প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক পরে নোভাকের চোখে পড়ল একখানা গ্রাম। এই প্রথম সে জিভারোদের গ্রাম দেখতে পেল
ঘরবাড়িগুলি কাঠের তৈরি, মাথার উপর শুষ্ক লতাপাতার আচ্ছাদন। কুটিরগুলোর চারপাশে বড়ো বড়ো কাঠের খুঁটি দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। বেড়ার খুঁটিগুলোর মধ্যে একটু বৈশিষ্ট্য আছে– খুঁটিগুলো মাথার দিকে বর্শার মতো চোখা। দূর থেকে মনে হয় অনেকগুলি অতিস্থূল কাষ্ঠনির্মিত বল্লম কুটিরগুলিকে ঘিরে পাহারা দিচ্ছে।
গ্রামবাসীরা ক্যানো দুটিকে দেখতে পেল। নদীর তীরে দলে দলে ছুটে এল পুরুষ, নারী, শিশু এবং কুকুর। নোভাক মেয়েদের দিকে এক নজর তাকিয়েই বুঝল দীর্ঘদেহের অধিকারিণী না হলেও এই কৃষ্ণকেশী অর্ধসভ্য জিভারো নারী শ্বেতাঙ্গ সুন্দরীদের চাইতে একটুও কম সুন্দর নয়— নাক-চোখ এবং অধর-ওষ্ঠের এমন নিখুঁত গড়ন ইতিপূর্বে নোভাকের চোখে পড়েনি।
ক্যানো থেকে একটা মোটা দড়ি তীরের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হল। কয়েকটি মেয়ে বুক জলে নেমে সেই দড়ি শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে। নোভাক দেখলে জিভারো নারী শুধু সুন্দরী নয়, তাদের দেহের শক্তিও অসাধারণ। অবলা হস্তের সবল আকর্ষণে দুটি নৌকাই তীরে এসে ভিড়ল।
নোভাকের মালপত্রগুলি ক্যানো থেকে নামিয়ে ফেলা হল।
দলের সর্দার নোভাকের চুলের মুঠি ধরে টেনে তাকে নৌকো থেকে নামিয়ে আনলে। মেয়েরা তৎক্ষণাৎ ঘিরে ধরলে বন্দিকে লাল চুল তারা কখনো দেখেনি, বন্দি নোভাকের রক্তবর্ণ কেশ তাদের কাছে বিস্ময়ের বস্তু। বন্দি অনুমান করলে জিভারো মেয়েরা বোধ হয় মানুষের চুলে কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙ দেখেনি।
বন্দিকে নিয়ে যাওয়া হল একটা কুঁড়ে ঘরের মধ্যে।
ঘরটা প্রায় অন্ধকার, কোনো জানালা নেই শুধু যাতায়াত করার জন্যে আছে একটি চোটো দরজা। সেই দরজা দিয়ে নোভাককে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে জিভারোরা প্রস্থান করলে।
ঘরের চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নোভাক দেখল ঘরের মেঝেটা অতিশয় অপরিষ্কার এবং এখানে সেখানে ছড়িয়েই আছে অনেকগুলি শুষ্ক অস্থি পঞ্জর। তার নাকেও এসে ধাক্কা মারলে একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ। অন্য সময় হলে এমন নোংরা পরিবেশের মধ্যে সে হয়তো বমি করে ফেলত কিন্তু এখন সে এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইল না। এমনকী হাড়গুলো মানুষের কি জন্তুর তাও সে পরীক্ষা করলে না কোনোমতে মেঝের খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে সে শুয়ে পড়ল এবং একটু পরেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল তার সমগ্ৰ চেতনা…
এইভাবে শুরু হল ফ্রাঙ্ক নোভাকের জীবন জিভারোদের মধ্যে…
.
