২. ডাকাতে ঝিলের তিন পাশে

ডাকাতে ঝিলের তিন পাশে যে নিবিড় জঙ্গল আর ভুসভুসে কাদা, তাতে জায়গাটা মানুষের পক্ষে প্রায় অগম্য। দিনের বেলাতেই জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকার ঘনিয়ে থাকে। ঝিলের জলেও বিস্তর আগাছা আর কচুরিপানা জন্মেছে। বহু দিন এই দৃষিত জল কেউ ব্যবহার করেনি। এমনকী, স্নান করতে বা মাছ ধরতেও কেউ আসে না।

ঝিলের দক্ষিণ ধারে একখানা পুরনো বড় বাড়ি। বাড়িটার জীর্ণ দশা বাইরে থেকে বোঝা যায়। সিদ্ধিনাথ দিন রাত শুনতে পায়, বাড়িটার ভিতরে ঝুরঝুর করে চুন বালি খসে পড়ছে। মেঝেয় গর্ত বানাচ্ছে ইঁদুর। আরশোলা, উইপোকা, ঘুণ, বিছে, তক্ষক, কী নেই এই বাড়িতে? আর যারা আছেন, তাঁদের কথা ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। রাতের বেলায় কত শব্দ হয় বাড়ির মধ্যে, কত খোনা গলার গান, হাসি শোনা যায়। সিদ্ধিনাথ তখন আউট হাউসে নিজের ছোট ঘরখানায় কাঠ হয়ে থাকে। সিদ্ধিনাথ আগে রোজ ঝাড়পোঁছ করত। আজকাল হাল ছেড়ে দিয়েছে। সপ্তাহে এক দিন করে সে বাড়িটা ঝাড়পোঁছ করে বটে, কিন্তু বুঝতে পারে, নড়বড়ে বাড়িটার আয়ু আর বেশি দিন নয়। হঠাৎ ধসে পড়ে যাবে।

বাড়ির পিছন দিকে বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি নেমে গেছে ঝিলের জলে। সিঁড়ির অবস্থা অবশ্য খুবই করুণ। মস্ত মস্ত ফাটল হাঁ করে আছে। তার মধ্যে কচ্ছপেরা ডিম পেড়ে যায়। ঢোঁড়া সাপ আস্তানা গাড়ে। পোকা-মাকড় বাসা বেঁধে থাকে। কোথাও কোথাও শান ফাটিয়ে উদ্ভিদ উঠেছে।

সিদ্ধিনাথই একমাত্র লোক, যে ঝিলের জল ব্যবহার করে। এই জলে সিদ্ধিনাথ কাপড় কাঁচে, বাসন মাজে, স্নান করে। তার অসুখ করে না। গত চল্লিশ বছর ধরে সদাশিববাবুর এই বাড়িখানায় পাহারাদারের চাকরি করছে সে। এই চল্লিশ বছর ধরে প্রায় প্রতি দিনই সে ঘাটের সিঁড়ি কত দূর নেমে গেছে, তা ডুব দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছে। তার কারণ, কিংবদন্তী হল, এই সিঁড়ির শেষে, ঝিলের একেবারে তলায় কোনও গহিন রাজ্যে একখানা মন্দির আছে। সেখানে ভারী জাগ্রত এক দেবতা আছেন। যে একবার সেখানে পৌঁছতে পারবে, তার আর ভাবনা নেই। দুনিয়া জয় করে নেওয়া তার কাছে কিছুই নয়।

সিদ্ধিনাথ বহু দিনের চেষ্টায় এ-পর্যন্ত জলের তলায় ষাটটা সিঁড়ি অবধি যেতে পেরেছে। তারও তলায় সিঁড়ি আরও বহু দূর নেমে গেছে। কোনও মানুষের পক্ষে তো দূর নেমে যাওয়া সম্ভব নয়।

সিদ্ধিনাথ পারেনি বটে, কিন্তু আজও সে প্রায়ই ঘাটের পৈঠায় বসে জলের দিকে চেয়ে থাকে।

আজ সকালে ঘাটে বসে যখন আনমনে নানা কথা ভাবছিল, তখন হঠাৎ কেমন যেন মনে হল, কেউ আড়াল থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

