২. জগাই আর মাধাইকে

জগাই আর মাধাইকে অনেকে নামের মিল দেখে ভাই বলে মনে করে। কিন্তু আসলে তারা ভাই নয়, বন্ধু বলা যায়। জগাইয়ের নাম জগন্নাথ, আর মাধবের নাম মাধবচন্দ্র। পদবিও আলাদা-আলাদা। জগাই আগে গঞ্জে গামছা বিক্রি করত। মাধাইয়ের ছিল আয়না, চিরুনি, চুলের ফিতে ফিরি করে বেড়ানোর ব্যবসা। কোনওটাতেই সুবিধে হচ্ছিল না বলে একদিন দুজনে একসঙ্গে বসে ভাবতে শুরু করল। ভেবেটেবে দু’জনে মোট দু’শো সাতাত্তর টাকা খরচ করে তেলেভাজার দোকান দিল, আর ভগবানও মুখ তুলে চাইতে লাগলেন। আশপাশে ফুলুরি-বেগুনির বিস্তর দোকান থাকা সত্ত্বেও জগাই-মাধাইয়ের দোকান ঝমাঝম চলতে লাগল। এক-একদিন দু’ তিনশো টাকা বিক্রি। মাথাপিছু নিট আয় দিনে একশো-দেড়শোয় দাঁড়িয়ে গেল। ব্যবসা যখন জমে গেছে ঠিক সেই সময়েই একদিন সদলবলে পানুবাবু এসে হাজির। পানুবাবুর বাবরি চুল, জম্পেশ গোঁফ, গালপাট্টা, গায়ে গিলে করা পাঞ্জাবি, পরনে ময়ূর ধুতি, পায়ে দামি চপ্পল। সাতটা গাঁয়ের লোক পানুবাবুকে যমের মতো ভয় করে। শালপাতার ঠোঙায় দলবল নিয়ে বিস্তর তেলেভাজা সেঁটে “বেশ করেছিস তো” বলে পানুবাবু দাম না দিয়েই উঠে পড়লেন। বললেন, “আমার নজরানা দেড়শো টাকা ওই পটলার হাতে দিয়ে দে।”

না দিয়ে উপায় নেই। জগাই-মাধাইও দিল। প্রথম প্রথম সপ্তাহে একদিন-দু’দিন এরকম অত্যাচার চলতে লাগল। মাসখানেক বাদে সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন। রোজ যে পানুবাবু আসতেন তা নয়। তাঁর দলবল দশ-বারোজন এসে হামলা করত। মোড়ল-মাতব্বর ধরেও লাভ হল না। গঞ্জের সব ব্যাবসাদারকেই ভোলা দিতে হয় বটে, কিন্তু জগাই-মাধাইয়ের উপর অত্যাচারটা যেন একটু বাড়াবাড়ি রকমের। তা বেচারারা আর কী করে, দোকানটা তুলেই দিল। ফের দু’জনে ভাবতে বসল। ভেবেটেবে দু’জনে মিলে একটেরে ছোট্ট একখানা মনিহারি দোকান খুলল। খুলতে না-খুলতেই পানুবাবুর দলবল এসে হাজির। তারা ধারে জিনিস নিতে লাগল টপাটপ। তোলা আদায় তো আছেই।

জগাই-মাধাই ফের পথে বসল। কেন যে পানুবাবু তাদের মতো সামান্য মনিষ্যির সঙ্গে এমন শত্রুতা করছেন তা বুঝতে পারছিল না।

মাধাই বলল, “বুঝলি জগাই, এর পিছনে ষড়যন্ত্র আছে। কেউ পানুবাবুকে আমাদের উপর লেলিয়ে দিয়েছে।”

“সেটা আমিও বুঝতে পারছি। শেষে কি গঞ্জের বাস তুলে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে?”

“তাই চল বরং। গঞ্জ ছেড়ে ছোটখাটো কোনও গাঁয়ে গিয়ে ব্যবসা করি। বড় বড় মানুষ বা ষণ্ডা-গুন্ডাদের সঙ্গে কি আমরা পেরে উঠব? আমাদের না আছে গায়ের জোর, না মনের জোর,না ট্যাঁকের জোর।”

“তা ছাড়া আর একটা জোরও আমাদের নেই। বরাতের জোর।”

“ঠিক বলেছিস।”

“তা হলেই ভেবে দ্যাখ, নতুন জায়গায় গিয়েও কি আমাদের সুবিধে হবে? গাঁয়ের লোক উটকো মানুষ দেখলে হাজারও খতেন নেবে। কোথা হতে আগমন, কী মতলব, নাম কী, ধাম কোথা, মুরুব্বি কে, ট্যাঁকের জোর কত। তারপর গাঁয়ের লোকের নগদ পয়সার জোর নেই, ধারবাকি করে খেয়ে ব্যাবসা লাটে তুলে দেবে।”

মাধাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তা বটে, আমাদের মুরুব্বির জোরও তো নেই। হ্যাঁরে, লটারি খেলবি?”

“বারদশেক খেলেছি। দশবারই ফক্কা।”

“না রে, আমার মাথা ঠিক কাজ করছে না।”

“আমারও না।”

পিছন থেকে কে যেন মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “আমার মাথাটা কিন্তু দিব্যি খেলছে।”

দু’জনেই একটু চমকে উঠে পিছন ফিরে চাইল। কিন্তু পিছনে কেউ নেই দেখে মাধাই বলল, “একী রে বাবা! কথাটা কইল কে? ও জগাইদা!”

