ধীর পায়ে দুজন এগিয়ে এল। লম্বা লোকটি ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে ইংরিজিতে বলল, “কগ্র্যাচুলেশন্স। তুমি খুব ভাল বক্সার।”
রতন অবাক হয়েছিল ঠিকই। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার সঙ্গে করমর্দন করে ইংরিজিতে বলল, “ধন্যবাদ। কিন্তু তোমরা কারা? বিদেশী?”
লম্বা লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ঠিক ধরেছ। আমরা বিদেশী। আমার নাম জন, আর আমার এই বন্ধুর নাম রোলো।”
ভদ্রতাবশে রতন রোলোর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল। কিন্তু জন টপ করে তার হাতটা ধরে ফেলে বলল, “ও কাজ কোরো না। রোলোর কোনো সৌজন্যবোধ নেই।”
রতন ভাল করে তাকিয়ে দেখল, রোলোর মুখে একটা অত্যন্ত নিষ্ঠুর নির্দয়তার চিহ্ন আছে। চোখ দুটো আধবোজা এবং পলকহীন। মুখে কেমন একটা বোকা-বোকা ভ্যাবলা ভাব। রোলোর দিকে তাকালে খুব সাহসী লোকেরও অজ্ঞাত কারণে একটু গা ছমছম করবে।
জন বলল, “তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করতে এসেছি বলে কিছু মনে কোরো না। তোমার সঙ্গে আমাদের একটু গোপনে দেখা করা দরকার ছিল। আমরা বিদেশী, তাই সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। গভীর রাত ছাড়া উপায় ছিল না।”
রতন একটু হেসে বলল, “কিন্তু এখন তো আমার ঘুমিয়ে থাকার কথা। আজ ঘুম আসেনি বলে আমি বাইরে এসেছিলাম। এলে তোমরা কী করতে!”
জনও হাসল। তারপর মৃদুস্বরে বলল, “তুমি বাইরে না এলে আমরা তোমার ঘরে যেতাম। আমাদের দরকারটা জরুরি।”
রতন আগাগোড়া একটা অস্বস্তি বোধ করছে। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে, এরা খুব সহজ সাধারণ লোক নয়। বক্সিং করতে গিয়ে রতনকে সাহেব-সুবোর সঙ্গে অনেক মিশতে হয়েছে। এরা দুজন তাদের মতো নয়। এদের চারদিকে একটা রহস্যের ঘেরাটোপ রয়েছে।
রতন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি, তোমরা বক্সিং দেখে বেড়াচ্ছ নানা জায়গায়। তোমরা কি বক্সিং ভালবাসো?”
“নিশ্চয়ই। আমরা সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছি ভাল প্রতিভাবান ন্যাচারাল বক্সার খুঁজে বের করতে। তোমার মধ্যে আমরা সেইরকম একজনকে খুঁজে পেয়েছি।”
রতন একটু অবাক হয়ে বলল, “আর সেই জন্যই এত রাতে আমার কাছে এসেছ?”
জন মৃদু হেসে বলল, “অনেকটা তাই। আমরা তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে প্রফেশন্যাল বক্সিং-এ নামাতে চাই।”
আমেরিকায় যাওয়ার কথায় রতন খুশি হয় ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে আর একটা কারণে তার মন খারাপ হয়ে যায়। সে বলে, “কিন্তু আমার বাবাকে ফেলে আমেরিকায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার বাবা পাগল। তাঁকে খাওয়াবে পরাবে কে?”
জন একটু চুপ করে থেকে বলে, “শুনে দুঃখ পেলাম। তবে তুমি যদি চাও তো তোমার বাবাকেও আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি। সেখানে মানসিক রুগিদের ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তোমার বাবা হয়তো সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। এবং তাঁর বিজ্ঞান-গবেষণা আবার শুরু করতে পারবেন।”
বিজ্ঞান-গবেষণা! শুনে চমকে উঠল রতন। বলল, “আমার বাবা যে বিজ্ঞানের গবেষণা করতেন, সে কথা তোমরা জানলে কী করে?”
