২. তোমার একুশ বছর বয়েস

তোমার একুশ বছর বয়েস হতে আর কত বছর আছে? টুনু হঠাৎ ওকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়, এক্ষুনি বিয়ে করে ফেলবার ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার। বিয়ে-টিয়ে করে অনেক দুর দেশে চলে যাই। বেশ। এত পাকা ছেলে, এখনও সাবালক হলে না! ছিঃ।

হঠাৎ অন্যমনা হয়ে যাওয়া গৌতম সচেতন হয়ে মৃদু হেসে বলে, তোমার ইচ্ছেটার সঙ্গে আমার সাবালক হওয়া না হওয়ার সম্পর্কটা কী বলো তো? জগতে কি একুশ বছর পার হওয়া কোনও সাবালক জীব নেই?

দেখো, তুমি আমায় রাগিও না। টুনু ঝংকার দিয়ে বলে, তোমার মতন একটা নাবালককে যে ভালবেসেছি, বিয়ে করতে চাইছি–এতেই ধন্য হয়ে থাকা উচিত তোমার। অত ফুটোনি কীসের?

আমাকে? আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও।

গৌতম যেন আকাশ থেকে পড়ে।

 টুনু ক্রুদ্ধগলায় বলে, মাথা ঘুরে গেল, না? হ্যাঁ চাই। আর তোমার ওই দাদুর সম্মতি আদায় করেই চাই।

ওঃ, কল্পনার দৌড় কী বিরাট! তুমি কি পবিত্র ব্রাহ্মণকুলে জন্মেছু যে দাদুর নাতবউ হবার স্পর্ধা রাখো?

টুনু বিচলিত হয় না। দৃঢ় গলায় বলে, দৈবায়ত্ত কুলে জন্ম, কিন্তু পুরুষত্ব করায়ত্ত মোর। বিয়েতে তুমিই না হয় কনের পার্টটা নিয়ো। কিন্তু লক্ষ্মীটি, চলো না একদিন আমাদের বাড়িতে। বাড়িতে বসে বেশ যত্ন করে চা খাওয়াতে ইচ্ছে করছে তোমায়। রেস্টুরেন্টের কেবিনে চোর চোর হয়ে বসে ভাল লাগছে না আর।

গৌতম হেসে বলে, আমার বাড়িতে দাদু, তোমার বাড়িতে বাবা! মেয়ে একটা বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে এনে বাড়িতে তুললে নিশ্চয়ই তিনি আহ্লাদে বিগলিত হবেন না। কে দাঁড়াবে জেরার মুখে?

বাবা? আমার বাবা? টুনু একটু ব্যঞ্জনাময় হাসি হাসে।

সে হাসিতে বুঝি কৌতুক আছে, বেদনা আছে, হতাশাও আছে।

টুনু বলে, রাত এগারোটা পর্যন্ত বসে না থাকলে তো আমার বাবার জেরার মুখে দাঁড়াবার আশঙ্কা নেই।

তাই নাকি? অত রাত্তিরে ফেরেন? ক্লাবে-টাবে যান বুঝি?

যান কোথাও। টুনু গম্ভীর হাস্যে বলে, বিপত্নীকের কাছে নাকি সন্ধ্যার শূন্যতা বড় কষ্টকর। বাবার সঙ্গে সব দিন দেখাই হয় না আমার, ঘুমিয়েই পড়ি।

ও! তুমি তা হলে এখন বাড়ি গিয়ে একাই থাকো?  

একা কেন? টুনু কৌতুকে হেসে ওঠে। কত লোক বাড়িতে! ধরো বামুনদি, বুড়ি ঝি, বুড়ো চাকর, খোকা চাকর

নিজের লোক কেউ নেই?

 টুনু উদাস হাসি হেসে বলে, কই আর? সেই জন্যেই তো একটা নিজের লোক জোগাড় করবার তালে ঘুরে বেড়াচ্ছি। নিজের ভার নিজে আর বইতে ইচ্ছে করছে না।

তোমার তা হলে একটি বেশ ভারিক্কি গার্জেনতুল্য নিজের লোক দরকার।

তোমার পরামর্শের জন্যে ধন্যবাদ। রেগে ওঠে টুনু।

ওঠবার সময় গৌতম বলে, তা হলে বলছ, আমিই সন্ধেবেলা তোমার বাড়ি গিয়ে আড্ডা দেব?

তাই তো বলছি?

 থাকো তো সেই পাথুরেঘাটায়

সেখানেও মানুষ থাকে।

তা নয়, যেতে আসতেই তো

 তা হলে যেয়ো না।

উঃ, কী রাগ! বলছি এই আড্ডাটি নিশ্চয়ই তোমার এই বামুনদি কোম্পানি সুচক্ষে দেখবে না।

বয়ে গেল।

 তোমার বাবার কর্ণগোচর করবে—

টুনু হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে তীব্রস্বরে বলে, সেটাই চাই আমি। আমি একটা হেস্তনেস্ত করতে চাই। আর। এটাই তার রাস্তা।

কী? বাবা যখন তিরস্কার করতে আসবেন, গৌতম হেসে বলে, তখন বলে উঠবে, এই পাপিষ্ঠই আমার প্রাণেশ্বর!

উঃ, গৌতম, কী পাকা ছেলে তুমি! সত্যি, আমার মাঝে মাঝে আশ্চর্য লাগে। তোমার ওই বাড়িতে থেকে

দেখো টুনু, যে গাছ চারিদিকে শিকড় বিস্তারের জায়গা না পায়, সে মাটির গভীরে শিকড় চালায়। আর দুর্ভিক্ষের ভিক্ষুক খাদ্য পেলেই গোগ্রাসে খায়।

ওরা ছাড়াছাড়ি হবার জন্যে উঠে দাঁড়ায়।

গৌতমের ভারী মন কেমন করে টুনুর মুখটা দেখে।

 ওই রোগা রোগা শুকনো-মুখ টুনু, এখন বাসের ভিড় ঠেলে কতদূরে যেন যাবে। আর এক কষ্টের পর যেখানে গিয়ে ঢুকবে, সেখানে ওকে রিসিভ করবার জন্যে শুধু বামুনদি, শুধু বুড়ি ঝি। আর শুধু বুড়ো চাকর, আর খোকা চাকর।

টুনুর বাবা বনেদি বড়লোক। টুনুদের বাড়ির মেঝেয় ছোপ ধরে যাওয়া মার্বেল পাথর। টুনুদের বাড়ির খড়খড়ি শার্সি লাগানো জানলা-দরজার মাথা পর্যন্ত লম্বা লোকেরও সহজে হাত যায় না।

টুনুদের গ্যারেজে দুটো গাড়ি।

একটা হয়তো অকেজো মতো, আর একটা তত ভাল। টুনুর বাবার বিজনেসে খাটে।

তা টুনু যখন বেথুনে পড়েছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে, বাড়ি থেকে গাড়ি করেই আসা-যাওয়া করেছে। কিন্তু টুনু যখন সকলের অনুরোধ উপরোধ হিতবাণী সব ঠেলে দিয়ে হঠাৎ খুব একটা উলটোপালটা কাণ্ড করে বসল, বাবা খাপ্পা হল।

বাবা বলল, গাড়ির এত সময় নেই যে, সেই মুল্লুকে চারবার যাবে আসবে। যেমন লক্ষ্মীছাড়া বুদ্ধি, তেমনি লক্ষ্মীছাড়ার মতো বাসেই যেও।

তা সত্যিই তাই যায় টুনু।

লক্ষ্মীছাড়ার মূর্তিতে টেঙশ টেঙশ করে বাসেই যাওয়া আসা করে।

তা হোক। এটাই স্বাধীনতা।

 টুনুদের বিচারে আরামের থেকে স্বাধীনতা ভাল।

কিন্তু এই ভাবেই কি চলতে থাকবে নাকি? শেষ পর্যন্ত টুনু রেগে বলেছিল, আমি একটা বেচারি মেয়ে নয়? রোজ রোজ রাত্তির পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকতে ভাল লাগে আমার?

তা রাত্তির পর্যন্ত অবশ্যই।

এখানে সেখানে, লেকে, রেস্টুরেন্টে সাড়ে আটটা পর্যন্ত তো থাকেই ওরা, তারপর এই দক্ষিণাঞ্চল থেকে সেই উত্তরাঞ্চল।

তোমার আর কী, এই গড়িয়াহাট থেকে টুক করে ঢাকুরিয়া। ইচ্ছে করলে হেঁটেও যেতে পারো। টুনু রেগে রেগে বলে, আমার? আমার কথা ভাবো!

তা টুনুর কথা ভাববে এবার গৌতম। টুনুর বাড়িতেই যাবে, ঠিক করে।

 টুনুর নিন্দে হবে?

টুনু তো তাই চায়। ওই নিন্দেটাই নাকি ওর অভীষ্ট সিদ্ধির রাস্তা।

আর গৌতম?

তাকেও কি বড় হতে হবে না? একুশ বছর বয়েস পূর্ণ হবার জন্যে আরও সাত মাস অপেক্ষা করতে হবে বলে কি বড় হতে বাধা আছে?

হয়তো একুশ বছর পার হয়ে আরও একুশ বছরের পথ ধরলেও সত্যি বড় হয়ে উঠতে পারত না গৌতম। ও শুধু ভাবত, রোসো, আমি এবার যা ইচ্ছে করব, আমি কি বড় হইনি?অথচ সেই ইচ্ছেটার কোনও চেহারা খুঁজে পেত না।

টুনুর ইচ্ছের প্রাবল্যই ওকে বড় করে ফেলছে।

গৌতমকে আস্ত একটা মেয়ে ভালবেসে মরে যাচ্ছে, বিয়ে করবার জন্যে দিন গুনছে, এর থেকে রোমাঞ্চকর আর কী আছে?

