২. দরজা অতিক্রম করে

দরজা অতিক্রম করে সুশীল রায়কে অনুসরণ করে আমরা যেখানে এসে দাঁড়ালাম, সেটা একটা প্রকাণ্ড দরদালান। চারদিকটা একটু চাপা সেকেলে ধাঁচের বলে আলোর পর্যাপ্ততা। একটু কম।

সেই দালান-সংলগ্ন গোটা চার-পাঁচ ঘর। তারই একটা ঘরের মধ্যে ঐ বাড়িরই চাকর-ঠাকুর-ঝি ইত্যাদির দল ফিস ফিস করে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে।

আরো এগিয়ে দানের শেষ প্রান্তে এসে, মস্ত বড় উঁচু ও মজবুত পাল্লাওয়ালা ও পাল্লার গায়ে বিচিত্র নক্সার কাজ করা দরজার সামনে আমরা দাঁড়ালাম। দোরগোড়ায় একজন পুলিস প্রহরায় নিযুক্ত।

দরজার পাল্লা দুটো ভেজানো ছিল। হাত দিয়ে পাল্লা দুটো ঠেলে প্রথমে সুশীল রায় ও তার পশ্চাতে আমি ও কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করলাম। এবং সঙ্গে সঙ্গে কে যেন বললে, কে রে সুধা?

চমকে ফিরে চেয়ে দেখি, দাঁড়ের ওপর বসে প্রকাণ্ড একটি লালমোহন।

গত সন্ধ্যায় সচ্চিদানন্দ সান্যালের মুখে শুনেছিলাম, বাইরের ও অন্দরের মধ্যবর্তী যে দরজার কথা, এইটাই তবে সেই দরজা।

এখানেও অনুরূপ একটি প্রশস্ত দরদালান—ঠিক যেমনটি পশ্চাতে দরজার ওপাশে এইমাত্র ফেলে এলাম।

পর পর চারটি ঘর। এবং দালানের শেষ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে, সোজা উঠে গিয়েছে প্রশস্ত। সিঁড়ি দ্বিতলের দিকে। এগিয়ে গেলাম আমরা সিঁড়ির দিকে।

আবার লালমোহনের গলা শোনা গেল, উপরে যাও কেন? কে গা!

জব্বর পাহারা তো! চোখ এড়াবার উপায় নেই!

কিন্তু এতক্ষণ এই বাড়িতে এসেছি, একমাত্র ঐ দাঁড়ের উপর উপবিষ্ট লালমোহনের কণ্ঠস্বর ছাড়া দ্বিতীয় কোন মানুষের কণ্ঠস্বর বা কথা এখনও পর্যন্ত শুনতে পাইনি।

সমস্ত বাড়িটার মধ্যে যেন একটা অস্বস্তিকর অদ্ভুত স্তব্ধতা থমথম করছে। মনে হচ্ছে কেউবুঝি এখানে নেই।

নির্জন এই বাড়িটার মধ্যে যেন একাকী ঐ লালমোহনটিই দাঁড়ের উপর বসে বসে বুড়ো ঠাকুদার মত পাহারা দিচ্ছে।

সিঁড়িতে পা দিলাম আমরা। সঙ্গে সঙ্গে আবার লালমোহনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কে গা! কথা শুনছ না কেন?

ফিরে তাকালাম, দেখি লালমোহনটা একদৃষ্টে ঘাড় বেঁকিয়ে আমাদের দেখছে।

সুশীল রায় বললেন, এস, এস সুব্রত। পাখীটা অমনিই।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কিরীটী সুশীল রায়কে প্রশ্ন করে, কিন্তু এ বাড়ির লোকজন। কোথায়? কাউকে দেখছি না!

এস না, দোতলাতেই সব আছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই সুশীল রায় বললেন।

দোতলায় পৌঁছেই কিন্তু মনে হল, এ যেন অন্য কোন বাড়িতে আমরা এলাম।

একটি টানা বারান্দা কিছুদূর গিয়ে চন্দ্রের মত বাঁয়ে বেঁকে গিয়েছে। চোখের সামনেই দেখা যায় উন্মুক্ত দক্ষিণ। নীচে বাগান। নানা প্রকারের ফুল-ফলপাতাবাহারের গাছ সেখানে দেখা গেল। সযত্ন-রক্ষিত উদ্যান। বুঝলাম বাড়িটা রাস্তার দিকে উত্তর চাপা হলেও অবারিত দক্ষিণ দিকটায় এ বাড়ির ঐশ্বর্য্য।

নীচের বাগানে বোধ হয় অনেক বেল ফুল ফুটেছে। তারই মিষ্টি গন্ধের একটা ঝাপ্টা বায়ুতরঙ্গে ভেসে এল।

বারান্দায় পর পর ঘর।

চন্দ্রাকৃতি বারান্দার ওপ্রান্ত হতে দুটি মনুষ্যমূর্তি এগিয়ে এল। একজনের বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে, কালো আঁটসাঁট গড়ন। পরিধানে একটি পরিষ্কার ধুতি, গায়ে একটি অনুরূপ পরিষ্কার গেঞ্জি। খালি পা। দেখলে ভৃত্যশ্রেণীর বলেই মনে হয়।

দ্বিতীয় জন আটাশ-ঊনত্রিশ বৎসর বয়স্ক একটি যুবক। পরিধানে সরু কালোপাড় কাঁচির মিহি ধুতি। গায়ে একটা সাদা সিল্ক-টুইলের আমেরিকান কলারের হাফসার্ট। চোখে কালো সেলুলয়েডের চওড়া ফ্রেমের চশমা। লেন্সের ওপাশ হতে একজোড়া কালো চোখ বুদ্ধির দীপ্তিতে যেন ঝকঝক করছে। মাথার কোঁকড়ানো চুল রুক্ষ বিশ্বস্ত। ছোট কপাল, নাকটা একটু চাপা।

ইন্সপেক্টর সুশীল রায়ের সঙ্গে আমাদের দুজনকে দেখে ওরা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

কিরীটী সুশীল রায়কে চোখের ইঙ্গিতে প্রশ্ন করে, এঁরা কে?

একজন শিবানীদেবীর সঙ্গে যে ভৃত্যটি এসেছেসেই নন্দন, আর উনি হচ্ছেন সচ্চিদানন্দবাবুর বড় ভাইয়ের ছেলে আনন্দ সান্যাল। সুশীল রায় বললেন।

আনন্দ সান্যাল! কিন্তু গতকাল সচ্চিদানন্দবাবুর মুখে যতদূর শুনেছিলেন, এ বাড়িতে তিনি, তাঁর স্ত্রী রাধারাণীদেবী, শিবানীদেবী ও তার ভৃত্য নন্দন এবং এ বাড়ির দাস-দাসী, সোফার ব্যতীত আর কেউ নেই? কিরীটী বললে।

না। আনন্দবাবু তো আছেনই, আরো আছেন মহিমারঞ্জন, সচ্চিদানন্দের শ্যালক ও তাঁর মেয়ে পারুলদেবী। এবং মহিমারঞ্জন ও তাঁর মেয়ে পারুল দেবী তো শুনলাম এ বাড়িতে গত ছমাস ধরেই আছেন। আর উনি—আনন্দবাবুও আছেন তা প্রায় গত তিনমাস এখানে। তাই না আনন্দবাবু?

হ্যাঁ। আনন্দ সান্যাল মৃদু কণ্ঠে সায় দিলেন সুশীল রায়ের কথায়।

বলীনবাবু কোথায়? সুশীলবাবু আনন্দ সান্যালকেই আবার প্রশ্ন করলেন।

হলঘরে আছেন।

চল হে কিরীটী, হলঘরেই যাওয়া যাক। কিন্তু আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?

আপনাদের জন্য চায়ের যোগাড় দেখতে—আনন্দ সান্যাল বললেন।

বলীনের বুঝি এরই মধ্যে চায়ের পিপাসা পেয়ে গেল?

আনন্দ সান্যাল ও নন্দন এগিয়ে গেল দোতলারই সিঁড়ির পাশের ঘরটায়। দোতলার সেইটেই পরে জেনেছিলাম কিচেন।

মনে মনে এ বাড়ির লোকগুলোকে চিন্তা করছিলাম।

বাড়ির মালিক সচ্চিদানন্দ সান্যাল, ধনী, নিঃসন্তান। বয়স পঞ্চাশের মধ্যে বা সামান্য বেশী।

সচ্চিদানন্দের স্ত্রী রাধারাণীদেবী, বিকৃত মস্তিষ্কা। নিষ্ফলা।

আনন্দ সান্যাল সচ্চিদানন্দের ভ্রাতুস্পুত্র। তরুণ-বয়স্ক, গত তিন মাস ধরে এ বাড়িতে এসে উঠেছেন, কিন্তু সচ্চিদানন্দ গতকাল তাঁর সম্পর্কে কোন কথাই বলেননি বা এমনও হতে পারে, বলা কোন প্রয়োজন মনে করেননি বা অবকাশ হয়নি। সচ্চিদানন্দ যদি কোন নির্দিষ্ট উইল না করে গিয়ে থাকেন তো ঐ আনন্দ সান্যালই এই সম্পত্তির মালিক হচ্ছেন ন্যায়ত ও আইনত। এখানে আসার আগে উনি কোথায় ছিলেন?

এ বাড়ির চতুর্থজন মহিমারঞ্জন। বয়স কত হবে কে জানে! সম্পর্কে সচ্চিদানন্দের শ্যালক। এখানে আছেন গত ছমাস ধরে। এখানে আছেন যখন, বুঝতে হবে সচ্চিদানন্দেরই পোষ্য ছিলেন।

পঞ্চমা এ বাড়িতে মহিমারঞ্জনের একমাত্র কন্যা পারুলদেবী।

সর্বশেষে ষষ্ঠজন এ বাড়ির শিবানীদেবীর পরিচয়ে স্বনামধন্যা অভিনেত্রী মণিকাদেবী। গত দেড় মাস হল এ বাড়িতে এসে আবির্ভূত হয়েছেন শিবানীদেবী। যে শিবানী দীর্ঘ আট বছর পূর্বে একদা সচ্চিদানন্দের স্ত্রী রাধারাণী কর্তৃক বিতাড়িত হয়েছিলেন। এবং সঙ্গে এসেছে তাঁর ভৃত্য নন্দন।

এরা ছাড়া এ বাড়িতে আছে চাকর-চাকরাণী ও সোফার।

.

সকলে এসে আমরা নির্দিষ্ট হলঘরটির মধ্যে প্রবেশ করলাম।

বেশ প্রশস্ত হলঘরটি।

মেঝেতে কার্পেট বিছানো, এদিকে-ওদিকে আছে সব সেকেলে মোটা মোটা ভারী আসবাবপত্র।

ডানদিককার দেওয়ালে বিলম্বিত প্রকাণ্ড এক ব্যাঘ্রচর্ম। বাঘের মাথাটা উঁচিয়ে আছে, কাঁচের চক্ষু দুটো ঝকঝক করে যেন দুখণ্ড অঙ্গারের মত জ্বলছে।

চারদিকের দেওয়ালে টাঙানো চারটি তৈলচিত্র। একটি মধ্যবয়সী নারীর চিত্র, কপালে সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুর-রেখা। চওড়া লালপাড় শাড়ির অবগুণ্ঠন কপালটি ছুঁয়ে আছে।

আর তিনটি চিত্র পুরুষের।

একটি চিত্র শিকারী ব্রিচেস পরিহিত, হাতে ধরা রাইফেল একটি। সম্পূর্ণ চিত্র। পায়ের সামনে লম্বমান একটি মৃত ব্যাঘ্র।

চিনতে কষ্ট হয় না, এ সেই পুরুষের চিত্র, নিচের ঘরে যার চিত্র ইতিপূর্বেই আমরা দেখে এসেছি।

বাকি দুটির মধ্যে একটি আট-দশ বৎসর বালকের। অন্যটি একটি বৃদ্ধের। মুখে ওমর খৈয়ামের মত সাদা চাপদাড়ি।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেই, একটি কেদারার উপরে উপবিষ্ট বলীনবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতেই তিনি সাদর আহ্বান জানালেন কিরীটীকে, আরে কিরীটীবাবু! আসুন, আসুন—

.

হলঘরের মধ্যে শুধু বলীন সোমই ছিলেন না, আরও একজন প্রৌঢ় সুশ্রী ভদ্রলোক ছিলেন। পরে জেনেছিলাম, উনি সচ্চিদানন্দবাবুর শ্যালক মহিমারঞ্জন গাঙ্গুলী। ভদ্রলোক বয়সে প্রৌঢ় হলেও দেহের মধ্যে একটি বাঁধুনি আছে। মাথার মধ্যস্থলে টাক ও রগের পাশের চুলে সাদার ছোপ পড়লেও বয়স যে পঞ্চাশের উর্ধ্বে নয়, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।

আমরা ঘরে প্রবেশ করতেই মহিমারঞ্জনের দৃষ্টি আমাদের উপর পতিত হয়েছিল। ভ্রূ কুটি কুঞ্চিত করে নিঃশব্দ সপ্রশ্ন ইঙ্গিতে যেন জানতে চাইলেন, আমরা আবার কে? কোথা থেকে আমরা এলাম?

কিন্তু তাঁকে বেশীক্ষণ সন্দেহের মধ্যে রাখলেন না বলীন সোম।

তিনি আমাদের উভয়েরই পূর্ব-পরিচিত।

আমাদের অকস্মাৎ ঐ সময় এখানে দেখে বিস্মিত হলেও চোখ-মুখের উৎফুল্ল ভাবটা সহজেই প্রকাশ পেল। কলকষ্ঠে সম্বর্ধনা জানালেন, এ কি! কিরীটীবাবু, সুব্রতবাবু আপনারা?

প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, হ্যাঁ। যোগাযোগটা একটু অদ্ভুত মনে হচ্ছে সোমবাবু, না?

সত্যিই! কিন্তু সংবাদটা দিল কে আপনাদের?

