চক্রপুরের দারোগাবাবুকে দেখলে যে কারও শ্রদ্ধা হবে। যাঁ, শ্রদ্ধা করার মতোই চেহারা। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া এবং তেমনই দশাসই। যখন শ্বাস ফেলেন তখন মোষও লজ্জা পায়। ইদানীং ভুড়িটা বড্ড ঝুলে পড়েছে আর গলার নীচেও থাক-থাক চর্বি জমেছে বটে, কিন্তু এখনও একটু কষ্ট করলে ছোটখাটো একখানা খাসি বা মাঝারি একখানা পাঁঠার মাংস একাই সাবাড় করতে পারেন। অবশ্য তার সঙ্গে লুচি বা পরোটা থাকা চাই। শেষ পাতে একটু ক্ষীর দুবেলাই চাই। দিনের বেলা চারটি ভাতই খান বটে, তবে চার হাতা ভাত হলে দু হাতা ঘি লাগে। তা এ-সবের জন্য তাঁকে তেমন ভাবতে হয় না। দারোগাবাবু টিকে আছেন বলে গোটা এলাকাই টিকে আছে। লোকে তাই কৃতজ্ঞতাবশে এ-সবই জোগান দেয়। দারোগাবাবু খাবেন, এর চেয়ে আহ্লাদের ব্যাপার আর কী আছে?
আজ সকালবেলাতেই নেতাই আর জগা এসে হাজির। দুজনেই একসঙ্গে হাতজোড় করে বলল, “বড়বাবু, সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড। কুঞ্জখুড়োর বাড়িতে যারা ডাকাতি করেছিল তাদেরই একজন মনসাপোঁতার জঙ্গলে সেঁধোলো। অবশ্য এমনি সেঁধোয়নি, এমন তাড়া করেছিলাম যে, বাছাধন আর পালানোর পথ পায়নি।”
দারোগাবাবু, অর্থাৎ সুদর্শন হালদার গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে কোয়াটারের বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে
ছিলেন। কথাটা শুনে কোনও ভাবান্তর হল না। শুধু বললেন, “আজ্ঞে আমরা হলুম তো মনসাপোঁতার জগা আর নেই। আমাদের কথাটা একটু মনে রাখবেন।”
সুদর্শনবাবু নিমীলিত নয়নে তাদের দিকে চেয়ে বললেন, “কেন, তোদের কথা আবার মনে রাখতে হবে কেন?”
নেতাই মাথা চুলকে একটু ফিচিক হাসি হেসে বলল, “কথাটা তা হলে খুলেই বলি বড়বাবু। কুঞ্জখুড়োকে তো চেনেন, সাতটা গাঁ মিলেও অতবড় বন্ধকি কারবার আর কারও নেই। সোনাদানা হীরে জহরত দাঁড়া দোনলা। ওঁর মক্কেলরা সবাই টাকার কুমির। ডাকাতরা এসে সেইসব গচ্ছিত জিনিস চেঁছেছে নিয়ে গেছে। কুঞ্জখুড়োর একটা মস্ত দোষ হল, সরকারবাহাদুরের ওপর একেবারেই ভরসা নেই। তাই ঠিক করেছেন ডাকাতদের হদিস যে দিতে পারবে তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা প্রাইজ দেবেন।”
সুদর্শনবাবু সবেগে সোজা হয়ে বসে বললেন, “কত টাকা বললি?”
“আজ্ঞে পঞ্চাশ আছে আপাতত, তবে ওটা দু-একদিনের মধ্যেই লাখে উঠে যাবে মনে হয়।”
“কই, আমি তো প্রাইজের কথা শুনিনি!”
