২. দ্বিতীয় অঙ্ক–নিঃসন্দেহ

দ্বিতীয় অঙ্ক–নিঃসন্দেহ

০১.

 একটি চিঠি

মাঝে মাঝে অবকাশ যাপন করতে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরের একটি শহরে আসেন। এবারেও তিনি সমুদ্রে কাছাকাছি ছোট্ট বাড়িটিতে উঠেছেন। বাগানে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন তিনি। হঠাৎ একজায়গায় তার দৃষ্টি আটকে গেল। পরলোকে স্যার বার্থালমিউ। তিনি সম্পূর্ণ খবর মন দিয়ে পড়লেন। কি নিদারুণ দুঃসংবাদ! হাত থেকে কাগজ পড়ে গেল। নানান কথা স্মৃতি হয়ে ফিরে এলো। বারে বারে খবরের কাগজের কয়েকটি কথা মনে পড়লোতর আকস্মিক জীবনাবসান, কফি পান করিতেছিলেন, চিকিৎসক আসিবার পূর্বেই তাহার মৃত্যু

আর একটি আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে আশ্চর্য ধরনের মিল রয়েছে।

স্যার চার্লসকে আসতে দেখে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট আশ্চর্য হলেন। জানা গেল তিনিও কাগজ থেকে এই দুঃসংবাদটি অবগত হয়েছেন।

সত্যি, এভাবে টলি যে চলে যাবে, ভাবতে পারি না শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট।

–স্বৰ্গত ব্যারিংটনের মৃত্যুর সঙ্গে এই মৃত্যুর বিস্ময়কর সাদৃশ্য আছে।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

একসময় চার্লস বললেন– হারমিয়োনের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলাম। এর আগে অবশ্য একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেটার উত্তর দিইনি। সকলের পাগলামিতে তো সব সময় প্রশ্রয় দেওয়া যায় না। তবে এই চিঠিটা একটু অন্যরকমের।

-কি রকম?

বলা যেতে পারে, এটি একটি সাহয্যের জন্য আবেদন। চার্লস পকেট থেকে চিঠিটা বের করে দিলেন। নিন, পড়ে দেখুন।

শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট চিঠিটা পড়লেন, তবে চিঠির সারমর্ম ছিলো–

বার্থালমিউয়ের মৃত্যুর দিন হারমিয়োন ও তার মা ইয়র্কশায়ারের বাড়িতে এক পার্টিতে উপস্থিত ছিলো। তাদের চোখের সামনে ঘটেছে সেই নিদারুণ ঘটনা। তার ধারণা, স্যার বার্থালমিউ এবং শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য একই সূত্রে গাঁথা। তার ধারণা, একমাত্র স্যার চার্লস এই রহস্য উদঘাটন করতে পারেন?

চিঠির প্রসঙ্গ নিয়ে আর কোনো আলোচনা হলো না।

–আচ্ছা, সেদিনকার পার্টিতে কারা কারা ছিলেন?

–কেন, কাগজেই সবার নাম ছিলো। স্যার চার্লস খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে জায়গাটা দেখালেন।

লর্ড ও লেডি এডেন, লেডি মেরি লিটন গোর, স্যার জোসেলিন ও লেডি ক্যাম্বেল, ক্যাপটেন ও শ্রীযুক্তা ডেকার্স, শ্ৰীমতী এঞ্জেলা সাট ক্লিফ।

–অলিভার ম্যানডার্সের নাম নেই। স্যার চার্লস বললেন।

 এমন সময়ে পরিচারক এসে খানকয়েক চিঠি এবং একটি অর্ধ সাপ্তাহিক সংবাদপত্র শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে দিয়ে গেল। সংবাদপত্রটি স্যার চার্লস হাত বাড়িয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

একটু পরেই প্রায় চীৎকার করে বললেন–শুনুন শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট, কাগজ কি বলছে। বার্থালমিউর মৃতদেহ ময়না তদন্ত করে দেখা গেছে যে নিকোটিন জাতীয় বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।

–এখন বসে থাকলে চলবে না। স্যার চার্লস বললেন। ইংলণ্ডে আপাততঃ ফিরে যাবো, তারপর কি করা যায় ভাবা যাবে।

তাহলে আমিও তাই করবো। ঐ অঞ্চলের পুলিসের বড়কর্তা কর্ণেল জনসন আমার বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি। আমি গেলে হয়তো আপনাদের কাজে লাগলেও লাগতে পারি।

 শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট সমুদ্রতীরের কাছে একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লেন। একটু দূরে একজন মহিলা একটি সাপ্তাহিকী পড়ছেন। একটি শিশু বালি নিয়ে খেলা করছে। আরো একটু দূরে একজন ভদ্রলোক বসে আছেন পেছন ফিরে। তবে তাকে চেনা মনে হলো তার।

শিশুটির হাসি শুনে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ফিরে তাকালেন। ঐ ভদ্রলোকও মুখ ফেরালেন। দুজনে চোখাচোখি হলো।

–আরে এরকুল পোয়ারো, আপনি এখানে। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন শ্রীযুক্ত। স্যাটার্থওয়েট। আধঘন্টা আগে স্যার চার্লসের সঙ্গে দেখা হলো। আবার এখন আপনার সঙ্গে। কি ব্যাপার বলুন তো?