বড় হয়ে যাবার এটাই তো মূল উপকরণ।

 কলেজ থেকে বাড়ি ফেরা, টুনু যাদবপুরে ভর্তি হয়ে পর্যন্তই বন্ধ হয়েছে।

দাদু প্রশ্ন করেন না, কাজেই দাদুর সঙ্গে মিথ্যে কথা বলার প্রশ্ন নেই। জিজ্ঞেস করে পিসি। মানে, প্রথম প্রথম করছিল, এখন আর করে না। পিসিকে যা-তা বলে বোঝানো যায়।

পিসি ক্রুদ্ধ গলায় বলত, কলেজ ভাঙতেই লাইব্রেরিতে ঢুকিস, খিদে পায় না?

না তো!

গৌতম মনে মনে বলে, এটা মিছে কথা নয়, খিদে তো পায়ই না। পাবে কেন, খাই তো কোথাও না কোথাও।

আমি যে তোর খাবার নিয়ে বসে থাকি।

আর থেকো না।

পিসি ধরা গলায় বলে, তা তো বলবিই। এখন বড় হয়ে গেছিস যে! এ তো আর ছোটবেলা নয় যে, ইস্কুল থেকে এসেই দুমদাম করে চেঁচাবি, পিসি কী আছে দাও।

তোমার নিজের কথার নিজেই জবাব দিলে তুমি পিসি! এখন আর ছোটবেলা নেই।

 পিসি অন্যদিকে মুখ ফেরাত। পিসি আস্তে বলত, ছেলেগুলো কী তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়!

 এখন আর খাবার নিয়ে বসে থাকে না পিসি, কারণ গৌতম একেবারে রাত করেই ফেরে।

 একদিন টুনু কলেজে আসেনি, গৌতম বাড়ি ফিরেছিল। সেইদিন দাদু প্রশ্ন করেছিলেন, সন্ধ্যা-গায়ত্রীটা তা হলে ছাড়লে?

গৌতম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিল চোখ নিচু করে, সেইভাবেই বলে, সময় হচ্ছে না তো।

সময় না হওয়াটা তোমার ইচ্ছাকৃত। দাদু ভারী গলায় বলেন, হঠাৎ সময়ের এত ঘাটতি হবার কারণ কী?

গৌতম চোখ না তুলেই বলে, বন্ধু-টন্ধুদের তো ওই সময় ছাড়া পাওয়া যায় না।

গায়ত্রী ত্যাগ করে বন্ধুদের সঙ্গে মেশাটাই তা হলে তোমার অভিরুচি?

দেবেন্দ্রনারায়ণের মনে পড়ে না, নিজে তিনি বেয়াল্লিশ বছর বয়েস পর্যন্ত গায়ত্রী ত্যাগ করেই কাটিয়েছেন। গৌতমের কি সেই কথা মনে পড়ে যায়? না, শোনা কথা মনে পড়ে না গৌতমের।

গৌতম নিজে থেকেই মাথা তুলে দাদুর দিকে তাকিয়ে বলে, ভেবে দেখলাম সন্ধে না হতেই পাখির মতো ডানা গুটিয়ে বাসায় ফিরে এসে মন্ত্র জপ করার কোনও মানে হয় না।

মানে হয় না? ও! তা হলে বেশ ভাল ভাল বন্ধুর সঙ্গে মিশছ মনে হচ্ছে। বেশ উঁচু স্টাইলে কথাও শিখছ। যাক, আমার কিছু বলার নেই। তা সকালটাই বা বন্ধ করোনি কেন?

গৌতম গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে না, কিন্তু আর একটা মন্ত্র জপ করে। সে মন্ত্র বৃথা ভয় করব কেন? তাই গৌতম এ প্রশ্নে সহজ গলায় বলে, সকালে তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।

ওঃ! দাদু বলিষ্ঠ দুটো থাবা পিঠের দিকে জড়ো করে একটুক্ষণ পায়চারি করতে করতে বলেন, এ শিক্ষা বোধহয় তোমার এই মামার বাড়ি থেকে আহরণ করা?

আমি কোনওখান থেকেই কিছু আহরণ করি না।

বন্ধু-টন্ধু সকলেরই থাকে, তবু স্কুল-কলেজ থেকে বাড়ি সকলেই আসে। বেশ তো, তাদের নিয়েই চলে আসতে পারো।

গৌতম মনে মনে হেসেছিল। কারণ, তখনও টুনু এ বাড়িতে আসেনি।

গৌতম ভেবেছিল, বন্ধুকে নিয়েই চলে এলে তুমি কি আর পায়ের উপর থাকবে বৃদ্ধ মহোদয়, স্রেফ ফেন্ট হয়ে যাবে।

মুখে বলেছিল, লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেই দূর থেকে আসে, চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়।

এটাও আমি মিথ্যা করা বলিনি–ভেবেছিল গৌতম। টুনু দূর থেকেই আসে। আর লাইব্রেরিও বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু টুনু সেদিন বেড়াতে আসার পর দাদু নাতির বন্ধুর স্বরূপ বুঝে গেছেন।

আর যেন কোনও প্রশ্ন করার নেই তাঁর।

মৃত্যুর পর আর ডাক্তার ডাকতে যাবেন কেন?

 পিসিই জেরায় ফেলল। পরদিন বলল, মেয়েটা কে রে?

কলেজের একটা মেয়ে। আবার কে?

মেয়েমানুষ হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে?

কথাটা বড় সেকেলে আর বোকার মতো হল পিসি!

হল তো হল। বলি একটা মেয়ের সঙ্গে এত ভাব কীসের?

এত ভাব? এত ভাবের কী দেখলে তুমি?

দেখলাম বাবা! সহজে কেউ কাউকে ডাকনামে ডাকে না।

বা! ডাক-ফাঁক নেই–ওটাই ওর সত্যিকার নাম। কলেজে তো টুনু মজুমদার নামেই পরিচিত।

 ঢং! পিসি ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ওইরকম ঢং হয়েছে আজকাল। ভদ্রমতো একটা নামও রাখে না। কী জাত ওরা?

গৌতম হঠাৎ হেসে উঠে বলে, হঠাৎ ওর জাত নিয়ে পড়লে যে? কী দরকার?

 আছে দরকার। পিসি গম্ভীর গলায় বলে, সবই তো চোখের উপর দেখতে পাচ্ছি।

 গৌতম ভিতরে ভিতরে কেঁপে ওঠে।

তবু গৌতম হাসি বজায় রেখে বলে, তা হলে তো ওই জাত গোত্র সবই দিব্যদৃষ্টিতে জেনে ফেলবে। মজুমদার কী জাত হয়? বামুন নয় বলেই মনে হয়। কেন, ঘটকালি করবে?

আমার দায় পড়েছে, বলে উঠে গিয়েছিল পিসি।

আর গৌতম ভেবেছিল একটা মেয়ে একদিন বেড়াতে এলেই যদি এত সন্দেহ, তবে আর সাবধানতার অর্থ কী? কেন লুকোচুরি, কেন অপরাধী ভাব?

টুনুর বাড়ির বামুনদি কোম্পানিরাও হয়তো শুনতে চাইবে ছেলেটা কী জাত। যাক। গৌতম আর দ্বিধা করবে না।

টুনু বলল, আজ একটা ট্যাক্সিতে যাই চল।

গৌতম ভুরু কুঁচকে বলে, কেন?

 ভয় নেই বাবা, ভয় নেই। তোমায় নিয়ে পালাব না। এমনি ইচ্ছে করছে। আজ তুমি প্রথম যাবে আমাদের বাড়ি!

আমার অত পয়সা নেই।

বাঃ, আমার কাছে তো আছে।

পৌরুষে বাধবে। অনেকদিন তুমি খাইয়েছ। আজ আবার গাড়ি চড়াবে। উহু।

 টুনু মলিন মলিন গলায় বলে, সব ধারের হিসেব রাখছ বুঝি? ঠিক আছে, পরে সুদসুদ্ধু নেব।

সেই পর-টা কবে আসবে? একমাত্র ভরসা তো লটারি। যা অন্য লোকে পায়। নিজেরা কেউ কখনও পায় না।

পাস করে বেরিয়ে তুমি কাজ পাবে না বুঝি?

 ওই আনন্দেই থাকো।

যাকগে যাক, আজ আমার কথা শোনো লক্ষ্মীটি। কিছুক্ষণ বেশ জগতের সবাইয়ের চোখ এড়িয়ে শুধু আমরা। ভাবতে ভাল লাগে না তোমার?

.

শেষ পর্যন্ত টুনুরই জিত হল।

গাড়িতে বসে টুনু আহ্লাদে গলায় বলে, কেমন ভাল হল বলো তো?

খুব ভাল।

আচ্ছা, পাস করে বেরোবার আগেই তোমার একুশ বছর বয়েস হয়ে যাবে, তাই না?

