২. আতিথেয়তায় মল্লিকমশাই পয়লা নম্বর

॥ ২ ॥

আতিথেয়তায় মল্লিকমশাই যে একেবারে পয়লা নম্বর সেটা খাবার বহর দেখেই বোঝা গেল। মাছের যে এতরকম জিনিস রান্না হতে পারে সেটা আমার ধারণাই ছিল না। ফেলুদা অল্প খায়, কিন্তু লালমোহনবাবু ভোজনরসিক—খুব তৃপ্তি করে খেলেন। ওঁর খুশির আরেকটা কারণ হচ্ছে যে পঞ্চাননবাবু ওঁর লেখা সম্বন্ধে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করছিলেন তাই ভদ্রলোক নিজের ঢাক পেটাবার একটা সুযোগ পেলেন।

খাবার পর মল্লিকমশাই বললেন, ‘এবার আপনাদের একটু এনটারটেন করব। চলুন আমার সংগ্রহের কিছু জিনিস দেখাই।’

আমরা আবার দোতলায় ফিরে এলাম। এবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডানদিকে না ঘুরে বাঁদিকে ঘুরলাম। এদিকেই পঞ্চাননবাবুর ঘর আর তাঁর সংগ্রহশালা।

জিনিসপত্র অনেকরকম জোগাড় করেছেন ভদ্রলোক তাতে সন্দেহ নেই। তার প্রত্যেকটারই আবার একটা করে পরিচয় আছে। মহর্ষির নাগরাটা প্রথমেই দেখা হল, তারপর ক্রমে টিপুর নস্যির কৌটো, ক্লাইভের ট্যাঁকঘড়ি, সিরাজদ্দৌলার রুমাল, রানি রাসমণির পানবাটা—এ সবই দেখলাম। আমরা সকলেই অবিশ্যি খুবই তারিফ করলাম, কিন্তু আমার যেন কেমন-কেমন লাগছিল। কোন জিনিসটা কার ছিল সেটা জানা গেল কি করে? ক্লাইভের ঘড়িতে ত আর ক্লাইভের নাম লেখা নেই। বা সিরাজদ্দৌলার রুমালেও নেই।

সব দেখেটেখে চারজনে ঘরে ফেরার পথে নবজীবনবাবু ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন মনে হল?’

ফেলুদা বলল, ‘খুব কনভিনসিং লাগল না।’

‘কনভিনসিং? ওর মধ্যে একটা জিনিসও জেনুইন নেই। লোকটা বোগাস, হামবাগ। মহর্ষির নাগরা থেকে ত রীতিমতো নতুন চামড়ার গন্ধ বেরোচ্ছিল।’

ঘণ্টা তিনেক বিশ্রামের সময় ছিল, তারপর অনুষ্ঠানে যাবার জন্য তৈরি হয়ে নিলাম। ফেলুদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরল বোধহয় আজ দশ বছর পর। ওকে পোশাকটা যে দারুণ মানায় সেটা স্বীকার করতেই হয়। লালমোহনবাবু একটা নকশাদার কাশ্মিরী শাল চাপিয়েছিলেন, বললেন সেটা ওঁর ঠাকুরদাদার ছিল।

ঠিক পৌনে ছ’টায় বেয়ারা পাঠিয়ে আমাদের ডেকে নিলেন পঞ্চাননবাবু। শীতকাল, তাই এর মধ্যেই বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে! অনুষ্ঠানের জায়গায় পৌঁছে দেখি আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। স্পটলাইট, ফ্লুয়োরেসেন্ট লাইট, রঙিন বাল্‌ব—কিছুরই অভাব নেই।

আমরা মঞ্চে গিয়ে বসলাম। সংবর্ধনার ব্যাপারটা একেবারে শেষে—অর্থাৎ ক্লাইম্যাক্স। তার আগে নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটকের অংশের দৃশ্য—সবই হল। সকলেই আজ জান দিয়ে দিচ্ছে ফেলুদাকে ইমপ্রেস করার জন্য, ফেলুদাও হাততালিতে কার্পণ্য করছে না।

সংবর্ধনার ব্যাপারটা কুড়ি মিনিটে সারা হয়ে গেল! সময় একটু লাগল মানপত্রটা পড়তে। এটা বলতেই হবে যে মানপত্র দুটো দেখতে বেশ ভালো হয়েছে, আর যে লিখেছে তার হাতের লেখা খুব ভালো। সব শেষে কয়েকজন সাংবাদিক ফেলুদাকে ঘিরে ধরল, আর তাদের কিছু প্রশ্নের জবাবও দিতে হল ফেলুদাকে। সে বলল এখন তার অবসর—হাতে কোনো কেস নেই।

নবজীবনবাবু অনুষ্ঠানের শেষে পঞ্চাননবাবুর সঙ্গে বাড়ি ফিরে গেলেন, আমরা রয়ে গেলাম কারণ আমাদের নেমন্তন্ন আছে ফেলুদার সহপাঠী সোমেশ্বর সাহার বাড়িতে। ভিড় কমবার পরেই ভদ্রলোক হাসিমুখে ফেলুদার দিকে এগিয়ে এলেন।

‘চিনতে পারছিস?’

