২. চুরাশি বছরের বৃদ্ধ

খবরটা দূতের মুখে পৌঁছে গিয়েছিল প্রাসাদে। চুরাশি বছরের বৃদ্ধ রাজা লক্ষণ সেন যখন সবে দু’পাত্র পান করে বিশ্রাম নেবেন বলে ভাবছিলেন তখন তাঁর শ্যালক ঝড়ের মতো ঘরে প্রবেশ করল, সর্বনাশ আসছে, এখনই আমাদের এখান থেকে রওনা হতে হবে।

বৃদ্ধ বয়সে নবীনা স্ত্রীর অনেক আবদার সহ্য করতে হয়। লক্ষণ সেনকেও করতে হয়েছিল। তা ছাড়া শরীরের কারণেও স্ত্রীর আবদারে শ্যালককে রাজ্যশাসনের কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এই শ্যালকটির গুণের শেষ নেই, অযথা নাটক করতে পছন্দ করে। সেন বংশের রাজা বল্লাল সেনের পুত্র বৃদ্ধ লক্ষণ সেন বলল, আঃ, এখন আমার নিদ্রা যাওয়ার সময়, তোমার রসিকতা পছন্দ করছি না।

একদম রসিকতা নয়। এইমাত্র খবর এসেছে ভয়ংকর দ্রুতগামী জন্তুর পিঠে চড়ে যবনরা নদী পেরিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করেছে। তাদের জন্তুদের খুরের ধাক্কায় ধুলোর ঝড় উঠেছিল। ওদের সংখ্যা কত জানা যাচ্ছে না, কিন্তু লড়াই করতে যাওয়া মানে আত্মহত্যা করা। আমি ইতিমধ্যে বজরা, নৌকা প্রস্তুত করতে আদেশ দিয়েছি। আপনি তৈরি হন। মধ্যরাতেই আমাদের এই জায়গা থেকে চলে যেতে হবে।

বৃদ্ধ রাজা সোজা হলেন, চলে যাব? অন্য কোনও–।

তাকে থামিয়ে দিয়ে তার শ্যালক বলল, কোনও পথ নেই। আমি চাই না আমার বোনের স্বামীর অপঘাতে মৃত্যু হোক।

কিন্তু এখান থেকে গৌড়ে যেতে বজরা, নৌকোর কী প্রয়োজন?

গৌড়ে যাব না। সেখানে যেতে চাইলে স্থলপথে, যবনরা আমাদের ধরে ফেলবে। আমরা ভাগীরথী নদী দিয়ে পূর্ববঙ্গে চলে যাব। তারপর সমুদ্রের ধার দিয়ে বরিশালে পৌঁছে যাব। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে মেঘনা নদী দিয়ে ঢাকার কাছাকাছি সোনার গ্রামে পৌঁছাতে পারলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারব। ওখানে আপনার যে প্রাসাদ আছে তা অত্যন্ত সুরক্ষিত।

শ্যালকের কথায় লক্ষণ সেনের মনে পড়ল। বহুকাল তিনি তার রাজ্যের ওই অঞ্চলে যেতে পারেননি। হ্যাঁ, সোনার গ্রামে পৌঁছালে তিনি নিরাপদেই থাকবেন। কিন্তু তার শরীরে হেমন্ত সেন, বিজয় সেন, বল্লাল সেনের রক্ত আছে। সেই তিনি চোরের মতো নিজের রাজত্বের এই অংশ ছেড়ে চলে যাবেন? কিন্তু অশক্ত শরীর নিয়ে রুখে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। রাত একটু গম্ভীর হলে নির্বাচিত সৈনিক, কর্মচারীদের নিয়ে শ্যালক তাকে বজরায় তুলে বিশ্রাম নিতে বললেন। তার নবীনা রানি দ্বিতীয় বজরায় অন্যান্য মহিলাদের সঙ্গে যাত্রা শুরু করলেন। তাদের পেছনে আরও তিরিশটি বিশাল নৌকোয় যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে সৈনিক ও কর্মচারীরা নবদ্বীপ ত্যাগ করে অন্ধকারে চুপিসারে নদীর মাঝখান দিয়ে যাত্রা শুরু করল। সামনে অনিশ্চয়তা কিন্তু পাশের জঙ্গলে ওৎ পেতে থাকা নিশ্চিত মৃত্যুর চেয়ে সেটা অনেক বেশি স্বস্তির। সেন বংশের শেষ রাজা অন্ধকারে দক্ষিণবঙ্গ ত্যাগ করলেন।

সকাল হতেই দুশো অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে তাদের নেতা চলে এল মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির কাছে। নেতার নাম আলি মর্দান খিলজি। সম্পর্কে দূর সম্পর্কের আত্মীয়। দুর্দান্ত যোদ্ধা এবং অনুগত। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি বললেন, আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। সব সৈনিক সুস্থ ভাবে আসতে পেরেছে তো?

হ্যাঁ, কারও কোনও সমস্যা হয়নি। আপনি আদেশ করলে আমরা যে কোনও কাজ করতে তৈরি আছি। আলি মর্দান বলল।

বেশ। তা হলে লক্ষণ সেনের দুর্গ দখল করা যাক। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আদেশ দেওয়ার সময় তার এক বিশ্বস্ত কর্মচারী সামনে এসে সেলাম করল, এইমাত্র দূত খবর নিয়ে এসেছে, লক্ষণ সেনের প্রাসাদে বৃদ্ধ বৃদ্ধা এবং কিছু পরিত্যক্ত মহিলা ছাড়া আর কেউ নেই। কাল গভীর রাতে রাজা তার দলবল ধনসম্পত্তি নিয়ে নদীপথে স্থানত্যাগ করেছেন। তাই প্রাসাদ দখল করতে কিছুমাত্র সমস্যা হবে না।

কথাগুলো শোনামাত্র ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি। চিৎকার করে বললেন, এই খবরটা এখন দিতে এসেছে দূত? কেন কাল মধ্যরাত্রে দাওনি? এমন অকর্মণ্য অপদার্থ লোককে সঙ্গে রাখা মানে বিপদ ডেকে আনা। ওকে এখনই দূর করে দাও। আর, হ্যাঁ, নদীপথে রাজার নৌকা কতদূর যেতে পারে? আমরা স্থলপথে গিয়ে তাদের আক্রমণ করতে পারি না?