এবারে জবাব দিলেন আমাদের হয়ে সুশীল রায়। বললেন, আজকের দুর্ঘটনাটা না ঘটলেও ওঁরা আসতেন। সচ্চিদানন্দ সান্যালের আমন্ত্রণেই ওঁরা এসেছেন। এসে আমার মুখে শুনলেন ব্যাপারটা।

কি রকম? সচ্চিদানন্দ সান্যালের সঙ্গে আপনাদের পূর্ব-পরিচয় ছিল নাকি?

পূর্ব-পরিচয় বলতে যা বোেঝায়, ততটা অবিশ্যি ছিল না বা তার সুযোগও হয়নি। সবেমাত্র। কাল সন্ধ্যাতেই পরিচয় ঘটেছে। জবাব দিল কিরীটী।

আশ্চর্য তো! বললেন বলীন সোম।

কথাটা আপনার জানা প্রয়োজন মিঃ সোম। বলে কিরীটী গতরাত্রে আমাদের সঙ্গে সচ্চিদানন্দের সাক্ষাৎ-পর্বটা যথাসম্ভব সংক্ষেপে বিবৃত করে গেল, কেবল মণিকা সম্পর্কে সচ্চিদানন্দের সন্দেহের কথাটা বাদ দিয়ে।

এমন সময় হঠাৎ কথা বললেন মহিমারঞ্জন, হ্যাঁ, সচ্চিদানন্দ আপনার কাছে যাবে পরামর্শের জন্যে, আমায় বলেছিল বটে।

বলীন সোম এবারে মহিমারঞ্জনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন, কিরীটীবাবু, ইনি মহিমারঞ্জন গাঙ্গুলী—সচ্চিদানন্দবাবুর শ্যালক।

ওঃ, নমস্কার। কিরীটী নমস্কার জানাল।

প্রতিনমস্কার জানালেন মহিমারঞ্জন।

সুশীল রায় কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে এবারে বললেন, কিরীটীবাবু, সোম রইলেন, আমার জরুরী কাজ আছে। আমাকে একবার লালবাজার যেতে হবে। আপনি যখন ঘটনাচক্রে ঘটনাস্থলে এসেই পড়েছেন, আপনার সাহায্য থেকে নিশ্চয় বঞ্চিত হব না আশা করি।

সাহায্য সত্যিকারের কতটুকু আপনাদের করতে পারব জানি না সুশীলবাবু। তবে এ ব্যাপারে সাধ্যমত চেষ্টা করতে বিমুখ হব না জানবেন।

তাহলেই হবে। আচ্ছা চলি, আবার দেখা হবে।

সুশীল রায় আর দাঁড়ালেন না, ঘর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন।

সুশীল রায়ের প্রস্থানের পর ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই চুপ করে ছিলেন। একটা বিশ্রী থমথমে ভাব ঘরের মধ্যে যেন জমাট হয়ে ওঠে। এমন সময় ক্ষণপূর্বে ঐ ঘরে আসবার সময় বারান্দায় দেখা নন্দন চাকরের হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে পিছনে পিছনে আনন্দ সান্যাল এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

নন্দন ভৃত্যই সকলের হাতে এক কাপ করে চা তুলে দিল।

কেবল আনন্দ সান্যাল চা নিলেন না।

চা পরিবেশিত হয়ে যাবার পর আনন্দ সান্যাল বলীন সোমকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি ভিতরে কাকীমার ঘরে আছি দারোগাবাবু। দরকার হলে ডাকবেন।

কথাগুলো বলে উত্তরের কোন অপেক্ষামাত্রও না করে আনন্দ সান্যাল নিঃশব্দে ধীর পদে কক্ষ ত্যাগ করে চলে গেলেন।

তাঁর পায়ের চলমান চটির শব্দটা বারান্দায় মিলিয়ে গেল।

নিঃশব্দেই চা-পান-পর্ব সমাধা হল।

কারো মুখেই বড় একটা কথা নেই।

কিরীটী কিছুক্ষণ পরে ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল। বললে, আপনার তদন্ত ও জবানবন্দি নেওয়া কি শেষ হয়েছে সোমবাবু?

প্রায়। সামান্যই বাকি। মৃতদেহ দেখবেন নাকি? কিরীটীকেই প্রশ্ন করলেন সোম।

দেখব বৈকি। তার আগে ঘটনাটা সংক্ষেপে শুনতে পারলে ভাল হত। কিরীটী জবাব দিল।

.

ঘটনাটা সংক্ষেপে তখন কিরীটীর অনুরোধে বলীন সোম বলে গেলেন: গত রাত্রে প্রায় এগারোটা নাগাদ সচ্চিদানন্দ ঘরে ফিরে আসেন। সচ্চিদানন্দের পাশের ঘরেই থাকেন মহিমারঞ্জন। মহিমারঞ্জন তখনও জেগে ছিলেন। সন্ধ্যা থেকে তাঁর মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল তাই তখনও ঘুমোতে পারেন নি।

সচ্চিদন যে ফিরে এসেছেন, তাঁর পায়ের শব্দে ও মণিকার সঙ্গে কথাবার্তার শব্দেই টের পান মহিমারঞ্জন।

মণিকা অর্থাৎ শিবানী তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, এত রাত হল যে কাকাবাবু আপনার?

একটা জরুরী কাজ ছিল মা।

আপনার খাবার নিয়ে আসছি। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে নিন।

তোমার কাকীমা ঘুমিয়েছেন?

হ্যাঁ।

তুমিও শুতে যাও শিবানী। আজ রাত্রে আর কিছু খাব না।

খাবেন না কেন?

না, ক্ষিদে নেই।

একেবারে কিছু না খেয়ে থাকবেন? এক গ্লাস দুধ এনে দিই–

না, কিছুই খাব না।

তারপর আর কিছুই জানেন না মহিমারঞ্জন। রাত্রে সচ্চিদানন্দ খেয়েছিলেন কিনা তাও জানেন না। কারণ তার কিছু পরেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

ঘুম ভাঙ্গে তাঁর খুব ভোরে শিবানীর ডাকাডাকিতে।

খুব সকালেই শিবানীর শয্যাত্যাগের অভ্যাস। শয্যাত্যাগের পর প্রথম কাজই হচ্ছে এক গ্লাস গরম জল ও একখণ্ড লেবু সচ্চিদানন্দের শিয়রের সামনে টীপয়ের উপরে রেখে যাওয়া।

ভোরে শয্যাত্যাগ করে খালি পেটে প্রথমেই এক গ্লাস লেবুর জল খাওয়া সচ্চিদানন্দের দীর্ঘদিনের অভ্যাস ছিল।

শিবানী এ বাড়িতে পা দিয়েই প্রতিদিন সকালের ঐ কর্তব্যকর্মটির ভার স্বেচ্ছাতেই নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে জলের গ্লাস ও লেবু নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখে, সচ্চিদানন্দের শয্যা খালি এবং ঘরে কেউ নেই। ঘরের দরজা অবশ্য খোলাই থাকে বরাবর। আজও সকালে খোলাই ছিল।

শয্যায় সচ্চিদানন্দকে না দেখে শিবানী একটু বিস্মিত হয়। কারণ চিরদিনই একটু বেলা করে সচ্চিদানন্দের শয্যা ত্যাগ করা অভ্যাস। ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। বাথরুমে যেতে পারে। ভেবে শিবানী সেদিকে তাকিয়ে দেখে, বাথরুমের দরজাটা খোলা। এগিয়ে গিয়ে তবু একবার শিবানী বাথরুমে উঁকি দেয়। বাথরুমও খালি।

তবে এত সকালে গেলেন কোথায় সচ্চিদানন্দ!

নীচে যাননি তো–বাগানে!

কিন্তু বাইরের বারান্দায় বের হয়ে দেখে, দোতলার সিঁড়ির দরজাটা তখনও বন্ধ। নিজের হাতে প্রত্যহ শিবানী ঐ দরজা সকালে খুলে দেয়। সে সেদিন সকালে তখনো ঐ দরজাটা খুলে দেয়নি।

তবে কি সচ্চিদানন্দ ছাতেই গেলেন—অর্কিড-ঘরে প্রায়ই যান।

কে জানে, ছাদে অর্কিড-ঘরে গিয়েছেন কিনা।

ছাদের উপরে একটা কাঁচের অর্কিড-ঘর আছে। চিরদিন সচ্চিদানন্দের বাগান, গাছপালা, ফুলের অত্যন্ত সখ। শুধু সখ নয়, একটা প্রচণ্ড নেশা ছিল তাঁর।

স্বহস্তে নীচে বাড়ির পশ্চাৎভাগে যে উদ্যানটি আছে প্রত্যহ চার-পাঁচ ঘণ্টা তার তত্ত্বাবধানে কাটান। অবশ্য তিনজন মালীও আছে উদ্যানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। আর আছে তিনতলায় ছাদের উপরে বহু অর্থব্যয়ে নির্মিত বড় সখের কাঁচের তৈরী একটি অর্কিড-ঘর। বহু দুষ্প্রাপ্য নানাজাতীয় অর্কিডের সমাবেশ সেই কাঁচের অর্কিড-ঘরে। অর্কিড-ঘরটি সকলেই জানে সচ্চিদানন্দের প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় বস্তু। বাড়িতে যতটুকু সময় থাকেন, তার বেশীর ভাগ সময়টাই হয় নীচের উদ্যানে, না হয় অর্কিড-ঘরে কাটে সচ্চিদানন্দের।

সকালবেলা উঠে হয়ত অর্কিড-ঘরেই গেছেন ভেবে শিবানী তিনতলার ছাদে যায়। অর্কিড-ঘরের কাঁচের দরজা বন্ধই ছিল। দরজা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে একটু এগুতেই শিবানী থমকে দাঁড়ায়। মেঝের উপরে লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছেন সচ্চিদানন্দ।

ব্যাপারটা শিবানী প্রথমে বুঝতে পারে নি, তাই তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে সচ্চিদানন্দকেতোলবার চেষ্টা করতে যেতেই যেন হঠাৎ থেমে যায়। বরফের মত ঠাণ্ডা এবং লোহার মত শক্ত শরীরটা। একটা আর্ত অর্ধস্ফুট চিৎকার করে শিবানী যেন ভূত দেখার মতই পিছিয়ে আসে।

প্রথমটায় শিবানী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা মুহূর্ত সে বুঝতেই পারেনি কি করবে। বাড়ির কেউ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। অত ভোরে এ বাড়ির কেউই বড় একটা শয্যাত্যাগ করে না—একমাত্র শিবানী ছাড়া।

কি করা উচিত বুঝতে না পেরে নিজে প্রথমেই সে মহিমারঞ্জনের ঘরে ঢুকে তাঁকে ঠেলে ঘুম থেকে তোলে।

মামাবাবু! মামাবাবু! শীগগির উঠুন—

ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে শয্যার উপরে উঠে বসেন মহিমারঞ্জন।

কি! কি শিবানী! কি ব্যাপার?

শিবানীর চোখ-মুখের চেহারা একেবারে মড়ার মত ফ্যাকাশে।

কথা বলতে গিয়ে গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে–সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে মামাবাবু!

সর্বনাশ! কিসের সর্বনাশ?

কাকাবাবু–বাকিটা আর শেষ করতে পারে না শিবানী।

কি-কি হয়েছে সচ্চিদার? কথা বলছ না কেন শিবানী?

আপনি এখুনি একবার উপরে কাচঘরে চলুন। কোনমতে কথা কটি উচ্চারণ করে শিবানী।

কাচঘরে! মানে অর্কিড-ঘরে?

হ্যাঁ। শীগগির চলুন একটিবার–

তারপরেই শিবানীর সঙ্গে সঙ্গে সোজা মহিমারঞ্জন তিনতলায় সচ্চিদানন্দের অর্কিড়-ঘরে গিয়ে ঢোকেন এবং তাঁর অসাড় প্রাণহীন দেহটা মেঝের উপর লম্বমান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন।

তাঁর পরিধানে স্লিপিং পায়জামা ও কিমনো। খালি পা। চটিজোড়া অদূরে পড়ে আছে।

ক্রমে বাড়ির অন্যান্য সকলকেও ডাকা হয়, একমাত্র সচ্চিদানন্দের স্ত্রী রাধারাণীকে বাদে। রাধারাণী তখনও ঘুমোচ্ছিলেন। বেলা প্রায় নটা পর্যন্ত তাঁর ঘুমনো অভ্যাস। এবং যতক্ষণ না নিজে থেকে তাঁর ঘুম ভাঙ্গে, ডাক্তারের কঠিন নির্দেশ আছে, কেউ যেন কোন কারণেই তাঁর ঘুম না ভাঙান বা কোনভাবে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটান।

কাজেই রাধারাণী যেমন নিজের শয্যায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিলেন তেমনি ঘুমোতে থাকেন।

অতঃপর কি করা কর্তব্য সকলে মিলে পরামর্শ করে স্থির করেন। পাড়ার পরিচিত—বিশেষ করে সচ্চিদানন্দের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচিত বৃদ্ধ ডাক্তার হরপ্রসন্ন ভট্টাচার্যকে ক দেওয়া হয়।

তিনি সব দেখে-শুনে বললেন, অনেকক্ষণ মারা গিয়েছেন এবং মৃত্যুর কারণটা ঠিক স্বাভাবিক না মনে হওয়ায় Death certificate দিতে রাজী হন না। এবং আরো বলেন, অবিলম্বে নিকটবর্তী থানায় একটা সংবাদ দিতে।

শেষ পর্যন্ত ডাক্তার হরপ্রসন্নর পরামর্শ মতই থানায় ফোন করা হয়। বলীন সোম আসেন এবং তিনিই এখানে এসে ফোনে সুশীল রায়কে সংবাদ দিয়ে আনান।

এই সংক্ষেপে ঘটনাটা।

জবানবন্দি সকলেরই নেওয়া হয়েছে, একমাত্র সচ্চিদানন্দের স্ত্রী রাধারাণীদেবীর বাদে। কিন্তু কারো কাছ হতেই উল্লেখযোগ্য এমন কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি যাতে সচ্চিদানন্দের মৃত্যুর উপরে কোন আলোকসম্পাত হয়।

রাধারাণীদেবী নিশ্চয়ই শুনেছেন ব্যাপারটা? কিরীটী প্রশ্ন করে বলীন সোমকে।

হ্যাঁ। আনন্দবাবু কিছুক্ষণ আগে বলেছেন।

শুনে তাঁর কোন reaction, মানে প্রতিক্রিয়া—কিরীটী জিজ্ঞাসা করে।

না। শুনলাম তাঁর মুখেই—মানে আনন্দবাবুর মুখেই, কোন সাড়া-শব্দই করেননি সংবাদটা শুনে। একেবারে যেন বোবা হয়ে গিয়েছেন।

হুঁ। আচ্ছা চলুন,মৃতদেহটা একবার দেখে আসা যাক। বলীন ঢোমকে উদ্দেশ্য করেই কিরীটী কথাগুলো বলে।

চলুন।

আমি, কিরীটী, মহিমারঞ্জন ও বলীন সোম ঘর থেকে বের হলাম।

.