জগাইও হাঁ হয়ে বলল, “তাই তো! স্পষ্ট শুনলুম।”

একটা গলাখাঁকারি দিয়ে কণ্ঠস্বর ফের বলল, “ঠিকই শুনেছ, ভুল নেই।”

দু’জনের কথা হচ্ছিল ভর সন্ধেবেলা গঞ্জের খালের ধারে ফাঁকা হাটের একটা চালার নীচে বসে। বাঁশের খুঁটির উপর শুধু টিনের চাল। ন্যাড়া ফাঁকা ঘর, কোনও আবরু নেই, হাওয়া বাতাস খেলছে।

মাধাই বলল, “দ্যাখ তো জগাই, টিনের চালের উপর কেউ ঘাপটি মেরে বসে কথা কইছে কি না।”

জগাই দেখেটেখে বলল, “না, চালের উপর তো কেউ নেই।”

গলাটা খিক করে হেসে বলল, “জন্মে কখনও টিনের চালে ওঠার অভ্যেস নেই আমার। বুঝলে!”

মাধাই তটস্থ হয়ে বলে, “আপনি কে আজ্ঞে? দেখতে পাচ্ছি না কেন?”

গলাটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “দেখাদেখির দরকারটা কী? চাই তো বুদ্ধি-পরামর্শ? দেখে হবে কোন কচুপোড়া?”

“আজ্ঞে, ভয়ডরেরও তো ব্যাপার আছে।”

গলাটা ফের খিঁচিয়ে উঠে বলল, “কেন, ভয়ের আছেটা কী? ব্যবসাপত্তর তো লাটে উঠেছে, ভিটেমাটি ছাড়ার জো, এখন আর ভয়টা কীসের শুনি! কথায় বলে ন্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়।”

“কিন্তু আমার যে বেজায় ভয় করছে। ওরে জগাই, তোরও করছে তো!”

“দাঁড়াও, ভেবে দেখি। হ্যাঁ গো মাধাইদা, আমার গা-টা বেশ শিরশির করছে, হাত-পায়ে যেন একটা খিল-ধরা ভাব, গলাটাও কেমন শুকনো-শুকনো। এ তো ভয়েরই লক্ষণ মনে হচ্ছে।”

গলাটা বেজায় খাপ্পা হয়ে বলল, “ওসব মোটেই ভয়ের লক্ষণ নয়। আজ দুপুরে ভাত খাওনি বলেই ওসব হচ্ছে।”

জগাই কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “দুশ্চিন্তায় খাওয়াদাওয়া যে মাথায় উঠেছে মশাই, খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি।”

“ওসব খবর আমার জানা, তাই তো বলছি, ওসব মোটেও ভয়ের লক্ষণ নয়। তবে ভয় পাওয়ার সুবিধেও আছে। ভয় থেকে নানা ফিকির মাথায় আসে।”

জগাই একগাল হেসে বলল, “আপনি বেশ বলেন তো! তা আপনি কে বলুন তো! ভূতপ্রেত নাকি?”

“ওসব পুরনো বস্তাপচা কথা যে কেন তোমাদের মাথায় আসে তা কে জানে বাবা। ভূতপ্রেত মনে করার দরকারটাই বা কী? একজন বন্ধুলোক বলে ভাবলেই তো হয়!”

“তা নামটা?”

“কণ্ঠস্বর হলে কেমন হয়? ভাল না?”

জগাই গদগদ হয়ে বলে, “চমৎকার নাম।”

মাধাই তাড়াতাড়ি বলল, “তা কণ্ঠস্বরের কণ্ঠ লাগে। আপনার কণ্ঠটাও তত দেখা যাচ্ছে না মশাই।”

কণ্ঠস্বর এবার খ্যাক করে একটু হেসে বলল, “বলিহারি বাপু তোকে, বলি কণ্ঠ কি একটা দেখবার মতো জিনিস! জন্মে শুনিনি বাপু কেউ কারও গলা দেখতে চায়।”

মাধাই কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “তা মুখের ছিরিখানা যখন দেখাচ্ছেন না

তখন কণ্ঠটা দেখলেও একটু ভরসা পাওয়া যেত আর কী! ভয়ডরের একটা ব্যাপার তো আছে!”

“দ্যাখ মেধো, তোকে বহুকাল ধরে দেখে আসছি, লোক তুই মন্দ নোস বটে, কিন্তু জগাইয়ের মাথায় যে একরত্তি বুদ্ধি আছে তোর সেটুকুও নেই। বলি, গোটা মানুষটা ছেড়ে যদি শুধু তার গলাটা দেখতে পাস, তা হলেই কি তোর ভয় কমবে?”

মাধাই কুঁকড়ে গিয়ে বলল, “আজ্ঞে, সেটাও ভাববার কথা।”

“তবে! তার চেয়ে এই যে আমি মোটামুটি গায়েব হয়ে আছি। সেটাই কি ভাল নয়!”

“এখন তাই মনে হচ্ছে বটে।”

জগাই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “আমাদের দোষত্রুটি নেবেন না কণ্ঠদাদা, অবস্থা গতিকে আমরা বড্ড ঘেবড়ে আছি৷ মাথায় কোনও মতলব আসছে না।”

কণ্ঠস্বর বলল, “সে আমি খুব বুঝতে পারছি। ভেবেছিলুম কাউকে কোনওদিন বলব না। এসব গুহ্য কথা বলার আমার দরকারটাই বা কী? ধনরত্নে তো আর আমার কাজ নেই। কিন্তু তোদের অবস্থা দেখে আজ বড্ড বলি বলি ভাব হচ্ছে। ভাবলাম আহা এসব জিনিস এ-দুটো দুঃখী লোকের ভোগে লাগুক। দুনিয়ার ভালমন্দ জিনিস তো এরা চোখেও দেখেনি, চেখেও দেখেনি। সেই জন্যেই বলছি, মন দিয়ে শোন। শুনছিস তো?”

