ওদিকে জয়পতাকাবাবুর কী হল সেটাও একটু দেখা দরকার।
একথা ঠিক যে, তিনি কালুকে নিরস্ত করতে গিয়ে প্রচণ্ড সাহস ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি যে স্পেনদেশে জন্মগ্রহণ করলে একজন প্রথম শ্রেণীর বুল ফাঁইটার হতে পারতেন, সে-বিষয়েও আর সন্দেহ থাকার কথা নয়। কালুকে তিনি নিরস্ত ও পরাস্ত করেও একেবারে শেষরক্ষাটা হয়নি। লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে কালু তাঁকে ঢু মেরে শূন্যে নিক্ষেপ করে এবং তিনি শূন্যে পুরোপুরি দুটো ডিগবাজি খান। এর পরের দৃশ্য যদিও জয়পতাকাবাবুর জয়ই ঘোষণা করে। দেখা যায় তিনি কালুর পিঠে সওয়ার হয়ে বসে আছেন এবং কালু ভীত ও বিস্মিত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ছুটছে।
দৃশ্যটা ভাল হলেও জয়পতাকাবাবুর কিন্তু এতে কোনও কৃতিত্ব নেই। কারণ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে কালুর পিঠে সওয়ার হওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর ছিল না। নেহাতই দৈবক্রমে তিনি কালুর পিঠের ওপর এসে পড়েন। কিন্তু লোকে তা জানে না। লোকে এও জানে না যে, কালুর তোয় জয়পতাকাবাবুর মাথায় এমনই এক সাঙ্ঘাতিক ঝাঁকুনি লাগে, যার ফলে তাঁর বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে যায় এবং তিনি স্মৃতিভ্রংশ হয়ে পড়েন।
কালু যখন তাঁকে পিঠে নিয়ে ছুটছে, তখন জয়পতাকাবাবু বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা কী হচ্ছে। তবে তিনি বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে পড়লেও স্বাভাবিক জৈব তাড়নায় ছুটন্ত কালুর পিঠ থেকে নামবার চেষ্টা করলেন না। বরং খুব আঁট হয়ে বসে রইলেন। বসে বসে তিনি চারিদিকের ছুটন্ত বাড়িঘর এবং লোকজন দেখতে লাগলেন। এটা কোন শহর তা তিনি বুঝতে পারছিলেন না, যদিও এই শহরেই তাঁর জন্ম। তিনি যে কে, তাও তিনি বুঝতে পারছিলেন না। পূর্বাপর কোনও ঘটনাই তাঁর মনে পড়ল না। তিনি শুধু বুঝতে পারছিলেন যে, এক বেগবান ষাঁড়ের পিঠে তিনি বসে আছেন। ব্যাপারটা তাঁর কাছে খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছিল। যেন তিনি রোজই ষাঁড়ের পিঠে চেপে ঘুরে বেড়ান। তাই তিনি হাসি-হাসি মুখ করেই বসে রইলেন। শুধু তাই নয়, রাস্তার দুধারে দাঁড়ানো যেসব লোক বিস্ময়ে এবং আতঙ্কে দৃশ্যটা দেখছিল, তাদের উদ্দেশে হাত নেড়ে অভিনন্দনও জানাতে লাগলেন।
কালুর জীবনে এরকম অভিজ্ঞতা আর হয়নি। এই শহরে সে ছিল একচ্ছত্র সম্রাট। এই অঞ্চলে আরও কয়েকটা ষাঁড় আছে বটে, কিন্তু তারা কেউ কালুর সমকক্ষ নয়। কালুকে তারা রীতিমত মান্যগণ্য করে, এমনকী নিজেদের ভাষায় হয়তো কাকা-জ্যাঠা বা ওস্তাদ কিংবা মহারাজ বলে ডাকেও। কালুকে খাতির না করেই বা কে? উঁতোর চোটে সে বহু লোককে ঢিট করেছে, স্বয়ং দারোগাবাবুকেও ছাড়েনি। এমনকী শ্যাম লাহিড়ীর খুনিয়া ডোবারম্যান কুকুরটা অবধি তাকে পথ ছেড়ে দেয়। কালুর পিঠে যখন একটা মাছিও বসবার আগে দুবার ভাবে, তখন এ লোকটা যে, কী করে উড়ে এসে জুড়ে বসল সেটাই কালুর মাথায় আসছে না। যতই ভাবছে কালু ততই এই হেনস্থা আর অপমানে আরও মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। আর আতঙ্কিত হয়ে সে ছুটছেও প্রাণপণে। আপদটাকে পিঠ থেকে না সরাতে পারলে তার শান্তি নেই।