কাঁচের তৈরী আগাগোড়া অর্কিড-ঘর। কাচঘর।

মস্তবড় ছাদ। ছাদের ঠিক মধ্যস্থলে পটে-আঁকা একটি ছবির মতই যেন সবুজ ফার্ণে চতুর্দিক হতে আচ্ছাদিত অর্কিড-ঘরটি।

সর্বাগ্রে বলীন সোম ও তাঁর পশ্চাতে একে একে আমরা কাচঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। বলীন সোমই কাচঘরে প্রবেশের দরজাটা খুলে নিজে সর্বপ্রথম ভিতরে প্রবেশ করলেন। আমরা সকলে অতঃপর একে একে তাঁকে অনুসরণ করে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

চারদিকে নানা জাতীয় অর্কিডের বিচিত্র সমারোহ। কত জাতের যে অর্কিড, তার নাম-ঠিকানা কিছুই আমার জানা নেই।

মাটির টবে, ঝুলন্ত তারের টবে, বাস্কেটে, নানা আধারে নানা জাতের অর্কিড। অর্কিডে অর্কিডে ঘরটি যেন একেবারে ভর্তি। মধ্যে মধ্যে যাতায়াতের জন্য সরু পথ।

ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে একটি কাঠের বেঞ্চ—ঠিক তারই সামনে বস্ত্রাচ্ছাদিত হয়ে আছে সচ্চিদানন্দের মৃতদেহ।

বলীন সোমের নির্দেশেই মৃতদেহটিকে বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত করে রাখা হয়েছিল চিৎ করে শুইয়ে। এবং তিনিই এগিয়ে গিয়ে মৃতদেহের উপর থেকে বস্ত্রাচ্ছাদনটা টেনে তুলে নিলেন।

বিস্ফারিত চক্ষু। সমস্ত মুখখানার মধ্যে যেন একটা নীল আভা ছড়িয়ে আছে।

দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠের পাশ দিয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত রক্তধারা শুকিয়ে আছে কালো একটি সুতোর মত। প্রসারিত দুটি বাহু মুষ্টিবদ্ধ।

গতকাল রাত্রি দশটা পর্যন্ত ঐ ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে কত গল্প করে এসেছেন। স্বপ্নেও, ভাবিনি যাঁকে গতরাত্রে দশটার পর বিদায় দিয়েছিলাম সুস্থ সবল, তাঁকে আজ প্রত্যুষে অমনি করে ধূলি-মলিন প্রাণহীন অসাড় অবস্থায় তাঁরই বহু যত্নের বড় আদরের অর্কিড়-ঘরের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখব!

সেই চিরপুরাতন প্রশ্নটা যেন আবার নতুন করে মনের মধ্যে এসে উদয় হয়। কাল যে ছিল, আজ সে নেই!

কেই বা জানত, তাঁর শেষের মুহূর্তটি এমন করে ঘনিয়ে এসেছে!

মৃত্যু ঠিক এসে দাঁড়িয়েছে অলক্ষ্যে নিঃশব্দে তাঁর একেবারে পশ্চাতে!

এই তো মানুষের জীবন! কখন যে কোন্ মুহূর্তে তার অবসান ঘটবে কেউ জানতে পারে না। অথচ এরই জন্য কত না স্বপ্ন রচনা, কত না আস্ফালন,কত না আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা!

মানুষের মন স্বভাবতই এমনি। তাই বোধ করি সে বার বার মৃত্যু দেখে ক্ষণেকের জন্য দার্শনিক হয়ে ওঠে, আবার কিছুক্ষণ পরে সব ভুলে গিয়ে মৃত্যুকে অস্বীকার করে জীবনের সাজঘরে মুখে চুনকালি মেখে অভিনয় করে। হাসে, কাঁদে, ভালবাসে, ঘৃণা করে, আক্রোশে অধীর হয়।

হঠাৎ যেন কিরীটীর কণ্ঠস্বরে আমার দার্শনিক চিন্তাধারাটা ছিন্ন হয়ে গেল। চেয়ে দেখি, মৃতদেহ উপুড় করে কিরীটী ঘাড়ের কাছে হস্তষ্কৃত লেন্সের সাহায্যে কি যেন পরীক্ষা করতে করতে বলছে, ঘাড়ের কাছে মৃতের একটা কালো বিন্দু লক্ষ্য করেছেন সোম?

কালো বিন্দু! সোম এগিয়ে গেলেন।

হ্যাঁ, দেখুন। একটা pin point blood clot বলে মনে হচ্ছে যেন দেখুন

আমিও এগিয়ে গিয়ে দেখলাম। শুধু একটা পিন পয়েন্ট ব্লাড ক্লট নয়, তার চারপাশে একটা অস্পষ্ট কালো দাগও আছে।

কোন পোকা-টোকা বিষাক্ত কিছুতে কামড়ায়নি তো? ঘরের মধ্যে চারদিকে যা সব অদ্ভুত গাছগাছড়া রয়েছে সোম বললেন কিরীটীকে লক্ষ্য করে।

বিচিত্র কিছু নয়। এবং সে-রকম বিষাক্ত পোকাও আছে, যার কামড়ে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ঐ সঙ্গে আমাদের আরো কিছু অবতে হবে সোম। কথাগুলো ঠিক জবাবে নয়, যেন কতকটা আত্মগতভাবেই বলতে বলতে সহসা কিরীটী মৃতের মুষ্টিবদ্ধ হাতের ভিতর থেকে একটা লাল ও সাদায় মেশানো সুতো অতি যত্নে ধীরে ধীরে টেনে খুলে নিয়ে, হাতের পাতায় রেখে লেন্সের সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

কি ওটা? এগিয়ে গেলাম আমি।

একগাছি লাল ও সাদায় মেশানো সুতো। বলতে বলতে কিরীটী সুতোগাছটি পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তার মধ্যে রেখে সযতনে কাগজটি পুনরায় ভাঁজ করে বুক-পকেটে  রেখে দিল।

আচ্ছা সোম, ডাক্তার ভট্টাচার্য মৃত্যু সম্পর্কে আর কিছু বলেছেন? কি ভাবে মৃত্যু হল বা কিছু?

না, তেমন কোন কিছু স্পষ্ট করে বলেননি। কেবল বললেন, মৃতদেহ দেখে তাঁর মনে হয় কোন তীব্র বিষের ক্রিয়াতেই মৃত্যু ঘটেছে।

মৃত্যু কতক্ষণ আগে হয়েছে বলে তাঁর মনে হয়?

রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে।

আচ্ছা এবারে চলুন নীচে যাওয়া যাক। এ বাড়ির সকলকেই আমি নিজে কিছু কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

বেশ তো, চলুন।

পুনরায় সেই চাদরটি দিয়ে বলীন সোম মৃতদেহটা সম্ভপণে ঢেকে দিলেন। তারপর সকলে আমরা একে একে কাচঘর থেকে বের হয়ে এলাম। ছায়ান্ধকার ঘেরা কাচঘর থেকে জ্যৈষ্ঠের প্রখর রৌদ্রঝলকিত প্রকৃতির মধ্যে এসে আমাদের সকলের চোখে কেমন যেন ধাঁধা লেগে গেল।

সকলে নীচে নেমে এলাম।

প্রথমে দোতলায় যে ঘরে এসে আমরা সমবেত হয়েছিলাম, সেই ঘরের মধ্যেই এসে আবার সকলে উপবেশন করলাম।

প্রথমেই সচ্চিদানন্দের শ্যালক মহিমারঞ্জনের ডাক পড়ল।

কিরীটী প্রশ্ন শুরু করল, কতদিন আপনি এ-বাড়িতে আছেন মহিমাবাবু?

তা প্রায় মাস ছয়েক তো হবেই।

এখানে আসবার আগে আপনি কোথায় ছিলেন?

আমাদের আদি বাস বর্ধমান জেলায়। আসানসোলের কাছাকাছি মিঠানীতে প্রেমদাসজীর কলিয়ারীতেই আমি কাজ করছিলাম। মতের অমিল হওয়ায় কাজ ছেড়ে দেব-দেব করছিলাম, এই সময় সচিই আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসে তার ব্যবসাপত্র দেখবার জন্যে।

সচ্চিদানন্দবাবুর কোন ব্যবসা ছিল নাকি?

হ্যাঁ, কয়লার।

কি রকম লাভ হত তাতে?

বছরে বিশ-ত্রিশ হাজার তো বটেই।

মনে মনে ভাবছিলাম, এ কথাটা গতকাল সচ্চিদানন্দ তোকই একবারও বলেননি! লোকট তাহলে মোটামুটি ধনীই ছিল বলতে হবে।

আচ্ছা, সচ্চিদানন্দবাবুর ঐকয়লার ব্যবসা ছাড়া আর কোন আয়ের পথ ছিল কি মহিমাবাবু?

কলকাতার উপরে পাঁচ-ছখানা বাড়ি আছে, তার ভাড়ার আয়ও কম নয়। তাছাড়া এদিক-ওদিকে বেশ কিছু জমিজমাও আছে।—মহিমারঞ্জন জবাব দিলেন।

ব্যাঙ্কে নগদ টাকাকড়ি?

নিশ্চয়ই আছে, তবে সঠিক খবর আমি তো জানি না। তার সলিসিটার অচিন্ত্য বোস বলতে পারেন।

অচিন্ত্য বোস? মানে বোস অ্যাণ্ড দত্তর সিনিয়ার পার্টনার?

হ্যাঁ।

আপনার নিজের সংসারে কে কে আছেন মহিমাবাবু? মানে আপনার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে—

কিরীটীর প্রশ্নে মহিমারঞ্জন মৃদু হেসে বললেন, স্ত্রী, আজ গত হয়েছেন তেরো বছর। তারপর আর ওপথে পা বাড়াবার সাধ হয়নি রায় মশাই। একটি মাত্র পুত্র, সে বর্ধমানেই থাকে তার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে।

ছেলের সঙ্গে আপনার বনিবনা কেমন?

ঠিক তা নয়, সদ্ভাবটুকু বজায় রেখে পিতাপুত্র বর্তমানে আমরা দূরে-দূরেই থাকি।

মহিমারঞ্জন ও তাঁর একমাত্র পুত্রের মধ্যে সম্পর্কটা তাঁর ঐ কথার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে যাওয়ায় কিরীটী বোধ করি ও সম্পর্কে দ্বিতীয় আর কোন প্রশ্নই করল না। সম্পূর্ণ অন্য কথায় ফিরে গেল সে।

আচ্ছা, রাধারাণীদেবী তো আপনার সহোদরা ভগ্নীই?

না, বৈমাত্রেয় বোন। আমার পিতার দুই সংসার—প্রথম পক্ষের সন্তান আমি, রাধা আমার বিমাতার সন্তান।

সচ্চিদানন্দবাবু সম্পর্কে যতটা পারেন, মোটামুটি একটা ধারণা দিতে পারেন মহিমাবাবু?

প্রশ্নের জবাবে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মহিমারঞ্জন জিজ্ঞাসা করলেন, কি জানতে চান বলুন?

প্রশ্নটা তো আমার স্পষ্ট মহিমাবাবু। জবাবটাও স্পষ্ট পেলে সুখী হব।

একটু যেন নিজেকে গুছিয়ে নিয়েই মহিমারঞ্জন বলতে শুরু করলেন :

দেখুন কিরীটীবাবু, যে ভাবেই হোক, লোকটা আজ সাংসারিক সমস্ত নিন্দাস্তুতির বাইরে চলে গিয়েছে। অন্য সময় বা অন্য পরিস্থিতি হলে হয়ত আপনার প্রশ্নের কোন জবাবই দিতাম না। কিন্তু ঘটনাচক্রে এমন একটা বিশ্রী পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে, আমি না বললেও হয়ত নানা জনের মুখে নানা কথা আপনারা শুনবেন। এবং তার কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যে, হয়ত জানতেও পারবেন না। সেক্ষেত্রে উচিৎ ভেবেই যা আমি তার সম্পর্কে জানি, বলছি। দোষ-গুণ ভাল-মন্দ নিয়েই মানুষ। তার বাইরে কেউ নয়। তবু আজ বলব, চরিত্রে তার দোষ থাকলেও গুণটাই ছিল বেশী। তাই তো ভেবে অবাক হচ্ছি, যেন দিশে পাচ্ছি না, যদি আপনাদের অনুমানই শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, অর্থাৎ তাকে কেউ হত্যাই করে থাকে তাহলে কে সে, লোকটাকে এমন করে হত্যা করল আর কেনই বা করল?

