।। দুই ।। – চাঞ্চল্যকর খবর
দু—দিন পরে।
সকাল বেলায় প্রণবেশ এসেছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছেই। আমার স্ত্রী দু’স্লাইস করে এগটোস্ট আর চা দিয়ে নিজেও বসেছে। নোটন পড়ছে পাশের ঘরে।
প্রণবেশ অনেকক্ষণ ধরে অম্বুজ লাহিড়ির গুণকীর্তন করে গেল। উনিও নাকি যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন একজন সাধক। আমি অবশ্য এই প্রথম দেখে ততটা মুগ্ধ হতে পারিনি। একটু যেন অহংকারী বলে মনে হয়েছিল। আর খুব সাদাসিধে নয়।
বললাম, চলে যাবার সময় হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও না বলে অমন গম্ভীর মুখ করে কেন গেলেন সেটাই বুঝতে পারছি না। তোমায় কিছু বলেছেন?
প্রণবেশ মাথা নাড়ল। বলল, না। অবশ্য আমারও খটকা রয়েছে। মনে হল বউদি ওই যে বললেন, সুব্বা যদি ট্রেনে উঠে কলকাতা পর্যন্ত আমাদের ধাওয়া করত তাহলে কী হত বলুন তো? যাক খুব বেঁচে গেছি।—এই কথার উত্তর দিতে গিয়েও উনি কেন চেপে গেলেন!
একথা শুনে আমার স্ত্রীর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললেন, সুব্বা সত্যিই এখানে এসে পড়বে না তো?
আমি জোরে হেসে বললাম, অত সহজ নয়। এটা কলকাতা শহর। ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি রাস্তা কাঁপিয়ে ছুটছে। লোকের ভিড়। এটা কাঠমান্ডুর সেই নির্বান্ধব পাহাড়তলি নয়, নির্জন দেশের গ্রাম হরিদেবপুরও নয়। কেউ ওটাকে কোলে করে নিয়ে এসে হাওড়া বা শেয়ালদা স্টেশনে তুলে দিলেও সল্টলেক পর্যন্ত রাস্তা খুঁজে খুঁজে আসা সুব্বা কেন ওর প্রভু সেই তান্ত্রিকটার পক্ষেও সম্ভব নয়। তার ওপর তোমার স্বামী একজন পুলিশ অফিসার মনে রেখো। হাতের কাছে দুটো টেলিফোন। হেড কোয়ার্টারে একটা ফোন করলেই—কী বল প্রণবেশ?
প্রণবেশ আজকের কাগজটা পড়ছিল। একটু হাসল। তারপরই হঠাৎ কাগজের ওপর ঝুঁঁকে পড়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, আরে! এ আবার কী?
বললাম, কী? রহস্যজনক খুন?
লক্ষ করলাম প্রণবেশের দু—চোখ যেন বিস্ময়ে বড়ো হয়ে উঠেছে।
খবরটা কী ছাই বলো না।
প্রণবেশ তার উত্তর না দিয়ে শুধু একটা খবরের দিকে আঙুল দেখিয়ে কাগজটা আমার হাতে দিল।
ছোট্ট খবরটা এইরকম, গতকাল গভীর রাত্রে চিৎপুর রোড (রবীন্দ্র সরণি) আর বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং—এর মুখে প্রহরারত পুলিশ এক অদ্ভুতদর্শন ছেলেকে একা একা বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে দেখে তার কাছে এগিয়ে যায়। তাকে বার বার ডাকলেও সে সাড়া দেয় না। কাছে যেতেই সে অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
পড়তে পড়তে আমার শরীর হিম হয়ে এল। আর আমার স্ত্রী ফ্যাকাশে মুখে শুধু আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মিনিট পাঁচেক আমাদের মুখে কোনো কথা সরল না। প্রণবেশ আর আমি নিঃশব্দে সিগারেট খেতে লাগলাম।
কিছুক্ষণ পরে প্রণবেশ আমাকে বলল, কী মনে হয়?
বললাম, কনস্টেবলটি যদি বাড়িয়ে কিছু বলে না থাকে তা হলে নিঃসন্দেহে অদ্ভুত ঘটনা। অবশ্য আমার মনে হয় গুরুত্ব দেবার কিছু নেই যতক্ষণ না ওই ‘অদ্ভুতদর্শন’ কথাটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে। ‘অদ্ভুতদর্শন’ বলতে পুলিশটি কী বলতে চাইছে? যদি ওটা নিছক কথার কথা হয় তাহলে nothing serious—মাথা ঘামাবার কিছু নেই। কেননা হয়তো বাইরে থেকে আসা কোনো নতুন ছেলে পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছিল।
কিন্তু ওই যে বারে বারে ডাকলেও সাড়া দেয়নি। কাছে যেতেই অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়—কথাগুলোর মানে কী?