ছুটতে ছুটতে কালু শহর পেরিয়ে এল। পথশ্রমে তার মুখ দিয়ে ফেনা উড়তে লাগল। তবু সে থামল না। সে পরিষ্কারই বুঝতে পারছে যে, শহরের অন্যান্য ষাঁড় আর তাকে আগের মতো মান্যগণ্য করছে না, লোকেরাও আর তাকে শিবের বাহন বলে কলটা-মুলোটা ভেট দেবে না। শ্যাম লাহিড়ীর ডোবারম্যান কুকুর এবার তাকে দেখলেই নিঘাত ইংরেজিতে ঘেউ ঘেউ করে দুয়ো দেবে। গায়ের জ্বালা জুড়োতে সামনে নদী দেখে কালু তাতে নেমে পড়ল।
নদীতে জল বেশি নেই। কালুর পেটটাও ভিজল না জলে। সে নদী পেরিয়ে ডাঙায় উঠল। সামনে পটাশগড়ের ভয়াবহ জঙ্গল। এই জঙ্গলে ঢুকবার আগেই বাঘের গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়। তা ছাড়া আরও কত হিংস্র জানোয়ার আছে। ভালুক, চিতা, গণ্ডার, বুনো শুয়োর, বন্য কুকুর আর মোষ।
পটাশগড়ের আরও নানা বদনাম আছে। তবে কালু সেগুলো জানে না। সে বাঘের গায়ের গন্ধটা অবশ্য ভালই টের পায়। বাঘ হল পশুর জগতে গুণ্ডা বলো গুণ্ডা, মস্তান বলো মস্তান। তাই অতীতে অনেকবার ধারেকাছে এলেও কালু পটাশগড়ের জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পায়নি। কিন্তু আজ তার মাথার ঠিক নেই। পিঠের বিচ্ছিরি বোঝাটাকে না নামালেই নয়। পটাশগড় ঘন জঙ্গল। লুতায়-পাতায়, গাছপালায় একেবারে নিচ্ছিদ্রই বলা যায়। কোনও একটা ফাঁক দিয়ে একবার জঙ্গলে ঢুকতে পারলে ডালপালায় আটকে লোকটা তার পিঠ থেকে পড়বেই।
কালু জানে না, পটাশগড়ের জঙ্গলে শুধু সে কেন, অমন বাঘা শিকারি শ্যাম লাহিড়ী অবধি একেবারের বেশি দুবার ঢোকেনি। জঙ্গলের ভিতরে ভুতুড়ে জলা, চোরাবালি, গভীর খাদ সবই আছে। আছে জোঁক, সাপ, বিছে, তা ছাড়া আর যা আছে তা
নিয়ে লোকে বেশি উচ্চবাচ্য করে না। কিন্তু জায়গাটা সবাই এড়িয়ে চলে। এমনকী কাঠুরে বা পাতাকুড়নি বা মউলিরাও বড় একটা এদিকপানে আসে না। এসব জানে না বলেই কালু তার পিঠের অনভিপ্রেত সওয়ারটিকে নিয়ে সবেগে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।
জয়পতাকাবাবুর স্মৃতিভ্রংশ হলেও জৈবিক বুদ্ধি লোপ পায়নি। তিনি ঘন ডালপালা দেখেই কালুর পিঠে সটান শুয়ে পড়লেন উপুড় হয়ে। তাতে খুব একটা লাভ হল না। সন্ধের আবছা আঁধার নেমে এসেছে বাইরে। আর জঙ্গলের ভিতরটা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। সবেগে নানা গাছের ডাল হেডসারের বেতের মতো জয়পতাকাবাবুর পিঠে এবং হাতে-পায়ে এসে লাগছিল। তিনি উঃ-আঃ করতে লাগলেন। কালু আরও ভিতরে ঢুকে পড়তে লাগল। সপাং করে পিঠে একটা কচি বাঁশের ডগা লাগতেই জয়পতাকাবাবু ‘গেলাম’ বলে মাথাটা যেই তুলেছেন, অমনি গদাম করে একটা মোটা গাছের ডাল তাঁর কপালে এসে লাগল। জয়পতাকাবাবু মাটিতে ছিটকে পড়ে গেলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে কে যেন কাছ থেকেই ভারী মোলায়েম গলায় বলে উঠল, “আসুন! আসুন! কী ভাগ্য আমাদের!”
