সেদিন চিরন্তনের ওই ছেলেটার উপর যেন কেমন শ্রদ্ধাভাব এসেছিল। ওর ওই শান্ত স্থিরতার কাছে নিজের অশান্ত অস্থির অভিযোগে আন্দোলিত চেহারাটা দেখে লজ্জা এসেছিল।
মনে হয়েছিল ও বোকাও নয়, ভীরুও নয়, ও মহৎ, পবিত্র, সরল!
কিন্তু সেই আর একদিন?
যেদিন নিত্যধন নিজের দোষ ধ্রুবর ঘাড়ে চাপিয়ে ঠাস ঠাস করে চড় বসিয়ে দিয়েছিল ওকে, আর ও হেঁটমুণ্ডে নিঃশব্দে নীচে নেমে গিয়েছিল।
সেদিন ধ্রুবর উপর থেকে যেন সব স্নেহ শ্রদ্ধা মুছে গিয়েছিল চিরন্তনের।
অনাদির জন্যে একটা ওষুধ আনবার কথা ছিল, এবং নিত্যধনই সেটা অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসবে, এমন একটা কথা ছিল যেন।
কিন্তু নিত্যধনের সেই ফেরার পথেই হঠাৎ তার গলায় তুমুল একটা চেঁচামেচি উঠল, এবং অনাদির কাতর গলার আওয়াজ শোনা গেল তার অন্তরালে, ওষুধে আমার দরকার নেই নিত্য, ক্ষ্যামা দে আমায়।
দাদার চিৎকারে কর্ণপাত করেনি চিরন্তন, বাবার এই কাতর গলা শুনে বেরিয়ে এল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে দেখতে পেল, দাদা ধ্রুবর গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে ধিক্কারের গলায় বলে উঠেছিল, বাবারও যেমন, তাই এই সব মাল পুষছেন বসে বসে!
ছেলেটা নেমে গিয়েছিল সিঁড়ি দিয়ে।
চিরন্তন ক্রুদ্ধ হয়েছিল।
চিরন্তন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি ধ্রুব এমন কোনও অপরাধ করতে পারে যাতে এমন রূঢ় নিষ্ঠুর শাসন চালানো যায় তার উপর।
তাই দাদা বলে সমীহ না করে কড়া গলায় প্রশ্ন করেছিল, তুমি হঠাৎ হাইকোর্টের জজের পদটা পেলে কোথা থেকে?
মানে?
ততোধিক ক্রুদ্ধ শুনিয়েছিল নিত্যধনের গলা।
মানে? মানে হচ্ছে–ওই হতভাগা পোষা জীবটা কী ভয়ংকর অপরাধ করেছিল যার জন্যে
নিত্যধন এমনিতে হয়তো অত নির্মম নয়। হয়তো দোষটা ধ্রুব সত্যিই করলে, শুধু ধমকের উপর দিয়েই সারত, কিন্তু তখন নিজে সাফাই হতে হবে। তাই চড়া গলায় অনেক মন্তব্য সহকারে যা বলেছিল তার মর্ম এই–অফিস থেকে ফেরার পথে আনলে বাবার যথার্থ সময়ে ওষুধ পড়বে না বলে নিত্যধন অফিস যাবার প্রাক্কালে ডাক্তারের প্রেসক্রিপসানটা আর টাকাটা ধ্রুবর হাতে দিয়ে পঞ্চাশবার করে বলে গিয়েছিল যেন ঠিক সময়ে এনে খাইয়ে দেয়, কিন্তু পাজি ছেলেটা, যাকে নাকি অনাদি কালসাপের নজির রাখতেই দুধ কলা দিয়ে পুষছেন, ওষুধ তো আনেইনি সে, টাকাটাও কোথায় উড়িয়ে দিয়েছে। এতেও যদি রাগ না হয় তো রক্তমাংসের মানুষে আর পাথরে তফাতটা কী?
চিরন্তন বিশ্বাস করতে পারেনি, ধ্রুবকে এ ধরনের একটা কাজ দিয়ে পঞ্চাশবার বলে যাবার পর ধ্রুব এমন দায়িত্বহীন হতে পারে। কোনও ধরনের কাজেই পারে না, এই চিরন্তনের বিশ্বাস।
তাই চিরন্তন তীব্র প্রশ্ন করেছিল, বলে গিয়েছিলে? না বলবে ভেবেছিলে?
ভেবেছিলাম! শুধু ভেবেছিলাম!
দাদা খেপে ওঠার অভিনয় করেছিল, তা হলে ওর জামার পকেট থেকে প্রেসক্রিপসানটা বেরোল কী করে?
ওর পকেট থেকে বেরিয়েছে?
না তো কি মিথ্যে কথা বলছি আমি? না কি নিজে ওর পকেটে পুরে রেখে—
দাদার রাগে দুঃখে ঘৃণায় কণ্ঠরোধ হয়ে গিয়েছিল।
চিরন্তন দিশেহারা হয়েছিল।
চিরন্তন এটাও ভাবতে পারেনি, দাদা এই সমস্ত কথা বানিয়ে বলছে।
দাদা অনেক সময় অনেক বাজে কথা বলে থাকে, ছেলেবেলায় অনেক মিথ্যেকথা বলেছে, তবু এই বয়েসে এত নিচু কাজ করবে?
তাই চিরন্তন দিশেহারা গলাতেই বলেছিল, প্রেসক্রিপসানটা ছিল? আর টাকাটা?
সেই তো! সেই কথাই তো হচ্ছে! বলে নিত্যধন তাড়াতাড়ি বলেছিল, যাক গে আমি আবার টাকা দিয়ে নিয়ে আসছি। ও আর উদ্ধার হয়েছে!
অনাদি আর একবার আর্তনাদ করেছিলেন, ওষুধ আমি চাই না বাবা! রেহাই দে আমায়।
কিন্তু ততক্ষণে নিত্যধন নেমে গেছে।
চিরন্তনের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, চিরন্তন নেমে এসে দেখতে পেয়েছিল ধ্রুব সেই বৈঠকখানা ঘরটার গলির দিকের জানলায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পিঠ ফিরিয়ে।
চিরন্তন কাছে গিয়ে কড়া গলায় বলেছিল, এই, বাবার ওষুধ আনিসনি কেন?
ধ্রুব চমকে তাকিয়েছিল।
ধ্রুবর চোখে বিস্ময় ফুটে উঠেছিল, এটা বোধহয় তার আশঙ্কায় ছিল না।
কিন্তু এ কি অপরাধীর মুখ?
চিরন্তন ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল, নিজের ওই রূঢ়তায় লজ্জিত হয়েছিল।
তবু বেশ চড়া গলাতেই বলেছিল, দাদা তোকে অনেকবার করে বলেছিল?
ধ্রুবর মুখে অতি ক্ষীণ একটু হাসি ফুটে উঠেছিল। ধ্রুব মাথা নেড়ে বলেছিল, একবারও না।
বলেনি?
ধ্রুব আর একবার শুধু মাথা নেড়েছিল।
ধ্রুবর ওই অভিযোগহীন মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুন চেপে গিয়েছিল চিরন্তনের। আর চিরন্তন জীবনে যা না করেছে, তাই করে বসেছিল। চিরন্তনও তার দাদার মতো ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছিল। বলে উঠেছিল, বলেনি, তবু চুপ করে ছিলি? ইডিয়ট? কেন? কেন চুপ করে ছিলি?
ধ্রুব নীরব।
বলতেই হবে তোকে, কেন?
ধ্রুব নিথর।
তুই শুধু ভালমানুষী দেখাতে চোর অপবাদ সহ্য করবি?
ধ্রুব পাথর।
তুই উঠে আয় আমার সঙ্গে।
থাক ছোড়দা, কী হবে?
চোর অপবাদ নিয়ে বসে থাকবি?
ধ্রুব একটু হেসে বলেছিল, তোমরা তো আর বিশ্বাস করছ না?
আমি না করি, আর সবাই করবে।
মামাও করবেন না।
একটু থেমে বলেছিল, শাশ্বতীও নয়।
কিন্তু মিথ্যেবাদীর শাস্তি হবে না তাতে।
তথাপি ধ্রুবকে রাজি করাতে পারেনি বড়দের সামনে গিয়ে বলে, আমার দোষ নেই।
সেদিন যেন সব মায়া স্নেহ শ্রদ্ধা চলে গিয়েছিল ছেলেটার উপর থেকে। মনে হয়েছিল, রাবিশ! রাবিশ! একেবারে রাবিশ মাল!
অথচ আবার কাছাকাছি এলে
এমন আরও কত কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে নিজের ছোট বোনটার ভবিষ্যৎ ওর সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে দেখে।
জুড়ে যাচ্ছে, এবং চিরন্তন পরোক্ষভাবে আজ সেই যাওয়াটায় সাহায্যই করল।
তবু সন্দেহও আছে।
ও কি সত্যিই পারবে শেষ পর্যন্ত?
ও কি বিয়ে করার যোগ্য?
ছেলেবেলার কথা বাদ দিলেও, এখন এই বউদির আমলের সংসারে কষ্টের তো শেষ নেই ওর, কিন্তু ঘৃণা আসে ওর সহনশীলতা দেখে।
মনে হয় এটা ক্লীবত্বেরই আর এক নাম।
নইলে বউদি তো কম অপমান করে না ওকে! মাও বাদ যায় না।
অথচ ও চলে যায় না।
আমি তো বাড়ির ছেলে, চিরন্তন মনে মনে বলে, আইনসঙ্গত দাবিও নাকি আছে এদের বাড়ির উপর, তবু আমায় যদি কেউ ওভাবে বলে, আমি বাড়ি ছেড়ে গিয়ে ফুটপাথে পড়ে থাকতাম।
আত্মসম্মানবোধ কি সত্যিই নেই ওর?
কী জানি, হয়তো ওকে আমি ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু ও যেমনই হোক, ওকে ভিন্ন শাশ্বতীটার তো গতি নেই। অতএব ওদের প্রতি অনুকূল হতেই হবে।
জানি এই নিয়ে বাড়িতে একটা ঝড় উঠবে, উঠুক। সেই ঝড়ের মধ্যে দিয়েই হবে ওদের ভালবাসার পরীক্ষা।
তবু আমার ওদের ওই রবীন্দ্রযুগের প্রেম দেখে হাসিই পায়। এ যুগ তোদের ওই প্রেমকে জোলো পানসে ছাড়া কিছু বলবে না। তথাপি দেখতে মন্দ লাগে না। ওই যে ওরা দুজনে একটু বেড়াতে যাচ্ছে, আর ভাবছে যেন ভয়ংকর একটা কিছু দুঃসাহসিক কাণ্ড করছে, এটা উপভোগ্য।
জানি আর কেউ বললে ধ্রুব যেত না। শুধু আমি বলেছি বলেই–ধ্রুব আমায় ভালবাসে। ছেলেবেলা থেকেই সেটা বুঝতে পারি আমি। আমার থেকে এমন কিছু ছোট নয়, তবু গুরুজনের মতো ভাবে।
কিন্তু এ বাড়িতে আর কতদিন থাকবে ও? পরের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহ করবে কী করে?
শাশ্বতীর কথা ভাবলেই বেহালার সেই ছোট্ট বাড়িটার কথা মনে পড়ে যায়। গুমোট ধরা বিকেলে যেখানে যেতে ইচ্ছে করে চিরন্তনের।
অথচ শাশ্বতীর সঙ্গে কোনও মিল নেই। সেখানে যেতে ইচ্ছে করে কি ওদের বাড়িটি ছবির মতো বলে? না কি সেই বাড়িতে ঢুকলেই ফুলে আলো করা একটু উঠোন দেখা যায় বলে? অথবা সেই ফুলের সমারোহের মাঝখানে একটু তুলসী মঞ্চ আছে বলে?
ওই তুলসী মঞ্চের মধ্যেই কি বিশেষ একটা নতুনত্বের স্বাদ পায় চিরন্তন? যদিও চিরন্তন সেটা নিয়ে কৌতুক কম করে না।
বলে, সন্ধ্যার প্রাক্কালে গলবস্ত্র হয়ে ওই মঞ্চের নীচে মাথা ঠোকেন তো? আর প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে বলেন তো, তোমার তলায় দিলাম আলো, অন্তিমকালে কোরো ভাল? এবং প্রাতঃকালে মন্ত্রপাঠ করেন, তুলসী তুলসী নারায়ণ, তুমি তুলসী বৃন্দাবন–
মনীষা হেসে বলে, এত তো ঠাট্টা, কিন্তু জানতে তো কিছু বাকি দেখি না। শিখলেন কী করে এত?