তৈলখনির সন্ধানে গিয়ে ইকুয়েডরের জঙ্গলে জিভারোদের হাতে নোভাক যখন বন্দি হল তখন তার বয়স ৩৫ বৎসর। বন্দি হওয়ার আগে তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে তৈল ব্যবসায়ীদের সাহচর্যে! নোভাকের জন্ম হয়েছিল ওকলাহামা প্রদেশের সাপলা শহরে। তার বাবা পাভেল নোভাক ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তৈলবিশেষজ্ঞ। তেলের খনিতে কিভাবে ডিনামাইট ব্যবহার করতে হয়, হঠাৎ আগুন ধরে গেলে কি করেই সেই আগুনকে নিভিয়ে ফেলা যায়– এই সব খুঁটিনাটি ব্যাপারে প্যাভেল নোভাকের জ্ঞান ছিল অসীম। মাত্র ১৬ বৎসর বয়সে বাপের কাছে তালিম পেয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক বাপকা বেটা হয়ে উঠল। সেই অল্প বয়সেই সে তৈলখনির ভয়ংকর আগুনকে এত সহজভাবে আয়ত্ত করতে পারত যে সেই অঞ্চলের তৈলবিশারদ দক্ষ মানুষগুলিও তার কৃতিত্বে অবাক হয়ে যেত। শুধু তৈলবিদ্যা আয়ত্ত করেই নোভাক খুশি হয় নি। দ্যপও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে ভূবিদ্যা শিখল ভালোভাবে। চার বছর ধরে সৈন্য-বিভাগের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে সে সমস্ত ইউরোপ ঘুরল। বিভিন্ন অয়েল কোম্পানি বা তৈল-প্রতিষ্ঠানগুলি নোভাককে নিয়ে টানাটানি শুরু করলে। মাটির নীচে কোথায় তৈল লুকিয়ে আছে সে খুব সহজেই তা বলে দিতে পারত– এ বিষয়ে তার যষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছিল অতিশয় জাগ্রত।
ভেনিজুয়েলায় একবার তৈল-অভিযানে গিয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক স্থির করলে সে আর চাকরি করবে না। তেল সম্বন্ধে যাদের খুব ভালো অভিজ্ঞতা আছে, সেই সব লোক চাকরি না করেও প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারে। এই সব তৈল-বিশেষজ্ঞরা মাস মাস বেতন না নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। চুক্তিবদ্ধ তৈল-বিশেষজ্ঞরা যখন নতুন তৈলখনির সন্ধান পায়, তারা সেই খনির ভার দেয় কোনো তৈল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানকে। উক্ত প্রতিষ্ঠান হয় তেলের খনির মালিক কিন্তু এই আবিষ্কারের বিনিময়ে তৈল-বিশেষজ্ঞ পায় এককালীন প্রচুর টাকা এবং বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দেবার জন্য কোম্পানি আবিষ্কারকর্তাকে প্রতি বৎসর লভ্যাংশের কিছু অংশ দিয়ে থাকে। এই অর্থের পরিমাণ সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য। ফ্রাঙ্ক নোভাক সাধারণ মানুষ নয় নিজের সম্বন্ধে তার বিশ্বাস ছিল অত্যন্ত গভীর। নোভাক ঠিক করলে যে সে আর চাকরি করবে না বরং স্বাধীনভাবে বিভিন্ন স্থানে তৈল-খনির গহ্বরে একবার নিজের ভাগ্যকে যাচাই করে দেখবে।
কারাকাস অঞ্চলে নোভাকের সঙ্গে একটা ছোটো তৈল-প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ হল। প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট জানালেন যদি সে তেলের খনির সন্ধানে ইকুয়েডর অঞ্চলে সম্পূর্ণ এককভাবে যেতে সম্মত হয় তাহলে উক্ত প্রতিষ্ঠান তাকে ২৫,০০০ ডলার দিতে রাজি আছে। টাকার অঙ্কটা অবশ্য খুবই বেশি, কিন্তু একটা বিরাট দল নিয়ে অভিযানে চালাতে গেলে আরও দশগুণ টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা, তার উপর যদি অভিযান ব্যর্থ হয় তাহলে তো সমস্ত টাকাটাই জলে গেল। প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ভাবলেন অত টাকার ঝুঁকি না নিয়ে ২৫,০০০ ডলার দিয়ে নোভাকের মতো অভিজ্ঞ লোককে নিযুক্ত করাই বুদ্ধিমানের কাজ। স্থির হল নোভাক যদি সত্যিই কোনো তৈলখনির সন্ধান পায় তাহলে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক ছাড়া ওই তেলের খনি থেকে যে টাকা লাভ হবে, তার একটা অংশ সে চিরজীবন ভোগ করতে পারবে।
প্রস্তাবটা লোভনীয়। কিন্তু ইকুয়েডরের বনভূমি অতিশয় বিপদজনক। ফ্রাঙ্ক নোভাক দুঃসাহসী মানুষ, স্বর্ণপ্রসূ তৈলখনির জন্য কোনো বিপদের সম্ভাবনাকে সে গ্রাহ্য করলে না– সে রাজি হয়ে গেল।
প্রেসিডেন্ট বললেন, এটা ডিসেম্বর মাস। সামনেই বড়দিনের উৎসব। উৎসবের দিনগুলো দেশে কাটিয়ে ইচ্ছে করলে তারপরেও তুমি ইকুয়েডর-অভিযান শুরু করতে পারো।
নোভাক জানিয়ে দিলে বড়োদিনের উৎসব নিয়ে সে সময় নষ্ট করতে রাজি নয়, এখনই সে যথাস্থানে যাত্রা করবে শুভস্য শীঘ্রং!