জয়পতাকাবাবু কপালটা চেপে ধরে খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, তিনি জয়পতাকাবাবু।
নামটা মনে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাদবাকি সবকিছুই সিনেমার ছবির মত তাঁর মনে পড়ে যেতে লাগল। মনে না পড়লেই অবশ্য ভাল ছিল, কারণ তাঁর এও মনে পড়ল যে, এই সেই ভয়াবহ মনুষ্যবর্জিত রহস্যময় পটাশগড়ের জঙ্গল। মনে পড়ার সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর গায়ে কাঁটা দিল ভয়ে। কার গলা একটু আগে শুনলেন তিনি? জয়পতাকাবাবু চারিদিকে তাকাতে লাগলেন। নিশ্চিদ্র
অন্ধকারে জোনাকি জ্বলছে। গাছপালায় বাতাসের সরসর শব্দ হচ্ছে। একটা হুতোম প্যাঁচা আর একঝাঁক শেয়ালের ডাক শোনা গেল। একটা কেমন বোঁটকা গন্ধও পাচ্ছেন জয়পতাকাবাবু।
তাঁর ভরসা এই যে, কাছাকাছি মানুষ আছে। একটু আগেই ভারী বিনয়ী আর মোলায়েম একটা মনুষ্যকণ্ঠ তিনি শুনতে পেয়েছেন।
জয়পতাকাবাবু গা’টা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “কে? কেউ কি আছেন কাছাকাছি?”
কেউ কোনও জবাব দিল না। তবে চাপা হাসির একটা ভারী ক্ষীণ শব্দ শুনতে পেলেন জয়পতাকা। গায়ে আবার কাঁটা দিল। যতদূর জানা যায় সাহেবশিকারিরা অবধি এই জঙ্গলকে এড়িয়ে চলত। ডাকাবুকো শ্যাম লাহিড়ী একবার ঢুকেছিলেন। কী হয়েছিল কে জানে। শ্যাম লাহিড়ী ভারী চাপা স্বভাবের গম্ভীর মানুষ। কাউকে সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেননি। তবে নিজে আর কখনও ঢোকেননি এই জঙ্গলে।
জয়পতাকা খানিকক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকটা অন্ধকারে অনুভব করার চেষ্টা করলেন।
জঙ্গলটা শহরের উত্তর দিকে। সুতরাং তিনি যদি দক্ষিণ দিকে এগোন, তা হলে একসময়ে জঙ্গলের বাইরে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন, কিন্তু দিক ঠিক পাবেন কী করে? এই ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নিজের হাতের তেলো অবধি দেখা যাচ্ছে না যে! সুতরাং তিনি ঠিক করলেন নাক বরাবর এগিয়ে যাবেন। এক জায়গায় স্থির হয়ে থেকে এগনোই ভাল। পটাশগড়ের জঙ্গলে রাত কাটানোর কথা ভাবাই যায় না।
জয়পতাকা যেই পা বাড়িয়েছেন অমনি সেই মোলায়েম গলা যেন বলে উঠল, “ঠিকই যাচ্ছেন।”
গলাটা এত ক্ষীণ আর এত দূর থেকে এল যে, সেটা আসলে গলা না মনের ভুল তা বুঝতে পারলেন না জয়পতাকা। তবে তিনিও ভারী বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনি যদি আমাকে একটু সাহায্য করেন তবে ভারী ভাল হয়। বড় বিপদে পড়েছি।”
