২. ডুগুডুগু

ডুগুডুগু

রতনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে মানিক দরজায় টোকা দেবার আগেই খুট করে দরজাটা খুলে গেল, দরজার ওপাশে রতন দাঁড়িয়ে আছে। মানিক অবাক হয়ে বলল, “কী হলো? দরজায় টোকা দেবার আগেই দরজা খুলে দিলে?”

“হুঁ দিয়েছি।”

“নিশ্চয়ই টেলিপ্যাথি। তুমি টেলিপ্যাথি করে বুঝে গেছ আমি এসেছি। ঠিক কি না?”

“উঁহু।” রতন মুখ শক্ত করে বলল, “আমি ক্লোজসার্কিট টিভিতে দেখেছি তুমি আসছ।”

মানিকের একটু মন খারাপ হলো, বলল, “ইশ! যদি টেলিপ্যাথি হতে তাহলে কী মজা হতো তাই না? তুমি একটু গবেষণা করে টেলিপ্যাথি যোগাযোগ করতে পার না?”

“মোবাইল টেলিফোন টেলিপ্যাথি থেকে অনেক ভালো কাজ করে। অনেক সস্তাও।”

মানিক হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “নাহ্! তোমার মাঝে কোনো কোমল ব্যাপার নেই। তোমার সবকিছু হচ্ছে কাঠখোট্টা।”

রতন একটু সরে মানিককে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দিয়ে বলল, “এটা মোটেও সত্যি না। আমার সবকিছু যদি কাঠখোট্টা হতো তাহলে আজকে তোমাকে আমি বাসাতে ঢুকতেই দিতাম না।”

মানিক অবাক হয়ে বলল, “সে কী! আমাকে কেন বাসায় ঢুকতে দেবে?”

রতন মুখ শক্ত করে বলল, “এখন কয়টা বাজে?”

মানিক তার ঘড়ি দেখে বলল, “এগারোটা।”

“তোমার সকাল আটটার সময় আসার কথা ছিল, আজকে আমাদের সাভারে সাপের বাজারে যাবার কথা। তুমি এসেছ তিন ঘণ্টা পরে। এগারোটায়।”

মানিক এমনভাবে রতনের দিকে তাকিয়ে রইল যে তাকে দেখে মনে। হলো সে রতনের কথা বুঝতে পারছে না। একটু ইতস্তত করে বলল, “আটটা আর এগারোটার মাঝে পার্থক্য কী? একই তো কথা।”

“একই কথা?” রতন চোখ কপালে তুলে বলল, “একই কথা?”

“হ্যাঁ একই কথা। সময় নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কী আছে? আমরা সময়কে ব্যবহার করব, নাকি সময় আমাদের ব্যবহার করবে?”

“মানে?”

“কে বলেছে আমাদের ঘড়ি ধরে চলতে হবে? আমি আমার জীবনকে ঘড়ি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না। কক্ষনো না। আমার যখন ইচ্ছে ঘুমাব যখন ইচ্ছা ঘুম থেকে উঠব।”

রতন বলল, “ঠিক আছে। তাহলে তুমি কেন কালকে বললে আজ সকাল আটটায় আসবে? আমি আটটা থেকে অপেক্ষা করছি। তোমাকে ফোন করেছি তুমি ফোন ধরো না”

মানিক মুখ গম্ভীর করে বলল, “শুধু ঘড়ি না আমি মোবাইল ফোনকেও আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না। কক্ষনো না।”

“খুব ভালো কথা। তাহলে তুমি কেন আমাকে তোমার মোবাইল টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললে, সকালে ফোন করো। ঘুম থেকে তুলে দিও। আমি ফোন করেছি–”

“ও!” মানিকের চোখ মুখ হঠাৎ ঝলমল করে উঠে, “এখন বুঝতে পেরেছি! কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম সাদা রাজহাঁস পানিতে ভাসছে। ঠিক তখন টেলিফোন দিল ঘুমটা ভাঙিয়ে তার মানে সেটা ছিল তোমার টেলিফোন! তুমি ফোন করে আমার ঘুম ভাঙিয়েছ?”

“আমি মোটেই তোমার ঘুম ভাঙাতে পারি নাই। তাহলে তুমি এগারোটার সময় আসতে না।”

“ঘুমটা ভেঙেছিল কিন্তু আমি টেলিফোনটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে গেলাম। স্বপ্নে রাজহাঁসগুলো আর পেলাম না, এবারে শুধু পাতিহাঁস।”

রতন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার টেলিফোন বন্ধ করার কথা না। তোমার উঠে বসার কথা, ঘুম থেকে জেগে ওঠার কথা। সত্যি কথা বলতে কী, এলার্ম দিয়ে তোমার নিজেরই ঘুম থেকে ওঠার কথা।”

মানিক মুখ শক্ত করে বলল, “আমি এলার্ম ক্লককে আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না। কক্ষনো না।”

“তুমি কখনো এলার্ম ক্লক দিয়ে ঘুম থেকে ওঠার চেষ্টা করেছ?”

“অবশ্যই করেছি। আমি প্রত্যেক রাতে ঘুমানোর সময় আমার এলার্ম ক্লকটা সেট করি। সকাল সাতটার জন্যে।”

“তারপর?”

“সকাল সাতটায় এলার্ম বাজে আমি তখন ঘুমের মাঝে এলার্মটা বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে যাই। পৃথিবীর কোনো এলার্ম ক্লক আমাকে কখনো ঘুম থেকে তুলতে পারেনি।”

রতন সরু চোখে মানিকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি এমন কোনো এলার্ম ক্লক চাও যেটা তোমাকে ঘুম থেকে তুলে দিতে পারবে?”

“না চাই না।”

রতন মাথা নেড়ে বলল, “আমি সেটাই ভেবেছিলাম।”

“কী ভেবেছিলে?”