বাঃ, এসব শিখতে আবার আলাদা স্কুল লাগে নাকি? বাংলা দেশের মাটিতে ভূমিষ্ঠ, বাংলা দেশের জলবায়ুতে বর্ধিত, এ সব পাঠ তো আপনা থেকেই মুখস্থ হয়ে যায়।
মনীষা হেসে বলে, কিন্তু জানেন, আজকাল অনেক মেয়ে এ সব কথার ছন্দাংশও জানে না। এই আমার পাশের বাড়িতেই এক মেয়ে আছে, আমার এই তুলসীমন্দির দেখে এমন একখানা অবাক হয়। যে, মনে হয় চিড়িয়াখানার কোনও আজব জীব দেখছে। আর এই সব মন্ত্রট? সে তো ভাবাই যায় না। একদিন বলেছিলাম মেয়েটাকে, আজ পূর্ণিমা, তুলসী তলায় হরির লুঠ দেব, এসো সন্ধ্যাবেলা। বলব কি আপনাকে, এমন মুখ করল যেন পুস্তুভাষা শুনল। তারপর সে কী কৌতূহল, আর কী সে বিস্ময় প্রশ্ন! হরির লুঠ মানে কী, কী রকম সেই দৃশ্য, কী দিয়ে বানানো হয় হরির লুঠ, ইত্যাদি ইত্যাদি। শুনতে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছিল ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিই।
খুব সাধু ইচ্ছে–চিরন্তন বলেছিল, কত বড় মেয়ে?
কুড়ি বাইশের কম নয়। কিন্তু শুধু ওই একটা মেয়েই নয়, ওই রকম ন্যাকামাকা মেয়েতেই দেশ ভর্তি। আমি বলি, বিলেত থেকে এলি নাকি এইমাত্র? না স্বর্গ থেকে খসে পড়লি? বইও পড়িস না? গল্পের বই, পড়ার বই? বইতে কী না থাকে? বাঙালি জীবনের রীতিনীতি, ব্রত পুজো, সব কিছুই তো লেখা হয় আজকাল। ঠাকুমা দিদিমাদের কাছ থেকে স্থানচ্যুত হয়ে, বেলাদি ইন্দিরাদির কলমে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তা শুনতে পাস তো? তবে অমন ন্যাকা সাজিস কেন বাবা?
ফুলে ভরা উঠোনের মাঝখানেই একখানা বেতের মোড়া এগিয়ে দিয়ে, নিজেও জুত করে একটা মোড়া নিয়ে বসে, এই রকম প্রাঞ্জল ভাষায় মন্তব্য প্রকাশ করে মনীষা।
আর চিরন্তন বলে, এই জন্যেই আপনার কাছে আসতে ইচ্ছে করে। আপনার প্রকাশভঙ্গি এত তীক্ষ্ণ, মতামত এত স্পষ্ট, বক্তব্য এমন জোরাল এবং ভাষা এমন স্বচ্ছন্দ যে, মাঝে মাঝে মনে হয় কলম ধরলে আপনি নাম করা লেখিকা হতে পারতেন।
সেটা আর এ জীবনে হল না।মনীষা হাসে, কতকগুলো ন্যাকা পাকা, অথবা কাঁচা মেয়ে চরাতে চরাতেই জীবন যাবে।
এটা আপনার ইচ্ছাকৃত, চিরন্তন বলে, এত কষ্ট করবার কোনও হেতু তো নেই আপনার?
হেতু যে কোথায় কীভাবে থাকে মশাই, মনীষা হেসে ওঠে, ওটা অনেকটা অদৃশ্য কালির লেখার মতো।
মনীষার হাতে দিব্য হৃষ্টপুষ্ট একজোড়া বালা আছে, মনীষার পরনের শাড়িগুলি সাদা হলেও আদৌ ইঞ্চি-পাড়ের নয়, মনীষার চুলগুলি আধছাঁটা হলেও শৌখিন কেয়ারি, কিন্তু মনীষার সিঁথিটা ধবধবে সাদা।
কে জানে, মনীষা কুমারী না বিধবা।
কিন্তু কোনও কুমারী মেয়ে কি এই বয়েসে এমন একা বাস করে? কেউ না কেউ তো থাকে তার?
সংশয় তো সেইখানেই! মনীষা সম্পূর্ণ একা থাকে। মনীষার রাঁধুনি, বাসনমাজুনি, দেহরক্ষী, দ্বাররক্ষী, একাধারে সবকিছু একটা মাঝারি বয়েসের ঝি। ঝিটা রঙিন শাড়ি পরে চটি পায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, এবং মনীষার সঙ্গে একসঙ্গে চা খায়।
ঝিও বলা যায়, সখীও বলা যায়।
তবে রাত্রে সে তার স্বামীটিকে সঙ্গে নিয়ে এ বাড়িতে শুতে আসে।
প্রথম শুনে চিরন্তন তত হেসেই অস্থির।
এ ব্যবস্থা আপনি অ্যালাউ করেন?
মনীষা হেসে বলেছিল, ক্ষতি কী? আমার কোনও ক্ষতি নেই, ওদের পরম লাভ, অতএব মেনেই নিয়েছি। বিরহজ্বালা যে কী জ্বালা সে তো বুঝি? হেসে খানখান হয়েছে মনীষা; তারপর বলেছে, তা ছাড়া ক্ষতি ছেড়ে বরং আমার লাভই। এতে বাড়িতে একটা পুরুষ মানুষ থাকবে রাত্রে। নইলে ইহ-সংসারের পুরুষ জাতির ব্যগ্র সহানুভূতির উৎকণ্ঠায় নিশা প্রায় মহানিশা হবার জোগাড় হয়েছিল।
তা আপনিও যেমন, চিরন্তন বলে উঠেছিল, এই জঙ্গলের মাঝখানে একাকিনী মহিলা এলেন বাস করতে! সজাগ হয়ে উঠবে না সবাই?
সেই তো যন্ত্রণা! মাঝে মাঝে ভাবি মেয়েদের এই অসহায়তা, এই একা থাকলে আশঙ্কিত হয়ে থাকা, এ অবস্থার পরিবর্তন কি পৃথিবীতে কোনও কালে, কোনও যুগেই আসবে না?
আসবে! চিরন্তন বেপরোয়া গলায় বলে, মহিলারা কোনও বিজ্ঞানের কৌশলে পুরুষে পরিণত হয়ে গেলে আসবে।
বাঃ, চমৎকার!
চমৎকার বলার কিছুই নেই, এটাই হচ্ছে স্বাভাবিক সত্য। গাছে ফল থাকবে, মানুষ পেড়ে খাবে না, এ তো আর হয় না?
সম্পর্কটা কেবলমাত্র খাদ্য-খাদক?
তা আবার বলতে? তা ছাড়া যার যত পয়সা সে তত খায়। হাজার হাজার বছরের ইতিহাস দেখুন, ওই একই সত্য লিখিত আছে। রাজাদের রানির সংখ্যার শেষ নেই, বাদশাদের বেগমের সংখ্যার শেষ নেই।
এটাকে আপনি খারাপ বলেন না?
মোটেই না! চিরন্তন জোর গলায় বলে, যেটা স্বাভাবিক, তাকে খারাপ বলতে যাব কেন? ধনী মহিলারা যে দু-হাজারটা শাড়ি কেনেন, দশ বিশ সেট গয়না কেনেন, তাকে কি আপনি খারাপ বলেন?
মনীষা অবাক গলায় বলে, সেটা আর এই এইটা এক হল?
কেন নয়? দুটোই উপভোগের বস্তু সংগ্রহ করার নেশা।
আপনার মতবাদ শুনে যে গা ছমছম করছে।বলে হেসে ওঠে মনীষা।
চিরন্তনও হেসে ওঠে, বলে, আমার আগের কথাটা কিন্তু লক্ষ করেননি। বলেছি, পয়সা থাকলে, বলেছি ধনী মহিলা।
কিন্তু যারা পরের বাগানের ফল পাড়তে আসে? তারা?
তারা হতভাগা! তাদের কথা আমি ধরি না।
কিন্তু বিপজ্জনক তো তারাই। উৎখাত করতে পেলে ছাড়ে না।
তবু তো আছেন সাহস করে।
দেখছি। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
হঠাৎ বেশ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে যায়। কোথাও বোধ হয় বৃষ্টি হয়ে গেছে। বৃষ্টি-বোয়া ফুলের গন্ধ এসে আছড়ে পড়ে।
চিরন্তন হঠাৎ পুরনো প্রসঙ্গ ছেড়ে বলে, আপনাকে দেখলে কিন্তু হিংসে হয় আমার। বেশ আছেন। এইসব ফুলটুল সবই আপনার হাতের?
আমার বললে আমার, ঈশ্বরের বললে ঈশ্বরের।
আপনি খুব ঈশ্বরবিশ্বাসী, তাই না?
নিশ্চয়।
কিন্তু আপনার মতো বুদ্ধিসম্পন্ন মস্তিষ্কের পক্ষে এটা অস্বাভাবিক।
কেন? আপনার কি ধারণা, বুদ্ধির সঙ্গে ঈশ্বরের বিরোধ?
সেটাই যুক্তিগ্রাহ্য।
বুদ্ধির সঙ্গে ঈশ্বরের বিরোধে হিটলার, বুদ্ধির সঙ্গে ঈশ্বরের মিলনে রবীন্দ্রনাথ!
এসব তর্কের শেষ নেই।
তা হলে তর্কটা থাক না! তার চেয়ে বরং আপনার নতুন প্রেমের গল্প বলুন।
চিরন্তন হেসে উঠে বলে, সেটা আবার কোথায় পাব?
ওমা, কেন সেদিন যে বললেন—
কী বললাম বলুন তো?
বাঃ বললেন না, হঠাৎ কেমন প্রেম প্রেম অনুভব করছি, অথচ ঠিক বুঝতে পারছি না—
ও হো হো–জোরে জোরে হাসে চিরন্তন, সে গল্প তো গল্প। প্রায় ঠাকুরমার ঝুলির গল্প।
ঠকাচ্ছেন! চেপে যাচ্ছেন। রেগে যাচ্ছি।
তা হলে তো আবার গল্প বানাতে হয়।
থাক, শুনতে চাই না।
সেই ভাল, বরং গান ধরুন শোনা যাক।
দেখুন, রোজ রোজ ও সব চলে না। পাড়ার লোক যদি দেখে সন্ধ্যার আলোছায়ায় বসে মনীষা দেবী একটি অনাত্মীয় যুবককে গান শোনাচ্ছেন, তা হলে কালই মনীষা দেবীর স্কুল লাটে উঠবে।
আশ্চর্য! এইভাবে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। চিরন্তন বলে, পদে পদে নিষেধের শৃঙ্খল। পদে পদে পাছে লোকে কিছু বলে।
মনীষা এখন আর হাসে না।
মনীষা উদাস নিশ্বাস ফেলে বলে, কে জানে হয়তো ওটারও দরকার। লোকভয়, রাজ্যভয় আর ধর্মভয়, এই ত্রিবিধ ভয়ের শাসনেই মানুষ যথেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারে না। আমার জীবনটাই দেখুন না–
আপনি তা হলে আপনার এই জীবনের জন্যে অনুতপ্ত?
মনীষা অন্যমনা গলায় বলে, অনুতপ্ত নই, তবে মাঝে মাঝে মনে হয়, কী অর্থহীন আমার সমাজের ওপর এই চ্যালেঞ্জ! সমাজের তো কিছুই লোকসান হল না। অথচ আমাকেও-বলেই হঠাৎ আবার হেসে ওঠে মনীষা, দূর, যত সব বাজে কথা! জীবনটা হাতে পেলেই বা সেটাকে নিয়ে করতাম কী? আর একটা বিয়ে করে সংসারধর্ম পালন? অথবা পরম উপভোগের সুখে নিমজ্জিত হয়ে যৌবনযাপন করে, অবশেষে বার্ধক্যের হাতে আত্মসমর্পণ? এ ছাড়া আর নতুন কী করবার আছে বলতে পারেন?
চিরন্তন বলে, শুধুই কি তাই? এই বিশাল পৃথিবী পড়ে আছে সামনে, কত অফুরন্ত তার রহস্য, কত অনাস্বাদিত তার স্বাদ, একটি মুক্ত জীবনের কত সম্ভাবনা
যেমন সম্ভাবনার দৃষ্টান্ত আপনি–আবার জোর গলায় হেসে ওঠে মনীষা, অনেক তো ভাল ভাল কথা জানেন, অনেক বড় বড় চিন্তা করেন, কিন্তু বলুন তো কেন পড়ে আছেন এই ক্ষুদ্র পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে আটকে? তুচ্ছ একটা মার্কেন্টাইল ফর্মে একটা সাধারণ কেরানির চাকরি করছেন, খাচ্ছেন, ঘুমোচ্ছেন এবং বড় বড় চিন্তার মধ্যে সাঁতার দিয়ে বেড়াচ্ছেন, ব্যস হয়ে গেল।
চিরন্তন ওর মুখের দিকে তাকায়।
কিন্তু চিরন্তন ওর মুখের রেখাগুলো আর স্পষ্ট দেখতে পায় না, কারণ তখন সন্ধ্যার অন্ধকারের দাঁত পড়ন্ত সূর্যের মরণ যুদ্ধের সঙ্গে জিতে গেছে।
চিরন্তন তবু ওই আবছা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমি আমার জন্মদিনেরর জন্যে অপেক্ষা করছি।
জন্মদিন!
