রেলস্টেশন নবীগঞ্জ থেকে মাইল-দেড়েক দূরে। ব্রাঞ্চ লাইনের ছোট্ট স্টেশন। সারাদিনে দুখানা আপ আর দুখানা ডাউন গাড়ি যায়।
রাত দশটার ডাউন ট্রেনটা পাস করানোর জন্য পয়েন্টসম্যান ভজনলাল স্টেশনে এসেছে। এ-সময়টায় স্টেশনমাস্টারমশাই থাকেন না। ভজনলাল ডাল রুটি পাকিয়ে রেখে সময়মতো চলে আসে। ট্রেন পাস করিয়ে দিয়ে খেয়ে ঘুম লাগায়। এই ট্রেনে যাত্রী থাকে না। কেউ নামেও না, ওঠেও না।
আজও ট্রেনটা পাস করাচ্ছিল ভজনলাল। কিন্তু ট্রেনটা এসে দাঁড়াতেই সামনের কামরার একটা দরজা পটাং করে খুলে গিয়ে একটা বিভীষিকা নেমে এল। পরনে জরির পোশাক ঝলমল করছে। এরকম লম্বাচওড়া লোক ভজনলাল জীবনে দেখেনি। দুখানা হাত যেন শালখুঁটি, কাঁধ দু’খানা গন্ধমাদন বইতে পারে, আর বুকখানা যা চওড়া ভজনলালের খাঁটিয়াখানা বোধ হয় তাতে এঁটে যায়। লোকটা কামরা থেকে লাফ দিয়ে নেমে সামনে ভজনলালকে দেখেই হুহুঙ্কারে জিজ্ঞেস করল, “উও কাঁহা?”
ভজনলাল এমন ঘাবড়ে গেল যে, হাত থেকে লাল-নীল বাতিটা খসে পড়ে গেল প্ল্যাটফর্মে। সে দু হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কৌন হুজুর?”
লোকটা ফের হুঙ্কার ছাড়ল, “কাঁহা হ্যায় উও? আঁ! কাঁহা ছিপা হুয়া হ্যায়?”
ভজনলাল কাঁপতে কাঁপতে বলে, “নেহি মালুম হুজুর!”
লোকটা দুখানা বিশাল থাবায় ভজনলালের কাঁধ ধরে একটা রামঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “নেহি মালুম! নেহি মালুম! ক্যা নেহি। মালুম রে? আভি উসকো লে আও। কাঁহা ছিপায়গা উও?”
ভজন ভয়ে আধমরা। বলল, “জি হুজুর। জরুর কুঁড় লায়েঙ্গে। লেকিন উনকো নাম তো বতাইয়ে।”
দৈত্যটা ভজনলালকে ছেড়ে দিয়ে কপালে হাত বোলাতে-বোলাতে এবার বাংলায় বলল, “তাই তো! নামটা কী যেন! অনেক দিনের কথা কিনা। নামটা তো মনে পড়ছে না।”
ভজনলাল দম ফেলার সময় পেল। বড্ড ঘাবড়ে গিয়েছিল সে। হাতজোড় করে বলল, “নামটা ইয়াদ না হলে কোই হরজা নেই হুজুর। লেকিন লোকটা দেখতে কেমুন আছে সিটা তো বোলেন।”
দৈত্যটা একটা বিশাল শ্বাস ছাড়ল। সেই শ্বাসের ধাক্কায় ভজন এক-পা পিছিয়ে গেল যেন। শ্বাস ছেড়ে দৈত্যটা বলল, “লোকটা রোগাপটকা, ফরসা, একটু ট্যারা, মাথায় বাবরি চুল। বুঝলি? কোথায় লোকটা?”
ভজনলাল মাথা নেড়ে বলে, “মিলে যাবে হুজুর। জরুর মিলে যাবে। কাল হবিবপুরে হাটবার আছে, বহুত আদমি আসবে। ওইরকম তিন-চারটা আদমি ধরে লিয়ে আসব।”
লোকটা বড় বড় চোখে ভজনলালকে প্রায় ভস্ম করে দিয়ে বলল, “ফরসা বললাম নাকি? না, লোকটা কালোই হবে। আর ট্যারা নয়। অনেকটা চিনেম্যানের মতো দেখতে। আর রোগাপটকাও নয়। বেশ লম্বাচওড়া চেহারা। বুঝতে পেরেছিস কার কথা বলছি?”
“জি হুজুর, মিলে যাবে।”
দৈত্যটা দাঁত কিড়মিড় করে বাজ-পড়া গলায় বলল, “লোকটাকে পেলে আমি কী করণ জানিস?”