আলি মর্দান মাথা নাড়ল, এটা করলে খুবই ভাল হত। কিন্তু নদীর তীর ধরে যাওয়ার পথ নেই। অনেক ঘুরে যেতে হবে। ততক্ষণে ওরা সমুদ্রে পৌঁছে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা দেবকোটে পৌঁছে গেলে সমস্ত বঙ্গদেশ আমাদের অধিকারে আসবে। রাজা লক্ষণ সেন যেখানেই লুকিয়ে থাকুক তাকে ঠিক খুঁজে বের করব।

হু। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি কথাগুলো মানতে বাধ্য হলেন। তাঁর খুব খারাপ লাগছিল। যুদ্ধ না করে অনায়াসে প্রাসাদ দখল করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। সব কিছু আলুনি মনে হচ্ছিল তার।

*

এ এক বিস্ময়। এই কয়েক বছর আগে কিছু জানার জন্যে এর কাছে, ওর কাছে ছুটতে হত। প্রত্যেক শহরেই এক-একজন সিধুজ্যেঠা থাকেন। তারা অনেক কিছু জানলেও সবজান্তা নন। কিন্তু গুল খুললে ভূগোল এবং ইতিহাস হাতের মুঠোয় চলে আসে। অর্জুন ল্যাপটপের সামনে এসে বোম টিপতেই এক লহমায় আটশো বছর পিছিয়ে যেতে পারল। কিন্তু এখনও একটা ধন্দ আছে। লক্ষণ সেন নবদ্বীপ ছেড়েছিলেন কোন সালে? বারোশো এক না বারোশো চার? দক্ষিণবঙ্গ ত্যাগ করে লক্ষণ সেনের চলে যাওয়ার পর থেকে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির বঙ্গ দখল সহজ হয়ে গেল। প্রায় দশ হাজার সৈনিক নিয়ে তিনি গৌড় দখল করেন। তার পরের দুই বছর ধরে তিনি তার নতুন রাজত্বের ভিত শক্তিশালী করতে অনেকগুলো প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করেন যার প্রতিটির দায়িত্ব দিলেন একজন তুর্কি সেনাপতিকে। এই সময়টায় মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি অনেক মসজিদ নির্মাণ করেন, অনেক মাদ্রাসা তৈরি করেন এবং নিম্নবর্গের হিন্দুরা যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা অত্যাচারিত, তাদের মুসলমান ধর্মে ধর্মান্তরিত করেন। এই বঙ্গদেশে মুসলমান ধর্মের গোড়াপত্তন করার কৃতিত্ব তার।

এইসময় তার মনে হল তিব্বত দখল করতে হবে। তার কাছে খবর এসেছিল পৃথিবীর অর্ধেক মণিমানিক্য হিরে জহরত তিব্বতে লুকিয়ে রাখা আছে। তিব্বতকে কোনও বিদেশি তেমন করে জানতে পারেনি। তাই তিব্বত দখল করতে পারলে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠা সম্ভব হবে। এই অভিযানে তাকে সাহায্য করার জন্যে তিনি কামরূপের রাজার কাছে অনুরোধ রাখেন। বর্তমানের অসমকে তখন কামরূপ বলা হত। কিন্তু মধ্য বর্ষাকাল এবং শীত আসন্ন বলে কামরূপের রাজা তাকে একটি বছর অপেক্ষা করতে উপদেশ দেন যা শুনতে রাজি ছিলেন না মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি। তিনি ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন। এই অধৈর্য হয়ে শক্তি হারানোর ঘটনা ইতিহাসে বারংবার ঘটেছে। রাজা বাদশা বা সেনাপতিরা যত ক্ষমতাবান হন না কেন প্রকৃতি বিরূপ হলে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। অর্জুন যা পড়ল তা আটশো বছর আগে ঘটে গেলেও মাত্র বাহাত্তর-চুয়াত্তর বছর আগে তার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। হিটলারের সাইবেরিয়া আক্রমণ আর মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির তিব্বত অভিযানের ফলশ্রুতিতে কোনও পার্থক্য নেই।

বারোশ ছয় সালে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি তিব্বত দখল করতে প্রস্তুত হন। এবার তিনি বিশ্বস্ত অনুচর আলি মর্দান খিলজিকে সঙ্গে নিলেন না। তার অনুপস্থিতিতে রাজত্ব দেখাশোনার দায়িত্ব দিলেন।

বিশাল সৈন্যবাহিনী, যাদের পুরোভাগে কয়েকশো অশ্বারোহী সৈন্য এবং অন্যান্য সেনাপতিরা মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজিকে অনুসরণ করছিল। একজন মেচ উপজাতির আদিবাসী, যাকে মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করার পর আলি নামে ডাকা হয় সে গাইডের কাজ করছিল। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি যাচাই করে দেখেছেন ওই লোকের নখদর্পণে রয়েছে পাহাড়ি পথগুলো। পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে ওঁরা একটি নদীর পাশ দিয়ে বারোটি থামের ওপর তৈরি পাথরের সেতু অতিক্রম করলেন। অর্জুনের মনে হল ওই নদীর নাম তিস্তা। শিলিগুড়ি থেকে সেবক হয়ে তিস্তার ধার দিয়ে এগিয়ে ওপারে যেতে হয় তিস্তাবাজারের সেতু পার হয়ে। আটশো বছর আগে বোধহয় ওদিকের কোনও একটা জায়গায় পাথরের সেতু ছিল।

প্রায় পনেরো দিন মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির সৈন্যবাহিনী দিনে পথ চলে, রাতে বিশ্রাম নিয়ে ছুম্বি উপত্যকায় পৌঁছাল। এইসময় শীত প্রচণ্ড হয়েছে। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির সৈন্যবাহিনী তিব্বতি গ্রামগুলোতে লুঠপাঠ শুরু করল। মহম্মদ নিজে কয়েকটি বৌদ্ধ মনেষ্ট্রি দখল করে যাবতীয় সম্পদ করায়ত্ত করলেও শীত সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়ল। এই অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে তিব্বতিরা ঐক্যবদ্ধ হল, তারা প্রতি আক্রমণ শুরু করল। তখন বরফ পড়ছিল। সেনাবাহিনীর প্রচুর যোদ্ধা মারা গেল। ক্ষতির পরিমাণ দেখে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আদেশ দিলেন ফিরে যেতে। কিন্তু পাহাড়ি পথে তিব্বতিদের গরিলাহানা তীব্রতর হওয়ায় সৈন্যরা অসহায় হয়ে পড়ল। তাদের খাবার পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য হল নিজেদের ঘোড়া মেরে ফেলে তার মাংস খেতে। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি যখন সেই পাথরের সেতুর কাছে ফিরে আসতে সক্ষম হলেন তখন দেখলেন তিব্বতি গেরিলারা সেতুর অনেক স্তম্ভ ধ্বংস করে ফেলেছে ফলে সেতু প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। এই ভয়ংকর নদী পার হওয়া অসম্ভব বুঝে তিনি কাছাকাছি একটি মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই মন্দির যখন শত্রুপক্ষ ঘিরে ফেলল তখন তার সৈন্যরা মরিয়া হয়ে নদী পার হতে চাইলে প্রচুর সৈনিক এবং ঘোড়া জলের স্রোতে ভেসে গেল। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি যখন কোনওমতে নদী পার হয়ে এলেন তখন তার সৈন্যবাহিনীর মাত্র একশোজন জীবিত ছিল। কিন্তু নদী পার হওয়া সম্ভব হত না যদি না তার সেনাপতি মহম্মদ শিরান খিলজি সঙ্গে থাকতেন। মহম্মদ শিরান তার সেনাপতিকে মৃত ঘোড়ার আড়ালে ভাসিয়ে রেখে নদীর ওপারে নিয়ে আসেন। এই বিপর্যয়ে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন শত্রুপক্ষের চোখের আড়ালে তাকে কিছুদিন লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দেয় তার পথ প্রদর্শক আলি। মহম্মদ শিরান তাকে একটি গুহায় নিয়ে যান যা লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। গুহাটিকে খুব পছন্দ হয় মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির।

.