“তুমি এলার্ম ক্লকটা ব্যবহার করো যেন সেটা তোমার ঘুমটা একটু ভাঙানোর চেষ্টা করে আর তখন সেটাকে বন্ধ করে তুমি আরো জোরেসোরে পাগলের মতো ঘুমাও।”

মানিকের মুখটা আনন্দে ঝলমল করে উঠল, মাথা নেড়ে বলল, “তুমি একেবারে ঠিক ধরেছ! আমি যখন একটা যন্ত্রকে অপমান করি তখন আমার এক ধরনের আনন্দ হয়!”

“অপমান?”

“হ্যাঁ।”

“যন্ত্রকে অপমান করা যায় সেটা আমি এই প্রথম তোমার কাছে শুনলাম।”

মানিক গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, বলল, “করা যায়। তুমি যদি চাও আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব।”

রতন বলল, “আমি শিখতে চাই না।”

“না চাইলেও শিখিয়ে দিতে পারি।” মানিক উদারভাবে হেসে বলল, “যন্ত্রকে অপমান করতে হয় তাকে গুরুত্ব না দিয়ে। যে যন্ত্রের যে কাজ সেটা না করিয়ে সেটা দিয়ে অন্য অসম্মানজনক কাজ করিয়ে।”

“অসম্মানজনক কাজ?”

“হ্যাঁ। যেমন মোবাইল টেলিফোন আমি ব্যবহার করি দেওয়ালে পেরেক ঠোকার জন্যে।”

রতন চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল, কিছু-একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, শেষ পর্যন্ত বলল না। মানিক পকেট থেকে তার টেলিফোনটা বের করে দেখিয়ে বলল, “এই দেখ একটু ফেটেফুটে গেছে। অপমানের চূড়ান্ত।”

“আর কী কর?”

“যেমন মনে করো টেলিভিশন। সেটা আমার বিছানার পিছনে কাত করে রেখেছি।”

“কাত করে রেখেছ?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“আমি যখন কাত হয়ে শুয়ে থাকি তখন যেন দেখতে পারি।”

“যখন সোজা হয়ে বসে থাক কিংবা দাঁড়িয়ে থাক?”

“তখন টেলিভিশনের উপর আমি আমার জুতো মোজা রাখি। চূড়ান্ত অপমান।”

রতন মাথা নাড়ল, বলল, “টেলিভিশনের বোঝার ক্ষমতা থাকলে তার কাছে এটা চূড়ান্ত অপমান মনে হতে পারত। তুমি ঠিকই বলেছ।”

মানিক উৎসাহ পেয়ে বলল, “তারপর মনে করো ফ্রিজ। ফ্রিজকে আমি ব্যবহার করি ঘর ঠান্ডা করার জন্যে। যখন গরম পড়ে তখন আমি ফ্রিজের দরজা খোলা রাখি।”

রতন মাথা নেড়ে বলল, “এভাবে কখনো ঘর ঠান্ডা হয় না।”

“না হলে নাই, কিন্তু ফ্রিজের অপমান তো হয়। ফ্রিজের মাঝে আমি ময়লা কাপড় রাখি সেইটাও অপমান।”

রতন মাথা নাড়ল। মানিক বলল, “তারপর মনে করো ইলেকট্রিক ইস্ত্রি। আমি সেটা দিয়ে রুটি টোস্ট করি।”

“রুটি টোস্ট কর?”

“হ্যাঁ। একটা পাউরুটির স্লাইস প্লেটে রেখে তারপর উপর গরম ইস্ত্রি চেপে ধরি। রুটিটা তখন টোস্ট হয়। ইস্ত্রিটাকে তখন আমি অপমানসুচক কথা বলি।”

“তুমি ইস্ত্রির সাথে কথা বল?”

“হ্যাঁ। অপমানসুচক কথা।”

“কী রকম কথা?”

মানিক মুখ সুচালো করে বলল, “যেমন আমি বলি, ধিক ইস্ত্রি ধিক। ধিক তোমার এই অর্থহীন জীবন। তুমি ধ্বংস হও, তোমার কানেকশান ছুটে তুমি জঞ্জালে পরিণত হও আমি তোমাকে সেই অভিশাপ দিই”

রতন বলল, “কানেকশান ছুটে তোমার ইস্ত্রি জঞ্জালে পরিণত হলে তোমার আরেকটা ইস্ত্রি কিনে আনতে হবে, তোমার টাকা পয়সা নষ্ট হবে, তারপরেও তুমি এই অভিশাপ দাও?”

“হ্যাঁ। দিই।” মানিক হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি কোনো যন্ত্রকে আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে দেব না।”

“তুমি আর কোন কোন যন্ত্রকে অপমান কর?”

“সব যন্ত্রকে। যখন আলোর দরকার হয় তখন আমি একটা একটা লাইট নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে মোমবাতি জ্বালাই। মোমবাতির আলোতে কাজ করি আর ইলেকট্রিক লাইটগুলোকে হালকা গালাগাল করি।”

“তাতে লাইটগুলোর অপমান হয়?”

“না। পুরোপুরি অপমান হয় না। তাই যখন দিনের বেলা অনেক আলো থাকে তখন সব লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে তাদেরকে অপমানসূচক কথা বলি।”

“কী রকম অপমানসূচক কথা বল?”

যেমন আমি বলি, “এই যে ইলেকট্রিক লাইট, তুমি কি দেখছ এখন চারিদিকে কী চমৎকার সূর্যের আলো? এই চমৎকার সূর্যের আলোতে তোমার কি নিজেকে অত্যন্ত অকিঞ্চিকর মনে হচ্ছে না? তোমার আলো কতো ক্ষুদ্র কতো তুচ্ছ কতো নগণ্য দেখেছ? এইরকম কথা।”

রতন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার বাসায় কম্পিউটার আছে?”

মানিক মাথা নাড়ল, বলল, “না নাই। আমি কম্পিউটারকে ঘৃণা করি।”

রতন চোখ কপালে তুলে বলল, “ঘৃণা? তুমি বলছ ঘৃণা?”

