কখনও ছাঁকনি জাল, কখনও ফাঁদি জালে রোজ এই সন্ধেবেলাটায় খালে মাছ ধরে লখাই। বেশিরভাগই চুনোপুঁটি। খালুই মাঝামাঝি ভরে গেলেই উঠে আসে। গোপালহাটির কুমোরপাড়ার খালধার বড় ভাল জায়গা নয়। কাছেপিঠে লোকবসতি নেই। চারদিক বড় বড় গাছের ছায়ায় হাকুচ অন্ধকার। বুক সমান আগাছায় চারদিক ছেয়ে আছে। তবে ভয় খেলে তো গরিবের চলে না।
আজ একটু দেরিই হয়ে গেল লখাইয়ের। অন্ধকারটা বেশ গাঢ়িয়ে গিয়েছে। শেষ দিকটায় একটা মাছের ঝাক চলে আসায় লখাই উঠে আসতে পারছিল না। খালুই আজ প্রায় ভরাভর্তি। লখাই ভারী খুশি। আজ যাহোক দুটো পয়সা আসবে হাতে।
তা এই খালধারে যাতায়াতের পথে লখাইয়ের সঙ্গে অনেকেরই দেখা হয়। শিয়াল, সাপ, বেজি, ভাম, বাদুড়। একদিন তেনাদের একজনের সঙ্গেও দেখা হয়ে গিয়েছিল। তেড়ে ঝড়জল হচ্ছিল সেদিন। আকাশও ঘনঘন ঝিলিক মারছিল। ওই অশ্বথ গাছটার তলায় একটা ঝিলিকের আলোয় দেখল, লম্বামতো কে একজন দাঁড়িয়ে আছে। দু’খানা ভীমলোচনে যেন লখাইয়ের দিকেই চেয়ে। ভয়ে রামনামটা অবধি ভুলে মেরে দিয়েছিল সেদিন। হাত-পায়ে সাড় ছিল না। চিড়বিড় করে কেবল বলছিল, “আরে, ওই যে কার যেন ছেলে, কী যেন নাম? আরে ওই তো বনবাসে গিয়েছিল যে লোকটা? ধুত্তোর, ওই যে হরধনু ভাঙল না! কী মুশকিল! নামটা যে পেটে আসছে, মুখে আসতে চাইছে না… দ্যাখো তো কাণ্ড…!”
একটু দূর থেকে একটা মোলায়েম খোনা গলা বলে উঠল, “আহা, রামনামের কথা ভাবছ তো? তা রামনাম তো ভাল জিনিস। কষে রামনাম করো তো হে, একটু শুনি।”
লখাই মহা ফঁপড়ে পড়ে গেল। ভূত যদি নিজেই রামনাম করে, তা হলে তো বড়ই মুশকিল! কাজকারবার চলবে কী করে? আতঙ্কে রামনাম ভুলে লখাই আঁ আঁ করে প্রাণপণে আর্তনাদ করে উঠেছিল। লম্বা ভূতটা তখন “আ মোলো যা, এ যে মুছে যায়!” বলে ভারী বিরক্ত হয়ে ফুস করে বাতাসে আর অন্ধকারে মিশে অদৃশ্য হয়ে গেল।
দিনসাতেক পরের কথা! সন্ধের মুখে মাছটাছ ধরে লখাই খাল থেকে ভেজা গায়ে উঠে সবে গুটিগুটি বাড়ির পথ ধরেছে, ফের সেই অশ্বত্থ গাছের তলায় ঝুঝকো আঁধারে সেই লম্বা ভূতকে দাঁড়ানো দেখতে পেল। লখাই “ওরে বাবা রে! ভূত…ভূত…!” বলে চেঁচিয়ে ছুটতে গিয়ে গাছের শিকড়ে পা আটকে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি। হাঁচোড় পাঁচোড় করে উঠতে গিয়ে সে ‘হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ করে রক্ত জল করা ভুতুড়ে হাসিটাও শুনতে পেল। লখাই ভেবে নিল, আজ আর রক্ষে নেই! সে হার্ট ফেল হয়ে মরেই যাবে বুঝি! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। দম নিতে আঁকুপাঁকু করছিল সে। হাওয়ায় একটা লাট খেয়ে লম্বা ভূতটা শূন্যে একটু ঝুলে থেকে বলল, “ওরে, এখানে আমিও এককালে মাছ ধরতাম কিনা!”