এই পর্যন্ত জানার পর অর্জুনের ধন্দ বাড়ল। গুহাটি কোথায়? যদি সেটা তিব্বতের এলাকায় হয় তা হলে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব হবে। চিন সরকার তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি দিতে যেসব প্রশ্ন করবে তা সুখকর হবে না। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি যে পথ দিয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন তার একটা ম্যাপের কথা জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বলেছিলেন। এবং একথাও বলেছেন যে সেটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয় না। এখন নেট থেকে যে ম্যাপটা অর্জুন পেল তা অনেকটা এইরকম–শিলিগুড়ি থেকে কাঠমান্ডু হয়ে গ্যাংটক হয়ে লাসায় পৌঁছায় ট্যুরিস্টরা। এটাই সহজ পথ। অবশ্যই মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির সময়ে এই পথ ছিল না। অনেক সন্ধানের পর একটি প্রাচীন পথের সন্ধান পেল অর্জুন। কালিম্পং থেকে জেনেপ লা হয়ে নাথুলা দিয়ে তিব্বতে প্রবেশ করা যেত। তিব্বতি ব্যবসায়ীরা এই পথেই যাতায়াত করত। নাথুলা থেকে ফারি শুরু হয়ে গ্যাংসে, ক্যারস, চুসুই হয়ে তিব্বতের রাজধানী লাসায় পৌঁছে যাওয়া যেত। অর্জুনের মনে হল এই পথটাই পথপ্রদর্শক আলি মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজিকে চিনিয়ে দিয়েছিল। অর্জুন ম্যাপটা একটা কাগজে এঁকে নিল।

.

ম্যাপটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও অর্জুনের অনুমানে এল না যদি ওই তিব্বতি ব্যাবসাদারদের ব্যবহৃত পথ ধরে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি তিব্বতে প্রবেশ করে থাকেন তা হলে ফেরার পথে কোন জায়গার গুহায় তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন। যেখানে তিনি কিছুদিন ছিলেন সেখানেই ধনরত্ন লুকিয়ে রেখে আসা স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ব্যাপারটা গুলিয়ে দিচ্ছে ওই নদীর কারণে। অভিযানের সময়ে কি মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি এবং তার সৈন্যবাহিনী তিস্তা নদী পার হয়েছিলেন? ফেরার সময় যে বিপর্যয় হয়েছিল, যে নদী পার হতে তিনি তার বিপুল সৈন্যদের হারিয়েছেন সেটাও কি তিস্তা নদী? কিন্তু তিস্তা নদী বয়ে গিয়েছে কালিম্পং-এ যাওয়ার অনেক আগে। সেই জায়গা কখনওই তিব্বতের অধিকারে ছিল না। সিকিম-ভুটান ভারতের ওই নদীর পাশে এসে তিব্বতিরা কী করে আক্রমণ করবে? ওখানে আসার অধিকার তাদের ছিল না। বরং ওই অঞ্চলের কিছুটা কামরূপের রাজার অধীনে ছিল। বারোটি থামের ওপর তৈরি পাথরের সেতু কোন নদীর ওপরে ছিল? অর্জুনের প্রথমে মনে হচ্ছিল ওটা তিস্তাবাজারের কাছে তিস্তা নদীর ওপর থাকতে পারে। কিন্তু তিব্বতিরা সেই নদীর কাছে আসতে পারে যে নদী তাদের অধিকারে ছিল। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজিকে বিতাড়িত করেছে তারা, নদী অতিক্রম করে আক্রমণ করেনি। তা হলে নদীটি তিস্তা নয়। নাথুলা থেকে ফারি যাওয়ার পথে সেইসময় খরস্রোতা পাহাড়ি নদী নিশ্চয়ই বয়ে যেত। হঠাৎ মাথায় এল, সেই নদীর নাম রঙ্গিত নয় তো যে পরে কালিম্পং-এর কাছে এসে তিস্তায় মিশেছে। অর্জুন ঠিক করল অধ্যাপক শরৎ মাইতির সঙ্গে দেখা করবে। ওঁর লেখা বইয়ের নাম তিস্তার উৎস সন্ধানে। উনি নিশ্চয়ই রঙ্গিতের খবর রাখবেন।

কিছুদিন মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজিকে নিয়ে এমন নিমগ্ন ছিল অর্জুন যে বইপত্র আর ল্যাপটপের বাইরে কোনও বিষয়ে মন দেয়নি। এই সময় হঠাৎ জনাব কামরুজ্জমানের ফোন এল, আপনি কতদূর এগিয়েছেন?

অর্জুন বলল, অনেকটাই জেনেছি। আপনারা কবে আসতে পারবেন?

আমার মেয়ে রোজি এখন নার্সিংহোমে। ও বাড়িতে ফিরবে আগামীকাল। তার কয়েকদিনের মধ্যেই যেতে পারব। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি বললেন।

রোজির কী হয়েছিল?

কেউ ওকে গুলি করেছিল। ও নিজেই গাড়ি চালায়। একেবারে জনবহুল জায়গা ঘুলঘুলাইয়ার সামনে ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। খুব অল্পের জন্যে গুলি বুকে না লেগে ডান হাতের কনুইয়ের কাছে লাগে। আততায়ী। ধরা পড়েনি। পুলিশ চেষ্টা করছে খুঁজে বের করতে। হাসপাতালেও পুলিশ পাহারায় ছিল। আগামীকাল বাড়িতে এলে ও নিরাপদে থাকবে। তবে হাতের হাড় ভেঙেছে সেই সঙ্গে মানসিক আঘাতও পেয়েছে। এখন অন্তত একমাস ওকে বাড়িতেই থাকতে হবে।

ওকে কে গুলি করল? কেন করল?

