২. চেনা মানুষের মৃত্যুসংবাদ

চেনা মানুষের মৃত্যুসংবাদ পাওয়া মানেই একটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে যাওয়া। যেতে হবে, সময়োচিত শোকজ্ঞাপন করতে হবে। এড়াতে না পারলে শ্মশানবন্ধু হতে হবে। আনঅ্যাভয়েডবল।

বাসুদেব সেনগুপ্তের মৃত্যুসংবাদটা শবর পেল সকালে, কেফাস্টের সময়। বাসুদেব যে তার খুব প্রিয় বা শ্রদ্ধেয় মানুষ ছিলেন এমন নয়। কিন্তু সন্ড কটা এড়ানোও যায় না। তার পিসতুতো বোনের শ্বশুর। তা ছাড়া শবর যে ক্লাবে ফুটবল খেলত সেই ক্লাবের একজন বিশিষ্ট প্রাক্তন খেলোয়াড় ও কর্মকর্তা। ভালই চেনাজানা ছিল একটা সময়ে।

ব্রেকফাস্টটা পুরোটা খেতে পারল না শবর। উঠে পড়ল। যেতে হবে।

পুলিশ জিপে বেশি সময় লাগল না। লিফটে আটতলায় উঠে দেখল বাসুদেবের ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই রয়েছে। বিস্তর লোক জমা হয়েছে ঘরে। ক্লাবের লোকেরা এসেছে, বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়, আত্মীয়স্বজন তো আছেই। ঘরে থমথমে একটা ভাব। সামনের ঘরেই একটা ডিভানে বাসুদেবকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ফুল, মালা, ধূপকাঠি, বিভিন্ন ক্লাব বা কর্মকর্তাদের দেওয়া ফুলের চাকা ডিভানের গায়ে দাঁড় করানো।

ঘটনাটা দুঃখজনক। ফোনে বাসুদেবের বড় ছেলে বলেছিল, লিফটেনা উঠে বাসুদেব হেঁটে উঠছিলেন। কমজোরি হার্ট ওই পরিশ্রম নিতে পারেনি। সাততলার গোড়াতেই বাসুদেব হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। রাত দশটা অবধি কেউ ঘটনাটা টের পায়নি। কারণ ফ্ল্যাটবাড়িটার অধিকাংশই খালি, লোক এখনও আসেনি৷ দশটাতেও স্বামী না ফেরায় শিখাদেবী বেরিয়ে এসে লিফটে নীচে নামেন। দারোয়ান কিছু বলতে পারেনি। ছ’তলার নন্দীবাবু রাত সাড়ে দশটায় ফিরে বাসুদেবকে দেখতে পান। তিনিই শিখাকে খবর দেন।

ঘরে কান্নাকাটি তেমন কিছু নেই। বাসুদেবের স্ত্রী সোফায় বসে আছেন, দুপাশে দু’জন মহিলা। শিখার মুখখানা থমথমে এই মাত্র। ছেলে অর্কদেব আর বুদ্ধদেব একটু গম্ভীর মাত্র। মেয়ে সুপর্ণা একটা সোফায় বসে চোখে রুমাল চাপা দিয়ে মাথা নিচু করে আছে।

শবর শিখার কাছেই এগিয়ে গেল।

স্যাড, মাসিমা।

শিখা বিমর্ষ গলায় বলল, কী করে যে হল!

উনি লিফট থাকতে হেঁটে উঠছিলেন কেন?

কী করে বলব? শরীর নিয়ে খুব বড়াই ছিল তো? হয়তো শক্তি পরীক্ষা করতে চাইছিল।

স্ট্রেঞ্জ!

