২. আঙুল দিয়ে বাতাসে আঁকিবুকি

আঙুল দিয়ে বাতাসে আঁকিবুকি কাটা আর বিড়বিড় করা রামবাবুর পুরনো স্বভাব। বাতাসে আঁকিবুকি করে কী লেখেন কেউ জানে না, অনেকে বলে, “আঁক কষেন। অনেকে বলে, ছবি আঁকেন। অনেকে বলে, “ভূতপ্রেতের সঙ্গে সঙ্কেতে কথা কন। দু-চারজন বলে, ওটা হচ্ছে ওর বায়ু। আসল কথাটা অবশ্য পুরনো দু-চারজন লোকেরই জানা আছে। রামপদ বিশ্বাস যৌবনে হাত-টাত দেখে বেড়াতেন। ভাল করে জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়ন করবেন বলে কাশীতে গিয়ে এক মস্ত জ্যোতিষীর শাগরেদি করতে থাকেন। বেশ শিখে ফেলেছিলেন শাস্ত্রটা। হঠাৎ একদিন নিজের জন্মকুণ্ডলিটা গ্রাম থেকে আনিয়ে বিচার করতে বসলেন। আর তখনই চক্ষুস্থির। গ্রহ-সংস্থান যা দেখলেন তাতে তাঁর নিজের ভবিষ্যৎ অতীব অন্ধকার। এ-কোষ্ঠীতে কিছুই হওয়ার নয়। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে নানাভাবে বিচার করলেন। কিন্তু যা দেখলেন তাতে ভরসা হওয়ার মতো কিছু নেই। হতাশ হয়ে তিনি হাল ছাড়লেন বটে, কিন্তু কোষ্ঠীর চিন্তা তাঁর মাথা থেকে গেল না। দিনরাত ভাবতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে কাগজে, তারপর দেওয়ালে বা মেঝেতেও নিজের ছকটা একে একমনে চেয়ে থাকতেন। বিড়বিড় করে বলতেন, “নাঃ, রবি অত নীচস্থ-ইস, শনিটাও যদি এক ঘর তফাত হত..মঙ্গলটার তো খুবই খারাপ অবস্থা দেখছি…!” সেই থেকে রামবাবুর মাথাটা একটু কেমন-ধারা হয়ে গেল। যখন হাতের কাছে কাগজ-কলম বা দেওয়াল-টেওয়াল জোটে না তখন তিনি বাতাসেই নিজের কোষ্ঠীর ছক আঁকতে থাকেন আর বিড়বিড় করেন। তবে নিজের কোষ্ঠীর ফলটা খুব মিলে গেছে তাঁর। কিছুই হয়নি রামবাবুর, ঘুরে-ঘুরে বেড়ান আর বিড়বিড় করেন আর বাতাসে আঁকিবুকি কাটেন।

তবু রামবাবুর কাছে পাঁচটা গাঁ-গঞ্জের লোক আসে এবং যাতায়াত করে। তার কারণ, রামবাবু মাঝেমধ্যে ফস্ করে এমন এক-একটা ভবিষ্যদ্বাণী করে ফেলেন যা অক্ষরে-অক্ষরে মিলে যায়। তাঁর মুখ থেকে যদি কখনও ওরকম এক-আধটা কথা বেরিয়ে পড়ে সেই আশায় অনেক দূর-দূর থেকে লোক এসে তাঁর বাড়িতে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকে। এই তো মাত্র বছর-দুই আগে ফটিক কুণ্ডুর দেউলিয়া হওয়ার দশা হয়েছিল। ফটিক রামবাবুর বাড়ির মাটি কামড়ে দিন-রাত পড়ে থাকত। অবশেষে একদিন রামবাবু রাত বারোটায় বাতাসে ঢ্যাঁড়া কাটতে কাটতে ঘরের বাইরে এলেন। বারান্দায় কম্বল বিছিয়ে ফটিক বসে বসে মাথায় হাত দিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। রামবাবু তার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, “ফটিক, বাড়ি যাও। পরশুদিন বেলা বারোটার মধ্যে খবর পেয়ে যাবে।”

শশব্যস্তে ফটিক বলল, “কিসের খবর?”

“যে- খবর পাওয়ার জন্য হাঁ করে বসে আছ। যাও, ভাল করে খেয়েদেয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোও গে। রাহু ছেড়েছে, বৃহস্পতির বাঁকা ভাব সোজা হয়েছে, আর চিন্তা কী?”

রামবাবুর কথা একেবারে সোনা হয়ে ফলল। পরের-পরের দিন দশটা নাগাদ ফটিকের লটারি জেতার খবর এল। দু’লাখ টাকা। এখন ফটিকের পাথরে পাঁচ কিল। সেই টাকায় ব্যবসা বাণিজ্য করে এখন ফলাও অবস্থা, বোল-বোলাও ব্যাপার।

চৌধুরী বাড়ির নতুন জামাই এক দুপুরে শ্বশুরবাড়িতে খেতে বসেছে। রামবাবু রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে হঠাৎ বাড়িতে ঢুকে সোজা জামাইয়ের সামনে হাজির। খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, “চৌধুরীমশাই, দিব্যি জামাইটি হয়েছে আপনার। ফরসা রং, রাজপুত্তুরের মতো মুখ, টানা-টানা চোখ, দু’খানা হাত, কিন্তু পা কি একখানা কম?”

নগেন চৌধুরী এমনিতেই রামবাবুকে পছন্দ করেন না, তার ওপর তাঁর এই উটকো আগমনে তিনি চটে গিয়ে বললেন, “একখানা পা মানে? খোঁড়াখুঁতো জামাই শস্তায় ঘরে এনেছি বলে ভাবছ? নগেন চৌধুরী অত পিচেশ নয়। নগদ দশটি হাজার টাকা বরপণ, একখানা মোটর সাইকেল, রেডিও, চল্লিশ ভরি সোনা, আলমারি, ফার্নিচার…বুঝলে! জামাই শস্তায় হয়নি। বাইরে তোমরা কেপ্পন বলে আমার বদনাম রটাও, সে আমি জানি। তা বলে এত কেপ্পন নই যে, কানা-খোঁড়া ধরে এনে মেয়ের বিয়ে দেব। ও জামাই, এই বেয়াদবটাকে তোমার দুটো ঠ্যাং বের করে দেখিয়ে দাও তো!”

