নফরগঞ্জের উঠতি এবং নবীন চোর চিতেনের এই সবে নামডাক হতে শুরু করেছে। আশপাশের পাঁচ-দশটা গাঁয়ে চোরের মহল্লায় সবাই মোটামুটি স্বীকার করছে যে, চিতেন যথেষ্ট প্রতিভাবান এবং তার ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। চিতেন ছিপছিপে, ছোটখাটো, গায়ের রংটি শ্যামলা। চোরেদের বেশি লম্বা হলে বিপদ, তারা চট করে ঝোপেঝাড়ে বা টেবিল বা চৌকির নীচে লুকোতে পারে না। ঢ্যাঙা হলে দূর থেকে চোখেও পড়ে যায়। বেঁটে হওয়াটাও কাজের কথা নয়। বেঁটে হলে অনেক জিনিসের নাগাল পাবে না, উঁচু দেওয়াল টপকাতে সমস্যা হবে এবং লম্বা পা ফেলে দৌড়তে পারবে না বলে ধরা পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। চিতেনের উচ্চতা একেবারে আদর্শ। বেঁটে নয়, লম্বাও নয়। রং কালো বলে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিতে সুবিধে। সে দৌড়য় হরিণের মতো। গায়ে জোর বলও যথেষ্ট। কিন্তু তার আসল প্রতিভা হল চোখে। চিতেনের চোখ সর্বদাই সবকিছুকে লক্ষ করে। সন্দেহজনক কিছু ঘটলেই তার চোখে পড়ে যায়।
রামভজনবাবু যখন সাঁঝবেলাটিতে নফরগঞ্জের হাটখোলার কাছে নবীন মুদির দোকানের সামনে এসে গাঁয়ে কোনও কৃপণ লোক আছে কি না তার খোঁজ করছিলেন, তখনই চিতেন তাঁকে লক্ষ করল। বুড়োমানুষটির হাবেভাবে সন্দেহ করার মতো অনেক কিছু আছে। নবীনের দোকানের সামনে বসে কাঠকয়লার আংড়ায় আগুন পোয়াচ্ছিল গাঁয়ের মাতব্বররা। বিশুবাবু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কৃপণ! তা মশাই, কৃপণের খোঁজ করছেন কেন?”
রামভজন ফোকলামুখে হেসে বললেন, “কুঁড়োরহাটের মহাজন বিষ্ণুপদ দাসের নাম শুনেছেন কি? আমি তাঁরই কর্মচারী। তা তাঁর শখ হয়েছে মহল্লার সব কৃপণদের নিয়ে একটা সম্মেলন করবেন। সেরা কঞ্জুষকে ‘কঞ্জুষরত্ন’ উপাধি দেওয়া হবে। আমার ওপর হুকুম হয়েছে কৃপণ খুঁজে বের করতে। বড়লোকের শখ আর কী!”
এ-কথায় সবাই হইহই করে উঠল। ব্যোমকেশবাবু বললেন, “তার আর চিন্তা কী? ঠিক জায়গাতেই এসে পড়েছেন। ওই আমাদের বিপনেকে নিয়ে যান, তার মতো কিপ্টে ভূভারতে নেই।“
তারপর সবাই মিলে বিপিনবাবুর কিপ্টেমির মেলা গল্প বলে যেতে লাগল। কিন্তু রামভজনবাবুর আষাঢ়ে গল্পটা চিতেনের মোটেই বিশ্বাস হল না। উচ্চবাচ্য করে সে ঘাপটি মেরে একধারে বসে রইল। রামভজনবাবু যখন বিপিনের বাড়ি রওনা হলেন তখন সেও পিছু নিল। জানলায় কান পেতে সে সব কথাবার্তাও শুনল। ধনরত্নের কথাটা তার মোটেই বিশ্বাস হল না, তবে ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা না জেনেই চলবে কী করে চিতেনের!
