২. আমেন, আমেন

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আমেন, আমেন

একমাস পরে।

সোনালি শামুকের খোলের মতো রোদ এখন বিবর্ণ। নীলাভ কুয়াশা মাঠের দিগন্তে। বুনো হাঁসেরা দলবেঁধে উড়ছে চণ্ডালী ঝিলের আকাশে। কাশফুল উত্তরের দুরন্ত বাতাসে ঝরে গেছে।

বুনো হাঁসগুলি ঝিলের জলে নেমে পড়েছে।

শরবন থেকে বন্দুকের শব্দ। পানকৌড়ি পানারিপাতার দামে মুখ লুকিয়েছে। তিতিরগুলি ভীতভাবে ব্যানাবনে ঢুকে পড়েছে। জলে যেন চাবুকের আস্ফালন। বুনো হাঁসগুলো এলোমেলো উড়ছিল।

আবার বন্দুকের শব্দ।

হঠাৎ ডেকে ওঠা জলপিপি পাখি থেমে যায়। ফাঁড়িঘাসের সাদা বক হিজলের শাখায় উড়ে গিয়ে বসে। ট্টিট্টিভ চলে গেছে অনেক দূরে। শীতের আকাশে তার বিলাপ যেন ছোট ছোট মৃত্যুকেই ডেকে আনে বারবার।

ঝিলের জলে ঝাঁপ দিয়েছে তিনটি মেয়ে। দুহাতে জলজ ঘাসগুলো সরিয়ে দ্রুত এগোচ্ছে। ডানাভাঙা বুনো হাঁস শালুকের পাতায় মুখ ঘষছে।

শরবন থেকে শব্দ ওঠে : এই খবরদার!

মুখ ফেরায় তিনটি মেয়ে। হিহি করে হেসে ওঠে। একজন বুকের কাছে আহত পাখিটা চেপে ধরে। তারপর আঁচলের আড়াল দিয়ে নিয়ে আসে।

শরবনের ফাঁকে এক বন্দুকধারী। এদিকেই এগিয়ে আসছে সে।

কাপড় নিঙড়াচ্ছে এরা। উত্তরের বাতাসে রুক্ষ পিঙ্গল চুলের গোছা কেঁপে কেঁপে গালে পড়ছে। হাঁসটি বুকের ভেতর তখনও ছটফট করছে। সামলাতে গিয়ে হিহি করে ফের হাসছে পরস্পর।

বন্দুকধারী মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এসে। —হাঁস ধরলি কেন রে?

দুহাতে বুকে হাঁসটা চেপে ধরে মেয়েটি জবাব দেয়—আমার ইচ্ছে।

—ভালো চাস তো ছেড়ে দে বলছি! দাঁত বের করে ধমকায় লোকটি। বড় মুখরা মেয়ে। বলে,—দেবনা।

—মাগনী নিবি?

আর কথা বলে না কেউ। ধানকুড়োনো ঝুড়িগুলি কাঁধে তুলে চলতে থাকে। এবার বন্দুকধারী পথ রুখে দাঁড়ায়। —দাম দিয়ে যা তবে।

তিনজনেই ভীষণ চমক খেয়েছে। হাঁসটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দ্রুত এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। রুষ্টা তিনটি নাগিনীর মতো ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে চলে।

পিছনে আবার বন্দুকের শব্দ।

হনহন করে সবার আগে চলেছে টগর। পেছনে নেতা আর এলোকেশী। ঝিলে শিকারি নামতে দেখে অনেক আশা নিয়ে ওরা ছুটে এসেছিল। প্রতি শীতে শিকারি নামে ঝিলে। তখন ওরা মাঠে ধানকুড়ানো বাতিল করে চলে আসে এখানে। যদি বরাতে জোটে দু—একটা।

জোটে না। তবু আসে।

টগর বলে—উর কী দোষ ভাই! মোটে তো একটি হাঁস।

নেত্য মুখ বেঁকিয়ে বলে,—ছি, ছি, কী ঘেন্নার কথা।

তামাসা করে এলোকেশী।—তুমাকে ঘেন্না বলে মনে হবে বইকি। লতুন মেয়ে। কাঁচা বয়েস।

আমরা কিন্তু অনেক দেখেছি। এখন পাথর হয়ে বেঁচে আছি। বুঝলে?

কাঁচাবয়সি নেত্য ঝাঁঝালো স্বরে বলে,—তবে পালিয়ে এলে ক্যানে? দাম দিয়ে লিয়ে এলে না?

অবাক হয়ে যায় টগর আর এলোকেশী ওর স্পষ্ট কথার ঝাঁঝে। নেত্য পলাশ গাঁয়ের মেয়ে। বাঁকা নদী পেরিয়ে পলাশগাঁ। লোকে বলে—সেথা মাগিরা মোড়লি করে, মিন্সেরা বাঁদর। ঠিক কামরূপ—কামিখ্যের দেশ। রাজ্যের ডাকিনী যোগিনী প্রেতিনী সেখানে পুরুষের শিখরে জাদুর পলতে জ্বেলে বসে রয়েছে। নেত্যবালার মা তো তাদের ঠাকরুনটি। কেশে জটা, কপালে সিন্দূরের ঘটা, লালপেড়ে শাড়ি পরে মাথা দোলায়। কালীকরালী ভীমা ভয়ংকরীর ভর ওঠে। চন্দন আর সিঁদুরে রাখা পিঁড়িতে ঘিয়ের পিদীম জ্বলে। ধুপচি থেকে সাপিনীর ফণার মতো পেঁচিয়ে দোল খায় ঘননীল ধোঁয়ার রাশি।

লোকে বলে পলাশ গাঁয়ের দেবী। নাম তরঙ্গিনী। তার মেয়ে নেত্য। মুখের কথায় তপ্ত খই ফোটে। ফের সে তীব্র ব্যঙ্গে বলে উঠল,—এত যদি সতীকন্যে, কলকাতা পালায় ক্যানে চণ্ডালিকের মেয়েরা?

টগর আর এলোকেশী বেশ বুঝতে পারে, নেত্য কাজলের কথাই বলছে। গতকাল সন্ধ্যায় ছকুলালের বউর সঙ্গে একচোট হয়ে গেছে নেত্যর। ধুলোর ঝড় ছুটেছিল পাড়ায়। ঝগড়ায় কাণ খুব স্পষ্ট নয়। নেত্য নাকি ওলাঙ্গিনীকে যেচে বলতে গিয়েছিল—এ ভিটের কিছু দোষ আছে গো। বরঞ্চ বলো যদি, মাকে খবর দিই। দেবীর ভরে পায়শ্চিত্তির বিধেনটা বলে দেবে।

ওলাঙ্গিনী এতেই ক্ষেপে গিয়েছিল।—আমি হচ্ছি কিনা বিনোটির মেয়ে। রেললাইনের ধারে জন্মো। আমি ওসব মানিনে। তারপর হঠাৎ সে চিৎকার করে একটা প্রতিজ্ঞা করে বসল।—আমি যদি সতীকন্যে হই, মনে কোনো পাপ না থাকে, সব দোষ বিনেশ হয়ে যাবে।

পালটা নেত্যও ক্ষেপল। সে ভেবেছিল, তার মাকে বড় অপমান করা হল। কোমরে আঁচল জড়িয়ে ক্ষিপ্তা নেত্য বলেছিল—কে কতো সতীকন্যে সব জানা আছে। কলকাতার ডাক এলে তখন পিঠে পাখা গজায়। ব্যস! এটুকুই যথেষ্ট ওলাঙ্গিনীর কাছে। কাজল সম্পর্কে তার মনে একটা গভীর গর্ববোধ কাজ করে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে সে কাজলের সব কথা জেনেছিল ছকুলালের কাছে। প্রায়ই অনুযোগ করত—দিদি বুঝি আমাকে ঘেন্না করে। একটিবারও এল না দেখতে। বারবার সে তাকে চিঠি লিখতে বলত। আশ্বিনে গয়লাদের হাতে ছকুলাল মার খেয়ে একটিমাস ঘরে পড়ে রইল। দীনুকে দিয়ে পোস্টকার্ড আনিয়েছিল ওলাঙ্গিনী। দীনুই বরাবর চিঠিপত্র লিখে দেয়। এবারও লিখত। কিন্তু ছকুলাল গোঁ ধরে বসে থাকল। সে বলেছিল,—কাজল একথা শুনলে হাসবে। ওলাঙ্গিনী কথাটা বুঝতে পারেনি। তবু কাজলকে সে মনে মনে খুবই শ্রদ্ধা করে। কাজলের নিন্দা সে কিছুতে সইতে পারে না।

এলোকেশী গোমড়া মুখে চলেছে। কোনো ঝঞ্ঝাটে সে থাকতে চায় না। নিরিবিলি এমনি করে জীবন কাটাবার ইচ্ছে তার বরাবর। তাই স্বামীর ঘর করে না। মায়ের কাছে থেকে গেল বিয়ের পর থেকেই। স্বামীটাও গতিক বুঝে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। বরং নেত্যর সঙ্গ তাকে এমন ক্ষুব্ধ করছে। সে ভাবছিল, পরের দিন একা—একা আসবে মাঠে, সেই ভালো।

টগর নেত্যর কথার ভঙ্গি শুনে হাসছে। বলে,—কলকাতায় বশীকরণ আছে। টান দেয় চণ্ডালিকের মেয়েদের। সৈরভীর কথা শুনিসনি রে ছুঁড়ি।

নেত্য মাথা নেড়ে বলে—আরও কত শুনেছি। বশীকরণের একটা কাটান আছে। বুঝলে? মায়ের কাছে শিখেছি। সব বশীকরণ জ্বলে ভস্মো হয়ে যায়।

হঠাৎ নেত্য অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় ঝুঁকে পড়ে ধানের শিষ কাটতে থাকে। সোনালি শামুকের ধারালো ঠোঁটে তাজা শিষগুলি কট কট করে কেটে যাচ্ছে। এলোকেশী ওর কাণ্ড দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। টগর ফিস ফিস করে ওঠে।—এই ছুঁড়ি, তোকেই ভস্ম করে দেবে জাগালরা!

নেত্য মুচকি হাসে। ভয় পায় না। শুধু একবার চোখ তুলে চারপাশটা দেখে নেয়। কাছাকাছি কোনো জাগাল নেই। আবার সে হাত বাড়ায় ধানের শিষে।

দেখাদেখি টগরও ঝুঁকে পড়ে। এলোকেশী কিছুসময় গাল চুলকোয়। উসখুস করে। ওদের ভরে আসা ঝুড়িগুলি দেখে তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। শেষে আর লোভ সম্বরণ করতে পারে না। একই ক্ষিপ্রতায় সে দলে যোগ দ্যায়।

দূরে দূরে ধানকাটার সাড়া। কলরবমুখর মাঠ। ঝুঁকে পড়ে ধান কাটছে লোকজন। কাস্তেয় রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। এখন গ্রামের কাছাকাছি জমিগুলোতে ধানকাটা চলেছে। ধীরে ধীরে ঝিলের প্রান্তে নাবাল মাঠে ওরা নেমে আসবে।

তিনটি সোনালি শামুক থেকে কট কট শব্দ। এতদূরে বলে কারুর লক্ষ্য নেই হয়তো। থাকলে অশ্লীল চিৎকার অঙ্গের বসন ঢিলে করে দিত।

নেত্য মুচকি হেসে পিঠটা সোজা করে। বলে—উঃ একেবারে অভ্যেস নাই! বন্দুকধারীর মতো কেউ না এলে বাঁচি। ছি ছি, কী ঘেন্না!

তখন, এতক্ষণ পরে জাগালের হাঁক। ইস্পাতের সূক্ষ্ম ফলা যেন কানে এসে বেঁধে। এরা অমন সচকিতা। পরস্পর নিঃশব্দে তাকায়। তারপর চলতে থাকে।

একটি নতুন কণ্ঠ। …হেই শালীবিটিরা!…বড় অশ্লীল আর চাষাড়ে। লোকটা কে?

যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে টগর বলে,—জাম্ভু না?

এলোকেশী নীরবে মাথা নাড়ে।

হেঁট হয়ে একটা খসেপড়া ধানের শিষে হাত বাড়িয়েছিল নেত্য। আচম্বিতে কাঁধ থেকে ঝুড়িটা খসে গেল তার। কার কালোকুচ্ছিত কর্কশ একখানা হাতে ঝুড়িটা দোল খাচ্ছে দেখে সে অবাক। সোজা হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চণ্ডালিকার পশ্চিমমাঠে সাপিনী যেন ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। হিসহিস করে নিশ্বাস ফেলছে।—ঝুড়ি লিলে ক্যানে?

হা হা করে বড়বড় দাঁতে হাসছে রসিকলাল রাজবংশী ওরফে জাম্ভু জাগাল।

—ক্যানে তা জানো না? কী সতীকন্যে গো!

খানিক লজ্জা খানিক অপমানের দুঃখ। তবু শান্ত থাকতে চেষ্টা করে নেত্য। বলে—ভালো চাও তো ঝুড়ি দাও।

—তুমি সেই পলাশগেঁয়ে বউ না। জাম্ভু সকৌতুকে বলে। দেবীর কন্যে মহাদেবী। চেঁচাতে গিয়ে থেমে যায় নেত্য। ছোঁড়াটাকে সে খুবই চেনে। এতদিন আলকাপ গানের দলে সঙের ছড়া গাইত। এখন মাঠে এসে জুটল কীভাবে, সে জানে না। এত কাছাকাছি তাকে দেখে যেন ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। ভীষণ হাসিয়ে দিত ও। নেত্য হাসি সামলাতে না পেরে ছুটে পালিয়ে গেছে আসর ছেড়ে। কখনও হাসবার ভয়ে মিছিমিছি মুখ বেঁকিয়ে বলত—ছাই হাসাচ্ছে। কান্না পায় কথা শুনলে।

গম্ভীর মুখে জাম্ভু বলে—ঝুড়িটা ছিজ কল্লাম।

নেত্য চমকে ওঠে। সত্যি নিয়ে চলে যাচ্ছে রে! নেত্য বলে—ছিজ মানে?

—ছিজ কল্লাম গো গুণিনের বেটি। মাঠের পুলিশ কিনা! একটা উপযুক্ত উপমা ব্যবহার করে জাম্ভু সগর্বে তাকাচ্ছে চারপাশে। আমিন সেখ ওর কাণ্ড দেখে হাসছে। জাম্ভু ঠিক পুলিশের ভঙ্গিতে মার্চ করে এগোচ্ছে।

বিব্রত হয়ে নেত্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। টগর একটু দূরে চলে গেছে কখন। এলোকেশী এই লম্বা জমিটার প্রান্তে আলে বসে শামুক দিয়ে পিঠ চুলকোচ্ছে। সে সবটুকুই দেখেছে।

আকর্ণ হেসে এগিয়ে যায় জাম্ভু। লাঠিটা বগলে রেখে ঝুড়ি দোলাতে দোলাতে কুঁড়ের দিকে চলেছে। সেখানে যোগীবর, বায়তুল্লা আর ছকুলাল গায়েন রোদ পোয়াচ্ছে বসে। জাম্ভু ওদের একটিনির জাগাল। সেই দুঃসময়ের গোটা মাস একা এতবড় মাঠের দায়িত্ব সে ছাড়া কেউ নিতে সাহস পায়নি। এর মূল্য সে কতটুকু পাবে, তা অনিশ্চিত। স্থায়ী জাগালদের প্রাপ্য থেকে সামান্য একটু হিস্যে। আসলে এ একটা নেশা তার কাছে।

ধুপ করে নেত্য এলোকেশীর পাশে বসে পড়ে। ঘরে ফিরলে নীলকান্ত হয়তো কিছু বলবে না। ভারী ভালোবাসে বউকে। কিন্তু তীব্র অপমানবোধে নেত্য কাতর। গানের জগতের এক নায়ক—যাকে দেখে সে কত রাতের আসরে গভীর সুখ অনুভব করেছে—ঘরে ফিরেও যার কথা ভেবে নিঃশব্দে লুকিয়ে হেসেছে—তাকে এই নিষ্ঠুর ভূমিকায় এখন দেখতে চায়নি যেন।

এলোকেশী হাসছে। —পেছন ছাড়লি ক্যানে?

—যাঃ! ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে নেত্য। রাগে থরথর করে কাঁপে। সরু নাকের ওপর নাকছাবির লাল পাথর জ্বলে—জ্বলে ওঠে। পাতলা শুকনো ঠোঁট দুটিতে দাঁতের দাগ কেটে বসে।

—মন্দ কথা বলিনি রে! এলোকেশী গম্ভীর হয়। —ওরা অমন করে। একটুখানি ধরাধরি কল্লে গলে যায়। যা না পেছনে।

নেত্য উঠে দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে। —তুমিও সঙ্গে চলো দিদি।

—ক্যানে? লজ্জা ক্যানে রে? এলোকেশী প্রশ্ন করে।

—লজ্জা না। আঁচল কামড়ায় নেত্য।

—তবে ভয়? বশীকরণের ভয় তো! এলোকেশী আবার হাসে।

—ইস! কোথাকার ঘাটের মড়া! অমন বশীকরণে আমি…. অশ্লীল চেঁচিয়ে ওঠে নেত্য।

টগর আসে এতক্ষণে।—পলাশগেঁয়ে বউকে বশীকরণ করে সাধ্যি কার? বরঞ্চ চোখের ছটায় হাজার বশীকরণ ঝিলিক দিচ্ছে। ওরে পলাশগেঁয়েনী, জাগালদের এমনি করে নয়নবাণ মারিস দিকিন।

—পারবো না আমি। নেত্য থমকে দাঁড়ায়। মুখটা কাঁদো—কাঁদো হয়ে উঠেছে তার।

এলোকেশী পিঠে হাত রেখে ঠেলে। টগর বলে—বেচারীরা রোদবাতাস শীতে কষ্ট করে মাঠে পড়ে থাকে। এট্টুখানি সুখ দিলিই যদি! উটা তো শুধু মোনের সুখ। মোনে—মোনেই নেকা থাকল। কে জানবে!

শিউরে ওঠে নেত্য। একটু কাঁদে। চোখের জলে গাল ভিজে যায়। এমনি করে বেঁচে থাকার জন্যে মা তাকে চণ্ডালিকা পাঠিয়ে দিল।

চিঠি এসেছে ছকুলালের। ভগ্নী কাজলবালা লিখেছে, সে শীগগির চণ্ডালিকা আসচে। রতনকুমার এখন আসবে না। সুমুখে পরীক্ষা—পড়া কামাই হবে। তাছাড়া সে আসছে এক বেলার জন্যে কী একটা কাজে।

চিঠি মাঠে বয়ে এনেছিল দীনুপদ। বায়তুল্লাদের সুমুখেই চেঁচিয়ে পড়ল সে। শুধোল বায়তুল্লা—রতন কুমারটা কে বটে গায়েন?

ম্লান হাসি ছকুলালের মুখে। —ভুল নেকেছে হে। রতনলাল আমারই ছেলা।

—রতনলাল পিতা ছকুলাল, রতনকুমার পিতা ছকু—ইটা কেমন যেন হল গায়েন। হিসেব করে বলে বায়তুল্লা। ইটা তো সোন্দর মিলছে না।

উদাস গলায় বলে ছকুলাল—না মিললেও ভগ্নীর সাধ। বড় নোকের সঙ্গে থাকে। উয়ার বেপারটা তো অন্য রকম।

তা বটে। থেমে যায় বায়তুল্লা। ভিতরে একটা কুৎসিত ব্যঙ্গের স্পর্শ পায়। মনে মনে বলে, কাজলের কাহিনী দেশে অজানা কার! কাজলকে সে দেখে আসছে ছেলেবেলা থেকে। কলকাতায় থেকে যাবার পর সে আর সেই শিশুবেলার থেকে। কলকাতায় থেকে যাবার পর সে আর সেই শিশুবেলার কুনাইকন্যে হেলাফেলার মেয়েটা হয়ে নেই। বদ্দর ঘরে বৌঝিটি। চওড়াপাড় রঙিন শাড়ির ভেতরে নকশাকাটা সায়ার ঝলক, পায়ে স্যান্ডেল, রেশমি ব্লাউজে ঢাকা পুষ্ট শরীর, হাতে একটা সুটকেস—চণ্ডালিকা স্টেশনে নেমে টগবগিয়ে গাঁয়ে ঢোকে। ভীড় করে কুনাই পাড়ার লোকেরা। উঁকি দেয় মুসলমান পাড়ার ডাকসাইটে চ্যাংড়ার দল। ছকুলালের গান শোনার হিড়িক পড়ে যায়। আসে বাবুপাড়ার কেউ। সিগ্রেটের ধোঁয়া ছেড়ে হাঁকে—কাল একটা মুনিব দিস ছকু। আরও আসে অনেক। রাজবংশী পাড়া থেকে হাড় হাবাতে নিতাই, নাপিতপাড়া থেকে বনমালী প্রামাণিক। একদিন গয়জদ্দি মশুলকেও দেখিছিল বায়তুল্লা অকারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে। বায়তুল্লা ডাকলেই খেঁকিয়ে উঠছিল—দাঁড়া না বাবা, ব্যস্ত কীসের? ঘাগি মুরগি যেন ডানা ফুলিয়ে ইচ্ছের ডিমে তা দিচ্ছে বসে বসে, খোঁচালেই কর্কশ চেঁচানি।

ছকুলাল অতশত বোঝে না কিংবা বুঝেও না—বোঝার ভান তার। অত দেখে কী হবে? ওর ওই এক ধুয়া। বিরক্ত হত কাজল। আর সাফাই গাইত ছকুলাল—রাগলে চলবে না বাছা, মানুষ মানুষের বাড়িতে আসে। তাছাড়া গায়েন বলে একটা সুনাম আছে তো বেহ্মাণ্ডে। তাই আসে ওরা কাজল বলত—নিত্যি কি এমনি আসে?

আমতা আমতা করে বানিয়ে বলত ছকুলাল—হ্যাঁ, আসে অবশ্যি। পিথিবীতে আমি তো পির হয়ে আছি সকলের—তাই আসে।

—তা তোমার প্রিয়রা থাকতে এত দুর্দশা কেন তোমার? ঘরের চালে খড় নেই, পরনের কাপড়ে হাজারটা তালি, এমন দশা কেন দাদা, রেগে চোখ মুখ লাল করে ফেলত কাজল। এসব বন্ধ না হলে আমি এক্ষুনি পালাব।

নির্বিকার ছকুলাল বলত—তা তুমার ইচ্ছে ভগ্নী। বাধা দেয় সাধ্যি কার বলো!