দুদিন পরেই নোভাক আকাশপথে ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোর উদ্দেশে যাত্রা করলে। অকাশপথে উড়ে যেতে যেতে উড়োজাহাজে বসে এবং কুইটোর একটা হোটেলের মধ্যে সে ইকুয়েডর অঞ্চলের বিভিন্ন রেড-ইন্ডিয়ান জাতি সম্পর্কে লিখিত অনেকগুলি বই পড়ে ফেললে। তাছাড়া ইকুয়েডরের ভৌগোলিক বৃত্তান্ত এবং তৈলখনি সম্বন্ধেও সে কয়েকটা বই থেকে নানা রকম জ্ঞাতব্য তথ্য সংগ্রহ করলে। তারপর কুইটো থেকে একটা জিপগাড়ি নিয়ে পূর্ব-আন্দির গড়ানো পার্বত্যভূমির উপর দিয়ে সে গাড়ি ছুটিয়ে দিলে। জিপগাড়ির মধ্যে নানা রকম প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে অবশ্য সে ভুল করেনি- এই সব দরকারি জিনিসের মধ্যে ছিল অ্যাট্রোপিন, পেনিসিলিন, শুকনো জমাট খাবার, জরিপের যন্ত্র, তেল দেখবার গিয়ার, ডিনামাইট, তাবুর সাজ-সরঞ্জাম এবং একটা আর্মির বন্দুক ও তিনশ টোটা।
পার্বত্যভূমির নীচে একটা গ্রামে পৌঁছে একজন স্থানীয় পাদরির সাহায্যে সে ছজন কুইচা জাতের রেড-ইন্ডিয়ান মাঝি জোগাড় করে ফেললে। বেশ মোটা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কুইচারা ফ্রাঙ্ক নোভাকের মালপত্র বহন করতে এবং প্রয়োজন হলে জলপথে নৌকা চালাতে রাজি হল। ১৯৫৫ সালে ডিসেম্বরের তিন তারিখে কুইচাদের নিয়ে ফ্রাঙ্ক নোভাক তার অভিযান শুরু করলে।
প্রথম প্রথম ধারাল ম্যাচেটের আঘাতে লতাপাতা কেটে এগিয়ে যেতে ভালোই লাগছিল। নোভাক অবাক হয়ে ভাবছিল জঙ্গল কেটে অভিযান চালাতে অভিযানকারীরা এত অনিচ্ছুক হয় কেন? একটু পরেই তার ভুল ভাঙল। ঘন ঘন ম্যাচেট চার্লিয়ে তার হাত হয়ে গেল অবশ, কিন্তু তার সামনে তখনো দুলছে অসংখ্য লতাপাতার সবুজ যবনিকা!–~
নোভাক ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার সঙ্গী কুইচারা সম্পূর্ণ নির্বিকার। তারা খুব সহজেই জঙ্গল কাটতে কাটতে পথ করে এগিয়ে চলেছে।
শুধু কি লতাপাতার বাধা? অসংখ্য মশা আর উড়ন্ত কীট এসে আক্রমণ করলে তাদের। অস্থির হয়ে উঠল নোভাক; তার হাত মুখ প্রভৃতি যে সব জায়গা পরিচ্ছদের আড়ালে ঢাকা পড়ে নি, সেই সব অনাবৃত স্থান পতঙ্গের দংশনে ফুলে উঠে ভীষণভাবে জ্বালা করতে লাগল। কুইচাদের মুখের ভাব নির্বিকার মশককুলের আক্রমণ অথবা কীট-পতঙ্গের দংশন তারা আমলেই আনলে না।
নোভাক সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে এই খর্বকায় লোকগুলির দিকে তাকাল। কুইচারা মোটেই দীর্ঘ দেহের অধিকারী নয়, কিন্তু তাদের নাতিবৃহৎ পেশিবহুল শরীর যেন লোহা দিয়ে তৈরি। বিশেষ করে তাদের সর্দার মালোর চেহারাটা সত্যিই দেখবার মতত। সঙ্গীদের মত সে-ও খর্বকায়, তবে তার দৈর্ঘ্যের অভাব পূরণ করে দিয়েছে একজোড়া পেশীবহুল