বলতে বলতে একটু থেমে মহিমারঞ্জন আবার বলতে লাগলেন, আগে আত্মীয়তার সূত্রে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত ও দেখাশোনার মধ্যে দিয়ে তার সঙ্গে যেটুকু পরিচয় ছিল, তখন লোকটাকে ততটা না চিনতে পারলেও, গত ছয় মাস ঘনিষ্ঠভাবে তার পাশে পাশে থেকে যেটুকু চিনেছি, সেটুকুই বলতে পারি। সচ্চিদানন্দ মদ্যপান করত, কিন্তু মদ্যপান করে কখনোও এই ছ মাসে তাকে মাতাল হতে দেখিনি। প্রথম যৌবনে তার নাকি একটা কলঙ্ক ছিল, বিবাহের পর যেটা রাধারাণী জেনেছিল। কিন্তু তারপর আর গত ঊনিশ-কুড়ি বছর সে সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্যই শুনিনি। রাধাকে সে সত্যিই খুব ভালবাসত।

বাধা দিল এই সময় কিরীটী, সচ্চিদ্মনন্দবাবুর বাল্যবন্ধু যতীন চাটুয্যে সম্পর্কে কিছু জানেন আপনি?–যতীনবাবুর স্ত্রী নারায়ণী ও তাঁর কন্যা শিবানী?

একটু ইতস্তত করেই যেন মহিমারঞ্জন জবাব দিলেন, হ্যাঁ, তাদের কথা শুনেছিলাম বটে, তবে চাক্ষুষ তাদের কখনও দেখিনি। বন্ধুর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও কন্যা অনেকদিন পরে কোন সংবাদ না দিয়ে এখানে এসে উঠেছিল বলে শুনি। কিন্তু আমি এখানে এসে তাদের কাউকেই দেখিনি। নারায়ণীদেবীর তখন মৃত্যু হয়েছে, আর শিবানী তখনও নিখোঁজ।

হুঁ। আচ্ছা, ঐ মণিকাদেবী সম্পর্কে আপনার কি মনে হয় মহিমাবাবু?

মেয়েটি সত্যিই বড় ভাল। যেমন শান্ত-শিষ্ট, তেমনি ভদ্র, বিনয়ী ও প্রখর বুদ্ধিশালিনী।

মণিকাদেবী সম্পর্কে সচ্চিদানন্দবাবুর মনোভাব তো আপনি জানতেন?

জানতাম।

আচ্ছা, আপনার ভগ্নীর যে মস্তিষ্ক-বিকৃতির কথা শুনেছি, সে-কথা কি সত্যি?

সত্যি। বহুদিন ধরেই সে অভাগিনী মস্তিষ্ক-বিকৃতিতে ভুগছে।

কতদিন হবে বলে মনে হয়?

তা ধরুন বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ তো হবেই। বলতে গেলে বিবাহের বছর তিনেক পরেই রাধারাণীর মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ প্রকাশ পায়।

মস্তিষ্ক-বিকৃতি ঘটবার মত কোন অসুখ-বিসুখ বা কোন দৈব-দুর্ঘটনা ঘটেছিল কি, যাতে করে—

তা তো কিছু জানি না। তবে এইটুকুই জানি, ঐ সময় রাধারাণী ছমাসের অন্তঃস্বত্ত্বা ছিল। সচ্চিদানন্দের সঙ্গে সে তাদের দেশে ঢাকায় যায়। মাসখানেক বাদেই ফিরে আসে কলকাতায়। কলকাতায় ফিরেই একদিন রাধারাণী দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কেমন বেকায়দায় পড়ে যায় ফলে তার গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। সেও অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারপর বহুদিন ধরে চিকিৎসার পর শারীরিক সে সুস্থ হয়ে উঠলেও কিন্তু একটু একটু করে মস্তিস্ক-বিকৃতির লক্ষণ দেখা দিল। এবং সে দোষ এখনও তার সারেনি। তবে ইদানীং মাস দেড়েকশিবানী আসবারপর থেকে দেখছি, হঠাৎ যেন কেমন শান্ত, চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল।

আপনার বোনের মুখে কখনও কোনদিন কিছু আপনি শোনেননি?

না। বরাবরই রাধারাণী একটু স্থির ও গম্ভীর প্রকৃতির। কোন কথাই কাউকে সে বড় একটা বলত না, বা বলতেও শুনিনি।

সচ্চিদানন্দবাবুর মৃত্যুর ব্যাপারে কাউকে কোনরকম আপনার সন্দেহ হয়।

না।

অতঃপর ডাক পড়ল সচ্চিদানন্দের ভ্রাতুস্পুত্র আনন্দ সান্যালের।

আনন্দ সান্যালের বয়স ছাব্বিশ-সাতাশের বেশী হবে না। রোগাটে পাতলা দেহের গড়ন। কালো চেহারার উপরে মুখখানি তীক্ষ্ণ। চোখ দুটি যেন বুদ্ধির প্রাচুর্যে ঝকঝক করছে।

সচ্চিদানন্দের বড় ভাই নিত্যানন্দ সান্যালের একমাত্র পুত্র।

সচ্চিদানন্দর যা কিছু অর্থ সম্পত্তি, তার মূলে তাঁর মামা। মামা ছিলেন অপুত্রক। প্রচন্ড অর্থশালী লোক। সচ্চিদানন্দকে তাঁর দশ বছর বয়সের সময় তাঁর কাছে নিয়ে যান, বিহারে। চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত সচ্চিদানন্দ তাঁর মামার কাছেই ছিলেন, তারপর মামার মৃত্যুর পর তাঁর সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন।

কলকাতার এই বাড়িটাও মামার।

অন্য ভাগ্নে নিত্যানন্দ যে মামার সম্পত্তির কোন কিছুই কেন পেলেন না, সেও একটা রহস্য।

যাই হোক, নিত্যানন্দের অবিশ্যি সেজন্যে কোন দুঃখ ছিল না।

তিনি জয়পুর স্টেটে মোটা মাইনেতেই কাজ করতেন। চার মাস আগে নিত্যানন্দর মৃত্যু হয়, এবং মৃত্যুর পর সচ্চিদানন্দের আহ্বানেই আনন্দ তাঁর কাছে চলে আসে।

আনন্দ লেখাপড়া বিশেষ কিছু করে নি কলেজে বা স্কুলে। তবে নিত্যানন্দ বাড়িতে তাকে প্রাইভেট টিউটর রেখে যথেষ্ট লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। ইদানীং এখানে আসা অবধি আনন্দ কাকার কাছে থেকে কাকার ব্যবসাতেই হানোতে কাজ শিখছিল।

আনন্দ দোতলার পাঁচখানি ঘরের একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরটিতে থাকে।

সে বললে, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। গতরাত্রেও সে প্রায় বারোটা পর্যন্ত জেগে পড়ছিল। শোবার পর বারান্দায় সে দুবার কারও পায়ের শব্দ শোনে। একবার খুব লঘু পদশব্দ। অন্যবার স্পষ্ট না হলেও মনে হয়েছিল, তার পরিচিত কাকারই ঘাসের চটির শব্দ। আর বিশেষ কিছুই সে বলতে পারে না। কারণ তারপরই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজ সকালে মণিকার ভৃত্য নন্দনের ডাকে তার ঘুম ভাঙে।

কাকীমাকে সে-ই কাকার মৃত্যু-সংবাদটা দিয়েছে, কিন্তু সে-সংবাদ শুনে তাঁর মধ্যে কোন চাঞ্চল্যই প্রকাশ পায়নি।

সংবাদটা শুনে তিনি যেমন গুম হয়ে ছিলেন, এখনও তেমনি গুম হয়েই যেন সোফাটার উপরে বসে আছেন।

একটি কথাও কারও সঙ্গে বলেননি।

আনন্দ সেই থেকে তাঁর পাশেই আছে।

আনন্দ সান্যালকে বিদায় দিয়ে ডাকা হল এবারে শিবানীর পরিচয়ে আগতা অভিনেত্রী মণিকাদেবীকে।

আনন্দকে বলে দেওয়া হয়েছিল, মণিকাদেবীকে এই ঘরে পাঠিয়ে দিতে।

.

লঘু পদবিক্ষেপে মণিকা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

পদশব্দে সকলেই আমরা মুখ তুলে তার দিকে তাকালাম। রূপালী পর্দায় বহুবার দেখা পরিচিত মুখ। নামকরা একজন প্রথম শ্রেণীর অভিনেত্রী হিসাবে মণিকাদেবীর প্রচুর খ্যাতি আছে।

বহু সিনেমা-কাগজে বহুবার ঐ মুখখানি দেখেছি। তবু যেন একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে, রূপ-সজ্জার বাইরে একান্ত সাদাসিধে সেই প্রতিভাশালিনী অভিনেত্রীকে দেখে মনে হল, এমনটি বুঝি পূর্বে দেখিনি।

ছিপছিপে দেহের গঠন। কাঁচা সোনার মত উজ্জ্বল গাত্র-বর্ণ। সামান্য একটু লম্বাটে ধরনের মুখখানি। উজ্জ্বল ভাসা-ভাসা টানা দুটি চক্ষু। দৃঢ়বদ্ধ পাতলা ওষ্ঠ। ধারালো চিবুক। মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝাবার উপায় নেই বয়স তার সঠিক কত। মনে হয়, সতেরো-আঠারোর বেশী কিছুতেই নয়। অথচ সচ্চিদানন্দর হিসাব অনুসারে পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স তো নিশ্চয় হওয়া উচিত।

অপূর্ব দেহের বাঁধুনি। যৌবনশ্রী যেন দেহের তটে তটে উছলে পড়ছে। কি ঢল ঢল লাবণ্য! মাথার চুল এলো খোঁপার আকারে কাঁধের উপরে ভেঙে পড়ছে। পরিধানে সাদা একটি ব্লাউজ ও সাধারণ ফিকে নীল একটি দামী তাঁতের শাড়ি। খালি পা। হাতে দুগাছি করে সোনার চুড়ি, দুকানে দুটি হীরের দুল।

আপনার নাম মণিকাদেবী? কিরীটীই প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ। মৃদু শান্ত কণ্ঠ হতে মণিকার জবাব এল।

বসুন। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা আছে।

মণিকা এগিয়ে গিয়ে সামনের সোফার উপরে বসল।

গতকাল রাত্রে ফেরবার পর একমাত্র আপনার সঙ্গেই শুনলাম সচ্চিদানন্দবাবুর দেখা হয়েছিল, তাই না মণিকাদেবী?

কিরীটীর প্রশ্নে চমকে যেন মণিকা তার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাল। তারপর মৃদুকণ্ঠে বলল, হ্যাঁ।

কি কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আপনার কাল রাত্রে?

বিশেষ কোন কথাই হয়নি। খাবার কথা বলতে তিনি বললেন, খাবেন না। তখন এক গ্লাস দুধের কথা বললাম, তাও বললেন খাবেন না।

তারপর?

তারপর আমি চলে যাই নিজের ঘরে।

রাত্রে কাল কটার সময় শুয়েছিলেন আপনার মনে আছে কি?

রাত তখন সাড়ে এগারোটা হবে।

সাধারণত কখন আপনি ঘুমোতে যেতেন?

তা প্রায় ঐ রকম সময়ই হয় রাত্রে আমার শুতে শুতে।

বিছানায় শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিশ্চয় আপনি কাল রাত্রে ঘুমিয়ে পড়েননি?

না। বোধ হয় কিছুক্ষণ জেগেই ছিলাম।

কিছুক্ষণ মানে কতক্ষণ?

মিনিট পনেরো-কুড়ি হবে বোধ হয়।

শোবার পর বাইরের বারান্দায় কোনরকম শব্দ শুনেছেন কি?

প্রত্যুত্তরে যেন একটু ইতস্তত করেই মণিকা বললে, না।

ঠিক মনে করে বলছেন? একটু ভেবে দেখুন।

হ্যাঁ, ঠিকই বলছি।

আপনি কোন্ ঘরে থাকেন দোতলায়?

কাকীমা ও কাকাবাবুর মাঝের ছোট ঘরটায়।

এরপর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। মনে মনে বোধ হয় কোন একটা মতলব গুছিয়ে নেয়।

মণিকাদেবী!

বলুন?

আপনার আসল নাম তো শিবানীদেবী, তাই না?

কিরীটীর কথায় মণিকা আবার চমকে ওর মুখের দিকে তাকায়। কিন্তু প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না।

আপনি হয় তো আশ্চর্য হচ্ছেন আমার কথা শুনে, তাই না? আমি জানি আপনার সত্যিকারের পরিচয়।

সত্যিকারের পরিচয় জানেন? মণিকার প্রশ্নটা যেন তার উত্তেজিত চাপা কষ্ঠ হতে তীক্ষ্ণ শরের মত নির্গত হয়ে এল।

হ্যাঁ, জানি।

জানেন? কি জানেন?

আপনার সত্য পরিচয়, অর্থাৎ আপনি যে আসলে শিবানীদেবী-সচ্চিদানন্দবাবুর মৃত বন্ধুর কন্যা।

জানেন?

হ্যাঁ।

কিরীটীর প্রত্যুত্তরের সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্ত-পূর্বে মণিকার চোখমুখে যে একটা চাপা ব্যাকুলতা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং যেটা আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেনি, আবার হঠাৎ-ই সেটা যেন মিলিয়ে গেল।

জানি যে, আট বছর আগে আপনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর মাত্র মাস দেড়েক আগে ফিরে এসেছেন চিঠি দিয়ে।

মণিকা চুপ করেই থাকে, কোন কথা বলে না। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত স্তব্ধতাটা যেন কেবল বড় দেওয়াল-ঘড়ির পেণ্ডুলামটার একঘেয়ে টষ্ট শব্দে পীড়িত হতে থাকে।

আচ্ছা, সত্যি বলুন তো মণিকাদেবী, আপনি সর্বজন-প্রশংসিত ও আকাঙ্খিত অভিনেত্রীর জীবন থেকে হঠাৎ এতদিন বাদে আবার ঘরোয়া জীবনের মধ্যে ফিরে এলেন কেন?