‘অনায়াসে,’ বলল ফেলুদা। ‘গোঁফটা ছাড়া আর প্রায় কিছুই বদলায়নি।’

‘তুইও মোটামুটি একই রকম আছিস, তবে চোখে একটা দীপ্তি দেখছি যেটা বুদ্ধি পাকবার ফলে হয়েছে। ক’টা কেস হ্যান্ডল করলি এ পর্যন্ত?’

‘হিসেব নেই,’ বলল ফেলুদা। ‘গোড়ার দিকে হিসেব রাখতাম, আজকাল ছেড়ে দিয়েছি।’

‘তোর সঙ্গে একজন আলাপ করতে ভীষণ আগ্রহী’—সোমেশ্বর সাহা তাঁর পিছনে দাঁড়ান এক ভদ্রলোককে পিঠে হাত দিয়ে সামনে আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। —এঁর নাম জয়চাঁদ বড়াল। এখানকারই বাসিন্দা। ইনিই মানপত্রটা ডিজাইন করেছেন।’

‘তাই বুঝি?’ বলল ফেলুদা। ‘খুব ভালো হয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম।’

জয়চাঁদবাবু লজ্জায় ঘাড় নিচু করে বললেন, ‘আপনার কাছ থেকে প্রশংসা পাবো এ কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি আপনার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত।’

‘আজ ইনিও আমাদের বাড়িতেই খাচ্ছেন,’ বললেন সোমেশ্বরবাবু। ‘চ—এখানে দাঁড়িয়ে থেকে গেঁজিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার বাড়ি বেশি দূর নয়। মিনিট দশেক পা চালাতে পারবি ত?’

‘জরুর।’

সোমেশ্বরবাবুর বাড়ি বড় না হলেও, বেশ গুছোন। সেটা বোধহয় ওঁর স্ত্রীর জন্য। স্ত্রী ছাড়া একটি দশ বছরের ছেলেও আছে ভদ্রলোকের। জয়চাঁদবাবু সমেত আমরা চারজনে বৈঠকখানায় বসার দশ মিনিটের মধ্যেই সরবত এসে গেল। স্ত্রী উমাদেবী বললেন, ‘আগে সরবতটা খান—সাড়ে ন’টার মধ্যে আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করে দেব।’

মিনিট পাঁচেক এটা-সেটা নিয়ে কথা হবার পর সোমেশ্বরবাবু জয়চাঁদ বড়ালকে দেখিয়ে বললেন, ‘এঁর একটা বিশেষ কিছু বলার আছে তোকে। আমার মনে হয় তুই ইন্টারেস্ট পাবি।’

‘বটে?’ বলল ফেলুদা। ‘কী ব্যাপার শুনি।’

‘কিছুই না,’ সলজ্জ হাসি হেসে বললেন জয়চাঁদবাবু, ‘আমাদের ফ্যামিলি সংক্রান্ত একটা ব্যাপার।’

লালমোহনবাবু আগ্রহের সঙ্গে একটু এগিয়ে বসলেন। ‘কী ব্যাপার, কী ব্যাপার?’—গল্পের গন্ধ পেলেই ভদ্রলোক চনমনিয়ে ওঠেন।

জয়চাঁদবাবু হাত থেকে সরবতের গেলাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘আমি নিজে এখন ইস্কুল মাস্টারি করি, কিন্তু আমার পৈতৃক ব্যবসা ছিল হীরে-জহরতের। কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে আমাদের একটা গয়নার দোকান এখনো আছে; সেটা দেখেন আমার এক কাকা। আমি যাঁর কথা বলছি তিনি ছিলেন আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদা—নাম ছিল অভয়চরণ বড়াল। তিনিই এই ব্যবসা আরম্ভ করেন। জাহাজে করে ভারতবর্ষের উপকূলে সব শহরে গিয়ে হীরে পান্না কেনাবেচা করতেন। মাদ্রাজের কাছাকাছি কোনো একটা শহরে তিনি একবার একটা রত্ন পান। সেটা তিনি যত্ন করে জমিয়ে রেখেছিলেন। সে রত্ন এখনো আমার কাছে রয়েছে। সেটা আমি আপনাদের দেখাতে চাই।’

