই পাহাড়ের নাম নাকি আলেকজান্ডার—এখানে নাকি প্রসপেক্টররা মাটি খুঁড়ে সোনা পেয়েছে।
সেদিন বছরের শেষদিন, ৩১ ডিসেম্বর, অসহ্য গরম, যেন লু বইছে, আর তারই মধ্যে বহর এসে পৌঁছুলো মাউন্ট আলেকজান্ডারে। সোনা এমন একটা ধাতু যার নাম শুনলেই কেমন যেন চোখ চকচক ক’রে ওঠে সকলের, আর সেটা নিশ্চয়ই নিছক সৌন্দর্যত্যায় নয়—কেননা প্রায় সবধাতুরই নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, কিন্তু সোনার মতো আর-কিছু এমন ক’রে মানুষকে আকৃষ্ট করেনি। মাউন্ট আলেকজান্ডারের কথা শোনবামাত্র সকলেরই ইচ্ছে হলো একবার গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসেন সোনার খনি। এমনিতে, অনেক সময়েই বড়ো-বড়ো সোনার ডেলার বদলে সুতোর মতো সোনার একটা রেখা চ’লে যায় পাথরের মধ্যে, অথবা মিশে থাকে মাটির ঢেলায়। কখনও-বা মিশে থাকে বালিতেও। তাকে ঝাঁঝরির মধ্য দিয়ে সাফ ক’রে নিতে হয়; পাথর ভেঙে বার ক’রে নিতে হয় সোনার সুতো; মাটির ঢেলা থেকে সোনা আলাদা করে নেবার জন্যে অনেক সময় এমনকী জল ও মাটিকে গুলে নেয়া হয়, তারপর সেই জল পরিসূত ক’রে নেয়া হয়, ঘোলাজল নিয়ে যায় মাটি, প’ড়ে থাকে সোনার গুঁড়ো। কীভাবে সোনা খুঁড়ে তোলা হয় সেটা যেমন দেখে এলেন সবাই, তেমনি দেখে এলেন সোনা তোলবার পর দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য যে-বাড়িটার কোষাগারে সে-সব জমা দেয়া হয়। সেখান থেকে প্রত্যেক প্রসপেক্টরকেই রসিদ দেয়া হয়, কে-কত আউন্স সোনা তুলেছে, তারপর সেগুলো চালান দেবার ব্যবস্থাও করা হয়, কড়া পাহারা থাকে সবসময়, বন্দুকের ঘোড়ায় থাকে তাদের হাত, আর সে-হাত প্রায় সবসময়েই চুলবুল ক’রে ওঠে, একটু-কিছু সন্দেহজনক দেখলেই গুলিগোলা চলে হরদম। বিশেষত ডাকাতের উৎপাত বেড়ে যাবার পর থেকে কড়াক্কড়ি বেড়েছে প্রচুর। এখনাকার ডাকাতরা যেমন প্রাণের ভয় করে না, এখানকার সেপাইশাস্ত্রীরাও প্রায় সে-রকম। যারা সেপাই হয়েছে, তারাও যেমন অবস্থাবিপাকে ডাকাত হ’য়ে যেতো পারতো, ডাকাতরাও অনেকে ঠিকমতো সুযোগ পেলে সেপাইশাস্ত্রী হয়ে উঠতে পারতো। সেপাই বা ডাকাত—দুয়েরই স্বভাবপ্রকৃতি বা মনের ধাতের মধ্যে তফাৎ যা আছে, তা সামন্যই এখানে তো উর্দি দেখেও বোঝবার জো নেই কে যে কী। তার ওপর এই মাউন্ট আলেকজান্ডারে আবার সোনা খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে নানারকম দামিপাথর, সেগুলো আবার থরে থরে সাজানো আছে কোষাগারের সংগ্রশালায়। কতরকম রঙবেরঙের পাথর, পাথর না-বলে তাদের হয়তো রত্ন বলাই উচিত। এত-সব ঘুরে ঘুরে দেখতে-দেখতে পণ্ডিতপ্রবর জাক পাঞ্চয়লের চোখের মণিও কেমন জ্বলজ্বল ক’রে উঠেছিলো। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিলো যদি একটা সোনার ঢেলা সঙ্গে ক’রে নেয়া যেতো।
তাঁর হাবভাব দেখে মেজর ম্যাকন্যাব্স একবার শুধু চিবিয়ে-চিবিয়ে বলেছিলেন : ‘খামকা আর ছোট্ট-একটা সোনার ঢেলা নিয়ে গিয়ে কী করবেন, মঁসিয় পাঞয়ল? তার চেয়ে—ঐ দেখুন দামিপাথর আছে এখানে—খুঁজলে হয়তো পরশপাথরই পেয়ে যাবেন একটা। জগতের দার্শনিকরা তো তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন চিরকাল—তা-ই না? আপনিও খুঁজে দেখুন না—পরশপাথর খুঁজে পেয়ে গেলে ফ্রাসে ফিরে যা-ই ছোঁবেন, তা-ই তো সোনা হ’য়ে যাবে। এখান থেকে অত ওজন ব’য়ে নিয়ে যেতে আর হবে না তাহ’লে।’
তাঁর এই অপরূপ তাত্ত্বিক ইয়ার্কিটি শোনবার পর সেখানে যে নিছক হাসির হররাই উঠলো তা নয়, মঁসিয় পাঞয়লের ভূতুড়ে আবেশটাও একনিমেষে কেটে গেলো।
নতুন বছরে প্রথম দিনটাও কাটলো সেই স্বর্ণ-উপত্যকা পেরিয়ে আবার অপেক্ষাকৃত সমতলভূমিতে নেমে আসতে। তারপর জানুয়ারির দুই তারিখে বহর এসে পৌঁছুলো সারি সারি ইউক্যালিপটাস গাছের দুরতিক্রম্য এক জঙ্গলে। এত-নিবিড়ভাবে গাছগুলো সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যে ফাঁকফোকর দিয়ে গ’লে বলদে-টানা গাড়িটা নিয়ে-যাওয়াই দায়। তার ওপর আবার এই ঢ্যাঙা-ঢ্যাঙা গাছগুলোর রুপোলি ঢালে রোদ্দুর প’ড়ে ঝলসে ওঠে—চোখ ধাঁধিয়ে যায়। আর কেমন-একটা ঝিমধরা গন্ধ, সুগন্ধই বলা যায়, কিন্তু এতগুলো গাছ থেকে এই গন্ধ বেরুচ্ছে যে হাওয়া যেন তাতে কেমন ভারি হ’য়ে আছে। পাঞয়ল সুযোগ পাবামাত্রই জ্ঞান দেখিয়ে ব’লে উঠেছেন : ‘এই ইউক্যালিপটাস নামটা এসেছে গ্রিক কালুপ্তোস থেকে, সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে লাতিন ইউ। কালুপ্তোস মানে ঢেকে ফেলা, কারণ এর ফলগুলো পাপড়ি মেলবার আগে টুপির মতো কিছু দিয়ে ঢাকা থাকে, যাতে রোদ্দুর থেকে বাঁচে।’
রবার্ট কৌতূহলী হ’য়ে জিগেস করলে, ‘আর এই গন্ধ? সে কি ঐ মুদিত কুসুমকলি থেকেই আসে?’ পাঞয়লের সঙ্গে কথা বলবার সময় রবার্ট ফাজলেমি করে মাঝে -মাঝে সাধুভাষা ব্যবহার করতে শুরু করেছে। ‘না কি গাছের ঐ রুপোলি বাকল থেকে?’
‘না, না, গাছটার গুঁড়ি বা কাণ্ড কাঠ হিশেবে ব্যবহার করা হয়—গন্ধ মূলত আসছে এর বাহারে, সতেজ আর সবুজ পাতাগুলি থেকে, ঐ পাতাগুলো নিংড়েই বার করে নেয়া হয় ইউক্যালিপটাসের তেল—আর সে-সব লোকে অ্যান্টিসেপটিক হিশেবে ব্যবহার করে?’
‘কিন্তু এ-গাছ তো কই আমি আমাদের দেশে দেখিনি!’
‘গাছটা প্রধানত হয় অস্ট্রেলেশিয়ায়—সেখানে রীতিমতো চাষ করা হয় এর। এই বনটাকে দেখে মনে হচ্ছে এটাও কারু আবাদ হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু এর মজা হচ্ছে একবার লাগালেই হ’লো, কোনো তদারক আর করতে হয় না বিশেষ। মাটি থেকে রস শুষে নেয়। ঐ যাকে বলেছো মুদিত কুসুমকলি, শুখা সময়ের জন্যে তার ভেতরেই গাছ তার প্রাণরস জমিয়ে রাখে। কিন্তু কালুপ্তোস মানে তো ঢেকে দেয়া—ছেয়ে দেয়া, যেন সবকিছু ছেয়ে আছে—সোজা সরলরেখায় উঠে যায় এই গাছ, কখনও-কখনও দুশো ফিট অব্দি লম্বা হয়। ঐ ওপর থেকেই বোধহয় নজর রাখে সবকিছুর ওপর, ঢেকে রাখে তলার জমি।’
বক্তৃতার একটা মনোমতো বিষয় পেলে জাক পাঞ্চয়ল আর-কিছু চান না—তুবড়ির মতো জ্ঞানগর্ভ বাক্য বেরিয়ে আসতে থাকে মুখ থেকে। ছুটলে কথা থামায় কে? অন্তত কোনো ফরাশির মুখ বন্ধ করবে কে—কথার জাহাজ একেকজনে—মেজর ম্যাকন্যাব্সের মতে, সেইজন্যেই তারা সবাই কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা।
পরের দিন সূর্য ডোবার সময় জঙ্গলের পাশেই দেখা গেলো ছোট্ট একটা লোকালয়—শহর ঠিক নয়, বরং ছোটো-একটা গ্রাম। নাম সীমূর। কিন্তু অজ পাড়াগাঁ হ’লে কী হবে, এখানে একটা সরাইখানা আছে। সেই সরাইখানাতে আশ্রয় নেবার পর রবার্টকে সঙ্গে ক’রে পাঞয়ল গোটা গ্রামটায় একটা টহল দিয়ে এলেন। এবং সারাক্ষণই চললেন নানা বিষয়ে জ্ঞান বিলোতে বিলোতে। রবার্ট সেদিক দিয়ে খুব ভালো শ্রোতা—মাঝে-মাঝে ফোড়ন কাটে, উসকে দেয় আর পাঞয়লের শ্রীমুখ থেকে নিঃসৃত হ’তে থাকে কথার ফুলঝুরি। আর তাই, নিজের বক্তৃতায় এতটাই মশগুল ছিলেন পাঞয়ল, যে খেয়ালও করেননি গোটা গ্রামটায় এত উত্তেজনা আর চাঞ্চল্য কেন।
ঐ দুর্ধর্ষ ট্রেনডাকাতির পর থেকেই গোটা ভিক্টরিয়া রাজ্যই অত্যন্ত হুঁশিয়ার হ’য়ে উঠেছে। রাতে তারা বারে বারে এসে লক্ষ ক’রে যায় দরজা-জানলা ঠিকঠাক বন্ধ ক’রে রেখেছে কি না। লর্ড গ্লেনারভনের বহরও এই ক-দিন অত্যন্ত সাবধান হ’য়ে পথ চলেছে, কড়ানজর রেখেছে চারপাশে, সারাক্ষণই থেকেছে সজাগ সেইজন্যে এই সীমুরের লোকদের চাঞ্চল্যটা পাঞয়লের একটু খেয়াল ক’রে দেখা উচিত ছিলো। কিন্তু নিজের কথা শুনতে তাঁর এতই ভালো লাগে যে চারপাশে যে একটা চাপা ফিশফিশ গুজুর গুজুর উত্তেজনা চলেছে সেটা তিনি আদপেই লক্ষ করেননি।
কিন্তু সরাইখানার মালিকের সঙ্গে দু-চারমিনিট এটা-সেটা নিয়ে কথা ব’লেই উত্তেজনার মূল কারণটা জেনে ফেলেছিলেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। জেনেও, তিনি রাটি কাড়েননি। চুপচাপ বসেছিলেন খাবারটেবিলে, ছুরি-কাঁটা-সুপের বাটিতেই মনোনিবেশ ক’রে বসেছিলেন। পরে যখন লেডি হেলেনা ও মেরির সঙ্গে রবার্টও শুতে চ’লে গেলো, তখনই মেজর ম্যাকন্যাব্স কথাটা পাড়লেন ঠাণ্ডা চাপাগলায়। ‘অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড নিউ-জিল্যান্ড গেজেটে খবর বেরিয়েছে—ডাকাতদলের নাকি খোঁজ পাওয়া গেছে।’
সঙ্গে-সঙ্গে, কেমন-একটু চঞ্চল স্বরেই বুঝি, আয়ারটন জিগেস করলে, ‘ধরা পড়েছে?’
গত কয়েকদিন ধ’রে ডাকাতদের ভয়ে যেভাবে রাতের ঘুম মাথায় উঠে গিয়েছিলো, তাতে এই খবরটা শুনে একটু চাঞ্চল্য তো হবেই। যাক, এবার তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা যাবে।
মেজর খুবই ছোট্ট উত্তর দিলেন। কাটা-কাটা গলায় বললেন, ‘না।’
লর্ড এডওয়ার্ড জিগেস করলেন : ‘খোঁজ পাওয়া গেছে মানে? এরা কারা—সে খবর কি জানা গেছে?’
কথাটি না-বলে মেজর ম্যাকন্যাব্স লর্ড এডওয়ার্ডের দিকে খবরকাগজটা এগিয়ে দিলেন। চক্ষের নিমেষে খবরটার ওপর চোখ বুলিয়ে নিলেন গ্লেনারভন। যেন গোগ্রাসে গিললেন খবরটাকে।
আয়ারল্যান্ড থেকে দ্বীপান্তরে পাঠাবার সময় বেপরোয়া উনত্রিশজন ডাকাত ছ-মাস আগে পুলিশপাহারার নজর এড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। এদের পাণ্ডাটির নাম বেন জয়েস—যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি দুঃসাহসী; কিন্তু শুধু প্রচণ্ড দুঃসাহসই তার নেই, মাথায় প্রচণ্ড বুদ্ধি। এতই ধূর্ত যে পুলিশ এর আগে এই নরাধমের কোনো নাগালই পায়নি, তো পাকড়াবে কী করে? কী ক’রে সে যে এখন অস্ট্রেলিয়ায় এসে হাজির হয়েছে, সেটাও একটা দুর্ভেদ্য প্রহেলিকা। স্যান্ডহার্স্ট রেলপথে ট্রেনটা উলটে দিয়ে দুর্ঘটনাটা ঘটিয়েছে এরাই—যাতে অনায়াসেই লুঠের কাজ চালাতে পারে।
প’ড়েই লর্ড এডওয়ার্ডের চোখ কপালে উঠে গেলো। তাহ’লে কি স্থলপথে যাবার পরিকল্পনাটা খারিজ করতে হবে? তবে কি মেলবোর্নে গিয়েই উঠে পড়বেন ডানকানে?
তাঁর প্রশ্নটা শুনে মেজর ম্যাকন্যাব্স সরাসরি আয়ারটনকেই জিগেস ক’রে বসলেন : ‘আয়ারটন, তুমি কী বলো? আমাদের পক্ষে এখন কী করলে ঠিক হবে? মনে রেখো, এই মক্কেলের নাম বেন জয়েস—পুলিশের কর্তারা অব্দি তাকে ডরান।’
আয়ারটন কী যেন একটু ভেবে বললে, ‘আমরা এখনও মেলবোর্ন থেকে দুশো মাইল দূরে রয়েছি। এতটা পথ পেরিয়ে সেখানে পৌঁছুতে আমাদের অনেকটাই সময় লেগে যাবে। এ-রাস্তার কোনখানে কোন বিপদ ওৎ পেতে লুকিয়ে আছে, তা কে বলবে?’
লর্ড এডওয়ার্ড জিগেস করলেন, ‘তাহ’লে কী করবো?’