সেটা আপনাকে সাক্ষাতে বলব। রোজি বাড়িতে ফিরে আসার পর আমি সব বুঝে দিন ঠিক করব। মিস্টার অর্জুন, আমি ফিনানশিয়াল সাপোর্ট দেব কিন্তু বাকি সবকিছু আপনাকে অর্গানাইজ করতে হবে।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

শুধু একটাই কৌতূহল, সেই গুহাটি কোথায় তা কি অনুমান করেছেন?

না। অর্জুন স্পষ্ট জানাল।

.

গ্যাংটকের ক্যাপিটাল হোটেলে দুটো ঘর বুক করেছিলেন জনাব কামরুজ্জমান খিলজি। ইন্টারনেটে এই সুবিধে নেওয়ার সময় তাকে নিজের এবং অর্জুনের আধার নাম্বার দিতে হয়েছিল। অর্জুন সোজা গ্যাংটক চলে যাবে। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি লখনউ থেকে দিল্লি হয়ে বাগডোগরায় নামবেন। সেখানে অর্জুনের পরিচিত ড্রাইভার গনেশ সিং গাড়ি নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করবে। অর্জুন গনেশকে বলে দিয়েছিল ভদ্রলোককে নিয়ে সোজা সেবক দিয়ে গ্যাংটকে চলে না এসে পাংখাবাড়ি দিয়ে কার্শিয়াং হয়ে ঘুমের কাছে গিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে পেশক-মংপু হয়ে তিস্তাবাজারে নামতে। এটা সে বলেছিল কারণ যদি কেউ বা কোনও দল জনাব কামরুজ্জমান খিলজিকে অনুসরণ করে তা হলে খেই হারিয়ে ফেলবে।

ক্যাপিটাল হোটেলে চেক ইন করে অর্জুন দেখল জনাব কামরুজ্জমানের পৌঁছাতে এখনও ঘণ্টা চারেক লাগবে। বাগডোগরায় প্লেন নামবে দেড়টার সময়। সোজা পথে এলে চারটের মধ্যে পৌঁছাতে পারতেন। ঘুরে আসবেন বলে পাঁচ বা সাড়ে পাঁচটা হয়ে যাবে। এই সময়টা কাজে লাগানো যাক। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে চকে চলে এল। চারপাশে সুন্দর সুন্দর দোকান, মাঝখানে বাঁধানো জায়গায় ট্যুরিস্টদের ভিড়। টিবেটিয়ান কিউরিও শপটা খুঁজে বের করতে একটুও অসুবিধে হল না। এই দোকানের মালিক একজন সিকিমিজ বৃদ্ধ যাঁর সঙ্গে অর্জুনের আলাপ হয়েছিল কালিম্পং-এ। চমৎকার বাংলা বলেন। নাম জনি ওয়াজ্জাপা। উপাধিটা সঠিক মনে রাখতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে অর্জুনের সন্দেহ আছে। মিস্টার জনির সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল শিলিগুড়িতে। তেনজিং নোরগে বাস টার্মিনাসে। বারবার যেতে বলেছিলেন গ্যাংটকে।

দোকানে বেশ ভিড়। বেশিরভাগই বিদেশি। তাদের কিউরিও কেনার খুব শখ। একটি তরুণ সিকিমিজ এগিয়ে এল, বলুন, কী চাইছেন?

মিস্টার জনি আছেন?

হ্যাঁ আছেন। কিন্তু দাদু এখন খুব ব্যস্ত। কী নাম আপনার?

অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকি।

ছেলেটি দোকানের ভেতরে চলে গেলে অর্জুন দেখল পরপর নানান সাইজের লাফিং বুদ্ধের মূর্তি এপাশে সাজানো রয়েছে। এগুলোকে দেখেই বোঝা যায় খুব সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে। কিউরিও বলা চলে না। ট্যুরিস্টরা ওই হাসিমুখের বুদ্ধমূর্তিকেই বেশি পছন্দ করছেন। ছেলেটি ফিরে এসে ইশারায় ওকে অনুসরণ করতে বলল। ক্রেতাদের পাশ কাটিয়ে অনেকটা এগিয়ে যেতেই বৃদ্ধকে দেখতে পেল অর্জুন। ওঁর পরনে টিবেটিয়ান পোশাক, মুখে স্বর্গীয় হাসি। হাত বাড়িয়ে অর্জুনের হাত ধরে জনি বললেন, তুমি যে আমাকে মনে রেখেছ তাতে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। কিন্তু আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিতে হবে। তুমি আমার ওই অফিসঘরে আরাম করে বসো, আমি আসছি।

ছেলেটিকে নিজেদের ভাষায় কিছু নির্দেশ দিতেই সে অর্জুনকে ওপাশের একটি ঘরের দরজা খুলে নিয়ে গেল। ছোট্ট ঘর, টেবিলের এপাশে দুটো চেয়ার, ওপাশে একটা। টেবিলের ওপর অনেকগুলো ফাইল সাজিয়ে রাখা আছে। ছেলেটি বলল, আপনি কী পছন্দ করেন? ঠান্ডা না গরম?

অর্জুন হাসল, ধন্যবাদ, একটু আগেই চা খেয়েছি, কিছু দরকার নেই।

আমার ঠাকুরদা খুশি হবেন না। ছেলেটি গম্ভীর হল।

আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলব।

আপনি কি টিভি দেখবেন?

না, ধন্যবাদ।

তা হলে ক্লোজ সার্কিট টিভি চালিয়ে দিচ্ছি। দোকানের ভেতরটা ভাল ভাবে দেখতে পারবেন। ছেলেটি এগিয়ে গিয়ে দেওয়ালের একটা নক্‌ টিপতেই সেখানকার কাঠের প্যানেল সরে গেল। একটা মনিটরে আলো ফুটতেই তার মধ্যে দোকানের ভেতরটা দেখতে পাওয়া গেল। অর্থাৎ বৃদ্ধ জনি এই ঘরে যখন বসেন তখন তার নজরে দোকানের সবকিছু ধরা পড়ে।

