চত্ত্বর ধরে ছুটতে ছুটতে আরেকটা চিৎকার শুনতে পেল কিশোর। আস্তাবলের দিক থেকে আসছে।
বিপদে পড়েছে মুসা, ভীষণ বিপদ। কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে তাকে। কোরালের বেড়ায় পিঠ ঠেকিয়ে বাঁকা হয়ে আছে। আক্রমণের ভঙ্গিতে ওর দিকে এগিয়ে চলেছে বিরাট কালো একটা ঘোড়া। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কালো চোখের তারা, ঘামে ভেজা চামড়া চকচক করছে সিকিউরিটি ল্যাম্পের আলোয়, নীলচে দেখাচ্ছে।
ধড়াস করে এক লাফ মারল কিশোরের হৃৎপিণ্ড। ইউনিকর্ন।
পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা। সামনের দুই পা গেঁথে ফেলতে চায় মুসার বুকে। কিছুই করার নেই তার। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে মাথার ওপর দুহাত তুলে তাকিয়ে রয়েছে আতঙ্কিত অসহায় দৃষ্টিতে।
কোন রকম দ্বিধা না করে লাফিয়ে কোরালের বেড়া ডিঙাল কিশোর।
সাবধান! পেছন থেকে চেঁচিয়ে হুশিয়ার করল লিলি।
মাথা ঝাড়া দিল ঘোড়াটা। পা চালাল। সামনের দুটো খুর অল্পের জন্যে লাগল না মুসার মুখে।
চিৎকার করে হাত নাড়তে নাড়তে ছুটল কিশোর। ঘোড়াটার নজর এদিকে ফেরাতে চাইছে, যাতে মুসাকে আর আক্রমণ না করে।
ফিরেও তাকাল না ঘোড়াটা। আরেকবার লাফিয়ে উঠল পেছনের পায়ে ভর দিয়ে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে কিশোর। মুসার এক হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। সরো, সরে যাও!
পেছনে এসে চিৎকার শুরু করল লিলি। ঘোড়াটার নাম ধরে ডাকতে লাগল। এই সুযোগে মুসাকে নিয়ে সরে এল কিশোর। গেটের দিকে দৌড় দিল দুজনে। ঘোড়াটা আবার এদিকে নজর দেয়ার আগেই দৌড়ে গেট পেরিয়ে এল।
লিলি লাগিয়ে দিল গেট।
থ্যা-থ্যাঙ্কস! গলা কাঁপছে মুসার।
কিছু হয়নি তো তোমার? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ন-না! ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকাল আবার মুসা, এখনও ফোঁস ফোঁস করছে ওটা। আরি পরে, কি জানোয়ার…
কি হয়েছে? খোয়া বিছান পথে বুটের শব্দ তুলে দৌড়ে আসছে লুক, বোলান। মুসার কাছে এসে ঝাঁজাল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, এখানে কি করছিলে?
কয়েকজন মেহমানও এসে ঘিরে দাঁড়াল ওদেরকে।
গেট খোলা দেখে ঢুকে পড়েছিলাম, মুসা বলল। ভাবলাম বাড়িতে যাওয়ার এটা শর্টকাট…
গেট খোলা ছিল? তুমি শিওর?
হ্যাঁ।
মুসার হয়ে কিশোর বলল, হয়তো হুড়কো লাগাতে ভুলে গিয়েছিল…
অসম্ভব! মানতে পারল না লুক। গেট ঠিকমত বন্ধ রাখার ব্যাপারে কড়া নির্দেশ রয়েছে এখানে। কিছুটা শান্ত হয়ে এসেছে ফোরম্যান। মুসাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক আছ তো?
আছি।
গুড। মেহমানরা সব কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে জোর করে হাসল লুক। আপনারা যান। ডিনারের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
অন্যান্য মেহমানদের নিয়ে সরে গেল ব্রড জেসন, তিন গোয়েন্দার দিকে তাকাল লুক, তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন?