গৌতম হেসে উঠে বলে, তোমার মাথা থেকে এই একুশে পোকাটা তো যাচ্ছে না। শিবঠাকুরের আপন দেশে পাঠিয়ে দেওয়া যাক তোমায়। যেখানে কেবল একুশের ছড়াছড়ি।

টুনু জানালার বাইরে তাকায়।

 টুনুর রোগা কালো গ্রীবার ভঙ্গিমাটিও অভিমানের ছোঁয়ায় সুন্দর দেখায়।

 টুনু বলে, আমার সব কথা তো জানো না।

বেশ, জানাও।

 জানাব। জানাব বলেই তো

 টুনু ওর একটা হাত চেপে ধরে।

টুনুকে দেখলে নেহাতই হা-ঘরের ঘরের মেয়ের মতো দেখায়। কিন্তু সবাই জানে টুনু বড়লোকের মেয়ে।

ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে টুনু যখন বেণী দোলাতে দোলাতে বলে, চলো, তখন গৌতম নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করে, টুনু বড়লোকের মেয়ে। অথচ কী অদ্ভুত লক্ষ্মীছাড়ার মতো বেড়ায়, ভাবল গৌতম।

.।

টুনু গৌতমকে যে ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো, সে ঘরের চেহারাটায় কিছু আধুনিকতার প্রলেপ পড়েছে।

এ ঘরে বাড়ির সাবেকি ড্রইংরুমের মতো জানলায় দরজায় রেশমি দড়ি বাঁধা পুরনো ভেলভেটের পরদা দোদুল্যমান নয়, হ্যান্ডলুমের পরদা। ঝালর ঝোলানো ভারী ভারী সোফা সেটের পরিবর্তে, হালকা আধুনিক আসবাব।

শুধু ঘরের দেয়ালে একটা পাথরের পরীর হাতে দেয়াল ঘড়ি, আর মেঝে থেকে ছফুট উঁচু একটা দাঁড় করানো আয়না পুরনো দিনের ফ্যাশন বহন করছে, যে জিনিস সর্বদাই দর্শকের সপ্রশংস দৃষ্টি আদায় করে নেয়। এটা টুনুর বাবার আধুনিক ড্রইংরুম। বাবার বিজনেসের বন্ধুরা এ ঘরে এসে বসেন।

তবে সম্প্রতি সন্ধেবেলা আর এ ঘরে জমজমাটি আসর বসে না। ভদ্রলোক এক নতুন নেশায় মেতেছেন। সেখানেই রাত দশটা পর্যন্ত কাটে।

টুনু বলল, বোসো একটু। কোনওদিনই তো কলেজ ফেরত স্নান হয় না, আজ একটু স্নান করে আসি।

এসো। কিন্তু গৌতম বলে, তোমাদের বারান্দার ওধারে একটা অ্যালসেশিয়ানকে ঘুরতে দেখলাম। ওকে বাঁধো।

টুনু খিলখিল করে হেসে ওঠে, কুকুরকে ভয় পাও বুঝি? ও কিছু করবে না।

করুক না করুক, ওকে না বাঁধলে স্রেফ উঠে পালাব।

উঃ, বাবা! টুনু চাপা একটু ঝংকার দিয়ে বলে, ঠিক আছে। তোমায় বাঁধবার জন্যেই ওকে বাঁধতে হবে। কুকুরে ভয়, মেয়েতে ভয়, তুমি কী?

মেয়েতে ভয় মানে?

ভয় না তো কী? ট্যাক্সি শুনেই তো মুখ সাদা হয়ে গিয়েছিল।

বাজে কথা বোলো না।

বাজে বইকী! বলে হাসতে হাসতে চলে যায় টুনু।

বিশেষ একটা সুরে কুকুরটাকে ডাক দিয়ে নিয়ে চলে যায় বোধহয় বাঁধতেই।

একা ঘরে বসে গৌতম ভাবে, আচ্ছা, আমি কি সত্যিই ভিতু? কই? আমার পরিবেশে এর থেকে আর কত সাহসী হব? টুনুর মতো আমার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আছে? ও শুকনো চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু টাকা-পয়সা খরচ করে প্রচুর। আমার তো যা কিছু বাড়তি সবই চাইতে হবে। চাইবার ভয়ে আমি বাড়তি খরচের দিকে যেতে পারি না। টুনুকে কি এত কথা বলা যায়?

আর কুকুরের কথা? কুকুরকে কি আমি আগে ভয় করতাম?

ছেলেবেলায় তো কুকুরছানা নিয়েই খেলা ছিল আমার। বড় কুকুরও তো ছিল বাড়িতে। কিন্তু বাবাকে যখন নিয়ে গেল, সেই কুকুরটা হঠাৎ খেপে গিয়ে কী ভীষণ আর্তনাদ করতে করতে মাকে তাড়া করল! মালি আর রামলগন দুজনের কেউ ওর কাছে যেতে পারল না।…কোনও একজন বাবু চিৎকার করে বলতে লাগল, খেপে গেছে, গুলি করা হোক। কিন্তু গুলি-টুলি কেউ করতে এল না।…আমি লোহার গেটের পাশের পিলারটার উপর উঠে পড়ে (খেলবার জন্যে প্রায়ই যেখানে উঠতাম আমি) পরিত্রাহি চেঁচাতে চেঁচাতে দেখতে পেলাম, মা পাগলের মতো রাস্তায় ছুটোছুটি করে ইরামাসিদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে প্রাণ বাঁচাল। মার শাড়িটা ওদের দরজার বাইরে পড়ে থাকল।

কুকুরটা সেই বন্ধ দরজায় কী আছড়ানো আছড়াতে লাগল, আমার মনে হল দরজা ভেঙে ফেলে ঘরে ঢুকে পড়ে মাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলবে ও।

রামলগনরা দূর থেকে থান ইট মেরে মেরে ওকে আধমরা করে দিল, ওই দরজাটার সামনে দুই পা প্রসারিত করে শুয়ে পড়ল ও।

জানি না ও মরে গিয়েছিল, না বেঁচে উঠেছিল। দাদুর সঙ্গে তো চলেই এলাম আমরা। কে জানে, পরদিন না আরও পরে। তবে কুকুরটাকে আর দেখিনি। তার সেই হিংস্র মূর্তিটাই আমার মনের মধ্যে দেগে বসে আছে।

কিন্তু এত কথা কি টুনুকে বলতে যাব আমি?

অনেক লোকেরই কুকুরে ভয় থাকে, আমারও আছে। ব্যস। সবাই যে টুনুর মতো ডাকাবুকো হবে, তার মানে নেই।

.

টুনু দোতলায় উঠে বাথরুমে যেতে যেতে ডাকল, বামুনদি।

বামুনদি একগাল হেসে এসে দাঁড়াল, আজ যে বড় দিদিমণির এক্ষুনি আবির্ভাব ঘটল। তোমার বিকেলের মুখ তো ভুলেই গেছি।

আর ভুলবে না। বলে হেসে উঠে টুনু বলে, আমার একটি বন্ধু এসেছে, চট করে তাকে কী খাওয়াতে পারবে বলো তো?

বন্ধু এসেছে শুনে খুশি হয় বামুনদি।

আগে আগে তো ইস্কুল কলেজ থেকে মেয়ে জুটিয়ে এনে বাড়িতেই আড্ডা বসাত টুনু। বামুনদির ওপর চা জলখাবারের ফরমাশ করত অবলীলায়।

বামুনদি টুনুর মায়ের আমলের লোক। অনেক দিনেরই লোক, টুনুর মায়ের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সংসারের দিন দেখেছে সে, অসুখে পড়ে থাকা মলিন দিন দেখেছে, মৃত্যুও দেখেছে। টুনুর মায়াতেই পড়ে আছে সে। তা ছাড়া বলতে গেলে সংসারের কীর পদটা তো প্রায় তারই এখন। টুনুর সব আবদার হাসিমুখেই সয় সে।

বামুনদি অনেকদিন পরে কৃতার্থ হয়।

বামুনদি বিগলিত গলায় বলে, তুমিই বলো কী খাওয়াব?

কী করেছ বিকেলে? ভালটালো করোনি কিছু?

বামুনদি কপালে করাঘাত করে, হায় ভগবান! বিকেলে ভাল জলখাবারের পাট আর আছে নাকি? তুমিও ফেরো না, বাবুও ফেরেন না, সন্ধেবেলা গুচ্ছির পরোটা করে আমরা তোকজনেরা গিলি।

খুব ভাল কাজ করো– টুনু হেসে উঠে বলে, এখন আমাদের গেলাবার জন্যে যা করতে পারো করো। ভাল হওয়া চাই। আমি চান করে আসছি।

বামুনদির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের উপর আস্থা আছে টুনুর।

 বামুনদি দুচার মিনিটে অতিথি বিনোদনের আয়োজন মজুতই রাখে।

 টুনু বাথরুমে ঢুকে যাচ্ছিল, বামুনদি হেঁকে বলল, কটা মেয়ে?

 মেয়ে! টুনু হেসে উঠে বলে, মেয়ে আবার কখন বললাম তোমায়? ছেলে। একটা মোটে।

বাথরুমের দরজা বন্ধ করে হেসে কুটিকুটি হয় টুনু।

 বুড়ি এখন চোখ কপালে তুলে মরুক।

তা চোখ কপালে না তুললেও, চিন্তিত না হয়ে পারল না বুড়ি। তলে তলে হচ্ছে একটা কিছু না হলে এমন করে নিডুবি হয়ে থাকে মেয়ে? এক-একদিন রাত নটার আগে বাড়ি ফেরে না। জিজ্ঞেস করলেই বলে, ওঃ, সে দারুণ পড়া! তুমি কী বুঝবে বুড়ি?

সম্প্রতি আবার বলেছিল, একটা ছেলে পড়ানো ধরেছি।

বামুনদি কপালে হাত রেখে বলেছিল, তোমার বাপের পয়সা কে খায় তার ঠিক নেই, তুমি করছ ছেলে পড়ানো?