আমার একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের প্রশ্নটা নিয়েই কি আপনি অযথা অযৌক্তিকভাবে টানাটানি করছেন না মিঃ রায়?

অযথা বা অযৌক্তিক নয় বলেই করলাম প্রশ্নটা। যাক সে-কথা। আপনিই তো সর্বাগ্রে আজ সকালে আবিষ্কার করেছেন মৃত সচ্চিদানন্দবাবুকে?

হ্যাঁ।

কখন আপনি উঠেছিলেন আজ সকালে?

ভোর সাড়ে পাঁচটার কিছু আগে।

উঠেই কি আপনি লেবু-জল নিয়ে সচ্চিদানন্দবাবুর ঘরে গিয়েছিলেন?

না। স্নান সেরে গিয়েছিলাম।

আচ্ছা, এবার আপনি যেতে পারেন।

মণিকা নিঃশব্দে কক্ষ হতে চলে গেল।

কিরীটী এবারে মহিমারঞ্জনকে লক্ষ্য করে বললে, আপনার বোনের সঙ্গে একটিবার দেখা করতে চাই মহিমাবাবু।

বেশ তো। চলুন।

.

আমি, কিরীটী ও বলীন সোম মহিমারঞ্জনের পিছনে পিছনে গিয়ে নির্দিষ্ট ঘরে প্রবেশ করলাম।

প্রশস্ত ঘরটি বেশ। ঘরের দেওয়াল ও সিলিং ফিকে সবুজ রঙে ডিসটেম্পার করা। ঘরের সব কটি জানলাতেও ফিকে সবুজ রঙের পর্দা দেওয়া দেওয়ালের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ম্যাচ করে।

ঘরের মেঝেতে ধূসর রঙের পুরু গালিচা বিছানো। দেওয়ালগুলো নিরাভরণ, কোন ছবি, ক্যালেণ্ডার বা ফটো নেই, মাত্র দক্ষিণ দেওয়ালে একটি পরমহংসদেবের ধ্যানস্থ নিমীলিতচক্ষু প্রতিকৃতি ছাড়া। ঘরের দেওয়াল ঘেঁসে একটি নীচু ধরনের আধুনিক ডিজাইনের খাট। তার উপরের শয্যাটা এখনও এলোমেলো হয়ে আছে বোধ হয় গত রাত্রে শয্যাধিকারীর ব্যবহারের জন্যে। তারই কিছুদূরে গোটা-দুই চওড়া দামী সোফা। ঘরে আর কোন আসবাবপত্রের বাহুল্য নেই।

একটা সোফার উপরে পাশাপাশি আনন্দ সান্যাল ও একটি মধ্যবয়সী মহিলা মুখ নীচু করে বসেছিলেন। বয়স হলেও দেহের বাঁধুনি যেন এখনও রীতিমত অটুটই আছে।

আমাদের পদশব্দে আনন্দ সান্যাল মুখ তুলে তাকিয়ে ভূ-দুটো কোঁচকালেন। তাঁর পার্শ্বে উপবিষ্টা ভদ্রমহিলাটিও মুখ তুলে ঐ সঙ্গে আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।

ভাসা-ভাসা তাঁর দুটি অসংবদ্ধ চোখের তারায় যেন কেমন একপ্রকার অসহায় দিশেহারা দৃষ্টি। তিনি যেন এ পৃথিবীতে নেই। এই পৃথিবীর সুখ-দুঃখ, ভাবনা-চিন্তার স্পর্শের বাইরে যেন তিনি। সমস্ত মুখখানা ব্যেপে যেন একটা ক্লান্ত, রুগ্ন, কৃশ ছায়া।

ভদ্রমহিলার চেহারা অন্যথায় মোটামুটি সুন্দরই বলা যেতে পারে। চোখে-মুখের মধ্যে একটা চমৎকার আলগা লক্ষীশ্রী আছে। মাথাভর্তি কুঞ্চিত কেশ এলিয়ে পড়েছে পশ্চাতের দিকে, মাথার অবগুণ্ঠন স্খলিত হয়ে কাঁধের উপরে নেমে এসেছে। সিঁথিতে ক্ষীণ সিঁদুর-রেখা এখনও এয়োতির চিহ্ন ধারণ করে আছে। হাত দুটি কোলের উপরে পড়ে আছে শ্লথভাবে। মণিবন্ধে চারগাছি করে সোনার চুড়ি ও সাদা শাঁখা। পরিধানে চওড়া সাদা-কালো ভেলভেট-পাড়ের শাড়ি। গায়ে সাদা সেমিজ।

আমাদের হয়ে মহিমারঞ্জনই কথা বললেন তাঁর ভগ্নীকে সম্বোধন করে, রাধারাণী, এঁরা– পুলিসের লোক, তোমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতে চান।

কিন্তু সম্বোধিতার নিকট হতে ক্ষীণতম সাড়া বা প্রত্যুত্তরই এল না। তিনি নিশ্চল পাষাণ-প্রতিমার মত সোফার উপরে যেমন বসেছিলেন, তেমনি ভাবেই বসে রইলেন। কোন কথা যে তাঁর কানে গিয়েছে, তাও মনে হল না।

মহিমারঞ্জন আবার ডাকলেন স্নিগ্ধ কঠে, রাধারাণী!

কিন্তু এবারেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না।

রাধারাণী, শুনছ?

তবু সাড়া-শব্দ নেই। নিশুপ হয়ে যেমন বসে ছিলেন, তেমনি বসেই রইলেন।

কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিন্তু চেয়েই ছিল রাধারাণীদেবীর মুখের দিকে। মহিমারঞ্জনের শেষ ডাকে এতক্ষণ পরে আবার রাধারাণীদেবী মুখ তুললেন।

চোখে তাঁর সেই আগের মতই নির্বোধ অসহায় দৃষ্টি।

এঁরা তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। এঁরা যা জিজ্ঞাসা করেন, তার জবাব দাও।

রাধারাণীদেবী মুখ ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালেন।

হঠাৎ আনন্দ সান্যালের কণ্ঠস্বরে যেন সকলেই আমরা চমকে উঠি।

বেশ রুক্ষ-কণ্ঠেই আনন্দ সান্যাল বললে, কেন আপনারা কাকীমাকে এ সময়ে বিরক্ত করতে এলেন? দেখছেন উনি অত্যন্ত নাভাস হয়ে পড়েছেন! যা জিজ্ঞাসা করবার, কাল এসে জিজ্ঞাসা করলেও তো পারেন।

জবাব দিলেন আমাদের হয়ে বলীন সোম। বললেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত আনন্দবাবু। ওঁর এ সময়কার মনের অবস্থা যে বুঝতে পারছি না তা নয়, কিন্তু আমাদেরও উপায় নেই আর। কয়েকটা প্রশ্ন ওঁকে আমাদের করতেই হবে।

কিরীটী এবার কথা বললে, রাধারাণীদেবী, আপনার কপালের ডানদিকে ঠিক ভূর উপরে একটা কালো দাগ দেখছি। কোনরকম আঘাত বা চোট লেগেছিল কি আপনার কপালে আজ-কালের মধ্যে?

কিরীটীর প্রশ্নে চমকে আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালাম অদূরে উপবিষ্টা রাধারাণীদেবীর মুখের দিকে। সত্যিই তো! একটা কালসিটের দাগ রয়েছে কপালের ডান দিককার ভূর ঠিক উপরে। এতক্ষণ তো আমাদের কারুরই ওটার উপরে নজর পড়েনি! মনে হচ্ছে এখন বটে, কোন শক্ত কিছুতে আঘাত লেগে বুঝি থেঁতলেই গিয়েছে। কিরীটীর প্রশ্নে রাধারাণী নিঃশব্দে হাত তুলে কপালের নির্দিষ্ট স্থানটিতে একবার হাত বুলিয়ে সামান্য একটু মুখটা বিকৃত করলেন। মনে হল যেন যন্ত্রণাবোধেই মুখটা বিকৃত হল। কিন্তু কোন জবাব দিলেন না তিনি।

কোথাও চোট লেগেছিল নিশ্চয়ই, তাই না? কিরীটী পুনরায় প্রশ্ন করে।

মনে নেই তো! ক্ষীণ কণ্ঠে এই সর্বপ্রথম কথা বললেন রাধারাণী।

নিশ্চয়ই চোট লেগেছিল। মনে করে দেখুন।

কিরীটীর কথায় জ্ব-কুঞ্চিত করে বোধ করি কয়েক মুহূর্ত স্মরণ করার চেষ্টা করলেন কোন কথা। কিন্তু মুখের দিকে চেয়ে মনে হল, মনে করতে পারছেন না।

কি, মনে পড়ছে না?

না।

আচ্ছা, কালকের রাত্রের কথা কিছু আপনার মনে আছে রাধারাণীদেবী?

কালকের রাত্রের কথা?

হ্যাঁ। মানে কাল রাত্রে আপনার স্বামীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

আমার স্বামী!

হ্যাঁ। সচ্চিদানন্দবাবু—আপনার স্বামী।

সচ্চিদানন্দবাবু! আমার স্বামী! কথাটা উচ্চারণ করে ভদ্রমহিলা এমনভাবে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন যে, মনে হল তার কথার বিন্দুবিসর্গও তিনি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন নি। বা পারছেন না।

হ্যাঁ, সচ্চিদানন্দবাবু—আপনার স্বামী। কাল রাত্রে তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি?

আমার স্বামী!

হ্যাঁ, আপনার স্বামী।

আমার স্বামী! তিনি কে? এমন অসহায় করুণ কষ্ঠে শেষের কথাগুলো ভদ্রমহিলা উচ্চারণ করলেন যে, মনে হল স্বামী কথাটার মানেও যেন তিনি জানেন না বা বোঝেন না। সম্পূর্ণ অজ্ঞাত, অপরিচিত ঐ শব্দটা তাঁর কাছে। কিরীটীর মুখের দিকে আমি তাকালাম। ঘরের মধ্যে অন্যান্য সকলেও পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে যেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।

কোন কথাই কি আপনার মনে পড়ছে না রাধারাণীদেবী? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।

কই না তো!

এই বাড়ি, ঘর, দুয়ার, আপনার স্বামী, আপনার দাদা মহিমাবাবু—

দাদা মহিমাবাবু! অস্পষ্টভাবে কেবল উচ্চারণ করলেন কথাগুলো রাধারাণী দেবী।

আমাকেও কি তুই চিনতে পারছিস না রাধারাণী?

মৃদুভাবে ঘাড়টা কেবল নাড়লেন রাধারাণী। বোঝা গেল, মহিমারঞ্জনকেও তিনি চিনতে পারছেন না।

কাকীমা! এবারে আনন্দ সান্যাল ডাকল রাধারাণীকে।

রাধারাণী আনন্দের ডাকে মুখ তুলে তাকালেন, কিন্তু তাঁর অসহায় নিরুৎসুক দৃষ্টি থেকে বোঝা গেল স্পষ্টই যে, তাকে তিনি চিনতে পারছেন না।

দুহাতে হঠাৎ রাধারাণীকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুলভাবে আনন্দ সান্যাল ডাকলে, কাকীমা! কাকীমা! তুমি কি আমাদের কাউকেই চিনতে পারছ না?

পূর্বের মতই মৃদু ঘাড় নেড়ে রাধারাণী জানালেন, না।

রাধারাণীদেবী কাউকেই চিনতে পারছেন না।

মহিমারঞ্জন ব্যাকুল হয়ে আবার যেন ভগ্নীকে কি বলতে যাচ্ছিলেন, কিরীটী তাঁকে বাধা দিয়ে বললে, থাক, ওঁকে আর বিরক্ত করবেন না মহিমাবাবু। সম্ভবত কোন কারণে মনে হচ্ছে ওঁর স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে।

কি বলছেন আপনি!

মহিমারঞ্জনের প্রশ্নটা যেন একটা আর্ত চিৎকারের মতই শোনাল।

অতঃপর কিরীটী বললে, চলুন এ-ঘর থেকে। ওঁকে আর বিরক্ত না করাই ভাল।

সকলে নিঃশব্দে আমরা ঘর হতে বের হয়ে এলাম।

.