ঘোড়াটাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে লিলি। সেদিকে তাকিয়ে কিশোর জবাব দিল, দেখি, ঘোড়াটাকে।
আর কিছু না বলে লুকও কোরালে ঢুকল, লিলিকে সাহায্য করার জন্যে।
লিলির সঙ্গে কথা আছে, ফিসফিস করে দুই বন্ধুকে বলল কিশোর।
কি? রবিনের প্রশ্ন।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে গেটটা ইচ্ছে করেই খোলা রাখা হয়েছিল, কোন কারণে। ভাবছে কিশোর। ঘোড়াটার সম্পর্কে সবারই খুব খারাপ ধারণা। সেটাই যেন প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছে জানোয়ারটাকে দিয়ে মুসাকে আক্রমণ করিয়ে।
কে গেট খোলা রাখতে যাবে?
সেটাই জানার চেষ্টা করব। অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে মুসা, ওকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, সত্যিই তোমার কোথাও লাগেনি তো?।
নাহ্, মাথা নাড়ল মুসা। তবে তোমরা আসতে আরেকটু দেরি করলেই হগেছিলাম। বাপরে বাপ, এরকম সাংঘাতিক জানোয়ার আর দেখিনি! এমন ভাবে আটকে ফেলল আমাকে কিছু করতে পারলাম না। হাসল মুসা। বড্ড খিদে পেয়েছে। কি দিয়েছে টেবিলে, দেখেছ? ডাবল চিজ আর পেপারোনি পিজা হলে খুব ভাল হত।
পুরোপুরিই স্বাভাবিক হয়ে গেছে মুসা, কথাতেই বোঝা গেল। হাসল রবিন। মুসাকে হতাশ করার জন্যেই যেন বলল, না, ওই জিনিস এখানে পাবে না। খেতে হবে মোষের কাবাব আর কালো কফি, ওয়েস্টার্ন কাউবয়দের মত।
মুখ বাঁকাল মুসা। আরে না, কি যে বলো। তার চেয়ে ভাল জিনিস নিশ্চয় বানাবেন কেরোলিন আন্টি। মেহমানরা কি আর অত বাজে খাবার খেতে পারে নাকি।
কিশোরও হাসল। তোমার জন্যে একলা যদি বানায়। আন্টির সঙ্গে বেশ খাতির জমিয়ে ফেলেছ এসেই, খেয়াল করেছি।
ও, রান্নাঘরে কাজ করেছি দেখে? তা তো করতেই হবে। আমাদেরকে তো বলাই হয়েছে, যতদিন থাকব, র্যাঞ্চের কাজ করতে হবে। তাহলে থাকা-খাওয়া ফ্রি…তোমরা দুজন বেরিয়ে গেলে, আমিই তোমাদের হয়ে…
কেন যে রাজি হলাম, গুঙিয়ে উঠল রবিন। ওসব রান্না-ফান্না এখন ভাল লাগে না আমার…।
কেন রাজি হয়েছি, খুব ভাল করেই জান তুমি, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। তুমিই তো অনুরোধ করলে আমাদেরকে আসতে…
করলাম তোমার কথায়। আমি কি আর জানি নাকি এতটা খারাপ অবস্থা। বেহমার বাল্যবন্ধুর অনুরোধ রাখতে এসে শেষে কোন্ হেনস্তা হতে হয়। কে জানে!
