ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
এটা কবুল করতেই হয় যে আমার সমস্ত সচেতন চেষ্টা সত্ত্বেও পরের দু-দিনে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের নাম বারেবারে আমার মনের মধ্যে হানা দিয়েছে। তাহলে এই রাগৎস এই সে সাধারণত থাকে, আর এটাও আমি তারপরেই জেনে গিয়েছি যে তার সঙ্গে থাকে একজনই মাত্র ভৃত্য, হেরমান, সেও তার প্রভুর মতোই রূঢ়, ভ্রূকুটিপরায়ণ, এবং প্রভুর মতোই সে সারাক্ষণ তার মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। আমার কেবলই থেকে থেকে এটাও মনে হচ্ছিলো যে, সেদিন যে-লোকটা আমাদের পিছু নিয়েছিলো বলে আমার ধারণা হয়েছিলো, যাকে আমি ভেবেছিলুম চোখের ভুল অথবা মতিভ্রম বলে, তার চলাফেরার ভঙ্গির সঙ্গে এই হেরমানের চলাফেরার ভঙ্গির কোনোই তফাৎ নেই।
বুলভার তেকেলিতে আমি আর কাপ্তেন হারালান আচমকা কার মুখোমুখি গিয়ে পড়েছিলুম, তা মার্কের কাছে বলে দিয়ে কোনো লাভ হবে না বলেই আমি ভেবেছিলুম। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যে রাগৎস-এ ফিরে এসেছে এটা শুনলে মার্ক হয়তো বেশ বিচলিত হয়েই পড়বে। শঙ্কার ছায়া ফেলে খামকা বেচারার মনখারাপ করে দিয়ে কী লাভ? আমি নিজে অবশ্য মনে-মনে একটু ঘাবড়েই গিয়েছি–মার্ক আর মাইরার বিয়ের আগেই মার্কের প্রতিদ্বন্দ্বীর এই আবির্ভাব কোনো গণ্ডগোলের সূত্রপাত নয় তো?
ষোলো তারিখ সকালবেলায় আমি যখন হাঁটতে বেরুবো বলে তৈরি হচ্ছি, এমন সময়ে হঠাৎ কাপ্তেন হারালান এসে হাজির। একটু অবাকই হয়ে গেছি আমি তাকে দেখে, কেননা এটা স্থির হয়েছিলো সেদিন আর হারালানের সঙ্গে আমার দেখা হবে না, কেননা তার নাকি সামরিক বাহিনীতে কী-একটা জরুরি কাজ আছে।
আরে! তুমি! আমি বিস্মিতভাবে বলে উঠেছি, হঠাৎ যে! তা, ভালোই হলো?
আমার হয়তো দেখারই ভুল হয়ে থাকবে, কিন্তু তার মুখচোখ দেখে মনে হচ্ছিলো সে যেন কোনো কারণে ভারি উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। সে শুধু বললে, মঁসিয় ভিদাল, বাবা আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। তিনি বাড়িতে আপনারই জন্যে অপেক্ষা করছেন।
চলো, তোমার সঙ্গেই যাই, আমি উত্তর করেছি; খুবই আশ্চর্য বোধ করেছি আমি, একটু যেন অস্বস্তিও–যদিও এর কোনো স্পষ্ট কারণ ছিলো না। আবার কী নতুন উৎপাত হলো যে ডাক্তার রডারিখ এই সাতসকালে আমাকে তলব করে পাঠিয়েছেন? মার্কের বিয়ে সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারেই কি? কোনো কথা না-বলেই দুজনে আমরা তারপর হেঁটে গিয়েছি রডারিখ-ভবনে।
ডাক্তার একাই বসেছিলেন তার পড়ার ঘরের টেবিলে। মুখ তুলে তাকাতেই মনে হলো ছেলের চেয়েও বেশি যেন ঘাবড়ে গিয়েছেন তিনি।
নিশ্চয়ই কিছু-একটা হয়েছে, আমি মনে-মনে ভেবেছি, আর ছোটোহাজরির টেবিলে সকালে যখন মার্কের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তখন সে এর বিন্দুবিসর্গও কিছু জানতো না।
আমি ডাক্তার রডারিখের মুখোমুখি একটা আরাম কেদারায় বসে পড়েছি, কাপ্তেন হারালান ম্যান্টলপীসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর আমি একটু শঙ্কিতভাবেই ডাক্তার কী কথা পাড়েন, তার জন্যে চুপচাপ অপেক্ষা করেছি। আপনি যে সব কাজ ফেলে এক্ষুনি দেখা করতে এসেছেন, সেইজন্যে, ডাক্তার রডারিখ বলেছেন, সেইজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।
আমি উত্তর দিয়েছি, আমি সবসময়েই আপনার কাজ করতে প্রস্তুত, ডাক্তার রডারিখ।
আমি হারালানের উপস্থিতিতেই আপনার সঙ্গে একটা বিষয়ে আলোচনা করতে চাই।
বিয়ের ব্যাপারে কিছু?
হ্যাঁ, বিয়ের ব্যাপারেই।
তার মানে আপনি যে-কথা বলতে চাচ্ছেন তা নিশ্চয়ই খুবই সিরিয়াস-কিছু?
হ্যাঁও বটে, আবার নাও বটে, ডাক্তার একটু ইতস্তত করেছেন, তবে এ-ব্যাপারটা কিন্তু আমার স্ত্রী-কন্যা অথবা আপনার ভাই–কেউই কিছু জানেন না। আপনাকে যা বলতে যাচ্ছি, তা এঁদের কানে উঠুক, এটা আমি ঠিক চাই না। সবকিছু শুনলেই আপনি বুঝতে পারবেন আমার এ-সিদ্ধান্ত ঠিক কি না।
প্রায় যেন আঁতের মধ্যেই আমি ততক্ষণে টের পেয়ে গেছি বুলভার তেকেলির হানাবাড়ির সামনে সেদিন যার সঙ্গে আমার আর হারালানের দেখা হয়েছিলো, সে-ই কোনোভাবে এই প্রহেলিকাটির মূলে।
গতকাল, অপরাহ্,ে ডাক্তার রডারিখ ততক্ষণে প্রসঙ্গটি পেড়েছেন, মাদাম রডারিখ আর মাইরা যখন বাড়ি ছিলো না, আর আমার রুগি দেখার সময় এগিয়ে এসেছে, হঠাৎ আমার পরিচারক এসে জানালে যে এমন-একজন ব্যক্তি আমার দর্শনপ্রার্থী, যার সঙ্গে আমার ঠিক দেখা করার ইচ্ছে ছিলো না। সেই দর্শনপ্রার্থীই হলো ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, কিন্তু আপনি হয়তো এই জার্মানটার কথা কিছু শোনেননি…
আমি তার সম্বন্ধে জানি, আমি বাধা দিয়ে জানিয়েছি।
তাহলে এও নিশ্চয়ই আপনি জানেন যে প্রায় মাস ছয়েক আগে, আপনার ভাই মাইরার পাণিপ্রার্থনা করার অনেক আগে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এসে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। আমার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে কথা বলে–তার সম্বন্ধে তাদেরও একই রকম বিতৃষ্ণা ছিলো–আমি ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে জানিয়ে দিয়েছিলুম যে আমি তার প্রস্তাবে সম্মত হতে অপারগ। এই প্রত্যাখ্যানটা মেনে না-নিয়ে সে সরাসরি সরকারিভাবে বিয়ের প্রস্তাব করে পাঠায়–আমিও সরাসরি এমনভাবে তাকে আমাদের অসম্মতি জানিয়ে দিই যে তার যে এ-ব্যাপারে কোনোই আশা নেই, সেটা বুঝতে পারার কোনো অসুবিধে তার ছিলো না।
ডাক্তার রডারিখ যখন পুরো ব্যাপারটা বিশদ করে আমায় জানাচ্ছিলেন, কাপ্তেন হারালান তখন কেমন অস্থিরভাবে সারা ঘরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলো। বেশ কয়েকবারই একটা জানলার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বুলভার তেকেলির দিকে তাকাচ্ছিলো।
ডাক্তার রডারিখ, আমি ততক্ষণে তাকে জানিয়েছি, এই প্রস্তাবের কথা আগেই আমার কানে এসেছে। আমি এও জানি যে আমার ভাই বিয়ের প্রস্তাব করার আগেই
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তার প্রস্তাব করেছিলো।
হ্যাঁ, প্রায় তিন মাস আগে।
কাজেই, আমি বলেছি, এ তো আর এমন নয় যে মার্কের সঙ্গে আগেই বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিলো বলে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে উপেক্ষা করা হয়েছে, বরং তাতে এটাই বোঝা যায় যে তার সঙ্গে বিয়ে দিতে আপনাদের আদপেই ইচ্ছে করেনি
তা তো করেইনি! আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ডাক্তার রডারিখ বলেছেন, এ-রকম কোনো বিবাহসম্বন্ধে আমরা কিছুতেই সম্মতি দিতুম না–তাছাড়া মাইরা নিজেও সে-বিয়েতে বেঁকে বসেছিলো, সে নিজেই এ-বিয়েতে রাজি হয়নি।
সে কি ভিলহেল্ম স্টোরিৎসের সামাজিক পদমর্যাদার জন্যে? না কি আরো-কোনো ব্যক্তিগত আপত্তি ছিলো?
তার সামাজিক পদমর্যাদা হয়তো অনেকের চাইতেই বেশ ওপরে, ডাক্তার রডারিখ আমায় বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, এটা ধরেই নেয়া যায় যে তার বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক পিতৃদেব তার জন্যে অতুল বৈভব রেখে গিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তি হিশেবে সে নিজেই
আমি তাকে জানি, ডাক্তার রডারিখ।
আপনি ওকে চেনেন?
আমি তখন খুলে বলেছি কী করে আমার সঙ্গে ডরোথিতে তার দেখা হয়েছিলো, যদিও তখন আমি ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি সে আসলে কোন মহাশয়। কারণ সেই জার্মান তো মাত্র তিন-চারদিনই আমার সহযাত্রী ছিলো, আর আমি যখন রাগস পৌঁছেছি সে তখন বজরায় ছিলো না–সেইজন্যেই আমি ধরে নিয়েছিলুম যে সে ভুকোভারে নেমে গিয়েছে।
সেদিন, আমি আরো বলেছি, আমি আর কাপ্তেন হারালান তার বাড়ির পাশ দিয়ে যখন হেঁটে যাচ্ছিলুম, শুধু তখনই তাকে ঐ বাড়ি থেকে বেরুতে দেখে আমি বুঝতে পারি যে আমার সেই সহযাত্রীটিই আসলে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস।
অথচ তবু কি না লোকের মুখে শুনেছি সে কয়েক সপ্তাহ আগেই রাগৎস ছেড়ে চলে গিয়েছে, বলেছেন ডাক্তার রডারিখ।
লোকে তা-ই ভেবেছে। আর সে-যে অন্তত কিছুদিনের জন্যে শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলো তার আরো প্রমাণ হলো যে মঁসিয় ভিদাল তাকে বুডাপেন্ট-এ দেখেছেন, এবার কাপ্তেন হারলান তার মত ব্যক্ত করেছে, তবে সে-যে আবার রাগৎস-এ ফিরে এসেছে, তাতে আর-কোনো সন্দেহই নেই।
ডাক্তার রডারিখ আবার নিজের কথার খেই তুলে নিয়েছেন, তার সামাজিক পদমর্যাদা সম্বন্ধে আমার কী ধারণা, তা তো আমি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি, মঁসিয় ভিদাল। আর তার জীবনযাপনের ধরন–তার বাঁচনরীতি-সেটা যে কী, তা কেই-বা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে যে সে তা জানে? সেটা পুরোপরি কুহেলিঢাকা, প্রহেলিকায় ভরা। লোকটা যেন মনুষ্যসমাজের বাইরেই তার সময় কাটায়।
এটা কি আপনি একটু বাড়িয়ে বলছেন না? আমি আপত্তি জানিয়েছি।
আমি জানি যে এতে একটু হয়তো অতিশয়োক্তি আছে, কিন্তু তবু এটা তো ঠিক যে তার উদ্ভব হয়েছে কোনো সন্দেহজনক বংশে। তার আগে তার বাবা অটো। স্টোরিৎসও বিস্তর উদ্ভট কিংবদন্তির বিষয় হয়েছিলেন।
সেই কিংবদন্তিগুলো তার মৃত্যুর পরও যে বেঁচে আছে তার প্রমাণ তার সম্বন্ধে আমি ভারি অদ্ভুত সমস্ত কথা বুড়াপেশটের একটা খবরকাগজে পড়েছি। উপলক্ষ ছিলো তার মৃত্যুবার্ষিকী, যেটা প্রতি বছরই প্রেমবার্গে ধুমধাম করে উদযাপিত হয়–প্রেমবার্গে ঠিক নয়, উদযাপিত হয় তার কবরখানায়। সেই খবরকাগজটাকে যদি সাক্ষী মানতে হয় তবে বলতেই হয় যে কুসংস্কারে-ভরা যে-সব কিংবদন্তির কথা আপনি বললেন, সময় তাতে একটা আঁচড়ও কাটতে পারেনি। মৃত বৈজ্ঞানিক এখনও নিজের সম্বন্ধে যাবতীয় উপকথাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। লোকের মতে, তিনি না কি ছিলেন মায়াবিদ্যায় সুপণ্ডিত এক ঐন্দ্রজালিক, যিনি পরলোকের সব রহস্য জানেন এবং এখনও যাবতীয় অতিপ্রাকৃত শক্তির চর্চা করে থাকেন। পড়ে মনে হলো, লোক আশা করে প্রতি বছরই তার বার্ষিকীর দিনে তার গোরস্থানে অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত কিছু ঘটবে।
তাহলে, মঁসিয় ভিদাল, ডাক্তার রডারিখ আলোচনায় ইতি টেনেছেন তারপর, প্রেমবার্গে লোকে কী বিশ্বাস করে এটা জানবার পর আপনার নিশ্চয়ই এটা জেনে বিস্ময় জাগবে না, রাগৎস-এ লোকে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে কী অদ্ভুত চোখে দ্যাখে। … আর সেই লোকই এসে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো। শুধু তা-ই নয়, তার ধৃষ্টতা এমনই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে, গতকাল এসেও সে আবার বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে।
গতকাল! আমি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠেছি।
হ্যাঁ, গতকাল, যখন কাল বিকেলে সে এখানে এসেছিলো।
আর, কাপ্তেন হারালান তখন ঘোষণা করেছে, আর-কিছু যদি সত্যি নাও হয়, সে-যে প্রশিয়ান এটা তো ঠিক। আর তার প্রস্তাব উপেক্ষা করার পেছনে সেটাই যথেষ্ট কারণ।
ঐতিহ্য এবং পরম্পরা মাগিয়ারদের রক্তে জার্মানদের সম্বন্ধে যে-ঘৃণা যে জাতিবৈরিতা বুনে দিয়েছে, কাপ্তেন হারালানের এই ঘোষণায় সেটাই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
কী হয়েছিলো, বলছি, শুনুন। ডাক্তার রডারিখ বিশদ করে বলেছেন। আপনার ব্যাপারটা পুরোপুরি জানাই ভালো। আমাকে যখন এসে বললে যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এসেছে, আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়, আমি একটু দোনোমনা করেছিলুম… তাকে কি ভেতরে আসতে বলবো, নাকি সরাসরি বলে দেবে যে তার সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়?
হয়তো সেই কথাই জানিয়ে দেয়াই ভালো হতো, বাবা,কাপ্তেন হারালান মাঝখানে পড়ে মন্তব্য করেছে, কারণ প্রথমবারে তার বিয়ের প্রস্তাব উপেক্ষা করার পর লোকটার বোঝা উচিত ছিলো, কোনো অছিলাতেই তার আর এ-বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা দেয়া উচিত নয়।
হ্যাঁ, সে হয়তো ঠিক, ডাক্তার রডারিখ বলেছেন, তবে আমার আবার এ-রকম কাঠখোট্টাভাবে কিছু বলে দিতে ভয় করে–তা থেকে না আবার কোনো কেলেঙ্কারির সৃষ্টি হয়।
তাহলে আমি তার একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতুম, বাবা!
আর শুধু তোকে আমি জানি বলেই, ডাক্তার রডারিখ তার ছেলের হাত চেপে ধরেছেন, ঠিক সেইজন্যেই আমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে, কোনো গোলমাল যাতে না-হয়, তার চেষ্টা করেছি… যা-ই হোক না কেন, আমি তোকে তোর মা, বোন বা আমার কথা মনে রাখতে আরজি জানাচ্ছি–যদি কোনো প্রকাশ্য কেলেঙ্কারির মধ্যে মাইরার নাম একবার উঠে পড়ে তাহলে সেটা তার পক্ষে ভারি বেদনাদায়ক হবে। এই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যদি কোনো গোল পাকায়, তবে দ্বন্দ্বযুদ্ধ-টুদ্ধ তার কোনো উত্তর। হবে না।
কাপ্তেন হারালানকে আমি তো সবে গত কয়েকদিন ধরে দেখেছি, তাতেই আমার মনে হচ্ছিলো যতই ভদ্র বা শীলিত হোক না কেন, তার মাথায় বড় চট করেই রক্ত চড়ে যায়, নিজের বংশমর্যাদা সম্বন্ধে সে অত্যন্ত সচেতন, বংশের সুনামে একটা ছোট্ট আঁচড় পড়লেও সে তা আদপেই সহ্য করবে না। আর সেইজন্যেই আমার মনে হলো মার্কের এই প্রণয়-প্রতিদ্বন্দ্বীর পুনরাবির্ভাব এবং পুনরায় বিবাহপ্রস্তাব পাঠানো কেন যেন একটা শোচনীয় সর্বনাশের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ডাক্তার রডারিখ তখন সেদিনকার মোলাকাটার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন–যাবতীয় খুঁটিনাটি সমেত। আমরা যে-ঘরটায় বসে আলোচনা করছি, সেই ঘরটাতেই ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে অভ্যর্থনা করা হয়েছিলো। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস গোড়ায় এমন সুরে কথা বলেছে, যাতে বোঝা যাচ্ছিলো সে একেবারে নাছোড়বান্দা লোক, একটা-কিছু তার মাথায় এলে সে তাতে আঠার মতো লেগে থাকতে পারে। তার বক্তব্য ছিলো, সে-যে ডাক্তার রডারিখের দর্শনপ্রার্থী হয়ে এসেছে এতে অবাক হবার কিছু নেই, রাগৎস-এ ফিরেই সে সবিনয়ে আবার-একবার সনির্বন্ধ অনুরোধ করে দেখবে বলে সে আগেই ঠিক করে রেখেছিলো।
মিথ্যেই তখন ডাক্তার রডারিখ ভদ্রভাবে তার প্রস্তাবটি আবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যুদ্ধে বা প্রণয়ে হারবার পাত্র নয়, তার গলার স্বর ক্রমশ চড়েছে, শোভনতার সীমা ছাড়িয়ে গেছে, সে চেঁচিয়ে বলেছে মাদমোয়াজেল মাইরার সঙ্গে মার্ক ভিদালের যে-বাগদান হয়েছে সেটা এক্ষুনি নাকচ করে দিতে হবে, তার দাবিটাই সর্বাগ্রে বিবেচ্য, সে এই তরুণীর প্রণয়াসক্ত, এবং এই তরুণী যদি শেষ পর্যন্ত তার না-হয়। তবে সে যাতে আর-কারু না-হয় সেই ব্যবস্থা সে করবে।
কী ঔদ্ধত্য!… কী আম্পর্ধা! চেঁচিয়ে উঠেছে কাপ্তেন হারালান, এমন কথা বলবার দুঃসাহস তার হয় কী করে! আমি যদি তখন এখানে থাকতুম তবে তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দিতুম!