ভজন ভয়ে-ভয়ে বলে, “পিটবেন হুজুর। লোকটা মালুম হচ্ছে, বৃহহাত বদমাশ আছে।”
লোকটা একটা হাত মুঠো পাকিয়ে বলল, “আগে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাব। তারপর ময়দার মতো ঠাসব, দলা পাকিয়ে ফেলব। তারপর সেই দলাটা দিয়ে ফুটবল খেলব। তারপর কিছুক্ষণ লোফালুফি করব, তারপর নদীতে ফেলে দেব। তারপর তুলে এনে মুগুর দিয়ে চ্যাপ্টা করব। তারপর…”
ভজনলাল মাথা নেড়ে বলে, “সমঝ গিয়া মালিক। আদমিটার নসিব খারাপ আছে। যো ইচ্ছা হয় করবেন হুজুর, আমি আঁখ মুদিয়ে থাকব। “
“মনে থাকে যেন, লোকটা বেঁটে, কালো, মাথায় টাক, দাঁতগুলো উঁচু, গাল তোবড়ানো…”
“জি হুজুর। এখানে সব কিসিম পাবেন। কাল হাটবারে পসন্দ করে লিবেন। আমি একটা-একটা করে আদমি ধরে এনে হুজুরের সামনে ফেলে দিব, হুজুর পসন্দ করে লিবেন।”
দৈত্যটা চোখ মিটমিট করে বলল, “পছন্দ! পছন্দ করার কথা উঠছে কেন রে? আমি তাকে মোটেই পছন্দ করি না।”
“জি হুজুর। আপনার বাত ঠিক আছে। আমি ভি তাকে পসন্দ করি না।”
“মনে থাকে যেন, লোকটা বেশ লম্বা, ফোলা, মাথায় টাক
কিংবা বাবরি চুল, চিনেম্যান বা কাফ্রির মতো দেখতে, নাকটা থ্যাবড়া হতে পারে আবার চোখাও হতে পারে।”
“জি হুজুর। খুব ইয়াদ থাকবে। আপনি এখন গিয়ে আরাম করুন।”
দৈত্যটা আর-একটা শ্বাস ফেলে গদাম-গদাম করে নাগরা জুতোর শব্দ তুলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। তারপর জোরকদমে হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
ভজনলাল জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল, “রামজি কি কৃপামে আজ তো বাঁচ গয়া। জয় রামজি, সীতা মায়ি, বজরঙ্গবলি কি! কাল ক্যা হোগা রামজিকি মালুম।”
রাত এগারোটাতেই নবীগঞ্জ নিশুতি। ঘোর অন্ধকার রাত্রি, তাতে আবার কুয়াশা পড়েছে। পাঁচু বিষয়কর্মে বেরিয়েছে। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, গায়ে চুপচুপে করে তেল মাখা, হাতে একটা থলি। থলিতে সিঁদকাঠি আছে, কুকুরের জন্য বিস্কুট আর মাংসের হাড় আছে, নানারকম চাবি আছে, শিক বাঁকানো আর কাঁচ কাটার যন্ত্রপাতিও আছে।
রায়বাবুর বাড়িতে চুরি করা শক্ত কাজ। রায়বাবুর একটা বিশাল কুকুর আছে। পাঁচু বার তিনেক চেষ্টা করে পেরে ওঠেনি। আজ সে তৈরি হয়েই এসেছে। গতকাল রায়বাবু ধান বেচে বেশ কয়েক হাজার টাকা পেয়েছেন। শোওয়ার ঘরে লোহার আলমারিতে রাখা আছে। কাজটা শক্ত। কিন্তু শক্ত কাজেই তো আনন্দ।
রায়বাবুর বাড়িটা বাইরে থেকে খুব ভাল করে দেখে নিল পাঁচু, কেউ জেগে আছে কিনা। জানলায় কান পেতে শুনল, ভেতরে শাসের যে শব্দ হচ্ছে তা ঘুমন্ত মানুষের শ্বাসের শব্দ কিনা। এসবের জন্য সূক্ষ্ম কান চাই। শিখতে অনেক সময় আর মেহনত খরচ হয়েছে পাঁচুর। তবে না সে আজ পাশ করা চোর।
কুকুরটা সামনের বারান্দায় থাকে। সেদিকটায় যায়নি পাঁচু। কোনও শব্দও করেনি। তবু কুকুরটা বোধ হয় টের পেয়ে আচমকা ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। পাঁচুর কাজ বাড়ল। বিরক্ত হয়ে সে সন্তর্পণে এগিয়ে গিয়ে বারান্দার গ্রিলের ভেতরে বিস্কুট আর হাড় দুটো ছুঁড়ে ফেলল। তারপর অপেক্ষা করতে লাগল। বিস্কুট আর হাড়ে ঘুমের ওষুধ দেওয়া আছে। পাঁচ-ছ ঘণ্টা টানা ঘুম হবে।
একটা ঝোঁপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে রইল পাঁচু। কুকুরটা একটু দ্বিধায় পড়ল। তারপর জিনিসগুলো শুকল। তারপর হাড়খানা নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করল। তারপর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।
আর দেরি নয়। চটপট কাজ শেষ করে ফেলতে হবে। পাঁচু উঠে দাঁড়াল। ঝোঁপের ওপাশ থেকে আরও একজন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু ওঠাটা কিছু অদ্ভুত। উঠছে তো উঠছেই। যেন শেষ নেই। পাঁচুর মাথার ওপরেও বোধ হয় আরও হাত দেড়েক উঠে গিয়ে তবে লোকটার ওঠা শেষ হল। শুধু উঁচুই নয়, বহরের দিকটাও দেখার মতো। এত বড় বহরের মানুষ পাঁচু কখনও দেখেনি। সামনের বাড়িটা, এমনকী বাগানটা অবধি আড়াল হয়ে গেল।
অন্য কেউ হলে চেঁচামেচি করত, ভিরমি খেত বা দৌড়ে পালাত। দৌড়ে পালানোর অবস্থা অবশ্য পাঁচুর নেই। ভয়ে হাত-পা সব অসাড় হয়ে গেছে। তবে তার অনেক দেখা আছে, অভিজ্ঞতাও প্রচুর। রাতবিরেতে বেরোলে কতরকম ঘটনাই ঘটে। সাপ, ভূত, পাগলা কুকুর। তবে এটি ব্ৰহ্মদৈত্য কিনা তা ঠাহর হল না তার। তবে শুকনো গলাটা পরিষ্কার করতে গিয়ে তার গলা থেকে একটা ছাগলের ডাক বেরোল।
ব্রহ্মদৈত্য চাপা গলায় বলে উঠল, “তুই!”
গলা দিয়ে স্বাভাবিক স্বর বেরোল না। ফের ছাগলের ডাক। সেই ছাগলের গলাতেই পাঁচু বলে উঠল, “আমি!”