বিপিনের তিন মাসির কারও মনেই যে সুখ নেই তা চিতেন জানে। কাশীবাসীমাসির বয়স এই অষ্টাশি পেরিয়েছে, হাসিরাশিমাসি ছিয়াশি, আর হাসিখুশিমাসির এই আশি হল। তাঁরা কেউ বিয়ে করেননি, তিনজনে মিলে বোনো বিপিনকে অনেক আশায় মানুষ করেছেন। বিপিন তাঁদের নয়নের মণি। তাঁদের বিষয়সম্পত্তি সবই বিপিনবাবুই পাবেন। এই বাড়িঘর, গয়নাগাটি, নগদ টাকা, সব। কিন্তু হলে কী হয়, বিপিনবাবু বড় হয়ে অ্যায়সা কেপ্পন হয়েছেন যে, মাসিদের ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। হোমিওপ্যাথির শিশিতে করে রোজ এক শিশি সর্ষের তেল আনেন বিপিন। নিয়ম করে দিয়েছেন, তরকারিতে দশ ফোঁটার বেশি তেল দেওয়া চলবে না। তা সেই অখাদ্য তরকারি মাসিরা গিলবেন কী করে? বিপিন ওই অখাদ্যই সোনা-হেন-মুখ করে খান দেখে তিন মাসিই বিরলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
একদিন দুপুরবেলা চিতেন নারকোল পেড়ে দিতে এসে দেখল, তিন বুড়ি বোন চোখের জল ফেলতে-ফেলতে তেঁতুল দিয়ে কোনওরকমে ভাত গিলছেন। কাণ্ড দেখে চিতেন হাতজোড় করে বলল, “মাসিমাগণ, বিপিনবাবু কৃপণ লোক জানি, কিন্তু তা বলে আপনারা কেন কষ্ট করবেন?”
হাসিমাসি বললেন, “তা কী করব বাবা বল, বিপনে যে দশ ফোঁটার বেশি পনেরো ফোঁটা তেল তরকারিতে দিলে ‘ওরে বাবা, এ যে তেলের সমুদুর বলে রাগ করে খাওয়া ফেলে উঠে যায়।”
চিতেন বলল, “মাসিমাগণ, এক-একজনের এক একরকম সুখ! কৃপণের সুখ কৃচ্ছসাধনে। বিপিনবাবু দুঃখ পেতে ভালবাসেন বলেই দুঃখ জোগাড় করে আনেন। তাঁর জন্য আপনাদের দুঃখ হয় জানি, কিন্তু তার ওপর আপনারা যে দুঃখ পাচ্ছেন তাতে দুঃখ যে ডবল হয়ে যাচ্ছে।”
“তা কী করব বাবা, একটা বুদ্ধি দে।”
“আমি বলি কী, বিপিনবাবু যখন দুঃখের মধ্যেই সুখ পাচ্ছেন তখন আপনাদের আর দুঃখ বাড়িয়ে কাজ নেই। দিন, টাকা দিন, আমি চুপিচুপি ভাল-মন্দ কিনে এনে রোজ দিয়ে যাব।”
“সে কি আমাদের গলা দিয়ে নামবে বাবা?”
“ভাল করে তেল-ঘি দিয়ে রান্না করবেন, দেখবেন হড়হড় করে নেমে যাচ্ছে।”
তা সেই থেকে চিনে গোপনে মাসিদের বাজার করে দিয়ে যায় বোজ। সেরা তরকারি, ভাল মাছ, তেল, ঘি। দুধওলাও ঠিক করে দিয়েছে সে। মাসিরা এখন ভাল-মন্দ খেয়ে বাঁচছেন।
কাজেই এ-বাড়িতে চিতেনের বিলক্ষণ যাতায়াত।
ওদিকে বিপিনবাবু ভেতরবাড়িতে এসে শশব্যস্তে হাসিরাশিমাসিকে ডেকে বললেন, “ও মাসি, একজন মস্ত বড় মানুষ এসেছেন আজ। তাঁর জন্য লুচি, আলুর দম, ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ঘন দুধ চাই। তার আগে চা-বিস্কুট। শিগগির থলিটলি দাও, আমি চট করে গিয়ে সব নিয়ে আসি।”
শুনে তিন মাসিরই মুছা যাওয়ার জোগাড়। হাসিমাসি উৎকণ্ঠিত হয়ে বললেন, “কে এসেছে বললি? সাধুটাধু নাকি? শেষে কি হিমালয়-টয়ে নিয়ে যাবে তোকে? ওষুধ করেনি তো!”
