২. নমস্কার সনাতনবাবু

নমস্কার সনাতনবাবু।

আরে, আসুন, আসুন। নমস্কার, নমস্কার।

একটু বিরক্ত করতে এলাম।

বিরক্ত কীসের? আপনারা আইনের রক্ষক, আপনাদের একটু সাহায্য করব এ তো সৌভাগ্য।

শবর সনাতনবাবুর মুখোমুখি চেয়ারে বসল।

একটু চা বা কফি?

না, ধন্যবাদ।

ঠান্ডা কিছু খাবেন?

না, না, ব্যস্ত হবেন না, আই অ্যাম অলরাইট।

তারপর বলুন।

ভজনবাবুর সঙ্গে আপনার কেমন পরিচয়?

খুব একটা নয় মশাই। যৎসামান্য। বাড়ির উলটোদিকে একটা গ্যারেজ থাকায় খুবই ডিস্টার্বড হতে হয়। দিনরাত দুমদাম শব্দ হচ্ছে, কলকবজ চলছে, মিস্ত্রিদের হল্লাও আছে।

আপনি কি গ্যারেজটা তুলে দেওয়ার জন্য একটা মামলা করেছিলেন?

ঠিক মামলা নয়। আমার স্ত্রী হার্টের রুগি, জোরালো শব্দ তার পক্ষে ক্ষতিকারক। সেটা জানিয়ে পুলিশে একটা রিপোর্ট করি। ভজনবাবুকে একটা উকিলের চিঠিও দিই।

তার আগে কি ভজনবাবুর সঙ্গে আপনার কথা হয়েছিল?

হয়েছিল।

কীরকম কথা?

প্ৰথমে তো লোকটাকে ভালমানুষ বলেই মনে হয়েছিল। আমি ওঁকে মাঝে মাঝে বলতাম। লোকালিটির মধ্যে গ্যারেজ থাকায় পাড়ার লোকের অসুবিধে হচ্ছে, উনি যেন হাইওয়ের দিকে গ্যারেজটা সরিয়ে নেন।

উনি কী বলতেন?

উচ্চবাচ্য করতেন না। চুপচাপ শুনতেন।

তারপরই ঝগড়া লাগে?

ঝগড়া ঠিক ওর সঙ্গে হয়নি।

তবে কার সঙ্গে?

ভজনবাবুর একজন কর্মচারী আছে, তার নাম রাখাল।

খুব লম্বাচওড়া?

হ্যাঁ সে-ই। ও হচ্ছে ঘাটপুকুরের মস্তান।

ঝগড়া হল কেন?

একদিন দুপুরে ওরা একটা গাড়ির বডি তৈরি করছিল। সে সাংঘাতিক দুমদাম শব্দ। আমার স্ত্রী দুপুরে ঘুমোতে পারেননি, শব্দে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমি অফিস থেকে ফিরে ঘটনা শুনে গ্যারেজে যাই। তখন রাখালের সঙ্গে কথা হয়।

কী কথা হল?

আমি বললাম, এরকম চলবে না। রাখালও তেড়া তেড়া জবাব দিচ্ছিল। তারপর ঝগড়ার মতো হল।

তখন কি ভজনবাবু গ্যারেজে ছিলেন?

না।

ঝগড়াটা কতদূর গড়িয়েছিল?

আমরা ভদ্রলোক, ছোটলোকদের সঙ্গে কি ঝগড়ায় পারি? রাখাল আমাকে দেখে নেবে। বলে শাসিয়েছিল।

আপনি কী করলেন?

পাড়ার নাগরিক কমিটিকে জানালাম। তারা পরদিন গিয়ে ভজনবাবুকে ধরল।

ফলাফল কী হয়েছিল?