ঠিক জানি, আমি মনে-মনে ভেবেছি, এরা দুজনে যদি কখনও পরস্পরের মুখোমুখি হয় তবে ডাক্তার রডারিখ যে-ভয় পাচ্ছেন তা-ই হবে–একটা রক্তারক্তি কাণ্ড এড়ানো মুশকিল হবে–সংঘর্ষ একটা অনিবার্য।
শেষে যখন সে চেঁচিয়ে এই হুমকিটা দিয়েছে, ডাক্তার রডারিখ বলেছেন, আমি তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে ইঙ্গিত করেছি আমি তার এ-রকম কথা শুনতে আদৌ প্রস্তুত। নই। বিয়ের সব কথা ঠিক হয়েছে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠানটা পাকাপাকিভাবে ঘটে যাবে।
কয়েকদিন কেন, কোনোদিনই আর ঐ অনুষ্ঠান হবে না, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস হুমকি দিয়েছে।
মহাশয়, আমি তখন তাকে দরজাটা দেখিয়ে বলেছি, অনুগ্রহ করে বিদেয় হোন! অন্য যে-কেউ হলে বুঝতে পারতো তার পক্ষে এই আলোচনা প্রলম্বিত করা মোটেই উচিত নয়।
কিন্তু ভিলহেল্ম স্টোরিৎস অন্য ধাতে গড়া, সে বসেই থেকেছে, আবার নামিয়ে এনেছে গলার স্বর, ভয় দেখিয়ে যা আদায় করতে পারেনি তা সে এবার বিনয় দেখিয়ে বশে আনতে চেয়েছে–অন্তত এই কথাটা আদায় করতে চেয়েছে যে মাইরা ও মার্কের বিয়ের প্রস্তাবটা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। আর-কোনো উপায় না-দেখে দরজার কাছে গিয়ে আমি ঘণ্টা বাজিয়েছি ভৃত্যদের জন্য। সে অমনি আমার হাতটা চেপে ধরেছে, আবার তার ঐ বদরাগ ফিরে এসেছে শতগুণে-আরক্ত চোখে, ধমকের সুরে, চীৎকারে –এতটাই সে চাঁচাচ্ছিলো যে মনে হচ্ছিলো বাইরে থেকেও তা শোনা যাচ্ছে। ভাগ্যিশ আমার স্ত্রী বা কন্যা কেউই তখন বাড়ি ছিলেন না।
অবশেষে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-অগত্যা–যেতে রাজি হলো, কিন্তু যাবার আগে ভয়ংকর-সব হুঁশিয়ারি দিয়ে গেলো। মাইরা যেন কিছুতেই মার্ককে বিয়ে না-করে। এমন সমস্ত বাধাবিপত্তির উদ্ভব হবে যে অনুষ্ঠানটাই অসম্ভব হয়ে উঠবে। স্টোরিৎসদের এমন অনৈসর্গিক শক্তি আছে যা সমস্ত মানুষী চেষ্টাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে, আর তাকে যে-পরিবার এমন উপেক্ষা করেছে, তুচ্ছ করেছে, তার বিরুদ্ধে এই অনৈসর্গিক ক্ষমতা ব্যবহার করতে সে মোটেই দ্বিরুক্তি করবে না… তারপর সে স্টাডির দরজা হ্যাঁচকা টান দিয়ে সজোরে খুলে দাপাতে-দাপাতে চলে গেলো; আর আমি তার ঐ-সব দুর্বোধ হুমকিতে বিচলিত হয়ে হতভম্বভাবে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলুম।
ডাক্তার রডারিখ আবারও পইপই করে আমাদের বলেছেন, এর একটা কথাও যেন ঘুণাক্ষরেও মাইরা বা মাদাম রডারিখের কানে গিয়ে না-পৌঁছোয়–মার্ক যে এর বিন্দুবিসর্গও টের পাক, তাও তার ইচ্ছে নয়। তাদের অন্তত এই উদ্বেগ ও আশঙ্কা থেকে অব্যাহতি দেয়া উচিত। তাছাড়া, আমিও এটা ভালো করেই জানতুম যে মার্কও কাপ্তেন। হারালানের মতোই ব্যাপারটার এক্ষুনি একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলতে চাইবে, চাইবে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা। কাপ্তেন হারালান অবশ্য তখনকার মতো তার বাবার কথা গত্যন্তর না-দেখে মেনে নিয়েছে। বলেছে, বেশ, আমি গিয়ে ঐ হতভাগাটাকে কোনো সাজা দেবো না। কিন্তু ধরো সে নিজেই যদি গোল পাকাতে আমাদের কাছে আসে?… ধরো সে-ই গিয়ে যদি আচমকা মার্কের ওপর হামলা করে?… ধরো সে যদি ক্রমাগত খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে আমাদের উত্ত্যক্ত করেই চলে?
না, ডাক্তার রডারিখ এ-সব অবাঞ্ছিত সম্ভাবনার কোনো উত্তরই দিতে পারেননি।
এই বিমূঢ় দশাতেই তখনকার মতো আমাদের আলোচনা শেষ হয়েছে। যা-ই ঘটুক কেন, আমাদের শুধু অপেক্ষাই করে যেতে হবে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যদি নেহাৎই কথার কথা না-বলে থাকে, যদি হুমকিগুলো সত্যি-সত্যি সে কাজে খাটাতে চায়, তাহলে ঝুলির বেড়াল তো বেরিয়ে পড়বেই, কোনো কথাই আর ধামাচাপা থাকবে না। কিন্তু তা না-হলে, আমরা কেউই যদি এ-সম্বন্ধে কোনো উচ্চবাচ্য না-করি, তাহলে কেউই কোনোদিন এই বিশ্রী অবাঞ্ছিত ব্যাপারটার কথা জানতে পারবে না। কিন্তু কীই-বা করতে পারে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস? বিয়েটা সে বন্ধ করবে কোন উপায়ে? সে কি প্রকাশ্যে সকলের সামনে মার্ককে অপমান করে তাকে বাধ্য করবে দ্বন্দ্বযুদ্ধে? মাইরাকে সে কি বীর্যশুল্কা হিশেবেই মানুষের পর্যায় থেকে একেবারে নামিয়ে আনবে নিছক পুরস্কার বা পণ্যে–আবারও পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষ হাঁকিয়ে জাঁকিয়ে বসবে এইখানে?
আর তক্ষুনি খবর এলো প্রথম দফায় কী কাণ্ড ঘটাবে তার ঐ অপার্থিব ক্ষমতা! পুরভবনের দেয়ালে, যেখানে মার্ক আর মাইরার বিয়ের নোটিস টাঙানো ছিলো, সেটা নাকি দিনের বেলায়, প্রকাশ্যে, সকলের চোখের সামনে হাঁচকা টানে উপড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছে কেউ। কে-সে? কেউ-না। কারণ সবাই যা চোখে দেখেছে, তা হলো : নিজে নিজেই দেয়াল থেকে উঠে এলো কাগজটা, আর ছিঁড়ে গেলো–আপনা থেকেই, নিজে-নিজেই। কেননা দেয়ালের গা ঘেঁসে কোত্থাও কেউ তখন ছিলো না ।
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এই প্রহেলিকা-ব্যাখ্যারও-অতীত এই-যে ব্যাপারটা ঘটে গেলো, কে তার ঘটক হতে পারে? তাতে যার নিজের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, সে-ই তো। এই প্রথম আক্রমণের পর আরো-আক্রমণ হবে, এর চেয়েও গুরুতর, সাংঘাতিক? রডারিখ পরিবারের বিরুদ্ধে শোধ নেবার জন্যে একটানা যত-সব ভীষণ কাণ্ড ঘটানো হবে, এ তারই সূচনা নয় তো? তখন আমরা শুধু এই কথাই ভেবেছি।
পরদিন ভোরবেলায়–কাপ্তেন হারালান যখন তার বাবাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলেছিলো, তখন, বোঝাই যেতে পারে, তিনি কী-রকম ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন।
নিশ্চয়ই ঐ বদমায়েশটার কাজ এটা, বিষম চটে গিয়ে হারালান বলে উঠেছিলো, কেমন করে যে কাণ্ডটা বাধিয়েছে, সেটা অবশ্য আমার মাথায় ঢুকছে না। এখানেই সে-যে থেমে থাকবে না, তা জানি–কিন্তু ফের কোনো গোল না-পাকাতে পারে, আমাকে তারই কোনো-একটা উপায় ভেবে বার করতে হবে?
মাথা ঠাণ্ডা রাখো, হারালান, আমি বলছি, আর এমন-কিছুই কোরো না যা গোটা ব্যাপারটাকে আরো-গোলমেলে করে তুলবে।
বাবা যদি, লোকটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার আগে, আমায় হুঁশিয়ার করে দিতেন, কিংবা তার পরেও যদি আমাকে কিছু-একটা করবার অনুমতি দিতেন, তবে এতক্ষণে
আমরা হতচ্ছাড়ার হাত থেকে নিষ্কৃত পেয়ে যেতুম।
আমার কিন্তু এখনও মনে হয়, হারালান, তোমার নিজের এ-ব্যাপারটায় জড়িয়ে পড়া মোটেই ঠিক হবে না।
আর ও যদি জ্বালাতন করতেই থাকে?
তাহলে তখন পুলিশকে ব্যাপারটা হাতে নিতে বলতে হবে। তোমার মা-র কথা ভাববা, বোনের কথা ভাবো–
কী ঘটেছে, তারা কি তা আর জানতে পাবে না?
আমরা ওঁদের কিছুই বলবো না, মার্ককেও কিছুই জানাবো না, আগে বিয়েটা হয়ে যাক, তারপর দেখা যাবে কী করে এর একটা সুব্যবস্থা করা যায়।
পরে…? বলেছে কাপ্তেন হারালান, কিন্তু তখন যদি বড়-বেশি দেরি হয়ে যায়?
ডাক্তার রডারিখের মনের ভেতরটায় যতটাই না বিষম উদ্বেগ থেকে থাকুক, সেদিন তার স্ত্রী বা কন্যার মনের ভেতর কিন্তু আসন্ন সান্ধ্য-মজলিশের কথা ছাড়া আর-কোনো ভাবনাই ছিলো না–সেই রাত্তিরেই বিয়ের চুক্তিটায় সই করা হবে। ডাক্তার অনেক লোককেই নেমন্তন্ন চিঠি পাঠিয়েছিলেন, আর এখানে, যেন কোনো নিরপেক্ষ ভূমিতেই, মাগিয়ার অভিজাত সমাজ সরকারি-সব কর্মচারীর সঙ্গেই মেশামিশি করবে, সামরিক বাহিনী, বিচারবিভাগ, পৌর দফতর–সব জায়গার লোকই থাকবে এখানে। মস্ত সব ঘর, অনায়াসেই দেড়শো অভ্যাগত ধরে যাবে এখানে, আর সান্ধ্য-মজলিশের পর গ্যালারিতে। আয়োজন করা হবে নৈশভোজের।
মাইরা রডারিখ যে তার প্রসাধনের ব্যাপারে মশগুল হয়ে ছিলো, এতে নিশ্চয়ই অবাক হবার কিছু নেই, যদিও মার্ক তার সাজগোজের বহর আর বাহার দেখেই তার প্রতি আসক্ত হয়নি।
অপরাহ্নে, প্রস্তুতি সমস্তই যখন সারা আর মহিলারা বিশ্রাম করছেন, আমি হঠাৎ একটা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে দেখে বুঝি বেশ-একটু উত্ত্যক্তই বোধ করেছি। সে কি দৈবাৎ এখানে এসে হাজির হয়েছে? মনে তো হয় না। নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে সে, মন্থর পায়ে, মাথাটা একটু নোয়ানো। কিন্তু যেই সে বাড়িটার উলটো দিকটায় এসে পৌঁছেছে, অমনি থমকে থেমে গিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সে, আর তার চোখ থেকে যেন আগুন বর্ষাতে শুরু করেছে।
বেশ কয়েকবার বাড়িটার বিপরীত দিকের শানরাস্তায় এদিক-ওদিক পায়চারি করেছে। সে, শেষটায় এমনকী মাদাম রডারিখেরও নজরে পড়ে গিয়েছে। তিনি তাঁর স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করেছেন, কিন্তু ডাক্তার তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, ভাবনার কিছু নেই-এই অদ্ভুত লোকটা যে সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো, সেটা তিনি ঘুণাক্ষরেও ফাস করেননি।
এখানে এই তথ্যটাও জুড়ে দেয়া উচিত মার্ক আর আমি যখন আমাদের হোটেলে যাবো বলে বেরিয়েছি, তখন একটা চকের মাথায় লোকটার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেছে। মার্ককে দেখবামাত্র সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, একটু যেন দোনোমনা করেছিলো, পথের মাঝেই আমাদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা পাকাবে কি না। কিন্তু সে অনড় দাঁড়িয়েই রইলো, নিশ্চল, মুখটা থেকে সব রং যেন শুষে নিয়েছে কেউ, হাত দুটো এমনভাবে আড়-ধরা যেন সে বিষম এক মৃগীরোগেরই শিকার-ওখানে রাস্তাতেই আচমকা দুম করে পড়ে যাবে নাকি? তার চোখ দুটো–জ্বলজ্বলে বিস্ফারিত আগুন ধরা চোখ দুটি-মার্ককে পারলে যেন ভস্মই করে ফেলতো। মার্ক অবিশ্যি এমন ভান করেছে যেন লোকটাক সে দেখতেই পায়নি!
ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে যাবার পরেই মার্ক আমাকে জিগেস করেছে : ঐ লোকটাকে তুমি দেখলে?
হ্যাঁ, মার্ক।
ও-ই হলো ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, যার কথা সেদিন আমি তোমায় বলেছিলুম।
আমি জানি।
তাহলে একে তুমি চেনো?
কাপ্তেন হারালানই একে চিনিয়ে দিয়েছে–
আমি ভেবেছিলুম লোকটা বুঝি রাস ছেড়ে চলে গিয়েছে, মার্ক বলেছে।
দেখাই তো যাচ্ছে যে যায়নি–অথবা ক-দিনের জন্যে যদি গিয়েও থাকে, তবে আবার ফিরে এসেছে।
অবিশ্যি এতে কিছুই এসে-যায় না।
না, কী-ই বা এসে-যায়? মুখে এ-কথা বলেছি বটে, তবু ভেতরে-ভেতরে নিশ্চয়ই ভেবেছি ভিলহেল্ম স্টোরিংস এখানে না-থাকলেই বুঝি বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করা যেত।
সন্ধে নটা নাগাদ, ডাক্তার রডারিখের বাড়ির সামনে প্রথম কোচগাড়িগুলো এসে থামলো, আর ঘরগুলো লোকের ভিড়ে সরগরম হয়ে উঠলো। সামরিক উর্দি আর পোশাকি বেশভূষার মাঝে চারপাশ আলো করেই যেন ঝলমল করছে মহিলাদের পোশাক। অতিথিরা ঘরে বা গ্যালারিতে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, ডাক্তার রডারিখের পড়ার ঘরে সাজিয়ে-রাখা ছিলো ঝকঝকে সব বিয়ের উপহার–সবাই তার তারিফ করছে, হাসি-ঠাট্টা রসিকতা চুটকি গল্প দিয়ে কেউ-কেউ আসর জমাবার চেষ্টা করছে। মস্ত বৈঠকখানাটার একটা টেবিলে সাজিয়ে-রাখা আছে বিয়ের চুক্তিপত্র, একটু পরেই সেটাতে স্বাক্ষর করা হবে; অন্য-একটা টেবিলে জমকালো একটা গোলাপের তোড়া আর নারঙ্গি মুকুল–আর মাগিয়ার ঐতিহ্য অনুযায়ী, তার পাশেই, মখমলের জাজিমে, শোভা পাচ্ছে কনের মাথার মুকুট, বিয়ের দিন যখন মাইরা ক্যাথিড্রালে যাবে তখন সেটা পরবে।
ঠিক ছিলো, সন্ধের আসরটাকে তিন ভাগে ভাগ করা হবে : কনসার্ট আর বলনাচের মজলিশের মাঝখানে সম্পাদিত হবে সবচেয়ে জরুরি কাজ–চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করা হবে। ত্রিগানেস-এর বিখ্যাত অর্কেস্ট্রার ওপরই সংগীত পরিবেষণের ভার পড়েছে, তাদের দলের নেতাকে নিয়ে সবশুদু জনা-বারো বাজিয়ে সেইজন্যে এখানে এসে জমায়েৎ হয়েছে।
মাগিয়ারদের সংগীতপ্রীতির কথা ইওরোপে কে না জানে, তবে মার্কের মন এই গানবাজনার দিকে ছিলো কি না সন্দেহ; সে সারাক্ষণ যেন অনিমেষ-লোচনেই তাকিয়েছিলো মাইরার দিকে। হাততালির উচ্ছ্বাস থেমে-যাবার পর বাজিয়েরা একে-একে যে যার আসন থেকে উঠতেই ডাক্তার রডারিখ আর কাপ্তেন হারালান এমন উচ্ছ্বসিতভাবে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে তারিফ করলেন যে অর্কেস্ট্রার লোকেরা যেন লজ্জাই পেলে একটু।
এর পরেই এলো বিবাহ-চুক্তিতে স্বাক্ষরের পালা, যথোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গেই সাঙ্গ হলো সেটা, আর তারপরে সাময়িক একটা বিরতি এলো আসরের কাজে। অতিথিরা নিজেদের আসন ছেড়ে উঠে ছোটো-ছোটো দলে ভাগ হয়ে আড্ডা দিচ্ছে, কেউ-কেউ গেছে আলোঝলমল বাগানটায় খোলা হাওয়ায়; পানপাত্রগুলো কখনোই আর শূন্য থাকছে না।
এতক্ষণের মধ্যে মজলিশের কোনো অনুষ্ঠানেই কোনো ঝামেলা হয়নি। যেমন হর্ষ ও আনন্দে তার সূচনা হয়েছে তেমনি হর্ষ ও আনন্দেই তার কেন সমাপ্তি হবে না, তার কোনো কারণ আমি অন্তত দেখিনি। সত্যি-বলতে, আগে মনের মধ্যে একটা কাটা যদি খচখচ করেও থাকে, এখন কিন্তু আমি রীতিমতো আশ্বস্তই বোধ করছিলুম–স্বস্তিও। কাজেই অনুষ্ঠানের সাফল্যের জন্যে মাদাম রডারিখকে অভিনন্দন জানাতে আমার ভুল হয়নি।
মানুষের স্মৃতি ব্যাপারটা ভারি রহস্যময়, ঠিক যেন একটা ধাঁধার মতো। কোথায় কখন কী কথার অনুষঙ্গে কোন কথা মনে পড়ে যায়, কে বলবে। কেন-যে হঠাৎ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর কথাই আমার মনে হানা দিচ্ছে, জানি না। তবে এও জানি, এই স্মৃতিও মন থেকে একদিন উধাও হয়ে যাবে।
অর্কেস্ট্রা আবার তৈরি হয়ে আছে, কাপ্তেন হারালানের কাছ থেকে ইঙ্গিত পাবামাত্র তারা ফের বাজানো শুরু করে দেবে। কিন্তু গ্যালারির দিকে, যেখানে বাগানের দিকে দরজা খুলে গেছে, সেখান থেকে কার একটা গলা ভেসে এলো। আওয়াজটা এখনও বেশ দূরে, কিন্তু বড় যেন রূঢ়, রুক্ষ আর কর্কশ, আর উৎকট একটা গানের সুরে বেজে উঠেছে গলাটা, কিম্ভুত তার লয়, বিদঘুঁটে তার ছন্দ, গলায় সুরের লেশমাত্র চিহ্ন নেই, বেতালা, বেসুরো, অদ্ভুত একটা গান।
প্রথম ভার্জ নাচের জন্যে যে-যুগলরা প্রায় পা বাড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলো তারা কেমন যেন থমকে গিয়েছে… উৎকর্ণ হয়ে গানটা শুনছে তারা-সান্ধ্য আসরের অংশ হিশেবেই কি এই চমকটার ব্যবস্থা করা হয়েছে?