জামাই কিছু হতভম্ব হয়ে বিচি সমেত একটা কাঁটালের কোয়া গিলে ফেলল। তারপর ভয়ে-ভয়ে দুটো পা বের করে দেখাল।

রামবাবু বিমর্ষ হয়ে বললেন, “নাঃ, ডান ঠ্যাংটা তো হাঁটুর নীচ থেকে নেই দেখছি। তাতে অবশ্য তেমন ক্ষতি নেই, এক ঠ্যাঙেই দিব্যি কাজ চলে যাবে।”

নগেন চৌধুরী মহা খাপ্পা হয়ে বললেন, “চোখের মাথা খেয়েছ নাকি? স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ দুটো ঠ্যাং)! তবু বলছ!” বলেই গলা একটু নামিয়ে বললেন, “কী বলতে চাও সে আমি বুঝেছি। এই কথাই তো বলতে চাইছ যে, বাপ-মা মরা ভাইঝিটাকে কেন ধরেবেঁধে ওই কানা সাতকড়ির সঙ্গে বিয়ে দিলাম! ওরে বাবা, সে কি আর শস্তা খোঁজার জন্য! গাঁয়ের পাঁচটা লোক জানে বিয়ের রাতে দশরথ দত্ত নগদ পাঁচ হাজারের জন্য অত চাপাচাপি না করলে ঘটনাটা ঘটতই না। দশরথ দেমাক দেখিয়ে ছেলে তুলে নিয়ে গেল, তখন মেয়েটা লগ্নভ্রষ্টা হয় দেখে কানা সাতকড়ির সঙ্গে বিয়ে দিই। তবে আমি জানি, লোকে কথাটা বিশ্বাস করে না। তারা বলে বেড়ায়, দশরথের সঙ্গে নাকি আমি আগেই সাঁট করে রেখেছিলাম, আর সাতকড়ির সঙ্গেও নাকি বোঝাঁপড়া ছিল। আমার কুচ্ছো গাইতে হলধর গায়েন পালা অবধি বেঁধে শিবরাত্তিরের মেলার সময় আসর জমিয়েছিল। ছিঃ, ছিঃ কী বদনামই না করতে পারো তোমরা!”

রামবাবু এত কথা কানে নিলেন না। দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বললেন, “ঠ্যাং একটাই, তাতে ভুল নেই। সামনের অমাবস্যার পর বিয়ে হলে এ-জামাই আপনি অনেক শস্তায় পেতেন। একেবারে জলের দর।”

এই ঘটনার দু’দিন পর অমাবস্যা ছিল। নগেন চৌধুরীর জামাই শিমুলগড়ে গাড়ি ধরতে গিয়ে চাকার তলায় পড়ে ডান পা খোয়াল। এখন ক্রাচ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

বুড়ো গৌরগোবিন্দর বয়স বিরানব্বই পেরিয়ে তিরানব্বইতে পড়ল। গত দশটি বছর গৌরগোবিন্দ ধৈর্য ধরে আছেন যদি তাঁর সম্পর্কে এক-আধটা কথা রামের মুখ থেকে বেরোয়। আজ অবধি বেরোয়নি। গৌরগোবিন্দ সকালে উঠে পান্তাটি খেয়েই একখানা মাদুর বগলে করে এসে রামবাবুর দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায় চেপে বসে যান। গ্রীষ্মে ফুরফুরে বাতাস থাকে, শীতে থাকে রোদ। বসে দিব্যি আরামে ঝিমুনি এসে যায়। দুপুরে নাতনি এসে ডাকলে গিয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে নেন, তারপর একখানা বালিশ বগলে করে নিয়ে এসে এখানেই দিবানিদ্রাটি সেরে নেন। সন্ধেবেলা ঘরে ফিরে যান। একেবারে রুটিন। নিবারণ পুততুন্ড একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “গৌরদাদু, বিরানব্বই পেয়ে বার পরও কি মানুষের ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকে?”

গৌরগোবিন্দ একঝুড়ি আসল দাঁত দেখিয়ে হেসে বললেন, “ওরে, আমি যে আর মাত্র চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের বেশি বাঁচব না সে আমিও জানি। তাই বলে কি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকব?”

এ-কথার পর আর কার কী বলার থাকতে পারে?

আজ ভোরবেলায় গৌরগোবিন্দ যথারীতি দক্ষিণের বারান্দায় মাদুর পেতে বসে আছেন। দিব্যি হাওয়া দিচ্ছে। শরৎকালের মিঠে রোদটাও পড়েছে পায়ের ওপর। কিন্তু গৌরগোবিন্দের আজ ঝিমুনিটা আসতে চাইছে না। কাল রাতে গাঁয়ে চোর ঢুকেছিল, সেই খবরটা পাওয়া ইস্তক মনটা কেমন চুপসে গেছে। বেশ বুকের পাটাওয়ালা চোর, ঢুকতে গেছে গগন সাঁপুইয়ের বাড়ি। আর কে না জানে যে, গগন সাঁপুই হল সাক্ষাৎ কেউটে? তবে চোর ধরা পড়ার একটা ভাল দিকও আছে। সেইটেই ভাবছিলেন তিনি।

উঠোনের আগড় ঠেলে নটবর ঘোষকে ঢুকতে দেখে গৌরগোবিন্দ খুশি হলেন। গাঁয়ের পাঁচটা খবর এবং পাঁচ গাঁয়ের খবর ওর কাছেই পাওয়া যায়। বছর দুই আগে নটবর ঘোষের জ্যাঠা পাঁচুগোপাল মোকদ্দমার সাক্ষা দিতে সদরে যাচ্ছিল,. স্টেশনে রাম বিশ্বেসের সঙ্গে দেখা হতেই রাম বাতাসে ঢ্যাঁড়া কাটতে কাটতে বলল, “খুব যে যাচ্ছ! বলি উইল-টুইল করা আছে? আর উইল করেই বা কী হবে। তোমার ধনসম্পত্তি তো পিঁপড়েরা খাবে বাবা। তবে একটা কথা, খুব দুর্যোগ হবে, বুঝলে! ভয়ানক দুর্যোগ। রেলগাড়ি অবধি না ভেসে যায়!”