ভজনবাবু রাখালকে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে বললেন। রাখাল ক্ষমাও চাইল। কিন্তু গ্যারেজের শব্দটার যে সমস্যা ছিল তার তো সমাধান হল না। ভজনবাবু বললেন, আপনারা একটা টাইম বেঁধে দিন, আমরা সেই সময়েই গাড়ির বডির কাজ করব, অন্য সময়ে করব। ब्न्म

তা হলে তিনি কো-অপারেট করতেই চেয়েছিলেন।

তা বলতে পারেন। তবে ওটা আই ওয়াশ। গ্যারেজে শব্দ তো সারাদিনই হত। বডির কােজই তো শুধু নয়।

আপনার একটি মেয়ে, তাই না?

হ্যাঁ। তার বিয়ে হয়ে গেছে।

আপনার জামাই কন্ট্রাক্টর তো!

সবই তো জানেন তা হলে।

জানি। জানাটাই আমাদের কাজ।

সনাতনবাবু, আপ্যায়িতের হাসি হেসে বললেন, আপনারা জানবেন না তো কে জানবো?

আপনার জামাই বিজয়বাবু চাঁপাডালির মোড়ের কাছে থাকে।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আপনি চান। আপনার মেয়ে-জামাই আপনার কাছাকাছি কোথাও এসে থাকুক, যাতে বিপদে আপদে তারা আপনাদের দেখাশোনা করতে পারে।

কী আশ্চর্য! হ্যাঁ, তাই। আপনি সত্যিই

দাঁড়ান, কথাটা শেষ করার পর আপনার হয়তো ততটা ভাল লাগবে না।

আরে বলুন না। ভাল না লাগার কী আছে?

আপনি মেয়ে-জামাইয়ের জন্য এ পাড়ায় একটু বড় একটা প্লট খুঁজছেন, তাই তো!

হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই।

আপনার জামাই ভজনবাবুর গ্যারেজের জমিটাই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছিল। কিন্তু ভজনবাবু জমি বিক্রি করতে রাজি হননি।

আমার জামাই ওকে দুনো টাকা অফার করেছে। তাও রাজি হয়নি। এতে কোনও অপরাধ হয়নি তো!

আরে না। অপরাধ কীসের? তবে ভজনবাবুর গ্যারেজটা তুলে দিতে পারলে আপনার অনেক সুবিধে।

সনাতন চুপ।

এবার ঘটনার দিনের কথা।

বলুন না। কী বলতে হবে। পুলিশকে একদফা বলেছি।

সেদিন রাতে রিঙ্কু খুন হয়।

হ্যাঁ মশাই। কী নৃশংস ব্যাপার। ফুটফুটে মেয়েটা পাড়া দাপিয়ে বেড়াত। তাকে কেউ ওভাবে খুন করে? লোকটার ফাঁসি নয় মশাই, শূলে চড়ানো উচিত ওকে।

সে তো বুঝলাম। কিন্তু শূলে চড়াতে গেলে কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণের দরকার।

সোজা কেস মশাই। আমরা সবাই জানি।

কী জানেন?

খুন। আর রেপ ওই ভজনই করেছে।

কীভাবে জানলেন?

রিঙ্কুর তো যাতায়াত ছিলই ওর কাছে। সেদিন সন্ধে থেকে আটকে রেখেছিল ঘরে। তারপর রেপ করার পর মেরে ফেলে।

কী করে বুঝলেন? কোনও চিৎকার শুনেছেন?

চিৎকার! না, সেরকম কিছু শুনিনি।

এ জায়গাটা খুব নির্জন। রাতে আরও নির্জন। সামান্য শব্দ হলেও শোনার কথা।

তা ঠিক। তবে আমার ঘরে অনেক রাত অবধি টিভি চলে। আমার শাশুড়ি ইনসোমানিয়ার রুগি। তিনি সন্ধেরাত্তির থেকেই টিভি ছেড়ে বসে থাকেন। টিভির শব্দে

বুঝেছি। রিঙ্কুকে আপনি সেদিন গ্যারেজে ঢুকতে দেখেছেন?

না, দেখিনি। তবে সাইকেলটা দেখেছি।

সেটা জানি। রিঙ্কু কি খুব ঘনঘন গ্যারেজে আসত?

খুব ঘনঘন। রোজই আসত।

আপনার কি ধারণা মেয়েটা ভজনবাবুর সঙ্গে ইনভলভূড ছিল?