চোখ মিটমিট করল কিশোর। তা বোধহয় হব না। আর অবস্থা অতটা। খারাপও বোধহয় নয়, খালি রান্নাঘরেই বসে থাকতে হবে না।
ভুরু কুঁচকে তাকাল রবিন, কেন, রহস্য পেয়ে গেলে নাকি এরই মধ্যে?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দুজনকে বলল কিশোর, এক কাজ করো, তোমরা চলে যাও। আমি আসছি।
কি করবে? মুসা জানতে চাইল।
কাজ আছে। তোমরা যাও। পরে বলব সব।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল রবিন আর মুসা।
কোরালের বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল কিশোর। তার দিকে কড়া চোখে তাকাল একবার লুক। কেয়ারই করল না কিশোর, তাকিয়েই রয়েছে। খেপা ঘোড়াটাকে কিভাবে সামলাচ্ছে লিলি, দেখছে। কিছুতেই দড়ির বাঁধনে আটকা পড়তে চাইছে না ইউনিকর্ন, লাথি মারছে মাটিতে, মাথা ঝাড়ছে, ফোঁস ফোঁস। করছে। মোলায়েম গলায় কথা বলছে লিলি।
অবশেষে ধরা দিতেই হলো ঘোড়াটাকে।
কিশোরের দিকে এগিয়ে এল লুক। সাংঘাতিক বোকামি করে ফেলেছিল তোমার বন্ধু। ওটা ঘোড়া তো না, একটা শয়তান। খুনী।
খুনী? মানে?
লুক জবাব দেয়ার আগেই ঘোড়ার দড়ি ধরে ফিরে তাকিয়ে লিলি বলল, অহেতুক দোষ দিচ্ছ কেন? ইউনিক কাউকে খুন করেনি।
নাকি সুরে ডেকে উঠল ঘোড়াটা।
সরু হয়ে এল লুকের চোখের পাতা। কিশোরকে বলল, একটা কথা বিশ্বাস, করতে পারো, ভয়ানক বদমেজাজী জানোয়ার ওটা। একটু আগে নিজের চোখেই। তো দেখলে। ওটার কাছ থেকে দূরে থাকবে। লিলির দিকে এগিয়ে গেল সে। ওর হাত থেকে দড়িটা নিয়ে বলল, এই শয়তানটাকে আমি সামলাচ্ছি। তুমি যাও। কিশোর তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
দড়ি হাতবদল হতেই দ্বিধায় পড়ে গেল ইউনিকর্ন। নেচে উঠল। দড়ি ধরে জোরে ঝাঁকি দিয়ে ওকে শান্ত হওয়ার ইঙ্গিত করল লুক। টেনে নিয়ে চলল।
বেড়ার বাইরে এসে কিশোরের কাছে দাঁড়াল লিলি। মুসার কিছু হয়নি তো?
না। ভয় পেয়েছিল, সেরে গেছে।
পাবেই। বড় বড় র্যাঞ্চ হ্যাণ্ডদের ভয় পাইয়ে দেয় ইউনিক, আর মুসা তো… কথা শেষ না করেই কিশোরের দিকে তাকিয়ে হাসল লিলি। তবে খুনী নয়। ঘোড়াটা, একথা বিশ্বাস করতে পার। লুক বাড়িয়ে বলেছে। এটা ওর স্বভাব। কিছু গড়বড় হয়ে গেলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, অযথা দোষ দিতে থাকে একে ওকে। তাছাড়া ইউনিককে ও দেখতে পারে না।
দেখতে পারে না কেন?
আব্বার মৃত্যুর জন্যে ও ইউনিককে দায়ী করে। কিশোরের মতই লিলিও বেড়ায় হেলান দিয়ে তাকাল লুকের দিকে, জোর করে টেনে টেনে ঘোড়াটাকে আস্তাবলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
কেন? আবার প্রশ্ন করল কিশোর।
সে অনেক কথা। ভীষণ বদমেজাজ ঘোড়াটার। কয়েক বছর আগে, রোডিও খেলার জন্যে নেয়া হয়েছিল ওটাকে। প্রচুর বদনাম কামিয়ে বিদেয় হতে হয়েছে। কারোরই চড়ার সাধ্য হয় না ওটার পিঠে। আব্বা তো ঘোষণা করে দিয়েছিল, যে। এক মিনিট ইউনিকনের পিঠে চেপে থাকতে পারবে, তাকে মোটা টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। অনেক কাউবয় চেষ্টা করেছে, কেউ পারেনি। উড়তে শুরু করে ঘোড়াটা। ধোয়াটে হয়ে এল লিলির চেহারা। শেষে আব্বা নিজেই একদিন চেষ্টা করল। ছুঁড়ে ফেলে দিল ওকে ইউনিক। জন্মের মত পঙ্গু হয়ে গেল আব্বা।
তাই? বিড়বিড় করল কিশোর। তারপরই বুঝি আপনাকে রোডিও ছাড়তে হল?