“আজ্ঞে ছোট মুখের কথা তো, এখনও বড় কান অবধি পৌঁছয়নি। তবে ভাববেন না, কুঞ্জখুড়ো গাঁময় ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। যে ধরবে সে পুলিশই হোক আর পাবলিকই হোক, পঞ্চাশ হাজার থোক পাবে। তাই বলছিলাম, আমাদের কথাটা একটু মনে রাখবেন। নিজের চোখে দেখা, ডাকাতটা মনসাপোঁতার জঙ্গলে ঢুকেছে।”
দারোগাবাবু একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, “কিন্তু সেই জঙ্গলটা তো ভাল নয় রে।”
নেতাই ঘাড় নেড়ে বলে, “আজ্ঞে না। ব্ৰহ্মদত্যির বাস তো আছেই, তার ওপর বুনো কুকুরেরও উৎপাত।”
“ডাকাতটার চেহারা কেমন?”
“আজ্ঞে ডাকাতের মতোই। মোটাসোটা, কালো, রক্তবর্ণ চোখ। ও ভুল হওয়ার জো নেই।”
সুদর্শনবাবু চিন্তিত মুখেই বললেন, “তোদের চক্রপুর তো ক্রমে-ক্রমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে দেখছি। এই তো কিছুক্ষণ আগে স্টেশনমাস্টার সতীশ আর তার স্যাঙাৎ এসে নালিশ করে গেল, কে একটা লোক নাকি ট্রেন থেকে জিনিসপত্র চুরি করে নেমে পড়েছিল। রেল-পুলিশ বলেছে লোকটা স্টেশনের চৌহদ্দি পেরিয়ে যাওয়ায় তারা আর কিছু করতে পারবে না। এখন আমার যত দায়। আবার একটু আগে ফণিবাবুর নাতি পন্টু এসে বলে গেল, কে নাকি তাদের বাড়ি থেকে কদিন আগে কোদাল চুরি করে নিয়ে গেছে, আজ সকালে নাকি আবার আশ্রয় চুরি করতে এসেছিল। অবশ্য আশ্রয় কী জিনিস তা আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না। কিন্তু এ তো দেখছি চোর-ছ্যাঁচড়-ডাকাতদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠল!!”
নেতাই গদগদ হয়ে বলে, “সে সত্যি কথা, তবে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো আপনিও তো আছেন, আর সেইটেই আমাদের ভরসা। পঞ্চাশ হাজারের পঞ্চাশও যদি পাই তবে গোয়ালঘরটা ছাইতে পারি, একজোড়া লাঙলের ফালও কেনা বড় দরকার।”
সুদর্শনবাবু বজ্রগম্ভীর গলায় বললেন, “এখন বাড়ি যা তো বাপু। আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় একটু ভাবতে দে।”
দুজনে বিদেয় হলে সুদর্শনবাবু উঠে তাঁর পুলিশের পোশাক পরে নিলেন। তারপর কোমরে রিভলভার এঁটে থানায় রওনা দিলেন।
থানা থেকে গোটাচারেক সেপাই সঙ্গে নিয়ে সুদর্শনবাবু মনসাপোঁতার জঙ্গলের ধারে যখন এসে পৌঁছলেন তখন বেশ বেলা হয়েছে, রোদ চড়েছে এবং খিদেও পেয়েছে। খিদে পেলে সুদর্শনবাবুর মাথার ঠিক থাকে না।
জঙ্গলের দিকে মুখ করে মুখের দৃধারে হাত দিয়ে চোঙার মতো করে সুদর্শনবাবু একখানা পিলে চমকানো হাঁক দিলেন, “ওরে, জঙ্গলের মধ্যে কে আছিস? যদি প্রাণে বাঁচতে চাস তো বেরিয়ে আয়। নইলে রক্ষে থাকবে না কিন্তু?”