কাপ্তেন হারালান আমার দিকে এগিয়ে এলো।
কী এটা? আমি জিগেস করলুম।
জানি না, এমন-একটা সুরে সে উত্তর দিলে যার মধ্যে উদ্বেগের ভাবটা স্পষ্ট।
কোত্থেকে আসছে গানটা? রাস্তা থেকে?
উঁহু… সে-রকম তো মনে হচ্ছে না।
সত্যিই, অমন উৎকট বেসুরো গানটা যে গাইছে সে যেন বাগান থেকে ক্রমেই গ্যালারির দিকে এগিয়ে আসছে–প্রায় যেন ঢুকেই পড়েছে ভেতরে, বলা যায়।
কাপ্তেন হারালান আমার হাতটা চেপে ধরে আমাকে বাগানে যাবার দরজাটার দিকে টেনে নিয়ে গেলো। আমি বুঝি একটু আঁৎকে গিয়েই তার অনুসরণ করেছি, বাগানটা আলোয় ঝলমল করছে, এখান থেকে সম্ভবত পুরো বাগানটাকেই আমরা দেখতে পাবো…
কিন্তু কাউকেই আমরা দেখতে পাইনি।
ততক্ষণে ডাক্তার ও মাদাম রডারিখও আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, ডাক্তার রডারিখ নিচু গলায় কী যেন বলেছেন তার ছেলেকে, আর সে শুধু ঘাড় নেড়েই তার উত্তর দিয়েছে।
অথচ সেই উৎকট বেতালা গানটা কিন্তু এখনও শোনা যাচ্ছে–কেউ যেন গলা ছেড়ে গান গাইছে, আর শুধু তা-ই নয়, গানটা যেন ক্রমেই এগিয়ে আসছে কাছে…
মার্কও, মাইরার হাতে ধরে, গ্যালারিতে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে; মাদাম রডারিখ ফিরে গেছেন অন্য মহিলাদের মধ্যে–তারা ঘাবড়ে গিয়ে নানারকম প্রশ্ন করছেন, কিন্তু মাদাম রডারিখ তার কোনো জবাব দেবেন কী, তিনি নিজেই তো জানেন না এই অদ্ভুত হেঁড়েগলার গানটি কার অবদান।
আমি গিয়ে দেখছি কী ব্যাপার!বলে, কাপ্তেন হারালান সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। আর তার পেছন-পেছন গেলেন স্বয়ং ডাক্তার রডারিখ, তার কয়েকজন ভৃত্যকে সঙ্গে নিয়ে। কৌতূহলী হয়ে আমিও তাদের পেছন-পেছন গেলুম।
আচমকাই, যখন মনে হচ্ছে, এই গায়ক গ্যালারিটা থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে আছে, তখন গানটা থেমে গেলো।
আমরা বাগানে গিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলুম। সবখানেই আলো জ্বলছে, কোথাও এমন-কোনো কোণা নেই যেটা ঝাপসা অন্ধকারে বা ছায়ায় ঢাকা-খুঁজতেও আমরা কোনো কোণা বাকি রাখিনি, অথচ তবু কাউকেই আমাদের চোখে পড়লো না…
এই হেঁড়ে গলাটা তবে কার? বুলভার তেকেলির সেই ভবঘুরে গায়কটির?
সেটা সম্ভব বলে মনে হলো না, তাছাড়া দেখতে পেলুম বুলভারটিও সম্পূর্ণ জনশূন্য পড়ে আছে।
শুধু একটা আলো জ্বলছে, বামদিকে, পাঁচশো গজ দূরে, অতদূর থেকে সেই মিটমিটে আলোটা স্পষ্ট দেখাই যায় না। আলোটা এসে পড়েছে কোন-এক জানলা থেকে-–ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর বাড়ির মিনার থেকে।
গ্যালারিতে যখন ফিরে গেলুম, তখন অভ্যাগতদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তরে আমরা শুধু অর্কেস্ট্রাকে আবার ভাজের বাজনা শুরু করে দিতেই বলতে পেরেছি। কাপ্তেন হারালান অর্কেস্ট্রাকে ইঙ্গিত করতেই আবার যুগলেরা সবাই নাচের জন্যে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালে।
কী? মাইরা আমায় হেসে জিগেস করলে, আপনার নাচের সঙ্গিনী বেছে নেননি এখনও?
আমার সঙ্গিনী? সে-তো মাদমোয়াজেল আপনিই হবেন–তবে সে শুধু দ্বিতীয় ভালজটার জন্যে।
তাহলে, অঁঁরি, মার্ক বললে, আমরা তোমাকে বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবো না।
মার্ক কিন্তু ভুল বলেছিলো। মাইরা আমার সঙ্গে যে-ভালজটা নাচবে বলে কথা দিয়েছিলো, তার জন্যে আমায় অনেকক্ষণ অপেকক্ষা করতে হয়েছে। সত্যি-বলতে, আমি এখনও সেই নাচটার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
অর্কেস্ট্রা তখন শুধু তার ভনিতা শেষ করেছে, আর অমনি, গায়ককে কেউ এবারও দেখতে পায়নি, হেঁড়েগলার গানটা বাজনা ছাপিয়ে বেসুর জাগিয়ে দিলে–এবারে বৈঠকখানাটির ঠিক মাঝখান থেকেই উঠলো আওয়াজ।
অতিথিরা শুধু আঁৎকেই ওঠেনি, সেইসঙ্গে তাদের পুরো ব্যাপারটাই জঘন্য লেগেছে। হেঁড়ে গলা ঘর ফাটিয়ে গেয়ে চলেছে ফ্রেডারিক মারগ্রাডে-র ঘৃণাবিদ্বেষের স্তব, সেই আলেমান স্তোত্রগান, হিংসা ও হিংস্রতা ছড়ায় বলে সবখানেই যার জঘন্য কুখ্যাতি। মাগিয়ার স্বদেশপ্রেমের প্রতি ইচ্ছে করে, সরাসারি, কেউ কুৎসিত কটাক্ষ করছে-না, কটাক্ষমাত্র নয়, তাকে অপমানই করছে।
অথচ যার ঐ হেঁড়ে গলা গাঁক-গাঁক করে উঠেছে বৈঠকখানার ঠিক মাঝখানটায় কেউই তাকে দেখতে পাচ্ছে না… নিশ্চয়ই সে এখানে আছে, সকলের মাঝখানে, অথচ কেউ তার শ্রীমুখটিকে দেখতে পাচ্ছে না…
নাচিয়েরা সবাই বৈঠকখানার বিভিন্ন প্রান্তে ছিটকে ছড়িয়ে গেছে, গ্যালারিতেও গেছে অনেকে, আর কেমন-একটা গা-শিরশির-করা ভয় ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে, বিশেষত মহিলাদের মধ্যে।
কাপ্তেন হারালান ছুটে গেলো ড্রয়িংরুমটার এদিক থেকে ওদিক, তার চোখ দুটি থেকে আগুন ঝরছে, যে-লোকটাকে চর্মচক্ষু দেখতে পারছে না, পেলেই তাকে পাকড়ে ধরবে সজোরে, এমনিভাবে বাড়ানো তার হাত দুটি। আর সেই মুহূর্তেই শোনা গেলো ঘৃণাবিদ্বেষের স্তব-এর শেষ স্বরগুলো, তারপরেই গলাটা আবার মিলিয়ে গেলো।
আর তারপরেই আমি দেখতে পেয়েছি, অন্তত আরো একশোজন আমার সঙ্গে দেখতে পেয়েছে আমি তখন যা দেখেছি–আর আমার মতোই তারাও কেউ নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে চায়নি।
টেবিলের ওপর গোলাপের যে-তোড়া ছিলো সারা ঘরটায় রঙ জ্বালিয়ে, হঠাৎ সেটা কুটি-কুটি করে ছিঁড়ে ছড়িয়ে গেলো মেঝেয়, অদৃশ্য কার দাপাদাপি-করা পায়ের তলায় সেগুলো ত্থেলে গেলো… ঐ-যে, মেঝের ওপর ছড়িয়ে আছে-কুটি-কুটি-করা–বিয়ের চুক্তিপত্রটা!
এবার আতঙ্কই নেমে এলো সকলের মধ্যে, যেন কোনো বিভীষিকা দেখে সকলেরই চোখ বিস্ফারিত। এ-রকম অপার্থিব ভুতুড়ে জিনিশ দেখে সবাই স্তম্ভিত, সন্ত্রস্ত, সকলেই যেন প্রাণ হাতে নিয়ে পালাতে পারলে বাঁচে। আমি বুঝি তখন নিজেকে বারেবারে জিগেস করছি : আমার মাথা ঠিক আছে তো, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো, এই প্রহেলিকা কি তবে এই বিজ্ঞানের যুগেও বিশ্বাস করতে হবে!
কাপ্তেন হারালান এসে সদ্য তখন আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। রাগে তার মুখ যেন রক্তশূন্য! অস্ফুট স্বরে সে বলেছে : এ সেই হতভাগাই–ভিলহেল্ম স্টোরিৎস!
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস!… হারালান পাগল হয়ে যায়নি তো?
তবে সে যদি পাগল না-হয়ে গিয়ে থাকে, আমার যে শিগগিরই মাথাখারাপ হয়ে যাবে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই! জেগে আছি আমি, কোনো আবেশ নেই তার, অথচ আমি তখন দেখতে পেয়েছি, হ্যাঁ, আমার নিজের চোখেই আমি দেখেছি, সেই মুহূর্তে, বিয়ের মুকুটটা মখমলের জাজিমের ওপর থেকে নিজে-থেকেই-যেন শূন্যে উঠে যাচ্ছে! কোন হাত যে সেটা উঠিয়েছে টেবিল থেকে, তা আমরা কেউই দেখিনি, কিন্তু আমাদের ফ্যালফ্যাল চোখের সামনেই সেটা ড্রয়িংরুম পেরিয়ে গিয়ে, গ্যালারির মধ্য দিয়ে, বাগানে চলে গেলো–আর তারপরেই সেটা, বেমালুম, অদৃশ্য হয়ে গেলো!
এ-যে ভীষণ ব্যাপার!… অস্ফুট স্বরে বলে উঠেছে কাপ্তেন হারালান।
ড্রয়িংরুম থেকে সে তখন তীরের মতো ছুটে বেরিয়েছে, গিয়ে নেমেছে বুলভার তেকেলিতে! আমিও তক্ষুনি তার পেছন-পেছন ছুটেছি।
একজনের পেছনে আরেকজন, আমরা হুড়মুড় করে ছুটে গিয়েছি ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর বাড়িতে। উঁচুতে, মিনারের শুধু-একটা-মাত্র জানলা তখনও মিটমিট করে জ্বলছে অন্ধকারে। হারালান ফটকের হাতলটা ধরে তখন সজোরে ঝাঁকুনি দিচ্ছে । আমার ওপরও কী-যে ভর করেছে, জানি না, আমিও তার সঙ্গে সেই হাতল ধরে তারই সঙ্গে প্রাণপণে টান দিয়েছি। নিরেট, ভারি পাল্লা সেই ফটকের, দুজনে মিলেও তাকে একফোঁটাও নড়াতে পারিনি। কয়েক মুহূর্ত ধরে শুধু প্রাণপণেই টেনেই গেছি আমরা হাতল। রাগে আমরা বোধহয় তখন সব চেভেদ হারিয়ে ফেলেছিলুম…
হঠাৎ ফটকের পাল্লাটা তার কজার উপর সশব্দে নড়ে উঠেছে…
ভিলহেল্ম স্টোরিৎসকে অভিযুক্ত করে কাপ্তেন হারালান স্পষ্টই একটা মস্ত ভুল করে বসেছিলো… ভিলহেল্ম স্টোরিৎস ককখনো বাড়ি ছেড়ে বেরোয়নি সন্ধেবেলায়, কারণ ফটকের পাল্লা দুটি খুলে আমাদের সামনে এসে এখন যে পঁড়িয়েছে সে খোদ ভিলহেল্ম স্টোরিৎসই, সশরীরে, জলজ্যান্ত, তর্কাতীত।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ
পরদিন ভোরবেলাতেই এ-সব ঘটনার সত্য-মিথ্যা বিবরণ দাবানলের মতো গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রথমত, লোকে যে এ-সব ঘটনাটাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেবে না, এটা তো জানা কথাই ছিলো। অথচ স্বাভাবিক যদি না-হয়, তবে কী? বুদ্ধিতে এর কোনো ব্যাখ্যা চলে না–অন্তত এখনও এর কোনো ব্যাখ্যা কারু জানা নেই। তবে কি অতিপ্রাকৃত-কিছু? অলৌকিক?
সন্ধের মজলিশ তো তার পরেই ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিলো। সব ভেস্তে যাওয়ায় মার্ক আর মাইরাও বিষম বিচলিত হয়ে পড়েছিলো। তাদের ফুলের তোড়া কেউ দাপাদাপি। করে ঘেঁৎলে দিয়েছে পায়ের তলায়, ছিঁড়ে কুটিকুটি করেছে বিয়ের চুক্তি, এমনকী সকলের ফ্যালফ্যাল চোখের সামনে দিয়ে চুরি হয়ে গেছে কনের মুকুট!… বিয়ের ঠিক আগেই, এ-কী অলক্ষুণে কাণ্ড!
দিনের বেলায় দলে-দলে লোক ভিড় করে এসেছে বাড়ির সামনে, উত্তেজিতভাবে কত-কী বলাবলি করেছে। কারু-কারু মুখে তো উড়ো-খইয়ের মতো তুলকালাম সব অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা ফুটেছে, কেউ-কেউ শুধু ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে তাকিয়ে দেখেছে বাড়িটা। হানাবাড়ি নাকি?
