২. কবি সদানন্দ মহলানবিশ

সকালবেলাতেই কবি সদানন্দ মহলানবিশ এসে হাজির। বগলে কবিতার খাতা। ডান হাতে মজবুত একটা ছাতা। বাঁ হাতে বাজারের ব্যাগ।

কবি সদানন্দকে দেখলে সকলেই একটু তটস্থ হয়ে পড়ে। মুশকিল হল, সদানন্দর কবিতা কেউ ছাপতে চায় না। কিন্তু না ছাপলেও কবিতা যাকে একবার ধরেছে তার পক্ষে কি আর কবিতা ছেড়ে দেওয়া সম্ভব? সদানন্দও তাই কবিতা লেখা ছাড়েনি। একটু বুঝদার লোক বলে যাকে মনে হয় তাকেই ধরে কবিতা শুনিয়ে দেয়। ফুচুর জ্যাঠামশাই বলেন, “সদাটার আর সব ভাল, কেবল কবিতা শোনানোর বাতিকটা ছাড়া।”

সকালে কাছারি-ঘরে বসে ফুচুর জ্যাঠামশাই পাটের গুছি পাকিয়ে গরুর দড়ি তৈরি করছিলেন। সদানন্দকে দেখে একটু আঁতকে উঠে বললেন “ওই যাঃ, একদম ভুলেই গেছি, আজ সকালে আমার একবার সদাশিব কবরেজের বাড়ি যেতে হবে। গোপালখুড়োর এখন-তখন অবস্থা। নাঃ, এক্ষুনি যেতে হচ্ছে।”

সদানন্দ কবি হলেও কবির মতো দেখতে নয়। রীতিমত ঘাড়ে-গদানে চেহারা। শোনা যায় কুস্তি আর পালোয়ানিতে একসময়ে খুব নাম ছিল। তার মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। গায়ে মোটা কাপড়ের একটা হাফ-হাতা শার্ট, পরনে ধুতি। চোখের দৃষ্টি খুব আনমনা। আজ তাকে আরও আনমনা দেখাচ্ছে। মুখটা একটু বেশি শুকনো। চোখে একটা আতঙ্কের ভাব। ফুচুর জ্যাঠামশাইয়ের দিকে চেয়ে সদানন্দ ভাঙা-ভাঙা গলায় বলে, “ব্যস্ত হবেন না। গোপালখুড়ো আজ একটু ভাল আছে। সদাশিব কবিরাজ গেছে ভিনগাঁয়ে রুগি দেখতে। আর–আর আমি আজ আপনাকে কবিতা শোনাতে আসিনি।”

ফুচুর জ্যাঠামশাই গঙ্গাগোবিন্দ একটা আরামের শ্বাস ফেলে বলেন, “তাই নাকি? তা-তাহলে বরং–”

“হ্যাঁ, একটু বসি। আপনি নিশ্চিন্তে দড়ি পাকাতে থাকুন।

আমি এসেছি, একটা সমস্যায় পড়ে।”

“কী সমস্যা বলো তো?”

“আপনি তো সায়েন্সের ছাত্র শুনেছি।”

“ঠিকই শুনেছ। বঙ্গবাসীতে বি এসসি পড়তাম। স্বদেশি করতে গিয়ে আর পরীক্ষাটা দিইনি। তবে আই এসসি-তে রেজাল্ট ভাল ছিল। ফার্স্ট ডিভিশন, উইথ দুটো লেটার।”

“বাঃ। তাহলে আপনাকে দিয়ে হবে। আচ্ছা, আলোকবর্ষ কথাটার মানে কী বলুন তো।”

“ও, ওটা হল গিয়ে ইয়ে” বলে ফুচুর জ্যাঠামশাই একটু ভাবেন। তারপর বলেন, “আমাদের আমলে সায়েন্সে রবিঠাকুর পাঠ্য ছিল না।”

কবি সদানন্দ বিরক্ত হয়ে বলে, “এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসছে কোত্থেকে? আলোকবৰ্ষ কথাটার মানে জানতে চাইছি।”

“ডিকশনারিটা দেখলে হয়। তবে মনে হচ্ছে যে বছরটায় বেশ আলো-টালো হয় আর কি, আই মিন গুড ইয়ার।”

সদানন্দ বিরস মুখে বলে, “এ-শহরে কলকাতা থেকে একটি অতি ফাজিল ছেলের আমদানি হয়েছে। আমাদের পরেশের ভাগ্নে। কাল নতুন একটা কবিতা লিখলাম। পরেশকে শোনাতে গেছি সন্ধেবেলা। একটা লাইন ছিল, ‘শত আলোকবর্ষ পরে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল হে বিধাতা…’। ছোরা সঙ্গে-সঙ্গে হাঃ হাঃ করে হেসে বলে উঠল, আলোকবর্ষ কোনও বছর-টছর নয় মশাই, ওটা হল গিয়ে দূরত্ব।”

জ্যাঠামশাই দড়ি পাকানো বন্ধ রেখে চোখ পাকিয়ে বললেন, “বলেছে?”