“আহাঃ, সেসব নয়। ইনি মস্ত মানুষ। এঁকে খুশি করতে পারলে মস্ত দাঁও মারা যাবে।”
বিপিনবাবু থলিটলি নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যেতেই খুশিমাসি গিয়ে বিপিনবাবুর ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে এসে বললেন, “হ্যারিকেনের আলোয় যা দেখলাম তাতে মনে হল শুটকো মতো এক বুড়োমানুষ। বাঁদুরে টুপি থাকায় মুখটা ভাল দেখা গেল না। তা সে যেই হোক, তার কল্যাণে বিপিনটার পেটেও যদি আজ একটু ভাল-মন্দ যায়!”
উঠোনের দরজা দিয়ে চিতেন ঢুকে পড়ল। বারান্দায় বসা তিন চিন্তিত মাসির দিকে চেয়ে হাতজোড় করে বলল, “মাসিমাগণ, আপনাদের বাড়িতে কে একজন মহাজন না মহাপুরুষ এসেছেন বলে শুনলাম। সত্যি নাকি?”
মাসিদের সঙ্গে চিতেনের সম্পর্ক খুবই ভাল। চিতেন যে একজন উদীয়মান নবীন চোর, তাও মাসিদের অজানা নেই। এমনকী কোন বাড়িতে নতুন বউ এসেছে, কোন বাড়িতে কোন গিন্নি নতুন গয়না কিনল, সেসব সুলুকসন্ধানও মাসিরা চিতেনকে নিয়মিত দিয়ে থাকেন। মাসিদের দৃঢ় বিশ্বাস, চিতেনের যা বুদ্ধি আর এলেম তাতে সে একদিন দেশ-দশের একজন হয়ে উঠবে।
তাই তাকে দেখে তিন মাসিই হাঁফ ছেড়ে ফোলামুখে হেসে বললেন, “আয় বাবা, আয়।”
কাশীবাসীমাসি বললেন, “মহাপুরুষ কি না কে জানে বাবা, তবে বশীকরণ-টরন জানা লোক কেউ এসেছে। ভয়ে আমরা ও-ঘরে যেতে পারছি না।”
চিতেন বুক চিতিয়ে বলল, “মাসিগণ, ঘাবড়াবেন না, আমি গিয়ে বাজিয়ে দেখে আসছি।”
ভজনবাবুর বয়স একশো থেকে দেড়শো বছরের মধ্যেই হবে বলে অনুমান করল চিতেন। দুশো বছর হলেও দোষ নেই। কারণ একটা বয়সের পর মানুষের চেহারা এমন দড়কচা মেরে যায় যে, আর বুড়োটে মারতে পারে না।
তা এই বয়সের মানুষরা সুযোগ পেলেই একটু ঝিমোয় বা ঘুমোয়। কিন্তু ভজনবাবুর ওসব নেই। চিতেন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল, ভজনবাবু তার দিকে জুলজুল করে চেয়ে আছেন।
“তুমি আবার কে হে?”
চিতেন হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমাকে এ বাড়ির কাজের লোক বলে ধরতে পারেন।”
লোকটা চমকে উঠে বললেন, “কী সর্বনাশ! কৃপণের বাড়িতে কাজের লোক! কাজের লোকই যদি রাখবে তা হলে আর তাকে কৃপণ বলা যাবে কী করে? অ্যাাঁ, এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা! তা কত বেতন পাও শুনি?
চিতেন তাড়াতাড়ি জিভ কেটে বলে, “আজ্ঞে, আমি তেমন কাজের লোক নই। বিপিনবাবু নিকষ্যি কৃপণ। কৃপণকুলতিলক বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না। আমি কাজের লোক হলেও বিনিমাইনে আর আপখোরাকি কাজের লোক। বিপিনবাবুর তিন মাসি আছেন, তাঁরা আমাকে একটু-আধটু স্নেহ করেন আর কী!”