মেয়েটা একটু ফস্টিনস্টি করার মতো ছিল। আর ভজনবাবু তো অতি বাজে লোক। শুনেছি। ওর চরিত্রদোষ আছে বলে বউয়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে।

ভজনবাবুর সঙ্গে রিঙ্কুর ঘনিষ্ঠতা কীরকম ছিল জানেন?

গাড়ি চালাতে শেখাত, ঢলাঢ়লিও করত, গ্যারেজে বসে আডডা মারত। তাই নিয়ে অশান্তিও হয়েছে।

কীরকম অশান্তি?

পাড়ার ছেলেরা ভজনবাবুর ওপর কয়েকবারই চড়াও হয়েছে।

কেন?

রিঙ্কুর সঙ্গে ওর। খারাপ সম্পর্ক বলে।

রিঙ্কুর বাবা কি কখনও ভজনবাবুকে কিছু বলেছে?

শচীনন্দন? ও কি একটা মানুষ? সারাদিন তো চিংড়ির ভেড়িতেই পড়ে থাকত। সংসার ভেসে গেলেও খেয়াল করত না। একটু সাবধান হলে মেয়েটা বাঁচত।

রিঙ্কুর সাইকেলটা খুনের পরদিনও গ্যারেজে ছিল, তাই না?

হ্যাঁ।

আপনি কি আগের দিন জানতে পেরেছিলেন যে রিঙ্কুকে পাওয়া যাচ্ছে না?

না। আমার কানে আসেনি।

পাড়ার ছেলেরা যখন জানতই যে রিঙ্কু প্রায়ই ভজনবাবুর গ্যারেজে আসে তখন তারা গ্যারেজে রিঙ্কুর খোঁজ করল না কেন বলুন তো!

জানি না মশাই। ওখানেই তো আগে খোঁজা উচিত ছিল।

রিঙ্কু কি কখনও আপনার বাড়িতে আসত?

না। এ বাড়িতে তার সমবয়সি তো কেউ নেই, কেন আসবে?

ওদের পরিবারকে আপনি কতটা চেনেন?

ভালই চিনি। আমরা কয়েকজন প্রথম এ জায়গায় বাড়িঘর পত্তন করি। শচীনন্দন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তবু ভালই আলাপ আছে।

যাতায়াত আছে?

কালেভদ্রে। যে যার ধান্ধায় ব্যস্ত, সময়টা কোথায়? শচী তো থাকেও না। এখানে। মাছের ভেড়িতে পড়ে থাকে।

সেই রাতে অস্বাভাবিক কোনও চিৎকার বা শব্দ শোনেননি তো!

না মশাই, মনে তো পড়ছে না।

ভাল করে ভেবে দেখুন তো, রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনও সময়ে খুব কুকুর ডাকছিল কি?

সনাতন মল্লিক ক্ৰ কুঁচকে একটু ভেবে সোৎসাহে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এগারোটার পরে কিছু কুকুর খুব ডাকছিল বটে। তবে তারা কিন্তু রোজই ডাকে। সেদিন হয়তো একটু বেশি ডাকছিল।

আর কোনও অস্বাভাবিক শব্দ?

না, মনে পড়ছে না।

রিঙ্কুর কোনও বিশেষ ছেলেবন্ধু ছিল কি?

সে আমি কী করে জানিব? পাড়ার ছেলেছোঁকরাদের জিজ্ঞেস করুন। ওরা হয়তো বলতে

পারবে।

আপনার কি মনে হয় ভজনবাবু খুন করতে পারেন?

না পারার কী আছে? ও লোক সব পারে।

আপনার স্ত্রীর অসুখটা কি জটিল?

হার্ট প্রবলেম। অ্যানজাইনা।

আপনার শাশুড়ি তো সারা রাত জেগে থাকেন।

হ্যাঁ।

তিনি মধ্যরাতে কোনও শব্দ শুনেছেন কি?