“তোমার সম্পর্কে আমরা সবরকম খোঁজ-খবর নিয়েছি।”
রতন বলল, “আমেরিকায় যাওয়ার অনেক খরচ। সে-টাকা কে দেবে?”
“আমি দেব। আমেরিকায় আমি হব তোমার ম্যানেজার। তুমি যখন বক্সিং থেকে অনেক টাকা রোজগার করবে, তখন এই টাকা শোধ হয়ে যাবে। ওটা নিয়ে ভেবো না।”
“তুমি কি আমেরিকান?”
জন ম্লান হেসে মাথা নাড়ল, “না। আমি আমেরিকান নই। আমি পৃথিবীর সব ধনী দেশের শত্রু।”
“তার মানে?”
“মানেটা আস্তে-আস্তে বুঝতে পারবে। তবে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে শত্রুতা করতে হলে তেমনি শক্তিশালী অস্ত্র চাই। শুধু বক্সিং দিয়ে তো ওদের ঘায়েল করা যাবে না।” বলে জন একটু হাসল। তারপর বলল, “কথাগুলো তোমার কাছে ধাঁধার মতো লাগছে, না?”
রতন মাথা নেড়ে বলল, “হয়তো আমি ইংরিজি ভাল জানি না বলেই তোমার সব কথা বুঝতে পারছি না।”
জন মাথা নেড়ে বলল, “ইংরিজির দোষ নেই। তুমি তো খুব সুন্দর ইংরিজি বলো। বোধহয় ভালো কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়েছ, তাই না?”
রতন মাথা নিচু করে বলল, “হ্যাঁ।”
“তোমাদের ইংরিজি ভাষার প্রতি একটা হ্যাংলামি আছে। তা হোক, ইংরিজি ভাষা তোমার বিস্তারে সাহায্য করবে। সেই সঙ্গে যদি ইংরেজদের গুণগুলো পেতে তাহলে আরো ভাল হত।”
রতন লজ্জায় একটু রাঙা হল। বলল, “তোমার কি আর কোনো কথা আছে?”
জন গম্ভীর গলায় বলল, “আছে, তোমার বাবা যখন পাগল হয়ে যান তখন তিনি কোন্ বিষয়ে গবেষণা করছিলেন তা কি তুমি জানো?”
“না। বাবার যখন মাথা খারাপের লক্ষণ দেখা দিচ্ছিল তখন আমি খুব ছোট।”
জন গলাটা একটু খাটো করে বলল, “সেই সময়ে তোমার বাবার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। তাকে তোমার মনে আছে?”
রতন বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, “বাবার সঙ্গে আমার তেমন যোগাযোগ ছিল না। আমি দিল্লির একটা ভাল স্কুলে পড়তাম, থাকতাম বোর্ডিং-এ। তবে শুনেছি বাবার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল, তার নাম বোধহয় ছিল রাব্বি।”
জন একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, “হ্যাঁ। রবিন ফরডাইক; ওদের পরিবার ছিল জার্মান ইহুদি।”
“আমি অত জানি না। রাব্বিকে আমি দেখিনি।”
জন মৃদুস্বরে বলে, “তোমার বাবা যখন আমেরিকায় ছিলেন, তখন রবিনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। রবিন বা রাব্বি খাঁটি ইহুদি নয়। তার মা ছিল ব্যাংককের মেয়ে। রবিন যেমন মেধাবী তেমনি ধূর্ত। সে ভেবেছিল তোমার বাবাকে ভাঙিয়ে সারা দুনিয়া জুড়ে একটা একচেটিয়া ব্যবসা করবে।”
রতন হাঁ করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আমি তো এতসব জানি না। শুধু শুনতে পাই আমার বাবাকে তাঁর এক অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি কী একটা ওষুধ খাইয়ে পাগল করে দিয়েছিল।”
জন বলল, “হতে পারে। তবে যে-উদ্দেশ্যে রবিন তোমার বাবার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়েছিল তা সফল হয়নি। তুমি বিজ্ঞানের কিছু জানো?”
“খুব সামান্য। বাবা পাগল হয়ে যাওয়ায় আমি বেশিদূর
পড়াশুনো করতে পারি নি। সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করি।”
“তবু এটা তো জানো যে, সারা দুনিয়ায় এখন একটা এনার্জি ক্রাইসিস চলছে!”