রোজ যেমন সকালবেলায় বেড়াতে বেরোন, তেমনিভাবে মাদাম বা মাদমোয়াজেল রডারিখ আজ আর বেড়াতে বেরোননি। মাইরা সারাক্ষণ তার মায়ের সঙ্গে-সঙ্গে থেকেছে ছায়ার মতো, পুরো ব্যাপারটায় বিষম ঘাবড়েই গিয়েছে সে, তার নিশ্চয়ই পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার।
আটটার সময় মার্ক আমার ঘরের দরজা খুলে ঢুকেছে, সঙ্গে তার ডাক্তার রডারিখ আর কাপ্তেন হারালান। সব ভালো করে আলোচনা করে নিতে হবে আমাদের, জরুরি কী-ব্যবস্থা করা যায় সে-বিষয়টা ঠিক করে নিতে হবে। ভালো হয়, যদি সেই আলোচনাসভা রডারিখভবনে না-বসে। সারা রাত মার্ক আর আমি একসঙ্গে থেকেছি, শুধু দিন ফোটবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে বেরিয়ে পড়েছে মাদাম রডারিখ আর তার ভাবী বধুর খবর নিতে। তারপর, তারই পরামর্শে, ডাক্তার তার ছেলেকে নিয়ে এখানে চলে এসেছেন।
অঁরি, মার্ক শুরু করেছে, আমি বলে দিয়েছি, কাউকে যেন এ-ঘরে ঢুকতে না দেয়, এখানে কেউ আমাদের কথাবার্তা শুনতে পাবে না, আমরা ছাড়া ঘরে আর-কেউ নেই–কেউই নেই! কিন্তু এ-কী দশা হয়েছে মার্কের! আগের দিন সন্ধেবেলায় যে মুখটা ছিলো হর্ষোজ্জ্বল, সুখী, এখন সেই মুখই কেমন যেন ঝুলে পড়েছে, রক্তহীন, ফ্যাকাশে, তবে এমন অবস্থায় সকলেই যেমন ঘাবড়ে গিয়েছে, তার চেয়ে বেশিকিছু তার হয়নি সম্ভবত।
ডাক্তার রডারিখ প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে তার সংযমের বাঁধ ভেঙে না-পড়ে। তার ছেলের অবস্থা অবশ্য ঠিক তার উলটোই, ঠোঁট চাপা, চোখ দুটো রক্তবর্ণ, উত্তেজিত; সে-যে কী-রকম ঘোরের মধ্যে আছে, তার মুখচোখ দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে।
মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে নিজেকে আমি সারাক্ষণ পইপই করে বুঝিয়েছি। তাছাড়া আমাকে তো প্রথমে মাদাম রডারিখ ও তার মেয়ের কুশল জেনে নিতে হবে।
কাল যা কাণ্ড হয়েছে, তাতে দুজনেই ভারি বিচলিত হয়ে পড়েছেন, ডাক্তার আমার প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, তাদের সেরে উঠতে কয়েকদিন লেগে যাবে। তবে মাইরা-গোড়ায় সে ভারি ঘাবড়েই গিয়েছিলো–এখন সামলে ওঠবার চেষ্টা করছে, মাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করছে–তিনি তো তার চাইতেও বেশি মুষড়ে পড়েছেন। আশা করি কাল সন্ধ্যাবেলাকার স্মৃতি শিগগিরই তার মন থেকে মুছে যাবে–যদি-না অবশ্য আবার ও-রকম জঘন্য কোনো কেলেঙ্কারি হয়…
আবার কোনো কেলেঙ্কারি? আমি জিগেস করেছি, তার কোনো ভয় নেই আমাদের, যে-অবস্থায় অমন বিদঘুঁটে কাটা হয়েছে–বিদঘুঁটে বা উৎকট ছাড়া আর কী-ই বা বলবো একে–সে-রকম কোনো পরিস্থিতি আর হবে না।
কে জানে? ডাক্তার রডারিখ বুঝি কিছুতেই আশ্বস্ত হতে পারেননি। কে জানে? বিয়েটা এখন ভালোয়-ভালোয় হয়ে গেলেই বাঁচি। এখন আর আমি ও-সব হুমকিকে অবিশ্বাস করতে পারছি না…
পুরো বাক্যটা তিনি শেষ করতে চাননি, কিন্তু আসলে তিনি কী বোঝাতে চাচ্ছিলেন, কাপ্তেন হারালান এবং আমার তা মোটেই অগোচর থাকেনি। মার্ক যেহেতু ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর শেষ অপকীর্তির কোনো খবর রাখে না, সে তাই ঐ হুমকির কথাটা ঠিক ধরতে পারেনি।
কাপ্তেন হারালানের একটা নিজস্ব মত ছিলো, তবে সে টু শব্দটি না-করে চুপচাপ থেকেছে, সম্ভবত জানতে চাচ্ছে গত রাতের কাণ্ডটা সম্বন্ধে আমি সত্যি-সত্যি কী ভাবছি।
মঁসিয় ভিদাল, ডাক্তার জিগেস করেছেন, এ-সব অদ্ভুত কাণ্ড দেখে আপনার কী মনে হচ্ছে?
আমার মনে হয়েছে আমি যদি কোনো অবিশ্বাসীর ভূমিকায় অভিনয় করি, তাহলেই ভালো করবো : কাল রাতে যে-সব অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে, তাদের ওপর তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়তো ঠিক হবে না। আপাতত কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না বলেই যে ওদের ভুতুড়ে বা অতিপ্রাকৃত বলে ভাবতে হবে, এমন মাথার দিব্বি কে দিয়েছে। তবু, এখানে চুপি-চুপি কবুল করি, ডাক্তার রডারিখের প্রশ্নটা আমায় ভারি অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দিয়েছিলো।
ডাক্তার রডারিখ, আমি শুধু বলেছি, আমার মনে হয় ও-সব ব্যাপারকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও চলবে। কারু কোনো রসিকতা, কোনো প্র্যাকটিক্যাল জোক, এছাড়া আর এদের নিয়ে কী ভাববো, বলুন। আপনার অতিথিদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন কেউ ছিলো যে নানারকম হাতসাফাইয়ের খেলা দেখায়, কোনো ম্যাজিশিয়ান, আর কোনো ওস্তাদ হরবোলা, সন্ধের মজলিশটা সে তার নিজের কারদানি দেখিয়ে জমাতে চেয়েছিলো… আপনি তো জানেনই এ-সব জাদুবিদ্যায় আজকাল কত লোক ওস্তাদ হয়ে উঠেছে… তবে তার রুচিটা অবশ্য একটু উৎকট গোছের ছিলো, এটা মানতেই হয়…
কাপ্তেন হারালান আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনিমেষ-লোচনে শুধু আমাকে নিরীক্ষণই করেছে তখন, যেন বুঝতে চেয়েছে, মুখে যা-ই কেন না-বলি, ভেতরে ভেতরে আমি সত্যি কী ভাবছি। তার দৃষ্টিটা যেন এই কথা বলতে চেয়েছে : আমরা কিন্তু এ-সব উটকো হেঁদো কথা শুনতে আসিনি।
তার মানে, মঁসিয় ভিদাল, ডাক্তার বলে উঠেছেন, কাল যা হয়েছে, তা আসলে ছিলো কারু ম্যাজিকের খেলা…
ডাক্তার রডারিখ, আমি তাকে থামিয়ে দিয়েই বলেছি, এই ব্যাখ্যাটা বিশ্বাস না করলে বলতে হয় কাল যা ঘটেছিলো তা কোনো অতিপ্রাকৃত ঘটনা–কিন্তু সেটা আমি আদপেই মানতে রাজি নই…
অতিপ্রাকৃত বা অনৈসর্গিক নয়, এতক্ষণে কথার মাঝখানে ঢুকেছে কাপ্তেন হারালান, স্বাভাবিক কোনো ব্যাপারই ছিলো–তবে কীভাবে কেউ এ-সব কাজ হাসিল করেছে, সেই পদ্ধতিগুলোই শুধু আমাদের জানা নেই।
আমি আবারও জোর দিয়ে বলেছি, কাল যার গলা আমরা শুনেছি, সেটা মানুষেরই গলা। আর তা যদি হয়, তবে তা যদি কোনো হরবোলার বদ রসিকতার নিদর্শন না হয়, তবে কী?
ডাক্তার রডারিখ তখন এমনভাবে মাথা নেড়েছেন যেন এমন ব্যাখ্যা তার কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছে না।
তখন, তর্কের খাতিরে, আমি আবারও বলেছি, এত অতিথির মধ্যে কোনো উটকো লোক যে ঢুকে পড়েনি, তা-ই বা কে বলবে? সে সম্ভবত ড্রয়িংরুমে গিয়ে তার হরবোলার খেল দেখিয়ে ঘৃণাবিদ্বেষের স্তবটা গেয়ে মাগিয়ারদের জাতীয়তাবোধকেই ঘা দিতে চেয়েছিলো। সম্ভবত লোকটা আলেমান–বা তা যদি নাও হয়, তাদেরই পোষা কোনো চর।
যদি আমরা ব্যাপারটাকে অমানুষিক-কিছু বলে না-ভাবি, তাহলে এই অনুমানটাকে অবিশ্বাস করার বা সত্য বলে না-মানার কোনো কারণ নেই। ডাক্তার রডারিখ এ সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে না-দিলেও খুব সহজ একটা সত্য কথা বলেছেন :
আপনার কথাটাকেই যদি মেনে নিই, মঁসিয় ভিদাল, যে কোনো হরবোলা–বা কোনো উদ্ধত আলেমান চরই-অনামন্ত্রিত ড্রয়িংরুমে ঢুকে পড়ে আমাদর তার কারদানি দেখিয়ে ভড়কে দিতে চেয়েছিলো–আমার অবশ্য এ-কথায় আদৌ কোনো সায় নেই–তবে ঐ ফুলের তোড়া মাড়িয়ে থেৎলে দেয়া, বিয়ের চুক্তিপত্রটা কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেলা বা অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে ঐ বিয়ের মুকুট নিয়ে কেটে পড়া–এদের আপনি কী করে ব্যাখ্যা করবেন?
ঠিকই, যত-বড়ো জাদুগরই হোক না কেন, কেউ কিছু টের পেলে না, আর সে দিব্বি সকলর চোখে ধুলো দিয়ে এ-সব অপকীর্তি করে গেলো, এটা অবশ্য মানতে মন চায় না। অথচ আছে তো নিশ্চয়ই দুর্দান্ত সব জাদুগর, অদ্ভুতকর্মা ম্যাজিশিয়ান!
কাপ্তেন হারালান তখন আমায় খুঁচিয়েছে, কী, কিছু বলছেন না কেন, মঁসিয় ভিদাল। ফুলের তোড়াটা যে ছিঁড়েছে, বিয়ের চুক্তিপত্রটা যে কুচিকুচি করেছে, বিয়ের মুকুটটা তুলে নিয়ে ড্রয়িংরুম থেকে চোরের মতো যে কেটে পড়েছে, সে কেমনতর হরবোলা–আর এ-সবই বা কেমনতর প্র্যাকটিক্যাল জোক?
আমি এ-কথার কোনো উত্তর দিইনি।
কাপ্তেন হারালান কেমন তেতে উঠেই বলেছে, আপনি কি আমাদের এটাই বোঝাতে চাচ্ছেন যে আমরা সবাই কোনো বেঘোরবিভ্রমের শিকার হয়েছি–পুরোটাই ছিলো সমবেত অলীকদর্শন!
উঁহু, তা নিশ্চয়ই নয়, কোনো বেঘোরবিভ্রমই নয়–একশোরও বেশি লোক সবকিছু নিজেদের চোখে দেখেছে–এমন সমবেত বিভ্রম ঠিক স্বাভাবিক নয়।
আমাকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে না-দেখে ডাক্তার রডারিখই তারপর নিজের মত দিয়েছেন : যা যেমনভাবে ঘটেছে, তাকে তেমনভাবেই আমাদের মেনে নেয়া উচিত। নিজেদের যেন আমরা ঠকাবার চেষ্টা, না-করি। এমন-সব জিনিশ ঘটেছে এখনও যার কোনো স্বাভাবিক ব্যাখ্যা আমাদের হাতে নেই–অথচ এগুলো যে ঘটেছে তাও আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারছি না। তবে, আমরা যদি মূল প্রসঙ্গটা থেকে দূরে সরে যেতে না-চাই, তাহলে আমাদের মানতেই হবে যে এ কারু ঠাট্টাইয়ার্কি ছিলো না, বরং শত্রুর কাজ, নেহাৎই কোনো দুশমনের অপকীর্তি, যে সারা সন্ধ্যার উৎসবটাকে ভেস্তে দিয়ে আমাদের ওপর শোধ নিতে চাচ্ছিলো।
দুশমন! এতক্ষণে মার্কের বিস্ময় আরো বহুগুণ চড়ে গিয়েছে। আপনার দুশমন? আমার? আপনি তাকে চেনেন?
হ্যাঁ, এবার কাপ্তেন হারালান ঝুলি থেকে বেড়ালটাকে বার করে দিয়েছে, হ্যাঁ, মার্ক। এ সেই পাজিটা যে তোমার আগে আমার বোনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো।
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস?
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস।
মার্ক যা জানতো না, এবার তাকে তা-ই খুলে বলা হয়েছে। কয়েকদিন আগে আবার সে-যে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলো, তার কথা বিশদভাবে খুলে বলেছেন ডাক্তার রডারিখ। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায়, সে যে-সব হুমকি দিয়েছিলো, তার কথাও বলতে হয়েছে ডাক্তার রডারিখকে। কেননা, কাল সন্ধেবেলায় যে-সব বেয়াড়া ব্যাপার ঘটেছে, তার জন্যে যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তবে তার ওপরেই যে সব সন্দেহ এসে বর্তায়, এটা এর পর আর এড়িয়ে-যাওয়া যায়নি।
আর আপনারা আমাকে এর একটি কথাও ঘুণাক্ষরেও জানাননি। মার্ক বেশ তেতেই উঠেছে। শুধু আজ আমাকে কথাটা বলছেন, যখন কি না মাইরার জীবন বিপন্ন, তাকে শাসিয়ে গেছে পাজি লোকটা!… বেশ, এই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, আমি তাকে দেখে নেবো–তাকে ছুঁড়ে বার করবো আমি, তারপর–
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কাপ্তেন হারালান বলেছে, তার ভার তুমি আমাদের ওপর ছেড়ে দিতে পারো, মার্ক। সে গিয়ে তো আমাদের বাড়িই কলুষিত করে এসেছে, আমাদেরই উচিত তার দূষিত–
মার্ক নিজেকে আর সামলাতে পারেনি। কিন্তু সে অপমান করেছে আমারই বাগদত্তাকে?
রাগ বোধহয় দুজনকেই অন্ধ করে ফেলেছিলো। ঐ ভিলহেল্ম স্টোরিৎস আসলে রডারিখ পরিবারের ওপরই শোধ নিতে চেয়েছে, চেয়েছে তাদের ওপর নির্মম কোনো প্রতিশোধ নেবে। আচ্ছা, তর্কের খাতিরে এতটুকু না-হয় মানা গেলো। কিন্তু কালকের ঐ ঘটনায় যে তারই হাত আছে, সে-যে ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারটার সঙ্গে জড়ানো, সেটা প্রমাণ করা একেবারেই অসম্ভব। আমরা তো শুধু আর নিছক অনুমানের ওপর নির্ভর করে কোনো নালিশ করতে পারি না, বলতে পারি না : ওহে স্টোরিৎস, কাল সন্ধেবেলা তুমিও অতিথিদের ভিড়ের মধ্যে ছিলে। তুমিই ঘৃণাবিদ্বেষের স্তবটা গেয়ে আমাদের । সবাইকে অপমান করেছে। তুমিই ছিঁড়ে ফেলেছে ফুলের তোড়া আর বিয়ের কাগজ। তুমিই চুরি করে নিয়ে গেছে ঐ বিয়ের মুকুট! কেউই তাকে চোখে দ্যাখেনি, কেউ না!
তাছাড়া, আমরা কি গিয়ে নিজের চোখেই দেখে আসিনি যে সে তার বাড়িতেই ছিলো সে-রাতে? এটা ঠিক যে আমরা যখন ফটকের দরজাটা নিয়ে ঠেলাঠেলি করছি, সে তখন বড্ড বেশি সময় নিয়েছিলো, রডারিখ-ভবন থেকে চলে আসবার পক্ষে সে সময় যথেষ্টই ছিলো, কিন্তু কাপ্তেন হারালান বা আমি কেউই তাকে দেখতে পেলুম না।–অথচ সে দিব্বি আমাদের সামনে দিয়ে ফিরে এলো!
এর সব কথাই আমি তখন খুঁটিয়ে বলেছি তাদের, চেঁচিয়েও উঠেছি একবার, বলেছি, মার্ক আর হারালানের উচিত আমার কথা মন দিয়ে শোনা–ডাক্তার রডারিখ অবশ্য আমার যুক্তির সারবত্তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। আমার চোটপাট সত্ত্বেও মার্ক বা হারালান–কেউই তখন আমার কথা শুনতে চায়নি, তারা তক্ষুনি বুলভার তেকেলিতে সরাসরি ভিলহেল্ম স্টোরিংস-এর বাড়ি চলে যেতে চেয়েছে।
তবে শেষটায়, অনেক তর্কাতর্কির পর, আমরা মোটামুটিভাবে–সম্ভবত একমাত্র–তথ্যযুক্তিওলা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছি। আমি তাদের বাৎলেছি :আমাদের বরং টাউনহলে চলে-যাওয়া উচিত এখন। পুলিশের বডোকর্তাকে সব খুঁটিনাটি জানিয়ে বুঝিয়ে বলা উচিত, এ-যাবৎ কী-কী ঘটেছে। রডারিখ পরিবারের সঙ্গে এই আলেমানটির কী সম্বন্ধ, সেটাও খোলশা করে জানানো উচিত, বলা উচিত মার্ক আর তার বাগদত্তাকে সে কীভাবে শাসিয়েছে। সে এমন-সব পদ্ধতি ব্যবহার করবে বলে হুমকি দিয়েছে যা নাকি সমস্ত মানুষী শক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারবে-নিছকই গালভরা বুলি নিশ্চয়ই সে সব–তবু সে-যে এসব কথা বলে শাসিয়েছে, এটা পুলিশের জানা উচিত। এরপর পুলিশের বোকর্তাই ঠিক করবেন, তিনি এই আলেমানটি সম্বন্ধে বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না।
এই পরিস্থিতিতে, আমাদের পক্ষে এটাই কি সবচেয়ে ভালো কাজ হবে না? সাধারণ কোনো নাগরিকের চাইতে পুলিশ অনেক বেশি ক্ষমতা ধরে। কাপ্তেন হারালান আর মার্ক ভিদাল গিয়ে যদি তার বাড়ির ফটকে ঘা মারে, তবে সে-দরজা খোলা না-খোলা সম্পূর্ণ তার খামখেয়ালের ওপর নির্ভর করবে। সে-যদি দরজা না-খোলে, তবে কি জোর করে ঢুকে পড়বে ভেতরে? কোন অধিকারে? সেটা কি তাদের পক্ষে অনধিকার প্রবেশ হবে না? অথচ পুলিশ কিন্তু ইচ্ছে করলেই, পরোয়ানা নিয়ে গিয়ে, জোর করে ভেতরে ঢুকে পড়বে। তাহলে কি আমাদের পক্ষে এখন মুশকিল আসানের জন্যে পুলিশের সাহায্য নেয়াই ঠিক হবে না?