না। পুলিশ তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সেই ভয়ে তিনি মধ্যমগ্রামে তীর বড়মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আছেন।

আপনার স্ত্রী বাড়িতে আছেন?

আছেন।

তীকে ডাকুন।

তাকেও জেরা করা হয়েছে।

জানি। আমার দু-একটা প্রশ্ন মাত্র।

ডাকছি।

সনাতনবাবু ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে আনলেন। মধ্যবয়স্কা সাধারণ চেহারার ভদ্রমহিলা। মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে।

মাপ করবেন, আপনি অসুস্থ, তবু বিরক্ত করছি।

অসুস্থতা তেমন কিছু নয়। প্রশ্ন করতে পারেন।

ভজনবাবু কেমন লোক?

ভাল নয়। গ্যারেজটার জন্য আমাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। ওঁকে বলছি বাড়ি বিক্রি করে অন্য জায়গায় বাড়ি করতে।

গ্যারেজের শব্দে আপনার অসুবিধে হত, সে তো বুঝলাম। ভজনবাবুকে কতটা চিনতেন?

চিনতাম একটু-আধটু। দেখতাম প্রায়ই।

দেখে কী মনে হত?

মনে আবার কী হবে। চেহারাটা ভাল। একটা মারুতি গাড়ি করে আসা-যাওয়া করত। ইদানীং তো থাকতই এখানে।

কখনও আলাপ হয়নি?

তা হবে না কেন?

কী সূত্রে আলাপ?

আমরা বছর চারেক হল এ বাড়ি করেছি। ভজনবাবু তার বছরখানেক আগে এখানে গ্যারেজ করেন। বাড়ি করার মেটেরিয়াল আমরা ওঁর গ্যারেজেই রাখতাম। তখন ওঁর ব্যাবসা বড় হয়নি।

ওর ক্লায়েন্টরা কীরকম?

ইদানীং তো দেখতাম বেশ বড়লোক মাড়োয়ারিরা আসছে। শুনেছি। ওঁর খদেররা। বেশিরভাগই বড়লোক।

ঘটনার দিনের কথা মনে আছে?

থাকবে না কেন? তবে আমরা কিছু দেখিওনি, শুনিওনি।

রিঙ্কুকে যে সন্ধেবেলা থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ খবর কি জানতেন?

না। আমাদের কেউ বলেনি। রিঙ্কুরা একটু তফাতে থাকে। মাঠের ওপাশে। পাড়াটা আলাদা।

রিকুকে তো চিনতেন!

হ্যাঁ। ছোট থেকে দেখছি। ওর মা যখন এখানে থাকত তখন কয়েকবার গেছি। ওদের বাড়িতে। ওর মা-ও আসত।

মা কেমন মহিলা?

খারাপ তো তেমন কিছু দেখিনি। দেখতে সুন্দর ছিল, আর উগ্ৰ সাজগোজ করত।

আর কিছু?

না। আর কী বলুন!

ভজনবাবু সম্পর্কে আর কিছু বলতে পারেন?

না।

রিঙ্কু মেয়েটা কেমন ছিল?

ভাল নয়। বড্ড উড়নচণ্ডী।

সে কি খুব ঘনঘন ভজনবাবুর কাছে আসত?

হ্যাঁ। রোজ। দুজনের তো খুব ভাব ছিল দেখেছি।

কীরকম ভাব?

মাখামাখি ছিল বেশ।

কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন?

দু’জনে গাড়ির সিটে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে গাড়ি চালাত দেখেছি।

রিঙ্কুর অনেক ছেলেবন্ধু ছিল কি?

ও বাবা, সে অনেক ছিল।

তারা ভজনবাবুকে হিংসে করত না?

করত বোধহয়। গ্যারেজে তো কতবার বোমা পড়ল, হামলা হল। কেন হাঙ্গামা হত কে জানে বাবা!

সেই হামলার লিডারশিপ কে দিত বলতে পারেন?

না। হাঙ্গামা হলে আমরা জানালা দরজা বন্ধ করে দিই। গ্যারেজটার জন্য আমাদের খুব অশান্তি হচ্ছে।

গ্যারেজটা উঠে গেলে কি আপনাদের সুবিধে হয়?