বললাম, ওর মানে সোজা। সম্ভবত গ্রামের ছেলে। গভীর রাত। পথ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছিল। হঠাৎ পুলিশের হাঁকড়ানি শুনে এক দৌড়ে কোনো অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। আর সাড়া দেয়নি। হয়তো ছেলেটা কালা। এ ছাড়া আর কী হতে পারে?
আমার স্ত্রী ভয়ার্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ গো, সুব্বা নয় তো?
আমি জোরে হেসে বললাম, মাথা খারাপ নাকি? সুব্বা আসবে আমাদের গ্রাম থেকে এত দূরে কলকাতায় ট্রেনে চেপে?
সেই সন্ন্যাসীটা ওকে নিয়ে ট্রেনে করে আসতে পারে তো!
তা আসতে পারে কিন্তু আশা করি সল্টলেকে এসে পৌঁছোতে পারবে না। কেননা সন্ন্যাসী ঠাকুরকে আমি ঠিকানা দিয়ে নেমন্তন্ন করে আসিনি।
আমার কথা শুনে গৃহিণী অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন।
গৃহিণী নিশ্চিন্ত হলেও প্রণবেশকে দেখে মনে হল ও যেন তখনও কী ভাবছে।
বললাম, কী হে! কী এত ভাবছ?
ও তার উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিল। তারপর ডায়াল করতে লাগল।
হ্যালো, জোড়াসাঁকো থানা? কমলেশবাবু নাকি? আমি প্রণবেশ কথা বলছি।
হ্যাঁ, ভালো আছি। না, খুন—খারাপির ব্যাপার কিছু নয়। অন্য একটি ব্যাপার। আজকের কাগজে একটা খবর দেখলাম—
হ্যাঁ। আমাদের জগদীশ ঘোষ ওইরকম কিছু একটা দেখেছিল। ও তো ভয়ে মরে যাচ্ছে। বলছে ভূত ছাড়া কিছু নয়।
ওর কথা বিশ্বাস করেই কাগজে খবর পাঠিয়ে দিলেন?
কী খবর ভাই? এখানে আর—সবাই ওর কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেছে। ওদের ধারণা অলৌকিক কিছু। শেষে ওদেরই চাপে খবরটা বার করতে হল।
আপনার কী ধারণা?
নিজে চোখে তো দেখিনি। তবে ও যে ভাবে বর্ণনা দিচ্ছে তাতে কিছু যে একটা দেখেছে তাতে সন্দেহ নেই। এতদিন ও এত জায়গায় গভীর রাতে ডিউটি দিয়েছে, কখনও তো এরকম ভয় পায়নি। তা ছাড়া—
তা ছাড়া কী বলুন।
তোমার মনে আছে কিনা জানি না বেশ কয়েক বছর আগে রেড রোডে এক পুলিশ অফিসার গভীর রাতে জিপ চালিয়ে যেতে যেতে রাস্তার মাঝখানে কিছু একটা দেখেছিলেন। সে খবর কাগজে ছাপা হয়েছিল। পুলিশের ব্যাপার বলেই ওটা আমি ফাইল করে রেখেছি। ইচ্ছে করলে একদিন দেখে যেও।
তা না হয় দেখব। আপনি একবার জগদীশকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারেন?
তা পারি। কিন্তু তুমি হঠাৎ এ নিয়ে এত ভাবছ কেন? তুমিও কি ওইরকম কিছু দেখেছ?
না। তা নয়। এ নিয়ে পরে কথা বলব।
প্রণবেশ ফোন ছেড়ে দিল।
বললাম, একেবারে জোড়াসাঁকোয় ফোন করে বসলে?
হ্যাঁ। যে দেখেছে সে ঠিক কী দেখেছে তা স্পষ্ট করে জানা দরকার।
মনে হচ্ছে তুমি ব্যাপারটায় খুব গুরুত্ব দিচ্ছ?
এতক্ষণে প্রণবেশ একটু হাসল।
বলল, দেখাই যাক না শ্রীমান জগদীশ কী বলে। কী জানি বাবা, আমার কীরকম ভয় করছে। বলে আমার স্ত্রী উঠে গেলেন।