“তোকেই তো খুঁজছি! সেই ঢ্যাঙা, সুটকো, হাড়গিলে, দাঁত উঁচু চেহারা!”
পাঁচু বুদ্ধিমান। টপ করে বুঝতে পারল, লম্বাচওড়া হলেও লোকটা ব্ৰহ্মদৈত্য নয়। মানুষই। বুঝবার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচুর গলার স্বর ফিরে এল। খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, “উনি আমার পিসেমশাই।”
“কে কার পিসেমশাই!”
“ওই যার কথা বললেন। ঢ্যাঙা, সুটকো, হাড়গিলে, দাঁত উঁচু। সবাই ভুল করে কিনা। আমার আপন পিসেমশাই তো, তাই আমার সঙ্গে চেহারার খুব মিল। অনেকে যমজ ভাই বলে ভুল করে।”
দৈত্যটা যেন ভাবিত হল, “পিসেমশাই! পিসেমশাই! কোথায় তোর পিসেমশাই?”
“আছে মশাই, আছে। কিন্তু এত রাতে তাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে?”
লোকটা ঝোঁপ পেরিয়ে এসে পাঁচুর কাঁধ খামচে ধরে বলল, “কোথায় আছে? কোথায়?”
থাবা খেয়ে পাঁচু চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগল। কিন্তু বুদ্ধিটা গুলিয়ে যেতে দিল না। গলাটি মোলায়েম করে বলল, “আজ্ঞে আর ঝাঁকাবেন না, হাড়ে-হাড়ে খটাখট শব্দ হচ্ছে। বলছি, একটু দম নিতে দিন।”
“তাকে কী করব জানিস? বস্তায় পুরে আছড়ে-আছড়ে ঘেঁচে ফেলব। তারপর গরম জলে সেদ্ধ করব। তারপর গরম তেলে ভাজব।”
“খুব ভাল হয় তা হলে। দেখবেন আবার কাঁচা তেলে ছাড়বেন না। তেলটা বেশ ফুটে উঠলে, তবেই ছাড়বেন। নিজের পিসেমশাই বলেই কবুল করতে লজ্জা হয় মশাই, কিন্তু উনি খুব যাচ্ছেতাই লোক। এই দেখুন না, অগ্রহায়ণ মাসের ঠাণ্ডায় আমি ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরছি, ট্যাঁকে পয়সা নেই, পেটে ভাত নেই, আর উনি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছন।”
কাঁধে আর-একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দৈত্যটা বলল,”কোথায় সে?”
“ওই যে বাড়িটা দেখছেন, সামনের ডান দিকের ঘরখানা, ওইখানে। তবে সাড়াশব্দ করবেন না। পিসেমশাইয়ের বন্দুক আছে। দুম করে বন্দুক চালিয়ে দিলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।”
“বন্দুক!” বলে লোকটা যেন ভাবিত হয়ে পড়ল। নিজের কপালে একটু টোকা মেরে মাথা নেড়ে বলল, “না, তার তো বন্দুক থাকার কথা নয়! তার বন্দুক ছিল না।”
“ছিল না বলে কি হতে নেই মশাই? দশ বছর আগে আমারও তো দাড়িগোঁফ ছিল না, তা বলে এখন কি হয়নি? চালের দর কি আগে পাঁচ টাকা কিলো ছিল? এখন কী করে পাঁচ টাকা হল বলুন! আগে তো সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরত, তা বলে কি এখন ঘোরে? এখন পৃথিবীই তো দেখছি সূর্যের চারদিকে পাক মেরে-মেরে হয়রান হচ্ছে। এই নবীগঞ্জে আগে চোর-ডাকাত ছিল কখনও? তা বলে কি এখন চোর-ডাকাত হয়নি?”
লোকটা এসব কথা কানে তুলল না। কেমন যেন ভয়-খাওয়া গলায় বলল, “বন্দুক! বন্দুকটা কী জিনিস বলো তো! লম্বামত দেখতে, দুম করে শব্দ হয়?”
“শব্দ বলে শব্দ! সে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। তার ওপর পিসেমশাইয়ের বন্দুককে বন্দুক না বলে কামান বলাই ভাল।
গেল বার পিসেমশাই এক ডাকাতকে গুলি করেছিলেন, ডাকাতের গায়ে গুলি লাগেনি বটে, কিন্তু শব্দেই সে মূর্ছা গেল। পরে পুলিশ এসে জল-টল দিয়ে তার মূছ ভাঙায়। আরও কী হল জানেন? সেই শব্দে মশা-মাছি কাক-চিল সেই যে নবীগঞ্জ ছেড়ে পালাল, আর ছ’ মাসের মধ্যে এদিকপানে আসেনি।”
দৈত্যটা যেন একটু চঞ্চল হল, চারদিক চেয়ে হঠাৎ পাঁচুকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “বন্দুক! বন্দুক খুব খারাপ জিনিস। শব্দ হয়।”
বলেই চোখের পলকে ঘুরে অন্ধকারে দুদ্দাড় করে পালাতে লাগল। লোকটার আক্কেল বলে কিছু নেই। মচাত করে একটা গাছের ডাল ভেঙে ফেলল, একটা টিনের ক্যানেস্তারা প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে ফেলল, খটাস করে ফটক খুলল। আর সেই শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে রায়বাবু চেঁচাতে লাগলেন, “কে রে! কে ওখানে?”