“অ! তা কী মনে করে আগমন?”
“আজ্ঞে। মাসিরা জানতে পাঠালেন, আপনার কোনও সেবার দরকার আছে কি না।”
“সেবা! কীরকম সেবা?”
“এই ধরুন, একটু গা-হাত-পা টিপে দেওয়া বা মাথায় বিলি কাটা বা আঙুল মটকানো!”
ভজনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “ও বাবা, ওসব করলে এই বুড়ো শরীরের হাড়গোড় ভেঙে যাবে।”
“তা হলে অন্তত জুতো মোজা খুলে দিই, বাঁদুরে টুপিটাও খুলে ফেলে বেশ জুত করে বসুন।”
ভজনবাবু আতঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন, “না, না, এই বেশ আছি।”
“তা রাত্রিবেলা তো এখানেই দেহরক্ষা করবেন, না কি?”
ভজনবাবু খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “দেহরক্ষা! দেহরক্ষা করব মানে! মশকরা করছ নাকি হে!”
জিভ কেটে হাতজোড় করে চিতেন বলে, “আজ্ঞে মুখসুখ মানুষ কী বলতে কী বলে ফেলি। বলছিলাম, রাতে তো এখানেই ঘাঁটি গাড়তে হবে, না কি!”
ভজনবাবু চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, “তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব লোক দেখছি হে! এখানে ঘাঁটি গাড়ব না তো কি এই শীতের মধ্যে মাঝরাতে বুড়োটাকে বাইরে বের করে দেবে নাকি?”
জিভ কেটে এবং নিজের কান মলে চিতেন ভারী অনুতপ্ত গলায় বলে, “কী যে বলেন ভজনবাবু, শুনলেও পাপ হয়। এই বাড়িঘর আপনার নিজের বলেই মনে করুন। বলছিলুম কী, ভজনবাবু, আপনার কি জুতোমোজা পরেই শোয়ার অভ্যেস?”
ভজনবাবু খ্যাঁক করে উঠে বললেন, “কেন, আমি কি পিচেশ না সাহেব যে, জুতো পরে বিছানায় শোব?”
একগাল হেসে চিতেন বলল, “যাক বাবা, বাঁচা গেল। এমন ঢাকাঁচাপা দিয়ে রেখেছেন নিজেকে যে, চেনার উপায়টি পর্যন্ত নেই। তা বলছিলুম ভজনবাবু, ওদিকে তো মাসিরা ময়দা-টয়দা মেখে ফেলেছে, ছোলার ডাল সেদ্ধ হয়ে এল বলে, তা এই সময়টায় জুতা-মোজা খুলে একটু হাত-মুখ ধুয়ে নিলে হয় না? টুপিটা খুলতে না চান খুলবেন না, কিন্তু যদি অনুমতি করেন তো পায়ের কাছটিতে বসে জুতোজোড়া খুলে দিই। বেশ জাম্বুবান জুতো আপনার, ফিতের ঘর বোধ হয় দশ বারোটা।”
ভজনবাবু একটু দোনোমোনো করে বললেন, “তা খুলতে পারো।”
মহানন্দে চিতেন ভজনবাবুর পায়ের কাছটিতে বসে জুতো খুলতে লেগে গেল। ভজনবাবুর লম্বা ঝুলের কোটটা হাঁটুর নীচে প্রায় গোড়ালি অবধি নেমেছে। ডান দিকের পকেটটা চিতেনের একেবারে হাতের নাগালে। এই পকেটেই মোহর আর হিরেখানা রয়েছে। ডান পায়ের জুতো খুলতে খুলতেই দু আঙুলের ফাঁকে ধরা আধখানা ব্লেড দিয়ে পকেটের কাপড়টা ফাঁক করে ফেলল চিতেন। টুকুস করে মোহর আর হিরেখানা তার মুঠোয় এসে যাওয়ার কথা। কিন্তু খুবই আশ্চর্যের বিষয়, পকেট থেকে কিছুই পড়ল না। তবে কি বাঁ পকেট? নাঃ, এতটা ভুল চিতেনের চোখ করবে না। জানলার ফাঁক দিয়ে সে সবই লক্ষ করেছে। তবে যদি হুঁশিয়ার বুড়ো পকেট বদল করে থাকে তো অন্য কথা। চিতেন বাঁ পায়ের জুতো খোলার সময় বাঁ পকেটটাও কেটে ফেলল, কিছুই বেরোল না।
ফোকলা মুখে একটু হেসে ভজনবাবু বললেন, “কী, পেলে না তো! ওরে বাবা, তোমার মতো কাঁচা চোর যদি আমাকে বোকা বানাতে পারত, তা হলে আর এই শর্মার নাম রামভজন আদিত্য হত না, বুঝলে? পকেটদুটো খামোখা ফুটো করলে, এখন ফের সেলাই করে কে?”