হবে না? খুব হয়। দিন না উঠিয়ে।

ভজনবাবু কনভিকটেড হলে গ্যারেজ উঠেও যেতে পারে।

তাই হোক বাবা। ক’দিন গ্যারেজটা বন্ধ বলে খুব শান্তিতে আছি।

শচীনন্দনবাবু, আপনার শোকটা যে কতখানি তা বুঝতে পারছি। এ সময়ে আপনাকে ডিস্টার্ব করা হয়তো উচিত নয়। আপনার অস্বস্তি হলে আমি আপনাকে প্রশ্ন করবও না।

শচীনন্দনের বয়স মাত্ৰ বিয়াল্লিশ হলেও শরীরে অতিরিক্ত চর্বির জন্য বয়স্ক বলে মনে হয়। মাথায় টাকা। প্রচুর কেঁদেছেন বলে চোখ দুটো এখনও রক্তিম। মুখে গভীর শোকের ছাপ। দৃষ্টিতে শূন্যতা। মাথা নেড়ে শচীনন্দন বলল, না, কোনও অসুবিধে হবে না। কী জানতে চান বলুন।

আপনার ডিভোর্স কতদিন হয়েছে?

বছর সাত-আট।

ডিভোর্সের কারণটা কী?

আমার মেয়ের মৃত্যুর সঙ্গে এ ব্যাপারের কী সম্পর্ক?

হয়তো সম্পর্ক নেই। ইচ্ছে না হলে বলার দরকার নেই।

শচীনন্দন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, টু কাট এ লং স্টোরি শর্ট, আমার স্ত্রী শ্যামলী আর একজন লোকের প্রেমে পড়েছিল।

লোকটা কে?

শুনেছি। ওর পূর্বপ্রণয়ী। তার নাম সুজিত।

তারা এখন কোথায় থাকেন?

কানপুর।

রিঙ্কুর খবর তাঁকে দেওয়া হয়েছে কি?

হ্যাঁ। শ্যামলী তো তিন-চার দিন হল চলেও এসেছে। এই বাড়িতেই আছে।

ওঁর হাজব্যান্ডও এসেছেন কি?

না। ওর এ পক্ষের দুটো মেয়েকে নিয়ে এসেছে।

ডিভোর্সের পর উনি রিঙ্কুর কাস্টডি চাননি?

না। বোধহয় সুজিতের ইচ্ছে ছিল না।

শুনেছি আপনি রিঙ্কুর দেখাশোনা করার সময় পেতেন না।

ঠিকই শুনেছেন। আমার ব্যাবসাটা বড়। মাছের ব্যাবসা। একা মানুষ, সামাল দিতে হিমশিম খাই। তবে রিঙ্কুর দেখাশোনা আমার মা আর বাবাই করেন। ঝি-চাকরের অভাব নেই।

শ্যামলীদেবীর সঙ্গে কি আপনার বাবা-মা’র বনিবনা ছিল না?

না। আজকালকার মেয়েরা শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মা-বাবাকে

ডিভোর্সের কারণ সেটাই নয় তো?

সেটা অপ্রধান কারণ। আমি শ্যামলীর জন্য আর একটা বাড়ি করে দিচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাবেন বাড়িটা খানিকটা হয়ে পড়ে আছে। বলেছিলাম, কাছাকাছি আলাদা থাকে, তা হলে খিটিমিটিও লাগবে না, সম্পর্কটাও ভাল থাকবে ও রাজি ছিল। কাজেই ডিভোর্সের কারণ আমার মা-বাবা হতে পারে না।

বুঝলাম। রিঙ্কু সম্পর্কে আপনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন?

মেয়েটা চঞ্চল ছিল। ডাকাবুকোও।

অবাধ্য ছিল কি?

একটু ছিল।

আপনাকে কেমন ভালবাসত?