জগাই বলল, “কান খাড়া করে শুনছি কণ্ঠদাদা, আর শুনতে লাগছেও বেজায় ভাল। সত্যি কথা বলতে কী, সেই গেলবার রাসের দিনে রামশঙ্কর ভটচাজমশাইয়ের কীর্তনের পর আর কিছু এত ভাল লাগেনি। কী বলো মাধাইদা?”

মাধাই বেজার মুখে বলল, “তা কেন, শ্যামগঞ্জে সেবার যে নিমাই সন্ন্যাস’ পালা শুনলাম, তাই বা মন্দ কী?”

“তা বটে, সেইসঙ্গে মুকুন্দ রক্ষিতের কথকতার কথাও বলতে হয়, আহা, আজও চোখে জল আসে।”

একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। কণ্ঠস্বর ভারী মনমরা গলায় বলল, “নাঃ, তোদের দিয়ে হবে না রে, বলে লাভ নেই। টাকাপয়সার কথা শুনে কোথায় হামলে পড়বি, তা না, রাজ্যের বাজে কথা এনে ফেললি!”

জগাই কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “দোহাই কণ্ঠদাদা, আর দগ্ধে মারবেন না। গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিলে যে মারা পড়ব।”

মাধাইও গোঁ ধরে বলল, “তোরই তো দোষ। একটা গুরুতর কথা হচ্ছে, ধাঁ করে কেত্তন এনে ফেললি। ওতেই তো আমাদের সব কাজ ভন্ডুল হয়ে যায়।”

চোখ মিটমিট করে জগাই বলল, “ও কণ্ঠদাদা, আছেন কি?”

“আছি রে আছি। আজ তোদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাব বলেই এখনও আছি। কিন্তু চাকা কি সহজে ঘুরবে? তোদের বুদ্ধির দোষে মরচে পড়ে আঁট হয়ে আছে। এখন মন দিয়ে শোন। ভুরফুনের মাঠ তো চিনিস?”

একগাল হেসে জগাই বলল, “তা চিনি না! এই তো খাল পেরোলেই সেই তেপান্তর।”

“ভুরফুনের মাঠের ভাঙা কেল্লা দেখেছিস তো!”

“আজ্ঞে, তবে দুর থেকে। কেল্লার কাছেপিঠে নাকি যেতে নেই। অজগর যেমন শ্বাস দিয়ে মানুষ, গোরু, মোষ সব টেনে নেয়, তেমনই নাকি ভাঙা কেল্লার ভিতরেও মানুষজনকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে হাপিশ করে ফেলে। সে নাকি ভূতপ্রেতের আখড়া।”

“তোর মাথা, মুখ কোথাকার। যারা কেল্লার ভিতর সোনাদানা খুঁজতে যায়, তারাই ওসব গল্প রটায়। যাতে আর কোনও ভাগীদার না জোটে। তবে খোঁজাই সার, কেউ কিছু পায়নি আজ অবধি।”

মাধাই তাড়াতাড়ি বলল, “তা হলে কেল্লার কথা উঠছে কেন আজ্ঞে! ও যে বড্ড ভয়ের জায়গা!”

কণ্ঠস্বর ফের খিঁচিয়ে উঠে বলল, “আর ধ্যাষ্টামো করিসনি তো মেধো। বলি এতই যদি তোর ভয়, তবে আমার সঙ্গে এতক্ষণ ধরে দাঁত কেলিয়ে কথা কইছিস কী করে! ভিরমি তো খাসনি!”

মাধাই মিইয়ে গিয়ে মিনমিন করে বলল, “ভয় যে লাগছে না তা তো নয়। একটু-একটু লাগছে।”

“ভয়টা কেমন জানিস! শীতকালে পুকুরে ডুব দেওয়ার মতো। প্রথম ডুবটাই যা শক্ত। তার পরের ডুবগুলোয় আর ঠান্ডা লাগে না। একবার ভয়টা কেটে গেলেই হয়ে গেল। তা ছাড়া দাঁওটাও তো কম নয় রে বাপু। ওখানে যা পাবি তাতে তোরা, তোদের পুত্র পৌত্রাদি, তস্য পুত্র পৌত্রাদি, তস্য পুত্র পৌত্রাদি সাত পুরুষ পায়ের উপর পা তুলে গ্যাঁট হয়ে বসে চৰ্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় খেয়ে গেলেও ফুরোবে না। বুঝলি! এখন ভেবে দ্যাখ, ভয় পাওয়াটা উচিত কাজ হবে কি না।”

জগাই ঝাঁকি মেরে বলল, “না, ভয়টা কীসের?” মাধাইও গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, “নাঃ, এখন যেন ততটা ভয় লাগছে না।”

“এই তো বাপের ব্যাটার মতো কথা! তা হলে শাবল আর কোদালের জোগাড় দ্যাখ, তারপর গড়িমসি ছেড়ে কাজে নেমে পড়। আগেই বলে রাখি, গুপ্তধন ছেলের হাতের মোয়া নয়। মেহনত করতে হবে। তারপর সোনাদানা দেখে ভিরমি খেয়ে পড়ে যদি অক্কা পাস তা হলে ভোগ করবে কে? কলজে শক্ত করে নে। কথায় বলে বীরভোগ্যা বসুন্ধরা।”

জগাই একগাল হেসে বলল, “না কণ্ঠদাদা, গায়ে বেশ জোর পাচ্ছি।”

মাধাই লাজুক লাজুক ভাব করে বলল, “তা কত হবে কণ্ঠদাদা? দশ-বিশ হাজার হবে না?”