একজন ক্রনিক হার্ট পেশেন্ট লিফট থাকতেও হেঁটে আটতলা উঠতে চাইবে কেন সেটা একটা জরুরি প্রশ্ন। কিন্তু সেটা নিয়ে আর মাথা ঘামানোর মানে হয় না।

একজন বিরলকেশ ত্রিশ-বত্রিশ বছরের মজবুত চেহারার লোক দরজার কাছাকাছি দাঁড়ানো। লোকটা একটু এগিয়ে এসে বলল, লিফটটা সার্ভিসিং হচ্ছিল বলে উনি হেঁটে উঠছিলেন। আমাদের তো উনিই খবরটা দিলেন যে, লিফটটা সার্ভিসিং হচ্ছে।

শবর বলল, ও।

লোকটা উপযাচক হয়েই বলল, আমরা অবশ্য নীচে নেমে সার্ভিসিং-এর লোকদের দেখতে পাইনি। তবে লিফটের দরজাটা খোলা ছিল।

আপনি কি এ বাড়ির ফ্ল্যাটওনার?

হ্যাঁ। আমি চারতলায় থাকি। ইন ফ্যাক্ট বোধহয় আমরাই ওঁকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখতে পাই। উনি বেশ ঘামছিলেন আর হাফাচ্ছিলেন। আমরা নামবার সময় ওঁর কথাই আলোচনা করছিলাম।

আমরা মানে কারা?

আমি, আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে। আমরা কাল সন্ধেবেলা একটা নেমন্তন্নে যাচ্ছিলাম। লিফটের সামনেই ওঁর সঙ্গে দেখা।

আপনার নাম?

বিরহ মৌলিক।

অর্ক একরকম বন্ধুর মধ্যেই পড়ে। শবরের সঙ্গে অর্কর বেশ ভাব আছে। এর বউ মধুমিতাই তার পিসতুতো বোন। অর্ক এগিয়ে এসে বলল, দারোয়ান কিন্তু বলছে কাল লিফট সার্ভিসিং করতে কারও আসার কথা সে জানে না। বাবা যখন সন্ধেবেলা ফিরেছিল তখন দারোয়ানটা ছিল না, চা খেতে গিয়েছিল। সে ফিরে এসে লিফটে কাউকে দেখেনি। তবে সেও বলছে, দরজাটা খোলা ছিল দেখে সে বন্ধ করে দেয়। এনি ওয়ে, ব্যাপারটা ডিসগাস্টিং। নতুন লিফট, তার আবার সার্ভিসিং-এর কী দরকার হল বুঝি না।

শবর একটু কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর বলল, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।

অর্ক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, কী আর করা যাবে। তবে লিফট যখন চলছে না তখন বাবা একটু অপেক্ষা করলে পারত। কারণ, ঘটনার আধ ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচতলার মিস্টার সাহা ফিরে আসেন। তিনি লিফটেই উঠেছেন।

শবর ব্যাপারটা তেমন মাথায় নিল না। যদিও তার মাথার ভিতরে কয়েকটা যুক্তি ঠিকমতো পারম্পর্যে আসছিল না, তবু সে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে চাইল মন থেকে। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মানেই হয় না।

একটু বাদে ঘরে ভিড় আরও বাড়ল। খাটটাট এসে গেছে। নীচে গাড়িও প্রস্তুত। ভিতরের ঘর থেকে মধুমিতা বেরিয়ে এসে শবরকে বলল, টুকুদা, তুমি কি শ্মশানে যাবে?

না রে, আমার কিছু জরুরি কাজ আছে। অনেক লোক দেখছি, আমার কি যাওয়ার দরকার?

না না, কোনও দরকার নেই। আমি ভাবছিলাম, শ্বশুরমশাই তো গেলেন, এরপর কী হবে। শুনছি, ঢাকুরিয়ার ভাশুর আর দেওররা নাকি হাঙ্গামা করতে পারে। তুমি বোধহয় জানো না যে, ঢাকুরিয়ার বাড়িটা থেকে শ্বশুরমশাই আমার খুড়তুতো আর জেঠতুতো দেওর ভাশুরদের বঞ্চিত করেছিলেন।

একটু আধটু শুনেছি। হাঙ্গামা করার কী আছে? দেওয়ানি মামলা, আদালতে ফয়সালা হবে।

মামলা তো হয়নি। তাতে নাকি লাভ নেই।

তা হলে আর হাঙ্গামা করে কী লাভ?