 স্যার চার্লস, এখানে আছেন নাকি?

হ্যাঁ, উনি বরাবরের জন্য লুমাউন ছেড়ে চলে এসেছেন। আপনার বোধ হয় জানা নেই।

–না, জানতাম না। তবে লুমাউনে তার থাকার একটা কারণ ছিলো। বলা যেতে পারে, একটি সুন্দরীই সেই কারণ। কিন্তু মেয়েটি সত্যিই স্যার চার্লসকে ভালোবাসতো। তাহলে কেন পালিয়ে আসা? অবশ্য কোনো মেয়েকে পিছু ধাওয়া করানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হলো তার কাছ থেকে পলায়ন।

পোয়াবোর অনেক কথার মাথামুণ্ডু শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বুঝতে পারলেন না। তিনি কি ভেবে স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংবাদ সম্বলিত সংবাদপত্রটি পোয়রোর হাতে এগিয়ে দিলেন।

গম্ভীরভাবে তিনি খবরটা পড়লেন। পলকের জন্য তার চোখে কাঠিন্য জ্বলে উঠলো। শান্ত ভাবে সংবাদপত্রটি ফিরিয়ে দিয়ে বললেন স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু একটু আশ্চর্যজনক, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

–স্যার চার্লসের অনুমানের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে শ্রীযুক্ত পোয়ারো।

–হতে পারে, তিনি শিল্পী মানুষ। শিল্পীদের কল্পনা ও অনুমানশক্তি একটু বেশিই থাকে। অবশ্য এর ফল সবসময় মঙ্গলজনক নাও হতে পারে। বেশ, স্যার চার্লসের খবর কি?

–তিনি আর আমি আজ রাতেই ইংলণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছি।

–তাহলে তিনি শৌখিন ডিটেকটিভ হতে চলেছেন। নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?

–হারমিয়োন তাঁকে ফিরে যাওয়ার জন্য মিনতি জানিয়ে চিঠি লিখেছে।

–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, ভাবছি অন্য কথা…মানব প্রকৃতির জ্ঞান কি সাংঘাতিক।

আর ভালো লাগছিল না স্যার স্যাটার্থওয়েটের। লণ্ডনের ঠিকানাযুক্ত একটি কার্ড পোয়ারোকে দিয়ে তিনি ওখান থেকে বিদায় নিলেন।

পোয়ারো চুপ করে বসে থেকে একসময় উঠে দাঁড়ালেন। টিকিটঘরের দিকে এগোলেন।

.

০২.

পলাতক খানসামা

পুলিস অফিসার কর্ণেল জনসন ও তার সহকারী ক্রস ফ্রিল্ড সুবিখ্যাত অভিনেতা স্যার চার্লস কার্টরাইটকে তাদের অফিস ঘরে ঢুকতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তাঁকে স্বচোক্ষে দেখতে পারবেন তারা তা স্বপ্নেও ভাবেননি।

শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটকে সঙ্গে নিয়ে স্যার চার্লস গিয়েছিলেন স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্যাবলী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে।

–আমরা তার হত্যাকারী কে জানতে পেরেছি। স্যার বার্থালমিউ মৃত্যুর দিন পনেরো আগে এলিস নামে এক খানসামাকে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ঐ ঘটনা ঘটার পরদিনই সে নিরুদ্দেশ হয়। সে পালিয়ে গিয়ে আমাদের সন্দেহকে আরো ঘন করে তুলেছে।

–সে পালালো কেন? আপনারা তো বলছেন, পুলিস তাকে সন্দেহ করেনি।

তার ধারণা ছিল, পুলিস তাকে সন্দেহ করছে। আমরা বাড়ির প্রত্যেকটি লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। স্যার জোনেলিন ক্যাম্বেল এবং ডাঃ ডেভিস স্যার বার্থলমিউয়ের মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন।

–খবরে প্রকাশ নিকোটিন জাতীয় বিষক্রিয়ায় স্যার বার্থালমিউয়ের মৃত্যু হয়, তাই তো?

-হ্যাঁ, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে নিহত ব্যক্তি ঐ বিষ খেয়েছিলেন। যে সব কাপে অতিথিরা এবং স্যার বার্থলমিউ কফি পান করেছিলেন সেগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু কোনোটিতেই নিকোটিন পাওয়া যায়নি।

স্যার চার্লস এবার শ্রীযুক্ত ব্যারিংটনের মৃত্যুর কথা বিস্তারিতভাবে জানালেন কর্ণেল জনসনকে।

–আচ্ছা, কর্ণেল, আপনি স্যার বার্থালমিউয়ের সমস্ত কাগজপত্র খুঁটিয়ে দেখেছেন? শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট জিজ্ঞাসা করলেন।

–হ্যাঁ, আমরা তার সেক্রেটারি শ্রীমতী লিণ্ডনের সহযোগিতায় তার সমস্ত কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখেছি। সন্দেহজনক কিছু পাওয়া যায়নি, যার সঙ্গে এই মৃত্যুর কোনো সম্পর্ক আছে।

-আচ্ছা, ঐ দিন ঐ সময়ে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন, বলতে পারেন?