সুটকেস গোছাতে বসত কাজল। তখন সত্যি বাধা দিত ছকুলাল। অনুযোগ করত—বুদ্ধিমান হয়ে কোধ শোভা পায় বাছা? ধরো, আজ বারণ কল্লাম, কাল যদি ঘরের চালে আগুন দেয়। ই তুমার কলকাতা লয়, ই হচ্ছে চণ্ডালিকা পরগনা। ইখেনে পান্তা ভাত ফুঁদিয়ে দিয়ে খেতে হয়।

এমন ঝগড়া প্রতিবার হয়েছে—তবু আসত কাজলবালা।

কিন্তু ঝগড়ার চেয়ে অন্য কিছু ঘটত ছকুলালের স্যাঙার পর। থমথমে মুখে দাদাকে ডেকে নিয়ে যেত কাজল কলকাতা ফেরার পথে। স্টেশনের প্লাটফরমে গোড়াবাঁধানো পিপুল গাছের নীচে বসে মিষ্টি স্বরে বোঝাত। সুবাসলতার মৃত্যুর পর সে বলেছিল—দেখলে তো ভগবানের ইচ্ছেটা কী। তারপর মল আদর বউ। কাজল বলল—এখনও সাধ মেটেনি তোমার? আবার কোন অভাগীকে এনে হত্যে করবে দাদা?

প্রতিজ্ঞা করে বসেছিল ছকুলাল। ভগ্নীর ছলছল চোখের দিকে চাইতে না পেরে প্রতিজ্ঞা করেছিল। —ইটা তো বিরিক্ষিদেব। ইর আশ্রয়ে বসে পিতিজ্ঞা কচ্ছি আর নারীলোকের মুখদর্শন করব না। হয়েছে তো?

ট্রেনের জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়া বোনের সহাস মুখখানি অনেক দিন ধরে মনে পড়ত তার। সেই কাজলবালা আসছে। এসে দেখবে ওলাঙ্গিনীকে। শুনবে দাদার মার খাওয়ার ঘটনা। ভারী গলায় বলবে—উপযুক্ত প্রতিফল। আর ছকুলাল তা সইতে পারবে না।

মুষড়ে পড়ে ছকুলাল। বিড়ির পর বিড়ি টেনে চলে। শেষ বিড়ি পুড়িয়ে আবার বিড়ি খোঁজে। জাম্ভু বলে—সবকটাই তো শ্যাষ করে দিলে গায়েন’দা। আমরা কী খাই এখন?

ছকুলাল খোঁজে নিত্যিকার চেনা লোকটাকে। মাথার ডালায় ভরা সন্দেশ, তেলে ভাজা আর বিড়ি, সিগ্রেট, পান নিয়ে যে মাঠে মাঠে ফিরি করে বেড়ায়। কেনে রাখালেরা, চাষিরা, ধানকুড়োনি মেয়েরা। তারা কুড়নো ধানের বদলে কেনে। জাগালেরা কেনে। অঢেল ধান এখন। যত পারো খাও পরে কোথায় পাবে এই প্রাচুর্যের আনন্দ?

দূরে দেখা যায় লোকটাকে। কোথায় বাড়ি কে জানে। প্রতি বছর চণ্ডালিকার মাঠে হাজির থাকা চাই তার। সে স্টেশনের কোথাও আড্ডা নিয়েছে। সারা রাত্তির জেগে সন্দেশ বানায়। ভোরে উঠে মাঠে মাঠে ছোটে। হাঁকতে হয় না, ওকেই ডেকে নেয় সবাই।

ডাকল জাম্ভু দেখতে পেয়ে। অমূল্যদা ও অমূল্যদা হে!

কাছে এল অমূল্য ফেরিওয়ালা, ডালা নামিয়ে বসল। বলল—উত্তর মাঠে আজ বড় রসের তুফান দাদা!

জাগালেরা কান খাড়া করে এগিয়ে এল—কী, কী?

বলল অমূল্য—ও মাঠে এক জাগা আছে না, কোমর বেঁকিয়ে হাঁটে। কী যেন নামটা…হ্যাঁ, হ্যাঁ লবকেষ্ট।

—সোনাডাঙ্গার লবকেষ্ট বাউরী। জাম্ভু বলল।

—কে জানে লবকেষ্ট না হাতিকেষ্ট! তুমি কেচ্ছাটা কহো অমূল্য দাদা। বায়তুল্লা অধীর।

—তা লবকেষ্টই বটে। একেবারে কলিকেষ্টও বলতে পারো। আচ্ছা মার খেলে জাদুমণি।

—ক্যানে, ক্যানে? কে মাল্লে?

বর্ণনা করল অমূল্য বায়তুল্লাকে লক্ষ্য করে?—ও মাঠে তোমাদের স্বজাতি এক স্যাকের জমি আছে। সেই জমির ধান ওই কেষ্ট বাবাজীবন আপন হাতে ছেঁটে কেটে এক মাগির ঝুড়িতে চালান দিচ্ছিল। পীরিতের কন্যে তিনি। কিন্তু কোথা ছিল বাবা আয়ান ঘোষ, থুড়ি আয়ান স্যাক। —মানে যিনির জমি। এসেই দ্দেমার কেষ্টচন্দ্রকে। মাগি দ্দে দৌড়। মুসলমানের হাতের পিটুনী, যমের বাবার তিন কম্ম হয়ে যায়। বাছাধন এখন ঠান্ডারাম হয়ে গিয়েছেন।

—তা বটে, তা বটে। খুশি হয় বায়তুল্লা।

ছকুলাল শুনতে শুনতে চমক খায় বারবার। ওলাঙ্গিনী নয় তো?

সে তাকায় চারপাশে। দূরে কোথাও ওলাঙ্গিনী আছে। ধান কুড়োচ্ছে সুদামসখীর সঙ্গে। ওই ওদের মরশুম। কুড়োত তুফানী। কুড়োত আদর বৌ। তিন চার মণ ধান জড়ো করত এসময়। বেচে সাধ—আহ্লাদ মেটাত ওরা। সোয়ামীর কাছে যে সাধ মেটে না—অলংকার, রঙিন শাড়ি—জামা, সাবান, ফুলেল তেল। ওরা যায় গাঁয়ের মাঠ থেকে ভিন গাঁয়ের মাঠে। কত দূর—দূরান্তরে। টগর এলোকেশীরা তো যায় সেই অচিন্তপুর, বিনুটি, কাপাস তলা, সে এক দেশান্তর। ফিরে আসে অনেক রাত্তিরে। কাটা ধানের গোড়ায় পা ফেলে পা দুটো হয়ে যায় গাছের বাকলের মতো খসখসে ফেটে ফুটে একাকার। আর শিশিরের জল জমে থাকা ধানের মুড়োয় পায় জন্মে যায় এক বিশ্রী ব্যামো। গোড়ালি ফুলে বেদনায় অস্থির। পা ফেলতে কান্না। তখন ওষুধও অব্যর্থ। পুকুরঘাট থেকে তুলে আনা ভেজা ইট জ্বলন্ত উনুনে ফেলে দেয়। তার উপর ঢেলে দেয় পান্তাভাতের জল। বাষ্প ওঠে হুস করে। আহত পা সেই বাষ্পের ওপর চেপে ধরে। আবার ফিরে পায় পুরনো চলার বেগ। হনহনিয়ে ছোটে তখন মাঠে মাঠে দূরান্তর।

সন্দিগ্ধ চোখে ছকুলাল বারবার ওলাঙ্গিনীকে খুঁজতে চেষ্টা করছিল।

গতরাত্তিরে কার জমির ধান চুরি গিয়েছিল। ডগা ছেঁটে অনেকখানি জমির ধান সাবাড়। প্রধানেরা তদন্ত করে গেছে। জাগালদের শাসিয়েছে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে।

বায়তুল্লা হুংকার দিচ্ছিল বসে বসে। —প্রিতিবার এমনি চুরি হবে, ক্ষতিপূরণ যাবে জাগালের ঘাড় ভেঙে? ক্যানে, ক্যানে এই অবিচের? দিবনা ক্ষতিপূরণ। এতবড় মাঠে তিনচাট্টে জাগাল। সামালাই কীভাবে? বিচের নাই শালাদের! পরের ধানের জন্যে মার খেয়ে একমাস মসুরীসেদ্ধ খেলাম।

ছকুলাল পরামর্শ দেয়—এক কাজ কল্লে হয় ভায়াজীবন।

বায়তুল্লা খেঁকিয়ে ওঠে—কাজের গুষ্টিকে বেচি। ফি বছর এমন হলে কোন হারামী নামবে হে মাঠে ই পাপের কাজ কত্তে?

বোঝায় ছকুলাল—আহা শোনই না। মাথাটা ঠান্ডা করো দিকিনি এট্টু।

বায়তুল্লা। যোগীবার কী বলতে গিয়ে প্রচণ্ড কাশছে। রাগলে এমনি বেসামাল হয়ে ওঠে সে।

—সারা আত্তির এক—একজন এক—এক ঠাঁই পাহারা দিলে কেমন হয়? এট্ট মেহনত বৈতো লয়। বলো রাজি আছো? ছকুলাল বলে।

কিছু বলে না কেউ। এমন অনেক পাহারা বসিয়েছে ওরা। এর জন্যে ন’টাকা দামের টর্চ আলো কেনার সাধ ছিল বায়তুল্লার। কোনোদিনই কেনা হল না।

কিন্তু জাম্ভুর একটা আছে। উৎসাহে লাফিয়ে ওঠে সে—আমার তিনবেটারি টর্চ আছে। ভয় কী?

মুখ ভেংচায় বায়তুল্লা। তিনবেটারি টর্চ তো সিবার বাঁকু ঘোষেরও ছিল।

পলকে মনে পড়ে অনেকদিন আগের ঘটনাটা। জাতে গয়লা বাঁকু ঘোষ। সুঁদিনপুরের লোক। কোন কলুর মেয়ে নিয়ে রাতারাতি দেশান্তর হয়েছিল। কতকাল পরে ফিরল দেশে। সুঁদিপুর যাওয়ার মুখ নেই। এল চণ্ডালিকা। সঙ্গে মেয়েটা কোথায় খুইয়ে বসেছে। একা—একা ফিরে জুটল নিতাই রাজবংশীর বাড়ি। দুজনেই ঘোড়েল গাঁজাখোর। নিতাই—এর বেহুলাসুন্দরীর দল ছিল। বাঁকু ঘোষের ভাগ্যে পড়ল চাঁদসদাগরের পার্ট। জমিয়ে তুলল বাঁকু ঘোষ চণ্ডালিকার রাজবংশীপাড়া।

হঠাৎ ঘাড়ে ভূত চাপায় নিল জাগালী। একসময় অবনী চক্কোত্তির জমির ধান চুরি হল। তদন্তে গিয়ে সবে দেখল ধানের পাতায় রক্তের ছোপ। অবশ্যই হাত কেটেছে তাড়াতাড়ি ধান কাটাতে। চতুর চক্কোত্তি, তখনও এখনকার মতো ঝুপসী বনে যায়নি, একেবারে জাগালদের কুঁড়েয় এসে জুটল। সেখানে বাঁকু ঘোষ ছাড়া আর সবাই হাজির।

—তোদের সেই মহারাজ বাঁকু চন্দ্রটা কোথায় রে;

সবে মুখচাওয়াচাওয়ি করে।

—কই রে চন্দ্রসদাগর মশায়?

—এঁজ্ঞে অনুপস্থিত।

—কেন?

কেউ বলতে পারে না কেন।

কিন্তু চক্কোত্তির বিরাম নেই। যখন তখন রাতবিরেতেও হাজির। অবশেষে দেখা মেলে বাঁকুর। —মহারাজের হাত কাটল কীসে? যুদ্ধ করেছিলেন রণক্ষেত্রে?

আমতা আমতা করে বাঁকু—এজ্ঞে নেশাখোর মানুষ। আছাড় খেয়ে শামুকে কেটে যেয়েছে গো।

—তুর বাপের নিকুচি করেছে শালা ডাকাত। চলো আভি থানামে।

থানা যেতে হয় না। গ্রামে গিয়েই চূড়ান্ত। মার খেয়ে চণ্ডালিকা ছাড়ল বাঁকু ঘোষ। আর পাত্তা নেই আজ অবধি।

সত্যমিথ্যা কেউ জানেনা। শুধু বাঁকু ঘোষের আর্তনাদটা এখনও জাগালের কানে লেগে রয়েছে। এই পশ্চিমমাঠের অনেক নিঃঝুম রাত্রির অন্ধকার ভেদ করে কখনো সাড়া দিয়ে যায় যেন।…উ কিছু লয় মশায়, কিছু লয়। নেশার ঘোরে পড়ে যেয়ে শামুকে কেটেছিলো! …জাগালের রক্ত ঝরার বিরাম নেই মাঠে। রক্তে তো আর ধরা পড়ে না কিছু! চোর আর জাগাল, রাজা আর সঙাল, সবার রক্তই লাল।

টিট্টিভ ডাকছে বিলের কিনারায়। সে—ডাকে পড়ন্ত বেলায় রোদ্দুর করুণ হয়ে উঠেছে। বুনোহাঁসের পাখার ধ্বনি বাজছে থেকে থেকে।

অবশেষে ছকুলালের পরামর্শ মেনে নিয়েছে জাগালেরা।

টর্চের আলো থেমে থেমে দক্ষিণের মাঠে। পলকে দূর থেকে কাছে। কাছ থেকে দূরে। আকাশ থেকে মাটিতে। ভুল হয় শীতের ডাইনির হাসি বলে। অন্ধকার দিয়ে বানানো পিচ্ছিল ঠোঁট থেকে চকিত হাসির ঝিলিক।

নিথর চরাচর।

খালি এঞ্জিনটা চলে যায় বিকট জন্তুর মতো চেঁচাতে চেঁচাতে। রেললাইনের কাছেই জাম্ভুর পাহারা।

আজ আর মাঠে জাগালের হাঁক নেই। এই অপরিসীম অন্ধকারের আবর্তের মধ্যিখানে তারা কান পেতে সতর্ক। বোকা অনভিজ্ঞ জাম্ভু মিছেমিছি টর্চ জ্বালছে কেন?

আর ঘোরা যায় না। শিশিরে ভিজে পায়ের কোনো সাড়া নেই। অনভ্যস্ত শরীরে শাসন না মানার আভাস। অসহায়ের মতো হঠাৎ ভাবে জাম্ভু, এর চেয়ে কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘরের কোণে শুয়ে থাকা আরামে উত্তাপে মায়ের জঠরে থাকার মতো। কী প্রতিদানের আশায় এ মাঠের বুকে এমনি ঘুরে বেড়ানো তার? কিছু ধানের জন্যে? উঁহু তার প্রাণ গেলেও সে বলবে না কাউকে। পশ্চিমের মাঠে অনেক খুশি হওয়ার সম্পদ কুড়িয়ে পেয়েছে সে। অনেক ক্লান্ত মেয়ের শরীরের ছন্দে অপরূপ কুহকের ব্যঞ্জনা; এই মাঠে যারা ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো পায়ে পায়ে জীবনের ক্ষুধিত গান ছড়িয়ে মাটিতে ধুলোয় ঘাসে। যা নিয়ে অনেক স্বপ্ন জমে ওঠে জাম্ভুর গোপন ইচ্ছার বন্য দুর্দমতায়। অথচ দিনের সব বিলাসের মূল্য দিতে হবে এই শীতার্ত রাত্রির মধ্যে এমনি অস্বস্তি আর অনভ্যাসে ক্লান্ত শরীর দিয়ে।

বাইশ বছরের জীবনে অনেক আঘাত সয়েছে সে। সংসারে আপন জন কেউ বেঁচে নেই। ছেলেবেলা থেকে গেরস্থর বাড়ি রাখালি করে জীবন কাটিয়েছে।

মনে একটা বিশ্রী পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছে পলাশগেঁয়ে মেয়েটি। এর আগে অনেক নারীর স্পর্শ হয়ে গেছে তার, এও হয়তো তাদের একজনেরই মতো। কিছু তফাত আছে কি? হয়তো আছে। আর যে—পার্থক্য এ মেয়ে পরপুরুষের আবেষ্টনীর মধ্যে নতুন বলে। জীবনের আসল জায়গায় পা দিয়ে যাদের সঙ্গে এর সাক্ষাৎ ঘটছে তাদের অন্য ভাবে দেখছে বলে।

কেমন যেন ইচড়ে পাকা মেয়ে। পুরুষালি তেজ। পলাশ গাঁয়ের মেয়ে জন্ম থেকে বশীকরণ বিদ্যে নিয়ে আসে। ঝুড়ি কেড়ে নেওয়ার সময় কেমন দর্পে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

ভারী অহংকার। চুন্নির আবার দেমাক!

ওকে কি ঠিকই লক্ষ করেছিল জাম্ভু? বিল থেকে উঠে আসার সময় তিনটির মধ্যে এই একটিকে? কে জানে। আসলে ওর চেনা দর্প অহঙ্কারকে হিংস্র হাতে ছিঁড়ে ফেলার নিষ্ঠুর ইচ্ছের আবির্ভাব আরও আগে। আলকাপ গানের আসরে। ছুঁড়ি তাকে ভারী অবহেলা করত। জাম্ভুর সঙদারি বচন শুনে আসার যখন লোকের মুখে হাসির ঝড়, মেয়েদের জায়গা থেকে নেত্যর গলা শোনা যেত—পলাশ গেঁয়ে সঙালের কাছে ই কচি খোকাটি। ইর কথায় হাসি আসে নাকিন? কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে লো আঁটকুড়িরা। কাঁদ, কাঁদ খানিক। অম্মা আবার দাঁতগুলোন কী মোটা, ছ্যাঃ! চুন্নি, শাঁকচুন্নি ঘুটেকুড়ুনি, পাড়াকুঁদুলি।

ক’মাস হল এসেছে এর মধ্যে পাড়া মাথায় করে ঝগড়ায়। ওই অতটুকু মেয়ে! হিংস্র মনে ভাষা বানায় জাম্ভু, কাল তুকে মাঠে পেলে একবার দেখব পলাশগেঁয়ে বশীকরণটা কেমন জিনিস।

টর্চের টিপকলটা বিগড়ে গেছে হঠাৎ। বারবার ক্রুদ্ধ হাতে টিপে চলল জাম্ভু।

কুঁড়ে থেকে নড়েনি যোগীবর। এতে কোনো লাভ হবে না সে ভালোই বোঝে। যারা চুরি করে তারা এদের চেয়েও সেয়ানা। তারা হাওয়ায় মিশে থাকে। মাটির ফাটলে লুকিয়ে থাকে। পলকে বেরিয়ে আসে সরীসৃপের মতো বুকে হেঁটে নিঃশব্দে। জাগালের চোখে তখন সদ্য কালঘুমের মায়া।

তারা ছদ্মবেশী।

ধান মাথায় লোকটিকে দেখে চেঁচাবে জাগাল—হৈ কে যায়?

—আমি আমিন স্যাক। সাতকাঠার বিচাড়ের ধানগুলান লিয়ে যেছি হে।

আর কী বলা যায় তাকে! চুরির বশীকরণ বিদ্যে। এই বিরাট মাঠে কে কার ধান নিয়ে যাচ্ছে, অত তদন্তের ঝামেলা সামলায় কে!

তামাক খেয়ে কাশতে হয়। তবু অভ্যেস, ঘনঘন তামাক সাজে, টানে আর কাশে। কাশির দমকে চোখ দুটো ফুলে বেরিয়ে আসতে চায়। মুখের সব রক্ত চামড়া ফেটে ছিটকে পড়তে চায়। সর্দিশ্লেষ্মা আর দুর্গন্ধ লালা ঝরে পড়ে ফ্যাকাসে ফাটাফাটা ঠোঁটের ফাঁকে। হাড্ডিসার বিরাট আয়তন বুকের পাঁজরে থর থর করে কাঁপে অবরুদ্ধ শ্বাস। তবু অভ্যেস।

বায়তুল্লা বলত, রেলের ইঞ্জিন পুষে রেখেছে বঁধু।

মনে পড়ে যায় এই সব সময়। হাসতে গিয়ে আবার প্রচণ্ড কেশে ওঠে যোগীবর।

পীরপুকুরের পাড়ে একটা দীঘল তেঁতুলগাছে বসেছিল বায়তুল্লা। পশ্চিমে লক্ষ্য রেখে একেবারে মগডালে ঠিক হুতুমপ্যাঁচার মতো।

জাগালীর নেশা ওর রক্তে মিশে গেছে এখন। বাপের ক’বিঘে থাকলেও জাগাল হত সে। মাঠে মাঠে লাঠি হাতে খবরদারি করে ঘুরে বেড়ানোর অনেক শান্তি অনেক সুখ। রাখাল—গয়লাদের চোখ রাঙিয়ে সে বাদশার মতো অহঙ্কারী। মাঠের বাদশা।

বউ গোলবানু খুশি নয় এতে। সে চায় ভাতারটা তার অন্য পুরুষের মতো দুপাঁচবিঘে ভাগে চাষ করুক। পরের ধন আগলে শুধু শরীরের বেমারি। দিনে দিনে কমজোর হয়ে যাওয়া। মনে অশান্তি।

কিন্তু জমির ল্যাঠা কেমন, দেখেছে বায়তুল্লা! হায়, বাপটা তার জমির শোকে পাগল হয়ে মল বুড়োবয়সে! পূর্বমাঠের নাবাল জমি। কতবিঘে তার হিসেব নেই। কাগজপত্তর সব অম্বিকে চক্কোত্তির হাতে তুলে দিয়েছিল আহাম্মক বুড়োটা। নাবাল মাঠের জমি ডুবে যেতে বর্ষায় বাঁকী নদীর বানে। গোটামাঠটা কালে অনাবাদি হয়ে গিয়েছিল। গজাতো শুধু ব্যানা উলুকাশের জঙ্গল বালিয়াড়ি আর খালডোবা জলার ফাঁকে ফাঁকে। কালের চাকা আবার ঘুরল। উত্তরে বাঁকির ধারে উঁচু বাঁধ দেওয়া হল জমিদার আর সরকারের তদারকে।

বোকা চাষিরা অনাবাদি এই জমিগুলোর কথা কবে ভুলে গিয়েছিল। খাজনা দেয়নি অনেকবছর। কী হবে অকারণ কড়ি গুণে ওই নিষ্ফলা মাটির টুকরোর জন্যে। কদাচিৎ কোন বেহায়া চাষি কোথাও চালিয়ে ব্যানার বন সাফ করে বুনত চৈতালী। তাও রাখাল—গয়লার দৌরাত্ম্যে ঘরে ঢুকত না একমুঠো।