স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তার। নোভাক দেখল মালোর ঘর্মসিক্ত শার্টের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে পৃষ্ঠদেশের সর্পিল মাংসপেশী এবং ঘন সারিবদ্ধ বৃক্ষ ও লতাবঝাপের বন্ধনকে ম্যাচেটের আঘাতে কাটতে কাটতে সে এমন সহজভাবে এগিয়ে চলেছে যে মনে হয় লোকটি এতটুকু ক্লান্তিবোধ করছে না। কিন্তু কুইচারা ক্লান্ত না হলেও নোভাকের শরীর এক ঘণ্টার মধ্যেই অবশ হয়ে এল, হাঁপাতে হাঁপাতে সে চেঁচিয়ে উঠল, আর
বাবা, আর নয়। একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। মালপত্র নামিয়ে সবাই বসে পড়ল। নোভাক প্যাকেট বার করে সিগারেট ধরালে তারপর প্যাকেটটাকে এগিয়ে দিলে কুইচাদের দিকে। কুইচারা এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি, নিঃশব্দে পথ চলেছে। এবার তাদের ভাবলেশহীন মুখে ফুটল হাসির রেখা– তারা হঠাৎ হৈ হৈ করে কথা বলতে শুরু করলে। তাদের কাছেই নোভাক শিখল কেমন করে বনের পথে মালপত্র ঘাড়ে করে হাঁটতে হয়। কুইচারা ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে পারে খুব সহজেই নোভাক তাদের কথা বুঝতে পারলে।
নোভাক এবার প্রশ্ন করলে, তোমরা এতক্ষণ একটাও কথা বলনি কেন? গ্রামের মধ্যেও তোমাদের মুখে একটাও কথা শুনতে পাইনি!
মালো দন্তবিকশিত করে বললে, মালিক, তোমাকে আগে ঠিক বুঝতে পারিনি। সাদা চামড়ার অনেক লোক আমাদের মানুষ বলে গণ্য করে না, তাদের কাছ আমরা শুধু ভারবহনকারী জানোয়ার মাত্র। তাই তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলি না, কেবল চুক্তিমতো কাজ করে যাই। তুমি আমাদের দু-পেয়ে জন্তু মনে করোনি, তাই তোমার সঙ্গে আমরা গল্প করছি, সহজভাবে মন খুলে কথা বলছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গল্প বেশ জমে উঠল। প্রভুভৃত্যের নীরস সম্পর্কের বদলে উভয়পক্ষে গড়ে উঠল বন্ধুত্বের মিষ্ট বন্ধন।
মালো বললে, মালিক! কাঁধের মালটাকে বেশি ঝুলিয়ে না দিয়ে খুব উঁচু করে রাখো আর মেয়েমানুষের কাপড় কাঁচার মতো ধপাস ধপাস করে ম্যাচেট না চার্লিয়ে চলবার সময়ে যখন তোমার বাঁ পা মাটিতে পড়বে, ঠিক তখনই লক্ষ্যবস্তুর উপর কোপ হাঁকড়াবে।
মালোর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করে নোভাক দেখল সত্যিই তাতে পরিশ্রম অনেক কম হয়।
সেদিন অর্থাৎ ডিসেম্বরের তিন তারিখে তারা এসে পৌঁছল পাটাজা নামক স্থানে।
মালো বললে, আজ রাতে এখানেই তাবু ফেলা যাক। কাল সকালে আমরা জলপথে ক্যানো ভাসিয়ে যাত্রা শুরু করব।