তবে ভেবে দেখলে ভয় পাওয়ারও একটা শেষ আছে। প্রায়ই ভয় খাওয়ার ব্যাপার হতে থাকলে ভয়টাও ক্ষয় হতে থাকে। কারণ, মাঝেমধ্যেই লম্বা ভূতটা হানা দিতে থাকায় লখাইয়ের ভয়টা ঘষা খেতে-খেতে একেবারে এইটুকুন হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে ঢ্যাঙা ভূতের সঙ্গে তার একটু-আধটু কথা চালাচালিও শুরু হয়। এই যেমন ঢ্যাঙাভূত একদিন জিজ্ঞেস করল, “তোর নাম কী রে?”
“লখাই। তোমার?”
“আমি হলুম বগা।”
“এই খালধারেই তোমার বাড়ি বুঝি?”
“আরে না! একশো বছর আগে গোঁসাইপাড়ায় আমাদের দু’খানা কুঁড়েঘর ছিল বটে, সেসব আর নেই। ওই যে বললুম, এই খালে রোজ বিকেলে আমিও মাছ ধরতুম। তারপর দিল একদিন মা মনসার বাহন ঠুকে। কেউটে!”
“আহা রে!”
“মরে গিয়ে দুঃখ আমারও হয়েছিল। তখন আমার কতই বা বয়স? এই তোমার মতোই হবে। বড়জোর কুড়ি-বাইশ। রাগের চোটে আমি সাপটার উপর চড়াও হলুম। তার গর্তে গিয়ে ঢুকে গলা চেপে ধরে বললাম, “ল্যাজে একটু পা পড়েছে বলেই কামড়াবি হতচ্ছাড়া? আমার খালুইভরা মাছ পড়ে রইল। তাঁকে বারো গন্ডা পয়সা পড়ে রইল, আমার বুড়ি মা হাঁ করে দাওয়ায় বসে রইল, কোন আক্কেলে বিষ ঢাললি রে বদমাশ?’ তা দেখলুম, সাপটা বাংলা কথা একদম বুঝতে পারল না। শুধু ফেসফাস করতে লাগল। বিশেষ পাত্তা দিল না।”
সেবার বর্ষার সময় খাল-বিল একাকার হওয়ায় বড় গাং থেকে খালে কামট ঢুকে পড়েছিল। লখাই তখন কোমরজলে নেমে মাছ ধরছে, ঠিক সেই সময় পিছন থেকে “লখাই, কামট! কামট! উঠে আয়।” বলে বগা চেঁচিয়ে হুঁশিয়ার করে দেওয়ায় অল্পের জন্য |||||||||| বেঁচে যায় লখাই। নইলে কামটটা তার পেটের মাংস প্রায় খুবলেই নিয়েছিল আর কী! তো তার পর থেকে বগার সঙ্গে তার দিব্যি ভাবসাব হয়ে যায়। মাঝে-মাঝে পাশাপাশি বসে দু’জনে সুখ দুঃখের কথাও কয়।
একদিন খুব চিন্তিতভাবে লখাই বলল, “আচ্ছা বগাদা, তোমার তো মোটে শরীরই নেই, তা হলে আছো কী করে?”
বগাও ভারী ভাবনায় পড়ে গিয়ে বলল, “সে কথাটা নিয়ে আমিও অনেক ভেবেছি, বুঝলি! কিন্তু ভেবে থই করে উঠতে পারিনি।”
“আচ্ছা, তোমার কি খিদে পায়?”
“না তো!”
“অসুখবিসুখ করে?”
“না।”
“ভীমরুলে হুল দিলে ব্যথা পাও?”
“উঁহু।”
“তা সেটা তো ভাল কথা। কিন্তু কী করে বর্তে আছো সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।”
“হু। হাওয়া-বাতাসের মতো একটা মিহিন জিনিস হয়ে গিয়েছি বলে মনে হয়।”
“কিন্তু সেখানেও কথা আছে। হাওয়া-বাতাস তো আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তোমাকে তো দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। তুমি ঢ্যাঙা, রোগা গড়ন, লম্বাটে মুখ, মাথায় ছোট-ছোট চুল। এমনকী, পরনে ধুতি আর গায়ে ফতুয়া পর্যন্ত আছে। একটু আবছা-আবছা বটে, কিন্তু দেখা তো যাচ্ছে!”
“কথাটা মন্দ বলিসনি। না থেকেও আছি কী করে, সেটা আমিও ঠিক বুঝতে পারি না। তুই বরং বিজয়বাবুকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখিস। তার মেলা বিদ্যে। দিনরাত রাশিরাশি কেতাবের মধ্যে ডুবে আছে। দেখবি, ঠিক ফস করে বলে দেবে।”
“ঠিক বলেছ তো! কথাটা আগে কেন মাথায় খেলেনি সেটাই ভাবছি।”