শেষটায়, সবাই এ-কথা মেনে নেবার পর ঠিক হয়েছে, মার্কের এক্ষুনি রডারিখভবনে ফিরে-যাওয়া উচিত, আর ডাক্তার রডারিখ, কাপ্তেন হারালান আর আমি–আমরা তিনজনে যাবো টাউনহলে।
তখন সাড়ে-দশটা বেজে গিয়েছে। সারা রাগৎস ততক্ষণে আগের রাতের হট্টগোলের কথা জেনে গিয়েছে। ফলে লোকে যখন দেখেছে ডাক্তার তার ছেলেকে নিয়ে হন্তদন্তভাবে টাউনহলের দিকে চলেছেন, তখন তারা অনায়াসেই বুঝে গিয়েছে তার কী মৎলব।
আমরা যেতেই, ডাক্তার খোদ পুলিশের বড়কর্তার কাছে নিজের নাম পাঠিয়েছেন, আর অমনি, অবিলম্বে, তার ঘরে আমাদের ডাক পড়েছে।
মঁসিয় হেনরিখ স্টেপার্ক মানুষটি এমনিতে বেশ ছোটোখাটো হলে কী হবে, সারাক্ষণই তিনি যেন টগবগ করে ফুটছেন প্রাণচাঞ্চল্যে। মানুষটি বিশেষ কাণ্ডজ্ঞান ধরেন, সত্যিকার গোয়েন্দার সব গুণগুলোই তার আছে, এর আগে বেশ কয়েকটি জটিল রহস্য ভেদ করে তিনি তারই প্রমাণ দিয়েছেন। যদি এই প্রহেলিকার ওপর কেউ কোনো আলো ফেলতে পারে, তবে সন্দেহ নেই সেই মানুষটি হবেন মঁসিয় হেনরিখ স্টেপার্ক। তবে এই বিশেষ পরিস্থিতিটায় তিনি কি সত্যিকিছু করতে পারবেন? যা-কিছু কাল রাতে ঘটেছে, তা সত্যি-বলতে-মোটেই কোনো মানুষী কাজ বলে তো মনে হয় না। অন্যদের মতো তিনিও ঘটনাগুলো সম্বন্ধে ভাসা-ভাসাভাবে কিছু কথা শুনেছেন, তবে শুধু এখনই। তিনি আমাদের কাছে জানতে পেলেন সত্যি-সত্যি কী হয়েছে।
আমি ধরেই নিয়েছিলুম, ডাক্তার রডারিখ, যে আপনি এসে দেখা করবেন, আমাদের স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেছেন, সত্যি-বলতে, আমি তার ওপর ভরসা করে ছিলুম। আপনি যদি না-আসতেন তো আমাকেই শেষে আপনার কাছে যেতে হতো। আপনার বাড়িতে কী-সব তাজ্জব ব্যাপার ঘটেছে, তার কথা কাল রাতেই আমার কানে পৌঁছে ছিলো, আপনার অতিথিরা যে শুধু ভড়কেই যাবেন না, বিষম ভয় পেয়েও যাবেন, সেটাও আশ্চর্য কিছু ছিলো না। কিন্তু যেটা আরো-ভয়ানক–সেই আতঙ্ক এখন গোটা রাগৎসেই ছড়িয়ে পড়েছে, খুব সহজে যে লোকের ভয় কেটে যাবে, তা আমার মনে। হয় না। গোড়াতেই শুধু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন, ডাক্তার রডারিখ। কেউ কি সম্প্রতি আপনার ওপর বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছে? এতটাই ক্ষুব্ধ যে মাদমোয়াজেল মাইরা রডারিখের সঙ্গে মঁসিয় মার্ক ভিদালের বিয়েটা ভেস্তে দিতে চাচ্ছে? ভাবছে যে এভাবে সব পণ্ড করে দিয়ে আপনার ওপর শোধ নেবে?
আমার তো তা-ই মনে হয়, ডাক্তার তাকে বলেছেন।
আর, সে-লোকটা কে?
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস নামে একটা লোক।
কাপ্তেন হারালানই প্রচণ্ড ঘৃণাভরে নামটা বলেছিলো, শুনে যে পুলিশের বড়োকর্তা খুব-একটা যে অবাক হয়েছেন, এমনটা মোটেই মনে হয়নি আমার।
ডাক্তার রডারিখ তারপর সব খুঁটিনাটি জানিয়েছেন, ধারাবাহিকভাবে, তার বৃত্তান্ত থেকে এই কথাটা বাদ দেননি, ঠিক কোন কথা বলে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস তাকে শাসিয়েছিলো, বলেছিলো, বিয়েটা এমনভাবে ভণ্ডুল করে দেবে, মানুষ যার কথা। কোনোদিনও কল্পনাও করেনি।
হ্যাঁ-হ্যাঁ, মঁসিয় স্টেপার্ক সায় দিয়েছেন, আর সে তার ঐ অমানুষিক শক্তির পরিচয় দেয় গোলাপের তোড়া ছিঁড়ে ফেলে, অথচ কেউ তাকে সে-কাজ করতে দ্যাখেনি –তা-ই তো!
আমরা সকলেই কথাটায় সায় দিয়েছি।
তবে আমাদের এই মতৈক্য মোটেই কিন্তু প্রহেলিকাটির ওপর কোনো আলোই ফেলতে পারেনি, যদি-না আমরা বলি যে সে এক পিশাচসিদ্ধ, শয়তানের চেলা। কিন্তু পুলিশ তো আর ভূতপ্রেতপিশাচ নিয়ে কাজ করে না, তাকে কাজ করতে হয় বাস্তবের সীমার মধ্যেই। পুলিশ তার প্রকাণ্ড হাতটা শুধু কারু রক্তমাংসের ঘাড়েই ফেলতে পারে। ভূতপ্রেতপিশাচকে গ্রেফতার করায় এখনও তারা সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। যে লোকটা বিয়ের কাগজ কুচি-কুচি করে ছিঁড়েছে, গোলাপের তোড়াটাকে পায়ের তলায় মাড়িয়েছে, যে বেমালুম বাটপাড়ি করেছে ঐ মুকুটটা, সে যদি মানুষ হয় তবেই তারা তাকে পাকড়াতে পারবে।
আমাদের সন্দেহ যে দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সে-বিষয়ে মঁসিয় স্টেপার্কের কোনো দ্বিমত ছিলো না।
এই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস, তিনি বলেছেন, এ-লোকটার ওপর যে কবে থেকেই আমার নজর ছিলো, যদিও সরকারিভাবে কেউ কোনোদিনই তার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করেনি। ভারি ঢাক-ঢাক গুড়গুড় তার সব বিষয়ে, ভীষণ একাচোরা–কীভাবে থাকে, কী করে, কী তার জীবিকা–কেউই তা জানে না। কেন-যে সে স্পেমবার্গ ছেড়ে এসে এখানে জুটলো! সেটা তো তার জন্মভূমি। দক্ষিণ প্রশিয়ার লোক হয়েও কেন সে এসে মাগিয়ারদের এই দেশে আস্তানা গেড়েছে? কেন কেবল একজন বুড়ো চাকরকে নিয়ে সে বুলভার তেকেলির ঐ হানাবাড়িটায় থাকে–যেখানে, কোনো মানুষ তো দূরের কথা, সম্ভবত কোনো কাকপক্ষীও ঢোকে না। তার সমস্তই ভারি সন্দেহজনক–খুবই সন্দেহজনক।
কাপ্তেন হারালান তখন আসল কথাটা পেড়েছে, আপনি এখন কী করবেন বলে ভাবছেন, মঁসিয় স্টেপার্ক?
স্পষ্টই তো বোঝা যাচ্ছে, খোদ পুলিশের বড়োকর্তার মুখ থেকে জবাব এসেছে, এক্ষুনি গিয়ে তার বাড়ি চড়াও হতে হবে, হয়তো খুঁজে দেখলে অনেক সাবুদ মিলবে
সেখানে, অনেক নথিপত্র–হয়তো কোনো ইঙ্গিত মিলবে
কিন্তু সেভাবে গিয়ে চড়াও হতে হলে, জিগেস করেছেন ডাক্তার রডারিখ, রাজ্যপালের মঞ্জুরি লাগবে না? কোনো পরোয়ানা?
ব্যাপারটা একজন বিদেশীকে নিয়ে, আর সেই বিদেশী আপনাকে ও আপনার পরিবারকে যা-নয়-তা-ই বলে শাসিয়ে এসেছে। রাজ্যপাল যে পরোয়ানাটা মঞ্জুর করবেন, তাতে কোনো সন্দেহই নেই।
আমি তখন শুধু জানিয়েছি, কাল স্বয়ং রাজ্যপাল অকুস্থলে ছিলেন।
জানি, মঁসিয় ভিদাল, এবং তিনি নিজের চোখে কী দেখে এসেছেন, সে নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন।
তিনি কি তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন? জিগেস করেছেন ডাক্তার রডারিখ।
না, তিনি বলেছেন সাধারণ-বুদ্ধিতে তার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু, আমি বলেছি, তিনি যখন শুনবেন যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এই ব্যাপারটায় জড়িয়ে আছে–
তা বরং ব্যাপারটা বোঝবার জন্যে তাকে আরো উগ্রীব করে তুলবে। বলেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক, আপনারা বরং অনুগ্রহ করে এখানে একটু অপেক্ষা করুন। আমি সোজা রাজভবন চলে যাবো–আধঘণ্টার মধ্যেই বুলভার তেকেলির হানাবাড়িটা খানাতল্লাশ করবার পরোয়ানা নিয়ে এসে হাজির হবো। বাড়িটা আমরা একেবারে তছনছ করে খুঁজে দেখবো, ডাক্তার রডারিখ।
আমরাও তাহলে আপনার সঙ্গে যাবো, প্রস্তাব করেছে কাপ্তেন হারালান।
যদি তাতে আপনার তৃপ্তি হয়, কাপ্তেন হারালান। আপনিও না-হয় চলুন আমাদের সঙ্গে, মঁসিয় ভিদাল, পুলিশের বড়কর্তা আমাকেও আহ্বান করেছেন।
মঁসিয় স্টেপার্কের দলবলের সঙ্গে তোমরাই না-হয় যেয়ো, কাপ্তেন হারালানকে বলেছেন ডাক্তার রডারিখ, আমি বাড়ি ফিরে যাবার জন্যে একটু উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি। খানাতল্লাশ শেষ হয়ে যাবামাত্র তোমরাও বাড়ি ফিরে এসো।
কেউ গ্রেফতার হলে পর, তবেই, মনে হলো এই অরুচিকর ব্যাপারটার ইতি টেনে দেবার জন্যে মঁসিয় স্টেপার্ক রীতিমতো প্রতিজ্ঞা করে বসে আছেন।
তক্ষুনি তিনি রাজভবনের দিকে বেরিয়ে গেলেন, ডাক্তার রডারিখও তারই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন, বাড়ি ফিরবেন বলে।
কাপ্তেন হারালান আর আমি পুলিশের দফতরেই বসে-বসে মঁসিয় হেনরিখ স্টেপার্কের ফিরে-আসার প্রতীক্ষা করেছি, কিন্তু নিজেদের মধ্যে আর বিশেষ কোনো কথা হয়নি। তাহলে অবশেষে ঐ হানাবাড়িটায় ঢুকবো আমরা?… বাড়ির মালিককে কি তখন বাড়িতেই পাওয়া যাবে? তাকে দেখে কাপ্তেন হারালান নিজেকে সামলে রাখতে পারবে তো?
আধ ঘণ্টা পরেই মঁসিয় স্টেপার্ক পরোয়ানাটা নিয়ে এসে পৌঁছেছেন–তাতে অবস্থা বুঝে যে-কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করবারই মঞ্জুরি দেয়া হয়েছে তাকে। পরোয়ানাটা দেখিয়ে তিনি বলেছেন, আপনারা বরং আগেই চলে যান। আমি একদিক দিয়ে যাবো, আমার সেপাইশান্ত্রী অন্যদিক দিয়ে যাবে। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই আমরা ঐ বাড়িটায় পৌঁছে যাবো। ঠিক!
ঠিক, উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলেছে কাপ্তেন হারালান। আমিও তার সঙ্গে-সঙ্গে তক্ষুনি টাউনহল থেকে বেরিয়ে বুলভার তেকেলির দিকে পা বাড়িয়েছি।
.
নবম পরিচ্ছেদ
মঁসিয় স্টেপার্ক যে-রাস্তাটা ধরে গিয়েছিলেন, সেটা তাঁকে শহরের উত্তরভাগ দিয়ে নিয়ে যাবে, আর তার পুলিশবাহিনী, জোড়ায়-জোড়ায়, যাচ্ছিলো শহরের মাঝখানটা দিয়ে। আমি কাপ্তেন হারালানের সঙ্গে দানিউবের তীর ঘেঁসেই চলেছি।
আকাশ সেই থেকে মেঘে ভরে আছে। মস্ত-সব ধূসর মেঘের পাঁজা পরস্পরকে তাড়া করে আসছে পুর থেকে, আর জোরালো টাটকা হাওয়ায় দানিউবের হলদে জলের মধ্যে ঢেউ কেটে-কেটে চলেছে নৌকোগুলো। জোড়ায়-জোড়ায় সারস আর গাংচিল সোজা চলে যাচ্ছে হাওয়ার দিকেই, আর তীক্ষ্ণ চেরা সুরে থেকে-থেকে ডুকরে উঠছে। এখনও বৃষ্টি পড়ছে না বটে, কিন্তু ওপরের মেঘের রাশি অনবরত ভয় দেখাচ্ছে, হয়তো যে-কোনো সময় তুলকালাম বাদল শুরু হয়ে যাবে।
শহরের হাট-বাজারগুলো ছাড়া–সেগুলোতে অবিশ্যি চাষীদের সঙ্গে-সঙ্গে শহরবাসীও ভিড় জমিয়েছে-রাস্তায় এমনিতে পথচারী খুব-একটা নেই। তবে স্বয়ং পুলিশের বড়োকর্তা তার বাহিনী নিয়ে যদি আমাদের সঙ্গে আসতেন, তবে দেখতে-না দেখতে চারপাশে ভিড় জমে যেতো, সেদিক থেকে টাউনহল থেকে বেরিয়ে আমরা যে আলাদা-আলাদা পথে চলেছি, সেটা ভালোই হয়েছে।
কাপ্তেন হারালান আবারও মুখে কুলুপ এঁটে আছে। এখনও তার মেজাজটা যে রকম তিরিক্ষি আর তেরিয়া হয়ে আছে, তাতে ভিলহেল্ম স্টোরিসের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সে-না একটা কেলেঙ্কারি কাণ্ড করে বসে। শুধু সেইজন্যেই আমার মনে হচ্ছিলো, মঁসিয় স্টেপার্ক আমাদের তার সঙ্গে আসতে দিয়ে বোধহয় ভালো করেননি।
ডাক্তার রডারিখের বাড়ি রাস্তার যে-মোড়টায়, সেখানে পৌঁছুতে আমাদের মিনিট পনেরোর বেশি লাগেনি। একতলার কোনো জানলাই ভোলা নেই, মাদাম রডারিখ আর তার কন্যা যে-ঘর দুটোয় থাকেন তাদেরও জানলার খড়খড়ি নামানো। আগের রাতের উৎসবের মেজাজের সঙ্গে কী তফাৎ আজকের দিনটার! কাপ্তেন হারালান বুঝি নিজের অজান্তেই একবার থমকে গিয়ে ঐ বন্ধ খড়খড়িগুলোর দিকে তাকিয়েছে। তার বুক চিরেই বুঝি বেরিয়ে এসেছে একটি দীর্ঘশ্বাস, কিন্তু একটাও কথা বলেনি। মোড়টা ঘুরে, আমরা বুলভার তেকেলির পথ ধরেছি তারপর, সোজা গিয়ে নেমেছি ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর বাড়িটার সামনে।
খুব তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ফটকের সামনে একটা লোক পায়চারি করে বেড়াচ্ছে, হাত দুটো পকেটে গোঁজা। কাছে গিয়ে দেখি, মঁসিয় স্টেপার্ক। আগেকার কথা অনুযায়ী আমি আর কাপ্তেন হারালান গিয়ে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছি। প্রায় তক্ষুনি, উর্দি না-পরা একদল পুলিশম্যান এসে হাজির হয়েছে। মঁসিয় স্টেপার্কের ইঙ্গিতে তারা রেলিঙের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়েছে তারপর। তাদের সঙ্গে এক কামারও এসে হাজির হয়েছে–যদি দরকার হয় তবে তালা ভেঙেই ভেতরে ঢুকতে হবে। যথারীতি জানলাগুলো বন্ধ, মিনারের জানলায় খড়খড়িগুলো নামানো।
ভেতরে কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমি মঁসিয় স্টেপার্ককে বলেছি।
সেটাই আমরা এক্ষুনি জেনে নিতে চলেছি, তিনি উত্তর দিয়েছেন। তবে বাড়িটা একেবারে ফাঁকা দেখলে আমি একটু অবাকই হবো। ঐ-তো, দেখুন-না, বাঁদিকের ঐ চিমনিটাকে, চোঙ থেকে তো ধোঁয়া বেরুচ্ছে।
আর সত্যিই, ছাতের ওপর হালকা, সূক্ষ্ম ধোঁয়ার কুণ্ডলি।
প্রভু যদি বাড়ি নাও থাকে, মঁসিয় স্টেপার্ক জুড়ে দিয়েছেন, ভৃত্যটি নিশ্চয়ই বাড়ি আছে। আমাদের ভেতরে ঢুকতে দেবার জন্যে তাতে অবশ্য কিছুই এসে-যায় না, প্রভু ভৃত্যের যে-কোনো-একজন বাড়ি থাকলেই হলো।
আমি অবশ্য কাপ্তেন হারালানের ভাবগতিক দেখে ভেবেছি ভিলহেল্ম স্টোরিৎস বাড়ি না-থাকলেই ভালো, আরো-ভালো হয় সে যদি রাগৎস ছেড়ে অন্য-কোথাও চলে গিয়ে থাকে।
মঁসিয় স্টেপার্ক এদিকে প্রায় বজ্রনিনাদে কড়া নেড়ে চলেছেন। তারপর একটু থেমে দাঁড়িয়ে আমরা অপেক্ষা করেছি ভেতর থেকে কেউ এসে যদি ফটকটা খুলে দেয়। মিনিটখানেক কেটে গেলো। কারু কোনো পাত্তা নেই। আবার ফটকের কড়ার বজ্রনিনাদ।
বাড়ির লোকগুলো নিশ্চয়ই কালা, মঁসিয় স্টেপার্ক ফোড়ন কেটেছেন, কানে শোনে না। তারপর, কামারের দিকে ফিরে বলেছেন, দ্যাখো, তুমি কী করতে পারো।
পুলিশের হয়ে কাজ না-করলে এ-কামার নিশ্চয়ই ওস্তাদ চোর হতে পারতো। সে তার ঝোলা থেকে ছুঁচলো একটা ফলা বার করেছে, সেটা তালার ফোকরে ঢুকিয়ে দু-বার ঘোরাবামাত্র অত-বড়ো লোহার দরজাটা খুলে গিয়েছে।
আমাকে আর কাপ্তেন হারালানকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশের বড়োকর্তা তারপর উঠোনে পা রেখেছেন। সঙ্গে আরো-চারজন পুলিশও চলেছে, শুধু দুজন রয়েছে বাইরে, পাহারায়।
তিন পৈঠার এক সিঁড়ি আমাদের নিয়ে গেছে বাড়ির দরজায়–বাইরের ফটকটার মতো সেটাও বন্ধ।
মঁসিয় স্টেপার্ক তার হাতের ছড়িটা দিয়ে তিনবার ঠকঠক করেছেন দরজায়।
কোনো সাড়া নেই। ভেতরেও কারু-কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
ওস্তাদ কামার ফের তার ঝোলা থেকে এক সবখোল চাবি বার করে তালায় ঢুকিয়েছে। কে জানে এই তালা হয়তো দু-তিন পাক দিয়ে আটকানো, ভেতর থেকে হুড়কোও আটকানো থাকতে পারে। হয়তো বাইরে পুলিশবাহিনী মোতায়েন আছে দেখে তারা যাতে ভেতরে না-ঢোকে, সেইজন্যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস ভেতর থেকে খিল তুলে দিয়েছে। কিন্তু না, সে-রকম কিছুই নয়। চাবি ঘুরেছে তালায়, দরজাও তক্ষুনি খুলে গিয়েছে।
চলুন, ভেতরে যাই, বলেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক।
দরজার ওপরেই স্কাইলাইট, তার মধ্য দিয়ে আলো গিয়ে পড়েছে করিডরে, ঢাকাবারান্দায়, আর করিডরের ঠিক শেষ প্রান্তে দ্বিতীয়-একটা দরজা খুলে গেছে পেছনের বাগানে, তার ওপরে কাঁচের পাল্লা দেয়া একটা জানলা-সেদিক থেকেও আলো এসে পড়েছে এই ঢাকাবারান্দায়।
পুলিশের বড়োকর্তা কয়েক পা এগিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়েছেন:কেউ কি ভেতরে আছো?