নোভাক সম্মতি দিলে। কুইচারা তাবু খাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টিনে জমানো শুকনো খাবার কুইচারা বাধ্য হয়ে খায়, কিন্তু ওই শুষ্ক খাদ্য তারা পছন্দ করে না- এ কথাটা নোভাকের জানা ছিল। সে মাথার উপর দৃষ্টির নিক্ষেপ করলে গাছে গাছে বসে আছে অথবা দোল খাচ্ছে অনেকগুলো বাঁদর। নোভাক শুনেছিল এইসব বাঁদরের মাংস নাকি অতিশয় উপাদেয় খাদ্য। অতএব গর্জে উঠল তার হাতের বন্দুক, বৃক্ষশাখা থেকে সশব্দে মাটির উপর আছড়ে পড়ল কয়েকটা বাঁদরের মৃতদেহ।
এমন টাটকা মাংস পেয়ে কুইচারা খুব খুশি। বাঁদরের মাংস খাওয়ার প্রবৃত্তি নোভাকের হল না, সে শুকনো টিনের খাবারেই ক্ষুধা নিবৃত্ত করলে।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে তারা শুকনো লতাপাতা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে তাবুর ভিতর ঢুকে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালবেলায় অগ্নিকুণ্ডর আশেপাশে দেখা গেল জাগুয়ার প্রভৃতি বিড়াল জাতীয় হিংস্র জন্তুর পায়ের চিহ্ন।
রাত্রিতে সবাই যখন নিশ্চিন্ত ঘুমে অচৈতন্য ছিল তাঁবুর ভিতরে, অরণ্য-প্রাচীরের অন্তরালে তখনও তাদের লক্ষ্য করেছে ক্ষুধিত, শাপদের জ্বলন্ত চক্ষু!…
কুইচারা কাজের লোক। চটপট নদী থেকে দুটো মস্ত মস্ত মাছ তারা ধরে ফেললে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল ব্রেকফাস্ট বা প্রাতরাশ। তারপর নদীর জলে ভাসল ক্যানো- শুরু হল জলযাত্রা।
নোভাকের কাছে জলযাত্রা খুব আরামদায়ক লাগল। নদীর উপর সর্বদাই ছুটছে বাতাস; তাতে গরমের কষ্টও কম আর দুরন্ত বাতাসের মাতামাতি দূর করে দিলে উড়ন্ত পতঙ্গদের- কুইচাদের সঙ্গে যোগ নিয়ে নোভাকও দাঁড় বাইতে শুরু করলে।
সেদিন বিকালবেলা যখন তারা নদীর ধারে বিশ্রাম নেবার জন্য থামল, তখন নোভাক অনুভব করলে অরণ্য এখানে অগভীর এবং গরমও খুব বেশি। তারা তখন বনের মধ্যে প্রায় ২৫ মাইল চলে এসেছে। নোভাক সে রাত্রে তার বই খুলে স্থানীয় অধিবাসীদের কথা পড়তে লাগল। রেড-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে কয়েকটা জাতি এই অঞ্চলে বাস করে, তাদের নাম- কুইচা, জিভারো, কোকোমা, মুরাট, অকা প্রভৃতি। শুধু বই পড়ে নোভাক ক্ষান্ত হল না, সে এইসব জাতি সম্বন্ধে মালোকে প্রশ্ন করতে শুরু করলে।
মালোর কাছ থেকে যে ধরনের উত্তর এল, তাতে নোভাক খুব সন্তুষ্ট হতে পারলে না। সে বুঝল রেড-ইন্ডিয়ানদের সমস্ত জাতির শাখা-প্রশাখার সঙ্গে মালোর বিশেষ পরিচয় নেই।
অবশেষে নোভাক প্রশ্ন করলে, এরা কি হিংস্র?
মালো বললে, কে জানে! রেড-ইন্ডিয়ানদের স্বভাব-চরিত্র নিয়ে জোর করে কিছু বলা যায় না। আজ হয়তো তারা শান্ত আবার কাল হয়তো দেখবে সবাই খুনের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। এদের মধ্যে জিভারোদের সবাই ভয় করে। এখন অবশ্য জিভারোরা শান্ত হয়ে আছে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে অকা জাতি।
-অকা? তারা অবার কারা?