‘দেখুন,’ আয়ারটন বিশদ ক’রে বললে, ‘বিপদের ভয় যদি করেন, তবে এটা মানতে হয় যে বিপদ যে-কোনোদিক থেকেই আসতে পারে। আমরা মেলবোর্নের পথই ধরি, কিংবা সোজা নাকবরাবর এগুই—কোথাও আমরা খুব-একটা নিরাপদ নই। বেন জয়েসের দল কোথায় আছে, কেউ জানে না—সে যদি আমাদের ওপর হামলা করতে চায় তবে যেদিকেই যা-ই না কেন, সেদিকেই সে এসে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আমরা আটজন লোক যদি সজাগ থাকি আর দৃঢ়তার সঙ্গে তাদের ঠেকিয়ে রাখতে চাই, তাহ’লে আমার মনে হয় আমরা আটজনেই ঊনত্রিশজন ডাকাতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবো। আমাদের শুধু খেয়াল রাখতে হবে, বিপদের সময় আমরা যাতে ঘাবড়ে গিয়ে কোনো গণ্ডগোল না-ক’রে বসি—যেন সবসময় মাথা ঠাণ্ডা রাখি। আমরা যদি খুব-বিচলিত বোধ না-করি, তাহলে বলবো আমরা যেদিকে চলেছি, সেদিকেই বরং ক্রমাগত এগিয়ে যাই।’
‘হ্যাঁ, আমাদের ছকটা হঠাৎ দুম করে পালটে ফেলার কোনোই মানে হয় না, পাঞয়ল সায় দিয়ে বললেন, ‘তাছাড়া কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খোঁজ তো অ্যাদ্দিনেও পাওয়া যায়নি—সেটা পাওয়া যেতে পারে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে গেলেই।’
‘তবে,’ আয়ারটন বললে, ‘সাবধানের মার নেই। আমরা যদি খোলাখুলি ডানকান জাহাজে খবর পাঠিয়ে দিই, তবে তারাও অহেতুক আমাদের নিয়ে ভাববে না।’ জাহাজের কথাটা উঠতেই কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের মনে হ’লো, এবার আলোচনাটায় তাঁরও অংশ নেয়া উচিত। ‘খামকা ওদের খবর পাঠিয়ে লাভ কী হবে? এখনও নিশ্চয়ই মেরামতের কাজ শেষ হয়নি। আমরা যদি হঠাৎ দুম ক’রে আমাদের বাদ দিয়েই ডানকানকেচ’লে যেতে বলি, তাহলে পরে আমাদেরই মুশকিলে পড়তে হতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে হঠাৎ কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো খবর এলে আমাদের হয়তো জলপথেই বেরিয়ে পড়তে হ’তে পারে। জাহাজ যদি আগেই ছেড়ে যায় তবে হয়তো দরকারের সময় আমরা গিয়ে মেলবোর্নে জাহাজ ধরতে পারবো না।’ .
‘হ্যাঁ, আগেকার প্ল্যানমাফিক ডানকানের যেখানে থাকবার কথা, সে না-হয় সেখানেই থাকুক—তাদের অযথা খবর পাঠিয়ে বিব্রত ক’রে কোনো লাভ নেই,’ এই মন্তব্যটা খোদ লর্ড এডওয়ার্ডের। আর তা শুনে আয়ারটন আর সে নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করলে না। বরং বললে, ‘ঠিক আছে। তা-ই না-হয় হোক। তাহলে কাল ভোরেই আমরা এখান থেকে রওনা হ’য়ে পড়বো।’
জানুয়ারি মাসের পাঁচতারিখ সন্ধেবেলায় বহর যেখানে এসে পৌঁছুলো, সেটা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের রাজ্য। এ-অঞ্চল সংরক্ষিত, রিজার্ভড। অর্থাৎ শাদাআদমিরা এখানে যেখানে-খুশি যেতে পারবে, এবং যা-খুশি তা-ই করতে পারবে, কিন্তু এই কালো আদিবাসীরা এর চৌহদ্দি পেরিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। এমনিতেই শাদারা কালোদের নির্বিচারে হত্যা করেছে অ্যাদ্দিন, কিন্তু পাঁচবছর আগেও যে-সব আদিবাসী এখানে ছিলো, যে যার নিজেদের দেশে—এটা তো তাদেরই দেশ, না কী?—তারা ইচ্ছেমতো চলাফেরা ক’রে বেড়াতে পারতো—তাদের অনেক স্বাধীনতা ছিলো। কিন্তু তাদের বাঁচিয়ে রাখার বাহানা ক’রে—এটা একটা ছুতো বই আর-কিছু না, কারু স্বাধীনতা কেড়ে নেবার একটা অছিলাই তো শুধু—তাদের এই জঙ্গলে এনে ঢ্যাঁড়া কেটে গণ্ডি এঁকে ব’লে দেয়া হয়েছে, ‘তোমরা আর-কখনও এই গণ্ডির বাইরে যেতে পারবে না।’
পাঞয়ল বলছিলেন : ‘কিছুদিন আগেও, এই এতটা-রাস্তা পেরুবার সময় অস্ট্রেলিয়ায় যারা আগে থেকেই থাকতো, তাদের অনেককেই আমরা হয়তো দেখতে পেতুম। এবং আর-কিছুদিন পরে হয়তো কোথাও কোনোখানেই তাদের একজনকেও দেখতে পাবো না। অস্ট্রেলিয়া হ’য়ে উঠবে শাদাদেরই দেশ—যেন কেউ জাদুগালচেয় ক’রে ইওরোপটাকেই এখানে এনে বসিয়ে দেবে—তবে বেশির ভাগ লোকই যে ব্রিটেনের হবে, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। এমনকী তারা এ-দেশটার বিভিন্ন অঞ্চলের নামও দেবে নিজেদের দেশের মাতব্বরদের নামে। ভাষাতাত্ত্বিকেরা জানতেও পাবেন না এখানকার লোকে জায়গাগুলোর নাম কী দিয়েছিলো। এই-যেমন, মেলবোর্ন রাজ্যের রাজধানীর নাম দেয়া হয়েছে ভিক্টরিয়া। এটা নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়ার আদিমানুষদের ভাষার কোনো শব্দ নয়।’
‘কিন্তু এ-কথাটা আর নতুন কী? শাদারা যেখানেই গেছে, সুযোগ পেলেই খুন করেছে, বা হঠিয়ে দিয়েছে সে-দেশের আগেকার আধিবাসীদের। মার্কিন মুলুকের কথাই ধরুন না কেন? ইয়াঙ্কিরা ইন্ডিয়ানদের কটা উপজাতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, বলুন?’ এ-কথাটা মেজর ম্যাকন্যাব্স-এর।
পাঞয়ল একটু ক্ষুব্ধ স্বরেই বলেছিলেন : ‘আমার এক-এক সময়ে সন্দেহ হয় এ-সব সংরক্ষিত এলাকা তৈরি করার গোপন মানেটাই হলো আদিবাসীদের সব্বাইকে একটা ছোটো জায়গায় ঠুশে ঢুকিয়ে দাও—তাদের বাকি সব জমিজমা কেড়ে নাও—তারপর দরকার হ’লে গোটা জাতিকে জাতি লোপাট ক’রে দিতে হ’লে আর ভাবনা কী—সব্বাইকেই তো একজায়গায় পেয়ে যাচ্ছো।’
এই কথাগুলো ঠিক কারুই পছন্দ হচ্ছিলো না, এমনকী পাঞয়লের নিজেরও না। বেন জয়েসের লুঠপাটের সঙ্গে সরকারের আইনমাফিক ডাকাতির তফাৎটা কেবল মাত্রায়—সরকার যেটা বিরাট তোড়জোড় ক’রে আইনমাফিক করতে পারে, বেন জয়েস সেটা পারে না—তাছাড়া সে-যে নরাধম তার প্রমাণই তো হ’লো এই তথ্য যে সে শাদাদের হত্যা করে শাদাদের জিনিশপত্র লুঠ ক’রে নেয়।
সংরক্ষিত এলাকার পাশেই তাঁবু খাটানো হয়েছিলো। সন্ধের অন্ধকার নেমে এসেছে তখন। আর তারই মধ্যে হঠাৎ দেখা গেলো আবছামতো কী-একটা জীব ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর ডাল থেকে ডালে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে দূরে মিলিয়ে গেলো।
কোন জীব এটা?
সন্দেহ ভঞ্জন করেছিলেন পাঞয়লই। ‘নিশ্চয়ই ঐ আদিবাসীদেরই একজন হবে—আমাদের ওপর নজর রাখছিলো—এখন অন্যদের খবর দিতে চ’লে গেলো।’
পরের দিন ভোরবেলায় গ্লেনারভনের বহর যখন সরাসরি সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে পড়লো—শাদাদের তো এখানে যেতে কোনো বারণ নেই—তখন খানিকটা এগিয়ে যাবার পরই তুলনায়-খোলামেলা একটা জায়গায় দেখা গেলো আদিবাসীদের ছাউনিগুলো—ডজন খানেক তাঁবুর মতো ঝুপড়ি, আর তার আড়াল থেকেই উঁকি দিচ্ছে ত্রস্ত ও চঞ্চল সব আদিবাসীদের মুখ। ইওরোপের পণ্ডিতদের কথাই আলাদা। কোন-একজন নৃতাত্ত্বিক নাকি অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের দেখে বলেছেন, বাঁদর থেকে মানুষ হ’য়ে যাবার যে-স্তর-পরম্পরা আছে তার মধ্যে একটার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি; এতকাল তাকেই বলতো হারানো যোগসূত্র—মিসিংলিঙ্ক। এই পণ্ডিতের দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছিলো অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরাই নাকি সেই হারানো যোগসূত্র
তা এই মিসিংলিঙ্কদেরও নিজেদের ভাষা আছে, তারা তাদের সেই ভাষাতেই নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ ক’রে, খবরের আদানপ্রদান ক’রে নিজেদের পূর্বপুরুষের গল্প শোনায় ছোটোদের, এই ভাষাতেই তারা গান করে, স্বপ্ন দ্যাখে, আর এতকাল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনেকরকম জল্পনাও করতো—তবে আজকাল তারা জেনে গেছে যে তাদের ভবিষ্যৎ ব’লে আর-কিছু নেই, ফলে এখন আর হয়তো পরেরদিন কী হবে তা নিয়ে তারা আর মাথাই ঘামায় না।
আয়ারটন বললে যে সে নাকি এদের ভাষা জানে—জাহাজডুবির পর সে নাকি এ-রকমই ছোটো-একদল আদিবাসীদের সঙ্গে দু-দুটো বছর কাটিয়েছে—সে বলতে চাচ্ছিলো গোলামি করে কাটিয়েছে, কিন্তু তাকে দিয়ে যে-সব কাজ করানো হ’তো, আদিবাসীরা নিজেরাও উদয়াস্ত সেই কাজই করতো, আর তাকে দেখবামাত্র তাকে তারা নির্যাতনও করেনি—অথবা মেরে ফেলবার কথাও ভাবেনি। তবে কাজের বড়ো অংশটাই এখানে করতে হয় মেয়েদের, ছেলেরা শিকার করে, রক্ষণাবেক্ষণ করে, এখন আবার সবসময় হুঁশিয়ার হ’য়ে থাকে—কখন শাদারা এসে হাজির হয়।
আয়ারটন বললে, ‘কাপ্তেন গ্রান্ট যদি সত্যি-সত্যি বেঁচে থাকেন, তাহ’লে নিশ্চয়ই এইরকমই কোনো আদিবাসীদের দলের মধ্যে আছেন—আর আমাকে যেমন হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হ’তো, তাকেও নিশ্চয়ই সেইরকম ভাবেই এদের জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে।’
‘কিন্তু তুমি তো এদের চোখে ধুলো দিয়ে সটকে আসতে পেরেছো,’ মেজর ম্যাকন্যাব্স বললেন : ‘এরা কি বন্দীদের ওপর কড়া পাহারা রাখে না?
‘পালিয়ে-যাওয়া খুব-একটা কঠিন নয় হয়তো, কিন্তু আসল কষ্ট শুরু হয় এদের হাত থেকে পালিয়ে আসার পরেই। দেখছেনই তো এই সংরক্ষিত এলাকার আশপাশে শাদাদের কোনো লোকালয় নেই। তাছাড়া অজানা অচেনা জায়গায়—কোথায় কী আছে আপনি জানেন না। পালিয়ে আসার মানে তো আপনি ঝাঁপ খাবেন সরাসরি অজ্ঞাতের মধ্যে –
এ-সব কথা যখন চলছে তখন আদিবাসীদের মধ্যে একটা কলরব উঠলো হঠাৎ। এমু পাখিদের একটা ঝাঁক নাকি দেখা গেছে। পাখি বটে, কিন্তু ওড়ে না, ছোটে—আর এত-জোরে ছোটে যে পলক-না-ফেলতেই তারা চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায়। এদের মাংস খুব সুস্বাদু ব’লেই তাদের আত্মরক্ষার জন্যে পা দুটোকে এমন তীব্রগতিতে ব্যবহার করতে হয়। ডানাগুলো কেমন বেঢপ, আর কেমন যেন মাংসের ঢিবির মতো। তাই উড়তে পারে না বটে, তবে সবচেয়ে-দ্রুত ঘোড়ার চেয়েও জোরে ছোটে। তাই এদের কুপোকাৎ করতে হয় বিস্তর বুদ্ধি খাটিয়ে। একজন আদিবাসী এমুর একটা খোলশ প’রে, এমু সেজে, এমুদের মতো আওয়াজ করতে-করতে এমুর ঝাঁকটার কাছে গিয়ে আচমকা বেধড়ক লাঠি চালিয়ে পাঁচ-পাঁচটা এমুকে ঘায়েল ক’রে ফেললে।
কিন্তু তারপরেই শিকার করবার আরো-একটা অদ্ভুত উপায় দেখতে পেলেন গ্লেনারভনরা। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে এসেছিলো কাকাতুয়ার মতো নীলরঙের অচেনা পাখির একটা ঝাঁক। চুপি-চুপি, কোনো শব্দ না-ক’রে একজন আদিবাসী গাছের আড়ালে স’রে গিয়ে গাঢাকা দিয়ে দাঁড়ালে। তার হাতে কঠিন একটা বাঁকানো কাঠ—প্রায় চাঁদের ফালির মতো বাঁকা। কেউ কিছু বুঝে ওঠবার আগেই সাঁ ক’রে কোমরের কাছ থেকে ঐ বাঁকা ফালিকাঠটা হাতের একটা ঝটকায় বিদ্যুৎবেগে ছুঁড়ে দিলে, আর হঠাৎ প্রায় চল্লিশ হাত পথ কোমরসমান উঁচু দিয়ে উঠে গিয়েই আচমকা সেটা সটান একলাফে উঠে গেলো অনেক ওপরে, তারপর সেই নীলপাখিদের ডজনখানেককে একসঙ্গে ঘায়েল ক’রে ফের বিদ্যুৎবেগে ছুটে এসে সোজা সেই আদিবাসীর কাছে ফিরে এলো, ধুপ ক’রে পড়লো তার পায়ের কাছে।
পাঞয়ল যেন এই অচেনা অস্ত্রটার মধ্যেই চেনা-কিছুকে খুঁজে পেলেন। বিস্ময়ে চিৎকার ক’রে উঠলেন : ‘অ্যা! ব্যুমেরাং। নেহাৎ ছোট্ট একটা কাঠের ফালি–কিন্তু ছোঁড়বার কায়দাটাই আসল আর সেটা জানে অস্ট্রেলিয়ার এই অ্যাবওরিজিনিরাই শুধু!’
‘সবদেশের আদিবাসিন্দারাই মাথা খাটিয়ে শিকারের সব বিচিত্র উপায় উদ্ভাবন ক’রে নিয়েছে,’ লেডি হেলেনা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছিলেন দৃশ্যটা। আমেরিকায় তারা বার করেছে ল্যাসো, এমন কায়দায় দড়ির ফাঁস ছোঁড়ে যে বুনোমোষকেও কব্জা ক’রে ফেলতে পারে। এরা বানিয়েছে ব্যুমেরাং! মাথায় যদি প্রখর বুদ্ধি না-থাকে তাহলে এমন-কোনো হাতিয়ারের কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। অস্ত্রটা নষ্ট হয় না আদৌ—যেন একটা অস্ত্রেই আস্ত একটা অস্ত্রাগার–কেননা যেটাকে ছুঁড়ে মারা হ’লো, সেটাই আবার কাজ হাসিল করে ফিরে এলো! সত্যি, মানুষ যে কত কী-ই না মাথা খাটিয়ে বার করতে পারে!’
‘হুম!’ মেজর ম্যাকন্যাব্স বললেন, ‘এরা আবার মানুষ নাকি? শোনেননি মসি পাঞয়লের কাছে? কোন-একজন মস্ত পণ্ডিত নাকি বলেছেন এরা বাঁদরও নয়—মানুষও নয়—তারই মাঝামাঝি-কিছু—মাথা খাটিয়ে এই পণ্ডিত এর একটা নামও দিয়েছেন—মিসিংলিঙ্ক। আপনি ঠিক কথাই বলেছেন। মানুষ যে কত কী-ই বার করতে পারে মাথা খাটিয়ে!’
৪. ডানকান গেলো কোথায়?
রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর শিবিরে যখন আড্ডা জমেছে, হঠাৎ—আশ্চর্য কাণ্ড!—অস্ট্রেলিয়ায় ইওরোপ থেকে অনেকদুরে, জঙ্গলের মধ্যে ভেসে এলো মোৎসার্টের অপেরার সুর : কারা যেন ডন জোভান্নি গাইছে।
এখানে? বনের মধ্যে? ডন জোভান্নি?
পাঞয়ল সবে কী-একটা প্রসঙ্গে তাঁর পাণ্ডিত্য জাহির করতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কারা গাইছে দা পোন্তের ইতালীয় ভাষায় লেখা ডন হুয়ানের কাহিনী—ভোল্ল্ফগাঙ আমাডেউস মোৎসার্ট যার সুর দিয়েছিলেন, যে-অপেরা প্রথম প্রযোজিত হয়েছিলো বোহিমিয়ার প্রাহায়, ১৭৮৭ সালে–সেখানে ডন হুয়ানকে পাতালে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো পাথরের অতিথি।
স্তব্ধতার মধ্যে খানিকক্ষণ শুধু দূর থেকে ভেসে আসা মোৎসার্টের সুর ছাড়া আর কিছুই নেই। তারপর, খানিকক্ষণ বাদে তাও মিলিয়ে গেলো রাতের হাওয়ায়। একটুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে মেজর ম্যাকন্যাব্স জিগেস করলেন : ‘ডন জোভানি না?’