পাঁচগোপালের জরুরি মামলা। রামের কথায় কান দেওয়ার ফুরসত নেই। তাই পাত্তা দিল না। সেই রাতে সত্যিই ভয়ঙ্কর দুযোগ দেখা দিল। যেমন ঝড় তেমনই বৃষ্টি। রাত দশটার আপ ট্রেন শিমুলগড়ে ঢোকার মাইল দুই আগে কলস নদীর ব্রিজ ভেঙে স্রোতে খানিকটা ভেসে গেল। সাক্ষ্য দিয়ে পাঁচুগোপাল আর ফিরল না। কিন্তু মুশকিল হল, চিরকুমার। পাঁচুগোপালের যা কিছু বিষয়-সম্পত্তির ওয়ারিশান হল নটবর ঘোষ। হলে কী হয়, পাঁচুগোপালের টাকাপয়সা আর সোনাদানা সব লুকিয়ে রাখা আছে। কাকপক্ষীতেও জানে না। কোথায় আছে তা খুঁজে বের করা শিবের অসাধ্য। পাঁচুগোপাল জ্যাঠার লুকনো সম্পত্তির হদিস করতে নিত্যি এসে এখানে ধরনা দেয়। কিন্তু সুবিধে হয়নি। রাম গুপ্তধনের ব্যাপারে একেবারে চুপ। নটবর একবার কালী কাপালিকের কাছেও গিয়েছিল। কালী নরকরোটিতে করে সিদ্ধি খেতে-খেতে হাঃ হাঃ করে হেসে বলেছিল, “আপনার জ্যাঠার ভূত তো নিত্যি আমার কাছে আসে। সুলুকসন্ধান সবই জানি। তবে মশাই, বটতলায় মায়ের থানটা আগে বাঁধিয়ে দিন, গুপ্তধনের হদিস একেবারে হাতে-হাতে দিয়ে দেব। আপনার জ্যাঠারও তাই ইচ্ছে কিনা।”

মায়ের থান বাঁধানোর কথায় নটবর পিছিয়ে গেলেন। এখনও পিছিয়েই আছেন। কালী কাপালিক মাঝে-মাঝেই হানা দিয়ে বলে যায়, “মশাই, কাজটা কিন্তু ভাল করছেন না। আপনার জ্যাঠা কৃপিত হচ্ছেন। কটা টাকাই বা লাগবে? গোটা কয়েক ইট, এক চিমটি সিমেন্ট আর একটা রাজমিস্ত্রির একটুখানি যা খরচ, তার বদলে সাত-আট লাখ টাকার সোনাদানা–এ-সুযোগ কেউ ছাড়ে!”

গৌরগোবিন্দ হাতছানি দিয়ে নটবরকে ডাকলেন। “গৌর-ঠাকুরদা যে।” বলে নটবর এসে মাদুরের এককোণে চেপে বসে বললেন, “আচ্ছা ঠাকুরদা, এই বয়সে এই পাকা আপেলটির মতো চেহারা নিয়ে ঘুরতে তোমার লজ্জা হয় না? এখনও বত্রিশ পাটি দাঁত, মাথাভর্তি কালো চুল, টান চামড়া, বলি বুড়ো হচ্ছ না কেন বলো তো! এ তো খুব অন্যায্য কাজ হচ্ছে ঠাকুরদা! প্রকৃতির নিয়মকানুন সব উলটে দিতে চাও নাকি? সেটা যে গর্হিত ব্যাপার হবে!”

গৌরগোবিন্দ একগাল হেসে বললেন, “হব রে বাবা, আমিও বুড়ো হব। আর বিশ-পঁচিশটা বছর একটু সবুর কর, দেখতে পাবি। সব ব্যাপারেই অত তাড়াহুড়ো করতে নেই। কত সাধ-আহ্লাদ শখ-শৌখিনতা বাকি রয়ে গেছে আমার!”

নটবর চোখ কপালে তুলে বলেন, “এখনও বাকি! তা বাকিটা কী-কী আছে বলো তো ঠাকুরদা?”

“আছে রে আছে। এই ধর না, আজ অবধি কাশী গিয়ে উঠতে পারলাম। তারপর ধর, এখনও আমার বত্রিশটা মামলার রায় বেরনো বাকি। তারপর ধর, সেই ছেলেবেলা থেকে শুনেছি, হলদে চিনি দিয়ে বাঁকিপুরের ক্ষীর নাকি অমৃত–তা সেটাও আজ অবধি চেখে দেখিনি। তারপর ধর, ফিবছর যেসব লটারির টিকিট কাটছি তার একটাতেও প্রাইজ মারতে পারিনি। তারপর রাঙি গাইটার দুধ খাওয়ার জন্য কবে থেকে আশা করে আছি, দেবে-দেবে করছে, দিচ্ছে না। আরও কত আছে। তা সব একে-একে হোক। তারপর ধীরেসুস্থে বুড়ো হওয়ার কথাবব খন। অত হুড়ো দিসনি বাপ।”

“কিন্তু বয়সটা কত হল সে-খেয়াল আছে?”

গৌরগোবিন্দ খাড়া হয়ে বললেন, “আমার বয়সটার দিকে তোদের অত নজর কেন রে? নিবারণ যে একশো পেরিয়ে এক গণ্ডা বছর টিকে দিব্যি হেসেখেলে পাঁঠার মুড়ো চিবিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা তোদের পোড়া চোখে পড়ে না নাকি? কুঞ্জপুরের শৈলেন ঘোষ–সেও কি কম যাচ্ছে! আমার হিসাবমতো তার এখন একশো সাত। তা শৈলেন বাকিটা রাখছে কী বল তো! গেল হপ্তায় নবাবগঞ্জে হাট করতে এসে গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে গেল, নিজের চোখে দেখা। পরশুদিন সারা রাত জেগে কলসি গাঁয়ে ভট্ট অপেরার যাত্রা দেখেছে, দু’মাস আগেও ফুটবল মাঠে গিয়ে কুঞ্জপুরের হয়ে মেলা নাচানাচি করে এসেছে–তা এদের বেলায় কি চোখ বুজে থাকিস?”

নটবর ঘোষ সবেগে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, “ওটা কাজের কথা নয়। সব জিনিসেরই একটা সময় আছে। তোমার মধুগুলগুলি গাছের আমগুলো যদি জষ্টি মাসে না পাকে তবে কি তুমি খুশি হও? খেতের ধান সময়মতো না পাকলে তোমার মেজাজখানা কেমনধারা হবে বলো তো! এও হচ্ছে সেই কথা। তিরানব্বই বছর বয়সে বত্রিশখানা দাঁত, টানটান চামড়া, মাথা ভর্তি চুল নিয়ে গটগট করে ঘুরে বেড়াচ্ছ–তোমার আক্কেলটা কী বলো তো! আম পাকে, ধান পাকে, আর মানুষ পাকবে না?”

গৌরগোবিন্দ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মধুগুলগুলি আমের কথা বলে খারাপ করে দিলি তো মেজাজটা। গাছ কেঁপে আম এসেছিল এবার। চোর-ছোঁড়াদের জ্বালায় কি একটাও মুখে দিতে পেরেছি! কী চোরটাই হয়েছে গাঁয়ে বাপ। তোরা সব করিসটা কী? এই তো গগনের বাড়ি কাল অতবড় চুরিটা হয়ে গেল! শিমুলগড় কি চোরের মামাবাড়ি হয়ে উঠল বাপ? তা চোরটাকে তোরা করলি কী?”