নীলামে উঠেছিল অনেক জমি। স্বনামে বেনামে জমিদারেরাই ডেকে নিত। ডাকতেন চক্কোত্তি, শংকরী প্রসাদ, গয়জদ্দি, যুগশ্বের আর সোনাডাঙ্গার ইনতাজ সরদার। অনেক জমি চাষিরা ইস্তফা দিয়ে এসেছিল বলে কাগজপত্রের চিহ্ন পাওয়া যায় এঁদের ঘরে। এখন চাষিরা বলে, সবই জাল। সবার সঙ্গে এভাবে জমি হারাল বায়তুল্লার বাপও। তারপর হল বাঁধ।

সেই অনাবাদি বালিয়াড়ি আর বন্যার জঙ্গল পলকে উধাও। ফলল সেখানে অঢেল অপ্রমেয় ফসল। চক্কোত্তির ছোট ছেলে শরদিন্দু বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যা শিখে এসে কলের লাঙল নিয়ে বসল সেখানে ফার্ম খুলে। ফসলের স্তূপে নোতুন বানানো গুদামঘর ভরে তুলল। হাঁটু অবধি প্যান্ট গুটিয়ে সে মাঠে ঘোরে। অদ্ভুত—দর্শন যন্ত্রের সাহায্যে নিজে দিনরাত্তির প্রাণান্ত পরিশ্রম করে। দেখেশুনে চাষিদের চোখ ছানাবড়া। কপালে করাঘাত শেষ করে বেপরোয়া রুখে দাঁড়াল, এবার ফেরত দাও আমদের জমি। দাঙ্গা হল। ফসল লুঠ। আগুন জ্বালিয়ে ফসল নাশ। মামলা—মোকদ্দমা হইচই। জেল জরিমানার পালা চুকে কিছু শান্ত হল কেউ। কেউ তখনো তুষের মতো ভেতর ভেতর জ্বলছে। ইন্ধন জোগাচ্ছে যারা, তাদের চেনে বায়তুল্লা। তারা শহরের লোক। শহর থেকে আসে। মিটিং করে। নানান কথা বলে, চেঁচায় গলা ফাটিয়ে। বলে লড়াই, অধিকার, লাঙল যার জমি তার। পুবমাঠে তাই দশজন জাগাল। শক্তসমর্থ সব নামজাদা লেঠেলরা। পায় অনেক বেশি এ মাঠের জাগালের তুলনায়।

বাপজানও মামলা করেছিল। হেরে গেল শেষটা। অবশিষ্ট দু—এক বিঘে যা ছিল ওতেই শেষ। চক্কোত্তির বড় ছেলে ঝিকটিপোঁতার নামজাদা উকিল। মামলা সে হাইকোর্টে পৌঁছতে দেয় না।

ক্ষেপে গেল বাপজান। ফরাজি মুসলমান—একবার গান শুনলে যার চল্লিশ বছরের বন্দেগী নষ্ট, সেই সাচ্চা ফরাজি বুড়ো ধেই ধেই নেচে গান গাইত। বায়তুল্লার মনে বাপের ওই ভয়াল—দর্শন চেহারাটার একটা স্পষ্টতম ছায়া জন্মে গিয়েছিল। ও মাঠে জাগালীর লোভ মনে এলেই সে এক গর্জন শুনত গভীর আশমান থেকে, হুঁশিয়ার নেমকহারাম! নিস্তেজ হয়ে যেত সে।

পীরপুকুরের পাড়ে নীচে শেয়ালেরা চেঁচিয়ে উঠেছে হঠাৎ। চোখ মুছে হাই তুলে দোওয়া পড়ে বায়তুল্লা। তৌবা, তৌবা। হে খোদা, শয়তানের হাত থেকে পরিত্রাণ করো।

মাথার ওপর থেকে কী একটা পাখি বিষ্ঠা ছেড়ে দিয়েছে মুখে। দাড়ি বেয়ে পড়ে গেল সেই কুৎসিত জিনিসটা। তখন লাঠির বাড়ি মারে উপরের ডালে। পাখি উড়ে যায়। ক্রুদ্ধ বায়তুল্লা নেমে আসে গাছ থেকে। পুকুরের ঠান্ডা জলে নেমে অজু করে সে। তারপর আম গাছের নীচে নগ্ন মাটিতে পশ্চিমমুখো বসে গভীর রাত্রির ‘নফল’ (অতিরিক্ত) নমাজে বসে।

আল্লাহু আকবর!

একটু দূরে সরে গেছে শেয়ালেরা। অবাক হয়ে চেয়ে আছে নিশীথ রাত্রির এই আশ্চর্য আত্মসমর্পণ দেখে।

ধীরে ধীরে সব ডুবে গেছে রাতের গভীরতম স্তরে। আর বুঝি ফুটবে না আলো রং স্পন্দন। এক ভয়াবহ শূন্যতা সঞ্চারিত হয়েছে নিঃঝুম চরাচরে। কুয়াশা জমেছে অন্ধকারের বুকে। কীটেরা বূর্জাহত। এখন আর কেউ যেন জীবিত নেই। হাসিগান কান্না কথা সব এই হিমডাকিনীর এলানো চুলের মধ্যিখানে হারিয়ে গেছে। গাছে ঠেস দিয়ে থাকা শরীর বিবশ স্থবির যেন একটা পাথরের টুকরো। ছকুলাল ঘুমিয়ে নেই, জাগাও নয় ঠিক। কেমন হারিয়ে যাওয়ার স্রোতে নিজেকে সঁপে দিয়েছে সে। চণ্ডালিকার মাঠের এই রাত্তির তার জীবনে ভারী নতুন।

কত জাগাল, কত মরিয়া চাষা, হারানো গোরু—বাছুরের তল্লাশে কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত কত গেরস্থভীতু রাখাল, আর তাদেরই জন্যে শয্যার নিশ্চিন্ত আরাম ছেড়ে চলে আসে মায়েরা ম্লান লণ্ঠনহাতে আর্তকণ্ঠে ডেকে ফিরেছে এই সব মাঠে। শীতের ডাইনি তাদের বুকে দাঁত বসিয়েছে চোখ উপড়ে নিয়েছে হিংস্র ক্ষুরধার কুয়াশানখ।

এইসব সে জানত না। কল্পনায় আনাও ছিল দুঃসাধ্য। মানুষের জন্যে বুঝি মন কাঁদছিল ছকুলালের। আহা মা বসুমতী, এত যন্তনা তুর ওদরে জন্ম লিয়ে!

অজানা আতঙ্কের বিষে মন জরজর। এই রাক্ষসী ডাইনির কবল থেকে বাঁচার জন্যে মনে পড়ে গেছে তার মাকে।

আমি হারিয়ে গেলাম মা।

সেদিন গয়লাদের হাতের নিষ্ঠুর আঘাতে সে ভেঙে পড়েনি। আজ ছকুলাল ফুঁপিয়ে উঠল হঠাৎ। জাগালির চেয়ে কিছু জমি ভাগে মেলে না কারুর কাছে? শংকরীপ্রসাদের কাছে। আশ্চর্য; নাথুলালের মৃত্যুর পর সব অধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। রাজাবাবুর চোখে সে বিষ।

বিছানাচ্যুত শিশু যেন মায়ের স্তন খুঁজছে রাত্রির অন্ধকারে। ছকুলাল খুঁজতে লাগল তেমনি এক উষ্ণতা। কোমলতা। অমৃতময়তা।

আচমকা এক শব্দের ঝড়। ছিঁড়ে গেল পলকে ঘুমের আচ্ছন্নতা। স্বপ্নের চাতুরিতে জেগে ওঠা কান্না পলকে উধাও। লাফিয়ে উঠে বসে ছকুলাল।

কী স্বপ্নের গন্ধ এই মাত্র মুছে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। ভাবতে ভাবতে কান পাতে বিলের দিকে। অস্পষ্ট একটা গোলমালের শব্দ সেখানে। ধর, ধর, মার, পালোলো! কারা চেঁচাচ্ছে চণ্ডালি বিলের কোলে। কুয়াশার ঠাহর করা যায় না। লাঠিটা মাটিতে ঠুকে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ছকুলাল। ওপাশে সাঁৎ করে কারা ছুটে পালায় এলিয়ে পড়া ধানের উপর মসমসিয়ে। ছকুলাল চেঁচিয়ে উঠতে চায়—এখানে, এখানে! কথা থেমে যায়। কে একজন গাছের শেকড়ে টোক্কর খেয়ে এসে পড়ে একেবারে তার পায়ের ওপর। শিউরে ওঠে শরীর। গলা কাঠ। পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে ছকুলাল। চণ্ডালিকা পরগনার আবার কোন ‘বিত্যেন্ত’ শুরু হচ্ছে এখন থেকে।

ফিসফিস করে কথা বলে উঠেছে সেই শরীর। ব্যাকুলভাবে বলছে, দোহাই তুমাকে পায়ে পড়ি গো। একটু চুপ করো। আমাকে বাঁচতে দাও।

হুঁশ ফেরে ছকুলালের। চাপগলায় বলে, বেপারটা কী বটে?

আমরা সুঁদিপুরের লোক। বিলে লুকিয়ে জাল ফেলেছিলাম। ধরা পড়ে যেয়েছি গো!

আশ্চর্য হয়ে যায় ছকুলাল। এ যে মেয়ে—ছেলে! আর, আর যেন সেই বিন্দুবাসিনী!

পা থেকে মাথা অবধি এক ঝলক রক্ত হৃৎপিণ্ড থেকে বেরিয়ে দুভাগ হয়ে চলে যায়। তুমি বিন্দুবাসিনী?

কে? নড়ে উঠেই থেমে গেছে হিমে ভেজা কাশফুল। গায়েন, তুমি গায়েন?

বিড় বিড় করে বিন্দু, গায়েন তুমি এখেনে! আমাকে তুমি ধরিয়ে দেবে গায়েন?

বিল থেকে কোলাহল করে ছুটে আসছে ওরা। ঝাঁকড়া শ্যাওড়ার মাথায় গিয়ে মিশিয়ে থাকে বিন্দু। ছকুলাল এতক্ষণে বিড়ি ধরায়, মুখ দিয়ে অনেকটা ধোঁয়া ছাড়ে। ওদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় ইচ্ছে করেই। চেঁচায়, কে যায়? কে বটে?

উপরে বিন্দু মরিয়া। গায়েন তাকে ধরিয়ে দেবে তাহলে!

নীচে ছকুলালের স্বর। কারা আসে রা দ্যাও চট করে!

কে? ওরা এগিয়ে আসে। কে বটে;

আমি ছকু জাগাল। তুমরা?

গায়েনদাদা নাকিন হে? ইদিকে লোক ছুটতে দেখলা না?

দেখিছি। হুই পথ ধরে পালিয়েছে। কিন্তুক বিত্যেন্তটা কহো তো আগে।

গাছতলায় চারজন লাঠি বল্লমধারী। চোখের ক্ষুরধার হিংসার ছটা অন্ধকার আর কুয়াশা ভেদ করে নজরে পড়ে। ….শালা সুঁদিপুরের বাগদি হে, গায়েন। চুরি করে পত্যহ মাছ ধরে। আজ ধরিছি হাতে নাতে।

আরেক জন বলে, জালগুলান সব ফেলে পালিয়েছে। আমরা নালায় উ মাথা থেকে আসবার আগেই। কাজে লাগবে জালগুলান।

গাছের উপর তাকায় একজন। যেতে পারেনি শালারা। নিশ্চয় কাছে পিঠে গাছ—গাছোড়ে লুকিয়ে আছে।

ওপরে বিন্দু পোকার মতো নিঃসাড়। শ্যাওড়া গাছে প্রেতিনী যেন।

মাথা নাড়ে ছকুলাল। —তা হতে পারে। কিন্তুক ই গাছের তলায় আমি সেই সনজে থেকে।

উপরে নিশ্বাস ছাড়তে চায় বিন্দু। টেনে টেনে নিঃশব্দে। হৃৎপিণ্ডের ধ্বনি এবার মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।

গয়জদ্দি মণ্ডলের লোকেরা সরে যায় দূরে। সেখানে জালগুলো আগলে নিয়ে বুড়ো যখের মতো বসে আছে মণ্ডল নিজে। এই হিমে বুড়োটা মরে যায় না কুঁকড়ে!

ছকুলাল চাপা গলায় ডাকল, বিন্দু, বিন্দুবাসিনী!

দক্ষিণে জাম্ভুর টর্চের আলো। রেললাইনে সিগনালপোস্টের লাল আলো সবুজ হয়ে গেল। তিনটের গাড়ি আসবে।

বিন্দু, নেমে এসো নির্ভয়ে। ছকুলাল ডাকে।

সুঁদিপুরের বিন্দুবাসিনী নেমে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে! ছকুলাল কী বলবে বুঝতে পারে না। বিন্দুও স্তব্ধ। লজ্জা, এ বড় লজ্জা! চণ্ডালিকার রূপবান গায়েন পুরুষের সামনে এমনি করে ধরা পড়ে যাওয়া। এমনি হার স্বীকার। সে নতমুখে পা বাড়ায়।

তখন ছকুলাল গলা ঝেড়ে নেয়। ডাকে—শোন। বিন্দু ঘুরে দাঁড়ায়। মুহূর্তে সে সহজ হয়ে উঠেছে। একটু হেসেছে সেই শব্দ। যেন বলছে—ভাগ্যিটা দেখছ, গায়েন?

কিন্তু কিছুই বলে না ছকুলাল। হঠাৎ সে অস্ফুট চেঁচিয়ে ওঠে, তুমি পালাও পালাও বিন্দুবাসিনী!

অঘ্রাণের দ্বিতীয় সপ্তাহ।

সময়টা বড় কাজের। একটু অবসর মেলে না। একের পর এক জমি থেকে ধান উঠছে। সেখানে গিয়ে ন্যায্য পাওনা আদায় করা। বিঘে পিছু দশ আঁটি। তাতেও ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা কম চলে না। জমির পরিমাণ কমিয়ে বলে। জাম্ভু আর ছকুলাল প্রথম প্রথম এসব দেখাশুনা করত। কিন্তু বায়তুল্লা আর চুপচাপ বসে থাকতে পারল না জিরেন নিয়ে। এরপর ওরা দুজন শুধু রক্ষণাবেক্ষণে রইল। আদায়পত্তর বায়তুল্লা আর যোগীবর করবে। বলে বায়তুল্লা, ভাবলাম একটু জিরেন লিই, ঘটল না। নতুন মানুষ পেয়ে শালারা ঠকিয়ে বিন্তি কাবার করে দিচ্ছে। বলে যোগীবর, পেচণ্ড এ ঠকান। ই মাঠে দুকুড়ি কাঠায় বিঘের মাপ আছে।

আনাড়ী ছকুলাল শুধোয়, সত্যি?

হো—হো হাসে বায়তুল্লা। আমার চোখে ধুলো দেবার সাধ্যি কার; ই মাঠে আজ সাতআট বচ্ছর আছি। সব জমির মাপ আমার একোবারে ঠোঁটস্ত।

বঁধুর ক্ষমতার গর্বে গর্বিত যোগীবর। বলে, বিশ্বেস না হয়, পরখ করে দ্যাখো বাছা। আজকের বাড়ি কাপুড়ের লিস্টির মতন বঁধুর মোনে লিস্টির খাতা নেকা আছে। আমার কিন্তুক বাছা উসব মোনেটোনে থাকে না!

পাওনা ধানগুলো অবসরমতো ওরা ঠেঙিয়ে নেয় পালাক্রমে। হিসেব বখরা করে আপন আপন বাড়িতে রেখে আসে। কুঁড়ের সুমুখে একটা ছোটখাটো খড়ের পালাও হয়ে গেছে ততদিনে। চেঁছেছুলে পরিষ্কার সাদা মাটি। তাতে গোবর নিকিয়ে দিয়ে গেছে নির্মলা আর ওলাঙ্গিনী। গোলবাণু ঘর থেকে পথে নামলে বায়তুল্লার মাথায় খুন চেপে যায়। তাই ওদিকে রেহাই বায়তুল্লার। বসে বসে দেখিয়ে শুনিয়ে খামার তৈরি করতে সাহায্য করেছে মেয়ে দুটোকে।

এত কাজ এখন। তবু একটু অবসর করে নেবে ছকুলাল। কাজল কখন এসে পড়ে। তার আগে একবার স্টেশন বাজারে যাওয়া দরকার। কিছু কেনাকাটা করতে হবে। কাল আবার নবান্নের দিন।

ব্যবস্থা করে ফেলে সে। দীপুপদকে ডেকে পাঠায়। দীনু এলে ওকে একটিনিতে দেয় সে একবেলার জন্যে। তা রাজি দিনু। জাম্ভু উল্লসিত। আলকাপের দলে কবিয়ালির প্রথা আছে। দীনু সেই কবিয়াল। অল্পসল্প লেখাপড়াও জানে। যাত্রায় দলে কেষ্ট সাজতে গিয়ে পাঠশালায় ইস্তফা। কিন্তু গান ছাড়ল না। অবশেষে মেতেছে কবি নিয়ে। রাজ্যের শাস্তর নিয়ে আলোচনা তার। রাশীকৃত পুঁথিপুরাণে ঘর বোঝাই। কোত্থেকে কীভাবে জোগাড় করে কে জানে!

জমিয়ে রাখে দীনু ছড়াপাঁচালি গেয়ে। কানে হাত দিয়ে ওস্তাদী ঢঙে গলায় গিটকিরি দিয়ে ধুঁয়া গায়—

 দেবের দেব মহাদেব ববম ভোলা।

 হাড়ের মালা গলে বাবার

 (হাতে) সিদ্ধির ঝোলা।

ধুঁয়া আড়াই বার গায় জাম্ভুর আর যোগীবর। দোহারকী করে এরা। আর বায়তুল্লা অবাক চোখে তাকিয়ে দীনুর দিকে। গতিবিধি লক্ষ্য করে চুপচাপ। ধুয়ো শেষ করে পয়ারছন্দে গায় দীনু—

 কুচুনীপাড়ায় ভোলা যাও কিসের কারণ

 কার সঙ্গে প্রেম করে মজাইলে মন হে……….

যোগীবর চোখ ঠার দেয়, উসব গুহ্যতত্ত্ব হে বঁধু!

যোগীবর বায়তুল্লার দৃষ্টি আকর্ষণে ভারী খুশি। বলে, উতো সামান্য কথা। চিকিষ্টোর আঠারোশোর গোপিনী ছিলো। নীলে করতেন বিন্দেবনে। সিখানে রাসনীলের সকল দেবতার নেমতন্ন। কেবল শিবের নাই। শিব গেলেন সিখানে এক গোপিনীর রূপ ধরে। নারীমূর্তিতে। তারপরে…..

গান থামিয়ে দীনু বলল, ইটা কতি আছে গো কাকা, কোন পুরাণে?

তা জানিনে বাবা। ঠাকুরমশায়ের কাছে শুনিছি। শিবের গভভসংবাদ গো। বিপক্ষকে প্রশ্ন করে দেখো। ঘায়েল হয়ে যাবে।

বায়তুল্লা বলে, বড় আজগৈবী শাস্তর তুমাদের বঁধু। কোন ওড় নাই!

ঘুরে বসে যোগীবর, তুমি জানো না বঁধু, একবার আমাদের শিশুবয়েসে তুমার স্বজাতি চাঁদু কবেল এল আখুরাজার বাড়িতে। ধুয়ো দিলে,

 যত সব বামুন গোয়েলে,

 গরু খেয়ে ঢেকেছিলো বোরার পোয়ালে।।

গোমাংস ভক্ষণ করে বোরাধানের পোয়ালে ঢেকে এখেছিল। বুঝলে? জবাব দেয় সাধ্যি কার? মোচলমানের মুখে হেঁদুর তাবৎ বেদপুরাণ। ধন্যি দিলে শ্রোতারা মেডেল দিলে আখোরাজা। হুঁ হুঁ! মাথা নাড়ে যোগীবর।

উৎসাহী দীনু বলে আর—তবলার প্রথম চাঁটিতে কী বোল ওঠে জানো চাচা? তান….সেন! মানে গানের আদি গুরু যিনি। তুমাদের স্বজাতি।

—কী জানি বাপু। মুখ গোমড়া করে উঠে দাঁড়ায় বায়তুল্লা। —উসব কহে কী ফায়দা হবে বাপধোনরা? যা কাজ, করি এসো। তানসেনচাচা তো রুজীর মালিক লয়। বাপ জাম্ভুবান, টিন লাগা দিকিন। দীনুপদ, শাস্তর পরে হবে জাদুমণি। তক্তাখান পাতো টিনে। বঁধু, আবার তামুক খাবা; এসো দিকিন, খানিক ধান ঠেঙাই আগে!

জমাট সভা বিষাদে ভেঙে যায় নিমেষে। অকারণ একবার চেঁচায় জাম্ভু,—হেই…….হৈ…….হো……..ও……….ও শালীবিটিরা।

দূরে যেতে যেতে পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে একটি মেয়ে। নেত্যবালা না?

স্টেশনবাজারের একটা কাপড়ের দোকান ঢোকে ছকুলাল। দু’মণ ধান বেচে হাতে পেয়েছিল চব্বিশটে টাকা। চার টাকা দিয়েছে ওলাঙ্গিনীকে নবান্নের জন্যে। বাকি টাকা নিয়ে বুক ফুলিয়ে দোকানে ঢোকে সে।

বেশ সোন্দর একখান রঙিল শাড়ি দিবেন বাছা! বেশ চেকন পারা। মজবুত যেন হয়।

ছকুলাল গর্বিতভাবে চারপাশে তাকায়। ধন্যি যায় রেফুজিদের। ইস্টিশানের ধারে কেমন সোনার বাজার পত্তন কল্লে। সপ্তায় দুদিন হাট। রাজাবাবুরা যা কোনোদিন করতে পারেননি। ইস্কুল, পোস্টাপিস, খেলার মাঠ, ধন্যি বটে!

কী দামের কাপড়?

তা আট দশট্যাকার বটে। ছকুলাল শাড়ির আলমারিতে লুব্ধ চোখে তাকায়। বাহারিয়া শাড়ির স্তূপে বসে বিপন্নমুখে ছটফট করে।

ফাজিল দোকানদর বলে, বৌর জন্যে?

এঁজ্ঞে হ্যাঁ। ঘরে আর তো মেয়েছেলা নাই।

মুখে টিপে হাসে দোকানদার। কী রং বউয়ের? মানানসই দিতে হবে তো।

তা হবে বইকি। উৎসাহে জাঁকিয়ে বসে ছকুলাল। জীবনে এই প্রথম এতদামের শাড়ি কিনছে সে। কাজল যেমন পরে থাকে, তেমনি পরবে ওলাঙ্গিনী।

অঙটা বাছা পরিষ্কার কিন্তু আমা হতে ময়লা পারা। মিথ্যে বলব না। বেশ মোটা সোটা গড়ন। বেঁটেও লয় লম্বাও লয়। এই ধরুন……

বুঝেছি, বুঝেছি!