নাঃ, আজও হল না। পাঁচু দুঃখিতভাবে মাথা নাড়ল। কিন্তু নবীগঞ্জে এই অসুরটা কোত্থেকে হাজির হল, মতলবটাই বা কী, সেটা জানতে হচ্ছে। রায়বাবু বাতি জ্বেলে লাঠি হাতে বেরিয়ে আসতে-আসতে হাঁকডাক করছেন। তাঁর কাজের লোক, জোয়ান ছেলেরা, সব ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে। পাঁচু ধীরেসুস্থে তার থলি গুছিয়ে নিয়ে গা-ঢাকা দিল।
দুঃখবাবুর আজকাল ঘুম খুব পাতলা হয়েছে। গাঁট্টার ভয়ে সবসময়েই একটা আতঙ্ক। তবে ভালর মধ্যে এই যে, আগে যেমন যখন-তখন গাঁট্টা, কাতুকুতু, সুড়সুড়ি হত, এখন তেমনটা হয় না। প্রথম গাঁট্টাটা আজকাল খুব ভোরের দিকে হয়। আর মজা এই, গাঁট্টা খেয়েই উঠে পড়লে এবং দৌড়তে শুরু করলে আর কোনও উৎপাত থাকে না। দুঃখবাবু দৌড়লে যে ভূতটার কী সুবিধে, তা অনেক মাথা ঘামিয়েও দুঃখবাবু বুঝতে পারছেন না।
আজ মাঝরাতে হঠাৎ দুঃখবাবুর ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে যেন অন্ধকারেও একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পেলেন। সেই চোরটাই আবার এসেছে নাকি? চোরকে দুঃখবাবুর কোনও ভয় নেই, কারণ চোর তাঁর নেবেটা কী? তিনি বরং আগন্তুকের সাড়া পেয়ে খুশিই হলেন। দুটো সুখ-দুঃখের কথা তো বলা যাবে।
“কে, চোরভায়া নাকি? আরে, এসো, এসো। বোসো দেখি জুত করে। শরীর-গতিক সব ভাল তো! বাড়ির খবরটবর সব ভাল? খোকাখুকিরা ভাল আছে তো! আর বউ? তিনি ভাল আছেন তো।”
চোরভায়া জবাব দিল না, তবে বিকট একটা শ্বাস ফেলল।
“তা বেশ হাঁফিয়ে পড়েছ দেখছি ভায়া! বোসো, বসে একটু জিরোও। তোমার মেহনত তো কম নয়। রাত জেগে খুবই পরিশ্রম করতে হয় তোমাকে। তা দুধ-টুধ খাও তো নিয়মিত? এত পরিশ্রম, একটু দুধ-ঘি না হলে শরীরে এত সইবে কেন? আমি বলি কি, একটু চ্যবনপ্রাশ খেয়ে দ্যাখো, ওতে বেশ বল হয়।”
এই বলে ফস করে হারিকেনের নিবুনিবু সলতেটা একটু উসকে দিলেন দুঃখবাবু। আর তারপরেই বিকট মূর্তি দেখে তাঁর মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। এতবড় যে কোনও মানুষের চেহারা হতে পারে, তা জানা ছিল না তাঁর। তার ওপর আবার রাজারাজড়াদের মতো জরির পোশাক!
দৈত্যটা আর-একটা ঝড়ের মতো শ্বাস ফেলে বলল, “তা হলে তুই-ই সেই পামর?”
দুঃখবাবু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থাকলেন। তারপর হঠাৎ তাঁর মনে হল, সেই ভূতটাই মূর্তি ধরে আসেনি তো! ভূতেরা অনেক কিছু পারে। যখন-তখন অদৃশ্য হয়ে যায়, আবার যার-তার রূপ ধারণ করে।
একটু কাঁপা গলায় দুঃখবাবু বলে উঠলেন, “আপনিই কি তিনি?”
দৈত্যটা বিশাল আর-একটা শ্বাস ফেলে বলে, “আমিই। তোকে কী করব জানিস! আগে তোকে ধরে গোটাকয়েক আছাড় দেব। তারপর বনবন করে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলব। তারপর মুগুর দিয়ে পিটিয়ে চ্যাপটা করে রোদে শুকিয়ে পাঁপরভাজা বানাব। তারপর গুঁড়ো করে নস্যি বানিয়ে উড়িয়ে দেব ফুঁ দিয়ে।”
দুঃখবাবু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বললেন, “আমার ওপর আপনার এত রাগ কেন? দিন রাত গাঁট্টা মারছেন, কাতুকুতু দিচ্ছেন, সুড়সুড়ি দিচ্ছেন, তাতেও হল না? আমি রোগাভোগা, দুঃখী মানুষ, আমার ওপর এই অত্যাচার কি ভাল?”
দৈত্যটা অবাক হয়ে বলে, “গাঁট্টা? কাতুকুতু? সুড়সুড়ি? ফুঃ, ওসব আমার মোটেই পছন্দের জিনিস নয়। আমি চাই শঠে শাঠ্যং।”।
এবার দুঃখবাবু খানিকটা দুঃখে, খানিকটা রাগে ফুঁসে উঠে বললেন, “আপনি মোটেই ভাল লোক নন। আড়াল থেকে গাঁট্টা মারেন, কাতুকুতু দেন, সুড়সুড়ি দেন, সাহস থাকলে সামনে এসে দাঁড়ালেই পারতেন। আড়াল থেকে লোককে যন্ত্রণা দেওয়া খুব খারাপ অভ্যাস। এখন তো খুব দাঁত বের করে এসে হাজির হয়েছেন, বলি এখন যদি আমি উলটে আপনাকে কাতুকুতু দিই? গাঁট্টা মারি? সুড়সুড়ি দিই?”