 একটা নাম লেখা কাগজ এগিয়ে দিলেন কর্ণেল জনসন। দেখা গেল, সেক্রেটারি, পাচিকা, পরিচারিকা পাঁচজন, অতিথি সাত জনের নাম রয়েছে।

–দেখছি, ঐ দিন শ্ৰীমন অলিভার ম্যানভার্স হাজির ছিলেন। স্যার চার্লস বললেন।

-হ্যাঁ, সেদিন তিনি ওখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসতে গিয়ে একটা পাঁচিলে ধাক্কা মারেন। ফলে গাড়ি বিগড়ে যায় বাইমিউয়ের সঙ্গে ওর চেনা জানা ছিল। তাই তিনি তাকে তাঁর বাড়িতে থাকার আমন্ত্রণ জানান। তাই তিনি তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন দুর্ঘটনা ঘটার পর।

–আচ্ছা, আমরা চাই স্যার বাংলিমিউয়ের বাড়িটা একটু পরীক্ষা করে দেখতে। সেখানকার লেবেদের সঙ্গে কয়েকটা কথা বলবো আপনাদের আপত্তি নেই তো?

–আপত্তি নেই তবে নতুন কিছু পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না!

 কর্ণেল জনসনের কাছ থেকে ওঁরা বিদায় নিয়ে ফিরে এলেন।

.

০৩.

কোন্ জন?

–আপনি তাহলে বিশ্বাস করেন যে দুটি মৃত্যুর মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে? স্যাটার্থওয়েট প্রশ্ন করলেন।

–হ্যাঁ, সেই রকম তো আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে আবিষ্কার করতে হবে সেই যোগসূত্রটি কি?

ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। দুটি পার্টিতেই উপস্থিত ছিলেন এমন লোকের সংখ্যা কিন্তু বেশি। এটাকে কি বলবেন?

–সমাগতন।

–না, আমি বলবো পরিকল্পনা। টলির, মানে আপনাদের স্যার বার্থালমিউয়ের পরিকল্পনা। আশা করি, আমি তাকে আপনাদের থেকে বেশি জানতাম। কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে গভীর ভাবে ভাবতো। কোনো কাজ শুরু করার আগে রীতিমত ছক করে কাজে নামতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ব্যারিংটনকে হত্যা করা হয়েছিল। আমার সঙ্গে টলিও একমত ছিলো, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ না করে আমাকে উল্টে সাবধান করে দিয়েছিলো। আমি জানি, সে ঐ হত্যা রহস্য উদঘাটন করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। সেই উদ্দেশ্য নিয়ে সে ব্যারিংটনের মৃত্যুদৃশ্য পুনরাভিনয়ের আয়োজন করলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় হত্যাকারী ধরা পড়লো না। বরং তার মৃত্যু হলো।

-কিন্তু খানসামাটা যদি দোষ না করে থাকবে তাহলে পালালো কেন?

–হতে পারে। ওর বিরুদ্ধে এর আগে ছোটখাটো কোনো অপরাধের জন্য পুলিসের খাতায় নাম লেখা আছে। তাই পুলিসের হাঙ্গামা এড়াতে সে পালিয়েছে।

–তাহলে আপনার ধারণা, অতিথিদের মধ্যে কেউ একজন এই জঘন্য কাজ করেছে? স্যার স্যাটার্থওয়েট জানতে চাইলেন।

–হুঁ!

কাকে সন্দেহ হয়?

–এর উত্তর দেওয়া মুশকিল। একটু চিন্তা করলে দেখা যায় কাউকেই সন্দেহ করা চলে না। আবার এটাও বোঝা যাচ্ছে, এঁদের মধ্যেই হত্যাকারী লুকিয়ে আছে।

অলিভার ম্যানডার্স সম্পর্কে আপনার কি মনে হয়?

–একথা বলেছেন নে? স্যার চার্লস বললেন। এ ব্যাপারে তাকে আমার সন্দেহ হয় না। কারণ সে সেদিন আচমকা এসে পড়েছিল। সে মোটেও উলির নিমন্ত্রিত ছিল না। আপাততঃ পেটে কিছু না পড়লে বুদ্ধি খুলবে না।

ওঁরা দুজনে একটা বেঁস্তোরায় গিয়ে ঢুকলেন।

.

০৪.