ছেলেটি বেরিয়ে গেল দরজা বন্ধ করে। অর্জুন সিসি টিভিতে দেখছিল ক্রেতাদের। বেশিরভাগই সাদা চামড়ার। ওরা কেউ জানেই না যে ওদের ছবি ক্যামেরায় উঠছে। একটি সুন্দরী মেয়ে, সম্ভবত আমেরিকান, ব্যাগ খুলে কিছু বের করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার অজান্তে কিছু মাটিতে পড়ে গেল। এই পড়ে যাওয়াটা মেয়েটির নজর এড়িয়ে গেল। যেটা সে চাইছিল সেটা বের করে পাশের মহিলার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। যেহেতু অর্জুন ব্যাপারটা মনিটারে দেখেছে তাই সে অস্বস্তিতে পড়ল। ঠিক তখনই একটা মোটাসোটা লোক দোকানে ঢুকল। দেখলেই বোঝা যায় বেশ শক্তি আছে শরীরে। বাউন্সারদের চেহারা এমন হয়ে থাকে। কিন্তু এই লোকটি বিদেশি নয়, বাঙালিদের চেহারা এরকম হয় না। লোকটা দোকানে ঢুকে যেভাবে চারপাশে তাকাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল কাউকে সে খুঁজছে। এই সময় জনিসাহেবের নাতিকে এগিয়ে যেতে দেখল অর্জুন। লোকটার সঙ্গে ওর কী কথা হল তা বোঝা গেল না। একটু ইতস্তত করে দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেল লোকটা।

তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন জনিসাহেব। আমার কাছে আপনি আজ প্রথমবার এলেন কিন্তু কিছু খেতে চাইছেন না, এটা কীরকম কথা? অবশ্য আমি কাউকেই খাওয়ার জন্যে জোর করি না। চেয়ারে বসে ভদ্রলোক বললেন, গ্যাংটকে কবে এসেছেন? বেড়াতে না কোনও কাজে?

জনিসাহেবের দিকে তাকাল অর্জুন। যেদিন প্রথম দেখেছিল সেদিনই ওর মনে হয়েছিল ভদ্রলোকের চেহারায় তিব্বতি এবং সিকিমিজ ছাপ আছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্নটা করা সৌজন্যে আটকায় বলে সে করেনি। কিন্তু এটাও মনে হয়েছিল, মানুষটির মধ্যে একটি ভালমানুষ বাস করে। অর্জুন বলল, ঠিকই ধরেছেন, কাজের সুবাদে এসেছি। আর ওই ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাই।

বলুন, আমি কী করতে পারি!

আমরা একটা গুহার সন্ধানে এসেছি। ওই গুহা আটশো বছর আগে ছিল। তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সমস্যা হল ওই গুহা গ্যাংটক থেকে লাসার মাঝখানে কোনও পাহাড়ে ছিল যা এখনও বোধহয় আবিষ্কৃত হয়নি। অর্জুন বলল, এই খোঁজার ব্যাপারে আমরা কীভাবে অনুমতি পেতে পারি?

জনিসাহেব বললেন, আপনি যদি কোনও ডুবুরিকে বলেন সমুদ্রের নীচ থেকে বিশেষ একটা ঝিনুক তুলে আনো কিন্তু সেই ঝিনুক সমুদ্রের কোথায় আছে তা জানি না তা হলেও বোধহয় তার সমস্যা কম হবে না। লাসা বর্ডার থেকে অনেক দূরে। চিন সরকার সেখানে যাওয়ার অনুমতি চট করে দিতে চায় না। দিল্লির চিনা দূতাবাসে ভিসার জন্যে কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হয়। ওঁরা যদি মনে করেন আপনার যাওয়ার পেছনে সঠিক কারণ আছে তা হলে আপনাকে ডেকে ইন্টারভিউ নেবে। তাতে সন্তুষ্ট হলে প্লেনে চেপে লাসায় যেতে পারবেন। অতএব সেই গুহা যা খুঁজতে আপনি এসেছেন তা যদি তিব্বতে থেকে থাকে তা হলে আমি কোনও সাহায্য ইচ্ছে থাকলেও দিতে পারব না।

যদি সিকিমের, মানে ভারতীয় এলাকায় থেকে থাকে?

তা হলে সরকারি অনুমতি পেতে অসুবিধে হবে না। নাথুলা অবধি যেতে তেমন কোনও ঝামেলায় পড়বেন না। সীমান্ত পর্যন্ত তো অনেকেই বেড়াতে যান। আপনারা কতজন যাবেন? জনিসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।

আমরা দু’জন। আর যাদের দরকার তাদের আপনি যদি ঠিক করেন!

তা হলে তো দলটা বড় হয়ে যাবে।

হ্যাঁ। একটা গুহাকে খুঁজে বের করতে বেশ কয়েকজনের সাহায্য দরকার হবে। খোঁড়াখুঁড়ির কাজে, তাবু, মালপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে লোক দরকার।

সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। কিন্তু এই যে আপনারা পাহাড়ে পাহাড়ে গুহা খুঁজবেন, এক জায়গায় কিছুদিন থাকতে হতে পারে এর জন্যে নিশ্চয়ই সরকারের অনুমতি নিতে হবে। সেটা চাইলে সরকারকে কারণটা বলতে হবে।

অর্জুন কয়েক মুহূর্ত ভাবল। জনাব খিলজি তাঁর পূর্বপুরুষের লুকিয়ে রাখা ধনরত্ন উদ্ধার করার জন্যে গুহা খুঁজবেন জানলে অফিসারদের কী প্রতিক্রিয়া হবে? খবরটা প্রচারিত হবেই এবং তা হলে আরও নতুন বিপদ ডেকে আনা হবে না তো! যে জনিসাহেবের মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমরা যদি গুহায় কথা না বলি?

বেশ, কিন্তু একটা বিশ্বাসযোগ্য কারণ দেখাতে হবে তো!’

আপনি মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির নাম শুনেছেন?

মাথা নাড়লেন জনিসাহেব, না। তিনি কী করেন?

অর্জুন সংক্ষেপে মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির পরিচয় দিয়ে বলল, আমার ক্লায়েন্ট মহম্মদ কামরুজ্জমান খিলজির পূর্বপুরুষ হলেন ওই ভদ্রলোক। দু’জনের মধ্যে প্রায় আটশো বছরের ব্যবধান। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি তিব্বত আক্রমণ করেছিলেন। অনেক ধনরত্ন সংগ্রহ করে দেশে ফিরে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঠান্ডা এবং তিব্বতি সেনাদের আক্রমণে কাহিল হয়ে একটি গুহায় আশ্রয় নেন। পরে ফিরে যাওয়ার সময় এই গুহার মুখ বন্ধ করে যান। সেই গুহায় কী রেখেছিলেন তিনি তা কেউ জানে না। ওঁর উত্তরাধিকারী সেই গুহা খুঁজে বের করতে চাইছেন। এই ব্যাপারে তিনি আমার সাহায্য চেয়েছেন। আজ বিকেলেই তিনি এই শহরে চলে আসবেন।

একটু ভাবলেন জনিসাহেব। তারপর বললেন, আটশো বছর আগের এই ঘটনার কথা আমরা ছাত্র অবস্থায় ইতিহাস বইতে পাইনি। যাঁরা প্রাচীন তিব্বত সম্পর্কে ভাল জানেন তারা বলতে পারবেন। মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, নাঃ, ওই গুহার কথা বলে আবেদন করা ভুল হবে। একটা কাজ করলে হয়, মিস্টার খিলজি তো আজই আসছেন?