হ্যাঁ! প্রকৃত জন্মদিন! চিরন্তন যেন সামনের মানুষটাকে ভুলে নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলে, এই জীবনটাই যে আমার আসল জীবন, তা আমি মনে করি না। আমার যে আমি ওই মার্কেন্টাইল ফার্মে কেরানিগিরি করে, খায়, ঘুমোয়, বন্ধুর বাড়ি আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, সেটাই কি সত্যি আমার প্রকৃত সত্তা? না, যে আমির জন্যে এই পৃথিবীতে এলাম, যে আমি গর্বের অন্ধকারে বসে ভূমিষ্ঠ হবার জন্যে ছটফট করছে, তার সেই জন্মক্ষণের মুহূর্তই শুনছি আমি?
মনীষা আর হেসে ওঠে না, তবু তার গলার শব্দটা হাসির মতোই লাগে, ওই গুনেই মরতে হবে। দেখবেন সে জন্মক্ষণ আর আসবে না। সমস্ত রঙিন সম্ভাবনা সাবানের ফানুসের মতো গলে গলে পড়ে যাবে, আর অপেক্ষার মুহূর্তগুলি গুনতে গুনতে জীবনের ঘড়ির বারোটা বেজে যাবে। আপনার সেই আসল আমির উদ্যত গঙ্গা শিবের জটার মধ্যে পাক খেয়ে খেয়েই শুকিয়ে ফুরিয়ে যাবে।
আপনি দেখছি দারুণ নিরাশাবাদী!
নাঃ, আমি শুধু সত্যবাদী।
আপনি বুঝি সব জানার শেষ কথা জেনে বসে আছেন?
শেষ কথা নয়, অশেষ কথা।মনীষা আস্তে বলে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, জীবন জিনিসটা বুঝি একটা ফলের মতো, আর প্রত্যেকের জন্যেই তার এক একটা বরাদ্দ আছে। সে ফলে আস্তে আস্তে রং ধরবে, আস্তে আস্তে সে সুপক্ক হবে, তখন সেই ফলটি আস্বাদন করা হবে তারিয়ে তারিয়ে। কিন্তু সত্যি তো তা নয়! ওর না আছে বরাদ্দের হিসেব, না আছে সম্পূর্ণতা। এই যে বাতাস বইছে আমাদের ঘিরে, এর থেকে নিশ্বাস-টিশ্বাস নিচ্ছি, বেশ আছি। হঠাৎ যদি এই বাতাসের খানিকটা আমার নিজের বলে নিয়ে রাখব ভেবে সেটুকু মুঠোয় ভরে ফেলবার জন্যে তার পিছু পিছু ছুটি, তা হলে সেটা আপনার ওই জন্মলক্ষণের অপেক্ষায় বসে থাকার মতোই হবে। কোনও একটা জায়গায় আশাভঙ্গের আছাড়ে সমাপ্তি।
আপাতত আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না।বলে মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায় চিরন্তন।
মনীষা কিন্তু বসেই থাকে, বসে বসেই বলে, আপনাকে কিন্তু আজ একটু চা-ও খাওয়ালাম না।
ক্রটির হিসেবটা ভোলা থাকল–বলে উঠোনের বেড়ার দরজা ঠেলে দিয়ে বেরিয়ে আসে চিরন্তন।
বাড়ির নকশাটা ঠিক গ্রামের বাড়ির মতো।
বেড়ার দরজা আছে, উঠোনে তুলসীমন্দির আর জবা, অতসী, শিউলি দোপাটি, টগর, মল্লিকার গাছ আছে, দাওয়া আছে, মায় রান্নাঘরের পিছনে ছোট একটা পুকুর।
রোদের সময় পুকুরের জলটা চিকচিক করে, বৃষ্টির সময় যখন উঠোন বাগান সব একাকার হয়ে যায়, তখন বড় একটা জলাশয়ের মতো দেখতে লাগে।
মনীষা তখন তার ঝিকে ডেকে ডেকে হেসে হেসে বলে, দেখ নয়ন, আমরা স্রেফ জলে পড়ে আছি, তাই না?
কিন্তু মনীষা নামের ওই বিদ্যে বুদ্ধিওলা সুন্দরী তরুণী মেয়েটা এমন জলেই বা পড়ে আছে কেন? ডেকে কথা বলবার জন্যে নয়ন ছাড়া আর কেউ তার জোটে না কেন? আর চিরন্তন নামে ওই খাস শহুরে ছেলেটাই বা মাঝে মাঝে এসে উদয় হয় কেন তার জলে পড়ে থাকা অবস্থার দর্শক হতে? যে ছেলেটা নাকি তার আসল জন্মদিনের অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ, এবং নিজেকে সাধারণণাত্তর ভাববার একটি মধুর সুখে উন্নাসিক!
এখানে ও কেন?
মনীষার সঙ্গে ওর সম্পর্কই বা কী?
তা এত সব কেনর উত্তর জানতে হলে অনেকটা পিছিয়ে যেতে হয়।
পিছিয়ে যেতে হয় মনীষার উনিশ বছর বয়েসের পটভূমিকায়। যেখানে মনীষার ভূমিকা মাত্র একটি সহশিক্ষার শিক্ষায়তনের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্রীর।
দেখতে ভাল, পড়াশুনোয় ভাল, আচার-আচরণে ভাল, এবং বাকপটুতায় ভাল এই মেয়েটা তার সহপাঠীদের অনেকেরই আগ্রহ সঞ্চয় করে ফেলেছিল।
আড়ালে অবশ্য ওর নানাবিধ নামকরণ হয়েছিল। মেয়েরা এবং ঈর্ষাকাতর ছেলেরা বলত, ওস্তাদ..ডাঁটুস..উঁচু..নাকী..ঢঙিনী ইত্যাদি, কিন্তু সামনে? একটু মিশতে পেলে রীতিমত খুশি।
যে ছেলেরা ঈর্ষাপোষণ করত না, তারা অনেকেই সম্বোধনটা আপনি থেকে তুমিতে নামিয়েছিল এবং অন্তত জনা তিন-চার ছেলে আপন আপন ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গে মনীষা মুখার্জি নামটাকে জড়িয়ে ফেলতে শুরু করেছিল।
কিন্তু একপাল কাকের মুখ থেকে মাংসখণ্ডটুকু ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেল চিলে।
ইংরেজির প্রফেসর অমরেশ ঘোষাল তাঁর ছাত্রীকে পাত্রী করে ফেলে একদিন বিবাহ অফিস থেকে বিয়েটা সেরে নিয়ে ক্লাসে বসে ঘোষণা করলেন, তোমরা নিশ্চয় শুনে খুশি হবে–
ব্যাপারটা এতই অপ্রত্যাশিত যে, খুশি হয়েছি এই ভানটুকু দেখাতেও খানিকটা সময় লাগল ওদের। এমনটা যে ঘটতে পারে কারুরই ধারণার মধ্যে ছিল না। সন্দেহই ছিল না। একচক্ষু হরিণের মতো ওরা কেবল সহপাঠী-রাজ্যেই তীক্ষ্ণ লক্ষ্য রাখছিল।
অতঃপর মনীষার উপর নিদারুণ চটে গেল সবাই। মনীষাকে অনেকে অনেক কিছু বলেছে আগে, কিন্তু ঘোড়েল বলেনি, গভীর জলের মাছ বলেনি, এবার সেইগুলোই বলতে লাগল। ছি ছি, ভিতরে ভিতরে এই ব্যাপারটি চালাচ্ছিল, অথচ একবিন্দু টের পেতে দেয়নি কাউকে। এ যেন সহপাঠী-পাঠিনীদের সঙ্গে একরকম বিশ্বাসঘাতকতা।
তবে?
বিশ্বাসঘাতককে কে সম্মান দেয়?
বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কে মেলামেশা রাখে?
মাটিতে দাঁড়িয়ে গাছ নাড়া দিচ্ছিলে সবাইয়ের সঙ্গে, হঠাৎ লাফিয়ে মগডালে উঠে গেলে, আর কায় দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে ডেকে কথা কইবার?
ওদের রাগ হওয়া অসঙ্গত নয়।
কিন্তু টের কি মনীষা নিজেই পেয়েছিল কদিন আগেও?
মনীষা কি কোনওদিন ভেবেছিল সে তার থেকে কুড়ি বছরের বড় ওই আলুভাতের মতো তেলা তেলা মুখ, আর দুধে আলতা গোলা রং অধ্যাপকটির সঙ্গে জীবনের গ্রন্থি বন্ধন করে বসবে?
অথচ হয়ে গেল তেমন ঘটনা। কদিন ধরে যেন পড়া বুঝতে যাচ্ছিল অধ্যাপকের বাড়িতে, এবং তাঁর সুগভীর যত্ন সহকারে পড়ানোয় বিগলিত হচ্ছিল, হঠাৎ অধ্যাপক এমন একটা কাঁচামি করে বসলেন, যেটা লোকসমাজে বলে বেড়ালে লোকে গায়ে ধুলো দিত।
কিন্তু মনীষা গভীর ধরনের মেয়ে।
মনীষা বলে বেড়াল না। এমনকী নিজের বাড়িতেও না। মনীষা ধরে নিল–এটাই তার বিধিলিপি, কাজেই ধরে বসল, বিয়ে করতে হবে।
বিয়ে করতে হবে। এমন সেকেলে কথা শুনতে হবে স্বপ্নেও ভাবেননি ইংরেজির অধ্যাপক অমরেশ ঘোষাল। কিন্তু হঠাৎ যেন প্রস্তাবটা খুব খারাপ লাগল না তাঁর। যদিও তিনি মনীষাকে সান্ত্বনা দিলেন অনেক, দুঃখ প্রকাশ করলেন বিস্তর, এবং জ্ঞান দিতে চেষ্টা করলেন–অ্যাকসিডেন্ট ইজ অ্যাকসিডেন্ট, ওর জন্যে জীবনটাকে বিশৃঙ্খল করে ফেলা বোকামি, কিন্তু মনীষার গোঁ ভাঙতে পারলেন না।
মনীষার বাপ-ঠাকুরদা বরিশালের লোক, পাকিস্তান হয়ে যাওয়ায় কলকাতাবাসী, মনীষা কোনওদিন বরিশাল চক্ষে দেখেনি।
তবু মনীষার রক্তে বরিশালী গোঁ কাজ করল। মনীষা বলল, তা হয় না।
হয়তো মনীষার সেই রক্তে আরও একটা জিনিস অদৃশ্য হয়ে মিশিয়ে ছিল, সেটা এই আলোড়নে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
শহরে জন্ম, শহরে লালিত-পালিত, শহুরে আধুনিকতার চিন্তাধারার মধ্যে শিক্ষাদীক্ষা, তবু সেই অদৃশ্য হয়ে মিশিয়ে থাকা পবিত্রতার গ্রামীণ সংস্কার দৃশ্যমান হয়ে উঠে বলল, তা হয় না।
অমরেশ ঘোষাল তবুও বললেন, আমি তোমার থেকে কুড়ি বছরের বড়
কুড়ি বছরের ছোট ছাত্রী মুখ লাল করে মুখের উপর বলে বসল, সেটা মনে পড়ল বুঝি দায়িত্ব নেবার সময়?
বেশ আমি রাজি, কিন্তু তোমার গার্জেনরা?
সে ভার আমার।
কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখো! এখনও ভেবে দেখবার সময় রয়েছে–
সময় নেই।
আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেকে শাস্তি দিতে বসছ না তো?
শাস্তি-শাসনের প্রশ্ন নেই, ধরে নিয়েছি এটাই আমার নিয়তি।
তুমি নিয়তি মানো?
মানি বইকী! নইলে এই পরিস্থিতিতে এসে পৌঁছব কেন?
বেশ, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
কবিত্ব করে বললেন ইংরেজির অধ্যাপক। তারপর বললেন, তা হলে চলো তোমার বাবার কাছে।
বাবা নেই মনীষার, মা আর ঠাকুমা, কাকা আর ভাই বোন, এই নিয়ে সংসার।
প্রস্তাবটি সেখানে গৃহীত হতে দেরি হল না। শুধু অন্য আত্মীয়জন নাক তুলে বলল, এ মা, বর যে মনীষার ডবল বয়েসী! বলল, বাবা, একেই বলে প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে। নইলে কখনও এমন হতে পারে? অত বুদ্ধিমতী মেয়ে মনীষা! সে কিনা এই ফাঁদে পড়ল?
কেউ কেউ বা ওই বুদ্ধিটাতেই সন্দেহ প্রকাশ করল।
বলল, মনে হত মনীষা বেশ বুদ্ধিমতী।
কিন্তু বেশি সমালোচনা কেউ করতে পারল না, কারণ পাত্র হিসেবে তো আর অমরেশ ঘোষাল ফেলনা নয়? রূপ আছে, বিত্ত আছে, বিদ্যা আছে, প্রতিষ্ঠা আছে। বয়েসটাই যা চল্লিশ।
কিন্তু চল্লিশটাই বা এমন কী বয়েস?
সেটা তো ভদ্রলোক মেকআপ করেও নিচ্ছেন কান্তিতে, পুষ্টিতে, তরুণজনোচিত ভঙ্গিতে এবং সুরুচিসম্মত সাজসজ্জাতে।
তবে আর আপত্তি কোথায়?
একটা প্রশ্ন উঠেছিল, এত সব থাকতে, ভদ্রলোকের ঘর এযাবৎ শূন্য কেন?