ডগডগে লাল তাঁতের শাড়ি। চওড়া সোনালি ফুল আঁকা পাড়। আঁচলটা কী চওড়া। তেমনি সোনালি নকসার বাহার। জমিনে ঘন নীল রেশমি সুতোর তারা বসানো। মনে মনে এই শাড়ি পরা ওলাঙ্গিনীর চেহারা কল্পনা করে ছকুলাল।

কিনল ব্লাউজ। আশমানি রঙ রেশমি ব্লাউজ। হাতে গলায় লাল নকশা। একটা সবুজ সায়াও কিনল; মনোহারি দোকানে কিনল সাবান হিমানি ফুলেল তেল। কেমিকেলের দুল কিনতে গিয়ে দাম শুনে চমকে উঠল। সাড়ে পাঁচ টাকা? তবে সোনা কি দোষ কল্লে?

আবার ফিরল কাপড়ের দোকানে। ভুল হয়ছিল বাছা। লিজের জন্যে এট্টা গেঞ্জি আর একখান গামছা প্রয়োজন। কাজল কামিনী গামছা দেবেন।

সন্দেশও নিল একঠোঙা। বেচারা ওলাঙ্গিনী কি কিছু খেতে পায় এসব ‘দব্য’? আর সবশেষে কিনল দুখিলি পান আর একটা সিগারেট। একখিলি পান মুখে পুরে অন্যখিলি রেখে দিল ওলাঙ্গিনীর জন্যে। লাল গামছায় সবগুলো বেঁধে কাঁধে ফেলে এগিয়ে চলল চণ্ডালিকার পথে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মুখ ফেরাল পশ্চিম দিগন্তে।

দিগন্তের নীচে সূর্যের শেষ আলো মিলিয়ে যাচ্ছিল।

ওলাঙ্গিনী তখনও ফেরেনি। এক্ষুনি আবার মাঠে ফিরতে হবে। বেচারা দীনু এতক্ষণ তার পথ চেয়ে হাপিত্যেশ করছে। কিছুক্ষণ ব্যস্ত হয়ে অপেক্ষা করে ছকুলাল। সন্ধ্যা নামে। আকাশ থেকে হিমার্দ্র অন্ধকারের ডানা নেড়ে প্রকাণ্ড একটা শকুন ভাগাড়ে নেমে আসছে যেন। সুদামসখীর মায়ের কাছে একবার খোঁজ নিয়ে আসে সে। বুড়ি বলে, একা তুমারটাকে ফেলে তো সুদাৎ ঘরে ফিরবে না বাবা। অপিক্ষা করো। যেয়েছে বুঝি এট্টু দূরান্তর।

ফিরে এসে ঘর খুলে জিনিসপত্রের বান্ডিলটা ভাঙা সিন্দুকে ছেঁড়া ন্যাকড়ার স্তূপের মধ্যে লুকিয়ে রাখল ছকুলাল। ওলাঙ্গিনীকে অবাক করে দেবে সে। খানিক তামাশা করবে। খানিক কপট ক্রোধে চেঁচাবে, কতি পেলি এই দামী দামী দ্রব্যগুলা? কী মজাই না হবে।

ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে উঠল ছকুলাল।

দেয়ালের মোটা পেরেকে একখড়ি পাকা কলা ঝুলছে। কাল নবান্ন। চাবিটা যথাস্থানে রেখে গান গাইতে মাঠে নামে সে। ওখানে ধান ঠেঙানোর আওয়াজ শোনা যায় কুঁড়ে থেকে। আগুনও জ্বালিয়েছে ওরা। খানিক পরে পাহারার বন্দোবস্ত মতো এক এক জন এক একদিকে বেরিয়ে গিয়ে চুপটি করে বসে থাকবে! যোগীবর ভাত রান্না করে তিন জনের জন্যে। বায়তুল্লার ভাত আসে বাড়ি থেকে। খাওয়া সেরে সব বেরুবে আপন এলাকায়।

দূর থেকে সাড়া দেয় ছকুলাল, দীনুপদ আছিসরে বাবা?

এই যে মামা! দীনুও সাড়া দেয়।

যোগীবর উনুনে লকড়ি গুঁজছে। —কাজ হল বাবা ছকু?

নীরবে মাথা নাড়ল ছকুলাল। দীনু চলে গেলে হঠাৎ যোগীবর উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচায়, তুর খুড়িমাকে কাল একবার আসতে বলিস বাছা!

আচ্ছা।

আঁধারে মিশে যায় দীনু।

একসময় খাওয়া শেষ হয়ে যায়, বায়তুল্লা লাঠি হাতে এগিয়ে যায় পীরপুকুরের দিকে। জাম্ভূ টর্চ জ্বেলে চলে দক্ষিণের রেললাইনের কাছে।

হঠাৎ বলে ছকুলাল, এটা পাথথনা ছিল যোগীকা।

তামাক সেজে জাঁকিয়ে বসেছে যোগীবর। কাশতে কাশতে শুধোয়, কীরূপ?

আজ আমাকে ইদিকটা দ্যাও কাকা। তুমি অনুগ্য করে শ্যাওড়াতলা যেলে উত্তুম হয়।

চোখ লাল করে বলে যোগীবর, কারণটা?

আমার শরীল আজ অচল ঠেকেছে কাকা। ক’রাত খুব নাচারে ছিলাম। অব্যেস নাই কিনা। বিড়বিড় করে বলে ছকুলাল।

অনেকক্ষণ কাশে যোগীবর। তারপর সিদ্ধান্ত জানায়, উঁহু। তা পারব না বাছা ছকু। তুমি পাড়াপিতিবেশী বটে। কিন্তুক যুবো বয়েস তুমার। আমার অবস্তাটা দেখছো না। আগেভাগে তখন তুমি ইদিক লিলেই পাত্তে। তুমাকে তো কেউ জোর করে গছিয়ে দেয়নি। তাছাড়া ইসব তো তুমারই শলাসুলুক। এখন বাজে কথা বললে তো চলবে না জাদু।

ঝগড়ার সুর যোগীবরের কণ্ঠে। একটা নির্জীব স্থবির জীব স্বরূপে বেরিয়ে পড়েছে চণ্ডালিকার মাঠে। ছকুলাল অবাক।

আবার বলে যোগীবর, আগ কল্লে চলবে না ধোন। হাঁপকাশির রুগি, এই হিমে উই লরককুণ্ডুতে বেসজ্জন দিবা আমাকে। আর যুবো বয়েসে কুঁড়েয় আরামে লিদ্রা যাবা, ইটা কেমন বিচার? লিজে ভাবোদিকিন খানিক।

এবার মায়া হয় ছকুলালের। কিন্তু মন তার আহত হয়ে গেছে। সেদিন রাত্তিরে ডহরের ধারে দাঙ্গায় বায়তুল্লার পাশে লাঠিধরা লোকটা কি এই? কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে চলে আপন এলাকায়। পেছনে যোগীবর ভাঙা গলায় গান গাইতে চেষ্টা করছে।

শেওড়াগাছের উঁচু হয়ে থাকা গুঁড়িতে গিয়ে বসে ছকুলাল। মনে পড়ে সে—রাত্রির কথা। গলা ফাটিয়ে হেসে ওঠে সে। ভয় পেয়ে পেঁচাটা উড়ে যায়। তারপর আবার ফিরে এসে পাতার আড়ালে ঢোকে। মেয়ে বটে একখানা, ধন্যি যাই সাহসকে।

বিন্দু বলেছিল, জালখানা বেহাত হয়ে বড় বিপদ হল গায়েন। অনেক ট্যাকা লাগবে।

এই মুহূর্তে মনে হয় তার, একখানা জাল ওকে কিনে দিলে বড় ভালো হয়। ওলাঙ্গিনী রাগ করবে না। বরং খুশি হবে। জাগালির ধান সবগুলো ঘরে যাক, তারপর কিনবে জাল। দিয়ে আসবে চুপিচুপি। বিন্দু তার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে। গয়লারা মৃত্যু হয়েছে ভেবে ফেলে দিয়ে এসেছিল শরবনের আড়ালে। বিন্দু না এলে সেখানে সে মরে যেত।

জীবনের দাম এত! বেঁচে থেকে এত আনন্দ আরাম শান্তি!

পেঁচাটা এতক্ষণে বিরক্ত। চেঁচিয়ে উঠেছে আচমকা। ছকুলাল একটুকরো মাটি হাতড়ায়। যাঃ যাঃ, ধুঃ শালার আপদ। ঢিল না পেয়ে হাত তুড়ি দেয় সে। তারপর উঠে দাঁড়ায় হঠাৎ। দ্রুত পা চালায় গ্রামের দিকে। আজ সে ওলাঙ্গিনীকে সাজাবে নতুন ‘দব্য’ দিয়ে। বলবে, ভগ্নীর সুমুখে এমনি করে সেজে থাকবে। কিন্তু মায়ের পেটের বোনের সঙ্গে এ যেন একটা প্রতিযোগিতা। এ কি ভাবছে সে?

একমুহূর্ত ইতস্তত করে ছকুলাল। পলকে সব সংশয় দ্বিধা কেটে যায়। ন্যায়সংগত রোজগারের গর্ব আর পুরুষত্বের অহংকার সব মালিন্য ঘুচিয়ে দেয় মন থেকে।

ওলাঙ্গিনীর থাকার কথা সুদামসখীর মায়ের কাছে। কিন্তু কী ভেবে নিজের বাড়ি ঢোকে ছকুলাল। দরজা বন্ধ রয়েছে ঘরে। দাওয়ায় উঠে চাবিটা খুঁজতে থাকে। আর তৎক্ষণাৎ ওপাশে ভাঙা পাঁচিলের ওপর শুকনো তালপাতার বেড়ায় একটু শব্দ। কী যেন বাড়ি ঢুকছে চুপিচুপি। একটু অবাক হয়ে ভালো করে নজর রাখে ছকুলাল। উঠোনে যে দাঁড়িয়েছে সে পুরুষ। চোরচোট্টা নাকি? একটু হেসে দেয়ালে ঢেস দিয়ে নিঃশব্দে গতিবিধি লক্ষ্য করে। লোকটা কপাটহীন বাড়ির সদর দোরে সুমুকে দাঁড়ায়। তারপর কাকে চাপা গলায় ডাকে। এবার ছকুলাল চিনতে পারে। বনমালী নাপিত।

আর মেয়টো? কে, কে ও? ওলাং, তার ওলাং।

চাপার স্বর কানে আসে। এস!

না।

কেনে?

কে দেখে ফেলবে।

ধূর! শালা গায়েন এখন বিলের মাঠে ঠ্যাং তুলে পড়ে আছে। ইথেনে কেমন সোন্দর জায়গা!

না। দিঘির উদিকে চলো।

ক্ষুরকাঁচিধরা লিকলিকে হিংস্র হাতটা নড়ছে, বেশ দেখা যায় এখান থেকে। আর সইতে পারে না ছকুলাল। লাফ দিয়ে পড়ে আচমকা। উঠোনের পাথুরে নিবারণ মাটিতে হাঁটু দুমড়ে পড়ে যায়। তারপর দাঁড়ায়। ততক্ষণে ওরা উধাও।

বাঁশবনে শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি দমকা বাতাসে। শিমুলগাছে শকুনেরা একবার নড়ে ওঠে। অন্ধকারে শুধু থরেবিথরে হলুদ ফুল। ছকুলাল চোখ মুছেও পথ পায় না। মাতালের মতো টলতে টলতে গিয়ে দরজা খোলে। সন্তর্পণে হাত বাড়ায় সিন্দুকে। জিনিসপত্রের বান্ডিলটা তুলে নিয়ে দরজায় তালা এঁটে বেরিয়ে পড়ে চাবি যথাস্থানে রেখে। এখন সে অনেক শান্ত। জীবনে এই ঘটনা সে কারুর কাছে প্রকাশ করবে না। করে লাভ কী! রায়দিঘির পাড়ে চাপা স্বর যেতে যেতে কানে আসে। ছকুলাল মাঠে গিয়ে নামে। পথ না ধরে এবড়োখেবড়ো জমির ওপর পাথরের টুকরোর মতো গড়িয়ে চলে।

বনমালী নাপিত। মেয়েটা ওলাঙ্গিনী। রক্তের নামে শপথ করে বলবে ছকুলাল, হ্যাঁ ওলাঙ্গিনী। উথালপাথাল রঙের খেলা শুরু করেছে সে সোয়ামীর মাঠে থাকার নিশ্চিন্ত সুযোগে। কিন্তু সুদামসখীর মা? হয় তো টাকা খেয়েছে। এই তো সংসারের বিধান। মধ্যে কদিন হঠাৎ একটা আলোয়ার আলো। কী নির্বোধ ছকুলাল। নির্জন প্রান্তরে অন্ধকারে একটা ভুলোর দিকে ছুটেছিল! শ্যাওড়াগাছে পেঁচাটা আবার ডেকে উঠেছে। বুকখানা দুহাতে চেপে ধরে মাতালের মতো এগোয় সে। না, শ্যাওড়াগাছটাও হারিয়ে গেছে। পেঁচাটাও। পট থেকে সব ছবি মুখে গেছে। শুধু নীল কুয়াশা আর অন্ধকার নিষ্ঠুর এক শূন্যতার মধ্যিখানে ডুবে যাওয়া, লুকিয়ে যাওয়া।

সোয়ামী জাগাল হলে তাদের বউ হয়তো এমনি করে রং খেলে। ও রঙের খেলা জানে ছকুলাল। কুনাইপাড়ার ওই শয়তান রংটি তার বড় পরিচিত। নাঃ, আর শুনবে না ওলাঙ্গিনী কী বলে। শোনার কোনো দরকারও নেই। মন বলে কিছু শুনো না, সামনে চলো। শীতের অন্ধকার মাঠে। কাঙাল হয়ে জানোয়ারের মতো পড়ে থাকো শিশিরে হিমে নিস্পন্দ। স্বপ্ন দেখো না। শীত বড় কষ্টের ঋতু। জাগালি বড় দুঃখের জীবন। মাঠ যখন তুমি ঘর করে তুলেছ—ওদিকে ঘর তোমার মাঠের মতো শূন্য হয়ে উঠেছে। সেখানে এখন শীত শিশির আর নিঃসঙ্গতা। জাগালের কাছে ঘর—মাঠের ফারাক থাকতে নাই।

চিরদিন বাহিরকে ঘর করে তুলেছে ছকুলাল। গায়েন ছকুলাল বারবার তার ঘর বাহির হয়ে গেলে বাহিরকেই ভেবেছে এই তো আমার ঘর। এই আমার সংসার। তুফানী ‘আদর, সুবাসলতা কেউ তাকে ঘরে থাকতে দেয়নি।

দেয়নি। কিন্তু তারা কেউ ওলাঙ্গিনীর মতো নয়।

শূন্য ঠান্ডা মাঠে ছকুলাল পাগলা ঘোড়ার মতো মুখ উঁচু করে ছোটে। অবুঝ মন বাগ মানে না।

দিকভ্রান্তের মতো হাঁটছিল ছকুলাল।

না, তুফানী আদর সুবাস—কেউ ওলাঙ্গিনীর মতো ছিল না। এতদিনে বুঝতে পারছে ছকুলাল পুরুষের বুকের খানিতে থাকা সেরা সোনাটি তবু তো তারা পায়নি। তার হতভাগিনী। ছকুলালের ভালোবাসার খাঁটি ‘দব্যটি’ পায়নি। হয়তো পেত। পাবার আগেই মরণ তাদের টেনে নিয়ে গেল।

বুঝতে পারছে ছকুলাল। কারণ কি না এতদিনে বাউণ্ডুলে গায়েন গান ছেড়ে ঘোর সংসারী হতে চেয়েছিল। বাহির আর টানছিল না তাকে। ওলাঙ্গিনী তার পা দুটো মাটিতে বসিয়ে দিয়েছিল শিকড়ের মতো। এবার যথার্থ গাছ হয়ে উঠত ছকুলাল। সংসারের সব গাছের মতো ছায়া বিস্তার করে ফুল ফোটাত, ফল ধরাত। খাঁটি গেরস্থ হয়ে উঠত সে। ওলাঙ্গিনী তার মন কেড়েছিল। বুকের সোনাটি পেয়েছিল সে।

হতভাগিনী ওলাঙ্গিনী, তা না হলে কেন ভরা গেরস্থালি ছেড়ে দাদার বাড়ি একবস্তরে তাকে পালিয়ে আসতে হয়? কেনই বা তার দাদা অম্বিকা হঠাৎ চেনা বাউণ্ডুলে একটা অকর্মার সঙ্গে তাড়াহুড়ো তার স্যাঙা দিয়ে বসে? এবার সব জানা গেল।

গভীর দুঃখে অভিমানে ছকুলাল ওলাঙ্গিনীর অবহেলায় ফেলে দেওয়া ‘সোনা’টা যেন হাতে নিয়ে অন্ধকারে প্রথমে তুফানীকে খুঁজল।

হ্যাঁ তুফানীই পেতে পারত ছকুলালের পুরুষহৃদয়ের এ অমূল্য সম্পদ। ভালোবাসা। শুধু ভালোবাসা নয়—বিশ্বাস দিয়ে উজ্জ্বল করা ভালোবাসা। কজন মেয়েই বা তা পায়? ওলাঙ্গিনী পেয়েছিল, নিল না। এখন তাহলে তুফানীকেই দেবে। তুফানী সামনে নাই। শরীরে নাই। মনে তো আছে। মনের দিকে তাকিয়ে তুফানীকে দেখল ছকুলাল।

ওলাঙ্গিনী, তুমিও দেখ। তুফানীকে কী দিতে যাচ্ছি, কী পায় তুফানী তুমিও দেখ। চোখ থাকলে দেখতে পাবে। চোখ আছে তো দেখ। ………..

ওলাঙ্গিনীর চোখের আলো আছে। ছিল না তুফানীর। ছিল বাঁকী নদীর দহের মতো নিশ্চল স্তব্ধতা। হাজার তরঙ্গে কাঁপেনি সেখানে অতলপাতাল বুকের হৃদপিণ্ড। বড় বড় চোখে চেয়ে থাকত বোবার মতো। অবোলা গাই। সোয়ামীর পথেই পথ। তার জীবনেই জীবন, মরণ তার মরণে। কত অনশনতপ্ত দীর্ঘ দিন কেটে গেছে তার, যখন ছকুলাল দুটো চালের জন্যে একতারা বাজিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তর। বলেনি কোনোদিন, আর কী! ভেক লিয়েছ, এবার জাত বদলে বোষ্টম হও। কত বিরূপ হয়েছে। আর এই গুজব নিয়ে বিশ্রী হইচই কুনাইকুলে। তবু একতারা ছাড়তে বলেনি তুফানী। বলেনি ওলাঙ্গিনী বা কাজলের মতো, তুমি আরও পাঁচটা মানুষের মতো সহজ হও।

চেঁচিয়েছে কাজলবালা, লজ্জা করে না ভিক্ষে করতে? বাউল বোষ্টমের বেশে একতারা ডুগি বাজিয়ে দেশ দেশান্তর বেড়াতে? কী অদ্ভুত চলন তোমার দাদা, জাত দিলে না, ভেক ধরলে। ছি, ছি!

তখন মুখ খুলত তুফানী। শান্তস্বরে বলত, উটা একটা বিদ্যে বটে। ওজগার হয় তো ছাড়বে কেনে সি—বিদ্যে?

নষ্ট বিদ্যে।

বলত তুফানী, তুমিই তো সব সময় বলো দিদি, জাত আগে না যৌবন আগে! থেমে যেত কাজল। বিকেলের ট্রেনেই পালাত রাগ করে। আর সে চলে গেলে প্রতিবারেই মতোই কিছু টাকা পাওয়া যেত ঘরে।

ছকুলাল বলত তখন, ভগ্নীর কথাই সার করি। শিরোধায্য করি। আর গান গাইবোনা। আর ভেক লিবোনা।

ফুরুত সেগুলো। আবার অনটন। আবার বাড়ি বাড়ি মজুর খাটবর জন্যে সেধে বেড়ানো। আর সেই অনশনের বিপদে ভরা দুঃসহ দিন। লাফিয়ে উঠল ছকুলাল। অতনের মা!

তুফানী নিঃশব্দে হাতে তুলে দিয়েছে একতারা। তুফানীর হাসিমুখ। দুঃখের আঁধারে একটুকরো আলোর দীপ। শুকনো ঝুলেপড়া স্তনের বোঁটায় বাচ্চাটার মুখ লাগিয়ে দাওয়ায় খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে বসে তুফানী হাসছে।

লক্ষ্মীরাণী তুফানী। অভাব ছিল, ছিল না মনের জ্বালা। পাথর মেয়ে সাতদিন উপোসেও তেতে উঠবে না একটু। কী দুঃখ! দুদিন উপোস সেই সোনার পউষে—তুফানী বলেছিল, বাবার ঘরে ধান উঠেছে, চাট্টি লিয়ে আসি। বাধা দিয়েছিল ছকুলাল। শ্বশুরের…..।

তুফানী। খালি পেটে বাপের বাড়ি গিয়ে বুঝি গোগ্রাসে গিলল। সেখানে তখন ওলাওঠার বুড়ি ফিরছে আনাচে—কানাচে। সেখানে ঘরে ঘরে হাহাকার সোনার পউষে। মাথায় ধানের বস্তা আর কোলে বাচ্চা নিয়ে ভারে নুয়ে নুয়ে ফিরে আসার কথা তুফানীর। আর এই রূপখানি দেখতে, বোঝার ভার হালকা করতে ছকুলাল দাঁড়িয়েছিল গিয়ে পূর্বমাঠের খালের ধারে। তুফানী এল না। এল অভিলাষ। তুফানীর ছোট ভাই। আর কী সংবাদ! তুফানীর কাল হয়েছে গো!