“হ্যাঁ। যন্ত্রদের মাঝে সবচেয়ে বড়ো ক্রিমিনাল হচ্ছে কম্পিউটার।”

“ক্রিমিনাল?”

“হা। এটা যন্ত্র হয়েও এমন ভান করে যে এটা যন্ত্র না। এটা কীসের যন্ত্র সেটা নিয়েও সবাইকে ফাঁকি দেয়। কেউ বলে গান শোনার যন্ত্র, কেউ বলে সিনেমা দেখার কেউ বলে হিসাব করার, কেউ বলে চিঠি লেখার। এরকম কেন হবে? আগে ঠিক করে নিক এটা কীসের যন্ত্র তারপর আমি এটা স্পর্শ করব। তাছাড়া_”

“তাছাড়া কী?”

“তাছাড়া আমি নেতিবাচক নামের জিনিস পছন্দ করি না।”

“নেতিবাচক?”

“হ্যাঁ। নাম হচ্ছে কম্পিউটার। কম কেন? কোন জিনিসটা কম? যখন তৈরি হবে বেশি-পিউটার তখন দেখা যাবে।”

রতন বলল, “মানিক, তুমি মনে হয় একটা জিনিস বুঝতে পারছ না। এর নামটা এসেছে

মানিক রতনকে কথা শেষ করতে দিল না, বলল, “তোমাকে যদি বলা হয় কমবুদ্ধির একটা মেয়েকে বিয়ে করতে হবে, তুমি কি রাজি হবে? হবে না। তুমি চাইবে বেশি বুদ্ধির একটা মেয়ে। ঠিক সেইরকম কেন আমি কমপিউটারে রাজি হব? আমার দরকার বেশি-পিউটার।”

রতন হাল ছেড়ে দিল, মানিক ছাড়ল না, সে কথা বলে যেতেই লাগল। শেষপর্যন্ত যখন ক্লান্ত হয়ে একটু থামল তখন রতন জিজ্ঞেস করল, “এই যে তুমি যন্ত্রপাতিকে ঘৃণা কর, তাদের অপমান কর এর জন্যে তোমার কখনো কোনো সমস্যা হয় নাই?”

“হলে হয়েছে, কিন্তু সে জন্যে আমি আমার নীতিকে বিসর্জন দেইনি।”

“কী সমস্যা হয়েছে?”

“এই তো” বলে মানিক হাত নেড়ে বিষয়টা শেষ করে দেবার চেষ্টা করল।

রতন অবশ্যি সেটা মেনে নিল না, বলল, “তুমি শুধু তোমার দিকটা বলে যাকে মন্ত্রকে তুমি কীভাবে অপমান করেছ তা হবে না। যন্ত্রকে অপমান করার জন্যে যন্ত্র তোমাকে কী শাস্তি দিয়েছে সেটাও বলতে হবে।”

“সেটা এমন কিছু না।”

“তবুও শুনি।”

মানিক ইতস্তত করে বলল, “যেমন ধর থার্মোমিটারের ব্যাপারটা। মানুষের শরীরে হাত দিলেই বোঝা যায় জ্বর আছে কি নেই–খামোখা থার্মোমিটার নামে একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে। তাই থার্মোমিটারকে অপমান করার জন্যে আমি সেটাকে মানিক কথা থামিয়ে থেমে গেল।

“কী হলো, থামলে কেন বল। কী করতে থার্মোমিটার দিয়ে?” মানিক ইতস্তত করে বলল, “কান চুলকাতাম।”

রতন চমকে উঠে বলল, “সর্বনাশ! কানের ভিতর থার্মোমিটার ভেঙে গেলে কেলেংকারি হয়ে যাবে। থার্মোমিটারে থাকে পারদ, ভেঙে কানের ভিতর ঢুকে গেলে”

মানিক ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ। ডাক্তার খুব রাগ করেছিল”

“তার মানে সত্যি সত্যি তোমার কানের ভিতর থার্মোমিটার ভেঙে গিয়েছিল? কী সর্বনাশ!”

মানিক আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আগের দিনে ডাক্তাররা খুবই হৃদয়বান মানুষ ছিল। আজকালকার ডাক্তারেরা হৃদয়হীন এবং আবেগ বিবর্জিত।”

রতন মাথা নেড়ে বলল, “ডাক্তার কি তোমাকে কিল ঘুষি দিয়েছিল?”

“না। কিন্তু যে ভাষায় আমার সাথে কথা বলেছে সেটা কোনো সভ্য মানুষের উপযোগী ভাষা না। অমার্জিত বর্বর মানুষের ভাষা–”

“তোমার কপাল ভালো আমি ডাক্তার না, আর কানের ভিতর থার্মোমিটার ভেঙে তুমি আমার কাছে আস নাই। আমি হলে নির্ঘাত তোমাকে দুই এক ঘা লাগাতাম।”

মানিক খুব অল্প সময়ের মাঝে তার তিন নম্বর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোমরা বিজ্ঞানের মানুষেরা হৃদয়হীন। কাঠখোট্টা বিজ্ঞান তোমাদের সমস্ত আবেগ সমস্ত কোমল অনুভূতি শুষে নিয়েছে। আমি একজন কবি মানুষ, সুন্দরের পূজারী, আমার সাথে এই ভাষায় কথা বলা যায় না। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর”

“তোমাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। যখন একজন মানুষ কানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে শুয়ে থাকে তখন যদি দূরদূরান্ত থেকে মেডিকেল স্টুডেন্টরা তাকে দেখতে আসে এবং তখন যদি তাকে কানের ভেতর থার্মোমিটার ভাঙা পাগল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়, সেটা খুবই হৃদয়বিদারক। আমি সেই সব মুহূর্তের কথা মনে করতে চাই না। কমবয়সি সুন্দরী মেডিকেল স্টুডেন্টদের খিলখিল হাসির কথা আমি স্মরণ করতে চাই না।”

রতন খুব ভালো করে জানে কেউ কোনো কিছু স্মরণ করতে না চাইলেই যে সেটা তার স্মরণ হবে না এটা সত্যি নয় তাই মানিকের সবকিছু স্মরণ হতে লাগল। তার মুখচোখে একটা গভীর দুঃখের ছায়া পড়ল। রতনের মানিকের জন্যে একটু মায়া হলো, তাই বলল, “খামোখা ওই সব কথা মনে করে লাভ নেই–”

মানিক বলল, “তুমি চিন্তা করতে পারবে না। কী নিষ্পাপ চেহারার মেয়ে কিন্তু কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর!”