কোনো সাড়াই নেই, যদিও মঁসিয় স্টেপার্ক গলাটা আরো চড়িয়ে প্রশ্নটা করেছেন বাড়ির মধ্য থেকে কোনো আওয়াজই আসছে না। তবে, উৎকৰ্ণ হয়ে, প্রায় সর্বাঙ্গনে শ্রবণেন্দ্রিয়ে রূপান্তরিত করে, অবশেষে আমাদের মনে হয়েছে পাশের কোনো-একৗ ঘরে কি-রকম একটা কিছু যেন ঘসটে নিয়ে-যাওয়ার আওয়াজ হচ্ছে… কিন্তু সেটা ও ঘোর বিভ্রম বৈ আর-কিছু নয়, সে-সন্দেহটা উঁকি মেরেছে মনের মধ্যে।
মঁসিয় স্টেপার্ক সোজা এগিয়ে গেছেন করিডর ধরে, আমি গেছি তার পেছন পেছন, আর কাপ্তেন হারালান আমায় অনুসরণ করেছে। সেপাইদের একজন দাঁড়িয়ে থেকেছে সিঁড়ির কাছে, পাহারায়।
দরজাটা খুলে দিতেই, পুরো বাগানটাকেই দেখতে পেয়েছি আমরা। দেয়াল দিয়ে ঘেরা, মাঝখানটায় একটা লন, আগে হয়তো কেয়ারি-করা ছিলো, কিন্তু অনেকদিন নিশ্চয়ই কোনো কাস্তে বা কাঁচির ব্যবহার হয়নি এখানে, ঘাসগুলো লম্বা, তবে কেমন। যেন শুকিয়ে-যাওয়া, মরা। তার পাশ দিয়েই ঘুরে-ঘুরে গেছে পথ, দু-ধারে ঘন ঝোঁপঝাড়ের আঁচল। তার ওপাশে দেখা যাচ্ছে ঢ্যাঙা সব গাছ, তাদের পোঁতা হয়েছিলো দেয়ালের ধার ঘেঁসেই, তাদের ঝাকড়া ডালপালা ঠিক পাশের দুর্গপ্রাচীরের ছাঁচ অব্দি উঠে গিয়ে শাসন করছে যেন এখন।
সবকিছু থেকেই চূড়ান্ত অবহেলার লক্ষণ ফুটে বেরুচ্ছে।
তন্নতন্ন করে, তারপর, খোঁজা হয়েছে বাগানটা। সেপাইরা কাউকেই দেখতে পায়নি সেখানে, যদিও পথের ওপর দেখা গেছে সাম্প্রতিক যাতায়াতের পদচিহ্ন।
এদিকটায় জানলাগুলো বাইরে থেকে খড়খড়ি তুলে বন্ধ করে দেয়া–শুধু একতলার শেষ জানলাটা বাদে–সেখান থেকে গিয়েই আলো পড়ে সিঁড়ির পইঠা আলো করে দিয়েছে।
লোকজন যে একটু আগেও এ-পথ দিয়ে এসেছিলো, তাতে কোনো সন্দেহই নেই, মন্তব্য করেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক, কারণ দরজাটায় শুধু তালাই লাগানো–হুঁড়কোটা অব্দি তুলে দেয়া হয়নি।… লোকগুলো যদি আগে থেকেই হুঁশিয়ার হয়ে পালিয়ে না যেতো
আপনার কি মনে হয় যে তারা আগে থেকেই জানতে পেরেছে? আমি বলেছি, আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমার বরং মনে হচ্ছে তারা হয়তো এক্ষুনি যে-কোনো সময় এসে হাজির হবে।
মঁসিয় স্টেপার্ক অবিশ্যি তাতে সন্দেহভরে মাথা নেড়েছেন।
তবে, আমি আরো জুড়ে দিয়েছি, ঐ-যে একটা চিমনি দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে ভেতরে কোথাও আগুন জ্বলছে।
কোথায় আছে আগুন, দ্যাখো! অমনি পুলিশের বড়োকর্তার সতর্জন গর্জন কানে এসেছে!
বাগানে যে কেউ কোথাও নেই, এটা পুরোপুরি নিঃসন্দেহ হয়েই মঁসিয় স্টেপার্ক আমাদের ভেতরে চলে যেতে বলেছেন, তারপর বাগানের দরজাটা ফের বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
করিডরটা গেছে চার-চারটে ঘরের পাশ দিয়ে। তাদেরই একটায়, বাগানের পাশেই, কেউ যেন কিছু-একটা রান্না করছিলো। আরেকটা ঘর থেকে গিয়ে পড়া যায় দোতলার সিঁড়িতে, সিঁড়িটা তারপর সোজা চিলেকোঠার দিকে চলে গিয়েছে।
থানাতল্লাশি পুরোদমে শুরু হয়েছে ঐ রসুইঘর থেকেই। সেপাইদের একজন জানলার পাল্লা খুলে খড়খড়ি তুলে দিয়েছে, তাতে অবশ্য অল্পই আলো এসে পড়েছে। রান্নাঘরে।
রান্নাঘর, তবে সে নামেই। থাকার মধ্যে আছে লোহার এক চুল্লি, তার চিমনিটা উধাও হয়েছে দেয়াল-থেকে-বেরিয়ে আসা এক ছাঁচের তলায়; তার দুপাশে দুটো দেরাজ; ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল; দুটো বেতের চেয়ার আর দুটো জলচৌকি; দেয়াল থেকে ঝুলছে গোটা কতক হাতাখুন্তি; এককোণায় একটা পিতামহ ঘড়ি যেটা সারাক্ষণ টিকটিক করে বেজেই চলেছে, আর সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে তাতে কাল সন্ধেবেলাতেই চাবি ঘুরিয়ে দম দেয়া হয়েছে।
চুল্লিটার মধ্যে তখনও জ্বলছে কতগুলো কয়লা; তারই ধোঁয়া আমরা দেখেছি বাইরে থেকে।
রান্নাঘর তো দেখলুম, আমি বলেছি, কিন্তু রাঁধুনি যে না-পাত্তা!
এবং তার প্রভু-সে-ই বা কোথায়? জিগেস করেছে কাপ্তেন হারালান।
আমি অত সহজে ছাড়ছি না, সব তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবো,জানিয়েছেন মঁসিয়। স্টেপার্ক।
একতলার অন্য-দুটো ঘরও পর-পর দেখা হয়েছে। একটা নিশ্চয়ই বৈঠকখানা, পুরোনো ভারি আশবাবপত্রে ভরা, শৈলীগুলো টিউটানিক। শিকবসানো ফায়ার-প্লেসের ওপর, ম্যান্টলপীসের ওপর, নানারকম কারুকাজ-করা একটা ঘড়ি-রুচির তাতে কোনো চিহ্নই নেই; তার নিশ্চল কাটাগুলো আর ওপরকার জমে-থাকা পুরুধুলোর আস্তর দেখে। বোঝা গেছে অনেকদিন হলো সে-ঘড়ি আর চলছে না। জানলার মুখোমুখি দেয়ালটায় ডিম্বাকার একটা ফ্রেমে-পোরা একটা পোর্ট্রেট : তলায় গথিক হরফে নাম লেখা : অটো স্টোরিৎস।
ছবিটার দিকে আমরা অসীম কৌতূহলভরে তাকিয়েছি, তুলির টানে একটা বেপরোয়া স্পর্ধার ভাব, কিন্তু রঙের ব্যবহার বড্ড স্কুল যেন, কোনো অজ্ঞাত শিল্পীর আঁকা–তার নাম দস্তখৎ করা আছে তলায়, অর্থাৎ যথার্থ একটা শিল্পকর্ম। কাপ্তেন হারালান তো ক্যানভাসটার ওপর থেকে যেন চোখ সরাতে পারছিলো না। আর আমি? অটো স্টোরিৎস-এর মুখটা আমায় গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিলো। সে কি আমার মনের এমন অস্থির দশার জন্যে?… না কি, আমি, নিজের অজান্তেই, হানাবাড়িটার পরিবেশের শিকার হয়ে পড়েছি? এ-দুয়ের যা-ই হোক না কেন, এই ফাঁকা ঘরে, এখানটায় অটো স্টোরিৎসকে কোনো কিংবদন্তির জীবের মতোই দেখাচ্ছিলো। সেই বিশাল মাথা, সেই উশকোখুশকো আলুথালু কঁকড়া চুল, ঐ উন্নত ললাট, ঐ জ্বলন্ত দুই চক্ষু, ঐ মুখটা–তার ঠোঁট দুটো যেন জ্যান্ত–যেন কেঁপে উঠছে আধো আলোছায়ায়–আমার মনে হয়েছে এই প্রতিকৃতিটা যেন সজীব, যেন সেটা এক্ষুনি লাফিয়ে নেমে আসবে তার। ডিম্বাকার কাঠামো থেকে, যেন কোনো অপার্থিব ভুতুড়ে গলায় এক্ষুনি চীৎকার করে উঠবে : কে তোমরা? এখানে তোমাদের কে ঢুকতে দিয়েছে? কেন তোমরা দুম করে এসে আমার শান্তি ভঙ্গ করছো?
জানলার ভিনিসীয় খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে অল্প-অল্প আলো এসে পড়েছিলো ঘরে, তাই জানলার পাল্লা খোলবার কোনো দরকার হয়নি, আর সেই জন্যেই ঐ ছায়ার জাফরির মধ্যে প্রতিকৃতিটাকে সম্ভবত আরো-কিম্ভুত আরো-দুর্দান্ত দেখাচ্ছিলো।
অটো আর ভিলহেল্ম স্টোরিসের চেহারার সাদৃশ্য দেখে মঁসিয় স্টেপার্ক বুঝি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। বয়েসের তফাৎ যদি না-থাকতো, তিনি আমায় বলেছেন, তবে আমি ভাবতুম এ বুঝি পিতৃদেবতার নয়, পুত্রদেবতারই ছবি। দুজনেরই চোখগুলো একরকম, কপালটাও তা-ই, মস্ত ধড়ের ওপর তেমনি মস্ত মাথা বসানো… আর ঐ পিশাচের মতো চাউনি, ঐ অভিব্যক্তি! ওঝা ডেকে দুজনকেই ঝাড়িয়ে নিতে পারলেই বোধকরি ভালো হতো।
হ্যাঁ, আমিও সায় দিয়েছি, সাদৃশ্যটা, সত্যি, চমকপ্রদই!
কাপ্তেন হারালানকে কেউ যেন পেরেক ঠুকে ঐ ক্যানভাসের সামনেই আটকে দিয়েছে! যেন কোনো প্রতিকৃতি নয়, আসল মানুষটিই আছে তার সামনে।
কী কাপ্তেন, যাবেন না? আমি তার ঘোরটা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা করেছি।
করিডর দিয়ে তারপর আমরা গেছি পাশের ঘরটায়। এটা হচ্ছে কাজের জায়গা, ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, কর্মশালা–কিন্তু সবকিছুই যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। শাদা কাঠের তাক, পর-পর, তাতে সারি-সারি বইপুথি–বেশির ভাগই বাঁধানো নয়, আর বেশির ভাগ বইই গণিত, পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নশাস্ত্র বিষয়ে। কোণায় কতগুলো যন্ত্রপাতি, নানা আকারের নানা ধরনের, একটা ভোলা-উনুন–এদিক-ওদিক সরানো যায়, কতগুলো বকযন্ত্র, পাতনযন্ত্র আর নানা ধরনের ধাতুর নমুনা–যার কয়েকটাকে নিজে এনজিনিয়ার। হওয়া সত্ত্বেও আমি চিনতেই পারিনি। ঘরের মাঝখানে, একটা টেবিল-কাগজ ঠাশা, আরো-সব লেখালিখির জিনিশ, অটো স্টোরিৎস-এর রচনাসমগ্র-রতিনটে বা চারটে খণ্ড। তাদের পাশে একটা পাণ্ডুলিপি পড়ে আছে। ঝুঁকে পড়ে দেখি, সেই বিখ্যাত নামটাই দস্তখৎ-করা : আলোকবিদ্যা বিষয়ক একটি প্রস্তাব। কাগজপত্র, পুথির পর পুথি, পাণ্ডুলিপি–সব পর-পর মোহর-করা, বেঁধে-রাখা।
এ-ঘরেও খোঁজাখুঁজি করে কোনো লাভ হয়নি। আমরা যখন ঘরটা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন হঠাৎ ম্যান্টলপীসের ওপর কিম্ভুতকিমাকার দেখতে নীলচে একটা শিশির ওপর মঁসিয় পোর্কের নজর পড়েছে।
সে কি তার কৌতূহল চরিতার্থ করতেই, না কি তার রহস্যভেদী গোয়েন্দাবুদ্ধির তাগিদে, তিনি শিশিটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখবেন বলে সেটা ধরতে হাত বাড়িয়েছেন। কিন্তু হয়তো অসাবধান হয়ে থাকবেন, ঠিক মতো খেয়াল করেননি–শিশিটা ছিলো ম্যান্টলপীসের একেবারে ধার ঘেঁসে, যেই তিনি ধরতে যাবেন, অমনি ঠেলা লেগে হাত ফসকে শিশিটা মেঝেয় পড়ে গিয়ে চুরমার হয়ে গেলো।
তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো হলদে রঙের সরু সুতোর মতো তরল কী-যেন, দারুণ দাহ্য-কিছু নিশ্চয়ই, অদ্ভুত একটা গন্ধ ছড়িয়ে তক্ষুনি সেটা বাষ্প হয়ে একেবারেই। উবে গেলো। ভারি ক্ষীণ হালকা ছিলো গন্ধটা, কিন্তু আমার জানা কোনো রাসায়নিকের গন্ধের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই।
হুম! বলে উঠেছেন মঁসিয় স্টেপার্ক, একেবারে সময় বুঝে নিচে গিয়ে পড়েছে। শিশিটা–
তাতে আর সন্দেহ কী? আমি বলেছি, নিশ্চয়ই অটো স্টোরিৎস-এর উদ্ভাবিত কিছু ছিলো শিশিটায়।
ছেলের কাছে নিশ্চয়ই ফর্মুলাটা থাকবে, মঁসিয় স্টেপার্ক বলেছেন, ঐ সূত্র ধরেই সে জিনিশটা যত-ইচ্ছে বানিয়ে নিতে পারবে। তারপর, দরজার দিকে ফিরে, বলেছেন, এবার তাহলে দোতলায় যাওয়া যাক। সেপাইদের একজনকে তিনি নিচে করিডরে পাহারায় থাকতেই নির্দেশ দিয়েছেন।
এখানে, রান্নাঘরের মুখোমুখি যে-দরজাটা, সেটা খুলে গেছে দোতলার সিঁড়িতে, দু-পাশে কাঠের রেলিঙ, আমাদের পায়ের তলায় পইঠাগুলো মচমচ করে উঠে যেন আপত্তিই জানিয়েছে।
ল্যাণ্ডিঙে, পাশাপাশি দুটো ঘর। তাদের দরজাগুলো ভেজানো ছিলো, কিন্তু তালা লাগানো ছিলো না, হাতল ঘোরাতেই খুলে গেছে।
প্রথম ঘরটা নিশ্চয়ই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর শোবার ঘর। থাকার মধ্যে আছে একটা লোহারখাট, শিয়রের কাছে একটা টেবিল, ওক কাঠে তৈরি বিছানার চাদর ইত্যাদি রাখার একটা দেরাজ, তামার পায়ার ওপর দাঁড়-করানো প্রসাধন টেবিল, একটা সোফা, পুরু মখমলের গদি আঁটা একটা আরামকেদারা, আর দুটো চেয়ার; বিছানার ওপর না আছে কোনো চাদোয়া, না-বা মশারি; জানলাতে কোনো পর্দা নেই; আশবাব যা আছে তা নেহাৎই কেজো, যা না-হলে চলে না। কোনো নথিপত্র নেই, না ম্যান্টলপীসের ওপর, না কোণার গোল টেবিলটার ওপর। বিছানাটা এলোমেলো হয়ে আছে, সম্ভবত রাতে এই বিছানায় কেউ শুয়েছিলো। প্রসাধন টেবিলটার কাছে গিয়ে মঁসিয় স্টেপার্ক আবিষ্কার করেছেন সেখানে একটা গামলায় জল আছে, তার ওপর সাবানের ফেনা ভাসছে।
যদি, আমাদের তিনি বুঝিয়ে বলেছেন, ঐ জল ব্যবহার করা হবার পর চব্বিশ ঘণ্টা কেটে যেতো, তবে এতক্ষণে সাবানের ঐ বুড়বুড়িগুলো মিলিয়ে যেতো। তা যখন হয়নি, তখন তা থেকে অনুমান করতে পারি আমাদের শ্রীমান সকালবেলায় এখানেই মুখ ধুয়েছেন–বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগেই–
তাতে কি মনে হয় না যে সে আবার এখানেই ফিরে আসবে? আমি বলেছি, যদি-অবশ্য আপনার সেপাইদের সে এখানে মোতায়েন না-দ্যাখে।
সে যদি আমার সেপাইদের দেখে ফ্যালে, তবে আমার সেপাইরাও তাকে দেখে ফেলবে। তাদের ওপর হুকুম দেয়াই আছে, তাকে দেখতে পেলেই যেন ধরে নিয়ে আসে। তবে আমার মনে হয় না, সে আমাদের কাছে ধরা দেবে।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমরা একটা ক্যাচকেঁচে আওয়াজ শুনতে পেয়েছি, যেন কেউ এইমাত্র কোনো নড়ববাড়ে কাঠের মেঝেয় পা রেখেছে। আওয়াজটা যেন এসেছে পাশের ঘর থেকে, ঐ ওয়ার্কশপের ঠিক ওপরেই যে-ঘরটা।
এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যাবার একটা দরজা আছে। অর্থাৎ, ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের ল্যাঙি দিয়ে ঘুরে যেতে হবে না।
মঁসিয় স্টেপার্কের আগেই কাপ্তেন হারালান একলাফে ঐ দরজার কাছে গিয়ে হ্যাঁচকা টান দিয়ে ততক্ষণে দরজার কবাটটা খুলে ফেলেছে।
কিন্তু আমরা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছি সবাই। ঘরটায় কেউ নেই।
এটাও সম্ভব যে আওয়াজটা হয়তো ওপরের চিলেকোঠা থেকেই এসেছে–যেখান। থেকে সরাসরি মিনারটায় যাওয়া যায়।
এই দ্বিতীয় ঘরটা আগের ঘরটার চাইতেও যেন শাদাসিধে, বাহুল্যবর্জিত। একটা কাঠামোর ওপর একটা শক্ত ক্যানভাস চাপানো, একটা জাজিম-বহু ব্যবহারে চেপটে গিয়েছে, কিছু পুরু কম্বল, একটা পশমিনা চাদর, একটা জলের কুঁজো, একটা ফায়ারপ্লেস–যাতে কোনো ছাই বা ভস্মাবশেষ নেই–তার ওপরকার ম্যান্টলপীসের ওপর একটা বেলেপাথরের গামলা, আর ওক কাঠের একটা দেরাজ- যার ভেতর রাশি-রাশি বিছানার। চাদর, বালিশের ওয়াড় ইত্যাদি। এ-ঘরটা নিশ্চয়ই সেই পুরাতন ভৃত্য হেরমানেরই। আগের ঘরটার জানলা যদি-বা ঘরে যাতে হাওয়া আসে, সেজন্যে একটু খোলা ছিলো, এ-ঘরের জানলা কিন্তু ছিটকিনি দিয়ে আটকানো। নিকট-অতীতে কোনোদিনই যে সে জানলা খোলা হয়েছে, তা মনে হলো না। ছিটাকিনিটা জংধরা, আড় হয়ে আছে। লোহার-ফ্রেমে-আঁটা খড়খড়িটা শুদু নাড়ানো গেলো না।
কিন্তু মোদ্দা কথা এটাই যে, ঘরটা ফাঁকা। যদি চিলেকোঠা, মিনার, রান্নাঘরের নিচে মাটির তলার ভাড়ার–সব এ-রকমই শূন্য পড়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে প্রভু-ভৃত্য দুজনেই বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে–আর-কখনও ফিরে আসবে কিনা, তা-ই বা কে জানে!
