পোয়ারোর চোখের সামনে যেন ঠিক একটা এই রকম চিত্র ভেসে উঠল। সে অবশ্য কার্লের আর্তনাদ নিজের কানে শোনেনি। সেই প্রতিধ্বনি তার কানে এখনো বাজছে তার মনে হল। মনে হলো ঘড়িতে যেন নির্দেশ দিচ্ছে এখনই তিনটে আঠাশ। নিজের মনে মাথা নাড়ছিল পোয়ারো অবশ্য কার্লের মৃত্যুর সময় সে যদি উপস্থিত থাকত তাহলে সে দেখতে পেত দৃশ্যটা ঠিক এই রকমই এবং ভয়ার্ত আর্তনাদ শুনতে পেত সে। একথাও চিন্তা করলো পোয়ারো, সে যদি সেই সময় উপস্থিত থাকতো তাহলে কি, মৃত্যুর হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারতো? নিয়তি তবে আর কাকে বলে? সেদিন তাকে সব আশঙ্কার কথা পরিষ্কার ভাবে বললেন ভদ্রলোক, কিন্তু একবার তিনি জানতে চাইলেন না যে এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে কিনা? অদ্ভুত মানুষ তিনি। তাকে তিনি ডেকে আনলেন তার সমস্যার কথা বলার জন্য। কিন্তু যখনই পোয়ারো সমাধানের পথ বলতে গেল তখনই তিনি নির্বিবাদে বললেন, এখানেই আমার বক্তব্যের ইতি টানছি, আপনার সাহায্যের প্রয়োজন নেই, আমি নিজেই মোকাবিলা করতে পারবো আমার আসন্ন বিপদের। আপনি এখন যেতে পারেন। আর দেখুন মঁসিয়ে পোয়ারো কথাটা যেন পাঁচ কান না হয়ে যায়। আমি কেবল আপনাকেই আমার আশঙ্কার কথা বললাম। যদি সেই আশঙ্কার কথা অন্য কারো মুখে শুনি তাহলে বুঝবো সেজন্য আপনিই দায়ী হ্যাঁ, আপনিই। আমি তার আশঙ্কার কথা কারো কাছে প্রকাশ করব না, কার্লে একরকম জোর করেই আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন। নিজের মনে মাথা নাড়ল পোয়ারো, আমি কত মক্কেলকেই এরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছি এর আগে। সেটা যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, কথাটা প্রকাশ করা কর্তব্য মনে করল সে কারণ তার যে অবস্থা গেল। কার্লের ব্যক্তিগত জীবনের একটা অধ্যায় সম্পর্কে নীরব থাকতে পারে না সে, বিশেষ করে এ অবস্থায়, এই মুহূর্তে। এই আকস্মিক মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত কিছু প্রকাশ না করলে ব্যাহত হবে পুলিসী তদন্তের কাজ। সে নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না একজন গোয়েন্দা হিসাবে।
এরকুল পোয়ারো এবার ফিরে এলো বাস্তব পরিস্থিতিতে কথাটা মনে আসতেই।
সে বলল ডঃ স্টীলিং ক্লীটের দিকে তাকিয়ে, এইভাবেই কি জানালাটা ভোলা ছিল? ডঃ মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। ওই পথে তো কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। বলল ডঃ স্টীলিং ক্লীট। আচ্ছা তাই নাকি? নিজেই যাচাই করে নিতে চায় পোয়ারো তার কথাটা। পরের কথা শুনে তার বিশ্বাস হয় না, এটাই তার স্বভাব। সব কিছুই সে নিজে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেবে, তার জন্য যদি তাকে অপ্রিয় হতেও হয় সে গ্রাহ্য করে না।
সেজন্য সে মাথা ঝোকালো জানালা দিয়ে, কার্ণিশ বা ওই জাতীয় কোনো কিছুর বালাই নেই জানালার, নীচে। সরাসরি নীচের দিকে নেমে গেছে সিমেন্ট বাঁধানো মসৃণ দেওয়াল। এমন পাইপ যার সাহায্যে ওপরে উঠে আসা যায়, জানালার সংলগ্ন বা কাছাকাছি তেমন পাইপ তার নজরে পড়ল না। পোয়ারো দেখল মানুষ তো দূরের কথা একটা বেড়ালও ওই মসৃণ দেওয়াল বেয়ে উঠতে পারবে না। কারখানার নিরেট দেওয়াল জানালার ঠিক বিপরীত দিকে, সমগ্র দৃষ্টিপথ রুদ্ধ করে খাড়া ওপরের দিকে উঠে গেছে। কোনো ফাঁক ফোকর নেই তার মধ্যে।
তৎক্ষণাৎ শোয়ারো তার পর্যবেক্ষণ শেষ করে ফিরে তাকাল, তখনই বিস্ময়ের সুর ধ্বনিত হল ডঃ স্টীলিং ক্লীট এর কণ্ঠ থেকে এটাই বিশেষ আশ্চর্যের ব্যাপার যে মিঃ কার্লের মত একজন ক্রোড়পতি নিজের ব্যবহারের জন্য এরকম একটা অফিস ঘর পছন্দ করতে পারেন, তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো। জেলের কম্পাউন্ড থেকে যেন দূরের আকাশ দেখছি, দেখুন আপনি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালে তাই মনে হয় না?
সারাদিন পোয়ারো তার কথা, হ্যাঁ বাস্তবিক সেটাই। তারপর সে তাকাল হাত কয়েক দূরে জানালার বাইরে নীরেট ইটের দেওয়ালটার দিকে।
এই দেওয়ালটার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমার মনে হচ্ছে, ডঃ সীলিং ক্লীট।
দুচোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে নিমেষে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল ডঃ স্টীলিং ক্লীট। আপনি কি বলতে চাইছেন, এটা মনের উপরে প্রভাব পড়ার কথা, বললেন ডঃ স্টীলিং ক্লীট। পোয়ারো তৎক্ষণাৎ উত্তরটা দিল না। ধীরে ধীরে অলস ভঙ্গীতে এগিয়ে গেলো সে টেবিলটার দিকে। একটা লম্বা লোহার চিমটে তুলে নিল সে টেবিলের উপর থেকে। সেই চিমটের সাহায্যে কার্পেটের উপর থেকে একটি পোড়া দেশলাই এর কাঠি অতি সতর্কতার সঙ্গে তুলে নিলো সে, তারপর সেটা বাজে কাগজের বাক্সের মধ্যে ফেলে দিল। ডঃ স্টীলিং ক্লীট এর পছন্দ হলো না পোয়ারোর কাজের পদ্ধতি। ঈষৎ বিরক্তির ভাব ফুটে উঠল তার কথায়-কখন সে আপনার এই খুঁটিনাটি কাজ শেষ হবে। কোনো গুরুত্ব দিল না পোয়ারো তার এই অসহিষ্ণুতায়। পোয়ারো এমন ভাব দেখালো যেন তার কথাটা শুনতে পায়নি যে এবং আপন মনে অস্ফুটভাবে বলে উঠল সে, খুবই অভূত পূর্ব পরিকল্পনাটি এটা মেনে নিতেই হবে, হাতে ধরা চিমটেটা রেখে দিল টেবিলের উপর তারপর সে তাকাল স্টীলিং ক্লীটের দিকে। হাজার হাজার প্রশ্ন জমা আছে এখন পোয়ারোর চোখে।
ডঃ স্টীলিং ক্লীট পোয়ারোর মনোভাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জেগেছে এটা আমার মনে হচ্ছে। পোয়ারো উত্তর দিল, একটা নয় হাজারটা প্রশ্ন। তবে আমার এই মুহূর্তে একান্ত জানা দরকার যে প্রশ্নটা সেটা হল
বলুন পোয়ারো সেটা কি? ডঃ বললেন।
মিঃ এবং মিসেস কার্লে কোথায় ছিলেন, মিঃ কার্লের মৃত্যুর সময় বলতে পারেন?
স্টীলিং ক্লীট সামান্য সময় মনে করার চেষ্টা করল তারপর বলল নিশ্চয়ই, যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গী করে সে বলল : নিজের ঘরে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন মিসেস কার্লে, তার ঘরটা এই ঘরের ঠিক উপরে। ছাদের পাশে মিস কার্লের ঘর। সে আর্ট স্কুলের ছাত্রী। একটা স্টুডিও আছে তার ঘরের পাশেই। জোয়ানো তখন ব্যস্ত ছিলেন ছবি আঁকায় তার স্টুডিও ঘরে।
তবে, তাই নাকি? নীরব থাকল পোয়ারো দু-এক মিনিট, অলস ভঙ্গিমায় টেবিলের ওপর আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটলো, আবার সে মুখ খুলল, তারপর একসময়, মিস কার্লের সঙ্গে আমি একবার নিজে কথা বলতে চাই, তাকে কি দু এক মিনিটের জন্য এ ঘরে ডেকে আনা সম্ভব হবে আপনার কি মনে হয়?
আপনি যেটা ভালো বুঝবেন, উত্তর দিলেন ডঃ কৌতূহলের চিহ্ন ফুটে উঠল স্টীলিং ক্লীটের চোখে, তবে আর কথা না বলে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। ভেজানো দরজা ঠেলে মিনিট কয়েক বাদেই ঘরে এসে ঢুকল জোয়ানো কার্লে আমি আপনাকে অসময়ে ডেকে এনে কোনো অসুবিধায় ফেললাম নাতো ম্যাডাম?