পয়সাই কি সব বামুনদি?টুনু করুণ করুণ গলায় বলেছিল, সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে কী করব শুনি? বাবাকে তো চক্ষে দেখি না।

কথাটায় কাজ হয়েছিল। বামুনদি বলেছিল, কী আর বলব ভাই, তোমারই কপাল। নইলে এত বড় মেয়ে ঘরে, বাপ কোথায় তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে তা নয়, কোথায় ভেসে বেড়াচ্ছে।

তা, সেদিন বামুনদির সন্দেহ হয়নি।

ছেলে পড়ানো বলতে বামুনদির একটা হাফ প্যান্ট পরা বালকের মূর্তিই চোখে ভেসেছিল। আজ ভাবল, একবার বলছে বন্ধু, আবার বলছে ছেলে! কই, এ পর্যন্ত তো বাড়িতে ছেলেবন্ধু এনে জোটায়নি। সন্ধেবেলা কি একেই পড়ানো চলছে নাকি?

হবেই তো, বাপ যেমন ভাসিয়ে দিয়েছে। গাড়ি করে কলেজে যাবে-আসবে মেয়ে, তা নয়, তাকে মাঠে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তোক এখন একটা কিছু অঘটন।

চিন্তার ফাঁকে ফাঁকে হাত চলছিল বামুনদির নির্ভুল। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বার করে সাজাল। ডিমের পুর দিয়ে কচুরি ভেজে ফেলল, চা বানাল, মিহি করে আলু ভাজল।

খাবারের প্লেট হাতে করে সদ্য স্নান করে টুনু যখন ঘরে ঢুকল, তখন তার সারাদিনের লক্ষ্মীছাড়া চেহারায় চমৎকার একটি লক্ষ্মীশ্রী ফুটেছে। সাদা শাড়ি ছাড়া কোনওদিন কলেজে যায় না টুনু, সেই মূর্তিটাই দেখেছে গৌতম। আজ দেখল, টুনু একটা হালকা নীল রঙের শাড়ি পরেছে। তার সেই টান টান করে বাঁধা চুলটা খুলে ছড়িয়ে দিয়েছে মুখের চারপাশে। ছড়িয়ে আছে চুলগুলো। জল ঝরছে আগা দিয়ে।

গৌতম বলে উঠল, উঃ, খুব যে সেজেগুজে আসা হল। দেখে লোভ হচ্ছে।

টুনু দাঁড়িয়ে পড়ে ব্যঞ্জনাময় একটু হেসে বলে, লোভ হচ্ছে? কী ইচ্ছে করছে?

ইচ্ছে করছে তোমার মতো প্রাণভরা একটু স্নান করে আসি।

 টুনুর মুখটা একটু কালো দেখায়। তবু টুনু সামলে নেয়।

 বলে, লোভের দৌড় এই পর্যন্ত! সাধে বলি খুন করতে ইচ্ছে করে! এখন দয়া করে খাও দিকি।

 কই, তোমার কই?

বামুনদি আনছে।

আবার বামুনদি কেন? গৌতম অস্বস্তির গলায় বলে, একসঙ্গে নিয়ে এলেই হত?

 বাঃ! বামুনদিকে পাত্র দেখাব না?

গৌতম রাগ রাগ গলায় বলে, দেখো, বড় বাড়াবাড়ি করছ তুমি। এই রকম করবে বুঝি? তাহলে কে আসবে?

টুনুর মুখটা যেন নিভে যায়।

 টুনু মলিন গলায় বলে, তুমি আমার অবস্থা তো জানো না।

জানব না কেন? এখন তো আরও ভাল করেই জানলাম। বাড়ি ঢুকলে মার্বেল পাথরের সিঁড়িতে পা ফেলে ফেলে, লোকজনকে ফরমাশ করলে, হাতের কাছে খাবার এসে গেল, এখন পাখার তলায় বসে খাবে।

টুনু আস্তে হেসে বলে, এ সমস্তই বহিরঙ্গ গৌতম! ভিতরে অনেক সমস্যা।

একটা বিয়ে করতে পারলেই সব সমস্যা ঘুচে যাবে?

সব, সব। সমস্ত। বিয়ে না করলে তো এ বাড়ি থেকে পালাবার উপায় নেই।

বুঝলাম না। বাড়িতে কি ভূত আছে?

নেই। তবে ভূতের থেকে ভয়াবহ কিছু আসবার জন্যে প্রস্তুতি চলছে।

আর একটু প্রাঞ্জল করে বললে হত না?

আজ থাক গৌতম। আজ তুমি প্রথম এলে!

.

কিন্তু সেই প্রথম আসা থেকে অনেকবারই আসে গৌতম। বলতে গেলে টুনু টেনেই নিয়ে আসে।

 কিন্তু গৌতম বলে, আমার কিন্তু তোমাদের এই বিরাট বাড়িখানার থেকে নিরালার সেই কেবিনটাই বেশি ভাল লাগে।

আমারও লাগে না তা নয়, টুনু বলে, কিন্তু আমি তোমায় একটা বাড়ির মধ্যে পেতে চাই গৌতম। তাহলে যেন বল পাই, যেন বিশ্বাস আসে।

তারপর বলে, আচ্ছা গৌতম, ম্যারেজ রেজিস্ট্রারকে বলে কয়ে দু-চার মাস বয়েসটা বাড়িয়ে নেওয়া যায় না?

টুনু অবিরত বিয়ের স্বপ্ন দেখছে।

কিন্তু গৌতম? গৌতম কি সত্যি ভাবতে পারছে, সাবালকের পর্যায়ে উঠলেই সে বিয়ের জন্যে দরখাস্ত করতে পারবে?

টুনু এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, যাবার জন্যে ছটফট করছে (যদিও কারণটা আজ পর্যন্ত খুলে বলেনি) কিন্তু গৌতম তাকে কোন বাড়িতে তুলবে? গৌতমের সেই দাদুর বাড়িতে? এর থেকে অবাস্তব কল্পনা আর কী আছে?

কথাটা একদিন তুলল গৌতম।

সেদিন ওরা নিরালার কেবিনেও ঢোকেনি, পাথুরেঘাটার সেই পাথর বাঁধানো বাড়িটাতেও যায়নি। ওরা বুদ্ধ মন্দিরের বাগানে এসে বসেছিল।

গৌতম বলল, ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে পড়াটাই তো শেষ কথা নয় টুনু, তারপর?

টুনু আলগা গলায় বলে, তারপর আমরা সুন্দর একটি ফ্ল্যাট নেব

ম্যারেজ রেজিস্ট্রার বোধহয় সই-সাবুদের পর বড় এক থলি টাকা দেবে?

ঢং কোরো না। টুনু রুমাল বার করে ঘাড় মুছতে মুছতে লজ্জা লজ্জা গলায় বলে, তুমি তো আমায় কোনও কথা বলতেই দাও না। নইলে কবেই জানতে পারতে, মায়ের বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার নামে তোলা আছে। শর্ত হচ্ছে, বিয়ের সময় পাব। অর্থাৎ বিয়ের যৌতুক।

গৌতম কোনওদিন শোনেনি একথা। গৌতমের হঠাৎ ভয়ংকর একটা কষ্টে সমস্ত শরীর তোলপাড় করে ওঠে।

গৌতমের হঠাৎ নিজেকে খুব অকিঞ্চিকর লাগে। টুনুর এত আছে, গৌতমের পঞ্চাশটা টাকাও নিজের বলে নেই।

আর হঠাৎই গৌতমের টুনুকে একটি ঘুঘু মেয়ে মনে হয়।

ওঃ তাই! তাই বিয়ের জন্যে এত ব্যস্ততা।

ওই বিরাট অঙ্কের টাকাগুলি হস্তগত করবার জন্যে ছটফটানি ধরেছে, তাই যে করেই হোক একটা বিয়ের দরকার। তার মানে, যেমন সাদাসিধে সরল আর ভালবাসায় ভরা মেয়ে মনে হত, তা নয়।

অনেক টাকা দিয়ে গেছে ওর মা, সেই টাকায় বর কিনেপুষতে চায়।

আর সেই পোষ্য প্রাণী হিসেবে গৌতমকেই সে পছন্দ করেছে। যেমন ওদের বাড়ির সেই বিরাট অ্যালসেশিয়ানটাকে চোখের ইশারায় চালায়, ভেবেছে তেমনি চালাবে পোষা বরটাকে।

টুনুর এতদিনের সমস্ত আকুলতা, সব রহস্য জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায় গৌতমের চোখে। আর সেই যে একটা কারণ রোজ রোজ না বলে রেখে দেয়– সেই কারণটাও ধরা পড়ে যায়।

ওর নিজের একুশ বছর বয়েস হয়ে গেছে, ও আর অপেক্ষা করতে পারছে না, গৌতমকে তাই জোচ্চুরি করে সাবালক সাজাতে চাইছে।

গৌতমের মনে হয়, টুনুর মুখটা কী কাঠ কাঠ, টুনুর সামনের দাঁত দুটো কী বিশি রকমের উঁচু, টুনু কী কালো।

আমি ওকে এতদিন ভালবাসার চোখে দেখেছি বলে চোখে পড়েনি, ও এত বিশ্রি দেখতে।

 গৌতম তীব্রগলায় বলে ওঠে, ওঃ, তাই বুঝি? বিয়ের জন্যে এত ব্যস্ততার কারণ ওই টাকা! ওটা হস্তগত করবার জন্যে।

কী বললে?