বার্থালমিউয়ের বাসভবন

ইয়র্কশায়ারের এই প্রাসাদের মত পুরোনো বাড়িটি কিনে নতুন করে সংস্কার করেন স্বর্গত বাথালমিভ। কাছাকাছি একটি আরোগ্য নিকেতন গড়ে তুলেছিলেন।

স্যার চার্লস আর শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বার্থালমিউয়ের বাসভবনের বৈঠকখানায় বসে বাড়ির পাচিকা শ্রীযুক্তা মাহালেকির সঙ্গে কথা বলছিলেন। পনেরো বছর ধরে তিনি এখানে রান্না ছাড়া অন্যান্য কাজও করে চলেছেন। অন্যান্য পরিচারিকাদের চালনা করার দায়িত্ব ছিলো তার ওপর।

শ্রীযুক্তা লেকি কেঁদে চোখ ভেজালেন। বললেন–এমন মানুষটা চলে গেল। কোনোদিন কাউকে কড়া কথা বলতে শুনিনি। লোকের উপকার করেছেন অনেক।

–আচ্ছা, এলিস অর্থাৎ যে খানসামাটা পালিয়ে গেছে, তার সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?

–ওর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানি না। পনেরো দিন আগে এসেছিল, মাত্র দুমাসের জন্য ওকে বহাল করা হয়েছিল। কারণ ও বেকারের পরিবর্তে কাজ করতে এসেছিল। বেকার সাত বছর ধরে এখানে কাজ করছে। হালে সে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কর্তা ওকে হাওয়া বদলের জন্য পাঠিয়ে দেন। তাই এলিস এখানে কাজ করছিল।

এলিস সম্পর্কে আরো কিছু জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিস ওকে হত্যার দায়ে সন্দেহ করছে। কিন্তু আমার কোনো সন্দেহ হয় না ওর ওপর। তবে ও আমাদের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বা মেলামেশা করতো না। হয়তো নতুন বলে এরকম আচরণ করেছে।

তার চেহারার বৈশিষ্ট্য ছিল?

–একটু কুঁজো, লম্বা, চেহারা খারাপ নয়। বাইরে বেরোবার সময় কালো চশমা ব্যবহার করতো চোখের অসুখ আছে বলে।

ঘটনার দিন তার আচরণ কেমন ছিল? স্যার স্যাটার্থওয়েট জানতে চাইলেন।

–সেদিন আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম। এলিসও তার ব্যতিক্রম ছিল না। কর্তার মৃত্যুতে আমরা ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। কান্নাকাটি করেছিলাম। তবে ওকে তেমন মুষড়ে পড়তে দেখিনি। সে আমাদের সাধ্যমত সেবাযত্ন করেছিল।

–সেদিন রাত্রি থেকে সে উধাও তাই না?

–হ্যাঁ।

এবার আমরা অন্যান্য পরিচারিকাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই, আপনার যদি আপত্তি না থাকে।

–আপত্তি করার কিছু নেই, শ্রীযুক্তা লেকি বললেন। তবে মনে হয় না নতুন কিছু খবর পাবেন। সেদিন খাওয়ার টেবিলের দায়িত্ব ছিল বিয়াত্রিচে আর অ্যালিগের ওপর। আপনারা বরং ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।

শ্ৰীযুক্তা লেকির পর এবাড়ির সবচেয়ে পুরোনো পরিচারিকা হলেন বিয়াত্রিচে চার্চ। স্যার চার্লস তার কাছে জানতে চাইলেন, সেদিনকার ঘটনা কোন অতিথির ওপর কি রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল।

–রীতিমতো ভেঙে পড়েছিলেন এঞ্জেলা সাটক্লিফ। কিছুতেই রাতে কিছু খেলেন না। মাথা ধরার জন্য অ্যাসপিরিন খেলেন। তাঁর কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সকালে গিয়ে দেখি, অকাতরে ঘুমুচ্ছেন।

শ্রীযুক্তা ডেকার্সের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়নি। উল্টে তার ফিরে যেতে দেরী হয়ে যাবে ভেবে আপসোস করছিলেন। আর তাঁর স্বামী ব্রাণ্ডি গলায় ঢেলে নিজেকে সামলাচ্ছিলেন।

–লেডি মেরি সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

–ভদ্রমহিলার ব্যবহার যেমন সুন্দর, তেমনি মিষ্টি কথাবার্তা। ওঁর বাপের বাড়ির সঙ্গে আমাদের বাড়ির অনেককালের চেনা পরিচয়। তিনি সেদিন মুষড়ে পড়ে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেটা প্রকাশ করেননি। আর তার মেয়ে তো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলো। ছেলেমানুষ কিনা।

শ্ৰীমতী উইলস সম্পর্কে জানা গেল। তিনি কেবল হ্যাংলাপনা করে বেরিয়েছেন। কেমন একটা আদেখলাপনা ভাব।

–এবার বলুন, সেদিন স্যার বার্মালমিউয়ের আচার আচরণ কেমন ছিল?