কণ্ঠস্বর অট্টহাস্য করে বলল, “দুর মুখ! দশ-বিশ হাজার তো পাখির আহার। নজরটা একটু উঁচু কর দেখি মেধোতোর মতো ছোটলোককে গুপ্তধনের সন্ধান দিতে যাওয়াই বৃথা। বড্ড ভুল হয়েছে দেখছি।”

জগাই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “মাধাইদার কথা ধরবেন না কণ্ঠদাদা। পানুবাবুর একজন পাইক একবার মাথায় গাট্টা মেরেছিল, তারপর থেকেই মাধাইদার মাথাটার গণ্ডগোল। নইলে তোক বড্ড ভাল।”

মাধাইও কাঁচুমাচু হয়ে বলল, “আজ্ঞে, গরিব মনিষ্যি তো, সোনাদানা আর চোখে দেখলুম কই? তবে রয়ে-সয়ে হয়ে যাবে। এখন থেকে না হয় লাখ-বেলাখের নীচে ভাববই না।”

“তা হলে খুব হুশিয়ার হয়ে শোন। ভাঙা কেল্লার পিছনে উত্তর-পুব কোণে এখনও পড়ো-পড়ো হয়ে কয়েকখানা ঘর খাড়া আছে। একেবারে কোনার ঘরখানায় গিয়ে মেঝের আবর্জনা সরিয়ে উত্তর-পূর্ব কোণের মেঝেতে শাবল ঠুকলেই বুঝবি ফাঁপা ঢ্যাবট্যাব আওয়াজ আসছে। কোদাল আর শাবল দিয়ে চাড় মারলে বড়সড় পাথরের চাঁই উঠে আসবে। সঙ্গে টর্চ আর মোমবাতি নিয়ে যাস বাপু। গর্তের মধ্যে নেমে পড়লেই দেখবি, দিব্যি একখানা কুঠুরি। তার জানলা-দরজা নেই কিন্তু। একেবারে যমপুরীর অন্ধকার। নেমে সোজা পুব-দক্ষিণ কোণে গিয়ে ফের শাবল ঠুকবি। চাড় মেরে ফের একখানা চাঁই তুলে ফেলবি। ওর নীচে ফের একখানা ঘর। নেমে সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে গিয়ে ফের ওরকমভাবেই আর একটা পাথরের চাঁই তুলে ফেলবি। নীচে আর-একখানা ঘর।”

মাধাই বলে, “ওরে বাপ! অত নীচে?”

“তবে কি তোকে কেউ থালায় করে গুপ্তধন বেড়ে দেবে?”

“ঘাট হয়েছে আজ্ঞে। আর ফুট কাটব না। বলুন।”

“নীচের ঘরে নেমে পড়লি তো! এবার উত্তর-পশ্চিম কোণের পাথরটা সরালি। ক’টা হল গুনছিস?”

জগাই বলল, “আজ্ঞে, এটা পাঁচ নম্বর ঘর।”

“মেরেই দিয়েছিস প্রায়। পাঁচ নম্বরে নেমে এবার ফের উত্তর-পূর্ব কোণের পাথর সরিয়ে ছয় নম্বর ঘরে নামবি। এইখানে নেমে ভাল করে ইষ্টনাম স্মরণ করে নিস। বুকটা যেন বেশি ধড়ফড় না করে। কয়েক ঢোক জলও খেয়ে নিতে পারিস। এবার পুব-দক্ষিণের পাথর সরিয়ে যেই নেমে পড়লি অমনি কিন্তু একেবারে হকচকিয়ে যেতে হবে।”

মাধাই শশব্যস্ত বলে উঠল, “কী দেখব সেখানে কণ্ঠদাদা!”

“ওঃ, সে বলার নয় রে, বলার নয়, উফ, সে যা দৃশ্য!”

জগাই হেঁ-হেঁ করে হেসে বলল, “তা কণ্ঠদাদা, আপনার হিস্যা কত?”

“ওসব কথা পরে হবে’খন। এখন কাজে লেগে যা। দেরি করিসনি বাপু, বাতাসেরও কান আছে। যা, যা, বেরিয়ে পড়।”

জগাই-মাধাই উঠে পড়ল।

কোদাল, শাবল, মোমবাতি, টর্চ, জলের ঘটি নিয়ে যখন দু’জনে বেরিয়ে খাল পেরোচ্ছে তখন সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছে। ভুরফুনের মাঠে ভূতুড়ে কুয়াশা, আবছা জ্যোৎস্না আর হুহু বাতাসে দু’জনেরই একটু ভয়-ভয় করছে।

“কাজটা কি ঠিক হল রে জগাই! হুট বলতেই এই যে একটা বিপদের কাজে রওনা হলুম, শেষে ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু হবে না তো?”

“অত ভেবো না তো মাধাইদা। কণ্ঠদাদার দয়ার শরীর, নইলে কি এত বড় গুহ্য কথাটা আমাদের বলত? আমাদের যা অবস্থা তাতে শিয়াল কুকুরেরও চোখে জল আসে। সেই দুঃখেই না কণ্ঠদাদার মনটা নরম হয়েছে।”

“এই কণ্ঠদাদা লোকটা কে বল তো জগাই?”