দৈত্যটা এক-পা পিছিয়ে গিয়ে বলে, “কাতুকুতু? ওরে বাবা, কাতুকুতু আমি মোটেই সইতে পারি না।”
“তা হলে! যা নিজে সইতে পারেন না, তা অন্যকে দেন কোন আক্কেলে? ছিঃ ছিঃ, আপনি অত্যন্ত খারাপ। অতি জঘন্য চরিত্রের লোক। আপনাকে কাতুকুতু দিলেও কাতুকুতুর অপমান করা হয়।”
দৈত্যটা কিছুক্ষণ দুঃখবাবুর দিকে বড় বড় চোখে চেয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, “না, তুই নোস। সে তোর চেয়ে লম্বা, তোর চেয়ে অনেক জোয়ান, বয়সেও বড়। তার মাথায় তোর মতো টাকও নেই।”
দুঃখবাবু একথায় অত্যন্ত দুঃখ পেয়ে বললেন, “সবাই ওইকথা বলে। সকলেই নাকি আমার চেয়ে লম্বা, আমার চেয়ে জোয়ান, আমার চেয়ে বড়, তাদের টাকও নেই। তাতে কী এমন অপরাধ হল শুনি! রোগা, বেঁটে, কমজোরি আর টেকোরা বুঝি মাগনা এসেছে পৃথিবীতে! তাদের বুঝি ধরে ধরে কেবল কাতুকুতু দিতে হয়? সুড়সুড়ি দিতে হয়? গাঁট্টা মারতে হয়?”
দৈত্যটা পিটপিট করে চেয়ে বলল, “কাতুকুতু খুব খারাপ জিনিস।”
দুঃখবাবু খুবই রেগে উঠছেন ক্রমে-ক্রমে। এবার প্রায় ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, কাতুকুতু খারাপ, সুড়সুড়ি খারাপ। তার চেয়ে আরও খারাপ হল গাঁট্টা।”
দৈত্যটা দুঃখবাবুর সঙ্গে একমত হল না, মাথা নেড়ে বলল, “না, কাতুকুতুই সবচেয়ে খারাপ।”
দুঃখবাবু আরও একটু রেগে গিয়ে বললেন, “না, কাতুকুতুর চেয়ে গাঁট্টা আরও খারাপ। গাঁট্টার চোটে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমাকে মাইলচারেক দৌড়তে হয় তা জানেন?”
“দৌড় ভাল জিনিস।”
“মোটেই ভাল জিনিস নয়। দৌড়তে-দৌড়তে জিভ বেরিয়ে যায়। তবু কি থামবার উপায় আছে? থামলেই গাঁট্টা।”
“কাতুকুতুর চেয়ে গাঁট্টা ভাল।”
“না, কাতুকুতু তবু মন্দের ভাল।”
দৈত্যটা মাথা নেড়ে বলে, “কাতুকুতু খুব খারাপ।”
দুঃখবাবু রাগের চোটে দিশেহারা হয়ে বললেন, “কাতুকুতুই যদি খারাপ তা হলে আপনি আমাকে গাঁট্টা মারেন কেন?”
দৈত্যটা মাথা চুলকে বলল, “গাঁট্টা! না, গাঁট্টাটাট্টা আমি মারি না। যার ওপর রাগ হয় তাকে ধরে আমি গামছার মতো নিংড়ে ফেলতে ভালবাসি। তারপর কী করি জানিস? নিংড়োবার পর গামছার মতোই ঝেড়ে নিয়ে তারপর পাকিয়ে-পাকিয়ে একটা বল বানাই। তারপর বলটা দিয়ে খুব ফুটবল খেলি…”
“গাট্টা তা হলে কে মারে?”
“তার আমি কী জানি! তবে তুই অতি নচ্ছার লোক, তোকে গাঁট্টা মারাই উচিত।”
“আমি নচ্ছার লোক?”
“যারা কাতুকুতু দেয় তারা অত্যন্ত পাজি লোক।”
“আমি কখনও কাউকে কাতুকুতু দিই না।”
দুঃখবাবু খুব অভিমানভরে লোকটার দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ”এই যে রোজ আপনি আমাকে গাঁট্টা মারেন, তবু হাতের কাছে পেয়েও আমি আপনাকে একবারও কাতুকুতু দিয়েছি কি?”
দৈত্যটা একটু যেন শিহরিত হয়ে বলল, “বাপ রে।”
“একবারও দিয়েছি? বলুন!”
দৈত্যটা জবাব না দিয়ে তড়িঘড়ি দরজা খুলে পালিয়ে গেল।
কেউ বিশ্বাস করবে না। সেইজন্য কাউকে বলেও না পুটে সর্দার যে রাত বারোটার পর তার কান খুলে যায়। তখন হড়হড় করে কানের মধ্যে এতসব শব্দ ঢুকতে থাকে যে, পুটে আর ঘুমোতে পারে না। ঝিঁঝির ডাক, বাতাসের শব্দ, ইঁদুরের চিড়িক অবধি তখন বাজের শব্দের মতো কানে এসে লাগে। পুটে তাই বিকেল থেকে রাত বারোটা অবধি ঘুমোয়। রাত বারোটায় উঠে দিনের কাজ শুরু করে দেয়। প্রথমে ডন বৈঠক করে, তারপর পুজোআচ্চা, একটু প্রাতভ্রমণ সেরে রাত আড়াইটেয় ছোলা-গুড় খেয়ে দাওয়ায় বসে গুনগুন করে রামপ্রসাদী বা কীর্তন গায়। ভোর পাঁচটায় আবার কান বন্ধ হয়ে যায়।
আজও রাত বারোটায় ঘুম থেকে উঠে দাঁতন চিবোতে-চিবোতে কুয়োর পড়ে যাবে বলে দরজা খুলে উঠোনে নামতেই পুটে একটু চমকে গেল। অপদেবতা নাকি? উঠোনের যে ফটকটা আছে তার ধারে ওটা কে দাঁড়িয়ে? মনিষ্যি বলে তো মনে হয় না। এত বিরাট চেহারার কি মানুষ হয়? বারকয়েক রামনাম জপ করে নিয়ে গলাখাঁকারি দিয়ে পুটে বলল, “কে ওখানে?”