তা সে প্রশ্ন নিজেরাই উত্তর গড়ে সমাধান করে নিল তারা।
কেউ বলল, বিদ্যে বাড়াতে বাড়াতে খেয়ালে বয়েসটাও বাড়ছে।
আর কেউ বলল, না না, লোকটা নিতান্ত অল্প বয়েসে বিপত্নীক, তারপর আর বিয়ে করতে চেষ্টা করেনি। নেহাৎ নাকি মনীষা একেবারে ওর প্রেমে পাগল হয়ে ধরে পড়ল তাই
অবশ্য একথাটা যারা বলল, তারা অমরেশ ঘোষালের সেই বিবাহিত জীবনের কোনও প্রমাণপত্র দেখাতে পারল না। কারণ বরাবর সবাই দেখেছে, একটা চাকরই একাধারে অমরেশ ঘোেষালের মাতা কন্যা জায়া।
তার হাতের মুঠোতেই অমরেশের সংসার।
তবে?
তবে ওই বিপত্নীক কথাটা অমূলক। বিয়ে করবার ফুরসত পায়নি, সেটাই ঠিক।
হয়তো সারাজীবনই ফুরসত পেত না, যদি না মনীষা ওকে এমনভাবে পেড়ে ফেলত।
যাক যে পরিস্থিতিতেই হোক, বিয়েটা ধরে নিতে হবে বেশ প্রসন্ন চিত্তেই মেনে নিয়েছিলেন অমরেশ ঘোষাল।
তা না হলে ক্লাসে এসে বলতেন না–তোমরা নিশ্চয় শুনে খুশি হবে—
শুধু ঘোষণাই নয়, বাছা বাছা কয়েজন ছাত্র-ছাত্রী ও অধ্যাপককুলকে একদিন প্রীতিভোজে আপ্যায়িতও করে ফেললেন ঘোষাল। তারা এল, নেমন্তন্ন খেল, উপহার দিল।
অতওব ধরে নিতে হবে মনীষা নামের একাঙ্কিকাটির উপর যবনিকাপাত হয়ে গেল।
এরপর অভিমান, অভিযোগ, বেবি ফুড, পেরাম্বুলেটার, নার্সারি স্কুল, হাই স্কুল, আবার নার্সিং হোম, স্রেফ পৌনঃপুনিকতায় জড়িয়ে পড়া। অথবা হিসেব চতুরতা, টিউশনি, খাতা দেখা, টিচারি, আয়বৃদ্ধি, শহরতলিতে বাড়ি, শৌখিন গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই তো?
অতএব আর কে মনীষাকে নিয়ে মাথা ঘামায়?
কিন্তু মনীষা সেই ছকে বাঁধা জীবন থেকে সরে এল কী করে? সরে এল কেন?
মনীষার এই বেহালার বাসার অর্থ কী?
মনীষা কেন তার ঝিকে ডেকে ডেকে বলে, নয়না, আমরা যেন জলে পড়ে আছি, না রে?
মনীষার উঠোনে তুলসীমন্দির, ঘরে ঠাকুরের ছবি, অথচ মনীষা পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টার হাসি গল্পে কাটায়।
কোনটা তবে আসল মনীষা?
কে জানে, জগতে ওই আসল বলে বস্তুটা আসলে আছে কিনা। আর থাকেই যদি, তো ঠিক কোথায় থাকে!
উত্তরটা শক্ত।
বহির্জীবনের দৃশ্যের সঙ্গে ভিতরের গল্পটার মিল থাকে না। দৃশ্যটা দেখে গল্পের কাঠামোরা খুঁজে বার করতে গিয়ে হতাশ হতে হয়।
মনীষার ব্যাপারেও হয়েছে।
মনীষার সেই দর্শকরা তাই ছি ছি করেছে তাকে।
যে মেয়ে বয়েস মানল না, সঙ্গতি অসঙ্গতি মানল না, বন্ধুবান্ধবের হিতকথা অথবা ব্যঙ্গ বিদ্রূপ মানল না, দুম করে এক ডবলবয়েসী অধ্যাপককে বিয়ে করে বসল কেবল মাত্র প্রেমের পাগলামিতে, সেই মনীষাই কিনা তিন বছরের একটা ছেলেকে ফেলে রেখে একেবারে একা বসে বাস করতে এল স্বয়ং-নির্ভর হয়ে!
তোর বরের পয়সা কে খায় তার ঠিক নেই, (কারণ ঘোষালের শুধু তো অধ্যাপনাই নয়, বাপের আমলের পুস্তক ব্যবসায়ও আছে) আর তুই কিনা গ্রাসাচ্ছাদন চালাতে একটা গাঁইয়া স্কুলের টিচারি করে মরছিস?
হতে পারে তোমাদের প্রেম-বিবাহের পরিণতিটা যথারীতিই হয়েছিল, হতে পারে তোমাদের মধ্যে ভাবগত, আদর্শগত অথবা নীতিগত বিরোধ দেখা দিয়েছিল, তবু ছেলেটার মুখ চেয়ে তোমার সয়ে থাকা উচিত ছিল মনীষা!
রাজায় রাজায় যুদ্ধে উলুখড়ের প্রাণ যাওয়ার প্রবাদটা যে তুমি না জানতে, তা নয়।
কিন্তু তুমি সে সব ভাবোনি।
তার মানে তুমি যথেচ্ছাচারিণী হয়েছ।
এতে তোমার বিজ্ঞ আত্মীয়-স্বজন যদি তোমাকেই দোষারোপ করে থাকে, তো দোষ দেওয়া যায় না তাদের।
তোমার নিজের বড়মামা যে তাঁর ছোটবোনকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিলেন, এই জন্যেই স্ত্রীলোকের জন্যে শাস্ত্রশাসন তৈরি হয়েছিল, বুঝলি? এই জন্যেই সেকালে স্ত্রীজাতিকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। মেয়েমানুষের বিদ্যার বল, স্রেফ বাঁদরের হাতের খোন্তা। বাঁদরের হাতে খোন্তা পড়লে সে বাগানটাকে কুপিয়ে শেষ করে, আর ভাবে কাজ করছি। এও তাই। বুদ্ধি নেই, অথচ শক্তি হাতে এসে গেছে, তাই শক্তির অপব্যবহার করে তোক হাসাচ্ছে–, সেটাও ভুল বলেননি।
মোটকথা মনীষা কারও কাছ থেকে সহানুভূতি পায়নি।
সন্তানের জন্যে ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি না হয়ে যে-মেয়েমানুষ সেই সন্তানকেই ত্যাগ করে আসতে পারে, তার জন্যে সহানুভূতির নৈবেদ্য সাজাবার মতো উদার সমাজ আমাদের দেশে তে দূরস্থান, পৃথিবীর কোনও দেশেই আছে কিনা সন্দেহ।
মনীষা দেশ, সমাজ, মানুষ, সব কিছুই জানত, তবু মনীষা স্বেচ্ছাচারিণী হয়েছে।
তার মানে মনীষা সবাইকে অগ্রাহ্য করেছে।
তবে আর মনীষার সেই অহংকারের ফল ফলবে না কেন?
ফলেছে।
মনীষাকে শহর ছেড়ে একটা পচা পাড়াগাঁয়ে পড়ে থাকতে হয়েছে, এবং পাড়ার বদ লোকের অতি উৎসাহ থেকে আত্মরক্ষা করতে ঝিয়ের বরকে বাড়িতে জায়গা দিতে হচ্ছে পাহারা দিতে।
.
আপনি একটা কুকুর পুষলেও পারেন–বলেছিল চিরন্তন,বেশ বাঘের মতো একটা কুকুর, যে আপনার দারোয়ানের কাজ করতে পারবে, পুলিশের কাজ করতে পারবে। দেখছি কিনা একটি মহিলার ব্যাপারে–
মনীষা কিন্তু এহেন সাধু প্রস্তাব লুফে নেয়নি। বরং শুনেই চমকে উঠেছিল, ওরে বাবা! যে বাড়িতে কুকুর থাকে, আমি সে বাড়ির ছায়া মাড়াই না।
আহা সে তো আপনার পোষা কুকুর হবে।
পোষা হয়ে তো আসবেনা!মনীষা হেসে উঠেছিল।পোষ মানাবার পিরিয়ডটা? আমি তো ভয়েই হার্টফেল করে বসে থাকব।
সে সম্বন্ধে আমিও অবশ্য আপনার সঙ্গে একমত, তবে শুনেছি নাকি বাচ্চাবেলায় পুষলে
মনীষা হেসে উঠেছিল, নাঃ পোষ মানানোর বিদ্যেটা আমার নেই, পোষ মানারও নয়। দুদিকেই ফেলিওর। কিন্তু কোন মহিলার ব্যাপারে কী যেন বলছিলেন?
মহিলা? ও হো হো। বলছিলাম ওই কুকুরের কথা। মহিলাটি তাঁর স্বামীর কাছ থেকে আত্মরক্ষার্থে একটি অ্যালসেশিয়ান পুষেছেন, পাহারা দিতে রাত্রে ঘরে রাখেন।
স্বামীটি কী? মাতাল? দুশ্চরিত্র?
দেখুন লোকটা আমার আবাল্যের বন্ধু, কিন্তু চিনতে পারলাম না আজ পর্যন্ত। কখনও মনে হয় পত্নীগতপ্রাণ একটা বোকা লোক, কখনও মনে হয় কূটনীতিতে পোক্ত একটা নীতিজ্ঞানহীন লোক। চেনা বড় শক্ত।
অথচ আপনি বলছিলেন, বাচ্চবেলা থেকে পুষলে নাকি কই, আবাল্যের বন্ধুকে চিনতে পারছেন?
মনীষার এই বনবাসে চিরন্তনই একজন রাজ-অতিথি। নইলে আত্মীয় সমাজ তো মনীষাকে বর্জন করেছে।
কিন্তু চিরন্তন কেন আসে?
কীসের আকর্ষণে?
হয়তো কোনও আকর্ষণেই নয়, নিছক সময় কাটাতে। সেই একটা সওদাগরি অফিসের তুচ্ছ কেরানিগিরির সময়টুকু বাদে অগাধ অবসর চিরন্তনের।
অবসর জিনিসটাকে তো ঘণ্টা মিনিটের হিসেবে হিসেব করা যায় না, অবসর জিনিসটা স্রেফ মানসিক। মনটা নিজের কর্তব্যের দায়ে বন্দি, আর নিজের করণীয়ের চিন্তায় ব্যাপৃত না থাকলে অফুরন্ত সময় থেকে যায় হাতে।
চিরন্তন সংসারে নিজেকে কোনও কর্তব্যের দায়ে বন্দি করে রাখে না। চিরন্তন বাড়িতে থেকেও বাড়িছাড়া। চিরন্তন যে তার মা দাদা বোন বউদির বাড়ির লোক, তা চিরন্তনও ভাবে না, বোধ করি ওরাও ভাবতে ভুলে গেছে।
চিরন্তন যে তাদের ওই বাড়িতে খায় শোয়, এটাই যেন অভাবিত ঘটনা। চিরন্তন যেন গাছের ডাল থেকে খসে-পড়া একটা পাতা, খসে পড়েও ওই ডালপালার উপর পড়ে আছে, যে কোনও মুহূর্তে উড়ে পড়ে যেতে পারে। কোনও একটু অসতর্ক আন্দোলনে, কোনও একটা ঝোড়ো হাওয়ায়।
কিন্তু এই বা কেমন?
কর্তব্যের দায় থেকে নিজেকে একেবারে মুক্ত করে রেখেছে কেন চিরন্তন? অন্তত তার মা আছে, বোন আছে। বিধবা মা, অনূঢ়া বোন। সব কিছুই তার দাদা বইবে কেন? তার নিজের স্ত্রী পুত্র রয়েছে।
চিরন্তনের বউদি যদি এতে রাগ করে কথা শোনায়, দোষ দেওয়া যায় কি তাকে?
চিরন্তনের মা-ও মাঝে মাঝে আড়ালে ও কে কবলিত করে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করেন। বলেন, মা বোন নিত্যর একার নয়। বউমা তো রাগ করতেই পারে। তুমিই বা কেন এমন গা ঝাড়া দিয়ে থাকবে?
চিরন্তন গায়েই মাখে না।
বলে, সবাই কি সব পারে? এই যে তুমি ফার্স্টক্লাস রান্না করতে পারো, বউদি পারে না। আমি আড্ডা দিয়ে বেড়াতে পারি, দাদা পারে না
রান্নার উল্লেখে মা সন্তুষ্ট হলেও আড্ডার উল্লেখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বলেন, আড্ডা দেওয়াটা এমন কিছু মহৎ কাজ নয়!
চিরন্তন হেসে ওঠে, সংসারে সবাই সব সময় মহৎ কর্ম করছে, এই বুঝি তোমার ধারণা?
মা তখন আর বেশি বলে না।
মারও সেই অসতর্ক নাড়া দেওয়ার ভয়টা আছে। ভয় আছে হতাশ ঝোড়ো বাতাসের।
বন্ধন যে স্বীকার করতে রাজি নয়, তাকে বাঁধা যাবে কোন শাস্ত্রের শাসনে?
