আড়ে-দিঘে অষ্টপুর খুব একটা বড় জায়গা নয়, বিখ্যাতও নয় তেমন। তা অষ্টপুরে দ্রষ্টব্য জায়গা কিছু কম নেই। বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরের লাগোয়া দ্বাদশ শিবের থান আছে। পুব দিকে উজিয়ে গেলে দয়াল সরোবর। এত বড় দিঘি দশটা গাঁ ঘুরে পাওয়া যাবে না। দিঘি পেরোলে বাঁ হাতে নীলকুঠির মাঠ, তারপর জঙ্গলের মধ্যে ফস্টারসাহেবের ভুতুড়ে বাড়ি। ওদিকটায় না যাওয়াই ভাল। সাপখোপ আছে। আর এখানকার ভূত খুব বিখ্যাত। ডান ধারে সিটুলসাহেবের গির্জা। এখন আর এই অঞ্চলে খ্রিস্টান কেউ নেই বটে, কিন্তু হরেন চাটুজ্যের মা রোজ সন্ধেবেলা এসে গির্জায় মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যিশুবাবাকে প্রণাম করে যান। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, “আহা, যিশুবাবা বড় কষ্ট পেয়েছিল গো! ভাবলে আজও আমার চোখে জল আসে যে!”
গির্জা পেরিয়ে ডানহাতি রাস্তা ধরে সোজা এগোলে মহারাজ বীরেন্দ্রনারায়ণের ভাঙা প্রাসাদটা ডান হাতে পড়বে। রাজবংশের কেউ না থাকলেও ফটকের পাশে একটা খুপরি ঘরে বুড়ো ফাগুলাল আজও আছে। রাজবাড়ির পরেই মোস্তাফার হাট। এ হাটের খুব নামডাক। প্রতি মঙ্গলবারে বিশাল হাট বসে যায়। মোস্তাফার হাটের ধারেই মন্তেশ্বরীর খাল। খালধার দিয়ে ডানহাতি ঘুরে একটু এগোলেই থানা। থানা পেরিয়ে চণ্ডীমণ্ডপ, তারপর বিখ্যাত বটতলার চত্বর, যেখানে দোকানপাট আছে, চা আর নানখাটাই বিস্কুট পাওয়া যায়। বটতলা পেরিয়ে মসজিদ। ফের ডান দিকে ফিরলে দুর্গামণ্ডপ, প্রগতি ক্লাব, স্কুল, খেলার মাঠ। সুতরাং অষ্টপুর খুব একটা ফ্যালনা জায়গা নয়।
কয়েকদিন বর্ষাবাদলার পর আজ অষ্টপুরে রাঙা রোদ উঠেছে। আবহাওয়া অতি মনোরম। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। তার সঙ্গে গোরুর হাম্বা, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, বেড়ালের ম্যাও সবই যথোচিত শোনা যাচ্ছে। অষ্টপুরের মানুষজন অনেকেই বিষয়কর্মে বেরিয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ দাঁতন করছেন বা ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছেন, কেউ বা পুজো-আহ্নিকে বসেছেন, কেউ বাজারে গিয়ে সবজি বা মাছ কিনছেন, বটতলায় চায়ের দোকানে বেশ জটলা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে অষ্টপুরের জীবনযাত্রা বেশ স্বাভাবিকই বলা যায়।
জঙ্গল থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছিল না নবীন। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে পড়ে গিয়ে আর গাছে ধাক্কা খেয়ে তার মুখ, কপাল, হাত সব ক্ষতবিক্ষত। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কালশিটে পড়েছে। তার গায়ে এখনও কয়েদির পোশাক। লোকে লহমায় ধরে ফেলবে যে, সে জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। লোকালয়ে যেতে হলে তার একটা চলনসই পোশাক চাই। তারপর প্রাণে বাঁচতে দরকার একটু দানাপানির। নবীন জীবনে কখনও চুরিটুরি করেনি, ভিক্ষে করার অভ্যেসও নেই। কী করবে, তা সে ভেবে পাচ্ছিল না।