না, না, মোটেই না, বলল জোয়ানো কার্লে।
ধন্যবাদ পোয়ারো বলল, মেয়েটির দিকে অল্প সময় তাকিয়ে রইল পোয়ারো। মনে হল অস্বস্তিবোধ করছে জোয়ানো। আর থাকতে না পেরে সে বলে উঠল। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনি কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
হ্যাঁ তাই তো, যেন সম্বিত ফিরে পেলো পোয়ারো বলল, মাদমোয়াজেল, আপনাকে আমি দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই, আপনি কি তাতে বিরক্ত হবেন? সবিনয়ে সে বলল।
শান্ত শীতল ছায়া কাঁপতে লাগল জোয়ানোর চোখের তারায়। অবশ্যই না, বিরক্ত হবো কেন? ঠান্ডা গলায় বিনীত বাচন ভঙ্গীতে সে জানাল, আপনি আমাকে যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন প্রয়োজন মনে করলে। আর আমি সেজন্য একটুও বিরক্ত হবে না। আপনার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেব আমি বরং খুশী মনেই। অবশ্য যদি উত্তরগুলো আমার জানা থাকে তবেই
তবেই মানে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো।
মৃদু হাসলো জোয়ানো এই কথা বলে, আমি অপরূপা বুঝতেই পারছেন।
কিন্তু আমার ধারণা, আমার প্রশ্নগুলো খুব কঠিন এবং আপনার অজানা নয়। আর তাছাড়া অজানা প্রশ্ন আপনাকে করবই বা কেন? জোয়ানোর চোখে চোখ রেখে বলল পোয়ারো। আমার কাজ নয় কাউকে ঠকানো বা বেকায়দায় ফেলা। সত্যকে সামনে আনা আমার কাজ।
জোয়ানো চোখে গভীর সংশয় নিয়ে প্রশ্ন করল। আপনি কি সত্যই এই কেসের সত্যকে উদ্ঘাটন করতে পারবেন?
পারব না কেন, তবে সব কিছু আপনার উপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ আপনি কি বলেন তার ওপর।
জোয়ানো বলল, তাই নাকি?
এবার কোনো ভূমিকা না করেই পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি সে খবর জানতেন, যে আপনার বাবা তার টেবিলের ড্রয়ারে সবসময় একটা গুলি ভরা পিস্তল রেখে দেন?
ঘাড় নাড়লো জোয়ানো, না আমার জানা ছিল না বলল সে, এবার আপনার পরবর্তী প্রশ্ন বলুন।
হ্যাঁ অবশ্যই বলব, বলল পোয়ারো। এবার খুব মন দিয়ে আমার প্রশ্নটা শুনবেন তারপর বেশ চিন্তাভাবনা করে উত্তর দেবেন।
বেশ বলুন কি জানতে চান? জোয়ানো বলল।
আপনি এবং আপনার মা কোথায় ছিলেন, যখন আপনার বাবার মৃত্যু হয় পোয়ারো বলল, শুনেছি উনি আপনার বিমাতা, ঠিক বলছি তো?
উনি আমার সৎ মাই হন, লুইসি কার্লে ওর নাম। আমার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী বলল জোয়ানো। আপনারা দুজনে কোথায় ছিলেন, গত সপ্তাহে বৃহস্পতিবার। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার রাত্রে?
কি যেন চিন্তা করল জোয়ানো কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে। বলল বৃহস্পতিবার…একটু চিন্তা করতে দিন, অপেক্ষা করুন, মনে করতে চেষ্টা করল সে গত বৃহস্পতিবার আমরা যেন কোথায় ছিলাম? চিন্তা করার পর জোয়ানো বলল, হ্যাঁ এবার মনে করতে পেরেছি। আমরা থিয়েটারে গিয়েছিলাম প্রত্যেকে। দ্য লিটল ডগ লাফড নাটকটা দেখতে।
আপনার বাবা কি আপনাদের সঙ্গে যাবার প্রস্তাব করেছিলেন?
না, না কখনই তিনি নাটক, থিয়েটার দেখতে যেতেন না।
তাহলে সন্ধ্যে বেলাটা তিনি কিভাবে কাটাতেন প্রশ্ন করল পোয়ারো?
তিনি তার কাজ নিয়ে থাকতেন বলল জোয়ানো, পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন তিনি তার ঘরে।
কোথাও তিনি যেতেন না কখনও?
না…উত্তর দিল জোয়ানো।
তিনি সামাজিক মেলামেশা করতেন না? পোয়ারো প্রশ্ন করল, জোয়ানো এবার সোজাসুজি তাকান পোয়ারোর দিকে। বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করল সে। মনে মনে তখন সে ভাবছিল পারিবারিক কথা এই ভদ্রলোককে বলা সম্ভব কি না, বা বলা উচিত কিনা। সে পূর্বেই শুনেছে এরকুল পোয়ারোর নাম। মনের কথা ওকে বলা যায়? ওঁকে বিশ্বাস করা যায়। অন্যের কাছে নিশ্চয়ই তিনি তাদের ঘরোয়া কথা প্রকাশ করবেন না। তাছাড়া জোয়ানোর মনে আর একটা কথাও জাগল। চিকিৎসক এর কাছে তেমন রোগীর রোগ সম্পর্কে কিছু গোপন করা উচিত নয়। কারণ রোগ নির্ণয় করা তাহলে সহজ হবে। যেমনি খুনের কেসে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করে দিতে হবে। মিস কার্লে এইসব ভাবার পর আবার বলল :
মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি আপানকে সমস্ত সত্য কথাই বলব। আমার বাবার ব্যক্তিত্ব ছিল কাঠিন্যতা পূর্ণ। আর কেউ তাকে হয়তো এজন্য সহ্য করতে পারতো না। তার অতি কাছের লোকেরাও তাকে কিছুতেই পছন্দ করত না।
পোয়ারো মন্তব্য করল, সত্যি ম্যাডাম, খুব গুছিয়ে আপনি বলতে পারেন মার কথাটা। আমি আপনার মূল্যবান সময় সংক্ষেপে করে দিচ্ছি মিঃ পোয়ারো। এছাড়া আমার অন্য উদ্দেশ্য নেই। আবার সে বলল, আপনার প্রশ্নের অন্তর্নিহিত অর্থটা যে কী, তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। আমার সত্যার কথা যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে প্রথমেই বলি, তিনি আমার বাবাকে বিত্তবান জেনে সেই লোভেই বিয়ে করেছিলেন। এখানে আমিও কেন মুখ বুজে পড়ে আছি জানেন, আমি স্পষ্ট করেও বলছি, সেটাও আমার বাবার অর্থ ও সম্পত্তির লোভে। কারণ কোথায় চলে গিয়ে যে একা একা শান্তিতে থাকব তার উপায় নেই, কারণ আমার হাত একেবারে খালি। তার ওপর আমি ভালোবাসি একটি ছেলেকে, খুবই গরীব সে। আমার বাবা জানতেন আমাদের প্রেমের ব্যাপারটা, তিনি হয়তো মনে মনে চাইতেন যে আমি তাকে বিয়ে করি। আর যাহোক আমি তো বাবার সব বিষয় সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবো-কাজেই ব্যাপারটা খুব সহজ।
হা সাথে সাথে আপনার বাবার সৌভাগ্য আপনাতে বর্তাচ্ছে। ঠিক কথাই বলেছেন মিঃ পোয়ারো। তবে সিকি মিলিয়ন রেখে গেছেন সৎ মায়ের জন্য। এছাড়া আরও কিছু শর্ত ছিল তার উইল-এ। তবে বাদ বাকী সব আমার। মেয়েটি হঠাৎ হেসে উঠল তাহলে আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, বাবার মৃত্যু কামনা করা আমার পক্ষে খুবই যুক্তি যুক্ত তাই না?
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে পোয়ারো বলল। হ্যাঁ ম্যাডাম? আপনি দেখছি আপনার বাবার বিষয় সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে তার বুদ্ধিরও উত্তরাধিকারিণী হয়েছেন।
মেয়েটি চিন্তিত মুখে বলল, আমার বাবা যে চতুর ছিলেন একথা স্বীকার করি এবং চিনি প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। লোকের কাছে তার পরিচয় এরকমই ছিলো। তার অন্যকে নিয়ন্ত্রিত করবার একটা ক্ষমতা ছিল অথচ কিই বা লাভ হলো? শুধুই তিক্ততা সবই ব্যর্থ হলো–বড়ই প্রকট ছিল তার মধ্যে সাধারণ মানবিক গুণাবলীর স্বভাব।
স্রিয়মাণ মুখে বলে উঠলো পোয়ারো, হায়। ভগবান। কি অসম্ভব বোকা আমি?
চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জোয়ানো কার্লে ঘুরে দাঁড়াল দরজার দিকে। তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আর কিছু জানতে চান আপনি?
আছে আরো ছোট দুটি প্রশ্ন, এই লোহার চিমটেটা, টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল এবং জিজ্ঞাসা করল পোয়ারো এটা কি টেবিলের ওপর সব সময়ই পড়ে থাকে?
জোয়ানো বলল, বাবা ওটা ব্যবহার করতেন কোনো জিনিসপত্র তোলার জন্য। ঘর নোংরা থাকা কোনোমতেই তিনি বরদাস্ত করতে পারতেন না। পোয়ারো বলল, আর একটা প্রশ্ন? স্বাভাবিক ছিল কি আপনার বাবার দৃষ্টিশক্তি?