সচ্চিদানন্দবাবুর শয়নকক্ষটি একবার দেখা প্রয়োজন।

সকলে আমরা মহিমারঞ্জনবাবুর সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘরের দিকে এবারে অগ্রসর হলাম।

এ বাড়ির প্যাটার্নটা একটু অদ্ভুত।

অর্ধচন্দ্রাকৃতি দোতলার বারান্দাটা বেঁকে গিয়েছে পশ্চিম দিক হতে দক্ষিণকে কেন্দ্র করে পূর্বপ্রান্তে। বেশ চওড়া বারান্দা, আগাগোড়া সাদা-কালো মার্বেল পাথরে মোড়া।

উপরে সর্বসমেত সাতখানি ঘর এবং তিনটি বাথরুম। দুটি বাথরুম দুটি ঘরের সংলগ্ন। তৃতীয়টির সঙ্গে ঘরগুলির কোন নিকট যোগাযোগ নেই। সাতটি ঘরের মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঘরটিই সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত হলঘরের মত। সেই ঘরেই আমরা সমবেত হয়েছিলাম সর্বপ্রথমে।

সিঁড়ি দিয়ে উঠেই চন্দ্রাকৃতি বারান্দার এধারে দুখানি ঘর, বাকি পাঁচখানি ঘর বারান্দার অন্য অংশে।

প্রথম ঘরটিতে থাকে আনন্দ সান্যাল। দ্বিতীয়টি প্রায় খালি, সচ্চিদানন্দ তাঁর কাজ-কর্ম করতেন ঐ ঘরে বসে। তৃতীয়টি হল ঘর। চতুর্থটি ব্যবহার করতেন মহিমারঞ্জন। পঞ্চমটিতে থাকে রাধারাণীদেবী, সপ্তম ও সর্বশেষ ঘরটিতে থাকতেন সচ্চিদানন্দ নিজে। রাধারাণী ও সচ্চিদানন্দর ঘরের মধ্যবর্তী সর্বাপেক্ষা ছোট ঘরখানি—যেটা এযাবৎকাল স্টোর-ঘর রূপে ব্যবহৃত হত, মণিকা এ বাড়িতে আসবার পর থেকে সেই ঘরখানিই পরিষ্কার করে অধিকার করেছিল।

আমরা সকলে মহিমারঞ্জনকে অনুসরণ করে বারান্দার শেষপ্রান্তে সেই ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম। সেই ঘরেরই অল্প তফাতে তিনতলায় ওঠবার সিঁড়ি।

ঘরখানি আকারে বেশ বড়। সামান্য কিছু মুল্যবান আসবাবপত্রও আছে ঘরের মধ্যে।

একপাশে সিঙ্গ খাটে শয্যা বিস্তৃত। নিভাঁজ শয্যাটি দেখলেই বোঝা যায়, গত রাত্রে আদৌ ব্যবহৃত হয়নি।

তার পাশে একটি শ্বেতপাথরের ত্রিপয়। ত্রিপয়ের উপরে একটি রেডিয়াম ডায়াল দেওয়া সুদৃশ্য টাইমপিস্।

টাইমপিটির দিকে তাকাতেই নজরে পড়ল, ঘড়ির কাঁচটা বিশ্রীভাবে ফাটা। কোন শক্ত কিছুতে আঘাত লেগেই নিশ্চয় ঘড়ির কাঁচটা চিড় খেয়ে গিয়েছে। তারই পাশে একটি কালো কাঁচের গায়ে সোনালী ডিজাইন করা সুদৃশ্য ফ্লাওয়ার ভাসে এক থোকা রজনীগন্ধা। এখনো শুকিয়ে যায়নি, মৃদু সুরভি দিচ্ছে। এক পাশে প্রমাণ সাইজের আয়না বসানো এক-পাল্লার একটি আলমারি। তার উল্টোদিকে একটি ড্রেসিং-টেবিল। ড্রেসিং টেবিলের উপরে দাড়ি কামাবার সাজসরঞ্জাম সুন্দরভাবে সাজানো। তারই পাশে একটি আয়রণ সেফ চৌকির উপরে বসানো। তার ধার ঘেঁষে একটি আলনা। আলনায় কয়েকটি ভাঁজ করা ধুতি ও হ্যাঙারে পাঞ্জাবি ঝুলছে। নীচে কয়েক-জোড়া চক্চকে জুতো। ঘরের সর্বত্র সমস্ত জিনিসপত্রের মধ্যেই একটা চমৎকার সুশৃঙ্খল পরিচ্ছন্নতা ও রুচির প্রকাশ।

ঘরের মেঝেতে কোন কার্পেট নেই। কালো ইটালিয়ান মার্বেল পাথরে তৈরী পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে মসৃণ মেঝে। দেওয়ালে বা মেঝেতে কোথাও এতটুকু ঝুল বা ধুলোর নামগন্ধ নেই।

উত্তর, দক্ষিণ ও পূব—তিন দিকই ঘরের খোলা। জানলা রয়েছে। জানলায় ফিকে নীল রঙের দামী নেটের পর্দা খাটানো। খান-দুই সোফাও একদিকে রয়েছে। সোফার মধ্যবর্তী জায়গায় ছোট একটি নীচু টেবিলের উপরে একটি টেলিফোন ও টেবিল-ল্যাম্প।

ঘরের মধ্যে সবই রয়েছে প্রয়োজনীয়, কেবল বসে লেখাপড়া করার জন্যে টেবিল বা ঐ জাতীয় কোন ব্যবস্থা নেই।

ঘড়ির কাঁচটা ভাঙা দেখছি! ঐ রকম ভাঙাই ছিল নাকি মহিমাবাবু? কিরীটীর প্রশ্নে আকৃষ্ট হয়ে মহিমারঞ্জন ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত কাঁচ-ভাঙা টাইমপিসটার দিকে তাকিয়ে বললেন, তাই তো দেখছি! কিন্তু কালও সকালবেলা এ ঘরে এসে সচির

সঙ্গে যখন কথা বলছিলাম কই, তখন ভাঙা দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না!

আপনি একবার অন্যান্য সকলকে জিজ্ঞাসা করে আসুন তো মহিমাবাবু, তারা কেউ জানে কি না?

মহিমারঞ্জন চলে গেলেন ঘর থেকে বের হয়ে।

কিরীটী ঘরের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সর্বত্র দেখতে লাগল। হঠাৎ একসময় নীচু হয়ে খাটের তলায় দৃষ্টিপাত করেই ভেতরে ঢুকে কি টেনে বের করে আনল।

একটা দোমড়ানো-মোচড়ানো ফটোগ্রাফ।

কার ফটোগ্রাফ?

এগিয়ে গেলাম।

একটি তরুণীর ফটো। কিন্তু ফটোর তরুণীর মুখের দিকে তাকিয়েই যেন মনে হল, মুখটি চেনা-চেনা। কোথায় যেন দেখেছি।

একদৃষ্টে কিরীটী ফটোর মধ্যস্থিত তরুণীর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। হাফ বাস্ট।

চিনতে পারছিস সুব্রত?

কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে তাকালাম। চিনতে পারছি, অথচ ঠিক চিনতে পারছি না। কোথায় দেখেছি ঠিক অমনি একখানি মুখ, অথচ মনে করতে পারছি না সঠিক। কোথায়–কোথায় দেখেছি!

কি রে, চিনতে পারছিস না? আবার প্রশ্ন করে কিরীটী।

চুপ করে থাকি। কিরীটী ফটোটা বলীন সোমের দিকে এগিয়ে বললে, দেখুন তো সোম, মুখটা চিনতে পারেন কিনা?

তো! দেখতে দেখতে জবাব দিলেন সোম।

দেখুন তো ভালো করে, মণিকাদেবীর মুখের আদল অনেকটা কি পাচ্ছেন না?

তাই তো! সত্যিই, মণিকার মুখের আদলই তো রয়েছে ছবির মধ্যে।

কিন্তু ফটোটা খাটের তলায় এ অবস্থায় গেল কি করে, রায়? সোম প্রশ্ন করলেন।

কেমন করে আবার! কারও হস্ত-তাড়িত হয়ে!

একটু পরে মহিমারঞ্জন ফিরে এলেন।

কি খবর মহিমাবাবু? কেউ জানে?

না, কেউই বলতে পারল না। সকলেই বলছে ঘড়ির কাঁচটা ভাঙা ছিল না।

মণিকাদেবীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন?

করেছিলাম। তিনি কি বললেন?

সে-ও কিছু জানে না বললে।

হুঁ। আচ্ছা চলুন, সচ্চিদানন্দবাবুর বসবার ঘরটা একবার দেখব।

বসবার ঘরটা খোলা থাকে না। দরজায় হ্যাণ্ডেলের সঙ্গেই তালা লাগাবার ব্যবস্থা আছে।

মহিমারঞ্জন তাই বললেন, কিন্তু সে ঘরে তো সব সময় দরজায় তালা দেওয়া থাকে। তালার চাবি বরাবর সচির কাছেই থাকত। চাবিটা কোথায় জানি না তো। চাবি না হলে

সচ্চিদানন্দের শোবার ঘরের সর্বত্র তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোথাও তাঁর চাবির গোছাটা পাওয়া গেল না।

বাড়ির সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও চাবির গোছর কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। কেউই। বাড়ির মধ্যে বলতে পারল না, কোথায় তিনি চাবি রাখতেন।

দরজার তালা ভেঙ্গেই তাহলে না হয় চলুন, ঘরটা দেখা যাক কিরীটীবাবু। বলীন সোম বললেন।

হ্যাঁ। ঘরটা দেখতে হবে বৈকি। চলুন—তাই না হয় করা যাক।

কি আশ্চর্য, দরজার তালাটা আর ভাঙার প্রয়োজন হল না। দরজা ঠেলতেই দরজাটা খুলে গেল। বোঝা গেল চাবি দেওয়া ছিল না।

মহিমারঞ্জন কেবল ঠেলতেই ঘরের দরজাটা খুলে যাওয়ায় বললেন, আশ্চর্য, এ ঘরের দরজা তো তাকে ভুলেও কখনো খোলা রাখতে দেখিনি! ঘরের মধ্যে সব প্রয়োজনীয় জরুরী কাগজপত্র, ডকুমেন্ট থাকত বলে—এ ঘরের ব্যাপারে বরাবরই তাকে বিশেষ সতর্ক দেখেছি।

যা হোক, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে কিন্তু আমাদের থমকে দাঁড়াতে হল।

ঘরের মেঝেতে সর্বত্র কাঁচের টুকরো ও হেঁড়া কাগজ ছড়িয়ে রয়েছে। আর মস্ত বড় কাঁচের প্লেট দেওয়া সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার উপরে একটা কালো রঙ-এর পেট-মোটা বেঁটে Vat 69-এর বোতল। তার পাশেই একটা সোডা সাইফন দাঁড় করানো আছে।

ঘরের চারপাশে চারদেওয়াল ঘেঁষে দুটি কাঁচের বুক-সেলফ ও স্টীলের তৈরী আলমারি। একটা বড় সোফা ও খান-দুই চেয়ার।

কিরীটী ক্ষণকাল স্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে, নীচু হয়ে মেঝে থেকে সন্তর্পনে কাঁচের টুকরো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কয়েকটা কাগজের টুকরো তুলে নিয়ে সেগুলো দেখল। তারপর আবার এক এক করে মেঝে থেকে সমস্ত কাগজের টুকরোগুলোই কুড়িয়ে নিল। কাগজের কুড়োনো ছিন্ন অংশগুলো সব কিরীটী জামার পকেটে তুলে রাখল এবং এই সর্বপ্রথম এ ঘরে প্রবেশ করে কতকটা স্বগোতোক্তির মতই মৃদুভাবে বললে, একটা ছোটখাটো প্রলয়!

তারপরই এগিয়ে গিয়ে একে একে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ারগুলো ও আলমারির দরজাগুলো টেনে টেনে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল।

সবই বন্ধ। কোনটাই ভোলা নয়। এবং ঐ ঘরের মধ্যেও সচ্চিদানন্দর চাবির গোছাটা খুঁজে পাওয়া গেল না।

কিরীটী বলীন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, আনন্দবাবুকে একবার ডাকতে পারেন মিঃ সোম?

মহিমারঞ্জন আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন, তিনি সোমের নির্দেশে আনন্দ সান্যালকে ডাকতে গেলেন।

অত্যল্পকাল পরেই মহিমারঞ্জনের পিছনে পিছনে আনন্দ সান্যাল আবার ঘরে এসে প্রবেশ করে আমাদের সামনে দাঁড়ালো।

এই যে আনন্দবাবু! আপনাকে আবার কষ্ট দিলাম। আপনি তো এই ঘরের পাশেই থাকেন, কাল রাত্রে এই গ্লাস ভাঙার কোন শব্দ পাননি? বলে চোখের ইঙ্গিতে ঘরের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো ভাঙা কাঁচের গ্লাসের টুকরোগুলো দেখিয়ে দিল।

ভাঙা ছড়ানোকাঁচের টুকরোগুলোর দিকে ক্ষণকাল নির্নিমেষে তাকিয়ে থেকে আনন্দ সান্যাল জবাব দিল,, কোন শব্দই পাইনি তো!

কোন শব্দই পাননি পাশের ঘরে থেকেও? ঘুমটা তাহলে আপনার খুব গাঢ়ই বলতে হবে! শেষের দিকে কিরীটীর কথার মধ্যে সুস্পষ্ট ব্যঙ্গটা যেন আনন্দকে স্পর্শই করল না।

সে পূর্ববৎ ধীর চাপা কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ, ঘুম আমার সহজে ভাঙে না—

গতরাত্রে কখন শুতে যান?

রাত কটা ঠিক বলতে পারি না। তবে সোয়া দশটা থেকে সাড়ে দশটা হবে। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।

কিরীটী আনন্দ সান্যালের সঙ্গে কথা বলছিল বটে, তবে শ্যেনদৃষ্টিতে যেন তার সর্বাঙ্গ পরীক্ষা করছিল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। হঠাৎ আবার সে প্রশ্ন করলে, পায়ে কি আপনার ব্যথা আনন্দবাবু?

ব্যথা!

হ্যাঁ, প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছিলাম, ডান পা-টা যেন আপনি একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। কি হয়েছে পায়ে?

শেষের প্রশ্নে মনে হল আনন্দ সান্যালের মুখটা যেন সহসা দপ্ করে কেমন নিভে গিয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল এবার আনন্দ সান্যাল, কাল বাগানে বেড়াতে গিয়ে একটা পেরেক বিঁধেছিল পায়ে, তাই সামান্য একটু ব্যথা।

তবে যে একটু আগে বললেন, কোন ব্যথা নেই পায়ে।

ও এমন কিছু না, তাই—

কিরীটী আর দ্বিরুক্তি না করে বললে, গতকাল দিনে বা রাত্রে শেষবার কখন আপনার দেখা হয় আপনার কাকা সচ্চিদানন্দবাবুর সঙ্গে, আনন্দবাবু?

অফিস থেকে ফিরে তখন তিনি বের হচ্ছিলেন যেন কোথায়, সিঁড়ির নিচে দেখা হয়েছিল।

আর দেখা হয়নি?

না।

জানেন না গতরাত্রে কখন তিনি ফিরেছেন?

না।

.