মাথা ঝাঁকাল লিলি। আমাকে আসতে বাধ্য করেছে আসলে লুক। ওকে এমনি দেখে যাই মনে হয়, মনটা ওর খুবই ভাল।
এ ব্যাপারে একমত হতে পারল না কিশোর। তাহলে অ্যাক্সিডেন্টের জন্যে ইউনিককেই দায়ী করে লুক?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘোড়াটাকেও দোষ দেয়া যায় না পুরোপুরি। আব্বা তো জানতই ওটা বদমেজাজী, কাউকে পিঠে চড়তে দেয় না, তারপরেও বোকামি করতে গেল কেন? লুকের তো একেবারেই ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্বা শুনল না ওর কথা। অ্যাক্সিডেন্টের পর লুক চেয়েছিল ওরকম একটা বাজে জানোয়ারকে মেরেই ফেলা হোক। খামাখা বিপদ পুষে রেখে লাভ কি। যুক্তি আছে অবশ্য ওর কথায়। এই যেমন আজ আরেকটু হলেই মারা পড়েছিল মুসা। বাতাসে উড়ে এসে পড়া চুল। মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দিল লিলি। আব্বা লুকের কথায় কানই দেয়নি। তার ধারণা ছিল, ইউনিক এই র্যাঞ্চের জন্যে একটা অ্যাসেট। চড়তে না দিলে না দিল, প্রজনন তো করতে পারবে। ওর যেসব বাচ্চা হবে, একেকটা সোনার টুকরো।
হয়েছে নাকি?
নিশ্চয়ই। ওর কয়েকটা বাচ্চার বয়েস তিন বছর হয়ে গেছে। ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ওগুলোকে। ঘোড়া যারা চেনে তাদের ধারণা রোডিও খেলার জন্যে খুবই ভাল জানোয়ার হবে ওগুলো। আব্বার আশা ছিল, ইউনিকের বাচ্চা বিক্রি করেই র্যাঞ্চের ধার শোধ করে দেয়া যাবে। কিন্তু তার আশা পূরণ হওয়ার আগেই চলে গেল অন্য দুনিয়ায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলল লিলি।
সরি, সহানুভূতি জানাল কিশোর।
র্যাঞ্চিং ব্যবসা খুব ভাল বুঝত আব্বা। তার কাছেই কাজ শিখেছে লুক। সে ও ভাল বোঝে। হঠাৎ কি মনে হতেই সোজা হয়ে দাঁড়াল, লিলি। চলো, তোমাকে। একটা জিনিস দেখাব। রেসের ঘোড়া
লিলির পিছু পিছু আস্তাবলে ঢুকল কিশোর। আলো জ্বালল লিলি। নাক দিয়ে শব্দ করল কয়েকটা ঘোড়া। স্টলের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় গলা বাড়িয়ে দিতে লাগল ওগুলো, ওদের নাম ধরে ডাকল সে, আদর করে হাত বুলিয়ে দিল। মাথায়। কিশোরও কোন কোনটাকে আদর করল, দেখল ওগুলোর টলটলে বাদামী চোখ।
স্টলের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াল ওরা। খড়ের বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অবিকল ইউনিকর্নের মত দেখতে আরেকটা ঘোড়া। শান্ত সুবোধ, চোখে আগুন নেই। ওর নাম হারিকেন, ঘোড়াটার গলায় হাত বোলাতে লাগল লিলি। ইনডিপেনডেন্স ডে রেডিওতে এটার পিঠেই চড়ব আমি। হারিকেন নামটা ওর জন্যে ঠিকই হয়েছে, ঝড়ের মতই গতি। ওকে ছাড়া জেতার আশা কমই আমার।
দেখতে তো একেবারে…
ইউনিকের মত।
যমজ।
রেয়ার, তবে হয়। মেজাজ একেবারে বিপরীত দুটোর। এমনিতে খুব চুপচাপ থাকে হারিকেন, কিন্তু খেলার সময়… ওরিব্বাপরে, না দেখলে বিশ্বাসই করবে না। পকেট থেকে একটা আপেল বের করে ঘোড়াটাকে খেতে দিল লিলি।
আলাদা করে চেনেন কি করে দুটোকে?