পোয়ারোর দিকে নিশ্চল ভাবে তাকালো জোয়ানো। বলল সে, ঠিক কথা, না, তিনি চশমা ছাড়া একেবারেই কিছু দেখতে পেতেন না। সব কিছুই তার অস্পষ্ট মনে হত। তার দৃষ্টিশক্তি ছেলেবেলা থেকেই খারাপ ছিলো।
চশমা পরে তার কি দেখার অসুবিধা হতো পোয়ারো জানতে চাইল।
না, চশমা পরে দেখতে তার কোনো অসুবিধা হতো না, জানাল জোয়ানো।
খবরের কাগজের ছোট লেখা তিনি কি পড়তে পারতেন।
হ্যাঁ তা পারতেন অবশ্যই জোয়ানো উত্তর দিল। আচ্ছা ম্যাডাম এ পর্যন্ত থাক আমার আর কিছু জানার নেই। আপনি এখন যেতে পারেন। তবে আশাকরি প্রয়োজন হলে সহযোগীতা করবেন। পোয়ারো বলল তা অবশ্যই করবো। এই কথা বলে জোয়ানো আর দাঁড়াল না, মন্থর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো পোয়ারো অনেকক্ষণ বসে রইল জোয়ানো যে পথ দিয়ে চলে গেল সে দিকে তাকিয়ে। নানা চিন্তা খেলা করছে তখন তার মাথায়। একটা চিন্তার সমাধান হতে না হতেই আরেকটা চিন্তা হাজির হয় আবার সেই চিন্তার জট খুলতেই, নতুন আর একটা চিন্তা। এমন সেই চিন্তা, যেটার সঙ্গে কোনো মিল নেই আগের চিন্তাগুলোের। এই লোকের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তবে পোয়ারো মনোযোগ দিলে বুঝতে পারত। একত্রিত করা যায় সব চিন্তাগুলিকে, সেগুলো দেখা যাবে একই সূত্রে বাঁধা। প্রতিটি চিন্তাই যেন এ ওর পরিপূরক। সবগুলোই অসমাপ্ত বলে মনে হবে একটি পদ বাদ দিলে। সেজন্য সে কোনো চিন্তাই নস্যাৎ করতে পারলো না। প্রতিটি চিন্তা এবং তার সমাধানের উপায়। অর্থাৎ লুকিয়ে রাখল সে তার স্নায়ুর নাগপাশে। তখনই সে তার স্মৃতির ভাণ্ডারে হানা দেবে যখনই তার ইচ্ছা হবে। বা প্রয়োজন মনে করবে। এবং সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করবে। একটা সম্ভাবনার কথা মনে এল তার, সমাধানের সূত্রের কথা মনে করতেই। সে তার মাথার চুল ছিঁড়তে শুরু করল নিজের ওপর সে দোষারোপ করতে লাগল। সে বিড়বিড় করে নিজের মনেই বলতে লাগল, ওঃ কি নির্বোধ আমি। প্রকৃতপক্ষে আমি যেন জম্মের বোকা। একবারের জন্যও আমার সেদিকে দৃষ্টি পড়েনি অথচ সারাক্ষণ জিনিসটা আমার চোখের সামনে পড়ে রয়েছে। আমার তো বোঝা উচিত এত সামনেই পড়ে রয়েছে। তাদের কাছেই হয়তো নজরে আসেনি এত কাছে পড়ে আছে বলেই। আর একবার জানলা দিয়ে মাথা গলিয়ে পোয়ারো নীচের দিকে তাকালেন। কাছারি বিল্ডিং আর নর্থওয়ে হাউস এর মাঝ বরাবর একটি সরু প্যাসেজ এতক্ষণে তার নজরে পড়ল কালো একটা বস্তু প্যাসেজের মাঝখানে।
তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গীতে মাথা নাড়ালো পোয়ারো, একটা পরিপূর্ণ তৃপ্তির হাসি তার চোখে মুখে। সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে সে এবার নীচে নেমে এলো।
লাইব্রেরী ঘরে অন্য সকলে অপেক্ষা করছিল। পোয়ারো বেনেডিক্ট কার্লের সহকারী হুগো কর্নওয়ার্দিকে বলল : মিঃ কর্নওয়ার্দি, বিস্তারিতভাবে একটু বলুন আমাকে স্মরণ করে, যে। কখন, কি অবস্থায় মিঃ কার্লে আমার কাছে চিঠি পাঠাবার নির্দেশ দেন। কোনো ঘটনাই যেন দয়া করে বাদ দেবেন না। আচ্ছা চিঠির বয়ানটাও কি তিনি যথাযথভাবে আপনাকে বলে দিয়েছিলেন?
বুধবার বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ তিনি আমায় এই চিঠিটা টাইপ করার নির্দেশ দেন, আমার যতদূর মনে পড়ছে, বললেন মিঃ কর্নওয়ার্দি।
চিঠিটা তাকে দেওয়ার ব্যাপারে কি বিশেষ কোনো নির্দেশ ছিল? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন। আমাকে তিনি নিজে হাতে চিঠিটা তাকে দিতে বলেছিলেন।
তার নির্দেশ আপনিও ঠিক ভাবে পালন করেন?
হু বললেন কর্নওয়ার্দি।
খানসামাকে কি কোনোরকম ব্যক্তিগত নির্দেশ দেওয়া ছিল আমাকে তার কাছে নিয়ে আসার ব্যাপারে? কর্ণওয়ার্দি বললেন, হ্যাঁ, আমায় তিনি বলেছিলেন যেন খানসামা হোমসকে ডেকে দিই। এক ভদ্রলোক তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন আগামীকাল সন্ধ্যা সাড়ে নটায়, তিনি হোমসূকে তার নাম জিজ্ঞাসা করতে নির্দেশ দেন, আর যেন সে দেখতে চায় সেই চিঠিটা যেটা ওই ভদ্রলোককে পাঠানো হয়েছে।
খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, এ ধরনের নির্দেশে সাবধানতার মন্ত্রটা অশোভন ভাবে বেশি আপনার কি মনে হয়। মিঃ কর্নওয়ার্দি?
কর্নওয়ার্দি গুরুত্ব না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকালেন সতর্কতার সঙ্গে বলল সে, মিঃ কার্লে একটু অস্বাভাবিক ধরনের মানুষ।
মিঃ কালের আর কোনো নির্দেশ ছিলো, জানতে চাইলো পোয়ারো।
কর্নওয়ার্দি বললেন, তিনি আমাকে ছুটি নিতে বলেছিলেন ওই সন্ধে বেলাটার জন্য।
আপনিও সেই নির্দেশটা নিশ্চয়ই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন?
কর্নওয়ার্দি বলল, সেদিন সন্ধ্যায় আমি সিনেমা দেখতে চলে যাই, নৈশভোজের পরই। কখন আপনি ফিরে এলেন, জানতে চাইলো পোয়ারো।
তখন প্রায় সওয়া এগারোটা হবে, হুগো বললেন।
মিঃ কার্লের সঙ্গে সেদিন কি আপনার আর দেখা হয়েছিল?
না। বললেন কনওয়ার্দি।
তিনি কি পরের দিন সকালে আপনাকে এ বিষয়ে কিছু বলেছিলেন?
না তিনি কিছু বলেন নি, জানালো মিঃ কর্নওয়ার্দি আবার একটু থামলো পোয়ারো। শুরু করল আবার সে, যখন আমি এখানে এসে পৌঁছাই তখন আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়নি। না, আমাকে তিনি বলেছিলেন আমি যেন হোমসকে নির্দেশ দিই। আপনাকে যেন সোজাসুজি তার ঘরেই নিয়ে যাওয়া হয়। মিঃ কার্লে সেখানেই আপনার জন্য তিনি অপেক্ষা করবেন। কিছু জানেন কি আপনি এই ব্যবস্থা কি জন্য? পোয়ারো প্রশ্ন করলো।
মাথা নাড়লেন কর্নওয়ার্দি। কখনো আমি তার নির্দেশ সম্বন্ধে কোনো প্রশ্ন করতাম না, সেদিনও করিনি। তিনি খুব বিরক্ত হতেন তার মুখের ওপর কোনো কথা বললে। এই কারণে সব ব্যাপারেই আমি নীরব থাকতাম।
তিনি কি সবসময় তার নিজের ঘরেই আপনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলঃ হ্যাঁ, বেশির ভাগ সময়, তবে সবসময় নয়, আমার ঘরেও হয়তো কখনো আপনাদের বসানোর ব্যবস্থা হতো। বলল কর্নওয়ার্দি।
আচ্ছা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল কি এর পেছনে? কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করলো কর্নওয়ার্দি তারপর বলল, আমার তো সেটা মনে হয় না। অবশ্য এটা নিয়ে কোনোদিন বিশেষভাবে ভেবে দেখিনি।
এবার মিসেস কালের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো, ম্যাডাম, আপনাদের খানসামা হোমসকে একবার ডেকে দেবেন, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
অবশ্যই, মঁসিয়ে পোয়ারো তাকে আমি এক্ষুনি ডেকে পাঠাচ্ছি। তারপর বেল টিপলেন মিসেস কার্লে। হোমস সঙ্গে সঙ্গে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল অভিজ্ঞ খানসামার মতই।
আমাকে আপনি ডেকেছেন ম্যাডাম, সে জিজ্ঞাসা করল। পোয়ারোর দিকে ইঙ্গিত করে দেখিয়ে দিলেন মিসেস কার্লে। হোমস বিনীতভাবে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকাল। এবং বলল, বলুন স্যার কি জানতে চান? হোমস, বলতো তোমার প্রতি কি নির্দেশ দেওয়া ছিল, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন আমি এখানে আসি? বলল হোমস তার গলা পরিষ্কার করে মিঃ কর্নওয়ার্দি নৈশভোজের পর আমাকে বলেন। রাত সাড়ে নটা নাগাদ মিঃ এরকুল পোয়ারো নামে এক ভদ্রলোক মিঃ কার্লের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন। ভদ্রলোককে একটা চিঠি দেওয়া হয়েছে, একথাও তিনি বলেন। তিনিই যে মিঃ এরকুল পোয়ারো তা জানার জন্য আমাকে চিঠিটা দেখতে বলা হয়েছিল। তারপর আমাকে নির্দেশ দেওয়া ছিল ভদ্রলোককে মিঃ কর্নওয়ার্দির ঘরে নিয়ে যাওয়ার। এমন কোনো নির্দেশ তোমাকে কি তোমার মনিব দিয়েছিলেন, যে আমাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করার আগে তোমাকে দরজায় নক করতে হবে? খানসামা একটু হতভম্ব হয়ে গেল পোয়ারোর প্রশ্নটা শুনে। একটু করুণ বিপন্নভাব ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বলল সে, অবশ্যই সেটা ছিল মিঃ কার্লের স্থায়ী নির্দেশ। সব সময়েই নক করা আমাদের কাছে একটা প্রথা হয়ে গিয়েছিল। কোনো অপরিচিত লোককে সেখানে নিয়ে যাবার আগে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের লোকই বেশি আসত, দেখা করতে। আসতেন তারা ব্যবসার বিষয়ে।
আমাকে অবাক করেছিল সেটাই, পোয়ারো বলল, আর কিছু নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন আমার সম্পর্কে? সে বলল, না স্যার। আমাকে কেবল এই কটি নির্দেশ দিয়ে যান কর্নওয়ার্দি বেরিয়ে যাবার সময়। তখন কটা বেজেছিল পোয়ারো জানতে চাইলেন, স্যার, নটা বাজতে দশ মিনিট বাকী ছিলো। উত্তর দিল খানসামা।
তুমি কোথায় ছিলে আমি আসার আগে? কিচেনে ছিলাম স্যার খানসামা বলল।
অবাক হয়ে পোয়ারো বলল কিচেনে? আর একটু আগে তুমি বলেছিলে, তোমার বাড়ির সবার নৈশভোজ সারা হয়ে গিয়েছিল আগেই। তুমি তাহলে কিচেনে কি কাজ করছিলে?