অথচ মায়া-মমতা যে একেবারেই নেই তাও মনে হয় না। অথবা হুঁশ।
কবে যেন দেখেছিল মায়ের ঘরের বিছানা ময়লা। মা বলেছিল, ধোপা আসেনি। চিরন্তন একসঙ্গে চার জোড়া বিছানার চাদর কিনে এনে দিয়েছিল।
মা অবাক হয়ে বলেছিল, আটখানা বিছানার চাদর! কতকাল ভোগ করব বসে বসে? চাদরগুলোর আগেই আমার পরমায়ু ফুরোবে।
চিরন্তন হেসে উঠে বলেছিল, ভালই তো, তখন আর ফরসা চাদরের জন্যে বাজারে ছুটতে হবে না, তোমার বাক্স হাতড়ালেই পাওয়া যাবে।
আবার কবে যেন চোখে পড়েছিল, শাশ্বতী মুচি ডেকে নিজের চটি মেরামত করিয়ে নিচ্ছে। মুচি ডেকে জুতো মেরামতের ঘটনাটা কিছু আর ভয়ানক দুঃখবহ নয়, তা হলে আর এই মুচিকুল করে খেতো না।
চিরন্তন নিজেই কি কখনও মুচির হাতে জুতো সমর্পণ করে না? তবু হঠাৎ ওই দৃশ্যটা অসম্ভব খারাপ লেগেছিল চিরন্তনের। চিরন্তন তৎক্ষণাৎ শাশ্বতীকে আদেশ করেছিল, একটা ফরসা শাড়ি-টাড়ি পরে আয়, এক জায়গায় যেতে হবে।
শাশ্বতী ছোড়দার এই গম্ভীর আদেশে আশঙ্কিত হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে বলেছিল, কোথায়?
বাঘের মুখে। হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে
য্যাঃ, মানে
মানেটা পরে বোঝালেও চলবে। যা বলছি করো।
জুতোর দোকানে ঢুকতে গিয়ে চমকে উঠেছিল শাশ্বতী, না না, এ কী! আমার কিছু দরকার নেই বলে হাত পা ছুঁড়েছিল, কিন্তু চিরন্তনের প্রাবল্যে থেমে যেতে হয়েছিল তাকে।
অবশ্য পরমানন্দে যখন দু জোড়া জুতো নিয়ে বাড়ি ফিরল সে, মনেও হল না ক্ষণপূর্বেই ভয়ানক কুণ্ঠিত হচ্ছিল।
.
পুরো জ্বর নয়, শুধু যেন একটু আচ্ছন্ন ভাব। ধ্রুবর ঘরে শুয়ে শুয়ে চারদিক দেখছিল চিরন্তন, বাহুল্য। বিহীনতার চরম চেহারা।
ন্যূনতম যে প্রয়োজনটুকু, তার মধ্যে একটা টেবিল ফ্যানও পড়ে না? চিরন্তনের মনে হচ্ছিল যেন গরমে দম আটকে আসছে।
ধ্রুব এই ঘরে এই পরিবেশে নিশ্চিন্ত চিত্তে লেখাপড়া করে?
চিরন্তন ভাবল, কে জানে পরে ভবিষ্যতে শাশ্বতী ওই বুনো রামনাথটাকে সত্যি বরদাস্ত করতে পারবে কিনা। মেয়েরা বিত্ত চায়, ঔজ্জ্বল্য চায়, প্রাচুর্য চায়।
অথবা এ সব কিছুই চায় না।
মেয়েরা যে কী চায় আর না চায়, মেয়েরা নিজেই কি সে কথা জানে ছাই?
বউদিকে দেখলে মনে হয় তার চাওয়ার লক্ষ্য একটি নিজস্ব সংসার।
বউদি আলাদা হতে চায়।
মনে হয়, ওইটা পেলেই বউদির সব চাওয়া আর সব পাওয়ার সমাপ্তি। চিরন্তন তার সংসারের সব কিছুর সঙ্গে যোগশূন্য, চিরন্তন সাংসারিক ব্যাপারে উদাসীন, অন্যমনস্ক, তথাপি চিরন্তনের চোখে ধরা পড়ে এটা।
বউদি আলাদা হবার জন্যে ছটফটিয়ে মরছে। নিজের কর্তৃত্বে একটি সংসার।
কে জানে, সত্যিই যদি ওটা পেয়ে যায় বউদি, তখন আবার ভগবান চাইতে বসবে কি না!
সেটাও দেখেছে কিনা চিরন্তন।
দেখেছে লিলিমাসিকে।
মায়ের কীরকম যেন বোন লিলিমাসি। লিলিমাসির প্রয়োজনের অতিরিক্ত বড় বাড়ি, লিলিমাসির নিজস্ব ব্যবহারের জন্যে আলাদা গাড়ি, লিলিমাসির ঘরে মা-লক্ষ্মী ঝলমল করছেন। লিলিমেসো সুকান্তি, সুস্বাস্থ্যবান, স্মার্ট, চটপটে চতুর।
লিলিমাসির নিজের চেহারা দিব্য, ছেলে মেয়ে দুটো সুন্দর। লিলিমাসির সংসারে উপরওলা বলতে কেউ নেই, লিলিমাসিই সর্বময়ী কত্রী।
লিলিমেসো পৈতৃক ব্যবসা ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে দিন দিন যত উন্নতির সিঁড়ি গেঁথেছে, লিলিমাসিও ততই সমাজের উচ্চস্তরে ওঠার বেদি বানিয়েছে। যশ প্রতিষ্ঠা, মান সম্ভ্রম, টাকা দিয়ে আর কোনটা না কেনা যায়? কিনেছে সে-সব লিলিমাসি মেসোর ওই ফুলে ওঠা ব্যবসার টাকায়।
মোটের মাথায় লিলিমাসির যে আর কিছু চাইবার আছে এটা যেমন লোকেও বুঝত না, তেমনি লিলিমাসি নিজেও বুঝত না। সেই ষড়ৈশ্বর্যময়ী লিলিমাসিকে দেখতে ভাল লাগত চিরন্তনের, যেত প্রায়ই।
কিন্তু সেই লিলিমাসির হঠাৎ খেয়াল হল একটা জিনিস তার এখনও পাওয়া বাকি। অনন্ত স্বর্গবাসের টিকিটটা তার পাওয়া হয়নি। মানে লিলিমাসি ভগবান পায়নি।
এতদিন লিলিমাসি পায়ে চাকা বেঁধে আর ব্যাঙ্কের চেকবই হাতে নিয়ে সেই সব মার্কেটে ঘুরেছে, যে মার্কেটে ওই যশ প্রতিষ্ঠা, মান সম্ভ্রমটম পাওয়া যায়। হঠাৎ ওই স্বর্গের টিকিটের খেয়াল হওয়া মাত্র লিলিমাসি গাড়ির পেট্রল পুড়িয়ে পুড়িয়ে ওই ভগবান পাওয়ার মার্কেটে মার্কেটে ছুটোছুটি করতে শুরু করল।
বাবা, মা, মহারাজ, স্বামীজী, অবধূত, সিদ্ধযোগী, যখন যাঁর সন্ধান পাচ্ছে লিলিমাসি, ছুটছে তাঁর দোরে। আছড়ে পড়ে বলছে, আমায় ভগবান পাইয়ে দিতে হবে।
কেউ নির্দেশ দিলেন, সংসার বাসনা ত্যাগ করতে হবে, কারণ এই মলিন কুটিল পাপে পূর্ণ সংসারে ডুবে থাকলে তাঁকে পাওয়া অসম্ভব।
কেউ বললেন, সংসার বাসনা ত্যাগ করে যাবে কোথায়? এই ধূলিমলিন সংসারের মধ্যেই তো তিনি চিরবিরাজিত ত্রাতার মূর্তিতে। সংসার সেবা মানেই তাঁর সেবা।
কেউ বললেন, কৃচ্ছসাধনের পথই তাঁকে পাবার পথ।
কেউ বললেন, ভভাগের মধ্যেই তাঁর পূর্ণ রূপ।
কেউ বললেন, নিত্য লক্ষ নাম জপ করো, হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেবে ভগবান।
কেউ বলল, ভজন-পূজন সাধন আরাধন কিছুই কিছু নয়, চিত্ত পবিত্র রাখলেই তিনি এসে উদয় হবেন সেই পুণ্যস্থানে।
ফলে লিলিমাসি কিছুদিনের জন্যে সংসারে উদাসীন হল। ভাঁড়ারের চাবি ঝিকে ছেড়ে দিল, গয়না টাকার আলমারিতে চাবি লাগাতে ভুলতে লাগল, চাকরবাকরকে বকা বন্ধ করল, লিলিমেসোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করা ছাড়ল। আর ছাড়ল সাজগোজ।
লিলিমাসির টিপটপ বাড়িতে ধুলো জমতে লাগল, একমাসের জিনিস দশদিনে ফুরোতে লাগল, লিলিমেসস ক্লাবের সময়টা চতুগুণ বাড়িয়ে ফেলল, আর সেই ফাঁকে একদিন আলমারি থেকে টাকা গয়না লোপাট হয়ে গেল।
লিলিমাসি তখন গুরু বদলাল।
ঝেড়ে কুঁড়ে উঠে ডাক হাঁক শুরু করল, মিস্ত্রি লাগিয়ে নতুন করে বাড়ি রং করালো, পুরনো আসবাব বাতিল করে একেবারে হাল ফ্যাশানের গৃহসজ্জার আমদানি করল। এবং সাজ-সজ্জাহীন উদাসিনী উদাসিনী মূর্তি পরিত্যাগ করে নতুন রূপে ঝলসে উঠল। ঝলমলিয়ে আশ্রমে যেতে লাগল লিলিমাসি, সোনার খড়ম গড়িয়ে দিল গুরুদেবের।
একসময় দেখা গেল লিলিমাসি জীবহিংসা ত্যাগ করেছে, নিরামিষ ধরেছে; একসময় দেখা গেল লিলিমাসির জন্যে প্রতিদিন মায়ের বাড়ি থেকে মহাপ্রসাদ আসছে।
লিলিমাসি কোন এক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কিছুদিন হরদম তীর্থে তীর্থে ঘুরল, বিধবা দিদি আর গুরুভ্রাতা ভগ্নিদের সঙ্গে, ঘুরতে ঘুরতে তীর্থে তীর্থে আটকে বাঁধল, জলসত্র দিল, ছত্রদান করল, বিগ্রহের পায়ে সোনার নূপুর গড়িয়ে দিল, মন্দির নির্মাণে মোটা টাকা চাঁদা দিল।
আবার কোন এক দীক্ষাদাতা বললেন, সত্যিকার সাধন ভজন হয় শুধু কোণে বনে আর মনে।
বনে অবশ্য গেল না লিলিমাসি, তবে মন নিয়ে কোণে বসবার জন্যে ছাদে একটা ঠাকুরঘর বানাল সুন্দর করে। মোজেকের মেঝে, পাথরের বেদি, অষ্টধাতুর বিগ্রহ! বিগ্রহের রুপোর তাকুণ্ড, রুপোর কোশাকুশি, সোনার বাঁশি।
কিছুদিন তাঁর ভোগরাগ, রাস দোল ইত্যাদি নিয়ে খুব মাতল লিলিমাসি, সেই উৎসবের সূত্রে ঘন ঘন ওবাড়িতে নেমন্তন্নও হতে লাগল চিরন্তনদের। তারপরই শুনতে পেল চিরন্তন, লিলিমাসি অন্য এক উচ্চস্তরের দীক্ষাদাতার কাছে যাওয়া আসা করছে, যিনি নাকি বিগ্রহসেবাকে পুতুল খেলা বলে কৌতুক করেন।
অতএব মাইনে করা এক পুরুত ঠাকুর লিলিমাসির বংশীধারীর ভার নিয়েছে, এবং বাতাসা আর ছোলা ভিজে খেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে বংশীধারীকে! কারণ লিলিমাসি যে সময়ই পান না ভোগ টোগের ব্যবস্থা দেখতে। ও দুটো জিনিস মাসকাবারি বাজারের সঙ্গে এসে যায়, বোতলে ভরে তোলা থাকে।
তারও পরবর্তী স্টেজটা কী, সেটা জানা নেই চিরন্তনের। চিরন্তন আর যায় না লিলিমাসির বাড়ি।
ওই যে লিলিমাসি যে ঐশ্বর্য আমাকে অমৃত দিতে পারবে না, তা নিয়ে আমি কী করব? ভাবটি মুখে এঁকে জরিপাড় শাড়ি আর জড়োয়া বালা পরে ডানলোপিলোর গদি আঁটা গাড়িতে চেপে মুক্তি মার্কেটে ছোটে, দেখলে চিরন্তনের কেমন একটা বিতৃষ্ণ-কৌতুক আসে।
ভেজাল খাদ্য আর ভেজাল ওষুধের মতো ওই ভেজাল লিলিমাসিকে দেখে ভয়ানক দুঃখ লাগে চিরন্তনের। আগে সেই আহ্লাদে ডগমগ লিলিমাসি তবু নির্ভেজাল ছিল। চিরন্তন জানে ওকে যদি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়ে বলা যায়, দ্যাখো লিলিমাসি, তুমি দিন দিন কী ভেজাল হয়ে যাচ্ছ, মানবে সে কথা লিলিমাসি? রেগে উঠবে।
তার থেকে ও বাড়িতে আর না যাওয়াই শ্রেয়।
চিরন্তনের যেখানে যেতে ভাল লাগে সেখানে যাওয়াই স্বস্তির।
চিরন্তন বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করে না, কেন ভাল লাগে। ওর কাছে ভাল লাগাটা ভাললাগাই। দৈবাৎ জুটে যাওয়া একটা সম্পদের মতো।
.