চেনা খুবই কঠিন, তবে আমি পারি। সামনের ডান পায়ের খুরটা দেখো। সামান্য ওপরে একটুখানি জায়গার নোম সাদা দেখতে পাচ্ছ না? শুধু এটারই আছে, ইউনিকের নেই।
গলা বাড়িয়ে দেখল কিশোর। খুব ভাল করে না তাকালে চোখেই পড়ে না, সাদা অংশটা। হারিকেন নিশ্চয় খুব দামি?
তা তো বটেই। কিন্তু আমার মতে ইউনিকের দাম আরও বেশি হওয়া উচিত। ওর একেকটা বাচ্চা যা হয় না, আগুন।
এক পা এগিয়ে এসে রেইলের ওপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে দিল হারিকেন। কুচকুচে কালো রঙ, অনেক উঁচু, একটা দেখার মত জানোয়ার। ওর মসৃণ গলায় হাত বোলাতে লাগল কিশোর। ঘোড়াটাও বাহুতে নাক ঠেকিয়ে দিয়ে আদর নিতে লাগল।
লিলি হাসল। ও তোমাকে পছন্দ করেছে।…চলো, আর দেরি করব না। আলো নিভিয়ে দিল সে।
চত্বর ধরে হাঁটতে হাঁটতে কিশোর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, গেটটা কে খুলে রাখল, বলুন তো?
কি জানি, মাথা নাড়ল লিলি।
এরকম আর হয়েছে?
হয়েছে, দুএকবার। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেহমানরা ঢোকে, তারপর লাগাতে ভুলে যায়। ব্যাপারটা নিছকই অ্যাক্সিডেন্ট। বলল বটে লিলি, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে মনে হল না একথা বিশ্বাস করে সে। যত যাই বলো, আমার ভাই সাহস হচ্ছে না, ভয়ে ভয়ে ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে। রয়েছে মুসা। আগের সন্ধ্যার কথা ভুলতে পারছে না।
ভয় নেই, হেসে বলল কিশোর। ভাল ঘোড়াই দেয়া হবে তোমাকে। শয়তানী করবে না।
পরদিন সকালে আস্তাবলের কাছের বড় কোরালের বেড়ায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে ওরা। অন্য মেহমানরাও রয়েছে কাছাকাছি।
যার যার দায়িত্বে চড়বেন, ব্রড বলল। কি করে জিন পরাতে হয়, লাগাম লাগাতে হয় শিখিয়ে দেব। কারও চড়ার অভ্যেস আছে?