তখনো আমার নৈশভোজ সারা হয়নি খানসামাটি বলল। দোতলায়, না একতলায় তোমাদের কিচেনটা? পোয়ারো জানতে চাইল। দোতলায় স্যার, খানসামা বলল। কত দূরে সেটা মিঃ কালের ঘর থেকে? জানতে চাইল পোয়ারো। সে উত্তর দিল, দুখানা ঘরের পাশেই।
তাহলে ব্যাপারটা হচ্ছে, কর্নওয়ার্দি চলে যাবার পর দোতলায় তোমার মনিব কালের ঘরের সব থেকে কাছে ছিলে একমাত্র তুমিই। পোয়ারো মন্তব্য করল।
খানসামাটি বলল, হ্যাঁ স্যার।
তাহলে তুমি আজও কি কিচেনে ছিলে, তোমার মনিবের মৃত্যুর সময়?
হা স্যার, কিচেনেই ছিলাম আমি, সে জবাব দিল।
কোথায় ছিলেন তখন মিঃ কর্নওয়ার্দি?
পোয়ারো জানতে চাইলো।
খানসামা হোমস জোরে মাথা দুলিয়ে বলল তা, তো জানি না স্যার। আসলে আমি তখন ঠিক করে নজর দিইনি।
তুমি কি জানো তোমার ওপর নজর রাখা হয়েছিল? কি করে আমি জানব স্যার, আমার তো সেটা জানার কথা নয়।
তুমি কি করতে জানতে পারলে?
অবশ্যই একটু সতর্ক থাকতাম খানসামা বলল।
পোয়ারো জানতে চাইল কি ভাবে সতর্ক হতে?
তাহলে আমিও পাল্টে নজর রাখাতম।
হোমস চারিদিকে একবার নজর বুলিয়ে নিচুগলায় বলল, সব সময় সব কথা সবার সামনে বলা যায় না স্যার, কেউ শুনে ফেলতে পারে। এখানে দেওয়ালেরও কান আছে।
তোমার আশঙ্কার কথা নিরাপদ কোনো জায়গায় পরে না হয় শুনব, সেটাই ভালো হবে, পোয়ারো বলল। তোমার সঙ্গে কোথায় দেখা হতে পার?
বলল হোমস, আমার কিচেনে কিচেন খালি হয়ে যাবে একটু পরেই। আমার অনেক কথা বলার আছে স্যার। আপনার কাছে বলে হালকা হতে চাই। আমি কয়েকটি কথা বলতে চাই
হোমস আমিও যে তোমার কাছে কিছু শুনতে চাই বলল পোয়ারো। ঠিক আছে তাই হবে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো পোয়ারো। সত্যি কথা বলছে কি খানসামা হোমস? কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হচ্ছে তাকে। তার দৃষ্টি মনে হয় অন্যপথে সরিয়ে দিতে চাইছে সে কথার মারপ্যাঁচে। কি হতে পারে এর অর্থ? সময় নিতে চাইছে কেন সে? প্রমাণ সরাতে চায় কি সে মিঃ কার্লের খুন সংক্রান্ত বিষয়ে? কি তার মোটিভ হতে পারে? এটা যদি আত্মহত্যার কেস না হয়ে খুনের কেস হয়, তবে কিসে এতে অংশ নিয়েছিল? আর কেই বা কলকাঠি নেড়েছিল এই হত্যার পেছনে?
পোয়ারোর মনে হল অসম্ভব এতগুলো প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে পাওয়া। এর খুঁটিনাটি প্রত্যেকটি বিষয় ধীরে ধীরে আলোচনা করতে হবে। আর উত্তর বের করতে হবে প্রতিটি প্রশ্নের এক একটা করে। তারপর নির্দিষ্ট সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হবে উত্তরগুলিকে একত্র করে সাজিয়ে নিয়ে।
নতুন প্রশ্নমালার জের টেনে আবার সে শুরু করল খানসামা হোমস্ এর দিকে ফিরে কিয়ে মিঃ কার্লের সঙ্গে আর কি তোমার দেখা হয়ে ছিল হোমস?
প্রতিদিনের অভ্যাস মতো আমি ঠিক নটার সময় তার জন্য এক গ্লাস গরম জল নিয়ে গিয়েছিলাম, স্যার। বললো হোমস। গরম জলের গ্লাসটা তার টেবিলের ওপর রেখেও এসেছিলাম।
মিঃ কার্লে কি নিজের ঘরেই ছিলেন, না মিঃ কর্নওয়ার্দির ঘরে ছিলেন?
তারই ঘরে ছিলেন তিনি, স্যার।
কিরকম অবস্থায় তুমি তাকে দেখেছিলে? প্রশ্ন করল পোয়ারো।
চেয়ারে বসেছিলেন মিঃ কার্লে, বলল হোমস।
তুমি ঠিক দেখেছিলে তো, চেয়ারের পাশে তিনি কি পরেছিলেন?
না স্যার, আমি স্পষ্ট দেখেছিলাম তিনি বসেছিলেন চেয়ারের উপর।
তোমার অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য পড়েনি ঘরের ভেতর জানতে চাইলো পোয়ারো।
অস্বাভাবিক অর্থে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন স্যার জানতে চাইল হোমস।
ধরো, চেয়ারে বসেছিলেন তিনি–হয়তো কোনো সে রকম উত্তেজনা বা অস্বাভাবিক আচরণ, এইরকম কোনো লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলে কি?
না তো, সে রকম কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ তার মধ্যে আমি দেখিনি স্যার, উত্তর দিল হোমস।
আচ্ছা বলতে পারো সেই সময় মিসেস কার্লে এবং মিস কার্লে কোথায় ছিলেন? পোয়ারো জানতে চাইল। তারা দুজনেই তখন থিয়েটারে গিয়েছিলেন স্যার।
ওদের কি থিয়েটার থেকে ফেরার পর মিঃ কার্লের ঘরে ঢুকতে দেখেছিলে প্রশ্ন ছুঁড়ল পোয়ারো। তখন আমি কিচেনে ছিলাম, সঠিক বলতে পারব না জবাব দিল হোমস।
বর্তমানে আমার এতেই কাজ চলে যাবে। হোমসকে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে চলে যেতে বলল পোয়ারো।
অভিবাদন জানিয়ে হোমস ঘর থেকে চলে যাবার পর, পোয়ারো তাকালো ক্রোড়পতি বিধবা মিসেস কালের দিকে।
মিসেস কার্লে নড়াচড়া করছিলেন। পোয়রোর হাত থেকে কখন তিনি নিস্তার পাবেন কে জানে? তিনি কখনোই পুলিসী ঝামেলা বরদাস্ত করতে পারেন না। দরজার দিকে সেজন্য তিনি বার বার দৃষ্টিপাত করছিলেন। ভাবখানা এমন ছিল যে কখন পোয়ারো তাকে রেহাই দেবে। এই জিজ্ঞাসাবাদের সমাপ্তি হবে কখন?
মিসেস কার্লে এবার কয়েকটা প্রশ্ন করব আপনাকে, পোয়ারো জানাল। আপনার স্বামীর দৃষ্টিশক্তি কি স্বাভাবিক ছিল? একথা প্রথম জিজ্ঞাসা করছি।
না, তিনি কিছুই দেখতে পেতেন না চশমা ছাড়া বললেন মিসেস কার্লে।
তা হলে আপনি বলছেন যে তার দৃষ্টি শক্তি ক্ষীণ ছিলো? এটাই ধরে নেবো পোয়ারো বলল।
চশমা না পড়লে তিনি অসহায় হয়ে পড়তেন, এটা সত্যি কথাই মিসেস কার্লে জানালেন। একেবারেই যেন তিনি অন্ধ হয়ে যেতেন।
কয়েক জোড়া চশমাও ছিল তার নিশ্চয় জানতে চাইল পোয়ারো।
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মিসেস কালে জানালো–হ্যাঁ সেটাই ঠিক।
পোয়ারো আহ্ শব্দটা উচ্চারণ করল। তারপর সে আবার সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমার আর একটা প্রশ্ন আছে।
মিস কার্লে আর আপনি তো থিয়েটারে গিয়েছিলেন। স্বামীর সঙ্গে কি আপনি দেখা করেছিলেন থিয়েটার থেকে ফেরার পর?