‘হ্যাঁ, ডন জোভান্নি। যথারীতি পাঞয়লেরই সবজান্তা গলা বিশদ তথ্য জানাবার জন্যে চুলবুল করে উঠেছে। অপেরাটার আসল নাম অবশ্য ছিলো ইল দিসোলুতো পুনিতো, ও সিয়া ইল্ ডন জোভান্নি অর্থাৎ লম্পটের শাস্তি অথবা ডন জোভানি আর সে-বার বোহিমিয়ায় প্রথম প্রযোজনার সময়ই দারুণ হুলুস্থুল হয়েছিলো এটাকে নিয়ে—’
‘হ্যাঁ। তা না-হয় বোঝা গেলো, কিন্তু এত-রাতে এখানে সেই অপেরা গাইছে কারা?’ লর্ড এডওয়ার্ড গান শুনে বেশ হতভম্বই হ’য়ে পড়েছিলেন।
কারা যে গাইছিলো, সে অবশ্য পরদিন সকালেই জানা গেলো, যখন দেখা গেলো দুটি যুবক চলেছে ঘোড়ায় চ’ড়ে, সঙ্গে একপাল শিকারি কুকুর।
এঁদের শিবির দেখে যুবকরাই নিজে থেকে কৌতূহলী হ’য়ে ঘোড়া থামিয়েছিলো। আলাপ হবার পর যুবক দুটিকে ভালোই লেগে গেলো সকলের। কথায়-কথায় জানা গেলো তাদের বাবা লন্ডনের এক ধনকুবের, ব্যাঙ্কার। ছেলেদের ঝোঁক কেবল গানবাজনায়—এটা ব্যাঙ্কব্যবসায়ীর খুব-একটা পছন্দ হয়নি। অনেকবার নাকি চেষ্টা করেছেন ব্যাঙ্কের ব্যবসায় এদের ভিড়িয়ে দিতে, কিন্তু এইসব পাউন্ড-শিলিং-পেন্স জমা-খরচ সুদ-মূলধন—এইসবে কিছুতেই তাদের মন ওঠেনি। তারা বরং কোথায় কোন গানবাজনার আসর বসেছে, তার খবর রাখতেই বেশি-উৎসাহ বোধ করেছে। শেষটায় একদিন তাদের বাবা তাদের ডেকে বলেছিলেন, ‘বুঝতে পারছি যতদিন আমার এখানে থাকবে, ততদিন ভাববে পায়ের উপর পা তুলে কাটালেই চলবে। কীভাবে যে সংসার চলে সে-সম্বন্ধে কোনো ধারণাই তোমাদের হবে না। তার চাইতে তোমাদের টাকা দিচ্ছি, লণ্ডন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ো—যেখানে খুশি যাও, ভালো হয় ইওরোপ ছেড়ে গেলেই। গিয়ে, নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো। নটা-পাঁচটা আপিস যদি ভালো না-লাগে, তো অন্যকিছু করো—কিন্তু অন্য-কোথাও, এখানে নয়। যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারো তো ভালো, না-হ’লে বুঝবো দুটো অকম্মার ধাড়ি এককাঁড়ি টাকা জলে ফেলেছে। আমি না-হয় ধ’রে নেবো যে তবু তো নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে গিয়ে এরা টাকাগুলো খুইয়েছে। কিন্তু এভাবে আর চলবে না—’
বাবার কথা বলার ভঙ্গি দেখে এরা বুঝেছিলো, সত্যিই, এভাবে আর চলবে না। শেষটায় অনেক ভেবে তারা এসে হাজির হয়েছে পৃথিবীর একেবারে অন্যপ্রান্তে—এই অস্ট্রেলিয়ায়। এখানে এসে তারা ক্যাটলফার্ম খুলে বসেছে, গোরু-ভেড়ার ব্যবসা, আর তাদের র্যান্চটা হয়েছে এখনকার অন্য র্যাচগুলোর চাইতে একেবারেই অন্যরকম। অজস্র গোরু-ভেড়া সামলাচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা সামলাতে গিয়ে এখানে তারা তাদের র্যান্চকে কেন্দ্র ক’রে আস্ত একটা জনপদই গ’ড়ে তুলেছে। শুধু তাদের নিজেদের জন্যে যে মস্ত একটা প্রাসাদই বানিয়েছে তা নয়—তার আশপাশে তাদের কাছে যারা কাজ করে তারাও নিজেদের ঘরবাড়ি বানিয়েছে। জেনারেটর বসিয়েছে—সেখানে তড়িৎকোষ থেকে বিজলি উৎপাদিত হ’য়ে যে শুধু আলোই জোগায় তা-ই নয়, তারা বসিয়েছে টেলিগ্রাফভবন, যাতে বড়ো শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে সবসময়, চেষ্টা করেছে এই দূর জঙ্গলেও জীবনযাত্রার মান যাতে আদিম অতীতে ফিরে না-যায়, বরং বিজ্ঞানকে কাজে খাটিয়ে আজ মানুষ জীবনযাত্রাটা যতটা সহজ করে তুলেছে, এখানেও যেন সেই সহজ স্বাচ্ছন্দ্যের ছাপ পড়ে।
এখানে তারা খুব-ভালো আছে। সারাদিন সকলের সঙ্গে খাটে, র্যাচের তদারকি করে, এক কোরাল থেকে অরেকটা কোরালের সংযোগ রাখে, রাত্তিরে শুতে যাবার আগে মাঝে-মাঝে তাদের মনে পড়ে যায় বেটোফেন বা মোৎসার্টকে, আর কাল রাত্তিরে তাঁরা তাদের সেই গানই শুনেছেন।
সাধারণত যারা র্যান্চ চালায় তাদের ধরন-ধারণ হয় রুক্ষ, কর্কশ, একটু হয়তো, বা অমার্জিতও। এরা কিন্তু মোটেই সে-রকম নয়। খানিকক্ষণ কথাবার্তার পর তারা অভিযাত্রীদের আমন্ত্রণই জানিয়ে বসলো, ‘আসুন না, আমাদের খামারটা দেখে যাবেন একবার।’
এদের সঙ্গে আলাপ ক’রে অভিযাত্রীরা বেশ খুশিই হয়েছিলেন। তাছাড়া, এ-কদিন একটানা পথের ধকলে বেশ-একটু ক্লান্তিও লাগছিলো। একটা দিন না-হয় একটু অন্যরকম ভাবে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-পথশ্রম ছাড়াই কাটানো গেলো।
সারাটা দিন কাটলো এই ক্যাটলফার্ম ঘুরে বেড়িয়ে। এই যুবক দুটি কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিশাল বনের পাশে ইওরোপকে এনে বসিয়ে দেয়নি। বরং অস্ট্রেলিয়ার ভূদৃশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখেই, মানানসইভাবেই, সবকিছু গ’ড়ে তুলেছে। তাদের এই ছোট্ট গ্রামটা গ’ড়ে তুলতে গিয়ে তাদের অনেক গাছপালা কাটতে হয়েছে, এটা সত্যি—কিন্তু তারা নির্বিচারে গাছ কেটে বনকে বন সাফ করে দেয়নি, বরং র্যান্চটা গ’ড়ে তুলেছে এক বিস্তীর্ণ তৃণভূমির পাশে, যাতে গোরু-ভেড়া চ’রে বেড়াতে পারে, পরের পর গাছপালা কেটে তারা এই চারণভূমি গ’ড়ে তোলেনি। কেননা এটা তারা জানে যে এমনিতেই অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমি আউটব্যাকে এমনভাবে হা ক’রে থাকে যে যত গাছপালা কাটবে, ততই মরুভূমি এগিয়ে আসবে, বৃষ্টি পড়বে না—ঘাসও গজাবে না, এমনকী সব জীবজন্তুও এখান থেকে উধাও হ’য়ে যাবে। তারা চেয়েছে যাতে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশটাকে কাজে খাটিয়েই তাদের খামার গ’ড়ে তোলা যায়।
অর্থাৎ তৃণভূমিটাকে ঘিরেই জটিলঝুরি মস্ত গাছপালা নিয়ে মোটামুটি অক্ষতই থেকে গেছে এই নিবিড় বনানী-আর তার জীবজন্তুরাও আশ্রয় খুইয়ে এখান থেকে পালিয়ে যায়নি।
‘চলুন-না, আজ একটু বনের ভেতরে গিয়ে শোভা দেখে আসা যাক।’
খাওয়াদাওয়ার পর তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো।
বনের শোভা অবশ্য এই দিনগুলোয় যথেষ্টই দেখেছেন সবাই, কিন্তু এখানকার বনে নাকি এমন-সব জীবজন্তু আছে, যা আর কোথাও সহজে দেখা যাবে না। এ-কথা শুনে সকলের আগে উৎসাহে লাফিয়ে উঠেছিলো রবার্টই। আর তার উৎসাহ দেখে অন্যরাও আর-কোনো আপত্তি তোলেননি। কিন্তু তাতে অবশ্য একটা বিপত্তিই ঘটতে বসেছিলো। তাদের সঙ্গে দেখা হ’য়ে গিয়েছিলো ক্যাঙারুদের একটা ঝাঁকের—অনেক ছানা-রুর সঙ্গে মা-ক্যাঙারু। আর ক্যাঙারুর স্বভাবই এমন যে যদি তারা ভাবে আচমকা কোনো বিপদ এসে হাজির হয়েছে, তখন তারা গোড়ায় চেষ্টা করে লাফিয়ে-লাফিয়ে পালিয়েই যেতে—ক্যাঙারুর লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে-চলার দৃশ্য ভারি অদ্ভুত, কেমন হাসিও পায়—কিন্তু ব্যাপারটা খুব-একটা হাসির থাকে না, যদি তারা মনে করে যে সহজে পালিয়ে যেতে পারবে না। তখন উলটে তারা লাফিয়ে এসে হামলাই চালায়—তখন তারা লাথি কষায়, আর সেই চাঁট খেয়ে বড়ো-বড়ো জন্তুও একেবারে ঘায়েল হ’য়ে যায়।
ক্যাঙারুরা নিরামিষাশী — উদ্ভিদভোজী। শুধু অস্ট্রেলিয়া আর নিউগিনিতেই তাদের দেখা যায়। লম্বা ল্যাজ, আর শরীরের পেছন দিকটা এমন সবল-সুগঠিত যে তাতেই তারা একেক লাফে বড়ো-বড়ো দূরত্ব অতিক্রম করে যেতে পারে। আর প্রকৃতি যেমন তাদের আত্মরক্ষা করার জন্যে শক্তিশালী পশ্চাদ্দেশ আর সুগঠিত পা দিয়েছে, তেমনি এই ব্যবস্থাও করেছে বিপদের সময়, কোণঠাশা হ’য়ে গেলে, যাতে তারা ঐ পায়ের লাথি কষাতে পারে।
রবার্ট ঠিক টের পায়নি, বরং আগ্রহের বশে বড্ড-কাছে গিয়ে পড়েছিলো এক ছানা-রুর, যে-তখন মার বুকের থলে থেকে বেরিয়ে নিজেই চ’রে বেড়াচ্ছিলো। কিন্তু মা-ক্যাঙারুর ছিলো সজাগ কড়ানজর; সে রবার্টকে কাছে আসতে দেখেই একলাফে তার কাছে এসে পড়ে প্রায় লাথি কষাতেই গিয়েছিলো। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স হুঁশিয়ার না-থাকলে রবার্টকে আর দেখতে হতো না—কিন্তু কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স গায়ের জোরে ধেয়ে-আসা ক্যাঙারুর বুকে তাঁর ছোরা বসিয়ে দেয়াতেই রবার্ট সে-যাত্রায় বেঁচে গেলো।
এই বিপত্তির পর সবাই বেশ একটু মনখারাপ করেই ফিরে এসেছিলো। মিথ্যেমিথ্যি কোনো ক্যাঙারুকে মারার ইচ্ছে বোধহয় কারুই ছিলো না।
ক্যাঙারু নিরামিষাশী হ’লে কী হয়–আমাদের কিন্তু বিপদে ফ্যালে প্রায়ই,’ একটু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতেই ভাইদের একজন বললে, ‘শুধু লতাপাতা উদ্ভিদ খায় ব’লেই এঁদের খাই-খাই থেকে শস্যবাঁচানো একটা বিষম মুশকিলের ব্যাপার। ক্যাঙারুর ঝাঁক আসতে দেখলে আমরা নিজেরাও প্রায়ই উলটে ওদের মারতে বাধ্য হই।’
‘হ্যাঁ, একেই বলে জঙ্গলের নিয়ম। তুমি যদি নিজের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা না-করো, তবে তোমার দেখাশুনো করবার জন্যে এই বিজনবিভুঁইয়ে আর কেই-বা থাকবে?’ অন্যভাই সায় দিয়ে বলেছিলো।
বিশ্রামটা যদি অবিমিশ্র নিশ্চিন্ত হয়নি, তবু বোধহয় এই একটা দিন জিরিয়ে নেয়া ভালোই হয়েছিলো। কারণ পরদিন ভোরেই লর্ড গ্লেনারভনের বহর অস্ট্রেলিয়ার এমন অঞ্চলে পৌঁছে গেলো যেখানটা অত্যন্ত দুর্গম ব’লেই এখনও মানুষের অজ্ঞাত থেকে গেছে।
বহর এখন যেখানে এসে পৌঁছেছে মাউন্ট কচিউস্কোর কাছে, যে-পর্বতশ্রেণী দক্ষিণপূর্ব নিউসাউথ ওয়েল্স-এর পাশ দিয়ে উঠে গেছে ৭৩১৬ ফিট উঁচু, অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে-উঁচু পর্বতশ্রেণী—গ্রেট ডিভাইডিং রেন্জের মধ্যেও সবচেয়ে-উঁচু। ইওরোপ থেকে মানুষ গিয়ে তাকে একটা ইওরোপীয় নামই দিতে চেয়েছে, তাকে বলেছে অস্ট্রেলিয়ার আল্স—একদিকে পূর্ব-ভিক্টোরিয়া, আর দক্ষিণদিকে নিউ সাউথ ওয়েল্স–বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে চলে গিয়েছে পর্বতশ্রেণী। অস্ট্রেলিয়ার এই আল্পসের সবখানে এখনও কোনো অভিযাত্রীদলই যেতে পারেনি, ফলে প্রায়ই নতুন-নতুন তথ্য জড়ো হতে থাকে এই মাউন্ট কচিউস্কো সম্বন্ধে। এঁদের বহর অবশ্য এটা অতিক্রম ক’রে যাবে না, শুধু-যে দুর্গম তা নয়, এটা দুরারোহও—তাছাড়া কোথায় যে কী আছে, তাও জানা নেই—ফলে আগে থেকেই ঠিক ছিলো এর পাদদেশ ঘিরেই, এর পাশ কাটিয়ে, যাবে বহর।
কিন্তু তাহলেও ঠিক কোনখান দিয়ে গেলে যে এর পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে, সেটা জানা নেই—কোনো মানচিত্রেও এ-সম্বন্ধে কোনো হদিশ দেয়া নেই। এখানকার কারু কাছে জিগেস ক’রে পথঘাট সম্বন্ধে জেনে নিতে পারলেই ভালো হতো। সেইজন্যেই পথে যখন একটা সরাইখানা পড়লো, সেখানে গিয়ে জিগেস ক’রে সব ঘাতঘোঁৎ জেনে নেয়া ভালো ব’লেই ঠিক হ’লো।
সরাইওলা বোধহয় সত্যিকার একজন রেডনেক, খুবই রুক্ষ আর রূঢ় তার চেহারা, কথাবার্তাও কাটা-কাটা, কেমন যেন রাগি-রাগি। আয়ারটনের প্রশ্নের উত্তরে সে অবশ্যি একটা অপেক্ষাকৃত সহজ পথের কথা বাৎলে দিলে, সেখান দিয়ে গেলে পাহাড়ের ল্যাজের দিকটা ডিঙোনো যাবে—কিন্তু এই হদিশটুকু দেবার কোনো ইচ্ছে বোধহয় তার ছিলো না—ভাবটা এমন, যেন সে তার সিন্দুক থেকে মহামূল্যবান কোনো সম্পত্তি বার ক’রে দিচ্ছে।
সরাই থেকে বেরিয়ে আসার সময়েই ইশতেহারটা চোখে পড়লো লর্ড এডওয়ার্ডের। বেন জয়েসকে ধরিয়ে দেবার কোনো খবর দিতে পারলে একশো পাউন্ড পুরস্কার দেবে পুলিশ।
মেজর ম্যাকন্যাব্স হুলিয়াটা দেখে মন্তব্য করলেন : ‘এই বেন জয়েসের কুকীর্তিগুলো সম্বন্ধে যত খবর পাচ্ছি, ততই মনে হচ্ছে একে হয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড না-দিয়ে ফাঁসিতে লটকানোই উচিত ছিলো।’
‘লোকে যতটা বলে যদি সত্যিই সে এতটাই কুখ্যাত হয়, তাহ’লে মাত্র একশো পাউন্ড দাম হবে কেন তার মাথার?’ আয়ারটন একটা টিপ্পনী কাটলে। ‘আমার মনে হয়, এ-সব রটনার মধ্যে অনেকটাই বাড়াবাড়ি আছে—’
‘যতই অতিরঞ্জিত থাক না কেন,’ লর্ড এডওয়ার্ডের মন্তব্য, ‘বেন জয়েস যে খুব একটা সুবিধের লোক নয়, এটা ঠিক। না-হ’লে পুলিশ এমন হন্যে হয়ে তাকে খুঁজতো না। কিংবা যে-সব জায়গায় খুব-বেশি লোকজন নেই, সেইসব দূর-দূর জায়গায় এসে এমনভাবে হুলিয়া টাঙিয়ে দিতো না।’
‘অর্থাৎ,’ মেজর ম্যাকন্যাব্স বললেন, ‘সে-যে কখন কোথায় থাকে, পুলিশ সে-সম্বন্ধে কোনো খবরই রাখে না। তারা শুধু আন্দাজে ভর করে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে—’
এত-সব কথাবার্তার মধ্যে পাঞয়ল যে কোনো মন্তব্য করবেন না, তা তো আর হয় না। তিনি ব’লে উঠলেন, ‘এইভাবেই কিংবদন্তির জন্ম হয়। যার সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা নেই, তার সম্বন্ধেই সব উলটোপালটা উদ্ভট আজগুবি খবর বেরিয়ে যায়—আর লোকে ভাবে সে বুঝি সাধারণ মানুষের চাইতে একেবারেই অন্যরকম।’
বেন জয়েসকে জড়িয়ে কত-কী গল্প রটেছে, সে-সম্বন্ধে আলোচনাটা অবশ্য আপাতত মুলতুবি রইলো। এখন এই মাউন্ট কচিউস্কোর ল্যাজটা ডিঙিয়ে অস্ট্রেলিয়ার আল্পস-এর পাল্লা থেকে বেরিয়ে যাওয়াই জরুরি আর অব্যবহিত কাজ।
এবং কাজটা যে সহজ নয়, ক্রমাগতই তার প্রমাণ পাওয়া যেতে লাগলো। স্কটল্যান্ড যতই পাহাড়ি জায়গা হোক, হাইল্যান্ডের উচ্চভূমি যতই উবড়োখাবড়ো বা রুক্ষবন্ধুর হোক, এবং স্কটল্যান্ডর পাহাড় সম্বন্ধে তাঁদের যতই অভিজ্ঞতা থাক, এই পাহাড় টপকাতে তা মোটেই কাজে লাগবে না, এই মাউন্ট কচিউস্কোর যে-দিকটা অপেক্ষাকৃত নিচু, সেদিক দিয়েও পাহাড় টপকানো নেহাৎ সহজ কর্ম ছিলো না—বিশেষত এত-সব ঘোড়া আর বলদ নিয়ে। মেজর ম্যাকন্যাব্স প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পুরো ব্যাপারটার তত্ত্বাবধান করছিলেন। বিশেষত যখন একবার বলদে-টানা গাড়িটার একটা চাকা হঠাৎ-একবার দুম ক’রে খুলে এলো, আর তারপর রহস্যময়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো কয়েকটি বলদ আর একটা ঘোড়া। কেন-যে ওভাবে দুম করে তারা পপাত ধরণীতলে এবং মমার চ, সেটা প্রায়-যেন একটা দুর্বোধ্য, হেঁয়ালিই রয়ে গেলো। ক্লান্ত, অবসন্ন, রুক্ষ পাহাড়ি পথের বন্ধুর পাথরে হোঁচট খেয়েছে—এত-সব কথা ভেবেও বোঝা গেলো না তারা মাটিতে পড়বামাত্র মরলো কেন।
তারপর যখন বিশেষ-সাবধানে ধীরমন্থর গতিতে পাহাড়ের শীর্ষদেশটা ডিঙিয়ে তাঁরা ওপাশটায় পৌঁছেছেন, তখন চলতে-চলতে হঠাৎ জাক পাঞ্চয়লের ঘোড়াটাও কেমন বিচ্ছিরিভাবে পাগুলো দুমড়ে-মুচকে প্রায় হুমড়ি খেয়েই পড়লো এবং আর উঠলো না, তখন প্রায় চোখ ছানাবড়া হবার অবস্থা সকলের। কী কারণ থাকতে পারে এই বলদগুলো আর ঘোড়াগুলোর এমনভাবে চিৎপাত হ’য়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে প’ড়ে যাওয়ার? পাঞয়লকে নিয়েই যখন তাঁর ঘোড়াটা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো, তখন তাঁর মুখচোখের ভাব যদি ছবি এঁকে ফুটিয়ে তোলা যেতো! তাঁর মুখ দিয়ে বাক্য প্রায় সরছিলোই না, শুধু না, শুধু কোনোমতে অস্ফুট স্বরে বলতে পেরেছিলেন : ‘অদ্ভুত!’