একথার কেউ জবাব দিল না। জয়পতাকা কিছুক্ষণ অপেক্ষা। করে হতাশ হয়ে এগোতে লাগলেন। বন-জঙ্গলে এগনো ভারী শক্ত। পদে পদে বাধা। ঝোঁপঝাড়, কাঁটাগাছ, লতাপাতা সবই পথ আটকায়। পায়ে লতা জড়িয়ে দু’বার মুখ থুবড়ে পড়লেন জয়পতাকা। তবে নিচে গাছের পাতা আর লম্বা ঘাসের নরম আস্তরণ আছে বলে তেমন ব্যথা পেলেন না। একবার খুব কাছ দিয়ে একটা মস্ত বড় প্রাণী দৌড়ে চলে গেল। দুবার ক্রুদ্ধ বাঘের গর্জন শুনতে পেলেন দূর থেকে।
বুকটা ভারী ঢিবঢিব করতে লাগল কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আজ বিকেলে যে দুঃসাহসের সঙ্গে উনি খ্যাপা ষাঁড়ের মোকাবিলা করেছেন, সেই সাহসের কিছু তো এখনও অবশিষ্ট আছে। সেই সাহসে ভর করেই জয়পতাকা এগোতে লাগলেন। এগনোর পথে কোনও বাধাই তাঁকে আটকাতে পারছিল না। হঠাৎ খানিকটা স্যাঁতসেঁতে জমি পেলেন পায়ের তলায়। কয়েক পা এগোতে ভচাত্ করে হাঁটু অবধি ডুবে গেল কাদায়। তারপর কোমর অবধি বরফ-ঠাণ্ডা জল। জয়পতাকা পরোয়া না করে শীতে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে গতি বজায় রাখলেন। অবশ্য এটা ঠিক শীতকাল নয়। শরৎকাল। তবু এইসব পাহাড়ি অঞ্চলে একটু ঠাণ্ডাই পড়ে যায় এসময়ে। জয়পতাকা শীত প্লাস ভয় প্লাস উৎকণ্ঠাতেও কাঁপছেন। হঠাৎ সামনে ভুশ করে একটা নীলচে আলো লাফিয়ে উঠল শুন্যে। ভুতুড়ে লণ্ঠনের মতো কিছুক্ষণ নিরালম্ব হয়ে দুলতে লাগল। তারপর নিবে গেল। ফের একটু দূরে আর-একটা আলো লাফিয়ে উঠল। অন্য কেউ হলে এই কাণ্ড দেখে চেঁচাত। জয়পতাকা আলেয়ার কথা জানেন। তাই চেঁচালেন না। যদিও প্রথম আলেয়াটা দেখে তাঁর চেঁচাতে ইচ্ছে। হয়েছিল।
জলা পার হতেই অনেকক্ষণ সময় লাগল। জয়পতাকা যেন পরিশ্রান্ত বোধ করছেন। জলা থেকে ডাঙায় উঠে একটু জিরিয়ে নেবেন কি না ভাবছেন, এমন সময় সেই মোলায়েম কণ্ঠস্বর বাতাসের ফিরফিসানির মতো বলে উঠল, “এখন যে নষ্ট করার মতো সময় নেই। সাহেবের ডিনারের সময় হয়ে এল।”
কথাটার মানে কিছু বুঝতে পারলেন না জয়পতাকা। তবে বসতে তাঁর আর সাহস হল না। কোমরের লাল সালুটা খুলে হাত-পা একটু মুছে নিয়ে ফের এগোতে লাগলেন। ধুতি-পাঞ্জাবি জলে ভিজে শপশপ করছে। দিগভ্রান্ত, শ্রান্ত, ক্লান্ত জয়পতাকা চলতে লাগলেন।
আচমকাই অন্ধকারে একবার পা বাড়াতেই তিনি টের পেলেন, সামনে মাটি নেই। পা’টা টেনে নেওয়ার একটা শেষ চেষ্টা করলেন উনি। কিন্তু স্পষ্ট টের পেলেন কে যেন তাঁকে পিছন থেকে একটু ঠেলে দিল। জয়পতাকা একেবারে লাট খেয়ে-খেয়ে এক বিশাল খাদের মধ্যে হুহু করে পড়ে যেতে লাগলেন।
পড়ছেন আর ভাবছেন, এটা কি ঠিক হয়েছে? আজই যে লোকটা অমন খ্যাপা কালু ষাঁড়কে জব্দ করল তার প্রতি ভগবানের এ কি বিচার? তবে কি কিছু লোক ঠিক কথাই বলে? কালু কি তা হলে সত্যিই শিবের ষাঁড়? তার পিঠে সওয়ার হওয়া কি আমার উচিত হয়নি।