চিতেন একটু বোকা বনে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ভজনবাবুর পা ছুঁয়ে একটা প্রণাম করে বলল, “আপনি ওস্তাদ লোক।”
ভজনবাবু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বললেন, “আনাড়িতে যে দেশটা ভরে গেল রে বাপ! যেমন কাঁচা মাথা, তেমনই কাঁচা হাত। ছ্যাঃ ছ্যাঃ, এইসব দেখতেই কি এতদিন বেঁছে আছি! এর চেয়ে যে মরে যাওয়া অনেক ভাল ছিল।”
চিতেন লজ্জায় কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থেকে খুব অভিমানের সঙ্গে বলল, “তা আমাদের শেখায় কে বলুন! নফরগঞ্জের মতো পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছি, ভাল কোচ পাব কোথায়? ঠিকমতো কোচিং পেলে কি আর খেল দেখাতে পারতুম না! তা ভাগ্যে যখন আপনাকে পেয়ে গেছি তখন আর ছাড়ছি না, দু-চারটে কায়দা শিখিয়ে দিন ভজনবাবু।”
ভজনবাবু ফের খ্যাক করে উঠলেন, “আমি শেখাব? কেন, আমি কি চোর না ছ্যাচড়া? তুমি তো আচ্ছা বেয়াদব হে! ওসব আমার কর্ম নয়। যারা শেখায় তাদের কাছে যাও।”
কাঁচুমাচু হয়ে চিতেন বলল, “আপনার বুঝি এসব আসে না?”
“পাগল নাকি? জীবনে পরদ্রব্য ছুঁইনি। তবে হ্যাঁ, শিখতেই যদি চাও তবে কুঁড়োরহাটের সামন্তকে গিয়ে ধরো। এই অষ্টাশি বছর বয়স হল, তবু বিদ্যে ভোলেনি। ভাল চেলা পেলে শেখায়। পাঁচশো টাকা নজরানা আর সেইসঙ্গে ভালরকম ভেট দিতে ভুলো না। ভেট মানে জ্যান্ত একটা পাঁটা, আস্ত একখানা রুই মাছ, মিহি পোলাওয়ের চাল, গাওয়া ঘি আর তরিতরকারি এইসব আর কী।”
চিতেন লজ্জিতভাবে মাথা চুলকে বলল, “তাই যেতাম ভজনবাবু। কিন্তু ভাবছি কুঁড়োরহাটে সামন্তর কাছে গিয়ে এত বিদ্যে শিখে হবেটাই বা কী? আমাদের কাজ তো এই নফরগঞ্জের মতো অজ পাড়াগাঁয়ে। গেরস্তবাড়িতে ঢুকে পাওয়া যায় তো লবডঙ্কা। বড়জোর কাঁসার বাসন, মোটা ধুতি, মোটা শাড়ি, খুব বেশি হলে ফিনফিনে সোনার একটা চেন বা মাকড়িটাকড়ি। পাইলট হয়ে এসে কি শেষে গোরুর গাড়ি চালাব মশাই?”