হ্যাঁ।

কাল সকালে ওঁকে দিয়ে আবেদন করাতে হবে। ওঁর পূর্বপুরুষ যে পথ দিয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন সেই পথটা তিনি দেখতে চান। আটশো বছর আগে এলাকার গাড়ির রাস্তা ছিল না। পাহাড়ের ঘুরপথে যেতে হত। তাই মূল রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের ভেতর গিয়ে গুহা খুঁজতেই পারেন। ঠিক কিনা?

খুব ভাল বললেন। তাই করতে হবে। কিন্তু গাইড, মালবাহক, রান্নার লোক এবং খোঁড়াখুঁড়ির কাজ জানা কয়েকজনকে আপনি যদি ঠিক না করে দেন তা হলে আমার সমস্যা বাড়বে, অর্জুন বলল।

কোনও চিন্তা নেই। এ ব্যাপারে আমার ওই নাতি আপনাকে সাহায্য করবে। আমি ওকে পরে সব বুঝিয়ে দেব। জনিসাহেব বললেন।

অর্জুন বলল, আপনার অনেকটা সময় নিলাম। এখন ব্যাবসার সময়।

নো প্রবলেম।জনিসাহেব সিসি টিভির দিকে তাকালেন। এখন ক্রেতাদের ভিড় একটু কম। হঠাৎ অতি বৃদ্ধ একজনকে লাঠি হাতে দোকানে ঢুকতে দেখে জনিসাহেব উল্লসিত হলেন, আরে! মেঘ না চাইতেই জল। আপনাকে একটু আগে বলছিলাম প্রাচীন তিব্বত সম্পর্কে ভাল জ্ঞান যাদের আছে তারা আপনার কৌতূহল মেটাতে পারেন। ওই যে বৃদ্ধ ভদ্রলোককে দেখছেন ওঁর পোশাক দেখে আপনার নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে উনি তিব্বতি। তাই তো?

হ্যাঁ। শুধু পোশাক নয়, মুখের গড়ন, চুলের ধরন একই কথা বলছে। অর্জুন বলল।

কিন্তু উনি একশোভাগ বাঙালি।

অর্জুন চমকে ভদ্রলোককে দেখল। লম্বা মানুষ, বয়সের ভারে সামান্য কুঁজো হয়েছেন। কিন্তু ওঁর শরীর এবং ভঙ্গিতে এক ফোঁটা বাঙালিত্ব নেই। সে বলল, অবাক না হয়ে পারছি না।

ওঁর বয়স এখন পঁচাশির নীচে নয়। ভারত-চিন যুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত উনি লাসায় ছিলেন। ওখানেই জন্মেছেন, পড়াশুনো করেছেন। ওঁর স্ত্রীও তিব্বতি। সেসময় অনেক তিব্বতি ভারতে চলে এসেছিলেন আশ্রয়ের জন্যে। উনি আসেননি। না আসার কারণ ওঁর স্ত্রী তার বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে চাইছিলেন না। স্ত্রীবিয়োগের পর যখন এলেন তখন চিন সরকার তীব্র অত্যাচার করছে। ভারতে এসে উনি পড়াশুনা নিয়েই আছেন। ভারত সরকার ওঁকে তিব্বত বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে সম্মান দেখিয়েছে। জনিসাহেব ইন্টারকমের রিসিভার তুলে কাউকে বললেন, মিস্টার সিকদারকে অনুরোধ করে আমার ঘরে নিয়ে এসো।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, মিস্টার সিকদার?

হ্যাঁ। মিস্টার আর এন সিকদার। জনিসাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলেন দরজার কাছে। সেটা খুলে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বললেন, গুড আফটারনুন স্যার। আসুন, আসুন। কী সৌভাগ্য, আপনি আমার দোকানে বহুদিন পরে পায়ের ধুলো দিয়েছেন।

বাংলাটা আপনি মন্দ বলেন না মিস্টার জনি। আমি তো বাংলায় কথা বলার সুযোগই পাই না। মিস্টার সিকদার ভেতরে ঢুকলেন। অর্জুন দেখল, শুধু কুঁজো নয়, একটু খুঁড়িয়েও হাঁটেন উনি।

চেয়ার টেনে অর্জুনের পাশে বসতেই জনিসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, কী প্রয়োজন তা আমাকে ফোন করে দিলেই তো হত।

ফোনে কি সব কথা বলা যায়। আমি একটা বই খুঁজছি। লামার বইয়ের দোকানে খোঁজ করতে সে বলল অত পুরনো বইয়ের চাহিদা নেই বলে রাখে না। শেষ ছাপা হয়েছিল প্রথম মহাযুদ্ধের আগে। লামাই বলল আপনার দোকানে খোঁজ করতে। কিউরিও শপে বই বিক্রি হয় বলে তো শুনিনি। কিন্তু ওঁর মতে ওই সময়ের কপির তো এখন কিউরিও ভ্যালু তৈরি হয়েছে। আপনার এখানে থাকলেও থাকতে পারে। মিস্টার সিকদার কথা বলেন ধীরে ধীরে। শুনতে ভাল লাগে।

না। সেরকম বই আমার দোকানে নেই। কী নাম বইটির?

ইন্ডিয়া ভুটান ট্রেড রুট ঞ টিবেট।

আমি নাম শুনিনি।

আপনার শোনার কথা নয়। আমারও মনে ছিল না। কানে শুনেছি, চোখে দেখিনি। আজ সকালে দু’জন ভদ্রলোক এসেছিলেন আমার কাছে, তাঁদের অনুরোধ–। যাক গে, না পাওয়া গেলে আর কী করা যাবে!

অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। জিজ্ঞাসা করল, এখানকার স্টেট লাইব্রেরিতে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে না?

না ব্রাদার। থাকলে আমি তো জানতেই পারতাম। আর তা ছাড়া যারা এসেছিলেন তাদের ইন্টারেস্ট দু-চারশো বছরের রুট ম্যাপ নয়। একেবারে আটশো বছর আগের ব্যাপারস্যাপার ওঁরা জানতে চান। আর এন সিকদার তাঁর ঘড়ি দেখলেন, আচ্ছা, আমাকে এবার যেতে হবে।

আটশো বছর আগের ব্যাপার নিয়ে দু’জন লোক ওঁর কাছে গিয়েছেন শোনামাত্র অর্জুন সোজা হয়ে বসেছিল। সে বলল, স্যার, আপনার সঙ্গে একটা বিষয়ে কথা বলতে চাই।

সঙ্গে সঙ্গে জনিসাহেব বললেন, ওহহ! আমারই ভুল হয়েছে। অর্জুনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিইনি। ইনি অর্জুন, জলপাইগুড়িতে থাকেন। ওঁর নেশা পেশা হল সত্য সন্ধান করা। আর আপনার কথা ওঁকে আগেই বলেছি।

সে কী! আমার কথা বলতে গেলেন কেন?