জঙ্গলের আড়ালে ঘাপটি মেরে থেকে সে জায়গাটা একটু আঁচ করার চেষ্টা করছিল। গাঁয়ের নাম তার জানা নেই বটে, কিন্তু বেশ একটা লক্ষ্মীশ্ৰী আছে। বেশ পছন্দসই জায়গা।
বুদ্ধি তার কোনওদিনই বিশেষ নেই। তবু সে একটা গাছের তলায় বসে খুব মন দিয়ে ফন্দি আঁটার চেষ্টা করতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল, রাস্তার উলটো দিকে যে পুরনো গির্জাটা আছে, সেটায় বোধ হয় এখন কোনও লোকজন নেই। বড় দরজাটায় কোনও তালাটালাও দেখা যাচ্ছে না। সে উঁকি দিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে দুই লাফে রাস্তাটা ডিঙিয়ে গির্জার দরজাটা সাবধানে ফাঁক করল। তারপরেই চমকে উঠে দেখতে পেল, একজন বুড়ো মানুষ একটা লম্বা উঁটিতে লাগানো ব্রাশের মতো জিনিস দিয়ে ভিতরের মেঝে ঝাট দিচ্ছে। টপ করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল নবীন। আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেত।
ফের জঙ্গলের মধ্যে এসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল সে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে সে যে বাঁচবে না, এটা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল নবীন। সাহস করে কিছু একটা করতেই হবে। এমনকী, চুরিও।
জঙ্গলের আড়ালটা বজায় রেখেই সে খানিকটা এগিয়ে গেল। সামনে একটা বিশাল দিঘি, তাতে টলটলে জল। এদিকটায় লোকজনও নেই। নবীন দিঘির ধারে নেমে আঁজলা করে তুলে অনেকটা জল খেয়ে নিল। জলে খানিকটা কাজ হয় বটে, তবে বেশিক্ষণ জল খেয়ে থাকা যাবে না।
নবীন একটু দম নিয়ে সাহস করে জঙ্গল ছেড়ে বাড়িঘরের পিছনবাগে গা ঢাকা দিয়ে গাঁয়ের দোকানপাটের সন্ধানে এগোতে লাগল। যেখানে মেলা লোকের ভিড়, সেখানে মিলেমিশে গেলে হয়তো তার পোশাকটা লোকের তেমন চোখে পড়বে না।
কপালটা তার ভালই। বেশ একটা জমজমাট চত্বরের কাছেপিঠে সহজেই হাজির হয়ে গেল সে। প্রকাশ্যে বেরোতে অবশ্য সাহস হল না। একখানা খেজুর গাছের আবডালে কিছু ঝোঁপঝাড় দেখে সেখানেই গা ঢাকা দিয়ে নজর রাখতে লাগল। সামনেই একটা চাতালে বাজার বসেছে। রাস্তার দু’ধারে বেশ কয়েকটা দোকান। জামাকাপড়, খাবার, স্টেশনারি জিনিস সবই পাওয়া যায়। পয়সা থাকলেই হল। আর নবীনের পয়সাটাই নেই। মাধবগঞ্জের পিসির কাছে তার পাঁচ লাখ টাকা গচ্ছিত আছে বটে, কিন্তু থেকেও নেই। এখন মনে হচ্ছে, ওটা একটা রূপকথার গল্প ছিল।
একজন বেশ ফর্সা, স্বাস্থ্যবান, গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা লোক একটা ঝকঝকে সাইকেলে চেপে এসে চত্বরে নামল।