— পার্টির আয়োজন নিয়ে হৈ হৈ চলছে। কর্তা খুব খুশী। এমন কি একবার এলিসের সঙ্গে রসিকতাও করে ফেললেন। কর্তার কাছে টেলিফোনে জানানো হয়েছিল হাসপাতাল থেকে যে একটি নতুন রোগী এসেছে। ফোনটা ধরেছিল এলিস। রোগী নয় রোগীনীর নামটা ছিল ভীষণ খটোমটো। শ্রীযুক্তা ডি. রাসব্রিজার। এই নামটা নিয়েই কর্তা ওর সঙ্গে মজা করছিলেন।

শ্ৰীমতী চার্চকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।

বছর তিরিশের সাধারণ চেহারার মেয়ে অ্যালিস। কিন্তু শরীরের যৌবনের যাদু প্রকটিত।

দেখা গেল, এলিস সম্পর্কে তার ধারণা ভালো।

–ও কেমন করে বিষ দেবে? টেবিলের দায়িত্ব ছিলো আমার ওপর। যদি সে বিষ দিতো তাহলে নিশ্চয়ই আমার নজরে পড়তো।

–তার মানে তুমি বলতে চাইছো, প্রত্যেকে যে পট থেকে কফি খেয়েছিলেন, তোমার কর্তাও ঐ একই পাত্রে কফি পান করেছিলেন?

–হ্যাঁ, তাই।

— তাহলে তোমার কর্তাকে কে খুন করেছে বলে তোমার মনে হয়?

–উনি তো খুন হননি। হঠাৎ হার্টফেল করে মারা যান।

– জানেন স্যাটার্থওয়েট, ব্যারিংটনের মৃত্যুর সঙ্গে টলির মৃত্যুর যোগ না থাকলেও টলির মৃত্যুর জন্য আমি অ্যালিসকেই সন্দেহ করতাম।

– কারণ?

–মেয়েটা যেমন উশৃঙ্খলা, ও অতি সহজেই নিজের শরীরের দিকে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেই অবসরে কোনো কুমতলব হাসিল করা অসম্ভব নয়। তবে মেয়ে দেখে মজার মতো মন বা বয়স– কোনোটাই টলির ছিল না।

–কিন্তু নারীর আকর্ষণ মাথা খারাপ করার বিপদ এই বয়সেই সবচেয়ে বেশি নয় কি? –কি যে বলেন, আমতা আমতা করে বলেন স্যার চার্লস।

.

০৫.

খানসামার ঘর

–চলুন, খানসামার ঘরটা একবার ঘুরে আসি। স্যাটার্থওয়েট বললেন, তবে ভাবছি, পুলিস তো একবার ঘরটা দেখেছে। তারপর আর কিছু লাভ হবে?

–পুলিসের কথা আর বলবেন না। পাকা ডিটেকটিভের মত হেসে উঠলেন অভিনেতা স্যার চার্লস। ওরা খুঁজেছে অপরাধের প্রমাণ, আর আমরা খুঁজবো নির্দোষিতার প্রমাণ।

যে ঘরটিতে এলিস ছিলো সেখানে এসে ঢুকলেন দুজনে। বড় ঘর, এদিকে ফায়ার প্লেস। লোহার খাটে বিছানা পরিপাটি করে পাতা। আলনায় পোশাক সুন্দর করে সাজানো। একজোড়া জুতোও রয়েছে। কিন্তু খানসামার উদিটা আলনায় নেই। টেবিলের ওপর কালিভরা দোয়াত আছে কিন্তু কালি নেই। ঘরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। তেমন কিছু নজরে পড়লো না। তবে ফায়ার প্লেসের কাছে দেওয়ালে একটু কালি ছিটকে পড়ার দাগ নজরে পড়লো।

–না, এখানে কিছু পাওয়া যাবে না। হাতাশার সুর স্যার চার্লসের কথায়।

– এরকম বেতালা কাণ্ডের মধ্যে গল্পের গোয়েন্দারা যদি পড়তেন, তাহলে দেখতাম তাদের কি হাল হতো।

শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের কথা শুনে স্যার চার্লস হেসে উঠলেন।

স্যার বার্থালমিউয়ের বাড়ির বাগানে ওঁরা দুজনে পায়চারি করতে করতে আলোচনা করছিলেন।

–শ্ৰীমতী চার্চ বলছিলেন, স্যার চার্লস খুশীর মেজাজে ছিলো। এলিসের সঙ্গে ঠাট্টাও করেছিল। রোগীনীর নাম কি যেন বলেছিল?

– শ্রীযুক্তা ডি. রাসব্ৰিজার।

– টেলিফোনের খবরটা কোনো সাংকেতিক ব্যাপার বলে আমার মনে হয়। ঐ সঙ্কেতের প্রকৃত অর্থ আমাদের জানতে হবে। হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে যে ঐ নামে কোনো রোগিনী আমাদের জানতে হানে সাংকেতিক।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ওঁরা দুজন আরোগ্য নিকেতনে এসে হাজির হলেন।

হাসপাতালের মেট্রনের সঙ্গে কথা বলছিলেন স্যার চার্লস।

–অনেক কষ্টে তিনি এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে দিয়ে গেছেন, মেট্রন বলেন, এর বিরাট সুনামের প্রায় সবটুকুই তাঁর দান।

— আপনাদের এখানে নার্ভ কেসের চিকিৎসাই বেশি হয় তাই না?