শাশুড়ি তো এই ফ্ল্যাটে একা থাকবেন। উনি ভয় পাচ্ছেন, ওরা এসে হামলা করলে উনি তো কিছু করতে পারবেন না। উনি পুলিশ প্রোটেকশনের কথা বলছিলেন। তুমি কিছু করতে পারবে?

শবর মাথা নেড়ে বলে, এক্ষেত্রে পুলিশ অ্যান্টিসিপেটরি প্রোটেকশন দেয় না। তবে উনি সিকিউরিটি গার্ড রাখতে পারেন। কিন্তু তার দরকারটা কী? এত বড় ফ্ল্যাট, তোর এসে থাকলেই তো পারিস।

না বাবা, আমরা আলাদা আছি আলাদাই ভাল।

তোর দেওর বুদ্ধদেব তো বিয়ে করেনি, তো সে এসে মায়ের সঙ্গে থাকুক। বাস্তবিকই তো, এত বড় ফ্ল্যাটে উনি একা থাকবেন কী করে!

বুদ্ধদেব? তাকে তো চেনো না। আমার কর্তাটি তার বাবাকে পছন্দ করত না ঠিকই, কিন্তু ঘেন্নাও করত না। বুদ্ধদেবের আবার বাবার ওপর এত রাগ যে, বাবা যে বাড়িতে বাস করত সে বাড়িতেও সে বাস করবে না।

বাসুদেব সম্পর্কে শবর খানিকটা জানে। একসময়ে ভাল খেলোয়াড় ছিলেন বটে, কিন্তু জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বোধহয় আদ্যন্ত স্পোর্টসম্যান ছিলেন না। উপরন্তু অসম্ভব দাম্ভিক আর বদমেজাজিও ছিলেন। সে মধুমিতার কাছেই শুনেছে, স্ত্রীর সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল খুব খারাপ। পরিবারের ওপর নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব করতে চাইতেন বলে অর্ক আর বুদ্ধ বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। মেয়ে সুপর্ণাও বাপের বাড়িতে বিশেষ আসে না। কারণ, কী একটা মতবিরোধ হওয়ায় বাসুদেব নাকি জামাই শিবাজীকে জুতোপেটা করার হুমকি দিয়েছিলেন। মেগালোম্যানিয়াকদের সৌজন্যবোধ কমই থাকে। এরা নার্সিসিজমের করুণ শিকার। না পারে অন্যকে আপন করতে, না পারে নিজেকে অন্যের মধ্যে সঞ্চার করতে। ফলে এরা একা হয়ে যায়। বাসুদেবকে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় হচ্ছে। তাকে ঘিরে বেশ জমাট একটা ভিড়।

শবর বলল, তোর শাশুড়ি যাদের ভয় পাচ্ছে তাদের নাম আর ঠিকানা আমাকে একটা কাগজে লিখে দিস। দেখব।

মধুমিতা বলল, সবাই অ্যাগ্রেসিভ নয়। গোপাল বলে একজন আছে সে-ই একটু বেশি ভোকাল। আর শিবশঙ্কর। দু’জনেই আমার সম্পর্কে ভাশুর।

তুই চিনিস ওদের?

চিনি। কয়েকবার দেখেছি।

ভয় দেখাত নাকি?

ও বাবা, খুব ভয় দেখাত। লাশ ফেলে দেওয়ার কথাও বলত। শ্বশুরমশাইকে মুখের ওপরই গোপাল একদিন বলেছিল। শ্বশুরমশাই তেড়ে মারতে গিয়েছিলেন। ওঃ, সে কী কাণ্ড!

শবর একটু হাসল। বলল, এরকম ঘরে ঘরে হয়। অত ভাববার কিছু নেই। আমার মনে হয় না ওরা তোর শাশুড়ির ওপর হামলা টামলা করবে।

তুমি একটু থ্রেট করলে হয়তো ভয় পাবে।

উলটোও হতে পারে। থ্রেট করলে ইগোতে লাগবে। তখন হয়তো অ্যাগ্রেশনের রাস্তা বেছে নেবে। হিউম্যান সাইকোলজি বড় পিকিউলিয়ার।

মধুমিতা ভয় পেয়ে বলল, ও বাবা, তা হলে থাক। সত্যিই তো, ভয় দেখালে আবার উলটো বিপত্তি হতে পারে। গোপাল আবার ভীষণ গুন্ডা টাইপের।

দরজা দিয়ে তিন-চারজন ঢুকতেই মধুমিতা চাপা গলায় বলে উঠল, ও মা! ওই তো ওরা!