ওলাঙ্গিনী, তুমি তুফানীকে দেখছ? দেখ, চোখ থাকলে দেখ।

আর সুবাসলতা? তার কথাও বলি।

বিলের মধ্যে গ্রাম কুসুমপুর। তিরিশ ঘর কুনাই—এর গ্রাম। মেয়ের নাম সুবাসলতা। আহা রূপ! ঢলঢল যৌবন, সদ্য টলমল পূর্ণিমার চাঁদ। ভাগ্য ছকুলালের। সুবাসলতার কাঁচা বয়স। বারো থেকে তেরো বৈ নয়। মা নেই বাপ নেই, ঠাকুমার কাছে মানুষ। যোগীবরই কৃপা করে ঘটকালি করল। স্যাঙার বর ছকুলাল আর ‘বিইলে’ মেয়ে সুবাস। হলে কী হবে! যোগীবরের শ্বশুরবাড়ি কুসুমপুর। ওর শালা—সম্বন্ধী সে—গাঁয়ের মাতব্বর। বুড়িকে পটিয়ে ঠিকঠাক করে দিল সম্বন্ধ।

—আখুরাজার নাম শোননি চণ্ডালিকের? তেনার সন্তান শংকরীবাবু। তেনার আশ্রয়ে মানুষ ছকু। অভাবটা কী বাছা!

এসব অনেক বানিয়ে বলতে হয় স্যাঙা—বিয়ের ব্যাপারে। কিন্তু হঠাৎ বেঁকে বসল বুড়ি। —তা হলে তুমার আজাবাবুকে বলো সোনার গয়না ক’ভরি দেবে?

ঘাবড়ে গেল পাত্রপক্ষ। যুক্তি—শলা চলতে লাগল। —ঠিক আছে। সি বেবস্তাও হবে।

আড়ালে ছকুলালকে ডেকে নিয়ে গেল যোগীবর। —শোনো গো ছকু, কাছে এসো। কথা বলি এট্টা। বেপার বুঝেছ তো?

মাথা নাড়ল ছকুলাল বিষণ্ণ মুখে।

—তুমার মায়ের তো গয়না ছিল বাছা! সিগুলান আছে, না খেয়ে ফেলেছ?

—না গো, সি কথা আর শুধাও কেনে। সি এক দুঃখুর বিত্যেন্ত। ওই দুঃখুতে মায়ের মাথা খারাপ। আজাবাবু সব জোর করে কেড়ে লিয়েছিলো গো দুপুর আত্তিরে এসে। অ্যাদ্দিন কাকেও তো নজ্জায় বলা হয়নি সি সম্বাদ!

সন্ধ্যা নামছে তখন। ঝোপে—ঝাড়ে শেয়ালের মুখ। বাড়ির আনাচে—কানাচে এসে ডাকছে। বাঁদর—লাঠির গায়ে হলুদ ফুলে জমেছে সন্ধ্যার ছায়া। ঘন বাঁশবনের ভিতর ডোবা থেকে আসা হাঁসের চিৎকার। শেয়ালে তাড়া করেছে বুঝি। মেয়েদের ছুটোছুটি, হইচই হাঁকডাক। উঁচু উঁচু ঢিবির ওপর বসতির নীচে পথের দুপাশে খাল আর ব্যানার জঙ্গল। খরগোস ছুটে পালায় পায়ের ফাঁকে। সজনের ডালে লম্বা লেজ নাচাচ্ছে কী একটা পাখি। সরমহীনা মেয়েরা ওদের সুমুখেই একটু তফাতে—তফাতে পথের ধারে ঘাসের মধ্যে বসে পড়েছে একে একে। কুৎসিত গন্ধের উৎটির টের যায় এতক্ষণে। নাকে কাপড় দিয়ে যোগীবর টানে ছকুলালকে।

—সার এস বাছা। জংলা দ্যাশের কাণ্ডখান দেখছো!

হঠাৎ মনে এল ছকুলালের। কাজলকে বললে কি দু’এক মাসের জন্যে ধার দেবে না কিছু গয়না? এমন তো হয়েই থাকে। ধার করা গয়নার বিয়ে চালিয়ে নিতে হয়। তারপর বউ ঘরে গেলে সংসারে মন বসলে সব খুলে বলে রেহাই পাওয়া যায়। হয়তো খানিক মতান্তর, ঝগড়াঝাটি, খানিক কান্নাকাটি। আবার থেমে যায় সব। ছাড়াছাড়ি কদাচিৎ হয়। হলে সেখানে কারণটা গভীর কিছু।

অনেক গয়না কাজলের। কলকাতা থেকে ফিরল ছকুলাল। আনন্দে বিহ্বল হয়ে ফিরল। কাজল দিয়েছে কানের পাশা, গলায় চেন লকেটহার, ব্রোঞ্জের সোনা—মোড়া চুরি। আর দিয়েছে রুপোর গয়না। কোমরের বিছে, হাতের বাজু, পায়ের মল। রুপোরগুলো দাদার স্যাঙার যৌতুক। অবশ্যি সহজে দেয়নি। স্যাঙের জন্যে খানিক বকুনিও দিয়েছে দাদাকে। বংশ রাখবার মতো সম্পদ আছে ছকুলালের। রতনের মুখ চেয়ে কী দরকার ছিল আবার এসব ঝঞ্ঝাটের? বুঝিয়ে শান্ত করেছে ছকুলাল—জীবনে বেঁচে থেকে সুখী হওয়ার সাধ আর বয়স কি হারিয়েছে সে? তার ওপর, একা থাকার কী জ্বালা কাজল কেন তা বুঝতে পারছে না! একা হলে পৃথিবী যে শূন্য হয়ে ওঠে ছকুলালের কাছে।

সেই গয়না পরে সোনাজ্বলা অঙ্গে ঘরে এল সুবাসলতা। আর গয়নার রহস্য টের পেল কদিন পরেই। খুলে রেখে দিল একে একে।

—তা রূপেরগুলান তোমার লেয্য জিনিস। পরনা কেনে উগুলান!

পরল না। ছকুলাল বাড়িতে নেই। পালাল এক কাপড়ে। আর ফিরল না চণ্ডালিকা!

মাত্তর বিশবাইশ রাত্তির অষ্টমঙ্গলা সুদ্ধ। তবু কত সুবাস তার অঙ্গে! কত মধু তার চলন—বলনে! আনাড়ী মেয়ে সংসারের ঘেরাটোপে পড়ে বেমানান। কিন্তু গাছে চড়তে, শাক তুলতে আর খালেবিলে গর্তে হাত পুরে কাঁকড়া ধরতে ওস্তাদিনী। উনুন ধরিয়ে ধোঁয়ার জ্বালায় চোখ জ্বলছে বলে কাঁদত। অকারণ চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করত! আর একটিবার রায়দিঘির জলে নামলে ওঠার নাম নেই। হাঁসের মতো ডুবছে তো ডুবছেই। কোঁচড় ভরে গুগলি তুলছে। অবেলায় বাড়ি এসে সেগুলো থরে থিরে জ্বলন্ত ঘুঁটেয় সাজিয়ে গোগ্রাসে গিলত বসে বসে। নুন লংকার চাটনি মধ্যে মধ্যে আঙুলের ডগায় তুলে জিভে ঠেকাত আর টুক টুক শব্দ তুলত জিভে। লোকে বলত বউটা যেন সাঁওতাল!

পালাল সুবাসলতা। কালনাগিনীর দংশনে মুখে ফেনা উঠে ম’ল কুসুমপুরের বিলে।

এবার আদর বউকে দেখ ওলাঙ্গিনী। যদি চোখ থাকে, প্রাণভরে দেখ। সব পাপ পুড়ে যাবে পুণ্যের আগুনে।

আদরিণী গরবিনী অভিমানিনী।

গান বেঁধেছিল ছকুলাল :

 রাজার ঘরের আদরিণী গরবিনী ছিলেমে সই।

 মাঠের কাঠকুড়োনি লই।

কান্নার মেঘ একখানা। কথায় কথায় ফুলে ফুলে কান্না। হাইরোডের ওধারে সোনাডাঙ্গার মেয়ে। পাশের গ্রাম। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে বাপ দীননাথ কুনাই জাত দিয়ে হল দীন মহম্মদ। চমকে উঠল দেশ দেশান্তরে কুনাইকুল। ঘেন্নায় ভুরু কুঁচকে তাকাল হিন্দু সমাজ। দীন মহম্মদ ভিক্ষে মেগে খায় দেশান্তরে। এদিকে ছেলেমেয়ে আর অভাগিনী বউ ফিরছে বাড়িবাড়ি হা অন্ন। সোনাডাঙার মুসলমানেরা বিস্তর লোভ দেখায়। ওদিকে হিন্দুপাড়ায় মাত্র ক’ঘর কুনই আর বাগদি। তারা লাঠি তোলে অনবরত। চেঁচিয়ে ওঠে আদরের মা—তুই যদি গেলি আমাকে ফেলে গেলি কেনে রে লরক খেকো? তারপর সেও একদিন গলায় দড়ি দিয়ে মরল। তিনবছরের দুধের বাচ্চা ভাইকে কোলে নিয়ে আদরিণী মামার বাড়ি যেতে চেয়েছিল। মামাও ঠাঁই দেয়নি তাকে।

তখন অত কাঁদত আদর? ছিল এত অভিমান, এত চোখের জল? সে এত অন্য মেয়ে। ধমক খেলে চাইত নির্বাক। আঘাত পেলে বসে থাকত চুপচাপ। শুধু থাপ্পড় খেত বাচ্চাটা। একদিন সেটা দুধের অভাবে তিলেতিলে শুকিয়ে মরে গেল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখে আদর, একটা হিমশীতল টুকরো বুকে এঁটে আছে মরা কাঁকড়ার মতো।

নিষ্ঠুর মামা। সংবাদ রাখেনি কেউ। হয়তো তখন নিজের সংসারে তার উনুনের ছাই। তবু আদর বেড়ে উঠল লোকের বাড়িবাড়ি এঁটোকাঁটা খেয়ে। কুনাইকুড়রের মেয়ের ভাগ্যে এই তো চলেছে আবহমানকাল ধরে।

জুটল ছকুলালের ভাগ্যে। সুবাসলতার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। সোনাডাঙ্গার মুসলমানেরাই ঘটিয়ে দিল কৃপা করে। ওখানে মুখ বেঁকিয়ে বসে রইল কুনাইকুল, এখানে চণ্ডালিকার সমাজ। বাপ যার জাত দিয়েছে, তার মেয়ে ঘরে আনার অপরাধ বড় সোজা নয়। কিন্তু ছকুলালের ধরনই আলাদা। ও তো ভেকধারী বোরেগী। আর এ ঘটনা থেকেই চণ্ডালিকার কুনাই সমাজের সঙ্গে একটা অস্পষ্ট হিজিবিজি ভেদ চলেই আসছে তার।

আষাঢ় মাস। দিগন্তে একটুকরো মেঘ দেখলে গ্রামগ্রামান্তরের চাষিরা দৌড়ে বেরোয় মাঠে। হেই বাবা দেবরাজ, এট্টু কিরপা করো বাবা। সোনার রাজ্যি রসাতলে যায় আবার। মাঠে মাঠে মুসলমানেরা বৃষ্টির জন্যে নমাজ পড়ছে। উচ্চকণ্ঠে কেঁদে কেঁদে দরবার করছে আল্লাতালার কাছে। বউ আনতে আনতে শুনল ছকুলাল একসঙ্গে কয়েকশো লোকের সার বেঁধে দাঁড়িয়ে হিপিয়ে হিপিয়ে কান্না। কান্নার ঝড়, কান্নার সমুদ্দুর। তার পাশ দিয়ে পথ চলতে ছকুলালও কি এড়িয়ে যেতে পারে? থমকে দাঁড়িয়েছিল।

মুখ খুলেছিল আদর বউ—অত কাঁদছে কী জন্যে গো? আহা!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ছকুলাল।—বিষ্টির জন্যে। আবার আকাল লাগবে দ্যাশে।

—আকাল!

পলকে আর্তনাদ করে ওঠে আদর বউ। অনেক বছর আগের রক্তাক্ত স্মৃতিতে ভরা দুঃসময়টা আকাশজ্বলা রোদ্দুরে কাঁপছে এসে একঝাঁক শকুনের মতো। আর ছকুলালও মুখ বুজে থাকতে পারে না। ঘুরে দাঁড়ায় দুহাত জোড় করে সূর্যের মুখোমুখি—বিষ্টি দ্যাও, বিষ্টি, দ্যাও ভগমান! আমার অক্তের দোহাই তুমাকে এট্টু বিষ্টি দাও! তারপর এগিয়ে যেতে যেতে বলে—আদর বউ!

—বুলো।

—তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চলো। যেয়ে আবার রান্না চাপাতে হবে।

একটু থামে কথা। আবার বলে ছকুলাল—তুমি রান্না জানো আদর বউ?

—জানি। এতকাল তো নিজে হাতেই আন্না করে এলাম।

—কার জন্যে? তামাসার ভঙ্গিতে শুধোয় ছকুলাল।

—নিজের পেটের জন্যে আর কার জন্যে বুলো?

—তুমার ডর লাগতো না আদর?

—কেনে?

—এতকাল একলা ছিলা। ডর ভয় ছিল না তুমার?

—কীসের ভয়!

একমুহূর্ত ইতস্তত করে ছকুলাল। তারপর বলে, ধরো, তুমার জেবনের। এই বয়েস….

—ডর ভয় ছিল না আবার! কিন্তুক উপায় কী বলো;

—শুতে কার কাছে?

অবাক হয় আদর। খানিক চুপ করে থাকে। তারপর বলে—সুনন্দাপিসির কাছে। সত্যি বলতে গেলে পিসি না থাকলে আমিও মরে যেতাম গো। বেড়ালবাচ্চার মতো আগলে রাখতো পিসি। অক্তের কোনো সম্পর্ক নাই, একেবারে পর। তবু আমাকে দেখাশোনা করত। লোকে রটাত কূটনীগিরি করে পেট চালায়। আদরকীকে লিয়ে বেবসা পেতেছে। এই তো মা বসুমতীকে চরণ এখেছি—ওপরে জাগ্যত সূয্যিদেব আর পাশে তুমি…….ঢোক গিলে বলে আদর—অনেক ঝড় বয়েছে গো, অনেক কঠিন দিন। ভগমানের ইচ্ছেয় কোনো ক্ষেতি হয়নি আমার। নিত্যি সকালে পিসি উঠোনময় একরাশ মাটির ঢেলা কুড়িয়ে ফেলত, সারা রাত্তির ছোঁড়ারা এসে ঢিল ছুঁড়ত। এত অত্যেচার!

একটু থেকে আবার বলে—সুনন্দাপিসি রাঁড়ি। যৈবনে সোয়ামীর কাল হয়েছে। স্যাঙা করেনি আর। মাঠে ঘাটে শাকঘুঁটে কুড়িয়ে ওজগার। জানো গো, পিসির একটা আমড়া গাছ আছে। আমড়া হয় এই এত এত মোটা। কী মিষ্টি পাকলে! পেয়ারা গাছ আছে। এই এমনি এমনি পেয়ারা ধরে। সব বেচে দেয় পিসি। তরিতরকারিও লাগায় বর্ষায়। অনেক…

ঘরে ঢুকেই চাবিটা হাতে তুলে দেয় ছকুলাল। —এই তুমার ঘর। এই তুমার সংসার। দেখেশুনে লাও। (আহা ঘর, আহা সংসার! ওলাঙ্গিনী, তুর অনেক জন্ম কাটবে আদরকীর রক্ত দেহে আসতে।) তা সেই সংসার পাতল আদর বউ। আর বদলে গেল আস্তে আস্তে। রোদ বৃষ্টি খাওয়া শুকনো গাছে রং লাগল। সবুজ হল পত্রপল্লব। পুষ্ট হল ফুলে ফুলে ডাগর তরু। তখন চোখে আসে অকারণ কান্নার নদী। উথাল পাথাল কান্না। কথায় কথায় অভিমান। ছকুলাল বিব্রত।

বলে সুদামসখীর মা—রাগছো কেনে বাছা ছকু? এমন দিনেই তো কান্নার হাট বসাবে গো বউ। চোখের জল মুছিয়ে দেবার মানুষ পেয়েছে আজ। আজ তো কাঁদবেই জাদু। অ্যাদ্দিনের সকল দুঃখ পাথর ভেঙে ধারা বইয়ে দেবে মাণিক। রাগলে চলবে না। আমরা মেয়ে বটি। মেয়ের মন আমরা বুজি।

মাথা নাড়ত ছকুলাল। হয়তো তাই।

জমাট তুষারে লেগেছে উত্তাপ। গলেছে নদী। এবার সুরস হবে জীবনের কুল। ফল ফলবে অপ্রমেয় শস্যরাশি সেই উদ্দাম রসের সঞ্জীবনে। বন্ধ্যা মাটি হবে ফুলবতী ফলবতী।

ফর ধরল আদরকীর। ছকুলালের সন্তান গর্ভে ধরল সে। মা হওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বাসে নুয়ে নুয়ে পড়তে লাগল সবসময়।

তারপর?…..

চিরকালের সেই অপঘাতী মৃত্যু কখন পা টিপে টিপে পিছনে এসে দাঁড়াল আলোয় সংসার অন্ধকার করল।

ট্টি—ট্টি—ট্টি—

টিট্টিভের ডাক ঘননীল কুয়াশার কোন প্রান্তে।

চমক ভাঙে ছকুলালের। পালিমলিন ঘাসের নীচে নরম মাটি। কী একটা পোকা পা বেয়ে উঠতে চায়। শরবনের ফাঁকে সেই মরা হিজলের গাছটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। একটি দূরান্তর সময়ের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে সে বাঁচতে চেয়েছিল। বাঁচেনি। ওই গাছে তার বাপ নাথুলালকে পেয়েছিলেন রাজা রাখহরি রায় ‘সাত সালের’ বন্যায়। কোথা হতে ভেসে এসেছিল তার পূর্বপুরুষ?

দূর বিলের প্রান্তে একটা হাউই উঠে নিভে যায়। পথ ভুল করেছে ছকুলাল। কোথায় সেই শ্যাওড়া গাছ, কোথায় জোড়পাহাড়ের জলার ধার! দিশা লেগে কতক্ষণ ধরে ঘুরছে সে? এত শীত একটুও টের পায়নি শরীরে। নাটাজঙ্গলে বাচ্চা ছেলের কান্নার মতো ডাক। পাখির ডাক।

কাঁদছিল কিংবা কান্নার ভান করছিল সে। তাই চোখ মুছতে গিয়ে একটু হেসে ফেলল হঠাৎ। তারপর নালার জলে নেমে হাত মুখ ধুয়ে উঠে এল। বিড়ি ধরাল একটা। বগলে কাপড়ের বান্ডিলটা মায়ের কোলে ছেলের মতো জড়িয়ে আছে এখনও। পড়ে যায়নি কোথাও। নালার ধারে ধারে চলল ছকুলাল। নালাটা যেখানে বিলের সঙ্গে মিশেছে সেখানে জল বেশ পরিষ্কার। কোনো জঙ্গল নেই। তারপর শক্ত করে গিঁট দিয়ে নিশ্বাস রুখে ছুঁড়ে মারল গভীর জল লক্ষ্য করে। জলে শব্দ। কুয়াশার ঘোমটা ফাঁক করে তীক্ষ্ন চোখে চেয়ে আছে শীতের ডাইনি। অন্ধকারে বুকের ভিতর থেকে হৃৎপিণ্ডটা খুলে ছুঁড়ে দিয়েছে ছকুলাল।

পেঁচার ডাক কাছে। তাহলে ওই শ্যাওড়া গাছ। কাল আর নবান্ন খেতে যাচ্ছে না সে। আটার ডেলা তার পেটে কোনোদিন সয় না।

পৌষের মাঝামাঝি হয়ে যায়। কাজল তখনও আসে না।

আসে মা শীতলা। লোকে বলে বীভৎস এক থুত্থুড়ে বুড়ি সে। অঙ্গময় চোখ। যেদিকে সে তাকায়, মানুষের দেহ পচে খসে কদাকার হয়ে ওঠে। প্রথমে কুনাইপড়ায়, তারপর আস্তে আস্তে দুপাশে হাত বাড়ায় সেই অদৃশ্য ভয়ংকরী। সারাটা রাত্তির দল বেঁধে টহল দেয় এপাড়ায় মুসলমানেরা, ওপাড়ায় হিন্দুরা। অদ্ভুতদর্শন সব ফকির এসে জোটে কোত্থেকে। ‘জিকির’ হাঁকে উচ্চনাদে। গ্রামের পাড়ায় অলিগলি বিকৃতকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে, ইয়া রব, উতরেল হয়, বল হরি, হরিবোল! স্থবির রাতের হৃৎপিণ্ড ঝনঝনিয়ে ওঠে।

কাছের মাঠে ধানে নেই বলে জাগালেরা কুঁড়ে সরিয়ে এনেছে পীরপুকুরের কাছ ঘেঁসে। সারা রাত্তির দুরু দুরু বুকে তারা শোনে চার পাশের গ্রাম থেকে উদ্দাম ভয়াবহ আর্তরোল। সবচেয়ে বেশি শোনা যায় আজানের শব্দ। একদিগন্তে সে সুর না মেলাতে অন্যদিগন্তে আবার। কানে হাত ঢাকে তারা। সবচেয়ে ভয় পাইয়ে দেয় বায়তুল্লা। প্রবল পরাক্রমে গলা ফাটিয়ে সে চেঁচিয়ে ওঠে বারবার—আল্লোহো আকবর! ঘন ঘন পীরপুকুরে নেমে অজু করে আসে আর অবিশ্রাম নমাজ পড়ে চলে।

একদিন শোনা যায় স্টেশন থেকে চণ্ডালিকা আসার কাঁচা সড়কে হাঁক—ইয়া পীর মুশকিল আসান! ব্যাকুল হয়ে ওঠে যোগীবর। —ওহে বঁধু, ইবার বড়ো উত্তুম সম্বাদ। উনি এসে যেয়েছে। আর ভয় নাই। ডাকো, ডাকো হে উয়াকে! ও ছকু, ডাক বাবা! প্রচণ্ড ছটফট করে যোগীবর।

বায়তুল্লা সবিস্ময়ে তাকায়। ফরাজি মুসলমান। পীরফকিরে বিশ্বাস নেই তার। একমাত্র চেনে দীনের নবী মহম্মদ আর খোদাতালা। শেষ বিশ্বাস ডাক্তার বাবুকে।

বলে যোগীবর—ফি বছর বেয়াধি লাগলে উনি এসে সামলে দেয় বঁধু! আজন্ম দেখে আসছি।

তখনকার মতো ডাকে না কেউ। কিন্তু তাকে সকালে দেখা যায় মাঠে। লম্বা গেরুয়া জামা, গেরুয়া লুঙ্গি। মাথায় লাল পাগড়ির মধ্যে আরবি টুপি। গলায় অঢেল রঙিন পাথরের মালা। হাতে চিত্রবিচিত্র ময়ূরমুখো লাঠি, এসে বলে—ইয়া মালিক, মুশকিল আসান!