রতন বলল, “ছেড়ে দাও।”

“একজন আরেকজনকে ধরে কী খিলখিল হাসি।”

“ছেড়ে দাও।”

“শুধু মেডিকেল স্টুডেন্ট না, আস্তে আস্তে নার্স ওয়ার্ডবয় সবাই আসতে লাগল।”

“ছেড়ে দাও।”

“তারপর রোগীরা আসতে শুরু করল।”

“ছেড়ে দাও।”

“তারপর রোগীদের আত্মীয় স্বজন”

“ছেড়ে দাও।”

মানিকের গলাটা ধরে এল। ভাঙা গলায় বলল, “তারপর আত্মীয় স্বজনের আত্মীয় স্বজন–”

রতন বুঝতে পারল বিষয়টা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। তাই সে মানিককে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “চল, আমাদের এখন সাপের বাজারে যাওয়ার কথা।”

মানিক বলল, “চল। বিষাক্ত সাপ দেখে আমাকে বিষাক্ত স্মৃতির কথা ভুলতে হবে।”

.

এক সপ্তাহ পর রতন মানিককে একটা ছোটো বাক্স দিয়ে বলল, “এটা তোমার জন্যে উপহার।”

বাক্সটা খুব সুন্দর, রঙিন কাগজে মোড়ানো। দেখে মানিকের চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল, বলল, “আমার জন্যে উপহার?”

“হ্যাঁ।”

“আমার উপহার পেতে খুব ভালো লাগে।”

“সবারই ভালো লাগে, কিন্তু আমি জানি না, এই উপহারটা তোমার ভালো লাগবে কি না।”

“কেন?”

রতন বলল, “তার কারণ এটা একটা যন্ত্র। তুমি তো বলেছ তুমি যন্ত্র পছন্দ করো না।”

মানিকের মুখটা একটু বিমর্ষ হয়ে গেল, বলল, “যন্ত্র? কী যন্ত্র?”

“খুবই সোজা যন্ত্র। একটা এলার্ম ক্লক। তুমি বলেছিলে তোমার সকালে উঠতে সমস্যা হয় সেই জন্যে তৈরি করে দিলাম।”

“এলার্ম ক্লক? এলার্ম ক্লক তোমার তৈরি করতে হলো? আমি মাসে চার-পাঁচটা এলার্ম ক্লক কিনি! কিনি আর ভাঙি।”

“সেইজন্যেই তো তৈরি করে দিলাম। এটা ভাঙবে না। আর এই এলার্ম ক্লকটার মনে করো গণ্ডারের চামড়া, তুমি যতই অপমান করো, গালাগাল করো সে সবকিছু সহ্য করবে। তোমার যেভাবে খুশি তুমি এটাকে অপমান করতে পারবে।”

মানিকের মুখের বিমর্ষ ভাবটা এবারে একটু কমল, বলল, “অপমান করতে পারব?”

“পারবে।”

“দূরে ছুঁড়ে মারতে পারব?”

“অবশ্যই।”

“চমৎকার।” বলে মানিক রঙিন কাগজের মোড়কটাকে খুলে ভেতর থেকে একটা এলার্ম ক্লক বের করল, একেবারেই সাধারণ এলার্ম ক্লক, সে প্রায় নিয়মিত এরকম এলার্ম ক্লক বাজার থেকে কিনে আনে। তবে বাজার। থেকে যেটা কিনে আনে সেগুলোর থেকে এটা একটু ভারি।

মানিক বলল, “তুমি এত বড়ো বৈজ্ঞানিক, কত কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে পার, ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি চালাতে পার। আর তুমি কি না তৈরি করলে একটা এলার্ম ক্লক!”

রতন হাসল, বলল, “তোমার জন্যে আলাদা করে তৈরি করেছি!”

“যখন বাজতে শুরু করবে তখন টিপি দিলেই বন্ধ হয়ে যাবে তো?”

“হ্যাঁ। টিপি দিলেই বন্ধ হয়ে যাবে। আমি সকাল সাতটার জন্যে সেট করে দিয়েছি। তুমি ইচ্ছে করলে এটা অন্য সময়ের জন্যে সেট করতে পার।”

মানিক বলল, “সাতটাই ভালো। এলার্ম ক্লক ঘুমটাকে একটু হালকা করে দেয়। আবার নতুন করে ঘুমাই–তখন খুবই ভালো লাগে। দশটা এগারোটার দিকে যখন উঠি তখন শরীরটা একেবারে ঝরঝরে লাগে।”

রতন বলল, “ভেরি গুড।”

.

সেদিন রাত্রে ঘুমানোর সময় রতন মানিককে ফোন করল, বলল, “মানিক, ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?”

“শুয়েছি। এখনো ঘুমাইনি।”

“কাত হয়ে শুয়ে কাত হয়ে থাকা টেলিভিশন দেখছ?”

“ঠিকই অনুমান করেছ।”

“আমি তোমাকে ফোন করলাম, মনে করিয়ে দেবার জন্যে। এলার্ম ক্লকটা সেট করেছ তো?”