অদ্ভুত তো বটেই! এখন যে বাকি রইল মাত্র পাঁচটা ঘোড়া আর চারটে বলদ। এগুলোর যদি কিছু হয়, তাহ’লে বহর একেবারে অকেজো হ’য়ে যাবে, জনমানবহীন রুক্ষ পার্বত্যঅঞ্চলে বিষম বিপদের মধ্যে পড়বে। লর্ড এডওয়ার্ড এতটাই বোমকে গিয়েছিলেন, মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। শুধু মেজর ম্যাকন্যাব্স জাক পাঞ্চয়লের অস্ফুট আর্তনাদ, অদ্ভুত!-এর উত্তরে চাপাগলায় দাঁত চেপে বলেছিলেন : ‘খুবই অদ্ভুত!’
কিন্তু বিপদ আর প্রহেলিকা বোধহয় একা আসে না। সেই রাতেই মারা গেলো আরো একটা ঘোড়া, আর বলদ। আর কেন-যে এরা হঠাৎ এভাবে পর-পর মারা যাচ্ছে, সেই হিংটিংছট প্রশ্নটার কোনোই সমাধান হ’লো না। মেজর ম্যাকন্যাব্স যতই আপৎকালীন সতর্কতা নিয়ে চোখকানখুলে পুরো ব্যাপারটা আঁচ করবার চেষ্টা করুন না কেন, কেবল তাঁর মুখটা গম্ভীর হয়ে-যাওয়া ছাড়া আর-কিছুই হ’লো না—এবং তাঁর ললাটদেশে কেবল কতগুলো বাড়তি কুঞ্চনরেখা পড়লো।
আর আয়ারটন কেমন যেন হতভম্ব হয়ে আছে। সে ঘোড়া আর বলদগুলোর বিশেষ তোয়াজ করছে, পরিচর্যা করছে, কিন্তু কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না হঠাৎ এতটা পথ পেরিয়ে এসে এই পাহাড়েই এমন তাজ্জব কাণ্ডটা হচ্ছে কেন!
আপদের সেখানেই শেষ নয়। সাবধানে বাকি পথটা চলতে-চলতেও যখন পরের দিন জানুয়ারির তেরো তারিখে স্নোয়িনদীর আধমাইলের মধ্যে এসে গাড়ির চাকা ডেবে গেলো কাদার, তখন সকলের একেবারে মাথায় হাত। কোনোরকমে ঠেলেঠুলে গাড়িটাকে কাদার মধ্য থেকে তোলা হ’লো বটে, কিন্তু ঠিক হ’লো এখানেই আপাতত ছাউনি ফেলে রাতটা কাটিয়ে দেয়া হবে। তাতে এই জন্তুগুলো অন্তত বিশ্রাম করবার একটা সুযোগ পাবে-হয়তো পথের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারবে।
সবাই যখন গুছিয়ে ব’সে এইসব আকস্মিক উৎপাত সম্বন্ধে আলোচনা করছেন, তখন আয়ারটন আবার নতুন ক’রে তার প্রস্তাবটা দিলে।
‘সামনেই একটা মোটামুটি সুগম রাস্তা আছে—নাম লক্ষ্ণৌ রোড – ‘ তাকে কথাটা শেষ করতে না-দিয়েই জাক পাঞ্চয়ল বললেন, ‘কী মুশকিল! লোকেরা কি আর নতুন নাম পায় না কোথাও! পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যদি একই নাম দিতে থাকে, তাহ’লে আমরা যারা ভূগোল নিয়ে চর্চা করি—আমরা কোথায় যাই? এই পর্বতশ্রেণীর নাম গ্রেট ডিভাইড রেন্জ—মার্কিন মুলুকেও এমনি-একটি গ্রেট ডিভাইড আছে। কোথায় জানতুম ভারতবর্ষে লক্ষ্ণৌ নামে একটা জায়গা আছে, সিপাইবিদ্রোহের সময় সেখানে একটা প্রচণ্ড লড়াই হয়েছিলো। এখন, এইখানে কি না একটা লক্ষ্ণৌ রোড এসে হাজির। এই রাস্তা ধরেই কি আমরা সাতসাগর ডিঙিয়ে সোজা ভারতবর্ষে গিয়ে লক্ষ্ণৌ পৌছুবো নাকি? ‘
ভৌগোলিকের এই বিমর্ষ সমস্যায় সবাই কোথায় সহানুভূতি দেখাবেন না, সবাই হো-হো করে হেসে উঠলেন। আবহাওয়া গত ক-দিন ধরেই কেমন ভারি হ’য়ে ছিলো, তাঁর কথা শোনবার পর হঠাৎ যেন সব মেঘ কেটে গেলো, পরিবেশটা বেশ হালকা হ’য়ে গেলো।
হাসিটা একটু থামতেই আয়ারটন ফের নাছোড়ের মতো কথাটা পাড়লে। ‘আমাদের তো একের পর এক বিপদ লেগেই আছে। কবে যে সবাই মিলে আমরা পুরো রাস্তাটা পেরুতে পারবো কে জানে। তার চাইতে, কাছেই যখন লক্ষ্ণৌ রোড আছে, তখন, আমায় বরং মেলবোর্নেই পাঠিয়ে দিন—ডানকানের খোঁজে। যাতে ডানকান সোজা পুব উপকূলে চ’লে যায়, সেই-মর্মে বরং একটা চিঠি লিখে দিন, যাতে আমাদের কাজ খানিকটা এগিয়ে থাকে।
আর-কেউ কিছু বলবার আগেই মেজর ম্যাকন্যাব্স বাধা দিলেন। ব্রিটানিয়া যে ঠিক কোথায় ডুবেছে, তা জানা আছে একমাত্র আয়ারটনেরই। তাকে কী ক’রে এখন সবাইকে ছেড়েছুড়ে একা চলে যেতে দেয়া যায়?
সঙ্গে-সঙ্গেই মেজর ম্যাকন্যাব্সের কথায় সায় দিলেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স। তাঁরও মত : ডানকান ফার্স্টমেট টম অস্টিনের তত্ত্বাবধানে যা করছে করুক—কিন্তু কাপ্তেন গ্রান্টের কোনো হদিশ না-পাওয়া অব্দি আয়ারটনের মূল বহর ছেড়ে যাওয়া চলবে না।
আয়ারটন যখন বললে যে ‘আমি শুধু আমাদের কাজটা খানিকটা এগিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম,’ তখন তার মুখে যে হাঁড়িপানা ভাব ফুটে উঠেছিলো, সেটা আর কেউ খেয়াল করুক বা না-করুক, মেজর ম্যাকন্যাব্স বেশ লক্ষ্য করেছিলেন। এ-কথায় তার অতটা নিরাশ হ’য়ে পড়ার কী আছে? আয়ারটনের হাবভাবের মধ্যে কী-একটা যেন আছে, যেটা মেজর ম্যাকন্যাব্সের আদপেই ভালো লাগছে না। অথচ স্পষ্ট ক’রে তিনি নিজেই জানেন না—সেটা কী? তাই এ নিয়ে তিনি আর-কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। মনে-মনে ঠিক ক’রে নিলেন, আয়ারটনের ওপর এখন থেকে কড়ানজর রেখে চলতে হবে।
সম্ভবত মনের মধ্যে কোথাও-একটা অস্বস্তি খচখচ করছিলো ব’লেই সে-রাতে একটা নাগাদ ঘুম ভেঙে গেলো মেজর ম্যাকন্যাব্সের। গোড়ায় তিনি বুঝতেই পারেননি হঠাৎ এত-তাড়াতাড়ি তাঁর ঘুম ভেঙে গেলো কেন। আর তারপরেই চোখ কচলে ধড়মড় করে তিনি উঠে বসলেন।
তাঁরা যেখানে ছাউনি ফেলেছিলেন, সেখানে প্রায় আধমাইল জায়গা ফসফরফার্নের হালকা-নীল আলোয় আলো হ’য়ে আছে—কিন্তু সেটাই তাঁর ধড়মড় ক’রে উঠে-বসার কারণ নয়। একটু-দূরে কয়েকটা কালো-কালো ছায়া, অথবা আরো-ভালো ক’রে বলা যায় ছায়ার মতো মানুষ, ঝুঁকে প’ড়ে ছায়ামূর্তিগুলো যে মাটির ওপর কী-সব চিহ্ন খুঁটিয়ে দেখছে।
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে প্রায় ছুটেই যেতে চেয়েছিলেন মেজর, কিন্তু শেষটায় লম্বা-লম্বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে প্রায় গুড়ি মেরে এগুলেন, তিনি। কী ব্যাপার? এরা কারা?
মেজর ম্যাকন্যাব্স ছাউনি ছেড়ে ওভাবে ঘাসবনের মধ্যে মিলিয়ে যাবার খানিকক্ষণ বাদেই বৃষ্টি নামলো। বড়ো-বড়ো ফোঁটা, যেন পিপে-পিপে জল ঢেলে দিচ্ছে কেউ আকাশ থেকে। ঝলকবান হবে নাকি? পাঞয়ল আধোঘুমের মধ্যে খানিকটা ভিজে গিয়েই বললেন, ‘এমন মুষলধারে বৃষ্টি পড়লেই এদিকটায় ঝলকবান ডাকে—ফ্ল্যাশফ্লাড—বন্যার মতো জল গড়িয়ে যায় পাহাড় থেকে, সামনে যাকে পায় সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’ আর কথা কটা জড়ানো সুরে বলতে-বলতেই সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়ে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেলো তাঁর। ‘নাঃ, এই তুমুল বৃষ্টি এই তাঁবুর মধ্যে আর থাকতে দেবে না দেখছি!
বৃষ্টির ঝমঝম শব্দেই শুধু নয়, বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে গিয়ে একটু আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো লর্ড এডওয়ার্ডের। এবার বুঝলেন পাঞয়ল ঠিকই বলেছেন—এমন বৃষ্টিতে এই তাঁবুর মধ্যে আর টেকা যাবে না। সবাইকে সাথে নিয়ে তক্ষনি তিনি গিয়ে আশ্রয় নিলেন সেই বলদে-টানা গাড়িটায়, মেরিকে নিয়ে লেডি হেলেনা যেখানে এই প্রচণ্ড বৃষ্টিতেও খানিকটা সুরক্ষিত আছেন।
ভালো ক’রে কারুই ঘুম হয়নি, তার ওপর বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজেই গাড়িতে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে, আর পাঞয়লের ঝলকবানের কথা শুনে সবাই একটু আঁৎকেও উঠেছিলো—উত্তেজনায় সকলেই যেন একসাথে কথা কইছিলেন। সকলেই—কিন্তু মেজর ম্যাকন্যাব্স নন। এ-সব তালেগোলে কেউ খেয়ালও করেননি মাঝখানে কিছুক্ষণ তিনি কোথায় যেন উধাও হ’য়ে গিয়েছিলেন।
ঝলকঢলের আশঙ্কাটা মোটেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিলো না। আর-কিছু না-হোক, এ-ভয়টা তো আছেই এই তুমুল বর্ষায় স্নোয়ি নদীর জল ফুলে-ফেঁপে উঠতে পারে। তাই বৃষ্টির মধ্যে কেউ-না-কেউ মাঝে-মাঝে বেরিয়ে গিয়ে খোঁজ ক’রে এলেন জল বাড়ছে কি না।
বৃষ্টির কাণ্ডটা অদ্ভুতই বলতে হবে। যেই ভোর হলো, অমনি বৃষ্টিও থেমে গেলো। আকাশ দেখে কে বলবে যে একটু আগেই সে তুলকালাম ঢল নামিয়ে দিয়েছিলো। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে বটে, কিন্তু আকাশের মুখ হাঁড়িপানা, ঘন কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে সূর্যকে। কিন্তু কাদায় আটকে যাওয়া গাড়িটাকে এখনই টেনে-তোলা দরকার, না-হ’লে আরো-ফ্যাসাদে পড়তে হবে। শুধু বলদগুলোকে তাড়া লাগিয়ে কোনো লাভ হবে না, এই বৃষ্টির পর নরম কাদামাটিতে গাড়িটা যেভাবে এঁটে বসেছে তাতে একে টেনে-তোলা শুধু এই কটা বলদের কাজ নয়, বলদ ঘোড়া মানুষ সকলের সম্মিলিত শক্তি দরকার।
কিন্তু বনের মধ্যে যেখানে বলদ আর ঘোড়াগুলো রেখে আসা হয়েছিলো, সেখানে গিয়ে দেখা গেলো সব ভোঁ-ভোঁ—জন্তুগুলোর একটাও সেখানে নেই!