যোগীবর হাত জোড় করে বেরোয়—আসতে আজ্ঞা হোক বাবা। বসতে আজ্ঞা হোক।

তীক্ষ্নচোখে তাকায় বায়তুল্লা। বলে,—পেয়োজন?

ম্লান হাসি ফকিরের মুখে। রাঙা চোখে প্রশান্ত বরাভয়। বলে,—বালাবেমারিকা ওয়াস্তে বেটা।

চোখ পাকায় বায়তুল্লা। —অস্তেফস্তে বুজিনা। গেরাম ছেড়ে মাঠে ক্যানে; পষ্ট কথা কহো। ধান মাংতা?

—নেহি বেটা। লেকিন আপনা হাত সে খুশীসে দেখা তো………..

এগিয়ে আসে ফকির। আবার বলে—হাম আয়া বেমারিকালিয়ে আপলোককা ভালা করনে!

—ভালা করবে তো ইত্থেনে কেনে ধোন! গাঁয়ে যাও। ইত্থেনে তো কারু ব্যামো নাই। বায়তুল্লার কাণ্ড দেখে অবাক সকলে। স্পর্ধা দেখে স্তম্ভিত হয়েছে যোগীবর। ফিসফিস করে কী বলতে চায়। কাশি এসে পণ্ড করে দেয় সব। আঙুলে খোঁচা মারে বায়তুল্লার পিঠে। বায়তুল্লা চেঁচিয়ে ওঠে—কী খোঁচাখুচি কর হে বধুঁ? বেপারটা এট্টু বুজতে দাও না।

—তুম বহুত গোঁসা হয়েছে বেটা। দোওয়া দেতা হ্যায়—

বায়তুলা সাফ জবাব। —ধান নাই!

—মুশকিল আসান হোগা বেটা।

লাফিয়ে ওঠে বায়তুল্লা। —লাঠিখান দেখি হে বঁধু উয়ার মুশকিল আসানের গুষ্টিকে বেচে দিই বেলডাঙায় হাটে।

গোমড়া মুখে সরে যায় ফকির। বিড়বিড় করে কী বলতে বলতে যায়। বার বার পেছন ফিরে দেখে। যোগীবর ব্যাকুল। —কাজটা অন্যায় হল বঁধু বড় অন্যায়। বেষম অকম্ম!

বায়তুল্লা দাড়ির ফাঁকে কলকণ্ঠ হাসে। বলে—ই কি দেখলে বঁধু! অমন কতো ফিকিরওলা ফকির আমাকে বাপ বলে পথ দেখেছে। সিবার আবার বড় ভাইঝিটার বিত্যেন্ত শোন। বাঁজা মেয়ে বলে পুরুষে ভাত দেয় না তাকে। এল বাপের বাড়ি। একদিন দেখি ঘরে খিল এঁটে এক ফকির সাহেব তাকে লিয়ে বসে আছে। বাইরে বাড়ির লোকেরা গুজ গুজ করছে বসে। বেপারটা কী? না, ছেলা হওয়ার জন্যে ফাঁড়া কাটা হচ্ছে। আর যাবা কতি, লাথিয়ে খিল ভেঙে শালো ফকিরে ছাকে দ্দে মার। শালো শয়তানের বাচ্চা, পাশকরা ডাক্তোরে যে ব্যাধি নীরোগ কত্তে পাল্লে না, তুমি করবা ঘরে খিল তুলে?

যোগীবর রেগে যায়। —উ সব মিথ্যে বলতে চাও?

—একশো বার।

লাফিয়ে ওঠে যোগীবর—এমন বেয়াধিটি আছে, শালার ডাক্তোরদের বাবার সাধ্যি নাই নীরোগ করে।

—লিচ্চয় করবে। বায়তুল্লাও মাটিতে কিল মারে।

তর্ক থেকে বচসা। তারপর প্রায় মারামারির উপক্রম। দুই বঁধুকে শান্ত করে ছকুলাল আর জাম্ভু। হাপরের মতো ওঠে নামে যোগীবরের বুক। —বয়েসে উর বাপের তুল্যি, আমার জ্ঞানটা বেশি লয়, উর বেশি! শ্লেষ্মায় মুখ বুক একাকার। কাপড়ে হেঁট হয়ে মোছে সে।

বায়তুল্লা ঘাটে নেমেছে। শোনা যাচ্ছে তার মৃদু কোরাণ উচ্চারণ।

হাঁপাতে হাঁপাতে বলে যোগীবর—তু তো জানিস বাছা ছকু। পলাশ গাঁ—র খান থেকে মাদুলি এনেছিলাম। উতেই হাঁপের বেধিটা কেমন শান্ত ছোস্ত হল। আর উ বুলবে ইয়াতে কিছু হয় না উয়াতে কিছু হয় না। হয় উর ঢিপঢিপ মাথা ঠোকতে!

বড় ভাবনা ছকুলালের। বাড়ি যাওয়া সেইরাত্তির থেকে বন্ধ। পরদিন অবশ্য নবান্নের ডাক এসেছিল। ছলছুতো করে এড়িয়ে গেছে সে। অবশেষে ওলাঙ্গিনী নবান্নের খাদ্য বয়ে এনেছিল মাঠে। ছোঁয়নি ছকুলাল। সবটা সাবাড় করেছিল পেটুক জাম্ভু। তারপরও মাঝে মাঝে এসেছে ওলাঙ্গিনী। ধানকুড়োতে যাওয়াতে পথে দেখা দিয়ে গেছে খানিক। খবর দিয়েছে পাড়ায় ঘরের। বলেছে, মাঠে থাকো সিটাই ভালো। শান্তি হলে যেয়ো।

—তা বটেই তো।

—সইয়ের মা’র হয়েছে গো।

—ও।

এমনি করে ওলাঙ্গিনী চলে যায়। মিলিয়ে যায় দূর মাঠের প্রান্তে। আস্তে আস্তে বেলা বাড়ে। সূর্য ঢলে পড়ে পশ্চিমে। তখন একদিন বলে ছকুলাল—একবার গাঁ থেকে আসি গো যোগীকা।

শশব্যস্ত বাধা দেয় যোগীবর—না, না। উটী করো না বাছা। কী পেয়োজন; আমরা আছি। তুমি যাবা কী জন্যে? আমার বাড়িতে তিনটের হয়েছে। তাও তো আমি যাইনে।

বড় নিষ্ঠুর লোকটা। এত মৃত্যুভয়! সমর্থনের জন্যে সে তাকায় বায়তুল্লার দিকে। বায়তুল্লা বলে। —টিকে লিয়েছে?

—সেই ছেলেবেলায়।

—তবে যাওয়া ঠিক লয়।

যোগীবর খুশি হয়। সেদিন থেকে বায়তুল্লার সঙ্গে কথা বন্ধ করে তার। কথা বললে দুজনের ভঙ্গিটা বড় হাস্যকর। করুক খাক যাক ইত্যাদি কায়দায় কথা বলে। জাম্ভু জনান্তিকে বলে, আলকাপের সঙে মাগ—বরদের ঝগড়ার কেচ্ছা আছে অমনি। বউ বলে, চান করে আসুক, স্বামী বলে, তেল দিক—

মরিয়া হয় ছকুলাল। —বিশেষ পেয়োজন বাছা। ভগ্নীটা আসার কথা। এট্টু, বারণ করা উচিত কিনা বুলো। অন্য কউ হলে কথা ছিল কাজল। সে কিনা কলকাতার মেয়ে। তার মান রাখতেস হয়।

অগত্যা মত দেয় জাগলেরা। ছকুলাল পথেই দীনুকে দেখতে পায়। ওকে সঙ্গে নিয়ে স্টেশনে যায়। ডাকঘরে পোস্টকার্ড কিনে চিঠি লিখে দেয় দীনু। মোটা মোটা হরফে লেখে: শ্রীমতী কজল বালা দাসী। কেয়ার অফ শ্রীযুক্ত বাবু বংশীবদন মুখোপাধ্যায়। ১৭/২/৩ এ হরি বসু লেন, কলিকাতা।

পোস্টমাস্টার চশমা কপালে তুলে শুধোয়—অসুখের অবস্থা কী রকম? কমেছে?

—না মাস্টারমশাই। তেমনি আজ্ঞে।

ফিরে যেতে যেতে শোনে বিকেলের গাড়ির বাঁশি। একটা বিরাটকায় রক্তবর্ণ গিরগিটি কাঁটাবনে ঢুকছে যেন। হঠাৎ রেল গাড়িটার শব্দে ভয় পায় ছকুলাল। ভীষণ বুক ধড়ফড় করে তার। সারা পথ ওই ভয় ক্রমশ তাকে কাবু করে তোলে। কেন এমন হল, সে বুঝতে পারে না।

গাঁয়ে ঢুকে বলে ছকুলাল—বাবা দীনুপদ, এট্টু পাখথনা।

—বলো।

—আজি রাত্তিরটা গাঁয়ে থাকবো মোন বলছে। শরীল বড় অচল হচ্ছে দিনেদিনে। মাথাধরা আর জ্বর জ্বর ভাব। দীনু তার অবাধ্য হতে পারে না। তবু বলে—কিন্তুক বুজে দেখো মামা। গাঁয়ে বেপার তো ভাল লয়।

—বুজে দেখেছি বাবা দীনুপদ।

কোনো কথা বলেন না দীনু। এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। চেঁচিয়ে বলে ছকুলাল—আমি তুর দিদিকে সম্বাদ দিছি গো ভাগ্নে!

চেঁচিয়ে জবাব দেয় দীনু—পেয়োজন নাই।

হাসে ছকুলাল। ছেলেটা নিকামী দরদি! শুধু গান নিয়েই আছে। মঙ্গলা ছিল বলেই রক্ষে।

মঙ্গলার বাড়ি ঢোকে ছকুলাল। —কী কচ্ছিস রে জননী?

দীনুর দিদি মঙ্গলা সবে লম্ফ জ্বালছিল। বেরিয়ে আসে শশব্যস্ত—গায়েন মামা নাকিন গো? মাঠ থেকে হঠাৎ গাঁয়ে কেনে মামা?

—এলাম বাছা। গাঁয়ে ঘরে বিপদ শুনে মোন কি মানে রে জাদু? সম্বাদ লিতে এলাম।

ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে ছকুলাল।

মঙ্গলা তালপাতার আসন এগিয়ে দেয়। বলে—উঠে বসো মামা।

উঠে আসনে বসে ছকুলাল। বলে, তারপরে বিত্যেন্ত বুলো দিকিন।

—আর কী বুলব মামা। ঘরে ঘরে নেগেছে। পিতিদিন দুচারটে করে চলে যেছে। আমারই দুটোকে পরশু থেকে ধরেছে। মা হয়ে যন্তনা চোখে দেকা যায় না মামা। মা শেতলা, আমি হতচ্ছাড়ী ছারকপালী থাকতে জাদুদের কেনে মা! কেঁদে ওঠে মঙ্গলা।

বিব্রত ছকুলাল। এসব অবস্থা কোনোদিনই সে সইতে পারে না। এই দুঃখ এই নিরানন্দ ক্লান্তিকর বিশ্রীসময়গুলো থেকে চিরদিনই সরে থাকতে চায় দূরে। তাই উঠে পড়ে।

বলে মঙ্গলা—বলাতো উচিত লয়। কিন্তুক চাট্টি ভাত খাও মামা। দীনু একটা শোলমাছ ধরেছিল দিঘিতে। ঝোল আন্না করেছি টক দিয়ে। অ্যানেক দিন বাদে গাঁয়ে এলা। মামি তো বুঝি মাঠে মাঠেই ঘুরছে, আন্না করে দেয়ই বা কে। বেটাছেলের হাতের মাঠের আন্না—

দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে ছকুলাল।

—শরীল কেমন ঠেকছে মামা? আহা, নামুনে সুঁদিপুরওলা যেমন বেপারটা কল্লে তেমনি উদের গাঁয়ের খুব লেগেছে মামা। পোচণ্ড। নেত্য বলছিল, উর মা আসছে কাল ইখেনে। মায়ের ভর তুলবে।

শিউরে ওঠে ছকুলাল। বিন্দুবাসিনী কেমন আছে তবে? আবার বসে পড়ে সে।

—দে ভাগনী, তুর ইচ্ছে যখন হয়েছে, দে চাট্টি ভাত।

টক দেওয়া শোল মাছের ঝোল। অনেকদিন ভালো তরকারির স্বাদ পায়নি সে। ওলাঙ্গিনী! তুর সোয়ামীকে এক বেলাও কি চাট্টি রান্না করে খাওয়ানোর কথা জাগে না মনে? করলামই বা বারণ!

পরম তৃপ্তিতে ভোজন সাঙ্গ করে ছকুলাল। তারপরে বলে—কইরে মুংলী দেখি তুর পুতগুলান। ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে ছকুলাল। ঝুঁকে পড়ে লম্ফ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। দুটো ক্ষতবিক্ষত শিশুদেহে শেতলার বিষাক্ত নখের চিহ্ন। শিউরে ওঠে সে। চেয়ে থাকতে পারে না। ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে। উঠে এসে আবার দাওয়ায় বসে থাকে।

পোড়াচোখে সাত সন্ধেয় ঘুম কেনে গো!

পশ্চিমমাঠের রোদ্দুরে বাতাসে হিমে যে অমূল্য ঘুমকে নিঃশেষে নাশ করেছে, তা বুঝি আবার বেঁচে উঠল গাঁয়ের মাটিতে এসে। নারীর কল্যাণ আর সদিচ্ছার আবরণে ঘেরা এই ঘরকন্নার মধ্যে যেন জেগে উঠেছে তারই মনের গোপন কামনার স্বপ্নিল মায়া। তাই বুজি ঘুম। ঘুমোয় বসে বসে ছকুলাল গায়েন।

ওলাঙ্গিনী এসে ডাকে একসময়। —বাড়ি এসো।

—কে?

—আমি। বাড়ি এসো গাঁয়ে এসেছ। ভালো করেছ। তা ইখেনে কী কত্তে? ওলাঙ্গিনীর ঝাঁঝালো স্বরে উচ্চকিত ছকুলাল। কিন্তু তার শরীরের জন্যে মায়া আছে ওলাঙ্গিনীর? এই নিষ্ফল বিশ্বাসের মধ্যে ডুবে সুখ আছে কিছু? হাত ধরে টেনেছে ওলাঙ্গিনী। পেছনে পেছনে পুতুলের মতো উঠে যায় ছকুলাল।

—উদের বাড়ি ব্যামো। আর সিখেনে ভালো খেয়ে বসে আছো তুমি? ভাত কখনো দ্যাখোনি চোখে? এট্টু বুদ্দি নাই তুমার?

—নাই তো! শান্তস্বর ছকুলালের।

লম্ফ জ্বালে ওলাঙ্গিনী। দাওয়ায় তালাই বিছিয়ে দিয়ে বলে—আগে ঘাটে হাত পা ভালো করে ধুয়ে এসো। ঘাটে যায় না ছকুলাল। ওলাঙ্গিনীর দিকে মন নেই তার। এখন বড় ঘুম চোখে। ঘুম তাকে মাতাল করে তুলেছে। বলে—আমার খুব তন্দ্রা লেগেছে।

—তন্দ্রা নেগেছে? তো ঘরে শোবে চলো। হাত ধরে ওলাঙ্গিনী।

—এ্যাঁ। চোখে চোখে তাকায় ছকুলাল।

—কী হয়েছে তুমার? নেশা করেছ নাকিন গো? ছি, ছি। জেবনে যা করোনি, তাই কল্লে মাঠে জাগাল হয়? ছি ছি ছি!

বেরিয়ে যায় ওলাঙ্গিনী। তারপর সুদামসখীর বাড়ি থেকে তার গায়ে দেওয়া কাঁথাখান নিয়ে ঘরে ঢোকে। ঢেকে দেয় এক সুন্দর পাথরের পিণ্ডকে। মুখের উপর লম্ফ তুলে যেন কী পরখ করে। —তুমার মুখটা শুঁকে দেখি কী খেয়েছ?

মুখ এগিয়ে নিয়ে যায় ওলাঙ্গিনী। তার নিশ্বাসে গন্ধ। অনেক স্বপ্নের সুবাস সেই নিশ্বাসের গন্ধে এখনো কি খুঁজে পাওয়া যাবে? ছকুলাল পাশ ফিরে শোয়। দেয়ালের গায়ে ঝোলানো শিকের দড়িতে একসার কালো কালো মাছি।

দেখতে দেখতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে ছকুলাল। তখন বাইরে গ্রামের আকাশ মুহুর্মুহু থরথর করে উঠেচে ব্যাধির আতঙ্কে বিহ্বল একদল মানুষের দীর্ণ আর্তনাদে।

 বল হরি, হরি বোল!

 আল্লাহু আকবর!

খোলকরতালের সঙ্গে কীর্তনের পদ। মুসলমান পাড়ায় মোটা গলায় কে গাইছে—

 ইয়ানবী সালাম আলা

 ব্যাধি তু পালা পালা

গয়জদ্দি মণ্ড মনে হচ্ছে। ওলাঙ্গিনী খেতে বসলো দুপা সুমুখে বিছিয়ে।

অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। ছকুলাল উঠেই শোনে পলাশ গাঁয়ের তরঙ্গিনী এসেছে। মা শেতলার ভর হবে পাড়ায়। নেত্যবালার মা তরঙ্গিনী।

হাড়গিলে বুড়ি। জটাজুটে একেবারে ভয়ালদর্শন। সিঁদুরে কপাল রক্তলাল। রায়দিঘির পাড়ে শিবঠাকুরের থানে ভর উঠেছে শেতলা। দাঁতন করতে করতে এগিয়ে যায় ছকুলাল।

ভীড় জমেছে দস্তুরমতো। গ্রাম ঝেঁটিয়ে লোক এসে প্রবল কৌতূহল উঁকি দিচ্ছে চারপাশ থেকে। জটা নেড়ে চেঁচাচ্ছে বুড়ি। অভিশাপ দিচ্চে কাদের আজ সকাল থেকেই গাঁয়ে উনুন যেন বন্ধ থাকে এমত নির্দেশ ছিল তরঙ্গিনীর। মুসলমানপাড়া দিয়ে আসতে বুজি দেখেছিল, সে আদেশ মানেনি কারা। তাই ক্ষেপে গেছে মা শেতলা।

—আর উই যি নামুনে ভেয়েরা উর নিব্বংশ, নিব্বংশ হবে। আমাকে অবগ্যা, আমাকে অপহেল্লা? ধ্বংস হবে, ধ্বংস, ধ্বংস!

ঠোঁটের দুপাশে ফেনা জমেছে। দুলে দুলে অবিশ্রাম বলে চলেছে কত কী! সব বোঝা যায় না।

—আর ই গাঁয়ে যদি পলাশ গেঁয়ে বিটী আনলি আঁটকুড়েরা, কেনে তার অসনমান, কেনে তাকে হেনস্তা, কেনে তাকে অগেরাহ্যি? পলাশ গাঁয়ের তরঙ্গ আমার নিজের লোক। তার আশ্রয়ে আমার বসবাস। তার ভক্তিতে আমি বন্দিবেড়ে পড়ে রইছি। তার বংশগুষ্টি যি যিখানে আছে তাদের যে অসনমান করবে তাকে আমি ধ্বংস করব, নিব্বংশ করব। পলাশ গেঁয়ে বিটির হাত হতে ধানের জুড়ি কেড়ে নেওয়া। এত সাহস, এত পাপ—

একটু থেমে আবার বলে, এত আস্পদ্দা! উই পাপে ঢুকেছি আমি। হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিক বলছিরে হতচ্ছাড়ি, ডাকাবুকো লরকখেকোরা। উই পাপের ছেদ্র দিয়ে প্রবেশ করেছি ই গাঁয়ে।

মুখ চাওয়া চাওয়ি করে সবে। টগর আর এলোকেশী মুচকি হাসে। নেত্যকে দেখা যায় না এখানে। ওলাঙ্গিনী শিউরে উঠে চলে যায়। নেত্যর সঙ্গে ঝগড়া করেছিল সে। নেহাত গায়ে পড়ে ঝগড়া। আসলে পলাশগেঁয়ে মেয়েদের রীতিই এই। যা খুশি বলবে, ইচ্ছে হলে বুকে চড়েও ড্যাডাং ড্যাং নাচবে! সতীন আঁটকুড়ি বেবুশ্যে—

ওলাঙ্গিনী কেঁদে কেটে পাড়া মাথায় করেছিল।

ছকুলাল ফেরে খানিক পরে। মুখ ধুয়ে বলে—বাসি পান্তা আছে নাকিন ঘরে? মাঠে যেতে হবে।

ওলাঙ্গিনী শশব্যস্তে রান্না চাপায়। —শীতকালে পান্তা খায় নাকিন মানুষে? থামো এট্টু। আন্না করে দি।

বলে ছকুলাল—তা মন্দ হয় না। দীনুপদ আর ট্টু থাক না মাঠে।

ভাত নামে উনুন থেকে। বেগুন পোড়া আর মাছ পোড়ার তরকারি। ডাল রাঁধতে দেয় না ছকুলাল।

তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আসে। তারপর খেয়ে দেয়ে উঠোনে বসে বিড়ি ধরিয়ে রোদ্দুর পোহায়। কেন যে শরীরটা বড় অচল ঠেকছে তার। বড় মিষ্টি এই উত্তাপ! কী আরাম এখানে খানি শুয়ে!

খেজুর তালাই বিছিয়ে দেয় ওলাঙ্গিনী। শুয়ে পড়ে ছকুলাল। বলে—মাথাটা বড় ধরে থাকছে কদিন থেকে।

ঠান্ডা লেগেছে বোধ হয়। টিপে দিই।

বাধা দিতে গিয়ে ঠোঁট নড়ে না। চুপ করে থাকে ছকুলাল। বড় আরাম আর অস্পষ্ট একটা যন্ত্রণার মধ্যিখানে তলিয়ে যাচ্ছে সে। হাত পা দুমড়ে কুঁকড়ে মায়ের জঠরে শিশুর মতো একটি অপরিণত অবয়ব।

আজ আর ওলাঙ্গিনী মাঠে যাবে না।

মাঠে দীনুপদ অস্থির। শীতের উদ্দাম বাতাসে ঠোঁট দুটো শুকিয়ে নিরেট হয়ে আছে আর সারা মাঠে ফিরছে চাষিরা থমথমে মুখে উৎকণ্ঠায়। কোনো শব্দ নেই কোথাও। দূরে দেখা যায় নেত্যকে। আঁচল উড়ছে দুরন্ত বাতাসে। জাম্ভু লাঠি থেকে চিবুক তুলে খামাকা চেঁচায়—হেই শালীবিটিরা, সাবধান!