আপনার কি মনে হয়, আমি সিয় স্টোপার্ককে জিগেস করেছি, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস কোনোভাবে আগেভাগেই এই তদন্তের কথা জেনে গিয়েছিলো?
না, মঁসিয় ভিদাল, যদি-না সে টাউনহলে আমার ঘরে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থেকে থাকে, অথবা রাজভবনে আমি যখন রাজ্যপালের সঙ্গে কথা বলছি, তখন সেখানে যদি লুকিয়ে না-থাকে, তাহলে এ-কথা তার ঘুণাক্ষরেও জানবার কথা নয়।
আমরা বুলভার দিয়ে যখন আসছি, তখন নিশ্চয়ই তার চোখে পড়ে থাকবো।
হয়তো-কিন্তু আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে তারা পালাবে কোন চুলোয়?
খিড়কির দুয়োর দিয়ে যদি খোলা মাঠটায় চলে যায়–
বাগানের ঐ দেয়াল টপকাবার সময় তারা পেতো কোথায়? দেয়ালটা তো খুবই উঁচু। তাছাড়া অন্যপাশটা দিয়ে তো কেল্লার প্রাচীর গিয়েছে সেটা তারা পেরুবে কী করে?
মঁসিয় স্টোপার্কের ধারণা : ভিলহেল্ম স্টোরিৎস আর হেরমান নিশ্চয়ই আমরা বাড়ির ধারে-কাছে আসার অনেক আগেই চম্পট দিয়েছে।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ল্যাণ্ডিঙের সিঁড়ি দিয়ে যেই ওপরে উঠতে যাবো, অমনি কানে এসেছে একতলার সিঁড়িতে কার দুপদাপ পায়ের শব্দ, যেন কেউ হুড়মুড় করে ছুটে যাচ্ছে। আর ঠিক তারই সঙ্গে কানে এসেছে কার পড়ে যাবার শব্দ, আর আর্তনাদ।
রেলিঙ থেকে ঝুঁকে দেখি, আমরা যে-সেপাইকে নিচে পাহারায় রেখে এসেছিলুম সে উঠে পড়ে তার পেছনটা ডলছে।
অমনি মঁসিয় স্টেপার্ক শুধিয়েছেন, কী হয়েছে, লুডভিগ?
লুডভিগ ইনিয়েবিনিয়ে যা বলেছে তার সারমর্ম এই : সে সিঁড়ির দ্বিতীয় পইঠায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলো, এমন সময় তার কানে এসেছে কে যেন দুপদাপ করে সিঁড়ি দিয়ে ছুটেছে। তাড়াতাড়িতে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে যেই দেখতে যাবে কী ব্যাপার, সে নিশ্চয়ই আচমকাই বড্ড জোরে ঘুরেছিলো, কারণ তা দু-পাই সিঁড়ি দিয়ে হড়কে যায়, আর সে চিৎপাত হয়ে বেকায়দায় পড়ে যায়। কেমন করে যে পড়েছে সেটাই এক রহস্য। তার নিশ্চিত ধারণা, কেউ যেন তার পা ধরে হ্যাঁচকা একটা টান দিয়েছিলো–কিংবা এমন জোরে ধাক্কা দিয়েছিলো যে সে টাল সামলাতে না-পেরে পড়ে গেছে। অথচ সেটাও কোনোমতেই সম্ভব নয়। কারণ সদর দরজার কাছে যে-সেপাইরা পাহারা দিচ্ছে, তারা ছাড়া এখানে কোনো জনমানব ছিলো না।
হুম! চিন্তার এই ছোট্ট আওয়াজটুকু ছাড়া মঁসিয় স্টেপার্কের মুখ থেকে আর কোনো আওয়াজ বেরোয়নি।
তার মিনিট খানেক বাদেই আমরা গিয়ে তেতলায় পৌঁছেছি।
সারা তেতলা জুড়ে, এ-মাথা থেকে ও-মাথা অব্দি, একটাই চিলেকোঠা, দুটো স্কাইলাইট থেকে আলো ঢুকছে সে-ঘরে, একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই আমরা বুঝেছি, এখানেও কেউ এসে আশ্রয় নেয়নি। মাঝখানে একটা কাঠের সিঁড়ি, সেটা গেছে মিনারে, ছাতের ওপর। সিঁড়িটা যেখানে ছাত ছুঁয়েছে, সেখানে একটা ওপর-দরজা, পাল্লাটা ঠেললে ওপরদিকে উঠে যায়।
দরজাটা খোলা দেখছি, আমি মঁসিয় স্টেপার্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি অবশ্য ততক্ষণে মইটার পইঠায় পা রেখেছেন।
হ্যাঁ, মঁসিয় ভিদাল, আর ওখান দিয়ে বেশ টাটকা হাওয়াও আসছে ঘরটায়। আমরা নিশ্চয়ই তারই আওয়াজ শুনে থাকবো। আজ বেশ জোর হাওয়া দিচ্ছে–ছাতের ওপর হাওয়ামোরগটা বেশ আওয়াজ করেই পাক খাচ্ছে।
কিন্তু, আমি একটু আপত্তিই জানিয়েছি, আওয়াজটা মনে হচ্ছিলো কারু যেন পায়ের শব্দ।
কিন্তু কে আর হাঁটবে, বলুন? বাড়িটায় তো কারু চুলের ডগাটিও দেখা গেলো ।
যদি সে ঐ ওপরে থাকে, মঁসিয় স্টেপার্ক?
ঐ পাখির বাসায়? আকাশে?
কাপ্তেন হারালান এতক্ষণ চুপচাপ আমাদের আলাপ শুনেছে। এবার সে মিনারটা দেখিয়ে চলেছে, চলুন, ওপরে যাই।
মঁসিয় স্টেপার্কই প্রথমে মইটা বেয়ে উঠেছেন, পাশে একটা মোটা দড়ি ঝুলছিলো, সেটা ধরে-ধরে। তারপর কাপ্তেন হারালান, সব শেষে আমি। আট ফিট x আট ফিট হবে আয়তন, সম্ভবত দশ ফিট উঁচু, আর বেশ অন্ধকার, যদিও ওপরে একটা কাঁচের পাল্লা আছে। আসলে ঘরটা যে আঁধার হয়ে আছে, তার কারণ ভারি-ভারি পশমের পর্দা ঝুলছে চারপাশে। সেগুলো টেনে সরাতেই পুরো জায়গাটা ফটফটে দিনের আলোয় ভেসে গেলো।
প্রথমেই বলা উচিত, এই মিনারটাও ফাঁকাই ছিলো–কেউ কোথাও ছিলো না। পরোয়ানা নিয়ে এসে মঁসিয় স্টেপার্কের এই ছোঁ-মেরে-পড়া একেবারেই নিষ্ফল হয়েছে–আমরা এখনও জানি না কাল রাতে ঐ রহস্যময় ব্যাপারগুলো কী ছিলো।
আমি ভেবেছিলুম, এই কাঁচের মিনার হয়তো তৈরি হয়েছে আকাশটাকে পড়বার জন্যে–হয়তো জ্যোতির্বিদ্যার যন্ত্রপাতি থাকবে সেখানে। আমি ভুল ভেবেছিলুম। থাকার মধ্যে সেখানে ছিলো একটা টেবিল আর কাঠের চেয়ার।
টেবিলের ওপর পড়ে ছিলো কতগুলো কাগজ। তার মধ্যে বুড়াপেটে যে খবরকাগজ পড়েছিলুম, তারই একটা সংখ্যা–সেই-যাতে আসন্ন স্টোরিৎস-বার্ষিকীর কথা বেরিয়েছিলো। অন্য-সব কাগজপত্তরের সঙ্গে-সঙ্গে এ-সব কাগজও পুলিশ বাজেয়াপ্ত করলে।
বোঝাই যাচ্ছে, তার ল্যাবরেটরি বা ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এখানেই এসে বিশ্রাম করে। খবরটা যে সে মন দিয়ে পড়েছে, তার প্রমাণস্বরূপ খবরটার পাশে লাল কালি দিয়ে একটা ট্যাড়া আঁকা।
ঠিক সেই মুহূর্তে ক্রুদ্ধ বিস্ময়ের একটা চীৎকার সেই মিনারের পাখির বাসায় ফেটে পড়েছে।
কাপ্তেন হারালান দেয়ালের গায়ে একটা তাকে একটা ছোট্ট হালকা কাঠের বাক্স দেখে, সেটার ডালা শুধু খুলেছিলো…
আর বাক্সটা থেকে কী ওটা বার করে নিয়ে এসেছে সে?
সেই বিয়ের মুকুটটা! সেটা কাল রাত্তিরে ডাক্তার রডারিখের বাড়ি থেকে কেউ সকলের তাজ্জব চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে এসেছিলো।
.
দশম পরিচ্ছেদ
তাহলে এ-বিষয়ে আর-কোনো সন্দেহই নেই যে কাল সন্ধের ব্যাপারগুলোয় ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর হাত আছে : এখন আর এটা নিছকই সন্দেহ বা অনুমানের স্তরে নেই। যাকে বলে বাস্তব সাবুদ, তা-ই এখন হাতে আছে আমাদের। চুরিটা যেই হাতে-নাতে করে থাক, এই কিম্ভুত মুকুটহরণের ব্যাপারটি যে তারই সুবিধের জন্যে ঘটানো হয়েছে, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, আমরা যদিও-অবশ্য এখনও জানি না সে-কোন আজব উপায়ে দৃশ্যমান না-হয়েও চুরিটা কে করেছে।
কাপ্তেন হারালানের গলা তখন রাগে কেঁপে উঠেছে। এখনও কি আপনার কোনো সন্দেহ আছে, মঁসিয় ভিদাল?
মঁসিয় স্টেপার্ক কেমন যেন থম মেরে গিয়েছেন। এই আশ্চর্য প্রহেলিকাটির প্রায় বেশির ভাগ অংশই এখনও অজ্ঞাত রয়ে গেছে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর অপরাধ যদিও এখন তর্কাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে, সে-যে কোন আজব পদ্ধতি মারফৎ কাজটা হাসিল করেছে, সেটা কারু জানা নেই, কেউ কোনোদিন জানতে পারবে কি না তাও জানা নেই।
কাপ্তেন হারালান যদিও তার ক্ষুব্ধ কুপিত প্রশ্নটা আমাকেই জিগেস করেছে, আমি তবু তাকে কোনো উত্তর দিইনি। কীই-বা বলতে পারতুম আমি?
সে কিন্তু তখনও রেগে-তিনটে হয়ে বলেই চলেছে :এই হতচ্ছাড়াই কি আমাদের মুখের ওপর ঘৃণাবিদ্বেষের স্তব ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের নিদারুণভাবে অপমান করে যায়নি–যে-গানটা মাগিয়ার স্বদেশপ্রেমের গালে প্রচণ্ড-একটা থাপ্পড় কষিয়েছে! যা, এটা ঠিক যে আপনারা তাকে চাক্ষুষ দেখতে পাননি, তবে তার গলা যে নিজের কানেই শুনেছেন, সেটা তো আর অস্বীকার করতে পারবেন না। তাকে আমরা চোখে না-দেখলেও এই পাজির পাঝাড়াটা অকুস্থলেই ছিলো! আর যে-মুকুটটাকে তার স্পর্শ অমনভাবে কলুষিত করেছে, আমি চাই না তার কোনো অংশ অটুট থাকুক।
মুকুটটা সে প্রায় ভেঙে ফেলতেই যাচ্ছিলো, শুধু শেষ মুহূর্তে মঁসিয় স্টেপার্ক তাকে সামলেছেন। এটা ভুলে যাবেন না, কাপ্তেন হারালান, সাবুদ হিশেবে এটাকে দেখাতে হবে। আর তা জরুরিও হবে, কারণ আমার ধারণা ব্যাপারটা বিস্তর জল ঘোলা করে দেবে।
শুনে অবিশ্যি কাপ্তেন হারালান মুকুটটা তার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, তারপর আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছি। নিষ্ফলভাবে বাড়ির প্রত্যেকটা ঘর আরো-একবার খুঁজে তল্লাশ করে আমরা তারপর বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছি।
সদর দরজা আর ফটক বন্ধ করে সীল করে দেয়া হলো, আর দুজন সেপাই রইলো পাহারায়।
মঁসিয় স্টেপার্ক আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় পইপই করে বলে দিয়েছেন আমরা যাতে এই তদন্তের কথাটা গোপন রাখি, ঘুণাক্ষরেও কাউকেই যেন এ-কথা জানতে দিই না যে ঐ হানাবাড়িটায়গিয়ে আমরা সব তন্নতন্ন করে খুঁজে এসেছি, বিয়ের মুকুটটাকে পেয়েছি মিনারের পাখির বাসাটায়।
বুলভার দিয়ে আমি যখন কাপ্তেন হারালানের সঙ্গে রডারিখ-ভবনের দিকে হেঁটে আসছি, সে কিন্তু তখনও নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি–তার প্রতিটি আচার-আচরণে ভাবেভঙ্গিতে পদক্ষেপে প্রচণ্ড রাগ ফুটে বেরুচ্ছিলো। মিথ্যেই আমি চেষ্টা করেছি তাকে শান্ত করতে। এটাও মনে-মনে আশা করেছি যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস হয়তো এখন শহর ছেড়ে কেটে পড়েছে–কিংবা নাও যদি গিয়ে থাকে, এখন যখন তার বাড়ি খানাতল্লাশ করে হাতে-নাতেই জানা গেছে যে সে এই ব্যাপারটার সঙ্গে লিপ্ত আর সাবুদটা পুলিশ বাজেয়াপ্ত করে নিজের হেফাজতে রেখেছে, তখন সে চম্পট দেবারই চেষ্টা করবে। আমি তাকে বলেছি,শোনো, হারালান, আমি তোমার এই রাগের কারণটা ভালোই বুঝতে পারি, এও বুঝতে পারি তুমি চাও এ-সব পেজোমির জন্যে সে উপযুক্ত সাজা পাক। কিন্তু এটাও ভুলে যেয়ো না যে মঁসিয় স্টেপার্ক পইপই করে বলে গিয়েছেন পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখতে।
আর বাবা? আর তোমার ভাই মার্ক? তারা কি এই তদন্তের ফল কী হলো, তা জানতে চাইবে না?
চাইবে, তবে আমরা তাদের শুধু এই কথাটাই বলবো যে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এর সঙ্গে আমরা কিছুতেই দেখা করতে পারিনি-সম্ভবত সে রাস ছেড়েই কেটে পড়েছে। এটা ঠিক মিথ্যেও বলা হবে না।
মুকুটটা কোনখানে পাওয়া গেছে, সে-কথা আপনি তাদের জানাবেন না?