কাণ্ড দেখে, সকলেরই চোখ কপালে উঠে গেলো, হতভম্ব ভাবটা যে আছেই, কিন্তু বিপদের গুরুত্বটা উপলব্ধি করতে কারু একমুহূর্তও দেরি হয়নি। এমনিতেই তো গত ক-দিনে বেশ কিছু ঘোড়া আর বলদ টেশে গিয়েছে—তাতেই যা অসুবিধে হচ্ছিল, তা আর কহতব্য নয়। এখন এ-জন্তুগুলোর একটাকেও জায়গামতো না-দেখে সকলেরই মাথায় হাত। কী হবে এখন?
ঘন্টাখানেক প্রায় আশপাশের বনজঙ্গল তোলপাড় ক’রে খোঁজা হ’লো জন্তুগুলোকে—কিন্তু যতই হাঁকডাক চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করুন না কেন, এই জন্তুগুলোর কোনো সাড়াই পাওয়া গেলো না। এরা যেন কোন্ ফুশমন্তরের হাওয়ায় উবে গিয়েছে।
হাল ছেড়ে দিয়ে বিমর্ষভাবে যখন কাদায়-ডেবে-বসা গাড়িটার দিকে ফিরছে সবাই, তখন আচমকা ক্ষীণ চিঁহি-চিঁহি ডাক শোনা গেলো। হন্তদন্ত হ’য়ে-ছুটে গেলেন সবাই। সেই নিবিড় লম্বা ঘাসের বনে হাতের ঝটকায় পথ ক’রে নিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই দেখা গেলো—সেই বড়ো-বড়ো ঘাসগুলোর মধ্যে ঠ্যাং তুলে ম’রে প’ড়ে রয়েছে তিনটি ঘোড়া আর দুটি বলদ। চিল-শকুনরা পাক খাচ্ছে মাথার ওপর, কাকেদের ওড়াউড়ি, গাছের ডালে-ডালে বসে আছে গৃধিনীরা। আজ তাদেরই ফূর্তি সবচেয়ে-বেশি—এতবড়ো-একটা ভোজের ব্যবস্থা হওয়া মানে তো তাদের মহোৎসব।
লর্ড এডওয়ার্ড স্তম্ভিত হয়ে গেলেন—আক্ষরিকভাবেই যেন কোনো স্তম্ভ হ’য়ে গেলেন, স্ট্যাচু। একটু পরে যখন কথা বলবার ক্ষমতা ফিরে এলো, সে-কথা এতই ক্ষীণ শোনালো যে মনে হলো তাঁর গলা দিয়ে যেন কোনো আওয়াজ বেরুতে চাচ্ছে না। ‘আয়ারটন,’ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে তিনি বললেন—যেন কোনো ভূতুড়ে দুঃস্বপ্ন থেকে এখনও তিনি আবেশ কাটিয়ে জেগে উঠতে পারেননি, বাকি ঘোড়া আর বলদটাকে নিয়ে যাও।’
প্রায় টলতে-টলতেই যেন গাড়ির কাছে ফিরে এলেন সবাই, মোহ্যমান, এইটুকু পথ আসতে বুঝি আধঘন্টাই লেগে গেলো তাঁদের।
এতক্ষণ মেজর ম্যাকন্যাব্স টু-শব্দটি করেননি। নীরবে সবকিছু দেখে যাচ্ছিলেন। এবার লর্ড গ্লেনারভনের দশা দেখে আর চুপ করে থাকতে পারলেন না তিনি। ‘এর আগের বার নদী পেরুবার সময় সব কটা ঘোড়ার পায়ে নাল লাগানো হ’লে এমন অবস্থা কিছুতেই হ’তো না
‘এ-কথা কেন বলছেন?’ একটু হতভম্ব হ’য়েই জিগেস করলে আয়ারটন।
‘যে-ঘোড়াটার পায়ে নাল লাগানো হয়েছিলো, শুধু সেইটেই বেঁচে গেছে ব’লৈ –
‘আরে! তা-ই তো!’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স সবিস্ময়ে ব’লে উঠলেন। ‘এ-যে দেখছি তাজ্জব ব্যাপার!
মেজর ম্যাকন্যাব্সের দিকে তাকিয়ে আয়ারটন বললে, ‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা আপনি ঠিকই ধরেছেন।’
মেজর ততক্ষণে ফের তাঁর মুখে যেন কুলুপ এঁটে দিয়েছেন—আর একটা কথাও বললেন না। গ্লেনারভনের ভারি-কৌতূহল হচ্ছিলো—এখনও তিনি ঠিক ধরে উঠতে পারেননি ঘোড়ার পায়ে নাল লাগাবার সঙ্গে এই অপঘাত মৃত্যুগুলোর কী সম্পর্ক। মেজর কিন্তু তখন অপলকে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছেন অন্যান্য নাবিকদের নিয়ে আয়ারটন কীভাবে কাদার মধ্য থেকে গাড়িটাকে টেনে তোলবার ব্যবস্থা করছে। মেজরের মুখ থেকে হেঁয়ালিটার কোনো ব্যাখ্যা না-পেয়ে শেষটায় কাপ্তেনকেই জিগেস করলেন গ্লেনারভন, ‘আচ্ছা, ম্যাঙ্গল্স, ম্যাকন্যাব্স তখন কী বলতে চাচ্ছিলো?’
‘বুঝতে পারছি না।’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের গলায় চিন্তার ছাপ। তবে মেজর ম্যাকন্যাব্স সাধারণত উটকো-কোনো মন্তব্য করেন না—কারণ থাকলেই কিছু বলেন।’
এবার খুব নিচুগলায় লেডি হেলেনা জানালেন : ‘আমার মনে হয় মেজর কোনো কারণে আয়ারটনকে বিশ্বাস ক’রে উঠতে পারছেন না—এ-সবকিছুর জন্যে তাকেই সন্দেহ করছেন-‘
‘কিন্তু কেন?’ পাঞয়লও এবার একটু চমকে গেছেন। ‘আয়ারটন অবার কী করেছে?’
‘ম্যাকন্যাব্স যদি ভেবে থাকে, আয়ারটনই এই জন্তুগুলোর মৃত্যুর জন্যে দায়ী, তাহ’লে সে একটা মস্ত ভুল করেছে?’ একটু ভেবে নিয়ে বললেন গ্লেনারভন। ‘কিন্তু কাউকে সন্দেহ করার আগে তার উদ্দেশ্যটা নিয়ে ভাবতে হবে তো? খামকা আয়ারটন এমন কাজ করতে যাবে কেন? এতে তার কী লাভ হবে?’
‘এটা ঠিক যে জন্তুগুলো মারার পেছনে আয়ারটনের কী মতলব আছে আমরা সেটা জানি না,’ কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স বললেন, ‘কিন্তু মেজর এ-সম্বন্ধে সত্যি-সত্যি কী বলতে চান, সেইটেই আগে জানা দরকার।’
পাঞয়ল এতক্ষণে একটু ঘাবড়ে যাবার ভঙ্গিতেই বলেছেন : ‘ঐ পালিয়ে-যাওয়া কয়েদিগুলোর সঙ্গে মিলে কোনো ঘোঁট পাকায়নি তো?’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সকে নিয়ে এবার লর্ড গ্লেনারভন পাঁকে-পড়া গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেলেন। গাড়িটাকে টেনে তুলতে গিয়ে এতজন দশাসই জোয়ান বলদ আর ঘোড়াকে কাজে লাগিয়েও কিছু করতে পারেনি। গাড়িটার চাকাগুলো যেন সেখানে খুঁটি গেড়ে রয়েছে। আর-বেশি জোরাজুরি করতে গেলে এবার না গাড়িটাই ভেঙে যায়! তার অবস্থাও তো ভালো নয়। এরই মধ্যে একবার তাকে মেরামত ক’রে নিতে হয়েছে।
হাল ছেড়ে দিয়ে লর্ড গ্লেনারভন মেজাজ খারাপ ক’রে সবাইকে ডেকে ফের ফিরে এলেন তাঁবুতে। একটা জরুরি পরামর্শসভা বসানো ছাড়া এখন আর-কোনো উপায় নেই। তাঁরা এখন যেখানে আছেন সেখান থেকে মেলবোর্ন প্রায় শো-দুয়েক মাইল দূরে, আর টুফোল্ড উপসাগর সে-তুলনায় অনেকটাই কাছে — সত্তর-পঁচাত্তর মাইল দূরে হবে। এখন যখন মোটঘাট নিয়ে পায়দলেই যেতে হবে, তখন কোনদিকে যে যাওয়া উচিত, সে-সম্বন্ধে দ্বিতীয় কোনো মতই ছিলো না। পায়ে হেঁটে যেতে হবে যখন, তখন টুফোল্ড উপসাগরের দিকেই যাওয়া উচিত।
লেডি হেলেনা বললেন : ‘আমি আর মেরি রোজ কম করেও মাইল-পাঁচেক হাঁটতে পারবো। আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।’
পাঞয়ল বললেন, ‘একটা-কোনো বড়ো জনপদে গিয়ে একবার পৌঁছুতে পারলেই মেলবোর্নে আমরা খবর পাঠাতে পারবো। চাই-কি, নতুন-কোনো গাড়ি-ঘোড়াও জোগাড় করে নেয়া যাবে। সেদিক থেকে ইডেনে যাওয়াই ভালো। তাহ’লে টুফোল্ড উপসাগর অব্দি আর যেতে হয় না।’
‘তার চাইতে,’ আয়ারটন কী যেন ভেবে নিয়ে বললে, ‘এখান থেকেই ডানকানে খবর পাঠিয়ে সোজা টুফোল্ড উপসাগরে গিয়েই জাহাজে উঠলে ভালো হয় না কি?’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের দিকে তাকিয়ে লর্ড এডওয়ার্ড বললেন, ‘জন, তুমি কী বলো?’
টুফোল্ড উপসাগর বেশ-দূরে। অদ্দুর যাবার আর দরকার কী? তার চাইতে ইডেনেই না-হয় যাওয়া যাক—কিছুটা তাড়াহুড়ো করলে চার-পাঁচদিনেই পৌঁছে যাবো।’
যতই তাড়া করুন না কেন, পনেরো-বিশদিনের আগে ওখানে পৌঁছুনো যাবে না,’ আয়ারটন জানালে।
‘ঐটুকু রাস্তা যেতে অ্যাদ্দিন লাগবে?’ লর্ড এডওয়ার্ডের গলার বিস্ময় চাপা থাকেনি।
‘তার চাইতেও বেশিদিন লাগতে পারে,’ আয়ারটন সকলের সব আশায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিতে চাচ্ছে, ‘ভিক্টোরিয়ার সবচেয়ে দুর্গম জায়গা দিয়ে যেতে হবে—এখানটায় লোকজন সাধারণত আসে না—ফলে কোনো রাস্তা তৈরি হয়নি। মনে রাখবেন, আমাদের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ ক’রে যেতে হবে। চার-পাঁচদিনে যাওয়া মোটেই সম্ভব হবে না।’
‘বেশ-তো,’ ম্যাঙ্গল্স যেন খুব-একটা পাত্তাই দিলেন না, ‘বেশ, তাহ’লে না-হয় পনেরো-বিশদিন পরেই ডানকানে টম অস্টিনকে খবর পাঠানো যাবে। আমরা যদি অ্যাদ্দিন দেরি করতে পারি, তবে এ-কদিনে তেমন-একটা তফাৎ আর কী হবে?’
‘কিন্তু আমি তো সবচেয়ে-বড়ো মুশকিলটার কথা এখনও বলিনি,’ আয়ারটন আবার একখানা বিপত্তির কথা তুলেছে, ‘যতদিন-না সব জল নেমে যাচ্ছে, আমাদের তো তদ্দিন এখানে নদীর ধারেই ব’সে থাকতে হবে।’
ব’সে থাকতে হবে কেন?’ ম্যাঙ্গল্স একটু অবাক হলেন। ‘নদী কি কাছে কোথাও একটা সরু হয়ে যায়নি যে হেঁটে পেরুনো যায়?’
‘মনে হয় না। সকালে আমি তারও খোঁজ করছিলাম—কিন্তু রাতের বৃষ্টির ঢল নেমে জল ফুলে-ফেঁপে উঠেছে—এতটাই বান ডেকেছে যে জলে কেউ নামলেই কোথায় যে ভেসে যাবে, কেউ জানে না।’
লেডি হেলেনা সরাসরি জিগেস করলেন, ‘কিন্তু কত চওড়া এ-নদী?’
‘মাইলখানেক তো হবেই—এই তীর থেকে ওই তীর খুব স্পষ্ট দেখা যায় না। তার ওপর এমন সাংঘাতিক স্রোত যে–’
‘কিন্তু ভেলা বা ক্যানু তো যাবে,’ রবার্ট বললে, ‘এখানে তো আর গাছপালার অভাব নেই।
এতক্ষণে একটা কাজের কথা হ’লো। শুনেই কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স উৎসাহে লাফিয়ে উঠেছেন। ‘রবার্ট ঠিকই বলেছে। হাত-পা গুটিয়ে ব’সে না-থেকে অন্তত কিছু-একটা তো করা যাবে।’
আয়ারটনের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে লর্ড গ্লেনারভন জিগেস করলেন, তুমি কী বলো, আয়ারটন? সেটা করাই তো ঠিক হবে, তা-ই না?
‘কিন্তু যা-ই করুন না কেন, এখানে আমাদের অনেকদিন ব’সে থাকতে হবে—অন্তত যদ্দিন-না বাইরে থেকে কোনো সাহায্য আসে—’
আয়ারটনের কথা শেষ করতে না-দিয়ে একটু উত্ত্যক্ত ভঙ্গিতেই ব’লে উঠেছেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স, ‘সবসময় বাইরের সাহায্যের জন্যে ব’সে থেকে কী হবে? তোমার মাথায় যদি অন্যকোনো প্ল্যান থাকে তো সেটাই বলো।’
‘সেটাই এতক্ষণ ধ’রে বলবার চেষ্টা করছি। আমরা যতক্ষণ এখানে অপেক্ষা করবো, ডানকান ততক্ষণে টুফোল্ড উপসাগরে এগিয়ে এলে অনেকটা সময় বাঁচে—আর সবকিছুর একটা হিল্লে হ’য়ে যায়।’
‘সেই থেকে দেখছি তুমি বারে-বারে ডানকানের কথাই তুলছো। কিন্তু তাতে ফায়দাটা কী হবে? সাহায্যটা আসবে কোত্থেকে? তাছাড়া ডানকানকেই বা আমরা খবর পাঠাবো কী ক’রে?’
এমন সোজাসুজি কথাটা বলা হ’লো যে আয়ারটন একটু থতমত খেয়ে গেলো। কতটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, সেটা সে এতক্ষণে বুঝতে পারলে। একটু দোনোমনা ক’রে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়ে বললে, ‘কী করলে একটু তাড়াতাড়ি ঝামেলাটা মেটে, এতক্ষণ আমি শুধু সে-কথাটাই বলতে চাচ্ছিলাম। আমি গায়ে প’ড়ে কোনো পরামর্শ দিতে চাইনি, সেই স্পর্ধাও আমার নেই। আপনারা আলোচনা ক’রে যা ঠিক করবেন, তা-ই হবে।’
এবার একটু অসহিষ্ণু হ’য়েই গ্লেনারভন বললেন, ‘কিন্তু সেটা কোনো উত্তর হলো না। আমরা তো আলোচনাই করছিলুম। তোমার কী মত, সেটাই বলো। কী করলে আমরা আপাতত এই সমস্যাটা থেকে উদ্ধার পাই, সেটাই তো ভাবতে হবে—’
‘আমরা এখানেই ব’সে থেকে বিশ্রাম করি। ততক্ষণে ডানকান টুফোল্ডে এসে আমাদের সাহায্য পাঠাবার ব্যবস্থা করুক। এখান থেকে কেউ-একজন গিয়ে টম অস্টিনকে খবর দিক। ততক্ষণে আর বৃষ্টি না-হ’লে নদীর জলও ক’মে যাবে। তখন না-হয় দেখা যাবে কোনখানে নদী পেরুনো যায়। দরকার হ’লে তখনই ক্যানু বানিয়ে নেয়া যাবে।’
‘এটা অবশ্য মন্দ বলোনি। দেরি তো এমনিতেই হচ্ছে—তবে মাঝখান থেকে অনেকগুলো ঝামেলার হাত থেকে বাঁচা যাবে। আমাদের ঘোড়া আর বলদগুলো না-থাকায় সত্যিই তো এইভাবে এতটা পথ হেঁটে-হেঁটে যাবার চেষ্টা করা খুব বিপজ্জনক সন্দেহ নেই।’
এতক্ষণ মেজর ম্যাকন্যাব্স একটাও কথা বলেননি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এই কথা-কাটাকাটি শুনছিলেন। এবার সকলকে অবাক ক’রে দিয়ে ম্যাক্ন্যাস বললেন, ‘হ্যাঁ, এই প্রস্তাবটাই সবচেয়ে-ভালো। আয়ারটন যা বলেছে, আমিও এতক্ষণ তা-ই ভাবছিলুম।’
এবার যেন হতভম্ব হওয়ার পালা আয়ারটনের। সে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেজরের মুখের দিকে তাকালে। এতদিন যখনই সে ডানকানের কথা তুলেছে, তখনই মেজর ম্যাকন্যাব্স কোনো-না-কোনো আপত্তি তুলেছেন। অথচ এখন কেমন যেন তড়িঘড়ি বড্ড চট ক’রেই তার কথায় রাজি হ’য়ে যাচ্ছেন।
অন্যরাও বেশ অবাক হয়েছিলো। কিন্তু প্রস্তাবটায় মেজর ম্যাকন্যাব্সের সম্মতি আছে দেখে এই প্রস্তাবটাই গ্রহণ করা হ’লো। শুধু কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স তখন একটা বাস্তব অসুবিধের কথা তুললেন—’আমরা যদি নদী পেরুতে না-ই পারি, তবে টম অস্টিনের কাছে যে যাবে, সে-ই বা নদী পেরুবে কী করে?’
