২. একটি প্রাচীন রহস্য

দুই – একটি প্রাচীন রহস্য

হেরু ছিল জাতে বাউরি। কলটন সায়েবের মাপে ছ ফুট ছ ইঞ্চি উঁচু। রেলকোম্পানির তার ওজন ছিল পাক্কি দুমণ আট সেরের কিছু বেশি। বায়ুমণ্ডল থেকে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য অনেকখানি অক্সিজেন খরচ হত। তার অতিকায় শরীরের জন্যে অনেকটা স্পেস দরকার হত। দুটো বড় বড় হাত হাঁটুঅব্দি ঝুলিয়ে যখন সে রাঙামাটির ঝিল থেকে সন্ধেবেলা উঠে আসত, কাচ্চাবাচ্চারা ভয় পেয়ে যেত। ভিনগাঁয়ের লোকেরা গাঁয়ে ফিরে বলত—কর্ণসেনের রাজবাড়িডাঙায় স্বচক্ষে দানো দেখলাম। ঝুঝকি সন্ধেবেলা। যেন পাহাড়ে পুরুষ উদয় হল হঠাৎ। অ্যাদ্দিন কানেই শুনতাম, আজ দেখলাম।

কিন্তু মানুষ হিসেবে এত নরম শান্ত আর হাসিমুখ ছিল না তার মতো। কান টানলেও রাগত না হেরু। দুচার থাপ্পড় গেরস্থ তাকে অবলীলাক্রমে যখন তখন দিয়েছে। মিষ্টি কথায় তাকে দিয়ে অবিশ্বাস্যরকমের বেগার খাটানো গেছে। তল্লাটে কোথাও বিপাকে গোরুমোষের গাড়ির চাকা আটকালে হেরুর ডাক পড়েছে। গোরাংবাবু বলতেন, শালা বাউরিটা জ্যান্ত কপিকল।

একবার হল কী, গোবরহাটির বাবুবাড়ির এক বউঠাকরানকে দিতে আসছিল স্টেশনে—পালকি চাপিয়ে। বাঁকী নদী তো নৌকায় পেরোন গেল, হাউলিখালে পাঁকেকাদায় একবুক জল। জোড়ডোঙাটা কে নিয়ে পালিয়েছে। এখন উপায়? উপায় হেরু বাউরি। তারই স্বজাতি এক বেহারা ছিল দলে। হাউলি পেরিয়ে সে রেললাইন টপকে হন্তদন্ত হাজির হল রাঙামাটি। হেরু এল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু পালকি—তার ধরবে কোথা? একদিক ধরলে অন্যদিকে জল ছোঁয়। তখন বাবুমশাই বললেন, বরং পালকি থাক। বাবা হারাধন (হেরুর আসল নাম নাকি) বউমাকে তুই পার করে দে—খালি হাতপায় এখন স্টেশন যেতে পারলে বাঁচি! ট্রেনের সময় হয়ে এল রে!

 হেরু এই গল্পটা বরাবর করেছে। গল্পটা বলার আগে বড় বড় হলুদ দাঁত বের করে খিক খিক খিক খিক প্রচুর হেসেছে। একটু লাজুক দেখিয়েছে তাকে।… মাইরি, তুলতুলে গা, একদলা মাখন, (মাখন সে চোখে দেখেছে কি না লোকের সন্দেহ আছে জেনে তখুনি অন্য উপমায় গেছে)… কী বলব, যেন একদলা উল—ময়দার লেচি, উঃ সে কী বলব গো, টিপলে তরমুজের মতন আঙাপনা (রাঙামতো) রস গড়ায়, কী বলব…খিক খিক খিক খিক… বাবুরা… মাইরি বাবুরা কী সুখে বাঁচে।

হাসলে মনে হয় শালার গুয়োর ডিমটি ভাঙেনি।… গোরাং ডাক্তার বলতেন।

পশ্চিমের রাঢ় অঞ্চল থেকে ব্যাপারীরা গোকর্ণ—আঁরোয়া কাঁচা রাস্তায় ধান চাল খন্দ পাট হরেক পণ্য গোরুমোষের গাড়িতে নিয়ে আসে। কোদলার ঘাটে গঙ্গা পেরিয়ে চলে যায় বেলডাঙার বাজারে। বাঁকী নদী পেরোনো যদি বা গেল, হাউলিতে এসেই বিপত্তি বারোমাস। কাদা শুকোয় না সোঁতার। সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। এক মাইল দূরে স্টেশনধার থেকে শোনা যায় গাড়োয়ানের প্রচণ্ড চেঁচামেচি। হন্দে হন্দে হন্দে… লে লে লে লে… হেই হা হা হা হা…ধো ধো ধো ধো…

বেচারা অবলা জন্তুগুলো চেষ্টার কসুর করে না। হাঁটু দুমড়ে গোঙায়। বড় বড় চোখ ফেটে সাদা পর্দা ঠেলে আসে। চাকায় কাঁধ লাগায় গাড়োয়ান। গতিক বুঝে ব্যাপারীও জামা খুলে মালকোঁচা মেরে নেমে পড়ে পাঁকে। রে রে রে রে… হদ্দে হদ্দে হদ্দে। না, চলে যা রাঙামাটি। হেরুকেই ডেকে আন।…