কেউ সাড়া দিল না।
সুদর্শনবাবুর গলা আরও চড়ল, “বলি শুনতে পাচ্ছিস? ধরা না দিলে কিন্তু আমি ফোর্স নিয়ে জঙ্গলে ঢুকব। খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু তখন! একেবারে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটবে। ভাল চাস তো লক্ষ্মী ছেলের মতো দুটো হাত গৌরাঙ্গের মতো ওপরপানে তুলে বেরিয়ে আয়।”
কেউ এল না। সুদর্শনবাবু এবার গলা আরও ওপরে তোলার চেষ্টা করলেন, “ভাবছিস জঙ্গলের মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থেকে বেঁচে যাবি? জানিস এ-জঙ্গলে জয়রাম বেহ্মদত্যি থাকে? জানিস বুনো কুকুরদের কথা? তা ছাড়া সাপ-খোপ আছে, বাঘ-সিংহও থাকতে পারে। বিপদে পড়লে কিন্তু জানি না বাপু। কাজ কি তোর অত বিপদ মাথায় করে জঙ্গলে থাকার? থানায় ভাল বিছানা আছে, গায়ের কম্বল পাবি, চারবেলা মিনি-মাগনা খাওয়া জঙ্গলের চেয়ে ঢের ভাল। বলছি গুটিগুটি বেরিয়ে আয়। মারধর করব না রে বাপ, আমরা সেরকম লোকই নই।”
কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না।
সোজা আঙুলে যে ঘি উঠবে না এটা বুঝতে সুদর্শনবাবু একটু ফাঁপরে পড়লেন। কারণ বাঁকা আঙুলে ঘি তোলা কঠিন ব্যাপার। মনসাপোঁতার জঙ্গলে কেউ ঢুকবে না। তবু তিনি সেপাইদের দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, “জঙ্গলে ঢুকতে হবে। লোকটা ভেতরেই আছে।”
চারজন সেপাই সঙ্গে সঙ্গে চার হাত পিছিয়ে গেল। রামরিখ সিং বলল, “হুজুর, চাকরি যায় সে ভি আচ্ছা। দেশে ফিরে গিয়ে মকাইকা খেতি করব। লেকিন মনসাপোঁতায় ঘুসব না।”
অন্য সেপাইদেরও প্রায় একই কথা। চাকরি গেলে তাদের একজন ভিক্ষে করতেও রাজি, আর-একজন পানের দোকান দিতে চাইল এবং চতুর্থজন সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে যাওয়ার ভয় দেখাল।
মনসাপোঁতার জঙ্গল সম্পর্কে মানুষের ভয় অকারণে নয়। রাত্রিবেলা এই জঙ্গলে ভুতুড়ে আলো দেখা যায়, শোনা যায় নানারকম ভুতুড়ে শব্দও। দিনের বেলা আগে কাঠ কুড়োতে বা গাছ থেকে বুনো ফলপাকুড় সংগ্রহ করতে অনেকে ঢুকত। ইদানীং আর কেউ যায় না। কারণ আজকাল জঙ্গলে ঢুকলেই পেছন থেকে কে যেন আক্রমণ করে। পাথরের টুকরো বা ডাণ্ডা দিয়ে মেরে অজ্ঞান করে দেয়। তারপর টেনে জঙ্গলের বাইরে ফেলে দিয়ে যায়। জঙ্গলের ধারে যে অশ্বথ গাছটা আছে তার তলায় জবাফুল, কড়ি, জীবজন্তুর মাথা, হাড়গোড় ইত্যাদিও প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। এইসব কারণে মনসাপোঁতা এখন সকলের কাছেই নিষিদ্ধ জায়গা।
সুদর্শনবাবু তা ভালই জানেন। ঢুকতে হলে তাঁকে একাই ঢুকতে হবে। কিন্তু সেটা কেন যেন সাহসে কুলোচ্ছে না। তাঁর ইচ্ছে, সেপাইদের জঙ্গলে পাঠিয়ে তিনি বাইরে ওত পেতে
থাকবেন। কিন্তু তাঁর সেই ইচ্ছে পূরণ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তা বলে পঞ্চাশ হাজার টাকার কথাই বা তিনি ভোলেন কী করে? বেজার মুখ করে তিনি সেপাইদের বললেন, “ঠিক আছে, প্রত্যেকে দশ-দশ টাকা করে পাবি।”
সেপাইদের পায়ে তবু যেন পাথর বাঁধা।
সুদর্শনবাবু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “আচ্ছা যা, পঞ্চাশ-পঞ্চাশ।”
রামরিখ হাতজোড় করে বলল, “রূপাইয়া দিয়ে কী হবে বড়বাবু? জান না বাঁচলে রূপাইয়া দিয়ে কৌন কাম হোবে?”