সিসি টিভিতে আপনাকে আমার এখানে আসতে দেখে আসলে আমরা যে বিষয়ে কথা বলছিলাম তাও আপনার মতো কাউকে নিয়েই। জনিসাহেব একটু সংকোচে কথাগুলো বললেন।

ইন্টারেস্টিং। আর এন সিকদার চোখ ছোট করে বললেন। তারপর অর্জুনের দিকে তাকালেন। আপনি সত্য সন্ধানী? এই বয়সে? বাঃ, কী নাম যেন, ও হ্যাঁ, অর্জুন! খুব চেনা চেনা লাগছে নামটা। আপনি, আপনি কি সেই লাইটার রহস্যের নায়ক?

আমাকে আপনি তুমি বলবেন। অর্জুন হাত জোড় করল।

বাঃ। আলাপ করে খুশি হলাম। বেঁচে থাকার একটাই সুবিধে, প্রতিদিন কিছু না কিছু পাওয়া যায়। গ্যাংটকে কী কারণে?

আটশো বছর আগের একটা রহস্যের সন্ধানে। অর্জুন বলল।

মাই গড! আপনিও আটশো বছর আগের ব্যবসায়ীদের যাতায়াতের পথ খুঁজে চলে এসেছেন? আর এন সিকদার জিজ্ঞাসা করলেন।

না স্যার। ব্যবসায়ীদের নিয়ে আমার ক্লায়েন্ট মাথা ঘামাচ্ছেন না। তার পূর্বপুরুষ যে পথে ভারত থেকে আটশো বছর আগে তিব্বতে অভিযান করেছিলেন সেই পথটাকেই উনি শুধু দেখতে চাইছেন। অর্জুন বলল।

আচ্ছা! আপনার ক্লায়েন্টের নাম বলতে আপত্তি আছে?

না। তবে–? দ্বিধা কাটাল অর্জুন, ওঁর নাম মহম্মদ বিন কামরুজ্জমান খিলজি।

চোখ বন্ধ করলেন আর এন সিকদার। ভাবলেন। তারপর বললেন, অদ্ভুত কাণ্ড। মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজির বংশধররা এখনও বেঁচে আছে? তিনি ওই অভিযানের পথ খুঁজতে আপনার সাহায্য নিয়েছেন। অদ্ভুত ব্যাপার! ওই মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি বিবাহিত ছিলেন কিনা তা আমি কোনও গ্রন্থ থেকে জানতে পারিনি।

আপনার কাছে আজ যারা এসেছিল তারা কি লখনউয়ের লোক?

না। বলল দিল্লি থেকে এসেছে। ওরা ওই বাণিজ্যের পথটা সার্ভে করতে চায়। আটশো বছর আগে তিব্বতের লোক ভুটান বা তরাইতে মালপত্র নিয়ে যখন বাণিজ্য করতে যেত তখন যাতায়াতের পথ খুব দুর্গম ছিল না। সেই পথ আবিষ্কার করলে এখন অনেক কিছুর সুবিধে হবে। আর এন সিকদার বললেন, আমি ওদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন ওরা বারংবার আটশো বছর আগেকার পথের খবর জানতে চাইছে? তার আগে এবং ঠিক পরেও তো পথ ছিল। উত্তরে ওরা বলেছিল, ওই পথ মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি ব্যবহার করেছিলেন বলেই ওদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। একই দিনে আপনার মুখেও খিলজির নাম শুনছি। এখন মনে হচ্ছে ওদের সব কথা আমাকে খুলে বলেনি।

ওদের নাম জানেন?

মহম্মদ হাসান আর মহম্মদ মালেক।

হঠাৎ অর্জুনের মনে পড়ল সেই স্বাস্থ্যবান লোকটির কথা যে সন্দেহজনক ভাবে এই দোকানে ঢুকেছিল। জনিসাহেবকে অর্জুন অনুরোধ করল যখন সে এই ঘরে এসে সিসিটিভি দেখেছিল তখনকার ছবিটা রিউইন্ড করে আর একবার দেখানো যায় কিনা! জনিসাহেব একটু চেষ্টা করতেই ছবিটাকে দেখা গেল। অর্জুন বলল, স্যার দেখুন তো, এই যে লোকটি দোকানে ঢুকছে, চারপাশে তাকাচ্ছে, এখন জনিসাহেবের নাতির সঙ্গে কথা বলছে, সে কি আজ সকালে আপনার কাছে গিয়েছিল?

আর এন সিকদার মাথা দোলাতে লাগলেন, হ্যাঁ, এই লোকটা ছিল, ওর নাম বলেছিল মহম্মদ মালেক। কিন্তু ও এখানে কী করছে?

জনিসাহেব ইন্টারকমে তার নাতিকে ভেতরে ডাকতেই সে চলে এল। সিসি টিভির ছবিটি নাতিকে দেখিয়ে জনিসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ওই লোকটি দোকানে এসেছিল, তোমার সঙ্গে কথা বলেছে। ওর প্রয়োজনের কথা কি তোমাকে বলেছিল?

হ্যাঁ। জনিসাহেবের নাতি মাথা নাড়ল, ও জিজ্ঞাসা করেছিল আমরা খুব পুরনো বই রাখি কিনা। আমরা রাখি না তবু কৌতূহল হওয়ায় বইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম। ও বলেছিল এক্সপেডিশন অফ বক্তিয়ার খিলজি। আমি নেই বললে ও চলে গিয়েছিল। তাকে চলে যেতে বলে জনিসাহেব আর এন সিকদারকে বললেন, লোকটি আপনাকে মিথ্যে কথা বলেছে। ওরা এসেছে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আর আপনাকে ভাঁওতা দিয়ে সেই উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছে।

ভালই হল। ওদের বলে দেব সাহায্য করতে পারছি না। সত্যি তো, ওরা যা জানতে চেয়েছে সে বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। বইটা পেলে তবু কিছু বলতে পারতাম। যাক, চুকে গেল। কিন্তু ব্রাদার, তোমার ক্লায়েন্ট তো বোধহয় চিনে যাওয়ার ভিসা পাবেন না। পেলে ওঁর সমস্যা বাড়ত।

কেন?