না, করিনি–বললেন মিসেস কার্লে, আমরা আমাদের ঘরে সোজা চলে গিয়েছিলাম। অবশ্যই আমরা সেটাই করেছিলাম জোর দিয়ে বললেন মহিলাটি তার শেষ জবানবন্দীতে মিসেস কার্লে বলেছেন তিনি ও তার কন্যা জোয়ানো মিঃ কার্লের সঙ্গে দেখা না করেই যে যার ঘরে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটা থিয়েটারের টিকিট পাওয়া গেছে বেনেডিক্ট কার্লের ঘর থেকে। একটাই পাওয়া গেছে, দুটো টিকিটের মধ্যে…হয়তো ওদের দুজনের মধ্যে কেউ একজন তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। কে হতে পারে সেই একজন, মিস অথবা মিসেস কার্লে। থিয়েটারে গিয়েছিল ওরা দুজন। আর ফিরেও এসেছিল একই সঙ্গে। অতএব মিঃ কার্লের ঘরে কে প্রবেশ করেছিল? যদি কেউই গিয়েই থাকে, কেউ তা প্রকাশ করেনি জবানবন্দীর সময়। অর্থাৎ মিথ্যে বলছে কেউ না কেউ একজন। হয়ত বা তারা পরস্পরের অন্যায় কাজ ঢাকা দেবার চেষ্টা করছে। আবার অন্যভাবে মনে করা যায় তারা একজন আর একজনের কাছে, নিজেকে আড়াল রাখতে চাইছে। এই কথা বলে যে মিঃ কালের ঘরে তারা কেউই প্রবেশ করেনি। তাহলে-চিন্তা করছিল পোয়ারো এইসব তথ্য সম্বন্ধে।
এদের থেকে একটু অন্যরকম মিস জোয়ালো, এটাই মনে হয়। কারণটা হল এই যে, তার বাবাকে খুন করে বাড়তি কিছু তার লাভ হবে না, উইল করে তার নামেই লিখে গেছেন সমস্ত সম্পত্তি এবং অধিকাংশ অর্থই তার পিতা মিঃ কার্লে। তা হলে সে কেন তার পিতাকে হত্যা করবে? থিয়েটারের একটা মাত্র টিকিট পাওয়া গেছে কালের ঘরে। তার অনুমান যদি সত্যি হয়, পোয়ারো ভাবল, মিস জোয়ানো কালে যদি এই খুনের সঙ্গে জড়িত না হয়, তবে ধরে নিতে হয় টিকিটটা মিসেস কার্লেরই। হয়তো তিনি তার স্বামীর ঘরে গিয়েছিলেন। থিয়েটার থেকে ফেরার পর। হয়তো কোনো বোঝাঁপড়া করার জন্য, তা হলে কিসের বোঝাঁপড়া? মিসেস কার্লেকে তার উইলে অর্থ কিংবা সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করেছেন। সেটা কি মনঃপূত হয়নি মিসেস কার্লের? তিনি কি বদলাতে চেয়েছিলেন মিঃ কালের উইল? সেজন্যই কি তিনি ঢুকেছিলেন মিঃ কার্লের ঘরে একটা বোঝাঁপড়া করার জন্য। আর তারপর-না, সেটাই বা কি করে সম্ভব? মিঃ কার্লে যদি আত্মহত্যা না করে থাকেন। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন যে অবস্থায়, কোনো নারীর লক্ষ্য ভেদ করা সম্ভব নয়। হয়তো বা এটাই কোনো পুরুষের কাজ অথবা নিজেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন। অথবা কে হতে পারে সেই পুরুষটি যে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে?
মাথা নাড়লো পোয়ারো নিজের মনে। মনে হল তার মুখের ভাব দেখে যেন একটা প্রলম্বিত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ফুসফুস থেকে এটাই মনে হল। পোয়ারো তার সহজাত ভঙ্গীতে সামনের দিকে সামান্য একটু ঝুঁকে পড়ে বলে উঠল, মনে হয় এখানেই মামলার নিষ্পত্তি ঘটলো, এটাই আমার বিশ্বাস। তাহলে সমাধানের একটি সূত্র খুঁজে পেয়েছেন আপনি?
হ্যাঁ পেয়েছি হয়তো কিন্তু
তবে কিন্তু কেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
আমার এই সমাধানের সূত্র এখানে অনেকেরই যেমন, মিসেস কার্লে এবং হুগোর পছন্দ নাও হতে পারে। বলল পোয়ারো ওরাই বা কেন মেনে নেবেন না ওঁরা। আমরা অর্থাৎ পুলিশ কর্তৃপক্ষ যদি আপনার সমাধান সূত্রকে যথেষ্ট বলে মনে করি। বললেন মিঃ বানেট বিশেষত মিসেস কার্লে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবেন মেনে নিলে, সে কারণেই মানতেন না। স্বামী আত্মহত্যা করে কেন? হয়তো তার স্ত্রীর সহযোগীতা ও ভালোবাসার অভাবে, তাই নয় কি? আর স্ত্রীই বা নিজেকে শেষ করে কখন? স্বামীর অত্যাচারে।
ইনসপেক্টর বার্নেট বললেন, মিঃ পোয়ারো এটাই ঠিক কথা। আপনি কি তবে নিশ্চিত যে আত্মহত্যা করেছেন মিঃ কার্লে?
আত্মহত্যা করবেন কেন তিনি, আত্মহত্যা করার মতো কি তার কোনো কারণ ঘটেছিল? পোয়ারো বলল।
সেই দুঃস্বপ্ন দেখতে দেখতে হয়তো তিনি একসময় পাগলামীর পর্যায়ে চলে গিয়েছিলেন, আর পাগলামীর একটা লক্ষণ আত্মহত্যা করা। এটা জানেন তো?
অবশ্যই জানি, স্বপ্নটা যদি সত্যি হয় সেই ক্ষেত্রে বলল পোয়ারো।
তাহলে কি স্বপ্নটা সত্যি নয়? জানতে চাইলেন বার্নেট। স্বপ্ন কি আর সত্যি হয়? উত্তর দিল পোয়ারো। পোয়ারোর কথার সারমর্মে যা বোঝাতে চাইছেন, ইনসপেক্টর বার্নেট বুঝতে পারল, সে যা জেনেছে দুঃস্বপ্নের কোনো সম্পর্ক নেই কার্লের আত্মহত্যার সঙ্গে। তাহলে কিসের সঙ্গে জড়িত মিঃ কার্লের আত্মহত্যা।
সারা ঘরে এখন বিরাজ করছে একটা, অস্বস্তিকর নীরবতা। সেই ছোটখাট মানুষটির মুখের ওপর এখন সকলের উদগ্রীব দৃষ্টি। কিন্তু সে দিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না এরকুল পোয়ারোর। সে তখন ব্যস্ত তার পশমের মতো নরম গোঁফের প্রান্ত ভাগে হাত বুলাতে। এটাও একটা সহজাত অভ্যাসের অন্যতম। একটা বিব্রত হত বিহ্বল ভাব ইনসপেক্টর বার্নেটের মুখে। ডঃ স্টীলিং ক্লীট তাকিয়ে আছে, দুই ভুরুর মাঝখানে কুঞ্চন রেখে কুটীল চোখে, অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি মুখে চোখে মাখিয়ে চেয়ে আছে মিঃ হুগো কর্নওয়ার্দি। অব্যক্ত বিস্ময় মিসেস কার্লের দু চোখের কোণে আর অদ্ভুত চঞ্চলতা মিস জোয়ানোর চোখের তারায়।
মিসেস কার্লে শেষ পর্যন্ত ভঙ্গ করলেন সেই নীরবতা। ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠস্বরে তিনি বলে উঠলেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি এসবের, মানে কিছুই বুঝতে পারছি না, সেটা কি স্বপ্ন ছিল না দুঃস্বপ্ন? এ নিয়ে অবশ্যই ভাবনা চিন্তা করা উচিত।
মহাশয়া আপনি ঠিকই বলেছেন, পোয়ারো তাকে সমর্থন জানিয়ে বলল, সত্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্বপ্নটা।
কেঁপে উঠলেন মিসেস কার্লে, তিনি বললেন, এর আগে আমি কখনো অলৌকিক বা অতি অলৌকিক ব্যাপারটা বিশ্বাস করিনি। কাউকে যদি রাতের পর রাত এই দুঃস্বপ্নর শিকার হতে হয় সেরকম পরিস্থিতিতে
উঃ স্টীলিং ক্লীট বলল, সত্যিই ঘটনাটা আশ্চর্যজনক। অভূতপূর্ব, আপনার যদি না আপত্তি থাকে তাহলে মঁসিয়ে পোয়ারোকে আমাদের সরাসরি ব্যাপারটা বলতেন, যেহেতু আপনি সবিস্তারে খোদ মালিকের কাছ থেকে ব্যাপারটা শুনেছেন, আবার পেশাদারী ভঙ্গিমায় হালকা ভাবে একটু কেশে নিয়ে বলতে শুরু করল, মিসেস কার্লে, মাপ করবেন, মিঃ কার্লে যদি নিজের মুখে কথাটা না বলতেন। আমার বক্তব্য হচ্ছে যে
পোয়ারো বলল সত্যি তাইই, তারপরই তার আধবোজা চোখ দুটি খুলে গেল, সে যেন হঠাৎ জেগে উঠল পিঙ্গলস বুজ আলোর আভাস তার ধূসর চোখের মনিতে, যদি না শোনাতেন আমাকে এই কাহিনি বেনেডিক্ট কার্লে–নিঃশ্বাস নেবার জন্য একটু থামল সে। সবার মুখের উপর দিয়ে সে তার তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল দৃষ্টি অর্ধবৃত্তাকারে একবার বুলিয়ে নিল।
তারপর সে এইভাবে বলতে শুরু করল
সেদিন সন্ধ্যায় এমন একটা কিছু ঘটেছিল, যার ব্যাখ্যা করতে আমি পারিনি, হয়তো আপনারা সকলেই সেটা বুঝতে পেরেছেন। প্রথম কথা হল, মিঃ কার্লে কেন আমার সঙ্গে তার সেই চিঠি আনতে বলেছিলেন?