সিদ্ধিনাথ চার দিকে তাকিয়ে দেখল। কোথাও কেউ নেই। দিব্যি রোদ উঠেছে। ঠাণ্ডা বাতাস হাড় কাঁপিয়ে বয়ে যাচ্ছে, পাখি ডাকছে। ঝিলের ও পাশে নিবিড় জঙ্গলে অন্ধকার জমে আছে।

সিদ্ধিনাথ গায়ের চাঁদরখানা আর-একটু আঁট করে জড়িয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর আবার তার কেমন মনটা সুড়সুড় করে। উঠল। তার দিকে কে যেন আড়াল থেকে তাকিয়ে আছে।

সিদ্ধিনাথ ভারী অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এ রকম অনুভূতি তার বড় একটা হয়নি কোনও দিন। এই নির্জন জায়গায় কে আসবে, আর কারই বা দায় পড়েছে সিদ্ধিনাথের দিকে তাকিয়ে থাকার?

সিদ্ধিনাথ উঠে চার দিকে ঝোঁপঝাড় ঘুরে দেখল। হাতের লাঠিটা দিয়ে ঝোঁপঝাড় নেড়ে-চেড়ে দেখল। কেউ নেই।

সিদ্ধিনাথ আবার এসে পৈঠায় বসতে যেতেই ফটকের বাইরে একটা গাড়ির ভ্যাঁপোর ভোঁ শোনা গেল। বেশ ঘন-ঘন শব্দ হচ্ছে। কে যেন চেঁচাচ্ছে, “সিদ্ধিনাথ! ওহে সিদ্ধিনাথ!”

সিদ্ধিনাথ ভারী অবাক হল। কে আবার এল জ্বালাতে?

বাড়িটা ঘুরে সামনের দিকে বাগান পার হয়ে ফটকের কাছে এসে সিদ্ধিনাথ দেখল, জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে। কয়েকজন বাবু গেট ধরে ঝাঁকঝাঁকি করছেন।

“কী চাই আপনাদের?”

“আপনিই কি সিদ্ধিনাথ?”

“হ্যাঁ, আপনারা কারা?”

“আমরা সদাশিববাবুর কাছ থেকে আসছি। এ-বাড়ি আমরা ভাড়া নিয়েছি।”

সিদ্ধিনাথ চোখ কপালে তুলে বলল, “ভাড়া নিয়েছেন? বাড়ি যে পড়ো-পড়ো! শেষে কি বাড়ি-চাপা পড়ে মরার সাধ হল আপনাদের?”

অভিজিৎ বলল, “ফটকটা আগে খুলুন তো মশাই, বাড়িটা নিজের চোখে দেখতে দিন।”

লোকগুলোর চেহারা, পোশাক-আশাক বাবুদের মতো হলেও কেমন যেন মানুষগুলোকে বিশেষ পছন্দ হল না সিদ্ধিনাথের। কিন্তু সে হল হুকুমের চাকর। কোমরের কার-এ বাঁধা চাবি দিয়ে ফটকের তালা খুলে দিয়ে উদাস কণ্ঠে বলল, “দেখে নিন।”

আশ্চর্যের বিষয়, লোকগুলো বাড়িটা ঘুরে-ফিরে দেখে পছন্দ করে ফেলল। বলল, “বাঃ, দিব্যি বাড়ি।”

অভিজিৎ নামে লোকটি হঠাৎ ‘আপনি’ ছেড়ে ‘তুমি’তে নেমে সিদ্ধিনাথকে বলল, “তা, তুমি এখানে কত দিন আছ হে বাপু?”

“সে কি আর মনে আছে ভাল করে! তবে চল্লিশ বছর তো হবেই।”

“তা, তোমার দেশে-টেশে যেতে ইচ্ছে করে না?”

“দেশে যেতে?”