পড়তে অনেকটা সময় লাগছিল জয়পতাকাবাবুর। সেই ফাঁকে তিনি একটা হাই তুললেন এবং একবার আড়মোড়াও ভেঙে নিলেন। তারপর দ্বিতীয় হাইটা তুলতে গিয়ে একটা ধপাস শব্দ শুনলেন এবং শরীরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি লাগল। বুঝলেন যে, তিনি পড়েছেন। তবে বেঁচে আছেন কি না বুঝতে পারছেন না, খাস অবশ্য চলছে। বুকটাও ঢিবঢিব করছে।
খাদের মধ্যে অন্ধকার আরও জমাট, আরও নীরেট। জয়পতাকা চারদিক হাতড়ে হাতড়ে বুঝতে পারলেন, তিনি পড়েছেন রাজ্যের জমে থাকা শুকনো নরম পাতা আর পচা ডালপালার ওপর। সেটা এতই নরম যে, ফোমরবারের গদিকেও হার মানায়। জয়পতাকাবাবুর ইচ্ছে হচ্ছিল, এখানে শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেন।
কিন্তু সেই মোলায়েম কণ্ঠস্বর এখানেও সঙ্গ ছাড়েনি। বলে উঠল, “ডিনারের গং বেজে যাবে যে; সাহেব ভারী রাগ করবেন।”
কণ্ঠস্বরটি যারই হোক লোকটি হয়ত তেমন খারাপ নয়। তা ছাড়া ডিনারের কথাও বলছে। জয়পতাকার পেটে এখন দাউদাউ খিদে। সুতরাং একটু দম নিয়ে তিনি খাদ থেকে উদ্ধারের ফিকির ভাবতে লাগলেন। আপাতদৃষ্টিতে এই গভীর খাদ থেকে উদ্ধারের কোনও পন্থাই নেই। যদিও বা থাকে, এই অন্ধকারে তা খুঁজে পাওয়ার ভরসা নেই। লতাপাতা বেয়ে যদি ওপরে উঠতে হয় তা খুঁজে পাওয়ার ভরসা নেই। লতাপাতা বেয়ে যদি ওপরে উঠতে হয় তা হলেও জয়পতাকা পেরে উঠবেন না। তাঁর গায়ে আর জোর নেই। জীবনেও তিনি ব্যায়াম-ট্যায়াম করেননি। কেবল বই পড়েছেন।
“এগোলেই হবে, পথ পেয়ে যাবেন।” সেই মোলায়েম গলাটি বলল। জয়পতাকা সুতরাং ব্যাজার মুখ করে এগোলেন। সরু খাদ লম্বা একটা গলির মতো। কোনও সময়ে ভূমিকম্পের ফলে মাটিতে গভীর ফাটল ধরেছিল। সেটাই এখন হাঁ করা খাদ। দু’দিকে হাত বাড়ালেই এবড়োখেবড়ো দুটো দেওয়ালই স্পর্শ করা যায়। জয়পতাকা এরোপ্লেনের মতো দুদিকে হাত বাড়িয়ে সাবধানে এগোতে লাগলেন। দশ বারো পা হাঁটতেই ডান-ধারে আর-একটা গলি। কে যেন সেই গলির ভিতর থেকে চাপা গলায় বলে উঠল, “আসুন, এই পথ।”
জয়পতাকা অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে ঢুকে পড়লেন গলির মধ্যে। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু পায়ের নিচে বেশ মসৃণ মাটি।
একটা ঢালু বেয়ে ধীরে-ধীরে ওপরের দিকে উঠে গেছে।
কতক্ষণ ধরে যে হাঁটতে হল তা জয়পতাকার হিসেব নেই। হাঁটছেন তো হাঁটছেনই। পথ আর ফুরোচ্ছে না। জয়পতাকার বুদ্ধি-বিবেচনা তেমন কাজ করছে না। মাথাটা কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া লাগছে। ধকল তো বড় কম যায়নি। তিনি যন্ত্রের পুতুলের মতো হাঁটতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়লেন।