“বলেছে। অনেকক্ষণ ছোঁকরার সঙ্গে তর্ক হল। রাত্তিরে গেলুম হাইস্কুলের চণ্ডীবাবুর কাছে। সায়েন্সের টীচার। খবর-টবর রাখেন। তা তিনিও মিনমিন করে যা বললেন তার অর্থ, ছোঁকরা নাকি খুব ভুল বলেনি। আলোর গতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল…”

“আমাদের আমলে বিরাশি ছিল। এখন তাহলে বেড়েছে।” ফুচুর জ্যাঠামশাই গম্ভীর হয়ে বলেন।

“তা বাড়তেই পারে। চাল-ডালের দাম বাড়ছে, মানুষের নির্বুদ্ধিতা বাড়ছে, আলোর গতি বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সেই গতিতে ছুটে এক বছরে আলো যতটা দূরে যায় ততটা দূরত্বকেই নাকি বলে আলোকবর্ষ।”

“বাব্বাঃ! পাল্লাটা তাহলে কতটা দাঁড়াচ্ছে?”

“সাতানব্বই হাজার সাতশ একষট্টি কোটি ষাট লক্ষ মাইল।”

ফুচুর জ্যাঠামশাই একটু ভাবিত হয়ে বলেন, “উঁহু উঁহু! অত হবে না। আমাদের আমলে আরও কিছু কম ছিল যেন! ষাট নয়, বোধ হয় চুয়ান্ন লক্ষ মাইল।”

সদানন্দ খেঁকিয়ে উঠে বলে, “ছ লক্ষ মাইল না হয় ছেড়েই দিলাম মশাই, কিন্তু প্রশ্নটা তো তা নয়। কবিতাটার কী হবে?”

“ওটা তো ভালই হয়েছে। আলোর দৌড়ের সঙ্গে কবিতার কী সম্পর্ক?”

“কথাটা কি তাহলে ভুল? শত আলোকবর্ষ পরে কি দেখা হওয়াটা অসম্ভব? আলোকবর্ষ যদি টাইম ফ্যাকটরই না হয়, তাহলে তো খুবই মুশকিল।”

ফুচুর জ্যাঠামশাই একটু ভেবে বলে ওঠেন, “এক কাজ করো। ওটা বরং ‘শত আলোকবর্ষ ঘুরে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হল হে বিধাতা..’ এরকম করে দাও। ল্যাঠা চুকে যাবে, কেউ আর ভুল ধরতে পারবে না। সায়েন্সও মরল, কবিতাও ভাঙল না।”

হঠাৎ সদানন্দর মুখ উজ্জ্বল হল। বলল, “এই না হলে সায়েন্সের মাথা! বাঃ, দিব্যি মিলে গেছে। শত আলোকবর্ষ ঘুরে..বাঃ!”

ঠিক এই সময়ে নাপিতভায়া নেপাল ফুচুর জ্যাঠামশাইয়ের দাড়ি চাঁচতে এল। মুখ গম্ভীর। জল দিয়ে গালে সাবান মাখাতে-মাখাতে খুব ভারী গলায় বলল, “ঘটনা শুনেছেন? ওঃ কী রক্ত! কী রক্ত! গয়েশবাবু! বুঝলেন! আমাদের তেলিপাড়ার গয়েশবাবু–”

ঠিক এই সময়ে পাশের রাস্তা দিয়ে তিনটে ছোট বড় মূর্তি দৌড়ে এল। গোপাল ক্ষুর হাতে একটু আঁতকে উঠেছিল। মূর্তি তিনটে থেমে গেল। একজন মোটা গলায় পেঁচিয়ে উঠল, “গয়েশবাবু খু-উ-ন! গয়েশবাবু খু-উ-ন!” তারপর আবার দৌড়ে চলে গেল।

“গয়েশ খুন হয়েছে? অ্যাঁ!” ফুচুর জ্যাঠামশাই গঙ্গাগোবিন্দ হাঁ করে রইলেন। গয়েশ তাঁর দাবার পার্টনার ছিল যে!

নেপাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে নাহয় হল। কিন্তু সুমন্তবাবুর আক্কেলটা দেখলেন। একটা গুহ্য খবর আস্তে আস্তে ভাঙছি, উনি হেঁড়ে গলায় পেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করে চলে গেলেন।”