মানিক বলল, “তোমার চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমি এলার্মটা সেট করে আমার মাথার কাছে রেখেছি।”

“গুড। আর শোনো আমি আজ রাতে একটু শ্রীমঙ্গলের দিকে যাচ্ছি। সপ্তাহখানেকের জন্যে। এক সপ্তাহ পরে দেখা হবে।”

“ঠিক আছে। আমি ফোন করে তোমার খোঁজ নেব।”

রতন বলল, “আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে দুই দিকে টিলা, টেলিফোনের নেটওয়ার্ক নাই। ফোন করে মনে হয় আমাকে পাবে না।”

“কোনো সমস্যা নেই।”

মানিক ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করেনি যে আসলে অনেক বড়ো সমস্যা তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

.

ঠিক ভোর সাতটার সময় রতনের দেওয়া এলার্ম ক্লকটা বেজে উঠল। প্রথমে এলার্ম ক্লকের শব্দটা হলো মিষ্টি একটা বাজনার মতো, মানিক সেই শব্দটা প্রায় উপভোগ করতে শুরু করছিল ঠিক তখন সেটা কর্কশ শব্দ করতে শুরু করল। মানিক ঘুম ঘুম চোখে হাত বাড়িয়ে এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করতেই একটা খুব বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। এলার্ম ক্লকটা ছোটো একটা লাফ দিয়ে সরে গেল। শুধু যে সরে গেল তা না, সরে গিয়ে আরো কর্কশ শব্দে বাজতে লাগল। সারাজীবন মানিকের জীবনে যেটা ঘটেনি আজকে সেটা ঘটে গেল, তার এত সাধের ঘুমটা একটা চোট খেয়ে গেল। সে চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করল সত্যিই এলার্ম ক্লকটা লাফ দিয়ে সরে। গেছে নাকি তার চোখের ভুল।

মানিক দেখল এলার্ম ক্লকটা সত্যিই একটু দূরে বসে বিকট স্বরে চিৎকার করছে। সে হাত বাড়িয়ে আবার সেটা ধরার চেষ্টা করল আর কী আশ্চর্য সেটা সত্যি সত্যি ব্যাঙের মতো একটা লাফ দিয়ে মাথার কাছে রাখা টেবিলটার অন্য পাশে সরে গেল। শুধু তাই না, মনে হলো এলার্ম। ক্লকটা আরো জোরে শব্দ করতে শুরু করেছে।

মানিকের ঘুমটা এখন পুরোপুরি ভেঙে গেল। সে তার বিছানায় উঠে বসে এক ধরনের বিস্ময় আর আতঙ্ক নিয়ে এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে আবার এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করল আর কী আশ্চর্য এবারে সেটা লাফ দিয়ে মেঝেতে নেমে এল। নিজের চোখে দেখেও মানিকের বিশ্বাস হতে চায় না। তার ভেতরে কেমন যেন একটা জেদ চেপে যায়, সে আবার সেটাকে ধরার চেষ্টা করল আর এলার্ম ক্লকটা আবার লাফ দিয়ে সরে গেল। এবারে সে দুই হাতে সেটাকে জাপটে ধরার চেষ্টা করল, প্রায় ধরেই ফেলেছিল আর একেবারে শেষ মুহূর্তে সেটা পিছলে গিয়ে হাত ফসকে বের হয়ে গেল। এলার্ম ক্লকটার শব্দটা এবারে। কেমন যেন একটা হাসির মতো শোনাতে থাকে।

মানিক এবারে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল, সাথে সথে এলার্ম ক্লকটা হঠাৎ থেমে গেল। বিকট একটা কর্কশ আওয়াজ থেমে যাবার পর পুরো ঘরটা মানিকের কাছে কেমন যেন বেশি নীরব মনে হতে থাকে। বুকের ভেতর থেকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস বের করে দিয়ে মানিক আবার তার বিছানায় বসে পড়ে আর সাথে সাথে এলার্ম ক্লকটা আগের চেয়ে জোরে চিৎকার করতে শুরু করে। মানিক ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো লাফ দিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায় আর সাথে সাথে বিকট আওয়াজটা থেমে যায়। মানিক বুঝতে পারল এই এলার্ম ক্লকটা তাকে বিছানা থেকে নামিয়ে ছাড়বে। বিছানায় বসলেই এটা চিষ্কার করবে।

এতক্ষণে মানিকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। তার এত সাধের সকালের ঘুমের পুরোপুরি বারোটা বেজে গেছে। মানিক আরেকবার সাহস করে এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করল, সাথে সাথে এলার্ম ক্লকটা লাফ দিয়ে সরে গিয়ে আবার বিকট একটা শব্দ করে মানিককে জানিয়ে দিল যে তাকে ঘাটাঘাটি করলে সে আবার শব্দ করতে শুরু করবে।

মানিক কী করবে বুঝতে না পেরে এক পা পিছনে গেল, এলার্ম ক্লকটা কোনো কিছু করল না। সে ডান দিকে দুই পা এগিয়ে গেল তখন এলার্ম ক্লকটাও নিজে থেকে ডান দিকে ঘুরে গেল। মানিক বাম দিকে একটু সরে এল। আর কী আশ্চর্য! এলার্ম ক্লকটাও বাম দিকে ঘুরে গেল। মানিকের পরিষ্কার একটা অনুভূতি হলো যে এলার্ম ক্লকটা তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। মানিক সাবধানে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করল সাথে সাথে এলার্ম ক্লকটা বিকট স্বরে চিৎকার শুরু করে। মানিক তখন তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল, এলার্ম ক্লকটাও সাথে সাথে থেমে গেল। মানিক বুঝতে পারল এই এলার্ম ক্লকটা তাকে বিছানায় শুতে দিতে চায় না–সে যেন অন্য কোনো ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে না পারে সেজন্যে চোখের আড়ালও করতে চায় না।

মানিক কবি মানুষ। সে সহজে রেগে ওঠে না, রেগে উঠলেও সে কখনোই মাথা গরম করে না, একটু আধটু মাথা গরম করলেও সে কখনো। গলা উঁচু করে কথা বলে না। কিন্তু আজকে সব নিয়ম ভেঙে সে হাত পা নেড়ে চিৎকার করে এলার্ম ক্লকটাকে বলল, “বেটা বদমাইস! বেজন্মা। কোথাকার, তোর এত বড়ো সাহস–”