শবর নিস্পৃহ চোখে চেয়ে দেখল, গম্ভীর মুখের চারজন যুবক এবং অগ্রভাগে একজন বৃদ্ধ। সে জিজ্ঞেস করল, বুড়ো মানুষটি কে?

জেঠশ্বশুর।

গোপাল কোন জন?

সবুজ টি-শার্ট, মোটা গোঁফ।

গোপাল খুব লম্বা নয়, বেশ তাগড়াই চেহারা, তবে ভুঁড়ি আছে। পুরু ঠোঁট এবং মোটা গোঁফ। চোখে মুখে প্রবল স্মার্টনেস এবং আত্মবিশ্বাসের ছাপ। চারজনের কারও মুখেই বিশেষ শোক নেই। তবে বুড়ো মানুষটি কাঁদছেন। চোখ লাল। কান্নাটা নকল বলে মনে হল না শবরের।

বৃদ্ধটি তার মৃত ভাইকে কিছুক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে আদর বা আশীর্বাদ করলেন। তারপর শিখার কাছে গিয়ে একটু বসলেন পাশের সোফায়। বড় ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল বৃদ্ধকে। শিখার সঙ্গে তার কিছু কথাবার্তা হচ্ছিল। মৃদু স্বরেই।

শবর বলল, তোর শাশুড়ি বেশ শক্ত ধাতের মানুষ। স্বামী মারা যাওয়ায় ভেঙে পড়েনি তো।

মধুমিতা একটু মুখ বিকৃত করে বলল, দু’জনের সম্পর্ক তো ছিল বিষ। কঁদবে কী, মনে মনে হয়তো খুশিই হয়েছে। যা হাড়-জ্বালানো মানুষ ছিলেন শ্বশুরমশাই, বাব্বাঃ।

বাসুদেবকে নামানো হচ্ছে নীচে। একবার মৃদু হরিধ্বনি সহকারে খাট উঠে গেল কয়েকজনের কাঁধে, শবর লক্ষ করল গোপালও কাধ দিয়েছে। ঘনঘন ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছিল। দরজার সামনে একটু থমকাল শববাহকেরা। তারপর ভিড়টা বেরিয়ে গেল।

ধীরে ধীরে বেশ ফাঁকা হয়ে গেল ঘর।

শবর শিখার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

শিখা একদা সুন্দরী ছিলেন, এখনও আছেন। বয়স কম করেও পঞ্চান্নটঞ্চান্ন তো হবেই, বেশিও হতে পারে। কিন্তু এখনও বেশ ছিপছিপে এবং মুখশ্রীতে বার্ধক্যের বলিরেখা বা চামড়ার শিথিলতা নেই। বয়সের অনুপাতে তাকে বেশ কমবয়সিই লাগে।

শিখা মুখ তুলে বললেন, তুমি কি এখনই চলে যাবে?

হ্যাঁ মাসিমা, জরুরি কাজ আছে।

মাঝে মাঝে একটু খোঁজ নিয়ো। বড্ড একা হয়ে গেলাম তো!

বুড়ো মানুষটি শূন্য দৃষ্টিতে বসে ছিলেন। একথা শুনে বললেন, একা কেন বউমা, তোমার তো জনের অভাব নেই।

শিখা যেন একটু অস্বস্তি বোধ করলেন।

শবর আর দাঁড়াল না। ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল, চলি, মাসিমা। লিফটেই নীচে নেমে এল সে। শববাহকদের আগেই। কারণ ওরা সিঁড়ি বেয়ে নামছে। দেরি হবে। নীচে ফটকের সামনে পাড়ার লোকজনের একটু জটলা, ফুল দিয়ে সাজানো কাঁচের গাড়ি ঘিরে ভিড়।