‘হ্যাঁ হে। যাও না, দেশ থেকে কিছু দিন ঘুরে-টুরে এসো গিয়ে। আমরা নাহয় থোক কিছু টাকা দিচ্ছি তোমাকে।”

সিদ্ধিনাথ মাথা চুলকে বলল, “দেশ একটা ছিল বটে মশাই। এখান থেকে বিশ-মাইলটাক ভিতরে। বিশ বছর আগেও এক খুড়ি বেঁচে ছিল সেখানে। মাঝে-মাঝে যেতুম। বিশ বছর হল খুড়িমা মরে অবধি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেছে।”

অভিজিৎ একটু হেসে বলল, “তা, দেশে না যাও, তীর্থ-টির্থও তো করতে যেতে পারো। এক জায়গায় এত দিন একনাগাড়ে থাকতে কি ভাল লাগে?”

সিদ্ধিনাথ এবার একটু ভেবে বলল, “সেটা একটা কথা বটে। এত কাছে কলকাতার কালীঘাট, সেটা অবধি দেখা হয়ে ওঠেনি।”

“কালীঘাট যাও, হরিদ্বার যাও, কাশী যাও। ঘুরে-টুরে এসো তো! এখন আমরা এসে গেছি, বাড়ি পাহারা দেওয়ার তো আর দরকার নেই।”

‘কথাটা মন্দ বলেননি। আচ্ছা, বাবুকে বলে দেখি।”

অভিজিৎ মোলায়েম গলায় বলল, “তার দরকার কী? মাইনে তো তোমাকে আমরাই দেব, সুতরাং আমরাই এখন তোমার বাবু। আমরা যখন তোমাকে ছুটি দিচ্ছি, তখন আর তোমার ভাবনা কী?”

সিদ্ধিনাথ মাথা নেড়ে বলল, “যে আজ্ঞে। তা আপনারা কবে বাড়ির দখল নিচ্ছেন?”

“আজই। আমাদের সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র আর যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলো এ-বেলাই চলে আসবে। তুমি একটু ঝটপাট দিয়ে দাও ঘরগুলো।”

সিদ্ধিনাথ মিনমিন করে বলল, “বাড়ির অবস্থা কিন্তু ভাল নয় গো বাবুরা। কোন্ দিন যে হুড়মুড় করে পড়বে, তার কিছু ঠিক নেই কিন্তু।”

তার কথায় অবশ্য কেউ কান দিল না।

বাবুরা যে অন্য ধাঁচের, তা বুঝে নিতে বেশি সময় লাগল না সিদ্ধিনাথের। এরা সব শহর-গঞ্জের লোক, মেলা লেখা-পড়া করেছে, চটাস-পটাস করে ইংরেজি বলে। এরা নিশ্চয়ই ভূত-প্রেত মানে না, ভগবানকেও মানে কি না সন্দেহ। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ভূতেরাও কখনও ভুলেও এ সব বাবুদের কাছে ঘেঁষেন না, সুতরাং এদের কাছে এ বাড়ির ভূতের বৃত্তান্ত বলে লাভ নেই।

সিদ্ধিনাথ ঘর-দোর ভাল করে ঝট-পাট দিয়ে ঝুল ঝেড়ে দিল।

বাগানটায় বড় জঙ্গল হয়েছে। আগে সিদ্ধিনাথ গাছ-টাছ লাগাত, আগাছা তুলে ফেলত। আজকাল আর পণ্ডশ্রম করতে ইচ্ছে যায় না। ফলে বাগানটা একেবারেই জংলা গাছে ভরে গেছে।

কোদাল কুড়ল কাঁচি নিয়ে সিদ্ধিনাথ বাগানটা পরিষ্কার করতে উদ্যোগ ছিল। বাবুরা ধেয়ে এল হাঁ-হাঁ করে। অভিজিৎ বলল, “খবরদার, ও কাজও করো না। আগাছার জন্যই বাড়িটা আমরা ভাড়া নিয়েছি।”

আগাছায় কার কী কাজ তা জানে না সিদ্ধিনাথ। তবে পরিশ্রম বেঁচে যাওয়ায় খুশিই হল সে। কিন্তু ভুতুড়ে জংলা বাড়ি ভাড়া নিয়ে শহুরে বাবুরা কী করতে চায়, তা তার মাথায় কিছুতেই সেঁধোল না। তাকে দেশে যেতে বলছে, তীর্থ করতে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে, এটাও তেমন সুবিধের ঠেকছে না সিদ্ধিনাথের। তাকে সরিয়ে দিতে চাইছে কি?