চড়েছে, জানাল তিন গোয়েন্দা। ওদেরকে সরিয়ে দেয়া হল বোসটনের ডক্টর কাপলিঙের পাশে। ডক্টরের স্ত্রী এবং কন্যাকে সরিয়ে আনা হলো কানসাসের একটা পরিবার আর শিকাগোর দম্পতি মাইক ও জেনি এজটারের পাশে, এরা কেউই চড়তে জানে না।
সবাইকেই একটা করে ঘোড়া আর জিন দিল ব্রড। কিশোরকে দেয়া হলো। একটা জেলডিং ঘোড়া। হরিণের চামড়ার মত ফুটফুটে চামড়া। নামটা বিচিত্র, জেনারেল উইলি। সবচেয়ে ভাল ঘোড়াগুলোর একটা দিলাম তোমাকে, ব্রড বলল। দেখো চড়ে, মজা পাবে। লিলি বলছিল ঘোড়ারা নাকি তোমাকে পছন্দ করে।
ব্রডকে ধন্যবাদ দিয়ে ঘোড়াটার মণ চামড়ায় হাত বোলাতে লাগল কিশোর।
জিন পরাতে শুরু করল সে। রবিন, মুসা আর ডক্টর কাপলিংও যার যার ঘোড়ায় জিন পরাতে লাগলেন।
রবিনকে দেয়া হয়েছে একটা মাদী ঘোড়া, কিছুটা চঞ্চল স্বভাবের, জিন। পরাতে গেলে কেবলই পাশে সরে যেতে চায়। নাম, স্যাণ্ডি। মুসার ঘোড়াটাও একটা প্যালোমিনো মাদী ঘোড়া, শান্ত, নাম ক্যাকটাস।
নিজের ঘোড়ায় পিঠ সোজা করে বসল ব্রড। পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে চলল ধুলোঢাকা একটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে। দুধারে পাইনের ঘন জঙ্গল। কিছুদূর। এগিয়ে একপাশে দেখা গেল একটা পাহাড়ী নালা বয়ে চলেছে। পানি বেশি না। পরিচিত পথ ধরে সহজ ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছে ঘোড়ার মিছিল।
ফেরার পথে যার যেভাবে ইচ্ছে ঘোড়া চালানর অনুমতি দিল ব্রড।
লাফ দিয়ে আগে বাড়ল কিশোরের জেনারেল উইলি। মসৃণ গতি। সামনের দিকে ঝুঁকে রইল কিশোর। বাতাসে উড়ছে ঘোড়ার ঘাড়ের লালচে চুল। অন্যদের, এমনকি ব্রডেরও অনেক আগেই কোরালের কাছে পৌঁছে গেল ঘোড়াটা। গর্ব হতে লাগল কিশোরের।
ভাল চালাতে পার তো তুমি, পাশে এসে ওর প্রশংসা করল ব্রড।
আসলেই ঘোড়াটা ভাল, জেনারেলের পিঠে আলতো চাপড় দিয়ে বলল কিশোর।
কোরালের ভেতরে একটা নড়াচড়া চোখে পড়ল তার। ভেতরে ছোটাছুটি করছে ইউনিকর্ন। পিঠে আরোহী নেই। এই দিনের আলোয়ও ভয়ঙ্কর লাগছে। ঘোড়াটাকে। ব্রডকে জিজ্ঞেস করল, কাল কে গেট খোলা রেখেছিল জানেন?
হাসি মলিন হয়ে গেল ব্রডের। আমি কি করে জানব? আমি তো ডিনারে বসেছিলাম।
সব মেহমানরাই বসেছিল।
নতুন কয়েকটা ছেলেকে আনা হয়েছে কাজ করতে, ওদের কেউ হতে পারে। কিংবা তোমার বন্ধুও খুলতে পারে।
পাশে এসে দাঁড়াল রবিনের ঘোড়া, স্যাণ্ডি। লাফিয়ে নামল রবিন। নাচতে লাগল চঞ্চল ঘোড়াটা, কিছুতেই যেন স্থির থাকতে পারে না।
মুসা কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
থাবা দিয়ে কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে রবিন বলল, পেছনে। মুসা আর ডক্টর, দুজনকেই পেছনে ফেলে এসেছে স্যাণ্ডি। ধুলো খাচ্ছে ওরা।
কপালে হাত রেখে শুকনো মাঠের ওপর দিয়ে তাকাল ব্রড। হলোটা কি? ওদের তো এতক্ষণে চলে আসার কথা। যাই, দেখি কি হলো? তোমরা তোমাদের ঘোড়াগুলোকে ঠাণ্ডা করতে পারবে?