–হ্যাঁ।

— আচ্ছা, শ্রীযুক্তা ডি. রাসব্রিজার নামে কোনো ভদ্রমহিলা এখানে এসেছেন? মহিলা আমার চেনাজানা। ওঁর সম্পর্কে টলির সঙ্গে আমার আগে কথা হয়েছিল।

–হ্যাঁ, এসেছেন। স্যার বার্থালমিউ যেদিন মারা যান সেদিন বিকালেই উনি ওয়েস্টইণ্ডিজ থেকে এখানে এসে পৌঁছোন। ওঁর স্বামী একজন আত্মীয়ের সঙ্গে এখানে ওঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

–এখন তিনি কেমন আছেন?

— খুব ভালো নয়। নার্ভাস ব্রেক ডাউন, বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখা করা বা চিঠি লেখা সব বন্ধ।

আরো দু একটা সাধারণ গ্রাম প্রকাশ করে ওঁরা আরোগ্য নিকেতন থেকে বেরিয়ে এলেন।

এরপর তারা হাজির হলেন স্থানীয় থানায়। অলিভার ম্যানডার্সের সেদিনের অ্যাকসিডেন্টে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য।

থানায় খোঁজ খবর দিলেন। যেখানে অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে জায়গাটিও দেখলেন। দুধারে প্রায় দশ ফুট উঁচু পাঁচিল একেবারে সোজা এবং প্রায় ফাঁকা রাস্তা চলে গেছে। থানা থেকে আশাপ্রদ কোনো ফল পাওয়া গেল না।

স্যার চার্লসের হঠাৎ খানসামার ঘরের দেওয়ালে দেখা কালির দাগ কথা মনে পড়লো। ওটা ভালো ভাবে পরীক্ষা করে দেখা দরকার।

.

০৬.

দেওয়ালে কালির দাগ

 দেয়ালের কালির দাগ দেখে কি বোঝা যেতে পারে সেটা বোধগম্য হলো না স্যার স্যাটার্থওয়েটের কাছে।

মনে হয় স্যার চার্লস সেটা বুঝতে পেরেই জিজ্ঞেস করলেন, দেওয়ালের ঐ জায়গায় কালির দাগটা কেমন করে পড়লো বলে আপনার মনে হয়?

— মনে হয়, কলম পড়ার কালির দাগ। স্যাটার্থওয়েট বললেন। এ ঘরে অবশ্য কোনো কলম পাওয়া যায়নি। বুঝতে হবে এলিসের কিংবা তার আগের খানসামার কোনো ফাউন্টেন পেন ছিল।

–কিন্তু কলম পাড়লে টেবিলে বসেই পাড়বে। ফায়ার প্লেসের দেওয়ালে যাবে কি করে?

 একটি লেখবার কাগজ আর পেনসিল মার্থা লেকির কাছ থেকে চেয়ে নিলেন স্যার চার্লস। এই ঘরে কি হচ্ছে সেটা জানা এবং দেখার জন্য অল্প বয়েসী পরিচারিকাদের কৌতূহলের শেষ নেই।

ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে কাগজ পেনসিল টেবিলের ওপর রাখলেন সার চার্লস। তারপর ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে মন দিয়ে দাগটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তাঁর নির্দেশ মত স্যার স্যাটার্থওয়েট খাটের ওপর চুপ করে বসে রইলেন।

পাঁচ মিনিট পর স্যার চার্লস উঠে এলেন –আমি এখন এলিস। আর এই পেনসিলটি হবে আমার কলম। অভিনয় হবে বোবা। কয়েক মিনিট লাগবে।

সেই কয়েক মিনিটে স্যার স্যাটার্থওয়েট বুঝতে পারলেন যে স্যার চার্লস সত্যিই কতবড়ো অভিনেতা।

চোখে মুখে দারুণ উত্তেজনা নিয়ে এলিস ঘরে ঢুকলো। দরজা বন্ধ করলো। কি যেন ভাবছে। এখনই তাকে কি যেন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। একটা শব্দ? না কিছু নয়। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। টেবিলের কাছে দ্রুত পায়ে এসে চেয়ারে বসলো, কাগজ কলম এগিয়ে নিলো! কি যেন লিখছে দ্রুত হাতে। শব্দে কান খাড়া করে। দরজার কাছ থেকে শব্দটা আসছে। তবে কি পুলিস? ভাষণ ভয় পেয়ে দ্রুত ছুটে গেল ফায়ার প্লেসের কাছে। কাগজটা দলা পাকিয়ে ফায়ার প্লেসের আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে হাতের কলমটা ছিটকে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে লাগলো। খুব স্বাভাবিক মুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল এলিস। দরজা খুলে দেখলো। না, কেউ নেই।

স্যার চার্লস, কালির দাগের রহস্যটা এবার আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। উচ্ছ্বসিত হলেন স্যাটার্থওয়েট।

পেনসিলটা ঘুরিয়ে নেবার জন্য স্যার চার্লস নিচু হলেন।

–মনে হচ্ছে, যা চেয়েছিলাম তার থেকে বেশি কিছু পেয়ে গেছি। স্যাটার্থওয়েট শীগগির আসুন।

স্যাটার্থওয়েট এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়লেন। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলেন, — মনে হচ্ছে। একটা কাগজ।