কর্নওয়ার্দি অভিমত প্রকাশ করল হয়তো সনাক্তকরণের জন্য।
অত সোজা নয় বাছা আমার, অত্যন্ত বিস্ময়কর ব্যাপারটা। নিশ্চয়ই কোনো জোরালো কারণ আছে এর পশ্চাতে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেটা শুধু আমাকে নিয়ে আসতেই বলা হয়নি, চিঠিটা আমাকে দিয়ে দিতেও বলেন। সেই চিঠিটা এমন কি তিনি নষ্ট করেও ফেলেননি, আমার চলে আমার পরও। তার সেই চিঠিটা আজ বিকেল পর্যন্ত তার অন্য কাগজের মধ্যে ছিলো। কেউ তিনি রেখে দিয়েছিলেন সেই চিঠিটা, স্বভাবতই এই প্রশ্ন আসে-কেন, কেন, কেন–এবার মুখ খুলল জোয়ানো কার্লে। এবার জোয়ানো কার্লে বলতে লাগল, সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা সবাইকে জানাবার জন্য চিঠিটা তিনি রেখে দিয়েছিলেন, কারণ যদি তার জীবনে কোনো অঘটন ঘটে এটা আমার ধারণা। তার কথায় সম্মতি জানালো পোয়ারো মাথা নেড়ে। তারপর শান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে সে ভাবল, মেয়েটা অসাধারণ। কেবলমাত্র তাই নয় সেজন্য মিসেস কার্লের থেকে অন্যরকম। তার মানসিকতা পৃথক, পরিচয়ও তার অন্যরকম। আর বিচার বুদ্ধি অনন্য। কিন্তু আবার ভাবল পোয়ারো, অভিনয় করছে না তো মেয়েটি? অনেক সময় চতুর মেয়েদের, ভেতরের রূপ বোঝা যায় না বাইরে থেকে দেখে। আবার জোয়ান কার্লের সম্বন্ধে বিরূপ কিছু ভাবাই যায় না। তাই সে ফিরে গেল মেয়েটির সম্বন্ধে পূর্ব ধারণায় এবং সে বলল :
ম্যাডাম আপনি খুবই বুদ্ধিমতী মহিলা। হ্যাঁ, এটাই একটা কারণ হতে পারে চিঠিটা রেখে যাওয়ার এবং ব্যাখ্যা করলে এটাই দেখা যায়। যেমন মনে করুন, সেই অদ্ভুত স্বপ্নের প্রসঙ্গ উঠবে মিঃ কার্লের মৃত্যুর পর পুলিসী তদন্তের সময়। হয়তো আমিও সে সময় জানাবো এই স্বপ্নের কথা, হয়তো আমার মতো মিসেস কালেও জানাবেন একই কথা। যেহেতু আমরা দুজন মৃত মিঃ বেনেডিক্ট কার্লের মুখ থেকে শুনেছি সেই স্বপ্নের কথা। ঘোড়ার মুখের কথার মতো যেন ব্যাপারটা। তবে অত্যন্ত জরুরী, সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা। যতই ভয়াবহ স্বপ্ন হোক না কেন ম্যাডাম, অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেটা। এবার আমি দ্বিতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে চাই। পোয়ারো বলল–আমি ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম মিঃ কার্লের কাছে তার স্বপ্ন কাহিনি শোনার পর, সে আমি তার ঘরে গিয়ে সেই টেবিল, টেবিল সংলগ্ন ড্রয়ার এবং রিভলবারটা স্বচক্ষে দেখব। প্রথমে তিনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে চেয়ার ছেড়ে যেন উঠে দাঁড়াবার ভঙ্গী করলেন, কিন্তু না, আমার অনুমান ভুল, সেটা তার ইচ্ছা ছিল না। তার মনের কথা হল তিনি তার ঘরে নিয়ে যেতে চান না। স্পষ্টভাবে বোঝা গেল কিছু একটা ভেবে নিয়ে তিনি মত পরিবর্তন করলেন। আমার প্রস্তাবটা তিনি সরাসরি বাতিল করে দিলেন। মানুষটা কি অদ্ভুত। রাজি হয়েও মত পরিবর্তন করলেন। তার এইরকম মানসিক পরিবর্তন কেন? কেন প্রত্যাখ্যান করলেন আমার সেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবটা? অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটা ভেবেছি, তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি। আপনাদের মতামতের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে চাই সেই গবেষণা লব্ধ উত্তরটা। আপনারা কি জানেন, এ সম্বন্ধে কিছু বলতে পারেন। চেষ্টা করে দেখুন না বলতে পারবেন। সবটা না পারলেও একটু কিছু বলুন। তারপর না হয় আমি বলব। হয়তো এসব ক্ষেত্রে আমরা নিজের চেয়ে অন্যদের মতামত বেশি কাজে লাগে। আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণ কি ছিল তার ক্ষেত্রে, সেজন্য আপনাদের বলছি, আপনারা কি কেউ জানেন? প্রত্যেকে প্রত্যেকের মুখের দিকে দেখতে লাগলো, তাদের অভিব্যক্তি এমন ছিল। যেন, তুমিই বলো। আমি শুনব, আমার ধারণাটা তোমার সঙ্গে মিলিয়ে নেব। আর চিৎকার করে বলে উঠব যদি মিলে যায়–ঠিক এই কথাটাই ভেবেছিলাম আমি। যদি না মেলে, সেজন্য চট করে বলার সাহস হচ্ছিল না। যদি রহস্য উদঘাটন না করতে পারি। কিছু মন্তব্য না করাই বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে চিন্তে এটাই ঠিক করলাম। ভুল বর্ণনা থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে মুখ বন্ধ করে থাকলে। পোয়ারো তাদের সম্বন্ধে এইসব চিন্তা করছিল। কেউই অগ্রসর হল না তার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। যেন সবাই পালন করছে এক অদ্ভুত নীরবতা।
যখন আপনাদের কাছ থেকে কোনো উত্তর পেলাম না। অতএব আমি প্রশ্নটা অন্যরকম ভাবে আপনাদের সামনে উপস্থিত করছি। এমন কিছু ছিল কি পাশের ঘরে যার জন্য মিঃ কার্লে রাজি হলেন না আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে? যদি তাই হয় তবে সেটা কী? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল। পূর্ববৎ নীরবতা বিরাজ করছিল ঘরের মধ্যে। কে যেন সবার মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছিল আর চাবি যেন হারিয়ে গেছে। পোয়ারো বলল, নিঃসন্দেহে প্রশ্নটা কঠিনই নয় শুধু, জটিলও বটে। সর্বোপরি এটাই সত্যি যে এমন কোনো কারণ ছিল যার জন্য মিঃ কালে তার সেক্রেটারীর ঘরেই বন্দোবস্ত করেছিলেন, আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। আর নিজের ঘরে নিয়ে যেতে তিনি অস্বীকার করেন যে কোনো কারণেই হোক। তার ঘরে এমন কিছু ছিল, যা আমাকে তিনি দেখাতে চাননি এর থেকেই প্রমাণিত হয়। হয়তো তার কোনো উপায় ছিল না আমাকে দেখাবার এমনটাও হতে পারে।
এরপর একটু নীরবতা পালন করলো পোয়ারো, তারপর সবার মুখের উপর দিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলে উঠল, আমি এবার তৃতীয় ঘটনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করবো এই নাটকের। সেটা ঘটনা হিসাবে বেশ চাঞ্চল্যকর এবং ওই সন্ধ্যায়ই ঘটেছিল। মনে আছে কি সেদিনের কথা, আমি যখন বেরিয়ে আসছিলাম ঘর থেকে মিঃ কার্লের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, হঠাৎ তখন তিনি একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলেন। একটা প্রথা বর্হিভূত কাজ করলেন তিনি অর্থাৎ আমার কাছে ফেরৎ চাইলেন চিঠিটা। আমার অবশ্য আপত্তি ছিল না চিঠিটা ফেরৎ দিতে, তবে এই ভেবে অবাক হয়েছি যে কেউ কাউকে চিঠি দিলে সেটা ফেরৎ দিতে পারা যায়। আর আমি ভুল করে তাকে অন্য একটা চিঠি দিয়ে ফেলি, চিঠিটা ছিল আমার লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের লেখা। আমার ফেরৎ দেওয়ার পর চিঠিটা তিনি চোখ বুলিয়ে দেখলেন, তারপর যত্ন করে পাশের টেবিলে রেখে দিলেন। ফিরে যাচ্ছিলাম আমি, তারপর হঠাৎ আমার মনে পড়ল দরজার কাছে এসে, তবে তার কাছে গিয়ে চিঠিটা আবার পালটে নিয়েছিলাম। তবে সেদিন-এর সাক্ষাৎকারের পর আমি মনে মনে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। একথা অস্বীকার করতে পারব না।
মনে মনে কোন সদুত্তর পাচ্ছিলাম না কতগুলো প্রশ্নের। শেষের ঘটনা তো বিশেষভাবে বিস্ময়কর।
বক্তব্য থামালো পোয়ারো। এবার সকলের মুখের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করলো। কিছুই কি আন্দাজ করতে পারছেন না আপনারা?