যেমন জুটে গেল আজ শাশ্বতীর আর ধ্রুবর।
অবশ্য চিরন্তনই নিমিত্ত।
তবে এ-ও ঠিক, নিমিত্তটা নিমিত্ত মাত্রই। ওদের ভাগ্যের গ্রহ আজ সুপ্রসন্ন ছিল। সুখস্বপ্নের অবাধ কল্পনাতেও যে আশা ওদের ছিল না, তাই পেয়ে গেছে। চিরন্তন ভাবল, আমি ওদের একটা বন্ধ দরজা খুলে ফেলবার সহায় হয়েছি। চোখ বুজে শুয়ে ওদের জন্যে শুভেচ্ছা রাখল চিরন্তন।
.
সিনেমা ভাঙার পর ওরা যখন বেরিয়ে এল, তখন খুশিতে টলটলে দুটো বাচ্চার মতো দেখাচ্ছিল ওদের।
ছবিটা কী দেখছিল, তা যেন মনেও নেই। ওরা যেন নিজেদের এই নতুন ঐশ্বর্য দেখতে দেখতেই বিভোর হচ্ছিল। ফার্স্ট ক্লাস সিটে বসে তারা দুজনে একলা সিনেমা দেখছে, আইসক্রিম খাচ্ছে, পটেটো চিত্স কিনছে, এও সম্ভব?
চির আত্মস্থ ধ্রুবর ভিতরেও যেন কৈশোর চাপল্যের জোয়ার এসেছিল।
বেরিয়ে পড়ে ভিড়ের মধ্যে শাশ্বতীর হাতটা চেপে ধরল ধ্রুবময়। বলল, এই শাশ্বতী, যা থাকে কপালে কোথাও একটু চা খেয়ে নিই চল।
শাশ্বতী বেণী লটকে মাথা নাচিয়ে বলে ওঠে, এই এতদিন পরে আবার আমাকে তুই বলা হচ্ছে যে বড়?
বললাম। ইচ্ছে হল! তুই তুই!
ওঃ বড্ড যে ইয়ে! কেন যাও না, বসে বসে খাতা দেখগে না?
এই, মনে করিয়ে দিস না ও সব। তা হলে আমিও তোকে মামিমার বকুনি মনে করিয়ে দেব।
দোহাই ধ্রুবদা!
আবার দাদা?
আচ্ছা না হয় ধ্রুববাবু! সত্যি, ছোড়দার দৌলতে বেরিয়ে পড়ে হঠাৎ কী মনে হচ্ছে জানো? আমাদের মতো বোকা পৃথিবীতে আর দুটো নেই। নিজেদের আনন্দের মুখে নিজেরাই পাথর চাপিয়ে রেখেছি আমরা। এই যে আজকের সুখ, এই যে আজকের স্বাধীনতা, এ আমরা এখনই ইচ্ছে করলেই পেতে পারি। ভয়ে ভয়ে কাঁটা হয়ে নয়, নির্ভয়ে। অথচ আমরা? আমরা ভয়ে কাঁটা হয়ে বসে আছি। প্রাপ্য পাওনার ওপর থেকে দাবি ছেড়ে দিয়ে চোরের ভূমিকায় দিন কাটাচ্ছি। তা হলে বলো আমাদের মতো বোকা কে?
ধ্রুবর সেই নতুন আভা লাগা মুখটায় ওর স্বভাবের স্তিমিত ছায়াটা পড়ে; তবু সে হেসে উঠেই বলে, লক্ষ লক্ষ! জগতের সমস্ত গরিবরাই আমাদের মতো বোকা।
কক্ষনো না! শাশ্বতী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, গরিব গরিবের মতোই থাকবে। নাই বা তাদের অনেক জিনিস থাকল, তা বলে ভালবাসার অধিকার থাকবে না? সে ভালবাসা ভোগ করবার অধিকার থাকবে না?
এই শাশ্বতী, এই ভিড়ের মধ্যে আর বক্তৃতা করতে বোসোনা, রাজনীতির লেকচারের মতো শোনাবে। চা খাবে তো বলল, না হয় তো চলল।
শাশ্বতীর প্রাণে ধিক্কার এসেছে, তাই শাশ্বতী হঠাৎ ঠিক করে ফেলেছে, আর চোরের ভূমিকায় থাকবে না।
কী আশ্চর্য! কেনই বা থেকেছে এতদিন? তার পুরো বয়েস হয়ে গেছে, এখনও কেন অত ভয়ে ভয়ে থাকবে? বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে? দিক না। নিজেরাই তো তারা বিদেয় হয়ে যেতে চায়।
তোমরা আমাদের হিতৈষী অভিভাবকরা, তোমরা যদি আমাদের মন-প্রাণের দিকে না তাকাও, আমাদের ভালবাসাকে মর্যাদা না দাও, আমাদেরই বা কী দায় তোমাদের মন-প্রাণের দিকে তাকাবার? তোমাদের অহমিকার মর্যাদা রাখবার?
প্রশ্ন আর উত্তর উভয় ভূমিকাতেই বিচরণ করতে থাকে শাশ্বতী এবং মনটাকে সাহসী করে ফেলে। অতএব বলে উঠতে বাধে না তার, খাব না কেন? নিশ্চয় চা খাব। গরিবের জায়গাতেই গিয়ে খাব।
ধ্রুব বলে, আজ ওটা থাক। আজ আমরা বড়লোক। আজ আমরা অত হিসেব-নিকেশ করব না।
বেশ! কিন্তু মনে রেখ, শুধু আজ! অন্যদিন আমরা সস্তার সিটে সিনেমা দেখব, সস্তার হোটেলে খেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে শুধু গল্প করে কাটাব।
এ ছবিটা অবশ্যই বিবাহোত্তর কালের?
না তো কি বর্তমান কালের? শাশ্বতী রেগে গিয়ে বলে, যা দেখছি, তখন তোমার সঙ্গে কেবল ঝগড়াই হবে।
মনে হচ্ছে কি? চন্দ্র সূর্যের মতো অবধারিত সত্য!
তা হোক। ঝগড়ায় আমি ভয় পাই না। বলে পা চালিয়ে ধ্রুবর সঙ্গ ধরে। বাবাঃ এত তাড়াতাড়িও হাঁটতে পারে ধ্রুব। অথচ এমনি দেখলে কত শান্ত মনে হয়।
ওরা ভেবেছিল একটা রেস্তরাঁয় ঢুকবে, কিন্তু মনে মনে যতই সাহসের মন্ত্র জপ করুক, শাশ্বতীই পিছিয়ে গেল।
বলল, যাকগে বাবা, ঝপ করে হয়তো চেনা লোক বেরিয়ে পড়বে। তখন মুশকিল হবে।
ধ্রুব মৃদু হেসে বলে, মুশকিল কী? চেনা কেউ যদি বলে, এ কী! এ তোমার কীরকম আচরণ?…তুমি বলে দেবে–এই সঙ্গী আমার প্রাণেশ্বর।
ওঃ খুব যে! গোবেচারা মাস্টারমশাইটি, ভিতরে ভিতরে এত!
গোবেচারা কে বললে? ধ্রুব বলে, ছাত্ররা আমায় যথেষ্ট ভয়-ভক্তি করে।
দেখো, এই ছেলে পড়ানো কাজটাই যে তোমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ তা বুঝি– শাশ্বতী বলে, তোমায় বলি বটে, বিনা মূলধনে ব্যবসা করেও কোটিপতি হবার দৃষ্টান্ত আছে, বলি–উঠে পড়ে লেগে ভাল জায়গায় চাকরি খোঁজো, কিন্তু ভিতরে ভিতরে জানি ওসব কিছু তুমি পারবে না। তার চেয়ে সংসারে বেশি আয় করতে আমিও চাকরি-টাকরি করব।
তুমি?
ধ্রুব হেসে ওঠে, কে তোমাকে চাকরি দেবে? হায়ার সেকেন্ডারি তো বিদ্যে!
সে কথা জানি না। জানি আজকালকার দিনে মেয়েরা বসে থাকে না। যা পারি করে তোমার সাহায্য করব।
বাঃ। শুনে বেশ লোভ লেগে যাচ্ছে।
মিথ্যে লোভ দেখাচ্ছিনে মশাই, দেখো।
শাশ্বতী তার ভাবী সংসারের কল্পনায় বিভোর হয়। বিভোর হয় চোরের ভূমিকা থেকে মুক্তি পাবে বলে।
কী মনোরম সেই জীবন, কেউ তাদের ওপর চোখ রাখতে আসবে না, কেউ তাদের ওপর চোখ রাঙাতে আসবে না! চিরপরিচিত তারা দুজন নতুন হয়ে উঠবে, চিরদিনের ভালবাসা নতুন আলোয় ঝলসে উঠবে।
চায়ের দোকানের স্বাদটা আজ মুলতুবি রইল।
আর ভয় করব না ভেবেও কেমন একটা অস্বস্তি তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলল বাড়ির দিকে। আর বাড়ির মোড়ে এসে যখন সেই অস্বীকার করা ভয়টাই কেমন করে যেন বুকটাকে হিমসিম করে দিল, তখনই পৃথিবীর পরম সত্যটি শাশ্বতীর মনের মধ্যে ঝলসে উঠল।
সেই সত্যের আগুনে দগ্ধ শাশ্বতী দার্শনিকের গলায় বলে উঠল, প্রেমে পড়লে মানুষ বড় আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যায়।
হঠাৎ এ মতবাদ?
না, দেখলাম কিনা তাই। নিজেকে দিয়েই দেখলাম। এই এতক্ষণের মধ্যে একবারও মনে পড়েনি ছোড়দার জ্বর দেখে এসেছি।
ওটা পৃথিবীর নিয়ম।
তা হোক, নিজেকে খুব বাজে মনে হচ্ছে। কে জানে জ্বর বাড়ল কি না।
তাড়াতাড়ি এগোয়। যেন এতক্ষণের ত্রুটি পূরণ করে নেবে ওই দ্রুততাটুকুর মধ্য দিয়ে।
এই মন শাশ্বতীর।
মুখে যতই বেপরোয়া কথা বলুক, পরোয়াটা করে প্রতি পদে পদে। মনে যতই জোর আনুক আমি আর নাবালিকা নই, বুকটা ঠিকই বরফ হয়ে যায়।
কিন্তু যে ছোড়দার জ্বরের জন্যে অত অপরাধবোধ আসছিল শাশ্বতীর, তার সেই ছোড়দা তখন বিছানা ছেড়ে হাওয়া। মাথাধরা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানাও ছেড়েছে। চটি পায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে, দোতলায় ওঠেনি।
দোতলায় তখন সুপ্রভার বিস্ময় কণ্ঠ উদ্দাম হয়ে উঠেছে, সেজেগুজে বেরিয়ে গেছে দিদিমণি? কোথায় গেছে বলে যায়নি? বলি, আমি তো মরে যাইনি। আমায় ডাকিসনি কেন?…কী করে জানবি এতক্ষণ বাইরে থাকবে? নাই বা জানলি, তবু বলবি।..ভর দুপুরে মেয়ে বেরিয়ে গেলেন! বলা নেই কওয়া নেই, চটি জোড়া পায়ে গলালেই হল!
চিরন্তন শুনতে পাচ্ছে, মা এমনভাবে চাকরটাকে উদ্দেশ করে চালিয়ে যাচ্ছেন, যেন দোষটা সম্পূর্ণ ওই ছোঁড়াটারই। মার এই এক অদ্ভুত স্বভাব, যে সামনে নেই তার উদ্দেশে অজস্র সমালোচনা করে যাবেন, এবং ওই বাক্যস্রোত প্রবাহিত হবে এমন একজনকে সামনে দাঁড় করিয়ে, যার সঙ্গে অপরাধী ব্যক্তির কোনও যোগই নেই। আর এটাও কখনও ভাবেন না মা, তার কাছে কতটুকু বলা উচিত। মা অনায়াসেই তাঁর বাসনমাজা ঝিয়ের কাছে ছেলের বউয়ের তীব্র সমালোচনা করেন, ঘরঝাড়া চাকরের কাছে মেয়ের।…আর অতীতে চিরদিন করে এসেছেন, ছেলেমেয়ের কাছে স্বামীর সম্পর্কে এবং স্বামীর কাছে ছেলেমেয়ে সম্পর্কে।
কটু তিক্ত কষায় লবণাক্ত বহু সমালোচনা করতে পারেন মা, কিন্তু সবটাই অপরাধীর অসাক্ষাতে। সামনে দাঁড়িয়ে বেশি কথা বলার সাহস নেই তাঁর।
সেটি অবশ্য আমার বউদি ঠাকুরানীর আঠারো আনা আছে–ভাবল চিরন্তন হেসে হেসে, আর মার সেই বিরক্ত কণ্ঠ শুনতে শুনতে বেরিয়ে গেল, কেন রে বাপু, এত স্বাধীনতা কীসের? না হয় তোদের একালে মেয়েমানুষের রাস্তায় বেরোনো হয়েছে, তাই বলে মা-ঠাকুমাকে এত অগ্রাহ্য? তাদের ধারার কিছু রাখতে নেই? একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ করতে হয়? ভয়ডর বলে কিছু নেই?… চালিয়ে যাচ্ছেন মেল ট্রেন।
চিরন্তন পথে বেরিয়ে ভাবল, মার তাঁর মেয়ের সম্বন্ধে এই ভাব, অথচ বেচারা মেয়েটা মার ভয়ে কাঁটা। হয়তো সংসারের সব ক্ষেত্রে এমনই হয়। এক পক্ষ ভাবে অনেক দিচ্ছি, অপর পক্ষ ভাবে, কিছুই পাচ্ছি না।
তারপর ভাবতে ভাবতে চলল, শাশ্বতীটার কপালে হয়তো আজ অনেক লাঞ্ছনা আছে। কে জানে, ধ্রুবটাকেও অপমান সইতে হবে কি না।
আমি এর কারণ হলাম।
কিন্তু এর প্রয়োজনও রয়েছে। এ সংসার ওদের ভালবাসাকে প্রশ্রয় দেবে না, সাহায্য করবে না, সহানুভূতির চক্ষে দেখবে না, নিজেদের ব্যবস্থা ওদের নিজেদেরই করতে হবে। এইভাবে বিদ্রোহের মধ্যে দিয়েই তার পরীক্ষা হোক।
নিজেদের জীবনকে কি ওরা চুরি করে নেবে? ছিঃ!