খুব। বলেই শচীনন্দন দুহাতে মুখ ঢেকে রইল। কান্না চাপার চেষ্টা করতে লাগল।

শবর চুপ করে বসে রইল।

মিনিট কয়েক পরে ধাতস্থ হয়ে শচীনন্দন বলল, ওর সম্পর্কে পাড়ায় দুর্নাম শুনবেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, রিঙ্কু খারাপ ছিল না। আদর পেয়ে পেয়ে একটু স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছিল মাত্র।

এরকম হতেই পারে। আপনি কি জানেন ভজনবাবুর সঙ্গে ওর কীরকম রিলেশন ছিল?

কী করে বলব? ভজন মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসত। একটু গভীর আর চুপচাপ মানুষ। আমার ওকে খারাপ লাগত না।

রিঙ্কু কি কখনও বাড়ির কাউকে জানিয়েছিল যে ও ভজনবাবুকে বিয়ে করতে চায়?

না, সেরকমভাবে কিছু জানায়নি। তবে–

তবে কী?

আমার মায়ের কাছে ও প্রায়ই ভজনবাবুর গল্প করত।

কীরকম গল্প?

ভজনকে যে ও খুব পছন্দ করে সেই কথাই বলত।

পছন্দটা হৃদয় পৰ্যন্ত পৌঁছেছিল কি না জানেন?

শচীনন্দন একটু থিতামত খেয়ে বলল, আমি মাকে ডাকছি। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলুন।

শচীনন্দন গিয়ে তাঁর মাকে ডেকে আনলেন। মায়ের সঙ্গে ছেলের মুখশ্ৰীর অদ্ভুত মিল। মা অবশ্য রোগা মানুষ, বয়স মধ্য ষাট। মুখে গভীর শোক থিম ধরে আছে।

মাসিমা কিছু মনে করবেন না।

না বাবা, বিলো।

ভজনবাবুর সঙ্গে রিঙ্কুর সম্পর্ক কেমন ছিল?

কী করে বলব? খারাপ কিছু তো মনে হয়নি।

ভজনবাবুকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?

তাকেও খারাপ লাগেনি। মিশুকে ছিল না। এই যা।

রিকু কি তাকে ভালবাসত বলে মনে হয়? মানে রিঙ্কুর কথায় তেমন কিছু ধরা যেত কি?

শচীনন্দনের মা মাথা নেড়ে বললেন, বলতে পারব না বাবা। আজকালকার মেয়েদের কি অত সহজে বোঝা যায়? তা ছাড়া রিঙ্কুর বয়সটাই বা কী বলো! বুদ্ধিাশুদ্ধি তো ছিল না।

রিঙ্কু কি বোকা ছিল?

তাও নয়। লেখাপড়ায় বেশ মাথা, কথাবার্তায় চৌখস, আবার আগুপিছু না ভেবে হুটহাট এক-একটা কাজ করে বসত।

কিছু মনে করবেন না, ভজনবাবুছাড়া আর কোনও ছেলের প্রতি ওর সফটনেস ছিল কি?

ওসব জানি না বাবা। তবে ছেলেছোঁকরাদের সঙ্গে মিশত। খুব।

শচীনন্দন বলল, এসব জেনে আর কী হবে? খুনি তো ধরাই পড়ে গেছে।

সেটা ঠিক। তবে আমাদের কেস সাজাতে হলে সবরকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে নিতে হবে। কোনওখানে ফাঁক থাকলে সেই রন্ধ দিয়ে দোষী পার পেয়ে যায়।

পার পেয়ে যাবে কোথায়? পুলিশ ছাড়লেও এ পাড়ার লোক ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।

মৃদু হেসে শবর বলল, হ্যাঁ, জনগণের আদালতে তো সেরকমই হয়। শচীনন্দনবাবু, ভজনবাবুর গ্যারেজে বারিকয়েক হামলা হয়েছে। কেন জানেন?

চাঁদার জন্য। ব্যাবসা করলে বেকার ভাতা না দিয়ে রেহাই নেই। সেটা নিয়েই গণ্ডগোল। ও তো মারও খেয়েছে।

কে মেরেছিল?