এবার নটবর ঘোষের দীর্ঘশ্বাস ফেলার পালা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেঁটমুণ্ড হয়ে সে বলল, “সে-কথা আর জিজ্ঞেস কোরো না ঠাকুরা। গগনের

নাকি দয়ার শরীর, চোরের দুঃখে তার প্রাণটা বড় কেঁদেছিল। তাই ছেড়ে দিয়েছে।”

গৌরগোবিন্দ ফের খাড়া হয়ে বসে চোখ কপালে তুলে বলেন, “অ্যাঁ! ছেড়ে দিয়েছে! সে কী রে! একটা আস্ত চোরকে ছেড়ে দিলে!”

“চোরটা নাকি বড় কান্নাকাটি করছিল, তাইতে বাড়ির বারও ঘুম হচ্ছিল না। তাই নাকি ছেড়ে দিয়ে সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছে।”

গৌরগোবিন্দ মুখে একটা আফসোসের চুক-চুক শব্দ করে বললেন, “ইস! এ তো বড় ক্ষতি হয়ে গেল দেখছি! শিমুলগড়ের একটা নিয়ম আছে তো রে বাপ। সেই পুরনো আমল থেকে প্রথা চলে আসছে, চোর ধরা পড়লে তাকে দিয়ে যত পারো বেগার খাঁটিয়ে নাও। খেতে নিড়েন দেওয়াও, খানিকটা মাটি কুপিয়ে নাও, বাড়ির পানাপুকুরের পানা পরিষ্কার করাও, আগাছা সাফ করিয়ে নাও, এমনকী আগের দিনে বুড়ো বুড়িরা চোরকে দিয়ে পাকা চুলও বাছিয়ে নিত। আমি তো চোরের খবর শুনে ঠিক করে রেখেছি, তিনটে গাছের নারকোল পাড়িয়ে নেব, পাঁচখানা বড়-বড় মশারি কাঁচাব, কুয়োর পাড়টা পিছল হয়েছে, সেটা ঝামা দিয়ে ঘষিয়ে নেব, আর গোয়াল ঘরখানা ভাল করে সাফ করিয়ে নেব। না না, গগন কাজটা মোটেই ভাল করেনি।”

মুখোনা বেজার করে নটবর ঘোষ বলল, “চোরটার সঙ্গে আমারও একটু দরকার ছিল। এ-চোর তো যে-সে চোর নয়। গগনের বাড়ি হল কেল্লা। তার ওপর পাইক আছে, কুকুর আছে, লোক-লস্কর আছে। সেসব অগ্রাহ্যি করে চোর যখন গগনের বাড়ি ঢুকে সিন্দুক ভেঙে জিনিস হাপিস করেছে তখন একে ক্ষণজন্মা পুরুষ বলতেই হয়। আমি তখন থেকেই ঠিক করে রেখেছি, জ্যাঠার ধনসম্পত্তি কোথায় লুকিয়ে রাখা আছে তা একে দিয়েই খুজিয়ে বের করব। এর যা এলেম এ ঠিক পারবে। তা বরাতটাই আমার খারাপ। সকালে চোরের সন্ধানে গিয়ে শুনি, এই বৃত্তান্ত।”

গৌরগোবিন্দ দুঃখ করে বললেন, “এঃ, কতবড় সুযোগটা হাতছাড়া হল বল তো! আমার পাঁচ-পাঁচখানা মশারি কাঁচা হয়ে যেত, ঝুনো নারকোলগুলো গাছ থেকে নামানো যেত, তোর জ্যাঠার ধনসম্পত্তিরও একটা সুলুকসন্ধান এই ফাঁকে হয়ে যেতে পারত। আজকাল ভাল চোর পাওয়া কি সোজা কথা রে! এখনকার তো সব ছ্যাঁচড়া চোর। আগের দিনে চুরিটা ছিল এক মস্ত বিদ্যে। নিধে চোর, সিধু চোর, হরিপদ চোরকী সব চোর ছিল সে আমলে! কত মন্তর-তত্তর জানত, হাতের কাজ ছিল কত সাফ, তেমনই ছিল বুদ্ধি আর সাহস। সবই দিনকে দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে।”

বিরক্ত মুখে নটবর বলে, “এমন ঠ্যাটা জ্যাঠাও কি কখনও কেউ দেখেছ? আমরা দুটি ভাই সেই কবে থেকে জ্যাঠার সম্পত্তি তাক করে বসে আছি, অথচ টাকা-পয়সা নিয়ে একটা শ্বাস অবধি ফেলে গেল না! কেবল বলত, যদি সজ্জন হও, যদি দয়ালু হও, যদি ভাল লোক হয়ে উঠতে পার, তবে ঠিক খুঁজে পাবে। তা আমরা কি কিছু খারাপ লোক, বলো তো ঠাকুরদা?”

গৌরগোবিন্দ মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বললেন, “ওইর্টেই তো পাঁচুগোপালের দোষ ছিল রে, বড্ড বেশি ভালমানুষ। কলিযুগে কি অত বেশি ভাল হলে চলে! একটি মিথ্যে কথা বলবে না, অন্যের একটি পয়সা এধার-ওধার করবে না, কথা দিলে প্রাণপণে কথা রাখবে, ছলচাতুরির বালাই নেই, বাবুগিরি নেই, মাছমাংস অবধি খেত না, গরিবকে দুহাতে পয়সা বিলোত–এসব করেই তো বারোটা বাজাল তোদের। সেই পাপের শাস্তিও তো ভগবান হাতে-হাতে দিলেন, কলস নদীতে রেলগাড়ি ভেসে গেল, লাশটা অবধি পাওয়া গেল না।”

নটবর মাথা নেড়ে বলে, “আমরাও সেই কথাই বলি, অতি ভাল তো ভাল নয়। এই আমার কথাই ধরো না কেন, আমি ভাল বটে, কিন্তু জ্যাঠার মতো আহাম্মক তো নই। এই তো গতকালই মাছওয়ালা নিতাই প্রামাণিকের কাছ থেকে সাত টাকার মাছ কিনে দাম দিতে দশটা টাকা দিয়েছি। তা নিতাই তখন খদ্দের নিয়ে এত ব্যস্ত যে, ভুল করে তিন টাকার বদলে সাত টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছে। আমিও কথাটি না বলে টাকাটি ট্যাঁকে খুঁজে চলে এলাম। কারণ কী জানো? ওই ভুলটা হয়তো বা গ্যলক্ষ্মীরই কৃপা! নিতাই ওজনে ঠকায়, চড়া দাম হাঁকে, তারও একটা কর্মফল হয়তো ওই সাত টাকায় কাটল, কী বলো? জ্যাঠা হলে ২৪

আহাম্মকের মতো দরকার হলে বাড়ি গিয়ে টাকা ফেরত দিয়ে আসত। এই যে.আমি বন্ধক রেখে লোককে টাকা ধার দিই, জ্যাঠা এটা একদম সহ্য করতে পারত না। কিন্তু কাজটা কি খারাপ? গরিব-দুঃখী ঘটিটা, বটিটা, আংটিটা, দুলটা বন্ধক রেখে টাকা নেয়, এতে অধর্মের কী আছে বলো! এ তো এক ধরনের পরোপকারই হল। তাদেরও পেট ভরল, আমারও সুদ থেকে দুটো পয়সা হল।”

গৌরগোবিন্দ একগাল হেসে গলাটা একটু খাটো করে বললেন, “তা সোনাদানা কেমন কামালি বাপ? এক-দেড়শো ভরি হবে?”