মোটা মোটা দাঁত বের করে দীনুর পানে চেয়ে হাসে সে। দীনু অস্থির। গায়েন মামা কই?

ক’দিন পরে।

অস্ত—সূর্যের লাল আলো পীরপুকুরের গাছের পাতায়। মাঠের বুকে। খানিক পরে রং বদলে কনে—দেখা আলো। পশ্চিম দিগন্তে মেঘের আয়নার মুখ দেখছে সূর্য। একটু করে মেঘ জমেছে গত রাত্তির থেকে। দিনমান চলেছে আলোছায়ায় রাখালি লুকোচুরি।

পাড়ে ধানের ঝুড়ি রেখে জলে নেমেছিল নেত্য। চোখে একটা কুটো ঢুকেছে কীভাবে। একহাঁটে জলে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়ে জলে মুখ ডুবিয়ে রেখেছিল সে। ঠান্ডা জলের ভেতর তাকাতে চেষ্টা করছিল। কুটোটা ঝরে গেলে শান্তি আসবে চোখে।

কুটো ঝরে না। মরিয়া হয়ে বারবার মুখ রাখে জলে। তারপর লাল চোখ দুটো ক’বার পিটপিট করে মুখ তোলে। —নামুনে কুটোটা! গাল দিচ্ছিল সে।

পেছনে কণ্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে নেত্য। —জলে মুখ ঢাকছো কানে গো গুনিনের বিটী? কীসের লাজে গো!

জাম্ভু পায়ের ফাঁকে লাঠিটা রেখে অদ্ভুত ত্রিভঙ্গঠাটে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাৎ করে হাসছে। বড় বড় দাঁতে পানের রং।

জবাব দেয় না নেত্য। আবার জলে মুখ রাখে। ফরসা ঘাড়ের পাশে রুক্ষ চুলগুলো চিকচিক করে শেষ আলোর ছটায়।

—মুখ দেখাতে লজ্জা হচ্ছে নাকি, ও উপবতী কন্যে গো!

জলে মুখ। কথা কানে যায় না হয়তো। একটু পরে মুখ তোলে নেত্য। আঁচলে মুখ মুছে ঝুড়ির দিকে এগোয়। নিজের মনের সঙ্গে যেন কথা বলে—বাবাঃ কুটোটা যেন যমের মতো আটকেছে।

—কুটোয় আঠা দেওয়া আছে কিনা। টিপ্পনি কাটে জাম্ভু।

মুখ ঝামটা দেয় নেত্য। —তা তুমার কী হয়েছে? তুমার চোখেও কুটো ঢুকেছে নাকিন? জলে নামবা? দাঁড়িয়ে কী জন্যে তবে? আমি পথে কাঁটা দিইছি?

চোখে আঁচল চাপা দিয়ে এগোয় নেত্য। দূরে গ্রামের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে। —হেই ম, একা ফেলে চলে গেল দেখছি। ভারী বজ্জাত তো মাগিগুলান!

—ডর লাগে তো এগিয়ে দিই পলাশগেঁয়েনীকে। এগোয় জাম্ভু।

—না। ঘুরে দাঁড়ায় নেত্য। অবেলায় বাজপড়া তালের গাছে চিলের তীক্ষ্ন ডাক।

—মা মনসা যেন।

—কী বুল্লে?

—মা শেতলার বিটী মা মনসা।

—মুখ সামলে কথা কইবে জাগালের বেটা জাগাল।

—আগে তুমার মাকে বলবে সামলাতে। মাঠের জাগাল ধানচুন্নির ঝুড়ি কেড়ে লেয়। সে—সংবাদ শেতলাও রাখে কিনা। তাই বুলছি গো নতুন বউ। মা শেতলাকে মুখ সামলাতে বলছি।

—ঠাট্টা করোনা। মায়ের চোখ সবদিকে। হঠাৎ কেন যে হেসে ফেলে নেত্য।

জাম্ভু সাহস পায়। আরও এগিয়ে আসে।

—মারবা নাকিন? চারপাশে তাকায় নেত্য। চোখের জ্বালা বেড়েছে। জল পড়ে আবার ভেজা গাল। কাপড়ের ঘেঁসে আবীরের মতো টকটকে। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা কনে দেখা আলোয় আগুনের মতো জ্বলে উঠেছে। ভয় পেয়েছে নেত্য। এই জংলা জন্তুকে বিশ্বাস নেই। অসহায়ের মতো জাগালদের কুঁড়ের দিকে তাকায় সে। সেখানে কেউ নেই। বায়তুল্লা, যোগীবর, ছকুলালের একটিনি দীনুপদ, কেউ না। (আঁটকুড়েরা গেল কতি মত্তে?)

ছমছমিয়ে সন্ধ্যার ছায়া নামছে। দিগন্তের একটুকরো কালো মেঘে সব আলো ঢেকে ফেলল। পায়ে পায়ে এগোয় নেত্য পেছন ফিরে ফিরে। এগোয় জাম্ভুও।

—কী মতলব তুমার? শীতে দাঁত কাঁপছে। কাঁপছে ঠোঁটদুটো। চারপাশে তাকিয়ে নেত্য ছুটতে চায়। কিন্তু সুমুখে জাম্ভু।

—ছুটো না। ইথেনের মাটিতে আঠা মাখানো আছে। মাঠের রাজা তো বটি। হাতের লাঠি ফেলে দেয় জাম্ভু।

—কি করবা তুমি? আর্তকণ্ঠস্বর গোধূলির বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। দূরে ডহরের পথে রাখালেরা ফিরছে গোরু নিয়ে গাঁয়ের দিকে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে।

—দেখবো, তুমার শেতলাও ই সংবাদটা রাখে কিনা।

—না, না সঙাল!

বুনো হাসের পাখার ধ্বনি মাথার ওপর। সঙাল! আলকাপের সঙদার জাম্ভুর দেশোয়ালি নাম। অতি মিষ্টি, অতি প্রিয় নাম। আদিম রক্তের স্রোতে দমকা বাতাসের আবর্ত ওঠে।

—তুমার পায়ে পড়ি সঙাল। আজ লয়, অন্যদিন। মিনতি করি সঙাল। তুমার চরণ ধরি। পলাশগেঁয়ে বউ কেঁদে উঠেছে আর্তকণ্ঠে।

—না! পশ্চিম মাঠের কোনো জন্তু হুংকার দিয়ে ওঠে।

আমার কথা আখো সঙাল। আজ আমি অশোচ আছি। বিশ্বেস করো সঙাল। পলাশগেঁয়ে মুখরার কান্নার স্রোতে চোখের কুটোটা অবশেষে ভেসে গেছে কখন অজানিতে। আচমকা হো হো করে হেসে ওঠে জাম্ভু। দাঁতগুলো আবছা আঁধারে ঝকমকিয়ে ওঠে।

—বোলো তুমার শেতলাকে, পলাশগেঁয়ে বশীকরণ চণ্ডালিকেয় খাটবে না। ইথেনে আঠামাখানো ফাঁদ পাতা আছে, পলাশগেঁয়ে পাখিধরার ফাঁদ।

হোঃ হোঃ হোঃ………উথালপাথাল হাসছে রসিকলাল রাজবংশী।

নেত্য উড়েছে ভয়চকিত পাখির মতো।

ছকুলালকে দংশন করেছে শেতলাবুড়ি। তাই দীনুর ঘাড়েই ঝামেলা। পুঁথিপত্তরগুলো সব ঘর থেকে এনেছে সে। পড়ার সময় নেই। তবু প্রাণের সাথী সঙ্গে না থাকলে হাঁপিয়ে ওঠে। ওই তার এক নিজের জগৎ। পুরাণকারের বর্ণনা থেকে মালমশলা কুড়িয়ে বানানো সেটা। সেখানেই ডুবে স্বস্তি তার। একে নিয়ে সে বেঁচে আছে। হাজার দেবতগন্ধর্ব যক্ষরক্ষ কিন্নরের সাহচর্যে দিন কাটানো। বাস্তব পৃথিবীর সুখদুঃখের ঢেউ সেখানে পৌঁছোয় কদাচিৎ।

রহস্যের পর রহস্যে ভরা এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কুশের জন্ম কী থেকে? কুশঘাস শুধু? ধূর, জানো না বিত্যেন্ত। বরাহঅবতারে বরাহরূপী নারায়ণের ক’গাছা লোম খসে পড়েছিল হিরণ্যাক্ষের সঙ্গে যুদ্ধকালে। তা কুড়িয়ে রাখলেন বাল্মীকি। তার থেকে হল কুশ ঘাস।

সৃষ্টিকালে বটপত্রে নারায়ণ ভেসেছিলেন। নিরাকার ব্রহ্মাণ্ডে বটপত্র এল কোত্থেকে? (এর জবাব সে জানে না) আঠারো কলার নাম জানো? জানো ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র এক কন্যার নাম? পাঁঠার সঙ্গে গান্ধারীর প্রথম বিয়ে? পাঁঠাটা কে বটে? কাম। স্বয়ং ধর্ম কামরূপ ধারণ করেছিলেন।

ব্রহ্মার কন্যা সন্ধ্যাবতী। রূপ দেখে পিতা পাগল। কাম জরজর নয়নে চান ব্রহ্মা। তারপর………

বায়তুল্লা লাফিয়ে ওঠে মেরে বসে আর কী। —তুর শাস্তরের তিনকম্ম করি। যত শালা আজগৈবি। বায়তুল্লা কাছেপিঠে না থাকলে যোগীবর গোপনে পরামর্শ করে দীনু আর জাম্ভুর সঙ্গে। —আসছেবার বেঁচেবত্তে থাকলে ই ভেয়ের সঙ্গে আর মাঠে নামছিনে বাপধন। তুরা দুজনে থাকবি, কেমন? পাহারার ব্যাপার ঢিলে পড়ে গেছে ছকুলাল যাওয়ার পর। কিন্তু দিনে কাজের চাপ বড়। বিলের কাছাকাছি এলাকায় এখন ধান কাটা চলেছে। কদিনের মধ্যেই কুঁড়ে আরও সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এখানে জাম্ভু দিনমান ধান ঠেঙার একা একা। ওরা তিনজন পালাক্রমে ধান বয়ে নিয়ে আসে দূর থেকে।

জ্যোৎস্না রাত। কিন্তু মেঘের পর মেঘ উঠে আসছে দিগন্ত থেকে। পলকে ছায়াঘন মাঠ, পলকে জ্যোৎস্নার ফুল ফুটছে। আনমনে একা ফিরছিল জাম্ভু। মাঠের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর কিছুদিন পরে এ মাঠ তাদের হাত থেকে চলে যাবে। এখানে ফুরোবে তাদের রাজ্যপাট। আসবে কেবল ঘুঁটেকুড়ুনি মেয়েরা। এ মাঠ ওদের জন্মের থেকে কেনা। আর কিছুদিন পরে শূন্যবুক মাঠে এসে বলতে পারবে জাম্ভু, হেই শালির বেটী, সাবধান;

আর সেইসব রোদ্দুরমাখা সবুজমাঠ, মেঘলা বিষণ্ণ মড়ার মুখ মাঠ, লালচেলিপরা বিকেলের কনেমাঠে! হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে দেখবে আপন রূপের ভাঁজ কোন নিঃঝুম খরার দুপুরে ফাঁকা বাতাসে দুরন্ত রোদ্দুরে তেতেপুড়ে এসে একদল মাঠকন্যে। নির্জন নিথর উদাস দুপুর, ঘুঘুর ডাকে তন্দ্রা ঘনিয়ে আসে চোখের পাতায়। স্বপ্নের স্বাদে মন ভরে ওঠে। মাঠের সুখ এইসব মাঠকন্যাদের নিয়েই যুগযুগান্তকাল দানা বেঁধেছে।

হঠাৎ সেই হলুদ মাঠে শীতের জ্যোৎস্নায় মুহ্যমান মাঠে বিকট জোরে চেঁচিয়ে ওঠে জাম্ভু। এলোমেলো হাঁটতে থাকে। অনিবার্য ভবিষ্যতকে এই কঠোর কর্কশ গানের আড়ালে ঢেকে রাখতে চায়। গলা তোলে উঁচু থেকে উঁচুতে। শেয়ালের মতো উঁচু মুখে চেঁচাতে চেঁচাতে এগিয়ে চলে। থ্যাবড়া পায়ে শুকনো খড় সাপের মতো জড়িয়ে যায়।

—যোগীকা!

ধড়মড়িয়ে ওঠে যোগীবর। খড়ের গাদা থেকে ভারীগলায় সাড়া দেয়। —কে রে?

—আমি দীনুপদ।

—কী সম্বাদ?

—রাত তিনটের গাড়ি গেল। জাম্ভুটা এখনও ফিরল না তো!

—উ জন্তি একটা। উর কথা বুলতে আছে? কোন গাছের মাথায় বসে বুজি গান ধরেছে।

—আমার কেমন সন্দ লাগে গো।

কান খাড়া করে যোগীবর। —কী, কী?

—কদিন থেকে উর ভাগগতিক ভালো ঠেকছে না।

—কারণটা?

—উই নীলকান্তর বউ আছে নেত্যবালা,………

—হুঁ হুঁ।

—উর পেছনে লেগেছে জাম্ভু। কাল দেখলাম বউটা হেসে ঢলাঢলি করছে জাম্ভুর সঙ্গে। টগরদের সঙ্গ এখন ছেড়েছে বউটা। একা একা ঘুরছে মাঠে।

—হুঁ হুঁ।

কাঁথা সরিয়ে রেখে বাইরে বেরোয় যোগীবর। কালিপড়া লণ্ঠনের দম বাড়িয়ে দেয়। ভালুকের মতো থপ থপ করে একটু হাঁটে। তারপর ভাঙা গলায় হাঁকে—হেই জাম্ভু, জাম্ভু….অ….অ….অঃ!

কুঁড়ের আর কোণে বায়তুল্লার ক্রুদ্ধ চাপা স্বর—আধহাত পৌঁছায় না হাঁক। তার আবার হাঁকার শখ দ্যাখো। ঘুম ভেঙে গেছে বলে রেগে উঠেছে সে। আবার পাশ ফিরে শোয়।

যোগীবর তামাক সাজতে বসে।

দীনু বলে—আমি এট্টু সম্বাদ লিয়ে আসি কাকা।

—হুঁ হুঁ।

ঘুম ভাঙার পর বরাবরই হুতুমপ্যাঁচার মতো স্বর বেরোয় যোগীবরের। তামাকের রসে আনন্দ পাওয়ার পশুশ্রম করে বসে বসে। মাঝেমধ্যে মাথা নেড়ে বলে—হুঁ হুঁ। জাম্ভু বলে—বেলো ফেঁসে যাওয়া হারমুনিওম।

দীন ছুটে যায়। রায়দিঘির পাড়ে পৌঁছেই কান খাড়া করে। নিমজাম জিয়ালার নীচে ঘন কালকাসুন্দে আর ঝুমকোর জঙ্গলেভরা মাটিতে ঘুটিঙ কাঁকর খোলামকুচিতে লেগে আছে কত প্রেমিক—প্রেমিকার পায়ের চিহ্ন অনেক যুগ থেকে। দুর্গন্ধ নোংরার রাজ্য। কাছেই ভাগাড় থেকে টেনে আনা মরা হাড়ের ধারালো বুকে টোক্কর লেগে সেখানে পা কাটে অসতর্ক মানুষের। সেখানেই বনমালী নাপিতেরা, আর হয়তো ওলাঙ্গিনীর মতো মেয়েরা মধুচক্র পাতে নির্জন গহন রাত্তিরে।

পুবদক্ষিণ কোণের ছাতিম গাছে বুক দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় দীনুপদ। মেঘলা রাত। কিন্তু দিন বলে ভ্রম হয়। হাড়কাঁপানো শীত এখানে মাঠের চেয়েও অনেক বেশি। ঠকঠক করে কাঁপছিল সে রায়দিঘির জলছুয়ে আসা উত্তুরে বাতাসের আঘাতে।

—ইত্থেনে থাকতে আমাকে কিছু ভালো লাগে না সঙাল, বিশ্বাস করো। মাঠে মাঠে আর ঘুরতে পারিনে।

—পালাতে চাও? চলো, দুজনে পালাই।

—পালাবো?

আর শুনতে চায় না দীনু। এই কৌতূহলটা তার মোটেই অভ্যাসের নয়। অথচ কী ভেবে সে এসেছিল? কানে আঙুল দিয়ে পক্ষীরাজের মতো ছুটতে চায় সে। পাপ মহাপাপ তো! কী দরকার ছিল এসব দেখবার শোনবার! শুধু মনের ছটফটানি অজ্ঞাত আবেগের দোলা লেগে। নেত্যর স্বামী নীলকান্ত তার বন্ধু। দুজনে কত গভীর রাত্তির অবধি তারা গল্প করত শাস্ত্র—তত্ত্ব নিয়ে। নীলকান্তর মতো সমঝদার তার কে আছে আর! কিন্তু এ যেন সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থেকে গড়ে ওঠা কোনো সদিচ্ছার কারসাজি নয়। কেমন যেন খাপছাড়া। কেমন আকস্মিক! হিংসের আগুন কেন জ্বলছে মনে তার উথাল—পাতাল? কেন সব শাস্তর কবিয়ালি, এতদিনের গড়ে ওঠা অনন্য জগৎটা তার পলকে পলকে রূপ বদলাচ্ছে! যেন কোনোকিছুর মানে নেই, কোনোকিছুতেই সুখী হবার নয়। নেত্য তার দিকে চেয়ে হাসত। বাড়ি গেলে খুশি হয়ে বসতে আসন দিত। মাঠে গিয়ে বলত—’কবেল। এর থেকে কী আশা করা যায়?’

দীনু লাফিয়ে লাফিয়ে উঁচু আলগুলো ডিঙিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ যেন ভয় পেয়েছে সে। একটা কিছু ওলটপালট হচ্ছে বসুমতীর কোনো পাতাল প্রদেশে, যার জন্যে পায়ের মাটি থির মানে না।

বসুদেব দেবকীকে হরণ করেছিলেন। কৃষ্ণ রক্মিণীকে। অর্জুন সুভদ্রাকে। শাম্ব হরণ করলেন দুর্যোধন কন্যা লক্ষ্মণাকে। অনিরুদ্ধ ঊষাকে।

পলকে বদলে গেছে জগৎ। তারা সব জয়ী। আর রাবণ—বিংশতিভুজ দশানন? সীতা কি অপাপবিদ্ধা ছিল? আবার রং ফেরে মনের বিশ্বে। নেত্য সীতা নয়। সামান্য মাঠকন্যে। সঙ্গে সঙ্গে এক বিবর্ণ ধূসরতার ঝড়ে কাঁপতে লাগল স্বর্গমর্ত্যপাতাল। পশ্চিমের মাঠ ডুবল ভয়ের হলুদ—হলুদ ছায়ায়। আলের ঘাসে লুটিয়ে পড়ে সোনালি জ্যোৎস্নায় আবার রূপান্তর। পূর্বাকাশে চণ্ডালিকার ওপর একটুকরো মেঘ বুনোমোষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রায়দিঘির পাড় থেকে জাম্ভু কি উঠেছে আকাশে লাফ দিয়ে? ছকুলাল জানে না, যোগীবর জানে না, জাম্ভু নীলকান্ত কেউ না, নেত্য না—জানবে না কোনোদিন এই অবিশ্রান্ত রূপান্তরের সংবাদ। কেবল পলাশগেঁয়ে ডাইনি কি ছুটে আসবে এই হতাশ বিবর্ণ রাত্তিরে শিরে জাদুর পিদীম জ্বেলে দীনুর দিকে শকুনচোখ হেনে?

—যোগীকা!

—কে, দীনুপদ এলা! তামুকখোর ভালুকটা হুঁকো হাতে বসে।

—আমি মিথ্যে সন্দ করেছিলাম গো।

—মিথ্যে?

—হ্যাঁ গো। মিথ্যে।

—হতে পারে বাছা। চোখের ভুলে মানুষ ব্যাঁকাকে সোজা দেখে।

লিজের মোনের আয়নায় যদি পারার দোষ থাকে, বুজলে বাবা দীনুপদ, সব দেখবে এলোমেলো।

শ্রীকৃষ্ণের মতো সুন্দর বিশবছরের কবেল দীনুপদ পাণ্ডুর হিমঘন নীরব মাঠের আকাশ খুঁজে সেই ভয়ালদর্শন মেঘখানা আবার দেখতে চায়। খড় টেনে আগুন ধরিয়ে ডাকল যোগীবর। …আয় বাবা, একটু আগুন পোঁহাই। অক্ত জমে গেল রে।

কুঁড়ে আরও সরিয়ে নিয়ে এসেছিল জাগালেরা। একেবারে চণ্ডালি—বাঁধা বিলের কিনারায় কাছের মাঠে কোথাও ধান নেই আর। কেবল এই মেটেল নাবাল জমির বুকে পচাপাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কিছু ধান। উঠতে আর দিন পাঁচেক বড় জোর। হঠাৎ নামল পৌষে বাদলা।

দুরন্ত বাদলা। আষাঢ়ের বৃষ্টিঝরা দিনের মতো দিন। আকাশে ঘন মেঘ। অবিরল ধারে বৃষ্টি। সেই সঙ্গে তীব্র বাতাস। প্রচণ্ড হিমে নিঃশেষ সব উত্তাপ। শরীর জমে কাঠের মতো নিঃসাড়। সারা মাঠ জুড়ে নেচে চলেছে শীতের প্রেতিনী হাতে তালি দিয়ে খলখল হেসে। মাঠের দিকে চাইতে ভয় করে। আর আকাশের মেঘে ভয়ংকরের চোখরাঙানি। বিজলির ছটা পলকে পলকে মেঘের ডাক। বুকের স্পন্দন থেমে যেতে চায়।

বেলা বাড়লে বাড়ছে ঝড়ের বেগ। বাড়ছে বৃষ্টি। থইথই জল জমেছে মাঠে। যোগীবর আর বায়তুল্লা কুঁড়ের এককোণে বসে ছিল। নেহাৎ অস্থায়ী বলে কেবল আঁটিবাঁধা খড় চাপিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার আশ্রয় এখানে।

সকাল অবধি ওদের দুজনে সেই পুরনো বিবাদের জেরস্বরূপ আকারে ইঙ্গিতে আলাপ চলছিল। এইবার শুরু হয় আগের মতো স্বাভাবিক কথাবার্তা। প্রথমে বলে বায়তুল্লা।

—দুনিয়ার সকলের আছে আরাম, কেবল এই হারামীদের ঘাড়ে…

কথা কেড়ে নিয়ে বলে যোগীবর—পাপের বোঝা।

খুশি হয় বায়তুল্লা। বলে—ঘর গেরস্থালি মাগছেলে ফেলে এই তেপান্তরে কীসের আশায়? না—চাট্টি ধান!