মালিক, অকা হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক জাতি। তারা সুযোগ পেলেই নরহত্যা করে। যে জিভারোরা সমস্ত অরণ্যবাসীর আতঙ্ক, তারাও অকাদের যমের মতো ভয় করে। জানো মালিক, কোনো অকা কখনো নরকে যায় না!
–কেন?
–কারণ নরকের রাজা শয়তানও অকাদের ভয় করে।
নোভাক হেসে উঠল।
মালো গম্ভীরভাবে বললে, হেসো না মালিক। কোনো অকার সঙ্গে যদি কখনো তোমার দৃষ্টি বিনিময় ঘটে, তবে সেই মুহূর্তে ধরে নিতে পারো যে তুমি আর বেঁচে নেই। অকা বড়ো ভয়ংকর জাতি।
অকাদের সম্বন্ধে আরও যেসব কাহিনি মালোর মুখ থেকে নোভাকের কর্ণগোচর হল সেগুলো সত্যিই ভয়ানক।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো নোভাক শুনতে লাগল সেই রক্তপিপাসু জাতির ভয়াবহ কাহিনি…
অভিযানের চতুর্থ দিনে ক্যানো দুটো উপস্থিত হল একটি গ্রামের কাছে। কিন্তু এ কি দৃশ্য!
নদীর ধারে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলি দগ্ধ পর্ণকুটিরের ভগ্নাবশেষ, নদীতীরে বালুকাভূমির উপর অবস্থান করছে একাধিক পুরুষের মুণ্ডহীন দেহ এবং ছিন্নস্কন্ধ। মৃতদেহগুলির ক্ষতস্থানে বন বন করে ঘুরছে শবভোজী মক্ষিকার দল- ভয়াবহ দৃশ্য!
কয়েকটি রেড-ইন্ডিয়ান মেয়ে ছুটে এল ক্যানো দুটির কাছে। একজন নোভাকের কাঁধে-ঝোলানো বন্দুকটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ক্রন্দন-জড়িত স্বরে চিৎকার করে উঠল। অন্য মেয়েগুলিও কাঁদতে লাগল এবং কথা কইতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে। তাদের কথার অর্থ নোভাক বুঝল না, কিন্তু মালোর উদবিগ্ন মুখভঙ্গি দেখে তার ধারণা হল ব্যাপারটা বেশ গুরুতর।
মেয়েটির কথা শেষ হতেই মালো নোভাককে বললে, জিভারো! জিভারোরা হানা দিয়েছে এই গ্রামে তাই ওদের এই দুর্দশা! মেয়েরা বন্দুকটা দেখে খুশি হয়েছে, তারা আশা করছে তুমি জিভারোদের পিছনে তাড়া করবে এবং তাদের শাস্তি দেবে।
–হুম। এটা যদি জিভারোদের কীর্তি হয় তাহলে তাদের শাস্তি হওয়াই উচিত। তুমি কি বল, মালো?