হঠাৎ মনে হল, পথ শেষ হয়েছে। সামনে ফাঁকা জমি। চোখ কচলে জয়পতাকা চাইলেন। দেখলেন, বেশ মাখোমাখো একটু চাঁদের আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে ঝোঁপঝাড় থাকলেও তেমন বড় গাছপালা নেই। আর জ্যোৎস্নায় অনেকটা বালিয়াড়ি চিকচিক করছে।
জয়পতাকা আরও কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। দৃশ্যটা খুবই রহস্যময়। বালিয়াড়ির ঠিক মাঝখানে একটা বাড়ির মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। বেশ বড় বাড়ি। তবে অন্ধকার। জ্যোৎস্নায় সেটাকে ধ্বংসপ্প বলেই মনে হতে লাগল তাঁর।
জঙ্গলের মধ্যে হরিণের গলা ঝাড়বার মতো বিশ্রী ‘হ্যাক হ্যাক’ ডাক শুনতে পেলেন। তারপরই চাপা একটা গর্জন। এক শিঅলা হরিণ তীরবেগে পিছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বালিয়াড়িতে পড়ে ছুটতে লাগল। কিন্তু দশ কদমও যেতে পারল না। জয়পতাকা বিস্ময়ে গোলাকার চোখে দেখলেন হরিণটার চারটে পা বালিতে বসে গেল। তারপর পেট অবধি, তারপর সমস্ত শরীরটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডে অদৃশ্য হয়ে গেল বালির তলায়। একটা চিতা বাঘ বালিয়াড়ির ধারে কিছুক্ষণ পায়চারি করে আবার জঙ্গলে ঢুকে গেল।
জয়পতাকা শুকনো মুখে একটা ঢোঁক গিললেন, এই সাঙ্ঘাতিক চোরাবালির মাঝখানে বাড়ি তৈরি করেছিল কে? কীভাবেই বা করল?
হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল। পটাশগড় নামটা যা থেকে হয়েছে তা আসলে একটা কেল্লা। এই কেল্লার নামই পটাশগড়। শোনা যায় সাধারণত কেল্লার চারধানে পরিখা থাকে, পটাশগড়ের চারধারে পরিখা ছিল না ছিল চোরাবালি। কেল্লা যারা আক্রমণ করতে আসত তাদের সমাধি রচিত হত চোরাবালিতে। পটাশগড়ে তাই বাইরের শত্ৰু কখনও ঢুকতে পারত না। কিন্তু এ-গল্প কিংবদন্তি বলে জয়পতাকা বিশ্বাস করেননি। তা হলে কি এই সেই কুখ্যাত পটাশগড়?
জয়পতাকা অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইলেন। চারদিকে হাহাকারের মতো চোরা বালিয়াড়ি। মাঝখানে একটা ধ্বংসস্তূপ,
কী অদ্ভুত দেখাচ্ছে মৃদু জ্যোৎস্নায়!
“ডিনারের আর দেরি নেই। সময় হয়ে এল।”
জয়পতাকা চারদিকে এস্ত হরিণের মতো তাকালেন। ফাঁকা জায়গা, কেউ লুকিয়ে থাকলেও আন্দাজ করতে পারবেন। কিন্তু কেউ কোথাও নেই। ফের যখন বাড়িটার দিকে ফিরে তাকালেন জয়পতাকা, তখন তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। ধ্বংসস্তূপ আর নেই। সেই জায়গায় ছোট্ট একটা দোতলা কেল্লা যেন দুধে স্নান করে ঝকঝক করছে। ঘরে-ঘরে বাতি জ্বলছে। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে!