যদিও স্মৃতি আবছা হয়ে গেছে, অনেকেই জানেন না কিন্তু তিব্বতের বৌদ্ধ মনেষ্ট্রিগুলোতে মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি সম্পর্কে ভয়ংকর ভীতি ছড়িয়ে আছে। যেমন চেঙ্গিজ খান, আলেকজান্ডারকে নিয়ে মানুষ মাথা ঘামান, এখন কিন্তু তারা যে ভয়ংকর আগ্রাসী ছিল তা ইতিহাস যারা পড়ে তারা জানে। এই খিলজি বেশ কিছু বৌদ্ধ মনেষ্ট্রি ধ্বংস করেছিল। মনেস্ট্রিতে যা সম্পদ ছিল তা লুঠ করেছিল। শুধু সোনা হিরে নয়, দামি দামি পুঁথিও। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ভুল করেছিল, তিব্বতে তা করেনি। কিন্তু ওই অভিযানের সময়টা সে ভুল নির্বাচন করেছিল। শীত বাড়তে লাগল দ্রুত, বরফ পড়তে লাগল। ওই আবহাওয়ার সঙ্গে তুর্কি সেনারা পরিচিত নয়, ফলে তারা মারা পড়তে লাগল। তিব্বতি সেনারাও গেরিলা আক্রমণ শুরু করেছিল। খিলজি ভেবেছিল জীবিত সৈন্যদের নিয়ে শীতকালটা গুহায় কাটিয়ে ভারতে ফিরে যাবে। কিন্তু খাদ্যাভাব দেখা দিল। যুদ্ধের ঘোড়া মেরে সৈন্যরা পেট ভরিয়ে আরও বিপদে পড়ল। এই ঘটনা থেকে তিয়াত্তর-চুয়াত্তর বছর আগে হিটলার যদি শিক্ষা নিত তা হলে সাইবেরিয়ায় অভিযান করত না। যাক গে, তোমার সঙ্গে কথা বলে ভাল লাগল, আজ উঠি।

বৃদ্ধ আর এন সিকদার লাঠিতে ভর করে উঠে দাঁড়ালেন।

স্যার, একটা কথা জানতে চাইব? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

যেসব গুহায় মহম্মদ বিন বক্তিয়ার খিলজি আশ্রয় নিয়েছিলেন সেইসব গুহা কী করে দেখে আসা সম্ভব? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

খিলজির দেশে ফেরার পথটা বের করতে পারলেই খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। আমি এটা নিয়ে কখনও ভাবিনি।

একটু ভেবে দেখবেন স্যার।

দেখি!

আর একটা কথা। ভেবে যদি কিছু তথ্য পান তা হলে আমাকে বলার আগে আর কাউকে বলবেন না।

এটাও ভেবে দেখব। বৃদ্ধ আর এন সিকদার বেরিয়ে গেলেন। জনিসাহেব ওঁর পেছন পেছন গেলেন এগিয়ে দিতে।

অর্জুনের মনে টিভিতে দেখা মানুষটির ছবি ভাসছিল। যারা জনাব কামরুজ্জমান খিলজির সঙ্গে শত্রুতা করছে তারা যে খুব চতুর মানুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। জনাব কামরুজ্জমান খিলজি যে উদ্দেশ্যে তার কাছে এসেছেন সেটা ওরা জেনে ফেলেছে। শুধু জানাই নয় বিভিন্ন সূত্রে তথ্য জোগাড় করছে। এই গ্যাংটক শহরে এসে আর এন সিকদারের কাছে পৌঁছানো খুব সহজ কাজ নয়।

এক্সপিডিশন অফ বক্তিয়ার খিলজি’ বইটির কথা অর্জুন জানত না। ওরা সেটা জেনেছে এবং খোঁজ করছে। অর্থাৎ ওই গুহার অধিকার পেতে ওরা মরিয়া হবেই।

জনিসাহেব ফিরে এলেন, তা হলে কাল সকাল দশটায় আপনি আপনার ক্লায়েন্ট মিস্টার খিলজিকে নিয়ে আমার দোকানে চলে আসুন। আমরা একসঙ্গে সরকারি দপ্তরে দরবার করতে যাব।

অর্জুন উঠে ভদ্রলোকের সঙ্গে হাত মেলাল। তারপর ওঁকে অভিযানের সঙ্গীদের সঙ্গে যোগাযোগের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

*

শীত বাড়ছে। বরফ পড়ছে সমানে। মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি সেই পাহাড়ের গুহায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। মহম্মদ শিরান খিলজির সাহায্য না পেলে তার পক্ষে সুস্থ হওয়া যে সম্ভব হত না তা বুঝে ভাল লাগছিল না। কারণ মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি আজীবন স্বাবলম্বী। কখনও কারও অনুগ্রহ নেননি। তার কেবলই মনে হচ্ছিল, কামরূপের রাজার পরামর্শ মেনে শীতের পরে তিব্বত অভিযান শুরু করলে তাকে এই বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে হত না। তিনি কামরূপের রাজার পরামর্শ কানে তোলেননি বলে রাজা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন। তা না হলে দুর্বল তিব্বতি সৈন্যদের পক্ষে তাকে এতটা বাধা দেওয়া সম্ভব হত না।

এখন চারপাশ বরফে ঢাকা। তীব্র খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে। প্রচুর সৈন্য যেমন মারা গিয়েছে, যুদ্ধের ঘোড়াগুলোকে হারাতে হয়েছে। এখন যে কজন সৈন্য শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বিভিন্ন গুহায় আশ্রয় নিয়ে আছে তারা অনাহারে মরার চেয়ে বাকি ঘোড়াগুলোকে হত্যা করাই শ্রেয় মনে করছে। তার ওপর তিব্বতি গেরিলারা ক্রমশ চোরাগোপ্তা আক্রমণ বাড়াচ্ছে। তাকে অনেকটা সুস্থ দেখে মহম্মদ শিরান খিলজি পরামর্শ দিলেন, অবিলম্বে স্থান ত্যাগ করে সমতলে নেমে যাওয়া উচিত। পরামর্শ মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজির কাছে। একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পাহাড় থেকে যখন তিনি নামতে পারলেন তখন তার সঙ্গী মাত্র আশিজন সৈনিক এবং কুড়িটি ঘোড়া। সেই অবস্থায় তিনি তাঁর রাজধানী দেবকোটে পৌঁছালেন। তিব্বত অভিযানে যাওয়ার আগে এই রাজধানীর দায়িত্ব তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সহযোগী আলি মর্দান খিলজির ওপর দিয়ে গিয়েছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা দেখে কিছুদিন বিশ্রামের পরামর্শ দেওয়া হল। কিন্তু মহম্মদ বক্তিয়ার খিলজি প্রতিজ্ঞা করলেন, আবার শক্তি সঞ্চয় করে সামনের গ্রীষ্মে তিনি তিব্বত আক্রমণ করে লাসা দখল করবেন।

ওই অভিযান না করলে তিনি গুহায় রেখে আসা সম্পদ সমতলে নিয়ে আসতে পারবেন না।