না মালিক, তুমি যেও না। জঙ্গলের মধ্যে তুমি জিভারোদের দেখার আগেই তারা তোমায় দেখতে পাবে। ওই লোকগুলির যা অবস্থা হয়েছে- মালো মুণ্ডহীন দেহগুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলে তারপর নোভাকের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল, তোমারও ঠিক ওই অবস্থা হবে।
সেই রাতটা নোভাক আর তার সঙ্গীরা সেই গ্রামেই থাকল। গাঁয়ের পুরুষরা মৃতদেহগুলির অগ্নি-সৎকার, মেয়েরা দগ্ধ কুটিরের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে আবার নতুন ঘর তৈরি করার উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
সকালে উঠেই নোভাক দেখলে গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক। নারীপুরুষ সকলের মুখেই হাসি দেখা দিয়েছে, প্রাত্যহিক কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামবাসীরা তাদের দেখলে মনেই হয় না যে গতরাত্রে এই গ্রামের মধ্যে খুনোখুনি রক্তারক্তি হয়ে গেছে। নোভাক বুঝল গ্রামবাসীরা দার্শনিক।
তারা বিশ্বাস করে মৃত মানুষ জীবিতের সঙ্গী হতে পারে না তাই মৃতের জন্য শোক না করে খুব সহজভাবেই তারা জীবনযাত্রার সহজ কর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে।
মালো এবং তার সঙ্গীদের জীবন-দর্শন এত সরল নয়। গ্রামবাসীদের মতো সহজভাবে তারা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে পারলে না।
সেদিন সকালবেলা মালো দলের মুখপাত্র হয়ে নোভাককে বললে, জিভারোরা খেপে গেছে। আমাদের মাথাগুলো আর নিরাপদ নয়। মালিক, আমরা ফিরে যেতে চাই।
নোভাক তাদের বোঝাবার চেষ্টা করলে, জিভারোদের সঙ্গে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত বিবাদ নেই। তারা আমাদের কেন আক্রমণ করবে? হয়তো এই গ্রামবাসীরা জিভারোদের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়েছিল তাই এমন ভয়ানক কাণ্ড ঘটেছে। যাই হোক আমি এখানে তেলের সন্ধানে এসেছি, এখন ফিরে যেতে পারব না।
মালো বললে, মালিক তাহলে তুমি থাকো, আমরা চললুম।
নোভাক দেখলে বেগতিক!–ইকুয়েডরের বনপথে একা একা পথ চলা দুঃসাধ্য ব্যাপার, যে। ভাবেই হোক কুইচাদের মত বদল করাতেই হবে। সে এবার অন্য কায়দা ধরলে, তিক্তকণ্ঠে বিদ্রূপ করে বললে, মালো তুমি একটা পুরুষ মানুষ নও! তোমার বুকে মানুষের হৃৎপিণ্ড নেই, আছে একটা মুরগির কলজে! তুমি এদের দলপতি হয়েছে কেন? এখানকার একটা মেয়েমানুষও তোমার চাইতে ভালো সর্দার হতে পারে।
মালোর মুখ চোখের চেহারা ভয়ানক হয়ে উঠল।
সে পিছন ফিরে চলে যাওয়ার উপক্রম করলে, পরক্ষণেই এক পায়ের উপর ভর দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে পাক খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মালিকের উপর তার দুহাতের দশটা আঙুল বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরলে নোভাকের কণ্ঠনালী!
এমন অতর্কিত আক্রমণের মুখে নোভাক সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে পারলে না, কোনো রকমে মালোর পেটে হাঁটুর গুতো মেরে সে নিজকে ছাড়িয়ে নিল।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পরস্পরকে ছেড়ে সরে গেল, দুজনেই দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে হাঁফাতে লাগল। অন্য কুইচারা দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল পাথরের মতো- দ্বন্দ্ব যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করবে না।
আবার আক্রমণ করল মালো। নোভাক শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে ঘুসি ছুড়ল কিন্তু মালো ক্ষিপ্রপদে সরে গিয়ে ঘুসিটাকে ব্যর্থ করে দিলে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে নিজের গতির বেগে নোভাক ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। তৎক্ষণাৎ এক লাফে নোভাকের পাশে এসে দাঁড়াল মালো, হাঁটু দিয়ে ধূর্ত রেড-ইন্ডিয়ান সজোরে আঘাত করলে নোভাকের কিডনিতে। নোভাক ছিটকে পড়ল মাটিতে! মালো ভূপতিত শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে লাথি ছুড়ল। নোভাক চট করে প্রতিদ্বন্দ্বীর পা ধরে ফেললে, তারপর দুহাতে গোড়ালি ধরে এক ঝটকায় পা মুচড়ে ভেঙে দেবার চেষ্টা করলে।
কিন্তু মালো মারামারিতে ওস্তাদ, সে সার্কাসের পাকা খেলোয়াড়ের মতো শূন্যপথেই নিজের দেহটাকে ঘুরিয়ে নিলে। মালোর পা ভাঙল না বটে কিন্তু তার দেহটা সশব্দে আছাড় খেল কঠিন মাটিতে আর সমস্ত শরীরের ওজনটা এসে পড়ল পেটের উপর তার দম ফুরিয়ে গেল।
নোভাক মালোকে টেনে তুলল, পর পর চারটি নিষ্ঠুর ঘুসির আঘাতে শেষ হয়ে গেল লড়াই।
নোভাকের প্রথম দুটি ঘুসি পড়ল মালোর পেটে, তৃতীয়টি পড়ল মুখে আর আঘাতের যন্ত্রণায় মালো যখন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তখন চতুর্থ ঘুসিটি তার ঘাড়ের উপর- মালো ভূমিশয্যা গ্রহণ করলে।
আবার তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলে নোভাক, হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলে মানো, তোমার উপর আমার রাগ নেই। কিন্তু আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে। শোনো, আমরা এগিয়ে যাব– ঠিক?