এই বিপত্তির সময় অবধারিত সন্ধেবেলা। দিনের রোদ্দুর থেকে বাঁচতে বিকেলে গাড়ি ছেড়েছিল। ‘দিন সবরে’ হাউলি পেরোতেই হবে, এমনতরো তাগিদও ছিল। তত্রাচ যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়।

হ্যাঁ, সত্যিসত্যিই বাঘ। গোবরহাটি পাতেণ্ডা থেকে পুবে বাঁকীর দিকে নিম্নভূমিতে নামলেই দুধারে বিল খাল আর ঘন জঙ্গল। আঁরোয়ার জঙ্গলের নামডাক কম নয়। ১২৭০ সালে জেমো—কান্দির রাজারা এখানে হরিণ মেরেছিলেন। এখন আর হরিণ নেই। কিন্তু বাঘ আছে। হরেক রকম জন্তু আছে। বন্দুক কাঁধে দু—চারজন দিশি—বিলিতি সায়েব আর আমল—ফয়লা সম্বচ্ছর চিরোটি স্টেশনে রেলগাড়ি থেকে নামছেই। কে জানে, কী মারতে পারে, বাঘ না খেঁকশেয়ালের ছানা। তবে বাঘ আছেই। হাউলির সোঁতায় পাওট পড়ে প্রায়ই। স্টেশন থেকে রাতদুপুরে তার ডাক শোনা যায়। রেললাইনের ধারের জঙ্গলে ডেকে বেড়ায় কখনো—সখনো। যে রাতে হেরু প্রথম ডাকাতি করে, ডাবকইয়ের ওদিকের ফটকের সামনে একজোড়া বাঘ একটা মালগাড়িকে এক ঘণ্টা আটকে রেখেছিল।

সন্ধেবেলা হেরুর আড্ডা গোরাংবাবুর ডাক্তারখানার বারান্দা। হাউলির ওদিক থেকে চেঁচামেচি ভেসে এলেই গোরাংবাবু বলেন, ওই বেধেছে! হেরু, তৈরি হ বাপ!

হেরু তৈরি। বেশ খানিক রাত হলে গায়ে কাদা মেখে ভূত হয়ে ডাক্তারখানার পিছনের পুকুরটাতে—

গোরাংবাবু সবে খেতে বসেছেন, হঠাৎ প্রচণ্ড ঝপাংঝপ আওয়াজ জলে—শুনেই মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেন, অ মা স্বর্ণ, স্বর্ণলতা!

স্বর্ণলতা কুপিহাতে হেঁসেল থেকে বেরিয়ে বলে—কী হল?

—হাঁড়িতে দুচাট্টি আছে রে?

—কেন?… স্বর্ণ ঝেঁঝে ওঠে। তেজি মেয়ে।… ভাত অত সস্তা নাকি? যাদের গাড়ি ঠেলছে তারা দ্যায়না কেন? দ্যায় না যদি, গাড়ি ঠেলতেই বা যায় কেন? তোমার দত্যি পোষার বড়লোকি শখ দেখে বাঁচিনে!

স্বর্ণ টের পায়। ওরে বাস রে! হেরুর গ্রাস দেখলে শরীর শিওরে ওঠে। একসের চালের ভাত না গিললে ওর চলেই না। তাকে খাওয়াতে চায় এক আনা ভিজিটের গোরাং ডাক্তার!

ভাবে একখানা ভিজিট—কিন্তু তাই বা কে দ্যায় বাবাকে? একফালি কুমড়ো কী দুটো বেগুন, নয়তো এককাঠা চাল—তাও রোগ কমতির দিকে যাচ্ছে দেখলে, তবেই। তার অমন দত্যি খাওয়ানোর বাতিক দেখে পিত্তি জ্বলে যায় না?

 গোরাংবাবু কাঁচুমাচু মুখে বলেন—স্বর্ণ, একমুঠো হলেই হবে মা। আজ বড়মুখ করে চাইছিল সন্ধেবেলা, কথাও দিয়ে ফেলেছি। ওই শোন, চান করতে নেমেছে। এক্ষুনি এসে পড়ল বলে। ও মা স্বর্ণলতা!…

স্বর্ণ চ্যাঁচায়—তার চেয়ে একটা কুকুর পোষ। কাজ দেবে।

হেরু দিব্যি আশা নিয়ে আসছিল। আজ ন’খানা গাড়ি ঠেলে পেয়েছে এককাঠা ধান, আট কাঠা ছোলা, এক ডেলা গুড়—একটা গুড়ের গাড়িও ছিল। লোকে এত ঠকায় ওকে। হেরু কি বোঝে না সেটুকু? বুঝেও কী বলবে! আহা, বড় বিপদে পড়েছে বেচারারা—গতর খাটিয়ে এট্টুকুন করলামই বা উবকার।

স্বর্ণ আবার তেড়ে ওঠে—চুপ করে থাকো তো। আ তু বলে ডাকলেই আসবে—আমি লম্ফ নিয়ে খুঁজতে যাব? বাঃ, বেশ বলছ।

গোরাংবাবু কান খাড়া করেই আছেন, হেরু আর আসে না। কতক্ষণ পরে উঠে বাইরে বেরোন। মলোচ্ছাই গেল কোথা লোকটা? বড়মুখ করে বলেছিল—আজ এবেলা একমুঠো খাব ডাক্তারবাবু।

প্লাটফর্মে মিটিমিটি পিদীম জ্বেলেছে। আপ বারহারোয়া প্যাসেঞ্জার আসবার সময় হল। আলোর ঝিলিক পড়েছে লোহার পাতে। চকচক করছে রুপোর মতো। তাকে নিমেষে কালো করে চলে গেল একটা নিঃশব্দ ইঞ্জিনের মতন প্রকাণ্ড লোক। কেন গেল?