নটবর লজ্জায় নববধূর মতো মাথা নামিয়ে বলে, “অত নয়। তবে তোমাদের আশীর্বাদে খুব খারাপও হয়নি।”

এই সময়ে উঠোনের আগড় ঠেলে লম্বা-চওড়া একটা লোক ঢুকল। খালি গা, মালকোঁচা মেরে ধুতি পরা, হাতে একখানা পেতলের গুল বসানো লম্বা লাঠি।

গৌরগোবিন্দ সচকিত হয়ে বলেন, “কে রে ওটা?”

“ঘাবড়াও মাত ঠাকুরদা, ও হল গগনের পাইক। ওরে ও লক্ষ্মণ, বলি খবর-টবর আছে কিছু?”

লক্ষ্মণের মুখোনা কেমন ভ্যাবলামতো। চোখে-মুখে কেমন একটা ভয়-খাওয়া ভাব। কাছে এসে যখন দাঁড়াল তখনও একটু হাঁপাচ্ছে। ভাঙা গলায় বলল, “আচ্ছা, এই গাঁয়ে কি খুব ভূতের উপদ্রব আছে মশাই?”

গৌরগোবিন্দ ফের খাড়া হয়ে বললেন, “ভূত তো মেলাই আছে বাপু। শিমুলগড়ের ভূত তো বিখ্যাত। কিন্তু তোমাকে হঠাৎ ভূতে পেল কেন? কিছু দেখেছ-টেখেছ নাকি?”

লক্ষ্মণ একটু মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে, সেটা বলতে পারব না। বলা বারণ। তবে সেটা বড় অশৈলী কাণ্ড।”

গৌরগোবিন্দ সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, “পেটে কথা রাখতে নেই। কথা রাখলেই পেটের গণ্ডগোল হয়। কলেরা অবধি হতে দেখেছি।”

লক্ষ্মণ একটু ভড়কে গিয়ে বলে, “কলেরা!”

“কলেরা, সান্নিপাতিক, শূলব্যথা। কী বলিস রে নটবর?”

“একেবারে নিয্যস কথা। আরে লক্ষ্মণভায়া, দাঁড়িয়ে কেন? বোসো, বোসো। আমরা তো সবাই তোমার কথা বলাবলি করি। হ্যাঁ বটে, গগন এতদিনে পয়সা খরচ করে একখানা লোক রেখেছে বটে। যেমন তেজ তেমনই সাহস। বুঝলে গৌরঠাকুরদা, কালকের চোরটাকে তো এই লক্ষ্মণই সাপটে ধরেছিল। নইলে সে কি যে-সে চোর, ঠিক পাঁকাল মাছটির মতো পিছলে বেরিয়ে যেত থলিটি নিয়ে। লক্ষ্মণ খুব এলেমদার লোক। কাছে-পিঠে এমন একখানা লোক থাকলে বল-ভরসা হয়।”

লক্ষ্মণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাদুরের এককোণে বারান্দা থেকে পা ঝুলিয়ে বসল। কাঁধের গামছা দিয়ে কপালটা একটু মুছে নিয়ে বলল, “আমার সাহসের কথা আর বলবেন না, গায়ের জোরের কথাও আর না তোলাই ভাল। কাল রাতে যাকাণ্ড হল, যত ভাবছি তো বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। গগনবাবুর চাকরি আমি ছেড়ে দিচ্ছি। এ-গাঁয়ে আর নয়।”

গৌরগোবিন্দ মাথা নেড়ে বলেন, “ভুল করছ হে বাপু। এ-গাঁয়ের জল-হাওয়া খুব ভাল। কত লোক এখানে হাওয়া বদলাতে আসে। আর ভূতের কথা যদি বলো তো বলি, শিমুলগড়ের ভূতের যে এত নামডাক, তাও তো এমনই নয়। এমন ভদ্র, পরোপকারী, ভাল আর শান্ত ভূত আর কোথাও পাবে না। বিশেষ করে বাইরের লোকের সঙ্গে বেয়াদবি করাটা তাদের রেওয়াজই নয়। তবে হ্যাঁ, বিশেষ কারণ থাকলে অন্য কথা। আর নতুন ভূতেরা একটু-আধটু মজা করে বটে, তবে সেটা ধরতে নেই।”

লক্ষ্মণ মাথা নেড়ে বলে, “না না, নতুন ভূত নয়। ইনি পুরনো ভূত। গায়ে পেল্লায় জোর।”

নটবর চোখ কপালে তুলে, “ভূতের গায়ে জোর! সে কী গো! ভূত তো শুনেছি বায়ুভূত জিনিস। ধোঁয়া বা গ্যাস জাতীয় বস্তু দিয়ে তৈরি ফঙ্গবেনে ব্যাপার। তা গায়ের জোরটা বুঝলে কী করে? ভূতের সঙ্গে কুস্তি করলে নাকি?”

লক্ষ্মণ তাড়াতাড়ি নিজের দু কান স্পর্শ করে জিভ কেটে বলে, “তেনার সঙ্গে কুস্তি যেন কখনও করতে না হয়, এই আশীবাদটুকু করবেন। যা একটু ছোটখাটো ঝাঁকুনি দিয়েছেন তাতেই হাড়গোড় কিছু আলগা হয়ে রয়েছে। সারা রাত্তির ঘুমোতে পারিনি। রামবাবুর কাছে ব্যাপারটা বলে একটা নিদান নিতেই আসা।”

গৌরগোবিন্দ আরও একটু ঝুঁকে বলেন, “তা ভূতের সঙ্গে তোমার লাগল কী নিয়ে? শিমুলগড়ের ভূতেরা তো বাপু সাত চড়ে রা করে না। তা ইনি কূপিত হলেন কেন? বাসী কাপড়ে বটতলায় যাওনি তো! এঁটো মুখে তুলসীগাছ ছোঁওনি তো! না কি অন্য কোনও অনাচার!”