জগাই মাথা চুলকে বললে, “লোক না পরলোক তা ঠিক বুঝতে পারলাম না। ওসব নিয়ে ভেবে কী হবে বলো। কণ্ঠদাদা তো আমাদের উপকারই করেছে!”

ঠিক মাথার উপর থেকে কে যেন খ্যানখেনে গলায় বলে উঠল, “কে কার উপকার করল শুনি?”

দু’জনে চমকে দাঁড়িয়ে পড়ে ঠাহর করে দেখল একটা ঝুপসি গাছের নীচে তারা থেমেছে। শেওড়া গাছ বলেই মনে হচ্ছে। জগাই আর মাধাই পরস্পরের দিকে একটু সরে এল। জগাই ফ্যাসফেসে গলায় বলল, “কণ্ঠদাদা নাকি? গলাটা যে অন্যরকম লাগছে!”

গলার স্বরটা সড়াৎ করে গাছের নীচে নেমে একেবারে তাদের মুখোমুখি হল। বলল, “কণ্ঠদাদা? সেটি আবার কে হে?”

স্বর শোনা যাচ্ছে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না দেখে এবার তারা ততটা ঘাবড়াল না। আগের অভিজ্ঞতা তো আছে। মাধাই বলল, “আজ্ঞে আমরা কি আর তাকে তেমন চিনি! শুধু কণ্ঠস্বর শোনা গেছে, দেখা যায়নি। এই আপনার মতোই।”

“বুঝেছি। নিজের নাম কণ্ঠস্বর বলেছে তো!”

“যে আজ্ঞে।”

“মহা নচ্ছার জিনিসের পাল্লায় পড়েছ হে। বলি গুপ্তধনের সন্ধান দিয়েছে নাকি?”

জগাইয়ের গলাটা বড্ড বসে গেছে। ক্ষীণ গলায় বলল, “ওই আর কী!”

“কেল্লার কোণের ঘরে পাথর সরিয়ে সরিয়ে সাত ধাপ নামতে হবে, তাই না?”

মাধাই হতাশ হয়ে বলল, “বলতে নিষেধ ছিল। কিন্তু আপনি দেখছি সবই জানেন। আপনি কে বলুন তো!”

“কুঁড়োরাম রায়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ! লোকের মুখে মুখে ফেরে, শোনোনি?”

জগাই মাথা চুলকে বলল, “শুনেছি নাকি মাধাইদা?”

মাধাই ঘাড় চুলকে, মাথা নেড়ে, অনেকক্ষণ ভেবে বলল, “শুনেই থাকব। তবে আমাদের তো মোটা মাথা, তাই কিছু মনে থাকে না। সেইজন্যই তো লেখাপড়া হল না কিনা! আট বছরের চেষ্টায় সাত ঘরের নামতা মুখস্থ হয়।”

জগাই বলল, “আমার তো আকবরের ছেলের নাম আজও মনে নেই। কত বেত খেয়েছি তার জন্য।”

গলার স্বর বলল, “তা আজকাল আর ততটা শোনা যায় না বটে, চ্যাংড়া-প্যাংড়াদের মনে থাকার কথা নয়, কিন্তু গঞ্জের বুড়ো মানুষদের কাছে নামটা বলে দেখো, জোড় হাত কপালে ঠেকাবে। পরোপকারী হিসেবে একসময়ে খুব নাম ছিল হে আমার। সারাদিন কেবল পরোপকার করে বেড়াতুম। এমন নেশা যে, নাওয়া-খাওয়ার সময় জুটত না। এই কারও কাঠ কেটে দিলুম, কাউকে জল তুলে দিয়ে এলুম, কারও বেড়া বেঁধে দিলুম, কারও মড়া পুড়িয়ে এলুম, কারও গাছ থেকে নারকোল পেড়ে দিলুম, কাউকে পাঁচটাকা ধার বা কাউকে দু’ চার পয়সা ভিক্ষে দিলুম, কারও বাড়িতে ডাকাত পড়লে হাউড় দিয়ে গিয়ে পড়লুম। ওঃ, সে কী পরোপকারের নেশা! তাতে অবশ্য মাঝে মাঝে বিপদেও পড়তে হয়েছে। যেদিন পরোপকারের কিছু খুঁজে পেতাম না সেদিন ভারী পাগল-পাগল লাগত। একদিন তো গণেশ পুতিতুণ্ডর পিঠ চুলকোতে বসে গেলুম। গণেশ তখন খুব মন দিয়ে সেলাই মেশিনের সুচে সুতো পরাচ্ছিল। বাধা পড়ায় এই মারে কি সেই মারে। আর একদিন কাজ না পেয়ে নদীয়া দাসের দাওয়ায় একটা বুড়ো মানুষ শুয়ে আছে দেখে ভাবলুম বুড়ো বয়সে তো লোকের পায়ে ব্যথাট্যথা হয়, তা দিই লোকটার পা টিপে বসেও গেলাম পা টিপতে। লোটা প্রথমটায় উচ্চবাচ্য করল না, একটু বাদে বেজার মুখে বলল, ঝুটমুট মেহনত করছেন বাবু, ওটা আমার কাঠের পা।”

মাধাই হাতজোড় করে কাতর গলায় বলল, “গুরুতর বিষয়কর্ম রয়েছে মশাই, এবার আমাদের বিদেয় হতে আজ্ঞা করুন।”

কুঁড়োরাম ভারী উদাস গলায় বলল, “যাবে? তা যাও! পরের উপকার করা আমি বহুকাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন মানুষের বিপদ দেখলেও চুপটি করে থাকি। যা হচ্ছে হোক, আমার কী?”