মালো মাথা নাড়লে, ঠিক।
তল্পিতল্পা গুটিয়ে আবার সবাই ক্যানোতে উঠল–শুরু হল জলযাত্রা। প্রথম দু ঘণ্টা কেউ কথাবার্তা বললে না। নদীর চাইতে নদীর তীরের দিকেই কুইচাদের দৃষ্টি বেশি সজাগ দেখা গেল। তারা জানত জিভারোরা যদি নরমুণ্ড শিকার করতে চায়, তাহলে নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যেই তারা গা-ঢাকা দিয়ে সুযোগের প্রতীক্ষা করবে। নোভাক নীরবতা ভঙ্গ করার চেষ্টা করলে না, গুলিভরা বন্দুক কোলের উপর রেখে সে স্থির হয়ে বসে রইল চলন্ত নৌকার উপর শুধু তার প্রখর চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি ঘুরতে লাগল নদীর তীরে তীরে বনভূমির বুকে।
সন্ধ্যা হল, চারদিকে ঘনিয়ে এল অস্পষ্ট অন্ধকার।
হঠাৎ একজন কুইচা মাঝি চেঁচিয়ে উঠে নদীর তীরে একদিকে আঙুল দেখাল। তার নির্দেশ অনুযায়ী দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই সকলের চোখে পড়ল বালির উপর বিঁধে আছে একটা বল্লম।
খুব তাড়াতাড়ি বৈঠা চার্লিয়ে তারা জায়গাটা পেরিয়ে গেল এবং রাত্রির অন্ধকার যতক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টিকে একেবারে আচ্ছন্ন না করে ফেলল, ততক্ষণ পর্যন্ত নৌকা বেয়ে চলল প্রাণপণে।
সেই রাত্রিতে তারা আগুন না জ্বালিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই তাবু খাটাল। ঠান্ডা শুকনো টিনের খাবার চিবিয়ে তার ক্ষুধা শান্ত করলে এবং অন্ধকার তাবুর গর্ভে শয্যাগ্রহণ করে শুয়ে পড়ল। নোভাকের ঘুম এল না। তার চারপাশে কম্বল মুড়ি দিয়ে যে লোকগুলো শুয়েছিল, তাদের অস্পষ্ট কথাবার্তা শুনে নোভাক বুঝল যে আজ রাত্রে তাঁবুর মধ্যে কোনো লোকই নিদ্রাদেবীর আরাধনা করতে রাজি নয়– তীব্র শঙ্কা ও উদ্বেগ সকলের চোখ থেকে ঘুমকে তাড়িয়ে দিয়েছে…
কুয়াশা-আচ্ছন্ন প্রভাত।
তীব্র কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল কয়েকটা কাকাতুয়া!
নোভাক উঠে বসল, দেখল সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ কুইচারা!
সকলের মুখপাত্র হয়ে মালো বললে, মালিক, আমরা ফিরে যাচ্ছি।
নোভাক বললে, কালও তুমি ওই কথাই বলেছিলে।
নোভাক উঠে দাঁড়াল। তারপর শুরু হল লড়াই।
কিন্তু এবার আর দ্বন্দ্বযুদ্ধ হল না, অন্যান্য কুইচারা একসঙ্গে নোভাককে আক্রমণ করলে। তারপর কেমন করে আহত নোভাককে ফেলে রেখে কুইচারা সরে পড়ল, কেমন করে হল জিভারোদের আক্রমণ এবং কেমন করে জিভারোদের হাতে বন্দি হয়ে নোভাক এল জিভাবোদের গ্রামে সেই কথা কাহিনির পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা আছে, আবার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন।