ঊর্মিলার নির্বাসন দণ্ড হয়েছে।
ঊর্মিলা এই অদ্ভুত পরিস্থিতিটার দিকে যেন সকৌতুকে তাকাচ্ছে।
রমাদের এই ঘরটা থেকে দেখা যায় শুধু রান্নাবাড়ি। বোঝবার উপায় নেই এ বাড়িতে সুন্দর একটা বাগান আছে, আর সেই বাগানের ধারে একটা সুন্দর মহল আছে। বোঝা যায় না ওদিকের ওই উঠোনটা ঘিরে চক মিলানো দোতলা আছে, তিনতলায় পাথর মোড়া নতুন ঝকঝকে ঠাকুরঘর আছে।
এদিকটা বাড়ির পিছন দিক।
যেন ফুল-তোলা কাঁথার উলটো দিক। এখানে এরা থাকে। বরাবর থেকেছে। ঊর্মিলা কোনওদিন এ ঘরে ঢুকতে আসেনি। ভাবেওনি ওদের কী কষ্ট!
কিন্তু ঊর্মিলারই কি খুব একটা কষ্ট হচ্ছে? ঠিক বুঝতে পারছে না। ঊর্মিলা যেন একটা রঙ্গমঞ্চে রয়েছে। যেন বন্দিনী রাজকন্যার ভূমিকা অভিনয় করছে। রাজপুত্তুর এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে তাকে!
কিন্তু রাজপুত্তুর কি বারবার আসে?
বারবার কি পক্ষীরাজ ঘোড়া জোটে তার?
ঊর্মিলার কি তবে এই নির্বাসনই জীবনের শেষ কথা হয়ে যাবে? তবে এবার সত্যভামার উপদেশ মানলেই বা ক্ষতি কী? রান্নাঘরের কাছাকাছি তো রয়েছে, কেরোসিন পাবে অন্তত।
নিজের এই চিন্তায় লজ্জিত হল ঊর্মিলা। নিজের কথাই ভাবছে, সমুদ্রের কথা ভাবছে না। যে সমুদ্র আযৌবন শুধু ঊর্মিলা নামের একটা মেয়েকে তপস্যা করে আসছে।
কিন্তু ঊর্মিলাকে অলকা যে বিশেষণ দিয়েছে, সে কি ভুল?
ঊর্মিলা কি অবিশ্বাসিনী নয়?
শিবানীর চিঠির মোড়কে ভরে ভরে–সমুদ্রস্রোত কাগজের নৌকো ভাসায়নি সে? সেই নৌকোয় চড়িয়ে নিয়ে আসেনি সমুদ্রর প্রাণপুরুষকে?
অবিশ্বাসিনী তবে কাকে বলে?
হতে পারে ঊর্মিলা সেই সব চিঠিতে সমুদ্রর সমস্ত আবেগ আর আকুলতাকে অবিরাম ভর্ৎসনাই করে এসেছে, তাকে ঊর্মির কথা ভুলতে নির্দেশ দিয়েছে, তবু সেই ভর্ৎসনার মধ্যে কি তীব্রতা ছিল? সেই নির্দেষের মধ্যে জোর?
সতী নারীর কাঠিন্য ছিল তাতে?
রুদ্ররোষের তীব্র বহ্নি?
ছিল না।
তবে?
ঊর্মিলা যদি অবিশ্বাসিনী না হত, নিশ্চয় সমুদ্রর ওই পাগলামি ভরা চিঠিগুলো ছিঁড়ে ফেলে দিত, শিবানীকে এই দূতিয়ালিতে নিষেধ করত, চিঠির জবাব না দিয়ে নীরব থাকত।
কিন্তু ঊর্মিলা তা করেনি।
ঊর্মিলা তার বাল্যপ্রেমকে পরম স্নেহে লালন করে এসেছে গৌরবময় দাম্পত্য জীবনের মধ্যেও।
আর পরে? পরে
শিবানী যখন লিখেছে, এখন তো আর অবৈধর দায়ে পড়বি না, কেন তবে আর ওই সোনার খাঁচায় বসে ছাতুর গুলি খেয়ে খেয়ে জীবনটা ফসিল করে ফেলবি? তোর জন্যে না হোক, সমুদ্রর জন্যেও অন্তত চলে আয়। এসে নিজে তুই অনুতাপে দগ্ধে মরিস ক্ষতি নেই, ওটাকে বাঁচা…ভেবে দেখ একটা মানুষ তোর জন্যে বরবাদ হয়ে গেল, অথচ তুই তোর সেই দস্যু রত্নাকর শ্বশুরের বংশ-গৌরবের চিন্তায় বিভোর হচ্ছিস!…কিন্তু বিধবা বিয়ে তো বেআইনি নয়। আর এ যুগে, ভয়ংকর একটা নিন্দনীয়ও নয়।..যারা এখনও তাদের পূর্বপুরুষের চশমা পরে পৃথিবীকে দেখতে চায়, তাদের মোহভঙ্গ হওয়াই ভাল.তখন তো সেই মোহভঙ্গ করতেই মুদগর ধরেছিল ঊর্মিলা!
সমুদ্র সেন নামের একটা পাগলামিকে বাঁচাবার জন্যে রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়েছিল অনেক কিছু হত্যা করে। হত্যা করেছে এদের স্নেহ, সহানুভূতি, ভালবাসা, বিশ্বাস। ওরা ধরে এনেছে সেই হত্যাকারীকে।
অতএব তাকে বেদিতে বসিয়ে পুজো করবে এমন আশা করা যায় না।
ঊর্মিলা তাই তার শাশুড়িকে রুদ্রাণী ভাবছে না, শ্বশুরকে নৃশংস।
ভাবছে ওঁরা স্বাভাবিক।
শুধু বুঝতে পারছে না মধুর ব্যবহারটা।
মধু কেন একবারও আসছে না?
মধু কী করে ওর কাকিমাকে না দেখে থাকছে? বারণ করেছে ওরা? আটকে রেখেছে?…
মধু কি আটক মানবার ছেলে?
নিষেধ পালন করবার ছেলে?
যে করে হোক হঠাৎ একবার দমকা হাওয়ার মতো ছুটে এসে কাকিমণি বলে জড়িয়ে ধরবে, এই আশায় তৃষিত হয়ে রয়েছে দেহ মন, কিন্তু কোথায়?
কোথায় সেই তৃষ্ণার জল?
.
গাড়িখানা বেরিয়ে গেল।
ধুলোটা উড়ল অনেকক্ষণ, তার পরে সেটাও মিলিয়ে গেল।
সমুদ্র সেন নামের ধিকৃত ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল তবুও। আটাশ বছরের একটা আস্ত মানুষকে কি ছেলেটা বলা চলে?
তা সব ক্ষেত্রে হয়তো চলে না, কিন্তু সমুদ্রকে বলা চলে! সমুদ্রর মুখের রেখায় সেই কমনীয়তা, সমুদ্রর জমাট চুলে সেই অবিন্যস্ততা, সমুদ্রর চোখের দৃষ্টিতে সেই স্বপ্নের গভীরতা।
আটাশ বছর বয়েস হয়ে গেছে সমুদ্রর, তবু তারুণ্য ওকে লাবণ্যের মতো বেষ্টন করে আছে। তাই সমুদ্রকে দেখলে মনে পড়ে না ওর রং ময়লা, অথবা ওর বয়েস কত! কিন্তু কী লাভ হল তাতে?
সমুদ্র তার স্বাস্থ্যসতেজ দীর্ঘ দেহে তারুণ্যের লাবণ্য আর শক্তি বহন করেও দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতো, রুক্ষ চুলগুলি নিয়ে টানাটানি করল অহেতুক, আর বড়লোকের ঘরের একটা ঘি দুধ খাওয়া গোলগাল ছেলে তাকে ব্যঙ্গ করে ধিক্কার দিয়ে আর শাসিয়ে তার হাতের মুঠোয় আসা আজন্মের সাধনার সিদ্ধিকে মুঠো থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল।
সমুদ্র রুখে উঠল না, সমুদ্র তার গলার কলার চেপে ধরল না, সমুদ্র একবিন্দু প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারল না।
এও বলতে পারল না, ঊর্মি, তুমি তো আর নাবালিকা নও, তোমার প্রাক্তন ভাশুর তোমার উপর জোর ফলান কোন অধিকারে?
বলতে পারল না, দেখি তো কেমন নিয়ে যেতে পারেন ওকে!
আশ্চর্য, কিছুই বলতে পারল না। অথচ বলবার অনেক কিছু ছিল, বলবার অধিকারও ছিল।
আর ঊর্মি?
রাবণের হাতে সীতার মতো ঊর্মি শুধু মিনতিতে ছটফট করল। ঊর্মি শুধু প্রার্থনায় কাতর হল।
তাতে তো লাভ হল না।
খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসা পাখি আবার খাঁচায় উঠল। অবশ্য এবার কড়া শিকল পড়ল তার পায়ে।
নিশ্চয় আগে স্বাধীনতা যদি কিছু থেকে থাকত সেটা খর্ব হবে, চিঠিপত্র সেন্সর হবে, আর নজরবন্দির জীবনে থাকতে হবে।
বড়লোকের বাড়ির কঠিন প্রাচীরের অন্তরাল থেকে কবার পালিয়ে আসা সম্ভব?
চুলগুলোকে মুঠোয় চেপে চেপে মাথাটায় ব্যথা ধরিয়ে ফেললে সমুদ্র, তারপর ভাবতে লাগল, আবার কোন উপায়ে?
আচ্ছা এ রকম বোকার মতো করলাম কেন আমি?
ভাবল সমুদ্র।
আর ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্তে এল।
আর কিছু নয়, সেই আদি ও অকৃত্রিম, চির পুরাতন কারণ। সংস্কার!যুগ যুগান্তরের সঞ্চিত সংস্কার, শিরায় প্রবাহিত পিতৃপিতামহের রক্তের সংস্কার, পাপপুণ্যবোধের চিরন্তন সংস্কার।
যখন ঊর্মিলার স্বামীর দাদা ওদের ধরে ফেলল, ধমক দিল, তখন ঊর্মিলাও যে নিজের তেজে জ্বলে না উঠে অনড় হয়ে গেল, সেও ওই সংস্কার ছাড়া আর কী?
অথচ সংস্কার বস্তুটা আসলে কিছুই নয়। একটা ফাঁপা রঙিন বেলুন। ফুঁ দিলেই ফেটে যায়।
হৃদয়-রাজ্যের প্রজা নয় সে, মানবিক ধর্মের ধার ধারে না মোটেই। আর একনিষ্ঠতার ধারও ধারে না। বহতা নদীর মতো সে অবিরতই তো নিজের গতি বদলায়, চেহারা বদলায়, মাটির তারতম্যে রংও বদলায়।
চিরাচরিত সংস্কার!
ওটা একটা প্রচলিত শব্দমাত্র। ওর মধ্যে সত্য নেই। কালে কালে যুগে যুগে সংস্কারের চেহারা বদলায়, দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সংস্কারের রূপ বিভিন্ন।
সংস্কারের সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্বন্ধ নেই, সত্যের কোনও সম্বন্ধ নেই, সভ্যতার কোনও সম্বন্ধ নেই। ও হচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী। ওর পাওনা জুগিয়ে চলা ছাড়া উপায় নেই মানুষের।
ঊর্মিলা জুগিয়েছে।
ঊর্মিলা তাই সেদিন রুখে উঠে বলতে পারল, আমি নাবালিকা নই।
ঊর্মিলা ভাবল, আমি অন্যায় করেছি।
সেই ভাবনাটাই ভীরু করে তুলল ঊর্মিলাকে।
ভীরু ভীরু।
ভীরু তারা দুজনেই তাদের নাম দুটো একটা অর্থহীন বোঝা।
অথচ ওই নাম দিয়ে কত কবিত্ব করেছে তারা!
সমুদ্র আর ঊর্মি কী চমৎকার অর্থবহ, কী গভীর ব্যঞ্জনাময়; এ যেন তাদের ভাবী জীবনের ভাবদ্যোতক!
কবিত্ব করত নাম দুটো খেলিয়ে ছড়িয়ে বিকশিত করে।
একদিন তো সমুদ্র একটা কবিতাই লিখে ফেলল। কলেজে বসে, নোটের খাতায়।
ওঃ কী সেই উল্লাস!
কী চাঞ্চল্য!
কতক্ষণে দেখানো যায় ঊর্মিলাকে। কিন্তু সেখানেই কি অবাধ স্বাধীনতা ছিল? প্রেমকে কি এদেশের সমাজ কোনওদিন সুচক্ষে দেখবে? মনে হয় না। সমাজ নামের পাহাড়টা তো ভেঙে পড়ে যাচ্ছে, তথাপি অভিভাবকের তীব্র দৃষ্টি, অসন্তোষ আর অপছন্দ, প্রেমকে পঙ্গু করে রাখবে।
প্রেম নাকি অন্ধ।
এদেশে প্রেম শুধু অন্ধ নয়, খোঁড়াও। এত বিষয়ে সংস্কারমুক্ত হচ্ছে লোকে, শুধু ওই এক ব্যাপারে সংস্কারে আচ্ছন্ন।
কেউ কাউকে ভালবাসছে–দেখল কি ভুরু কুঁচকে উঠল তার! আর চেষ্টা চলতে লাগল কী কী উপায়ে তাদের পথে পাথর ফেলা যায়।
আগ্রহ দিয়ে, আশীর্বাদ দিয়ে প্রেমকে গ্রহণ করতে এগিয়ে আসবে, এমন অভিভাবককুল কি জন্মাবে এদেশে?
আশ্চর্য, সব প্রেম মহান, ঈশ্বরপ্রেম দেশপ্রেম থেকে শুরু করে ভ্রাতৃপ্রেম বন্ধুপ্রেম, মাতৃ-পিতৃ সন্তান প্রেম। সকলের প্রতিই ঢেলে দাও হৃদয়-রস-সুধাঁধারা, শুধু মানব-মানবীর সহজাত প্রেম, যা চিরন্তন, যা নিত্যকালের, যা সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকে সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত চলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এসেছে, সেই প্রেমকে ওরা কিছুতেই পবিত্র বলবে না!
যদি বলত!
তা হলে সমুদ্রর জন্যে ঊর্মির ব্যাকুলতা দেখে ঊর্মির অভিভাবককুল, এবং ঊর্মির জন্যে সমুদ্রর চাঞ্চল্য দেখে সমুদ্রর অভিভাবককুল কৌতুক বোধ করত, আর মুখ টিপে হেসে বলত, নাঃ এ দুটোকে মিলিয়ে দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
কিন্তু তা হয়নি।
উভয়পক্ষের অভিভাবককুল ভুরু কুঁচকে বলেছিল, এই বয়েসে এত পাকামি!
ষোলো আর একুশ এই দুটো বয়েসকে ওরা প্রেমে পড়ার উপযুক্ত বলে গণ্য করেনি। বলেছিল পাকামি!
আর সেই পাকামিকে সায়েস্তা করবার জন্যে ঝপ করে বিয়ে দিয়ে ফেলেছিল ঊর্মিলার। বলে বেড়িয়েছিল, মস্ত জমিদারের বাড়ি, এখনও মরাহাতি লাখ টাকা! এমন ঘর বর আর পাওয়া যাবে, তাই
কেঁদে কেঁদে রোগা হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। আর অকৃতী অসহায় একুশ বছরের ছেলেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছিল হিতৈষীকুলের সেই নিষ্ঠুরতা।
আশ্চর্য, প্রত্যেকটি প্রৌঢ় মানুষই তো কৈশোর যৌবন পার হয়ে তবে প্রৌঢ়ত্বের দরজায় এসে পা দেয়, তবু ভুলে যায় কেন সেই দিনগুলো? কেন ভেবে নেয়, অনেক টাকা থাকাই অনেক সুখপ্রাপ্তির উপায়?
ঊর্মির অভিভাবকরাও সেই ভুল করেছিল।
ভেবেছিল, ওই লাখ টাকার বাড়িতে পড়লেই ঊর্মিলা সুখে থাকবে।
এই মনোবৃত্তি!
এদের চোখ এড়িয়ে ভালবাসা?
এদের ফাঁকি দিয়ে কবিতা শোনানো? তবু হয়ও।
ঊর্মিলা শোনে।
সবটা মন দিয়ে শোনে, তারপর খুব নিরীহ গলায় বলে, কোথা থেকে টুকলিফাই করলে?
সমুদ্র অবশ্যই রেগে আগুন হয়ে ওঠে।
বলে যাও, চলে যাও, শুনতে হবে না তোমায়।
আহা রাগ করছ কেন, জন্মে কখনও কবিতা লিখলে না, হঠাৎ দিব্যি একখানা লেখা হয়ে গেল, এটা একটু ইয়ে না?
যে কোনও কাজই প্রথমে একদিন হঠাৎই হবে—
তাই বুঝি? ওঃ তা হলে তুমি নিজেই লিখেছ বলছ?
না, বলছি না–সমুদ্র আরও রেগে ওঠে, টুকেছি। হল তো?
হাতের মুঠোয় দলা পাকাতে গিয়েছিল, ঝপ করে ধরে ফেলল ঊর্মি।
আর বোধ করি এই প্রথম ঊর্মিলা সমুদ্রর অমন কাছাকাছি এল।
প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো পড়ল কিনা।
সমুদ্র স্থির হয়ে গেল।
সমুদ্র ওকে ধরে ফেলল।
কিন্তু ছাড়িয়ে নিল ঊর্মিলা।
খুব সহজ কৌশলে ছাড়িয়ে নিয়ে সহজভাবে বলল, বেশ, না হয় নিজেই লিখেছ, কিন্তু শুধু লিখলেই হয় না, ভাল করে পড়তে শিখতে হয়। যা তড়বড় করে পড়লে, মাথাতেই ঢুকল না। কই আর একবার একটু ধীরেসুস্থে পড়ো তো দেখি।
কোনও নতুন কবি এরপরও পারে রাগ করে থাকতে?
সমুদ্রর নিজেরই তো মনে হচ্ছিল, তেমন করে পড়া হল না—
অতএব ধীরেসুস্থে আবার পড়ল সে–
এখানে সমুদ্র শূন্য
বিদীর্ণ বালুকা শয্যা পাতি।
সেখানে বন্দিনী ঊর্মি।
যাপিতেছে ব্যর্থ দিন রাতি।
এখানে সমুদ্র বক্ষ
পিপাসায় করে হাহাকার,
সেখানে উত্তাল ঢেউ
আছাড়িয়া মরে অনিবার।
অবরুদ্ধ বেদনায় চিত্ত তার
করে থরথর,
অশান্ত সমুদ্র হেথা
দীর্ঘশ্বাসে তোলে শুধু ঝড়।
সে কোন পূর্ণিমা লগ্নে
টুটে যাবে দেয়াল কারার?
শূন্যতার বক্ষ ভরি
এ সমুদ্রে, উঠিবে জোয়ার।
বলা বাহুল্য, এবার পাঠভঙ্গিতে রীতিমত নাটকীয় সুর লাগানো হল।
ঊর্মিলা মৃদু মৃদু হেসে শুনছিল, শেষ হলে বলল, যদি সত্যিই মৌলিক হয়, মন্দ হয়নি বলতে হবে। অর্থাৎ কবিতা হিসেবে অচল নয়। কিন্তু অপরের মন নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে না? এখানের খবর না হয় মোক্ষমভাবে জানো, কিন্তু সেখানের খবর? সেটাতে এত নিশ্চিত হচ্ছ মানে?
মানে?
সমুদ্র জ্বলজ্বল মুখে বলে, মানে হচ্ছে কবিরা সবখানের খবর জানতে পারে।
সব জানা নির্ভুল নয়—
নির্ভুল! দারুণ নির্ভুল!
ঊর্মিলা আর একটু হেসে বলেছিল, তা হলেও পূর্ণিমা লগ্নের আশা কোথায়?
আশা করব। আশা করে অনন্তকাল বসে থাকব
ঊর্মিলা আলো আলো মুখে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, কই দেখি কবিতাটা আর একবার নিজে পড়ি।
ঊর্মিলা সেটা মনে মনে পড়ে নিয়ে বলেছিল, ঠিক আছে। এটা আমার কাছে থাক।
বলেই চট করে ব্লাউজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছিল।
সমুদ্র বিগলিত মুখে বলেছিল, আরে ওটা কেন? খুব ভাল করে লিখে দেব একটা।
থাক দরকার নেই। খুব ভালয় দরকার নেই।
তা হলে পছন্দ হয়েছে তোমার?
খুব! সত্যি সমুদ্র, তুমি যে এত ভাল কবিতা লিখতে পারো তা জানতাম না।
যদি দিন পাই দেখাব আরও কত কবিতা সৃষ্টি করতে পারি। কিন্তু
কী কিন্তু?
কিন্তু এখন যেন হাত পা বাঁধা। এই যে একটু শোনাব, তার জন্যেও তো কত কৌশল! বুক ধড়ফড় করছে।
ঊর্মিলার হঠাৎ সারা মুখটা লালচে হয়ে ওঠে। ঊর্মিলা বলে, বলো না তুমি আমার কাকাকে?
ধেৎ!
ধেৎ মানে? না বললে ওঁরা বুঝবেন কী করে?
তা বটে!
কোথায় সমুদ্র শুষ্কতায় বিদীর্ণ হচ্ছে, আর কোথায় ঊর্মির আকুল আবেগ আছড়ে পড়ছে, কে জানবে?
তাই সমুদ্র চোখ কান বুজে ঘেমে-টেমে বলে ফেলেছিল, ঊর্মিকে আমায় দিন।
এর উত্তরে অভিভাবককুল বলে উঠেছিল, এত পাকামি?
বলেছিল, এত সাহস?
তখন সাহস ছিল সমুদ্রর।
অথচ এখন সে স্রেফ একটা কাপুরুষের চরিত্র অভিনয় করে এল!
.
এদিকের জানলা থেকে শুধু রান্নাবাড়িটাই দেখা যায়। সেই জানলার ধারেই যা একটু আলো, বাকি ঘরটা ছায়া ছায়া অন্ধকার।
জানলার ধারটা ছাড়া বই পড়া যায় না।
তাই এখানটাতেই বসে ঊর্মিলা।
বই ভিন্ন টিকবে কী করে?
এই একটা দয়া করেছেন রত্নাকর, বই বন্ধ করেননি। তবে যা কিছু বই পড়তে পাবে, তা তাঁর কাছ থেকে একবার যাচাই হয়ে আসবে।
বৃথা নাটক নভেল তো দেবেন না, ধর্মগ্রন্থ, মহাপুরুষের জীবনী–এ সব বই পড়া দরকার। তাই দেন বৈঠকখানার লাইব্রেরি ঘর থেকে।
ওটাও একটা বড়মানুষির অঙ্গ!
লাইব্রেরি থাকা।
তিন পুরুষের সঞ্চয়ে লাইব্রেরির আয়তনটা মন্দ নয়।
ঊর্মিলা যখন প্রথম এসেছিল, সমগ্র বাড়িটা তাকে দেখানোর জন্যে বৈঠকখানা বাড়িতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সমুদ্রর সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার দুঃখে কেঁদে কেঁদে কাহিল ঊর্মিলা ওই বইয়ের আলমারিগুলো দেখে মোহিত হয়েছিল। ভেবেছিল, যাক সারাজীবন এতেই কেটে যাবে যা হোক করে।
কিন্তু ঘর করতে বসে দেখল, বই এরা রেখেছে ঢের, কিন্তু পড়ার বিরোধী। বিশেষ করে মেয়েদের। তা ছাড়া অনেক এত্তালা দিয়ে তবে বই বার করানো যায়।
ভারী যেন দীন মনে হয় তাতে নিজেকে। ভারী বেচারি।
কমে এল পড়া।
কিন্তু এবারে রত্নাকর নিজেই রমাকে দিয়ে বই পাঠাচ্ছেন।
এইগুলো পড়তে বলবে, বুঝলে?
কাকে বলবে, তা আর বোঝাতে হয় না। রমা ঘাড় কাত করে, এনে দেয় এ ঘরে। বলে, তোমার দৌলতে আমরাও তরে যাচ্ছি। বাবাঃ, মামার লাইব্রেরি থেকে বই চাইবার সাহস কার আছে?
তার মানে এখনও কিছু দৌলত আছে ঊর্মিলার। সেই দৌলতে নির্বাসন দণ্ড সহনীয় হচ্ছে তার। শ্বশুর তাকে বই পাঠিয়ে দিচ্ছেন বেছে বেছে।
কিন্তু সেই দুর্লভ দৌলত কি ভোগ করছে ঊর্মিলা? করে কী? জানলার ধারে এসে পড়া ওই আলোটুকুতে ধর্মগ্রন্থখানা খুলে ধরে ও যে চিন্তা করে, সে কি ধর্মচিন্তা?
না ভয়ানক অধর্মচিন্তা?
বিধবা মেয়েমানুষের পক্ষে প্রেমাস্পদের চিন্তার মতো গর্হিত চিন্তা আর কিছু আছে নাকি?
তারপর সমুদ্র কী করল?
এ চিন্তা ছাড়া আর কোনও মহৎ চিন্তা নেই ঊর্মিলার।
কিন্তু আজ ঊর্মিলা অন্য চিন্তা করছিল।
রান্নাবাড়ির যে বিবর্ণ দেয়ালটা এই জানলার সামনা-সামনি, আর যার থেকে কোনাকুনি দেখা যায় বড় দাওয়ায় কুটনো কোটার আসর বসেছে, সেই দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ মনটা হারিয়ে গিয়েছিল ঊর্মিলার।
হঠাৎ যেন মাত্র আজই এ সব দৃশ্য দেখেছে ঊর্মিলা। আর অবাক হয়ে গেছে।
ওই ওরা!
নিত্যদিন যারা ঠিক ওইখানে একই দৃশ্যে অবতীর্ণ হচ্ছে, জীবনের শেষ লক্ষ্য যাদের স্থির হয়ে গেছে, কুটনো কোটা, বাটনাবাটা, রান্নার জোগাড় আর খাওয়ার তদারকিতে, এ ছাড়া আর কোনও কিছু ভাববার নেই, ঊর্মিলা ওদেরই মতো?
বাংলা দেশের একটা বড়লোকের বাড়ির পরিবারভুক্ত আশ্রিতা বিধবা! এই তো ওদেরই পরিচয়।
যদি ওরা দীন-দরিদ্র হত, যদি নিশ্চিত অন্নের প্রতিশ্রুতি না থাকত, হয়তো সেই অন্নচেষ্টায় পৃথিবীর কর্মচক্রে আবর্তিত হতে নেমে পড়তে হত ওদের, আকাশের নীচে, খোলা রাস্তায়।
কিন্তু ওরা দীন-দরিদ্র নয় ওদের নিশ্চিত অন্নের প্রতিশ্রুতি আছে। তার মূল্য শোধ করতে ওদের শুধু এই চৌধুরীবাড়ির পাকশালার পাকচক্রে আবর্তিত হলেই চলবে।
ঊর্মিলারও শেষ পর্যন্ত তাই হবে।
ঊর্মিলা আস্তে আস্তে ওই লীলাপিসি আর নতুন কাকিদের দলে ভিড়ে যাবে। ওদের মতোই তুচ্ছ কথাকে উচ্চস্থান দিয়ে একঘেয়ে দিনযাপনের বিরক্তির মধ্যে বৈচিত্র্যের আস্বাদ খুঁজতে চেষ্টা করবে।
ক্রমশ ওদের মতো শেমিজ ব্যতীতই শুধু তসর কাপড় পরে ঘুরবে, শুচিবাই হবে, মালা জপ করবে!…
ধড়ফড়িয়ে উঠল মন। ইচ্ছে হল দেয়ালে মাথাটা কোটে, তবু ভাবতে চেষ্টা করল, ওদের সঙ্গে কীসেই বা তফাত আমি? ওরাও উচ্চ ভদ্রবংশের মেয়ে, ওদেরও একদা জীবন শুরু হয়েছিল মালাচন্দন শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনির তোরণ পার হয়ে। ওদেরও স্বপ্ন ছিল, সাধ ছিল, বেদনাবোধ ছিল। এখন ওরা ফসিল হয়ে গেছে!
ঊর্মিলাও যাবে তাই।
ওদের পর্যায়ে আমি? বলে নিজেকে বিশিষ্ট ভাবছে এখন ঊর্মিলা, এই বিরাট ভুলটা প্রতি মুহূর্তে খর্ব হতে হতে একদিন সে ওদেরই পর্যায়ভুক্ত হয়ে যাবে।
এই বিষণ্ণ চিন্তার মধ্যে ডুবতে ডুবতে যেন তলিয়ে যাচ্ছিল ঊর্মিলা, হঠাৎ আবার ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়াল।
বিদ্রোহী হয়ে উঠল মন।
না, না, না, কিছুতেই না।
আমাকে উদ্ধার হতে হবে, আমাকে বাঁচতে হবে। আমাকে আর-একজনকে বাঁচাবার ভার নিতে হবে। আমি চিঠি লিখব ওকে, আবার এই পাথরের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে যাব আমি।…
আবার বসে পড়ল।
আর ঠিক সেই সময় জানলার নীচে মধুকরের মুখটা দেখা গেল। পা উঁচু করে এবং মুখ উঁচু করে, তবে এই জানলার নাগাল পেয়েছে সে।
খুব নিচু গলায় ডাক দিল সে, কাকিমা!
কাকিমা?
ঊর্মিলা চমকে উঠল, ঊর্মিলা যেন বর্তে গেল, ঊর্মিলা শুধু বলতে পারল, মধু! সেই উচ্চারণটুকুর মধ্যেই যেন জগতের সমস্ত মধুরস উথলে উঠল।
মধুর বুড়ো আঙুলের উপর সমস্ত দেহটার ভর। কষ্টে বলে, এসো তুমি এখানে।
ঊর্মিলাও কষ্টে বলে, যাচ্ছি সোনা, যাচ্ছি।তারপর দ্রুত বেরিয়ে আসে বাইরে, সিঁড়ির তলার দরজা দিয়ে। যে সিঁড়িটা শুধু রান্নাবাড়ির ছাতে ওঠার। যে ছাতে শুধু ওই আশ্রিতারা বড়ি আচার আমসত্ত্ব রোদে দিতে ওঠে দুপুরবেলা, এখন কেউ নেই। এখন সবাই পাকশালের পাকচক্রে আবর্তিত হচ্ছে।
ঊর্মিলাকে কেউ দেখতে পায় না।
.
বুড়ো একটা আমড়াগাছ শাখা-প্রশাখা বিছিয়ে এই রান্নাশালার পিছনটা অন্ধকার করে তুলেছে। সেখানে বসে পড়ে ঊর্মিলা মধুকে কোলে নিয়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, এতদিন পরে এলি তুই? দুষ্টু দুষ্টু!
মধু সতেজে নিজের দোষ অস্বীকার করে।
বলে, আমি কি আসতাম না? ওরা বলল, তুমি তোমার মুখটা পুড়িয়ে ফেলেছ, তোমাকে দেখলে ভয় করবে, তুমি কথা কইবে না, তুমি আমায় চিনতে পারবে না– তেজ ভাসিয়ে কান্নায় ডুকরে ওঠে কণ্ঠ।
শান্ত হতে সময় দিয়ে মৃদু হেসে বলে ঊর্মিলা, এ সব কে বলল রে?
মা দিদা পিসি ঠাকুমা বামুনদি আরও সবাই। বলল যে, তুমি বাপের বাড়ি গিয়েছিল না হাতি, তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে, তুমি খারাপ হয়েছিলে!
মৃদু হাসি মিলিয়ে যায়, স্তব্ধ হয়ে যায় ঊর্মিলা।
ছেলেটা ভয় পায়।
ভীরু ভীরু গলায় বলে, তুমি রাগ করলে? ও সব তো ওরা বলেছে—
তা তুই এবার এলি যে?
বাবা বলল, সব মিছে কথা। তোমার মুখ ঠিক সুন্দর আছে। তোমাকে চিনতে পারব, তুমি কথা কইবে–
বাবা!
তার মানে ঊর্মিলার জীবনের সেই শনি!
কঠিন হয়ে ওঠে ঊর্মিলা।
আস্তে বলে, তোমার বাবার কথা ঠিক নয়, ওদের কথাই ঠিক!
য্যাঃ!
মধু এটা পরিহাস ভেবে হেসে ওঠে, কই তবে? কই তোমার মুখ পোড়া? এই তো তুমি আমায় চিনতে পারছ। তুমি এ ঘরে থাকবে না আর, এ ঘর বিচ্ছিরি!
ঊর্মিলা যেন ভুলে গেছে, ও একটা ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলছে। তাই বলে, আমিও তো বিচ্ছিরি! আমি তাই এই ঘরেই থাকব।
না, তুমি ভাল।
মোটেই না!
বলছি ভাল! বাবা বলেছে, তুমি খুব ভাল
নাঃ, সত্যিই ভুলে গেছে ঊর্মিলা ওর সামনে একটা ছোট শিশুর আগ্রহব্যাকুল মুখ।
তাই সহসা ছেলেটাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে রূঢ় গলায় বলে ওঠে, না, বলেননি তোমার বাবা!
হয়তো আরও কিছু বলত।
থামতে হল।
স্বয়ং বাবার-ই আবির্ভাব ঘটল সেখানে। অপ্রত্যাশিত আকস্মিক!
খোকা অভিমানে খান খান হয়ে ছুটে যায়, বাবা, তুমি বলোনি কাকি ভাল? কাকি বলছে বলোনি।
শিলাকর ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে মৃদু গম্ভীর হাস্যে বলে, ছোট ছেলেটার উপর রাগের ঝাল মিটিয়ে লাভ কী? বেচারা কদিন বড্ড কষ্ট পেয়েছে।
ঊর্মিলা আস্তে আঁচলটা মাথায় তুলে দেয়।
শিলাকর আবারও বলে, তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়াটা ধৃষ্টতা হবে, তাই না?
ঊর্মিলা এবার কথা বলে, স্পষ্ট পরিষ্কার গলায়।
বলে, এ বাড়িতে ভাদ্রবউয়ের সঙ্গে কথা বলার রীতি নেই, তা অবশ্যই জানেন আপনি!
শিলাকর তেমনই গম্ভীর-হাস্যে বলে, জানি। কিন্তু।
মাপ করবেন। এভাবে মধুকেও পাঠাবেন না, আপনিও আসবেন না।
দ্রুত পায়ে ফিরে যায় ঊর্মিলা।
তার ভাশুরকে মূক করে দিয়ে।
শিলাকর আবার ওর পিছন পিছন ছুটে যাবে? বলবে, আমি তোমার যা ক্ষতি করেছি তার জন্যে আমার যন্ত্রণা হচ্ছে! খুব যন্ত্রণা!
কথা কওয়ার রীতি নেই।
কিন্তু একবার সহস্র কথা কয়েও সে রীতি অটুট থাকে?
বাবা! মধু বিচলিত গলায় বলে, কাকিমা দুষ্ট হয়ে গেল কেন?
কী জানি– অন্যমনস্কর মতো কথাটা উচ্চারণ করেই শিলাকর বলে ওঠে, সবাই তোমার কাকিমাকে শাস্তি দিয়েছে, তাই ওঁর দুঃখু হয়েছে।
কে শাস্তি দিয়েছে?
সব্বাই! আমি, তোমার দাদু, দিদা, মা, ভগবান সব্বাই। আমি সবচেয়ে বেশি।
তুমি কেন? তুমি কক্ষনো না। তুমি তো কাকিমাকে ভালবাস! বাসো না?
শিলাকর যেন চমকে ওঠে। শিলাকর ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখে, শোনা কথা বলছে কিনা। তারপর শিলাকর ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে বলে, বাসি বইকী! নিশ্চয় বাসি।
.
ঝুলনে সত্যভামার ঠাকুরের মহোৎসব হয়।
উৎসবটা আস্তে আস্তে পরিণত হয়েছে মহোৎসবে।
নীচতলার ঠাকুরদালানে জায়গার অভাব ছিল না। কিন্তু পশুরক্তে কলঙ্কিত সেই বেদিতে তো আর প্রেমের দেবতা বসতে আসেন না। সত্যভামার দীক্ষা গ্রহণের পর তাই ঠাকুরঘর বানানো হয়েছিল তিনতলার উপর। মার্বেল মোড়া, বেদি গাঁথা।
বাগানের সব ফুল তুলসী সেইখানে ওঠে।
প্রথম প্রথম সত্যভামা নিজে নিজেই বিশেষ একটু ভোগ দিয়ে বাড়ির লোককে বিতরণ করতেন। ক্রমশ সেটা বাড়তে বাড়তে পুরোহিতের দ্বারা পুজো, আর রীতিমত মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। সাধ আর চেষ্টার সঙ্গে যথেচ্ছ পয়সা মিলিত হলে বৃদ্ধি তো হবেই! সব কিছুরই হয়।
এখন কীর্তন হয়।
এখন পাড়াসুদ্ধ সকলের প্রসাদের নিমন্ত্রণ জোটে।
শুধু রত্নাকর ওর মধ্যে থাকেন না।
রত্নাকরের জন্যে যথারীতি মুরগির ঘরে ব্যবস্থা হয়।
রত্নাকর কোনওদিন সত্যভামার গুরুদেবকে প্রণাম করতে আসেন না। অবশ্য সত্যভামাও এখন আর কুলগুরু এলে প্রণাম করতে ছোটেন না। কিন্তু সে তো আর স্বামীর সঙ্গে রেষারেষি করে নয়? সে গুরু তান্ত্রিক সাধক বলে!
তন্ত্রসাধনা হল নিকৃষ্ট মার্গের, ওর সাধকরা অপবিত্র। দুর্গোৎসবের কাজকর্মও তো করেন না আর সত্যভামা।
সে যাক, ঝুলনের সময় গুরুদেব এসে কদিন থাকেন দোতলায় দক্ষিণ বারান্দার দিকের ঘরে। যে ঘরে আগে রত্নাকর থাকতেন। গুরুর জন্যে শ্রেষ্ঠ স্থানটি গ্রহণ করতে স্বামীর অনুমতি চেয়েছিলেন সত্যভামা।
রত্নাকর বলেছিলেন, একশোবার! একশোবার! তোমার গুরুর যদি ওই মদটদ খাওয়া ঘরে পবিত্রতা হানির ভয় না থাকে, স্বচ্ছন্দে
সত্যভামা সতেজে বলেছিলেন, গুরুদেব অপবিত্র হতে যাবেন কেন? ঘরটাই পবিত্র হবে। আর আমি কি ধোওয়া মোছা না করেই ওঁকে থাকতে দেব?
তা বটে!
হেসেছিলেন রত্নাকর ওঁর নিজস্ব ব্যঙ্গের ভঙ্গিতে।
তদবধি গুরুদেব এলেই ওই ঘরে।
আরাম, আয়েস আর আকুলতাময় আবেদন, এই তিনটেতে মিলে আটকে ফেলে তাঁকে দু-চার দিন। সত্যভামা ঠিক করেছেন এবারে ওঁর ওই থাকাকালীন সময়ে ঊর্মিলাকে দীক্ষা দিতে বলবেন।
সব ইতিহাস খুলে বলেই বলবেন।
গুরুর কাছে আবার লজ্জা কী?
আর—
ভেবে রেখেছেন সত্যভামা, গুরুদেবের কাছে চুপি চুপি অনুরোধ জানিয়ে রাখবেন, প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ গুরুদেব যেন মস্তক মুণ্ডনের আদেশ দেন।
তবেই জব্দ হয় সর্বনাশী!
জব্দ করা দরকার।
ভয় হচ্ছে, সর্বনাশী বুঝি সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে।
সংসারের তলায় তলায় সেই আতঙ্কের ছায়া!
অলকার জ্বলন্ত চোখের দৃষ্টিতে, নিশ্বাসের উত্তাপে সেই খবরের আভাস।
মাথা মুড়লে তবু যদি আকর্ষণ হারায়।
কিন্তু গুরুদেব কি দীক্ষা দিতে রাজি হবেন ওই পতিতাকে? আর দিলেও, মস্তক মুণ্ডনের আদেশ দেবেন কী?
রুপোর খড়ম গড়িয়ে রাখবেন এবার সত্যভামা গুরুর জন্যে।
পরামর্শের সঙ্গিনী অলকাই।
সে কিন্তু গুরুর ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করে না। করে আসামির প্রশ্নে।
বলে, উনি ঠিকই রাজি হবেন মা! আপনি অনুরোধ করলেই হবেন। তিনিই রাজি হবেন কিনা। সন্দেহ। আমার তো মনে হয় না ছোটবউ রাজি হবে।
হবে না, ওর বাপ হবে!
সত্যভামা বলেছেন, ঘাড় ধরে করিয়ে নেব। নচেৎ ঘাড়ে ধরে বার করে দেব।
আহা তা হলে তো বড়ই শাস্তি? সে তো ওর শাপে বর! তাই তো চায় ও।
কথাটা সত্যি।
তাড়িয়ে দেওয়া মানেই তো ওকে ওর প্রার্থিত পথে ছেড়ে দেওয়া। তার চাইতে বাড়িতে বন্দি করে রাখাই ভাল।
কিন্তু বন্দিত্বের দুর্দশার মধ্যেও যে সেই তীক্ষ্ণদাঁত উঁদুর সংসারের ভাঁড়ার ঘরে সিঁদ কাটতে বসেছে।
শুধু যে অলকাই ভ্রম দেখেছে তা তো নয়, সত্যভামাও দেখেছেন বইকী! সত্যভামা দেখেছেন, রান্নাবাড়ির পিছনে তাঁর বড়ছেলের ঘোরাঘুরি। যে ছেলে সত্যভামার দেবতা ছেলে!
ও কেন ওখানে?
জীবনে কখনও ওদিকে গেছে ও?
ওদিকের পথ চেনে?
চিনত না।
এখন চিনেছে।
নিজের চক্ষে দেখেছেন সত্যভামা।
আর দরদটাও তো দেখছেন।
হিমুর বউয়ের জন্যে কবে কোনদিন ভাবতে বসেছে হিমুর দাদা? বসেনি।
অথচ এখন ভাবতে বসেছে।
এখন এসে অভিযোগ করছে, তোমাদের এই কাজটা শুধু নিষ্ঠুরতাই হয়নি, ইতরতাও হয়েছে।
অভিযোগ করছে, তোমাদের দুর্ব্যবহারই অতিষ্ঠ করে তুলেছিল ওঁকে, বুঝতে পারছি এখন।
অভিযোগ করছে, শুধু ওঁকেই শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, মধুকেও দেওয়া হচ্ছে।
এর অর্থ কী?
অর্থ হচ্ছে টনক নড়া!
বিধবা ভাদ্রবউয়ের দুঃখকষ্ট ভেবে টনক নড়েছে বাছার!
প্রতিকার করতে হবে না এর?
বাঁধ দিতে হবে না?
বড়বউমা ঠিকই বলেছে, তাড়িয়ে দেওয়া মানেই তো ওর সুবিধে করে দেওয়া। নজরবন্দি রাখতে পারলে তবে–।
ঠিক।
তার ব্যবস্থাই করবেন সত্যভামা!
ন্যাড়া করে, মোটা থান পরিয়ে, নিত্য দুবেলা হাজার জপের নির্দেশ দিয়ে আটকে আটকে রাখবেন। ঝোঁকটা কেটে যাবে।
আটক সবদিকে। দেহে মনে।
ওদিকে বাগানের পিছনের দরজাতেও তো দারোয়ান বসানো হয়েছে।
আয়োজন যে চলছে একটা, এবং সেটা ঊর্মিলাকে সুপথে আনবার জন্যেই, সেটা বুঝতে দেরি হয় না ঊর্মিলার।
রমাই খবর সরবরাহক।
এবার মনে হয় মামি তাঁর নিজের গুরু দিয়ে মন্তর দেওয়াবেন তোমায়। মামার সঙ্গে কথা হচ্ছিল শুনলাম। মামি বলছিলেন–তোমাদের কুলগুরুর তো শক্তিমন্ত্র, ওকে আর তা দিয়ে কাজ নেই। শান্ত মন্ত্রই ভাল।
তারপর নিশ্বাস ফেলেছিল রমা।
অথচ আমি এতবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছি, গা করেন না কখনও।
রমার সঙ্গে আগে এত কথা হত না।
আজকাল হয়।
ঊর্মিলা অবিরত চেষ্টা করে নিজেকে রমার পর্যায়ে ভাবতে। তাই সকৌতুকে প্রশ্ন করেছিল, সত্যি ইচ্ছে করে তোমার দীক্ষা নিতে?
করে বইকী! করবে না?
আচ্ছা, কেন?
কেন? কেন মানে? জীবনের একটা অবলম্বন তো চাই।
তোমাদের মামিমার মতো ছোট ছোট কাপড় গয়না, ছোট ছোট বাসন নিয়ে পুতুল খেলে সে অবলম্বন পাবে?
রমা এই বউটার দুঃসাহসিক কথাবার্তায় ক্রমশই আরও বেশি অভ্যস্ত হচ্ছে, তাই চমকালেও শিউরে ওঠে না।
হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলে, পেলেই বা কী? আমার ও সাধ কুঁজোর চিত হয়ে হয়ে শোয়ার মতো। অত আমায় দিচ্ছে কে? আমার উপকরণ গাছের ফুল আর গঙ্গার জল।
তা তার জন্যে ঘটা করে দীক্ষা নেওয়ার কী আছে?
ঘটা? আমার আবার ঘটা!
আচ্ছা বাপু, না হয় ল্যাঠা। তা সেটাই বা কেন? নিজে নিজে হয় না?
বাঃ, নিজে কী করে বুঝব ঠিক পথে যাচ্ছি কি না।
বুঝতে হলে নিজেই বুঝতে হয় রমা ঠাকুরঝি!
তাই কি হয়? রমা বলে, মন তো সর্বদাই বিপথে ছুটতে চায়।
হয়তো কিছু ভেবে বলেনি রমা।
হয়তো গতানুগতিক শোনা কথাই বলেছিল, তবু আরক্ত হয় ঊর্মিলা। বলে, কোনটা বিপথ কোনটা ঠিক পথ, সেই রহস্যই ভেদ হয়নি এখনও পর্যন্ত। এক এক সমাজের এক এক পথ। কিন্তু সমগ্র মানুষের মনের রাজ্যের একটা মাত্রই পথ!
রমা বলে, মুখ মানুষ, বুঝি না ভাই অত! জানি জীবনে আর কিছুই যখন ধরবার নেই, তখন ভগবানকেই ধরা ভাল।
তা বটে! অগতির গতি-ঊর্মিলা আস্তে হাসে।
আচ্ছা রমা ঠাকুরঝি, তোমার স্বামীকে খুব বেশি মনে পড়ে তোমার?
কই আর?
রমা বিষণ্ণ হয়, একটা ছবি পর্যন্ত নেই।
তা হলে? হঠাৎ যদি ফিরে এসে দাবি করেন, আমিই তোমার স্বামী, চিনবে কী করে?
হিন্দু মেয়ে তা ঠিক চিনে নেয়।
অহিন্দু মেয়ে পারে না?
তাদের রীতিনীতি সংস্কার সব আলাদা। হিন্দু মেয়ের চিন্তায় স্বামীই সব।
আচ্ছা, তোমার যদি আবার বিয়ে করবার উপায় থাকত, করতে পারতে না?
ছি ছি, কী বলছ ছোটবউদি! নিজের মন দিয়ে সবাইকে বিচার কোরো না।
তা বটে। তা হলে এখন এই দাঁড়াচ্ছে-তুমি এখন একটি গুরু, একটি ইষ্ট, আর একটি ঠাকুরঘর পেলেই মনে করবে জীবন সফল হল।
তাই করতে হবে।
করতে হবে নয়, করবে কি না?
করব! রমা কথায় দৃঢ়তা আনে। তা ছাড়া আর কী?
আচ্ছা, তারপর যদি তোমার স্বামী ফিরে আসেন, আর এসে বলেন, এ সব আমি পছন্দ করি না। ছাড়ো তোমার ঠাকুর।তখন?
রমা ক্ষীণ গলায় বলে, বাঃ তাই বা বলবেন কেন?
যদি বলেন! যদি এতদিনকার নিরুদ্দিষ্ট জীবনের মধ্যে তেমনি কোনও শিক্ষাই গ্রহণ করে থাকেন তিনি? কাকে ছাড়বে? ঠাকুরকে না স্বামীকে?
এখন বলতে পারছি না।
তার মানে সত্যি কথা বলবার সাহস নেই তোমাদের রমাদি!
রমা নিশ্বাস ফেলে। রমা ভাবে, চিরকাল যাকে পরের ভাত খেতে হচ্ছে, তার আবার সে সাহস আসবে কোন পথে?…ভাবে, তোমার মতন ভাগ্য কি? স্বামী গেল, অত বড় কেলেঙ্কারি করলে, তবু স্বামীর ঘরে ঠাঁই পাচ্ছ, ভাত পাচ্ছ। আবার এখন আরও কিছু পাবার আশা পাচ্ছ! ধর্মপথে না হোক, তবু পাওয়া।…ধর্মপথের ধার তো তুমি ধার না।
হ্যাঁ, সন্দেহের বাষ্প সকলের মনের তলায়।
মেয়েমানুষের চোখ বড় তীক্ষ্ণ।
এতটুকুতেই বুঝতে পারে সে।
আর এতটুকুকেও ও কিছু নয় বলে অবহেলা করে উড়িয়ে দেয় না।
আশ্চর্য হবার কিছু নেই।
এ বংশের পুরুষদের আরও অনেক গর্হিত অনাচারের কাহিনী শুনেছে রমা। আশ্চর্য শুধু এই বিধাতা যাকে দেন, তাকে ঢেলে মেপে দেন। নইলে রমাও চিরদুঃখিনী, রমাও চির বেওয়ারিশ! আর সত্যিই কিছু সহোদরা নয় রমা! লতায় পাতায় সম্পর্ক ধরে পিসতুতো বোন।
অন্তত ভাদ্রবউয়ের থেকে ভাল সম্পর্ক।
অথচ কেউ কোনওদিন একটু হেসে কথা বলে না রমাকে। কেউ কোনওদিন বিশেষ একটু দৃষ্টিতে দেখেনি।
দেখতেই কি তবে খুব বিশ্রি রমা?
তা নয়। বিশ্রি আদৌ নয়।
সবাই বলে সে কথা।
বলে, এত দুঃখেও চেহারার বাঁধুনিটি দেখ। সুখে থাকলে আরও কত খোলতাই হত! সুখের ঘরেই তো রূপের বাসা!
ভাগ্য!
সবই ভাগ্য!
ঊর্মিলার ভাগ্যকে ঈর্ষা করে সেখান থেকে উঠে যায় রমা।
আর ঠিক সেই সময় ঊর্মিলার জানলায় ঊর্মিলার দুর্ভাগ্যের ছায়া পড়ে।
ঠিকরে ওঠে ঊর্মিলা।
আবার? আবার আপনি এভাবে এখানে
না এসে যে উপায় হচ্ছে না–শিলাকর যেন ঠিকমতো সম্বোধন খুঁজে পায় না, যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়। নাম করে ডাকবে? না কি ছোট বউমা বলবে? বুঝতে পারল না। তাই ড্যাশ দিয়ে ছেড়ে দিল।
ঊর্মিলা তীব্র চাপা গলায় বলে, কেন? কীসের নিরুপায়তা আপনার?
শিলাকর এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, এত শীঘ্র বলা যাবে না। অথচ বলা বিশেষ দরকার।
ঊর্মিলার মুখটা কঠিন হয়ে ওঠে, কঠিন হয়ে ওঠে সমস্ত স্নায়ুশিরা। ঊর্মিলার অপরাধের সাক্ষী হয়ে ও বুঝি ভেবেছে, ঊর্মিলা নীচ নোংরা ইতর?
ওই কমনীয় মুখের অন্তরালে আত্মগোপন করে আছে এ কোন কুৎসিত জীব! এতদিন দেখেছে দূর থেকে, অন্তরাল থেকে। দেবতার মতো মনে করেছে। এই তার স্বরূপ!
হঠাৎ মনে হয়, এই তো হবে স্বরূপ।
দেবতার মতো ভাবাটাই ভুল ভাবা হয়েছে। সেই ভুল ভাবনাটা নিয়ে আমার বড়জার ভাগ্যকে হিংসে করেছি। ভেবেছি ইনিও তো রত্নাকর চৌধুরীর ছেলে।
কিন্তু এখন তো সে ভুল নেই।
এখন তবে স্বরূপ দেখে আশ্চর্য হচ্ছি কেন?
স্বরূপ তো সেদিনই দেখা হয়ে গেছে, যেদিন ওঁর পায়ে পড়েছি, মাথা খুঁড়েছি, বাঁচবার জন্যে ব্যাকুলতায় ভেঙে পড়েছি।
কিন্তু উনি?
উনি তখন প্রমাণ করেছেন, উনি রত্নাকর চৌধুরীর ছেলে।
তবে?
তবে আবার বিস্ময় কীসের?
আচ্ছা, আমি কেন সেদিন বোকার মতো ওঁর পায়ে পড়তে গেলাম? আমি কেন ওঁকে ভয় করতে গেলাম? ঊর্মিলা ভাবে, আমি তো রুখে উঠে বলতে পারলাম, কই ডাকুন না আপনার পুলিশকে, দেখি সে কার পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হয়?…ঘুষ দিয়ে হাতে রাখত? আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করতে পারতাম!…আমাকে কেউ নাবালিকা ভাবত না। আইন আমার পক্ষে ছিল, পাবলিক আমার পক্ষে হত।
অথচ সে সব খেয়াল করলাম না আমি। আমি ওঁর পায়ে পড়তে বসলাম!…আর উনি যখন ব্যঙ্গবিদ্রূপ আর শাসনের পথ ধরলেন, আমি তখন নিরুপায়ের ভূমিকায় ওঁর নিষ্ঠুরতার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম।…একেবারে নিরেট বোকার মতো ওঁর পিছু পিছু ওঁর গাড়িতে এসে উঠলাম।
এখন বুঝতে পারি কেন অমন অদ্ভুত বোকামি করেছি।
আমি ওঁকে দেবতা ভাবতাম, তাই!
আমি ওঁর ছদ্মবেশকে বিশ্বাস করতাম, তাই!
দেব-হৃদয়ের কাছে আবেদন করতে গিয়েছিলাম, নিজের অধিকার ভুলে।
ওই যে শান্ত সৌম্য গাম্ভীর্য, ওইটাই ওঁর ছদ্মবেশ। এখন খুলে পড়ছে সেটা, ভিতরের কুশ্রী রূপ ধরা পড়ছে।
আমার বড়জার কাছে সেই ভিতরের রূপ আগেই ধরা পড়েছে, তাই সব সময় ওর মধ্যে অসন্তোষ! আমি অবাক হতাম, আমি ভাবতাম মানুষ যত পায় ততই তার চাহিদা। নইলে ওর মধ্যে এত অসন্তোষ!
এখন বুঝতে পারছি কেন ওই অসন্তোষ।
বেশি কাছাকাছি না এলে ছদ্মবেশ চেনা যায় না। এতদিন তাই চিনতে পারিনি। এবার পারছি, আর ওর ওই সৌম্য শান্ত ভদ্র চেহারাকে বিশ্বাস করব না। ও ওর ছোট ভাইয়ের সগোত্র! ও হিমাকর চৌধুরীর ভাই, রত্নাকর চৌধুরীর আত্মজ, এই ওর শেষ পরিচয়!
কিংবা আরও পরিচয় আছে।
ও সত্যভামা দেবীর গর্ভজাত।
ছদ্মবেশের ব্যাপারে যিনি সবাইকে টেক্কা দিতে পারেন।
তুলসী কাঠের মালার আবরণের নীচে রক্তপিপাসু এক বাঘিনী! হ্যাঁ, তাই তুমি!
তোমার ছোট ছেলে নতুন বিয়ে করে সুন্দরী স্ত্রী নিয়ে মেতেছিল বলে তুমি বশীকরণের ওষুধ খাইয়ে মারলে ছেলেটাকে!
তুমি ভাবো কেউ জানে না তোমার সেই ওষুধ প্রয়োগের কথা, কিন্তু আমি জানি। আমি জেনেছিলাম কিন্তু আমি ওসবে বিশ্বাস করতাম না, তাই প্রতিবাদ তুলিনি।
তারপর দেখলাম, সে বুক গেল বুক গেল বলে ছটফটিয়ে উঠল। অবাক হলাম, অভিভূত হলাম। অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটে তা হলো না কাকতালীয়? এই ভাবতে ভাবতে একটা সিদ্ধান্তে স্থির হলাম।
সেই ওর রোগের সূত্রপাত!
কিন্তু ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে তোমার বশও হল না।
অথচ এসব না করলেও পারতে তুমি সত্যভামা দেবী, তোমার ওই ছেলে তার সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে তেমনি করেই মেতেছিল, রত্নাকর চৌধুরী তাঁর নতুন ঘোড়াটা কিনে যেমন মেতেছিলেন। তার বেশি কিছু নয়।
তুমি তোমার ছোট ছেলেকে বড় বেশি ভালবাসতে, তাই হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ভেবে দিশেহারা হয়ে যা তা একটা কাণ্ড করে বসেছিলে!
ও যখন মারা গেল, প্রথম ধাক্কাটায় হঠাৎ অসতর্ক হয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলে তুমি, আমি কী করলাম। আমি কী করলাম!
কিন্তু উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলে তুমি, এ আর্তনাদের অর্থ খুঁজবে লোকে। পুত্রশোকের সেই মহামুহূর্তেও সে কথাটা মনে পড়ল তোমার, তাই নিজেকে সামলে নিলে, কথাটা শুধরে নিলে। সুরটা টেনে নিয়ে বলতে লাগলে, আমি কী বিষকন্যা এনে তোকে ধরে দিলাম বাবা–
সেটা আর আর্তনাদ থাকল না, বিলাপ হল।
কিন্তু কেউ বুঝতে পারল না।
ভাবল, অপয়া বউকে অপয়া বলাটাই স্বাভাবিক! ঘোরালো করে বলতে গেলে বিষকন্যা! তা সেটা অবিশ্বাস করেনি কেউ। অনেকেই বিষদৃষ্টিতে তাকিয়েছে আমার দিকে। ভেবেছে সত্যিই তো–অমন জলজ্যান্ত পাহাড়ের মতো ছেলেটা, বউকে ছুঁল আর রোগে পড়ল।
পরে ভেবেছি, রোগের কারণ যদি ব্যক্ত করে বসতাম কারও কাছে, হয়তো প্রতিকার হত। কিন্তু ওই বশীকরণটরণ আমার কাছে বিশ্বাসের সত্যে স্পষ্ট নয়, দ্বিধার কুয়াশায় ঝাপসা। তাই কাউকে বলিনি। বলবার মতো রুচিও ছিল না আমার, সেটাও একটা কারণ! কিন্তু আমি যে সবই বুঝতে পেরেছিলাম তোমার চেষ্টা তোমার নিষ্ফলতা, তোমার আর্তনাদ, তোমার সামলে নেওয়া–সব, সেটা তোমায় জানতে দিইনি!
তুমি সত্যভামা দেবী, জীবহিংসা করো না। তুমি অহিংস, তুমি বৈষ্ণব!
এই ছদ্মবেশ নিয়ে তুমি তোমার বাঘ-শিকারি স্বামীকে অভিভূত করে বশ করতে চেয়েছিলে। পারলে না, হারলে! কিন্তু একটা সুবিধে হল, ছদ্মবেশের নিখুঁত পালিশে সেই বাঘা স্বামীর বজ্রমুষ্টি থেকে পিছলে সরে আসতে পারলে তুমি!
হয়তো বা তিনি অবজ্ঞায় ছেড়ে দিলেন তোমাকে। কিন্তু তাতে তোমার দুঃখ রইল না, উপগ্রহ হয়ে ঘুরে মরতে এখন নিজের একটি পরিমণ্ডল রচনা করে নিয়ে নিজ কক্ষে স্থির হয়ে আছ।
রত্নাকর চৌধুরী তোমায় বাধা দেন না।
তোমায় তোমার পুতুল খেলার টাকা জোগান। সেটা তোমার প্রতি প্রীতি নয়, তাঁর বিবাহিতা স্ত্রীর সম্ভ্রম। সেই সম্ভ্রমের সুযোগটা ভালভাবেই নিচ্ছ তুমি। তোমার ছেলে মারা যেতে আরও বেশি করে নিচ্ছ।
এই শাক্ত বাড়িতে বৈষ্ণব ধর্মের জয়ধ্বজা ওড়াচ্ছ।
তুমি কি সত্যিই বৈষ্ণব?
তুমি অহিংস?
ফুঃ!
সব তোমার ছদ্মবেশ!
অতএব তোমার ছেলে ছদ্মবেশী হবে, সেটা কিছু বেশি কথা নয়।
কিন্তু ঊর্মিলা সবাইয়ের সব ছদ্মবেশ ধরে ফেলেছে। ঊর্মিলাকে ভোলানো যাবে না।
তাই ঊর্মিলা তার ভাশুরের ওই ভিক্ষুক মূর্তির দিকে তাকিয়ে বিগলিত হয় না, তীব্র হয়। বলে, আপনার সঙ্গে কোনও দরকার থাকতে পারে না আমার।
শিলাকর এ অপমান গায়ে মাখে না।
শিলাকর ওই উজ্জ্বল দীপশিখার মতো দৃপ্ত মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে দেখে। আশ্চর্য, এত দুর্গতিতেও নিভে যায়নি, মুষড়ে যায়নি।
ব্যগ্রভাবে বলে, তোমার দরকার না থাক আমার আছে
ঊর্মিলা আরও রুক্ষ গলায় বলে, সেটা আমার ভাববার কথা নয়। আপনাকে অনুরোধ করছি এভাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করবেন না।
ছদ্মবেশী শিলাকর ওর সেই সৌম্য মুখ নিয়ে মৃদু গম্ভীর হাসে।
রাখব অনুরোধ। কিন্তু তার আগে আমারও একটা অনুরোধ রাখতে হবে। সন্ধ্যার পরে একবার
আর সহ্য করা অসম্ভব!
মুখের উপর জানলাটা বন্ধ করে দেওয়াই মুখের মতো জবাব। তবু সেটা করবার আগে বলে নেয় ঊর্মিলা, একটা অসহায় মেয়ের বাঁচবার পথে কাঁটা দিয়ে এইবার বুঝি তার মরার পথটা প্রশস্ত করে দিতে চান? না কি চান এ বাড়িতে একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটুক? বাবুডাঙার চৌধুরীদের সুনাম সম্পর্কে তো চেতনার অভাব নেই আপনার, একটা বিধবা বউয়ের আত্মহত্যায় সে সুনামের হানি হবে না?
শিলাকর তবু সরে যায় না।
তবু মাথা হেঁট করে না, বরং আরও ব্যগ্র আরও দ্রুত বলে ওঠে, এই ভয়! এই ভয়েই অস্থির হচ্ছি আমি। তোমার সঙ্গে যা দুর্ব্যবহার করা হচ্ছে–
দুর্ব্যবহার? আমার সঙ্গে? ঊর্মিলার মুখ ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, আপনার মার দুর্ব্যবহারের কথা বলছেন? দেখে বড় দুঃখ পাচ্ছেন বুঝি?
পাচ্ছি! বিশ্বাস করো–
ঊর্মিলা জানলার কপাটটা চেপে ধরে। ঊর্মিলা বলে, বিশ্বাস অবিশ্বাস কিছুই করতে চাই না আপনাকে। দয়া করে আমাকে দয়া দেখাতে আসার অভিনয়টা করবেন না।
জানলাটা বন্ধ করে দেয় ঊর্মিলা।
হাঁপায় যেন।
সেই বন্ধ জানলাটায় পিঠ দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে দাঁড়িয়েই স্থির হয়ে যায়।
মুখোমুখি হয় অলকার সঙ্গে।
তার মানে অলকা জানলা বন্ধ করা দেখেছে।
অলকা জানলা খোলা থাকাও দেখেছে অবশ্যই।
ঊর্মিলা অতএব আরও স্থির হবে। হবে আরও শান্ত।
অলকাও স্থির।
অলকার হাতে যে একটা পুজোর থালা ছিল, আর তাতে কটা মঙ্গলদ্রব্য ছিল, সেটা হাত থেকে পড়ে গেল না বোধ করি অত বেশি স্থির হয়ে গেছে বলেই।
কিন্তু ঊর্মিলা ফিরে দাঁড়াতেই অলকা কাঁপল।
অলকা যেন বিদ্যুতের শক খেল।
অলকার অভ্যস্ত হাত বোধ করি অলকার অবচেতনায় থালাটাকে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল, কিন্তু অলকা কাঁদতে লাগল।
রাগে দুঃখে, অপমানে ধিক্কারে, অলকার কাঁপা কাঁপা গলাটা ভারী বিকৃত শোনাল। সেই বিকৃত প্রশ্ন যেন এই ঘরের দেয়ালগুলোয় মাথা খুঁড়ল, কে ছিল ওখানে?
অলকার যন্ত্রণায় ঊর্মিলার চোখে জল এল, ঊর্মিলা মাথা নিচু করল।
অলকা আবার বলল, চুপ করে রইলি যে? মাথা হেঁট করছিস যে? বল কে ছিল?
ঊর্মিলা এবার মুখ তোলে।
বলে, বললে তুমি দুঃখ পাবে দিদি!
দুঃখ পাচ্ছে দেখছে, তবু ওই কথাই বলল।
আমি দুঃখ পাব সেই ভাবনা ভাবছিস তুই? অলকা ভাঙা চাপা গলায় বলে, ঢলানি কথাটার মানে জানলাম এতদিনে। কিন্তু না শুনে ছাড়ব না আমি, নিজ মুখে বল তুই, কে ছিল ওখানে?
হয়তো অলকা তখনও সামান্যতম আশা করছিল ঊর্মিলা আর কারও নাম করে উঠবে। হয়তো ওর সেই প্রণয়ীটি আবার এসে জুটেছে, আবার পালাবার ষড়যন্ত্র ভাঁজা হচ্ছে। ঈশ্বর করুন তাই হোক।
কিন্তু ঈশ্বর তা করলেন না।
ঊর্মিলা ওর চোখে চোখ ফেলে আস্তে বলল, তোমার স্বামী।
তোমার স্বামী!
বটঠাকুর নয়, তোমার স্বামী!
তার মানে চিরদিনের সেই শ্রদ্ধা সম্মানের ডাকটা ডাকতেও আর সাহস নেই। সম্পর্কটা মুছে ফেলেছে লক্ষ্মীছাড়ি।
অলকার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
অলকা মান বজায় রাখতে পারল না।
অলকার রুদ্ধকণ্ঠ থেকে স্থলিত হয়ে পড়ল, আমার স্বামী! বটঠাকুর বলবার সাহসটাও নেই আর? কেমন? কী বলব, তোকে আমার ছুঁতে ঘেন্না তাই! নইলে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দিতাম তোকে! দেউড়ির বার করে দিতাম!
ঊর্মিলা সহসা ওর খুব কাছে সরে আসে।
কিন্তু আগের মতো গায়ে হাত রেখে কথা কইবার সাহস হয় না বোধ করি। শুধু গলার সুরে ব্যর্থ বিহ্বলতা!
তাই দাও না দিদি! পায়ে পড়ি তোমার! বড় দয়া করা হবে আমায়! কত ভালবাসতে আগে–
অলকা এ বিহ্বলতার মর্ম ঠিক বুঝতে পারে না। অলকা ভাবে এ বুঝি ব্যঙ্গ! অলকার ক্ষমতার তুচ্ছতাকে ব্যঙ্গ!
অলকা ফেটে পড়ে, জানি জানি, এখন তুই আমাকে ঠাট্টা করবি। বড় গাছে নৌকো বেঁধেছিস তুই এখন। তোকে তাড়াবার সাধ্য আর নেই আমার, তা আর জানি না? এখন বুঝতে পারছি, ও তোকে খুঁজে আনল কী করে। সব ছল, সব ষড়যন্ত্র! ও-ই তোকে বার করে নিয়ে গিয়েছিল, আবার
আঃ দিদি!
ঊর্মিলা ছিটকে সরে যায়, চৌকির উপর বসে পড়ে, দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে।
অলকা সেদিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, তুমি ও রকম করলেই বা কী, আমার সর্বস্ব তত খোয়া গেছে! সে যে অনবরত কোন চেষ্টায় ঘুরছে, বুঝছি না আমি?.মধুকে চর করে করে লুকিয়ে লুকিয়ে খবর নিচ্ছে তোর, দেখছি না?
তুই বা কতক্ষণ অটল থাকবি?
আর কেনই বা থাকবি?
তুই তো খারাপ!
অলকা সেই কথাটাই ছুঁড়ে মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। থাক, ওসব আর দেখাতে আসিস নে। আমায়! খারাপ মেয়েমানুষের অনেক বিদ্যে জানা থাকে! আমি শুধু ভাবছি ছোটঠাকুরপোর মুখটা কি একবারও মনে পড়ছে না তোর?
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায় অলকা কান্না চাপতে চাপতে।
ঊর্মিলা অনুভব করে অলকার মর্মদাহ, সে দাহর জ্বালা যে ঊর্মিলার মধ্যেও।
ঊর্মিলা ওর সেই চৌকিটায় লুটিয়ে পড়ে।
নিজের জন্যে যতটা, তার থেকে অনেক বেশি যন্ত্রণা অনুভব করে অলকার জন্যে। অলকার বুদ্ধি কম, কিন্তু ভালবাসাটা কম নয়।
ঊর্মিলাকেও সে ভালবেসে এসেছে এযাবৎ, প্রাণ থেকেই।
.
এখন আমি কী করব!
ভাবল ঊর্মিলা।
অলকা চৌধুরীর ছোটঠাকুরপোর মুখটা তো মনে আসছে না আমার! তবে কীসের ধ্যান করব?
আমি কি তবে সত্যিই সেই পথ বেছে নেব? নিরুপায়তার শেষ পথ?
কিছুই শক্ত নয়, কোনও উপকরণ জোগাড় করতে হবে না। এই অট্টালিকার বেষ্টনীর মধ্যেই পুকুর আছে, প্রকাণ্ড পুকুর। অন্তত একটা সাড়ে পাঁচ ফুট দেহকে গ্রাস করে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট প্রকাণ্ড!
কিন্তু তা হলে?
ঊর্মিলা নামের একটা জ্বলজ্বলে ঝকঝকে আস্ত মেয়ে, সমুদ্র সেন নামের একটা মূঢ় ব্যাকুলতা যাকে পাবার জন্যে নিজেকে বিকিয়ে রেখেছে, সেই মেয়েটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাবুডাঙা নামের একটা অখ্যাত জায়গার একটা পানাভরা পুকুরে?
কেন যাবে?
রত্নাকর চৌধুরী নামের একটা মিথ্যা দম্ভের খেসারত দিতে? শিলাকর চৌধুরী নামের একটা নীচ লালসার জবাব হতে? অলকা চৌধুরী নামের একটা অবোধ যন্ত্রণাকে মুক্তি দিতে?
তাই! তাই!
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া ছাড়া এদের সম্পর্কে আর কোনও কিছু করার নেই ঊর্মিলার।
তবে ঊর্মিলা যদি এ বাড়ির হেড সত্যভামা চৌধুরীর ইচ্ছার পুতুল হয়ে যায়? তাঁর হিংসার বলি হতে মাথা মুড়িয়ে শুভানন্দ স্বামীর পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলে প্রভু আমায় উদ্ধার করো!
তা পারলে অবশ্য বলা যায়, আরও একটা পথ রয়েছে।
কিন্তু সে পথটা কি ওই পুকুরের জলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার থেকে অন্য কিছু? তার থেকে পুকুরই ভাল। তিলে তিলে মৃত্যু নেই তাতে।
নিজেকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব ভেবে মৃত্যুশোকের মতো কষ্ট হয় ঊর্মিলার।
অকারণে, একান্ত অনিচ্ছায়, এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে ঊর্মিলাকে। সমুদ্র সে খবর শুনতে পাবে, সমুদ্র ঊর্মিলার এই বিশ্বাসঘাতকতায় স্তম্ভিত হয়ে যাবে!
সমুদ্রকে একটা চিঠি পর্যন্ত লিখে যেতে পারবে না ঊর্মিলা।
রত্নাকর চৌধুরীর কড়া পাহারা এড়িয়ে চিঠি পাঠাবার উপায় নেই।
আশ্চর্য, আমি একটা সভ্য যুগে, একটা সভ্য দেশে, একটা সভ্য সমাজে বাস করছি। আমার শ্বশুর শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মেলামেশা করেন, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সারিতে বসেন, হয়তো বা আধুনিক মতবাদীদের সঙ্গে বসে তাদের গলায় গলা মেলান।
ওঁর বন্ধুরা ভাবতেও পারবে না, ওঁর সেই অনেক কুঠুরিদার পুরনো প্রাসাদের একটা কুঠুরির মধ্যে একটা অসহায় মেয়ে নজরবন্দি হয়ে পড়ে আছে!
কী করে ভাবতে পারবে?
রত্নাকর চৌধুরীর বৈঠকখানায় তো নিওনের আলো, অতি আধুনিক গৃহসজ্জা, লাইব্রেরিতে সংস্কৃতির ছাপ, সংগ্রহশালার রুচির পরাকাষ্ঠা।
রত্নাকর চৌধুরীর ড্রইংরুমের একটা দেয়ালে যেমন তাঁর শিকারি জীবনের সার্থকতার স্মারক প্রকাণ্ড একটা চার পা বিস্তার করা বাঘছাল, তেমনি আর একটা দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের মূল্যবান অয়েল পেন্টিং।
ঘরের এক কোণে যেমন হাতির পায়ের আধখানা দিয়ে বানানো বেঁটে স্তম্ভাধারের উপর ড্রাগনের মুখ, তেমনি আর একদিকের কোণে চন্দন কাঠের ত্রিপদীর উপর ফুলদানিতে রজনীগন্ধা।
রত্নাকর চৌধুরী তাঁর বিধবা পুত্রবধূকে নজরবন্দি করে রেখে দিয়েছেন সেকালের জমিদারের মতো, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
আর যদি সহসা একদিন তাঁর অন্দরের পুকুরে সেই বউয়ের মৃতদেহ ভেসে ওঠে?
তাতেই বা কী হবে?
খবরের কাগজের আকস্মিক দুর্ঘটনার তালিকায় একটা নতুন সংযোজন হবে মাত্র!
রত্নাকর চৌধুরী তাঁর সেই দুর্ঘটনায় মৃত পুত্রবধূর নামে হয়তো হাসপাতালে বেড দেবেন, হয়তো তার শ্রাদ্ধে কাঙালি ভোজন করাবেন।
যেমন করেছিলেন সত্যভামা দেবী তাঁর ছোটছেলের মৃত্যুতে।
ঊর্মিলা একদিন পুকুরে ভেসে উঠলে কারও কোনও ক্ষতি নেই, বরং তার সঙ্গে সঙ্গে সারা সংসার ভেসে উঠবে!
ওরা ডুবতে বসেছি ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছে, সে আতঙ্ক যাবে। বলবে, বাঁচলাম!
শুধু সমুদ্র নামের সেই ছেলেটা বলবে, ঊর্মি তুমি এই? বলবে, ভীরু নিষ্ঠুর! বলবে, ছি, ছি!
বলবে, ঊর্মিলা, তবে আমার আর বাঁচার অর্থ কী?
ঊর্মিলা তবে মরবে কেন?
কেন সমুদ্রকে মারবে?
রত্নাকর চৌধুরীর পারিবারিক সুনাম বাঁচাতে? শিলাকর চৌধুরীকে অধঃপতন থেকে বাঁচাতে?
রমাদের ওই ঘরটা থেকে কদাচ বেরোয় ঊর্মিলা।
আজ হঠাৎ বেরিয়ে এল, চলে এল দালানে।
সঙ্গে সঙ্গে কোথা থেকে যেন ছুটে এল মধু। দুহাতে ঊর্মিলাকে জড়িয়ে ধরে চাপা উল্লাসের গলায় বলে উঠল, কাকিমা, তোমার ঘর খোলা হয়েছে, দেখবে এসো।
ঊর্মিলা কি ওকে কোলে তুলে নেবে? খুব ইচ্ছে করা বুকটায় চেপে ধরে নেবে একবার? তারপর যা থাকে কপালে?
কিন্তু মধুকে যদি নির্যাতন করে?
ঊর্মিলাকে শাস্তি দেবার জন্যে ঊর্মিলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে?
ঊর্মিলা আস্তে ওর মাথায় হাত রেখে বলে, আচ্ছা দেখব।
এখনই চলো না! মধু কৌতুকের মুখে চুপি চুপি বলে, আমি না ওই চাবিটা নিয়ে ছুঁড়ে বাগানে ফেলে দিয়েছি, কেমন মজা? আর কী করে বন্ধ করবে?
ঊর্মিলা কষ্টে চোখের জল চাপে।
ঊর্মিলা সেই চোখে কৌতুক ফোঁটায়, ও মা, তাই বুঝি? তা হলে তো খুব মজা!
রঘুর ঘর ধোয়া হয়ে গেলে তুমি আর আমি আবার ও ঘরে ঢুকে খাটে শুয়ে পড়ব, কেমন?
ঊর্মিলা আস্তে বলে, কী হবে শুয়ে?
বারে বা, কী আবার হবে, গল্প শোনা হবে! এক বছর তুমি আমায় গল্প বলোনি।
তা আমি তো ছাই বিচ্ছিরি পচা! আমার কাছে গল্প শুনে কী হবে?
না, তুমি ভাল। মধু ঠিক সেদিনের মতোই বলে ওঠে, বাবা বলেছে তুমি ভাল। তুমি বন্দিনী রাজকুমারী
মুহূর্তে শুকিয়ে যায় সমস্ত সরসতা।
লোকটার ধূর্তামি দেখে কাঠ হয়ে যায় মন। এই কৌশলই খেলাতে চায় ও? ওই ছেলেটাকে মাধ্যম করে যোগাযোগ রাখতে চায় আমার সঙ্গে? কে জানে হয়তো বা শিখিয়েই দিয়েছে।
মধু, তুমি তোমার মার কাছে যাও
মধু সহসা এই ভাবপরিবর্তনে অবাক হয়। ছলছলে চোখে বলে, না, আমি তোমার কাছে থাকব। মা কি আমায় নেয়? খালি তো বলে, ছুঁসনি ছুঁসনি কাঁচাকাপড়, ঠাকুমা দেখলে মারবে! তোমার কাছেই থাকব গো
সমস্ত শরীরের মধ্যে অদম্য একটা আলোড়ন ওঠে, আত্মবিস্মৃত ঊর্মিলা ছেলেটাকে কোলে তুলে নেয়, বুকে চেপে ধরে। খুব ইচ্ছে করা বুকটায়। মনে হয় সবটা বুঝি ভরাট হয়ে উঠল।
কিন্তু সে কতক্ষণ?
সংসারের আর সকলের চোখ নেই?
তুমি ভাবছ চকমিলানো দালানের এই থামটার আড়ালে দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি, তোমায় কেউ দেখতে পাচ্ছে না!
কিন্তু সেটা তো সত্যি নয়। সত্যি যে নয়, সেটা প্রমাণ করতে মানদা ছুটে আসে। কড়া গলায় বলে, খোকাবাবু, আবার? চলো ঠাকুমার কাছে, দেখবে মজা!
হিঁচড়ে ঊর্মিলার কোল থেকে টেনে নিয়ে চলে যায়।
মধুর তারস্বরের আপত্তিতে কর্ণপাতও করে না।
ঊর্মিলা ফিরে আসে।
ঊর্মিলা তার সিদ্ধান্তে স্থির হয়।
ঊর্মিলা ঘরে বসে টের পায় উৎসবের আয়োজন এবার ঘোরালো! কীর্তন হবে, কৃষ্ণযাত্রা পালা হবে, গ্রামসুদু লোক প্রসাদ খাবে!
কিন্তু ঊর্মিলার সেই চাবি বন্ধ মহলটা খোলা হল কেন? উৎসবের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী?
আছে সম্পর্ক।
রমার মুখেই খবর।
এবারে গুরুদেবের হাঁটুতে বাত, দোতলায় উঠতে পারবেন না, তাই
গুরুদেবের হাঁটুতে বাত!
হঠাৎ ভারী হাসি পেয়ে যায় ঊর্মিলার!
শব্দ করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে।
দলে দলে আর্তজন আসে না গুরুদেবের কাছে? শুধু ভবরোগের মুক্তির আশাতেই নয়, দেহরোগের মুক্তির আশাতেও।
ওঁর প্রতিষ্ঠিত দেবতার চরণ তুলসী দিয়ে উনি কুষ্ঠ সারান, যক্ষ্মা সারান, পাগল সারান। বাত হাঁপানি অম্লশূল এসব তো ওঁর কাছে কিছুই না।
হায়, নিজের হাঁটুটার দিকে যদি তাকাতেন একটিবার!
রমা অবাক হয়ে বলে ওঠে, ও কী, হাসলে যে?
এমনি। অনেকদিন হাসিনি কি না!
.
কথা যা বলে রমাই বলে। ওকে কেউ আঁটতে পারে না। যখনকার যা খবর সরবরাহ করবে স্বেচ্ছায়।
মানদার আস্পর্দাটা কত বেড়েছে দেখেছ? তোমার কাছ থেকে কীভাবে হিঁচড়ে নিল ছেলেটাকে কাল?
ঊর্মিলা গম্ভীর হয়।
বলে, ওর কী দোষ?
তা যাই বলো, অমন হিচড়াতে কেউ বলেনি।
হয়তো বলেছে।
হতে পারে। আমাদের মামিটির তো আবার পবিত্র অপবিত্র জ্ঞানটা বেশি! ওইটুকু বাচ্চা, ওর আর
সহসা পাথর হয়ে যায় রমা।
সামনে ভূত দেখে যেন।
পবিত্রতা সম্পর্কে যিনি রীতিমত কড়া, তিনি এই অপবিত্র ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মামিমা!
এইটুকুই শুধু বলে রমা।
সত্যভামা বলেন, তুইও তো দেখছি সোজা মেয়ে নয় রমা! রাতদিন ওর সঙ্গে তোর কীসের এত ফুসফুস গুজগুজ শুনি? যাক বলে দে ওকে, কাল সকালে যেন কিছু খেয়ে মরে না, স্নান করে বসে থাকে যেন, গুরুদেব বলেছেন কালই দীক্ষা দেবেন।
হঠাৎ একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ডই করে বসে ঊর্মিলা। সে তার শাশুড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, এই রমাদির ভারী ইচ্ছে দীক্ষা নেয়, ওকেই দিতে বলবেন।
সত্যভামা অবশ্যই এর জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই আরক্ত মুখে তীব্রকণ্ঠে বলেন, রমার হয়ে তোমার ওকালতি করতে হবে না। তোমাকে যা বলা হচ্ছে তাই করবে। সকালে স্নান করে
ঊর্মিলা আস্তে বলে, আমাকে দীক্ষা দিয়ে দরকার কী? ওতে আমার বিশ্বাস নেই।
কী? কী বললে? ওতে তোমার বিশ্বাস নেই?
না।
বলতে মুখে বাধল না তোমার ছোটবউমা? কত জন্মের ভাগ্যি তোমার যে, পোকা খাওয়া ধান আমি আবার ঝেড়ে বেছে ঘরে তুলতে চাইছি! গুরুদেবের অশেষ কৃপা তাই প্রায়শ্চিত্তে মাথা মুড়োবার আদেশ দেননি! আর তুমি কিনা–
ঊর্মিলা সোজা চোখে তাকিয়ে বলে, আমাকে মাপ করবেন মা!
মা! মা বলতে এসেছ? আমার হিমুকে খেয়ে, আমার কুলমান সব খেয়ে আবার মা বলে সোহাগ কাড়ানো? লজ্জা করল না?
ঊর্মিলা তেমনিভাবেই বলে, দেখছেন তো লজ্জা আমার নেই।
দেখছি! দেখছি! শুধু ভেবে পাচ্ছি না, এত লোক মরছে, তোমার কেন মরণ নেই। আচ্ছা, দেখব কেমন তুমি প্রায়শ্চিত্ত না করো, কেমন তুমি গুরুমন্ত্র না নাও। জ্যান্ত পুঁতব তোমায় আমি। নারায়ণ! নারায়ণ।
দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যান তিনি, বোধহয় গুরুর কাছে গিয়েই পড়তে। প্রায়শ্চিত্তের বিধানে মস্তক মুণ্ডনে রাজি করানো যায়নি তাঁকে। তিনি বলেছিলেন, না না! তাতে দরকার নেই! অল্প বয়েস, দুঃখ পাবেন। সত্যভামা সেইটাই করিয়ে ছাড়বেন।
তাতেই জব্দ হবে।
সুন্দর মুখ, আর কাঁচা বয়েস, পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতি তার উপর।…সাধু সন্তরাও এ দুর্বলতা থেকে বাদ পড়েন না। তাঁরাও উজ্জ্বল মহিলাটিকে দেখলেই আগে তাকে মা করে কথা বলেন, কালো কুশ্রী দীনহীন বুড়ো বুড়িরা কোথায় পিছিয়ে পড়ে থাকে। সুন্দর সুন্দর তরুণী মেয়েরা আবদারে গলে কাছে এগিয়ে আসে, ঠাকুর উদারতার সঙ্গে তাদের আবদার শোনেন, আর সংসারক্লান্ত হাতে শির-ওঠা বউটা যেই এগিয়ে আসতে চায়, চেলারা ভারীমুখে জানান দেয়, ঠাকুরের বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটাবেন না, বাবাকে ব্যস্ত করবেন না!
আর কিছুই নয়, মানুষের রীতি।
এ রীতির হাত এড়াতে পারে না কেউ। নইলে গুরুদেব ওই পাজি মেয়েটার পরপুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যাবার খবর শুনেও রাগে আগুন হয়ে উঠলেন না! শুধু বললেন, সাবধান হওয়া উচিত ছিল তোমাদের, বয়েসটা খারাপ!
আর প্রায়শ্চিত্তের বিধানে সত্যভামার প্রস্তাব শুনে প্রায় শিউরে উঠে বললেন কিনা, না, তার দরকার নেই, তার দরকার নেই!
কেন?
দরকারটা নেই কেন?
যে পাপে সেকালে পাপিষ্ঠাদের জ্যান্ত পুঁতেছে, সেই পাপে ওটুকু শাস্তিও হবে না? মুড়োনো মাথায় আবার তো চুল গজাবে।
ওর ওই কেশবতী কন্যার মতো চুলগুলোই যেন সবচেয়ে চক্ষুশূল সত্যভামার!…
হিমু চলে যাবার পর ও যখন ওই চুলের রাশি বালিশে ছড়িয়ে দিয়ে পালঙ্কে শুয়ে বই পড়ত, তখন থেকেই সত্যভামার ইচ্ছে হত বড় একখানা কাঁচি এনে দেন সাফ করে ওই ঢেউখেলানো চুলের জঙ্গল!
না, গুরুদেবকে দিয়ে ও বিধান দিতেই হবে। ওর এখনকার এই আস্পর্দার কথা সবিস্তারে বলতে হবে। শুনলে অবশ্যই
.