আয়ারটন এবার তড়িঘড়ি তার পরামর্শ নিয়ে খাড়া। ‘খামকা কাউকে নদী পেরুতে হবে কেন? আমাদের তো এখনও একটা ঘোড়া আছে। সেই ঘোড়ায় চেপে সে লক্ষ্ণৌ রোডে ফিরে যাবে—সেখান থেকে সোজা চলে যাবে মেলবোর্নে। ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে বেশিদিন লাগবে না। চট ক’রেই পৌঁছে যাবে মেলবোর্ন—সেখান থেকে টুফোল্ডের মুখে আসতে আর ক-দিনই বা লাগবে?’
সঙ্গে-সঙ্গে মেজর ম্যাকন্যাব্স কথাটায় সায় দিলেন। ‘এই কথাটা আগেই আমাদের ভাবা উচিত ছিলো। এতেই সবচেয়ে-তাড়াতাড়ি ঝামেলাটার একটা সুরাহা হবে।’
‘কিন্তু যাবে কে? আমাদের তো কারুই এখানকার পথঘাট জানা নেই,’ লর্ড গ্লেনারভন জিগেস করলেন।
‘আমাকে এই রাস্তা দিয়েই বুনোদের হাত থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিলো, ‘আয়ারটন বললে, ‘আমি এখানকার রাস্তাঘাট একটু-আধটু জানি। আপনি যদি হুকুম করেন তো আমিই যেতে পারি। একটা চিঠি লিখে টম অস্টিনকে নির্দেশ দিন—একসপ্তাহের মধ্যে ডানকানকে নিয়ে টুফোল্ডের মুখে এসে হাজির হ’য়ে যাবো।’
‘না-না, তুমি কেন যাবে?’ আপত্তি তুলেছেন জন ম্যাঙ্গল্স। ‘তুমি চ’লে গেলে, ব্রিটানিয়া কোথায় ডুবেছিলো, সে-জায়গাটা চিনিয়ে দেবে কে? অন্তত সে-জায়গাটা শনাক্ত ক’রে দেবার জন্যেও তোমার এখানে থাকা উচিত।’
কিন্তু তৎক্ষণাৎ আপত্তিটাকে নস্যাৎ ক’রে দিলেন ম্যাকন্যাব্স। ‘না কাপ্তেন, আয়ারটনের প্ল্যানটাই ভালো–সে এখানকার রাস্তাঘাট চেনে, সে চট ক’রে পৌঁছে যেতে পারবে মেলবোর্নে। তাছাড়া আমরা তো এখন এখানে নদীর জলের শোভা দেখবো, ঢেউ গুনবো আর হাওয়া খাবো-আমরা তো আর এখান থেকে নড়ছি না এখন, যে ব্রিটানিয়া কোথায় ডুবেছিলো সে-জায়গাটা খুঁজতে বেরিয়ে যাবো। সেই-অর্থে, আয়ারটনের তো এখানে কোনো কাজ নেই। সে-ই বরং বার্তাটা নিয়ে যাক।’
‘তাহ’লে এই কথাটাই ঠিক হ’লো,’ লর্ড এডওয়ার্ড বলেছেন, ‘আয়ারটনই যাবে।’ ব’লে তক্ষুনি তিনি চিঠি লিখতে বসে গিয়েছেন।
আর, অমনি, পলকের জন্যে উদ্ভাসিত হ’য়ে উঠেছে আয়ারটনের মুখ, চোখের তারায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছে। আর-কারু চোখে না পড়লেও জন ম্যাঙ্গসের সেটা চোখ এড়ায়নি।
লর্ড এডওয়ার্ড যখন চিঠিটার মুসাবিদা করছেন, কাঁধের কাছে মুখ এনে মেজর ম্যাকন্যাব্স ফিশফিশ ক’রে বলেছেন তাঁকে, ‘আয়ারটন বানানটা জানা আছে তো?’
‘বাঃ রে, যা হয়, তা-ই। আ-য়া-র-ট-ন।’
‘না। আমরা বলি আয়ারটন, তবে লেখার সময় বেন জয়েস।’
নিচু গলাতেই বলেছিলেন মেজর ম্যাকন্যাব্স কিন্তু স্তব্ধ তাঁবুর মধ্যে তবু যেন নামটা গমগম ক’রে বজ্রের মতো ফেটে পড়েছিলো।
হতচকিত, কেউ কিছু বুঝে ওঠবার আগেই, আয়ারটনের হাতে ঝিলিক দিয়ে উঠেছে ছোট্ট-একটা আগ্নেয়াস্ত্র, আর রিভলভারটি থেকে পর-পর তিনবার গুলি ছুটেছে। গুলি খেয়ে তক্ষুনি আছড়ে পড়েছেন লর্ড এডওয়ার্ড, কলমটা তাঁর হাত থেকে ছিটকে প’ড়ে গিয়েছে।
কিন্তু এই তিনবার-ছোঁড়া গুলির আওয়াজ বুঝি অন্য কোনোকিছুর সংকেতই ছিল—কেননা ঠিক তার প্রতিধ্বনি তুলেই বাইরে পর-পর শোনা গেছে আরো আগ্নেয়াস্ত্রের আওয়াজ।
হুটোপাটিটা শুরু হবার আগেই আয়ারটন উধাও। কাপ্তেন জন ম্যাঙ্গল্স অন্য মাল্লাদের নিয়ে ছুটে গিয়েও আয়ারটনের নাগাল ধরতে পারেননি, তিন লাফেই সে যেন গিয়ে ততক্ষণে পৌঁছেছে বনের পাশে-যেখানে তার সাগরেদরা এতক্ষণ ধ’রে ইঙ্গিতটারই অপেক্ষা করছিলো।
এই তাঁবুর মধ্যে থাকলে সবাই তাহ’লে দুশমনদের সহজ-চাঁদমারি হ’য়ে উঠবে—তাঁবুটা তাগ ক’রেই এই নৃশংস দস্যুগুলো তাহ’লে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করবে।
লর্ড এডওয়ার্ডের প্রাথমিক অপ্রস্তুত অবস্থাটা কেটে যেতেই তিনি লাফিয়ে উঠেছেন—তাঁর আঘাত ততটা গুরুতর নয়, গুলিটা তাঁর কাঁধ ঘেঁসে আছে, কেননা আয়ারটন তখন গুলি চালিয়েছিলো এলোপাথারি, তাগ ঠিক করবার মতো অবসর পায়নি। আর একমুহূর্তও সবুর করেননি লর্ড এডওয়ার্ড, মেরি আর হেলেনাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বলদে টানা গাড়িটার পেছনে—গাড়ির ওপরের ছাউনিটা মোটা-মোটা চামড়া আর কাঠে বানানো। অন্য-সবাই ততক্ষণে বন্দুক তুলে নিয়েছেন হাতে, এই দুশমনদের যে-ক’রেই হোক ঠেকাতে হবে। বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করা চলবে না।
কয়েক ঝাঁক গুলি ছুটেছিলো, তারপরেই সব হঠাৎ এখন চুপ হ’য়ে গেছে, সব ঠাণ্ডা, শত্রুদের আর-কোনো সাড়াশব্দ নেই। কিন্তু বনের পাশে সব ভোঁ-ভোঁ, কোনো জনপ্রাণীর চিহ্নও নেই। আয়ারটন অথবা বেন জয়েস—যে-ই হোক না কেন, সে এই ফাঁকে তার তাঁবেদারদের নিয়ে চম্পট দিয়েছে—শুধু বারুদের গন্ধ আর ধোঁয়াই বুঝিয়ে দিচ্ছে একটু আগেই এখান থেকে গুলি ছুটেছিলো।
মেজর ম্যাকন্যাব্স তক্ষুনি কাপ্তেনের সঙ্গে ছুটে গিয়েছেন ধাওয়া ক’রে—লড়াইটা সামনাসামনিই হোক, অমন আড়াল থেকে শত্রুর মোকাবিলা করা যাবে না। কিন্তু অপ্রস্তুত অবস্থাটা কাটিয়ে উঠে ছুটে আসতে যতটা সময় লেগেছিলো তাতে শত্রুরা পালিয়েছে।
‘পালিয়েছে কি না কে জানে।’ বলেছেন মেজর। ‘হয়তো কোথাও ওৎ পেতে আছে—সুযোগ পেলেই অতর্কিতে এসে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এতে বরং বিপদ আরো বাড়লো। কোথায় কোন কোণ থেকে হামলা আসবে, কে জানে। এ-জায়গাটা তো এদের নিজেদের হাতের চেটোর মতোই চেনা। মুখোমুখি বাঘের সঙ্গে লড়াই করার চাইতে ঘাসের আড়াল থেকে সরসর ক’রে এগিয়ে-আসা সাপের ছোবল ঠেকানো অনেক কঠিন।’
‘আমাদের সারাক্ষণ হুঁশিয়ার হ’য়ে থাকতে হবে।’ মেজরের সঙ্গে গাড়িটার পাশে ফিরে আসতে-আসতে বলেছেন কাপ্তেন। ‘সবসময় কাউকে-না-কাউকে পাহারায় থাকতে হবে।’
দুজন মাল্লাকে বনের দিকে কড়ানজর রাখতে ব’লে তাঁরা তারপর গাড়ির আড়ালে এসেছেন। ততক্ষণে মেরি আর হেলেনা লর্ড এডওয়ার্ডের জখমটার শুশ্রূষা করতে লেগেছে। আঘাতটা, ভাগ্যিশ, তেমন-গুরুতর নয়, গুলিটা চামড়া ছ’ড়ে বেরিয়ে গেছে। রক্তস্রাব হচ্ছে, সেটা এক্ষুনি ব্যানডেজ বেঁধে বন্ধ করা চাই। ব্যানডেজ বাঁধা হ’য়ে যেতেই মেরি আর লেডি হেলেনাকে হুঁশিয়ার ক’রে দিয়েছেন লর্ড গ্লেনারভন। ‘সাবধানে থেকো তোমরা। এই গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ো না একবারও। সবচেয়ে-ভালো হ’তো যদি মাথার পেছনে দুটি ক’রে বাড়তি চোখ থাকতো—তাহ’লে সামনে-পেছনে দু-দিকেই নজর রাখা যেতো।’ এই রসিকতা ক’রে থমথমে অবস্থাটা একটু হালকা করে দিয়ে তারপর তিনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন মেজরের দিকে।
একটু আগেই যা ঘটেছে, তার আকস্মিকতায় লেডি হেলেনা একেবারে বোমকে গিয়েছিলেন। ভয় পাবেন বলে, আগে তাঁকে কেউ পলাতক কয়েদি, রেলগাড়ির হামলা, ইনাম ঘোষণা ক’রে হুলিয়া বেরুনো—এর কোনো কথাই কখনও বলেননি। এখন তাঁকে সবকিছু খুলে বলতে হয়েছে, একেবারে গোড়া থেকে—অন্তত যতটুকু তাঁরা জানেন।
মেজর আগেকার কথাটা বলতে-বলতে পকেট থেকে বার করে অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড নিউজিল্যাড গেজেটের সেই বিশেষ সংখ্যাটা দেখিয়েছেন, যেখানে দুর্ধর্ষ দস্যু বেন জয়েসের পালাবার খবর বেরিয়েছিলো।
‘আয়ারটনকে আমার গোড়া থেকেই সন্দেহ হচ্ছিলো—তার হাবভাব খুব-একটা ভালো লাগেনি কখনোই। স্পষ্ট ক’রে কোথাও আঙুল রেখে বলতে পারবো না যে এই একটা খুঁটিনাটি থেকে বুঝতে পেরেছি যে তাকে দেখে যা মনে হয়, সে আসলে তা নয়। কিন্তু কেন যেন তার কোনো কথাই আমার ঠিক বিশ্বাস হয়নি—একেবারে গোড়া থেকেই। কী জানি, সন্দেহ করা হয়তো আমার বাতিক। কিন্তু সন্দেহটা পাকিয়ে উঠেছিলো আরো, যখন পর-পর আপাতদৃষ্টিতে কতগুলো তুচ্ছ ব্যাপার নজরে পড়েছিলো। সেই যেবার গাড়ি সারাই করার জন্যে মিস্ত্রি এনেছিলো আয়ারটন, তখন সন্দেহটা আরো দানা বাঁধে। আমি দেখেছিলুম, গাড়ি সারাতে-সারাতে তারা ইশারা-ইঙ্গিতে চোখে-চোখে কথা কইছে। তাছাড়া আরো-একটা খটকা ছিলো প্রথম থেকেই। কোনো লোকালয় কাছে এলেই আয়ারটন এড়িয়ে-এড়িয়ে যায় কেন, কেন কোনো গ্রামে বা শহরে ঢুকতে চায় না।’
‘হ্যাঁ,’ জন ম্যাঙ্গল্স বলেছেন, ‘এটা আমিও খেয়াল করেছিলুম। আয়ারটন সবসময়েই বলতো একজন কারু গাড়ির কাছে থেকে লটবহরের ওপর নজর রাখা উচিত। আর সেই দায়িত্ব সবসময়েই আগবাড়িয়ে সে নিজের কাঁধেই তুলে নিতো।
‘চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে,’ জ্ঞানগর্ভ বাণী আউড়েছেন জাক পাঞ্চয়ল, ‘এখন হয়তো তার সমস্ত আচার-আচরণ থেকেই আমরা নতুন-নতুন সব অর্থ নিংড়ে নিতে পারবো।’
এই স্বতঃসিদ্ধ আর্যবচনকে কোনো পাত্তা না-দিয়েই মেজর ফের নিজের কথার জের তুলে নিয়েছেন। তাছাড়া আরো একটা ব্যাপারে আমার কেমন অস্বস্তি লাগছিলো। ডানকানকে যাতে টুফোল্ড উপসাগরে নিয়ে আসা হয়, সেজন্যে সে কী-রকম ঘ্যানঘ্যান করতো, মনে আছে? প্ৰায় যেন জেদ ধরেই বসেছিলো—যে-ক’রেই-হোক, ডানকানকে উপসাগরের মুখে নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া, এটা কেউ খেয়াল করেছে কি না জানি না—বলদ আর ঘোড়াগুলোর দেখাশুনো করবার ভার ছিলো ওরই ওপর। অথচ সেগুলো সব পর-পর রহস্যময়ভাবে অজানা কোনো রোগে মারা গেছে!’
‘এত-সব জেনেও আমাদের কাউকে কিছু না-বলা ঠিক হয়েছে?’ লেডি হেলেনা জিগেস করেছেন।
‘শুধু সন্দেহের ওপর ভর করে তো কারু দিকে আঙুল তুলে বলা যায় না—তুমি লোকটা খলনায়ক, তোমাকে সবকিছুর কৈফিয়ৎ দিতে হবে। আমাকে ব’সে থাকতে হয়েছে অকাট্য প্রমাণের জন্যে—আর সব সন্দেহ বুকের মধ্যে চেপে রেখেছি ব’লে ক্রমশই আমার অস্বস্তি বেড়েছে। তারপর শেষটায় কালরাতে যখন উটের পিঠে শেষখড় পড়লো, তখন আর আমার সন্দেহ আর নিছক-সন্দেহ থাকেনি—প্রায় হাতে-নাতেই প্রমাণটা পেয়ে গিয়েছিলুম।’
‘কেন?’ বেশ-কৌতূহলী হ’য়েই প্রশ্ন করেছেন লেডি হেলেনা।
কাল রাতে বৃষ্টি শুরু হবার আগে, হঠাৎ কেন যেন আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি যে তখন উঠে তাঁবুর বাইরে গিয়েছিলুম, সেটা কেউ জানে না। ফসফর-ফার্নের নীলচে আলোয় দেখি কাদার ওপর আমাদেরই ঘোড়র পায়ের ছাপ দেখে-দেখে চুপিসারে আসছে তিনটে ছায়ামূর্তি—গুঁড়ি মেরে কাছে গিয়ে দেখি সেই-তিনজন ছায়ামূর্তির মধ্যে একজন সেই মিস্ত্রি—সেই-যে লোকটা ভাঙাগাড়ি মেরামত করতে এসেছিলো—ভালো ক’রে তাকিয়ে দেখি লোকটার হাতে কালো-কালো গোল দাগ—সম্ভবত হাতকড়ারই দাগ। অন্তত আমার তা-ই মনে হয়, এখানে কয়েদিদের হাতে আঁটো ক’রে হাতকড়া পরানো হয়।’
রুদ্ধশ্বাসে লেডি হেলেনা বলেছেন : ‘তারপর?’