জোর একখানা গলাখাঁকারি দিয়ে গলার ফাঁসফেঁসে ভাবটা ঝেড়ে ফেলল জগাই। তারপর ভারী শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “তা ইয়ে, কুঁড়োরামদাদা, আমাদের কি কোনও বিপদ দেখতে পাচ্ছেন? কথাটা এমনভাবে কইলেন যে বুকের ভিতরটা কেমন খামচা মেরে উঠল।”

মাধাইও তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমারও যেন কেমন একটা হল। ঠিক খামচা নয়, গরম তেলে বেগুন পড়লে যেমন ছাত করে ওঠে, অনেকটা সেরকম।”

জগাই ফের বলল, “কুঁড়োরামদাদা, আপনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন গতিক সুবিধের নয়!”

মাধাইও পোঁ ধরে বলল, “মনটা যে বড্ড কু গাইছে কুঁড়োদা।”

কুঁড়োরাম বলে উঠল, “ওরে না, না, পরের উপকার করা আমি ভুলেই গেছি। এই তো সেদিন মহেশপুরে ‘মহিষাসুর বধ’ পালায় যে ছোঁকরা চোমরানো গোঁফ লাগিয়ে কার্তিক সেজেছিল, সে একটা সিনের শেষে ছারপোকা কামড়ানোয় গোঁফটা খুলে নাকের নীচে চুলকোতে গিয়ে পরের সিনে গোঁফ লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। চোখের সামনে দেখেও কিচ্ছুটি বলিনি। যা হয় হোক, আর হলও তাই। গোঁফ ছাড়া পরের সিনে নামতেই হইহই কাণ্ড। পালা নষ্ট হওয়ার জোগাড়।”

“আমাদের উপর অত বিমুখ হবেন না কুঁড়োদা।”

জগাইও বলে উঠল, “আমাদের গায়ের জোর, মনের জোর, ট্যাঁকের জোর, বরাতের জোর, মুরুব্বির জোর, বুদ্ধির জোর, কোনও জোরই নেই কিনা।”

কুঁড়োরাম ফস করে একটা শ্বাস ফেলার মতো শব্দ ছাড়ল। তারপর বলল, “এই তো সেদিন বর্ষাকালের সন্ধেবেলায় গয়ারামবাবু চণ্ডীমণ্ডপে বসে গাঁয়ের মাতব্বরদের সঙ্গে কূটকচালি করতে করতে আনমনে তামাকের নল ভেবে সাপের লেজ টেনে নিয়ে মুখে দিয়েছিলেন, চোখের সামনে দেখেও কিছু বলেছি কি? কিচ্ছু বলিনি। যা হয় হোক।”

জগাই শশব্যস্তে বলল, “তা কী হল?”

“বরাতের জোর ছিল খুব। সাপটা ছোবলও মেরেছিল বটে, তবে সেটা গিয়ে পড়ল গয়ারামবাবুর খড়মে। তাইতেই সাপটার দুটো বিষদাত ভেঙে রক্তারক্তি কাণ্ড।”

ফের একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কুঁড়োরাম। সেই শুনে কাঁদো কাঁদো হয়ে মাধাই বলল, “তবে কি আপনি ভাঙা কেল্লায় যেতে মানা করছেন কুঁড়োদা? কিন্তু মেলা সোনাদানা যে তা হলে হাতছাড়া হয়?”

“আমি কেন মানা করব রে? যাবি তো যানা। এই তো একটু আগে, পড়ন্ত বিকেলে গ্যানা গুন্ডার দল লাঠি-সড়কি বন্দুক নিয়ে ভাঙা কেল্লায় গেল। সেখানে তারা জটেশ্বর সাহার ছেলে নবীনের জন্য এখন ওত পেতে বসে আছে। নবীন গঞ্জে আদায় উসুল সেরে তাঁকে ত্রিশটি হাজার টাকা নিয়ে হরিপুরের দিকে এই একটু আগে রওনা হল। সঙ্গে আবার হাড়ে বজ্জাত নিমাইটাকেও জুটিয়েছে দেখলুম। একটু বাদেই সেখানে রক্তারক্তি কাণ্ড হবে। কিন্তু দ্যাখ, তবু কেমন চুপটি করে আছি। না বাপু, আমি আর পরোপকারের মধ্যে নেই। তোরা যেখানে যাচ্ছিস যা বাপু, যা খুশি কর, আমার তাতে কী?”

মাধাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, “গ্যানার দল! ওরে বাবা, তারা যে সাক্ষাৎ যমদূত!”

জগাইয়েরও মুখ শুকোল, “তা হলে কী হবে কুঁড়োদা? আমাদের বড়লোক হওয়া কি কপালে নেই?”

কুঁড়োরাম ভারী উদার গলায় বলল, “তাই কি বললুম রে? বড়লোক হওয়ার আশা যখন হয়েছে তখন গিয়ে কেল্লায় খোঁড়াখুঁড়ি লাগিয়ে দে। সাত ধাপ নীচে নেমে, ঘাম ঝরিয়ে হেদিয়ে গিয়ে যদি লবডঙ্কা পাস, তা হলেও আমি কিছু বলব না।”

মাধাই চোখ বড় বড় করে বলল, “গুপ্তধন কি তা হলে নেই?”