রাগে দুঃখে মেয়ের ওপর ফেটে পড়তে চেয়েছে গোরাং ডাক্তার। কিন্তু কী আর করা! মা মরা মেয়ে—তার ওপর বিধবা হল কপাল ভেঙে। জোরজারি করবে বা দুদশ কথা চটেমটে বলবেই বা আর কাকে—এই বাপটি ছাড়া?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে কতক্ষণ অন্ধকার বটতলায় দাঁড়িয়ে থেকেছে গোরাংডাক্তার। … মানুষ যেখানেই জন্মাক, মানুষ ভগবানের সন্তান। মানুষকে ছোট ভাবতে নেই। হেরুকেও আমি ছোট ভাবিনে। এ পোড়ো নিঃঝুম চুপচাপ জায়গা এসে মানুষকে খুব প্রয়োজনীয় লাগে। সন্ধে থেকে আর রাত কাটে না কিছুতেই। ঘুমের মাথা তো কবে খেয়ে বসে আছি। সারা রাত জেগে কাটানো যে কী অভিশাপ, কে বুঝবে? খাঁ খাঁ শ্মশানে এসে জুটেছিল তার ওপর। কথা বলার মানুষ যা পাই, সে দিনের বেলা। সন্ধে হতে—না—হতেই নানারকম ভয়ে যে—যার গাঁয়ে চলে যায়। যে যার ঘরে ঢুকে পড়ে। হেরু সেদিক থেকে বড্ড সাহসী মানুষ। দুপুর রাত অব্দি গল্পসল্প করে একা লাইন পেরিয়ে রাঙামাটি চলে যায়। কাল কি হেরু আর আসবে?

—ওখানে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে বকবক করছ? ঘরে এসো।

স্বর্ণলতা ডাকে—হাতে কুপি। গোরাং ডাক্তার আস্তে আস্তে এসে বাড়ি ঢোকেন। সারা রাত এ লাইনে যত গাড়ি যায়, সবার আওয়াজ শোনেন। হাউলির ব্রিজে উঠলে সে এক মজার বোল বলে রেলগাড়ি—এক ধামা চাল তিনটে পটল, এক ধামা চাল তিনটে পটল।….

রাঙামাটির পথে তখন হেরু বাউরি হাঁটছে অন্ধকারে। শনশন হাওয়া বইছে ‘ধুলোউড়ির মাঠে’। ভাত খাওয়ার দুঃখ ভুলে হেঁড়ে গলায় গান ধরেছে সে—

কানপাশাখান হারিয়ে এল্যাম

 ধুল্যাউড়ির মাঠে

জিয়াগঞ্জর বাজার হতে কিন্যেছিল ভাসুর

 (এখন) পাচন পড়বে পিঠে লো…

ঠাকুরবাড়ি ডাঙার ওপর দিয়ে লন্ঠন হাতে নেমে আসছিল চরণ চৌকিদার। গান শুনে হাঁকে—হেই! কে যায়?

—আমি হেরু হে চৌকিদার কাকা।

—কোত্থেকে আসছিস বাপ? (চরণের গলাটি বড় আদুরে।)

টিশিন থেকে, টিশিন!… হেরু নিজেকে স্টেশনের লোক বলেই মনে করে। এই পরিচয় দিতে তার প্রচুর গর্ব আছে।

জষ্টিমাসের শুরু সবে। গতবারের মতন খরা হলেই হয়েছে! দিনমান হুহু লু হাওয়া বয়। গাছপালা ঝোপঝাড় পাংশুটে মেরে গেছে। ডাঙায় ডাঙায় দু’চার ছোপ যা ঘাস ছিল, শুকিয়ে খয়েরি হয়ে পড়েছে। গেরস্থরা ধানের মরাইতে তালা সেঁটে দিয়েছে। চোর—ডাকাতের বড্ড ভয় এখন। গাঁয়ের যুবকদের দল বেঁধে রাতপাহারায় লাগিয়েছে। ওরা রাতদুপুর অব্দি গাঁয়ের চটানে শক্ত লাল মাটিতে খেলাধুলোয় মেতে গেছে।….

…ছাগলা রে ভাই পাগলা তোর ছাগল কোথা চরে?

…ডিঙডিঙে লগরে।

…খায় ক?

…লতাপাতা।

…হাগে কী?

…বকছ্যারানি।

…মোতে কী?

…কলুর ঘানি।

হেরু শুনতে শুনতে গাঁয়ে ঢোকে। যুবতীবউ রাঙি বাউরান হাপিত্যেশ করছে। গায়েভারী মেয়ে। আজ বাদে কাল বিয়োবে। আঁরোয়ার জঙ্গলে একটা শুকনো কুলাগাছ দেখে এসেছে হেরু। পালিতবাবুকে বলেকয়ে কাঠ কেটে আনবে। কুলকাঠের আঙারে (অঙ্গার) পোয়াতির গা’গতর না সেঁকলে, রস শুকোবে না। হেরু তা জানে।…

আঁরোয়ার পালিতবাবু বলতেন—না—জানার ভান করে থাকে ব্যাটা বাউরি। ভেতরে—ভেতরে সব জানে, সব বোঝে নিমুনমুখো যষ্ঠিটি।

 হেরু খিক খিক খিক করে হাসত।

—দোব শালার ঘাড়ে দু’চার রদ্দা, মুড়োটা মাটিতে ছেঁচড়ে। আবার হাসে দ্যাখো।

—বাবুমশায়, আমি তো দোষ করি নাই।

—ভাগ শালা, ভাগ হিয়াসে!

হঠাৎ পালিতবাবু কেন খেপে যায় ওর ওপর, হেরু বুঝতে কী পারে না? পারে। একদিন গোরাং ডাক্তার গাঁওয়ালে গেছে টাট্টু চেপে, বাড়িতে স্বর্ণ একা চালের ক্ষুদ বাছছে। যদুপুরের মোতি ডোমনি একটু আগে পাঁচকথা গল্পসল্প করে যেই বেরিয়েছে, খিড়কির পুকুরঘাট থেকে পালিতবাবু রাবণরাজার মতো হুমহাম করে এসে বললেন—সতী, ভিক্ষাং দেহি।

স্বর্ণ বিধবা যুবতী। একটু—আধটু প্রশ্রয় দিয়ে থাকবে কখনও। ওতেই নাই পেয়ে পালিতবাবুর মাথায় অগ্নি চড়ে বসেছিল।

ছাঁচতলায় শেয়ালে মুরগি ধরার মতো জাপটাজাপটি ধস্তাধস্তি হচ্ছিল। আর এক পা গেলেই ঘর, হঠাৎ হেরু এসে হেঁড়ে গলায় হাঁকে—ডাকতোরবাবু, ডাকতোরবাবু! সায়েব এসেছে—হন্টরসায়েব!

হেরুর পিছনে রেলের হান্টারসায়েব গোরাংবাবুর সঙ্গে দুপুরবেলা দেখা করতে এসেছেন। ট্রলিটা লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। ট্রলির ওপর রঙিন মস্তো ছাতা। আবদুল, তেনু, ইত্যাদিরা বটতলায় এসে জিরোচ্ছে। এবারও খরা হলে কী কী ঘটবে তাই নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। সওয়ারি এনেছিল একটা গোরুর গাড়ি। দুপুরের ট্রেনে কাটোয়া যাবে কোন নাদুসনুদুস বাবু—সঙ্গে বউ। এসব ছাড়া বিলকুল ফাঁকা থমথম করছে আশপাশটা। এদিকে হান্টারসায়েবের পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, গায়ে সাদা হাফশার্ট, মাথায় শোলার টুপি। টুপিটি বগলদাবা। টাক চুইয়ে ঘাম পড়ছে। মুখটা লাল গনগনে হয়ে গেছে রোদে। হেরু ডাকতে ডাকতে বাড়ি ঢুকে পড়ল—দরজাটা খোলাই ছিল।

হেরু শুধু বলেছে, ইটার মানে কী গো পালিতবাবু? আর পালিতবাবু মসমস করে খিড়কি দিয়ে চলে গেলেন। খানিকবাদে কোত্থেকে বন্দুকের আওয়াজ হল—ফটাং ভট! পরে জানা গেছে দোতলার ছাদ থেকে উড়ন্ত পাখি তাক করে বন্দুক গেদেছিলেন পালিতবাবু। মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল।

সেই দুপুরে স্বর্ণ ঘরের ভিতর মেঝেয় উপুড় হয়ে একবেলা হু হু করে কেঁদেছিল। হেরু দেখেছিল, গোরাংবাবুর বিধবা মেয়ের এই কান্নাকাটির ফলে তার একফুট খাপি আর ছফুট ছইঞ্চি লম্বা শরীরটা কেমন যেন করছে। লম্বা ভাড়ুলেডালের মতো বাহুদুটো কেবলই চমকে উঠছে আর শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কী করবি হেরু, তুই কী করবি? পালিতবাবুর মুণ্ডুটা মুচড়ে নোনা আতার মতো ছিঁড়ে কামড়ে খাবি?

হেরু কারও গায়ে সেদিন অব্দি হাত তোলেনি। আর পালিতবাবু রাজাউজির মানুষ। একখানা গাদাবন্দুক আছে তাঁর। তিনজোড়া হালবলদ আছে। চৌদ্দটা ধানের মড়াই আছে। হেরু সেদিন নিজের রাগে নিজেই ছটফট করে রাঙামাটির ঝিলে সিঙাড়া তুলতে চলে গেল। সারাক্ষণ একগলা প্রাচীন জলে (যে জলের পূর্বপুরুষ তেরোশো বছর আগে বুকে নিয়েছিল মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের নৌকো, পেয়েছিল চীনা যাজক হিউয়েন সাঙের দুটো অমল হাতের ময়লা কিংবা আরও আগে লঙ্কার রাক্ষসরাজা বিভীষণ বৃষকেতুর অন্নপ্রাশনে এসে বজরা থেকে হাত বাড়িয়ে আচমন করেছিলেন : গোরাং ডাক্তার বর্ণিত ভাষ্য) হেরু নিজের তাপ শীতল করে মনে মনে বলেছিল—তুই শালা অধম মনিষ্যি। ছোটজাতে তোর জন্মো। তোর এত রাগতাপ ক্যানে রে? ওরে বাউরির ব্যাটা বাউরি, বামন হয়ে তোর চাঁদ ধরার দুরাশা! ধিক তোকে, শত ধিক।

হেরু দেখে, সে কাঁদছে। স্বর্ণলতা তাকে একসন্ধ্যা একমুঠো ভাত দিতে বাপের সঙ্গে তর্কাতর্কি করছিল, সেদিন সে দুঃখ পেয়েছিল—চোখ ফেটে জল আসেনি। আজ আসছে কেন? শালা বাউরি, তুই কাঁদছিস কেন? হল কী তোর?

বিশাল আদিগন্ত ঝিলে কত লোক এখন সিঙাড়া তুলছে। গরিবগুরবো পাঁচগাঁয়ের পুরুষলোক এবং স্ত্রীলোক। এসেছে তপা বাগদিরা বাপব্যাটায়। এসেছে চরণচৌকিদারের মেয়ে বিন্নি। এসেছে ঘনা লখা মরা সরা চারভাই বাউরিকুলের। আর এসেছে ডাবকইয়ের ইয়াকুব তান্ত্রিক।

ইয়াকুব শবসাধক। কোদলার ঘাট থেকে মড়া তুলে নিয়ে গিয়ে তার বুকে চড়ে সাধনা করে। তার ঘরে অনেক মড়ার মাথা আছে। লুকিয়ে কালীপুজো করে এই মোছলমানটা। ওর সর্বনাশ হবে। (গোরাংবাবুর ভাষ্য) ইয়াকুব ডুবে ডুবে কী হাতড়াচ্ছে। ভুস করে মাথা তুলছে আর সাদা হাতের তালুতে খানিক লাল সুরকিমেশ মাটি পরখ করছে। ছুঁড়ে ফেলছে। চরণ চৌকিদারের মেয়ে বলল—আ মর! চোখে পড়বে যে! চোখের মাথা খেয়েছে—দেখতে পায় না?

ইয়াকুব বলে—বিন্নিদিদি নাকি? কবে আসা হল মধুপুর থেকে?

বিন্নির চুল থেকে জলের ফোঁটা ঝরছে। সে চোখ বাঁচাতে মুখ ফিরিয়ে জল ঝেড়ে বলে—এবেলা। তা এত খবরে কাজ কী লোকের?

লখা বাউরি বলে—মধুপুরে খালবিল কোথা হে ওস্তাদচাচা? খটখটে মাটি। রসকষ নাই।

ওস্তাদ শুনে ইয়াকুব গর্বিত। মুখ উঁচু করে হঠাৎ যেন তন্ত্রচালনা করে সূর্যদেবের উদ্দেশ্য। তারপর বাঁয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলে—হেরু নাকি রে?

হঠাৎ অমনি মুখ বাউরিসন্তানের মাথায় চকিত লোভের ঝিলিক—যেন কেয়াঝাড়ের ওপর সড়সড়ে করে লাউডগা সাপ চলে গেল। যাবে নাকি একদিন তান্ত্রিকের বাড়ি? সব হয় আর এটা হবে না কেন? লোহার পাতের ওপর ‘পেচণ্ড রাওয়াজ’ করে কী বিষম ভয়ঙ্কর চলে যায়। মনিষ্যি সব পারে—এটা কি পারে না? তাই বলি, মনা রে মনা! শান্ত হো, ছোস্থ হো। হেরু হাসে। বড় বড় হলুদ দাঁত বেরিয়ে পড়ে। বলে—একদিন যাব ওস্তাদ, একদিন যাব। ‘পেয়োজন’ আছে।

—যাস। বলে মানিকসন্ধানী ইয়াকুব ওস্তাদ আবার ডুব দেয়।

এর কয়েকদিন পরে হেরু সকালবেলা স্টেশনে এসেছে। স্টেশনের বারান্দায় খোলামেলায় সিগনালের হাতল। আপের দুখানা, ডাউনের দুখানা। খালাসিটা রোগা লিকলিকে মানুষ। নতুন এসেছে। রগ ফুলে যায় হাতল নামাতে। কাছাকাছি বসে মিটিমিটি চেয়ে দ্যাখে হেরু। পাখা না কাত হলে গাড়ি কেন আসবে না—সে বুঝতেই পারে না। কিন্তু লোকটার কষ্ট দেখে ভাবে, একবার আমাকে দিলেই পারে। পাংখার কত্তাবাবাকে সুদ্ধ নামিয়ে দেবে।…

অল্পস্বল্প যাত্রী এসেছে এ—গাঁ, ও—গাঁ থেকে। কোদলার ঘটকঠাকুর, ডাবকইয়ের সেরাজুল হাজি, পাতেণ্ডার মকরম সেখ, জিনপাড়া—কাতপুকুরের মুকুন্দ দফাদার আর গোবরহাটির নায়েবমশাই। সবাই যাবে আপে খাগড়া—ঘাটরোড—পরের স্টেশন। সেখান থেকে এক মাইল হেঁটে রাধার ঘাটে তেওয়ারীজীর নৌকো পেরিয়ে সদর শহর বহরমপুর।

আপ আজিমগঞ্জ লোকাল হাওড়া ছেড়েছিল রাতদুপুরে, চিরোটি পৌঁছল সকালবেলা। গাড়ি দাঁড়ানোর আগেই মস্ত কাপড়ের গাঁট দরজা গলিয়ে ফেলে দিয়েছে গোকর্ণের দাসজীবাবু। চেঁচিয়ে উঠেছে, হেরু, হেরু!

দাসজীবাবু জানে, হেরুর স্টেশনে থাকা সুনিশ্চিত। গোরাংবাবুর ডাক্তারখানার সামনে বটতলায় গোরুর গাড়ি রাখবে লায়েব সেখ—এইমতো কথা ছিল। প্লাটফর্ম থেকে এই ত্রিশ গজ দূরত্ব ডিঙোতে হেরুকে চাই—ই। নয়তো আঁরোয়া ঢুঁড়ে একদল শক্তসমর্থ মানুষ জোগাড় করে আনতে হয়।

হেরু এসে যায় হন্তদন্ত। একবার দাসজীবাবু, একবার কাপড়ের গাঁটে চোখ বুলোয়।

—কী বাবা? কেমন আছো? ভালো তো? বাড়িতে সব কুশল তো?… দাসজীবাবু খাঁটি বৈষ্ণব। কী মিঠে কথা! শুনতে হেরুর কান জুড়িয়ে যায়। একবার একটা প্রকাণ্ড কালো রহস্যময় বাকসো মাথায় করে ওঁর পিছন পিছন হেঁটে পাঁচমাইল দূরে গোকর্ণ বাজারে পৌঁছে দিয়েছিল হেরু। আঃ কত খাওয়া, কত! দোকানের বারান্দায় এক হাঁটু বিছিয়ে এক হাঁটু তুলে বাঁহাত মাটিতে ভর রেখে হেরু খাচ্ছে। চারটে পদ্মপাতার ওপর দু’সেরটাক ভিজে চিঁড়ে, আধ সের গুড়, কয়েক ছড়ি পাকা কলা। চৌকাঠে বসে দাসজী অনবরত বলছে—লজ্জা করো না বাবা, খাও খাও। আর দেব?

ভিড় জমিয়ে রাস্তার লোকেরা খাওয়া দেখছে। চৌধুরীবাবু জমিদারদের বাতিক আছে, ফি আষাঢ়ে চটানে মালামোর আয়োজন করেন। সে—মালামো বড় সাংঘাতিক। জানসুদ্ধ মরে যাওয়ার ব্যাপার গড়ায়। কে খবর দিয়েছিল, তাই চৌধুরীদের পাইক এসে গা টিপে দেখে যায়। বলে যায়—যাবার সময় দেখা করে যেয়ো কাছারিবাড়িতে।

হেরু যায়নি। তাই একটু ভয় হচ্ছে—এই যা! কিন্তু বত্রিশ নাড়ি চনমন করে উঠেছে দাসজীকে দেখামাত্র। আহা কত খাওয়া, কত!

—নে বাবা। এট্টুকুন কষ্ট কর।

 হেরু কাত হয়ে কাঁধ লাগিয়ে অস্ফুট আওয়াজ করে—অঁক! কী আশ্চর্য কথা, গাঁটটা কি পাহাড়, না পর্বত? বারকতক অঁক করেও তিলমাত্র ওঠবার লক্ষণ নেই দেখে সে ফোঁস ফোঁস করে দাঁড়িয়ে। টেরচা পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে—দড় লাগছে। রোজন?

—ওজন আর কত হবে!…দাসজীবাবু হাসে।…দেখলি নে—আমি এক ধাক্কায় গড়িয়ে ফেললাম একেবারে? নে—আবার চেষ্টা কর। তুই না পারলে কে পারবে বাছা? ততক্ষণ আমি বটতলায় যাই। লায়েবকে দেখি।…

হেরু তবু বলে—রোজন? রোজনটা বলে যান।

এ কী কাণ্ড! হেরু তো এমন করে না কোনোদিন! দাসজী এসে পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন—সামান্য, অতি সামান্য। মোটে পাক্কি একমণ বাইশ সের। এই দ্যাখ না—রেলের রসিদ রয়েছে।

 হেরু পড়তে জানে না। রসিদটা দেখেই কিন্তু বিশ্বাস হয়ে যায় তার। ওরে বাবা, এল—কোম্পানির ছাপা হরপে সই—শিলমোহর দেগে দিয়েছে—এ কি মিথ্যেমিথ্যি? পুনশ্চ একটা প্রচণ্ড আঁ্যাঁকে সে ঠেলতে ঠেলতে বেড়ার গায়ে নিয়ে ঠেসে ধরে গাঁটটা। এখানে লোক কোথায় যে মাথায় তুলে দেবে? লোক ডাকতে হলে হেরুর আবার আঁতে ঘা লাগে।

দাসজীবাবু অবাক। যারা সেখানে ছিল অবাক। মাথায় গাঁট তুলে টলতে টলতে লাইন ডিঙিয়ে চলেছে হেরু। দাসজী দৌড়য়। বটতলায় গিয়ে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। কোথায় লায়েব সেখের গাড়ি? বটতলা ফাঁকা সুনসান। সবে বটফল পাকতে লেগেছে। টুকটুকে লাল ফল—ভিতরটা হলুদ, পড়ে আছে খটখটে মাটিতে। অনবরত পড়ছে টুপটাপ। শালিখ কাক করকটা পাখি ডালে ডালে কলকলিয়ে বেড়াচ্ছে। ঠুকঠুক ঠোকরাচ্ছে। দাসজীমশায়ের টাকে পাখির গু পড়ল। টের পেল না দেখে হেরু মুচকি হেসে ফেলে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? দাসজী হাঁ হাঁ করে আসে—লক্ষ্মী বাবা, লক্ষ্মী সোনা, জাদু আমার। মোটে তো একমণ বাইশসের ওজন—তোর কাছে আবার ওজন? তুই কলির মহাবীর—(হনুমান বলে না সে) কত গন্ধমাদন তুললি! এ তো নস্যি। ওরে, আমার ঠাকুর মাথায় গিরিগোবর্ধন ধারণ করেছিলেন, তা জানিস? তোর দেহেও—ফেলিস নে বাবা। আড়াই ক্রোশ পথ মোটে। চানটান করে খাবি। হ্যাঁ—সেদিনের চেয়ে ডবল খাবি।