– কাগজ নয়। দাঁড়ান একমিনিট।

স্যার চার্লস দরজা খুলে বাইরে বেরোলেন। একটু পরেই একটা বোনবার কাঁটা হাতে নিয়ে আবার ঢুকলেন।

ফায়ার প্লেসের নিচে থেকে দলা পাকানো কাগজগুলো বের করলেন স্যার চার্লস। কয়েকটা চিঠি! মন দিয়ে দুজনে পড়লেন। এগুলি একই চিঠির কয়েকটা খসড়া মাত্র। অতিশয় স্পষ্টভাবে পত্রলেখক এলিস তার বক্তব্যটি জানিয়েছে — ডাক্তার কিভাবে মারা গিয়েছেন সব জানি। পুলিসকে এখনও কিছু বলিনি। শিগগির আমার সঙ্গে দেখা করে….।

হঠাৎ কোনো কারণে লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। হঠাৎ এলিস আচমকা ভয় পেয়ে কাগজগুলো দলা পাকিয়ে ফায়ার প্লেসের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

স্যার স্যাটার্থওয়েট অভিনন্দন জানালেন স্যার চার্লসকে।

–স্যাটার্থওয়েট, আমরা কিন্তু এখনো টলির আসল হত্যাকারী কে জানি না। এলিস নিজে খুন করেনি তবে কে করেছে সেটা সে জানে। ও চেয়েছিল হত্যাকারীর সঙ্গে ব্ল্যাকমেল করতে। কিন্তু গেল কোথায় সে?

— পুলিসকে তাহলে খবরটা জানাতে হয়। স্যাটার্থওয়েট জানালেন। পুলিশের ধারণা এলিসই খুন করেছে। অথচ আসল খুনী গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটা পুলিস বুঝুক।

– পুলিসের ওপর আমার একটুও আস্থা নেই। তাছাড়া পুলিসের কাণ্ডকারখানায় আসল হত্যাকারী হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। অতএব সেটা করা চলবে না।

–কিন্তু সৌজন্য বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।

–বেশ, জানিয়ে দিন। ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্যার চার্লস সম্মতি জানালেন।

.

০৭.

মন্ত্রণা

চিঠিগুলোর কথা জানালেন ওঁরা লণ্ডনের পুলিস অফিসার কর্ণেল জনসনকে। তিনি তাদের ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু মনে মনে খুশী হতে পারলেন না এই ভেবে যে দুজন অপেশাদার লোক তাদের ওপর টেক্কা দিচ্ছে।

কালির দাগ লক্ষ্য করে তারা কেমন ভাবে চিঠিগুলো উদ্ধার করলো সেটা বিস্তারিত জানালেন স্যার চার্লস।

চিঠিগুলো পেয়ে পুলিসের কাছে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হলো যে যাজক ব্যারিংটন এবং ডাক্তার বার্থলমিউয়ের মৃত্যু এক অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। কর্ণেল জনসন জানালেন, তিনি লুমাউনের পুলিস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যারিংটনের মৃত্যু সম্পর্কে নতুন করে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করবেন।

খবরের কাগজে যেন এখন চিঠিগুলোর কথা প্রকাশিত না হয় সে বিষয়ে পুলিসকে সাবধান করে দিয়ে স্যার চার্লস ও স্যাটার্থওয়েট থানা থেকে বেরিয়ে এলেন।

চেলাসায় শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েটের বাড়ি সাজানো গোছানো সুন্দর। বাড়ির মালিক যে শিল্প রসিক, তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।

বৈঠকখানা ঘরে বসে আছেন তিনজন– স্যার স্যাটার্থওয়েট, স্যার চার্লস ও হারমিয়োন।

 হারমিয়োনকে একটু রোগা লাগছে, কিন্তু তার ঠোঁটে লেগেছে প্রতিজ্ঞার কাঠিন্য, স্যাটার্থওয়েট লক্ষ্য করলেন।

— আপনি ফিরে আসবেন। আমি জানতাম। হারমিয়োন স্যার চার্লসকে লক্ষ্য করে বললো। এবার আর কোনো চিন্তা নেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ওর কথা বলার ভঙ্গীমা দেখে স্যাটার্থওয়েট স্পষ্ট বুঝে নিলেন যে হারমিয়োন স্যার চার্লসকে গভীরভাবে ভালোবেসেছে। আর চার্লসও হারমিয়োনকে ভালোবেসেছেন। একটি অপরাধ, না দুটি অপরাধ মাঝখানে সেতুবন্ধনের কাজ করে চলেছে।

দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতীরের কথা, বার্থালমউয়ের মৃত্যু সংবাদের কথা, ইয়র্কশায়ারে তাদের অভিজ্ঞতার কথা সবিস্তারে বললেন স্যার চার্লস।

সব শুনে হারমিয়োন মাথা নেড়ে বললো, আপনারা আসল কথাটাই বুঝতে পারেননি।

 ঘরের বাকি দুজন তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলেন।

–এলিস আর বেঁচে নেই। সে অনেক কিছু জেনে ফেলেছিল। তাই তাকে খুন করা হয়েছে। হত্যাকারী তাকে নিরাপদ মনে করেনি। তার মানে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা হলো তিন।

একটু চুপ করে থেকে স্যার চার্লস বললেন, তোমার কথা হয়তো মেনে নিলাম, কিন্তু এলিসের মৃতদেহটা কোথায় যাবে?