‘শুনি যে, সেই লোকটাই বলছে—’একটা বাদে সবগুলো ঘোড়াই টেশে গিয়েছে।’ উত্তরে অন্য-কে-একজন বলেছে—’মরবে না মানে? এত বিষ হাতিয়ে নিয়ে এসেছিলাম যে একটা গোটা ক্যাভালরির ঘোড়াগুলোকেই খতম ক’রে দেয়া যেতো।’ তৃতীয় লোকটা তখন বলেছে—’বেন জয়েসের এই প্ল্যানটা সফল হ’লে বলতে হবে যে ওর মতো বাহাদুর কোয়ার্টারমাস্টার আর-কোথাও জন্মায়নি—খোদ ওয়ালটার রলেকেও বুদ্ধির খেলায় ও হারিয়ে দিতে পারতো।’ এ-সব কথা শোনবার পর আমার আর কিছু জানতে বাকি থাকেনি। সব কী-রকম জলের মতো সরল হ’য়ে এসেছিলো। আয়ারটন কী বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলো, মনে আছে? সে বলেছিলো, সে নাকি ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার ছিলো। এরপর আর দুয়ে আর দুয়ে যোগ করতে কত বিদ্যে লাগে? বেন জয়েস তাহ’লে তারই নাম? দস্যুরা তারপর বনের মধ্যে মিলিয়ে যেতেই সে ফের ফিরে এসেছিলো তাঁবুতে।
সবকিছু শুনে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হ’য়ে ব’সে থেকেছেন সবাই, বাক্যহারা।
তারপর প্রায় বারুদে আগুন লাগার মতো ক’রে ফেটে পড়েছেন লর্ড এডওয়ার্ড। ‘নচ্ছার, পাজি, বেইমান! আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে ভুলিয়েভালিয়ে এই জনমনুষ্যহীন অঞ্চলটায় নিয়ে এসেছিলো সব্বাইকে খুন ক’রে সবকিছু লুঠ ক’রে নিয়ে যেতে—’
‘নিশ্চয়ই তা-ই ওর মলব ছিলো।’
‘তার মানে আগের বার সেই নদী পেরুবার সময় থেকেই—যখন ও গিয়ে মিস্ত্রি ডেকে এনেছিলো—ওর সাঙাগুলো আমাদের পিছু নিয়েছিলো।’
‘নিশ্চয়,’ মেজর বলেছেন, ‘এখন আর এতে কোনো সন্দেহই তো নেই!’
‘বিলজিবাবের বাচ্চা! তাহলে ও কোনোকালেই ব্রিটানিয়ায় কোনো কাজ করেনি। শুধু আমাদের ভাটকি দিয়েছে অ্যাদ্দিন!’
‘না, এ-ব্যাপারটায় বোধহয় ধাপ্পা দেয়নি। আমার মনে হয়, ব্রিটানিয়ায়ও নিশ্চয়ই কখনো-না-কখনো কাজ করেছিলো। না-হলে কাপ্তেন গ্রান্টের কথা ও জানলো কী ক’রে। আমার তো মনে হয়, আয়ারটনই ওর আসল নাম—বেন জয়েস ওর ছদ্মনাম—হয়তো আরো অনেক নাম আছে লোকটার
‘তাহ’লে ব্রিটানিয়ার কোয়ার্টারমাস্টার সেজে সে অস্ট্রেলিয়ায় আসে কী করে?’
‘সেই ধাঁধাটার উত্তর গোয়েন্দারাও খুঁজে পায়নি। হয়তো পরে কোনোদিন সব ফাঁস হ’য়ে যাবে। জানা যাবে, ও কীভাবে এখানে এসেছিলো।’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স বললেন, ‘গোয়েন্দারা আর কতটুকুই-বা জানে? তারা কি এটা জানে যে আয়ারটন আর বেন জয়েস আসলে একই লোক?’
তার মানে–ও যে খামারে কাজ নিয়েছিলো, সেটা কোনো বদ মতলব নিয়েই? জিগেস করেছেন লেডি হেলেনা।
‘সেখানেও নিশ্চয়ই কিছু-একটা বিষম গোল বাঁধাবার তালে ছিলো—হঠাৎ আমরা গিয়ে পড়ায় তার চেয়েও বড়ো-একটা প্রলোভন পেয়ে গেছে!’
‘মিস গ্রান্ট,’ কেমন উৎকণ্ঠিত স্বরেই জিগেস করেছেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স, ‘মিস গ্রান্ট, আপনাকে অমন অসুস্থ দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে?’
কাপ্তেনের কথায় অমনি সকলের চোখ গিয়ে পড়েছে মেরির ওপর। তার মুখ শুকিয়ে আমশি হ’য়ে গিয়েছে। এক্ষুনি যেন চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসবে—মনে হয়েছে সকলের।
মেরি ধরাগলায় শুধু বললে, ‘তাহ’লে বাবা – ‘
মেরির এই কথাটায় আবার সবাই যেন একঝটকায় বাস্তবের মধ্যে ফিরে এলো। আয়ারটন যদি বেন জয়েস হয়, তাহ’লে কাপ্তেন গ্রান্টকে খুঁজে পাবার যে-আশাটা ছিলো, সেটা এখন গেলো। ব্রিটানিয়া মোটেই টুফোল্ড উপসাগরের মুখে ঝড়ের পাল্লায় পড়েনি, সে যে কোথায় ডুবেছে কে জানে, অর্থাৎ কাপ্তেন গ্রান্ট মোটেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে পা দেননি।
অর্থাৎ আবারও একবার চিরকুটগুলো প’ড়ে ভুল-একটা মানে বার করেছেন জাক পাঞ্চয়ল—তাঁর এত পাণ্ডিত্য কোনো কাজেই তাহ’লে এলো না! এবার মুখ শুকিয়ে গেলো স্বয়ং জাক পাঞ্চয়লের।
মেরির জন্যে সকলেরই কেমন মায়া হচ্ছিলো, কিন্তু সবজান্তা পাঞয়লের মুখচোখ দেখেও মায়াই হয়েছে সকলের। বেচারি তো চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি, মাথাখাটিয়ে কোনো-একটা অর্থ তো বার করেছেন—যতটা তাঁর বুদ্ধিতে কুলিয়েছে।
লর্ড এডওয়ার্ড গাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন তারপর। সম্ভবত বুঝতে পারেননি মেরিকে এখন কী বলে সান্ত্বনা দেবেন। বাইরে এসে দ্যাখেন, মাল্লাদের দুজন রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে।
এদিকে মেঘ কেটে গিয়ে আলো ক’রে এসেছে তখন—কত নাম-না-জানা পাখির কলরব উঠেছে গাছের ডালে। ঐ-যে, একটা ক্যাঙারু লাফাতে লাফাতে গিয়ে বনের মধ্যে ঢুকলো, ছানা-রু তার বুকপকেট থেকে মুখ বার ক’রে চারিদিক সাগ্রহে দেখে নিচ্ছিলো। ক্যাঙারুর নিশ্চিন্ত ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেলো, আশপাশে নিশ্চয়ই কোনো মানুষ নেই—বেন জয়েস নিশ্চয়ই তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে দূরে-কোথাও কেটে পড়েছে। সম্ভবত মাত্র এই কজন অনুচর নিয়ে সে এখন কোনো মুখোমুখি সংঘর্ষে আসতে চায় না। সম্ভবত গেছে দলের বাকি লোকগুলোকে নিয়ে আসতে—তারপর এসে রাতের আঁধারে শিবিরটার ওপর চড়াও হবে।
রাগে লর্ড এডওয়ার্ডের সর্বাঙ্গ জ্ব’লে যাচ্ছিলো! পতঙ্গদের বিলজিবাবের এমনতর কোনো সুসন্তানের সঙ্গে এর আগে এমনভাবে তাঁর কখনও দেখা হয়নি।
আশপাশে একটু টহল দিয়ে তারপর তিনি ফিরে এসেছেন অন্যদের কাছে।
অন্যরা সেখানে ব’সে-ব’সেই তখনও উত্তেজিতভাবে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। লর্ড এডওয়ার্ডকে দেখেই কানে ম্যাঙ্গল্স ব’লে উঠেছেন; ‘আমাদের কিন্তু এখন হাত-পা গুটিরে অসহায়ভবে বসে থাকলে চলবে না। এখানে এই মাউন্ট কশচিউস্কোর আশপাশে হা ক’রে ব’সে থেকে আমাদের কী হবে?’
‘তুমি তাহলে কী করতে বলো আমাদের?’
‘এখানে বরং রাত্তিরে কখনও বেন জয়েসের হামলার মুখে পড়তে হবে আমাদের। তার চেয়ে বেন জয়েস যা করতে যাচ্ছিলো, ঠিক তা-ই করা দরকার আমাদের?’
‘অর্থাৎ?’
‘ঘোড়া তো একটাই আছে এখনও। সেটায় ক’রে কেউ-একজন এক্ষুনি মেলবোর্নের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ুক—তারপর যত তাড়াতাড়ি পারে—সাত থেকে দশদিনের মধ্যে—ডানকানকে ডেকে নিয়ে আসুক টুফোল্ডের মুখে!’
ম্যাঙ্গল্স ঠিকই বলেছেন। এক্ষুনি একটা-কিছু ব্যবস্থা করা দরকার।
জ্যান্ত ঘোড়া যেহেতু মাত্র একটাই, অতএব মাত্র একজন ছাড়া আর-কারু যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। যাবার কথায় কিন্তু সকলেই লাফিয়ে উঠেছেন—এমনকী রবার্টের উৎসাহটাই মনে হচ্ছিলো সবচেয়ে-বেশি। প্রত্যেকেই পারলে যেন তক্ষুনি ঘোড়া ছুটিয়ে টগবগ-টগবগ ক’রে মেলবোর্ন চ’লে যাবে। এই নিয়ে এমন তর্কাতর্কি বেঁধে গেলো যে লেডি হেলেনার প্রস্তাব হলো লটারি ক’রেই না-হয় ঠিক করা হবে কে যাবে। শেষপর্যন্ত সেই প্রস্তাবটাই মেনে নিয়েছে সবাই। আর লটারিতে শেষটায় নাম উঠে গেলো মাল্লাদের মধ্যে একজনের। ঠিক হলো, খাওয়াদাওয়ার পর রাত আটটাতেই সে বেরিয়ে পড়বে।
যাত্রার যখন প্রস্তুতি চলেছে, তখন মেজর ম্যাকন্যাব্স সবাইকে ডেকে আরেকটা বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন।
‘মনে আছে, ঘোড়াগুলোয় কী-রকম বিশেষ জাতের নাল পরানো হয়েছিলো?’
হঠাৎ এ-কথা শুনে একটু বুঝি হতভম্বই হ’য়ে গেছে সবাই।
মেজর ম্যাকন্যাব্স নিজেই তারপর হেঁয়ালিটার সমাধান ক’রে দিয়েছেন। ‘ঐ বিশেষ নাল পরানো হয়েছিলো এই জন্যে যাতে ঘোড়ার খুরের ছাপ দেখে-দেখে বেন জয়েসের লোকেরা জেনে নিতে পারে আমরা কোথায় কোপথ দিয়ে যাচ্ছি। এখনও নিশ্চয়ই এরা আমাদের ওপর কড়া নজর রেখে যাচ্ছে। আয়ারটন তো জানেই যে আমাদের এখনও একটা সতেজ ঘোড়া র’য়ে গেছে—সেটাতে ক’রেই তার মেলবোর্নে যাবার কথা হচ্ছিলো। তারা নির্ঘাৎ টের পেয়ে যাবে যে আমরা নিশ্চয়ই কাউকে মেলবোর্ন পাঠাবো—আর তার পেছন নিতে তাদের কোনোই অসুবিধে হবে না—ঐ ঘোড়ার নালের ছাপ দেখে-দেখেই তারা ব্যাপারটা জেনে যাবে। কাজেই আমাদের পক্ষে উচিত হবে ঐ বিশেষ মার্কামারা নালটা খুলে ফেলে নতুন-কোনো নাল পরিয়ে-দেয়া। তা না-হ’লে কারু পক্ষেই আর মেলবোর্ন যাবার মানে হয় না—পথেই তারা তার ওপর হামলা চালাবে।’
মেজর ম্যাকন্যাব্সের কথা শুনে আশঙ্কাটা যে একেবারেই অমূলক নয়, এটা বুঝতে কারুই আর দেরি হয়নি। তক্ষুনি ঘোড়ার খুর থেকে বিশেষ মার্কার নালগুলো খুলে ফেলে নতুন নাল লাগিয়ে দেয়া হ’লো, যাতে দস্যুদল কিছুতেই ঘোড়সোয়ার যে কে, কাদের জন্যে সাহায্য আনতে যাচ্ছে, সেটা বুঝতে না পারে!
কিন্তু তখনও সবচেয়ে-জরুির কাজটাই বাকি ছিলো। টম অস্টিনকে একটা চিঠি লিখতে হবে। এতক্ষণ উত্তেজনায় লর্ড এডওয়ার্ড তাঁর কাঁধ আর হাতের ব্যাথাটাকে তেমন আমল দেননি—এখন লিখতে বসে আবিষ্কার করেছেন হাতটা একটু নাড়লেই অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। দু-একবার যখনই চেষ্টা করতে গেছেন, তখনই তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে বিষম যন্ত্রণার ছাপ। শেষটায় পাঞয়লই বসেছেন তাঁর হয়ে চিঠিটা লিখে দিতে—লর্ড এডওয়ার্ড মুখে-মুখে ব’লে যাবেন চিঠির বক্তব্য, আর পাঞয়ল তা-ই শুনে গুছিয়ে লিখে দেবেন। কিন্তু পাঞয়লের মন তখন যে কোথায় প’ড়ে ছিলো, কে জানে। তখনও তিনি ভেবে চলেছেন বোতলে পাওয়া চিরকুটগুলোর মানে কী হতে পারে–আবারও তাহ’লে তিনি চিরকুটগুলোর সত্যিকার-মানে বুঝতে পারেননি। অন্যমনস্কভাবে লিখতে ব’সে প্রথমে খানিকক্ষণ কাগজ-কলমের সামনে তিনি হাঁ ক’রে ব’সে থেকেছেন, লর্ড এডওয়ার্ড তাঁকে যা লিখতে বলছিলেন, তার কিছুই যেন তাঁর কানে ঢুকছিলো না।
লর্ড গ্লেনারভনও আবারও বলেছেন, কিঞ্চিৎ বিরক্ত হ’য়েই : ‘কী হলো? লিখুন—’
‘অ্যা?’ ব’লে মঁসিয় পাঞয়ল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছেন তাঁর মুখের পানে। ‘লিখুন যে : টম অস্টিনকে জানানো হচ্ছে, এই এত্তেলাপাবামাত্রই যেন ডানকানকে নিয়ে
এ-তো মহামুশকিল হ’লো। মঁসিয় পাঞয়ল এখন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সামনে প’ড়ে-থাকা অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড নিউ-জিল্যান্ড গেজেট-এর সংখ্যাটার দিকে। ভাঁজ-করা কাগজটার নামটার শুধু একটা টুকরোই পড়া যাচ্ছে।
‘কী হ’লো, মঁসিয় পাঞয়ল? লিখুন—’
‘ও-হ্যাঁ, লিখছি। কিন্তু…অ্যালান্ড…অ্যালান্ড…অ্যালান্ড? অ্যালান্ড মানে?’ তড়াক ক’রে লাফিয়ে উঠতে গিয়ে আবার কেমন হতভম্বভাবে তিনি ব’সে পড়েছেন! ‘হাঁ, বলুন কী লিখতে হবে—’
‘টম অস্টিনকে জানানো হচ্ছে, এই এত্তেলাটা পাবামাত্র যেন ডানকানকে নিয়ে এক্ষুনি যেন অস্ট্রেলিয়ার পুব উপকূলে চলে আসে।’
‘অস্ট্রেলিয়া?’ আবার কেমন যেন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন মঁসিয় পাঞয়ল। ‘ও-হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া!’
কলের পুতুলের মতো চিঠিটা কোনোমতে লিখে শেষ করেছেন মঁসিয় পাঞয়ল, তারপর লর্ড এডওয়ার্ডকে দিয়েছেন চিঠিটায় সই করবার জন্যে। অসহ্য যন্ত্রণা সত্ত্বেও, দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে, কোনোরকমে নিজের নামটা সই করেছেন লর্ড এডওয়ার্ড। তারপর চিঠিটা ভাঁজ ক’রে যথারীতি সীলমোহর ক’রে দেয়া হয়েছে। আর কম্পিতহাতে লেফাফায় ঠিকানাটা লিখেছেন মঁসিয় পাঞয়ল :
মিস্টার টম অস্টিন,
বরাবরেষু ফার্স্টমেট,
ডানকান মেলবোর্ন
তারপরেই ধড়মড় করে উঠে প’ড়ে বেরিয়ে গেছেন বাইরে, তখনও বিড়বিড় করে তিনি ব’কে যাচ্ছেন অদ্ভুত-একটা শব্দ : ‘অ্যালান্ড…অ্যালান্ড…আল্যান্ড!’