“ওসব আমি জানি না বাপু। তোদের কণ্ঠদাদা যখন বলেছে তখন আমি তোদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে যাব কেন? আজকাল কারও উপকারও যেমন করি না, তেমনই আবার অপকারও করি না কিনা! বুকের জোর আর তাকত থাকলে গিয়ে দ্যাখ না। গুপ্তধনের আগে গ্যানা আছে, তার দলও ঘাপটি মেরে আছে। এসময়ে উটকো লোক হাজির হলেনা বাপু, বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলছি। ওইটেই তো আমার দোষ!”

জগাই কঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “কথা কইছেন বটে, তবে সবই তো সাঁটে। পরিষ্কার করে বুঝতে পারছি কই? মাধাইদা, তুমি কিছু বুঝলে?”

মাধাই গম্ভীর হয়ে বলল, “দুটো পয়সার মুখ আর বোধহয় এ জন্মে দেখা হল না রে জগাই।”

কুঁড়োরাম একটু নরম গলায় বলল, “আহা, অত ভেঙে পড়ছিস কেন? তোদের আর ক্ষতিটা কী হল? নবীন সাহার বিপদটা একটু ভেবে দ্যাখ। সে তো ধনে-প্রাণেই মরবে আজ। তোদের তো তবু প্রাণটা আছে।”

মাধাই আর জগাই খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর হঠাৎ কুঁড়োরামের কথাটা যেন সেঁধোল মাথায়, মাধাই আচমকা লাফিয়ে উঠে বলল, “তাই তো! নবীনটা যে বড্ড ভাল ছেলে রে জগাই! কতবার আমাদের দোকানে বেগুনি আর মোচার চপ খেয়ে তারিফ করে গেছে!”

জগাইও ঝুঁকি মেরে উঠে পড়ল, “হ্যাঁ তো মাধাইদা! নবীনের যে এত বড় বিপদ সেটা তো খেয়াল হয়নি। তাকে যে হুঁশিয়ার করা দরকার।”

অদৃশ্য কুঁড়োরাম নির্বিকার গলায় বলল, “পরোপকারের বাই চাগাড় দিয়েছে বুঝি! তা ভাল, আমারও চাগাড় দিত কিনা, লক্ষণ খুব চিনি। সেবার গুণময় মণ্ডলের বকনা বাছুর হারিয়ে গেল বলে আমি গোটা পরগনা চষে ফেলেছিলাম। দিনতিনেক বাদে যখন খিদে-তেষ্টায় চিচি করতে করতে বাছুর নিয়ে ফিরলাম, তখন গুণময় কী বলল জানিস? চোখ রাঙিয়ে, সপ্তমে গলা তুলে, পাড়া জানান দিয়ে চেঁচাতে লাগল, তুই হারামজাদাই আমার বাছুর চুরি করেছিলি! থানায় এত্তেলা দেওয়াতে ভয় খেয়ে ফেরত দিতে এসেছিস; চল, তোকে ফাটকে দেব। পাঁচজন জড়ো হয়ে গিয়েছিল, তারাও বলাবলি করছিল, চুরি করেছিলি তো করেছিলি, বাছুরটা সীতাপুরের গো-হাটায় বেচে দিলেই পারতিস। আহাম্মকের মতো কেউ চুরির জিনিস ফেরত দিতে আসে?’ সেবার যে কী নাকাল হতে হয়েছিল তা আর বলার নয়।”

জগাই আমতা-আমতা করে বলল, “এ কথাটাও কি সাঁটে বলা হল কুঁড়োদা?”

মাধাই চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তার মানে আমরা নবীনকে বাঁচাতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ব। এঁরা সব ঠিক মানুষ রে জগাই, বহু দূর দেখে তবে কথা কন।”

জগাইয়ের মনটা খারাপ, দুর্বল গলায় বলল, “তা বলে ছেলেটা বেঘোরে প্রাণটা দেবে নাকি মাধাইদা? আমাদের প্রাণের আর কী দাম বলো! ডাকাত-বদমাশের হাতে না মরলেও না-খেয়ে মরা তো কপালে লেখাই আছে। জীবনে কখনও একটা সাহসের কাজ করলুম না। আজ চোখ বুজে একটা করেই ফেলব নাকি মাধাইদা?”

মাধাই অনিচ্ছুক গলায় বলল, “কখনও ডাব-চিংড়ি খেয়েছিস রে জগাই?”

“না তো! কীরকম জিনিস সেটা?”

“আমিও খাইনি। ডাবের মধ্যে চিংড়ি মাছ দিয়ে করে। খেতে নাকি অমৃত, বড় সাধ ছিল মরার আগে একবার ডাব-চিংড়ি খেয়ে মরি। তারপর ধর, সেবার শিবরাত্রির মেলায় কী একটা সিনেমা যেন দেখলুম, তাতে দেখি, ভোরবেলা কাশীর ঘাটে লোকেরা ডনবৈঠক দিচ্ছে। দেখে বড় ইচ্ছে ছিল কাশীতে গিয়ে আমিও একবার ভোরবেলা ওরকম ডনবৈঠক দেব। তারপর ধর, হেঁটো ধুতি পরেই তো জীবনটা কাটল, জীবনে একবার একখানা আশি সুতোর কাপড় পরার বড় ইচ্ছে ছিল রে! দিব্যি কুঁচিয়ে কেঁচা দোলাব, আগাটা আবার ময়ূরের পেখমের মতো একটু ছড়িয়ে পিরানের পকেট থেকে উঁকি মারবে। তা সেসব আর হয়ে উঠল না। সে যাক গে। চল, আজ মরেই দেখি বরং।”

জগাই বিরক্ত হয়ে বলল, “দ্যাখো দিকি কাণ্ড! ওসব কথা কয়ে তুমি যে আমাকে কাহিল করে দিলে। আমারও যে বুকের মধ্যে উথাল-পাথাল হতে লেগেছে!”