ভজনবাবু ফোকলা মুখে একগাল হেসে বললেন, “তা বটে। ভাল চোরেরও আজকাল পেট ভরে না। দেশে খুবই অরাজক অবস্থা।”
“তা ইয়ে, বলছিলুম কি ভজনবাবু, একটা কথা ছিল।”
“কী কথা হে?”
“আমি আড়ি পেতে আপনার আর বিপিনদাদার কথাবাতা সবই শুনেছি। তা মশাই, আপনি কৃপণ লোক কেন খুঁজছেন সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”
“বুঝতে মাথা চাই, বুঝলে? কৃপণ লোক কেন খুঁজছি এটা বুঝতে পারা শক্তটা কী? কৃপণের কাছে কিছু থাকলে সে সেটা বুক দিয়ে আগলে রাখবে, মরে গেলেও খরচ করবে না। তাই কৃপণ হল ব্যাঙ্ক। এক তাল সোনা তাকে দিয়ে তীর্থভ্রমণে চলে যাও। তিন মাস পরে এসে দেখবে এক তাল সোনাই রয়েছে, এক রতিও খরচ হয়নি।”
“সেটা ঠিকই। তবে কৃপণ নিজের জিনিসই আগলায়, অন্যের গচ্ছিত রাখা জিনিসও কি আগলাবে ভাবেন?”
“দুর বোকা, অন্যের জিনিস বলে ভাবতে দেবে কেন? তাকে এক তাল সোনা দিয়ে বলল, এটা তোমাকে দিলুম।”
“তারপর?”
“তারপর এসে একদিন তাপ্পি মেরে হাতিয়ে নিলেই হল।”
চিতেন চোখ বড় বড় করে বলল, “আপনি যে সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই।”
“সাঙ্ঘাতিক কি না জানি না, তবে গবেট নই।”
“তা হলে ভজনবাবু, আপনি সত্যি-সত্যিই ওইসব সোনাদানা আর হিরে-জহরত বিপিনবাবুকে দিচ্ছেন না।”
ভজনবাবু ফের ফোকলা মুখে হেসে বললেন, “তাই কি বলেছি? ওরে বাবা, আমারও তো বয়স হল, না কি! এই একশো পেরিয়ে দেড় কুড়ি। তোমাদের হিসেবে একশোত্রিশ বছর। দু-চার বছর এদিক-সেদিক হতে পারে, কিন্তু কবে পটল তুলি তার ঠিক কী? তা আমি পটল তুললে তোমার ওই বিপিনবাবুই সব পাবে।”
একটা শ্বাস ফেলে চিতেন বলল, “বুঝেছি। বিপিনবাবুকে আপনি জ্যান্ত যখ করে রেখে যেতে চান।”
“নাঃ, তুমি একেবারে গবেট নও তো! বুদ্ধি আছে।”
“তা ভজনবাবু, এই যে আপনি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এখন আপনার ধনসম্পত্তি দেখাশোনা করছে কে?”
“তার ভাল ব্যবস্থা আছে। গজানন, ফুলমণি, নরহরি সব দিনরাত চোখে চোখে রাখছে।”
“তারা কারা? আপনার ছেলেমেয়ে বুঝি?”
“ওরে বাবা, না। তারা সব অশরীরী।”
“অশরীরী মানে! ভূত নাকি?”
“মানে তো তাই দাঁড়ায়। তবে কিনা সামনেই ফাল্গুন মাস। ফাল্গনে নয়নপুরে শিবরাত্রির মেলা। সেখানে ভূতেদেরও মস্ত মেলা হয়। বছরে এই একটাই তাদের বড় পরব। তাই সবাই মাঘ মাসেই সেখানে দলে দলে গিয়ে হাজির হয়। আমার মুখ চেয়ে তারা পাহারা দিতে রাজি হয়েছে বটে, কিন্তু দেরি দেখলে সব নয়নপুরে পালাবে। ভূতেদের বিশ্বাস কী বলো!”
চিতেন বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, “আপনার ভয়ডর নেই নাকি মশাই?”