ওরা বিদ্রোহের পথে নিজেদেরকে ঘোষণা করুক।
বিদ্রোহের শক্তি অর্জিত হয় আঘাতের মধ্যে থেকে, অপমানের মধ্যে থেকে। সেই আঘাত, সেই অপমান আসুক ওদের ওপর।
আমি ওদের বাঁচাতে পারতাম—
ভাবল চিরন্তন, আমি মাকে গিয়ে বলে আসতে পারতাম সব দোষ আমার, ওরা যেতে চায়নি, আমিই জোর করে কিন্তু আমি তা করলাম না। পক্ষপুটে আড়াল করে কদিন রাখা যায়? আর সে আড়াল শুধু নিজের উপর আস্থা হারাতে শেখায়। ওদের বুঝতে হবে ওদের পায়ের তলার মাটি কতটুকু। ওরা বুঝুক সে মাটিতে দাঁড়িয়ে লড়বার শক্তি ওদের আছে কি না।
যদি ফেলিওর হয়? মরুক, জাহান্নামে যাক!
চিরন্তনের জন্যে যখন ওরা চিন্তিত হচ্ছিল, চিরন্তন তখন ওদের কথাই চিন্তা করছিল। ওরা যখন বাড়ি ফিরল, চিরন্তন তখন তার রোগশয্যা ছেড়ে ভবানীপুরের পথ ধরেছে বাড়ির উদ্দেশে।
.
কিন্তু চিরন্তনের চিরকালের বন্ধু রামানুজের বাড়ি তো ভবানীপুরে নয়, সে তো ফার্ন রোডে। অভিজাত পাড়ায়।
অবশ্য ভবানীপুরও একদা অভিজাত পাড়া ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। এখন ওর যৌবন গেছে, ও মাহাত্ম্য হারিয়েছে। মানুষের মতো দেশ শহর, পাড়া প্রতিষ্ঠান, সব কিছুরই শৈশব, বাল্য, যৌবন, বার্ধক্য আছে, উদয় অস্ত আছে। এটা প্রকৃতির রীতি। কেউ যদি ভাবে কোনও কিছু চিরকাল অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকবে, তার মতো ভুল আর নেই। কোনও কিছু অবিরত উন্নতির পথে এগোবে, এমন চিন্তাও হাস্যকর। সমাজ সংসার সভ্যতা সংস্কৃতি সব কিছুতেই প্রকৃতির এই উত্থান-পতন উদয়-অস্তের লীলা।
একটা পরিবারকে কখনও পুরুষানুক্রমে উন্নতির পথে অগ্রসর হতে দেখা যায় না। এই দেখ সমৃদ্ধি সাফল্য শক্তিমত্তা, পরবর্তী পুরুষে দেখ সব কিছু অন্তর্হিত, অস্তমিত।…
মার্বেল পাথরে মোড়া বনেদি দালানে ছেঁড়া ফ্রক পরা মেয়ে ঘুরে বেড়ায়, চকমিলানো অট্টালিকার খাঁজে খাঁজে বহু বর্ণের ভাড়াটে এসে ঢোকে।
যেমন চিরন্তনের ওই ভবানীপুরের বন্ধুর বাড়িতে
.
কিন্তু রামানুজের এখন মধ্যাহ্ন সূর্য।
রামানুজের বাড়ির মেঝে সেকেলে ধরনের মার্বেল মোড়া নয়, সর্বাধুনিক নকশার মোজাইক করা।
সেই মোজাইক করা হল-এ ডানলোপিলোর সোফায় বসে রীতা জুলজুলকে বিস্কিট খাওয়াচ্ছিল।
জুলজুল কখনও আহ্লাদে ল্যাজ নাড়ছে, কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে রীতার কোলে উঠছে। কিছুক্ষণ আগে সে আহ্লাদের আতিশয্যে রীতার সিল্কশাড়িটা ফাঁস করে ছিঁড়েছে, রীতা সেই অপরাধে জুলজুলকে মিষ্টি ধমক দিয়েছে, জুলজুল, এটা কী করছ তুমি? এই নিয়ে সাতটা শাড়ি ছিঁড়ে দিলে তুমি আমার! নটি গার্ল, তোমায় কী শাস্তি দেব বলো?
জুলজুল সেই তিরস্কারে অভিমানাহত, তাই রীতা এখন তাকে বিস্কিট খাওয়াচ্ছে আর পিঠে হাত বোলাচ্ছে।
রামানুজের অবশ্য চিরন্তনের মতো কুকুরভীতি নেই, তবে খুব একটা প্রীতিও নেই। কুকুর ও খারাপ বাসে না এই পর্যন্ত। কুকুরপ্রেমী না হলেও, লোমওয়ালা সুন্দর কুকুর-টুকুর দেখতে তার ভালই লাগে।
কিন্তু নিজের বাড়িতে বাড়ি ঢুকেই যখন দেখে রীতার কোলে কুকুর, রাগে মাথা ঝিমঝিম করে আসে তার।
আজও এল।
তবু চিরপ্রথামতো বাড়ি ঢুকে মধুর হাসির হরির লুঠ ছড়াতেই হল।
সেই হাসি ছড়িয়ে টাইটা খুলতে খুলতে রামানুজ বলল, কখন ফিরলে?
কখন ফিরলাম!
রীতার ভুরু কুঁচকে উঠল, কিন্তু রীতা কণ্ঠে বিস্ময় ফোঁটাল না। কারণ বিস্ময় প্রকাশ জিনিসটা বিশি রকমের অনাধুনিক। আত্মস্থতাই আধুনিকতা।
রীতা সেই আত্মস্থ আধুনিক গলায় বলে, গেলাম কোথায় যে ফেরার প্রশ্ন?
গেলে কোথায়! কেন সিনেমায় যাওনি?
রামানুজ এত বেশি আধুনিক হয়নি, রামানুজ এখনও বিস্ময় প্রকাশ করে।
স্বপ্ন দেখছ বোধহয়। না কি এই সন্ধেবেলাই বোতল খালি করে এসেছ? বলে রীতা।
যা ইচ্ছে বলে নাও।
টাই খুলে ধাতস্থ হয়ে অন্য একটা সোফায় বসে রামানুজ বলে, তাজ্জব! চিরোটা তা হলে করল কী?
প্রশ্নটা আত্মগত, রীতা অতএব প্রতিপ্রশ্ন করল না। রীতা জুলজুলকে নিয়ে মাতামাতি করতে লাগল। একটু বেশিই করতে লাগল।
রামানুজ সেই দিকে তীব্র আগুনভরা দৃষ্টি মেলে মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে আবার বলে, চিরো আসেনি? অথবা ফোনও করেনি?
রামানুজের কণ্ঠস্বরে তিক্ততা।
কিন্তু রীতা আত্মস্থ।
রীতার কণ্ঠে শুধু মাজাঘষা তীক্ষ্ণতা।
তোমার কি ধারণা–তোমার অনুপস্থিতিতে তোমার বন্ধুরা তোমার স্ত্রীকে ফোন করে, সঙ্গদান করতে আসে?
একসঙ্গে এক গণ্ডা তোমার বলে রীতা, এবং প্রত্যেকটির উপর বিশেষ একটি মিহি জোর দেয়।
রামানুজ আরও তিক্ত গলায় বলে, আরে না না, ব্যাপারটা অন্য। আজ অফিসে কে একজন বলছিল, ফিরিঙ্গি অ্যান্টনি নাকি একখানা খুব ভাল ছবি হয়েছে, গান নাকি অপূর্ব! বাংলা ছবি যে দর্শনযোগ্য হতে পারে এ বিশ্বাস অবশ্য নেই, তবু ভাবলাম দেখলে হয়। তাই ম্যাটিনি শোর দুটো টিকিট আনিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় দিল্লি থেকে ট্রাঙ্ককল, দিবাভাই দেশাই আসছেন, এক্ষুনি তাঁকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। আর মানুষটা যখন দেশাই সাহেব, তখন ডিরেক্টরদের একজন কারুরই যাওয়া উচিত।…ব্যস, হয়ে গেল আমার সস্ত্রীক বাংলা সিনেমা দেখা! তখন তাই চিরোটাকে ফোন করলাম, তুই যা ভাই রীতাকে নিয়ে। আমার এই অবস্থা।…একবার বলল বটে, অফিসের ফাইল উদ্ধার হয়নি। আমি বললাম–ও বস্তুটা তো জীবনেও উদ্ধার হবার নয়, মৃত্যুকাল পর্যন্ত তাড়া করে বেড়ায়, অতএব টেবিলে চাপা দিয়ে রেখে চলে আয়।..এল চলে, তক্ষুনি এল। গ্ল্যাডলিই টিকিট দুটো নিল, বলল, চলে আসছে এখানে–
রীতা মন দিয়ে সবটা শুনল, তারপর একটু বাঁকা হাসি হেসে বলল, তুমি যদি লেখক হতে, বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হত। এত সব ভাল ভাল প্লট আসে তোমার মাথায়!
কী আশ্চর্য, তুমি ভাবছ আমি গল্প বানাচ্ছি? বিশ্বাস করো এর একটাও মিথ্যে নয়। টিকিট আমি আনিয়েছিলাম, চিররাও আমার অফিসে এসেছিল, এবং সে টিকিট নিয়েও চলে এসেছিল।
তারপর বোধহয় রাস্তায় বেরিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
বুঝতে পারছি না
তা স্নানটা সেরে কিছু মুখে দিয়ে, তবে বুঝতে চেষ্টা করতে বসলে হত না?
খুব নিরীহ প্রশ্ন করে রীতা।
রামানুজ যেন কৃতার্থ হয়, রামানুজ বলে, এ হতভাগ্য সম্পর্কে এখনও চিন্তা আছে তা হলে? আমি তো ধরে নিয়েছি তোমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে শুধু জুলজুল।…
কিন্তু ব্যাপারটা কী হল বলো তো?
রীতা বলে, তোমার বন্ধু ব্যাপারটা আমায় গোপনে জানিয়ে গেলে তোমায় জানাতে পারতাম!
রামানুজ উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতের তর্জনীটা তুলে ঘড়ির পেণ্ডুলামের মতো এদিক ওদিক চালিয়ে বলে ওঠে, ঠিক।
রীতা প্রশ্ন করে না, কী ঠিক?
রীতা কুকুরকে শাসায়। বলে, নটি গার্ল, সাহেবকে কামড়াবে না। সাহেব বড় ভদ্র ব্যক্তি।
রামানুজ সে কথায় কান দেয় না; রামানুজ বলে, না না, ব্যাপারটা চিন্তার ব্যাপার! তোমার কি মনে হয় চিরো তোমার এই জুলজুলের ভয়ে আসেনি?
হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
যদি না হতে পারে তো কী হতে পারে?
রীতা অগ্রাহ্যভরে বলে, রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়ে ফিনিশ হয়েও যেতে পারে।
ইস, কী বলছ রীতা!
বলছি খুবই সাধারণ কথা। একটা যুক্তিগ্রাহ্য সীমানায় তো এসে পৌঁছনো চাই? লোকটা তো বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না। জীবিত অথবা মৃত যাই হোক, দেহটার তো একটা ফয়সালা হওয়া চাই?