গৌতম ঠিকরে দাঁড়িয়ে উঠে রূঢ় গলায় বলে, যা সত্যি তাই বলেছি। কিন্তু তোমার যখন ওই টাকাটা করতলগত করাই উদ্দেশ্য, তখন আর গরিব ব্রাহ্মণের নাতিটাকে কেনবার চেষ্টা কেন? টাকার লোভে বিয়ে করতে ছুটে আসবে এমন সুপাত্রের তো অভাব নেই বাংলাদেশে।

টুনু বসে পড়ে। টুনু রুদ্ধ গলায় বলে, গৌতম!

আর অভিনয় করে কী করবে টুনু, সত্যটা বড় বেফাঁসভাবে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। তবে এইটাই শুধু ভেবে অবাক হচ্ছি, আমার মতো একটা ভুল পোক বাছতে গেলে কেন তুমি? যার জন্যে তোমায় এখনও ছ মাস অপেক্ষা করতে হবে। অঙ্কয় তো তুমি ভাল, এ অঙ্কটা এমন কাঁচা কষলে কেন?

টুনু আবার উঠে দাঁড়ায়। গম্ভীর গলায় বলে, তোমার ভুল ভাঙাবার চেষ্টা আমি এখন করব না গৌতম! নিজেই ভুল ভাঙবে। আচ্ছা চলি।

গাড়ি চড়ে ওরা কোথায় গেল রে রবি?

 ছোট ছেলেকে ডেকে প্রশ্নটা করে বুলবুলি পাখি।

বড় ছেলে ববি তো কথাই কয় না, নেহাত বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে বাড়ির ভাগ সম্পর্কে কিছু ফাঁকে পড়ে যাবে, তাই একই বাড়িতে ভিন্ন গোত্রের মতো বউ ছেলে নিয়ে বাস করছে সে।

তা ছাড়া মার ওই আহ্লাদী ছোট মেয়ের এ সংসারে ঢোকা পর্যন্ত রাগে হাড় জ্বলে গেছে তাদের। সুমিতা যতই বড় বউদিকে লাল গোলাপ, লাল গোলাপ ডেকে আদিখ্যেতা করুক, সাড়া দেয় না লাল গোলাপ।

একথা সত্যি, সুমিতা যখন প্রথম তার দুর্ভাগ্যের উপর আবার শাসনের শাস্তির জ্বালায় ছটফটিয়ে এখানে ছুটে এসেছিল, সহানুভূতি কম হয়নি তার। তার উপর আবার বেচারির ছেলে আটকে রাখা হয়েছে।

লাল গোলাপই উত্তেজিত হয়ে বলেছে, তোমরা চুপ করে থাকবে? কেস করুক সুমিতা। মায়ের কাছ থেকে বাচ্চা ছেলে কেড়ে রাখার আইন কোথায় আছে?

কিন্তু সুমিতাই সেই উত্তেজনা প্রশমিত করে দিয়েছে উদাস বৈরাগ্যের বাণী দিয়ে। বলেছে, কাড়াকাড়ি করে কী পাব লাল গোলাপ? ছেলে দাদুর কেনা গোলাম। আমাকে দেখতেই পারে না। বাপ মরে পর্যন্ত আমি যেন ওর দু চোখের বালাই হয়েছি।

ওমা! সে কী? কেন? সবাই বলেছে সমস্বরে।

সুমিতা আরও করুণ গলায় বলেছে, ভগবান জানেন। থাক, যেখানে ভাল থাকে থাক। এরপরে আবার ওর ঠাকুরদা বলে বসবেন–ছেলের শিক্ষা হয়নি।

বুলবুলি পাখি এ অপমান গায়ে রাখেনি, ফোঁস করে উঠে বলেছে, কেন? আমার ছেলেরা মুখ?

ওঁর মতে–সুমিতা হেসেছে ম্লান করুণ। বি এ এম এ পাশকে উনি শিক্ষা বলেন না। সংস্কৃত শেখা চাই। উপনিষদের বাণী মুখস্থ করা চাই। বলেন কী–তোমার ভাইদের পৈতে তো পোবার বাড়ি যায়, তাই না বউমা?

সেকেলের চরম। মুখ বাঁকিয়েছিল লাল গোলাপ।

তারপর লাল গোলাপই বলেছিল, নিরিমিষ খাবি মানে? চললাম আমি তোর জন্যে নিরিমিষ রান্নাঘর বানাতে। দায় পড়েছে! কেন, মার থেকে বেশি পুণ্যবতী হয়ে উঠতে চাস বুঝি? মা নরকে যাবেন, তুই স্বর্গে যাবি?

লাল গোলাপই বলেছিল, আমাদের মাঝখানে ঘুরে বেড়াবি তুই ওই ঝিয়ের মতো কাপড় পরে? বলিহারি তোর শ্বশুরকে বাবা। প্রাণে একটু মায়াও হয়নি।

তার মানে ববির বউয়ের প্রাণে মায়া ছিল। ববির বউ দুর্ভাগিনী ননদটাকে একটু স্নেহের পরশ দিতে চেয়েছিল। তার অন্ধকার-হয়ে-যাওয়া জীবনে একটু মোমবাতি জ্বেলে দিতে হাত বাড়িয়েছিল।

হৃদয়বত্তারই পরিচয় দিয়েছিল।

শুধু ধারণা ছিল না তার, সেই বাতির আলোকটুকুকেই আগুন করে তুলবে সুমিতা। আর সেই আগুনে ইন্ধন দিয়ে দিয়ে আপন চিতাশয্যা রচনা করবে।

চিতাশয্যাই। শুধু নিজেরই নয়, চিতাশয্যা নীতির, সভ্যতার, শালীনতার।

হয়তো এই ভয়েই এত বাঁধ দেওয়ার ঘটা। হয়তো বুদ্ধিমানেরা জানে মানুষকে বিশ্বাস নেই। আর এও জানে, বাঁধ ভেঙে দিলে সীমানার সীমা রাখা বড় কঠিন।

জানত না বলেই নিজের ভুল বুঝতে পারেনি লাল গোলাপ। এখন দারুণ চটে গেছে ওই অসভ্য মেয়েটার ব্যবহারে। ঊনচল্লিশ বছরের মহিলাকে যদি মেয়ে বলা যায়।

মার প্রশ্রয়েই এটি হয়েছে। এই কথাই বলেছে ববি।

ববিই তো গাড়ি পাঠিয়ে পাঠিয়ে বোনের ছেলেটাকে তার মার তৃষিত মাতৃচিত্তের কাছে এনে ধরে দিয়েছে। কারণ, ও দেখত সন্ধ্যাবেলা একা একা ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুমিতা।

মা বলত, একা ছাদে কেন রে সুমি? ভাইপো-ভাইঝিদের নিয়ে লুডো-টুডো খেল না?

সুমিতা বলত, ভাল লাগে না।

তার মানে নিজের ছেলেটি না হলে ভাল লাগবে না।

কিন্তু সে ওষুধ কাজে লাগল না।

ছেলে আসে বটে, মায়ের দিক ঘেঁষে না। ওই মামাতো ভাইবোনেদের সঙ্গে কাটায়।

ফের দিন গাড়ি পাঠাতে দেখলে সুমিতা ঠোঁট উলটে বলত, এসে তো আমার সবই করবে। ভেঁড়া ফুল খোঁপায় লাগে না, বুঝলে ববি? ওর মন থেকে আমায় কেটে দিয়েছেন ওরা।

দাদা বলার পাট নেই এদের বাড়িতে, ছোটরাও বড়দের নাম ধরে ডাকে।

দাদা বলেছিল, ওরা কেটে দিয়েছে। জোড় লাগা? তুই তো মা।

কিন্তু সুমিতা যেন ও কথাটা ভুলেই যেতে চেয়েছে।

সুমিতা ক্রমশ একা ছাদে ঘোরা ছেড়ে দিয়ে হুড়ে হয়ে উঠেছে। সুমিতা শাড়ি জামার হালকা একটু রঙের রেখার পথ দিয়ে টেনে এনেছে সব রং, সব রস, সব সুষমা, সব ঔজ্জ্বল্য।

তারপর কবে যেন ছোড়দা রবি খাল কেটে কুমির এনেছে।

ডেকে এনেছে তার বিজনেসের বড় পার্টনার মজুমদারকে।

মজুমদারকে হাতে রাখা বড় দরকার!

তা ছাড়া ব্যবসার শলা পরামর্শ করতে রবিকেই ছুটতে হত ওর কাছে অত মাইল দূরে।…এখন সে ক্লেশটা বেঁচেছে।

রবির বউ ওইটুকুতেই প্রীত।

নিত্য সন্ধ্যাবেলা বর ছুটত পার্টনারের বাড়ি, আর নিত্য এসে বলত, লোকটাকে ঠিক বোঝা যায় না। কোনদিন না বলে বসে ব্যবসা তুলে দেব।

এখন আর সে ভয় নেই।

এখন ওই প্রায় প্রৌঢ় লোকটাকে জালে তুলতে ভাল একটি টোপ জোগাড় করে ছিপ নিয়ে বসে আছে রবি।

রবির বউ, যাকে নীল গোলাপ বলে সুমিতা, সে শুধু বরের কাছে হেসে হেসে বলে, খুব রক্ষে যে কালো হয়ে জন্মেছি, নইলে তুমি নির্ঘাত আমাকেও টোপ করতে। তোমায় বিশ্বাস নেই।

অতএব বোঝা যায়, সকলের নীতিজ্ঞান সমান নয়।

 ববির বউ যাতে ঘৃণায় ধিক্কারে কঠিন হয়, রবির বউ তাতেই হেসে গড়ায়।

বুলবুলি পাখি যখন প্রশ্ন করল, গাড়ি করে ওরা কোথায় গেল রে রবি?