ঠিক এই সময়ে একটা মস্ত পাথর জঙ্গলের ভেতর থেকে প্রচণ্ড জোরে এসে অশ্বথ গাছটার গায়ে লাগল। সবাই আঁতকে উঠল এই আচমকা ঘটনায়। কিন্তু তারপরই একের পর এক পাথর উড়ে আসতে লাগল।
“বাপরে!” বলে সেপাইরা উলটোদিকে দৌড় দিল।
সুদর্শনবাবু রিভলভার বের করে শূন্যে একবার ফায়ার করে বললেন, “সাবধান বলছি! খবরদার, ঢিল ছুঁড়বি না, গুলি করব।”
জঙ্গলের মধ্যে কে যেন হিঃ হিঃ করে রক্তজল করা হাসি হেসে উঠল।
সুদর্শনবাবু আর দাঁড়ালেন না। সেপাইদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তিনিও ছুটতে লাগলেন।
সন্ধেবেলার আপ ট্রেন থেকে চক্ৰপুর রেল স্টেশনে চারটে লোক নামল। চারজনের চেহারাই বেশ লম্বা-চওড়া মজবুত। সঙ্গে মালপত্র বিশেষ নেই, শুধু একটা করে সুটকেস।
চক্ৰপুরে এরা যে নতুন তা বুঝতে পেরে ট্রেনটা পাস করিয়ে সতীশ এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনারা কোথা থেকে আসছেন?”
চারজনের একজন অন্য সকলের চেয়ে একটু বেশি লম্বা এবং চওড়াও। লোকটা সতীশের দিকে চেয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বলে, “আমরা একটা তদন্তে এসেছি।”
“তদন্তে? আপনারা কি পুলিশের লোক?”
“হ্যাঁ। আমরা গোয়েন্দা।”
সতীশ সরকারি কর্মচারী এবং পুলিশ-মিলিটারি দেখলে খুবই শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়ে। খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “আসুন, আসুন, স্টেশনঘরে একটু বসুন। চক্রপুরে হঠাৎ গোয়েন্দা-পুলিশের আগমন হল কেন সেটা একটু শুনি।”
এ-প্রস্তাবে লোকগুলোর তেমন আপত্তি হল না। স্টেশনের
ছোট ঘরে এসে চারজন যখন কাঠের বেঞ্চটায় বসল তখন কেরোসিনের আলোয় চারজনের চেহারা একটু পরিষ্কার দেখতে পেল সতীশ! সত্যি কথা বলতে কি, চারজনের চেহারাই একটু যেন অস্বস্তিকর। একজনের কপালে একটা বেশ গভীর কাটা দাগ আছে। একজনের নাক ভাঙা। তৃতীয়জনের একটা চোখ কানা। চতুর্থজনের বাঁ হাতের কড়ে আঙুলটা নেই।
এদের সদার বলে যাকে মনে হচ্ছিল সেই লম্বা-চওড়া লোকটা সতীশের দিকে চেয়ে বলল, “আমরা একজন ভয়ঙ্কর অপরাধীর খোঁজে এখানে এসেছি। লোকটা কয়েকদিন আগে একটা খুন করে পালিয়ে এসেছে। আমরা খবর রাখি, সে এদিকেই এসেছে। সম্ভবত এখানেই কোথাও তার পৈতৃক বাড়ি ছিল।”
সতীশ তটস্থ হয়ে বলে, “লোকটার চেহারা কেমন বলুন তো! কালো মতো? একটু থলথলে? মুখে একটা ভালমানুষী ভাব?”