‘সঙ্গে এনেছেন?’ জটায়ু প্রশ্ন করলেন।

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা খয়েরি রঙের রুমাল বার করলেন, তাতে গেরো দিয়ে বাঁধা একটা ছোট্ট লাল ভেলভেটের বাক্স। বাক্স খুলে তার থেকে একটা মুক্তো বার করে ভদ্রলোক আমাদের সামনে ধরলেন।

ফেলুদা উত্তেজনায় ভরা চাপা স্বরে বলে উঠল—

‘একি—এ যে পিংক পার্ল!’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ,’ বললেন জয়চাঁদ বড়াল। ‘অবিশ্যি গোলাপী হওয়ায় এর কোনো বিশেষত্ব আছে কিনা জানি না।’

‘কী বলছেন আপনি!’ বলল ফেলুদা। ‘ভারতবর্ষে যতরকম মুক্তো পাওয়া যায় তার মধ্যে সবচেয়ে দুষ্প্রাপ্য আর সবচেয়ে মূল্যবান হল গোলাপী মুক্তো।’

‘মুক্তো সাদা ছাড়া হয় তাই ত জানতাম না,’ বললেন লালমোহনবাবু।

‘সাদা লাল কালো হলদে নীল—সবরকম হয়,’ বলল ফেলুদা।

তারপর জয়চাঁদবাবুর দিকে চেয়ে বলল, ‘শুনুন—আপনি ও জিনিস ওভাবে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন না। বাড়িতে সিন্দুক থাকলে তাতে রেখে দেবেন।’

‘আজ্ঞে এটা আমি বার করি না বললেই চলে। আজ আপনাকে দেখাব বলে নিয়ে এলাম।’

‘আর কাকে দেখিয়েছেন ওটা?’

‘মাত্র একজন। গত সপ্তাহে একজন ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বণিকদের নিয়ে একটা বই লিখছেন—তাঁকে দেখিয়েছিলাম।’

‘এ ছাড়া আর কেউ জানে না ত?’

‘কী আর বলব বলুন—এই ভদ্রলোক, যিনি বই লিখছেন—তিনি আবার ঘটনাটা এক সাংবাদিককে বলেন। ফলে পরদিনই সেটা কাগজে বেরিয়ে যায়।’

‘কলকাতার কাগজে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনটে বাংলা কাগজে বেরিয়েছে। আপনি ফিরে গিয়ে সেটা দেখতে পাবেন।’

‘গোলাপী মুক্তো বলে বলা আছে তাতে?’

‘তাই ত বলেছে। একটা কাগজে ত এ-ও বলে দিয়েছে যে মুক্তোর মধ্যে গোলাপী মুক্তোই সবচেয়ে ভ্যালুয়েব্‌ল।’

‘সর্বনাশ!’ কপালে হাত ঠুকে বললে ফেলুদা। ‘আমি আপনাকে জোর দিয়ে বলছি এ জিনিস আপনি কাউকে কখনো দেখাবেন না। এই একটা মুক্তোর দাম কত তা আপনি কল্পনা করতে পারেন? বিক্রি করলে আপনি যা দাম পাবেন তাতে আপনার পরের দুই পুরুষ পর্যন্ত খাওয়া-পরার কোনো ভাবনা থাকবে না।’

‘এটা আপনি আমাকে বলে খুব উপকার করলেন।’

আমরা তিনজনেই একবার করে মুক্তোটা হাতে নিয়ে দেখলাম। নিটোল চেহারা। ফেলুদা বলল যে, শেপের দিক দিয়েও মুক্তোটা অসাধারণ।

জয়চাঁদবাবু তাঁর সম্পত্তি আবার পকেটে পুরে নিলেন। ফেলুদা ‘ছিক্‌’ করে একটা আক্ষেপসূচক শব্দ করে বলল, ‘খবরটা কাগজে বেরোন খুবই আনফরচুনেট ব্যাপার। আশা করি কোনো গোলমাল হবে না।’

‘যদি হয় তা হলে কি আমি আপনাকে জানাব?’

‘নিশ্চয়ই। আমার ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই সোমেশ্বর জানে। আপনি বিনা দ্বিধায় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এমন কি দরকার হলে ওটাকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে পারেন।’