“খুব আছে, খুব আছে। প্রথম যখন সেখানে গিয়ে হাজির হই, চারদিকে দুর্দম জঙ্গল, কয়েক ক্রোশের মধ্যে লোকালয় নেই। ভাঙা পোড়ো বাড়ির মধ্যে বিষধর সাপখোপ ঘুরে বেড়ায়, শেয়ালের বাসা, নেকড়ে বাঘের আনাগোনা তো আছেই, তার ওপর গিসগিস করছে ভূত। সে কী তাদের রক্ত-জল-করা হিঃ হিঃ হাসি, কী দুপদাপ শব্দ, কী সব ভয়ঙ্কর দৃশ্য।”
“আপনার ভয় করল না?”
“করেনি আবার! দাঁতকপাটি লেগে যাই আর কী! তবে কিনা সোনাদানা, হিরে-জহরতের মায়াও কি কম! তাই মাটি কামড়ে পড়ে ছিলাম। ওই দু-চারদিন যা ভয়টয় করেছিল। তারপর দেখলাম, ভূতকে ভয় করে লাভ নেই। বরং ভাব জমাতে পারলে লাভ। ভূতেরাও দেখল, আমাকে তাড়ানো সহজ নয়। তাই তারাও মিটমাট করে নিল। এখন বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলছে।”
“আর সাপখোপ?”
“তাদেরও আমি ঘাটাই না, তারাও আমাকে ঘাঁটায় না। জঙ্গলেরও একটা নিয়ম আছে। তোমাদের মতো অরাজক অবস্থা নয়। যে যার নিজের এলাকায় নিজের কাজটি নিয়ে থাকে, অযথা কেউ কাউকে বিরক্ত করে না।”
“ঠিক এই সময়ে কাশীবাসীমাসি এক কাপ গরম চা আর পিরিচে দুখানি বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ভজনবাবু একগাল হেসে বলে উঠলেন, “এসো খুকি, এসো। তা নামটি কী তোমার?”
কাশীবাসীমাসি ভয়-খাওয়া ফ্যাঁসফ্যাসে গলায় বললেন, “আজ্ঞে, আমি কাশীবাসী। আপনি মহাজন মানুষ, গরিবের বাড়িতে একটু কষ্ট হবে। বিপিন বাজার থেকে এসেই আপনার জন্য ময়দা মাখতে বসেছে। এল বলে?”
“আহা, তার আসার দরকার কী? মাখুক না ময়দা। ময়দার ধর্ম হল যত মাখা যায় ততই লচি মোলায়েম হয়। কী বলো হে?”
চিতেন মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, অতি খাঁটি কথা। তা ভজনবাবু, এই সাঙ্ঘাতিক জায়গাটা ঠিক কোথায় বলুন তো! কাছেপিঠেই কি? না কি একটু দূরেই?”
ভজনবাবু চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে একটা আরামের শ্বাস ফেলে বললেন, “কাছে না দূরে, পুবে না পশ্চিমে সেসব বলে কি নিজের আখের খোয়াব হে? আমাকে অত আহাম্মক পাওনি।”
“আজ্ঞে তা তো বটেই। সবাইকে বলে বেড়ালে আর গুপ্তধনের মানমর্যাদা বলেও কিছু থাকে না কিনা। মোহর তা হলে ওই সাত ঘড়া-ই তো! না কি দু-চার ঘড়া এদিক-সেদিক হতে পারে?”
“পাক্কা সাত ঘড়া। গত ষাট বছর ধরে রোজ গুনে দেখছি, কম-বেশি হবে কী করে?”
“আর ইয়ে ভজনবাবু, হিরে-মুক্তো কতটা হবে?”
“তা ধরো আরও সাত ঘড়া।”
“আপনি প্রাতঃস্মরণীয় নমস্য মানুষ। একটু পা টিপে দেব কি ভজনবাবু?”
“খবরদার না।”
“আচ্ছা, আপনার তো একজন কাজের লোকও দরকার, নয় কি? বয়স হয়েছে, জঙ্গলে একা থাকেন।”
“একাই দিব্যি আছি।”