উত্তর দিলো এবার প্রথমে ড. স্ট্রীলিং ক্লীট–মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের চিঠির কি ভূমিকা থাকতে পারে এর মধ্যে সেটা আমার বুদ্ধির অগম্য।
পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল, বুঝতে পারছেন না আপনি? উত্তর দিল হুগো কর্নওয়ার্দি, সত্যি তাই আমাদের ব্যাপারটা যেন অদ্ভুত মনে হচ্ছে। এবার মিসেস কার্লে মুখ খুললেন, ওদের দুজনের বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত হচ্ছি।
মিস জোয়ানো কার্লে শুধু ব্যতিক্রম। এবার সে বলল, অবশ্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের ঐ চিঠিটার, মঁসিয়ে পোয়ারো আমিও সেটাই মনে করি। এরকুল পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে সে অনুরোধ জানালো যাতে তিনি সেটা ব্যাখ্যা করে বলেন।
আপনার অনুমান নির্ভুল, ম্যাডাম, তার কথায় সম্মতি জানিয়ে পোয়ারো বলল, এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষের চিঠিটার। এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল পোয়ারোর ওষ্ঠা ধারে। লণ্ড্রী কর্তৃপক্ষ আমার টাই এর রঙ জ্বালিয়ে দিয়ে জীবনে এই একটি বার উপকার করেছিলো। এটাই খুব আশ্চর্যের ঘটনা যে আপনারা এমন একটা সহজ ব্যাপার কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। তিনি একপলকেই বুঝতে পারতেন যে আমি তাকে ভুল চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ভ্রূক্ষেপও করেননি। তবে কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। তাহলে কি তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না তখন? সত্যিই কি তিনি অন্ধ?
হঠাৎ প্রশ্ন করলেন ইনসপেক্টর বার্নেট, কেন, তখন কি চশমা ছিল না তার চোখে?
মাথা নেড়ে হেসে পোয়ারো বলল, তিনি অবশ্য চশমা পরেই ছিলেন। আর ব্যাপারটা আমার কাছে সেজন্যই আশ্চর্য মনে হয়েছিলো। অন্যমনস্ক ভাবে ঝুঁকে পড়লেন তিনি আমাদের দিকে এবং বললেন, মিঃ কালের স্বপ্নের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশী। লক্ষ্য করে দেখুন এই স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবে কত মিল। তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন আত্মহত্যা করছেন বাস্তবেও তাই হলো। তাকে মৃত অবস্থায় একলা ঘরের মধ্যে পাওয়া গেল। একটা রিভলবার পড়েছিল তার মৃতদেহের পাশে ঠিক সেই সময় তার ঘর থেকে কাউকে বেরিয়ে আসতে বা ঢুকতেও দেখা যায়নি, অর্থাৎ যে সময় তিনি মারা গেছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে অতএব এখানে অতি সহজেই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে অবশ্যই ঘটনাট আত্মহত্যা।
ড. স্ট্রীলিং ক্লীট পূর্ণ সমর্থন জানালেন, হ্যাঁ নিশ্চয়ই এটা ধরে নেওয়া যায়।
ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো চারিদিক দেখে নেওয়ার পোয়ারো ভালো করে নিল, তার কণ্ঠে মেঘ মেদুর রহস্যময় ভাব ফুটে উঠল। ঘটনাটা প্রকৃতপক্ষে কি জানেন। এটা একটা খুনের মামলা, আর অপরাধ জগতে এটা একটা অভুতপূর্ব নজির যে এর পশ্চাতে যে অভিনব পরিকল্পনা রয়েছে। পেয়ারো বলল, আসলে সেটাই মনে হয়।
অস্থিরভাবে পোয়ারো টেবিলের ওপর আঙুল দিয়ে টোকা মারছিল। একটা সবুজ আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তাকালে আমাকে হাস, যে তখন সেই
জানেন সেদিন মিঃ কার্লে আমাকে তার ঘরে নিয়ে যেতে চাননি কেন? কে ছিল তখন সেই ঘরে? বলল পোয়ারো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে তখন সেই ঘরে স্বয়ং বেনেডিক্ট কালেই ছিলেন। রুদ্ধশ্বাসে যেন সবাই তার কথাগুলো শুনছিলো। সামান্য হাসলো পোয়ারো তাদের বিস্মিত চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে। বলল, অবশ্যই আমার সঠিক উত্তর মিলছে ওই চিঠিটার জন্যেই। আমি হয়ত পাগলের মত প্রলাপ বকছি, এর পরেও আপনারা হয়ত সেটাই ভাবছেন। না, আমি সুস্থ মস্তিষ্কেই এই সিদ্ধান্তে এসেছি। আচ্ছা এবার তাহলে পরিষ্কার করেই বলি। আমি কথা বলেছিলাম মিঃ কার্লের সঙ্গে। কেন তিনি এই চিঠি দুটোর পার্থক্য করতে পারেন নি। জানেন কি আপনারা তার কারণ? কারণ তিনি ছিলেন একজন স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ।
চমকে উঠলেন ড. স্ট্রীলিং ক্লীট, স্বাভাবিক দৃষ্টি মানে, তিনি বললেন, ছেলেবেলা থেকেই ওর দৃষ্টি মানে, তিনি বললেন, ছেলেবেলা থেকেই ওর দৃষ্টি শক্তি খারাপ ছিলো, এটাই আমি জানি–তা সত্ত্বেও আপনি বলছেন যে
পরে সে প্রসঙ্গে আসছি পোয়ারো বলল, তখন উনি সত্যিই চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিলেন না। কারণ তার চোখে সে সময় শক্তিশালী লেন্সের চশমা ছিলো। ডা. স্ট্রীলিং ক্লীট, আমি কি ঠিক বলছি যে, ওই লেন্সের চশমা পরলে স্বভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন লোকও কার্যতঃ অন্ধ হয়ে যায়?
অস্ফুট স্বরে বলতে লাগল স্ট্রীলিং ক্লীট, হাঁ এটা খুব সত্যি কথা। অবশ্যই তা হতে পারে–পোয়ারো তার কথায় যোগ টেনে বলতে থাকে। মিঃ বেনেডিক্ট কার্লের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই আমার জানি না কেন মনে হয়েছিল। আমি একজন অন্তসারশূন্য ব্যক্তির সামনে উপস্থিতি হয়েছি। আর কোনো অভিনেতা যেন তার নির্দিষ্ট ভূমিকাটুকু অভিনয় করে চলেছে। ভেবে দেখুন একবার পারিপার্শ্বিক পরিবেশটার কথা। ঘরটা সামান্য আলো যুক্ত ছায়াময়। সবুজ ঘেরাটোপা দেওয়া একটা জোরালো আলো জ্বলছে ঘরের মাঝখানে। আর একজন দীর্ঘকায় মানুষ বসে আছেন আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে আলোর ঠিক পেছনেই। তার নাসিকা খড়গ এর মতো উন্নত, পরনে ঢিলেঢালা ড্রেসিং গাউন–অবশ্য এখন বোঝ যাচ্ছে নামটা তার নকল ছিলো। ধবধবে সাদা মাথা ভর্তি চুল। আর এক জোড়া চোখ লুকিয়ে চশমার পুরু লেন্সের আড়ালে।
অবশ্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ আছে কি। ডঃ বেনেডিক্ট কার্লে তার যে দুঃস্বপ্নের কথা নিজের মুখে আমার কাছে বলেছিলেন। মিসেস কার্লের উক্তি আর মিঃ কার্লের ব্যক্ত করা সেই অদ্ভুত স্বপ্নের কথা। এই দুটিই মাত্র প্রমাণ।
ইনসপেক্টর বার্নেট তার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল, মঁসিয়ে পোয়ারো, এর অন্তর্নিহিত কি মানে আপনি বলতে চাইছেন?