সদাশিবকতার বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর তেমন ভরসা নেই সিদ্ধিনাথের। নামে যেমন সদাশিব, কাজেও তেমনি বোম-ভোলানাথ। দুটো মন রাখা কথা বললেই একেবারে গলে। জল হয়ে যান। তবু তার কানে কথাটা তোলা দরকার। সিদ্ধিনাথ ফরসা ধুতি আর পিরান পরে, মাথায় একটা পাগড়ি বেঁধে লাঠিগাছ হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

পথে শ্রীপতির মুদির দোকান। সিদ্ধিনাথ দোকানের বাইরে একখানা বেঞ্চে বসে পড়ে, পাগড়ির ন্যাজ দিয়ে মুখ মুছে বলল, “ওরে, শ্রীপতি, শুনেছিস বৃত্তান্ত?”

“না গো সিদ্ধিনাথদা। বৃত্তান্তটা কী?”

“ঝিলের বাড়ি ভাড়া হল রে! একেবারে ফিটফাট সব বাবুরা এসে গেল।”

“বলো কী গো? তাই দেখছিলুম বটে একখানা ঢাকনা-খোলা জিপ গাড়ি হাঁকড়ে কারা সব যাতায়াত করছে।

“তারাই। ও দিকে বাড়ি যে কখন মাথার ওপর ভেঙে পড়ে, তার ঠিক নেই।”

“তা, ওই ভূতের বাড়িতে কি তিষ্টোতে পারবে? তোমার মতো ডাকাবুকো লোক পারে বলে কি আর সবাই পারে? তে-রাত্তির কাটবার আগেই চোঁ-চাঁ দৌড় দিয়ে পালাবে।”

সিদ্ধিনাথ মুখখানা বিকৃত করে বলল, “ভূতের কথা আর বলিস। তাদের আক্কেল দেখলে ঘেন্না হয়। এমনিতে তেনারা রোজ বাড়ির মধ্যে ভূতের নেত্য, ভূতের কেত্তন লাগাবেন, কিন্তু যখনই শহরের বাবুভায়েরা এল, অমনি সব নতুন বউয়ের মতো চুপ মেরে যান। এই তো কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে কাবাবুর ছেলের বন্ধুরা সব বেড়াতে এল। বউ-বাচ্চা সব নিয়ে। বনভোজন করল, কানামাছি খেলল। দু-তিন রাত্রি দিব্যি কাটিয়ে দিল। তা কই, তেনারা তো রা’ও কাড়েননি।”

শ্রীপতি একটু ভেবে বলল, “আসলে কি জানো সিদ্ধিনাথদা, গেঁয়ো ভূত তো, শহুরে লোককে ভয় দেখাতে ঠিক সাহস পায় না।”

সিদ্ধিনাথ উঠল, “যাই রে, কাবাবুর কাছে যেতে হবে।”

বাজারের মুখে পীতাম্বরের দরজির দোকানেও খানিক বসল সিদ্ধিনাথ। গায়ের পিরানটার বোতাম নেই। সেটা খুলে দিয়ে বলল, “দুটো বোতাম বসিয়ে দে বাবা।…বৃত্তান্তটা শুনেছিস? ঝিলের বাড়িতে যে সব কলকাতার বাবুরা এসে গেল।”

পীতাম্বর বোম বসাতে বসাতে বলল, “বুঝবে ঠেলা।” সিদ্ধিনাথ উদাস মুখে বলল, “মেলা টাকা। জিনিসপত্রও তো দেখছি পাহাড়প্রমাণ। কী মতলব কে জানে বাবা।”

পীতাম্বর দাঁতে সুতো কেটে বলল, “তোমার ঝিলের তলার সেই মন্দিরের হদিস পায়নি তো?”

সিদ্ধিনাথ একটু চমকে উঠে বলল, “ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস তো! নাঃ, এ তো বেশ ভাবনার কথা হল।”

পীতাম্বর নিশ্চিন্ত গলায় বলল, “ভাববার কী আছে? তুমি চল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করে যার হদিস করতে পারোনি, বাবুরা কি

আর হুট করে তার খোঁজ পাবে?”