আর যায় কোথায়! এলার্ম ক্লকটা তার জায়গায় একটা ছোটো লাফ দিয়ে বিকট স্বরে চিৎকার করতে থাকে, সেই চিৎকার এত ভয়ংকর যে। মানিকের প্রায় হার্টফেল করার অবস্থা। সে প্রায় না বুঝেই দুই হাত জোড় করে মাপ চাওয়ার ভঙ্গি করে নরম গলায় বলতে থাকে, “প্লিজ! প্লিজ। প্লিজ! রাগ করো না–আর কখনো বলব না মাপ করে দাও।”

এলার্ম ক্লকের শব্দটা তখন আস্তে আস্তে কমতে থাকে। তারপর। একসময় থেমে যায়। মানিকের তখন বুঝতে বাকি থাকে না, এলার্ম ক্লকটা শুধু যে তাকে চোখেচোখে রাখতে চায় তা না, সেটার সাথে গলা উঁচু করে কথাও বলা যাবে না! মানিক এক ধরনের হিংস্র দৃষ্টিতে এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকিয়ে থাকে তার এখনো বিশ্বাস হয় না একটা এলার্ম ক্লক তাকে এরকম বিপদে ফেলতে পারে। সে তখন সাবধানে এগিয়ে টেবিলের একপাশে রাখা তার মোবাইল টেলিফোনটা হাতে নিয়ে রতনকে ফোন করল। অন্য পাশে রতন নেই কিন্তু মানিক রতনের গলা শুনতে পেল, “মানিক, এটা আমি না, এটা আমার রেকর্ডিং—“

মানিক দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “আমি তোমার রেকর্ডিংয়ের বংশ নিপাত করি–”

“তুমি আমাকে কিছু বলছ কি না আমি জানি না–” রেকর্ডিং বলে চলল, “খামোখা চেষ্টা করো না, আমি শুনতে পাব না। যেহেতু তুমি ফোন। করছ আমি ধরে নিচ্ছি আমার এলার্ম ক্লকটা ঠিক ঠিক সময়ে তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে পেরেছে। হা হা হা–যাই হোক এলার্ম ক্লকটা ধরতে পারলে এটাকে তুমি বন্ধ করে দিতে পারবে কিন্তু তোমাকে বলা হয়নি এটাকে ধরা খুব সোজা না। আমি আমার রিয়েল টইম ডাইনামিক এলগরিদম এটার মাঝে ঢুকিয়ে দিয়েছি। তোমার বাসায় এই এলগরিদমের ফিল্ড টেস্ট হচ্ছে। ফিরে এসে আমি তোমার কাছ থেকে রিপোর্ট নেব।”

মানিক দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলল, “তোমার ফিল্ড টেস্টের চৌদ্দগুষ্টির নিপাত করি।”

রতনের গলার রেকর্ডিং বলতে লাগল, “আরো একটা কথা মানিক, তোমাকে বলা হয়নি। যন্ত্রপাতিকে তুমি অপমান করতে পছন্দ কর, কাজেই এটাকে তুমি যতো ইচ্ছা অপমান করতে পার, শুধু খেয়াল রাখবে গলার স্বর যেন উঁচু না হয়। তার কারণ এটার মাঝে সংবেদনশীল কণ্ঠস্বর পরিমাপের সফটওয়ারটাও আছে। হা হা হা।”

রতনের কথা পুরোপুরি শেষ হবার আগেই মানিক তার মোবাইল টেলিফোনটা মেঝেতে ছুঁড়ে মারল, শক্ত মোবাইল সেট, এটা দিয়ে সে দেওয়ালে পেরেক ঠুকে ঢুকিয়ে দেয় সেটার কিছু হলো বলে মনে হলো না। শুধু এলার্ম ক্লকটা নিজের জায়গায় একটা লাফ দিয়ে ঘুরে মানিকের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।

ঘণ্টাখানেক পর মনে হলো এলার্ম ক্লকটা একটু শান্ত হয়েছে, মানিক তখন খুব সাবধানে শোবার ঘর থেকে বের হয়ে বাইরের ঘরে এসে তার সোফায় বসে পড়ল। অবাক ব্যাপার হলো এলার্ম ক্লকটা ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে তার পিছু পিছু শোবার ঘরে চলে এল। দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সেটা তাকে চোখে চোখে রাখছে। মানিক সোফায় বসে দুই হাতে তার মাথা চেপে ধরে পুরো ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করল, লাভ হলো না, প্রত্যেকবারই তার মাথা আগের থেকে গরম হয়ে উঠতে লাগল। একটা তুচ্ছ এলার্ম ক্লক তাকে এভাবে অপদস্ত করবে সেটা মানিক কোনদিন কি চিন্তা করেছিল? সে খানিকক্ষণ সোফায় বসে লম্বা লম্বা কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল–তার প্রিয় একটা কবিতার লাইন আবৃত্তি করে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল, তাতেও খুব একটা লাভ হলো না, বরং তার মাথায় অন্য একটা কবিতার লাইন ঝিলিক করে উঠে, “এক ডান্ডায় ঠান্ডা করে দাও পৃথিবীর যত এলার্ম ক্লক…”

ঠিক এরকম সময় খুট করে বাইরের দরজা খুলে ময়নার মা ঘরে ঢুকল। ময়নার মা মানিকের ঘরদোর পরিষ্কার করে রান্নাবান্না করে দেয়, সে যখন আসে তখন ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিতে মানিকের আলসেমি লাগে তাই সে তার দরজার একটা চাবি ময়নার মাকে দিয়ে রেখেছে। ময়নার মা এভাবে বাসার চাবি নিতে আপত্তি করছিল, মানিক শোনেনি। জোর করে দিয়ে দিয়েছে। ময়নার মা দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে সোফায় মানিককে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল, বলল, “বাই! আপনি আজকে এত সকালে জাগুইন্যা?”