পোয়ারো কাধ ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, ষড়যন্ত্রটা এঁটেছিল দুজন মাত্র ব্যক্তি। তাদের দুজনের মধ্যে একজন হলেন মিসেস কার্লে আর অপরজন মিঃ হুগো কর্নওয়ার্দি। বেনেডিক্ট কার্লের জবানীতে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এই কর্নওয়াদি, আর আমার সঙ্গে কিরূপ আচরণ করতে হবে তিনিই সেটা নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি সিনেমা দেখতে চলে যান আমি এখানে এসে হাজির হবার আগেই। তবে প্রকৃত পক্ষে তিনি সিনেমা দেখতে যাননি। তিনি বাড়ী থেকে বের হবার পর আবার পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকে এসেছিলেন। তার কাছে কাছে সবসময়ই থাকত সেই দরজার একটা চাবি। নিজের ঘরেই তিনি বসে রইলেন সবার অলক্ষ্যে ফিরে এসে আর তিনি তখন বেনেডিক্ট কার্ডের ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন; আর আমরা সকলে আজ বিকেলে এখানে মিলিত হতে পেরেছি। কারণ হল এটাই।
দীর্ঘদিন ধরে যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। মিঃ কর্নওয়ার্দি, তিনি অবশেষে সেটা পেলেন।
আপনি কি বোঝাতে চাইছেন সুবর্ণ সুযোগের মানেটা কি? ইনসপেক্টর বার্নেট পোয়ারোকে বাধা দিয়ে প্রশ্ন করল। ব্যাপারটা হলো, দরজার বাইরে দুজন খবরের কাগজের প্রতিনিধি বসে থাকলে তারা যদি সাক্ষ্য দেয় নির্দ্বিধায় যে তারা কাউকে ঘরের ভেতরে ঢুকতে দেখনি। তার ওপর অবিরাম যানবাহন চলাচলের রাস্তাঘাট বিকেলের দিকে সবসময় কোলাহল মুখরিত থাকে। কর্নওয়ার্দি এই সুযোগে একটা লম্বা লোহার চিমটের ডগায় একটা বস্তু নিয়ে এসে তার ঘরের জানালার সামনে নাড়াতে থাকেন আড়াল থেকে। মিঃ কালে তখন ব্যাপারটা কি দেখবার জন্য জানালার সামনে এসে মুখ বাড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করেন ঠিক সেই মুহূর্তে কর্নওয়াদি তার কপাল লক্ষ্য করে গুলি চালান।
এবার আবার প্রশ্ন করল ইনসপেক্টর, কিন্তু কেন কেউ দেখতে পেল না মিঃ কর্নওয়াদি যখন গুলি চালাচ্ছেন? হয়তো তার সৌভাগ্যের ব্যাপার এটা যখন তিনি গুলি চালালেন তখন কেউ দেখতে পায়নি বলল পোয়ারো।
সেটা কি করে সম্ভব হলো? বানেট জানতে চাইলেন। একটা উঁচু নিরেট দেওয়াল ছিল মিঃ কার্লের ঘরের জানালার সামনে তার ফলেই তার এই অপকর্মের কোনো সাক্ষী রইলো না। স্টীলিং ক্লীট দুচোখে কৌতূহল মাখিয়ে প্রশ্ন করল, তারপর? মিঃ কর্নওয়াদি তারপর তার নিজের ঘরে বসে কুড়ি পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করেন। এরপর সেই লোহার চিমটেটা আর রিভলবারটা একতাড়া চিঠি আর ফাইলপত্রের আড়ালে লুকিয়ে বেশ সতর্কভাবে মিঃ কার্লের ঘরে প্রবেশ করেন তিনি খবরের কাগজের দুই প্রতিনিধির সামনে দিয়ে। পোয়ারো এইভাবে ব্যাপারটার ব্যাখা দিল। প্রথমেই তিনি একটা কাজ করলেন ঘরে ঢুকে। রিভলবারের উপরে মিঃ কার্লের আঙুলের ছাপ লাগিয়ে সেটা তার মৃতদেহের পাশে ফেলে রাখলো সে। যথাস্থানে লোহার চিমটেটাও রেখে দিলেন। তারপর ঘর ছেড়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলেন এবং চোখে মুখে নকল উদ্বেগ ফুটিয়ে তিনি সবাইকে জানিয়ে দিলেন মিঃ কার্লের আত্মহত্যার খবরটা।
এমন ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন যাতে করে পুলিশ মিঃ কার্লের ঘরে ঢোকা মাত্রই আমার চিঠিটা, যেটা আমার উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল, যাতে পুলিশের সেটা নজরে আসে। ফলে আমার এখানে ডাক পড়বে অনিবার্যভাবে। আর আমি যখন এখানে আসার পর আমার অনুরোধ মিঃ কালে তার স্বপ্নের অদ্ভুত যে বিবরণ শুনিয়েছিলেন সেটা সকলের কাছে খুলে বললো, তখন তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতার কথাও খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে।
তবে–বলে থামলো পোয়ারো।
ইনসপেক্টর বার্নেট জানতে চাইল মিঃ পোয়ারো এই তবে–টার মানে?
চকিতের মধ্যে মিসেস কার্লের মুখের ওপর পোয়রোর দৃষ্টি নিবন্ধ হলো। ধূসর পার ছায়া এখন মহিলার মুখাবয়বে। গভীর একরাশ ভয় ও হতাশা তার সেই দুচোখে।
এরকুল পোয়ারো তার বক্তব্য শেষ করতে গিয়ে একটু থেমে বলল, এবং পরিবেশে এরপর এক অন্তবিহীন সুখের পরিণতি লাভ করা যাবে। কারণ মিঃ কার্লে তার যাবতীয় অর্থ সম্পত্তি আর অর্থ তার একমাত্র মেয়ের নামে উইল করে গেলেও, কর মুক্ত আড়াই লক্ষ পাউন্ড দিয়ে গিয়েছিলেন তার স্ত্রীর নামে। দুজনেই বেশ সুখেই দিন কেটে যেত সেই টাকায়? এরকুল পোয়ারো ড. জন স্টীলিং ক্লীটকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এলেন নর্থওয়ে হাউস ছেড়ে। আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের ডানদিকে কারখানার বিরাট উঁচু পাঁচিল। লম্বা সরু একটা প্যাসেজ পাঁচিলের পাশ দিয়ে সোজা চলে গেছে। তারা এগিয়ে চলল দুজনে সেই রাস্তা ধরে। এরকুল পোয়ারো থেমে পড়ল মিঃ বেনেডিক্ট কালের ঘরের জানালার ঠিক নীচেই। সেখানে তার নজরে পড়ল কালো রঙ এর একটা বস্তু। পোয়ারো নীচু হয়ে সেটা কুড়িয়ে নিল। সেটা ছিল, একটা খেলনা বিড়াল, কালো কাপড় দিয়ে মোড়া।
পোয়ারো বলল, হায় ঈশ্বর, কর্নওয়ার্দি লম্বা চিমটে দিয়ে ধরে এই জিনিসটা মিঃ কার্লের জানালার সামনে নিয়ে এসে নাড়াচাড়া করছিল। অবশ্যই কর্নওয়ার্দি সে কথা জানত যে মিঃ কার্লে একেবারে বিড়ালদের সহ্য করতে পারেন না। আর জানালার ধারে ছুটে এসেছিলেন তিনি খেলনা বিড়ালটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে?
কর্নওয়ার্দি ওদিকে ফাঁদ পেতে বসেছিল। সেটা দেখার জন্য জানালার বাইরে দিয়ে মুখ বাড়ানো মাত্র সে রিভলবারের ট্রিগার টিপে দেয় তার কপাল লক্ষ্য করে। আর তারপরের ঘটনা তো আপনি জানেন অবশ্যই।
আচ্ছা তার কাজ শেষ করে তো মিঃ কর্নওয়ার্দি এই খেলনা বেড়ালটা এখান থেকে সরিয়ে ফেলতে পারত? তারপক্ষে সে কাজ করা সম্ভব ছিল না। কারণ এই ব্যাপারটা যদি দুর্ভাগ্য ক্রমে কারো চোখে পড়ে যেত তাহলে সন্দেহটা গিয়ে তার উপরেই পড়ত। আর লোকে ভাববে কোনো বাচ্চা ছেলেই হয়ত এটা এখানে ফেলে গেছে, যদি কারও নজরে আসত এখানে এই বিড়াল পড়ে আছে। কেউ মাথা ঘামাত না এটার বিষয়ে যে কোনো গুরুত্ব আছে। তা অবশ্য ঠিক স্টীলিং ক্লীট বলল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেরকম সন্দেহ করাই স্বাভাবিক সাধারণ লোকের পক্ষে। তবে এরকুল পোয়ারোর চোখে ধূলো দেওয়া অত সহজ নয় এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি কি ভেবেছিলাম জানেন আপনার বক্তৃতার শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত? আপনি হয়তো মনস্তাত্ত্বিক একটা ব্যাখ্যা দিতে যাচ্ছেন কোনো গালভরা শব্দের মালা সাজিয়ে, আড়াল থেকে কিভাবে অপরের মনে আত্মহত্যার প্ররোচনা কাজে লাগানো যায়? আপনি হয়তো তারই সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ হাজির করবেন। ওই দুজন ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিক এই রকমই একটা চিন্তা করে থাকবে, আমি বাজি রেখে এটাও বলতে পারি। এটাই মনে হচ্ছে যে তিনি অতি সহজেই ভেঙে পড়েছেন, মিসেস কার্লের আচার আচরণ দেখে। প্লাস পয়েন্ট এটা। না হলে স্বীকারোক্তি আদায় করা সম্ভব হতো না, কর্নওয়ার্দির মতো অসৎ লোকের কাছ থেকে। ভদ্রমহিলা যে ভাবে হাত উঁচু করে আপনার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, আমি তো নিজের চোখে দেখলাম। আপনার চোখ দুটো চিরদিনের মতো নষ্ট হয়ে যেত, যদি পেছন থেকে না আপনাকে জাপটে ধরতাম।
সে আবার এক মিনিটের জন্য থেমে বলল। মিস কার্লে ওদের মধ্যে ব্যতিক্রম আমার মনে হয়। আমি পছন্দ করি মেয়েটিকে। মঁসিয়ে পোয়ারো বুঝলেন, মেয়েটি দারুণ বুদ্ধিমতী। লোকে হয়ত মনে করবে আমি ভাগ্য ফেরানোর মতলব করছি আমি যদি ওর সঙ্গে মাখামাখি করার চেষ্টা করি।
বন্ধু আপনার বেশ দেরী হয়ে গেছে। কারণ ইতিমধ্যেই ওর হৃদয়ের শূন্য সিংহাসনটা দখল করে বসে আছে এক যুবক। এ খবর আমি জেনেছি। তাদের মিলনে আর কোনো বাধা নেই মিঃ কার্লের মৃত্যুর পর। আরও একটা অনুপ্রেরণা থাকতে পারত এটা ঠিক কথা। বলল স্টীলিং ক্লীট। পোয়ারো বলল, প্রেরণা আর সুযোগই শেষ কথা নয়। তার পশ্চাতে সক্রিয় থাকা চাই অপরাধী সুলভ মনোভাব।
মঁসিয়ে পোয়ারো আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন। বলল স্ট্রীলিং ক্লীট, আমি বাজী ধরে বলতে পারি, আপনি যদি নিজে হাতে এখনও কাউকে খুন করেন সেইক্ষেত্রে তার প্রমাণ খুঁজে বার করা কখনও কারো পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য আপনার পক্ষে এটা খুব সহজ ব্যাপার সেটা নিশ্চয়ই খেলোয়াড়ী মনোভাবের বিরুদ্ধ হবে।
এটা ইংরেজদের একটা বিচিত্র ধারণা উত্তরে জানানো পোয়ারো।