অতঃপর বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা নাগাদ মৃতদেহ মর্গে পাঠাবার ব্যবস্থা করে, বাড়ির দরজায় পুলিস প্রহরী মোতায়েন করে ও বাড়ির সকলকে আপাতত পুলিসের বিনা অনুমতিতে কোথাও না যাবার নির্দেশ জানিয়ে আমরা সকলে সচ্চিদানন্দর গৃহ থেকে বের হয়ে এলাম।

সারাটা পথ গাড়িতে আমাদের উভয়ের মধ্যে একটি কথাও হল না। কিরীটী গাড়ির ব্যাকে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে ধূমপান করতে লাগল। আমহার্স্ট স্ট্রীটে আমার নিজের বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে কিরীটী চলে গেল।

শুধু বললে, সন্ধ্যার দিকে সময় পেলে যেন তার ওখানে একবার যাই।

বললাম, যাব।

আহারাদির পর শয্যায় শুয়ে চোখ বুজে ঘুমুবার চেষ্টা করতে করতে সচ্চিদানন্দের আকস্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটাই আগাগোড়া আর একবার সুশৃঙ্খলভাবে পর পর প্রথম থেকে ভাববার চেষ্টা করছিলাম।

যতটুকু জানা গিয়েছে এবং বোঝা যাচ্ছে তাতে করে স্পষ্টই মনে হয়, সচ্চিদানন্দকে কেউ-না-কেউ হত্যাই করেছে। আর এও বুঝতে কষ্ট হয় না, বাইরে থেকে কেউ.এসে হত্যা করেনি। করেছেগতরাত্রে বাড়ির মধ্যে যারা উপস্থিত ছিল, তাদেরই মধ্যে কেউ-না-কেউ।

কিন্তু কে? কে হত্যা করল সচ্চিদানন্দ সান্যালকে?

মহিমারঞ্জন, আনন্দ সান্যাল, নন্দন, বিজনবিহারী—সচ্চিদানন্দের বাড়ির সরকার, এই চারজন পুরুষের মধ্যে তিনজন উপরেই থাকতেন এবং তাঁদের মধ্যে কারুর পক্ষেই সচ্চিদানন্দকে হত্যা করা অসম্ভব ছিল না। বাকি বিজনবিহারী নীচে থাকেন। মণিকাদেবীর কথা যদি সত্যিই হয়, তাহলে উপরে সিঁড়ির দরজা বন্ধ ছিল যখন, তখন তাঁর পক্ষে উপরে গিয়ে সচ্চিদানন্দকে হত্যা করা অতটা সহজসাধ্য নিশ্চয়ই ছিল না।

পুরুষদের বাদ দিলে বাকি থাকে দুজন নারী। সচ্চিদানন্দর স্ত্রী রাধারাণী ও অভিনেত্রী মণিকাদেবী। তারাই হত্যা করতে পারে।

ডাক্তার হরপ্রসন্ন বলেছেন, কোন তীব্র বিষের ক্রিয়ায় নাকি মৃত্যু ঘটেছে। সেক্ষেত্রে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, বিষ প্রয়োগের দ্বারাই সচ্চিদানন্দকে হত্যা করা হয়েছে তা সে যেই করুক। এবং ময়না তদন্তের দ্বারা সেটা প্রকাশ পাবেও সম্ভবত। সমগ্র ঘটনার মধ্যে কয়েকটি ব্যাপার বিশেষভাবে যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে কাঁচঘরের মধ্যে সচ্চিদানন্দের মৃত্যু। এবং সম্ভবতঃ

তাঁর মৃত্যু ঘটেছে রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে। কিন্তু অতরাত্রে তিনি কাঁচঘরে গিয়েছিলেন কি করতে? হত্যাকারীই কিতবে তাঁকে অত রাত্রে কাঁচঘরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, নিরিবিলিতে হত্যা ব্যাপারটা সম্পন্ন করবার জন্য? দ্বিতীয়তঃ সচ্চিদানন্দর দোতলার অফিস-ঘর-সর্বদা যেটা তালাবন্ধই থাকত, সেটা খোলা ছিল কেন? আর কাঁচের গ্লাসভাঙা টুকরোগুলোই বা সেখানে ছড়ানো ছিল কেন? টেবিলের উপরে রক্ষিত মদের বোতল ও সোডা সাইফন দেখে মনে হয় গত রাত্রে কিরীটীর ওখান থেকে গৃহে ফিরবার পর নিশ্চয় তিনি মদ্যপান করেছিলেন। এবং সম্ভবত যে গ্লাসটা ভাঙা অবস্থায় ঘরের মধ্যে দেখা গিয়েছে, সেই গ্লাসেই মদ্যপান করেছিলেন। কারণ অন্য কোন গ্লাস ঘরে দেখা যায়নি। গ্লাসটা ভাঙল কি করে? তাঁরই হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙেছে, না নেশার ঝোঁকে ইচ্ছে করে ভেঙেছেন, না অন্য কেউ ভেঙেছে? তৃতীয় ব্যাপার, সচ্চিদানন্দর ঘরের টাইমপিস্টার কাঁচ, যেটা পূর্বে কেউ ভাঙা দেখেনি, সেটা কি করে ভাঙল? চতুর্থ, সচ্চিদানন্দর খাটের তলায় প্রাপ্ত দোমড়ানো-মোচড়ানো সেই ফটোটা, যার সঙ্গে অভিনেত্রী মণিকাদেবীর অদ্ভুত একটি সাদৃশ্য আছে। পঞ্চম, রাধারাণীদেবীর পূর্ব-স্মৃতি লোপ। সচ্চিদানন্দর মৃত্যু ও অন্যান্য ব্যাপারগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও অদ্ভুত একটা পারম্পর্য আছে যেন। কোথায় যেন একটা অদৃশ্য যোগসূত্রে সব কিছু বাঁধা পরস্পরের সঙ্গে।

সব কিছু যেন একই কেন্দ্রে একাগ্ৰীভূত হয়ে উঠেছে।

তারপর গত রাত্রে সচ্চিদানন্দ বর্ণিত কাহিনী; তার কতটুকু সত্য কতটুকু মিথ্যা তাও এখন বোঝা যাচ্ছে না। তিনি অনেক কথাই বলেছিলেন গত রাত্রে, আবার অনেক কথাই যেন বলেননি। ইচ্ছে করেই কি প্রকাশ করেননি? তারপর ঐ বাড়ির লোকগুলোভাবতে লাগলাম, ঐ বাড়ির লোকগুলোর কথা।

সচ্চিদানন্দর মৃত্যুর ঠিক ছমাস আগে এ বাড়িতে তাঁর শ্যালক মহিমারঞ্জনের আবির্ভাব ঘটে। তার তিন মাস পরে এলেন ভ্রাতুস্পুত্র আনন্দ সান্যাল, তার দেড় মাস বাদে এল শিবানী পরিচয়ে অভিনেত্রী মণিকাদেবী। গৃহে একমাত্র বিকৃত-মস্তিষ্ক রাধারাণী বাদে আপনার বলতে কেউ ছিল না এতদিন। ছমাসের মধ্যে একে একে তিনজন এসে ভিড় করে দাঁড়াল। সঙ্গে এল আবার মণিকার ভৃত্য নন্দন।

ধন-প্রাচুর্য যথেষ্টই ছিল সচ্চিদানন্দ সান্যালের।

আচ্ছা, বাড়ির চাকর-বাকরগুলো! তারা অবশ্য নীচেই থাকত। ভৃত্য মাত্র দু-জন—সুবল আর রাজু। এবং রাতদিনের একজন ঝি সাবিত্রী। সাবিত্রীও নীচেই থাকত ইদানীং রাত্রে–মণিকা আসবার পর থেকে। মণিকারই ব্যবস্থামত সেটা হয়েছিল।

তিনজনেই পাঁচ-ছ বছর প্রায় এ বাড়িতে আছে। পুরনো লোক। তাদের অবশ্য কিরীটী কোন জিজ্ঞাসাবাদই করেনি।

কেন করেনি, তা সে-ই জানে। হয়তো বেলা হয়ে গিয়েছিল বলে করেনি—এমনও হতে পারে। বা প্রয়োজন বোধ করেনি বলেই করেনি।

ও-বাড়ি থেকে আসবার মুখে তিনজনই ওরা বাইরের ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। নিঃশব্দে। একবার মাত্র কিরীটী তাদের দিকে তাকিয়ে মহিমারঞ্জনকে প্রশ্ন করেছিল, ওরা কে? মহিমারঞ্জন বলেছিলেন, রাজু আর সুবল চাকর, সাবিত্রী ঝি বহুদিন থেকে রাধারাণীর দেখাশুনা করবার জন্যে নিযুক্ত আছে।

রাজু আর সুবলের মধ্যে সুবলের বয়স হয়েছে প্রৌঢ়। রাজুর বয়স ত্রিশ-বত্রিশের বেশি হবে বলে মনে হল না। বেশ একটু বাবু ও ফিটফাট বলেই মনে হল। সে-ই ছিল নাকি সচ্চিদানন্দর খাস ভৃত্য। ঐ তিনজন ছাড়া মণিকার ভৃত্য নন্দনও। তাকেই একমাত্র উপরে দেখা গিয়েছিল। সে নাকি রাত্রে মধ্যে মধ্যে দোতলার বারান্দায় শুত। অবশ্য গত রাত্রে নীচেই ছিল, পরে উপরে যায়।

এবং ভৃত্য হলেও একমাত্র নন্দনের সঙ্গে অন্যান্য ভৃত্যদের পার্থক্যটা চোখে যে পড়েনি তা নয়।

নবাগতা মণিকা ও ভৃত্য নন্দন ও-বাড়িতে যে বেশ একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে এই দেড় মাসের মধ্যেই সেটাও চোখে পড়ল।

.

সন্ধ্যার দিকে কিরীটীর বাড়ি গিয়ে দেখি, সে ফোনে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। কৃষ্ণা সোফার উপরে বসে গভীর মনোযোগের সঙ্গে একটা বাংলা উপন্যাস পড়ছে।

আমার পদশব্দে ফোন করতে করতে কিরীটী আমার মুখের দিকে বারেক তাকালেও নিজের ফোন করা নিয়ে ব্যস্ত রইল।

একেবারে সোজা গিয়ে কৃষ্ণার পাশের সোফাটার উপরে বসতেই সে ফিরে তাকাল।

ঠাকুরপো যে, কখন এলে?

এই মাত্র। এক কাপ চা খাওয়াও না—

চায়ের কথা ও আগেই বলেছে। বসো, জংলি এখুনি আনছে।

বলতে বলতে জংলি চায়ের ট্রে হাতে ঘরে প্রবেশ করল।

কিরীটীরও বোধ হয় ফোন করা শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেও পাশে এসে বসল ঐ সময়।

চা-পানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মধ্যে সচ্চিদানন্দর হত্যা-ব্যাপার নিয়েই আলোচনা চলতে লাগল।

কথায় কথায় কিরীটী একসময় বললে, সচ্চিদানন্দর সলিসিটারকে ফোন করছিলাম, সচ্চিদানন্দ উইল কিছু করে গিয়েছেন কিনা জানবার জন্য।

কি বললেন সলিসিটার?

করেছেন এবং উইলটা একটু interesting বলতে হবে। অবিশ্যি উইলটা আজকের করা নয়—আজ থেকে ন বছর আগেকার উইল।

তাই নাকি! এই ন বছরে আর উইল বদলায়নি লোকটা! আশ্চর্য!

তাই বটে। উইলে আছে, সচ্চিদানন্দের যাবতীয় সম্পত্তির যা valuation হবে, মায় ব্যাঙ্কের জমানো টাকা ও ব্যবসা নিয়ে তার তিন-এর চার অংশ পাবে তাঁর বন্ধু-কন্যা শিবানীদেবী।

বলিস কি!

হ্যাঁ। বাকি এক-চতুর্থাংশের অর্ধেক পাবেন তাঁর স্ত্রী রাধারাণীদেবী, বাকি অর্ধেক বর্তাবে ভ্রাতুস্পুত্র আনন্দ সান্যালকে। অবশ্য তাঁর স্ত্রী যতদিন জীবিত থাকবেন, তাঁর মাসোহারার একটা ব্যবস্থা আছে। ব্যবসা থেকে দুশো টাকা করে পাবেন, আর কলকাতার কাঁটাপুকুরের বাড়িতে থাকতে পাবেন।

সত্যিই উইলটা বিচিত্র! এবং উইল থেকে বোঝা যাচ্ছে, ঢাকা থেকে শিবানীদের আসবার পরই হয়তো উক্ত উইল লেখা হয়েছিল।

সামান্য বন্ধু-কন্যার প্রতি এতখানি প্রীতি কেমন যেন একটু অস্বাভাবিকই লাগছে না? বিশেষ করে, যে বন্ধুর মৃত্যুর পর সাত-আট বছর তার পরিবারের কি হল না হল জানবারও কোন চেষ্টাও হয়নি? কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললে।

সব কিছু বাঁকা দেখাই যেন তোমার একটা স্বভাব। কেন, কত লোক তো নিঃস্ব পরকেও সব কিছু দান করে যায় কত সময়! প্রতিবাদ জানায় কৃষ্ণা।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, স্বার্থটাই যে বাঁকা পথে চলে কৃষ্ণা, মানুষকে তাইতো বাঁকাভাবে সব দেখতে হয়। 

তা নয় গো, তা নয়। খুন, জখম, হত্যা, রাহাজানি, জাল, বাটপাড়ি, চুরি, ডাকাতি এই সব নিয়ে দিনের পর দিন ঘেঁটে ঘেঁটে তোমার মনও ঐ বাঁকা সব কিছুতেই দেখে। কিন্তু জেনো, পৃথিবী কেবল ঐ সব দুষ্কৃতি নিয়েই নয়। এই পৃথিবীর মানুষ নিঃস্ব হয়ে দান করতে পারে, পরস্পরের জন্য হাসতে হাসতে প্রাণ দিতে পারে।

কৃষ্ণার কথায় সত্যিই যেন চমকে উঠলাম। সত্যিই তো! ও তো একেবারে মিথ্যে বলেনি!