যোগীবর বলে, —আর ই পাপের কাজ লিবনা হে বধুঁ।

—কিন্তুক খাবা কী;

নিষ্ঠুর সত্যটা চাপা পড়ে কাশির দমকে। দুরন্ত বাদলায় হাঁপানি প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে। বড্ড কাহিল হয়ে পড়েছে যোগীবর। এমন বাদলা নামছে জানলে কি ইখেনে আসি হে।

ভারীগলায় বলে বায়তুল্লা—তুমাকে এ্যাদ্দুর আনার মত আমার মোটেই ছিল না বঁধু। কিন্তুক কী করা যায় বলো? দীনুপদ পালাল বহিনের ব্যামো বলে। জাম্ভু হারামীর বাচ্ছা তো লীলকান্তর মাগ লিয়ে দ্যাশ ছাড়লো। গায়েন—সেও ব্যামোয় পচছে।

—হুঁ হুঁ। শালা জাম্ভুবান জাতকুল সব খেলে হে। আহা বেচারী লীলকান্ত। বড়ো ভালো ছোকরা। পস্তায় যোগীবর। কাশতে কাশতে অতিকষ্টে কথা বলে। থামতে চায় না। ইচ্ছে করে না চুপচাপ মুখ বুজে থাকতে। কথা দিয়ে বাদলার উৎকণ্ঠিত প্রহর ঢেকে রাখতে চায়। বলে—কিন্তুক যিখানেই যাক, আমি ঠিক বলছি বঁধু—তুমি তো আবার উসব মানো না, ঔ দেবীর ভরওঠা মেয়ে তরঙ্গবালার হাত থেকে নিস্তার পাবে না। এমন বান মারবে শুওরের বাচ্চাটাকে—আর ছুঁড়িও মরবে। অমানুষি কি আপন—পর বাছে? নীলকান্তর ঘর সংসার করার সাদ নষ্ট করে কেউ রেহাই পাবে না।

এতগুলো কথা বলে হাঁপায় যোগীবর। বুকের শ্লেষ্মার পাহাড় ঝনঝনিয়ে ওঠে।

বলে বায়তুল্লা—তুমার ওগটা যেমন বেড়েছে, অধিক কথা না কহাই উচিত আমায় বিবেচনায়। তুমি চুপ করো এট্টু।

—হুঁ হুঁ। শুয়ে পড়ে যোগীবর। খড়ের বিছানার একপাশে দুর্গন্ধ শ্লেষ্মায় কুৎসিত ছেঁড়া বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে।

একটু বাইরে উঁকি দেয় বায়তুল্লা। দেখে আকাশ। বলে—আশমান ক্ষেপে যেয়েছে একেবারে। থামবার লক্ষণ নাই। এখন বাড়িই বা যাই কী ভাবে। ক্ষিদে লেগেছে পেচণ্ড।

মুখ তোলে যোগীবর।—আমারও। চাল যা ছিল ই বদলায় দুদিন ধরে আন্নাতো কত্তে পেলাম না। কাঁচা চাল ভিজিয়ে খেয়েই চলছে।

হেসে ওঠে বায়তুল্লা।—আমারও সেই ব্যাপার। কাল বিকেলে বাড়ি গেলাম যখন, চট্টি চাল বেশি করে আনলে কাজ হত, কে জানে এমন চাপবে।

—হুঁঃ! আমারও তাই।

দুজনের একই দশা। বুঝতে পেরে চুপ করে যায়। বৃষ্টি আর বাতাসের শব্দে চারপাশে কিছু শোনার উপায় নেই। কিন্তু হঠাৎ পেছন ফিরে কুঁড়ের চাল থেকে অযত্নে আটকে—রাখা খড়ের আঁটি খসে পড়ছে টের পায় ওরা। চমকে ওঠে। পরস্পর চোখে চোখ রাখে নিষ্পলক। তারপর নড়ে ওঠে যোগীবর। ওই যাঃ, এক কাণ্ড হয়েছে বঁধু।

—কীরূপ? আতঙ্কে কাঠ বায়তুল্লা।

—ভোলা মোন আমার। কাণ্ড দেখেছে?

বায়তুল্লা রেগে ওঠে।—আঃ বুলোনা কাণ্ডটা!

—চাট্টি চাল আছে।

—আছে? লাফিয়ে ওঠে বায়তুল্লা।

—আছে, কিন্তু ইখেনে লয়। হুই ঝোড় পাহাড়ের নীচে নালার জলে চুবানো। কাল বৈকেলে তুমি যখন বাড়ি গেলে উখেনে চুবিয়ে এথে এসেছিলাম। তারপরে তো বাদলা জোর লাগল। বাকি চালটা খেলাম রাত্তিরে। ওর কথাটা মোন হতে বেসজ্জন।

মুষড়ে পড়ে বায়তুল্লা।—উখেনে এখেছিলে কেনে?

—আর জল পাবো কতি ইখেনে?

—ধূর!

—তাছাড়া নালার জলে অমিত্যের স্বাদ আছে কিন্তুক। লয় কি না বলো বঁধু?

—তা আছে। জিভে জল বায়তুল্লার। এই বিলের জলের মধুময়তা আবাল্য তার পরিচিত। রাখালি জীবনে এই জলে গামছা ভেজা চালের স্বাদ এখনো ঘোচেনি জিভ থেকে। আর এ সংবাদ রাখে না চণ্ডালিকা পরগনার কোন চাষাভুষো রাখাল জাগাল?

হাঁটু গেড়ে বাইরে উঁকি দেয় সে। লোভী চোখে বৃষ্টিভেজা ঝাপসা ঢিবিটার দিকে তাকায়। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলে—আনবো?

—পারো তো আনো। আমি অক্ষম কিন্তুক!

উৎসাহে উঠে দাঁড়ায় বায়তুল্লা। বাইরে বেরিয়ে যায় সুজনী কাঁথা গায়ে লেপটে। খানিক গিয়ে আবার ফিরে আসে। বলে—আমি আনলে ছোঁয়া লাগবে বঁধু, তা খাবা তুমি?

—ক্যানে!

—তুমি খাবা না, আমি খাব। সিটা কেমন হয় বঁধু। থাক, যাব না।

—বঁধু! বিছানার আরাম ফেলে শরীর তুলেছে যোগীবর। বেশ মিষ্টি করে বলছে বঁধু, খেলে জাত যায় না, বুললে যায়। তাছাড়াই তেপান্তরে জাত আগে না জেবন আগে বিবেচনা করো দিকিন!

রক্তে বুঝি গতি এল খানিক। কাঁথাটা ভালো করে বুড়ি দিয়ে কুঁজো হয়ে চলল বায়তুল্লা। তারপর বাতাস বৃষ্টির বেগ বাঁচিয়ে চেঁচাল—ঠিক কোন জায়গায় আছে হে?

যথাসাধ্য চেঁচাল যোগীবরও। —সোজা চলে যাও ফজর হাজির সাতবিঘের আল ধরে। তারপরে ডান হাতে ঘুরবা। বুঝেছ!

—বুজোছ। বুলো। বায়তুল্লাকে ভেজা মুরগির মতো দেখাচ্ছে।

—চলে যেলে ঠাকুরের কাঠার আলে। তাপরে সুমুখে ওপারে মরা হেজল গাছ। উথেন থেকে আবার বাঁয়ে ঘুরে নালার ধারে ধারে যেয়ো। বুঝেছো;

—তা পরে—এ—এ—

—কুলগাছের শেকড়ে ন্যাকড়া বেঁধে ঝুলছে!

টুকরো গালমন্দের শব্দ বৃষ্টির ভেতর থেকে। আরও জোরে চেঁচায় যোগীবর—জলে চুবানো আছে…এ…এ

তারপর হাঁটুতে ভর দিয়ে গড়িয়ে পড়ে বিছানায়। আর তৎক্ষণাৎ আচমকা মুখের উপর শীতের ডাইনির হিমের নখের থাবা।

—একি, সব্বোনাশ!

কুঁড়ের কোণ থেকে খড় ততক্ষণে আরও খসে পড়েছে উদ্দাম বাতাসে। লাফিয়ে উঠে বসে যোগীবর। এখুনি খড় না চাপালে এই ভয়ংকর উলঙ্গ বাদলার ক্রুদ্ধ আঘাতে সে কারুর মুখ দেখবে না আর। কাঁথাখানা গায়ে জড়িয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে আসে বাইরে। অমনি তাকে নখ বসাতে থাকে শীত—বাদলার প্রেতিনীরা। কোনোরকমে সামলে নিয়ে পেছনের দিকে পৌঁছে কর্কশ অক্ষম হাতে খড় চাপাতে থাকে যোগীবর। মুখ তোলে একবার। দেখে দূরে বৃষ্টি বাতাসের ছাঁট বাঁচিয়ে টলতে টলতে কুঁজো হয়ে পথ চলেছে বায়তুল্লা। হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কখনো। চলেছে সে দুমুঠো চালের তল্লাসে। এই মিঠে জলের রসে তাতে কী মর্ত্যদুর্লভ স্বাদই না জমেছে এখন।

আকাশ দেখে যোগীবর। মেঘে মেঘে অন্ধকার। দেখে চার পাশ। ধূসর দিগন্তে হারানো গ্রাম—গ্রামান্তর। উন্মত্ত বাতাস পালোয়ানের মতো পাঁয়তারা ভাঁজছে তেপান্তরব্যাপী। নিঃসাড় আঙুলে খড় চাপাতে থাকে সে। আবার খসে পড়ে অন্যখানে। সেখানে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। ফিরে এসে দেখে আবার কোথা কঙ্কালের হাড়ের মতো বেরিয়ে পড়ছে নীচের বাঁশগুলো।

বাতাসের বেগ বাড়ল নাকি? প্রবলতম হল বর্ষা। এত বাতাস এত বৃষ্টি এই সোনার পউষে!

শী…আঁ….আঁ….আঁ….ই….শ…..শ….শ!

কে হাসছে না কাঁদছে। চমকে ওঠে যোগীবর। আবার সেই স্বর। কে হাসছে বা কাঁদছে। চমকে ওঠে যোগীবর। আবার সেই স্বর। কে হাসছে বা কাঁদছে। এক অনিবার তরঙ্গিল শব্দবন্যা বৃষ্টিরেখার বিন্যাসে ধেয়ে চলেছে দিক হতে দিগন্তরে। কুঁড়েটা নড়ে উঠল এবার। আবার। আবার। নাকে ছুঁচ ভরে জোতাপরানো গোরু যেমন চার ঠ্যাঙ ছোঁড়ে বেপরোয়া। চোখ খোলে না। অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে কোণের মোটা বাঁশখানা মাটির সঙ্গে চেপে রাখতে চেষ্টা করে। হিংস্র থেকে হিংস্রতর হয়ে উঠেছে তার রক্তের অন্ধকার রাজ্যের প্রাগৈতিহাসিক সেই রুগণ রাক্ষসটা। আর সেই তুচ্ছ হিংস্রতার আস্ফালন পলকে পলকে বেগবান হয়ে ওঠা বৃষ্টিময় বাতাস একটুও ভয় পায় না।

শীতের বেলা হয়তো পড়ে গেছে। সূর্য কত দূরে কে জানে। কিছু ঠাহর করার মন নেই। কতক্ষণ সে মেহনত করছে তাও হিসেবের বাইরে। অনেক অনেক দিন আগে বুঝি দেখল সে সূর্যের মুখ, দেখল বঁধু বায়তুল্লাকে—মধুমাখানো চালের পিণ্ডটার জন্যে একবুক ক্ষুধা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে যে গেছে দূর ঝোড়াপাহাড়ের প্রান্তে।

অনেক অনেক দিনের কথা যেন। কবে দেখে এল নির্মলার আর তার আটটি ছেলেমেয়ের প্রত্যাশী মুখ। প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজন। স্বপ্নের মতো সুদূর ধূসর আবছায়া। যেমন ধূসরতা এখন এই চরাচরে বাতাসের উচ্ছ্বাসে বৃষ্টির অবিশ্রাম ধারাপতনে, মেঘে—মেঘে নিশ্চিহ্ন দিগন্তের নীচে আহত মৃত্তিকার বুক ঘিরে জমে উঠেছে ঘরে ঘরে। যেমন অস্পষ্টতা তার শারীরিক অস্তিত্বের ওপর যন্ত্রণাহীন কোনো হিমঘন সুপ্তির নিবিড় স্পর্শে ঘনিয়ে এল আস্তে আস্তে।

সব গুলিয়ে যায় জলমাখা আয়নার মতো।

শুধু এই হিজিবিজি ঝাপসা আয়নার কোথাও একটুকরো স্মৃতি তখনও একবিন্দু রোদ্দুরের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে—বঁধু বায়তুল্লা চলে গেছে দুমুঠো চালের জন্য। চণ্ডালিবাঁধা বিলের মধুমদির জলে ভিজে যা এতক্ষণে অপরূপ ঐশ্বর্যের মতো। দুটি ক্ষুধিত জাগালের প্রতীক্ষায় উন্মুখ সেই স্বর্গীয় সম্পদ।

তখন ঘন নাটাশেয়াকুল আর অজানা লতাগাছেভরা এক কোণে বসে আড়ষ্ট দাঁতে চাল চিবুচ্ছিল বায়তুল্লা।

উঁচু স্বভাবে গড়ে ওঠা একটা ঢিবি। লোকে বলে রানিচণ্ডালিনীর নির্জন বাসভবনের ধ্বংসাবশেষ। তা নাহলে এই বিলের মধ্যিখানে কীভাবে জমে থাকবে অতবড় স্তূপটা।

তার এককোণে রাখালের বানানো লতাপাতার ছাউনি। ভিতরে রাশিকৃত শুকনো পাতা। বৃষ্টির ছাঁট আটকায়না তাতে। তবু একটু আশ্রয়। বৃষ্টি আর বাতাসের বেগ হঠাৎ বেড়ে উঠলে বায়তুল্লা নালা পেরিয়ে এখানে এসে বসেছিল। শীতে নালায় হাঁটু জল। ভয় পেয়ে তাড়া খাওয়া শেয়ালের মতো সে লুকোতে চেয়েছিল এখানে। কিছুক্ষণ চালগুলো নাড়াচাড়া করেছিল সে। খুলে দেখতে চেয়েছিল মধুস্বাদ চালগুলোর ‘বন্ন’। সেই হল কাল। টক দিয়ে চিংড়িমাছ রান্না করা মেয়ের গল্পের মতো।

আনমনে মুখে একমুঠো ফেলে দিয়েই ভেবেছিল, সব্বোনাশ! এঁটো চাল বঁধুকে দিই ক্যামনে? লজ্জা পেয়ছিল খুবই। কত ছোট হয়ে যাচ্ছে তার ব্যবহার! আট বছর ধরে জমে ওঠা দোস্তালির বেইমানী। পাথর দাঁতে চিবিয়ে চলে তবু। কী মধু, কী মধু।

কিন্তু তারপর? কীভাবে এ গোনার প্রতিকার? এবার সেই উপোসী হাঁপকাশের রুগির সুমুখে খালিহাতে দাঁড়াবে সে। বঁধু যোগীবরের চোখে যে ভাষা ফুটে উঠবে, তা সেদিনকার ঝগড়ার মতো নয়। তা অতি বিশ্রী। অতি কদর্য। বায়তুল্লা ফরাজি মুসলমান। এই তার অহঙ্কার। ফরাজি মুসলমানকে লোভী হতে নেই। আর ভাবতে পারে না সে। নিজের প্রতি দারুণ ক্রোধে আত্মহারা হয়ে ওঠে সে। হেতের থাকলে হয় তো এখুনি পেটটা কেটে চিরে ফেলত। দীর্ঘ সময় ধরে মাঠের বুকে রোদ বৃষ্টি বাতাসে তিলে তিলে গড়ে ওঠা দোস্তালি। হোক না কাফের, বিধর্মী। গ্রাম থেকে বাইরে এই নির্জন প্রান্তরে তারা দুজনে শিশু; খুঁজেছে আট বছরব্যাপী উলঙ্গ এই শিশু দুটো মা—খাকীর (বসুমতীর) মধুক্ষরা স্তনবৃন্ত। এর চেয়ে সত্য আর কিছু নেই। হে আল্লাতালা, হে দীনের নবী মোহাম্মদ, শিশুর জন্যে কোনো শরীয়ত নাই।

বাইরে চলেছে উন্মত্ত বাদলার আস্ফালন। মেঘে—মেঘে চিকুর হানছে। ঝরছে অঝোর ধারে বৃষ্টি। সাদা কাফনপরা লাশের মতো প্রান্তরটার শিয়রে দলবেঁধে জমায়েত হয়ে মৃতের জন্যে শেষ প্রার্থনা—জানাজার নমাজে অবতীর্ণ এরা। লাফিয়ে বাইরে বেরোয় বায়তুল্লা। চোখ বুজে দৌড়ে নেমে আসে। খাল পার হয়ে পূর্বমুখে ছুটে চলে কাদায় পিছল মাঠ বেয়ে। কোনো দিকে তাকাতে পারে না। অপরিসীম লজ্জার গ্লানিতে সে অন্ধ হয়ে গেছে আজ।

চণ্ডালিকা ঢুকল বায়তুল্লা। তখন শিলাবৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।

ধসেপড়া পাঁচিল সবখানে। উঁচু মাটির কোঠাঘরের দেয়ালে তালাই ত্রিপল টেঙেও রেহাই পায়নি কেউ। কালবাদলা যেন সবকিছুর ওপর উন্মাদের মতো লাথি মেরে চলেছে। ঘরের মেঝেয় জল। হাঁড়ি সরা বাসন পেতে দিয়ে গোলবানু বসেছিল বাচ্চাদের বুকে চেপে ধরে। এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে কাঁপছিল বসে বসে। কোলের বাচ্চাটা বসন্তের নখাঘাতে বীভৎস হয়ে আছে। মায়ের শিথিল স্তনে বিক্ষত ঠোঁট তার একটুও নড়ে না। পলকে সব দেখে নেয় বায়তুল্লা। তারপর কোণে যত্নে সাজানো স্তূপাকার হাঁড়িগুলো টেনে টেনে মেঝেয় ফেলে হঠাৎ। চেঁচিয়ে ওঠে গোলবানু—কী হয়েছে গো হঠাৎ, কী খুঁজছো অমন করে? কী হয়েছে তুমার?

জবাব শোনে না স্বামীর। তাই আবার ফুঁপিয়ে ওঠে—কী হয়েছে বলো না গো? কী করেছি আমি?

দেখাদেখি কান্নার সুর তোলে বাচ্ছারা। চেঁচায় বায়তুল্লা—ভেড়ার গোয়ালে আগুন লাগলো নাকিন রে বাবা।

—কী খুঁজছো?

—চাল।

—ক্যানে?

—পেয়োজন আছে। আবার খোঁজে বায়তুল্লা। হাঁড়িগুলো ভেঙে তছনছ করে দেয়। তারপর হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে গোলবানুর সুমুখে। ব্যাকুলভাবে বলে তুর পায়ে পড়ি ফতের মা, চাট্টি চাল কতি আছে কহো।

—বাদলায় ধান কুটতে পারিনি, চাল পাবো কতি গো? ভাত হয়নি দুদিন। ছেলেগুলান না খেয়ে আছে।

এক মুহূর্তে স্তব্ধ থাকে বায়তুল্লা। বলে গোলবানু—মুঠির চাল আছে লিবা?

মুঠির চাল! প্রতিবেলা রান্নার সময় একমুঠো করে তুলে ছোট্ট একটা হাঁড়িতে রাখতে হয়। প্রতি শুক্রবার মসজিদে জমা দিতে হয়। নেকীর পাথের সঞ্চয় করে রাখা অমৃতসম্পদ।

একটু ইতস্তত করে সে। কাফেরের জন্যে এই নেকীর দানা? গোনা হবে না? না, না। জানের জন্যে কোনো শরীয়ত নাই। গামছায় ঢেলে নেয় চালগুলো। দৌড়ে বেরিয়ে যায় আবার। শিলাবৃষ্টি থেমেছে তখন। তখন কমেছে বৃষ্টির ধারা। ক্ষান্ত হয়েছে তখন ঝড়োবাতাস। আর সন্ধ্যার মুখোমুখি গহনগোরে সমাহিত হয়ে গেছে কাফনজোড়া সেই মৃতদেহটা।

চণ্ডালি ঝিলের কোলে ঘন আঁধার। উপড়ে যাওয়া কুঁড়ের নীচে থেকে সে খুঁজে বের করে বন্ধু যোগীবর কুনাইয়ের হিম শরীর। প্রচণ্ড উত্তেজনায় ভেজা খড়গুলো চাপিয়ে কোনোমতে একটু আশ্রয় বানিয়ে নেয় বায়তুল্লা। আগুন জ্বালানোর জন্যে দেশলাই খুঁজে পায় না। সারাটিরাত্রি, শীতের দীর্ঘ অন্ধকার প্রহরগুলো কেটে যায় বায়তুল্লার নিদ্রাহীন পলকহারা চোখের ওপর। বুকের কাছে গলায় জড়ানো গামছায় চালের পিণ্ডটা হৃৎপিণ্ডের মতো ধুকধুক করছিল। দূরে ঝোড়পাহাড়ে শেয়াল ডাকছিল। হাজার হাজার কীটপতঙ্গ সরীসৃপ এই প্রকাণ্ড কবরখানার ফাটলে মুখ গুঁজে যেন প্রার্থনা করছিল। মৃত্যুর দেবতা আজরাইলের ডানার গর্জন তখন মিলিয়ে গেছে গভীর মহাশূন্যে।

সকাল হল। মেঘ না বৃষ্টি না। আকাশে সূর্যের হাসি। নীল আকাশের নীচে এ এক নয়া মাঠ। নয়া দুনিয়া। যোগীবর কুনাইয়ের লাশ বুকে নিয়ে আচমকা বিকট আর্তনাদ করে উঠল বায়তুল্লা।

—ইয়া আল্লা, আমার জনমভোর সব নেকীর বদলে বঁধুর জান ফিরিয়ে দাও। আট বচ্ছর পরে একা ঘরে ফিরতে হবে—হে দীনের পয়গম্বর মোহাম্মদ কবুল করো মোনাজাত।

দুহাত সামনে মুখের ওপর তুলে বায়তুল্লা কাঁদতে কাঁদতে মৃতের আত্মার জন্য প্রার্থনা করছিল…আমেন!

…আমেন!

…আমেন!