“কিছুটা জানি। মাটির নীচে খনিগুলির কয়লা ফুরিয়ে আসছে, শেষ হয়ে আসছে পেট্রোলিয়ম, পারমাণবিক শক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়ামের ভাণ্ডারও অফুরন্ত নয়।”
“বাঃ, তবে তো অনেকটাই জানো। আর এই শক্তি বা তাপের যে দুর্ভিক্ষ দুনিয়ায় শিগগিরই দেখা দেবে তার জন্য বিশ্বের সব ছোটবড় রাষ্ট্রই যে সমুদ্র বা সূর্যরশ্মি থেকে বিকল্প শক্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে, তাও তো জানো!”
“জানি। তবে সে কাজে মানুষ এখনো সম্পূর্ণ সফল হয়নি।”
“ঠিক। তোমার বাবা যে গবেষণাটা করছিলেন, তাও এই এনার্জি নিয়েই। তিনি অবশ্য কোনো বিকল্প শক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করছিলেন না। তবে তিনি সফল হলে দুনিয়া থেকে চিরকালের মতো এনার্জি ক্রাইসিস বিদায় নিত।”
“সেটা কী জিনিস?”
“তাঁর কাজটার নাম ছিল হিট অ্যামপ্লিফিকেশন। নামটা অবশ্য খুব সুন্দর নয়, কিন্তু কাজটা ছিল দারুণ গুরুতর।”
“কী রকম?”
“শব্দকে যেমন অ্যামপ্লিফায়ারে বহুগুণ বাড়ানো যায়, তেমনি তাপকেও হয়তো বাড়ানো সম্ভব। তাপ বিবর্ধন নিয়েও সারা দুনিয়ায় গবেষণা চলছে। কিন্তু আমরা খবর রাখি, তার মধ্যে তোমার বাবাই লক্ষের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু ঠিক সেইসময়ে একটা গুরুতর কিছু ঘটে যায় এবং তিনি পাগল হয়ে যান। রবিনও তাঁকে ছেড়ে পালিয়ে যায়।”
লোকটা ভাল না খারাপ তা বুঝতে পারছে না রতন। ওর মতলবটা কী তাও সে এখনো সঠিক জানে না। তবে তার বাবার আবিষ্কার সম্পর্কে যে এ-লোকটা খবর রাখে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
রতন বলল, “অতীত নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? যা চুকেবুকে গেছে তা আবার খুঁচিয়ে তুলতে আমার খারাপ লাগে।”
জন একটু হাসল। তারপর বলল, “ভারতীয়রা সব ব্যাপারেই একটু উদাসীন আর নির্লিপ্ত থাকতে ভালবাসে। আর তার জন্যই ভারতের উন্নতি ঘটেনি, ঘটবেও না। কিন্তু আমরা যারা বেঁচে থাকতে ভালবাসি এবং দুনিয়াকে দখল করার স্বপ্ন দেখি, তারা সহজে কিছু ছেড়ে দিতে রাজি নই। তোমার বাবা কেন পাগল হলেন বা তাঁর আবিষ্কারের মূল্য কতটা তা জানার আগ্রহ তোমার থাকা উচিত। তিনি যদি সত্যিই হিট অ্যামপ্লিফায়ার আবিষ্কার করে থাকেন তবে তার দাম এখনকার দুনিয়ায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। তুমি মহম্মদ আলির মতো বড় বক্সার হলেও কোনোদিন তো ডলার রোজগার করতে পারবে না।”
রতন কী বলবে? চুপ করে রইল।
জন তার কাঁধে একখানা হাত রেখে বলল, “কাল তুমি তোমার দলের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাও। আমরা দু চারদিনের মধ্যেই তোমার সঙ্গে দেখা করব।”
এই বলে জন আর রোলে চলে গেল। তাদের হঠাৎ আসা আর হঠাৎ চলে যাওয়াটা এমনই অস্বাভাবিক যে, ঘটনাটা স্বপ্ন না সত্য, তা নিয়ে রতনের একটু ধাঁধা রয়ে গেল।