কিরীটীর দিকে কিন্তু তাকিয়ে দেখি, সে মৃদু মৃদু হাসছে।

কুপিতা হচ্ছ কেন প্রিয়ে! আমার যাবতীয় কাজের কেবল একটা দিকই তোমার চোখে পড়ল কিন্তু অন্য একটা দিকও যে আছে, সেটা তো কই তোমার চোখে পড়ল না! পৃথিবীতে মানুষকে যদি বাঁচতেই হয়, তবে সব জেনে শুনে বুঝে বাঁচাই তত ভাল। এই খুন, হত্যা, জখম, রাহাজানি, জাল-জুয়াচুরি যে চলেছে কেন চলেছে? অভাবে, না স্বভাবে? কই, এ কথাটা তো কোনদিন তোমাদের মনে হয়নি? এত ধরপাকড় দেখেও তো কই মানুষ সাবধান হয় না, সৎ পথে চলে না?

কিন্তু এতে লাভ কি সত্যিকারের বলতে পার? কেবল কাদাই তো ঘেঁটে মরছ দিনের পর দিন!

ভুলো না কৃষ্ণা, এই কাদামাখা লোকগুলোর মধ্যেও মানুষ আছে। তারাও তোমাদের মত তথাকথিত সৎ ও সজ্জন। আর কাদা ঘাঁটার কথা যদি বল, তাহলে বলব, অবস্থা-বিশেষের কথা কেউ তো জোর করে বলতে পারে না। কাল যে তুমিই কাদা ঘটবে না, কে বলতে পারে? চোর, জুয়াচোর, জালিয়াৎ মাত্রই হয়তো সত্যিকার জন্ম-অপরাধীনয়। জন্ম-পরিবেশ, জীবন-পরিস্থিতি অনেক কিছুই হয়তো দায়ী এদের চোর-ডাকাত-হত্যাকারী প্রভৃতি পরিচয়ের মধ্যে। আমি তাই কাদা ঘাঁটি—যদি এই সব দেখে-শুনে তাদের চোখ খোলে। তারা নিজেদের নিজে চিনতে পারে।

একটানা কথাগুলো বলে বললে, বকবক করে গলা শুকিয়ে গিয়েছে। দেখ, যদি একটু চায়ের ব্যবস্থা করতে পার।

কৃষ্ণা আর কোন কথা বললে না, নিঃশব্দে উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেল।

উক্ত ঘটনার পর আরো চার-পাঁচ দিন কেটে গিয়েছে। সচ্চিদানন্দর হত্যা-ব্যাপারের কোন কিছুই আর অগ্রসর হয়নি। কেবল নতুন দুটি সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। একনম্বর ময়নাতদন্তের রিপোর্ট। সচ্চিদানন্দর পাকস্থলীতে অ্যালকোহল পাওয়া গিয়েছিল। প্রমাণ হয়েছে তাতে, সেরাত্রে তিনি মদ্যপান করেছিলেন বাসায় ফেরার পর। দ্বিতীয়তঃ সচ্চিদানন্দর মৃত্যুর কারণ সম্ভবত দুটি। একটি বেস অফ দি স্কালের ফ্র্যাকচার, দ্বিতীয়তঃ হাই ডোজে মরফিন। এবং সম্ভবত মরফিনটা তাঁর ঘাড়েই ইনজেকশন করা হয়েছিল। ঘাড়ের টিসুতে নাকি খানিকটা একিমোসিস আঘাতের রক্ত জমার চিহ্নও ছিল এবং পুলিস-সার্জেনের অভিমত—ঐ আঘাতেই বেস অফ দি স্কালের ফ্র্যাকচার হয়েছিল। অথচ ব্যাপারটা আমাদের কারোরই নজরে পড়েনি প্রথম দিন মৃতদেহ পরীক্ষা করবার সময়। এবং নজরে পড়েনি—সম্ভবত সচ্চিদানন্দর ঘাড়ে ঘন লম্বা চুল থাকায়।

কিরীটী ইতিমধ্যে বার দুই সচ্চিদানন্দর বাড়িতে ঘুরেও এসেছে।

আরো দিন চারেক বাদে কিরীটীর বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, সন্ধ্যার দিকে সচ্চিদানন্দর ওখানেই গিয়েছে।

অপেক্ষা করে রইলাম তার সঙ্গে আজ সাক্ষাৎ করব বলে।

রাত সাড়ে আটটা নাগাদ কিরীটী ফিরে এল। মুখটা যেন কেমন বিমর্ষ ও ক্লান্ত। ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে টানতে লাগল সে।

সচ্চিদানন্দর ওখানে গিয়েছিলি?

হ্যাঁ।

কি রকম বুঝছিস?

বিশেষ কিছুই না। রাধারাণীদেবী পূর্ববৎ। আজও অনেক চেষ্টা করলাম তাঁর পূর্বস্মৃতি ফিরিয়ে আনবার জন্য, কিন্তু বিশেষ কোন ফলহলনা। আর আরলোকগুলোও যেনধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আমার কি মনে হচ্ছে জানিস সুব্রত?

কি? ওর মুখের দিকে তাকালাম।

হয় ওরা সব কজনই খুব চালাক, না হয় আমিই বোকা।

মণিকাদেবীর সংবাদ কি?

সত্যিই যদি তার সবটাই অভিনয় হয় তো বলব, এত বড় অভিনেত্রী জীবনে আর আমি দেখিনি। বলতে বলতে পকেট থেকে একটা কাগজের বাক্স বের করলে কিরীটী।

প্রশ্ন করলাম, কি রে ওটা?

একটা 2 & half cc. hypodermic syringe—

সিরিঞ্জ! কোথায় পেলি?

রাধারাণীদেবীর ঘরে।

রাধারাণী!

হ্যাঁ। ডাক্তারের নির্দেশ ছিল ঘুমের জন্য প্রত্যহ তাঁকে মরফিন ইনজেকশন দেবার।

তা ওটা তুই নিয়ে এলি যে বড়?

প্রয়োজন আর হচ্ছেনা তাই। সেই রাত্রি থেকেই মাথার যাবতীয় গোলমাল যেমন একেবারে নিঃশেষে লোপ পেয়েছে, তেমনি বিনা মরফিনেই অপূর্ব শান্ত হয়ে দিনে-রাত্রে বেশীর ভাগ সময়ই গভীর নিদ্রা দিচ্ছেন ভদ্রমহিলা। তাই ডাক্তারের নির্দেশে মরফিন বন্ধ রাখা হয়েছে।

ভদ্রমহিলা কতদিন ধরে মরফিন নিচ্ছিলেন?

মাস চারেক হবে শুনলাম।

কোন addiction হল না?

হয়েছিল হয়তো-তবে স্মৃতিলোপের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো addiction-ও লোপ পেয়েছে।

ডাক্তারী শাস্ত্রে এমন হয় নাকি?

ডাক্তারী শাস্ত্র তো জানি না, তবে অভ্যাস আর ব্যানোর কথাও বলা যায় না ভাই।

তবে বল, সান্যাল-বাড়িতে আপাততঃ বেশ নিরুপদ্রবেই সকলের জীবন-যাত্রা অতিবাহিত হচ্ছে?

তা হচ্ছে।

তারপর নিঃশব্দে অর্ধ-সমাপ্ত সিগারটায় আরা গোটা দুই টান দিয়ে কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আমাদের অভিনেত্রী মণিকাদেবী সম্পর্কে আরো একটু বিশদভাবে তাঁর অতীত জীবনের খোঁজখবর করতে বলেছিলাম, করেছিলি?

কিরীটী আমাকে মণিকাদেবী সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিল বটে এবং আমিও খোঁজ নিয়েছিলাম। বললাম, হ্যাঁ, নিয়েছিলাম। গত চার-পাঁচদিন তো সেই ব্যাপার নিয়েই অভিনেত্রী মহলে একটু ঘন ঘন যাতায়াত করছিলাম। কিন্তু সেখানেও বেশ ধোঁয়া।

কি রকম? কিরীটী প্রশ্ন করে।

হেসে জবাব দিলাম, তাছাড়া আর কি বলব। অকস্মাৎ ধূমকেতুর মতই একদিন পাঁচ বছর আগে অভিনয়-জগতে উদিতা হয়ে, গৌরবের শিখরে উত্তীর্ণ হয়ে আবার গৌরব-শিখর হতেই অকস্মাৎ চার মাস আগে অদৃশ্য হয়ে যান। বাড়িতে তাঁর দিনের বেলায় অনেকের সমাগম হলেও রাত্রে তাঁর দ্বার কারো কাছেই খুলত না। সন্ধ্যা ছটার বেশি কোনদিন কোন প্রডিউসার বা ডিরেকটারই কোন টাকার লোভেই সুটিংয়ের জন্য আটকে রাখতে পারেনি। তাঁর কনট্রাক্টই থাকত সন্ধ্যা ছটায় পাঙ্কচুয়ালি তাঁকে ছেড়ে দিতেই হবে। রাত্রে কখনো তিনি সুটিং করেননি। বাড়িতে লোকজনের মধ্যে ছিল ঐ ভৃত্য শ্রীমান নন্দন ও এক বুড়ী ঝি সরলা। এখন সরলা যে কোথায়, কেউ তা জানে না। তবে একটু কথা শুনেছি

কি? কিরীটী প্রশ্ন করে আবার।

অভিনয়ের জগৎ থেকে সরে দাঁড়াবার মাস আষ্টেক আগে বনলতা নামে একটি অল্পবয়স্কা নবাগতা তরুণী অভিনেত্রীর সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় হয় মণিকার। এবং সেই মেয়েটি হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে যায়। অনেকের ধারণা বনলতার অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারে নাকি মণিকার হাত আছে।

কেন? ডিরেকটার ব্রজেনবাবু নাকি একদিন বনলতা অদৃশ্য হওয়ার পর মণিকাদেবীর বাড়ির মধ্যে বনলতাকে পলকের জন্য দেখেছিলেন। এবং তিনিই বললেন, দুজনের, মানে মণিকা ও বনলতার চেহারার মধ্যে নাকি একটা অদ্ভুত সাদৃশ্য ছিল। কোন একটা বইয়ে মা ও মেয়ের পার্ট করবার জন্য ব্ৰজেনবাবুই সর্বপ্রথম বনলতাকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ায় interview দিতে তাকে মনোনীত করেছিলেন, দুজনের মধ্যে ঐ ধরনের সাদৃশ্য দেখে।

বনলতার খোঁজ আর কেউ এখন জানে না?

না।

সেই বইটার কি হল?

অন্য মেয়ে পার্ট করেছে।

কিন্তু বনলতার কনট্রাক্ট?

সেটা অবশ্য ব্ৰজেনবাবু ভাঙলেন না।

উক্ত ঘটনার দিন পাঁচেক পরে কিরীটীর বাসায় গিয়ে শুনলাম, সে নাকি দিন চার-পাঁচেকের জন্যে কোথায় গিয়েছে জরুরী কাজে, কৃষ্ণা নিজেও জানে না।

.

দিন চার-পাঁচেকের জায়গায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল, কিরীটীর কোন পাত্তা নেই। একটু অবাকই হলাম। কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ কিরীটী কোথায় ড়ুব দিল! এক-আধ দিন নয়, একটা পুরো সপ্তাহ চলে গেল, অথচ কিরীটীর সংবাদ নেই। এই একটা সপ্তাহ এক ছত্র চিঠি পর্যন্ত কৃষ্ণাকে সে দেয়নি। লোকটার হল কি?

কিন্তু অদ্ভুত মেয়ে কৃষ্ণা!

কিরীটীর ব্যাপারে যেন তার তিলমাত্র চিন্তাও নেই। পূর্বের মতই সে হাসি-খুশি।

কিরীটীর অবর্তমানে সচ্চিদানন্দের মৃত্যু-রহস্যের উপর যেন একটা কালো যবনিকা নেমে এসেছে।

ভুলেই যেতে বসেছি যেন সে-কথা। রহস্য-উদঘাটনের ব্যাপারে এমন তো কখনো পূর্বে পলাতক হতে দেখিনি বা নিশুপ নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে দেখিনি কিরীটীকে! কোন একটা রহস্যের ব্যাপার তার হাতে এলে, যা হোক একটা শেষ নিষ্পত্তি তার না করা পর্যন্ত কি নিদারুণ একটা অস্থিরতা তার মধ্যে লক্ষ্য করেছি। নিজের মনে কি অদ্ভুতভাবেই না ছটফট করতে দেখেছি তাকে।

মনে মধ্যে সত্যিই একটা উদ্বেগ অনুভব করছিলাম। হঠাৎ কেন সে নিখোঁজ হয়ে গেল?

প্রত্যহই প্রায় যাই কিরীটীর বাড়িতে তার খোঁজে। টেলিফোনে সংবাদ নিতে পারি, কিন্তু আশযেনমেটেনা। এবং সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেমনে হয়, এইবার কিরীটীরসেই চির-পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পাব, কিন্তু পাই না। কৃষ্ণার সেই একই জবাব, না, কোন খবর নেই।

শেষ পর্যন্ত ঠিক বারোদিন পরে একদিন গিয়ে দেখি, বাইরের ঘরে সোফায় বসে কৃষ্ণা ও কিরীটী গল্প করছে।

এই যে সুব্রত, আয়-আয়—

কি ব্যাপার, কোথায় ড়ুব দিয়েছিলি?

সচ্চিদানন্দর হত্যা-সন্ধানে। কেন, কৃষ্ণা তোকে কিছু বলেনি?

কই না তো! ওঃ, তবে তুমি সব জানতে?

কি করব বল, সত্যবদ্ধ ছিলাম। মুখ খুলতে পারিনি। ওকেই জিজ্ঞাসা কর না। এখন আবার বলা হচ্ছে, কৃষ্ণা জানায়নি?

আরে সত্যি-সত্যি তুমি ওকে কোন কথা বলনি নাকি!

বলব মানে-promise করিয়ে নিয়েছিলে না!

কিন্তু যাক সে কথা। সে বোঝাপড়া ওর সঙ্গে পরে হবে বলে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, কোথায় ছিলি এতদিন?

বললাম তো।

সব খুলে বল।

কিরীটীর জবানিতেই এ কাহিনীর দ্বিতীয় অধ্যায় বর্ণনা করে যাই।