লক্ষ্মণ হতাশ গলায় বলে, “না গো বুড়োবাবা, ওসব অনাচার কিছুই করিনি। দোষের মধ্যে মনিবের হুকুম তামিল করতে গিয়েছিলাম। আমার কী দোষ বলো! মানছি যে, চোরটাকে মারধর করা ঠিক কাজ হয়নি। চোরটারও মতিভ্রম, পালানোর চেষ্টাই বা কেন করল কে জানে! তবে এটুকু বলতে পারি বুড়োবাবা যে, সে মরেনি। যখন তাকে বটতলার মাঠে নিয়ে ফেললুম তখনও বুক ধুকপুক করছিল।”

নটবর ঘোষ উত্তেজনায় প্রায় দাঁড়িয়ে গিয়ে বলে, “অ্যাঁ! বটতলার মাঠে নিয়ে ফেললে, মানে! ফেলার মতো কী হল?”

গৌরগোবিন্দও বেশ উত্তেজিত গলায় বললেন, “চোর কি ফ্যালনা জিনিস হে! অমন জিনিস হাতের মুঠোয় পেয়েও কেউ হাতছাড়া করে! কত কাজ হয়ে যেত! তা ফেলতে গেলে কেন বাপু? জন্মেও শুনিনি কেউ কখনও চোর ফ্যালে।”

লক্ষ্মণ যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে। মুখোনা ফ্যাকাসেপানা দেখাচ্ছে। আমতা-আমতা করে বলে, “চোর যে ফ্যালনা জিনিস নয় তা এখানে এসেই শিখলাম মশাই। নাক মলছি, কান মলছি, আর ইহজীবনে চোরকে হেলাফেলা করব না। রাতের তিনিও সে কথাই বলছিলেন কিনা!”

গৌরগোবিন্দ একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, “তা এই তেনাকে কেমন দেখলে বলল তো! পুরনো ভূত সব ক’জনকেই চিনি। বলি তিনুকে দ্যাখোনি তো! তিনুর গায়েও সাঙ্ঘাতিক জোর ছিল, মুগুরের বদলে রোজ সকালে দু খানা আস্ত চেঁকি দু হাতে নিয়ে বনবন করে ঘুরিয়ে মুগুর ভাঁজত। তবে বড্ড গবেট ছিল, খুব ভিতুও। গায়ে জোর থাকলে কী হয়, কেউ চোখ রাঙালেই লেজ গুটোত।”

লক্ষ্মণ মাথা নেড়ে বলে, “তা হলে ইনি তিনি নন। চুরি নিয়ে যখন আমাকে জেরা ছিলেন, তখনই বুঝেছিলাম এর খুব বুদ্ধি।”

নটবর বলল, “চুরি নিয়ে কী জেরা করল হে?”

লক্ষ্মণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তিনিই আমার চোখ খুলে দিলেন। তবে সে মশাই অনেক কথা। আমি বড্ড ভয় পেয়েছি। লক্ষ্মণ পাইকের বুকে ভয় বলে বস্তু ছিল না কখনও। কাল রাত থেকে হল। এখানে আমার আর পোষাবে না মশাই। রামবাবুর কাছে তাই হাতটা গোনাতে এসেছি।”

শুনে গৌরগোবিন্দ খুব অট্টহাসি হেসে বললেন, “কত বছর রামের পেছনে ফেউ হয়ে লেগে আছি জানো? আজ অবধি মুখের কথাটি খসাতে পারিনি। তবে বেড়ালের ভাগ্যে কারও কারও শিকে ছেড়ে দেখেছি। তোমারও কপাল ভাল থাকলে রামের মুখ থেকে বাক্যি বেরোবে।”

এমন সময় উঠোনের অন্যদিককার একখানা ঘরের দরজা খুলে রাম বিশ্বাস বেরিয়ে এলেন। ডান হাতে অবিরল ঢাড়া কেটে যাচ্ছেন, আর মুখে অনর্গল বিড়বিড়।

লক্ষ্মণ তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে জোড়হাতে রামবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “আমার সমস্যার একটা বিহিত করে দেন আজ্ঞে। আমার বড় বিপদ যাচ্ছে।”

রামবাবু কুঁচকে লক্ষ্মণের দিকে একটু চেয়ে থেকে বললেন, “ক’দিন শ্রীঘর বাস করা হয়েছে বলো তো! বছর পাঁচেক নাকি?”

লক্ষ্মণ এত ঘাবড়ে গেল যে, প্রথমটায় মুখে বাক্য সরল না। চোখ দুটো কেমন গোল্লা পাকিয়ে গেল ভয়ে। তারপর একটু ভাঙা গলায় বলল, “মোট তিন বছর। সবই তো আপনি জানেন, লুকোছাপা করব না। জেল যে খেটেছি তা পুরো নিজের দোষে নয়। লালু দাসের দলে ভিড়েছিলুম পেটের দায়ে। ঘরে বুড়ো বাপ, রোগা মা, তিনটে আইবুড়ো বোন, কী করব বলুন। মোট চারটে ডাকাতিতে ছিলুম বটে, কিন্তু দলে থাকাই সার। আমাকে তেমন দায়িত্বের কাজ দিত না, শুধু বাইরে পাহারায় রাখত। শেষে নারায়ণপুরে লালু ধরা পড়ল। মামলায় মোট পাঁচ বছর জেল হল তার। তা লালু দাসের মতো লোকেরা কি আর জেল খাটে! আমাকে ডেকে বলল, তোকে মাসে-মাসে চারশো করে টাকা দেব, আমার হয়ে জেল খাটবি।’ পেটের দায়ে রাজি হয়েছিলাম। তবে পুরো মেয়াদ খাটতে হয়নি। তিন বছর পর ছেড়ে দিল। লালু দিব্যি গায়ে ফুঁ দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বদনামের ভাগী হলাম গে আমি। নিজের গাঁয়ে অবধি ঢুকতে পারি না।”

রামবাবুর চেহারাটি ছোটখাটো, রংখানা ফরসা, মাথায় একটু টাক, তিনি অতি দ্রুত বাতাসে ঢ্যাঁড়া কাটতে কাটতে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে করতে আপনমনে বললেন, “একজনের নামের আদ্যক্ষর ন। আর-একজনের দুটো হাতই বাঁ হাত। হুঁহু, হুঁহু, এ তো ঘোর বিপদের লক্ষণ দেখছি। অর্থই অনর্থের মূল।”

কথাটা কাকে বলা তা বোঝা গেল না ঠিকই। কিন্তু সবাই একটু তটস্থ হল। নটবর, গৌরগোবিন্দ এবং লক্ষ্মণ ছাড়াও দশ বারোজন মানুষ ইতিমধ্যেই উঠোনের চারদিকে জমায়েত হয়েছে। সবাই এদিক-ওদিক চাওয়াচাওয়ি করছে। বিপদের কথায় সকলেরই মুখ শুকনো। এর মধ্যেই লক্ষ্মণ হঠাৎ বিদ্যুদ্বেগে ঘুরে সোজা গিয়ে নটবর ঘোষের সামনে দাঁড়িয়ে বাঘের গলায় গর্জন করে উঠল, “নটবরবাবু।”

লক্ষ্মণের এই চেহারা দেখে আতঙ্কিত হয়ে নটবর ঘোষ বললেন, “অ্যাঁ!”