– আছে, ঐ বাড়িরই কোথাও। ঐরকম প্রাসাদের মত বাড়িতে তো চোরাকুঠুরির অভাব নেই। ভালো করে খুঁজলে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

শ্ৰীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট ভাবলেন, হারমিয়োনের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে হত্যাকারী যে ভীষণ সাংঘাতিক সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তার মানে তিনিও বিপদে পড়েছেন। কেবল তিনি নন, স্যার চার্লস, হারমিয়োনও তার সঙ্গে আছে। প্রয়োজন মনে করলে খুনী আর একটা খুন…..

–আপনাকে এই তিনটি মৃত্যুর রহস্য খুঁজে বের করতেই হবে। হারমিয়োনের কণ্ঠে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। এ কাজ অন্য কাউকে দিয়ে হবে না, আমি জানি। আপনি নিশ্চয় ভয় পেয়ে পেছিয়ে যাবেন না। রহস্যের আড়ালে যে সত্য লুকিয়ে আছে সেটা আমরা, মানে আমি আর আপনি খুঁজে বের করবোই।

— আর স্যাটার্থওয়েট?

— হ্যাঁ।

শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট মনে মনে হেসে উঠলো, হারমিয়োন না চাইলেও তিনি ওদের সঙ্গে থাকবেন। কারণ তিনি রহস্য ভালোবাসেন। ভালোবাসেন মনুষ্য প্রকৃতির সমীক্ষা। এই সুবর্ণ সুযোগ তিনি কখনোই ছাড়বেন না।

অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে কি যেন ভাবলেন স্যার চার্লস। বোঝা যাচ্ছে, তিনি এখন পরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করবেন।

–আমরা বিশ্বাস করি যে দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি প্রথম হত্যাকাণ্ডটির থেকেই উদ্ভূত। অর্থাৎ ব্যারিংটনের মৃত্যু রহস্য সম্পর্কে বার্থালমিউ যা জেনেছিলেন, সেটা যেন আর কেউ না জানতে পারে সেইজন্য হত্যাকারীটি চিরদিনের জন্যে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিল, তাই তো?

হারমিয়োন ও স্যাটার্থওয়েট ঘাড় কাত করে তাদের মত জানালো।

— অতএব হত্যাকারীর উদ্দেশ্য কি ছিল সেটা জানতে হবে? প্রথমতঃ ব্যারিংটনকে হত্যা করে কেউ আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হবে এমন কোনো সম্ভাবনা কি আছে?

–মনে তো হয় না। স্যাটার্থওয়েট বললেন।

–তিনি তার অজ্ঞাতসারে কোনো ক্ষতি কারো করেছিলেন কিনা সেটা জানতে হবে। তৃতীয় কারণ ধরা যেতে পারে জিঘাংসাবৃত্তি। এটাও একধরনের পাগলামি। এক্ষেত্রে সেটাও প্রযোজ্য নয়।

একটু থেমে স্যার চার্লস আবার বলতে থাকেন– ভয়ও আর একটি কারণ হতে পারে। মনে করুন, ব্যারিংটন কোনো একটি লোককে কোনো এক বিশেষ সময়ে কোনো একটি জায়গায় দেখেছিলেন। হয়তো লোকটি এমন একটি অ্যালিবাই সৃষ্টি করে রেখেছে যে সেই সময়ে সে সেখান থেকে শখানেক মাইল দূরে আছে। যদি ব্যারিংটন সরল, মনে লোকটির সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা কারোকে বলে ফেলেন তাহলে?

– হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি। স্যাটার্থওয়েথ বললেন।

শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো, দুই পার্টিতে যাঁরা নিমন্ত্রিত ছিলেন তাদের নামের একটি তালিকা তৈরি করে কাকে কি কারণে সন্দেহ করা যায় সে বিষয়ে বিবেচনা করে দেখা।

তালিকা লিখতে বসলো হারমিয়োন, কার নাম আগে লিখবে, কার নাম লিখবে না এসব নিয়ে স্যার চার্লসের সঙ্গে প্রায় তর্ক লেগে গেল। একটা খণ্ড প্রলয় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা করে শ্রীযুক্ত স্যাটার্থওয়েট বেল বাজিয়ে কফির হুকুম দিলেন। স্যার চার্লস উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গেলেন একটা নিগ্রো-ভাস্কর্যের সামনে। গম্ভীর মুখে বসে রইলো হারমিয়োন।

কফি পান করার পর সবার মেজাজ স্বাভাবিক হলো। এবার ঠিক হলো –স্যার চার্লস কুলায় ফিরে যাবেন আর হারমিয়োন তার মাকে নিয়ে লুমাউথের ব্যারিংটনের সঙ্গে কথাবার্তা বলবে।