রবির আগেই রবির বউ উত্তর দিল, গাড়ি চড়ে সন্ধ্যাবেলা কোথায় আর যায় মানুষ মা? গঙ্গার ধারে কি গড়ের মাঠে।

রবির মা ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে বলে, তা হঠাৎ গড়ের মাঠে হাওয়া খেতে যাবার দরকারটা কী হল রবি?

রবি রুক্ষ গলায় বলে, সেটা আমায় জিজ্ঞেস না করে যারা গেল তাদের জিজ্ঞেস করলেই পারতে। তবে গেলেই বা কী পৃথিবী উলটে যাবে, তাও তো বুঝি না!

মা বোধ করি আজ মরিয়া হয়েই ছেলের সঙ্গে বোঝাঁপড়া করতে এসেছিল। তাই আরও রাগের গলায় বলে, বুঝবে না কেন? বাঙালির সমাজে বাস করো না? লোকনিন্দে কথাটার মানে জানো না?

লোকনিন্দে?

রবি হেসে উঠে বলে, হঠাৎ ভূতের মুখে রাম নাম কেন মা? তুমি তো কই ওই লোকনিন্দে জিনিসটার ধার ধারো না। বাঙালির সমাজে তো বিধবার শাড়ি চুড়ি পরা, মাছ মাংস খাওয়া সব কিছুতেই নিন্দে।

বুলবুলি পাখি ঠোঁট কামড়ায়। বুলবুলি পাখি বুঝতে পারে, সুযোগ পেয়ে ছেলে আজ তাকে দংশন করল।

নিজেই তো সে বলেছে, আমি ও সব কুসংস্কার মানি না।

কিন্তু খাওয়া জিনিসটা তো গৃহগণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ।

এটা কী? এ যে উচ্ছন্ন যেতে বসেছে সুমিতা।

আর সেটা বসেছে চল্লিশ বছর বয়েসে। চব্বিশ বছর হলে বুঝি এত লোকলজ্জা, এত অস্বস্তি হত বুলবুলি পাখির।

বহুদিনের ভয় ভুলে, বুলবুলি ছেলের মুখের কাছে আঙুল তুলে বলে, এই তুমি, তুমিই এইটি করলে, তুমিই! তুমিই।

রবি কী উত্তর দিত কে জানে, ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেন ঘুরে এসে আহ্লাদে ছলছল করতে করতে সুমিতা এসে ঢুকল, ওমা গো, তোমার এই ছোট মেয়েটা কী ভুলো গো! বাড়ির চটি পরে বেরিয়ে গেছি। তোমার ওই মজুমদারটিও তেমনি রবি! ইয়ারের রাজা! বলে কিনা–কে আপনার চরণ কমলের দিকে তাকাচ্ছে?

হি হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে সুমিতা, হালকা সিল্কের শাড়ির খাটো আঁচলটা বুক থেকে প্রায় খসেই পড়ে তার। কোনও মতে তার কোণটুকু কাঁধে তুলে, বাড়ির চটি ছেড়ে, বাইরের চটি পরে প্রায় হালকা হাওয়ার মতো ভেসে চলে যায় সুমিতা। মনে হল একটি সদ্য-তরুণী খুশির নৌকোয় পাল তুলে বেরিয়ে গেল।

সুমিতার গঠনভঙ্গিতে এখনও তরুণীর লাবণ্য, তরুণীর নমনীয়তা। চল্লিশের সুমিতাকে বোধ করি সহসা চব্বিশ বলে চালানো যায়।

সুমিতা যদি তার সেই কঠোর নীতি শ্বশুরের কাছে পড়ে থাকত, আর তার অকালবৃদ্ধা ননদের সঙ্গে এক ছাঁচে জীবন যাপন করত, সুমিতা নিশ্চয় এতদিনে একটি হলুদরঙা শীর্ণকায়া প্রৌঢ়ায় পরিণত হত। কিন্তু সুমিতা পিতৃগৃহের আরাম আয়েসের মধ্যে নিশ্চিন্ত কুমারী জীবনে লালিত হচ্ছে।

সুমিতা এযাবৎ খেয়েছে ঘুমিয়েছে, আর ফ্যাশান পত্রিকার পৃষ্ঠা উলটে উলটে নির্দেশ সংগ্রহ করে লাবণ্য বৃদ্ধির চর্চা করেছে। সুমিতা বোধ করি ভুলেই গেছে সে কুমারী নয়, তার একটা অতীত ছিল। হয়তো ইচ্ছে করেই ভুলেছে। তাই ওর মনের জগতে গৌতম নামের ছেলেটার স্থান হয়ে গিয়েছে ভাইপো-বোনগোর সামিল।

তাই গৌতম অনেক দিন পরে এসে দাঁড়ালেও সুমিতা মাতৃ-হৃদয়ের স্নেহক্ষুধা নিয়ে ছুটে আসে না!… গৌতম এসেছিস? বোস বলে কুকুরছানা নিয়ে লাফালাফি করে মেতে থাকতে পারে অনেকক্ষণ ধরে।

কিন্তু গৌতমের দিক থেকেই বা ব্যাকুলতা কই?

গৌতম কি ওই তরুণীর লাবণ্য আর কিশোরীর চাপল্যে মোড়া ক্ষীণাঙ্গী যুবতাঁকে মা বলে ভাবতে পারে? পারে না।

তাই গৌতমের চিত্তেও মা বলে ব্যাকুলতার সুর বাজে না। মামার বাড়ির মামি মাসিদেরই মতো একজন–এ ছাড়া আর কোনও অনুভূতি নেই তার মা সম্পর্কে!

মা ডেকে পাঠালে মাঝে মাঝে আসে গৌতম। বাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে ডেকে পাঠায় সুমিতা। অথবা বুলবুলি পাখি। কিন্তু আশ্চর্য, একদিনও তাকে খাওয়াতে পারে না এরা।

এ বাড়িতে এলে কোনওদিনই খিদে থাকে না গৌতমের।

সুমিতা কড়া গলায় বলে, কী, এখনও সেই বোষ্টমের খাওয়া চলছে বুঝি?

গৌতম বলে, তা কেন? টাইফয়েডের পর থেকে তো সবই খাই, মাছ মাংস ডিম। সাধন বেঁধে দেয়।

ও বাবা, এত উন্নতি! শুনে বাঁচলাম।

সুমিতা ভুরু কোঁচকায়, তা হলে আর এখানে খেতে বাধা কী?

বাধা তো বলিনি। খিদে নেই তাই বলেছি।

এখানে যেদিনই আসিস–বুলবুলি পাখি কাতর মুখে বলে, তোর খিদে থাকে না কেন, গৌতম ভাই?

এমনি।

 তা কেন? সুমিতা কুটিল গলা করে বলে, আমরা ওকে বিষ খাওয়াব সেই ভয়ে!

গৌতম মায়ের এ কথার উত্তর দেয় না, গৌতম মামাতো ভাইদের সঙ্গে ক্যারম খেলতে বসে যায়।

কিন্তু আর কি আসছে গৌতম?

কতদিন যেন আর আসেনি।

সুমিতা মনে মনে নিজের দিকে যুক্তি খাড়া করে, ঠিক আছে! আমিই বা কেন তবে ছেলে ছেলে করে মরতে থাকি?

দৈবক্রমে ওকে আমার গর্ভে জন্মাতে হয়েছিল এইমাত্র। যখন তেজপুরে থেকেছি, ও তো ওর বাপকেই ভজেছে। সবটা প্রাণ বাপের উপর। বুঝতে পারতাম না? আর তারপর তো আমাকে কাঠগড়াতেই বসিয়ে রেখেছে। যেন আমিই ওর বাপকে গুলি করেছিলাম। যাক গে, ওসব কথা আর ভাবতে চাই না। সেই অতীতটাকে মুছে ফেলতে চাই আমি, আমার জীবন থেকে। আমি সুমিতা নামের সেই মেয়েটা, যে মেয়েটা কলেজ যেত, গান গাইত, কলেজ সোশ্যালে অভিনয় করে বাহবা পেত, খেলাধুলোয় প্রত্যেকবার প্রথম হত।

সেই পুরনো জায়গায় পুরনো আমি, পুরনো জীবনের মধ্যে আবার সুন্দর হয়ে ফুটে থাকতে চাই। ব্যস। কী দরকার আমার ওই এক অনমনীয় বংশের অনমনীয় বংশধরকে খোশামোদ করে আপন করার চেষ্টায়।

এই সবই ছিল যুক্তি সুমিতার।

কিন্তু ক্রমশই যেন তার মনের সুর পালটাচ্ছে। অতএব যুক্তির সুরও।

ক্রমশ আর পুরনো জায়গায় পুরনো জীবনে, কুমারীর সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে থাকায় সুখ পাচ্ছে না সে।

এখন অন্য এক নতুন জায়গায়, নতুন জীবনের মধ্যে, নতুন হয়ে ফুটে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে সুমিতার। আর সেই জীবন ওর হাতের মুঠোয় এসে গেছে।

রবির বন্ধু এখন আর কেবলমাত্র রবিরই বন্ধু নেই, অনেক বড় বন্ধু হয়ে উঠতে চাইছে রবির বোনের।

.