মঁসিয় পাঞয়লের খ্যাপামির ধরনধারণ অ্যাদ্দিনে সকলেরই বেশভালোভাবে জানা হ’য়ে গেছে। ফলে তাঁর দিকে আর আলাদা নজর না-দিয়েই সবাই ব্যস্ত হ’য়ে পড়েছেন কখন অন্ধকার হয়, কখন দূত রওনা হবে মেলবোর্নের উদ্দেশে। সাবধানের মার নেই ভেবে শুধু-যে ঘোড়ার পায়ে নালগুলোই বদলে দেয়া হয়েছে তা নয়, ক্ষুরগুলো বেঁধে দেয়া হয়েছে কাপড় দিয়ে যাতে ছোটবার সময় খটাখট আওয়াজ না-হয়।
কিন্তু এত-সব সাবধানতা সত্ত্বেও কি আর আশঙ্কাটা কমে? রাতের আঁধারে কোনখানে যে বেন জয়েস (না কি সে আয়ারটন?) তার সাগরেদদের নিয়ে ওৎ পেতে আছে, তা কে জানে। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে ঘোড়াটা যেতে পারলে হয়। আবার বইতে শুরু করেছে ঝোড়োহাওয়া, আর বানভাসি নদীটার জলে প্রখর ঢেউয়ের আওয়াজও উঠছে তার সঙ্গে তাল রেখে। আর তারই সঙ্গে ছন্দমিলিয়ে যেন বুকে ঢিপঢিপ শব্দ বেড়ে যাচ্ছে। আটটার পরেই অন্ধকার লক্ষ করে ঘোড়াটা যখন ছুটে চ’লে গেলো, তখন রুদ্ধশ্বাস উৎকণ্ঠার সঙ্গে সবাই প্রার্থনা করছেন, যাত্রাটা যাতে নির্বিঘ্নে হয়। আর ঠিক এমন সময়েই বুকের ঢিপঢিপ শব্দ আরো বেড়ে গেছে, যখন হাওয়ার শোঁ-শোঁ আর জলের ছলছল ছাপিয়ে ভেসে এসেছে তীক্ষ্ণ একটা শিসের শব্দ। শিসের শব্দই তো? না কি পাখির ডাক?
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স বলেছেন, সন্দেহ নেই, কেউ কাউকে এই তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে যেন সংকেত দিচ্ছে। তাঁর অনুমানটা ভুল নয়, যেন সেটা বোঝাতেই দ্বিতীয় আরেকবার সব শব্দ ছাপিয়ে আবার রাতের অন্ধকার চিরে গেছে সেই শিসের আওয়াজ। আর তাপরেই দূর থেকে ভেসে এসেছে গুলির আওয়াজ—ঠিক যেদিকটায় ঘোড়াটা গেছে, সেদিক থেকে।
তার মানে—নিশ্চয়ই তার কোনো বিপদ হয়েছে!
লর্ড এডওয়ার্ড কী-রকম ক্ষিপ্ত জ্বরাতুর ভঙ্গিতে সেই গুলির শব্দের দিকেই ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন, কোনোরকমে তাঁকে আটকে রেখেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স।
‘এটা তো একটা ফাঁদও হ’তে পারে! ওরা হয়তো মলব এঁটেছে যে গুলির আওয়াজ পেয়ে সবাই সেদিকটাতেই ছুটে যাবেন—আর এই ফাঁকে ওরা ছুটে এসে অরক্ষিত গাড়িটায় মেয়েদের ওপর হামলা চালাবে—’
কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সও সায় দিয়েছেন। ‘এই পাজির পাঝাড়াগুলো হয়তো এ-রকমই একটা ফন্দি করেছে। দিনের আলো ফোটবার আগে কিছুই বোঝা যাবে না। আমাদের বরং এখানে আরো-হুঁশিয়ার হয়েই থাকা উচিত—’
লর্ড এডওয়ার্ডের গায়ে যেন মত্ত হাতির বল। তিনি এ-সব কথা শুনলে তো? কোনোরকমে ধস্তাধস্তি করে তাঁকে আটকে রেখেছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স, আর এমন সময়ে কানে ভেসে এলো কার যেন কাতর আর্তনাদ–কে যেন অন্ধকারের মধ্যে গোঙাচ্ছে :
‘বাঁচাও! বাঁচাও!’
এই গোঙানিটা শোনবার পর মনস্থির করতে আর একফোঁটাও দেরি হয়নি কারু। সেই আর্তনাদের শব্দ শুনেই সেদিকপানে ছুটে গিয়েছেন মেজর, আর তাঁর পেছন-পেছন কাপ্তেন।
ঐ তো ঝোপের মধ্য থেকে কে যেন কারাত-কাত্রাতে প্রায় গড়াগড়ি দিতে-দিতেই বুকে হেঁটে আসছে।
হ্যাঁ, তাঁদের সেই দূত। রক্তে তার সারা শরীরটা ভেসে যাচ্ছে। পিঠে আমূল বিঁধে আছে একটা ছোরা।
অমনি তাকে তাঁরা ধরাধরি ক’রে নিয়ে এসেছেন গাড়ির ভেতর। গলগল ক’রে রক্ত বেরুচ্ছে ক্ষত থেকে, ছুরিটা বাঁটশুদ্ধ বসানো; সে-যে বাঁচবে—এমন মনে হয়নি। কী-রকম নিস্তেজ হ’য়ে পড়ে থেকেছে বেচারি, আর কী-রকম যেন অস্ফুটস্বরে জড়ানো গলায় আর্তনাদ ক’রে বলেছে : ‘চিঠি… চিঠি…বেন জয়েস! তারপরেই সে জ্ঞান হারিয়ে প’ড়ে থেকেছে। লেডি হেলেনা আর মেরি তবু তার শুশ্রূষা ক’রে গেছেন—ক্ষতটায় কোহল দিয়ে পরিষ্কার ক’রে তাতে বেঁধে দেয়া হয়েছে ব্যানডেজ। আর তারই মধ্যে তার পকেট হাতড়ে দেখেছেন কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স। না, টম অস্টিনকে লেখা চিঠিটা তার কাছে নেই।
ভোরের আলো ফুটলে একবার সরেজমিন তদন্তে বেরিয়েছেন মেজর ম্যাকন্যাব্স। তাঁর মুখে গভীর কালোছায়া, কপালে চিন্তার ভাঁজ। আর ঝোপের পাশে তিনি আবিষ্কার করেছেন দস্যুদের দুজনের মৃতদেহ—কাপ্তেন ম্যাঙ্গসের মাল্লা যে ছোরার ঘা খাবার আগে যুঝেছিলো প্রাণপণে, এ তারই প্রমাণ। দস্যুদের দুজনের মধ্যে একজন চেনা—সেই মিস্ত্রি, আয়ারটন যাকে গিয়ে নিয়ে এসেছিলো সে-বার।
আরো-খানিকক্ষণ পরে মাল্লাটির জ্ঞান ফিরে এলো, কিন্তু অবিশ্রাম রক্তক্ষরণে এখনও কী-রকম যেন নেতিয়ে আছে সে। ভাঙা-ভাঙা দু-চার কথায় সে যা বললে, তার সারমর্ম দাঁড়ালো এইরকম : সে যখন অন্ধকারে ঘোড়া ছুটিয়ে খানিকটা দূর গেছে, তখনই হঠাৎ তার দু-পাশে গাছ থেকে লাফিয়ে পড়ে দস্যুরা। সে এলোপাথারি গুলি ক’রে শুধু দুজনকেই ঘায়েল করতে পেরেছিলো, কিন্তু কে যেন পেছন থেকে তার পিঠে সজোরে ছুরি বসিয়ে দেয়। অমন ভয়ংকর আঘাত খেয়ে আর সে তাদের কোনো বাধা দিতে পারেনি। দস্যুরা নিশ্চয়ই ভেবেছিলো যে সে বুঝি খতম হ’য়ে গেছে। তার পকেট হাতড়ে তারা শুধু চিঠিটা বার ক’রে নেয়।
‘দেখি, দেখি, চিঠিটা,’ বলেছিলো বেন জয়েস—অথবা সে কি আয়ারটন? ‘এবার আমাদের আর পায় কে? আমরাই ঐ ডানকান জাহাজের মালিক হ’য়ে বসবো। আমি এই ঘোড়ায় চেপেই ডানকানে চ’লে যাচ্ছি—তোমরা বরং চ’লে যাও টুফোল্ড উপসাগরের মুখে, কেম্পল পায়ার ব্রিজের কাছে। ডানকান একবার আমাদের দখলে এলেই জগৎ জানতে পারবে জলদস্যু কাকে বলে—ওয়ালটার রলে আর ফ্রান্সিস ড্রেকও আমাদের কাছে হার মেনে যাবে!’
বলেই, সে আর একটুও দেরি করেনি, ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়েছিলো অন্ধকারে।
এই আশঙ্কাটাই করেছিলেন সবাই। ফলে, পুরো ব্যাটারটা যে অপ্রত্যাশিত, সেটা বলা যায় না। কিন্তু তবু বাস্তব তার আঘাতে কেমন যেন ঘায়েলই ক’রে ফেলেছিলো লর্ড এডওয়ার্ডকে, ব’লে উঠেছিলেন : ‘ডানকান কি না শেষকালে জলদস্যুদের দখলে চ’লে যাবো! –’
হঠাৎ সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন মঁসিয় পাঞয়ল। ‘ককখনো নয়। বেন জয়েসের দলবল টুফোল্ডের মুখে পৌঁছুবার আগেই আমরা সেখানে পৌঁছে যাবে।’
‘কেমন ক’রে?’
‘কেন? রাস্তাটার কথাটা তো বেন জয়েসই ফাঁস ক’রে দিয়ে গেছে। ঐ কেম্পল পায়ার ব্রিজ দিয়ে। ব্রিজটা তো এখান থেকে কয়েক মাইল মাত্র দূরে—এক্ষুনি গিয়ে দেখে আসছি নদীতে বান ডাকলেও ব্রিজটা এখনও অটুট আছে কি না।’
এবং যেমন কথা, তেমনি কাজ। কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্সকে নিয়ে তক্ষুনি অন্ধকারে বেরিয়ে পড়েছেন মঁসিয় পাঞয়ল।
ফিরে যখন এসেছেন, তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে।
এবং ফিরে এসেছেন হতাশ ও বিধ্বস্ত। বানের জল ফেনিয়ে চর্কি দিয়ে ছুটেছে—কিন্তু ব্রিজটার কোনো চিহ্নই নেই কোথাও। দস্যুরা নিজেরা নদী পেরিয়ে যাবার পর সেতুটায় আগুন ধরিয়ে গেছে—আর ধ্বংসের কাজটা সাঙ্গ করেছে দুরন্ত ক্ষিপ্ত বানের জল ও!
এবার তাহ’লে বুঝি বোম্বেটেদের হাত থেকে ডানকানকে আর বাঁচানো গেলো না।
কাপ্তেন গ্রান্টের হদিশ করার চাইতেও এখন সবচেয়ে জরুরি যে-ক’রেই হোক, এখান থেকে সবচেয়ে কাছের কোনো লোকালয়ে গিয়ে ডানকানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা। নিজেদের অসহায় অবস্থায় সবচেয়ে-বেশি ভেঙে পড়েছেন লর্ড গ্লেনারভনই। তাঁর এত সাধের ডানকান কি না শেষটায় জলদস্যুদের কবলে গিয়ে পড়বে!
মেজর ম্যাকন্যাব্স আর কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স যতই তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করুন না কেন, তাঁরাও এই বিষম সঙিন অবস্থায় প্রচণ্ড হতাশ হ’য়ে পড়েছিলেন। অসহায় আক্রোশে নিজেদের হাত কামড়ানো ছাড়া আর-কিছুই যেন তাঁদের করার নেই।
শেষচেষ্টা অবশ্য একটা ক’রে দেখতেই হয়। পরদিন ভোরবেলাতেই কাপ্তেন ম্যাঙ্গল্স তাঁর লোকজন নিয়ে একটা ভেলা তৈরি করার কাজে লেগে গেলেন। কাঠের গুঁড়ি আর গাছের বাকল আর দড়ি দিয়ে বেঁধে কোনোরকমে যদি একটা ভেলা তৈরি ক’রে ফেলা যায়, তবে এই বানের জলে ভেসে গিয়ে তাঁরা কোনো লোকালয়ে পৌঁছে যাবেন।
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে প্রথম ভেলাটা বোধকরি পলকাই হয়েছিলো খুব—মোটেই পোক্ত ছিলো না। জলে নামতে-না-নামতেই সেটা ঐ তীব্র স্রোতের আবর্তে প’ড়ে ভেঙে গেলো।
শেষকালে আরো-মজবুত ক’রে আরো-একটা ভেলা বানানো হ’লো—আর একুশে জানুয়ারি স্রোতের তোড় যখন খানিকটা কমেছে, লর্ড এডওয়ার্ড তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে তাতেই উঠে বসলেন। গাড়িটা পড়ে রইলো ঐ বনের পাশে, কাদার মধ্যে। সঙ্গে নেয়া হলো সামান্য যা খাবারদাবার ছিলো, আর অস্ত্রশস্ত্র।
কিন্তু স্রোতের মুখে যেন খড়কুটোর মতোই ভেসে গেলো তাঁদের ভেলা। যতই মজনুত ক’রে বানাবার চেষ্টা করুন না কেন, মাঝনদীতে সেটা বুঝি এবারও ভেঙে যায়। গাছের গুঁড়িগুলো যেন দড়ির বাঁধন খুলে আলাদা হ’য়ে যাবে। কোনোরকমে যখন ওপারে পৌঁছুনো গেলো, তখন তাঁরা ধুঁকতে ধুঁকতে কোনোমতে শুধু নিজেদেরই বাঁচাতে পেরেছেন। খাবারদাবার খুব-একটা বাঁচানা গেলো না, অস্ত্রশস্ত্রও না—শুধু মেজর ম্যাকন্যাব্সের রাইফেলটা তিনি কিছুতেই হাতছাড়া করেননি—সেটা যেন ছিলো তাঁর নিজের শরীরটারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোনো দুর্ঘটনা ঘটবার আগেই তাঁরা যে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে তীরে নেমে পড়তে পেরেছেন, সেটাই যেন অনেকখানি।
তারপর যেমন ক’রে যে তাঁরা শ্রান্তক্লান্ত অবসন্ন বিধ্বস্ত দেহে টুফোল্ড উপসাগরে মুখ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে ডেলিগেট নামে একটা ছোট্ট অজপাড়াগাঁয় এসে পৌঁছেছেন, সে-কথা তাঁরা যেন নিজেই জানেন না।
সেখানে সরাইতে যখন সবাই খেয়েদেয়ে কোনোরকমে বিধ্বস্ত দেহে একটু প্রাণের সাড় ফিরে পেয়েছে, লর্ড এডওয়ার্ড সরাইখানার মালিককে জিগেস করেছেন কোনো ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যাবে কি না।
‘এমনিতে কোনো গাড়ি পাবেন না। তবে ডাকের গাড়ি ছাড়বে আজ—সেটায় যেতে পারেন,’ সরাইগুলো বলেছে।
সেটাতেই যাবার ব্যবস্থা হ’লো। কিন্তু দু-দিন দু-রাত যখন একটানা চ’লে ডাকের গাড়ি সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সমান্তরে সমুদ্রের কাছে পৌঁছুলো, তখন—
কোথায় ডানকান
শুধু ক্ষিপ্ত সমুদ্র গর্জাচ্ছে সেখানে, দিগন্ত অব্দি সব ফাঁকা। কোথাও কোনো জেলেডিঙিরও দেখা নেই, কোনো জাহাজ তো দূরের কথা।
তবে কি টম অস্টিন সোজা টুফোল্ডের মুখে ইডেনেই চ’লে গিয়েছে?
ডাকের গাড়ি তক্ষুনি ছুটেছে ইডেনে। কিন্তু সেখানেও ডানকানের চিহ্নমাত্রও সেই।
একটা সরাইতে উঠেই লর্ড গ্লেনারভন প্রথমেই গেছেন ডাক-তারের আপিশে। মেলবোর্নে টেলিগ্রাম করা হলো—ডানকান কোথায় গেছে, এক্ষুনি তার ক’রে জানাতে বলেছেন তিনি বন্দর কর্তৃপক্ষকে।
তারপর সময় যে আর কাটাতে চায়নি। শুধু অস্থির হ’য়ে খ্যাপা বাঘের মতো ছটফট করেছেন লর্ড এডওয়ার্ড।
টেলিগ্রামের উত্তর এলো দুপুর গড়িয়ে যাবার পর, বেলা দুটোয়।
.
লর্ড এডওয়ার্ড গ্লেনারভন
ইডেন
টুফোল্ড উপসাগর
১৮ জানুয়ারি ডানকান মেলবোর্ন থেকে রওনা হয়েছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। একটু অপ্রত্যাশিতভাবেই হঠাৎ নোঙর তুলে বারদরিয়ায় চ’লে গিয়েছে।
উটের পিঠ যদি আরো মজবুত হ’তো, তবু বোধহয় এই শেষখড়টাকে আর বইতে পারতো না—ঘাড়মুখ গুঁজে ছেড়ে প’ড়ে যেতো। এবার সত্যি-সত্যি আক্ষরিকভাবেই মাথায় হাত দিয়ে বসলেন লর্ড গ্লেনারভন। আশঙ্কাটা তাহ’লে সত্যি হ’লো শেষপর্যন্ত। ডানকান তবে বেন জয়েসের হতে প’ড়ে শেষটায় বোম্বেটে জাহাজ হ’য়ে গিয়েছে।
তাহ’লে এখন কাপ্তেন গ্রান্টের খোঁজে তাঁরা যাবেন কী করে? মেরি আর রবার্টকে তবে এখন কী বলবেন লর্ড গ্লেনারভন?