তা বলে চিরো সম্বন্ধে তুমি
রামানুজের কণ্ঠে আহত অভিমান, চিরো আমার চিরকালের বন্ধু
কিন্তু রীতা অবিচলিত।
রীতা হি হি করে হেসে ওঠে, তোমার চিরকালের বন্ধু কেন, তোমার সম্পর্কে হলেও ঠিক এই কথাই বলতাম আমি। একটা মানুষ যদি ড্যালহাউসি থেকে বালিগঞ্জে আসবার পথে অকস্মাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়, তা হলে তাকে খুঁজতে কোথায় ছোটে সবাই? থানায় অথবা হাসপাতালে! তা তোমার দি গুড ফ্রেন্ড থানাতেই বা যাবে কেন? অতএব শেষ গতি ওই হাসপাতাল। মনে হচ্ছে, ওই এরিয়ার মধ্যে ওই টাইমে কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে কিনা খোঁজ নেওয়া উচিত তোমার। মানে যখন স্মরণে রেখেছ চিরকালের বন্ধু!..তা ছাড়া–যখন ওর প্রতি একটা বড় আশা পোষণ করছ, তখন ওকে বাঁচিয়ে রাখা তোমার স্বার্থ।
রামানুজ যেন তার পাগলিনী স্ত্রীর অর্থহীন কথায় হতাশ হয়। রামানুজের চোখে সেই হতাশার ছায়া পড়ে।
রামানুজের কণ্ঠস্বরে তার ছোঁয়াচ এসে লাগে, ওর উপর আশা পোষণ করছি! কীসের আশা পোষণ করছি?
রামানুজ যেন বিস্ময়ে ভেঙে পড়ে।
রীতা কিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলে, সেটা তুমি নিজেই ভাল জানো।
রামানুজ নড়ে চড়ে বসে। বলে, রীতা, তোমার কথাবার্তাগুলো আজকাল কেমন উলটোপালটা হচ্ছে–
হচ্ছে বুঝি? বাঃ তা হলে তো তোমার সুবিধেই! তা হলে এই পাগলিনী স্ত্রীকে সোজা মেন্টাল হসপিটালে পাঠাতে পারা যাবে, তাকে তোমার কোনও বন্ধুর ঘাড়ে চাপাবার জন্যে বহুবিধ প্ল্যান খাটাতে হবে না মাথায়।
রীতা, তুমি আরও দুর্বোধ্য হচ্ছ।
তাই নাকি? ভয় পাচ্ছ? তা হলে সুবোধ সুবোধ্য হওয়াই ভাল। যাও স্নান সেরে নাও, আমি ফ্রিজ খুলে তোমায় খেতে দিই। দেখি বেহারী তোমার জন্যে কী কী বানিয়ে রেখে গেছে। ও আবার আজ ছুটি নিয়ে গেছে কিনা।
আবার ছুটি!
রামানুজ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এই না কদিন আগে ছুটি নিল?
সে তো ও মাসে।
ও মাস সে মাস জানি না, এভাবে যখন তখন ছুটি নেবে কেন?
রীতা কুকুরের কানের পিঠ উলটে উলটে দেখতে দেখতে নির্লিপ্ত গলায় বলে, নিয়মিত ছুটির ব্যবস্থা নেই বলে।
তুমি ওদের বড্ড সাপোর্ট করো। বাড়ির কাজ করছে, তাদের কি অফিসের মতো নিয়মিত ছুটি হবে নাকি?
হবে কিনা জানি না, তবে হয় না। আর সেই না হওয়ার জন্যেই যখন তখন যা-তা বলে ছুটি নিতে বাধ্য হয়। যেমন সেবার বলল বউয়ের অসুখ, এবার বলল ছেলের
সব ধাপ্পা
আহা ধাপ্পা বলছ কেন? বউ ছেলে থাকলেই তাদের পীড়াও থাকে। তাদের জন্যেও অতএব পীড়া ঘটে। তোমার তো তবু বাঁচোয়া ওর একটা জিনিস নেই।
রামানুজ হতাশ গলায় বলে, সেটাকে বাঁচোয়া বলছ?
বাঃ বলব না? ওর থেকে বাঁচোয়া আর কী আছে?
রামানুজ গম্ভীর হয়। রামানুজ যেন ক্ষুব্ধও হয়, রীতা, তোমার অবশ্যই মনে থাকা উচিত, তুমি এতে রাজি হয়েছিলে। তোমার সঙ্গে পরামর্শ করেই তবে তোমায় অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
রীতা এবার যেন একটু বিস্ময় প্রকাশ করে, কী আশ্চর্য, আমি কি বলছি আমাকে না জানিয়ে তুমি আমায় সর্বস্বান্ত করেছ?…তুমি আমার প্রেমে পড়ে বিয়ে করা বর, বিয়ের আগে কতদিন তোমার সঙ্গে পূর্বরাগ চালিয়েছি, তখন থেকে তুমি আমায় ওই অপারেশনের মধুময় পরিণাম দেখিয়ে দেখিয়ে মোহিত করেছ। কিন্তু থাক ওসব পুরনো ছেঁড়া কথা, তোমার এখন খাওয়ার দরকার।…এই জুলজুল…ওনাকে কামড়াতে যেও না, উনি অতি ভদ্র ব্যক্তি। ফ্রেন্ড।
এই বউ রামানুজের।
এই বউকে নিয়ে কী করবে রামানুজ?
স্বয়ং মহাদেবও সতীর মৃতদেহের ভার বেশিক্ষণ বহন করে উঠতে পারেননি, তাই উন্মত্তের ভান করে তাকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ছড়িয়ে ফেলে দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, অস্বীকার করে লাভ নেই, রীতার জীবনের একটা দিক শূন্য। আর তার জন্যে রামানুজ কিছুটা নিমিত্তের ভাগী। কিন্তু এমনিতেই কি কোনও মেয়ে বন্ধ্যা হয় না? তা ছাড়া এতই বা শূন্যতা কীসের রে বাবা? পৃথিবীতে কি আনন্দ উপভোগের আর কিছুই নেই? কেবলমাত্র ওই মা হওয়াটাই সর্বসুখাধার?…আর তাই যদি হবে, তবে–তখন কেন রাজি বলে স্বাক্ষর করেছিলে মানিক? আমার বাক্যচ্ছটায় ভুলে? কচি খুকি ছিলে তখন তুমি?
তা কেন, তখন তুমি ভেবেছিলে আমাদের এই যুগল জীবনই আমাদের যথেষ্ট।…কিন্তু এখন তুমি মনে করছ আমার মধ্যে আর হৃদয়ঘট ভরবার উপযুক্ত বারি পাচ্ছ না।…সেটা তোমারই মনের দোষ, আমার নয়। তুমিই বদলাচ্ছ। নইলে আমি তো তোমায় ঠিক আগের মতোই ত্রুটিহীন সঙ্গ সাহচর্য দিতে চেষ্টা করছি। তুমি যদি সেই মূল্যবান ঐশ্বর্যটাকে অবহেলায় ঝেড়ে ফেলে দিতে চাও, তুমি যদি আমার এই কষ্ট করে বার করা সময়টাকে একটা বস্তু বলে গণ্যই না করো, আমার চেষ্টা বজায় থাকবে কী করে? এই তো–আগে আগে মাসে একবার করে দুচারদিনের জন্যেও কলকাতার বাইরে বেড়াতে গেছি আমরা, রাজকীয় ভাবেই নিয়ে গেছি তোমায়, কিন্তু নিজেই তুমি সে পথে কাঁটা দিলে। দুম করে একটা কুকুর পুষে বসলে! তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়াও ঝামেলার ব্যাপার, তাকে রেখে যাওয়াতে নাকি তোমার পক্ষে অসম্ভব।
আমার ঠাকুমাকে দেখেছি, জন্মে জীবনে দেশের বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় আসতেন না। বয়েস হয়েছিল, একা থাকায় কষ্ট ছিল, তবু বলতেন, এখান ছেড়ে কী করে যাই?
তার কারণও ওই পোষা প্রাণী।
অবশ্য ঠাকুমার পোষ্যটি প্রাণী কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। ঠাকুমা পুষেছিলেন ঠাকুর।
কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঠাকুরে আর কুকুরে পার্থক্য কী? ভাবল রামানুজ, দুটোতেই সমান শৃঙ্খল!
আশ্চর্য বাবা, একদিকে মানুষ স্বাধীনতা-স্বাধীনতা করে হাঁপায়, আর অন্য দিকে ইচ্ছে করে পায়ে বেড়ির পর বেড়ি চাপায়। ছেলেমেয়ে হয়নি বলে উনি একেবারে পাগলা হয়ে যাচ্ছেন। কেন রে বাপু, কী রাজ্য রসাতলে যাচ্ছে তার জন্যে? কত ফ্রি আছিস তা ভাবছিস না? কুকুর পুষে, পাখি পুষে, লাল মাছ পুষে, স্বাধীনতা হারাস, সে আলাদা কথা, কিন্তু ফ্রিডমটা কি সুখের নয়?
নাঃ, মেয়েদের মাথাটা যে বিধাতা কী দিয়ে তৈরি করেছে, খুলি খুলে দেখতে ইচ্ছে করে।
তারপর রামানুজ আর একবার চিরন্তনের কথা ভাবল।
সত্যি লোকটা করল কী?
এ কথা অবশ্য ঠিক, রামানুজ নিজের জন্যে একটা বাংলা ছবির ম্যাটিনির টিকিট কাটেনি। কেটেছিল রীতাকে কারও উপর চাপিয়ে দিতে। কারণ রীতা বাংলা ছবি দেখতে ভালবাসে।
রীতাকে খুশি রাখতে পারলেই মঙ্গল। এবং সেই খুশিটা রামানুজ বাদে অন্য কাউকে দিয়ে হলেই রামানুজের পক্ষে মঙ্গল।..চিরন্তন রাজি না হলে রামানুজ সীতেশ সেনকে বলত, সীতেশ সেন কৃতার্থ হয়ে যেত। আর সীতেশ সেনও সময় দিতে না পারলে, দিলীপ।…রামানুজের অধস্তন। যাকে রামানুজ পোকার মতো পায়ের তলায় পিষে ফেলতে চায়, অথচ মুখে তোয়াজ করতে বাধ্য হয়।
তোয়াজ করতে হয় দিলীপ ইউনিয়নের পাণ্ডা বলে। কিন্তু সেটা তো পরোক্ষ ব্যাপার। প্রত্যক্ষে যদি কোম্পানির কোনও এক ডিরেক্টর কোম্পানির একজন কেরানির কাছে প্রার্থনা জানায় তার সুন্দরী স্ত্রীকে একটু সাহচর্য দিতে, কোনও কেরানি সেটা অবহেলা করতে পারে? পারে না, মাঝে মাঝেই ফাঁদে পড়তে হয় দিলীপকে।
দিলীপকে বেছে নেওয়ার আর একটা কারণ, দিলীপ বালিগঞ্জেই থাকে। সময় অসময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।
ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, দিলীপ এ টোপ গেলে। তবে সব সময় ইচ্ছে হয় না দিলীপের সঙ্গে রীতা ঘুরে বেড়াক। দিলীপ অসময়ের।
তাই আগে চিরন্তনকে ডেকেছিল।
আশ্চর্য! এল, রাজি হল, অথচ
বিশেষ কোনও একটা প্রতিবন্ধক না হলে
রীতা যা বলল, তাই নয় তো?
উঃ এমন সব ভয়ানক ভয়ানক কথা অবলীলায় বলতে পারে রীতা!
হঠাৎ ভেবে রোমাঞ্চিত হয় রামানুজ, আচ্ছা আমি যেটা চালাকি করে প্রতিপন্ন করতে চাই, সেটাই সত্যি নয় তো? সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো রীতা? নইলে শুধু আমায় জ্বালাতন করবার জন্যে অমন যথেচ্ছ কথা মুখে আনতে পারে?
কিন্তু এই পাগলকে কি পুরো উন্মাদ বলা যাবে? যেটা নাকি বিবাহ-বিচ্ছেদের একটা কারণস্বরূপ হতে পারবে? এই চিন্তা নিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসে রামানুজ।
রীতা এখন কুকুরমুক্ত।
এখন স্নেহময়ী স্ত্রী।
রীতা এখন বলছে, এই শোনো, ঘড়িতে অনেকগুলো তো বেজে গেছে–এখন আর শুধু চা না একেবারে খেয়েই নেবে? ডিনার টাইম তো হয়েই গেছে প্রায়।
কিন্তু রীতার এই সহজ স্নেহস্বরে বিশ্বাস কী? রীতা হয়তো আর এক মিনিট পরেই হি হি করে হেসে বলে উঠতে পারে, দেখছ তো, আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের কত দিয়েছে? দেখো বিনা পরিশ্রমে আমি কেমন পতিব্রতা সতী হতে পারছি। আমার চাকর-ভগবান জানেন কি না কি ময়লা হাতে আর নোংরা ভাবে এই সব খাবার বানিয়ে রেখে ফ্রিজে আর হট চেম্বারে পুরে রেখে গেছে, আমি সিল্কের শাড়ি পরে পরীর মতো সেজে তোমায় গরম ঠাণ্ডা সব রকম সাপ্লাই করছি। তুমি যেটা খেয়ে ধন্যি ধন্যি করছ, আমি অমায়িক গলায় বলছি সেটা আমার রান্না।
রামানুজের জীবন মহানিশা!
রীতা হয়তো বলবে, এই মহানিশা রামানুজ নিজে ডেকে এনেছে, কিন্তু সেটাই কি সত্যি? রামানুজ ভগবান মানে না বটে, তবে ভাগ্য বস্তুটা মানে।
.