“আপনার নামের আদ্যক্ষর ন।”

নটবর বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলে, “কে বলল ন?”

“আপনি নটবর।”

নটবর সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলে, “কখনও নয়। ভুল শুনেছ ভাই। আমার নাম হল গে হলধর। বিশ্বাস না হয় এই গৌর ঠাকুরদাকেই জিজ্ঞেস করো।”

লক্ষ্মণ পাইক তার দুটো হাত মুঠো পাকিয়ে দাঁতে-দাঁত ঘষে বলল, “চালাকি হচ্ছে? আমি নিজের কানে শুনেছি আপনার নাম নটবর।”

নটবর দাওয়ার ভেতর দিকে সরে বসে বলে, “আহা হা, অত খেপছো কেন ভায়া, নটবর বলে মাঝে-মাঝে ভুল করে কেউ-কেউ ডাকে বটে, তবে দেখতে হবে যে, কোন ন। মূর্ধণ না দন্ত্য ন। তোমাকে কিন্তু আগেভাগেই বলে রাখছি বাপু, দন্ত্য ন হলে কিন্তু মিলবে না। আমার নটবর হল মূর্ধণ দিয়ে। যাও না, ওই রামের কাছেই জেনে এসো না কোন ন।”

“আপনার হাত দুটো দেখি। আমার মনে হচ্ছে আপনার দুটো হাতই বাঁ হাত।”

নটবর তার হাত দুখানা পিছমোড়া করে রেখে আতঙ্কের গলায় বলে, “মোটেই নয় বাপু। আমার বাঁ হাতই নেই। দুটোই ডান হাত।”

ঠিক এই সময়ে হঠাৎ কাছেপিঠে প্রচণ্ড বজ্রাঘাতের শব্দের মতো শব্দ হল, “ব্যোম…ব্যোম…ব্যোম কালী! খেয়ে লে মা, সব খেয়ে লে! সব খেয়ে ফ্যাল বেটি করালবদনী। গরিব বড়লোক, সাধু-চোর, কালোধলো–সব ব্যাটাকে ধরে খেয়ে লে মা জননী। কড়মড়িয়ে খা মা, চিবিয়ে-চিবিয়ে খা, ছিবড়ে ফেলিসনি মা। সব গাপ করে দে।”

ওই বিকট শব্দে লক্ষ্মণ পাইক অবধি ঘাবড়ে গিয়ে হাঁ করে চেয়ে ছিল। সেই ফাঁকে নটবর ঘোষ দাওয়া থেকে নেমে সুট করে কচুবনের ভেতরে সেঁদিয়ে পালিয়ে গেল।

কালী কাপালিক রাম বিশ্বাসের বাড়িতে কখনও ঢোকে না। রামবাবুর ওপর তার একটা পুরনো রাগ আছে। বহুঁকাল আগে, কালী যখন কাপালিক হয়নি, তখন রামবাবু একবার তাকে বলেছিলেন, “ওরে, সামনের জন্মে তুই তো দেখছি বাদুড় হবি।” এই কথায় কালী প্রথমটায় ভীষণ ভয় খেয়ে যায়। অনেক কাকুতিমিনতি করতে থাকে, “ও রামবাবু, বাদুড় নয়, আমায় বরং সামনের জন্মে বানর করে দিন, তাও ভাল। বাদুড় হলে আমি মরে যাব। ও রামবাবু, আপনার পায়ে পড়ি।” পঞ্চানন সরখেল কাছেই ছিলেন, তিনি বললেন, “তা বাপু কালী, বাদুড়ের চেয়ে কি বানর হওয়া ভাল? বাদুড়ের তো দুখানা ডানা আছে, কত ঘুরেটুরে বেড়াতে পারে, আর বানর তো তাঁদড়ের একশেষ। এই সেদিনও আমার বাগানের তিন কাঁদি কলার সর্বনাশ করে গেছে। এ গাঁয়ে আর বানরের সংখ্যা বাড়ানো উচিত হবে না।” কালী তখন রেগেমেগে বলল, “বাদুড় যে মুখ দিয়ে পায়খানা করে তা কি জানেন? ওয়াক থুঃ। আমি কিছুতেই বাদুড় হতে পারব না। রামবাবু, একটা ব্যবস্থা করে দিন। কুকুর-বেড়াল সব হতে রাজি আছি, শুধু ওই বাদুড়টা পারব না।” রাম বিশ্বাস অবশ্য সেকথায় কান দেননি। শুধু বলেছেন, “যা দেখতে পাচ্ছি তাই বলেছি বাপু, ওর আর নড়চড় নেই।”

সেই থেকে রামবাবুর ওপর কালীর রাগ। সে এ বাড়ির উঠোন মাড়ায় না কখনও। তবে মাঝে-মাঝে আসে আর বাইরে দাঁড়িয়ে ‘ব্যোম কালী, ব্যোম কালী’ করে যায়।

আজ কালীর চেহারাটা কিন্তু ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। মাথার চুল সব ফণা ধরে আছে, দাড়ি-গোঁফ সব যেন ফুলেফেঁপে উঠেছে, রোষকষায়িত লোচন। রামবাবুর উঠোনের দিকে চেয়ে হাতের শুলখানা ওপরে তুলে বিকট স্বরে বলল, “এ-গ্রাম উচ্ছন্নে যাবে। অসুখ হয়ে মরবে, আগুন লাগবে, ভূমিকম্প হবে। এত বড় পাপের জায়গা আর নেই হে। সবার আগে যাবে ওই গগন সাঁপুই।”

কালীকে সবাই অল্পবিস্তর চেনে, তাই সবাই চুপচাপ বসে রইল। তবে লক্ষ্মণ পাইক এ-গাঁয়ে নতুন লোক। সে মনিবের নাম শুনে দু কদম এগিয়ে বলল, “কেন হে, গগন সাঁপুই আগে যাবে কেন?”