তা পারব। আমরা আসব, দরকার হবে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
না। লিলি জিজ্ঞেস করলে বল কোথায় গেছি। এখনই চলে আসব। ঘোড়া চালিয়ে রওনা হয়ে গেল ব্রড।
ঘোড়ার লাগাম ধরে টানতে টানতে ওগুলোকে গোলাঘরের কাছে নিয়ে চলল দুই গোয়েন্দা। কিশোর বলল, রবিন, বলো তো কাল কে কোরালের গেট খুলে রেখেছিল? এ ব্যাপারটা কি? কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, সত্যিই রহস্য পেয়ে গেলে মনে হচ্ছে?
হচ্ছে, যদিও নিশ্চিত হতে পারছে না কিশোর। সোনালি চুল, লম্বা, বেনিরই বয়েসী একটা মেয়েকে আসতে দেখল। পরনে জিন্স, গায়ে সিলভার-ট্রিম ওয়েস্টার্ন শার্ট, গলায় লাল রুমাল, মাথায় সাদা হ্যাট।
হাই, আরেকটু কাছে এসে ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হেসে বলল মেয়েটা, ব্রডকে দেখেছ? আমি বেনি কুপার, ওর বন্ধু।
নিজের আর রবিনের পরিচয় দিল কিশোর। তারপর বলল, এই একটু ওদিকে গেছে। এখুনি চলে আসবে।
গামলার কাছে এনে জেনারেলকে পানি খেতে দিল সে। খাওয়া হয়ে গেলে কোরালে ঢুকিয়ে দিয়ে এল অন্যান্য ঘোড়ার সঙ্গে।
অপেক্ষা করছে বেনি। ঘড়ি দেখল। সময় নেই আমার। আব্বাকে বলে এসেছি, শিগগিরই গিয়ে প্র্যাকটিস করব। মাঠের ওপাশে তাকাল ব্রডকে দেখার আশায়।
স্যাণ্ডিকে ঢোকানর জন্যে গেট খুলছে রবিন। ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিওতে আপনিও খেলবেন নাকি?
খেলব। কোমরের বেল্টের রূপার বাকলসের মতই চকচক করল বেনির হাসিটা। এই সময় লিলিকে আসতে দেখা গেল।
হাই, বেনিকে বলে কিশোর আর রবিনের দিকে ফিরল লিলি। আর সবাই কোথায়?
আসছে। কিশোর তাকিয়ে রয়েছে বেনির দিকে, লক্ষ্য করল, কি করে দ্রুত মিলিয়ে গেল মেয়েটার হাসি। ব্রড চলে এসেছিল আমার সঙ্গে। আবার গেছে দেখতে কোন গোলমাল হলো কিনা।
তাই নাকি?
কি শুনছি, লিলি? বেনি জিজ্ঞেস করল, আবার নাকি ব্লেডিওতে ঢুকবে?