মানিক বলল, “বাই বলে কোনো শব্দ নেই। শব্দ হচ্ছে ভাই। আর জাগুইন্যা বলে তুমি যদি জেগে ওঠা বুঝিয়ে থাক তাহলে হ্যাঁ আমি জাগুইন্যা।”

“কেন বাই? কোনো সমিস্যা?”

“সমিস্যা বলেও কোনো শব্দ নেই। শব্দটা সমস্যা। হ্যাঁ অনেক বড়ো সমস্যা। কিন্তু তুমি সেটা নিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না।”

“জে আচ্ছা।”

মানিক লক্ষ করল ময়নার মায়ের পিছন থেকে একটা ছোটো মাথা উঁকি দিল, এলোমেলো চুল বড়ো বড়ো চোখ। চোখে খানিকটা কৌতূহল এবং অনেকখানি ভয়। ময়নার মা বলল, “আমার মেয়ে ময়না।”

“আশ্চর্য! তোমার সত্যি সত্যি ময়না নামে মেয়ে আছে? আমি ভেবেছিলাম তোমার নামই হচ্ছে ময়নার মা।” মানিক তখন ছোটো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ময়না। আমার বাসায় তোমাকে স্বাগতম। আমি খুবই দুঃখিত আমার বাসায় তোমাকে আনন্দ দেবার মতো কিছু নেই।”

মানিকের কথা শুনে ময়না ভয় পেয়ে আবার তার মায়ের পিছনে লুকিয়ে গেল। ময়নার মা তখন ময়নাকে ধরে ঘরের ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল, “ময়না নামটা রাখা ঠিক হয় নাই। নাম রাখা উচিত ছিল কাউয়া।”

“শব্দটা কাউয়া না। শব্দটা কাক। তোমার এরকম ফুটফুটে মেয়ের নাম কাক রাখবে কেন? এরকম কথা মুখে আনাই রীতিমতো অপরাধ।”

ময়নার মা কোমরে গুঁজে রাখা একটা দড়ি বের করে ময়নার পায়ে বাঁধতে বাঁধতে বলল, “জন্মের দুষ্ট। জেবনটা তাবা করে দিল।”

মানিক ময়নার পায়ে দড়ি বাঁধতে দেখে অবাক হয়ে গেল, “জেবন” আর “তাবা” নামে দুটি বিচিত্র শব্দ পর্যন্ত হজম করে বলল, “তুমি ওর। পায়ে দড়ি দিয়ে বাঁধছ কেন?”

“সব সময় বেন্ধে রাখি। আপনি ঘুমায়ে থাকেন সেই জন্যে আপনি জানেন না। দড়ি দিয়ে টেবিলের সাথে বেন্ধে রাখি সে টেবিলের নীচে বসে বসে খেলে। আমারে ডিস্টার্ব দেয় না।”

“ডিস্টার্ব একটা ইংরেজি শব্দ। বাংলা বাক্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা ঠিক না। কিন্তু সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। আমি তোমাকে পরিষ্কার করে বলতে চাই, ময়নার মা, তুমি কিছুতেই একজন শিশুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না। কিছুতেই না।”

ময়নার মা একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, “বাই। যেদিন ময়নারে নিয়া আসতি হয় আমি দড়ি দিয়ে বেন্ধে রাখি। তা না হলে বাসার মদ্যি ঘুরি বেড়াবি। জিনিসপত্রে হাত দিবি।”

মানিক বলল, “আমার বাসায় বই ছাড়া কোনো জিনিসপত্র নেই। একটা ফুটফুটে মেয়ে যদি আমার বইয়ে হাত দেয় আমি খুবই খুশি হব। সেই বই যদি সে খুলে পড়ে আরো বেশি খুশি হব।” মানিক মেঘস্বরে বলে, “তুমি ময়নার পায়ের দড়ি খুলে দাও। সে বাসার মাঝে ছুটোছুটি করুক।”

“কিন্তু—“

“কোনো কিন্তু নেই।”

কাজেই ময়নার মাকে ময়নার পায়ের দড়ি খুলে দিতে হলো। ময়নার মুখে খুব সূক্ষ্ম একটা আনন্দের হাসি উঁকি দিয়ে গেল।

মানিক বলল, “ময়না, তুমি এই বাসায় যত ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পার। যেটা ইচ্ছে ধরতে পার, শুধু “ মানিক মেঝেতে নিরীহভাবে বসে থাকা এলার্ম ক্লকটা দেখিয়ে বলল, “এই ঘড়িটা থেকে সাবধান।”

ময়নার মা বলল, “ঘড়ি ফোলোরের উপর রাখছেন কেন?”

“তুমি নিশ্চয়ই ফ্লোর বলার চেষ্টা করছ। মেঝে বলে একটা চমৎকার বাংলা শব্দ থাকার পরও তুমি কেন ভুল উচ্চারণে ফ্লোর বলার চেষ্টা করছ আমি জানি না। যাই হোক ময়নার মা, আমি এই ঘড়িটা মেঝেতে রাখিনি। কেমন করে এটা মেঝেতে এসেছে আমি সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই না। তুমি যদি এটাকে ধরে এই বাসা থেকে দূর করতে পার তোমাকে আমি বিশেষ বোনাস দেব।”

“ঘড়িটা ফালায়া দিমু?”