হাবু আর জগুর দল।

আর কারও সঙ্গে ভজনবাবুর শক্ৰতা ছিল কি?

গ্যারেজটার জন্য পাড়ার লোকেদের অসুবিধে হচ্ছিল। আরও কী কী সব যেন, অত ডিটেলসে জানি না। তবে অশান্তি ছিলই।

ভজনবাবুকি একটু মারকুট্টা একরোখা লোক?

তা বোধহয় একটু আছে।

ব্যক্তিগতভাবে আপনি কি মনে করেন যে ভজনবাবুই আপনার মেয়েকে ওরকম নৃশংসভাবে মেরেছে?

শচীনন্দন অনেকক্ষণ ভাবলা। খুব চিন্তিত। তারপর মৃদু গলায় বলল, আর কে মারবে?

সম্ভাবনার কথা বলছি।

আপনারা কি আর কাউকে সন্দেহ করছেন?

আরে না।

আমার মেয়েকে মেরে কার কী লাভ বলুন! রিঙ্কু হয়তো দুষ্ট একটু ছিল, কিন্তু এত বড় শাস্তি ওর হল কেন? মেয়েটা আমার–

শচীনন্দন হঠাৎ কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

মা এসে ছেলেকে দুহাতে ধরে বলল, ওকে এবার রেহাই দাও বাবা। গত আটদিন ধরে ওর যে কী অবস্থা।

ঠিক আছে মাসিমা।

 

আপনি কি তদন্তের ব্যাপারে কথা বলবেন?

শ্যামলী নামক মহিলাটির মুখে শোক ও রাগের মাখামাখি লক্ষ করল শবর। রাগটাই বেশি। বেশ সুন্দর ঢলঢলে মুখশ্ৰীতে একটু কাঠিন্যও আছে। গভীরভাবে শবরের দিকে চেয়ে বলল, আপনাদের উচিত রিঙ্কুর বাবাকেও অ্যারেস্ট করা।

কে?

কেন সেটা আবার জিজ্ঞেস করছেন? ব্যাবসা-ব্যাবসা করে স্বার্থপর লোকটা মেয়েটার দিকে একটু নজরও রাখল না! ও যদি মানুষ হত তা হলে মেয়েটার এরকম পরিণতি হত বলে ভাবেন?

আপনি একটু শান্ত হন।

শান্ত হব? কী ভেবেছেন আপনারা? খুনির ফাঁসি হোক, একশোবার হোক, কিন্তু যার অবহেলার ফলে আমার ফুলের মতো মেয়েটা মরল সে কেন রেহাই পাবে?

ঠিক কথা। সে প্রশ্ন আপনাকে আমারও করতে ইচ্ছে করছে।

তার মানে?

আপনি যখন শচীনন্দনবাবুকে ছেড়ে চলে যান। তখন রিঙ্কু মাইনর। আপনি ইচ্ছে করলেই তো মেয়েকে নিয়ে যেতে পারতেন। নেননি কেন?

নিইনি বলেই মেয়েটাকে অবহেলা করা হবে? শুধু আমারই তো মেয়ে নয়, ওরও তো!

এটা আমার প্রশ্নের জবাব হল না। আমি জানতে চাই, আপনি মেয়েকে নেননি কেন?

মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে শ্যামলী বলল, আমার অসুবিধে ছিল।

কীরকম অসুবিধে?

এ প্রশ্নের জবাব কি দিতেই হবে?

না দিলেও কিছু করার নেই। ইচ্ছে না হলে বলবেন না।

আমার সেকেন্ড হাজব্যান্ড রাজি ছিল না।

আপনি কানপুরে থাকেন?

হ্যাঁ।

অত দূর থেকে মেয়ের খবর কীভাবে নিতেন?

চিঠি লিখে।

শচীনন্দনবাবুকে চিঠি লিখতেন?

না।

তা হলে?

পাড়া-প্রতিবেশীদের লিখতাম।

পাটিকুলারলি কাকে?