হেরু তাকায়।

—পেটভরে খাবি। যা মন চায়, বলবি—পাতে দেব। আর বাপ, হাঁটন দিই বাপব্যাটায়। তুই আমার পূর্বজন্মের ছেলে রে!

তাই শুনে হেরু অনায়াসে হাউলি সোঁতার পাঁক ঠেলে পার হয়। বাঁকী নদী খড়ি—খড়ি বালুচর। গোবরহাটির কাছে ফের চড়াই। মাথা যেন ঝিমঝিম করছে, হেরু বুঝতে পারে না। যত হাঁটে, মা বসুমতী যেন স্থির মানে না।—দাসজীমশাই! সে ডাকে।—ভুঁইকম্প হচ্ছে নাকি গো?

—না তো! না তো!

—আমার কেমন—কেমন লাগে। চোখে অন্ধকার, পা টলে গো!

—অমন হয় বাবা, অমন হয়।

—দাসজীমশাই, ইটার রোজন কত বললেন?

—এক মণ বাইশ সের রে বাবা, এক মণ বাইশ সের! এককথা বারবার বললে মুখ পচে যায়।

—দুমণ মাল আমি টেনেছি দাসজীমশাই। কিন্তুক এমন লাগে ক্যানে?

—তোর পেট যে খালি, তাই। রেতে কী খেয়েছিলি?

—একমুঠো ছোলা আর গুড়।

—সকালে?

—কিছু না মশাই, কিছু না।…হেরু হাঁপায়। পেটে বত্রিশ নাড়ি পাক খায়। সব রোদ মুছে অন্ধকার নামে জিনপাড়ার মাঠে। মনা রে মনা, শান্ত হো! ওই দেখা যায় গোকর্ণের রেশমকুঠির ‘বানুক’—আকাশ মাথা তুলে আছে। ওই দিঘির পাড়ে হাটতলা। চৈত্র মাসে শ্যামচাঁদের মেলা বসেছিল। রাঙীর পেটে যেন মেয়ে হয় হে ভগবান! গোকর্ণে তার বিয়ে দেব। ভালোটা মন্দটা কতরকম দেখবে। বাজার জায়গা।….

 সেইদিনই রাতে আঁরোয়ায় একটা সাংঘাতিক ডাকাতি হল। দোতলায় পালিতবাবুর বউ সবে নিচে থেকে খেয়ে গিয়ে পানের বাটা হাতে পা ছড়িয়ে বসেছে। চৌকাঠে হেলান দিয়ে বারান্দায় বসেছে সে। সামনে কুপি জ্বলছে। কুপির ধুঁয়োয় গতি সবসময় মানুষের নাকের দিকে—তাই পালিতগিন্নি মুখটা একপাশে কাত করে নাক কুঁচকে পানের বোঁটা ছাড়াচ্ছে। বারান্দাটা ছাদ বরাবর লোহার সিকে ঘেরা—চিড়িয়াখানার বাঘসিংহের খাঁচা যেমন। বারান্দার একদিকে তক্তাপোষ, অন্যদিকে বাড়তি খন্দ রাখবার জন্যে মাটির কুঠি। দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর আলমারিতে থাকে থাকে কাঁসার বাসনপত্তর চকচক করতে দেখা যাচ্ছে। লোহারামটা কোণে অন্ধকারে রয়েছে। পালিতবাবু বন্দুকটা তক্তপোষে বিছানায় রেখে বউর দিকে কাত হয়ে তাকিয়ে শুয়ে আছে। সিঁড়ির মুখের দরজা তখনও বন্ধ করা হয়নি। পালিতগিন্নি পান—সেজে মুখে ভরে রাতের মতো একবার ‘জল সারতে’ নিচে যাবে, তাই।

রাত দশটায় মেলগাড়ি গেল। নিচের দুই ঘরে দুই ছেলে বউ নিয়ে খিল কপাট এঁটে ফেলেছে। এত গরমেও ভিতরে শুতে হয়। জঙ্গুলে জায়গা। চোর—ডাকাতেরও ভয় আছে। উঠানে ধানের মরাইগুলোর পাশে ভীম রাজবংশী বল্লম পাশে নিয়ে খাটিয়া পেতে শুয়েছে। গাঁজাখোর মানুষ। বাইরে খামার—বাড়িতে মুনিশ মাহিন্দার চাকর সবাই উঠোনে তালাই পেতে রূপকথা শুনছে। গানের সময় হলে সবাই মিলে চড়া সুরে ধুয়ো গাইছে :