চটি বদলে পরে হাওয়ার মতো ভেসে গিয়ে গাড়িতে উঠল সুমিতা। গদিতে পিঠ দিয়ে বসে পড়ে বলল, বাবাঃ, হাঁপিয়ে গেছি। যা ছুটে গেছি, এসেছি।

সাধ করে এই কষ্টটা বরণ করলে, মজুমদার বাঁ হাত বাড়িয়ে পার্শ্ববর্তিনীকে একটু ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে টেনে এনে বলে, সাধ করে কষ্ট বরণ করলে। এত মূল্যবান সময়টুকু তুচ্ছ চটির জন্যে খানিকটা বাজে খরচ হল।

মজুমদার নিজেই গাড়ি চালাচ্ছিল।

মজুমদার তার সান্ধ্যভ্রমণের সময়টায় ড্রাইভারকে সঙ্গে রাখে না। মজুমদার চায় না তার নিত্য গতিবিধির রেকর্ড কারও খাতায় থাকে।

মজুমদার মাঝে মাঝেই এ বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েদের প্রমোদ ভ্রমণে বার করে নিয়ে যায়। হয়তো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে, নয়তো কোনও কার্নিভালে। একশো বেলুন কিনে ওড়াতে দেয় তাদের, আইসক্রিম খাওয়ায়, টফি খাওয়ায়, চানাচুর খাওয়ায়। আর তাদের ম্যানেজ করতে তাদের পিসিকে সঙ্গে নেয়। বলে, চলুন, চলুন, আপনিও চলুন। নইলে কায়দায় রাখতে পারব না।

চারটে বাচ্চার মধ্যে তিনটেই রবির, একটা ববির। ববির বউ সেটাকে চোখ রাঙিয়ে আটকাতে চেষ্টা করে, পেরে ওঠে না। আর রবির বউ তো এগিয়েই দেয়। স্বামীর বন্ধুর সঙ্গে ছেলেরা বেড়াতে যাবে, এর থেকে সুন্দর দৃশ্য আর কী আছে! বাড়িতে থাকা পিসি সঙ্গে যাবে, সেটাই বা কী এমন কুদৃশ্য?

কিন্তু ক্রমশ শুধু ওই পিসিটাই যাচ্ছে। তার কারণ, যাওয়াটা ঘড়ির কাঁটার এমন একটা খাঁজে এসে পৌঁছোচ্ছে যে, প্রায়ই সেটা হয়ে যাচ্ছে ছোটদের আহার নিদ্রার সময়।

অতএব ওরা আর এখন না-ই বেরোল।

 মজুমদার একহাতে পার্শ্ববর্তিনীকে বেষ্টন করে অন্যহাতে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। কারণ এই অপার্থিব সুখটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবার বস্তু।

কতদিন থেকে যেন জীবনটা তার স্রেফ মরুভূমি হয়ে বসে আছে। রস নেই, রং নেই, মাধুর্য নেই। শুধু টাকা উপার্জনের যন্ত্র হয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ, যদি সে টাকায় সুখ কেনা না যায়।

সুখ কোনওদিন কেনা হয়নি মজুমদারের। স্ত্রী একটা ছিল, তা সে ছিল প্রায় জন্মরুগ্ন। চিরদিন তার জন্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ভোগ করেছে, আর ডাক্তারের খরচা জুগিয়েছে। তারপর তো মরেই গেল।

মজুমদার যদি সেরকম বেপরোয়া হত, এতদিনে চরিত্র খারাপ করতে পারত, বেপরোয়া ড্রিঙ্ক করতে পারত, অসামাজিক জীবন যাপন করতে পারত। কিন্তু মজুমদার বেপরোয়া নয়। মজুমদার জীবন-লুব্ধ।

মজুমদার এখনও একটি সংসারের স্বপ্ন দেখে।

যে সংসার একটি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল গৃহিণীর উপস্থিতিতে স্বর্গোদ্যানতুল্য হবে। মজুমদার গাড়ি চালাতে চালাতে একটি পাশ্ববর্তিনীর অভাবে গভীর শূন্যতা বোধ করে, মজুমদার এই জগতের বহুবিধ রমণীয় প্রসাধনের দোকানের সামনে দিয়ে যেতে যেতে নিজেকে পরমবঞ্চিত মনে করে।

মজুমদারের একটা মেয়ে আছে বটে, কিন্তু সেটা না থাকাই। একবগা গাঁইয়া মতো। সাজগোজের ধার ধারে না, বাপের সঙ্গে সম্পর্কই নেই যেন।

কেন ওর ওরকম অসহযগিতা, বুঝতে পারে মজুমদার। বাপ হয়েছে বলে তার যেন জীবনবলে আর কিছু থাকবে না। স্রেফ স্নেহশীল পিতার মূর্তিতে বুডোর ভূমিকা পালন করে যেতে হবে। চুলোয় যাক।

মজুমদারের এখন ওই চুলোয় যাক মনোভাব। চুলোয় যাক লোকনিন্দা, চুলোয় যাক সভ্যতা ভব্যতা। আনন্দ পাবার অধিকার সবাইয়েরই আছে।

আমার এক জ্বালা হয়েছে– খিলখিলিয়ে হেসে বলে ওঠে সুমিতা, লোকের সামনে আপনি, লোকের আড়ালে তুমি। আচ্ছা এক দ্বৈত ভূমিকার মধ্যে পাক খাচ্ছি।

মজুমদার গল্পদ কণ্ঠে বলে, আর কেন কষ্টের মধ্যে থাকা? আমিও তো আর পারছি না।

সুমিতাও হঠাৎ নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বাঞ্ছিত প্রেমিক পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে বলে, আমিও আর পারছি না মজুমদার! সকলের চোখেই যেন অভিযোগের চাহনি। সকলের কথার সুরেই অবজ্ঞার আভাস। যেন আমি একটা কাঠগড়ার আসামি! কেন, কেন আমি এভাবে পড়ে থাকব?

মজুমদার খাড়া হয়ে বসে। বলে, আমি তো অনেকদিন থেকেই আবেদন দিয়ে রেখেছি সুমিতা, তুমিই আমায় ঠেকিয়ে রেখেছ।

আর রাখব না।

সুমিতা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, কীসের অপরাধে চোরের ভূমিকায় কাটাতে হবে আমায়? আমি যদি আমার হাহাকার করা শূন্য মনের জন্যে এতটুকু সুখ আহরণ করতে যাই, সেটা করতে হবে চুরি করে। আর সেটুকু ধরা পড়ে গেলে চোরের লজ্জা নিয়ে থাকতে হবে। লোকের সামনে দেখাই, ওসব গায়ে মাখছি না, কিন্তু গায়ে বেঁধে মজুমদার, ছুঁচের মতো বেঁধে। তুমি একটু ভালবাসো বলে সকলের বিষদৃষ্টিতে পড়ে আছি। মা পর্যন্ত

কান্নাটা আর একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে সুমিতার।

এটা কি অভিনয়?

 কেন তা হবে?

সুমিতার চিত্তভঙ্গির দিক থেকে এই অনুভূতি তো তাকে দহ্মাচ্ছে। চির প্রশ্রয়দাত্রী মা পর্যন্ত যে আজকাল বিমুখ, তা কি টের পায় না সে?

অথচ তার জন্যে এক আনন্দের জগৎ, ভোগের জগৎ প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। কীসের জন্যে সে জগতের আহ্বানকে ফিরিয়ে দেবে সুমিতা? মা একটু প্রসন্ন হবে বলে? বউদিরা একটু করুণা করবে বলে? দাদারা দৈবাৎ একদিন ডেকে কথা কইবে বলে? শুধু তো এইটুকু? আর কী?

ক্রমে সবাই সুমিতা নামের মেয়েটাকে ভুলে যাবে। নিজেদের উত্তাল জীবনের মাঝখানে সুমিতাকে কোনওদিন ডেকে আনবে না। আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাবে সুমিতা।

আর সেই একটা দিক?

 সেখানেই বা সুমিতার কোন পদমর্যাদা?

সেই কঠোর বৃদ্ধ তো অকারণেই সুমিতাকে অশুচি, অপবিত্র, চরিত্রহীনার দলে রেখে দিয়েছেন।

সুমিতা কি সেটা বুঝতে পারে না?

দূরে থেকেও সেটুকু বোঝবার ক্ষমতা আছে সুমিতার।

কারণ, সুমিতা ঝিয়ের বেশভূষায় না থেকে, মানুষের বেশভূষায় থাকে। কারণ সুমিতা আহার-পাত্রে আমিষের আস্বাদ নেয়। অতএব সুমিতা পতিত। তা পতিতই যদি, তো ভাল করেই পতিত হোক।

গৌতম? গৌতমই কি আমায় মা বলে সম্মান করে?