চারজন নিজেদের মধ্যে একটু দৃষ্টি-বিনিময় করে নিয়ে বলল, “ঠিক মিলে গেছে। লোকটার চেহারা দেখে ভুল বুঝবেন না। সে মোটেই ভালমানুষ নয়।”
সতীশ মাথা নেড়ে বলে, “সে আমি খুব জানি। লোকটা অন্যের মাল চুরি করে পালাচ্ছিল। টিকিটও ছিল না। পরে শোনা গেছে সে কোনও ডাকাতের দলেও ছিল।”
“অতি সত্যি কথা। এখন প্রশ্ন হল, লোকটা কোথায়?”
“লোকটা পালিয়েছে। যতদূর মনে হয় মনসাপোঁতার জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছে। তবে ভাববেন না, মনসাপোঁতায় একবার ঢুকলে
কারও নিস্তার নেই। ভয়ঙ্কর জায়গা।”
লোকটা বলল, “যত ভয়ঙ্কর জায়গাই হোক, লোকটাকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে। মনসাপোঁতা কোনদিকে?”
“সে অনেকটা দূর। রাতে সেখানে যেতে পারবেন না।”
“আমরা সকালেই রওনা হব। আজ রাতটা আমরা এই স্টেশনঘরেই কাটাতে চাই। আশা করি আপনার আপত্তি হবে না।” সতীশ মাথা নেড়ে বলল, “না, আপত্তি কিসের? কিছু রুটি-তরকারি পাঠিয়ে দেবখন।”
“তা হলে তো চমৎকার।” এই বলে লোকটা হাত বাড়িয়ে সতীশের হাত ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বন্ধুত্ব প্রকাশ করে বলল, “আমার নাম তিন সেন। আর এরা হল পচা, ল্যাংড়া আর সন্তু।”
হাতখানায় ঝাঁকুনি খেয়েই সতীশ বুঝে গিয়েছিল, তিনু সেন খুব শক্ত ধাতের লোক। সতীশের হাতটা যে ছিঁড়ে গেল না। সেটাই ভাগ্যের কথা। গোয়েন্দা-পুলিশ হলেও লোকগুলোর হাবভাব তেমন সুবিধের ঠেকছিল না তার। চোখগুলো যেন বড্ড জ্বলজ্বল করছে।
সতীশ টেবিলের কাগজপত্র একটু তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে রেখে বলল, “তা হলে আমি এখন আসি? পোটার লাখন একটু বাদে আপনাদের খাবার দিয়ে যাবেন!”
তিনু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, এখানে থানা-টানা আছে?”
“আছে। কেন, সেখানে খবর পাঠাতে হবে? কাল সকালেই লাখনকে পাঠিয়ে দিতে পারি দারোগাবাবুর কাছে।”
তিনু মাথা নেড়ে বলে, “তার দরকার নেই। প্রয়োজন হলে আমরাই যাব। আপাতত আমরা লোকাল পুলিশের সঙ্গে ইনভড হতে চাই না।”
“ঠিক আছে।” বলে সতীশ তাড়াতাড়ি কোয়াটারে ফিরে এল। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, এই চারজন গোয়েন্দা-পুলিশের কথা সুদর্শন দারোগাকে জানানো দরকার।
রাত্রিবেলা লাখন রুটি-তরকারি পৌঁছে দিতে গিয়ে খুব গণ্ডগোলে পড়ে গেল। স্টেশনের ঘরে চারটে তাগড়াই লোক কেরোসিনের বাতির আলোয় জাম্বুবানের মতো বসে আছে। একজন নিবিষ্ট মনে টেবিলের ওপর চারটে পিস্তল পর পর সাজিয়ে রেখে সযত্নে গুলি ভরছে। অন্য একজন বেশ তেজী গলায় বলছে, “অভয় সরকার মাস্ট বি কিল্ড। কোনওভাবে যেন পুলিশ ওর নাগাল না পায়। তার জন্য দরকার হলে আরও দু-চারটে লাশ ফেলে দিতে হবে। যদি কেউ ওকে প্রোটেক্ট করতে চায়।”
লাখন ইংরেজি এবং বাংলা দুটোই কিছু-কিছু বোঝে। পিস্তল দেখে এবং কথাবার্তা শুনে কুস্তিগির লাখনেরও হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
যে-লোকটা কথা বলছিল সে লাখনকে হঠাৎ দরজায় উদয় হতে দেখে কথা থামিয়ে বাজখাই গলায় বলে উঠল, “তুই কে রে?”