জানাবো, তাদের সেটা জানাও উচিত। তবে তোমার মাকে বা বোনকে এ-সম্বন্ধে কিছু বলার কোনো মানে হয় না। খামকা তাদের শঙ্কা বা উদ্বেগ বাড়িয়ে লাভ কী? আমি হলে শুধু বলতুম যে মুকুটটা তোমাদের বাগানেরই এককোণায় পাওয়া গেছে। বলে তোমার বোনকে মুকুটটা দিয়ে দিতুম।
এ-রকম মিথ্যের আশ্রয় নিতে কাপ্তেন হারালানের মন ওঠেনি বটে, তবে শেষ পর্যন্ত তার মনে হয়েছে আমিই বোধহয় ঠিক বলেছি। সিয় স্টেপার্ক অবশ্য মুকুটটা হাতছাড়া করতে চাইবেন না, তবে ঠিক হলো, আমি গিয়ে তার কাছ থেকে সেটা নিয়ে আসবার চেষ্টা করবো।
এ-সব কথা মুখে বলেছি বটে, তবে মার্ককে আড়ালে ডেকে নিয়ে সব কথা খুলে বলতে চাচ্ছিলুম আমি। আরো-বেশি-করে চাচ্ছিলুম, বিয়েটা এবার ভালোয়-ভালোয় উৎরে গেলেই হয়।
রডারিখভবনে পৌঁছুবামাত্র ভৃত্য এসে আমাদের পড়ার ঘরে নিয়ে গেছে–সেখানেই মার্ক ডাক্তার রডারিখের সঙ্গে বসে-বসে আমাদের প্রতীক্ষা করছিলো। এতই তারা অধীর হয়ে উঠেছিলো যে আমরা চৌকাঠ পেরুবার আগেই তারা আমাদের প্রশ্নে-প্রশ্নে জর্জরিত করে ফেলেছে।
যখন আমরা সব খুলে বলেছি, বুলভার তেকেলির ঐ হানাবাড়িতে কী-কী দেখেছি বা হয়েছে, তখন দুজনেই ঘৃণায়-ক্রোধে-বিস্ময়ে একেবারে রি-রি করে উঠেছে! মার্ক তো রীতিমতো মাথাগরম করে ফেলেছিলো। কাপ্তেন হারালানের মতো তারও মত, ও-সব ন্যায়বিচার-চিটার মাথায় থাক, এক্ষুনি গিয়ে বাছাধনকে একটা উচিত শিক্ষা দিয়ে আসা যাক।
মিথ্যেই আমি বোঝাবার চেষ্টা করেছি যে তার এই পহেলা দুশমনটি নিশ্চয়ই রাগৎস ছেড়ে চলে গিয়েছে।
শুনেই, মার্ক বলে উঠেছে :রাগৎস-এ যদি না-থাকে, তবে নিশ্চয়ই মেবার্গে আছে। যাবে কোথায়!?
আমি তাকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছি না দেখে শেষে ডাক্তার রডারিখ আমার সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। মার্ক, তোমার দাদা যা-বলছেন, সে-কথা তোমার শোনা। উচিত। যা হবার তা হয়েছে-এবার এই বিশ্রী ব্যাপারটা মন থেকে তাড়িয়ে দাও-ভুলে যাবার চেষ্টা করো। এ নিয়ে আর আলোচনা কোরো না, তবেই দেখবে ব্যাপারটা মন থেকে সরে গিয়েছে।
দু-হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে মার্ক যখন ক্রুদ্ধ ও হতাশ বসে থেকেছে, তখন তার দিকে আর তাকানো যাচ্ছিলো না। তার মনের মধ্যে কী-যে ভোলাপড়া চলেছে, তার সবটা না-হোক, অনেকটাই আমি আন্দাজ করতে পারছিলুম।
ডাক্তার রডারিখ আরো জানিয়েছেন : তিনি নিজে রাজভবনে গিয়ে রাগৎস-এর বড়োলাটের সঙ্গে দেখা করবেন। হাজার হোক, ভিলহেল্ম স্টোরিৎস এখানে বিদেশী, রাজ্যপাল নিশ্চয়ই তাকে এখান থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিতে কোনো দ্বিধা করবেন না। যে-বিষয়টায় আমাদের সতর্ক হয়ে লক্ষ রাখা উচিত, তা হলো, কাল যা-সব আজব অপকীর্তি ঘটে গিয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাক বা না-যাক, সে-রকম কোনো কেচ্ছাকেলেঙ্কারি যাতে আর না-ঘটে। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যে জাঁক দেখিয়ে হুমকি দিয়ে গেছে, তার তাঁবেদারিতে ভূতপ্রেতপিশাচ আছে, অতিপ্রাকৃত সব শক্তি, তাকে আর পাত্তা না-দেয়াই ঠিক হবে।
আবারও আমি জোর দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছি কেন মাদাম রডারিখ ও মাইরাকে এ-বিষয়ে সব বিশদ করে বলে দেবার দরকার নেই। মুকুটটা সম্বন্ধে আমার পরামর্শটাকেই মেনে নেয়া হলো। মার্ক গিয়ে তাকে বলবে যে সেটাকে তারা শেষ অব্দি বাগানেই খুঁজে পেয়েছে। তাতে অন্তত মনে হবে যে এ কারু বদ রসিকতা বৈ আর কিছু নয়, তাকে খুঁজে বার করে উচিত সাজাই দেয়া হবে পরে।
সেদিনই আবারও একবার টাউনহলে যেতে হয়েছে আমায়। মঁসিয় স্টেপার্ককে বুঝিয়ে-শুঝিয়ে মুকুটটা নিয়ে আমি রডারিখ-ভবনে ফিরে গেছি।
সেদিন সন্ধেবেলায় আমরা যখন মাদাম রডারিখ আর মাইরার সঙ্গে আসর জমিয়ে বসে চুটিয়ে গল্পগুজব করছি, মার্ক একটু খোলা হাওয়ায় হেঁটে আসবে বলে বাইরে গিয়েই, ফের হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এসেছে। মাইরা! মাইরা! এই দ্যাখো, তোমার জন্যে আমি কী নিয়ে এসেছি।
দেখেই, আসন থেকে উঠে মাইরা ছুটে গেছে তার দিকে। এ-যে আমার মুকুট!
হ্যাঁ, কী কাণ্ড দ্যাখো, বাগানের একটা ফুলের ঝাড়ের পাশে পড়ে ছিলো।
কিন্তু কেমন করে? কেমন করে গেলো ওখানে! মাদাম রডারিখ বিস্ময়ে থ।
কেমন করে আবার? ডাক্তার রডারিখ বলে উঠেছেন, উটকো কোনো লোক নিশ্চয়ই রবাহূত ঢুকে পড়েছিলো অতিথিদের মধ্যে। তারপর বিশ্রী, কুরুচিকর একটা রসিকতা করেছে লোকটা। যাক, এই আজগুবি ব্যাপারটা নিয়ে আর আমাদের খামকা মাথা ঘামাতে হবে না।
মাইরার চোখ ফেটে ততক্ষণে টলটলে মুক্তোর মতো জল বেরিয়ে এসেছে। সে শুধু বারেবারে বলেছে, ওহ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ তোমাকে, মার্ক, ধন্যবাদ!
পরের দিনগুলোয় আর-নতুন কোনো ঘটনা ঘটেনি, মাগিয়ার শহরটাও ফিরে পেয়েছে তার অভ্যস্ত নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনের ভঙ্গিমা। বুলভার তেকেলির হানাবাড়িটায় পুলিশ যে তন্নতন্ন করে খানাতল্লাশ চালিয়ে এসেছে, সে-কথা কেউ জানতেও পায়নি, কেউই এ-প্রসঙ্গে ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর নামও আর উল্লেখ করেনি। এখন আমাদের শুধু ধীরস্থিরভাবে–কিংবা হয়তো অস্থিরভাবেই–অপেক্ষা করতে হবে শুভদিনটার জন্যে, যেদিন মার্ক আর মাইরার বিয়েটা ঘটা করেই সম্পন্ন হবে।
মার্ক বেশির ভাগ সময়টাই আমায় একা কাটাতে দিয়েছে। আমি সময়টা কাটিয়েছি রাগৎস-এর আশপাশে ঘুরে বেড়িয়ে, আর মাঝে-মাঝেই কাপ্তেন হারালানও যথারীতি আমার সঙ্গী হয়েছে। বুলভার তেকেলি দিয়ে না গিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে শহরের বাইরে যাওয়াটা একটু অস্বাভাবিকই হতো আমাদের পক্ষে। সেই হানাবাড়িটা যেন হারালানকে চুম্বকের মতো টানছিলো। কিন্তু তাতে এটা কেবল আমরা বুঝতে পেরেছি বাড়িটা অন্তত এখনও ফাঁকাই পড়ে আছে, তাছাড়া এখনও দুজন সেপাই সারাক্ষণ মোতায়েন আছে। পাহারায়। ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যদি ফিরে আসতো তবে কিছুতেই সেপাইদের চোখে ধুলো দিতে পারতো না–এবং তক্ষুনি তাকে গ্রেফতার করা হতো। তাছাড়া, সে-যে এখানে নেই এখন, এবং রাগৎস-এর রাস্তায় যে আচমকা তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, এটার একটা প্রমাণও আমাদের হাতে এসে গিয়েছিলো।
২৯শে মে খোদ মঁসিয় পোর্কের মুখ থেকে আমি জানতে পেরেছিলুম যে অটো স্টোরিৎস-এর মৃত্যুর সেই পূর্বঘোষিত বার্ষিকী উৎসব ২৫শে মে প্রেমবার্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসবে অনেক লোক হয়েছিলো, আশপাশের শহর থেকেই শুধু নয়, বার্লিন থেকেও নাকি লোক এসেছিলো। হাজার-হাজার লোক হয়েছিলো সেখানে, এত লোক যে কবরখানায় আঁটেনি, লোক তার আশপাশেও উপচে পড়েছিলো। অনেক হৈ-হট্টগোল হ্যাঙ্গামাও হয়েছে, দুর্ঘটনা অপঘাতমৃত্যুও বাদ যায়নি। ভিড়ের মধ্যে দম আটকে, বা ভিড়ের চাপে পিষে গিয়েও, অনেক লোক নাকি মারা গিয়েছে সেই করবখানায়।
এটা তো কেউ ভুলে যায়নি যে অটো স্টোরিৎস-এর জীবনমৃত্যুকে ঘিরে কত কী কিংবদন্তি গজিয়ে উঠেছিলো, এবং এত-সব কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধবিশ্বাসী মানুষ তার অলৌকিক ক্ষমতার একটা মরণোত্তর নিদর্শন দেখতে চাচ্ছিলো। আশ্চর্য-কিছু যদি এই উৎসবে না-ঘটে, তবে আর অটো স্টোরিৎস-এর মাহাত্ম রইলো কী? আর-কিছু না হোক পুঁশিয়ার এই সিদ্ধপুরুষটিকে তো সর্বসমক্ষে কবর থেকে উঠে আসতে হয়। আর সেই মুহূর্তে পৃথিবীর আহ্নিক গতিতে যদি বিষম-কোনো ঝামেলা পাকিয়ে বসে, তাহলেও লোকে হয়তো অবাক হবে না। পৃথিবী হয়তো দিনরাত্রির আবর্তনটা হঠাৎ উলটো দিকে ঘুরেই শুরু করে দিলে নতুন করে, পশ্চিম থেকে পুবে ঘুরলেই বা পৃথিবীকে ঠেকাচ্ছে কে। তাতে সৌরজগৎ গোল্লায় যাক, তো, যাক-না!
লোকের মধ্যে এমনি-সব কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিলো তখন। আসলে কিন্তু পুরো অনুষ্ঠানটাই হয়েছিলো নীরস, সাধারণত এমন-সব স্মরণোৎসব যেমন হয়ে থাকে তেমনি। কবরের পাথর ভেতর থেকে হ্যাঁচকা টান মেরে কাঁচা ঘুম ভেঙে কেউ জেগে ওঠেনি। প্রেতসিদ্ধই হোক বা বিজ্ঞানসাধকই হোক, মৃত ব্যক্তি তার পারলৌকিক আশ্রয় ছেড়ে আদপেই বেরোয়নি আর পৃথিবীও তার আপন অক্ষচক্রকে কেন্দ্র করে যেমন ঘুরতো তেমনি ঘুরে চলেছে তার আহ্নিকগতিতে।
কিন্তু যে-তথ্যটা এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সেটা এই : অটো স্টোরিৎস-এর পুত্রবর সেই অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত ছিলো। সে-যে রাস ছেড়ে চলে গিয়েছে, এটাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আমি শুধু আশা করেছি যে সে যেন তার ভৃত্যকে নিয়ে আর এখানে ফিরে না-আসে।
তক্ষুনি আমি খবরটা পৌঁছে দিয়েছি মার্ক আর কাপ্তেন হারালানকে–যেহেতু তারা তখনও মাথাগরম করে অহেতুক (?) ক্ষুব্ধ হয়ে বসে ছিলো।
যদিও এই তাজ্জব ঘটনাগুলো যে-শোরগোল তুলেছিলো, তার প্রায় অনেকটাই তখন মিলিয়ে এসেছে, রাগৎস-এর রাজ্যপাল কিন্তু তখনও বেশ-একটু অস্বস্তি বোধ করেছেন। পুরোটাই কি কারু হাতসাফাই ছিলো, ভেলকির খেলা ছিলো, না কি সত্যি এর মধ্যে ছিলো ব্যাখ্যাতীত কোনোকিছুর উপস্থিতি–সেই রহস্যটার এখনও-অব্দি কোনো কিনারা হয়নি, আর এটাও ঠিক যে কানাঘুষোয় এ-ব্যাপারটা শহরের শান্তি যথেষ্ট বিঘ্নিত করেছিলো; এ-রকম যাতে আর-কখনও না-হয় তার ব্যবস্থা করা জরুরি বলেই রাজ্যপালের মনে হচ্ছিলো। সেইজন্যেই এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে মঁসিয় স্টেপার্ক তাকে যখন ভিলহেল্ম স্টোরিৎস-এর হুমকি ও অপকীর্তির কথা খুলে বলেছিলেন, তখন তিনি কতটা বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তাই এই তদন্তের ফলাফল জেনে, বিশেষত ও-বাড়িতে চোরাইমাল পাওয়া গেছে জেনে রাজ্যপাল ঠিক করেছিলেন বিদেশীকে এজন্যে বিশেষ কঠোর দণ্ড দেবেন। আর-কিছু না-হোক, একটা জিনিশ চুরি হয়েছে; ভিলহেল্ম স্টোরিৎস নিজে ঐ চুরি করে থাকুক বা না-থাকুক, তার উশকানিতেই ব্যাপারটা ঘটেছে অথবা এতে তার সরাসরি হাত আছে–কোনোভাবে। সে যদি রাগৎস ছেড়ে চলে না-যেতো, তবে তাকে গ্রেফতার করা হতো, আর একবার তাকে হাজতে পুরে ফেলতে পারলে আবার দৃশ্য বা অদৃশ্য ভাবে ডাক্তার রডারিখের বাড়িতে গিয়ে তার পক্ষে নতুন-কোনো অপকর্ম করা সম্ভব হবে না। সেইজন্যেই ৩০শে মে রাজ্যপালের সঙ্গে মঁসিয় স্টেপার্কের যে-কথোপকথন হয়েছিলো সেটা এইরকম :
আপনি এ-সম্বন্ধে আর নতুন-কোনো খবর পাননি?
না, ইওর এক্সেলেন্সি।
ভিলহেল্ম স্টোরিৎস যে ফের রাগৎস ফিরে আসবার মৎলব এঁটেছে, এমন মনে করবার কোনো কারণ ঘটেনি আশাকরি?
কিছুমাত্র না–কোনো কারণই নেই।
তার বাড়ির ওপর সেপাইরা এখনও নজর রেখেছে?
দিবারাত্রি-চব্বিশ ঘণ্টাই।
আমি ভেবেছি এ-বিষয়ে বুড়াপেটে সবিশেষ লিখে-জানানো আমার কর্তব্য, জানিয়েছেন রাজ্যপাল, এ-ব্যাপারটা এখানে কতখানি শোরগোল তুলেছে সেটা বুড়াপেটের জানা উচিত। ব্যাপারটার যাতে এখানেই ইতি ঘটে, সেইজন্যে যা-যা করা দরকার সবকিছুর আগাম অনুমোদন জানিয়ে সেখান থেকে বার্তা এসেছে।
যতক্ষণ-না ভিলহেল্ম স্টোরিৎস রাৎসে ফিরে আসছে,মঁসিয় স্টেপার্ক বলেছেন, ততক্ষণ তার কাছ থেকে ভয় করবার কিছু নেই আমাদের। সে-যে অন্তত পঁচিশ তারিখে স্পেমবার্গ ছিলো, সে-খবর আমরা নিশ্চিতভাবে জানি।
তা ঠিক, তবে সে হয়তো এখানে ফিরে আসবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। যাতে সে এখানে ফিরে না-আসতে পারে, তারই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে।
তার চাইতে সহজ আর-কিছু নেই, ইওর এক্সেলেন্সি। যেহেতু ব্যাপারটা একজন বিদেশীকে নিয়ে, তাই বহিষ্কারের ফতোয়া জারি করে দিলেই চলবে।
এমন-এক ফতোয়া, যা তাকে যে শুধু রাগৎস থেকেই বার করে দেবে তা নয় –গোটা অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় রাজ্য থেকেই বার করে দেবে।
হুকুমনামাটা হাতে পাবামাত্র, মঁসিয় স্টেপার্ক কথা দিয়েছেন, আমি সীমান্তের সব পাহারাদারদেরই নির্দেশ পাঠিয়ে দেবো।
ফতোয়াটায় তক্ষুনি দস্তখৎ করে সীলমোহর করে দেয়া হয়েছে–আর গোটা দেশেই ভিলহেল্ম স্টোরিৎস অবাঞ্ছিত বিদেশী বলে ঘোষিত হয়ে গেছে।
ব্যবস্থাটা নেয়া হয়েছিলো আমাদের সবাইকেই আশ্বস্ত করার জন্যে। কিন্তু তখন আমরা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পেতুম যে কী হতে চলেছে, তাহলে হয়তো অমন মিথ্যা আশ্বাসে স্বস্তি পেতুম না।