লোকটার হাবভাব ভারী বেপরোয়া। তালা না লাগিয়েই সাইকেলখানা বটতলার ছায়ায়, স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বাজার করতে ঢুকে গেল। পয়সা আছে বটে লোকটার। দরদাম না করেই একজোড়া ইলিশ কিনে ফিলল, দু’ কেজি পাঁঠার মাংস, এক কুড়ি কই মাছ, মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি দই আর দু’ বাক্স মিষ্টি। একটা কুলি গোছের লোকের হাতে বাজারের জিনিসগুলো গছিয়ে রওনা করিয়ে দিয়ে লোকটা চায়ের দোকানে চা খেতে বসল। তারপর চায়ের দাম মেটাতে মানিব্যাগটা যখন বের করেছে, তখনই বোধ হয় বটগাছ থেকে একটা বেরসিক কাক বড়-বাইরে করে দিল লোকটার পাঞ্জাবিতে। লোকটা ভারী বিরক্ত হয়ে একবার উপর দিকে চেয়ে শশব্যস্তে ছুটে গেল কাছের টিউবওয়েলে পাঞ্জাবি ধুতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানিব্যাগটা পড়ে রইল বেঞ্চের উপরেই। আর এমনই কপাল নবীনের যে, সে যেখানে লুকিয়ে আছে, তার মাত্র সাত-আট ফুট দূরেই মানিব্যাগটা। দোকানে খদ্দের নেই। দোকানিও অন্য কাজে ব্যস্ত। নবীনের মনে হল, এ একেবারে ভগবানের দান। এ সুযোগ ছাড়া মহাপাপ।
আর যাই হোক, নবীনের একটা গুণ স্বীকার করতেই হয়। সে হরিণের মতো দৌড়তে পারে। বুকটা যদিও কাপছিল, জীবনে কখনও চুরিটুরি করেনি বলে মনটাও আড় হয়ে আছে। তবু সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে নবীন দুই লক্ষে অকুস্থলে পৌঁছে মানিব্যাগটা খপ করে তুলে নিয়েই আবার হরিণপায়ে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। মানিব্যাগটা সঙ্গে রাখা বোকামি৷ সে তাড়াতাড়ি টাকাগুলো বের করে নিয়ে ব্যাগটা ফেলে দে দৌড়।
কথা হচ্ছে, সব ঘটনার আগেও ঘটনা থাকে, পরেও ঘটনা থাকে। এই অবনী ঘোষালের কথাই বলছিলাম আর কী। অবনী ঘোষাল অতিশয় হুশিয়ার লোক। জীবনে তার কখনও পকেটমারি হয়নি, বাড়িতে চোর ঢোকেনি, মন্দিরে জুতো চুরি যায়নি, কেউ তাকে কখনও ঠকাতেও পারেনি। অবনী সর্বদা সজাগ, চারদিকে চোখ, ঘুম খুব পাতলা, হিসেব-নিকেশের মাথা চমৎকার। দ্বিরাগমনে অষ্টপুরের শ্বশুরবাড়িতে এসেছে অবনী। রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় অবনীর শ্বশুর শ্রীনিবাস আচার্যি কথায় কথায় বললেন, “বাবাজীবন, অষ্টপুর বড় চোর-ঘঁচোড়ের জায়গা, রাস্তাঘাটে একটু খেয়াল রেখে চোলো৷ রাত্তিরে সজাগ থেকো।”
শুনে অবনী প্রায় অট্টহাসি হাসে আর কী। গম্ভীর ভাবে বলেছিল, “সেইসব চোর-বাটপাড় এখনও মায়ের পেটে।”
প্রথম রাত্তিরেই আড়াই হাজার টাকাসমেত তার মানিব্যাগটা বালিশের তলা থেকে হাওয়া, কবজি থেকে হাতঘড়ি আর ডান হাতের অনামিকা থেকে পোখরাজের আংটি উধাও, খাটের নীচ থেকে সুটকেস নিরুদ্দেশ, হ্যাঙারে ঝোলানো আন্দির পাঞ্জাবি থেকে সোনার বোতাম লোপাট।
কাণ্ড দেখে অবনী রাগে গরগর করতে লাগল, আক্রোশে ফুসতে লাগল, প্রতিশোধস্পৃহায় সঁত কড়মড় করতে লাগল। অষ্টপুরের চোরেদের সে পারলে চিবিয়ে খায়। তবু এখানেই শেষ