পিস্তলওলা লোকটা ধাঁ করে একটা পিস্তল তুলে তাক করে বলল, “হ্যান্ডস্ আপ।”
লাখন কথাটা বুঝল, তবে হাত তোলার উপায় ছিল না। এক হাতে টিফিনবাটিতে রুটি, অন্য হাতে অ্যালুমিনিয়ামের ডেকচিতে তার তৈরি বিখ্যাত আলুর তরকারি। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আমি লাখন আছি বাবুজি। পোটার লাখন। আপলোগা খানা লায়া।”
“অ!” বলে প্রথম লোকটা যেন খুব তাচ্ছিল্য করে বলল, “ওই টেবিলে রেখে যা, আর শোন, খবরদার সাড়াশব্দ না করে এ-ঘরে কখনও আসবি না। একেবারে জানে মেরে দেব।”
লাখন এত কাঁপছিল যে, হাত থেকে বাটিটাটি পড়েই যেত। কোনওরকমে টেবিলে নামিয়ে রেখে সে প্রাণভয়ে পালাতে যাচ্ছিল, কিন্তু পিস্তলওলা লোকটা উঠে এসে প্ল্যাটফর্মে তার পথ আটকাল, “এই, তুই আমাদের কথা কিছু শুনতে পেয়েছিস?”
“নেহি বাবু, রাম কি কিরিয়া।”
“যদি শুনে থাকিস তো ভুলে যা। মুখ দিয়ে যদি টু শব্দটি বেলোয় তা হলে কিন্তু খুন হয়ে যাবি। মনে থাকবে?”
“জি বাবু।”
“এখানকার থানাটা কোথায়!”
“আধা মিল দুর হোবে। দুই দিকে।”
“দারোগা কেমন লোক?”
“ভাল লোক আছে বাবুজি।”
“ভাল মানে কি? চালাক-চতুর, না বুদ্ধ?”
কোনটা বলা ঠিক হবে, তা বুঝতে না পেরে লাখন একটু মাথা চুলকোল। তার মনে হল দারোগাবাবু বোকা হলেই এদের সুবিধে। সে বলল, “বড়বাবু বুন্ধু আছে।”
“আর তুই! তুই চালাক, না বুদু?”
“আমি-ভি বুদ্ধ আছে।”
“তোর চেহারাটা ভাল। কুস্তিটুস্তি করিস নাকি?”
“থোড়া থোড়া।”
“ঠিক আছে, আমাদের কাজটা মিটে যাক, তারপর তোর সঙ্গে একদিন কুস্তি হয়ে যাবে।”
লাখন ভয় পেয়ে বলল, “নেহি হুজুর, হামি তো হারিয়ে যাব।”
লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, “লড়ার আগেই হেরে বসে আছিস! ঠিক আছে, তা হলে তোকে কুস্তির কয়েকটা প্যাঁচ শিখিয়ে দিয়ে যাব।”
“জি হুজুর মেবোন।”
“আর শোন, ওই স্টেশন-মাস্টারটা কেমন লোক?”
“ভাল আদমি বাবুজি।”
“তোর কাছে দেখছি সবাই ভাল! এ-লোকটা চালাক, না বোকা? সাহসী, না ভিতু?”
“ভিতু আছে, একটু বুন্ধু-ভি আছে।”
“দরকার পড়লে বোকা সাজতে পারে তো! তা হলেই হবে। এখন যা।”