হঠাৎ তপ্ত একঝলক জল চোখে উপচে ওঠে সুমিতার।

মজুমদার আত্মহারা হয়।

 মজুমদার সীমারেখার রেখা পার হয়ে যায়।

বুদ্ধ মন্দিরের চত্বর থেকে বেরিয়ে এসে গৌতম যখন রাস্তায় পা ফেলল, মাথার মধ্যে ওর তখন প্রবল একটা দাহ।

যে দাহটাকে ভাষা দিলে এই দাঁড়ায়—

ও এতদিন একটা মতলব নিয়ে আমার সঙ্গে মিশেছে। ও এতদিন আমাকে ওর একটা ইচ্ছাপূরণের যন্ত্র হিসেবে দেখেছে।

উঃ।

এইজন্যেই জগৎ চিরদিন মেয়েদেরকে সন্দেহের আর অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে থাকে।

বিশেষ কোনও মেয়ের জন্যে হয়তো সম্ভ্রম আছে পৃথিবীর, কিন্তু সমগ্র নারীজাতির জন্যে নয়। আর তার কারণ ওই টুনুর মতো মেয়ে।

টুনুর টাকার অঙ্ক শুনে তখন নিজেকে নিতান্ত অকিঞ্চিকর ভেবে যে দাহটা চিড়বিড়িয়ে উঠেছিল, সেইটাই ক্রমশ দাউ দাউ জ্বলতে শুরু করে নিজেকে প্রতারিত ভেবে।

ও আমাকে ঠকিয়েছে।

ও আমায় বুন্ধু ভেবে মনে মনে কত হেসেছে। এখন বুঝতে পারছি আমাকে ডেকে ডেকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কারণ কী। আর কিছুই নয়, নিজের ঐশ্বর্য দেখানো। শুধু নীচতলায় অতিথির ঘরে বসিয়েই আশা মেটেনি, ওর মরা মায়ের ছবি দেখাবার ছুতো করে আমায় দোতলায় তিনতলায় ডেকে নিয়ে গেছে।

কই, আমার তো কোনওদিন ইচ্ছে হয়নি টুনুকে আমার বাবার ছবি দেখাই? তার মানে, ইচ্ছেটা স্বাভাবিক নয়।

অথচ কী অপূর্ব দেখাচ্ছিল ওকে। এই যে আমার মা–বলে যখন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তখন ওর চোখ দুটো জলে টলটল করে উঠেছিল। হাসি হাসি মুখের সঙ্গে ওই জলটায় কী পবিত্র একটা সৌন্দর্য ফুটে উঠেছিল ওর রোগা রোগা মুখে।

কী মন কেমন করছিল তখন আমার দেখে!

ঠিক তখুনি বাবার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল আমার।

অথচ ও তখন একটা অভিসন্ধি নিয়ে অভিনয় করছিল।

তার মানে, ও একটা পাকা অভিনেত্রী।

নিজের মনে যুক্তি সাজিয়ে সাজিয়ে ক্ষতবিক্ষত হতে থাকে গৌতম।

যখন ও ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ছেড়ে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে যাদবপুরে চলে এসেছিল, তখনই আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল, এটা স্বাভাবিক নয়।

আমি সন্দেহ করলাম না। ও যা বোঝাল আমি তাই বুঝলাম। একটা মেয়ে আমাকে ভালবেসে, বাড়ির লোককে চটিয়ে, এত ঝামেলা পুইয়ে আমার কাছে চলে এসেছে ভেবে আহ্লাদে মরে গেলাম।

অথচ শ্রীমতী টুনু তখন এই ভেবে আহ্লাদে অধীর হচ্ছেন, খেলার ঘুঁটিটা পাকিয়ে আছি।

 হয়তো চিন্তার ভাগটা ঠিক এত স্পষ্ট হচ্ছিল না গৌতমের। তবে ধূমবাষ্পটা এই বাতাসের গতিতেই টলছিল।

আর এতদিন ধরে এত বোকা বনে থাকার বদলে কী শিক্ষা দেওয়া যায় টুনুকে, সেই চিন্তা খেলছিল।

হঠাৎ পিছন থেকে কাঁধে একটা হাত পড়ল।

গৌতম চমকে উঠল।

বেহায়া মেয়েটা আবার এসেছে বুঝি। চড়াৎ করে ঘাড় ফেরাল। ফেরাল, আর সঙ্গে সঙ্গে অপরাধী হেসে উঠল, কী রে, চোখে অমন আগুন কেন? ভস্ম করবি নাকি?

প্রসেনজিৎ।

গৌতমের স্কুলের বন্ধু। যদিও বয়েসে একটু বড়, কিন্তু একই পাড়ায় ছিল। ঢাকুরিয়ারই ছেলে, এখন ওর বাবা দমদমের দিকে বাড়ি করে চলে গেছেন। নিজেও প্রসেনজিৎ খড়গপুরে পড়তে চলে গেছে।

অনেকদিন পরে দেখা হল।

কিন্তু গৌতম তখনও বিচলিত, তাই গৌতমের মুখে উচ্ছ্বাস ফোটে না। গৌতম কিছু একটা বলতে যায়, তার আগেই প্রসেনজিৎ বলে ওঠে, কী ব্যাপার! মনে হচ্ছে যেন ভূত দেখলি। এদিকে তোদের বাড়িতে গিয়ে তাজ্জব। তুই নাকি আজকাল রাত দশটার আগে বাড়ি ফিরিস না, দাদু পিসিকে গ্রাহ্য করিস না। এতখানি উন্নতি কবে থেকে হল রে?

এতক্ষণে গৌতম কথা বলে।

 বাড়ি গিয়েছিলি?

গিয়েছিলাম তো! তোর পিসির হাতের সুজির পায়েস আর রসবড়া খেয়ে, তাঁর সঙ্গে এক ঘণ্টা ধরে গল্প করে, তোর আশায় হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছিলাম।

পিসি বলল আমি রাত দশটার আগে বাড়ি ফিরি না?

বলেছে। কিন্তু ভুল তো বলেনি। হাতে হাতেই তো প্রমাণ পাওয়া গেল। কী ব্যাপার রে, সত্যি?

ব্যাপার আবার কী? গৌতম গম্ভীর গলায় বলে, চিরদিনই মানুষ খোকা থাকে না।

 ধারণা ছিল, তুই চিরদিনই তাই থাকবি!

ধারণাটা অবাস্তব।

বাবাঃ, কী কাটা কাটা বোল ছাড়ছিস।

প্রসেনজিৎ ওর কাঁধে একটা থাবনা মেরে বলে, তোকে দেখে কী মনে হচ্ছে জানিস? হয় ব্যাঙ্ক ফেল হয়ে সর্বহারা হয়ে সংসার ত্যাগ করতে যাচ্ছিস, নয়–এইমাত্র বউকে পুড়িয়ে শ্মশান থেকে ফিরছিস।

হু।

গৌতম ভিতরের দাহ চাপা দিয়ে বলে, তুমিও কিছু কম কথা শেখোনি। তা এখন যাচ্ছিস কোথায়? দমদমে ফিরছিস?

না, আজ ঢাকুরেতেই থাকব। কাকার বাড়ি নেমন্তন্ন। প্রসেনজিৎ একটু হাসে, তখন কাকা বাবাকে তিষ্ঠোতে দেয়নি, আমাদের সঙ্গে কী না ব্যবহার করেছে, এখন খুব আদর।

এখন খুব আদর! দুর্ব্যবহারের পর আদর।

গৌতম কড়া গলায় বলে ওঠে, আর সেই আদর নিচ্ছিস তুই?

তা কী করা যাবে। প্রসেনজিৎ উদার হাস্যে বলে, আপনার লোককে তো ত্যাগ করা যায় না। যতই হোক বাবার ভাই। তা ছাড়া যখন দুর্ব্যবহার করেছে, তখন যদি রাগ করেছি তো, এখন ভাল ব্যবহার করলে হাস্যবদনে নেব না কেন?

গৌতম যেন অকারণ উত্তেজিত হয়। গৌতম ক্রুদ্ধ গলায় বলে, মানুষের মনটা তো অঙ্কশাস্ত্র নয় প্রসেন, তার একটা অনুভূতি আছে।

থাকলেই বা! ইহাই পৃথিবী, বলে একটু দার্শনিকের হাসি হেসে সব উড়িয়ে দেওয়াই শান্তির।

 এই কবছরেই তোর অনেক জ্ঞান জন্মে গেছে দেখছি।

গৌতম কাঁধটাকে নাচায়।

 আর তোর ব্রহ্মজ্ঞান।

প্রসেনজিৎ হা হা করে হেসে ওঠে। তারপর বলে, আচ্ছা কাল আবার আসছি, সকালটা আছি।

গৌতম বন্ধুকে আর একটু ধরে রাখতে আঁকুপাঁকু করে না, শুধু হঠাৎ বলে বসে, তোর বয়েস কত রে প্রসেন?

বয়েস? হঠাৎ এ প্রশ্ন? চাকরি-টাকরি আছে নাকি সন্ধানে?

আছে। গৌতম একটু রহস্যময় হাসি হেসে বলে, ভাল চাকরি! মোটা মাইনে, খাটুনির বালাই নেই, শুধু বস-এর একটু বশংবদ হওয়া।…বল না বয়েস কত?

প্রসেনজিৎ হেসে ফেলে, বলে, সঠিক বয়েসটা হচ্ছে বাইশ, কিন্তু যে রকম লোভনীয় চাকরির আশা দিচ্ছিস, তাতে আঠাবোয় ফিরে যেতেও রাজি আছি, আটাশে উঠতেও আপত্তি নেই। যেটা দরকার বলে দে।

হ্যাঁ! চাকরিই! না, কোনও কিছু হতে হবে না, যা আছিস তাতেই চলবে। কাল আয়, বলব সব।

আরে বাবা ধোঁকায় রাখছিস কেন? বলেই ফেল না। সত্যি চাকরি না আর কিছু!

বললাম তো কাল বলব।

ঠিক আছে। বুঝতেই পারছি, স্রেফ ধাপ্পা।

 আচ্ছা..

আচ্ছা। প্রসেনজিতের চলে যাবার দিকে কেমন একটা প্রতিহিংসা-প্রতিহিংসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে গৌতম।

কিন্তু প্রসেনজিৎ নিশ্চয়ই তার লক্ষ্য নয়। নিরীহ বাল্যবন্ধু।

ওই দৃষ্টিটা সেই অপরাধিনীর উদ্দেশে।…যে আজ গৌতমকে স্বর্গ থেকে আছড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে মর্ত্যধুলোয়।