“কেন রে, তোর আবার কী হল?”

“তোমার মতো বড় বড় আশা নেই আমার, কিন্তু ছোটখাটো কয়েকটা সাধ যে আমারও ছিল। ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিলুম, কিন্তু এখন সেগুলো চাগাড় মারতে লেগেছে যে! কেষ্টনগরের সরভাজা খেয়েছ কখনও? লোকে বলে সে নাকি একবার খেলে মরণ অবধি তার স্বাদ জিভে জড়িয়ে থাকে। তারপর ধরো, ওই যে মাউথ অর্গান কী যেন বলে, ঠোঁটে সাঁটিয়ে প্যাপোর-প্যাপোর বাজায়, খুব ইচ্ছে ছিল পয়সা হলে ওর একটা কিনে মনের সুখে হিন্দি গান বাজাব। আর একটা সাধও ছিল, কিন্তু বলতে লজ্জা করছে!”

“আর লজ্জা কীসের রে? একটু বাদেই যাদের মরতে হবে তাদের কি লজ্জা-ঘেন্না-ভয় থাকতে আছে?”

“তা হলে বলেই ফেলি! সেই যে বাজপুরের সত্যেনবাবু কী একটা সুগন্ধী মেখে মাঝে-মাঝে গঞ্জে আসে, শুকেছ কখনও? আহা, গন্ধটা নাকে এলে যেন প্রাণটা জুড়িয়ে যায়, বুক ঠান্ডা হয়, মনটা গ্যাস বেলুনের মতো উপর দিকে উঠে যায়। ইচ্ছে ছিল ওরকম এক শিশি সুগন্ধী কিনে কয়েকদিন কষে মেখে নেব। তা সেসব ভাবতে গেলে তো আর মরাই হবে না আমাদের।”

“যা বলেছিস। বেঁচে থাকলেও ওসব কি আর জুটত রে? তার চেয়ে চল, মরে ফিরে-যাত্রা করে আসি। বীরের মতো মরলে নাকি পরের জন্মটা দুধে-ভাতে কাটানো যায়।”

এতক্ষণ কুঁড়োরাম রা কাড়েনি। জগাই সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করল, “কুঁড়োদাদা কি এখনও আছেন?”

কুঁড়োরাম একটা জবরদস্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আছিও বলা যায়, নেইও বলা যায়। তা হলে মরাই সাব্যস্ত করলে দু’জনে?”

জগাই বলল, “মরার মোটেই ইচ্ছে ছিল না মশাই! তবে কিনা মনে হচ্ছে মরণটাই হন্যে হয়ে খুঁজছে আমাদের।”

মাধাই মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, খুঁজে-খুঁজে হয়রান হচ্ছে বেচারা।”

কুঁড়োরাম বলল, “তা হলে বাপু, এগিয়ে পড়ো। পা চালিয়ে হাঁটলে কেল্লার আগেই নবীনকে ধরে ফেলতে পারবে। তারা বেশ দুলকি চালে হাঁটছে, দেখে যেন মনে হয়, হরিপুরে পৌঁছোনোর মোটেই গরজ নেই।”

জগাই বলল, “আচ্ছা মশাই, নবীনের সাঙাত ওই নিমাই লোকটা কে বলুন তো!”

“হাড়বজ্জাত লোক হে। তবে পাজি হতে হলে ওরকমই হতে হয়। যেমন বুদ্ধি, তেমনই চারচোখো নজর, যেমন সাহস তেমনই গায়ের জোর, তার মনের কথা আঁচ করার উপায় নেই কিনা। এই গ্যানার কথাই ধরা, খুনখারাপি, লুটমার করে বেড়ায়, লোকে ভয়ও খায়, কিন্তু মাথায় কি একরত্তি বুদ্ধি আছে? এই যে নিমাই রায় ওর সঙ্গে সাঁট করেছে, শিকার ধরে দিয়ে মজুরি বাবদ কমিশন নেবে, তাতেই গ্যানা কাত। বুদ্ধি থাকলে বুঝতে পারত নিমাই রায় ওকে ল্যাজে খেলাচ্ছে। এই ভুরফুনের মাঠেই একদিন গ্যানাকে পুঁতে ওর দলের দখল নেবে নিমাই। না হে বাপু, বড্ড বেশি কথা কয়ে ফেলছি। তোমরা বরং এগিয়ে পড়ো। সন্ধে সাতটা এগারো মিনিটে মাহেন্দ্রক্ষণ আছে, এই সময়টায় যদি শহিদ হতে পারো তবে সোজা বৈকুণ্ঠলোকে চলে যেতে পারবে।”

মাধাই বিরক্ত হয়ে বলে, “যাচ্ছি মশাই, যাচ্ছি। ওঃ, আমাদের যমের মুখে ঠেলে দিতে যে ভারী আহ্লাদ আপনার!”

খুক করে একটু হাসির শব্দ হল। তারপর কুঁড়োরাম বলল, “কী করব বলল, আজকাল যে আমার রক্তারক্তি কাণ্ড দেখতে বড্ড ভাল লাগে!”