দাঁত কড়মড় সহ জবাব এল, “তোকেই খুঁজছি।”
পুঁটে সর্দারের হাত থেকে জলের ঘটিটা ঠাস করে পড়ে গেল। দাঁতনটাও ধরে রাখতে পারল না কাঁপা হাতে। এ যে যমদূত, তাতে আর তার সন্দেহই রইল না। পরনে ঝলমলে জরির পোশাক। নিতে এসেছে।
কিন্তু এমন কীইবা বয়স হল তার? এখনও দাঁত নড়েনি, চুলে তেমন পাক ধরেনি, এখনও কাঠ কাটতে পারে, জল তুলতে পারে, দশ-বিশ মাইল হাঁটতে পারে। যতীন-ময়রার সঙ্গে কথা হয়ে আছে, যেদিন পুঁটে সর্দারের একশো বছর পুরবে সেদিন যতীন তাকে একশোটা স্পেশ্যাল সাইজের রাজভোগ খাওয়াবে। এক-একখানার ওজন দেড় পোয়া। নবসঙ্ঘ ক্লাবের ছেলেরা বলেছে, পুঁটে সর্দারের একশো বছর বয়স হলে তারা চাঁদা তুলে একশোখানা একশো টাকার নোট দিয়ে মালা গেঁথে তার গলায় পরিয়ে গাঁয়ে মিছিল বের করবে। ইস, একেবারে তীরে এসে তরী ডুবল যে! উত্তেজনায় নিজের মাথায় একবার হাত বোলাল পুঁটে, এঃ, পয়সা খরচ করে আজ ন্যাড়া হওয়ার দরকারই ছিল না। মরবে জানলে কোন আহাম্মক পয়সা খরচ করে ন্যাড়া হয়!
গলাখাঁকারি দিয়ে পুটে বলল, “পেন্নাম হই যমদূতমশাই। তা এখনই কি যেতে হবে? নাকি দাঁতনটা করে নেব?”
যমদূত দাঁত কড়মড় করতে করতে বলল, “তোর সময় ফুরিয়েছে।”
তর্ক করে লাভ নেই, তবু পুঁটে সর্দার বিনীতভাবেই বলল, “আজ্ঞে হিসেবটা ঠিকমতো দেখে নিয়েছেন তো! হিসেবে কোনও ভুলভাল নেই তো!”
“কিসের হিসেব?”।
“আজ্ঞে চিত্রগুপ্ত মশাইয়ের খাতাখানার কথা বলছি। এত লোকের আয়ুর হিসেব কি সোজা কথা? ভুলভাল হতেই পারে। উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপল হয়তো।”
“আমাকে আঁক শেখাচ্ছিস?”
জিভ কেটে পুঁটে বলে, “আজ্ঞে না। আমার তেমন আস্পদা এখনও হয়নি। তবে কিনা অপরাধ যদি না নেন তো বলি, অনেক সময়ে নাম-ঠিকানাও ভুল হয় কিনা। আর-একবার নাম-ঠিকানাটা বরং মিলিয়ে দেখে নিন।”
যমদূত দাঁত কড়মড় করে বলল, “তুই-ই সেই লোক।”
পুঁটে বলল, “যে আজ্ঞে, তা হলে তো কথাই নেই। তা ওদিককার রাস্তাঘাট কেমন?”
“কোথাকার রাস্তা?”
“আজ্ঞে যমপুরীর রাস্তার কথাই বলছি। ভাঙাচোরা, খানাখন্দ নেই তো? বলেন তো লণ্ঠনটা সঙ্গে নিতে পারি। যেতে-যেতে আবার বৈতরণীর খেয়া না বন্ধ হয়ে যায়!”
“আমাকে যমপুরীতে পাঠাতে চাস?”
জিভ কেটে পুঁটে বলে, “না, না, ছিঃ ছিঃ। যমপুরীতে পাঠাব কি? সেটা যে আপনার বাড়ি। এমনি বলছিলাম আর কি। তা ওদিককার খবরটবর সব ভাল তো! যমদাদা ভাল আছেন তো? আর আমাদের যমুনাদিদি? তা আপনি দাঁড়িয়ে কেন? দাওয়ায় এসে বসে একটু জিরোন। রাস্তা তো কম নয়। হেঁটেই এলেন নাকি? গাড়ি-ঘোড়া কিছু নেই সঙ্গে?”
বলে পুঁটে হেঃ হেঃ করে ঘাবড়ে-যাওয়া কাষ্ঠহাসি হাসল। তারপর শশব্যস্তে বলল, “কী নিতে হবে বলুন তো সঙ্গে! গামছা
তো একটা লাগবেই। কয়েকটা দাঁতন নিই বরং, কী বলেন? আর ঘটিখানাও, নাকি? কাপড়জামা নিতে হবে না সঙ্গে?”
যমদূত সামনে এগিয়ে এসে বলল, “তোকে যমের বাড়ি পাঠাব বলেই তো এতদূর আসা।”
পুটে হাতজোড় করে বলল, “এসে খুব ভাল করেছেন। একদিন আগে এলে আরও ভাল হত। তা হলে আর পয়সা খরচ করে ন্যাড়াটা হতাম না। আপনিও চুলের ঝুটি ধরে দিব্যি টেনে নিতে পারতেন। খরচাটার কথাও একটু ভেবে দেখুন। আগে ন্যাড়া হতে মাত্র একটি পয়সা লাগত। এখন সেই দর ঠেলে কোথায় উঠেছে জানেন? পুরো এক টাকায়। বেঁচে থেকে
কোনও সুখ নেই, বুঝলেন, কোনও সুখ নেই। জিনিসপত্রের যা দাম হয়েছে শুনলে আপনি মূছ যাবেন। আজ সকালে কত দরে সরপুঁটি কিনেছি জানেন? শুনলে পেত্যয় যাবেন না, বারো টাকা। তাও কি দেয়? ষোলো টাকার এক পয়সা ছাড়বে না। অনেক ঝোলাঝুলি করে তবে বারো টাকায় রফা হল। বলুন না আজ্ঞে। তাড়াহুড়া কিছু নেই তো মশাই, আমরা তো আর ট্রেন ধরছি না। বসে একটু জিরিয়ে নিন। আমি টক করে কাজগুলো সেরে ফেলি।”
“কী কাজ?”