কালী অট্টহাস্য করে, “এ যে লক্ষ্মণ দরোয়ান দেখছি! বলি, আজ সকাল থেকে আমাকে যে আধসের করে দুধ পাঠানোর কথা ছিল, তার কী হল? আর মায়ের থান বাঁধানোর ইটের ব্যবস্থা? দেব নাকি সব ফাঁস করে? গগন সাঁপুইকে বলিস, কাজটা সে মোটেই ভাল করেনি। আমার আখড়ায় দেড় হাজার ভূত মন্তর দিয়ে আটকে রেখেছি। সবকটা কাঁচাখেগো অপদেবতা। একসঙ্গে যদি ছেড়ে দিই সারা গাঁ লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে কিন্তু।”

রোগামতো পটল সাহা কাঁটালগাছতলায় বসে ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ বলে উঠল, “কিন্তু আমরা যে শুনতে পাই তোমারই নাকি বেজায় ভূতের ভয়! সেই ভয়ে তুমি শ্মশানমশানে অবধি যাও না, মড়ার ওপর বসে তপস্যা কখনও করোনি!”

কালী কাপালিক আর-একটা অট্টহাসি হেসে নিয়ে বলে, “শবসাধনা! সে আমার কোন যুগে সারা হয়ে গেছে। আর শ্মশানের কথা বলছিস! আমার যখন এইটুকু বয়স তখন থেকে রথতলার শ্মশানে যাতায়াত। নন্দ কাপালিকের সঙ্গে তো সেখানেই ভাবসাব হল, মন্তর দিলেন। বুঝলে পটলবাবু, এইজন্যেই কথায় বলে পেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। আমি যদি অন্য গাঁয়ের লোক হতুম, তা হলে এই তোমরাই দুবেলা গিয়ে পেন্নাম ঠুকতে। তবে আমিও ছাড়বার পাত্র নই, কালী কাপালিক যে কী জিনিস তা একদিন এ-গাঁয়ের লোককে টের পাইয়ে ছাড়ব। আরও একটা কথা পেট-খোলসা করে বলেই দিচ্ছি। পাপ কখনও গোপন থাকে না।” এই বলে কালী লক্ষ্মণের দিকে চেয়ে মৃদু একটু ব্যঙ্গর হাসি হেসে বলল, “তোমার মনিবকেও কথাটা বোলো হে দরোয়ান। পাপ কখনও গোপন থাকে না। আমার কাছে সব খবরই আছে। বিকেল অবধি দেখব। যদি গগনের সুমতি হয় তবে কড়ার মতো কাজ করবে। আর যদি না করে তবে কাল সকালে সারা গাঁয়ে খবরটা রটে যাবে। থানা-পুলিশ হলে আমাকে দোষ দিয়ো না বাপু।”

কালী কাপালিক চলে গেলে সবাই একটু হাঁফ ছেড়ে নড়েচড়ে বসল।

কালী মনসাতলা পেরনোর আগেই গৌরগোবিন্দ পা চালিয়ে ধরে ফেললেন, “ওরে ও কালী, দাঁড়া বাবা, দাঁড়া। কথা আছে।”

কালী বিরক্ত হয়ে ফিরে দাঁড়াল, “আবার কিসের কথা!”

গৌরগোবিন্দ দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলেন, “একটু দুধের জন্য তোর এত হেনস্থা, এ যে চোখে দেখা যায় না রে! আমার কেলে গোরুর দুধ খাবি এক গেলাস? অ্যাই বড় আধসেরি গেলাস।” বলে গৌরগোবিন্দ দুই হাতে গেলাসের মাপ দেখিয়ে মিটিমিটি হাসলেন, “আর গোর দেখলেও ভিরমি খাবি। যেন সাক্ষাৎ ভগবতী। হাতির মতো পেল্লায় চেহারা, তেল চুকচুকে গায়ে রোদ পিছলে যায়। আর দুধের কথা যদি তুলিস বাপ, তা হলে বলব, অমন দুধ একমাত্র বুঝি রাজাগজাদেরই জোটে। যেমন ঘন, তেমনই মিষ্টি, আর তেমনই খাসা গন্ধটি! খাবি বাপ একটি গেলাস? গরম, ফেনায় ভর্তি, সরে-ভরা দুধ?”

কালী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “তোমার মতলব আছে ঠাকুরদা।”

একগাল হেসে গৌরগোবিন্দ বলেন, “দূর পাগলা, মতলব আবার কী রে? দুটো কথা-টথা কইব বসে, সেই তো এইটুকু থেকে দেখছি তোকে। আয়, আয়।”

নিজের বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই গৌরগোবিন্দ হাঁক মারলেন, “ওরে, তাড়াতাড়ি এক গেলাস দুধ নিয়ে আয় তত! আধসেরি গেলাসে, ভর্তি করে দিস। সাধু-সন্ন্যাসী মানুষ এরা সব, কুপিত হলেই বারোটা বাজিয়ে দেবে।”

দাওয়ায় কালীকে আসন পেতে যত্ন করে বসালেন গৌরগোবিন্দ। দুধও এসে গেল। কালীকে দুধটা খানিক খাওয়ার সময় দিয়ে গৌরগোবিন্দ গলাটা খাটো করে বললেন, “তা হলে কথাটা আসলে এই! মানে গগন সাঁপুই একখানা দাঁও মেরেছে!”

কালী নিমীলিত নয়নে চেয়ে বলে, “দুধটি বড্ড খাসা ঠাকুরদা, এর যা দাম দিতে হবে তাও আমি জানি। শোনো, কথাটা পাঁচকান কোরো না। ও-ছোঁকরা মোটেই চোর নয়। থলির মধ্যে দুশো এগারোখানা মোহর ছিল। গগন সেটিই গাপ করেছে। ছোঁড়ার কী মতিচ্ছন্ন হয়েছিল, কেন যে গগনের বাড়ি সেঁধোতে গেল।”

গৌরগোবিন্দ চোখ কপালে তুলে বলেন, “দুশো এগারোখানা! দেখলি থলি খুলে?”

“থলি খুলতে হবে কেন ঠাকুরদা! আমার কি অন্তর্দৃষ্টি নেই? বাইরে থেকেই দেখলুম, থলির ভেতর মোহর। দুশো এগারোখানা। তবে ভোগে লাগল না।”

“তার মানে?”

“ছোঁকরাকে রাতেই মেরে লাশ গুম করে দিয়েছে কিনা। কাল রাতেই ছোঁকরার প্রেতাত্মা এসে বলে গেল।”