আর কোন উপায় নেই, উদ্বিগ্ন হয়ে দিগন্তের দিকে তাকাচ্ছে লিলি। বয়েসের ইনডিপেনডেন্স ডে রোডিও দিয়েই শুরু করব আবার। বিকেলের উজ্জ্বল রোদ থেকে চোখ বাঁচাতে চোখের পাতা মিটমিট করছে সে। যাই। দেখা দরকার, কি হলো।
আবার ঘড়ি দেখল বেনি। ওকে বল আমি এসে খুঁজে গেছি। গুডবাই না বলেই ঘুরে দাঁড়াল বেনি, গটগট করে হাঁটতে লাগল তার পিকআপের দিকে।
আপনি আবার খেলবেন শুনে খুশি হতে পারেনি ও, কিশোর বলল।
হবে কি করে? আমার কাছে হেরে যাওয়ার ভয় আছে না। ছোটবেলা থেকেই আমরা প্রতিদ্বন্দ্বী। নাকের ডগা চুলকাল লিলি। ব্রডের সাথে বেশ ভাব মনে হয়! ও আসার পর থেকে প্রায়ই আসে আমাদের এখানে।
ওই যে, আসছে, চিৎকার করে বলল রবিন।
মাথা ঘুরিয়ে কিশোরও দেখতে পেল। আসছে দলটা।
এগিয়ে এল মুসা। চোখ বড় বড়। মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়ছে। উত্তেজিত লাগছে তাকে।
কি ব্যাপার? জানতে চাইল রবিন।
ডক্টরের জিন ঢিল হয়ে গিয়েছিল, কাছে এসে বলল মুসা। ক্যাকটাসের পিঠ থেকে নেমে ডলে দিতে শুরু করল ওর চামড়া। তার জন্যে থামতেই হলো আমাদের।
চড়লে কেমন? জিজ্ঞেস করল।
দারুণ! ক্যাকটাসের জিন খোলায় ব্যস্ত হল মুসা। ঘোড়াটাও খুব ভাল। জিন খুলে নিয়ে ওটার পেছনে চাপড় দিয়ে বলল সে, যা, যা। কোরালের দিকে দুলকি চালে এগিয়ে গেল প্যালেমিনো।
.
আগের দিনের চেয়ে আধঘন্টা পরে ডিনারের ঘন্টা পরল এদিন। টেবিলে রবিন আর মুসার পাশে বসল কিশোর। দেখল, লিলির চেয়ারটা খালি। নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছে কয়েকজন শ্রমিক। স্পষ্ট শোনা যায় না সব। কান। খাড়া করে শোনার চেষ্টা করল কিশোর।
এখনও আসছে না কেন? ফোরম্যান লুক বোলান বলল।
আসবে, বলল ব্রড। ও তো আর শিশু নয়, ঠিকই চলে আসবে। কাজেটাজে গেছে হয়তো কোথাও।
বড় বেশি উল্টোপাল্টা ব্যাপার ঘটছে ইদানীং র্যাঞ্চে, বলল আরেকজন র্যাঞ্চ হ্যাণ্ড। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিশোরের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল।
গোলমাল হয়েছে, ফিসফিস করে বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। দেখতে যাচ্ছি।
বেশি চিন্তা করছ, মুসা বলল। দেখগে, কোথায় কি কাজ করছে।
ডিনারের পরও করতে পারত। কেরোলিনকে জিজ্ঞেস করব। তোমরা এখানে থাক, আর কিছু বলে কিনা ওরা শোন।
রান্নাঘরে চলে এল কিশোর। অস্থির লাগছে কেরোলিনকে। কিছু করতে হবে নাকি? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পারবে? সত্যিই সাহায্য চান মহিলা। বার বার জানালা দিয়ে তাকাচ্ছেন। বাইরে। রাতের অন্ধকার নামছে। এভাবে এতক্ষণ তো দেরি করে না কখনও লিলি?
শহরে যায়নি তো? বড় একটা ট্রেতে চকলেট কেকের প্লেট সাজাতে সাজাতে বলল কিশোর।
না, গেলে বলে যেত। ঘণ্টা দুই আগে হারিকেনকে নিয়ে বেরিয়েছে। এক্সারসাইজ করাতে। বলেছে, খাওয়ার আগেই চলে আসবে। দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল মহিলার মুখে। কি যে করবে বুঝতে পারছি না… থেমে গেলেন আচমকা। এ কি হয়েছে দেখার জন্যে ঘুরে তাকাল কিশোর। সাদা হয়ে গেছে কেরোলিনের মুখ। জানালার বাইরে তাকিয়ে রয়েছেন। কি দেখেছে দেখার জন্যে ছুটে এল সে জানালার কাছে। ধক করে উঠল বুক। ঠাণ্ডা হয়ে আসছে হাত-পা।
একটা গাড়ি আসছে। পেছনে আসছে কালো একটা ঘোড়া। পিঠে জিন বাঁধা, অথচ আরোহী নেই।