সে আছে। রিঙ্কু একটু বড় হওয়ার পর ওকেই লিখতাম।

রিঙ্কু জবাব দিত?

হ্যাঁ।

সে কি আপনার জন্য ফিল করত?

নিশ্চয়ই।

আপনার ডিভোর্স কতদিন হয়েছে?

আট বছর।

রিঙ্কুকে আপনি কত বছর দেখেননি?

চার বছর আগে এসে দেখে গেছি।

চার বছর লম্বা সময়। মেয়েকে দেখতে ইচ্ছে হত না?

হবে না। সবসময়ে তো। ওর কথা ভাবতাম। কিন্তু ওখানে আমার নিজস্ব একটা ব্যাবসা আছে।

কীসের ব্যাবসা?

বাচ্চাদের ড্রেস তৈরির ব্যাবসা।

টাকা কে দিয়েছিল?

সুজিত-মানে আমার হাজব্যান্ড।

উনি কি আপনার আগের চেনা?

হ্যাঁ। ছেলেবেলা থেকে।

ওকেই আগে বিয়ে করলেন না কেন?

সেটা দিয়ে এই তদন্তে কী দরকার?

কখন কোনটা কাজে লাগে তার ঠিক কী?

বিয়ে করিনি বাধা ছিল বলে।

কীসের বাধা?

আমার বাবা রাজি ছিলেন না।

কেন, জাতের বাধা ছিল?

না।

তবে?

সুজিতকে আমার বাবা পছন্দ করতেন না।

আপনার বাবা বেঁচে আছেন?

না।

ঠিক আছে, আমি আপনার আর সময় নষ্ট করব না।

লোকটার ফাঁসি কবে হবে?

কার ফাঁসি?

ওই লোকটার। যে আমার মেয়েকে খুন করেছে!

ফাঁসি দেওয়ার মালিক আমি নই।

ওকে আমার হাতে ছেড়ে দেবেন?

কেন?

আইনের ফাঁক দিয়ে হয়তো বেরিয়ে যাবে। তার চেয়ে আমার হাতে ছেড়ে দিন।

কী করবেন?

খুন করব।

শবর হাসল, লোকটাকে কেউই পছন্দ করে না দেখছি।

পছন্দ করার কথা নাকি? রেপ আর খুন দুটোর জন্য তো আর দু’বার ফাঁসি হবে না। আমার হাতে ছেড়ে দিলে আমি আগে একটা একটা করে ওর চোখ ওপড়াব, জিব টেনে ছিঁড়ব, পুরুষাঙ্গ কাটব…

দাঁড়ান, অতি উত্তেজিত হবেন না। অপরাধ এখনও প্রমাণ হয়নি।

সেটা আপনাদের ইন এফিসিয়েন্সির জন্য হয়নি। অত বড় একটা অন্যায় করল আর আপনারা এখনও প্ৰমাণই করতে পারলেন না।

আমরা অযোগ্য হতেই পারি। কিন্তু তবু এসব ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করা ভাল নয়।

সেইজন্যই তো বলছি, ওকে না হয় জামিনেই ছেড়ে দিন কয়েকদিনের জন্য।

ওকে মারলে আমাদের যে আপনাকে ধরতে হবে।

ধরবেন। মরতেও রাজি।

আপনি অযথা রেগে যাচ্ছেন।

অযথা? আপনার মেয়ে আছে?

থাকার কথা নয়। আমি বিয়ে করিনি।

তা হলে বুঝবেন কী করে?

মেয়ের বাবা নাই বলে কি আপনাদের দুঃখের কারণটা বুঝতে পারব না?

ওর গ্যারেজটায় আমি আগুন লাগাব।

শবর শুধু হাসল।

শ্যামলী বলল, আচ্ছা, ওর সঙ্গে লক আপ-এ গিয়ে দেখা করতে দেবেন?

দেখা করতে চান?

খুব চাই। দরকার হলে ঘুষ দেব।

ঘুষ দিতে হবে না। তবে আমি চেষ্টা করব।

সত্যি করবেন?

করব।

থ্যাঙ্ক ইউ।