“যান, সামনেই রাস্তা। সাহেব অপেক্ষা করছেন।”
“কে আপনি?” হুঙ্কার দিলেন জয়পতাকা।
কেউ জবাব দিল না। একটা দমকা বাতাস হা হা করে বয়ে গেল শুধু।
জয়পতাকা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। কিন্তু পারলেন। পায়ে-পায়ে তিনি এগিয়ে যেতে লাগলেন সম্মোহিতের মতো।
আশ্চর্যের বিষয়, তিনি বালিয়াড়িতে নামবার আগেই একটা শেয়াল কোত্থেকে এসে তাঁর আগে নেমে পড়ল। তারপর তাঁর দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চেয়ে দুলকি চালে চলতে লাগল।
চোরাবালিতে শেয়ালটা ডুবল না।
জয়পতাকা শেয়ালটার পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। পায়ের নিচে বেশ শক্ত আঁট বালি। কোথাও তেমন ভুসভুসে নয়। তা হলে কি ধরে নিতে হবে যে, চারদিকে চোরাবালি থাকলেও কেল্লায় যাওয়ার একটা রাস্তা আছে? জয়পতাকা তাঁর পকেট থেকে একটা কাঁচা টাকা বের করে পাশে দেড়ফুট তফাতে ছুঁড়ে দিলেন। সেটা ভুস করে ডুবে গেল। জয়পতাকা তাঁর শস্তার কলমটাও ছুঁড়ে দিয়ে পরীক্ষা করলেন। সেটাও চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
বেশ বোঝা যাচ্ছিল চোরাবালির ভিতর দিয়ে একটি সরু চোরাপথ রয়েছে কেল্লার যাওয়ার জন্য। সেটা হাতখানেকের চেয়ে বেশি চওড়া নয়। বেভুলে একটু এদিক-ওদিক পা ফেললেই বেমালুম বালির মধ্যে গায়েব হয়ে যেতে হবে। জয়পতাকা শেয়ালটার পিছু পিছু চলতে লাগলেন। কেল্লার জমিতে যখন পা রাখলেন, তখন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় তাঁর ঘাম হচ্ছে।
কিন্তু চারদিকে বালিয়াড়ির মধ্যে চমৎকার মরুদ্যানের মতো বাগান দেখে জয়পতাকার প্রাণ জুড়িয়ে গেল, ভারী সুন্দর বাগান। পাথরে বাঁধানো ফোয়ারা থেকে জল ছড়িয়ে পড়ছে গোল পাথরের চৌবাচ্চায়। কেল্লাটি বেশ ছোট। শ্বেতপাথরের চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। সামনেই সিংহদরজা। জয়পতাকা নির্বিঘ্নে সিংহদরজায় পৌঁছে চারদিকে চাইলেন। কোনও পাহারাদার নেই। মানুষজন নেই। কিন্তু ভিতরে ঘরে-ঘরে ঝাড়বাতির উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। একটা পিয়ানোর মিষ্টি শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ক্ষুধাতুর ক্লান্ত জয়পতাকা ভিতরে ঢুকলেন।
“আসুন, আসুন, ডান দিকে ডাইনিং-হল। ঢুকে পড়ন!” সেই মোলায়েম গলা।
জয়পতাকা চারদিকে আবার চাইলেন। কেউ নেই। ডান দিকে একটা টানা চওড়া বারান্দা। ঝকঝক করছে পরিষ্কার। বারান্দা পেরিয়েই মস্ত লম্বা ডাইনিং-হল। অন্তত পঞ্চাশজন বসে খেতে পারে এত বড় মেহগনির টেবিল। তার ওপর মোমদানিতে সার সার মোম জ্বলছে। ওপরে জ্বলছে অন্তত দশটা ঝাড়বাতি। টেবিলের ওপর থরেথরে খাবার সাজানো। গন্ধে বাতাস ম-ম করছে। কিন্তু কেউ নেই।
জয়পতাকা থমকে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ একটা শব্দ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, টেবিলের চারধারে সাজানো চেয়ারের মধ্যে একটা চেয়ার কে যেন পিছনে টেনে সরিয়ে দিয়েছে।
“বসুন। ডিনারের সময় হয়েছে।” সেই বিনয়ী গলা। হঠাৎ একটি মিষ্টি গং বেজে উঠল অলক্ষ্যে।
জয়পতাকা সম্মোহিতের মতো টানা চেয়ারটায় বসলেন। ভারী অস্বস্তি হচ্ছে। গা-ছমছম করছে। আবার খিদেও ভয়ানক। একটু দ্বিধাগ্রস্ত হাতে তিনি চামচ তুলে নিলেন। তারপর খাওয়া শুরু করলেন।