“দাঁতনটা করে, পুজোটা সেরে নিয়ে চাট্টি ভেজানো ছোলা মুখে ফেলে রওনা দেব’খন। বেশিক্ষণ লাগবে না। কতটা পথ হবে বলুন তো! বেলাবেলি পৌঁছনো যাবে?”
“কোথায় যাবি?”
“কেন, যমের বাড়ি! হেঃ হেঃ, রাস্তাঘাট তা হলে বেশ ভালই বলছেন তো! তবে সাবধানের মার নেই। আজ সকালেই শুনলাম, রাজবাড়িতে খুব সাপের উপদ্রব হয়েছে। লাঠিগাছটা বরং সঙ্গে নেব’খন। মরতেই যাচ্ছি বটে, কিন্তু সাপখোপের হাতে অপঘাতে প্রাণটা দিই কেন?”
যমদূত একটু যেন ভড়কে গিয়ে বলে উঠল, “লাঠি! লাঠি দিয়ে কী হবে? না, লাঠির দরকার নেই।”
“নেই বলছেন? লাঠি কিন্তু খুব ভাল জিনিস। বন্দুক, পিস্তল, তলোয়ার, রামদা বিস্তর চালিয়েছি বটে, কিন্তু দেখলাম, লাঠির কোনও তুলনা নেই। একখানা লাঠি হাতে রাখলে যেন বল-ভরসা এসে যায়। তখন যমকেও ভয় করে না।”
যমদূত ঘন-ঘন মাথা নেড়ে বলল, “না, না, লাঠির দরকার নেই। তলোয়ার-টলোয়ারও খারাপ জিনিস।”
“নেব না বলছেন?”
যমদূত ধমক দিয়ে উঠল, “না! খবর্দার না!”
পুঁটে বেজার মুখে বলল, “তা হলে থাক। লাঠিখানা আমার অনেকদিনের বন্ধু কিনা, তাই নিতে চাইছিলাম। আমার সঙ্গে সেও একটু যমপুরী ঘুরে আসত। পাঁকা গিঁটেল বাঁশের লাঠি। কত মাথা ফাটিয়েছি, কত হাত-পা ভেঙেছি লাঠি দিয়ে। রাজামশাই খুশি হয়ে গাঁটগুলো পেতল দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। গুহ্যকথা প্রকাশ করা ঠিক নয়, তবে আপনি আপনজন বলেই বলছি, আমার লাঠি কিন্তু মন্ত্রসিদ্ধ। গোলক ওস্তাদের দলের সঙ্গে যখন আমাদের দাঙ্গা লাগল তখন তো বারোজন ঘিরে ধরে সড়কি, তলোয়ার চালিয়ে আমাকে প্রায় আধমরা করে ফেলেছিল আর কি। বললে পেত্যয় যাবেন না, তখন আমার হাত থেকে খসেপড়া ওই লাঠি নিজে থেকেই শুন্যে উঠে দমাদম পিটিয়ে সেই বারোজনকে তেপান্তর পার করে দিয়ে এসেছিল। আর একবার…”
যমদূত এক-পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “তোকে আমার একটুও পছন্দ হচ্ছে না। এই গাঁয়ের লোকগুলো অত্যন্ত পাজি।”
একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে পুটে বলল, “যে আজ্ঞে। নবীগঞ্জের লোকেরা খুবই পাজি। এতই পাজি যে, যম অবধি তাদের ছোঁয় না। তাই বলছিলাম, ঠিকানাটা ভুল হয়নি তো! একটু ভাল করে মাথাটা ঝাঁকিয়ে দেখুন তো! মাইল তিনেক উত্তরে শিবগঞ্জ আছে। সেখানে চুনো সর্দার বলে একজন থাকে। তার শুনেছি একশো বিরাশি বছর বয়স। সেই হবে তা হলে। এ-বেলা পা চালিয়ে চলে যান, পেয়ে যাবেন তাকে।”
দৈত্যটা মাথা নেড়ে বলল, “না রে, না। তার এই নবীগঞ্জেই আসার কথা। হবিবপুর স্টেশনে নেমে নবীগঞ্জ। আমার খুব মনে আছে। কিন্তু লোকটা যে কোথায় ঘাপটি মেরে আছে তা বুঝতে পারছি না।”
আশার আলোটা আরও উজ্জ্বল হল। একটু হাঁফ ছেড়ে পুঁটে বলল, “ওঃ, তাই বলুন? আমারও মনে হচ্ছিল কোথায় একটা ভুল হচ্ছে। আমার তো আর মরার বয়স হয়নি। চিত্রগুপ্তেরও একটু ভীমরতি হয়েছে মশাই, বুড়ো বয়সের তো ওইটেই দোষ কিনা! তবে এটুকু বলতে পারি, যাকে আপনি খুঁজছেন সে আমি নই।”
যমদূত একটু হতাশ গলায় বলে, “তা হলে সে কোথায়?”
আশার আলোয় এখন চারদিক একেবারে ঝলমল করছে। পুঁটে একগাল হেসে বলে, “আছে কোথাও লুকিয়ে-টুকিয়ে। বলেন তো, আপনার সঙ্গে আমিও একটু খুঁজে দেখতে পারি।”
“খুঁজবি?”