“হ্যাঁ।”

ময়নার মা এগিয়ে এসে এলার্ম ক্লকটা ধরার চেষ্টা করল আর সাথে সাথে সেটা ছোটো একটা শব্দ করে লাফ দিয়ে সরে গেল। ময়নার মা ভয় পেয়ে একটা বিকট চিৎকার দিয়ে পিছনে সরে এল এবং তখন প্রথমবারের। মতো ময়নার মুখে সত্যিকারের আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে। মানিক লক্ষ করল ময়নার সামনের কয়েকটা দাঁত নেই এবং দাঁতহীন এই হাসিটার মতো সুন্দর কিছু সে বহুদিন দেখছে কি না মনে করতে পারল না।

ময়নার মা দরজা ধরে বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিয়ে নিজের বুকে থুতু দিয়ে চোখ বিস্ফারিত করে এলার্ম ক্লকটার দিকে তাকিয়ে রইল এবং ময়না আনন্দে চিৎকার করে এলার্ম ক্লকটা ধরার জন্যে সেটার উপর লাফিয়ে পড়ল। এলার্ম ক্লকটা ছোটো একটা শব্দ করে লাফ দিয়ে সরে যায়, ময়না সেটাকে একটুর জন্যে ধরতে পারে না। তারপর যেটা ঘটল সেটার জন্যে মানিক একেবারে প্রস্তুত ছিল না, মানিক অবাক হয়ে দেখল ময়না তার ফোকলা দাঁত বের করে খিলখিল করে হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। এই ব্যাপারটাতে যে সত্যি সত্যি আনন্দের একটা বিষয়। আছে এই প্রথম মানিক সেটা লক্ষ করল। ময়না একটু পরেই আবার উঠে দাঁড়ায় তারপর আবার সেটা ধরার চেষ্টা করল, এলার্ম ক্লকটা আবার লাফ দিয়ে সরে গেল আর ময়না আবার খিলখিল করে হাসতে লাগল! ময়নার হাসি দেখে মানিকও প্রথমে মৃদুভাবে এবং একটু পরে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে একটা মজার জিনিসকে সে বোকার মতো ভয়ের জিনিস ভেবে আছে সেটা এই বাচ্চা মেয়েটা তাকে প্রথমবার বুঝিয়ে দিল।

ময়না এলার্ম ক্লকটাকে নিয়ে সারা ঘরে লুটোপুটি খেল, কখনো কখনো। ঘরের কোণায় প্রায় চেপে ধরল, শেষ মুহূর্তে মনে হয় ইচ্ছে করেই ছেড়ে দিল! ময়নার মা যখন কাজ শেষ করে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে তখন মানিক স্পষ্ট বুঝতে পারল এলার্ম ক্লকটা রীতিমতো নেতিয়ে পড়েছে। ময়না সেটাকে খুব সহজেই ধরে ফেলল তারপর যে দড়ি দিয়ে। তাকে বাঁধা হতো সেই দড়ি দিয়ে এলার্ম ক্লকটাকে বেঁধে ফেলল। মানুষ। যেভাবে পোষা কুকুরকে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায় ময়না সেভাবে এলার্ম ক্লকটাকে বেঁধে নিয়ে গেল। মানিক মুখে কৌতুকের হাসি নিয়ে দেখল এলার্ম ক্লকটা গোবেচারার মতো ছোটো ছোটো লাফ দিয়ে ময়নার পিছু পিছু যাচ্ছে!

.

পরদিন ভোরবেলা টেলিফোনের শব্দে মানিকের ঘুম ভাঙল। সে ঘুমঘুম গলায় ফোন ধরল, “কে?”

“আমি রতন।”

“ও! রতন।” আমি এখন ঘুমাচ্ছি, তুমি ঘণ্টাদুয়েক পর ফোন করতে পারবে? জরুরি কথা আছে।”

অন্যপাশ থেকে রতন চিৎকার করে বলল, “ঘুমাচ্ছ! এখনো ঘুমাচ্ছ। এলার্ম ক্লক তোমাকে তুলে দেয়নি?”

মানিক ঘুমঘুম গলায় বলল, “হ্যাঁ। তোমার এলার্ম ক্লক নিয়েই কথা। পরে ফোন কর।”

মানিক ফোন রেখে দেয়, রতন স্পষ্ট শুনতে পেল মানিক হালকাভাবে নাক ডাকতে শুরু করেছে।

.

ঘণ্টাদুয়েক পর রতন যখন আবার ফোন করেছে মানিক তখনও ঘুমাচ্ছে। আরো ঘন্টাদুয়েক পর যখন ফোন করছে তখন মানিকের ঘুম ভেঙেছে কিন্তু সে এখনো বিছানা থেকে নামেনি। রতন জিজ্ঞেস করল, “এলার্ম ক্লক তোমাকে ঘুম থেকে তুলতে পারেনি? এখনো ঘুমাচ্ছ?”

“এখন উঠে যাব। কাল ভালো ঘুম হয়নি তো তাই আজ একটু পুষিয়ে নিলাম। ভালোই হয়েছে তুমি ফোন করেছ, আমি তোমার সাথে কথা। বলতে চাচ্ছিলাম। হ্যাঁ তোমার এলার্ম ক্লকটা নিয়ে, এটা বাচ্চাদের জন্যে অসাধারণ একটা খেলনা হতে পারে।”

রতন খাবি খেল, “খেলনা?”

“হ্যাঁ। ছোটো বাচ্চারা এটার পিছনে দৌড়াদৌড়ি করে এটাকে ধরতে অসম্ভব পছন্দ করে। দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলে এটা পোষা কুকুরের মতো পিছন-পিছনে যায়।”

“পোষা কুকুর?”

“হ্যাঁ। তুমি যদি চাও তাহলে আমি খেলনা কোম্পানির সাথে কথা বলতে পারি। আমার পরিচিত একজন ইন্ডাস্ট্রিতে আছে। সে অবশ্যি জাহাজ বানায়। যে জাহাজ বানাতে পারে সে কি খেলনা বানাতে পারবে না?”

“জাহাজ?”

“খেলনাটার একটা মজার নাম দিতে হবে। আমার কী মনে হয় জানো, এর মজার একটা নাম হতে পারে ডুগুডুও।”

“ডুগুডুগু?”

“হ্যাঁ। ডুডুগু।”

.

সারাদেশের বাচ্চাদের খুব শখের খেলনা ডুগুডুগুর এই হচ্ছে জন্ম ইতিহাস।