“তা বটে। পাপী-তাপীদের কম্মও নয়। তবে কিনা এ হল ঘোর কলিকাল। উলট-পুরাণ যাকে বলে।”

পিরান গায়ে দিয়ে সিদ্ধিনাথ উঠে পড়ল।

পথে নবীনের বাড়ি। নবীন লোকটার জন্য সিদ্ধিনাথের ভারী দুঃখ হয়। সদাশিব কতার মতো নবীনের পূর্বপুরুষেরাও ডাকাত ছিল। শোনা যায়, তাদেরই দাপট ছিল বেশি। অবস্থা ছিল রাজা-জমিদারের মতোই। সেই নবীনের আজ টিকি অবধি মহাজনের কাছে বাঁধা।

অথচ নবীন লোকটা বড় ভাল। দোষের মধ্যে বেড়ানোর নেশা আছে, লোককে খাওয়াতে ভালবাসে, আর উদ্ভট জিনিস দেখলেই অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা না করে কিনে ফেলে। এই সব করে করে হাতের টাকা সব চলে গেছে। বাড়িটা অবধি মহাজনের কাছে বিক্রি করালায় বাঁধা।

থাকার মধ্যে নবীনের আছে এক বুড়ি পিসি আর এক পুরনো চাকর মহাদেব। প্রকাণ্ড দোতলা বাড়িটাতে তিনটে মোটে প্রাণী।

বয়সে নিতান্ত ছোঁকরা বলে সিদ্ধিনাথ নবীনকে নাম ধরেই ডাকে।

ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে সিদ্ধিনাথ হাঁক দিল, “ও নবীন! বলি নবীন আছ নাকি হে?”

নবীন দোতলার বারান্দায় বসে বই পড়ছিল। মুখ বাড়িয়ে বলল, “কী ব্যাপার সিদ্ধিনাথ-খুড়ো।”

“আর ব্যাপারের কথা বলল না। বলি কেটেরহাট যে কলকাতা হয়ে গেল হে। ঝিলের ধারের বাড়িতে যে ভাড়াটে এসেছে, সে-খবর রাখো?”

“সে তো ভাল কথা খুড়ো। তুমি এত কাল একা ছিলে, এবার কথা বলার লোক হল।”

“হ্যাঁ, কথা বলতে তাদের বড় বয়েই গেছে। আমাকে তাড়াতে পারলে বাঁচে। এক বার বলছে ‘দেশে যাও’, আবার বলছে ‘তীর্থ করে এসো গে’। মতলব বুঝে উঠতে পারছি না। পয়সা দিতে চাইছে।”

“দাঁওটা ছেড়ো না খুড়ো। এই বেলা ঘুরে-টুরে এসো গে।”

“ওরে বাপ রে, সে কি আর ভাবিনি? তবে কিনা কেটেরহাটের হাওয়া ছাড়া আমি যে হাঁফিয়ে উঠব বাপ।”

“তা বটে। তুমি হলে কেটেরহাট-মনুমেন্ট।”

“তোমার খবর-টবর কী? পাতাল-ঘরের দরজা খুলতে পারলে?”

নবীন হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না খুড়ো। বিশ বছরের চেষ্টাতেও খুলল না। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।”

সিদ্ধিনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নবীনের কপালটা সত্যিই খারাপ। বাড়ির তলায় একখানা পাতাল-ঘর আছে। কিন্তু মুশকিল হল, সেটার দরজা ভীষণ পুরু আর শক্ত, লোহার পাতে তৈরি। তাতে না আছে কোনও জোড়, না আছে চাবির ফুটো। কীভাবে সেই দরজা খুলবে, তা কে জানে। হাতুড়ি শাবল দিয়ে বিস্তর চেষ্টা করা হয়েছে, দরজায় আঁচড়ও বসেনি। দেওয়াল ফুটো করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু নিরেট পাথরের দেওয়াল টলেনি। কে জানে, হয়তো ওই পাতালঘরে গুপ্তধন থাকতেও পারে।

পাতালঘরের কথা মহাজন গোপীনাথ জানতে পেরে নবীনকে শাসিয়ে গেছে, “খবরদার, ও ঘরে হাত দেওয়া চলবে না। বাড়ি আমার কাছে বাঁধা, তার মানে বাড়ি এক রকম আমারই। এখন বাড়ির কোনও রকম চোট-টোট হলে কিন্তু জবাবদিহি করতে হবে।”