একো মাস দুয়ো মাসো রে তিনো মাসো যায়

দন্তে না কাটেরে ঘাসো কী হবে উপায়…

ভিতরবাড়ির উঠোনে ভীম রাজবংশীর গলায় অজগর সাপ—সে ধড়ফড় করে কাঠ হয়ে গেছে কয়েকদণ্ডেই। বিশাল কালো ছায়া পালিতের ঘরের ওপর দোলে। দুলতে দুলতে সিঁড়ির ভিতর দিয়ে ওপরের বারান্দায় যায়। পালিতবাবু ভীমের মতোই স্থির হয়। পালিতগিন্নি চেঁচিয়ে উঠেছিল।

পালিতগিন্নির মাথাটা শক্ত দেয়ালে ঠুকে নারকোল—ভাঙা করেছে। দেয়ালে মেঝে সবখানে ঘিলু আর চাপ চাপ রক্ত। বাকি দুটো লাসে রক্ত নেই। জিভ বেরিয়ে গেছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরে গেছে।

পালিতগিন্নির চেঁচিয়ে ওঠাটা শুনেছিল নিচের ঘর থেকে ছোট ছেলের বউ। সবে খোকা হয়েছে। খোকাটার পেচ্ছাবের কাঁথা বদলাচ্ছিল সে।

কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না নামটা। কানের ভুল। হেরু বাউরির মতো লোক এই কর্ম করবে, এ কী না জলে শিলা ভাসার ব্যাপার। পুলিশের ভয়ে লোকটা দেশ ছেড়েই পালিয়েছে হয়তো। গোরাংবাবু বলেন—এ একটা রহস্য। রাঙী বাউরান কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল পরে। সে বলেছে, গোকরনের দাসজীমশাই ভুলিয়ে—ভালিয়ে এক মণ বাইশ সের বোঝা বইয়ে নিলে—তার বিচার নাই? মরদটা ঘরে ফিরে সেই যে উপুড় হয়ে শুল তো শুলই। কথাটা নাই, বাত্তাটি নাই। শুধু চুপচাপ শুয়ে রইল—তো কাছে গিয়ে দেখি, চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নেমেছে। অ মিনসে, তোমার হল কী? কী দুখ বাজল বুকে অবেলায় গো? তখন—তখন বললে কী জানেন ডাক্তারবাবু? আঙী রে, আঙী। মনিষ্যি কী বলদিকিনি?…ক্যানে, ক্যানে—ইকথাটা ক্যানে গো বাউরির পো? চোখে ধারা নিয়ে পুরুষ বললে, দাসজীমশাই এক মণ বাইশ সের বলে আড়াই মণ বোঝা বওয়ালে! খাবার সময় কান করে শুনি—ভিতরে বলাবলি আর হাসাহাসি করছে, ব্যাটা বাউরিকে এক মণ বাইশ সের বলে আড়াই মণ বইয়েছি। ঠিকঠাক ওজনটা শুনলে ওর বাপের সাধ্যি ছিল না এ মাল মাথায় বইতে পারে। শুনে সঙ্গে সঙ্গে শরীল লীলবন্ন হয়ে গেল। চোখে আন্ধার দেখলাম। আ—ড়া—ই—মো—ণ। ছাতি ফেটে গেছে, না ফাটেনি? আমার সন্দ হল। আমি কী আর বেঁচে আছি? মনা রে মনা! আমি, না আমার ছেঁয়া বসে ভুজুন করছি? আমি কি প্রিকিতই সেই হেরু বাউরি—কেরু বাউরির ব্যাটা? তা আঙী, কথাটি বুঝে দ্যাখদিকিনি। হুঁ, বুঝে দ্যাখ। না—জানাতে সাপের বিষ হজম হয়। কিন্তু আমার তো হল না। আমি কী করব রে আঙী, কী করব? আমার যে অক্ত টগবগ করে ফুটছে। ইচ্ছে কচ্ছে পিথিমীটা দিই শালা ইদিক—উদিক করে! উঃ, মনিষ্যি কী, কী শালা এই দুপেয়ে জীব! ডাক্তোরবাবু, মরদটাকে বাগ মানাতে পারিনে। সে কী ভুঁইকম্প, সে কী হুলুস্থুলুস কাণ্ড! ডরে থত্থর করে ব্যানার ঝাড়ের মতন কাঁপি। এ ঝড় কোত্থেকে আনলে বাউরির ছেলে—এ তো দেখি নাই ডাক্তোরবাবু, এ তো দেখি নাই!

তারপর রাঙী সবার সামনে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।—এল কোম্পানি টিশিন না দিলে ও মোট বইতে যেত না। মোট বইতে না গেলে ডাকাতও হত না। টিশিন দিলে ক্যানে? বিচার করো সবাই—ক্যানে টিশিন দিলে এখানটায়, টিশিন?

হেরু যাও বাঁচত, আর বাঁচার উপায় থাকে না। গোরাংবাবু মাথা দুলিয়ে শুধু বললেন—হুঁ, ইহাই একটি রহস্য। বড়ই প্রাচীন রহস্য। হেরু ডাকাত হল কেন? কেন হেরু ডাকাত হল আচমকা? যদি বা হল, দাসজীকে বাদ দিয়ে পয়লা খেপেই পালিতকে নিয়ে পড়ল কেন?

টগরগাছে জল দিতে দিতে স্বর্ণলতা কান করে কথাগুলো শুনছিল। হঠাৎ তার বুকটা যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে। দুটো জাং ভারী লাগে আচমকা। কিছু কথা মনে পড়ে যায়।