নয়। সকালে বাজার করতে বেরিয়ে জীবনে প্রথম পকেটমারি হল তার এবং শীতলামন্দিরে প্রণাম করার সময় নতুন চপ্পলজোড়া হাপিশ।
বৃত্তান্ত এখানেই শেষ নয়। শ্যালকের নতুন সাইকেলখানা নিয়ে থানায় এজাহার দিতে যাওয়ার সময় পাশের বাড়ির যদুবাবুকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে নেমে অষ্টপুরের চোরেদের আদ্যশ্রাদ্ধ করছিল অবনী। সাইকেলখানার হ্যান্ডেল তার ডান হাতে শক্ত মুঠিতে ধরা। কথা শেষ করে পিছন ফিরে দেখে, সাইকেল উবে গিয়েছে, তার ডান হাতে হ্যান্ডেলের বদলে একটা মোমবাতি গুঁজে রেখে গিয়েছে কেউ।
শ্বশুরবাড়ির দেশে এসে এরকম আহাম্মক আর হাস্যাস্পদ হয়ে অবনী জ্বলে উঠল। ঠিক করল, এর একটা বিহিত না করলেই নয়। চোরদের উচিত শিক্ষা না দিয়ে সে ছাড়ছে না। সুতরাং গত তিন দিন যাবৎ সে শ’ পাঁচেক করে ডন বৈঠক দিয়েছে, মনের একাগ্রতা বাড়ানোর জন্য ধ্যান, অনুভূতির সূক্ষ্মতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণায়াম এবং আহারশুদ্ধির জন্য হবিষ্যি পর্যন্ত করেছে।
আজ সকালে উঠে তার মনে হয়েছে, হা, সে প্রস্তুত। শরীর হালকা লাগছে, বিশ ফুট দূরে একটা পেয়ারা গাছের মগডালে একটা ছোট্ট পিঁপড়েকেও ঠাহর করতে পারল সে। আলসে দিয়ে যে বেড়ালটা হেঁটে গেল, তার পায়ের শব্দ টের পেতে তার বিশেষ অসুবিধে হল না। এমনকী, নাকের ডগায় একটা মশা বসেছিল বলে সেটাকে মারতে যেই হাত তুলেছে, অমনি স্পষ্ট দেখতে পেল, মশাটা হাতজোড় করে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, “ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার, এবারকার মতো ছেড়ে দিন।”
গায়ের জোরের পরীক্ষাতেও সে কম গেল না। একটা ঝুনো নারকোল কিল মেরে ফাটিয়ে দিল, কুয়োর দড়ি দু হাতে টেনে ডিমসুতোর মতো ছিঁড়ে ফেলল, লোহার শাবল তুলে হাঁটুতে রেখে চাড় দিয়ে বেঁকিয়ে ফেলল।
তারপর গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে, মানিব্যাগে হাজার কয়েক টাকা নিয়ে, মা কালীকে প্রণাম করে বাজারে বেরোল। চোখ চারদিকে ঘুরছে, ছ’টা ইন্দ্রিয়ই সজাগ, শব্দ-দৃশ্য-গন্ধ সব টের পাচ্ছে। এবং বাজারের কাছ বরাবর গিয়ে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় স্পষ্টই জানান দিতে লাগল যে, চোরটা কাছেপিঠেই ঘাপটি মেরে আছে।
চোরটাকে খেলিয়ে তোলার জন্যই সে আজ ফসফস করে টাকা খরচ করল। তারপর চায়ের দোকানে বসে একটু ছোট্ট অভিনয় করতে হল। তার পাঞ্জাবিতে মোটেই কোনও কাক বড়-বাইরে করেনি। তবু সে মানিব্যাগটা বেখেয়ালে বেঞ্চের উপর রেখে পাঞ্জাবি ধুতে টিউবওয়েলে যেতেই চোরটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে পড়ল।
নবীন দৌড়ে সবে দিঘিটার দিকে বাঁক নিয়েছে, অমনি কে যেন কাক করে তার ঘাড় ধরে নেংটি ইঁদুরের মতো শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, “তা হলে তুমিই সেই ওস্তাদ, অ্যাঁ!”