গোপীনাথ শুধু মহাজনই নয়, লেঠেলদেরও সর্দার। তার হাতে মেলা পোষা গুণ্ডা-বদমাশ আছে। কাজেই তাকে চটিয়ে দিলে সমূহ বিপদ। নবীন তাই ভারী নির্জীব হয়ে আছে, আজকাল।

“তোমার কপালটাই খারাপ হে, নবীন। পাতালঘরটা খুলতে পারলে বুঝি বরাত ফিরে যেত।”

নবীন একটা হতাশার ভঙ্গি করে বলল, “পাতালঘরের কথা বাদ দাও, খুড়ো, তোমার ঝিলের তলার মন্দিরের কী হল বলো!”

সিদ্ধিনাথ কপাল চাপড়ে বলল, “আমার কপালটাও তোমার মতোই খারাপ হে, নবীন।”

সিদ্ধিনাথ নবীনের কথাটা ভাবতে ভাবতে ফের এগোল।

পথে আরও নানা চেনা লোক, চেনা দোকান, চেনা বাড়ি। সকলের সঙ্গে একটা-দুটো করে কথা বলতে বলতে যখন সদাশিবের বাড়ি গিয়ে হাজির হল, তখন প্রায় দুপুর, সদাশিব স্নানের আগে রোদে বসে তেল মাখছেন।

সিদ্ধিনাথ কাঁচুমাচু মুখ করে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সদাশিব মুখ তুলে চেয়ে বললেন, “এই যে নবাবপুর, এত দিনে দেখা করার সময় হল? বলি, সারা দিন কী রাজকার্য নিয়ে থাকা হয় শুনি? ঝিলের..তলার মন্দির নিয়ে ভেবে-ভেবে বাবুর বুঝি ঘুম হচ্ছে না?”

সিদ্ধিনাথ মাথা চুলকে বলল, “কতাবাবু, আপনার তো দয়ার শরীর, সারা জীবন পাপ-তাপ কিছু করেননি, বুড়ো বয়সে কি শেষে নরহত্যার পাপে পড়বেন?”

সদাশিব হাঁ করে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তার পর বললেন, “বটে! নরহত্যার পাপ? সেটা কী করে আমার ঘাড়ে অশাবে রে ধর্মপুর?”

সিদ্ধিনাথ যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে, ভাল মানুষের ছেলেদের যে সব ঝিলের বাড়িতে থাকতে দিলেন, ওদের অপঘাত তো ঠেকানো যাবে না। বাড়ির পড়ো-পড়ো অবস্থা। দেওয়াল-চাপা পড়ে সবগুলো মরবে যে!”

“তাতে আমার পাপ হবে কেন রে গো-মুখ? ওরা তো দেখে-শুনেই ও বাড়িতে থাকতে চাইছে। মরলে নিজেদের দোষে মরবে।

“তা না হয় হল, কিন্তু আমাকেও যে বিদেয় করতে চাইছে। বলছে দেশে যাও, না হয় তীর্থ করে এসো।”

“সে তো ভাল কথাই বলছে। যা না।”

সিদ্ধিনাথ বেজার মুখ করে বলল, “আপনি তো বলেই খালাস। কিন্তু আমি, কেটেরহাট ছাড়া অন্য জায়গায় গিয়ে কি বাঁচব?”

সদাশিব চোখ মিটমিট করে সিদ্ধিনাথের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “তোর বয়স কত হল, তা জানিস?”

“আজ্ঞে না।”

“তুই আমার চেয়েও অন্তত দশ-পনেরো বছরের বড়।”

“তা হবে। আপনাকে এইটুকু দেখেছি।”

“হিসেব করলে তোর যা বয়স দাঁড়ায়, তাতে তোর দু বার মরার কথা।”

“তা বটে।”

“অথচ তুই একবারও মরিসনি।”

“তা বটে।”

“তা হলে কেটেরহাটের বাইরে গিয়ে যদি না বাঁচিস, তা হলেই বা দুঃখ কী?”