“আজ্ঞে, আপনি স্বয়ং যমরাজার লোক, আপনার জন্য দরকার হলে প্রাণও দিতে পারি। তা লোকটা কে বলুন তো!”
যমদূত মাথা চুলকে বলল “বেঁটেই হবে বোধ হয়, রোগাপানা, মাথায় টাক।”
পুঁটে উজ্জ্বল হয়ে বলল, “তাই বলুন, বেঁটে, রোগা, মাথায় টাক হচ্ছে দুঃখবাবু, রাজবাড়ির সরকারমশাই, গাইয়ে হরেন চৌধুরী।”
যমদূত ঘন-ঘন মাথা চুলকে বলল, “আবার লম্বাও হতে পারে, বেশ শক্তপোক্ত চেহারা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল।”
“তার আর ভাবনা কী? এ নির্ঘাত শিকারি বাসব দত্ত, নয়তো মহিম হালদার, না হলে ব্যায়ামবীর ভল্লনাথ হতেই হবে।”
“রোগা আর লম্বা যদি হয়?”
“তা হলেই বা চিন্তা কিসের? হাবু বিশ্বাস আছে, হরিহর পণ্ডিত আছে, নয়ন বোস আছে।”
যমদূত একটা ঝড়ের মতো শ্বাস ফেলে বলল, “এ-গাঁয়ের লোকেরা অতি পাজি। নাঃ, লোকটাকে খুঁজে বের করতেই হবে।“
এই বলে যমদূত অন্ধকারে কোথায় মিলিয়ে গেল তা আর ঠাহর হল না পুটে সদরের। যেখানে খুশি যাক, আপাতত ধড়ে যে প্রাণটা বহাল রইল তাতেই পুঁটে খুশি। যমদূত পাছে ফিরে আসে সেই ভয়ে পুঁটে তাড়াতাড়ি দরজায় খিল দিয়ে শুয়ে পড়ল। ভোরের আগে আর বেরোচ্ছে না।
রাত পোয়ানোর আগেই অবশ্য আরও অনেকের সঙ্গেই দৈত্যটার মোলাকাত হল। নয়ন বোস মূর্ছা গেল, হরিহর পণ্ডিত আমগাছে উঠে বসে রইল। হাবু ঘোষ তার লুকনো টাকা ঘুষ দিয়ে দৈত্যটাকে খুশি করার চেষ্টা করল। বাসব দত্তর জ্বর আর পেটের গোলমাল হতে থাকল।
ভাঙা, প্রকাণ্ড রাজবাড়ির দোতলার একখানা ঘরে বীরচন্দ্র থাকে। দুশো বছরের পুরনো একখানা পালঙ্ক আর কিছু আসবাব আছে। এ ছাড়া বীরচন্দ্রের আর বিশেষ কিছু নেই। সামান্য জমিজমার আয় থেকে কোনওরকমে গ্রাসাচ্ছাদনটা চলে। বীরচন্দ্র খুবই লাজুক মানুষ। রাস্তায় বেরোলে এখনও লোকে তাকে রাজা বলে প্রণাম করে, অনেকে নজরানা দেয়, সেই ভয়ে বীরচন্দ্র বাইরে বেরনো ছেড়েই দিয়েছে। তার কোনও বন্ধুবান্ধব নেই। বীরচন্দ্রের একটাই শখ, বীণা বাজানো। বীণার শব্দ পাছে লোকের কানে যায় সেইজন্য বীরচন্দ্র মাঝরাতে উঠে বিভোর হয়ে বীণা বাজায়। তার মাঝে-মাঝে মনে হয়, এই বীণার জন্যই সে বেঁচে আছে।
আজও মাঝরাতে তন্ময় হয়ে বীণা বাজাচ্ছিল বীরচন্দ্র। হঠাৎ শুনতে পেল, সিঁড়ি বেয়ে ভারী পায়ে কে উঠে আসছে। লাজুক বীরচন্দ্র বাজনা বন্ধ করে দিয়ে বসে রইল। এত রাতে কে আসবে?
দরজায় ঘা দিয়ে কে যেন বলে উঠল, “সে কোথায় রে?”
বীরচন্দ্র উঠল। লাজুক হলেও সে একটুও ভিতু নয়। চেহারাটা যথেষ্ট লম্বাচওড়া এবং রাজকীয়। তার গায়েও খুব জোর। দরজাটা খুলে সে দেখল, জরির পোশাক পরা বিরাট লোকটা দাঁড়িয়ে আছে।
বীরচন্দ্র একটু অবাক হয়ে বলল, “কী চাই?”
দৈত্যটা কুতকুতে দুই চোখে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “লোকটা কোথায়?”
বীরচন্দ্র লোকের সঙ্গে বেশি মেলামেশা করে না বটে, কিন্তু তার পর্যবেক্ষণ তীক্ষ্ণ, বুদ্ধি ধারালো এবং কাণ্ডজ্ঞানও টনটনে।
সে লোকটার দিকে চেয়েই বুঝতে পারল, লোকটা দেখতে যত ভয়ঙ্কর আসলে তত বিপজ্জনক নয়।
সে মৃদু হেসে বলল, “এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউ থাকে। আপনি কাকে খুঁজছেন?”
“আরে ওই যে সিঁড়িঙ্গে চেহারার লম্বা বেঁটেপানা লোকটা! একমাথা টাক, তার ওপর বাহারে টেরিকাটা বাবরি। গায়ের রং কালো হলে কী হবে, টকটক করছে ফরসা।”
বীরচন্দ্র দরজা ছেড়ে দিয়ে বলল, “আসুন ভেতরে।”