নবীনের মুখে বাক্য নেই। শরীর দুর্বল, খিদে-তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত।
হ্যাঁচড়াতে-হাচড়াতে তাকে বাজারের চাতালে এনে ফেলল অবনী ঘোষাল। হাঁক মেরে বলল, “এই যে তোমাদের অষ্টপুরের ওস্তাদ চোরকে ধরেছি। এখন এর ব্যবস্থা তোমরাই করো। আমার মানিব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিল।”
অষ্টপুরের জামাই অবনী ঘোষালের হেনস্থার কথা গাঁয়ের সবাই জানত। তার জন্য মরমে মরেও ছিল তারা। শত হলেও গাঁয়ের কুটুম। তার হেনস্থায় অষ্টপুরেরই অপমান। সুতরাং চোখের পলকে
বিশ-পঞ্চাশজন লোক জুটে গেল। কারও হাতে বাঁশ, কারও হাতে লাঠি।
তারপর দে মার! দে মার! খিদের কষ্ট, অভাবের তাড়না থাকলেও জীবনে মারধর বিশেষ খায়নি নবীন। নিরীহ, ভিতু ছেলে সে। ধর্মভয় প্রবল। উপোসি, ক্লান্ত শরীরে হাটুরে মার খাওয়ার ক্ষমতাই ছিল না তার। তাই প্রথম কয়েক ঘা চড়চাপড় আর লাথি-ঘুসি খেয়েই সে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর আরও অন্তত আধ ঘণ্টা লাঠি আর বাঁশ দিয়ে যে পেটানো হল তাকে, তা আর সে টের পেল না।
মার যখন থামল, তখন নবীনের মুখ আর নাক দিয়ে প্রবল রক্ত গড়াচ্ছে, বাঁ চোখ ফুলে ঢোল, ঠোঁট ফেটে রক্তাক্ত হয়ে আছে। মাথার চুলে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
বটতলার একটু তফাতে একটা কদম গাছের তলায় লুঙ্গি পরা একটা লোক বসে বসে দৃশ্যটা দেখছিল। তার গায়ে একটা পিরান, গালে রুখু দাড়ি, ঝোলা গোঁফ। রোগা ছিপছিপে চেহারার মাঝবয়সি লোকটা দৃশ্যটা দেখে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলছিল, “একে আহাম্মক, তার উপর কাঁচা হাত। ওরে বাপু, বিশ-বাইশ বছর বয়সে কি আর কাজে নেমে পড়তে হয়! এ হল শিক্ষার বয়স। হাত পাকতে, বুদ্ধি স্থির হতেই তো কম করে দশটি বছরের ধাক্কা।”
অবনী ঘোষাল একটু তফাতে সঁড়িয়ে বিজয় গর্বে হাসি-হাসি মুখে দৃশ্যটা দেখছিল। ভিড়ের ভিতর থেকে একজন লোক বলে উঠল, “এঃ, এর যে হয়ে গিয়েছে রে।”
আর একজন উবু হয়ে বসে নাড়ি দেখে বলল, “নাড়ি চলছে কি
না বোঝা যাচ্ছে না বাপু।”
ভিড়টা সঙ্গে সঙ্গে পাতলা হয়ে যেতে লাগল।
লুঙ্গি পরা লোকটা এবার উঠে চায়ের দোকান থেকে এক ঘটি জল নিয়ে এসে নবীনের মুখে-চোখে একটু ঝাঁপটা দিয়ে ফের বিড়বিড় করে বলল, “পেটের দায় তো বুঝি রে বাপু, কিন্তু আগুপিছুও ভাববি তো। প্রাণটা গেলে আর মানুষের থাকে কী! দেহখানা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই। বিদ্যের আধার, প্রাণের আধার, ভগবানেরও বাস। দেহ কি ফ্যালনা রে!”